পরদিন সকালে কাগজ খুলে দেখি, তরফদার সম্বন্ধে খবর বেরিয়েছে যে উনি উনিশে ডিসেম্বর দলবল নিয়ে দক্ষিণ ভারত সফরে যাচ্ছেন, পঁচিশে ডিসেম্বর ম্যাড্রাসে ওঁর প্রথম শো।

ফেলুদা চুল ছাঁটতে গিয়েছিল, দশটা নাগাত ফিরল। ওকে খবরটার কথা বলতে ও গম্ভীরভাবে বলল, দেখেছি। .. আত্মপ্রচারের লোভ খুব কম লোকেই সামলাতে পারে রে, তোপ্‌সে! আমি একটু নরম-গরম কথা শোনাব বলে ওকে ফোন করেছিলাম, কারণ—বুঝতেই তো পারছিস—এই খবর বেরোনোর ফলে আমার কাজটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ছে।

তরফদার কী বললেন?

ফেলুদা একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, বিলে কী-আজকের দিনে শো-ম্যানদের পাবলিসিটি ছাড়া গতি নেই, মিস্টার মিত্তির; ও নিয়ে আপনি কাইন্ডলি আমাকে কিছু বলবেন না। আমি বললাম-যে-তিনজন ব্যক্তি নয়নের দিকে লুব্ধ দৃষ্টি দিচ্ছে, তারা যে তোমার প্রোগ্র্যামটা জেনে গেল, সেটা কি ভাল হল?–তাতে ছাক্রা বলল—আপনি চিন্তা করবেন না। আমি যেভাবে ওদের বলেছি, আমার বিশ্বাস তাতে ওরা নয়নকে পাবার আশা ছেড়েই দিয়েছে। -এর পর আর কী বলি বল? সত্যি যদি তাই হয় তা হলে তো আমার আর কোনও প্রয়োজনই থাকে না। কিন্তু আমি তো জানি যে নয়নের বিপদ-এবং সেই সঙ্গে আমার দায়িত্ব—-এখনও পুরোমাত্রায় রয়েছে! অর্থাৎ আমার দিক থেকে কাজে টিলে দেবার কোনও প্রশ্নই আসে না।

বাইরে গাড়ি থামার শব্দ, আর তার পরে পর পর দুবার কলিং বেল টেপার শব্দে বুঝলাম জটায়ু হাজির। এখন সোয়া দশটা; ভদ্রলোক সাধারণত নটা-সাড়ে নটার মধ্যে চলে আসেন। আজ কোনও কারণে দেরি হয়েছে।

দেখে ভাল লাগল যে ফেলুদার মুখ থেকে মেজাজ খিচড়ানো ভাবটা চলে গেল।

খবর আছে মশাই, খবর আছে! ঘরে ঢুকেই চোখ বড় বড় করে বললেন জটায়ু।

দাঁড়ান, দেখি আমি কত দূর আন্দাজ করতে পারি, বললেন ফেলুদা। আপনি নিউ মার্কেটে গেসলেন। ঠিক?

কী করে জানলেন?

আপনার কোটের বুক পকেট থেকে আইডিয়াল স্টোর্সের ক্যাশমেমোর ইঞ্চি খানেক বেরিয়ে আছে। তা ছাড়া আপনার কোটের বাঁ দিকের সাইড পকেট এমনভাবে ঝুলেফুলে রয়েছে যে বাঝাই যাচ্ছে আপনার প্রিয় টুথপেস্ট ফরহানসের একটি ফ্যামিলি সাইজ প্যাকেট রয়েছে ওখানে।

বোঝে!—নেক্সট?

আপনি রেস্টোরান্টে গিয়ে স্ট্রবেরি আইসক্রিম খেয়েছিলেন—তার দু ফোঁটা আপনার শার্টে পড়েছে।

সাবাশ!—নেক্সট?

আপনি একা কখনও রেস্টোরান্টে যান না। অৰ্থাৎ একটি পরিচিত ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছিল, যার সঙ্গে আপনি যান।

জবাব নেই!—নেক্সট?

আপনি তাকে নিয়ে যাননি, সেই আপনাকে নিয়ে গোসল। কারণ আপনাকে এত কাল চিনে অন্তত এটুকু জানি যে আপনার এমন কোনও বন্ধু এখন নেই, যাকে আপনি রেস্টোরান্টে নিয়ে গিয়ে আইসক্রিম খাওয়াবেন।

আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। —নেক্সট?

এ ব্যক্তির সঙ্গে সম্প্রতি আলাপ হয়েছে আপনার। পুরনো আলাপী বলতে আমরা দুজন ছাড়া আপনার আর কেউ নেই। তরফদার কি? না। তার এত সময় নেই; সে এখন সফরের তোড়জোড় করছে। চতুলেভীির কেউ কি? হজসন নন, কারণ সে ইনভাইট করলে আপনি রিফিউজ করবেন—একটানা ইংরিজি বলাটা আপনার পারদর্শিতার মধ্যে পড়ে না। তারকনাথ? উঁহু, তাঁর নিউ মার্কেটে কোনও প্রয়োজন থাকতে পারে না; উত্তর কলকাতায় দোকানের অভাব নেই। আর তা ছাড়া আমার ধারণা, তাঁর বাজার করার জন্য মাইনে করা লোক আছে। তা হলে বাকি রইল কে?

ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট! আপনি ধরে ফেলেছেন, ফেলুবাবু, ধরে ফেলেছেন! অনেক দিন পরে আপনার চিন্তাশক্তি আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার নমুনা পাওয়া গেল। থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার!

বসাক তো?

বসাক, বসাক—নন্দলাল বসাক! আজি প্রথম পুরো নামটা জানলুম।

আপনার সঙ্গে তাঁর কী কথা?

কথা ভাল নয়, ফেলুবাবু। ভদ্রলোক তরফদারকে আরও দশ হাজার ডলার অফার করেছিলেন। তার মানে ত্ৰিশ। আজকাল এক ডলারে কত টাকা?

সতেরোর আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে।

হিসেব করুন, গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠবে।

তরফদার কী বলেন?

তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তার ফলে বসাকের মেজাজ খিচড়ে যায়। তরফদারকে কিছু বলেননি, তবে আমাকে বললেন—আপনি ওই ভেলকিরামকে বলে দেবেন যে, বসাকের সংকল্পে ব্যাগড়া দেবে এমন লোক এখনও জন্মায়নি। শেষের কথাগুলো আরও সাংঘাতিক; বললেন—বড়দিনে মাদ্রাজে তরফদারের শো ওপন করছে; ইফ মাই নেম ইজ নন্দ বসাক—তা হলে সেই শো থেকে ওই খোকার আইটেম বাদ দিতে হবে। টেল দিস টু ইওর টিকটিকি ফ্রেন্ড।

ফেলুদার চেহারার সঙ্গে অনেক বাঙালিই পরিচিত, কাজেই বসাক যে তাকে চিনে ফেলবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবু কেন যেন আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল।

বসাকের হদিস তো তবু পাওয়া গেল, বলল ফেলুদা, তেওয়ারি ইজ আউট অফ দ্য পিকচার ) এখন বাকি তারকনাথ আর হজসন।

তারকনাথ কেন—গাওয়াঙ্গি বলুন! তারকনাথ খ্যাপাটে হতে পারেন, কিন্তু তাঁর যা বয়স তাতে তিনি এক কিছু করতে পারবেন না।

একেই ফেলুদা বলে টেলিপ্যাথি। তারকনাথের কথা ওঠার মিনিট খানেকের মধ্যেই কলিং বেল বাজায় দরজা খুলে দেখি স্বয়ং টি এন টি।

মিঃ মিত্তির আছেন? আসুন, আসুন, ভিতর থেকে বলল ফেলুদা। আপনিও দেখছি আমায় চিনে ফেলেছেন।

তা চিনব না কেন? ঘরে ঢুকে একটা কাউচে বসে বললেন ভদ্রলোক। আর আপনাকে যখন চিনেছি, তখন আপনার এই ল্যাংবোটটিকেও চিনেছি। আপনিই তো জটায়ু?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

একবার ভেবেছিলাম। আপনাকেও আমার আজব ঘরে এনে রাখব, কারণ গাঁজাখুরি গপ্পো লেখায় তো আপনি একমেবাদ্বিতীয়ম! হণ্ডুরাসে হাহাকার—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

ভদ্রলোকের এই ঘর-কাঁপানো হাসির সঙ্গে আবার নতুন করে পরিচয় হল।

তা হলে আপনার সঙ্গে মাদ্রাজে দেখা হচ্ছে? ফেলুদার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন তারক ঠাকুর।

আপনি যাওয়া স্থির করে ফেলেছেন?

শুধু আমি কেন? আমার ইউগ্যান্ডার অপোগগুটিও যাবেন! হাঃ হাঃ হাঃ-কেমন? ভাল হয়েছে? জটায়ু?

আপনি ট্রেনে যাচ্ছেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

তা ছাড়া তো উপায় নেই। প্লেনের সিটে তো গাওয়াঙ্গি বসতেই পারবে না!

আরেক দফা হো হো করে হেসে ভদ্রলোক উঠে পড়ে বললেন, আপনাকে একটা কথা বলি মিঃ মিত্তির-এমন অনেক সিচুয়েশান আছে, যেখানে শারীরিক শক্তির কাছে মানসিক শক্তি দাঁড়াতেই পারে না। গাওয়াঙ্গির চেয়ে আপনার বুদ্ধি যে অনেক গুণে বেশি তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আপনার ব্যায়ামের অভ্যাস থাকলেও, গাওয়াঙ্গিয় যে শারীরিক বল, তার শতাংশের একাংশও আপনার নেই। –গুড বাই।

ভদ্রলোক যেমন হঠাৎ এসেছিলেন, তেমনই হঠাৎ চলে গেলেন। আমি মনে মনে বললাম-এই গাওয়াঙ্গি বস্তুটিকে একবার চাক্ষুষ দেখতেই হবে।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়