গুণ্ডাদের আস্তানার শুটিংটা বিকেল সাড়ে চারটায় শেষ করে ফেরার পথে বিশুদা বলল, চল অংশু, আমরা কজন একবার মিঃ লোহিয়াকে দেখে আসি। ভদ্রলোক কেমন আছেন জানা দরকার।

একটা গাড়িতে বিশুদা, সুশীলবাবু, শঙ্কর মল্লিক, সুকান্তবাবু আর আমি গেলাম রাজবাড়িতে।

বাড়ির বাইরে পুলিশ, ভিতরে পুলিশ সারা বাড়ির চেহারাই পালটে গেছে। বাড়ির লোকজন সকলেরই মুখ গম্ভীর, সবাই ধীরে ধীরে হাঁটছে, ফিসফিস করে কথা বলছে–দেখে মনে হয় যেন সারা বাড়িটার ওপর শোকের ছায়া পড়েছে। তার উপরে আবার আজ দিনটাও করেছে মেঘলা।

তবু ভাল যে মিঃ লোহিয়ার মাথার জখমটা তেমন গুরুতর হয়নি। ভদ্রলোক দোতলার সামনে বারান্দায় মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় আরাম কেদারায় বসে ফলের রস খাচ্ছিলেন। আমাদের বসতে বলে পাশে দাঁড়ানো চাকরকে সকলের জন্য শরবত আনতে বললেন। সুশীলবাবু বললেন, আমরা কিন্তু আপনাকে মোটেই বিরক্ত করতে চাই না। আপনার এই দুর্ঘটনার কথা শুনে আপনি কেমন আছেন খালি সেইটুকু দেখতে এসেছি।

আই অ্যাম মাচ বেটার, বললেন মিঃ লোহিয়া, কী করব বলুন, মানুষের জীবন তো আর সবসময় একরকম যায় না। কপালে দুর্ভোগ ছিল, সে কে পারে খণ্ডাতে? আফসোস হয় যে, আমার এত হিরে জহরত থাকতে সে তোক আমার সাধের মণিটাই নিল।

এটা কি আপনার ওই চাকরেরই কীর্তি? প্রশ্ন করলেন সুশীলবাবু।

সে যখন পালিয়েছে তখন তাই ধরে নিতে হবে। অথচ লোকটা যে এমন সেটা আগে বুঝতে পারিনি। বদলি হিসেবে এসেছিল, আর কাজ করছিল ভালই। হঠাৎ যে কী গোলমাল হয়ে গেল।

সে তোক কি সত্যি করেই পালিয়েছে?

তাই তো মনে হচ্ছে। এমন একটা কুকীর্তি করে সেকি আর শহরে থাকবে? আমার সবচেয়ে আফসোস হচ্ছে যে আজ আপনাদের কাজটা হল না। ওটা বন্ধ করেছে আমার বাড়ির কর্মচারীরা। আমি জানলে বন্ধ হতে দিতাম না। আপনারা যদি চান তো কাল সকালেই আবার আসতে পারেন। আমার কোনও অসুবিধা হবে না।

তার কোনও প্রয়োজন হবে না, বললেন সুশীলবাবু, আপনি সেরে উঠুন। ইতিমধ্যে আমাদের অন্য জায়গায় অন্য কাজ আছে।

শরবত খেয়েই আমরা সকলে উঠে পড়লাম। সার্কিট হাউসে যখন ফিরলাম তখন ছটা বাজে। আমি ঘরে গিয়ে স্নানের জোগাড় করব কিনা ভাবছি এমন সময় কেষ্টদা এল। তার মুখ গম্ভীর।

কী হল, কেষ্টদা?

আমার কাজ কদ্দিন আছে তুমি বলতে পারো? জিজ্ঞেস করল কেষ্টদা।

আমি বললাম, চব্বিশ তারিখ পর্যন্ত। কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছ?

জগু ওস্তাদের কাজ কি চব্বিশের পরেও আছে?

না। ওর কাজ শেষ হচ্ছে চব্বিশে সকালে। ও সেইদিনই সন্ধ্যায় চলে যাবে।

তুমি ঠিক জানো?

আমাদের কাজের চার্ট তো বসবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো আছে। সেটা দেখলেই সব জানা যায়। কিন্তু তুমি কেন জিজ্ঞেস করছ বলো তো।

কারণ ওর কাজ শেষ হবার আগে আমি এখান থেকে চলে গেলে মুশকিল হবে। যদ্দিন ওর কাজ চলছে তদ্দিন আমি কিছু বলতে পারব না। চব্বিশ তারিখ ও চলে যাবার আগে আমার যা করার করতে হবে। হাতে বোধহয় মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় থাকবে। খুব গোলমেলে ব্যাপার।

আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম কেষ্টদার ভাবনার কারণটা। ও আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, সবচেয়ে মুশকিল কোথায় জানো? আমি বললেই যে এরা আমার কথা বিশ্বাস করবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই।

আমি কেষ্টদাকে সান্ত্বনা দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু পারলাম না। আরেকজন লোক এসে গেছে বারান্দায়। জগু ওস্তাদ।

দুজনে খুব দোস্তি দেখছি। বাঁকা হাসি হেসে বলল জগু ওস্তাদ। আরে ভাই, তোমরাই তো ক্ল্যাপ তুলবে হাউসে; আমাদের কপালে তো দুয়ো ছাড়া আর কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, এটা বলতে হবে যে তোমাদের দুজনেরই কাজ হচ্ছে ফার্স্ট ক্লাস। মাস্টার অংশুর তো জবাবই নেই, আর স্টান্টম্যানও জবর।

আমি বললাম, এসব আবার কী বলছ জগুদা, তুমি একটা ছবিতে থাকলে তোমার নামেই তো টিকিট বিক্রি হয় বলে শুনেছি।

জগু ওস্তাদ হঠাৎ যেন দেমাকে ফুলে উঠল।

তা ভিলেনের পার্ট করছি আজ এগারো বছর ধরে। অনেক এলেম লাগে ভিলেন করতে, বুঝলে কেষ্টভায়া–এটা তোমার ওই ডিগবাজি খাওয়া নয়। ভাল অ্যাকটিং আর জিমন্যাস্টিক এক জিনিস নয়।

কেষ্টদা একটু হেসে নরম গলায় বলল, সে কি আমি অস্বীকার করছি ওস্তাদজি? আপনার নাম ছবির টাইটেলে বড় করে থাকবে। আমার তো নামই থাকবে না। আমাদের কাজ আর কুলিগিরিতে কোনও তফাতই নেই।

কেষ্টদা যে এত বিনয়ী হতে পারে সেটা হয়তো জগু ওস্তাদ আশা করেনি, তাই সে একটু থতমত খেয়ে কথা পালটে বলল, আপসোস কী হচ্ছে জানো মাস্টার অংশু–এমন একটা পাথর লোপাট হয়ে গেল, আর আমি একবারটি দেখতেও পেলুম না। শুধু তোমাদের মুখে শুনে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হল। অবিশ্যি কে নিয়েছে পাথরটা সে তো জানাই আছে।

তার মানে? আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না।

ওই বিক্রম চাকরটা এক নম্বরের বজ্জাত।

তুমি কী করে জানলে? জগু ওস্তাদের মতলবটা কী সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

জানব না কেন? বলল জগু ওস্তাদ, আমরা তো মদের দোকানে যাই নেশা করতে, তাই আমাদের সব রকম লোকের সঙ্গে মিশতে হয়। ও ব্যাটা একদিন এসেছিল দোকানে। আমাকে ভজাবার তাল করছিল। নেশা করে ব্যাটা বলে কি–আমার মনিবের একটা দামি পাথর আছে; তোমাকে এনে দিলে কত টাকা দেবে আমায়? ভেবেছে ফিল্ম অ্যাকটর তো, কোটিপতি না হলেও, লাখপতি তো হবে নির্ঘাত। আমি তখন সবে শুরু করেছি, মাথা একদম ক্লিয়ার। ব্যাটাকে দোকানের বাইরে নিয়ে এলুম, তারপর গলার মাদুলি ধরে টান দিয়ে মাথাটাকে মুখের কাছে এনে বললুম–আর একটিবার অমন কথা বলেছ কি তোমাকে সোজা পুলিশের হাতে চালান দেব।

তাই করলেই তো পারতেন, বলল কেষ্টদা, তা হলে আর এই কেলেঙ্কারিটা হত না।

পাথর তো আর ওই ব্যাটার কাছে নেই, বলল জগু ওস্তাদ, ওটা অন্য জায়গায় পাচার করে মোটা বকশিশ নিয়ে ভেগেছে ব্যাটা বিক্রম। পুলিশের বুদ্ধি থাকলে এখানকার যত হিরে জহরতের কারবারি আছে তাদের বাড়ি রেড করা উচিত। জলের দরে অমন একটা পাথর পেলে এরা তো লুফে নেবে। যে পাথরের দাম হয়তো বিশ লাখ, তার জন্য হাজার দু হাজার পেলেও ওই বিক্রম ব্যাটা বর্তে যাবে। একটা সামান্য চাকরের আর চাহিদা কত হতে পারে?

জগু ওস্তাদ তার কথা শেষ করে গুড নাইট করে চলে গেল। আমি একটু অবাক হয়ে কেষ্টদার দিকে চাইলাম।

কী মনে হচ্ছে কেষ্টদা? কেষ্টদা চুপ মেরে গেছে। দুবার এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এখন এক-একবার সত্যিই মনে হচ্ছে আমি ভুল শুনেছিলাম। অবিশ্যি সেটা হলেই ভাল হয়। যদি প্রমাণ হয় যে ওস্তাদ পাথরটা নিয়েছে বিক্রমের কাছ থেকে তা হলে ফিল্ম অ্যাকটরদের বদনাম হবে। সেটা মোটেই ভাল নয়।

না, তা নিশ্চয়ই নয়।

<

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়