আপনি তো আমার লেখা শুধরে দেন, বললেন লালমোহনবাবু, সেটা আর এবার থেকে দরকার হবে না।

ফেলুদা তার প্রিয় সোফাটায় পা ছড়িয়ে বসে রুবিকস কিউবের একটা পিরামিড সংস্করণ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল; সে মুখ না তুলেই বলল, বটে?

নো স্যার। আমার পাড়ায় এক ভদ্রলোক এয়োচেন, কাল পার্কে দেখা হল। এক বেঞ্চিতে বসে কথা বললুম। প্রায় আধা ঘণ্টা। গ্রেট স্কলার। নাম মৃত্যুঞ্জয় সোম।

স্কলার?

স্কলার। বোধহয় হার্বার্ট ইউনিভার্সিটির ডবল এম এ, বা ওই ধরনের কিছু।

উফফ! ফেলুদা এবার মুখ না তুলে পারল না। হার্বার্ট নয় মশাই, হার্ভার্ড, হাভার্ড!

তাই হবে। হাভার্ড।

হাভার্ড সেটা বুঝলেন কী করে? নাকিসুরে মার্কিন মাক ইংরেজি বলেন ভদ্রলোক? ইংরিজিটা একটু বেশি বলেন। নাকিসুর কিনা লক্ষ করিনি। তবে বিদ্বান লোক। থাকেন। বহরমপুর। একটা বই লিখছেন, তাই নিয়ে রিসার্চ করবেন বলে ক’দিনের জন্য কলকাতায় এসেছেন। চেহারাতে বেশ একটা ইয়ে আছে। ফ্রেঞ্চ-কািট দাড়ি, চোখে সোনার বাই-ফোকাল, জামাকাপড়ও ধোপদূরস্ত। আমার হভূরাসে হাহাকার টা পড়তে দিয়েছিলুন। চৌত্ৰিশটা মিসটেক দেখিয়ে দিলেন। তবে বললেন ভেরি এনজয়েবল।

তা হলে আর কী। আপনার পেট্রল খরচ অনেক কমে যাবে এবার থেকে। আর গড়পার-বালিগঞ্জ ঠ্যাঙাতে হবে না।

তবে ব্যাপারটা হচ্ছে কী—

ব্যাপারটা কী হচ্ছে সেটা আর জানা গেল না, কেন না ঠিক এই সময় এসে পড়লেন ফেলুদার মক্কেল অম্বর সেন। নটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় আমাদের কলিং বেল বেজে উঠল।

অম্বর সেনের বয়স মনে হয়। পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে, ফরসা রং, দাড়িগোঁফ কামানো, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, গায়ে পাঞ্জাবি আর ধুতির উপর একটা পুরনো জামেওয়ার শাল। কাশ্মীরি শাল যে কতরকম হয় সেটা সেদিন ফেলুদার সঙ্গে মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে এসেছি।

অম্বর সেন ফেলুদার মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললেন, আপনিও ব্যস্ত মানুষ, আমিও ব্যস্ত। কাজেই সময় নষ্ট না করে সোজা কাজের কথায় চলে যাওয়াই ভাল। আগে এই জিনিসটা দেখুন।

পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন। খাতা থেকে ছেঁড়া একটা পাতা, সেটাকে দল করে পাকানো হয়েছিল, তারপর আবার হাত বুলিয়ে মসৃণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

কাগজটাতে গোটা অক্ষরে লাল কালি দিয়ে লেখা—আমার সর্বনাশের শাস্তি ভোগ করার জন্য প্ৰস্তুত হও। আর সাতদিন মেয়াদ। পালিয়ে পথ পাবে না।

কাগজটা নেড়েচেড়ে দেখে ফেলুদা প্রশ্ন করল, কীভাবে পেলেন এটা?

আমার বাড়িতে একতলায় আমার কাজের ঘর, বললেন ভদ্রলোক, রাত্তিরে এসে জানালা দিয়ে ছুড়ে ডেস্কের উপর ফেলে দিয়ে গেছে। সকালে আমার চাকর লক্ষ্মণ এটা পেয়ে আমার কাছে নিয়ে আসে।

আপনার ঘর কি রাস্তার উপর?

না। ঘরের বাইরে বাগান, তারপর কম্পাউন্ড ওয়াল, তারপর রাস্তা। তবে দেয়াল টপকানো যায়।

সর্বনাশের কথা যে বলছে সেটা কী?

অম্বর সেন মাথা নাড়লেন।

দেখুন মিস্টার মিত্তির, আমি নিৰ্বাঞ্ছাঁট মানুষ। আমার পেশা হল ব্যবসা, তবে আসল কাজ আমার ভাইই করে। আমার পাঁচ রকম অন্য শাখ আছে, সেই সব নিয়ে থাকি। সজ্ঞানে কারুর কখনও কোনও সর্বনাশ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। অন্তত এমন সর্বনাশ। নিশ্চয়ই নয় যেটা এই হুমকি-চিঠিকে জাস্টিফাই করতে পারে। ব্যাপারটা আমার কাছে সম্পূৰ্ণ অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে।

ফেলুদা ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ ভেবে বলল, অবিশ্যি এটা এক ধরনের রসিকতাও হতে পারে—যাকে বলে প্র্যাকটিক্যাল জোক। আপনার পাড়ায় কাছাকাছির মধ্যে মস্তান ছেলেদের আস্তানা আছে?

আমরা থাকি পাম এভিনিউতে, বললেন অম্বর সেন। পুব দিকে কিছু দূরে একটা বস্তি আছে, সেখানে এই ধরনের ছেলে থাকা কিছুই আশ্চর্য নয়।

পুজোর চাঁদার জন্য হামলা করে না?

তা করে, কিন্তু চাঁদা তো আমরা নিয়মিত দিই।

শ্ৰীনাথ চা এনেছে, তাই কাজের কথা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হল। লালমোহনবাবু দুবার বিড়বিড় করে রিভেঞ্জ কথাটা বললেন। ফেলুদা সেই সুযোগে আমাদের দুজনের সঙ্গে ভদ্রলোকের আলাপ করিয়ে দিল।

আপনিই বিখ্যাত লালমোহন গাঙ্গুলী?

হেঁ হেঁ।

ভদ্রলোক বেশ তৃপ্তি সহকারে চায়ে চুমুক দিয়ে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, আসলে আপনার বিষয় আমি আপনার কাহিনীগুলো থেকেই জেনেছি। তাই মনে হল আপনার কাছেই আসি।

পুলিশে খবর দেননি? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

আমার ভাই অবিশ্যি পুলিশের কথাই বলেছিল, কিন্তু আমি আবার এ সব ব্যাপারে একটু আন-অর্থডক্স। প্রচলিত নিয়মগুলো চট্ট করে মানতে মন চায় না। আর সত্যি বলতে কী, এখনও বোধহয় অতটা বিচলিত হবার কারণ ঘটেনি। আপনার কাছে এলাম, তার একটা কারণ আপনাকে দেখারও একটা ইচ্ছে ছিল। আমাদের পরিবারের মোটামুটি সকলেই আপনাকে চেনে।

পরিবারে আর কে কে আছেন?

আমার ভাই অম্বুজ আছে। সে বিয়ে করেছে, আমি করিনি। অম্বুজের স্ত্রী আছে, একটি মেয়ে আছে বছর দশোকের-ছেলে দুটি বড়, তারা বাইরে থাকে।–তা ছাড়া আমার বিধবা মা আছেন, আর আছে আমাদেরই এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সে আমাদেরই বাড়িতে মানুষ। ফ্যামিলি মেমবার বলতে এই, তার বাইরে তিনজন চাকর, একটি ঠিকে ঝি, রান্নার লোক, মালী, দারোয়ান আর ড্রাইভার। আমরা থাকি ফাইভ বাই ওয়ান পাম এভিনিউতে। বাবা ছিলেন নামকরা হার্ট স্পেশালিস্ট অনাথ সেন।

ফেলুদা একটু কিন্তু-কিন্তু ভাব করছে দেখে ভদ্রলোক বললেন, আপনাকে আমি শুধু ব্যাপারটা জানিয়ে গেলাম। হতে পারে এটা একটা প্রাকটিক্যাল জোক ছাড়া আর কিছুই না; তবে কী জানেন, এ ধরনের রসিকতার টারগেট বিখ্যাত ব্যক্তিদের মাঝে মাঝে হতে হয় ঠিকই, কিন্তু আমি তো আর তেমন কেউ-কেটা নই, তাই…

ফেলুদা বললে, বুঝতেই পারছেন, এ হুমকি যদি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হয় তা হলে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। যাই হাক-আপাতত এই চিঠিটা আমি রাখতে পারি তো?

নিশ্চয়ই। ওটা তো আপনাকে দেবার জন্যেই আনা।

 

এমন একটা হুমকি-চিঠি নিয়ে অম্বর সেনের ফেলুদার কাছে আসাটা একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হচ্ছিল, পরদিন সকালে পাম এভিনিউ থেকে যে ফোনটা এল, তাতে সমস্ত ব্যাপারটা একটা অন্য চেহারা নিল।

বসবার ঘর থেকে ফেলুদার ঘরে কলটা ট্রানসফার করে দিয়ে কান লাগিয়ে যা শুনলাম তা হল এই–

কে, মিস্টার মিত্তির?

অজ্ঞে হ্যাঁ!

আমার নাম অম্বুজ সেন। কাল আমার দাদা বোধহয় আপনার ওখানে গেসলেন একটা হুমকি-চিঠির ব্যাপারে?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

ওয়েল, হি ইজ মিসিং।

মানে?

দাদাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

পাওয়া যাচ্ছে না?

না! দাদা রোজ ভোরে গাড়িতে করে বেরোন; গঙ্গার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তারপর মাইল দুয়েক হাঁটেন! আজও গেসলেন, কিন্তু আজ আর ফেরেননি।

সে কী!

ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে এক ঘণ্টা ওয়েট করার পর। ও তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও দাদার দেখা পায়নি।

পুলিশে জানাননি?

সেখানে একটা গোলমাল আছে মিঃ মিত্তির। আমার মার বয়স আশি, শরীরও ভাল নেই। ওঁকে দাদার ব্যাপারটা নিয়ে এখনও কিছুই জানাইনি। পুলিশ এলেই কিন্তু ব্যাপারটা আর চাপা থাকবে না। তখন ওঁকে সামলানো মুশকিল হবে। কাজেই আমাদের ইচ্ছা কেসটা আপনিই হ্যান্ডল করুন। আপনার উপর আমাদের পুরো ভরসা আছে। অবশ্য আপনার উপযুক্ত পারিশ্রমিক আমরা দেব।

আমি তা হলে একবার আপনাদের ওখানে আসছি। অসুবিধা হবে না তো?

মোটেই না! আপনি এখনই চলে আসুন। আমাদের বাড়ির নম্বরটা জানেন তো?

ফাইভ বাই ওয়ান পাম এভিনিউ তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়