মণিলালবাবুর সঙ্গে কথা সেরে আমরা প্ৰদ্যুন্নবাবুর সঙ্গে গেলাম ইন্দ্রনারায়ণ আচার্যের ঘরে। ঘরটা এক তলার উত্তর-পশ্চিম কোণে। বাড়ির উত্তর দিকটা হচ্ছে সামনের দিক। মাঝখানে নাটমন্দির আর তাকে ঘিরে তিনদিকে বারান্দা আর সারি সারি ঘর। বাড়ির পিছনের দরজাটা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, পশ্চিমের বারান্দার শেষ মাথায়। তার মানে কেউ দরজা দিয়ে ঢুকে বারান্দা পেরোলেই ইন্দ্রনারায়ণবাবুর শোবার ঘর পাবে সামনে। তারপর উত্তরের বারীন্দী ধরে দশ পা গেলে ডাইনে পাবে ইন্দ্রনারায়ণবাবুর কাজের ঘরের দরজা। অর্থাৎ বাইরে থেকে একজন লোক এসে খুন করাটা খুবই সহজ ব্যাপার।

শোকার ঘরে খাট, একটা আলমারি, দুটো তাক আর কিছু ট্রাঙ্ক সুটকেস ছাড়া জিনিস বেশি নেই। আমরা কাজের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম।

এখানে বড় বড় দুটো তাক বোঝাই কাগজপত্র খাতা ইত্যাদিতে। বুঝলাম। এগুলোতে নাটক আর গানের খসড়া রয়েছে। সতেরো বছরের যত কাগজ সবই মনে হল এই দুটো তাকে রয়েছে! বারান্দার দিকে যে দরজাটা রয়েছে সেটার ঠিক ডান পাশে একটা টেবিল আর চেয়ার। বোঝাই গেল এইখানেই খুনটা হয়েছিল। টেবিলের উপর ফাউনটেন পেন, ডট পেন, পেনসিল, পেপার ওয়েট, কালি, টেবিল ল্যাম্প ইত্যাদি রয়েছে। আর যেটা রয়েছে সেটা হল একটা বেহালার কেস। ফেলুদা বলল, একবার আম আঁটির ভেঁপুর চেহারাটা দেখা যাক।

বাক্স খুলে বেহালাটা দেখে বুঝলাম ইন্দ্রনারায়ণবাবু সেটার খুব যত্ন নিতেন। একশো বছরের পুরনো বেহালা এখনও প্রায় নতুনের মতে রয়েছে।

ফেলুদা কেসটা বন্ধ করে দিল।

এ ছাড়া ঘরে রয়েছে এক পাশে একটা সোফা, একটা চেয়ার আর শ্বেত পাথরের একটা ছোট তেপায়া টেবিল। দেয়ালে ছবির মধ্যে রয়েছে দুটো বাঁধানো মানপত্র—ইন্দ্রনারায়ণের পাওয়া-একটা বিলিতি ল্যান্ডস্কেপ আর একটা রামকৃষ্ণ পরমহংসের মাকামারা ছবি।

ঘর দেখা হলে সোফা আর চেয়ারে ভাগাভাগি করে বসলাম আমরা চারজন প্ৰদ্যুন্নবাবু ইতিমধ্যে ঘোলের সরকতের জন্য বলেছিলেন, সেটা এনে চকর শ্বেতপাথরের টেবিলের উপর রাখল। সরবত খেতে খেতে কথা হল।

আপনার ঘরটা কোথায়? ফেলুদা প্রশ্ন করল প্ৰদ্যুম্নবাবুকে।

টেরচা ভাবে এই ঘরের বিপরীত দিকে, বললেন প্ৰদ্যুম্নবাবু, অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। একেরারে কোণের ঘরটা হল। লাইব্রেরি, আর আমারটা হল তার পাশেই।

আপনি রাত্রে ঘুমোন কখন?

তা বেশ রাত হয়। এক-আধা দিন তো একটা দেড়টাও হয়ে যায়। আমার কাজটা-অৰ্থাৎ কন্দৰ্পনারায়ণ সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারটা—আমি সাধারণত রাত্রেই করি। প্রথম দিকে আমার কাজ ছিল কীর্তিনারায়ণকে ইন্টারভিউ করা। তিনি বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর ঠাকুরদাদাকে দেখেছেন। তাঁর কাছ থেকে সব তথ্য নেওয়া হলে পর আমি চিঠিপত্র দলিল ডায়রি ইত্যাদি স্টাডি করা শুরু করি।

তা হলে সেদিন যখন খুনটা হয় তখন আপনি জেগে ছিলেন?

তা তো বটেই। তবে নাটমন্দিরটা এত বড় যে আমার কাজের ঘর থেকে এ ঘরটা দেখাও যায় না, এখানকার কোনও শব্দ শোনাও যায় না।

বীণাপাণি অপেরা থেকে লোক এসেছিল ইন্দ্রনারায়ণবাবুর কাছে সে খবর জানা গেল কী ভাবে?

সেটা বলেছে সন্তোষ বেয়ারা। অশ্বিনী ভিড় যে স্ক্রিপটা পাঠিয়েছিলেন সেটাও টেবিলের উপর পাওয়া যায়। ভদ্রলোক কখন যান। সে খবরও বেয়ারাই দেয়।

আপনি বেহালা শুনতে পাননি?

তা হয়তো এক-আধকার শুনেছি, কিন্তু সেটা প্রায় রোজই শুনতাম বলে বিশেষ করে সেই দিন শুনেছিলাম। কিনা বলতে পারব না।

কনদর্শনারায়ণ কি নিয়মিত ডায়রি লিখতেন?

পরের দিকে লেখেননি, কিন্তু পাঁচিশ বছর থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত লিখেছিলেন।

তার মানে বিলেত ভ্ৰমণের ডায়ারিও আছে?

আছে বইকী, আর সে এক আশ্চর্য জিনিস। কত লর্ড আর ডিউক আর ব্যারনের সঙ্গে যে তিনি খানাপিনা করেছেন তা পড়লে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। লণ্ডন থেকে কন্দৰ্পনারায়ণ ফ্রান্সে যান। সেখানে প্যারিসে কিছুদিন কাটিয়ে তিনি চলে যান। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে দক্ষিণ ফ্রান্সের রিভিয়েরাতে। আপনি তো জানেন এই অঞ্চলের কয়েকটি শহরের ক্যাসিনো হল জুয়াড়িদের তীৰ্থস্থান! কন্দৰ্পনারায়ণ মন্টি কালের ক্যাসিনোতে রুলেট থেকে লাখ লাখ টাকা জেতেন। খুব কম বাঙালিই সে যুগে বিলেত গিয়ে এরকম কীর্তি রেখে এসেছেন।

আচাৰ্যদের জমিদারি কোথায় ছিল?

পূর্ববঙ্গে কান্তিপুরে। বিরাট জমিদারি।

ফেলুদা একটা চারমিনার ধরাল! দুটো টান দিয়ে তারপর বলল, মৃতদেহ আবিষ্কার করে কে?

সেও সন্তোষ বেয়ারা। সে নিজে ফেরে প্রায় পৌনে একটায়। তারপর ইন্দ্রনারায়ণবাবুর কাজের ঘরে বাতি জ্বলছে দেখে একবার উঁকি দিতে এসে দেখে এই ব্যাপার! সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দেয়। তারপর আমি দোতলায় গিয়ে অন্যদের জানাই।

পুলিশে খবর দেবার সিদ্ধান্ত কার?

দেবনারায়ণবাবুর। বড় কর্তা না করেছিলেন, কিন্তু দেবনারায়ণবাবু বাপের কথায় কান দেননি।

আপনার সঙ্গে ইন্দ্রনারায়ণবাবুর সম্পর্ক কীরকম ছিল?

দিব্যি ভাল। আমি ভদ্রলোককেও কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। বিশেষ করে তাঁর বেহালা সম্পর্কে। উনি বলেন যন্ত্রটা খুব ভাল এবং আওয়াজ অতি মিষ্টি। প্রায় সত্তর বছর। ওটা না বাজানো অবস্থায় পড়ে ছিল, কিন্তু ইন্দ্রনারায়ণ ওটা বার করে বাজাতে আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গেই ওটার আওয়াজ খুলে যায়।

ভদ্রলোক সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

একেবারে কাজ-পাগলা মানুষ ছিলেন। কাজে ডুবে থাকতেন যতক্ষণ বাড়িতে থাকতেন। লাইব্রেরি থেকে বই নিতে আসতেন মাঝে মাঝে। বিশেষ করে ঐতিহাসিক নাটক লেখার সময় বই দেখার দরকার হাতই। কন্দৰ্পনারায়ণের ছেলে, কীর্তিনারায়ণের বাবা দর্শনারায়ণ ইতিহাসে এম. এ. ছিলেন। তাই লাইব্রেরিতে ইতিহাসের বই খুব ভালই আছে।

এবার অন্য দু ভাই সম্বন্ধে একটু জানতে চাই।

বেশ তো।

সবচেয়ে বড় তো দেবনারায়ণ। তারপর হরিনারায়ণ, তারপর ইন্দ্রনারায়ণ!

হ্যাঁ।

ইন্দ্রনারায়ণ তো বিয়েই করেননি। আর দেবনারায়ণ শুনলাম বিপত্নীক?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বছর সাতেক আগে ওঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়।

ওঁর ছেলেপিলে নেই?

একটি মেয়ে আছে, তার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী পুনায় কাজ করে। ছেলে একটি আছে সে আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে।

আপনার মতে দেবনারায়ণ লোক কেমন?

অত্যন্ত চাপা, গভীর প্রকৃতির মানুষ।

উনি কি চাকরি করেন?

উনি স্টকওয়েল টি কোম্পানিতে উঁচু পোস্টে আছেন।

অফিস থেকে বাড়ি ফেরেন কখন?

তা রাত সাড়ে নটার আগে তো নয়ই, কারণ অফিস থেকে ক্লাবে যান। সন্ধ্যাটা সেখানেই কাটান।

ভাইয়ের মৃত্যুতে কি উনি খুব শোক পেয়েছিলেন বলে মনে হয়?

তিন ভাইয়ের মধ্যে বিশেষ সম্ভাব ছিল না। বিশেষ করে ইন্দ্রনারায়ণ যাত্রার কাজ করেন। বলে আমার ধারণা অন্য দুভাই ওঁকে বেশ হেয় জ্ঞান করতেন।

কিন্তু কীর্তিনারায়ণ তো ছোট ছেলেকে বেশ ভালই বাসতেন।

শুধু ভালবাসতেন না, তিন ছেলের মধ্যে ছোটকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন। এ-বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই, কারণ অনেক কথাতেই এই পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পেত।

কীর্তিনারায়ণ কি উইল করেছেন?

করেছেন বলেই তো আমার ধারণা।

সেই উইলেও তো এই পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পেতে পারে।

তা তো পারেই।

ফেলুদা একটা চারমিনার ধরাল। লালমোহনবাবু তাঁর ছোট্ট লাল খাতাটা বার করে কী যে নোট লিখছেন তা উনি জানেন! হয়তো ভবিষ্যতের একটা গল্পের গ্লট ওঁর মাথায় আসছে।

এবার দ্বিতীয় ভাই সম্বন্ধে একটু জানা দরকার।

কী জানতে চান বলুন, বললেন প্ৰদ্যুম্নবাবু!

উনি তো চাটগার্ড অ্যাকাউন্ট্যাস্ট?

হ্যাঁ! স্কিনার অ্যান্ড হার্ডউইক কোম্পানিতে আছেন।

কেমন লোক?

ওঁর তো ফ্যামিলি আছে, কাজেই সেখানেই বড় ভাইয়ের সঙ্গে একটা তফাত হয়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোক মোটামুটি ফুর্তিবাজ, বিলিতি গান বাজনার খুব ভক্ত।

রেকর্ড আর ক্যাসেট শোনেন?

হ্যাঁ, তবে সেটা রবিবারে। অন্যদিন সন্ধ্যায় ইনিও ক্লাবে যান, ফেরেন সেই সাড়ে নটা দশটায়।

কোন ক্লাব?

স্যাটারডে ক্লাব।

বড় ভাইও কি একই ক্লাবের মেম্বার নাকি?

না, উনি বেঙ্গল ক্লাবে।

হরিনারায়ণের তো একটি মেয়ে আছে।

হ্যাঁ—লীনা। বুদ্ধিমতী। বছর চোদ্দ বয়স, পিয়ানো শিখছে। ক্যালকাটা গার্লস স্কুলে পড়ে। সে বেচারি কাকার মৃত্যুতে খুব আঘাত পেয়েছে, কারণ সে কাকার খুব ভক্ত ছিল।

আর হরিনারায়ণবাবু? তিনি আঘাত পাননি?

বড় দু ভাইয়ের কেউই ছাটকে বিশেষ আমল দিতেন না।

আর হয়তো ইন্দ্রনারায়ণ যাত্রা থেকে এত রোজগার করছে সেটাও তারা বিশেষ সুনজরে দেখত না।

তাও হতে পারে।

আমার অবিশ্যি এই দুই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেটা বোধহয় শনি কি রবিবার করলে ভাল হয়, তাই না?

শনিবার সকালে এলে দু ভাইকেই পাবেন।

আপনি যে কন্দৰ্পনারায়ণের জীবনীর উপর কাজ করছেন, সেটা কতদিন থেকে?

তা প্ৰায় ছমাস হল।

হঠাৎ এই মতি হল কেন?

আমি উনবিংশ শতাব্দী নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব বলে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশুনা করছিলাম। সেই সময় কন্দৰ্পনারায়ণের নাম পাই। খোঁজখবর নিয়ে জানি তাঁর বংশধরেরা এখনও আছেন বোসপুকুরে। সোজা এসে কীর্তিনারায়ণের সঙ্গে দেখা করি। কীর্তিনারায়ণ বলেন—তুমি আমার বাড়িতে থেকে রিসার্চ করতে পারো, কিন্তু সেই সঙ্গে আমার কিছু কাজও করে দিতে হবে। তার জন্য আমি তোমাকে পারিশ্রমিক দেব। আমি তখন খবরের কাগজের কাজ ছেড়ে এখানে চলে আসি। এখানে অনেক ঘর খালি পড়ে আছে, তারই একটা ঘরে আমাকে এক তলায় থাকতে দেন কীর্তিনারায়ণ। গত ছমাসে আমি এবাড়ির সঙ্গে বেশ মিশে গেছি। আমার কারবার অবিশ্যি শুধু কীর্তিনারায়ণকে নিয়েই, তবে অন্যরাও আমার ব্যাপারে কোনও আপত্তি করছেন বলে শুনিনি।

ভাল কথা–

ফেলুদা তার পার্স থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ বার করল।

এটা বোধহয় সেদিন আপনার পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল—আপনি যখন ঘাম রুমাল বার করেন। জন্মদিনের জন্য কেকের অর্ডার কি, নাকি টেলিগ্রাম?

ফেলুদা হ্যাপি বাথর্ডে হুকুম চাঁদ লেখা কাগজটা প্ৰদ্যুম্নবাবুর হাতে দিল। প্ৰদ্যুম্নবাবু ভুরু কপালে তুলে বললেন, কই, এমন তো কোনও কাগজ আমার পকেটে ছিল না। আর এই হুকুম চাঁদ যে কে সে তো আমি বুঝতেই পারছি না।

আপনি সেদিন কীসে করে আমার বাড়িতে এসেছিলেন?

বাস।

বাসে ভিড় ছিল? তার মধ্যে কেউ এটা পকেটে ফেলে দিতে পারে?

তা পারে, কিন্তু এটার তো কোনও মানেই আমি বুঝতে পারছি না।

এটা যদি আপনার না হয় তো আমার কাছেই থাকুক।

ফেলুদা কাগজটা আবার পার্সে রেখে দিল। এই কাগজ যে একটা রহস্যের মধ্যে পড়ে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়