এ সম্বন্ধে কর্তব্যনিরূপণের জন্য সে কমলার মুখের দিকে চাহিল। কমলা লইয়া যাইবার জন্য সংকেত করিল। সেই সংকেতের মধ্যে করুণামিশ্রিত গোপন প্রসন্নতা দেখিয়া উমেশ শাকসব্জিগুলি কুড়াইয়া চুপড়ির মধ্যে লইয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল।
রমেশ কহিল, “এ ভারি অন্যায়। ছেলেটাকে তুমি প্রশ্রয় দিয়ো না।”
রমেশ চিঠিপত্র লিখিবার জন্য তাহার কামরায় চলিয়া গেল। কমলা মুখ বাড়াইয়া দেখিল, সেকেণ্ড্ক্লাসের ডেক পারাইয়া জাহাজের হালের দিকে যেখানে তাহাদের দরমা-ঢাকা রান্নার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে সেইখানে উমেশ চুপ করিয়া বসিয়া আছে।
সেকেণ্ড্ক্লাসে যাত্রী কেহ ছিল না। কমলা মাথায় গায়ে একটা র্যাপার জড়াইয়া উমেশের কাছে গিয়া কহিল, “সেগুলো সব ফেলিয়া দিয়াছিস নাকি?”
উমেশ কহিল, “ফেলিতে যাইব কেন? এই ঘরের মধ্যেই সব রাখিয়াছি।”
কমলা রাগিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “কিন্তু তুই ভারি অন্যায় করিয়াছিস। আর কখনো এমন কাজ করিস নে। দেখ্ দেখি স্টীমার যদি চলিয়া যাইত!”
এই বলিয়া ঘরের মধ্যে গিয়া কমলা উদ্ধতস্বরে কহিল, “আন্, বঁটি আন্।”
উমেশ বঁটি আনিয়া দিল। কমলা আগে উমেশের আহৃত তরকারি কুটিতে প্রবৃত্ত হইল।
উমেশ। মা, এই শাকগুলার সঙ্গে সর্ষেবাটা খুব চমৎকার হয়।
কমলা ক্রুদ্ধস্বরে কহিল, “আচ্ছা, তবে সর্ষে বাট্।”
এমনি করিয়া উমেশ যাহাতে প্রশ্রয় না পায়, কমলা সেই সতর্কতা অবলম্বন করিল। বিশেষ গম্ভীরমুখে
তাহার শাক, তাহার তরকারি, তাহার বেগুন কুটিয়া রান্না চড়াইয়া দিল।
হায়, এই গৃহচ্যুত ছেলেটাকে প্রশ্রয় না দিয়াই বা কমলা থাকে কী করিয়া? শাক-চুরির গুরুত্ব যে কতখানি তাহা কমলা ঠিক বোঝে না; কিন্তু নিরাশ্রয় ছেলের নির্ভরলালসা যে কত একান্ত তাহা তো সে বোঝে। ঐ-যে কমলাকে একটুখানি খুশি করিবার জন্য এই লক্ষ্মীছাড়া বালক কাল হইতে এই কয়েকটা শাক-সংগ্রহের অবসর খুঁজিয়া বেড়াইতেছিল। আর-একটু হইলেই স্টীমার হইতে ষ্টি হইয়াছিল, ইহার করুণা কি কমলাকে স্পর্শ না করিয়া থাকিতে পারে?
কমলা কহিল, “উমেশ, তোর জন্যে কালকের সেই দই কিছু বাকি আছে, তোকে আজ আবার দই খাওয়াইব, কিন্তু খবরদার, এমন কাজ আর কখনো করিস নে।”
উমেশ অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া কহিল, “মা, তবে সে দই তুমি কাল খাও নাই?”
কমলা কহিল, “তোর মতো দইয়ের উপর আমার অত লোভ নাই। কিন্তু উমেশ, সব তো হইল, মাছের জোগাড় কি হইবে? মাছ না পাইলে বাবুকে খাইতে দিব কী?”
উমেশ। মাছের জোগাড় করিতে পারি মা, কিন্তু সেটা তো মিনি পয়সায় হইবার জো নাই।
কমলা পুনরায় শাসনকার্যে প্রবৃত্ত হইল। তাহার সুন্দর দুটি ূি কুঞ্চিত করিবার চেষ্টা করিয়া কহিল,
“উমেশ, তোর মতো নির্বোধ আমি তো দেখি নাই। আমি কি তোকে মিনি পয়সায় জিনিস সংগ্রহ করিতে বলিয়াছি?”
নৌকাডুবি ২৭ (৪)
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 181