এবার আমাদের সকলের দৃষ্টি গেল সন্ন্যাসীর দিকে। তাঁর এখনও কেমন যেন মুহ্যমান ভাব। হিন্দিতে বললেন, পিস্তলের শব্দ শুনে মনটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল—কিছু মনে করবেন না।

ফেলুদাও হিন্দিতে বলল, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার কাছে যে থলিটি আছে, সেটি একবার বার করা দরকার। আমরা আপনার বন্ধু, সেটা বোধহয় বুঝতেই পারছেন। ওটা আপনার গুহার মধ্যেই আছে তো?

আর কোথায় থাকবে? ওই তো আমার একমাত্র সম্পত্তি!

একজন কনস্টেবল গিয়ে গুহার ভিতর থেকে একটা লাল থলি বার করে নিয়ে এল। সেটা খুলতে প্ৰথমে বেরোল একটা পাকানো কাগজ। এটা রাজা চন্দ্ৰদেও সিং-এর সিলমোহর সমেত ভবানী উপাধ্যায়কে লকেট-দানের স্বীকৃতি।

তারপর বেরোল আরেকটা ছোট থলি থেকে সেই বিখ্যাত সোনার লকেট—বালগোপাল—যার অপরূপ সৌন্দর্য এই পরিবেশে, এই সকালের রোদে আরও শতগুণ বেড়ে গেছে।

এইবার ফেলুদা মুখ খুলল। তার বেস্ট হিন্দিতে সে বলল, এবার আপনার আসল পরিচয়টা দিলে কিন্তু আমাদের সকলের খুব সুবিধে হত।

আমার আসল পরিচয়।

আপনার নিজের নামটা বাংলাতেই বলুন না। অ্যাদ্দিন পরে বাংলা বলতে আপনার নিশ্চয়ই ভাল লাগবে।

উপাধ্যায় ফেলুদার দিকে অবাক হয়ে গিয়ে বাংলায় বললেন, আপনি বুঝে ফেলেছেন আমি বাঙালি?

কেন বুঝব না? বলল ফেলুদা, আপনি দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দিতে চিঠি লিখেছেন, কিন্তু আপনার ল আর বগীয় জ বাংলার মতো। তা ছাড়া আপনার হরিদ্বারের ঘরের তাকে একটা বইয়ের পাতার টুকরো পেয়েছি, সেটাও বাংলা।

আপনার বুদ্ধি তো আশ্চর্য তীক্ষ্ণ?

এবার আর একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন কি?

কী?

উপাধ্যায় কি সত্যিই আপনার পদবি, আর ভবানী কি সত্যিই আপনার নাম?

আপনি কী বলছেন আমি—

উপাধ্যায় কি গঙ্গোপাধ্যায়ের অংশ নয়, আর ভবানী কি দুগার আরেকটা নাম নয়? আমি যদি বলি, আপনার আসল নাম দুগামোহন গঙ্গোপাধ্যায়—তাহলে কি খুব মিথ্যে বলা হবে?

ছো—ছো-ছো–ছো—

আপনি কাকে ধিক্কার দিচ্ছেন। লালমোহনবাবু? ফেলুদা বলে উঠল।

ছো-ছোটকাকা।

দুগামোহন গঙ্গোপাধ্যায় অবাক হয়ে চাইলেন লালমোহনবাবুর দিকে।

আমি যে লালু! বললেন জটায়ু।

লালমোহনবাবু গিয়ে দুগামোহনকে টিপ করে প্রণাম করায় সাধুবাবা তাঁর ভাইপোকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তা হলে তো আমার সমস্যার সমাধান হয়েই গেল। ওই লকেট তো তোরই প্ৰাপ্য! ও জিনিস আমার কাছে রাখা এক বিরাট বিড়ম্বনা।

তা তো বটেই। তা, আমাকে দিলে আমি একটা ব্যাঙ্কের ভল্টে রেখে দিতে পারি। আপনি তো জানেন না ছোটকাকা, আজকাল আমি ছোটদের উপন্যাস লিখে বেশ টু পাইস করছি; তবে রুচির তো কিছু বলা যায় না, এক’দিন দেখব ঝাঁপ করে সেল পড়ে গেছে! তখন লকেটটা থাকলে তবু একটা…

*

নিজের ছেলে লকেটটা হাত করার তাল করছে জেনে উমাশঙ্করকে বাধ্য হয়ে ফেলুদাকে টেলিগ্রাম ও চিঠি পাঠাতে হয়েছিল। বাপকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখার ক্ষমতা দেবীশঙ্করের নিশ্চয়ই আছে। দুৰ্গমোহন খুন হলে লকেট বেহাত হয়ে যেত এটাও ঠিক, কিন্তু বাঁচিয়ে দিয়েছিল ওই ধস। দেবীশঙ্কর আটকা পড়ে গিয়েছিল রুদ্রপ্রয়াগে। সিংঘানিয়া যে এসেছিল কেদারে, সে একেবারে নিজের গরজে, লকেটটাকে কেনার জন্য।

দেবীশঙ্করই লোক লাগিয়ে ফেলুদার দিকে পাথর গড়িয়ে দিয়েছিল, সে-ই আবার কেদারে রাত্তির বেলা গুণ্ডা লাগিয়ে ফেলুদাকে জখম করার চেষ্টা করেছিল।

ছোটকুমার পবনদেও সিং অবিশ্যি তার ক্যামেরা দিয়ে পুরো ঘটনাই টেলি-ফোটা লেনাস-এর জোরে বেশ কাছ থেকেই তুলে রেখেছিল। দেবীশঙ্কর যে রিভলভার বার করে দুগামোহনের দিকে তাগ করেছিল, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাবার কথা। আপাতত ছোটকুমারের আর ফিল্ম নেই, কিন্তু দিল্লি থেকে স্টক এলে পরে দুৰ্গমোহনের একটা সাক্ষাৎকার নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। দুগামোহন আপত্তি করলেন না; বরং বললেন, একজন রাজার আশ্চর্য দরাজ মনের কথাটা বিশ্বের লোকের কাছে গোপন থাকে কেন? আমি টেলিভিশন ক্যামেরায় নিশ্চয়ই বলব আমার সোনার বালগোপাল, পাবার কথা।

পবনদেও বললেন, কিন্তু বালগোপাল তো আর আপনার কাছে থাকছে না।

না, বললেন দুৰ্গমাহন। সেটার ছবি যদি তুলতে চাও তা আমার ভাইপাকে বলো।

পবনদেও লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে বললেন, আপনার বাড়ি গিয়ে আমি লকেটটার ছবি তুলে আনতে পারি কি?

জটায়ু তাঁর সবচেয়ে বেশি সাহেবি উচ্চারণে বললেন, ইউ আর মোউস্ট ওয়েলখাম?

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়