আজ কমলার রাত্রের রন্ধনব্যাপার তেমন বেশি নহে। সকালের অনেক তরকারি এ বেলা কাজে লাগিবে। এমন সময় রমেশ আসিয়া কহিল, মধ্যাহ্নে আজ গুরুভোজন হইয়াছে, এ বেলা সে আহার করিবে না।
কমলা বিমর্ষ হইয়া কহিল, “কিছু খাইবে না? শুধু কেবল মাছ-ভাজা দিয়া–”
রমেশ সংক্ষেপে কহিল, “না, মাছ-ভাজা থাক্‌।” বলিয়া চলিয়া গেল।
কমলা তখন উমেশের পাতে সমস্ত মাছ-ভাজা ও চচ্চড়ি উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিল। উমেশ কহিল, “তোমার জন্য কিছু রাখিলে না?”
সে কহিল, “আমার খাওয়া হইয়া গেছে।”
এইরূপে কমলার এই ভাসমান ক্ষুদ্র সংসারের একদিনের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন হইয়া গেল।
জো্যাৎসনা তখন জলে স্থলে ফুটিয়া উঠিয়াছে। তীরে গ্রাম নাই, ধানের খেতের ঘন-কোমল সুবিস্তীর্ণ সবুজ জনশূন্যতার উপরে নিঃশব্দ শুরিত্রি বিরহিণীর মতো জাগিয়া রহিয়াছে।
তীরে টিনের-ছাদ-দেওয়া যে ক্ষুদ্র কুটিরে স্টীমার-আপিস সেইখানে একটি শীর্ণদেহ কেরানি টুলের উপরে বসিয়া ডেস্কের উপর ছোটো কেরোসিনের বাতি লইয়া খাতা লিখিতেছিল। খোলা দরজার ভিতর দিয়া রমেশ সেই কেরানিটিকে দেখিতে পাইতেছিল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রমেশ ভাবিতেছিল, ‘আমার ভাগ্য যদি আমাকে ঐ কেরানিটির মতো একটি সংকীর্ণ অথচ সুস্পষ্ট জীবনযাত্রার মধ্যে বাঁধিয়া দিত–হিসাব লিখিতাম, কাজ করিতাম, কাজে ত্রুটি হইলে প্রভুর বকুনি খাইতাম, কাজ সারিয়া রাত্রে বাসায় যাইতাম–তবে আমি বাঁচিতাম, আমি বাঁচিতাম।’
ক্রমে আপিস-ঘরের আলো নিবিয়া গেল। কেরানি ঘরে তালা বন্ধ করিয়া হিমের ভয়ে মাথায় র‌্যাপার মুড়ি দিয়া নির্জন শস্যক্ষেত্রের মাঝখান দিয়া ধীরে ধীরে কোন্‌ দিকে চলিয়া গেল, আর দেখা গেল না।
কমলা যে অনেকক্ষণ ধরিয়া চুপ করিয়া জাহাজের রেল ধরিয়া পশ্চাতে দাঁড়াইয়া ছিল, রমেশ তাহা জানিতে পারে নাই। কমলা মনে করিয়াছিল, সন্ধ্যাবেলায় রমেশ তাহাকে ডাকিয়া লইবে। এইজন্য কাজকর্ম সারিয়া যখন দেখিল রমেশ তাহার খোঁজ লইতে আসিল না, তখন সে আপনি ধীরপদে জাহাজের ছাদে আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু তাহাকে হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইতে হইল, সে রমেশের কাছে যাইতে পারিল না। চাঁদের আলো রমেশের মুখের উপরে পড়িয়াছিল–সে মুখ যেন দূরে, বহুদূরে; কমলার সহিত তাহার সংস্রব নাই। ধ্যানমগ্ন রমেশ এবং এই সঙ্গিবিহীনা বালিকার মাঝখানে যেন জ্যোৎস্না-উত্তরীয়ের দ্বারা আপাদমস্তক আচ্ছন্ন একটি বিরাট রাত্রি ওষ্ঠাধরের উপর তর্জনী রাখিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া পাহারা দিতেছে।
রমেশ যখন দুই হাতের মধ্যে মুখ ঢাকিয়া টেবিলের উপরে মুখ রাখিল তখন কমলা ধীরে ধীরে তাহার কামরার দিকে গেল। পায়ের শব্দ করিল না, পাছে রমেশ টের পায় যে কমলা তাহার সন্ধান লইতে আসিয়াছিল।
কিন্তু তাহার শুইবার কামরা নির্জন, অন্ধকার–প্রবেশ করিয়া তাহার বুকের ভিতর কাঁপিয়া উঠিল, নিজেকে একান্তই পরিত্যক্ত এবং একাকিনী বলিয়া মনে হইল; সেই ক্ষুদ্র কাঠের ঘরটা একটা কোনো নিষ্ঠুর অপরিচিত জন্তুর হাঁ-করা মুখের মতো তাহার কাছে আপনার অন্ধকার মেলিয়া দিল। কোথায় সে যাইবে? কোন্‌খানে আপনার ক্ষুদ্র শরীরটি পাতিয়া দিয়া সে চোখ বুজিয়া বলিতে পারিবে ‘এই আমার আপনার স্থান?’
ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়াই কমলা আবার বাহিরে আসিল। বাহিরে আসিবার সময় রমেশের ছাতাটা টিনের তোরঙ্গের উপর পড়িয়া গিয়া একটা শব্দ হইল। সেই শব্দে চকিত হইয়া রমেশ মুখ তুলিল এবং চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দেখিল, কমলা তাহার শুইবার কামরার সামনে দাঁড়াইয়া আছে। কহিল, “একি কমলা! আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি এতক্ষণে শুইয়াছ। তোমার কি ভয় করিতেছে নাকি? আচ্ছা, আমি আর বাহিরে বসিব না-আমি এই পাশের ঘরেই শুইতে গেলাম, মাঝের দরজাটি বরঞ্চ খুলিয়া রাখিতেছি।”

<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর