মুগ্ধ রমেশ ছুতা করিয়া আবার তাহার কাছে গিয়া কহিল, “তোমার খাওয়া হইয়াছে তো কমলা?”
কমলা কহিল, “বেশ, খাওয়া হয় নাই তো কী? কোন্কালে খাইয়াছি।”
রমেশ এ খবর জানিত, তবু এই প্রশ্নের ছলে কমলাকে একটুখানি আদর না জানাইয়া থাকিতে পারিল না; কমলাও রমেশের এই অনাবশ্যক প্রশ্নে যে একটুখানি খুশি হয় নাই তাহা নহে।
রমেশ আবার একটুখানি কথাবার্তার সূত্রপাত করিবার জন্য কহিল, “কমলা, তুমি নিজের হাতে কত করিবে, আমাকে একটু খাটাইয়া লও-না।”
কর্মিষ্ঠ লোকের দোষ এই, অন্য লোকের কর্মপটুতার উপরে তাহাদের বড়ো একটা বিশ্বাস থাকে না। তাহাদের ভয় হয়, যে কাজ তাহারা নিজে না করিবে সেই কাজ অন্য করিলেই পাছে সমস্ত নষ্ট করিয়া দেয়। কমলা হাসিয়া কহিল, “না, এ-সমস্ত কাজ তোমাদের নয়।”
রমেশ কহিল, “পুরুষরা নিতান্তই সহিষ্ণু বলিয়া পুরুষজাতির প্রতি তোমাদের এই অবজ্ঞা আমরা সহ্য করিয়া থাকি, বিদ্রোহ করি না, তোমাদের মতো যদি স্ত্রীলোক হইতাম তবে তুমুল ঝগড়া বাধাইয়া দিতাম। আচ্ছা, খুড়াকে তো তুমি খাটাইতে ত্রুটি কর না, আমি এতই কি অকর্মণ্য?”
কমলা কহিল, “তা জানি না, কিন্তু তুমি রান্নাঘরের ঝুল ঝাড়াইতেছ তাহা মনে করিলেই আমার হাসি পায়। তুমি এখান থেকে সরো, এখানে ভারি ধুলা উড়াইয়াছে।”
রমেশ কমলার সহিত কথা চালাইবার জন্য বলিল, “ধুলা তো লোক-বিচার করে না, ধুলা আমাকেও যে চক্ষে দেখে তোমাকেও সেই চক্ষে দেখে।”
কমলা। আমার কাজ আছে বলিয়া ধুলা সহিতেছি; তোমার কাজ নাই, তুমি কেন ধুলা সহিবে?
রেমেশ ভৃত্যদের কান বাঁচাইয়া মৃদুস্বরে কহিল, ‘কাজ থাক্ বা না থাক্, তুমি যাহা সহ্য করিবে আমি তাহার অংশ লইব।”
কমলার কর্ণমূল একটুখানি লাল হইয়া উঠিল; রমেশের কথার কোনো উত্তর না দিয়া কমলা একটু সরিয়া গিয়া কহিল, “উমেশ, এইখানটায় আর-এক ঘড়া জল ঢাল্ না–দেখছিস নে কত কাদা জমিয়া আছে? ঝাঁটাটা আমার হাতে দে দেখি।”
বলিয়া ঝাঁটা লইয়া খুব বেগে মার্জনকার্যে নিযুক্ত হইল।
রমেশ কমলাকে ঝাঁট দিতে দেখিয়া হঠাৎ অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “আহা কমলা, ও কী করিতেছ?”
পিছন হইতে শুনিতে পাইল, “কেন রমেশবাবু, অন্যায় কাজটা কী হইতেছে? এ দিকে ইংরাজি পড়িয়া আপনারা মুখে সাম্য প্রচার করেন; ঝাঁট দেওয়া কাজটা যদি এত হেয় মনে হয় তবে চাকরের হাতেই বা ঝাঁটা দেন কেন? আমি মুর্খ, আমার কথা যদি জিজ্ঞাসা করেন, সতী মায়ের হাতের ঐ ঝাঁটার প্রত্যেক কাঠি সূর্যের রশ্মিচ্ছটার মতো আমার কাছে উজ্জ্বল ঠেকে। মা, তোমার জঙ্গল আমি একরকম প্রায় শেষ করিয়া আসিলাম, কোন্খানে তরকারির খেত করিবে আমাকে এক বার দেখাইয়া দিতে হইবে।”
কমলা কহিল, “খুড়ামশায়, একটুখানি সবুর করো, আমার এ ঘর সারা হইল বলিয়া।” এই বলিয়া কমলা ঘর-পরিষ্কার শেষ করিয়া কোমরে-জড়ানো আঁচল মাথায় তুলিয়া বাহিরে আসিয়া খুড়ার সহিত তরকারির খেত লইয়া গভীর আলোচনায় প্রবৃত্ত হইল।
এমনি করিয়া দেখিতে দেখিতে দিন শেষ হইয়া গেল, কিন্তু ঘর-গোছানো এখনো ঠিকমত হইয়া উঠিল না। বাংলাঘর অনেকদিন অব্যবহৃত ও রুদ্ধ ছিল, আরো দুই-চারি দিন ঘরগুলি ধোওয়া-মাজা করিয়া জানালা-দরজা খুলিয়া না রাখিলে তাহা বাসযোগ্য হইবে না দেখা গেল।
কাজেই আবার আজ সন্ধ্যার পরে খুড়ার বাড়িতেই আশ্রয় লইতে হইল। আজ তাহাতে রমেশের মনটা কিছু দমিয়া গেল। আজ তাহাদের নিজের নিভৃত ঘরটিতে সন্ধ্যাপ্রদীপটি জ্বলিবে এবং কলমার সলজ্জ সিমতহাস্যটির সম্মুখে রমেশ আপনার পরিপূর্ণ হৃদয় নিবেদন করিয়া দিবে, ইহা সে সমস্ত দিন থাকিয়া থাকিয়া কল্পনা করিতেছিল। আরো দুই-চারি দিন বিলম্বের সম্ভাবনা দেখিয়া রমেশ তাহার আদালত-প্রবেশ-সম্বন্ধীয় কাজে পরদিন এলাহাবাদে চলিয়া গেল।
নৌকাডুবি ৩৪ (২)
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 181