পূর্বে যখন তাঁহার শরীর ভালো ছিল তখন অন্নদাবাবু ডাক্তারি ও কবিরাজি নানাপ্রকার বটিকাদি সর্বদাই ব্যবহার করিতেন–এখন আর ওষুধ খাইবারও উৎসাহ নাই এবং নিজের অস্বাসথ্য লইয়া আজকাল তিনি আর আলোচনামাত্রও করেন না, বরঞ্চ তাহা গোপন করিতেই চেষ্টা করেন।
আজ তিনি যখন অসময়ে কেদারায় ঘুমাইতেছিলেন তখন সিঁড়িতে পদশব্দ শুনিয়া হেমনলিনী কোল হইতে সেলাইয়ের সামগ্রী নামাইয়া তাহার দাদাকে সতর্ক করিয়া দিবার জন্য দ্বারের কাছে গেল। গিয়া দেখিল, তাহার দাদার সঙ্গে সঙ্গে নলিনাক্ষবাবু আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। তাড়াতাড়ি অন্য ঘরে পালাইবার উপক্রম করিতেই যোগেন্দ্র তাহাকে ডাকিয়া কহিল, “হেম, নলিনাক্ষবাবু আসিয়াছেন, ইঁহার সঙ্গে তোমার পরিচয় করাইয়া দিই।”
হেম থমকিয়া দাঁড়াইল এবং নলিনাক্ষ তাহার সম্মুখে আসিতেই তাহার মুখের দিকে না চাহিয়া নমস্কার করিল। অন্নদাবাবু জাগিয়া উঠিয়া ডাকিলেন, “হেম!” হেম তাঁহার কাছে আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “নলিনাক্ষবাবু আসিয়াছেন।”
যোগেন্দ্রের সহিত নলিনাক্ষ ঘরে প্রবেশ করিতেই অন্নদাবাবু ব্যস্তভাবে অগ্রসর হইয়া নলিনাক্ষকে অভ্যর্থনা করিয়া আনিলেন। কহিলেন, “আজ আমার বড়ো সৌভাগ্য, আপনি আমার বাড়িতে আসিয়াছেন। হেম, কোথায় যাইতেছ মা, এইখানে বোসো। নলিনাক্ষবাবু, এটি আমার কন্যা হেম–আমরা দুজনেই সেদিন আপনার বক্তৃতা শুনিতে গিয়া বড়ো আনন্দলাভ করিয়া আসিয়াছি। আপনি ঐ-যে একটি কথা বলিয়াছেন–আমরা যাহা পাইয়াছি তাহা কখনোই হারাইতে পারি না, যাহা যথার্থ পাই নাই তাহাই হারাই, এ কথাটির অর্থ বড়ো গভীর। কী বলো মা হেম? বাস্তবিক, কোন্‌ জিনিসটিকে যে আমার করিতে পারিয়াছি আর কোন্‌টিকে পারি নাই তাহার পরীক্ষা হয় তখনি যখনি তাহা আমাদের হাতের কাছ হইতে সরিয়া যায়। নলিনাক্ষবাবু, আপনার কাছে আমাদের একটি অনুরোধ আছে। মাঝে মাঝে আপনি আসিয়া যদি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করিয়া যান তবে আমাদের বড়ো উপকার হয়। আমরা বড়ো কোথাও বাহির হই না–আপনি যখনি আসিবেন আমাকে আর আমার মেয়েটিকে এই ঘরেই দেখিতে পাইবেন।”
নলিনাক্ষ আলজ্জিত হেমনলিনীর মুখের দিকে একবার চাহিয়া কহিল, “আমি বক্তৃতাসভায় বড়ো বড়ো কথা বলিয়া আসিয়াছি বলিয়া আপনারা আমাকে মস্ত একটা গম্ভীর লোক মনে করিবেন না। সেদিন ছাত্ররা নিতান্ত ধরিয়া পড়িয়াছিল বলিয়া বক্তৃতা করিতে গিয়াছিলাম–অনুরোধ এড়াইবার ক্ষমতা আমার একেবারেই নাই-কিন্তু এমন করিয়া বলিয়া আসিয়াছি যে, দ্বিতীয় বার অনুরুদ্ধ হইবার আশঙ্কা আমার নাই। ছাত্ররা স্পষ্টই বলিতেছে, আমার বক্তৃতা বারো-আনা বোঝাই যায় নাই। যোগেনবাবু, আপনিও তো সেদিন উপস্থিত ছিলেন-আপনাকে সতৃষ্ণনয়নে ঘড়ির দিকে তাকাইতে দেখিয়া আমার হৃদয় যে বিচলিত হয় নাই, এ কথা মনে করিবেন না।”
যোগেন্দ্র কহিল, “আমি ভালো বুঝিতে পারি নাই সেটা আমার বুদ্ধির দোষ হইতে পারে, সেজন্য আপনি কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ হইবেন না।”
অন্নদা। যোগেন, সব কথা বুঝিবার বয়স সব নয়।
নলিনাক্ষ। সব কথা বুঝিবার দরকারও সব সময়ে দেখি না।
অন্নদা। কিন্তু নলিনবাবু, আপনাকে আমার একটা কথা বলিবার আছে। ঈশ্বর আপনাদিগকে কাজ করাইয়া লইবার জন্য পৃথিবীতে পাঠাইয়াছেন, তাই বলিয়া শরীরকে অবহেলা করিবেন না। যাঁহারা দাতা তাঁহাদের এ কথা সর্বদাই সমরণ করাইতে হয় যে, মূলধন নষ্ট করিয়া ফেলিবেন না, তাহা হইলে দান করিবার শক্তি চলিয়া যাইবে।
নলিনাক্ষ। আপনি যদি আমাকে কখনো ভালো করিয়া জানিবার অবসর পান তবে দেখিবেন, আমি সংসারে কোনো-কিছুকেই অবহেলা করি না। জগতে নিতান্তই ভিক্ষুকের মতো আসিয়াছিলাম, বহুকষ্টে বহুলোকের আনুকূল্যে শরীর-মন অল্পে অল্পে প্রস্তুত হইয়া উঠিয়াছে। আমার পক্ষে এ নবাবি শোভা পায় না যে, আমি কিছুকেই অবহেলা করিয়া নষ্ট করিব। যে ব্যক্তি গড়িতে পারে না সে ব্যক্তি ভাঙিবার অধিকারী তো নয়।

<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর