অক্ষয় সমস্তদিন গোয়ালন্দে ছট্ফট্ করিয়া কাটাইয়া সন্ধ্যার ডাকগাড়িতে উঠিয়া পড়িল। পরদিন ভোরে কলিকাতায় পৌঁছিয়া প্রথমেই সে রমেশের দরজিপাড়ার বাসায় আসিয়া দেখিল, তাহার দ্বার বন্ধ; খবর লইয়া জানিল, সেখান কেহই আসে নাই।
কলুটোলায় আসিয়া দেখিল, রমেশের বাসা শূন্য। অন্নদাবাবুর বাসায় আসিয়া যোগেন্দ্রকে কহিল, “পালাইয়াছে, ধরিতে পারিলাম না।”
যোগেন্দ্র কহিল, “সে কী কথা?”
অক্ষয় তাহার ভ্রমণবৃত্তান্ত বিবৃত করিয়া বলিল।
অক্ষয়কে দেখিতে পাইয়া রমেশ কমলাকে সুদ্ধ লইয়া পালাইয়াছে, এই খবরে রমেশের বিরুদ্ধে যোগেন্দ্রের সমস্ত সন্দেহ নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হইল।
যোগেন্দ্র কহিল, “কিন্তু অক্ষয়, এ-সমস্ত যুক্তি কোনো কাজেই লাগিবে না। শুধু হেমনলিনী কেন, বাবা-সুদ্ধ ঐ এক বুলি ধরিয়াছেন–তিনি বলেন, রমেশের নিজের মুখে শেষ কথা না শুনিয়া তিনি রমেশকে অবিশ্বাস করিতে পারিবেন না। এমন-কি, রমেশ আজও আসিয়া যদি বলে ‘আমি এখন কিছুই বলিব না’, তবু নিশ্চয় বাবা তাহার সঙ্গে হেমের বিবাহ দিতে কুণ্ঠিত হন না। ইহাদের লইয়া আমি এমনি মুশকিলে পড়িয়াছি। বাবা হেমনলিনীর কিছুমাত্র কষ্ট সহ্য করিতে পারেন না; হেম যদি আজ আবদার করিয়া বসে ‘রমেশের অন্য স্ত্রী থাক্–আমি তাহাকেই বিবাহ করিব’, তবে বাবা বোধ হয় তাহাতেই রাজি হন। যেমন করিয়া হউক এবং যত শীঘ্র হউক, রমেশকে দিয়া কবুল করাইতেই হইবে। তোমার হতাশ হইলে চলিবে না। আমিই এ কাজে লাগিতে পারিতাম, কিন্তু কোনোপ্রকার ফন্দি আমার মাথায় আসে না, আমি হয়তো রমেশের সঙ্গে একটা মারামারি বাধাইয়া দিব। এখনো বুঝি তোমার মুখধোওয়া চা-খাওয়া হয় নাই?”
অক্ষয় মুখ ধুইয়া চা খাইতে খাইতে ভাবিতে লাগিল। এমন সময়ে অন্নদাবাবু হেমনলিনীর হাত ধরিয়া চা খাইবার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অক্ষয়কে দেখিবামাত্র হেমনলিনী ফিরিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
যোগেন্দ্র রাগ করিয়া কহিল, “হেমের এ ভারি অন্যায়। বাবা, তুমি উহার এইসকল অভদ্রতায় প্রশ্রয় দিয়ো না। উহাকে জোর করিয়া এখানে আনা উচিত। হেম! হেম!”
হেমনলিনী তখন উপরে চলিয়া গেছে। অক্ষয় কহিল, “যোগেন, তুমি আমার কেস আরো খারাপ করিয়া দিবে দেখিতেছি। উঁহার কাছে আমার সম্বন্ধে কোনো কথাটি কহিয়ো না। সময়ে ইহার প্রতিকার হইবে, জবর্দস্তি করিতে গেলে সব মাটি হইয়া যাইবে।”
এই বলিয়া অক্ষয় চা খাইয়া চলিয়া গেল। অক্ষয়ের ধৈর্যের অভাব ছিল না। যখন সমস্ত লক্ষণ তাহার প্রতিকূলে তখনো সে লাগিয়া থাকিতে জানে। তাহার ভাবেরও কোনো বিকার হয় না। অভিমান করিয়া সে মুখ গম্ভীর করে না বা দূরে চলিয়া যায় না। অনাদর-অবমাননায় সে অবিচলিত থাকে। লোকটা ট্যাঁকসই। তাহার প্রতি যাহার ব্যবহার যেমনি হউক, সে টিঁকিয়া থাকে।
অক্ষয় চলিয়া গেলে আবার অন্নদাবাবু হেমনলিনীকে ধরিয়া চায়ের টেবিলে উপস্থিত করিলেন। আজ তাহার কপোল পাণ্ডুবর্ণ, তাহার চোখের নীচে কালি পড়িয়া গেছে। ঘরে ঢুকিয়া সে চোখ নিচু করিল, যোগেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিতে পারিল না। সে জানিত, যোগেন্দ্র তাহার ও রমেশের উপর রাগ করিয়াছে, তাহাদের বিরুদ্ধে কঠিন বিচার করিতেছে। এইজন্য যোগেন্দ্রের সঙ্গে মুখোমুখি-চোখোচোখি হওয়া তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়া উঠিয়াছে। ভালোবাসায় যদিও হেমনলিনীর বিশ্বাসকে আগলাইয়া রাখিয়াছিল, তবু যুক্তিকে একেবারেই ঠেকাইয়া রাখা চলে না। যোগেন্দ্রের সম্মুখে হেমনলিনী কাল আপনার বিশ্বাসের দৃঢ়তা দেখাইয়া চলিয়া গেল। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে শয়নঘরের মধ্যে একলা সেই বল সম্পূর্ণ থাকে না। বস্তুতই প্রথম হইতেই রমেশের ব্যবহারের কোনো অর্থ পাওয়া যায় না। সন্দেহের কারণগুলিকে হেমনলিনী যত প্রাণপণ বলে তাহার বিশ্বাসের দুর্গের মধ্যে ঢুকিতে দেয় না–তাহারা বাহিরে দাঁড়াইয়া ততই সবলে আঘাত করিতে থাকে। সাংঘাতিক আঘাত হইতে মা যেমন ছেলেকে বুকের মধ্যে দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া রক্ষা করে, রমেশের প্রতি বিশ্বাসকে হেমনলিনী সমস্ত প্রমাণের বিরুদ্ধে তেমনি জোর করিয়া হৃদয়ে আঁকড়িয়া রাখিল। কিন্তু হায়, জোর কি সকল সময় সমান থাকে?
নৌকাডুবি ২২
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 162