কাশীর মতো থমথমে রাত খুব কম জায়গাতেই দেখেছি। সেটা আরও বেশি মনে হয় এই জন্যে যে দিনের বেলা জায়গাটা লোকে জুনে রঙে শব্দে ভরে থাকে। আমরা বারোটার সময় যখন জ্ঞান-বাপী পৌঁছলাম তখন একটা রাস্তার কুকুরের ডাক ছাড়া কোনও শব্দ নেই।

মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর ফেলুদা একটা শেষ-করা চারমিনার পায়ের তলায় ফেলে চাপ দিতেই চাপা গলায় শোনা গেল, মিস্টার মিত্তির  বুঝলাম মতিলাল বড়াল হাজির।

কতগুলো অন্ধকার মূর্তি আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আমার সঙ্গে তিনজন লোক আছে। আপনি রওনা দেবার জন্য তৈরি?

চাপা স্বরে প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা হচ্ছে। ফেলুদাও সেইভাবেই বলল, নিশ্চয়ই। আর, আমাদের গাইড করতে হবে না, আমরা রাস্তা জানি।

তা হলে চলুন।

অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। ফেলুদা আর মতিলালবাবু দুজনেই দেখলাম রাস্তা খুব ভাল করে জানে, আর এই ঘুটিঘুটে অন্ধকারেও বেশ দ্রুতই এগিয়ে চলেছে। এক জায়গায় একটা রাস্তার আলো টিমটিম করে জ্বলছিল। সেই আলোতে দেখে নিয়েছি মতিলালবাবুর তিনজন লোকের মধ্যে একজন ভীষণ ষণ্ডা। বুঝলাম। এই হচ্ছে মনোহর।

মগনলালের রাস্তার মুখে এসে সকলে থামল। ফেলুদা লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, আপনারা এইখানে অপেক্ষা করুন। আমাদের হয়তো মিনিট কুড়ি লাগবে।

কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই মতিলালবাবু আর ওই তিনজন লোকের সঙ্গে ফেলুদা মগনলালের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

কয়েক মিনিট দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজেদের নিশ্বাস ফেলার শব্দ পাচ্ছি।

অবশেষে লালমোহনবাবু হয়তা আর থাকতে না পেরে ফিসফিস করে বললেন, ওই গুণ্ডাদের সঙ্গে তোমার দাদার যাবার কী দরকার ছিল বুঝতে পারলাম না।

সেটা যথাসময়ে বুঝবেন।

আমার ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। ঠিক আছে।

আমার মনে হয় কথা না বলাই ভাল। ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। খুব মন দিয়ে শুনলে দূর থেকে হারমোনিয়াম আর ঘুঙুরের শব্দ পাওয়া যায়। আকাশের দিকে চাইলাম। এত তারা কলকাতার আকাশে কোনওদিন দেখিনি। এই তারার আলোতেই চার পাশ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। যতদূর মনে হয়, আজ অমাবস্যা।

বেশি সময় যায়নি, কিন্তু এখনই মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষণ হল? দিশ মিনিট? পনেরো মিনিট? আশ্চর্য! মগনলালের বাড়িতে ডাকাতি হচ্ছে, এখান থেকে ত্ৰিশ হাত দূরে, কিন্তু তার কোনও শব্দ নেই।

আরও মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকার পর পায়ের শব্দ পেলাম। একজনের বেশি লোক। এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

ফেলুদারাই ফিরছে। কাছে এসে বলল, চ।

কাজ হল? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।

খতম, বলল ফেলুদা! তারপর মতিলালবাবুর দিকে ফিরে বলল, অনেক ধন্যবাদ। আপনার শেয়ারের ব্যবস্থা আমি করে দেব।

আমরা আমাদের হোটেলের দিকে হাঁটা দিলাম।

কথা হল একেবারে ঘরে ঢুকে।

কিছু বলুন, মশাই। আর থাকতে না পেরে বললেন লালমোহনবাবু।

আগে এইটে দেখুন।

ফেলুদা পকেট থেকে লাল ভেলভেটের বাক্সটা বার করে খাটের উপর রাখল।

সাবাস  বললেন লালমোহনবাবু। কিন্তু কীভাবে হল ব্যাপারটা একটু বলুন। খুন-খারাপি হয়নি তো?

সেই পালোয়ানটা মাথায় একটু চোট পেয়েছে, সেটা মনোহরের কীর্তি।

কিন্তু ক্যাশবাক্স খুললেন কী করে?

যে ভাবে লোকে খোলে। চাবি দিয়ে।

এ, কি ম্যাজিক নাকি?

নো স্যার। মেডিসিন।

মানে?

সাপলাইড বাই নিরঞ্জনবাবুর বন্ধু ডাক্তার চৌধুরী।

কী সব বলছেন আবোল তাবোলা? কীসের সাপলাই?

ক্লোরোফর্ম বলল ফেলুদা। শঠে শাঠ্যম্‌। এবার বুঝেছেন?

 

পরদিন রাত সোয়া এগারোটায় দিল্লি এক্সপ্রেস ধরে তারপর দিন ভোর ছটায় দিল্লি পৌঁছলাম। এর আগের বার আমরা জনপথ হোটেলে ছিলাম, এবারও তাই রইলাম। ফেলুদা ঘরে এসে আর কিছু করার আগে বিভিন্ন হোটেলে ফোন করে খোঁজ নিতে আরম্ভ করল। সূর্য সিং কোথায় আছে। দশ মিনিট চেষ্টা করার পর তাজ হোটেলে বলল, হ্যাঁ, সূর্য সিং এখানেই আছেন। রুম থ্রি ফোর সেভ্‌ন।

একবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি কি? সৌভাগ্যক্রমে সূরয সিং তাঁর ঘরেই ছিলেন। এক মিনিটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেল। সন্ধ্যা ছটা। হোটেলে ওঁর ঘরেই যেতে হবে। কী কারণ জিজ্ঞেস করেছিল, বলল ফেলুদা। আমি তাকে পিংক পার্ল সংক্রান্ত ব্যাপার বলতে তৎক্ষণাৎ টাইম দিয়ে দিল।

দুপুর বেলাটা কিছু করার নেই। জনপথে একটা চিনে রেস্টোরান্টে খেয়ে দোকানগুলো দেখে তিনটে নাগাত হোটেলে ফিরে এলাম একটু বিশ্রামের জন্য। পৌনে ছটায় বেরোতে হবে। লালমোহনবাবু ফেলুদাকে মনে করিয়ে দিলেন, আপনার ইয়েটা নিতে ভুলবেন না।

 

ছটায় তাজে পৌঁছে ফেলুদা প্রথমে নীচ থেকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে আমরা এসেছি।

আমার ঘরে চলে আসুন, বললেন ভদ্রলোক।

তিনশো সাতচল্লিশে গিয়ে বেল টিপতে যে দরজা খুলল তাকে মনে হল সেক্রেটারি জাতীয় কেউ। বললেন, আপনারা বসুন, উনি এক্ষুনি আসছেন।

ঘর বলতে যা বোঝায় এটা তা নয়; তিনটে ঘর জুড়ে একটা বিশাল সুইট। যেটায় ঢুকেছি সেটা সিটিং রুম। আমরা সোফায় গিয়ে বসলাম।

মিনিট পাঁচেক বসতেই ভদ্রলোক এসে পড়লেন।

ইনি যে অত্যন্ত ধনী সেটা এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। গায়ে চাস্ত সুট, সোনার টাইপিন, পকেটে সোনার কলম। হাতে পাথর বসানো সোনার আংটি। বয়স পঞ্চান্নর বেশি। নয়। কনের দুপাশে চুলে পাক ধরেছে, বাকি চুল কালো, আর চাড়া দেওয়া গোঁফটাও কালো।

হু ইজ মিস্টার মিটার?

ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়ে পরিচয় দেওয়ার ব্যাপারটা সেরে নিল। ভদ্রলোক দেখলাম দাঁড়িয়েই রইলেন।

আপনার সঙ্গে পিংক পার্লের কী কানেকশন? ফেলুদাকে প্রশ্ন করলেন মিস্টার সিং।

ফেলুদা বলল, আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। জয়চাঁদ বড়াল মুক্তোটা আমার জিন্মায় রেখেছেন যাতে ওটা নিরাপদ থাকে।

কথাটা আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য। নই, মিস্টার মিটার। আপনি মালিকের কাছ থেকে যে মুক্তোটা চুরি করেননি তার কী প্রমাণ?

কোনও প্রমাণ নেই। আপনাকে আমার কথা মেনে নিতে হবে।

আমি তাতে রাজি নই।

তা হলে আমার একটা কথাই বলার আছে—আমি মুক্তোটা দেব না। এটা যার জিনিস তাঁর কাছে ফেরত চলে যাবে।

মুক্তোটা দিতে আপনি বাধ্য।

না মিস্টার সিং, আমি বাধ্য নাই। নো ওয়ান ক্যান ফোর্স মি।

চোখের  পলকে সূর্য সিং-এর হাতে একটা রিভলভার চলে এল, আর তার পরমুহূর্তেই একটা কান-ফাটানো গর্জন।

কিন্তু সেটা সূ্রয সিং-এর রিভলভার থেকে নয়, ফেলুদার কোল্ট থেকে। সে সূর্য সিং-এর হাত নামানা দেখেই ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে। আর বিদ্যুদ্বেগে নিজের রিভলভারটা বার করেছে।

গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যয সিং-এর হাত থেকে তার রিভলভারটা ছিটকে বেরিয়ে একটা ঠং শব্দ করে ঘরের পিছন দিকের মেঝেতে পড়ল।

সূরয সিং-এর চেহারা পালটে গেছে। তার চাউনিতে ঘৃণার বদলে এখন সন্ত্ৰম।

আমি চল্লিশ গজ দূর থেকে বাঘ মেরেছি, কিন্তু তোমার মতো টিপ আমার নেই। ঠিক আছে, আমি তোমার নামেই চেক লিখে দিচ্ছি, তুমি মুক্তোটা আমাকে দাও।

ফেলুদা পকেট থেকে ভেলভোটের কৌটোটা বার করে সূর্য সিংকে দিল। কেঁটাটা থেকে মুক্তোটা বার করে ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মধ্যে ধরে সেটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে থাকলেন সূর্য সিং। তাঁর চোখ জ্বল জ্বল করছে।

আমি এটাকে যাচাই করে নিলে আশা করি তোমার আপত্তি হবে না। এতগুলো টাকা…

ঠিক আছে।

শঙ্করপ্রসাদ! হাঁক দিলেন সূর্য সিং। পাশের ঘর থেকে একজন ফিটফট। ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, বছর চল্লিশোক বয়স, চোখে সোনার চশমা!

স্যার?

একবার দেখো তো এই মুক্তোটা জেনুইন কি না।

শঙ্করপ্রসাদ মিনিটখানেক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেই সেটা সূর্য সিংকে ফেরত দিল।

নো স্যার।

মানে?

এটা ফল্‌স। সস্তা সাদা কালচারড পার্লের উপর গোলাপী রং করে দেওয়া হয়েছে।

আর ইউ শিওর?

অ্যাবসোলিউটলি।

সূরয সিং-এর মুখ লাল। কাঁপতে কাঁপতে ফেলুদার দিকে চাইলেন। তাঁর কথা বলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে।

ইউ-ইউ–মেকি জিনিস আমাকে পাচার করছিলে?

ফেলুদার মুখ হাঁ হয়ে গেছে।

তা হলে বড়ালের বাড়িতেই নিশ্চয়ই ফল্‌স মুক্তো ছিল, বলল ফেলুদা।

তোমার রিভলভার নামাও।

ফেলুদা নামাল।

এই নাও তোমার ঝুঠা। মোতি।

ফেলুদা বাক্সসমেত মুক্তোটা সূর্য সিং-এর হাত থেকে নিল।

নিউ গেট আউট।

আমরা তিনজন সুবোধ বালকের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এলাম। যখন লিফ্‌টে উঠছি তখন দেখলাম ফেলুদার কপালে গভীর খাঁজ।

 

কলকাতা ফেরার পথে ট্রেনে ফেলুদা একটা কথাও বলল না। এমন অবস্থায় যে সে কোনওদিন পড়েনি সেটা আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি।

আমরা ফিরলাম রাত্রে। পরদিন সকলে আমার ঘর থেকে শুনতে পেলাম ফেলুদা গুন গুন করে গান গাইছে।

আমি বসবার ঘরে এসে দেখি ও পায়চারি করছে আর আলোকের এই বর্ণাধারায়-এর সুরাটা ভাঁজছে। আমাকে দেখেও সে পায়চারি, গান কোনওটাই থামল না। আমি অবশ্য খুশি। ফেলুদাকে মনমরা দেখতে আমার মোটেও ভাল লাগে না।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লালমোহনবাবুর গাড়ির হর্ন শোনা গেল। আমি দরজাটা খুলে দিলাম, ভদ্রলোক ঢুকলেন।

প্ৰাতঃ প্ৰণাম! ঘাড় হেঁট করে হাতজোড় করে বলল ফেলুদা। আসতে আজ্ঞা হাক। লালমোহনবাবু কেমন যেন থতমত খেয়ে একটা বাকা হাসি হেসে বললেন, আপনি কি তা হলে…?

আমি অন্ধকার পছন্দ করি না, লালমোহনবাবু, তাই সেখানে আমাকে বেশিক্ষণ ফেলে। রাখা চলে না। ফলস মুক্তোটা যে আপনার গড়পারের সেক্‌রা বন্ধুর কীর্তি সেটা আমি বুঝেছি, আর এটা যে আপনার এবং আমার ভ্রাতার যৌথ প্ৰয়াস সেটা বুঝেছি, কিন্তু কবে। কখন–

বলছি, স্যার, বলছি, বললেন লালমোহনবাবু। অপরাধ নেবেন না। কাইন্ডলি। আর আপনার ভাইটিকেও মাপ করে দেবেন। আপনি মগনলালের হুমকি যেরকম বেপরোয়া ভাবে নিলেন, তাতে আমি অত্যন্ত উদ্বেগ বোধ করছিলুম। ও মুক্তোটা পেয়ে যাবে এই চিন্তাটাই আমি বরদাস্ত করতে পারছিলুম না। ও তিন দিন সময় দিয়েছিল সোম, মঙ্গল, বুধ। মঙ্গলবার আমি সকলে আসি। আপনি চুল ছাটাতে গেলেন, মনে আছে তো? সেই সময় তপেশ আপনার চাবি দিয়ে আলমারি খুলে মুক্তোটা বার করে আমায় দেয়। এক দিনেই ডুপ্লিকেট হয়ে যায়। বুধবার ওটা তপেশকে এনে দিই, ও সুযোগ বুঝে সেটা আলমারিতে রেখে দেয়। যা করেছি তা শুধু আপনার মঙ্গলের জন্য, বিশ্বাস করুন।

আপনাদের ফন্দি অবিশ্যি তারিফ করার মতোই।

আপনি সেদিন যখন মগনলালকে বললেন মুক্তোটা ফলস, তখন আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাদের কারসাজি ধরে ফেলেছেন।

না ধরিনি। আপনাদের পক্ষে এতটা মাথা খাটানো সম্ভব সেটা ভাবতে পারিনি। আসলে আপনারা যে ফেলুমিত্তিরের এত কাছে থাকেন সেটা ভুলে গিয়েছিলাম।

জয়চাঁদবাবু নিশ্চয়ই আরও ভাল অফার পাবেন।

অলরেডি পেয়েছেন। কাল এসে সোমেশ্বরের একটা চিঠিতে জানলাম। এক আমেরিকান ভদ্রলোক। এক লাখ পঁচিশ অফার করেছেন।

বাঃ, এ তো সত্যিই সুখবর।

ফেলুদা এবার আমার দিকে ফিরল। আমি একটা গাঁটা কি রুদা এক্সপেক্ট করছিলাম, তার বদলে ও আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তোকে একটা অ্যাডভাইস দিই। এই ঘটনাটার বিষয় যখন লিখবি, তখন তোদের এই কীর্তিটার কথা একেবারে শেষে প্ৰকাশ করবি। নইলে গল্প জমবে না।

আমি অবিশ্যি তাই করেছি। লোকে আশা করি আমার এই কারচুপিটা মাইন্ড করবে না। তা হলে এবার আসলটা আপনাকে দিয়ে দিই? বললেন লালমোহনবাবু।

ইয়েস, ইফ ইউ প্লিজ, মিস্টার গাঙ্গুলী।

জটায়ু পকেট থেকে লাল ভেলভেটের কৌটোটা বার করে ফেলুদাকে দিল। ফেলুদা বাক্সটা খুলে জানালার কাছে গিয়ে আলোতে ধরল।

গোলাপী মুক্ত সগৌরবে বিরাজমান।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়