নীচে মাটিতে বসিয়া স্লেট-হাতে ছেলেরা মহা কোলাহল করিতে করিতে বিদ্যালাভ করিতেছে। বাড়ির কর্তাটির নাম তারিণী চাটুজ্জে। ভূপেনের কাছে তিনি তন্ন তন্ন করিয়া আমার পরিচয় লইলেন। তাঁবুতে ফিরিয়া আসিতে আসিতে ভূপেন বলিল, ‘ওহে, তোমার কপাল ভালো, তোমার একটা বিবাহের সম্বন্ধ আসিতেছে।’ আমি বলিলাম, ‘সে কী রকম?’ ভূপেন কহিল, ‘ঐ তারিণী চাটুজ্জে লোকটি মহাজনি করে, এতবড়ো কৃপণ জগতে নাই। ঐ-যে ইস্কুলটি বাড়িতে স্থান দিয়াছে, সেজন্য নূতন ম্যাজিস্ট্রেট আসিলেই নিজের লোকহিতৈষিতা লইয়া বিশেষ আড়ম্বর করে। কিন্তু ইস্কুলের পণ্ডিতটাকে কেবলমাত্র বাড়িতে খাইতে দিয়া রাত দশটা পর্যন্ত সুদের হিসাব কষাইয়া লয়, মাইনেটা গবর্মেণ্টের সাহায্য এবং ইস্কুলের বেতন হইতে উঠিয়া যায়। উহার একটি বোনের স্বামীবিয়োগ হইলে পর সে বেচারা কোথাও আশ্রয় না পাইয়া ইহারই কাছে আসে। সে তখন গর্ভিণী ছিল। এখানে আসিয়া একটি কন্যা প্রসব করিয়া নিতান্ত অচিকিৎসাতেই সে মারা যায়। আর একটি বিধবা বোন ঘরকন্নার সমস্ত কাজ করিয়া ঝি রাখিবার খরচ বাঁচাইত, সে এই মেয়েটিকে মায়ের মতো মানুষ করে। মেয়েটি কিছু বড়ো হইতেই তাহারও মৃত্যু হইল। সেই অবধি মামা ও মামীর দাসত্ব করিয়া অহরহ ভর্ৎসনা সহিয়া মেয়েটি বাড়িয়া উঠিতেছে। বিবাহের বয়স যথেষ্ট হইয়াছে, কিন্তু এমন অনাথার পাত্র জুটিবে কোথায়? বিশেষত উহার মা-বাপকে এখানকার কেহ জানিত না, পিতৃহীন অবস্থায় উহার জন্ম ইহা লইয়া পাড়ার ঘোঁট-কর্তারা যথেষ্ট সংশয়প্রকাশ করিয়া থাকেন। তারিণী চাটুজ্জের অগাধ টাকা আছে সকলেই জানে, লোকের ইচ্ছা–এই মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে কন্যা সম্বন্ধে খোঁটা দিয়া উহাকে বেশ একটু দোহন করিয়া লয়। ও তো আজ চার বছর ধরিয়া মেয়েটির বয়স দশ বলিয়া পরিচয় দিয়া আসিতেছে। অতএব, হিসাবমত তার বয়স এখন অন্তত চৌদ্দ হইবে। কিন্তু যাই বল, মেয়েটি নামেও কমলা, সকল বিষয়েই একেবারে লক্ষ্মীর প্রতিমা। এমন সুন্দর মেয়ে আমি তো দেখি নাই। এ গ্রামে বিদেশের কোনো ব্রাহ্মণ যুবক উপস্থিত হইলেই তারিণী তাহাকে বিবাহের জন্য হাতে-পায়ে ধরে। যদি বা কেহ রাজি হয়, গ্রামের লোকে ভাংচি দিয়া তাড়ায়। অতএব এবারে নিশ্চয় তোমার পালা।’ জান তো মা, আমার মনের অবস্থাটা তখন একরকম মরিয়া গোছের ছিল; আমি কিছু চিন্তা না করিয়াই বলিলাম, ‘এ মেয়েটিকে আমিই বিবাহ করিব।’ ইহার পূর্বে আমি স্থির করিয়াছিলাম, একটি হিন্দুঘরের মেয়ে বিবাহ করিয়া আনিয়া আমি তোমাকে চমৎকৃত করিয়া দিব; আমি জানিতাম, বড়ো বয়সের ব্রাহ্মমেয়ে আমাদের এ ঘরে আনিলে তাহাতে সকল পক্ষই অসুখী হইবে। ভূপেন তো একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেল। সে বলিল, ‘কী বল!’ আমি বলিলাম, ‘বলাবলি নয়, আমি একেবারেই মন স্থির করিয়াছি।’ ভূপেন কহিল, ‘পাকা?’ আমি কহিলাম, ‘পাকা’। সেই সন্ধ্যাবেলাতেই স্বয়ং তারিণী চাটুজ্জে আমাদের তাঁবুতে আসিয়া উপস্থিত। ব্রাহ্মণ হাতে পইতা জড়াইয়া জোড়হাত করিয়া কহিলেন, ‘আমাকে উদ্ধার করিতেই হইবে। মেয়েটি স্বচক্ষে দেখুন, যদি পছন্দ না হয় তো অন্য কথা–কিন্তু শত্রুপক্ষের কথা শুনিবেন না।’ আমি বলিলাম, ‘দেখিবার দরকার নাই, দিন স্থির করুন।’ তারিণী কহিলেন, ‘পরশু দিন ভালো আছে, পরশুই হইয়া যাক।’ তাড়াতাড়ির দোহাই দিয়া বিবাহে যথাসাধ্য খরচ বাঁচাইবার ইচ্ছা তাঁহার ছিল। বিবাহ তো হইয়া গেল।”
ক্ষেমংকরী চমকিয়া উঠিয়া কহিলেন, “বিবাহ হইয়া গেল–বল কী নলিন!”
নলিনাক্ষ। হাঁ, হইয়া গেল। বধূ লইয়া নৌকাতেই উঠিলাম। যেদিন বৈকালে উঠিলাম, সেইদিনই ঘণ্টা-দুয়েক বাদে সূর্যাস্তের এক দণ্ড পরে হঠাৎ সেই অকালে ফাল্গুন মাসে কোথা হইতে অত্যন্ত গরম একটা ঘূর্ণিবাতাস আসিয়া এক মুহূর্তে আমাদের নৌকা উল্‌টাইয়া কী করিয়া দিল, কিছু যেন বোঝা গেল না।
ক্ষেমংকরী বলিলেন, “মধুসূদন!” তাঁহার সর্বশরীরে কাঁটা দিয়া উঠিল।

<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর