আওরঙ্গাবাদ ঐতিহাসিক শহর। আবিসিনিয়ার এক ক্রীতদাস-নাম মালিক অম্বর–ভারতবর্ষে এসে তাঁর ভাগ্য ফিরিয়ে ক্ৰমে আমেদনগরের রাজার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন। তিনিই খাড়কে নামে একটা শহরের পত্তন করেন, যেটা আওরঙ্গজেবের আমলে নাম পালটে হয়ে যায় আওরঙ্গবাদ। মোগল আমলের চিহ্ন ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রায় তেরোশো বছরের পুরনো আট-দশটা বৌদ্ধ গুহা-যার ভেতরে দেখবার মতো কিছু মূর্তি রয়েছে। যে ভদ্রলোকটির সঙ্গে আজ আলাপ হল, তিনি বিকেলে আমাদের সঙ্গে আরেকটু বেশি ভাব জমাতে আমাদের ঘরে এসেছিলেন। একসঙ্গে চা খেতে খেতে ভদ্রলোক বললেন, এই সব গুহার মূর্তির সঙ্গে নাকি এলোরার মূর্তির খানিকটা মিল আছে।আপনারা কাল যদি সময় পান একবার দেখে আসবেন। আজ অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে; কাল সকালে দিন ভাল থাকলে আমরা সেই গুহাগুলো, আর তার কাছেই আওরঙ্গজেবের রানির স্মৃতিস্তম্ভ বিবি-কা-মাকবার দেখে আসব। আমাদের কাল দুপুরটা পর্যন্ত থাকতেই হবে, কারণ এগারেটার সময় জয়ন্ত মল্লিকের আসার কথা। আমাদের বিশ্বাস তিনি এলোরা যাবেন, এবং আমরা যাব তাঁকে ফলো করে।

রাত্রে খাবার পর ফেলুদা তার এলোরার গাইডবুক নিয়ে বসল। আমি কী করি তাই ভাবছি, এমন সময় জটায়ু এসে বললেন, কী করছ, তপেশীবাবু? বাইরে বেশ চাঁদ উঠেছে, চলো একটু বেড়িয়ে আসি।

হাটেল থেকে বেরিয়ে এসে দেখি বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। দূরে দক্ষিণ দিকে নিচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে, ওরই গায়ে বোধ হয় বৌদ্ধ গুহাগুলো। কাছেই একটা পানের দোকান থেকে ট্রানজিসটারে হিন্দি ফিল্মের গান বাজছে। রাস্তার উলটো দিকে একটা বন্ধ দোকানের সামনে দুটো লোক একটা বেঞ্চিতে বসে গলা উচিয়ে তর্ক করছে—কী নিয়ে সেটা বোঝার উপায় নেই, কারণ ভাষাটা বোধ হয় মারাঠি। দিনের বেলায় রাস্তাটায় বেশ লোকজন গাড়িটাড়ির চলাচল ছিল, এখন এই দশটার মধ্যেই সব কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। দূর থেকে একটা ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল, একটা পাগড়ি পরা লোক সাইকেল করে বেল বাজাতে বাজাতে আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল, কোথেকে জানি একটা লোক এ মধুকর-এ মধুকর  বলে চেঁচিয়ে উঠল—সবই যেন কেমন নতুন নতুন, সব কিছুর মধ্যেই যেন খানিকট রহস্য, খানিকটা রোমাঞ্চ, খানিকটা অজানা ভয় মেশানো রয়েছে। আর তার মধ্যে লালমোহনবাবু আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, শুভঙ্কর বোসকে দেখে একটু সাস্‌পিশাস্‌ বলে মনে হচ্ছে না তোমার?

বলতে ভুলে গেছি। ওই বাঙালি প্রফেসরটির নাম হল শুভঙ্কর বাস। আমি বললাম, কেন?

ওর সুটকেসের মধ্যে কী আছে বলো তো? পঁয়ত্রিশ কিলো ওজন হয় কী করে?

পঁয়ত্ৰিশ কিলো!-আমি তো অবাক।

বম্বেতে প্লেনে ওঠার আগে মাল ওজন করছিল। আমার সামনেই উনি ছিলেন। আমি দেখেছি। পয়ত্ৰিশ কিলো! যেখানে তোমার দাদারটা বাইশ, তোমারটা চোদ্দো, আমারটা ষোলো। ভদ্রলোককে অতিরিক্ত মালের জন্য বেশ কিছু টাকা দিতে হল।

এ খবরটা আমি জানতাম না। অথচ বাক্সটা বেশি বড় নয় ঠিকই। কী আছে ওটার মধ্যে?

পাথর  লালমোহনবাবু নিজেই ফিসফিস করে নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন। –কিংবা পাথর ভাঙার জন্য লোহার সব যন্ত্রপাতি; তোমার দাদা বলছিলেন। না-এইসব মূর্তি চুরির পেছনে একটা দল আছে? আমি বলছি উনি সেই দলের একজন। ওর নাকটা দেখেছি? ঠিক ঘনশ্যাম কর্কটের মতো।

ঘনশ্যাম কৰ্কট? সে আবার কে?

ও হা—তোমাকে বলা হয়নি। আমার নতুন গল্পের ভিলেন। তার নাকের বর্ণনা কীরকম দেব জান তো? পাশ থেকে দেখলে মনে হয় ঠিক যেন জলের উপর বেরিয়ে থাকা হাঙরের ডানা!

জটায়ু আমার মাথাটা গণ্ডগোল করে দিলেন। আমার কিন্তু শুভঙ্কর বোসকে একটুও সন্দেহ হয়নি। কারণ যে লোক আর্ট সম্বন্ধে এত জানেন…। অবিশ্যি এখন ভাবলে মনে হচ্ছে ভারতবর্ষের নাম-করা মন্দিরগুলো থেকে যারা মূর্তি চুরি করবে তাদেরও তো আর্ট সম্বন্ধে কিছুটা জানতেই হবে। ভদ্রলোকের চেহারার মধ্যে সত্যিই একটা ধারালো ভাব আছে।

তোমায় বলে দিলুম, লালমোহনবাবু বললেন, এবার থেকে খালি একটু চোখে চাখে রেখা। আমাকে আজকে একটা ল্যাবেঞ্চস অফার করেচিলেন, নিলুম না। যদি বিষ-টিষ মেশানো থাকে! তোমার দাদাকে বোলো ওঁর নিজের পরিচয়টা যেন গোপন রাখেন। উনি

রাত্রে ফেলুদাকে শুভঙ্কর বোসের বাক্সের ওজনের কথাটা বলতে ও বলল, পিয়ত্ৰিশ নয়, সাঁইত্রিশ কিলো। জটায়ুকে বলে দিস যে শুধু পাথরেরই ওজন হয় না, বইয়েরও হয়। আমার বিশ্বাস লোকটা পড়াশুনো করার জন্য সঙ্গে অনেক বই এনেছে।

 

পরদিন সকালে সাড়ে ছটায় ট্যাক্সি করে বেরিয়ে আমরা প্ৰথমে এখানকায় নকল তাজমহল বিবি-কা-মোক্বারা দেখে তারপর বৌদ্ধ গুহা দেখতে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ের গা দিয়ে অনেকগুলো সিঁড়ি উঠে তারপর গুহায় পৌঁছানো যায়। আমাদের সঙ্গে শুভঙ্কর বোসও রয়েছেন, সমানে আর্ট সম্বন্ধে জ্ঞান দিয়ে চলেছেন, তার অর্ধেক কথা আমার এ কান দিয়ে ঢুকে ও কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, বাকি কথা কোনও কানেই ঢুকছে না। লোকটাকে অনেক চেষ্টা করেও চোর-বদমাইস হিসাবে ভাবতে পারছি না, যদিও লালমোহনবাবু বার বার আড়াচোখে তাকে দেখছেন, আর তার ফলে সিঁড়িতে হোঁচট খাচ্ছেন।

আমরা ছাড়া আরও দুজন লোক আমাদের আগেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেছেন। তার মধ্যে একজন রংচঙে হাইওয়ান শার্ট পরা এক টেকো সাহেব, আর আরেকজন নিশ্চয়ই টুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের মাইনে করা গাইড।

ফেলুদা তার নকশা করা ঝোলাটা থেকে তার পেনট্যাক্স ক্যামেরাটা বার করে মাঝে মাঝে ছবি তুলছে, কখনও পাহাড়ের উপর থেকে শহরের ছবি, কখনও বা আমাদের ছবি। আমাদের দিকে ক্যামেরা তাগ করলেই লালমোহনবাবু থেমে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে পোজ দিচ্ছেন। শেষটায় আমি বাধ্য হয়ে বললাম যে হাঁটা অবস্থাতেও ছবি ওঠে, আর না-হাসলে অনেক সময় ছবি আরও বেশি ভাল ওঠে।

গুহার মুখে পৌঁছে ফেলুদা বলল, তোরা দ্যাখ আমি কটা ছবি তুলে আসছি। শুভঙ্করবাবু বললেন, দু নম্বর আর সাত নম্বরটা মিস করবেন না। এক থেকে পাঁচ এই কাছাকাছির মধ্যেই পাবেন, আর ছয় থেকে নয় হল এখান থেকে হাফ-এ-মাইল পুব দিকে। পাহাড়ের গা দিয়ে রাস্ত পাবেন।

একে জুন মাস, তার উপর ঝলমলে রোদ, তাই বাইরেটা বেশ গরম লাগছিল। কিন্তু গুহার ভিতরে ঢুকে দেখি বেশ ঠাণ্ডা। এক নম্বরটায় বিশেষ কিছু নেই, আর দেখেই বোঝা যায় সেটার কাজ অর্ধেক করে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর যেটুকু তৈরি ছিল তারও খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ে গেছে। শুভঙ্করবাবু তাও ভাৱী আগ্রহের সঙ্গে বারান্দার থাম, সিলিং ইত্যাদি দেখে খাতায় কী সব নোিট করে নিতে লাগলেন। আমি আর লালমোহনবাবু দু নম্বর গুহায় গিয়ে ঢুকলাম! ফেলুদা আমার সঙ্গে একটা টর্চ দিয়ে দিয়েছিল, বারান্দা পেরিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকে টৰ্চটা জ্বালতে হল। বেশ বড় একটা হল ঘর, তার শেষ মাথায় একটা প্ৰকাণ্ড বুদ্ধ মূর্তি। দু পাশের দেয়ালে টর্চ ফেলে দেখি সেগুলোতেও চমৎকার সব মূর্তি খোদাই করা হয়েছে। লালমোহনবাবু মন্তব্য করলেন, তখনকার আর্টিস্টদের শুধু আর্টিস্ট হলে চলন্ত না, বুঝলে হে তপেশ, সেই সঙ্গে গায়ের জোরও থাকতে হত। হাতুড়ি আর ছেনি দিয়ে পাহাড়ের গায়ের পাথর ভেঙে তৈরি করতে হয়েছে। এ সব মূর্তি-চাট্টিখানি কথা নয়।

 

তিন নম্বরের ভিতরে ঢুকে দেখি আরও বড় একটা হল ঘর, আর সে ঘর সেই গাইডের বকবকানিতে এমন গম গম করছে যে সেখানে টেকা দেয়। বাইরে বেরিয়ে এসে লালমোহনবাবু বললেন, তোমার দাদা গেলেন কোথায়? তাকে তো দেখছি না।

সত্যিই তো। ফেলুদা কোথায় গিয়ে ছবি তুলছে?

আর শুভঙ্করবাবুই বা কোথায়?

চলো, এগিয়ে চলো, বললেন লালমোহনবাবু।

পাশেই পর পর চার আর পাঁচ নম্বর গুহা রয়েছে, কিন্তু ফেলুদা না থাকায় কেমন যেন অসোয়াস্তি লাগছে। কাছাকাছির মধ্যে কোথাও নেই। আন্দাজ করে আমরা পুব দিকের গুহাগুলোর পথ ধরলাম; প্রায় আধ মাইল হাঁটতে হবে, কিন্তু যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। পাহাড়ের গায়ে গাছপালার চেয়ে পাথর আর ঝোপঝাড়ই বেশি। ঘড়িতে মাত্র সোয়া আটটা, তাই রোদের তেজ এখনও তেমন বেশি নয়। দশটার বেশি দেরি করা চলবে না, কারণ এগারোটার গাড়িতে জয়ন্ত মল্লিক আসবেন।

মিনিট পনেরো হাঁটার পর রাস্তা থেকে কিছুটা উপর দিকে একটা গুহা দেখতে পেলাম। এটা বাধ হয়। ছ নম্বর। পথে ফেলুদার কোনও চিহ্ন দেখতে পাইনি। লালমোহনবাবু গোয়েন্দার ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে রাস্তার উপর ঝুকে পড়ে পায়ের ছাপ খোঁজার বৃথা চেষ্টা করছেন। এ ধরনের পাহাড়ে পথে এমনিতেই বৃষ্টির জল দাঁড়ায় না, তার উপরে সকাল থেকে একটানা দুঘণ্টা রোদ হয়ে রয়েছে। রাস্তা একেবারে শুকনো খটখাটে।

আর এগোনের কোনও মানে আছে কি? তার চেয়ে ওর নাম ধরে ডাকলে কেমন হয়?

ফেলুদা! ফেলুদা।

প্রদোষবাবু! ফেলুবাবু~~~! ও মিস্টার মিত্তি-র !

কোনও উত্তর নেই। আমার পেটের ভিতরটা খালি খালি লাগছে।

পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে ওপর দিকে কোথাও চলে গেল নাকি? কোনও কিছুর সন্ধান পেয়েছে কি? জরুরি কিছু?—যার ফলে আমাদের কথা ভুলে গিয়ে তদন্তের কাজে লেগে যেতে হয়েছে?

লালমোহনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, এদিকে নেই। থাকলে ডাক শুনতে পেতেন। নিশ্চয় ওদিকেই আছেন। চলো ফিরে চলো। এবার দেখা পাব নিঘাত। তোমার দাদা তো আর খামখেয়ালি নন, বা কাঁচা কাজ করার লোক নন। চলো।

আমরা উলটোমুখে ঘুরলাম। কিছু দূর গিয়েই সেই সাহেব আর তার গাইডের সঙ্গে দেখা হল। এরা এক থেকে পাঁচ শেষ করে ছায়ের দিকে চলেছে। বেশ বুঝলাম গাইডের কথার ঠেলায় সাহেবের অবস্থা কাহিল।

ওই তো শুভঙ্করবাবু! লালমোহনবাবু বলে উঠলেন। ভদ্রলোক অন্যমনস্কভাবে। আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। জটায়ুর গলা শুনে মুখ তুললেন। আমি ব্যস্তভাবে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার দাদাকে দেখেছেন কি?

কই না তো। উনি যে বললেন ছবি তুলতে যাবেন?

কিন্তু ওকে তো দেখছি না। আপনি গুহাগুলো…?

কেভের মধ্যে নেই। আমি সবগুলো দেখে আসছি।

আমার ভয় ভয় ভাব দেখেই বোধহয় ভদ্রলোক সত্ত্বনা দেবার সুরে বললেন, কোথায় আর যাবেন-পাহাড়ের ওপর দিকে কোথাও গেছেন হয়তো। শহরটার একটা ভাল ভিউ পাওয়া যায় ওপর থেকে। একটু এগিয়ে গিয়ে জোরে ডাক দাও-ঠিক শুনতে পাবেন।

শুভঙ্কর বোস ছ নম্বর কেভের দিকে চলে গেলেন। লালমোহনবাবু ঘড়ঘড়ে চাপা গলায় বললেন, গীতিক ভাল লাগছে না তপেশ। এলোরা না যেতেই একটা চিন্তার কারণ ঘটবে এটা ভাবিনি।

মনে সাহস আনার চেষ্টা করে এগিয়ে চললাম! হাঁটার স্পিড আপনা থেকেই দ্বিগুণ হয়ে গেছে। খালি মনে হচ্ছে সময়ের ভীষণ দাম, এগারোটার মধ্যে হোটেলে ফিরতে হবে, মল্লিক এল কি না জানতে হবে। অথচ ফেলুদাই বেপাত্তা। ফেলুদা ছাড়া…ফেলুদা ছাড়া….

চারমিনার–লালমোহনবাবুর হঠাৎ চিৎকারে চমকে লাফিয়ে উঠলাম।

সামনেই পাঁচ নম্বর গুহার থামগুলো দেখা যাচ্ছে। তার বাইরে একটা কাঁটা-ঝোপের পাশে একটা হলদে রঙের সিগারেটের প্যাকেট পড়ে আছে। যাবার সময় সেটা হয় ছিল না, না হয় চোখে পড়েনি। খালি প্যাকেট কি? নাকি সিগারেট থাকা অবস্থায় পকেট থেকে পড়ে গেছে? কিংবা হাত থেকে?…

ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে সেটাকে তুললাম। খুলে দেখি খালি। ফেলে দিতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় দেখি দেখি বলে। লালমোহনবাবু সেটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আরও বেশি করে খুলতেই ভিতরের সাদা কাগজের গায়ে একটা ডট পেনের লেখা বেরিয়ে পড়ল। ফেলুদার হাতের লেখা—

হোটেলে ফিরে যা।

যদিও ফেলুদার একটা চিহ্ন পেয়ে হাঁপ ছাড়ার একটা কারণ হল, কিন্তু কী কারণে কী অবস্থায় সেটা লিখতে হয়েছে না জেনে পেটের ভিতরে খালি ভাবটা পুরোপুরি গেল না। লালমোহনবাবু বললেন, তা না হয় হোটেলে ফিরে গেলুম, কিন্তু মিস্টার বোসের কী হবে? তাঁর তো আরও চারটে গুহা দেখতে বাকি।

আমি বললাম, এক কাজ করি।–আমরা ফিরে গিয়ে ট্যাক্সিটা ওকে ফেরত পাঠিয়ে দিই।

এখানে থেকে ওঁর গতিবিধি একটু লক্ষ করলে হত না?

মিস্টার বোসের?

হ্যাঁ।

আমার কিন্তু মনে হয় ফেলুদার আদেশ মানা উচিত।

তবে চলে যাই হোটেলে ফিরে।

লালমোহনবাবু নিজে রহস্যের গল্প লেখেন বলেই বোধহয় মাঝে মাঝে ওঁর গোয়েন্দাগিরির ঝোঁক চাপে। বেশ বুঝতে পারছিলাম উনি শুভঙ্করবাবুকে ফলো করতে চাচ্ছেন, কিন্তু বাধ্য হয়েই বাধা দিতে হল। ট্যাক্সি আমাদের দুজনকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আবার গুহায় ফিরে গেল! এখন মাত্ৰ নটা। এইভাবে ফেলুদার অপেক্ষায় কতক্ষণ বসে থাকতে হবে জানি না।

ঘরে থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই দুজনে হাটেলের বাইরে রাস্তায় পায়চারি করতে লাগলাম। সকলে আকাশ পরিষ্কার ছিল, এখন আবার মেঘ করে আসছে। এক হিসেবে ভাল। গরমটা কমবে।

পৌনে দশটা নাগাদ শুভঙ্করবাবু ফিরে এসে ফেলুদা তখনও আসেনি শুনে খুব অবাক হয়ে গেলেন। অথচ আমরা যে একটা ক্রাইমের তদন্ত করতে এসেছি, বিপদের আশঙ্কা আছে, এটাও ওঁকে বলা যায় না, কারণ এখনও সেরকম আলাপ হয়নি, আর লালমোহনবাবুর এখনও বিশ্বাস উনি শত্রুপক্ষের লোক। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই। এটা বোঝানোর জন্য বললাম, ও ওইরকমই লোক। ভীষণ ভুলো আর খামখেয়ালি। আগেও অনেক বার এরকম করেছে।

প্রায় এক ঘণ্টা রাস্তায় পায়চারি করে ঘরে ফিরে এসে টিনটিনের বইটা খুলে তুষার মানবের রোমাঞ্চকর ঘটনায় মন দিতে চেষ্টা করলাম। এগারেটার কিছু পরে একবার মুনে হল যেন একটা ট্রেনের হুইসলা শুনতে পেলাম। পৌনে বারোটার সময় বাইরে একটা গাড়ির শব্দ পেলাম। গিয়ে দেখি একটা ট্যাক্সি থেকে দুজন ভদ্রলোক নামলেন। একজন মাঝারি হাইট, কাঁধ চওড়া, ঘাড়ে-গদর্শনে চেহারা, দেখেই কেন জানি মনে হয় কড়া সাহেবি মেজাজের লোক। অন্যজন লম্বা, বেলবটম প্যান্ট, ফুলকারি করা পাতলা শার্ট, গলায় চেন, লম্বা চুল, এলোমেলো গোঁফ দাড়ি। এরা দুজন ট্যাক্সি শেয়ার করে এসেছেন, এক জোটে ভাড়া চুকিয়ে দিলেন। লম্বার সঙ্গে একটা নতুন ক্যানভাসের ব্যাগ, আর ঘাড়ে-গদানের সঙ্গে পুরনো চামড়ার সুটকেস। মাল নিয়ে দুজনে হোটেলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ট্যাক্সি এসে পড়ল।

দরজা খুলে নামলেন জয়ন্ত মল্লিক।

তাকে দেখে যতটা নিশ্চিন্ত হলাম, তার চেয়েও বেশি অবাক হলাম ফেলুদার কাণ্ড দেখে।

এরকম অবস্থায় কি এর আগে পড়েছি কখনও? মনে তো পড়ে না।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়