একজনকে তো বিদায় করা গেল, বললেন তরফদার, এবার দ্বিতীয় ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা। পাংচুয়াল হলে তো আর দু-তিন মিনিটের মধ্যেই আসা উচিত।

দু মিনিট অপেক্ষা করতে হল না। নয়নকে ফেরত পাঠিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরকে যেতে হল সদর দরজায়। সে ফিরে এল সঙ্গে একটি কালো সুট পরা ভদ্রলোককে নিয়ে। তরফদার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, গুড মর্নিং। আপনার নামটা টেলিফোনে ঠিক ধরতে পারিনি। আপনি যদি…

তেওয়ারি, সোফায় বসে বললেন ভদ্রলোক, দেবকীনন্দন তেওয়ারি। টি এইচ সিন্ডিকেটের নাম শুনেছেন?

তরফদার, জটায়ু দুজনেই চুপ দেখে ফেলুদাকেই মুখ খুলতে হল।

আপনাদের ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের কারবার কি? পোলক স্ট্রিটে অপিস?

ইয়েস স্যার।

ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলেন বলে তরফদার আমাদের বিষয় ওঁকে বলে দিলেন।

এরা আমার তিনজন বিশিষ্ট বন্ধু। আশা করি এঁদের সামনে কথা বলতে আপনার কোনও আপত্তি হবে না।

নো, নো। তবে কথা মানে শুধু একটি প্রশ্ন। ওই ছেলেটিকে যদি একবার আমার সামনে উপস্থিত করেন, তা হলে আমি তাকে কেবলমাত্র একটি প্রশ্ন করব। জবাব পেলে আমার অশেষ উপকার হবে, আর আমার কাজও শেষ হবে।

দেখিয়ে বললেন, ইনি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবেন। দেখ। তার উত্তর দিতে পার কি না। তারপর তেওয়ারির দিকে ফিরে বললেন, আপনার প্রশ্নের উত্তর সংখ্যায় হবে। তো? অন্য কোনও প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এ দিতে পারবে না।

আই নো, আই নো। আমি জেনেশুনেই এসেছি।

তারপর—লালমোহমনবাবুর ভাষায়—নয়নের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবন্ধ করে ভদ্রলোক বললেন, আমার সিন্দুকের কম্বিনেশনটা কী সেটা বলতে পার?

নয়ন ফ্যাল ফ্যাল করে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে আছে দেখে ফেলুদা বলল, শোনো জ্যোতিষ্ক—কম্বিনেশন জিনিসটা কী সেটা বোধহয় তুমি জান না। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। একরকম সিন্দুক হয় যাতে তালাচাবি থাকে না। তার বদলে ডালার এক পাশে একটা চাকতি থাকে। যেটাকে ঘোরানো যায়। এই চাকতির গায়ে একটা তীর আঁকা থাকে, আর চাকৃতিটাকে ঘিরে সিন্দুকের গায়ে এক থেকে শূন্য অবধি নম্বর লেখা থাকে। কম্বিনেশন হল সিন্দুক খালার একটা বিশেষ নম্বর। চাকতিটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পর-পর সেই নম্বরের পাশে তীরটাকে আনলে শেষ নম্বরে পৌঁছতেই ঘড়াৎ করে সিন্দুক খুলে যায়—বুঝেছ?

বুঝেছি।

এখানে জটায়ু দুম করে একটা বেশ লাগসই প্রশ্ন করলেন তেওয়ারিকে।

আপনার নিজের সিন্দুকের কম্বিনেশন আপনি নিজেই জানেন না?

তেইশ বছর ধরে জেনে এসেছি, আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন তেওয়ারি। স্বভাবতই মুখস্থ ছিল। ক হাজার বার সে সিন্দুক খুলেছি তার কি হিসাব আছে? কিন্তু বয়স যেই পঞ্চাশ পেরিয়েছে আমনি স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে শুরু করেছে। আজ চার দিন থেকে নম্বরটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। একটা ডায়রিতে লেখা ছিল, বহু পুরনো ডায়রি—সেটা যে কোথায় গেছে। জানি না। আমি হয়রান হয়ে শেষে এই ছেলের খবর পেয়ে মিস্টার তরফদারের সঙ্গে অ্যাপায়েন্টমেন্ট করি।

আপনি কি আর-কাউকে কোনওদিন নম্বরটা বলেননি? আবার প্রশ্ন করলেন জটায়ু। ফেলুদার দিকে আড়াচাখে চেয়ে তার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে বুঝলাম সে জটায়ুকে তারিফ করছে।

তেওয়ারি বললেন, আমার ধারণা আমার পার্টনারকে বলেছিলাম—বহুকাল আগে অবশ্য-কিন্তু সে অস্বীকার করছে। হয়তো এও আমার স্মৃতিভ্ৰম। কম্বিনেশন তো আর পাঁচজনকে বলে বেড়াবার জিনিস নয়, আর এ-সিন্দুক হল আমার প্যাসোনাল সিন্দুক। আমার যে টাকা ব্যাঙ্কে নেই তা সবই এই সিন্দুকে আছে। অথচ…

তেওয়ারির দৃষ্টি সোফার পাশে দাঁড়ানো নয়নের দিকে ঘুরল। সঙ্গে সঙ্গে নয়ন বলল, সিক্স ফোর থ্রি এইট নাইন সিক্স ওয়ান।

রাইট! রাইট! রাইট! উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন তেওয়ারি। আর সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা ছোট্ট নোটবুক বার করে ডটপেন দিয়ে তাতে নম্বরটা লিখে নিলেন।

আপনার সিন্দুকে কত টাকা আছে সেটা আপনি জানেন? প্রশ্ন করলেন তরফদার।

এগজ্যাক্ট অ্যামাউন্টটা জানি না। বললেন তেওয়ারি, তবে যত দূর মনে হয়—লাখ চারেক তো হবেই।

এ কিন্তু বলে দিতে পারে, নয়নের দিকে দেখিয়ে বললেন তরফদার। আপনি জানতে চান?

তা কৌতুহল তো হয়ই।

তেওয়ারি ঠোঁটের কোণে হাসি আর চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে নয়নের দিকে চাইলেন।

টাক্লা-পয়সা কিছু নেই, বলল নয়ন।

হোয়াট!

তেওয়ারি সোফা থেকে প্রায় তিন ইঞ্চি লাফিয়ে উঠলেন। তারপর উত্তেজনা সামলে নিয়ে মুখে একটা বিরক্ত ভাব এনে বললেন, বোঝাই যাচ্ছে এই বালক সব ব্যাপারে রিলায়েবল নয়। এনিওয়ে, কম্বিনেশনটায় ভুল নেই। ওটা জানতে পেরে সত্যিই আমার উপকার হয়েছে।

তেওয়ারি দাঁড়িয়ে উঠে পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা গোলাপি কাগজে মোড়া সরু লম্বা প্যাকেট বার করে নয়নের হাতে দিয়ে বলল, দিস ইজ ফর ইউ, মাই বয়।

তেওয়ারিকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে তরফদার ফিরে আসতে ফেলুদা নয়নকে বলল, ওটা খুলে দেখো তো ওতে কী আছে।

প্যাকেট খুলতে বেরোল একটা ছোটদের রিস্টওয়াচ।

বাঃ! বললেন জটায়ু। এটা পরে ফেলো নয়ন ভাই, পরে ফেলো।

নয়ন ঘড়িটা হাতে পরে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

সিন্দুক খুলে তেওয়ারি সাহেবের প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে, বলল ফেলুদা।

সিন্দুকে যদি সত্যিই কিছু থেকে না থাকে, বললেন জটায়ু, তা হলে তেওয়ারি নিশ্চয়ই ওঁর পার্টনারকেই সন্দেহ করবেন?

 

ফেলুদা যেন মন থেকে ব্যাপারটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। তরফদারের দিকে ফিরে বলল, তোমরা যে দক্ষিণ ভারত সফরে যাচ্ছ, সেটা কীসে যাবে? ট্রেনে, না প্লেনে?

ট্রেনে অবশ্যই। সঙ্গে এত লটবহার, ট্রেন ছাড়া উপায় কী?

নয়নকে সামলাবার কী ব্যবস্থা করছি?

ট্রেনে তো আমিই সঙ্গে থাকব; কিছু হবে বলে মনে হয় না। ওখানে পৌঁছে আমি ছাড়া একজন আছে যে ওকে সব সময়ে চোখে চোখে রাখবে। সে হল আমার ম্যানেজার শঙ্কর।

কথা হয়তো আরও চলত, কিন্তু ঠিক এই সময়ে চাকর একটি প্যান্ট-কোট-টাই পরা ভদ্রলোককে এনে হাজির করলেন। বুঝলাম ইনি নাম্বার থ্রি।

গুড মনিং। আই মেড অ্যান অ্যাপয়েন্টমেন্ট উইথ—

মি, বললেন তরফদার। মাই নেম ইজ তরফদার।

আই সি। মই নেম ইজ হজসন। হেনরি হজসন।

প্লিজ সিট ডাউন।

তরফদারও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন; এবার দুজনেই একসঙ্গে বসলেন।

হজসনের গায়ের যা রং, তাঁকে সাহেব বলা মুশকিল। তাও ইংরিজি ছাড়া গতি নেই।

এঁরা কারা প্রশ্ন করতে পারি কি? পর পর আমাদের তিনজনের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন হজসন।

আমার খুব কাছের লোক। আপনি এঁদের সামনে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন।

হুম।

ভদ্রলোকের মেজাজ যে তিরিক্ষি, সেটা তাঁর পামানেন্টলি কুঁচকে থাকা ভুরু থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছিল।

আমার এক পরিচিত বাঙালি ভদ্রলোক লাস্ট সানডে তোমার ম্যাজিক দেখেছিল। সে একটি ছেলের আশ্চর্য ক্ষমতার কথা বলে। আমি অবিশ্যি তার কথা বিশ্বাস করিনি। আমি ঈশ্বর মানি না; তাই অলৌকিক শক্তিতেও আমার বিশ্বাস নেই। ইফ ইউ ব্রিং দ্যাট বয় হিয়ার—আমি ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই।

তরফদার যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও চাকরকে ডেকে পাঠালেন।

নারায়ণ, আরেকবার যাও তো—খোকাবাবুকে ডেকে আনো।

নয়ন মিনিট খানেকের মধ্যে হাজির।

সো দিস ইজ দ্য বয়?

হজসন নয়নের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আমাদের এখানে ঘোড়দৌড় হয় তুমি জান?

তরফদার সেটা বাংলা করে নয়নকে বললেন।

জানি, পরিষ্কার গলায় বলল নয়ন।

গত শনিবার রেস ছিল, বলল। হজসন। তিন নম্বর রেসে কত নম্বর ঘোড়া জিতেছিল, বলতে পার?

এটাও অনুবাদ হল নয়নের জন্য।

ফাইভ-এক মুহূর্ত না ভেবে বলে দিল নয়ন।

এক জবাবেই কেল্লা ফতে। সোফা থেকে উঠে প্যান্টের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভেরি ষ্ট্রেঞ্জ বলে এপাশ ওপাশ পায়চারি করতে লাগলেন। হজসন সাহেব। তারপর হঠাৎ থেমে তরফদারের দিকে সোজা দৃষ্টি দিয়ে বললেন, অল আই ওয়ান্ট ইজ দিস—আমি সপ্তাহে একবার করে এখানে এসে এর কাছ থেকে জেনে যাব সামনের শনিবার কোন রেসে কত নম্বর ঘোড়া জিতবে। সোজা কথায় বলছি—রেস আমার নেশা। অনেক টাকা খুইয়েছি, তাও নেশা যায়নি। কিন্তু আর হারলে দেনার দায়ে আমাকে জেলে পুরবে। তাই এবার থেকে শিওর হয়ে বেট করতে চাই। দিস বয় উইল হেলপ মি।

হাউ ক্যান ইউ বি সো শিওর? ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন তরফদার।

হি মাস্ট, হি মাস্ট, হি মাস্ট! বাঁ হাতের তেলের ওপর ডান হাত দিয়ে পর পর তিনটে ঘুষি মেরে বললেন। হজসন সাহেব।

নো-হি মাস্ট নট, দৃঢ়স্বরে বললেন তরফদার। অসাধু উদ্দেশ্যে কোনওরকমে ব্যবহার করা চলবে না। এই বালকের ক্ষমতা! এ ব্যাপারে আমার কথার এক চুল নড়াচড় হবে না।

এবারে হজসনের চেহারা হয়ে গেল ভিখিরির মতো। হাত দুটো জোড় করে ভদ্রলোক কাতর সুরে বললেন, অন্তত আগামী রেসের উইনারের নামগুলো বলে দিক! প্লিজ।

না হেল্প ফর গ্যাম্বলারুস, না হেলপ ফর গ্যাম্বলারস্! আশ্চর্য শুদ্ধ ইংরেজিতে ঘন ঘন মাথা নেড়ে বললেন জটায়ু।

হজসন সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন, তাঁর মুখ বেগুনি।

তোমাদের মতো এমন চ্যাঁটা আর মুর্খ লোক আমি আর দেখিনি, ড্যাম ইট!

কথাটা বলে আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে হজসন গটগটিয়ে সদর দরজার দিকে চলে গেলেন।

বিশ্ৰী লোক! হরিবল ম্যান! নাক কুঁচকে চাপা গলায় বললেন জটায়ু।

তরফদার নিয়নকে ঘিরে পাঠিয়ে দিলেন।

বিচিত্র সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট, বলল ফেলুদা। হজসন অবিশ্যি শুধু জুয়াড়ি নন, তিনি নেশাও করেন। আমি কাছে বসেছিলাম। তাই গন্ধটা সহজেই পাচ্ছিলাম। ওঁর যে দৈন্যদশা সেটা ওঁর কোটের আস্তিনের কনুই দেখলেই বোঝা যায়। ভাঁজ খেয়ে খেয়ে কোটের ওইখানটাই সবচেয়ে আগে জখম হয়। একে তাপ্লি লাগাতে হয়েছে, কিন্তু নতুন কাপড়ের সঙ্গে পুরনো রং বা কোয়ালিটি কোনওটাই মেলেনি। তা ছাড়া ভদ্রলোককে যে বাসে বা ট্রামে আসতে হয়েছে সেটা ওঁর ডান পায়ের কালো জুতোর ডগায় অন্য কারুর জুতোর আংশিক ছাপ দেখেই বোঝা যায়। এ জিনিস ট্যাক্সি বা মেট্রোতে হয় না।

এগুলো অবিশ্যি শুধু ফেলুদারই চোখে ধরা পড়েছে।

বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ পেয়ে আমরা আবার টান হয়ে বসলাম।

নাম্বার ফোর, বলল ফেলুদা।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়