সমাদ্দারের চাবি – ৩

ফেলুদা মণিমোহনবাবুর কাছ থেকে দুদিন সময় চেয়ে নিয়েছিল। চাইতেই হবে, কারণ রাধারমণবাবুর বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনও চাবি, বা চাবি দিয়ে খোলা যায় এমন কোনও বাক্স বা ওই ধরনের কিছু পাওয়া যায়নি। তাই ফেলুদা বলল, এক নম্বর, ওকে চুপচাপ বসে চিন্তা করতে হবে; দুই নম্বর, রাধারমণবাবুর কাগজপত্র ঘেঁটে লোকটা সম্বন্ধে আরও কিছু জানা যায় কি না দেখতে হবে, আর তিন নম্বর, গান বাজনা সম্বন্ধে আরেকটু ওয়াকিবহাল হতে হবে।

বামুনগাছি থেকে ফেরার পথে মণিমোহনবাবু বললেন, ‘কী রকম বুঝছেন মিস্টার মিত্তির?’

ফেলুদা তার গম্ভীর ও অন্যমনস্ক ভাবটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ‘আপনাকে কতগুলো সন তারিখের ব্যাপারে একটু হেলপ করতে হবে।’

‘বলুন।’

‘আপনার খুড়তুতো দাদা – অথাৎ রাধারমণবাবুর ছেলে মুরলীধর – কবে মারা গেছেন?’

‘ফিটি ফাইভে। আটাশ বছর আগে।’

‘তখন তাঁর ছেলের বয়স কত ছিল?’

‘ধরণীর? ধরণীর বয়স ছিল সাত কিংবা আট।’

‘ওরা কলকাতাতেই থাকত?’

‘না। দাদা ভাগলপুরে ডাক্তারি করতেন। উনি মারা যাবার পর বউদি ছেলেদের নিয়ে কলকাতায় এসে শ্বশুরবাড়িতে ওঠেন। তখন বাবা ছিলেন অ্যামহাস্ট স্ট্রিটে। অ্যামহাস্ট স্ট্রিটেই বউদি মারা যান। ধরণী তখন সিটি কলেজে পড়ছে। মা মারা যাবার পর থেকেই তার মতিগতি বদলে যায়। সে পড়াশুনো ছেড়ে থিয়েটারে টোকে। আর তার বছরখানেক পরে কাকাও চলে গেলেন বামুনগাছি। ওঁর বাড়িটা তৈরি হয়েছিল –’

‘ফিফটি-নাইনে। গেটের গায়ে ডেট লেখা রয়েছে।’

রাধারমণবাবুর কাগজপত্রের মধ্যে ছিল কিছু পুরনো চিঠি, কিছু ক্যাশ মেমো, দুটাে ওষুধের প্রেস্‌ক্রিপশন, স্পীগ্‌লার নামে একটা জামান কোম্পানির পুরনো ক্যাটালগ — তাতে নানারকম বাজনার ছবি ও দাম—-খাতার কাগজে লেখা কয়েকটা বাংলা গানের স্বরলিপি, খবরের কাগজ থেকে নানান সময়ে কাটা পাঁচটা নাটকের সমালোচনা – সেগুলোতে সঞ্জয় লাহিড়ী বলে একজন অভিনেতার প্রশংসা নীল পেন্সিলে আন্ডারলাইন করা।

এর মধ্যে তিনটি জিনিস নিয়ে ফেলুদা মন্তব্য করল। স্বরলিপিগুলো দেখে বলল, ‘সুরজিৎবাবু যে পোস্টকার্ডটা দেখালেন, তার হাতের লেখার সঙ্গে এ লেখা মিলে যাচ্ছে।’ ক্যাটালগটা দেখে বলল, ‘মেলোকর্ড বলে কোনও যন্ত্রের নাম এতে দেখছি না।’ আর থিয়েটারের সমালোচনাগুলো দেখে বলল, যদ্দূর মনে হচ্ছে, এই সঞ্জয় লাহিড়ী আর ধরণীধর সমাদ্দার একই লোক। আর তাই যদি হয় তা হলে বলতে হবে নাতির মুখ না দেখলেও তার সম্বন্ধে খোঁজ-খবরটা রাখতেন রাধারমণবাবু।’

কাগজগুলো সযত্নে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে রেখে ফেলুদা থিয়েটারের পত্রিকা ‘মঞ্চলোক’-এ টেলিফোন করে সঞ্জয় লাহিড়ী কোন যাত্রার দলে আছে জিজ্ঞেস করল। জানা গেল দলের নাম মডার্ন অপেরা। সেখানে সঞ্জয় লাহিড়ী হিরোর পার্ট করে। তারপর মডার্ন অপেরার অফিসে ফোন করে জানা গেল যাত্রার দল তিন সপ্তাহ হল জলপাইগুড়ি ট্যুরে বেরিয়ে গেছে। ফিরতে আরও দিন সাতেক। এ খবরটা অবিশ্যি মণিবাবু আগেই দিয়েছিলেন।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে আমরা বেরোলাম। একদিনে একসঙ্গে এতরকম জায়গায় অনেকদিন যাইনি। প্রথমে জাদুঘর। কেন যাচ্ছি আগে থেকে জানি না, কারণ ফেলুদার এখন মৌনীপর্ব। তার উপরে মাঝে মাঝে আঙুল মটকাচ্ছে। বোঝাচ্ছে সে ভীষণ মন দিয়ে ভাবছে, তাই ডিসটর্ব করা চলবে না। জাদুঘরে যে এরকম একটা বাজনার সংগ্রহ আছে সেটা জানতাম না। অবিশ্যি সবই দিশি বাজনা – একেবারে মহাভারতের যুগ থেকে আজকের যুগ পর্যন্ত। শুধু বীণাই যে এতরকম হতে পারে তা আমার ধারণা ছিল না।

এর পরে বিলিতি বাজনার দোকান। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের সালদানহা কোম্পানি বলল মেলোকর্ডের নাম কখনও শোনেনি। সেখান থেকে গেলাম লালবাজারে। লালবাজারের মণ্ডল কোম্পানির একটা ক্যাশমেমো রাধারমণবাবুর কাগজপত্তরের মধ্যে ছিল, তাই বোধহয় ফেলুদা সেখানে গেল। দোকানের মালিক একেবারে জহর রায়ের মতো দেখতে। বললেন, ‘সমাদ্দার মশাই আমাদের অনেকদিনের খদের। সেই আমার ফাদারের টাইম থেকে।’

‘মেলোকর্ড বলে কোনও যন্ত্রের নাম শুনেছেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘মেলোকর্ড? কই, না তো। ক্ল্যারিয়োনেট টাইপের কিছু? ফু দেওয়া যন্ত্র? উইন্ড ইনষ্ট্রমেন্ট?’

ফেলুদা বলল, না। বলতে পারেন হরমোনিয়াম টাইপের। সাইজে অনেক ছোট।। আওয়াজটা পিয়ানো আর সেতারের মাঝামাঝি।’

‘ছোট সাইজের বাজনা? তাতে কটা অকটেভ পাচ্ছেন আপনি?

আমি জানি যে সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা – এই আটটা সুরে মিলে একটা অকটেভ হয়। মণ্ডলের দোকানেই একটা হারমোনিয়ামে দেখছি তিন অকটেভের বেশি পদ রয়েছে। মেলোকর্ডে মাত্র একটা অকটেভ রয়েছে শুনে মণ্ডল মাথা নেড়ে বললেন, ‘না মশাই। এ শুনে মনে হচ্ছে খেলনা-টেলনা ধরনের কিছু হবে। আপনি বরঞ্চ নিউ মার্কেটে দেখুন।’

এর পরে ফেলুদা কলেজ স্ট্রিটের দাশগুপ্তের দোকান থেকে উনিশ টাকা দিয়ে তিনটে সংগীতের বই কিনল। তারপর সেখান থেকে বিধান সরণিতে মঞ্চলোকের অফিসে গিয়ে অনেক খুঁজে সঞ্জয় লাহিড়ীর একটা দুমড়ানো ছবি চেয়ে নিল। দাম দিতে হবে কি না জিজ্ঞেস করতে সম্পাদক প্রতুল হাজরা জিভ কেটে বলল, ‘দামের কথা কী বলছেন। আপনি ফেলুমিত্তির না?’

রাস্তার মোড়ের একটা দোকান থেকে ঠাণ্ডা লস্যি খেয়ে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরতে হয়ে গেল সাড়ে সাতটা। এসে দেখি পাড়া ঘুরঘুট্টি, লোড-শেডিং চলছে। ফেলুদা তার মধ্যেই মোমবাতি জ্বলিয়ে গানের বইগুলো উলটে-পালটে দেখতে লাগল। ন’টায় আলো আসার পর বলল, ‘তোপসে – তুই শ্রীনাথকে নিয়ে চট করে একবারটি পটুদের বাড়ি চলে যা তো—গিয়ে বল ফেলুদা একদিনের জন্যে হারমোনিয়ামটা চেয়েছে।’

ঘুমোবার আগে পর্যন্ত শুনলাম ফেলুদা প্য প্যা করে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে।

রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম একটা প্রকাণ্ড ঘরে একটা প্রকাণ্ড লোহার দরজা, আর তাতে একটা প্রকাণ্ড ফুটো। ফুটোটা এত বড় যে তার মধ্যে দিয়ে অনায়াসে উলটো দিকে চলে যাওয়া যায়, কিন্তু তা না করে আমি, ফেলুদা আর মণিমোহনবাবু তিনজনে একসঙ্গে একটা প্রকাণ্ড চাবিকে আঁকড়ে ধরে সেটাকে ফুটোটার মধ্যে ঢোকাতে চেষ্টা করছি আর সুরজিৎ দাশগুপ্ত একটা আলখাল্লা পরে তিড়িং-বিড়িং লাফাচ্ছেন আর সুর করে বলছেন, এইট টু নাইন ওয়ান — ‘এইট টু নাইন ওয়ান – এইট টু নাইট ওয়ান?’

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়