সপ্তম পরিচ্ছেদ

এক

স্বয়ংবর অনুষ্ঠানের গোড়া হইতেই জাতবর্মা শ্বশুরের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। প্রকাশ্যভাবে যৌবনশ্রী ও বিগ্রহপালের পলায়নে সাহায্য করিবার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না, সাহায্য প্রয়োজন হইবে এ সম্ভাবনাও তাঁহার মনে আসে নাই। তাই, যৌবনশ্রী যখন ধরা পড়িয়া গেলেন তখন জাতবর্মা কিছুই করিতে পারিলেন না। মুহূর্তমধ্যে একটা অঘটন ঘটিয়া গেল; কোথাকার একটা নগণ্য ভৃত্য সব পণ্ড করিয়া দিল।

লক্ষ্মীকর্ণ যৌবনশ্রীকে হাত ধরিয়া অবরোধে টানিয়া লইয়া চলিলে জাতবর্মাও সঙ্গে চলিলেন। শ্বশুরের প্রতি তাঁহার মন কোনও কালেই প্রসন্ন ছিল না, এখন আরও বিরূপ হইয়া উঠিয়াছে। তবু শ্বশুরগৃহে শ্বশুরের সহিত কলহ বাঞ্ছনীয় নয়, তিনি যথাসাধ্য শান্তস্বরে বলিলেন—মহাশয়, এ আপনার অনুচিত। কন্যা যার গলায় সর্বসমক্ষে বরমাল্য দিয়েছে তাকে আপনার গ্রহণ করা উচিত ছিল। নইলে স্বয়ংবরের সার্থকতা কি?

লক্ষ্মীকর্ণের চক্ষু দেখিয়া মনে হইল এখনি চক্ষু ফাটিয়া রক্ত বাহির হইবে। তিনি সেই চক্ষু জামাতার দিকে ফিরাইয়া গলার মধ্যে গৃঢ় শব্দ করিলেন—ষড়যন্ত্র! চক্রান্ত! সবাই বিশ্বাসঘাতক।

জাতবর্মা এবার প্রকাশ্যভাবেই উত্তপ্ত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন—ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী আপনি। আপনি যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করতেন ষড়যন্ত্রের প্রয়োজন হত না।

লক্ষ্মীকর্ণের ইচ্ছা হইল জাতবর্মাকে কাটিয়া ফেলেন। কন্যার বৈধব্য না ঘটাইয়া জামাতাকে কাটিয়া ফেলা সম্ভব হইলে তিনি অবশ্য তাহা করিতেন। কিন্তু তাহা অসম্ভব জানিয়া বলিলেন—কালসাপ! আমি ক্ষীর খাইয়ে কালসাপ পুষেছি।

জাতবর্মা দেখিলেন তর্ক করা বৃথা। তিনি অতি কষ্টে আত্মনিগ্রহ করিয়া নীরব রহিলেন, মনস্থ করিলেন অবিলম্বে পত্নীকে লইয়া পাপপুরী ত্যাগ করিবেন। এমন যাহার শ্বশুর তাহার শ্বশুরালয় শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যের নামান্তর মাত্র। রাজভবনে প্রবেশ করিয়া তিনি বীরশ্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। সংবাদ রাজপুরীতে রাষ্ট্র হইয়াছিল, বীরশ্রী সজল শঙ্কিত চক্ষে স্বামীর পানে চাহিলেন।

জাতবর্মা বলিলেন—চল বীরা, দেশে ফিরে যাই। এখানে আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে।

বীরশ্রী কাছে সরিয়া আসিয়া বাষ্পরুদ্ধস্বরে বলিলেন—যৌবনা কোথায়?

জাতবর্মা ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলিলেন—তাকে তোমার পিতৃদেব এইমাত্র অবরোধে টেনে নিয়ে এলেন। বোধহয় পাকশালায় নিয়ে গেছেন, কেটে কুটে শূল্য মাংস রন্ধন করবেন।

লক্ষ্মীকর্ণ কিন্তু কন্যাকে রন্ধনশালায় লইয়া যান নাই, তাহাকে তাহার নিজ গৃহাংশে লইয়া গিয়া শয়নকক্ষের মর্মর কুট্টিমে বসাইয়া প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। বিগ্রহপালের সহিত কোথায় যৌবনশ্রীর দেখা হইয়াছিল? কে দূতীর কাজ করিয়াছে? কেমন করিয়া যোগাযোগ ঘটিল? রাজপুরীর কোন কোন ব্যক্তি এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। ইত্যাদি। যৌবনশ্রী একটি প্রশ্নেরও উত্তর দেন নাই, বসুধাবদ্ধদৃষ্টি হইয়া নীরব ছিলেন।

উত্তর না পাইয়া লক্ষ্মীকর্ণ খুব খানিকটা দাপাদাপি করিয়া শেষে বলিলেন—বিশ্বাসঘাতিনি, তুই যেমন রাজাদের সমক্ষে আমাকে অপদস্থ করলি, আমিও তেমনি তোকে শাস্তি দেব। এই ঘরে তুই সারা জীবন বন্ধ থাকবি, পুরুষের মুখ দেখতে পাবি না। আজ থেকে এই ঘর তোর কারাগার। বলিয়া তিনি রঙ্গিণীকে ডাকিলেন।

রঙ্গিণী রাজপুরীর এক প্রেষ্যা। আট নয় বছর আগে সে কিছুদিনের জন্য লক্ষ্মীকর্ণের অনুগ্রহ লাভ করিয়াছিল। বর্তমানে গতযৌবনা হইলেও তাহার শরীর শক্ত ও সমর্থ, মুখে লাবণ্যের স্থানে কঠিনতা দেখা দিয়াছে। এখন সে অবরোধের দীপ-পালিকা। পুরাতন অনুগ্রহভাগিনীদের মধ্যে তাহাকেই লক্ষ্মীকর্ণ সর্বাধিক বিশ্বাস করেন।

রঙ্গিণী আসিলে লক্ষ্মীকর্ণ তাঁহার নিজের তরবারি তাহার হাতে ধরাইয়া দিয়া বলিলেন—রঙ্গিণি, আজ থেকে তোর অন্য কাজ নেই, তুই একে পাহারা দিবি। একে ঘরের বাইরে যেতে দিবি না। কাউকে ঘরে ঢুকতে দিবি না। এই আমার আদেশ, যদি অন্যথা হয়, তোর রক্ত দর্শন করব।

বিদ্রোহিণী কন্যাকে প্রহরিণীর হাতে সমর্পণ করিয়া দিয়া লক্ষ্মীকর্ণ প্রস্থান করিলেন। রাগ যতই হোক, তাঁহার বুদ্ধির ক্রিয়া একেবারেই বন্ধ হয় নাই। তিনি বুঝিয়াছিলেন ষড়যন্ত্রে রাজপুরীর অনেকেই লিপ্ত আছে। দশম গ্রহরূপী জামাতা বাবাজী আছেন, সম্ভবত বীরশ্রীও আছে। এবং নিশ্চয় আছেন পরমারাধ্যা মাতৃদেবী। তিনিই নিঃসন্দেহে এই ষড়যন্ত্রের প্রবর্তক, সকল অনিষ্টের মূল। লক্ষ্মীকর্ণ মাতৃদেবীর কক্ষে গেলেন।

হস্ত সঞ্চালনের ইঙ্গিতে সেবিকাদের কক্ষ হইতে বহিস্কৃত করিয়া লক্ষ্মীকর্ণ কম চক্ষে মাতার প্রতি চাহিলেন। শয্যায় শায়িতা মাতাও কটমট চাহিয়া প্রত্যুত্তর দিলেন। ষড়যন্ত্র যে ভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে এ সংবাদ এখনও অম্বিকা দেবীর কাছে পৌঁছে নাই। রোগপঙ্গু বৃদ্ধাকে কে সংবাদ দিবে?

লক্ষ্মীকর্ণ বলিলেন—আপনি যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তা সফল হয়নি। অণ্ড দ্রব হয়ে গেছে।

অম্বিকার চক্ষে উদ্বেগের ছায়া পড়িল, তিনি একটি ভ্রূ তুলিয়া নীরবে পুত্রকে প্রশ্ন করিলেন।

পুত্র বলিলেন—বিগ্রহপাল কুকুর শাবকের মত পালিয়েছে, যৌবনশ্রীকে নিয়ে যেতে পারেনি। তাকে আমি ঘরে বন্ধ করে রেখেছি। যতদিন বেঁচে থাকবে বন্ধ করে রাখব। আর যারা ষড়যন্ত্র করেছে লক্ষ্মীকর্ণ ব্যাঘ্র-চক্ষু মেলিয়া অকথিত বাক্যাংশের ইঙ্গিত মাতাকে বুঝাইয়া দিলেন।

অম্বিকার পক্ষাহত মুখে বিশেষ ভাবান্তর লক্ষিত হইল না, কেবল কণ্ঠ হইতে একটি অস্পষ্ট ধ্বনি নির্গত হইল। এই ধ্বনিকে পরাজয়ের স্বীকৃতি মনে করিয়া লক্ষ্মীকর্ণ ঈষৎ সন্তোষ লাভ করিলেন। তিনি আর বাক্যব্যয় না করিয়া দ্বারের দিকে চলিলেন।

দ্বার পর্যন্ত পৌঁছিয়াছেন এমন সময় পিছন হইতে অম্বিকার জড়িত কণ্ঠস্বর আসিল—তোর স্বয়ংবর তো পণ্ড হয়েছে।

লক্ষ্মীকর্ণ ঘুরিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার ক্রোধ আবার শিখায়িত হইয়া উঠিল। এই জড়পিণ্ড বুড়িটাকে গলা টিপিয়া মারিলেই ভাল হয়। কিন্তু মাতৃহত্যা মহাপাপ; বিশেষত প্রজারা জানিতে পারিলে ডিম্ব করিতে পারে। হতভাগ্য প্রজাগুলা বুড়িকে ভালবাসে। লক্ষ্মীকর্ণ কয়েকবার উত্তপ্ত দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া অনিচ্ছাভরে প্রস্থান করিলেন।

 

দুই

গুপ্ত মন্ত্রগৃহে প্রবেশ করিতে গিয়া রাজা দেখিলেন লম্বোদর দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া আছে। তিনি কোনও প্রকার ভণিতা না করিয়া বলিলেন—তোকে শূলে দেব।

লম্বোদর হাত জোড় করিল—আয়ুষ্মন, আমি নির্দোষ।

তুই সব নষ্টের মূল। শিল্পীটাকে ঘরে পুষে রেখেছিলি।

প্রভু, শিল্পীটা আমার শ্যালীকে নিয়ে পালিয়েছে।

ভাল করেছে। এবার তোকে শূলে দেব।

মহারাজ, আমি বাধা না দিলে বিগ্রহপাল রাজকন্যাকে নিয়ে পলায়ন করত।

মহারাজ এ কথাটা চিন্তা করেন নাই। লম্বোদর ষড়যন্ত্রে থাকিলে যৌবনশ্রীর পা জড়াইয়া ধরিয়া নিজেই ষড়যন্ত্র পণ্ড করিয়া দিত না। তিনি অঙ্গুলির ইঙ্গিতে লম্বোদরকে মন্ত্রগৃহে প্রবেশ করিতে বলিলেন। চারিদিকে গুপ্তশত্রু পরিবৃত হইয়া মহারাজ মনে মনে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিতেছিলেন, এখন যেন সহায় পাইলেন। যাক, তবু একজন বিশ্বাসী মানুষ আছে।

মন্ত্রগৃহের দ্বার বন্ধ করিয়া দুইজনে মুখোমুখি বসিয়া আলোচনা হইল। পরস্পরের সহিত সংবাদ বিনিময়ের ফলে ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া স্পষ্ট হইল। বিগ্রহপালকে তাড়া করিয়া কোনও লাভ আছে কিনা তাহাও আলোচিত হইল। বিগ্রহপাল সম্ভবত নদীপথেই পলাইয়াছে, কিন্তু এত বিলম্বে আর বোধহয় তাহাকে ধরা যাইবে না। তবু রাজা শশাণের ঘাটে একদল অশ্বারোহী পাঠাইলেন। লম্বোদর সঙ্গে গেল। বলা বাহুল্য বিগ্রহপালের নৌকা বহু পূর্বেই ঘাট হইতে অদৃশ্য হইয়াছিল।–

সূর্যাস্তের পর লম্বোদর ক্লান্ত অবসন্ন দেহে গৃহে ফিরিল। আজিকার দিনটা যেন বিভীষিকায় পূর্ণ। প্রাণ বাঁচিয়াছে বটে কিন্তু মন ক্ষতবিক্ষত। …কর্তব্য করিতে গেলে পদাঘাত মুষ্ট্যাঘাত, না করিলে, রাজরোষ-লাঞ্ছনা। তাহাও সহ্য হয় কিন্তু বান্ধুলি! তাহার চোখের উপর দিয়া বান্ধুলি চলিয়া গিয়াছে, মধুকরের ঘোড়ায় চড়িয়া তাহার গলা জড়াইয়া চলিয়া গিয়াছে!

বেতসী দ্বার পিণ্ডিকার বাহিরে দাঁড়াইয়া ব্যাকুল নয়নে পথের পানে চাহিয়া ছিল। স্বয়ংবর সভায় কি একটা গোলমাল হইয়াছে এইটুকুই তাহার কানে আসিয়াছিল। তাই অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তায় সে দ্বিপ্রহর হইতেই গৃহের সম্মুখে দাঁড়াইয়া কাটাইয়াছে, মধ্যাহ্নে অন্নগ্রহণের কথাও মনে ছিল না। লম্বোদর স্বয়ংবরের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, কি জানি কি ঘটিয়াছে! তারপর সন্ধ্যার সময় লম্বোদরকে আসিতে দেখিয়া সে ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিল।

প্রদোষের ম্লান আলোকে লম্বোদরের মুখ দেখিয়া বেতসীর বুক ধড়াস করিয়া উঠিল। যেন সর্বস্বহারার মুখ। বেতসীর মনে অনেক প্রশ্ন জমা হইয়াছিল, কিন্তু একটি প্রশ্নও সে মুখে আনিতে পারিল না। নীরবে হাত ধরিয়া সে লম্বোদরকে গৃহের মধ্যে লইয়া গেল। পীঠিকায় বসাইয়া তাহার পা ধুইয়া দিল। মুখে জল দিয়া গামোছায় গা মুছিয়া লম্বোদরের দেহ অনেকটা সুস্থ হইল। বেতসী তাহাকে শয়নকক্ষে লইয়া গিয়া নিজের শয্যায় বসাইয়া বলিল—আমি তোমার খাবার নিয়ে আসি।

বেতসী খাবার আনিতে গেল। লম্বোদর শয্যায় বসিয়া রহিল। ঘরের মধ্যে অন্ধকার ঘন হইতেছে। এ জগতে কেহ কাহারও নয়, সব বিচ্ছিন্ন সংযোগহীন নিরর্থক। জীবন শূন্য, কেবল বুকের মধ্যে একটা অবশ বেদনা হৃদ্স্পন্দনের সঙ্গে ধুক ধুক্ করিতেছে।

বেতসী খাদ্য পানীয় আনিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল—আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

লম্বোদর কী খাইল কিছুরই স্বাদ পাইল না। কপিঙ্খ সুরভিত তক্র, তাহারও স্বাদ নাই। পানাহার শেষ হইলে বেতসী বলিল—তুমি শোও, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। দীপ জ্বালব?

না।

লম্বোদর শয়ন করিয়া চক্ষু মুদিল, বেতসী শিয়রে বসিয়া লঘুহস্তে চুলের মধ্যে অঙ্গুলি সঞ্চালন করিতে লাগিল। ধীরে ধীরে লম্বোদর যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল।

সংসারে কোনও কিছুরই অর্থ হয় না…রাজকার্য..গুপ্তচরবৃত্তি…বান্ধুলি…সব অলীক…মিথ্যা। মিথ্যা।

পূর্বগগনে চাঁদ উঠিতেছে, পূর্ণিমার চাঁদ। শয্যার উপর চাঁদের আলো বাতায়ন দিয়া আসিয়া পড়িল, যেন শুভ্র ফুলের আস্তরণ বিছাইয়া দিল। সেই আলোতে লম্বোদরের মুখের পানে চাহিয়া বেতসী আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, অদম্য বাষ্পেচ্ছাস তাহার বুকের মধ্যে আলোড়িত হইয়া উঠিল। সে নত হইয়া লম্বোদরের মাথাটা বুকে চাপিয়া ধরিল।

লম্বোদর চমকিয়া চোখ খুলিল। একি! চাঁদের আলোয় ঘর ভরিয়া গিয়াছে। তাহার মনে হইল সে যেন এক অন্ধকারময় দুঃস্বপ্নের পঙ্ককুণ্ড হইতে উঠিয়া আসিল। এত আলো পৃথিবীতে আছে! আলো আছে, মাধুর্য আছে, স্নেহমমতা আছে। তাহার আপনার জন আছে, একান্ত আপনার জন। সুখে দুঃখে জীবনে মরণে সে শুধু তাহারই। তবে আর কিসের জন্য ক্ষোভ?

দুই বিন্দু আতপ্ত অশ্রু লম্বোদরের গণ্ডের উপর পড়িল। সে হাত বাড়াইয়া বেতসীকে বুকের কাছে টানিয়া লইল, পুরাতন চিরাভ্যস্ত স্নেহার্দ স্বরে ডাকিল—বেতসি—

 

তিন

পরদিন প্রভাতে জাতবর্মা সস্ত্রীক স্বদেশ প্রতিগমনের জন্য প্রস্তুত হইলেন। বীরশ্রী প্রথমে ঠাকুরানীর ঘরে গেলেন। অম্বিকা তাঁহার প্রিয়তমা নাতিনীর গলা জড়াইয়া অশ্রু বিসর্জন করিলেন। তারপর বলিলেন—ততার সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিন্তু তুই এ পাপপুরীতে আর থাকিস না, স্বামীকে নিয়ে নিজের দেশে চলে যা। এ রাজ্যের আর ইষ্ট নেই, পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। বিধাতার অভিশাপ, রাজা পুত্রহীন; তার উপর এত পাপ। এ বংশ আর বেশি দিন নয়।

বীরশ্রী বলিলেন—কিন্তু দিদি, যৌবনার কী হবে?

অম্বিকা বলিলেন—যৌবনার ভালই হবে। দেশসুদ্ধ লোকের সামনে সে বিগ্রহপালের গলায় মালা দিয়েছে, এখন আর অন্য কোনও রাজা তাকে বিয়ে করবে না। তোর বাপ কতদিন তাকে বন্ধ করে রাখবে? তুই দেখিস যৌবনার ভালই হবে। বাপ যতবড় দুরাচারই হোক, এ বংশের কোনও মেয়ে কখনও অসুখী হয়নি।

ঠাকুরানীর পদধূলি মাথায় লইয়া চোখ মুছিতে মুছিতে বীরশ্রী বিদায় লইলেন। পিতামহীর সহিত জীবনে আর দেখা হইবে না; পিত্রালয়ে আর কখনও আসিবেন সে সম্ভাবনাও অল্প।

সেখান হইতে বীরশ্রী যৌবনার নিকটে গেলেন। রঙ্গিণী খোলা তলোয়ার হাতে দ্বারের পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, বীরশ্রীকে আসিতে দেখিয়া তাহার কঠিন মুখ আরও কঠিন হইল। বীরশ্রী কাছে। আসিলে সে বলিল—বড় কুমারি, এ ঘরে প্রবেশ নিষেধ।

বীরশ্রী ভূক্ষেপ করিলেন না, যেন রঙ্গিণী নামী দাসীকে দেখিতেই পান নাই। কিন্তু তিনি কক্ষে প্রবেশ করিলেন না, বাহির হইতে ডাকিলেন—যৌবনা।

যৌবনশ্রী আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইলেন। তিনিও দ্বার অতিক্রম করিলেন না। দুই বোন দ্বারের দুই দিক হইতে পরস্পরের পানে চাহিলেন। দুইজনেরই চক্ষু অপূর্ণ হইয়া উঠিল।

কাল যৌবনশ্রীর রূপ ছিল নবোদ্ভিন্ন হিমচম্পকের ন্যায়, আজ সেই রূপ শুকাইয়া শীর্ণ হইয়া গিয়াছে। চোখের কোলে ছায়া, কেশ-বেশ অবিন্যস্ত, অঙ্গ নিরাভরণ। বীরশ্রীর হৃদয় মথিত করিয়া দীর্ঘশ্বাস পড়িল।

কিন্তু রঙ্গিণীর সম্মুখে অধিক হৃদয়াবেগ প্রকাশ করা চলিবে না। বীরশ্রী কণ্ঠস্বর দৃঢ় করিয়া বলিলেন—যৌবনা, আজ আমরা চলে যাচ্ছি।

এই কথা কয়টির মধ্যে কি ছিল জানি না, তাঁহাদের হৃদয়াবেগ আর শাসন মানিল না; দুইজনে ছুটিয়া আসিয়া পরস্পরের কণ্ঠলগ্না হইলেন। রঙ্গিণী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া তলোয়ার হাতে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার ঘোর বিপদ, একদিকে রাজা অন্যদিকে দুই রাজকন্যা; আগু হইলে রাম, পিছাইলে রাবণ।–বীরশ্রী ভগিনীর কানে কানে বলিলেন—আমরা পাটলিপুত্রে থামব। তুই বিগ্রহকে কিছু বলবি?

যৌবনশ্রী কয়েকবার অশ্রু গলাধঃকরণ করিয়া বলিলেন—তাঁকে বলল, এ জন্মে যদি দেখা না হয়, পরজন্মে দেখা হবে।

বীরশ্রী বলিলেন—এ জন্মেই দেখা হবে। তোকে বিগ্রহের কোলে যদি না তুলে দিতে পারি, বৃথাই আমি তোর দিদি।

আরও খানিক কান্নাকাটি হইল, তারপর বীরশ্রী চলিয়া গেলেন। রঙ্গিণী হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল।

মধ্যাহ্নের পূর্বেই জাতবর্মা ও বীরশ্রী রথে চড়িয়া শোণ-ঘাটের উদ্দেশে যাত্রা করিলেন। লক্ষ্মীকর্ণ মন্ত্রীদের লইয়া গুপ্ত মন্ত্রগৃহের দ্বার বন্ধ করিয়াছিলেন, বিদায়কালে কন্যা-জামাতার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন না।

ঘাটে পৌঁছিয়া জাতবর্মা ও বীরশ্রী বিষণ্ণমনে নৌকায় উঠিলেন। দিশারু শুভঙ্কর অপহৃত দাঁড়ের পরিবর্তে নূতন দাঁড় যোগাড় করিয়াছিল। নৌকা ছাড়িয়া দিল।

 

চার

পূর্বদিন এই সময় বিগ্রহপালের নৌকা ঘাট ছাড়িয়াছে।

ঘাট ছাড়িয়া নৌকা স্রোতের মুখে পড়িল। বায়ু প্রতিকূল হইলেও স্রোত ও দাঁড়ের জোরে নৌকা ক্ষিপ্রবেগে চলিল। দুই দণ্ডের মধ্যে শোণের ঘাট দিগন্তে বিলীন হইয়া গেল। দিব্যজ্যোতি ও রোহিতাশ্বকে আর দেখা গেল না।

আকাশে প্রখর রৌদ্র; এক মাসেই উত্তরগামী সূর্য বিলক্ষণ তপ্ত হইয়াছে। তিনজনে নিশ্বাস ফেলিয়া ছাদ হইতে নামিয়া আসিলেন। বান্ধুলি শয্যা পাতিয়া দিল, দুই বন্ধু উপবেশন করিলেন। বান্ধুলি ঘরের এক কোণে গিয়া পান সাজিতে লাগিল।

কথা বলিতে যেন সকলে ভুলিয়া গিয়াছে। অনঙ্গ থাকিয়া থাকিয়া উদ্বিগ্নচক্ষে বিগ্রহপালের দিকে চাহিতেছে, কিন্তু কথা কহিতেছে না। সে জানে বিগ্রহের মনের অবস্থা কিরূপ; এখন সান্ত্বনা দিতে গেলে সে আরও বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিবে। আর বান্ধুলি? সে কী কথা বলিবে? তাহার অবস্থা নববধূর মত; উপরন্তু শঙ্কা ও সঙ্কোচে সে এতটুকু হইয়া গিয়াছে। যৌবনশ্রী আসিতে পারেন নাই অথচ সে আসিয়াছে, এই অপরাধের ভারে সে যেন মাটিতে মিশিয়া আছে।

বিগ্রহপালের মনের মধ্যে তুমুল আন্দোলন চলিয়াছে; তাঁহার সংজ্ঞা অন্তর্মুখী, তাই তিনিও নীরব।—এ কী হইল! যৌবনশ্রী! যৌবনা! তোমাকে পাইয়াও পাইলাম না। এতদিনের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা সমাপ্তির উপান্তে আসিয়া লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল। …আরম্ভ হইতে দৈব ছিল অনুকূল। পথে বীরশ্রী ও জাতবর্মার সহিত সাক্ষাৎ, যৌবনশ্রীকে হরণ করার প্রস্তাবে তাঁহাদের সম্মতি ও সহায়তা, যৌবনশ্রীর সহিত সাক্ষাৎআত্রেই উভয়পক্ষের অনুরাগ, তারপর কার্যসিদ্ধির পক্ষে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা যেন অযাচিতভাবে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু হঠাৎ এ কী হইয়া গেল! প্রসন্ন ভাগ্যদেবতা অকস্মাৎ মুখ ফিরাইলেন। তীরে আসিয়া তরী ড়ুবিল!

বিগ্রহপালের মনে আত্মগ্লানিও কম ছিল না। কেন যৌবনাকে ছাড়িয়া চলিয়া আসিলাম। না হয় দুইজনে একসঙ্গে মরিতাম। রাজারা হাসিবে, কাপুরুষ বলিয়া ব্যঙ্গ করিবে। আর যৌবনা! সে যদি আমাকে কাপুরুষ মনে করে? না না, তা করিবে না। কিন্তু যৌবনশ্রী কি বাঁচিয়া আছে? যদি

তাঁহার মন অস্থিরতায় ছটফট করিয়া উঠিল; তিনি আর রইঘরে থাকিতে পারিলেন না, উঠিয়া গিয়া ছাদে বসিলেন। সূর্যের তাপ কমিয়াছে, দক্ষিণ হইতে মন্দ মন্দ বায়ু বহিতে আরম্ভ করিয়াছে।

রইঘরে বান্ধুলি অনঙ্গের কাছে আসিয়া চোখ ডাগর করিয়া চাহিল। দুইজনে নিম্নস্বরে কথা হইল। তারপর অনঙ্গও ছাদে গিয়া বিগ্রহের কাছে বসিল।

দুইজনে বসিয়া আছেন, কাহারও মুখে কথা নাই। সূর্যের বর্ণ পীত হইয়া ক্রমে লোহিতাভা ধারণ করিল। নৌকার ছায়া সম্মুখে দীর্ঘায়ত হইতে লাগিল।

হঠাৎ বিগ্রহপাল কথা বলিলেন। যেন দীর্ঘ নীরবতা লক্ষ্য করিয়া লঘুতার অভিনয় করিলেন, বলিলেন—তুই ঠিক বলেছিলি অনঙ্গ। পাটলিপুত্রের ঘাটে যে পাখি দুটো দেখেছিলাম সে-দুটো খঞ্জন নয়, কাদাখোঁচাই বটে।

অনঙ্গ একটু হাসিল, বলিল—আর্য রন্তিদেবও ঠিক বলেছিলেন, এখন পূর্ণ সিদ্ধি না হলেও অন্তে সিদ্ধি অনিবার্য।

বিগ্রহপালের মনের অন্ধকার কিছু স্বচ্ছ হইল না। রন্তিদেবের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা তাঁহার মনে ছিল না। তবে একেবারে হতাশ হইবার কারণ নাই। অন্তে সিদ্ধি কিন্তু সে অন্ত কতদূর?

তিনি ধীরে ধীরে কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন। পূর্বে অনঙ্গকে অতি সংক্ষেপে যাহা বলিয়াছিলেন, সভা হইতে বাহির হইবার পর লম্বোদর কর্তৃক যৌবনশ্রীর পদধারণ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া শেষে প্রশ্ন করিলেন—এ অবস্থায় তুই কি করতিস?

অনঙ্গ যেন একটু চিন্তা করিল, তারপর মাথা নাড়িল-কি করতাম বলতে পারি না। ঢাল নেই তলোয়ার নেই, এ অবস্থায় মানুষ কি করতে পারে? হয়তো লম্বোদরের বগলে কাতুকুতু দিতাম। কিন্তু তাতে ফল হত বলে মনে হয় না। লম্বোদর মানুষ নয়, গণ্ডার।

এতক্ষণে বিগ্রহপালের মুখে হাসির আভাস দেখা দিল, আত্মগ্লানিও লাঘব হইল। অনঙ্গ অপ্রত্যক্ষভাবে সেই চেষ্টাই করিতেছিল।

সূর্যাস্ত হইল, সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাকাশে চাঁদ উঠিল। বসন্ত পূর্ণিমার রাত্রি। বিগ্রহপাল চাঁদের দিকে চাহিয়া চাহিয়া আবার মুহ্যমান হইয়া পড়িলেন।

গরুড় আসিয়া বলিল—রাত্রি হল, এবার নৌকা বাঁধি?

অনঙ্গ বিগ্রহের পানে চাহিল। বিগ্রহ বলিলেন—আমি জানি না। যা ইচ্ছা কর।

অনঙ্গ তখন গরুড়কে বলিল—পিছনে ওরা আসছে কিনা জানা নেই, নৌকা বাঁধা নিরাপদ। হবে না। সারা রাত চাঁদ থাকবে, দিনের মত আলো। তুমি নৌকা চালাও। অনুকূল বাতাস উঠেছে, দাঁড় বন্ধ করে পাল তোল। স্রোতের মুখে পালের ভরে ভেসে চল। কিন্তু সাবধান, নৌকা চরে আটকে না যায়।

আজ্ঞা বলিয়া গরুড় প্রস্থান করিল।

অল্পক্ষণ মধ্যেই গরুড় দাঁড় বন্ধ করিয়া পাল তুলিয়া দিল। চারিদিক আবছায়া হইয়া গিয়াছে, তীররেখা অস্পষ্ট। নৌকার সম্মুখে গরুড় বসিয়াছে, পিছনে আছে হালী। দুইজনে সতর্কভাবে নৌকা চালাইতে লাগিল।

রাত্রির আহার শেষ হইলে বিগ্রহ অনঙ্গকে বলিলেন—তুই আর বান্ধুলি রইঘরে থাক। আমি ছাদে শোব।

অনঙ্গ বলিল—আমিও ছাদে শোব।

বিগ্রহ বলিলেন—কিন্তু, একা বান্ধুলির ভয় করবে না?

অনঙ্গ মুখ টিপিয়া বলিল—আমি থাকলেই ওর ভয় বেশি।—চল শুই গিয়ে।

ছাদে শয্যা রচনা করিয়া দুই বন্ধু শয়ন করিলেন। মুক্ত আকাশের তলে জ্যোৎস্নার প্লাবনে যেন ভাসিয়া চলিলেন। বিগ্রহপাল ভাবিতে লাগিলেন—যৌবনা যদি আজ এই নৌকায় থাকিত, পৃথিবীতে স্বর্গ নামিয়া আসিত। ভাবিতে ভাবিতে তাঁহার চক্ষু বাষ্পকুল হইয়া উঠিল।

ক্রমে রাত্রি গভীর হইল। ক্লান্ত-পীড়িত মন লইয়া একে একে সকলে ঘুমাইয়া পড়িলেন। কেবল গরুড় ও হালী সারা রাত্রি জাগিয়া নৌকা চালাইল।

 

পাঁচ

তিন দিন নদীবক্ষে যাপন করিয়া চতুর্থ দিনের পূর্বাহে বিগ্রহপাল পাটলিপুত্রের রাজঘাটে পৌঁছিলেন।

মহারানী পুত্রের মুখ দেখিয়া বুঝিলেন, কিছু ঘটিয়াছে। কিন্তু তিনি কুশলপ্রশ্ন করিবার পূর্বেই বিগ্রহপাল বলিলেন-মা, দেখ অনঙ্গ কেমন বৌ এনেছে।

বান্ধুলি মহারানীকে প্রণাম করিল। মহারানী বিস্ময়োফুল্ল মুখে তাহাকে কাছে টানিয়া লইলেন, তাহার ভীত-লজ্জিত মুখখানি ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন—কী সুন্দর বউ! এমন বউ কোথায় পেলি অনঙ্গ?

অনঙ্গ ঘাড় চুলকাইতে লাগিল। বিগ্রহ বলিলেন—সব পরে শুনো। ওদের এখনও বিয়ে হয়নি, তোমাকে বিয়ে দিতে হবে। এখন এদিকের সংবাদ বল। মহারাজ কেমন আছেন?

রানী বলিলেন—মহারাজ অসুস্থ। অসুস্থ?

কিছুদিন থেকে শরীর ভাল নেই। তারা তাঁর কাছে যা। তোদের আসার খবর পেয়েছেন, বিরামকোষ্ঠে আছেন।

বিগ্রহ ও অনঙ্গ বান্ধুলিকে মায়ের কাছে রাখিয়া মহারাজ নয়পালের নিকটে গেলেন।

নয়পাল প্রাসাদের একটি কক্ষে দিবাশয্যায় অর্ধশয়ান অবস্থায় বিশ্রাম করিতেছিলেন, একজন সংবাহক পদসেবা করিতেছিল। মহারাজের শরীর কিছু কৃশ, মুখের চর্ম শিথিল ও রেখাঙ্কিত হইয়াছে; কিন্তু তিনি শয্যাশায়ী হন নাই। লক্ষ্মীকর্ণের উদ্দেশে তিনি যে মারণ যজ্ঞের প্রবর্তন করিয়াছিলেন তাহাতে তিনি নিজেও যোগ দিয়াছিলেন; কুম্ভক রেচকাদি প্রক্রিয়ার ফলে, লক্ষ্মীকর্ণের যত না অনিষ্ট হোক, তিনি নিজে বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাঁহার অভ্যন্তরীণ যন্ত্রপাতি উলট-পালট হইয়া গিয়াছিল। অজীর্ণ ও অনিদ্রা রোগ ধরিয়াছিল।

বিগ্রহ ও অনঙ্গ আসিয়া পদবন্দনা করিলে তিনি শয্যায় উঠিয়া বসিলেন, সংবাহককে বিদায় করিয়া কুশল প্রশ্নাদি করিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন—কোথায় কোথায় গিয়েছিলে? কোন কোন দেশ দেখলে?

এখনই পিতাকে সব কথা বলার সংকল্প বিগ্রহপালের ছিল না, কিন্তু সরাসরি মিথ্যা কথাও বলিতে পারিলেন না। বলিলেন—কেবল ত্রিপুরী গিয়েছিলাম।

মহারাজ উচ্চকিত হইয়া চাহিলেন—ত্রিপুরী! অর্থাৎ-লক্ষ্মীকর্ণের কন্যার স্বয়ংবরে?

বিগ্রহ কুণ্ঠিতস্বরে বলিলেন—আজ্ঞা মহারাজ।

নয়পাল বিরক্ত হইলেন—অনাহূত শত্রুরাজ্যে গিয়েছিলে! লক্ষ্মীকর্ণ মহাপিশুন, সে যদি অসহায় পেয়ে তোমাকে হত্যা করত! কি জন্য গিয়েছিলে? যাবার আগে আমাকে বলনি কেন?

বিগ্রহপাল অধোমুখে রহিলেন। অনঙ্গ তখন সম্মুখে আসিয়া করজোড়ে বলিল—মহারাজ, যদি অনুমতি হয় আমি সব কথা বলতে পারি।

নয়পাল তাহার প্রতি অপ্রসন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন—বল।

অনঙ্গ তাঁহার পদপ্রান্তে বসিয়া সব কথা বলিল। শুনিতে শুনিতে মহারাজের অপ্রসন্নতা দূর হইল, তিনি উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। আখ্যান শেষ হইলে তিনি শয্যা হইতে লাফাইয়া উঠিয়া বলিলেন—যৌবনশ্রী স্বয়ংবর সভায় বিগ্রহের গলায় বরমাল্য দিয়েছে! তবে তো যৌবনশ্রী আমার পুত্রবধূ! লক্ষ্মীকর্ণ তাকে আটকে রাখে কোন্ স্পধায়!

অনঙ্গ যখন মহারাজকে কাহিনী শুনাইতেছিল বিগ্রহপাল তখন বাতায়নের সম্মুখে গিয়া বাহিরে তাকাইয়া ছিলেন। এখন তিনি সচকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার মুখ আনন্দে ভরিয়া উঠিল। তিনি দ্রুত গিয়া পিতার হাত ধরিলেন—মহারাজ, আপনি শান্ত হোন। আপনার শরীর অসুস্থ

মহারাজ কিন্তু শান্ত হইলেন না, বলিলেন—তোমরা যৌবনশ্রীকে আনতে পারলে না, অত্যন্ত পরিতাপের কথা। কিন্তু আমি ছাড়ব না। আমি এখনি লক্ষ্মীকর্ণের কাছে দূত পাঠাচ্ছি। সে যদি এই দণ্ডে আমার পুত্রবধূকে আমার কাছে পাঠিয়ে না দেয় আমি যুদ্ধ করব। চেদিরাজ্য ছারখার করে দেব।

বিগ্রহ ও অনঙ্গ মহারাজকে ধরিয়া শয্যায় বসাইয়া দিলেন। তিনি বলিতে লাগিলেন—মহারানী কোথায়? তিনি সংবাদ জানেন? তাঁকে ডেকে আনো। আমি যুদ্ধ করব। মহারানী কোথায়?

দুই বন্ধু মহারানীর কাছে গেলেন। গিয়া দেখিলেন মহারানী বান্ধুলির নিকট হইতে সব কথাই বাহির করিয়া লইয়াছেন। তিনি হাস্যবিম্বিতমুখে পুত্রের বুকের উপর স্নিগ্ধ করতল রাখিয়া বলিলেন—তুই ভাবনা করিস না। আমার ঘরের লক্ষ্মী আটকে রাখে এমন সাধ্য কারও নেই।

বিগ্রহ পিতার উত্তেজিত আস্ফালনে যে আশ্বাস লাভ করিয়াছিলেন মাতার শান্ত দৃঢ়তায় তদপেক্ষা অধিক আশ্বাস পাইলেন। হাসিমুখে কহিলেন—মহারাজ বলছেন যুদ্ধ করবেন।

মহারানী বলিলেন—প্রয়োজন হলে যুদ্ধ হবে। আপাতত বান্ধুলি আর অনঙ্গের বিয়েটা দিয়ে দিই। অনেকদিন বাড়িতে উৎসব হয়নি।

তারপর মহারানী বান্ধুলির হাত ধরিয়া এবং বন্ধুযুগল কর্তৃক অনুসৃত হইয়া মহারাজের নিকট চলিলেন।

 

ছয়

দুই দিন পরে জাতবর্মা ও বীরশ্রী আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

পাটলিপুত্রের রাজভবনে অনঙ্গের বিবাহ উপলক্ষে উৎসবের সূচনা হইয়াছিল, এখন তাহা চতুর্গুণ বর্ধিত হইল। বিগ্রহপাল বীরশ্রীকে প্রায় কাঁধে করিয়া ঘাট হইতে রাজপুরীতে আনিয়া মায়ের কোলে সঁপিয়া দিলেন। জাতবর্মাকে নয়পাল পুত্রস্নেহে আলিঙ্গন করিলেন। এই সময় ভারতের রাজন্যবর্গের মধ্যে পরস্পর প্রীতির সম্পর্ক ছিল না, যেখানে বাহিরে মৈত্রীবন্ধন আছে সেখানেও ভিতরে ভিতরে ঈর্ষা দ্বেষ অসহিষ্ণুতা ছিল। জাতবর্মা সস্ত্রীক পাটলিপুত্রে আসিয়া যেন সত্যকার হৃদয়ের সম্পর্ক স্থাপন করিলেন। নয়পাল স্বয়ং হৃদয়বান পুরুষ, তিনি বিগলিত হইয়া গেলেন। তাঁহার শত্রুর কন্যা এবং জামাতা স্বেচ্ছায় প্রীতিবশে তাঁহার কাছে আসিয়াছে। নয়পাল অসুস্থ শরীর লইয়া সর্বদা জাতবর্মার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন এবং বারম্বার অবরোধে গিয়া বীরশ্রীকে সাদর সম্ভাষণ করিয়া আসিলেন। মহারানী স্বহস্তে জাতবর্মাকে মিষ্টান্ন খাওয়াইলেন। বীরশ্রী তাঁহার পাকা চুল তুলিয়া দিয়া তাঁহার হৃদয় জয় করিয়া লইলেন। বান্ধুলি বীরশ্রীকে পাইয়া নববধূসুলভ লজ্জা সঙ্কোচ ভুলিয়া গেল এবং ক্রমাগত মহারানীর জন্য পান সাজিতে লাগিল। মহারানী পান ভালবাসেন, দিনে ত্রিশ-চল্লিশটা পান খান।

একদিন মহা ধুমধামের সহিত অনঙ্গ ও বান্ধুলির বিবাহ হইয়া গেল। মহারাজ স্বয়ং কন্যা সম্প্রদান করিলেন; মহারানী ও বীরশ্রী বান্ধুলিকে মহার্ঘ যৌতুক দিলেন। অনঙ্গ বধূ লইয়া নিজ গৃহে গেল। বিগ্রহপাল যৌবনশ্রীর কথা স্মরণ করিয়া মনে মনে বেদনা পাইলেও বন্ধুর বিবাহে সর্বদা অগ্রণী হইয়া রহিলেন এবং বাসক রজনীতে নবদম্পতিকে পুষ্পশয্যায় শয়ন করাইয়া গৃহে ফিরিলেন।

অতঃপর উৎসবের কলবলা কথঞ্চিত শান্ত হইলে নয়পালের বিরামকোষ্ঠে কূটনৈতিক সভা বসিল। সভায় উপস্থিত রহিলেন কেবল পাঁচজন, নয়পাল বিগ্রহপাল জাতবর্মা অনঙ্গ ও সচিব যোগদেব। যৌবনশ্রী সম্পর্কে কি করা যাইবে তাহাই বিচার্য। আলাপ আলোচনা মুখ্যত নয়পাল ও জাতবর্মার মধ্যে হইল।–নয়পালের মানসিক উত্তেজনা এখন সমীভূত হইয়াছে, তিনি ধীরকণ্ঠে বলিলেন—আমি বৃদ্ধ। হয়েছি, আমার আয়ু শেষ হয়ে আসছে। তার উপর দেহ পীড়াগ্রস্ত। তোমরা নবীন, আজ নয় কাল রাজ্যশাসনের ভার তোমাদের উপর পড়বে। তোমাদের প্রজা পালন করতে হবে, অন্য রাজাদের সঙ্গে মন্ত্রযুদ্ধ করতে হবে। এখন তোমরা বল, স্বয়ংবর সভায় যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। তার সমাধান কোন পথে? আমাদের কর্তব্য কি?

কেহ কোনও উত্তর দিল না, যোগদেব নীরব রহিলেন। তখন জাতবর্মা অগ্রণী হইয়া বলিলেন—আগে আপনি আজ্ঞা করুন, আর্য, আপনি কি কোনও কর্তব্য স্থির করেছেন?

নয়পাল বলিলেন—স্থির কিছু করিনি। তবে আমার বিবেচনায় প্রথমে লক্ষ্মীকর্ণের কাছে দূত পাঠানো উচিত।

জাতবর্মা বলিলেন—রাষ্ট্রনীতির নিয়মে দূত পাঠানোই হয়তো কর্তব্য। কিন্তু তাতে কোনও ফল হবে না আর্য। শ্বশুর মহাশয়কে আমি চিনি।

তাহলে অন্য উপায় আর কী আছে? ছলে বা কৌশলে কার্যোদ্ধার হতে পারে কি?

এখন আর সম্ভব নয়। শ্বশুর মহাশয় সাবধান হয়েছেন। যৌবনশ্রীর ঘরের দ্বারে পাহারা, রাজপুরী ঘিরে পাহারা বসেছে। ছল-চাতুরীতে আর কিছু হবে না।

নয়পাল নিশ্বাস ফেলিলেন। যৌবনশ্রী যদি চুপি চুপি পলায়ন করিতে সম্মত হইতেন তাহা হইলে কোনও গণ্ডগোল হইত না একথা সকলেরই মনে হইল। কিন্তু সেজন্য যৌবনশ্রীকে দোষী করিবার চিন্তা কাহারও মনে আসিল না। তিনি উচিত কার্য করিয়াছেন, আর্য নারীর ন্যায় আচরণ করিয়াছেন; তাঁহার আচরণে সকলেই গৌরবান্বিত। তবু তিনি উচিত কার্য সম্বন্ধে এতটা সচেতন না হইলেই বোধ করি ভাল হইত।

তাহলে যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর নেই, এই তোমার মত?

জাতবমা নতমস্তকে নীরব রহিলেন। নয়পাল তখন বলিলেন—আমি নিজের অভিপ্রায় তোমাদের বললাম। যদি বিনা যুদ্ধে কার্যসিদ্ধি হয় তাই ভাল, কিন্তু যদি যুদ্ধ করতেই হয় তাতে আমার অমত নেই। এখন তোমরা বল তোমাদের অভিপ্রায় কি?

বিগ্রহ নিবক রহিলেন, অনঙ্গও কথা বলিল না; যোগদেব একটা কিছু বলি বলি করিয়া থামিয়া গেলেন। শেষে কেহ কিছু বলিল না দেখিয়া জাতবর্মা বলিলেন—মহারাজ, আপনাকে মন্ত্রণা দেবার স্পর্ধা আমার নেই। কিন্তু অবস্থা যেরূপ দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হয় যুদ্ধ ছাড়া যৌবনশ্রীকে উদ্ধার করা যাবে না। এবং যদি যুদ্ধই করতে হয় তবে যত শীঘ্র সম্ভব প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন। শ্বশুর মহাশয় এখন একটু বিপাকে পড়েছেন, চেদিরাজ্য আক্রমণের এই প্রকৃষ্ট সুযোগ।

ঈষৎ হাসিয়া নয়পাল প্রশ্ন করিলেন—কিরূপ বিপাক?

জাতবর্মা বলিলেন—স্বয়ংবর সভায় যে-সব মিত্র রাজা এসেছিলেন তাঁরা সকলেই অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছেন, তাঁদের ধারণা চেদিরাজ তাঁদের হাস্যাস্পদ করেছেন। এখন আপনি চেদিরাজ্য আক্রমণ করলে তাঁরা কেউ সাহায্য করতে আসবেন না। শ্বশুর মহাশয় ভয় পেয়ে আপনার হাতে যৌবনশ্রীকে অর্পণ করতে পারেন।

নয়পাল প্রফুল্ল হইয়া বলিলেন—যথার্থ বলেছ। একথা আমার মনে উদয় হয়নি। হয়তো যুদ্ধ করবার প্রয়োজন হবে না, হুঙ্কারেই কাজ হবে। বৎস জাতবর্মা, আমি তোমার প্রতি বড় প্রীত হয়েছি। তুমি তোমার পিতার সুপুত্র বটে। আশীর্বাদ করি দীর্ঘজীবী হও।

এইবার সচিব যোগদেব প্রথম কথা বলিলেন, জাতবর্মাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন—ক্ষমা করবেন, একটি প্রশ্ন আছে। মগধ যুদ্ধযাত্রা করলে আপনি সঙ্গে থাকবেন তত?

জাতবর্মা অপ্রতিভ হইয়া পড়িলেন, নয়পালের দিকে চাহিয়া বলিলেন—মহারাজ, অন্তর্যামী জানেন আমি আপনার সঙ্গে যুদ্ধাভিযানে যোগ দিতে কত উৎসুক। শ্বশুর মহাশয় যেরূপ ব্যবহার করেছেন তাতে তাঁর প্রতি তিলমাত্র সহানুভূতি আমার নেই। কিন্তু আমি স্বাধীন নই, মাথার উপর পিতৃদেব আছেন। আমি দেশে ফিরে গিয়ে তাঁর কাছে সব নিবেদন করব। তিনি ন্যায়বান পুরুষ, অন্যায়ের পক্ষ কদাপি অবলম্বন করবেন না।

ভাল। আমি তাঁকে পত্র লিখব, তারপর তাঁর ইচ্ছা।–নয়পাল ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিলেন—আর একটা কথা। আমি লক্ষ্মীকর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে মাতা যৌবনশ্রীর কোনও অনিষ্ট সম্ভাবনা নেই?

জাতবর্মার মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল, তিনি বলিলেন—মহারাজ লক্ষ্মীকর্ণ যদি আপনার প্রতি বিদ্বেষবশত নিজের কন্যার অনিষ্ট করেন তবে তাঁর মত নরাধম ভূ-ভারতে নেই।

অতঃপর আরও কিছুক্ষণ আলোচনা হইল। যোগদেব কনিষ্ঠ সচিব হইলেও রাজার পারিবারিক মন্ত্রণায় যোগ দিতেন; বিশেষত এই ব্যাপারের সহিত আরম্ভ হইতেই তাঁহার একটা যোগসূত্র স্থাপিত হইয়াছিল। তিনি এখন সমস্ত করণীয় কর্মের ভার লইলেন। স্থির হইল চেদিরাজ্যে দূত পাঠানো হইবে, সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধযাত্রার উদ্যোগ হইবে। দৌত্য যদি বিফল হয় তখন নয়পাল যুদ্ধযাত্রা করিবেন। বজ্রবর্মা যদি তাঁহার সহযাত্রী হন ভাল, নচেৎ একাই যুদ্ধে যাইবেন। মগধ এখন আর সে-মগধ নাই সত্য, কিন্তু একেবারে মরিয়া যায় নাই।

সাত দিন মগধের আতিথ্য উপভোগ করিয়া জাতবর্মা ও বীরশ্রী আবার নৌকায় উঠিলেন। যাত্রার পূর্বে মহারানী বীরশ্রীর কণ্ঠে মহামূল্য রত্নহার পরাইয়া দিলেন। নয়পাল জাতবর্মাকে মণিমাণিক্যখচিত অঙ্গদ ও শিরস্ত্রাণ দিলেন।

প্রণামকালে বীরশ্রী মহারানীকে বলিলেন—মা, আমরা আবার আসব। এবার যৌবনাকে নিয়ে আসব।

মহারানী সজল নেত্রে তাঁহার ললাট চুম্বন করিয়া বলিলেন—এস।

<

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়