রামমোহন রায় সরণিতে সোমেশ্বর বর্মনের পেল্লায় বাড়ি। এরা আগে পূর্ববঙ্গের জমিদার ছিলেন, অনেকদিন থেকেই কলকাতায় চলে এসেছেন। এখন বাড়িতে অধিকাংশ ঘরই খালি পড়ে আছে। বাড়িতে চাকর বাদে লোক মাত্র পাঁচজন। সোমেশ্বর বর্মন, তাঁর ছেলে নিখিল, মিঃ বৰ্মনের সেক্রেটারি প্রণবেশ রায়, মিঃ বৰ্মনের বন্ধু অনিমেষ সেন, আর রণেন তরফদার বলে এক শিল্পী। ইনি নাকি সোমেশ্বরবাবুর একটা পোট্রেট করছেন। এসব খবর আমরা সোমেশ্বরবাবুর কাছ থেকেই পেলাম। ভদ্রলোকের বয়স ধরা যায় না। কারণ চুল এখনও তেমন পাকেনি, চোখ দুটো উজ্জ্বল, যেমন জাদুকরের হওয়া উচিত। আমরা একতলায় সোফায় বসেছিলাম। নিখিলবাবু আমাদের জন্য চায়ের অর্ডার দিলেন।

আমার বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার! বললেন সোমেশ্বরবাবু, ভাল পসার ছিল। আমি ল পড়েছিলাম, কিন্তু সেদিকে আর যাইনি। আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন তান্ত্রিক। হয়তো তাঁরই কিছুটা প্রভাব আমার চরিত্রে পড়েছিল। আমি ছোটবেলা থেকেই ভারতীয় জাদুবিদ্যায় ঝুঁকি। এলাহাবাদে একটা পার্কে এক বুড়োর ম্যাজিক দেখেছিলাম। তার হাত-সাফাইয়ের কোনো তুলনা নেই। মঞ্চের ম্যাজিকের অর্ধেকই আজ যন্ত্রপাতির সাহায্যে হয়, সেইজন্য তাতে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। ভারতীয় ম্যাজিক হল আসল ম্যাজিক, যেখানে মানুষের দক্ষতই সম্পূর্ণ কাজটা করে। তাই আমি কলেজের পড়া শেষ করে, এইসব ম্যাজিক সংগ্ৰহ করতে বেরিয়ে পড়ি। সুবিধে ছিল বাবা এসব বিষয়ে খুব উদার ছিলেন। আমি একটা নতুন কিছু করছি, এটাতে তিনি খুশিই হয়েছিলেন। আসলে আমাদের পরিবারে নানান লোকে নানান কাজ করে এসেছে চিরকালই। ডাক্তার, উকিল, গাইয়ে, অভিনেতা, সাহিত্যিক—সবরকমই পাওয়া যাবে আমাদের এই বৰ্মন পরিবারে, আর তাদের মধ্যে অনেকেই রীতিমতো সফল হয়েছেন। যেমন আমি হয়েছিলাম জাদুতে। আমার সব রাজা-রাজড়াদের কাছ থেকে ডাক আসত। প্রাসাদের ঘরে ফরাসের উপর বসে ম্যাজিক দেখাতাম—সব লোক হাঁ হয়ে যেত। রোজগারও হয়েছে ভাল। কোনও ধরাবাঁধা ফি ছিল না। আমার। কিন্তু যা পেতাম, সেটা প্ৰত্যাশার অনেক বেশি।

চা এসে গিয়েছিল। ফেলুদা একটা কাপ তুলে নিয়ে বলল, এবার আপনার পাণ্ডুলিপির কথা বলুন। শুনেছি, ভারতীয় জাদু নিয়ে আপনি একটা বড় কাজ করেছেন।

তা করেছি, বললেন সোমেশ্বর বর্মন, আমি যা করেছি, তেমন আর-কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই। এ-নিয়ে আমি প্ৰবন্ধ-টবন্ধও লিখেছি, এবং তার ফলেই আমার পাণ্ডুলিপির ব্যাপারটাও জানাজানি হয়ে গোসল। সেই কারণে সূৰ্যকুমার আমার কাছে আসে। নইলে তার তো জানার কথা নয়। অবিশ্যি জাদুকর হিসেবে সে আমার নাম আগেই শুনেছে।

সে কি আপনার পাণ্ডুলিপিটা কিনতে চায়?

তই তো বলে। সে সোজা আমার বাড়িতে চলে এসেছিল। আমার বেশ ভাল লাগে। ছেলেটিকে, দেখেছি কেমন একটা স্নেহ পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর অফারটায় আমি ঠিক রাজি হতে পারছি না। আমার ধারণা আমার কাজটা খুব জরুরি কাজ, এবং তার মূল্য বিশ হাজারের চেয়ে অনেক বেশি। সেইজন্যেই চাচ্ছিলাম পাণ্ডুলিপিটা আপনি একটু পড়ে দেখুন। আপনার তো নানান বিষয় পড়াশোনা আছে। সেটা আপনার কেসগুলো সম্বন্ধে পড়ে দেখলেই বোঝা যায়।

বেশ তো। আমি সাগ্রহে পড়বা আপনার লেখা।

সোমেশ্বরবাবু তাঁর সেক্রেটারির দিকে ফিরে বললেন, প্ৰণবেশ, যাও তো খাতাটা একবার নিয়ে এসো।

সেক্রেটারি চলে গেলেন আজ্ঞা পালন করতে।

ফেলুদা বলল, আমরা কাল সূৰ্যকুমারের ম্যাজিক দেখতে গিয়েছিলাম।

কেমন লাগল?

মোটামুটি বলল ফেলুদা, তবে ভদ্রলোক হিপনোটিজমটা বেশ আয়ত্ত করেছেন। আর যা ম্যাজিক, সবই যন্ত্রের কারসাজি।

সোমেশ্বরবাবু হঠাৎ সামনের প্লেট থেকে একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে, সেটা হাতের মুঠোয় বন্ধ করে, পরমুহূর্তেই হাত খুলে দেখালেন বিস্কুট হাওয়া। তারপর সেটা বেরোল লালমোহনবাবুর পকেট থেকে।

ফেলুদা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

আপনি ম্যাজিক বন্ধ করে দিলেন কেন? আপনার তো অদ্ভুত হাত!

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, আমি এখন পাণ্ডুলিপিটা নিয়েই কাজ করব। বইটা ছাপাতে

রলে মনে হয় কাজ দেবে। এ নিয়ে তো বই আর লেখা হয়নি।

তা হলে আমি খাতাটা নিলাম! বলল ফেলুদা, আমি পরশু ফেরত দেব। এইরকম সন্ধ্যাবেলা।

বেশ, তাই কথা রইল।

 

ফেলুদা পরদিন সকালেই বলল, তার নাকি পাণ্ডুলিপি পড়া শেষ হয়ে গেছে। সে সারারাত পড়েছে। ভদ্রলোকের হাতের লেখা মুক্তোর মতো—অ্যান্ড ইট্‌স এ গোল্ডমাইন। ছেপে বেরোলে, একটা প্রামাণ্য বই হয়ে থাকবে। বিশ কেন, পঞ্চাশ হাজার দিলেও এ পাণ্ডুলিপি হাতছাড়া করা উচিত নয়।

সন্ধ্যাবেলা সোমেশ্বরবাবুকে গিয়ে আমরা সেই কথাটাই বললাম। ভদ্রলোক শুনে যেন অনেকটা আশ্বস্ত হলেন। বললেন, আপনি আমার মান থেকে একটা বিরাট চিন্তা দূর করে। দিলেন। আমি দোষ্টানার মধ্যে পড়েছিলাম, কিন্তু আপনি যখন পড়ে এত প্রশংসা করলেন, তখন আবার আমি মনে বল পাচ্ছি। প্ৰণবেশ পাণ্ডুলিপিটাকে টাইপ করছে–ও-ও অনেকবার বলেছে। যে এতে আশ্চর্য সব তথ্য আছে। আমার বন্ধু অনিমেষও সেই একই কথা বলেছে। এবার নিশ্চিন্তে সূৰ্যকুমারকে না বলে দিতে পারব। ভাল কথা, কাল আমার ঘরে চোর এসেছিল।

সে কী?

আমার ঘুমটা ভেঙে যায়! আমি কে? বলতেই পলায়।

এর আগে কখনও চুরি হয়েছে কি?

কক্ষনও না।

আপনার ঘরে কোনও ভ্যালুয়েবল জিনিস আছে কি?

আছে। কিন্তু সেটা আমার সিন্দুকে থাকে। সিন্দুকের চাবি আমার বালিশের নীচে থাকে। আর সেটা সম্বন্ধে আমার বাড়ির লোকেরা কেউ জানে না।

আমি জানতে পারি কি? আমার অদম্য কৌতুহল হচ্ছে।

নিশ্চয়ই পারেন।

ভদ্রলোক উঠে দোতলায় গেলেন। তারপর মিনিট তিনেক পরে এসে একটা ছাঁইঞ্চি লম্বা জিনিস আমাদের সামনে টেবিলের উপর রাখলেন। সেটা একটা বংশীবাদক শ্ৰীকৃষ্ণের মূর্তি।

পঞ্চরত্নের তৈরি! বললেন সোমেশ্বরবাবু, তার মানে হিরে, পদ্মরাজ, নীলকান্ত, প্রবাল আর মুক্তো এর কত দাম জানি না।

অমূল্য, বলল ফেলুদা। এবং অপূর্ব জিনিস। এ-জিনিস কবে থেকে আছে?

এটা পাই রঘুনাথপুরের রাজা দয়াল সিং-এর কাছে। নাইনটিন ফিফটি সিক্সে। আমার ম্যাজিক দেখে খুশি হয়ে দেন। আমাকে জিনিসটা।

আপনাদের বাড়িতে দারোয়ান নেই?

তা আছে বইকী। তা ছাড়া চারজন চাকর আছে। চোরের মনে হয়। চাকরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।

যদি না চোর বাড়ির লোক হয়।

এ যে আপনি সব্বনেশে কথা বলছেন!

আমরা গোয়েন্দারা এরকম কথা বলে থাকি। সেটা সিরিয়াসলি নেবার কোনও দরকার নেই।

তাও ভাল।

আপনি বোধহয় বিপত্নীক?

হ্যাঁ।

আপনার ওই একটিই ছেলে?

না। নিখিল আমার ছোট ছেলে। বড়টি-অখিল-উনিশ বছর বয়সে বি. এ. পাস করে বিদেশে চলে যায়।

কোথায়?

সেটা বলে যায়নি। আমাদের ফ্যামিলিতে ভবঘুরেও রয়েছে কিছু কিছু। অখিল ছিল তাদের মধ্যে একজন। অস্থির চরিত্র। বলল, জার্মানি গিয়ে চাকরি করবে। তারপর বেরিয়ে পড়ল। এ হল নাইনটিন সেভেনটির কথা। তারপর আর কোনও যোগাযোগ করেনি। ইউরোপেই কোথাও আছে হয়তো, কিন্তু জানিবার কোনও উপায় নেই।

আপনার সেক্রেটারি প্রণবেশ এই কৃষ্ণটার কথা জানেন?

হ্যাঁ। সে তো আমার ঘরের ছেলের মতোই। আর তাকে তো আমার সব কাগজপত্র, করেসপন্ডেনস ঘাঁটতে হয়।

যাই হাক, এবার এটা তুলে রেখে দিন। এমন চমৎকার জিনিস। আমি কমই দেখেছি।

আমি তা হলে সূৰ্যকুমারকে না বলে দিই।

নির্দ্ধিধায়।

ফেলুদা উঠে পড়ল।

আমি একবার বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখতে চাই। চোর কোন কোন জায়গা দিয়ে আসতে পারে, সেটা একবার দেখা দরকার।

সবচেয়ে সুবিধে বারান্দা দিয়ে! আসলে আমার দারোয়ান একটু কর্তব্যে টিলে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

বাড়ির বারান্দা যে দিকে, সে দিকেই একটা বাগান রয়েছে। তবে সেটাকে খুব যত্ন করা হয় বলে মনে হল না। বাড়ির চারিদিকে বেশ উঁচু কম্পাউন্ড ওয়াল, সেটা টপকে পেরোনো সহজ নয়। দেয়ালের দুধারে গাছপালাও বিশেষ নেই।

ফেলুদা মিনিট পনেরো ঘোরাঘুরি করে বলল, চোর সম্বন্ধে ঠিক শিওর হওয়া গেল না। বাড়ির চোর না বাইরের চোর, সে-বিষয়ে সংশয় রয়ে গেল।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়