বাদশা আমানুল্লাহর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ। না হলে আফগানিস্তানের মত বিদকুটে গোড়া দেশে বল-ডান্সের ব্যবস্থা করতে যাবেন কেন? স্বাধীনতা দিবসে পাগমান শহরে আফগানিস্তানের প্রথম বল-ডান্স হবে।

আমরা যারা বিদেশী তারা এ নিয়ে খুব উত্তেজিত হইনি। উত্তেজনাটা মোল্লাদের এবং তাদের চেলা অর্থাৎ ভিশতি, দর্জী, মুদী, চাকর-বাকরদের ভিতর।

আমার ভৃত্য আবদুর রহমান সকাল বেলা চা দেবার সময় বিড়বিড় করে বললে, ‘জাত ধম্মো আর কিছু রইল না।’

আবদুর রহমানের কথায় আমি বড় একটা কান দিই নে। আমি শ্রীকৃষ্ণ নই; জাত ধম্মো বাঁচাবার ভার আমার স্কন্ধে নয়।

‘ধেঁড়ে ধেঁড়ে হুনোরা ডপকি ডপকি মেনিদের গলা জড়িয়ে ধেই ধেই করে নৃত্য করবে।’

আমি শুধালুম, ‘কোথায়? সিনেমায়?’

আর আবদুর রহমানকে পায় কে? সে তখন সেই হবু ডান্সের যা একখানা সরেস রগরগে বয়ান ছাড়লে, তার সামনে রোমান কুকর্ম কুকীর্তি শিশু। শেষটায় বললে, “রাত বারোটার সময় সমস্ত আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়। আর তারপর কি হয় দেব আমি জানি নে হুজুর।”

আমি বললুম, তোমার তাতে কি, ভেটকি-লোচন?

আবদুর রহমান চুপ করে গেল।‘ভেটকি লোচন’, ‘ওরে আমার আহ্লাদের ফুটো ঘটি’ এসব বললেই আবদুর রহমান বুঝতে পারত বাবু বদমেজাজে আছেন। এগুলো আমি মাতৃভাষা বাঙলাতেই বলতুম। আবদুর রহমান ঝাণ্ডু লোক; বাঙলা না বুঝেও বুঝত।

ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় সন্ধ্যার সময় বেরিয়েছি। পাগমানের ঝোপে ঝাপে হেথা হোথা বিজলী বাতি জ্বলছে। পরিষ্কার তকতকে ঝকঝকে পিচ-ঢালা রাস্তা। আমি আপন মনে ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি, এটা হল ভাদ্দোর মাস। কাল জন্মাষ্টমী গেছে। আমার জন্মদিন। মার মুখে শোনা। এখন সিলেটে নিশ্চয়ই জোর বৃষ্টি হচ্ছে। মা দক্ষিণের ঘরের উত্তরের বারান্দায় মোড়ার উপর বসে আছে। তার কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে চম্পা তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর হয়তো বা জিজ্ঞেস করছে, ‘ছোঁট মিয়া ফিরবে কবে?’

বিদেশে বর্ষাকাল আমার কাল। কাবুল কান্দাহার জেরুজালেম বার্লিন কোথাও মনসূন নেই। ভাদ্দোর মাসের পচা বিষ্টিতে মা অস্থির। তার নাইবার শাড়ি শুকোচ্ছে না, ভিজে কাঠের ধূয়োয় তিনি পাগল, আর আমি দেখছি হুড়মুড় করে বৃষ্টি নেমে আসছে, খানিকক্ষণ পরে আবার রোদ। আঙ্গিনার গোলাপ গাছে, রান্নাঘরের কোণে শিউলি গাছে, পিছনের চাউর গাছের পাতায় পাতায় খুশীর ঝিলিমিলি।

এখানে সে শ্যামল-সুন্দরের দর্শন নেই।

সর্বনাশ! পথ হারিয়ে বসেছি। রাত ন’টা। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। কাকে পথ শুধোই! ডান দিকে ঢাউস ইমারতে নাচের ব্যাণ্ডো বাজছে।

ওঃ! এটা তা হলে আমার ভৃত্য আবদুর রহমান খান বর্ণিত সেই ডান্স হল। এ বাড়ির খানসাম-বেয়ারা তা হলে আমাকে হোটেলের পথটা বাৎলে দিতে পারবে। পিছনের চাকর-বাকরদের দরজার কাছে যাই।

গেলুম।

এমন সময় গটগট করে বেরিয়ে এলেন এক তরুণী।

প্রথম দেখেছিলুম কপালটি। যেন তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র। শুধু, চাদ হয় চাপা বর্ণের, এর কপালটি একদম পাগমান পাহাড়ের বরফের মতই ধবধবে সাদা। সেটি আপনি দেখেন নি? অতএব বলব নির্জলা দুধের মত। সেও তো আপনি দেখেন নি। তা হলে বলি বন-মল্লিকার পাপড়ির মত। ওর ভেজাল এখনো হয় নি।

নাকটি যেন ছোট বাঁশী। ওইটুকুন বাঁশীতে কি করে দুটো ফুটো হয় জানি নে। নাকের ডগা আবার অল্প অল্প কাঁপছে। গাল দুটি কাবুলেরই পাকা আপেলের মত লাল টুকটুকে, তবে তাতে এমন একটা শেড রয়েছে যার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় এটা রুজ দিয়ে তৈরী নয়। চোখ দুটিনল না সবুজ বুঝতে পারলুম না। পরণে উত্তম কাটের গাউন। জুতো উচু হিলের।

রাজেশ্বরী কণ্ঠে হুকুম ঝাড়লে, ‘সর্দার আওরঙ্গজেব খানের মোটর এদিকে ডাক তো’।

আমি থতমত খেয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলুম।

মেয়েটি ততক্ষণে আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে আমি হোটেলের চাকর নই। তারপর বুঝেছে, আমি বিদেশী। প্রথমটায় ফরাসীতে বললে, ‘জ্য ভূ দমাঁদ পারদো, মঁসিয়ে—মাফ করবেন—’ তারপর বললে ফার্সীতে।

আমি আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফার্সীতেই বললুম, ‘আমি দেখছি।’

সে বললে, ‘চলুন।’

বেশ সপ্রতিভ মেয়ে। বয়স এই আঠারো ঊনিশ।

পার্কিঙের জায়গায় পৌঁছনর পূর্বে বললে, “না, আমাদের গাড়ি নেই।”

আমি বললুম, ‘দেখি, অন্য কোন গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি কি না।’

নাসিকাটি ইঞ্চি খানেক উপরের দিকে তুলে মুখ বেঁকিয়ে অত্যন্ত গাঁইয়া ফার্সীতে বললে, ‘সব ব্যাটা আনাচে কানাচে দাড়িয়ে বেলেল্লাপনা দেখছে। ড্রাইভার পাবেন কোথায়?’

আমার মুখ থেকে অজানতে বেরিয়ে গেল ‘কিসের বেলেল্লাপনা?’

মেয়েটি ঘুরে আমার দিকে মুখোমুখি হয়ে এক লহমায় আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত মেপে নিলে। তারপর বলল, ‘আপনার কোনো তাড়া না থাকলে চলুন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন।’

আমি ‘নিশ্চয় নিশ্চয়’ বলে সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ালাম।

মেয়েটি সত্যি ভারি চটপটে।

চট করে শুধালে, আপনি এদেশে কতদিন আছেন?-পারদোঁ—আমার ফ্রেঞ্চ প্রফেসর বলেছেন, অজানা লোককে প্রশ্ন শুধাতে নেই।

আমি বললুম, ‘আমারও তাই। কিন্তু আমি মানি নে।’

বোঁ করে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হয়ে বললে, ‘একজাকৎমা’—একদম খাঁটি কথা। আপনার সঙ্গে চলছি, কিংবা মনে করুন আমার আব্বাজান আপনার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন, আর আপনি আমায় কোনো প্রশ্ন শুধালেন না, যেন আমি সাপ ব্যাঙ কিছুই নই, আমিও শুধালুম না, যেন আপনার বাড়ি নেই, দেশ নেই। আমাদের দেশে তো জিজ্ঞাসাবাদ না করাটাই সখৎ বেয়াদবী।

আমি বললুম, ‘আমার দেশেও তাই।’

ঝপ করে জিজ্ঞেস করে বসলে, কোন দেশ?

আমি বললুম, ‘আমাকে দেখেই তো চেনা যায় আমি হিন্দুস্থানী।’

বললে, ‘বা রে! হিন্দুস্থানীরা তো ফ্রেঞ্চ বলতে পারে না!’

আমি বললুম, কাবুলীরা বুঝি ফ্রেঞ্চ বলে!

মেয়েটা খিলখিল করে হাসতে গিয়ে হঠাৎ যেন পা মচকে বসল। বললে, ‘আমি আর হাঁটতে পারছি নে। উঁচু-হিল জুতো পরা আমার অভ্যাস নেই। চলুন, ওই পাশের টেনিস কোর্টে যাই। সেখানে বেঞ্চি আছে।’

জমজমাট অন্ধকার। ওই দূরে, সেই দূরে বিজলি-বাতি। সামান্য এক ফালি পথ দিয়ে টেনিস কোর্টের দিকে এগুতে হল। একটু অসাবধান হওয়ায় তার বাহুতে আমার বাহু ঠেকে যাওয়াতে আমি বললুম, ‘পারদোঁ-মাফ করুন।’

মেয়েটির হাসির অন্ত নেই। বললে, ‘আপনার ফ্রেঞ্চ অদ্ভুত, আপনার ফার্সীও অদ্ভুত।’

আমার বয়স কম লাগল। বললুম, ‘মাদমোয়াজেল-’

‘আমার নাম শব্‌নম।’

তদ্দণ্ডেই আমার দুঃখ কেটে গেল। এ রকম মিষ্টি নামওয়ালী মেয়ে যা-খুশী বলার হক্ক ধরে।

বেঞ্চিতে বসে হেলান দিয়ে পা দুখানা একেবারে হিন্দুকুশ পাহাড় ছাড়িয়ে কাতাখান-বদখশান্ অবধি লম্বা করে দিয়ে বাঁ পা দিয়ে হুটুস করে ডান জুতো এক সাথে তাশকব্দ অবধি লম্বা ছুড়ে মেরে বললে, ‘বাঁচলুম।’

আমি বললুম, ‘আমার উচ্চারণ খারাপ সে আমি জানি। কিন্তু ওটা বলে মানুষকে দুঃখ দেন কেন?’

চড়াকসে একদম খাড়া হয়ে বসে, মোড় নিয়ে মুখোমুখি হয়ে বললে, ‘আশ্চর্য! কে বললে, আপনার উচ্চারণ খারাপ! আমি বলেছি ‘অদ্ভুত।’ অদ্ভুত মানে খারাপ? আপনার ফার্সী উচ্চারণে কেমন যেন পুরনো আতরের গন্ধ। দাঁড়ান, বলছি। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ঠাকুরমা সিন্দুক খুললে যে রকম পুরনো দিনের জমানো মিষ্টি গন্ধ বেরোয়। অন্য হিন্দুস্থানীরা কি রকম যেন ভোঁতা ভোঁতা ফার্সী বলে।

আমি বললুম, ‘ওরা তো সব পাঞ্জাবী। আমি বাঙলাদেশের লোক।’

এবারে মেয়েটি প্রথমটায় একেবারে বাক্যহারা। তারপর বললে, ‘বা-ঙ্গা-লা মুল্লুক! সেখানে তো শুনেছি পৃথিবীর শেষ। তার পর নাকি এক বিরাট অতল গর্ত। যতদূর দেখা যায়, কিছু নেই, কিছু নেই। সেখানে তাই রেলিঙ লাগানো আছে। পাছে কেউ পড়ে যায়। বাঙালীরাও নাকি তাই বাড়ি থেকে বেরয় না।’

আমি জানতুম, ভারতবর্ষে যেসব কাবুলী যায় তারা বাংলাদেশের পরে বড় কোথাও একটা যায় নি। এ সব গল্প নিশ্চয়ই তারা ছড়িয়েছে। আমি হেসে বললাম, “কি বললেন? বাঙালীরা তাই বাড়ি থেকে বেরয় না? যেমন আমি। না?”

এই প্রথম মেয়েটি একটু কাতর হল। বললে, “দেখুন, মঁসিয়ো-?”

আমি বললুম, আমার নাম মজনূন।

‘মজনূন!!!’

আমি বললাম, “হ্যাঁ।”

‘মজনূন মানে তো পাগল। জিন্ যখন কারো কাঁধে চাপে তখন ‘জিন’ শব্দের পাসট পার্টিসিপল মজনূঁন দিয়েই তো পাগল বোঝানো হয়। এ নাম আপনাকে দিলে কে?’

আমি বললুম, আমার বাবার মুরশীদ। দেখুন শব্‌নম বানু, সকলেরই কি আপনার মত মিষ্টি নাম হয়! শব্‌নম মানে তো শিশিরবিন্দু, হিমকণা?

‘খুব ভোরে আমার জন্ম হয়েছিল।’

আমি গুন গুন করে বললুম,

“আমি তব সাথী
হে শেফালি, শরৎ-নিশির স্বপ্ন, শিশির সিঞ্চিত
প্রভাতের বিচ্ছেদ বেদনা।”

‘বুঝিয়ে বলুন।’

আমি বললুম, আমাদের দেশে এক রকম ফুল হয় তার নাম শিউলি। কবি বলেছেন, শরৎ-নিশি সমস্ত রাত স্বপ্ন দেখেছে শিউলি ফোঁটাবার—আর ভোর হতেই গাছকে বিচ্ছেদ বেদনা দিয়ে ঝরে পড়ল সেই শিউলি।

শব্‌নমের কবিত্ব রস আছে। বললে, ‘চমৎকার! একটি ফুল সমস্ত রাতের স্বপ্ন। আচ্ছা, আমার নাম যদি শব্‌নম শিউলি হয় তো কি রকম শোনায়?’

আমি বললুম সে আপনি ধারণাই করতে পারবেন না, বাঙালীর কানে কতখানি মিষ্টি শোনায়।

হেসে বললে, ‘ফুল সম্বন্ধে কবি কিসাঈ কি বলেছেন জানেন?’

‘আমি হাফিজ, সাদী আর অল্প রুমী পড়েছি মাত্র।’

তবে শুনুন,

“গুল নিমতীস্ত হিদয় ফিরিস্তাদে আজ বেহেশৎ,
মরদুম করীমতর শওদ আন্দর নইম-ই গুল;
আয় গুল-ফরূশ গুল চি ফরাশী বরায়ে সীম?
ওমা আজ গুল অতীজতর চি সিতানী বি-সীম-ই-গুল?”

‘অমরাবতীর সঙ্গত এই ফুল এল ধরাতলে,
ফুলের পুণ্যে পাপী-তাপী লাগি স্বরগের দ্বার খোলে।
ওগো ফুলওয়ালী, কেন ফুল বেচো তুচ্ছ রুপার দরে?
প্রিয়তমা তুমি কি কিনিবে, বলো, রুপো দিয়ে তার তরে?’

আমি বললুম, ‘অদ্ভুত সুন্দর কবিতা। এটি আমার বাঙালাতে অনুবাদ করতে হবে।’

আপনি বুঝি ছন্দ গাঁথতে জানেন?

আমি বললুম, ‘সর্বনাশ। আমি মাস্টারি করি।’

‘সে আমি জানি। এদেশে দুরকমের ভারতীয় আসে। হয় ব্যবসা বাণিজ্য করতে, না হয় পড়াতে। তবে আপনাকে এর পূর্বে আমি কখনো দেখি নি। আচ্ছা, বলুন তো, আমানউল্লা বাদশার সব রকম সংস্কারকর্ম আপনার কি রকম লাগে?’

‘আমার লাগা না-লাগাতে কি? আমি তো বিদেশী।’

‘বিদেশী হলেও প্রতিবেশী তো। আমি ফ্রান্স থেকে ফেরার সময়-’

আমি অবাক হয়ে শুধালুমম, ‘ফ্রান্স থেকে-?’

‘ইংরেজের কল্যাণে বাবাকে নির্বাসনে যেতে হয়। আমার জন্য প্যারিসে। সেখানে দশ বছর আর এখানে ন’বছর কাটিয়েছি। যাকগে সে-কথা। দেশে ফেরার সময় বোম্বাই পেশাওয়ার হয়ে আসি। দাঁড়ান, ভেবে বলছি। ঠিক এই আগষ্টেই আমরা এসেছিলুম। সে কী বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি! বোম্বাই থেকে লাহোর পর্যন্ত। ঝপঝপ ঝুপঝাপ। গাড়ির শব্দের সঙ্গে মিলে গিয়ে চমৎকার শোনায়। তা সে যাকগে। কিন্তু ওই বোম্বাই থেকে এই পেশাওয়ার-এর সঙ্গে তো ফ্রান্সের কোনো মিল নেই। মিল আফগানিস্থানের সঙ্গে। দুটোই সুন্দর দেশ। আর ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ইরানী কবি কি বলেছেন, জানেন?

‘হাফিজ যেন কি বলেছেন?’

না। আলীকুলী সলীম বলেছেন:

“নীস্ত দর ইরান জমীন সামান-ইতহসীল কামাল
তা নিয়ামদ হিন্দুস্তান হিনা রঙ্গীন ন শুদ।”
“পরিপূর্ণতা পাবে তুমি কোথা ইরান দেশের ভূয়ে
মেহদির পাতা কড়া লাল হয় ভারতের মাটি খুঁয়ে।”

আমি শুধলুম, এদেশের হেনাতে কি কড়া রঙ হয় না?

বাজে। ফিকে। হলদে।

আমি বললাম, আপনি কথায় কথায় এত কবিতা বলতে পারেন কি করে?

হেসে বললে, বাবা আওড়ান। আর ন দশ বছরেও আমার আত্মসম্মান জ্ঞানটি ছিল অত্যুগ্র। প্যারিসে ক্লাসে ফারসী কবিতা কেউ আওড়ালে আমি সঙ্গে সঙ্গে ফার্সী শুনিয়ে দিতুম।

তারপর বললে, ‘বড় রাস্তায় তো জন-মানব নেই। শুধু মনে হচ্ছে একখানা মোটর বার বার আসা-যাওয়া করছে। নয় কি? আপনি লক্ষ্য করেছেন?’

আমি বললাম, “বোধ হয় তাই।”

বললে, ‘তবে আমাকে বলেন নি কেন?’

আমি এক-মাথা লজ্জা পেয়ে বললুম, ‘আমার ভালো লাগছিল বলে।’

মেয়েটি চুপ করে রইল।

আমি শুধালাম, ওটা কি আপনাদের গাড়ি? আপনাকে খুঁজছে?

‘উঁ।’

তবে চলুন।

না।

‘আচ্ছা। কিন্তু আপনার বাড়ির লোক আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করবেন না?’

‘তবে চলুন।’ উঠে দাঁড়াল।

আমি বললুম, শব্‌নম বানু আমাকে ভুল বুঝবেন না।

‘তওবা! আপনাকে ভুল বুঝব কেন?’

রাস্তায় যেতে যেতে বেশ কিছু পরে সেই কথার যেই ধরে বলল, বিদেশীর সঙ্গে আলাপ করতে ওই তো আনন্দ। তার সম্বন্ধে কিছু জানি নে। সেও কিছু জানে না। সেই যে কবিতা আছে,

“মা আজ আগাজ ওয়া আনজামে জাহান কেরীম
আওওল ও আখিরুই-ঈন তূহনে কিতাব ইফতালে অসৎ।”

“গোড়া আর শেষ এই সৃষ্টির জানা আছে, বলো, কার?
প্রাচীন এ পুঁথি গোড়া আর শেষে পাতা কটি ঝরা তার।”

এমন সময় সেই জ্বলজ্বলে আলোও পোড়ামুখো মোটর এসে সামনে দাঁড়াল। শব্‌নম বানু বললে, ‘চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দি।’

এতক্ষণ দুজনাতে বেশ কথাবার্তা হচ্ছিল। এখন ওই ড্রাইভারের সামনে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলুম। প্যারিস থেকে এসে থাক, আর খাস কাবুললীই হোক, এরা যে কট্টর গোড়া সে কি কারো অজানা? বললুম, ‘থাক। আমার হোটেল কাছেই।’

শব্‌নম বানু বুদ্ধিমতী। বললে, ‘বেশ। তবে, দেখুন আগা, আপনি কোনো কারণে কণামাত্র সঙ্কোচ করবেন না। আমি কাউকে পরোয়া করি না।’

পরোয়া শব্দটি আসলে ফার্সী। শব্‌নম ওই শব্দটিই ব্যবহার করেছিল।

‘আদাব আরজ।’

‘খুদা হাফিজ।’

হোটেলে ঢোকবার সময় পিছনে শব্দ হওয়াতে তাকিয়ে দেখি আবদুর রহমান। নিজের থেকেই বলল, একটু বেড়াতে গিয়েছিলুম।

আমি তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলুম ইনি একটি হস্তীমূর্খ না মর্কটচুড়ামণি?

সমস্ত রাত ঘুম এল না।

জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আদম-সুরৎ-কালপুরুষ। অতি প্রসন্ন বদনে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আকাশের পরিপূর্ণ শান্তি যেন তার অঙ্গের প্রতিটি তারায় সঞ্চিত করে আমার দিকে বিচ্ছুরিত করে পাঠাচ্ছেন।

একটি ফার্সী কবিতা মনে পড়ল।

ইরানের এক সভাকবি নাকি চাড়ালদের সঙ্গে বসে ভাড়ে করে মদ্যপান করেছিলেন। রাজা তাই নিয়ে অনুযোগ করাতে তিনি বলেছিলেন,

“হাজার যোজন নিচেতে নামিয়া আকাশের ওই তারা।
গোপদে হল প্রতিবিম্বিত; তাই হল মানহারা?”

শেষরাত্রে কালো মেঘ এসে আকাশের তারা একটি একটি করে নিবিয়ে দিতে লাগল। আমার মন অজানা অস্বস্তিতে ভরে উঠতে লাগল। বিবেকানন্দ ইংরিজী কবিতায় লিখেছিলেন ‘দি স্টার আর ব্লটেড আউট।’ সত্যেন দত্ত অনুবাদ করেছেন নিঃশেষে নিবেছে তারাদল। কেমন যেন, কি হবে একটা ভাব মনকে আচ্ছন্ন করে দিল।

শেষরাত্রে নামল খাঁটি সিলেটি বৃষ্টি।

প্রসন্নাস্ত, প্রসন্নাস্ত আমার অদ্য সন্ধ্যার সবিতার!

খুদাতালা বেহদ মেহেরবান। আমার শেষ মনস্কামনা পূর্ণ করে দিলেন। কী মূর্খ আমি! আমার প্রত্যাশা যে করুণাময়ের অফুরন্ত দান ছাড়িয়ে যেতে পারে, এ-দম্ভ আমি করেছিলুম কোন্ গবেটামিতে?

<

Syed Mujtaba Ali ।। সৈয়দ মুজতবা আলী