সপ্তম পরিচ্ছেদ – মুক্তি

চোর ধরার উত্তেজনায় সুগোপার রাত্রে ঘুম হয় নাই। ভোর হইতে না হইতে সে রাজপুরীতে আসিয়া উপস্থিত হইল।

রাজকুমারী রট্টা তখনও শয্যা ত্যাগ করেন নাই; শয়ন মন্দিরের দ্বারে যবনী প্রতিহারীর পাহারা। সুগোপা কিন্তু যবনীর নিষেধ মানিল না, শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হইয়া ডাকিল—সখি, ওঠ ওঠ, অশ্বচোর ধরা পড়িয়াছে।

রাজকুমারীর চক্ষু দুটি খুলিয়া গেল; যেন দুইটি খঞ্জন একসঙ্গে নৃত্য করিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন—দূর হ প্রেতিনী! কী সুন্দর স্বপ্ন দেখিতেছিলাম, তুই ভাঙ্গিয়া দিলি।

সুগোপা পালঙ্কের পাশে বসিয়া বলিল—ওমা, কি স্বপ্ন দেখিলে? ভোরের স্বপ্ন সত্য হয়। বল বল শুনি।

রট্টা বলিলেন—কমল সরোবরে এক হস্তী ক্রীড়া করিতেছিল; আমি তীরে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে হস্তী আমাকে দেখিতে পাইল; তখন সরোবরের মধ্যস্থল হইতে একটি রক্তকমল শুণ্ডে তুলিয়া আমার দিকে আসিতে লাগিল। আমি অঞ্জলি বাঁধিয়া হাত বাড়াইলাম। হস্তী তীরের নিকটে আসিয়া কমলটি আমার হাতে দিতে যাইবে, এমন সময় তুই

ঘুম ভাঙ্গিয়া দিলি।

সুগোপা বলিল—ভাল স্বপ্ন। গ্রহাচার্য ঠাকুরের নিকট ইহার অর্থ জানিয়া লইতে হইবে। এখন ওঠ, চোর দেখিবে না?

আলস্য ত্যাগের ভঙ্গিমায় দেহটি লীলায়িত করিয়া রট্টা উঠিলেন। চোর দেখিবার কৌতূহল নাই এমন মানুষ বিরল, তা তিনি রাজকন্যাই হোন আর মালাকর-বধূই হোন। তবু রট্টা পরিহাসচ্ছলে বলিলেন-তোর চোর তুই দেখ না, আমি দেখিয়া কি করিব?

সুগোপা বলিল—ধন্য! চোর তোমার ঘোড়া চুরি করিল, তবে সে আমার চোর হইল কিরূপে?

রট্টা বলিলেন—তুই চোরের চিন্তায় রাত্রে ঘুমাইতে পারিস নাই, সাত সকালে আসিয়া আমার ঘুম ভাঙ্গাইলি। নিশ্চয় তোর চোর।

সহাস্য মুখে রট্টা স্নানাগারের অভিমুখে চলিলেন। সুগোপাও রঙ্গ পরিহাস করিতে করিতে, গত রাত্রির চোর ধরার কাহিনী শুনাইতে শুনাইতে তাঁহার সঙ্গিনী হইল।

 

সূর্যোদয়ের দণ্ড দুই পরে রাজকীয় সভাগৃহে কিছু জনসমাগম হইয়াছিল। রাজার অনুপস্থিতিতে রাজসভায় অধিবেশন হয় না, মন্ত্রিগণ স্ব স্ব গৃহে থাকিয়া রাজকার্য পরিচালনা করেন, তাই রাজসভা শূন্যই থাকে। কিন্তু আজ কোট্টপাল মহাশয় প্রাতেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন; তাঁহার সঙ্গে কয়েকটি সশস্ত্র অনুচর। তদ্ব্যতীত পুরীর কয়েকজন দৌবারিক ও প্রতীহার আছে। অবরোধের কধুকীও চোরের খবর পাইয়া আসিয়া জুটিয়াছে। মন্ত্রীরা বোধকরি চোর ধৃত হওয়ার সংবাদ এখনও পান নাই, তাই আসিয়া পৌঁছিতে পারেন নাই।

রাজকুমারী রট্টা সভায় আসিলেন; সঙ্গে সখী সুগোপা। রট্টার পরিধানে হরিতালবর্ণ ক্ষৌমবস্ত্র, বক্ষে দূর্বাহরিৎ কথুলী, কেশ-কুণ্ডলীর মধ্যে শ্বেত কুরুবকের নবমুকুল চন্দ্রকলার ন্যায় জাগিয়া আছে—যেন সাক্ষাৎ বসন্তের জয়শ্রী। রট্টা আসিয়া সিংহাসনের পাদপীঠে বসিলেন। সুগোপা তাঁর পায়ের কাছে বসিল।

অভিবাদন শেষ হইলে রট্টা চারিদিকে চাহিয়া বলিলেন—চোর কোথায়?

কোট্টপালের ইঙ্গিত পাইয়া তাঁহার দুইজন অনুচর বাহিরে গেল; অল্পকাল পরে বদ্ধহস্ত চোরকে লইয়া ফিরিয়া আসিল। তাহাদের পিছনে গত রাত্রির তোরণ-প্রতীহার ও যামিক রক্ষিদ্বয়ও আসিল।

চোরকে সিংহাসনের সম্মুখে দাঁড় করানো হইল।

রট্টা স্থিরদৃষ্টিতে চোরকে নিরীক্ষণ করিলেন। সুগোপা তাঁহার কানে কানে প্রশ্ন করিল—চিনিতে পারিয়াছ?

রট্টা বলিলেন—হাঁ, চিনিয়াছি। কল্য জলসত্রে এই ব্যক্তিই আমার অশ্ব চুরি করিয়া পলাইয়াছিল। অশ্বচোর, তোমার কিছু বলিবার আছে?

চিত্ৰক এতক্ষণ সংযতভাবে দাঁড়াইয়া রাজকন্যার পানে চাহিয়া ছিল। রাত্রে অন্ধকূপ-বাসের ফলে তাহার বস্ত্রাদি কিছু বিস্রস্ত ও মলিন হইয়াছিল বটে, কিন্তু তাহার হাবভাব দেখিয়া তাহাকে তস্কর বলিয়া মনে হয় না। বরং কোনও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি অকারণে অপদস্থ হইলে যেরূপ ভৎসনাপূর্ণ গাম্ভীর্যের ভাব ধারণ করেন, তাহার মুখভাব সেইরূপ। সে একবার শান্ত অথচ অপ্রসন্ননেত্রে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল—এ আমি কোথায় আনীত হইয়াছি জানিতে পারি কি?

কোট্টপাল চোরের ভাবভঙ্গি দেখিয়া উষ্ণ হইয়া উঠিলেন, কঠোরকণ্ঠে বলিলেন—রাজসভায় আনীত হইয়াছ। তুমি রাজকন্যার অশ্ব চুরি করিয়াছিলে সেজন্য তোমার দণ্ড হইবে। এখন কুমারীর কথার উত্তর দাও; তোমার কিছু বলিবার আছে?

চিত্ৰক তেমনই ধীরস্বরে বলিল—আছে। ইহা কি দণ্ডাধিকরণ? বিচারগৃহ?

কোট্টপাল বলিলেন—না। তোমার বিচার যথাসময়ে হইবে। এখন প্রশ্নের উত্তর দাও কী জন্য অশ্ব চুরি করিয়াছিলে?

চিত্ৰক কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে রট্টার মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তারপর গম্ভীরস্বরে বলিল—আমি অশ্ব চুরি করি নাই, রাজকার্যে ঋণ গ্রহণ করিয়াছিলাম মাত্র।

সভাস্থ সকলে স্তম্ভিত হইয়া গেল। চোর বলে কি? কোট্টপাল মহাশয়ের চক্ষু রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল; চোরের এমন ধৃষ্টতা? রট্টার চোখেও সবিস্ময় রোষের বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইয়া উঠিল; তিনি ঈষৎ তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলিলেন—তুমি বিদেশী মনে হইতেছে। তোমার পরিচয় কি?

চিত্রক রাজকুমারীর রোষদৃষ্টির সম্মুখে কিছুমাত্র অবনমিত না হইয়া অকম্পিতস্বরে বলিল—আমি মগধের দৃত, পরমভট্টারক পরমেশ্বর শ্রীমন্মহারাজ স্কন্দগুপ্তের সন্দেশবহ।

সভাস্থ কাহারও মুখে আর কথা রহিল না; সকলে ফ্যালফ্যাল করিয়া ইতিউতি চাহিতে লাগিল। মগধের দূত! স্কন্দগুপ্তের বার্তাবাহক! স্কন্দগুপ্তের নামে হৃৎকম্প উপস্থিত হইত না এমন মানুষ তখন আর্যাবর্তে অল্পই ছিল। সেই স্কন্দগুপ্তের দূতকে চোর বলিয়া বাঁধিয়া রাখা হইয়াছে!

কোট্টপাল মহাশয় হতভম্ব। রাজকুমারী রট্টার চোখে চকিত জিজ্ঞাসা। সুগোপার মুখ শুষ্ক। সকলে চিত্রার্পিতবৎ নিশ্চল।

এই চিত্রার্পিত অবস্থা কতক্ষণ চলিত বলা যায় না; কিন্তু ভাগ্যক্রমে এই সময় রাজ্যের মহাসচিব চতুরানন ভট্ট দেখা দিলেন। চতুরানন বর্ণে ব্রাহ্মণ : চতুর স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি। তৎকালে ভারতভূমিতে বহু ক্ষুদ্র রাজ্যে বহু জাতীয় এবং বহু ধর্মীয় রাজা রাজত্ব করিতেন; উত্তরে শক হূণ ছিল, দক্ষিণে দ্রাবিড় গুর্জর ছিল। কিন্তু মন্ত্রিত্ব করার বেলায় দেখা যাইত একটি ক্ষীণকায় উপবীতধারী ব্রাহ্মণ মন্ত্রীর আসনটি অধিকার করিয়া আছেন।

সচিব চতুরানন সভায় প্রবেশ করিয়া কঞ্চুকী মহাশয়কে সংক্ষেপে দুই চারি প্রশ্ন করিয়া ব্যাপার বুঝিয়া লইলেন। তারপর সভার মধ্যস্থলে গিয়া দাঁড়াইলেন।

প্রথমে হস্ত তুলিয়া রাজকুমারীকে আশীবার্দপূর্বক তিনি বন্দীর দিকে ফিরিলেন। চতুরানন ভট্টের চোখের দৃষ্টি ক্ষিপ্র এবং মসৃণ; কোথাও বাধা পায় না। চিত্রকের আপাদমস্তক নিমেষমধ্যে দেখিয়া লইয়া তিনি আদেশ দিলেন—হস্তবন্ধন খুলিয়া দাও।

এতক্ষণ কে কি করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইতেছিল না, এখন যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। কোট্টপাল মহাশয় স্বয়ং চিত্রকের বন্ধন খুলিয়া দিলেন।

চতুরানন ভট্ট তখন স্মিতমুখে সুমিষ্ট স্বরে চিত্রককে সম্বোধন করিলেন—আপনি মগধের রাজদূত?

চিত্ৰক এই মসৃণ-চক্ষু মুদৃবা প্রৌঢ়কে দেখিয়া মনে মনে সতর্ক হইয়াছিল, বলিল—হাঁ। আপনি?

চতুরানন বলিলেন—আমি এ রাজ্যের সচিব। মহাশয়ের নাম? মহাশয়ের অভিজ্ঞান?

মুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরী তর্জনী হইতে উন্মোচন করিতে করিতে চিত্ৰক তড়িত্বৎ চিন্তা করিল, রাজলিপিতে দূতের নাম কোথাও আছে কি? যতদূর স্মরণ হয়—নাই। সে বলিল–আমার নাম চিত্ৰক বর্মা।

চতুরানন একটু ভ্রূ তুলিলেন—আপনি ক্ষত্রিয়? দৌত্যকার্যে সাধারণত ব্রাহ্মণ নিয়োগই বিধি।

চিত্রক বলিল—হাঁ। এই দেখুন আমার অভিজ্ঞান মুদ্রা।

অভিজ্ঞান দেখিয়া চতুরাননের চক্ষে সম্ভ্রম ফুটিয়া উঠিল। তিনি হস্তদ্বয় পরস্পর ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন—দূত মহাশয়, আপনি স্বাগত। দেখিতেছি উভয় পক্ষেই একটু ভুল হইয়া গিয়াছে। আপনি না বলিয়া অশ্বটি গ্রহণ না করিলেই পারিতেন রাজকুমারীর অশ্ব—

চিত্ৰক স্মিত হাস্য করিয়া রট্টার পানে আয়ত নয়ন ফিরাইল, বলিল—রাজকুমারীর অশ্ব তাহা আমি অনুমান করিতে পারি নাই।

এই বাক্যের মধ্যে কতখানি প্রগতা এবং কতখানি আত্মসমর্থন ছিল তা ঠিক ধরা গেল না, কিন্তু রট্টা চিত্রকের চক্ষু হইতে চক্ষু সরাইয়া লইয়া মনে মনে ভাবিলেন, এই দূতের বাল্পটিমা

আছে বটে, অল্প কথা বলিয়া অনেক কথার ইঙ্গিত করিতে পারে।

চতুরানন বলিলেন—অবশ্য অবশ্য। তারপর গত রাত্রেও যদি আপনি নিজ পরিচয়। দিতেন—

চিত্ৰক বলিল—কাহার কাছে পরিচয় দিব? যামিক রক্ষীর কাছে? তোরণ-প্রতীহারের কাছে?

চতুরানন চিত্রকের মুখের উপর পিচ্ছিল দৃষ্টি বুলাইয়া একটি নিশ্বাস ফেলিলেন—যাক, যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে—নির্বাণ দীপে কিমু তৈলদান। এখন আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু তৎপূর্বে, আপনি যে রাজবাতার বাহক তাহা কোথায়?

চিত্রক বলিল—সম্ভবত আমার থলিতে আছে, যদি না আপনার যামিক-রক্ষীরা ইতিপূর্বে উহা আত্মসাৎ করিয়া থাকে—

যামিক-রক্ষীরা সভার পশ্চাদ্ভাগে উপস্থিত ছিল, তাহারা সবেগে মস্তক আন্দোলন করিয়া এরূপ অবৈধ তস্করবৃত্তির অভিযোগ অস্বীকার করিল। চিত্ৰক তখন থলি খুলিয়া দেখিল, লিপি আছে। সে সযত্নে লিপি-কুণ্ডলী বাহির করিয়া একটু ইতস্তত করিল—রাজলিপি কিন্তু রাজার হস্তে দেওয়াই বিধি।

মন্ত্রী বলিলেন—সে কথা যথার্থ। কিন্তু মহারাজ এখন রাজধানীতে উপস্থিত নাই রাজকন্যাই তাঁহার প্রতিভূ। আপনি দেবদুহিতার হস্তে পত্র দিতে পারেন।

চিত্ৰক তখন দুই পদ অগ্রসর হইয়া যুক্তহস্তে লিপি রাজকুমারীর হস্তে অৰ্পণ করিল।

পত্র লইয়া রট্টা ক্ষণকাল দ্বিধাভরে রহিলেন, তারপর ইষৎ হাসিয়া লিপি কুণ্ডলী মন্ত্রীর হাতে দিলেন। হাসির অর্থ—রাজনীতির বিধি তো পালিত হইয়াছে, এখন যাহার কর্ম সে করুক।

লিপি হস্তে লইয়া মন্ত্রী চতুরানন কিন্তু চমকিয়া উঠিলেন—একি! লিপির জতুমুদ্রা ভগ্ন

দেখিতেছি! তিনি তীক্ষ্ণ সন্দেহে চিত্রকের পানে চাহিলেন।

চিত্রক তরল কৌতুকের কণ্ঠে বলিল—কাল রাত্রে আপনার যামিকরক্ষীরা আমার সহিত কিঞ্চিৎ মল্লযুদ্ধ করিয়াছিল, হয়তো সেই সময় জতুমুদ্রা ভাঙ্গিয়া থাকিবে।

কথাটা অসম্ভব নয়, কিন্তু মন্ত্রীর সংশয় দূর হইল না। তিনি যামিকরক্ষীদের পানে চাহিলেন, যামিক-রক্ষীরা মস্তক অবনত করিয়া স্বীকার করিল, মল্লযুদ্ধ একটা হইয়াছিল বটে।

চিত্ৰক মুখ টিপিয়া হাসিল; বলিল—আমার দৌত্য শেষ হইয়াছে। এবার অনুমতি করুন আমি বিদায় হই।

চতুরানন বলিলেন—সে কি কথা। আপনি মগধের রাজদূত; এতদূর আসিয়াছেন, এখনি ফিরিয়া যাইবেন? ভাল কথা, আপনার সঙ্গী-সাথী কি কেহই নাই?

চিত্ৰক নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—যখন যাত্রা করিয়াছিলাম তখন তিনজন সঙ্গী ছিল, পথে নানা দুর্ঘটনায় তাহাদের হারাইয়াছি—অশ্বও গিয়াছে। এদিকে পথ বড় জটিল ও বিপদসঙ্কুল। যাক, এবার আজ্ঞা দিন। বলিয়া রট্টার দিকে চক্ষু ফিরাইল।

রট্টা কিছু বলিবার পূর্বেই মন্ত্রী বলিয়া উঠিলেন—কিন্তু এখনি আপনার দৌত্য শেষ হয় নাই, আপনি যাইবেন কি প্রকারে? পত্রের উত্তর

চিত্রক দৃঢ়স্বরে বলিল—পত্রের উত্তর সম্বন্ধে আমার কোনও কর্তব্য নাই। আমি শ্ৰীমন্মহারাজের পত্র আপনাদের অর্পণ করিয়াছি, আমার দায়িত্ব শেষ হইয়াছে। বলিয়া অনুমতির অপেক্ষায় আবার রট্টার পানে চাহিল।

এবার রট্টা কথা বলিলেন, ধীর প্রশান্ত স্বরে কহিলেন—দূত মহাশয়, বিটঙ্ক রাজ্যে আসিয়া আপনার কিছু নিগ্রহ ভোগ হইয়াছে। নিগ্রহ অনিচ্ছাকৃত হইলেও আপনি ক্লেশ পাইয়াছেন। কিন্তু অতিথি-নিগ্রহ বিটঙ্ক দেশের স্বভাব নয়। আপনি কিছুদিন রাজ-আতিথ্য স্বীকার করিলে আমরা তৃপ্ত হইব।

চিত্ৰক এতক্ষণ পলায়নের একটা ছিদ্র খুঁজিতেছিল। বিটঙ্ক রাজ্য তাহার পক্ষে নিরাপদ নয়। সে বুঝিয়াছিল, কূটবুদ্ধি মন্ত্রী তাহার দৌত্য সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন নাই। উপরন্তু শশিশেখর যে-কোনও মুহূর্তে আসিয়া হাজির হইতে পারে। এরূপ অবস্থায় যত শীঘ্র এ রাজ্য ত্যাগ করা যায় ততই মঙ্গল। এতক্ষণ চিত্ৰক সেই চেষ্টাই করিতেছিল। কিন্তু এখন রাজকুমারী রট্টার কথা শুনিয়া সহসা তাহার মনের পরিবর্তন হইল। কুমারী রট্টার দিক্-আলোকরা রূপের ছটায়, তাঁহার প্রশান্ত গম্ভীর বাচনভঙ্গিমায় এমন কিছু ছিল যে চিত্রকের মন হইতে পলায়ন-স্পৃহা তিরোহিত হইয়া পৌরুষপূর্ণ হঠকারিতা জাগিয়া উঠিল। সে ভাবিল, বিপদের মুখে পলাইব কেন? দেখাই যাক না, চপলা ভাগ্যদূতী কোন্ পথে লইয়া যায়। জীবনের সকল পথের শেষেই তো মৃত্যু, তবে ভীরুর মত পলাইব কেন?

সে যুক্তকরে শির নমিত করিয়া বলিল—দেবদুহিতার যেরূপ আদেশ।

রট্টার মুখের প্রসন্নতা আরও পরিস্ফুট হইল; তিনি মন্ত্রীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন—আর্য চতুর ভট্ট, দূত মহাশয়ের স্থান ব্যবস্থা করুন।

চতুর ভট্ট এবার একটু বিপন্ন হইলেন। গত পঁচিশ বৎসরে বিটঙ্ক রাজ্যে পররাষ্ট্রের কোনও দূত আসে নাই, তাই রাজ্যে দূতাবাসের কোনও পাকা ব্যবস্থা নাই। কদাচিৎ মিত্ররাজ্য হইতে রাজকীয় অতিথি আসিলে রাজপুরীর মধ্যে কোনও এক ভবনে তাঁহার স্থান হইয়াছে। কিন্তু এই দূতটিকে কোথায় রাখা যায়? মগধের দূতকে ভালভাবেই রাখিতে হয়; নগরের পান্থশালায় স্থান নির্দেশ করা চলে না।…স্কন্দগুপ্তের পত্রে কী আছে তাহা এখনও দেখা হয় নাই; এতদিন পরে মগধ কি বিটঙ্ক রাজ্যের উপর একরা অধিকার দাবি করিতে চায় নাকি?…সে যাহোক পরে দেখা যাইবে, এখন দূতটাকে কোথায় রাখা যায়? দূতের দূতীয়ালিতে কোথায় যেন একটা গলদ রহিয়াছে—বিদায় লইবার জন্য এত ব্যগ্র কেন? উহাকে সহজে দৃষ্টিবহির্ভূত করা হইবে না—

চক্ষু অর্ধ-মুদিত করিয়া চতুর ভট্ট চিন্তা করিলেন; তারপর নিম্নস্বরে কঞ্চুকীর সহিত আলাপ করিলেন। তাঁহার যুগলের বক্রতা অপনীত হইল। তিনি বলিলেন—মগধের রাজদূতের জন্য যথোচিত সম্মানের স্থান নির্দিষ্ট হইবে; রাজপুরীর মধ্যেই তিনি অবস্থান করিবেন। সুবিধা হইয়াছে, মহারাজের সন্নিধাতা হর্ষ মহারাজের সঙ্গে চষ্টন দুর্গে গিয়াছে; হর্ষের স্থান শূন্য আছে। দূত মহোদয় সেইস্থানেই থাকিবেন।

এই ব্যবস্থায় সকলেই সন্তুষ্ট হইলেন। রাজপুরীতে স্থান দিয়া মগধদূতকে সম্মান দেখানো হইল, অপিচ সন্নিধাতার অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট পর্যায়ে স্থান দিয়া অধিক সম্মান দেখানো হইল না। চতুর ভট্ট সুখী হইলেন; দূত রাজপুরীর প্রাকার মধ্যে রহিল, ইচ্ছা করিলেও পলাইতে পারিবে না।

কঞ্চুকীর দিকে ফিরিয়া তিনি বলিলেন—লক্ষ্মণ, তোমার উপর দূত-প্রবরের সেবার ভার রহিল। এখন তাঁহাকে বিশ্রাম মন্দিরে লইয়া যাও। বলিয়া অর্থপূর্ণভাবে কঞ্চুকীর পানে চাহিলেন।

লক্ষ্মণ কঞ্চুকী চতুর ভট্টের মনোগত অভিপ্রায় বুঝিয়াছিল। সে চিত্রকের নিকটে আসিয়া বহু সমাদর সহকারে তাহাকে বিশ্রাম মন্দিরে আহ্বান করিল।

চিত্রক রাজকুমারীকে যুক্তকরে অভিবাদন করিয়া কঞ্চুকীর অনুবর্তন করিতে উদ্যত হইয়াছিল, সহসা একটা কথা স্মরণ হওয়ায় সে ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল—দেবদুহিতাকে একটি সংবাদ জানাইতে ইচ্ছা করি। গত রাত্রে আমি যে অন্ধকূপে বন্দী ছিলাম সেখানে একটি স্ত্রীলোক বন্দিনী আছে।

রট্টা নেত্র বিস্ফারিত করিয়া চাহিলেন—স্ত্রীলোক!

হাঁ। বন্দিনীর নাম পৃথা।

সুগোপা রট্টার পদমূলে বসিয়া শুনিতেছিল, সে চমকিয়া উঠিল—পৃথা!

চিত্ৰক বলিল—হতভাগিনী পঁচিশ বৎসর ঐ কারাকূপে বন্দিনী আছে। যখন প্রথম হূণ অভিযান হয় তখন পৃথা পূর্বতন রাজপুত্রের ধাত্রী ছিল—এক হূণ যোদ্ধা তাহাকে বলাৎকারপূর্বক ঐ স্থানে বন্দিনী করিয়া রাখিয়াছিল—

সুগোপা ছিন্নজ্যা ধনুর ন্যায় উৎক্ষিপ্ত হইয়া চিৎকার করিয়া উঠিল—আমার মা! আমার মা–!

<

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়