সন্ধ্যা ছটা নাগাত আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পায়ে হেঁটে ঘুরে না দেখলে নতুন শহর দেখা হয় না, এটা আমরা তিনজনেই বিশ্বাস করি। যোধপুর, কাশী, দিল্লি, গ্যাংটক-সব জায়গাতেই আমরা এ জিনিসটা করেছি। বম্বেতেই বা করব না কেন?

হোটেল থেকে বেরিয়ে ডান দিকে কিছু দূর গেলেই যাকে কেম্পাস কর্নার বলে, সেখানে একটা দুর্দান্ত ফ্লাইওভার পড়ে; প্রকাণ্ড প্ৰকাণ্ড তাগড়াই থামের উপর দিয়ে ব্রিজের মতো রাস্তা, তার উপরেও ট্রাফিক, নীচেও ট্রাফিক। আমরা ব্রিজের তলা দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গিবস রোড় দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলেছি। ফেলুদা ডান দিকে দেখিয়ে দিল পাহাড়ের গা দিয়ে হ্যাংগিং গার্ডনস যাবার রাস্তা। এই পাহাড়ের নামই মালাবার হিলস!

মাইলখানেক এগিয়ে যেতে সামনে সমুদ্র পড়ল। আপিস ফেরত গাড়ির স্রোত এড়িয়ে রাস্তা পেরিয়ে এক কোমর উঁচু পাথরের পাঁচিলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাঁচিলের পিছন দিকে সমুদ্রের জল এসে আছড়ে আছড়ে পড়ছে।

রাস্তাটা বাঁদিক দিয়ে সোজা পুবে চলে গিয়ে গোল হয়ে ঘুরে শেষ হয়েছে সেই একেবারে দক্ষিণে, যেখানের আকাশছোঁয়া বাড়িগুলো ঝাপসা হয়ে আছে বিকেলের পড়ন্ত রোদে। ওই ধনুকের মতো রাস্তাটা নাকি ম্যারিন ড্রাইভ।

লালমোহনবাবু বললেন, স্মাগলারই বলুন আর যাই বলুন-পাহাড় আর সমুদ্র মিলিয়ে বম্বে একেবারে চ্যাম্পিয়ন শহর মশাই।

পাঁচিলের ধার দিয়ে আমরা ম্যারিন ড্রাইভেক্স দিকে এগোতে লাগলাম! বা দিক দিয়ে পিঁপড়ের সারির মতো গাড়ি চলেছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর লালমোহনবাবু আর একটা মন্তব্য করলেন।

এখানে বোধহয় সি এম ডি এ নেই; আছে কি?

রাস্তায় খানাখন্দ নেই বলে বলছেন তো?

এয়ারপোর্ট থেকে আসার সময়ই লক্ষ করছিলুম যে, গাড়িতে চলেছি অথচ লাফাচ্ছি না। অবিশ্বাস্য?

কিছুক্ষণ থেকেই সমুদ্রের ধারে একটা জায়গায় ভিড় লক্ষ করছিলাম। যেমন রবিবার আমাদের শহিদ মিনারের নীচে হয়, অনেকটা সেই রকম। আরও কাছে যেতে ফেলুদা বলল জায়গাটার নাম চৌপাট্টি। এখানে রোজই নাকি রথের মেলার মতো ভিড় হয়। সার-বাঁধা দোকান, দেখেই মনে হয় ফুচকা বা ভেলপুরি বা আইসক্রিম বা ওই জাতীয় কিছু বিক্রি হচ্ছে।

ক্ৰমে কাছে এসে বুঝলাম আন্দাজে ভুল করিনি। মেলার মতো মেলা বটে। অর্ধেক বম্বে শহর ভেঙে পড়েছে এখানে। লালমোহনবাবু শিগগিরই রিচ ম্যান হচ্ছেন, তাই ওঁর ঘাড় ভাঙতে দোষ নেই। তিনজনে হাতে ভেলপুরির ঠোঙা নিয়ে ভিড় আর হই-হুল্লোড়ি ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রের ধারে বালির উপর বসলাম। ঘড়িতে পৌনে সাতটা, কিন্তু এখনও আকাশে গোলাপি রং। আমাদের মতো অনেকেই বালির উপর বসে আরাম করছে। লালমোহনবাবু খাওয়া শেষ করে হাত নেড়ে একটা সংস্কৃত শ্লোক আওড়াতে গিয়ে থেমে গেলেন। বা দিকে বসে থাকা লোকজনের মধ্যে কারুর হাত থেকে একটা খবরের কাগজ উড়ে এসে ভদ্রলোকের মুখের উপর লেপটে গিয়ে কথা বন্ধ করে দিয়েছে।

কাগজটা হাতে নিয়ে নামটা দেখে লালমোহনবাবু সবে ইভনিং নিউজ কথাটা বলেছেন, এমন সময় ফেলুদা তাঁর হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিল।

নামটা পড়লেন, আর তার নীচে হেড-লাইনটা চোখে পড়ল না?

আমরা তিনজনে একসঙ্গে কাগজটার উপর ঝুকে পড়লাম। হেডলাইন হচ্ছে–মাডর ইন অ্যাপার্টমেন্ট লিফুট, আর তার নীচেই যে খুন হয়েছে তার ছবি। যাক-এ তা হলে আমাদের লালশার্ট নয়।

খবরে বলছে, খুনটা হয়েছে দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে। খুনি এখনও ধরা পড়েনি, তবে পুলিশ অনুসন্ধান চালাচ্ছে। যে খুন হয়েছে তার নাম মঙ্গলরাম শেঠী। চারাকারবারিদের সঙ্গে যুক্ত ছিল, বেশ কিছু দিন থেকেই পুলিশ খুঁজছে। লিফুটে বেশ ধ্বস্তান্ধবস্তি হয়েছিল তারও নাকি প্রমাণ পাওয়া গেছে। কুয়ের মধ্যে নাকি এক টুকরো কাগজ পাওয়া গেছে মৃতদেহের পাশে। কাগজে একজনের নাম ছিল। নামটা হচ্ছে–

ও আঁ আঁ আঁআ আঁ আঁ…

একটা অদ্ভুত গোঙানি-টাইপের শব্দ লালমোহনবাবুর গলা দিয়ে বেরোল। ভদ্রলোক অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন মনে করে আমি তাড়াতাড়ি ওঁকে জাপটে ধরলাম। অবিশ্যি এ রকম করার যথেষ্ট কারণ ছিল। ইভনিং নিউজ লিখছে চিরকুটে লেখা ছিল—মিস্টার গাঙ্গুলী, ডার্ক, শর্ট, বল্ড, মুসটাশ।

খবরটা পড়া শেষ হওয়া মাত্র লালমোহনবাবু ফেলুদার হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন।

ফেলুদা বলল, এমন পরিষ্কার সমুদ্রতটটিকে আবর্জনায় ভরিয়ে দিলেন?

ভদ্রলোক এখনও ভাল করে কথা বলতে পারছেন না দেখে ফেলুদা এবার ধমকের সুরে বলল, আপনার কি ধারণা, গোটা শহরের লোক আপনাকে দেখেই বুঝে ফেলবে যে আপনিই হচ্ছেন এই ব্যক্তি?

লালমোহনবাবু এতেও সান্তুনা পেলেন না। কোনওরকমে ঢোক গিলে বললেন, কিন্তু-কিন্তু-এর মানেটা বুঝছেন তো? কে খুন করেছে, বুঝছেন তো?

ফেলুদা বেশ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে একদৃষ্টি লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, লালুদা, চার বছর আমার সংসৰ্গ-লাভ করেও মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে শিখলেন না।

কেন, কেন-লালশার্ট–?

লালশার্ট কী? কাগজটা লালশার্টেরই হাত থেকে লিফটে পড়েছে সেটা ধরে নিলেও তাতে কী প্রমাণ হচ্ছে? তার মানেই যে সে খুন করেছে তার কী প্রমাণ? আপনার কাছ থেকে প্যাকেট পাবার পর তার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক শেষ-এটা তো ঠিক? তা হলে কাগজটিরও তার আর কোনও প্রয়োজন থাকে না। লিফুটে ওঠার সময় সেটা পকেটে রয়ে গেছে দেখে, সে সেটা লিফটেই ফেলে দিল—এমন ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে কি?

লালমোহনবাবু তবুও ঠাণ্ডা হলেন না।আপনি যাই বলুন, লাশের পাশে যখন আমার নাম আর ডেসক্রিপশন লেখা কাগজ পেয়েছে, তখন আমার চরম ভোগান্তি আছে-এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। রাস্তা একটাই।টাকে তো আর চুল গজাবে না, হাইটও বাড়বে না, আর কমপ্লেকশনও চেঞ্জ হবে না। আছে এক গোঁফ। আপনি যাই বলুন, এ গোঁফ আমি কালই হাওয়া করে দেব।

আর হাটেলের লোকেরা কী ভাববো? তারা কি আর ইভনিং নিউজ পড়েনি ভেবেছেন? খুনের খবর শতকরা নব্ববুই ভাগ লোকে পড়বে, মানুষের স্বভাবই ওই। আমার ধারণা। আপনি গোঁফ ছাঁটলে দৃষ্টিাটা, এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহটা, আরও বেশি করে আপনার উপর পড়বে।

আকাশের লালটা যখন বেগুনি হয়ে শেষে পাংশুটের দিকে যেতে শুরু করেছে, পশ্চিমের চেরা মেঘের ফাঁকে শুকতারাটা পুবের ম্যারিন ড্রাইভের হাজার আলোর মালার সঙ্গে একা পাল্লা দিতে গিয়ে ধুকপুক করছে, তখন আমরা উঠে পড়ে গা থেকে বালি ঝেড়ে আবার মানুষ আর দোকানের ভিড় পেরিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে হোটেলমুখে হলাম।

বাড়ালেন, মুখটা তার উলটোদিকে ঘুরিয়ে রাখলেন। কিন্তু তাতেও রেহাই নেই, উলটাদিকে লবিতে বসা সাতজন দেশি-বিদেশি লোকের তিনজনের হাতে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড। স্ট্যান্ডার্ডের সামনের পাতাতেও খুনের খবর আর মৃতদেহের ছবি। খবরের মধ্যে টেকো বেঁটে গুফো রং-ময়লা মিস্টার গাঙ্গুলীর উল্লেখ নেই। এ হতেই পারে না।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়