সেই সকালটার কথা আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না। সেদিন ছিল রবিবার। তিনদিন ধরে সমানে বাদলা করে সেদিনই প্রথম ঝলমলে রোদ বেরিয়েছে। আমি একটা অঙ্ক কষে আমার খাতাটা বন্ধ করেছি এমন সময় বিশুদা এল। বিশুদা, বিশ্বনাথ গাঙ্গুলি, আমার জ্যাঠতুতো দাদা। সে একটা সিনেমা কোম্পানিতে কাজ করে। বিশুদা এসেই বলল, হ্যাঁ রে, তোর পুজোর ছুটি কবে থেকে শুরু হচ্ছে? আমি বললাম, সাতই অক্টোবর। কেন?

কারণ তোকে নিয়ে সকাবার তাল করছি।

তার মানে?

দাঁড়া, আগে কাকার সঙ্গে কথা বলি।

বাবা পাশের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন, বিশুদা সটান তাঁর সামনে গিয়ে হাজির হল, আমি তার পিছনে। বাবা কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন, কী রে বিশুসকাল-সকালকী ব্যাপার?

বিশুদার উত্তর শুনেই আমার বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করল। একটা জরুরি ব্যাপারে তোমার কাছে এসেছি ছোট্‌কা, বলল বিশুদা, আমাদের ডিরেক্টর সুশীল মিত্তির একটা ছবি করছেন। বেশিরভাগ শুটিং হবে বাইরে–আজমীরে। এতে একটা বছর বারোর ছেলের পার্ট আছে–খুব ভাল পার্ট, প্রায় বিশদিনের কাজ। আমার বিশ্বাস অংশুকে খুব ভাল মানাবে পার্টটাতে। এখন তুমি যদি…

শুধু আমি কেন, বললেন বাবা, আমার ছেলের একটা মতামত নেই?

বাবা যে কথাটা ঠাট্টা করে বলেছেন সেটা জানি, কিন্তু এটা বুঝলাম যে তাঁর খুব একটা আপত্তি নেই। অ্যাটিং জিনিসটা বাবা খুব পছন্দ করেন সেটা আমি জানি। আমাকে গলা ছেড়ে আবৃত্তি করতে বাবাই শিখিয়েছেন, আর ইস্কুলে আবৃত্তি করে প্রাইজ পেলে বাবাই সবচেয়ে বেশি খুশি হন।

ইস্কুল কামাই হবে নাকি? জিজ্ঞেস করলেন বাবা।

হলেও বড়জোর দুচারদিন, বলল বিশুদা। পুজোর ছুটির মধ্যে চোদ্দ আনা কাজ হয়ে যাবে; তারপর হয়তো চার পাঁচদিনের কাজ থাকবে কলকাতার স্টুডিওতে। অংশু তো ভাল ছেলে—দুচারদিন কামাইতে ওর কিছু ক্ষতি হবে না।

অংশুর কথা যে বলছিস, ও পারবে তো?

আলবত, বলল বিশুদা। তবে শুধু আমি বললে তো হবে না। কাল সকালে সুশীলবাবুকে একবার নিয়ে আসছি–সুশীল মিত্তির–আমাদের ডিরেক্টর। তবে ওঁর টেস্ট আমি জানি। আই অ্যাম সিওর অংশুকে ওঁর পছন্দ হবে। আর পার্টটাও খুব ভাল। ওই ছেলেকে নিয়েই যত কাণ্ডকারখানা। ওর পার্টটা ও আগেই পেয়ে যাবে, তুমি পড়িয়ে দিও। ওর কোনও অসুবিধা হবে না। তাছাড়া কাজের সঙ্গে সঙ্গে নতুন দেশ দেখা হবে সেটাও কি কম নাকি? কী রে অংশু, আমার সঙ্গে যেতে আপত্তি নেই তো? বাবা-মা থাকবেন না কিন্তু।

আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম আমার কোনও আপত্তি নেই। আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে।

বিশুদার দৌলতে আমার স্টুডিওতে গিয়ে শুটিং দেখা হয়ে গেছে। মোটামুটি কী ঘটনা ঘটে সেটা আমি জানি। দেখতে দেখতে আমার অনেকবার মনে হয়েছে–ওরকম আমিও পারি, ক্যামেরার সামনে আমার মোটেই ভয় করবে না। আমার ভুলের জন্য একই শট বার বার নিতে হবে না, কক্ষনও না।

অবিশ্যি সেটা কতদুর সত্যি তা এখনও জানি না।

বিশুদা আবার বলল, তোর কোনও চিন্তা নেই। কাজটা করতে তোর কোনও অসুবিধা হবে না। আর ছবি শেষ হয়ে সিনেমায় দেখানো হলে তোর কী নাম হয় দেখিস। এমনকী শ্রেষ্ঠ শিশু অভিনেতা হিসেবে পুরস্কারটা হয়তো পেয়ে যেতে পারে মাস্টার অংশুমান গাঙ্গুলি।

পরের দিন ডিরেক্টর সুশীলবাবু এলেন আমাকে দেখতে। ভদ্রলোক গম্ভীর হলেও, কড়া মেজাজের লোক বলে মনে হল না। উনি বলাতে আমি পুরাতন ভৃত্যটা আবৃত্তি করে শুনিয়ে দিলাম। তাতে মনে হল ভদ্রলোক খুশিই হলেন।

তবে তোমার একটা ক্যামেরা টেস্ট নিতে হবে দু-চারদিনের মধ্যে, বললেন সুশীলবাবু, সে ব্যাপারে বিশু তোমায় জানিয়ে দেবে। কয়েক লাইন কথা তোমার পাঠিয়ে দেব, সেটা তুমি মুখস্থ করে রেখো।

সুশীলবাবু চলে যাবার পর বাবা বলেন, দেখো বাবা, এও একরকম পরীক্ষা কিন্তু। স্কুলের পরীক্ষায় ভাল করো তুমি তেমনই এতেও ভাল করতে হবে। স্কুলে যেমন মাস্টারমশাই তেমনই এখানে ডিরেক্টর হবেন তোমার মাস্টার। তাঁর কথা শুনবে। পড়া যেমন মুখস্থ করো, তেমনই এখানেও তোমার পার্ট ভাল করে মুখস্থ করবে।

আমার ভয় ছিল যে মা হয়তো বেঁকে বসবেন, কিন্তু তিনিও এককথায় রাজি। ছেলে প্রায় এক মাসের জন্য দুরে চলে যাবে শুনে প্রথমে একটু খুঁতখুঁত করলেন, কিন্তু বিশুদাকে মা বাবা দুজনেই এত ভালবাসেন যে তাঁর উপর আমার ভার দিয়ে দুজনেই নিশ্চিন্ত।

আমি যে পার্টটা পেয়েই গেছি, ক্যামেরা টেস্টটা যে শুধু নামকাওয়াস্তে, সেটা বুঝলাম যখন দুদিন পরে বিশুদা আবার এল দরজি নিয়ে আমার জামার মাপ নিতে। কুর্তা আর চাপা পায়জামা পরতে হবে। আমাকে, রাজস্থানি পোশাক। কিন্তু শুধু একরকম পোশাকেই হবে না। আমাকে নাকি দুটো পার্ট করতে হবে: এক হল রাজা ভরত সিং-এর ছেলে অমৃৎ সিং, আর আরেক হল গরিব ইস্কুল মাস্টার গোপীনাথের ছেলে মোহন। দুজনেরই এক বয়স, এক চেহারা। পুরের মেলাতে দুজনের আলাপ হবে। একসঙ্গে দুজন একরকম দেখতে ছেলেকে দেখাবার জন্য ক্যামেরার কারসাজি ব্যবহার করা হবে। দুই নতুন বন্ধুতে মেলা ছেড়ে যাবে একটা নিরিবিলি জায়গায় খেলা করতে। সেখানে দুজন পোশাক অদলবদল করবে মজা করার জন্য। আর তার ফলে তিনজন গুণ্ডা রাজপুত্র ভেবে মোহনকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। তাদের মতলব হল রাজার কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে তারপর ছেলেকে ফেরত দেওয়া। এদিকে অমৃৎ বাড়ি ফিরে আসে মোহনের পোশাক পরে, আর এসে বাবা-মাকে সব কথা বলে। ছেলে পার পেয়ে গেছে জেনে বাবা-মা হাঁফ ছাড়েন, কিন্তু অমৃৎ জোর গলায় বলে যে তার বন্ধুকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত সে কারুর সঙ্গে কথা বলবে না। শেষকালে গল্পের হিরো তরুণ পুলিশ ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত রাঠোর অসমসাহসের পরিচয় দিয়ে মোটর সাইকেলে করে দস্যুদের হাত থেকে মোহনকে উদ্ধার করে আনবে।

গল্পটা জেনে আর পার্ট দুটো পড়ে আমার উৎসাহ দশগুণ বেড়ে গিয়েছিল, আর সেইসঙ্গে মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন জমা হতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে দুর্দান্ত সাহসী সূর্যকান্তর পার্টে কে অ্যাটিং করবে সেটা জানার জন্য ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। বিশুদা বলল ওই পার্টে শঙ্কর মল্লিক বলে একজন নতুন ছেলেকে নেওয়া হচ্ছে, সে নাকি দারুণ স্মার্ট আর খুব ভাল দেখতে। আমি বললাম, কিন্তু ও কি মোটর সাইকেল চালাতে জানে?

বিশুদা হেসে বলল, তা জানে ঠিকই, কিন্তু স্টান্টবাজির জন্য তো মাইনে করা স্টান্টম্যান আসছে বম্বে থেকে।

স্টান্টম্যান? সে আবার কী?

সে পরে দেখতে পাবি, বলল বিশুদা।

পাঁচই অক্টোবর আমাদের শুটিং-এর দল রওনা দিল আজমীর। হাওড়া থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে বান্দিকুই, বান্দিকুই থেকে আজমীর। তার মানে দুবার চেঞ্জ। পাঁচই সন্ধ্যায় রওনা হয়ে সাতই রাত্রে পৌঁছানো। আগে থেকে বগি বুক করে রাখা ছিল। চাকরবাকর ছাড়া আর সকলেই ধরে। গেছে একটা ফার্স্ট ক্লাস বগিতে। ট্রেনেই আমার সকলের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। অ্যাকটরদের মধ্যে এখন আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন সাতজন। এদের কাজ একেবারে প্রথম দিকেই। বাকি সবাই ক্রমে ক্রমে এসে পড়বেন। অমৃৎ সিং-এর বাবা-মা, মানে রাজা-রানীর পার্ট করছেন পুলকেশ ব্যানার্জি আর মমতা সেন। ইনস্পেক্টর সূর্যকান্তের পার্ট করছেন শঙ্কর মল্লিক, সে তো আগেই বলেছি। এ ছাড়া আছেন গুণ্ডাদের সর্দার ছগনলালের পার্টে জগন্নাথ দে। ইনি বাংলা ছবির নামকরা দুষ্ট লোক, বা যাকে বলে ভিলেন। এঁকে সবাই জগু ওস্তাদ বলে ডাকে। এইসব অ্যাকটর ছাড়া আছেন ডিরেক্টর সুশীলবাবু, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট উজ্জ্বল প্রামাণিক, ক্যামেরাম্যান ধীরেশ বোস, গল্পের লেখক সুকান্ত গুপ্ত, মেক-আপম্যান সজল সরকার। অ্যাসিস্ট্যান্টদের দলে আছেন সবসুদ্ধ আটজন, আর সবশেষে বিশুদা। এঁদের মধ্যে চোদ্দজন ট্রেন ছাড়বার কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো কামরায় ভাগ করে তাস খেলতে শুরু করেছেন। সাতজন খেলছেন রামি, আর সাতজন ফ্লাশ। আমি রামি জানি, তাই সেই কামরাতেই বেশিটা সময় কাটাচ্ছি। বিশুদাও রামির দলে ভিড়ে পড়েছে। যাঁরা খেলছেন না তাঁদের মধ্যে আছেন ডিরেক্টর সুশীলবাবু আর গল্প লিখিয়ে সুকান্ত। গুপ্ত। এঁরা দুজন ছবি নিয়ে আলোচনা করছেন। এছাড়া পুলকেশ ব্যানার্জি আর মমতা সেন দুজনেই হাতে ম্যাগাজিন নিয়ে বসে আছেন।

আমাকে আমার পার্ট দিয়ে দিয়েছে বিশুদা কলকাতায় থাকতেই। একটা ফাইলের মধ্যে প্রায় বিশপাতা ফুলস্ক্যাপ কাগজ। সেটা বাবা একবার পড়িয়ে শুনিয়ে দিয়েছেন আমাকে। তা থেকে আমি খানিকটা বুঝে গেছি কীভাবে আমাকে অ্যাটিং করতে হবে। খুব বেশি কথা নেই, তাই মুখস্থ করতে অসুবিধা হবে না। আসবার দুদিন আগে কলকাতার স্টুডিওতে আমার টেস্টটা নেওয়া হয়ে গেছে; তাতে শঙ্কর মল্লিকের সঙ্গে একটা ছোট দৃশ্যে আমাকে রাজস্থানি পোশাক পরে অ্যাটিং করতে হয়েছে ক্যামেরার সামনে। কাজটা নিশ্চয়ই ভাল হয়েছিল, তা না হলে সুশীলবাবু কেন আমার পিঠ চাপড়ে দুবার একসেলেন্ট বলবেন? আর সেই থেকেই লক্ষ করছি আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সুশীলবাবু হাসছেন।

বর্ধমানে থালিতে ডিনার খাবার পর আমি একটা আপার বার্থে উঠে নিজেই হোন্ডঅল খুলে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। মমতা সেন আমার কামরায় ছিলেন। তিনি বললেন, তুমি আমাকে এবার থেকে মমতামাসি বলে ডাকবে, কেমন? আর কোনও কিছু দরকার-টরকার হলে আমাকে বলবে।

আমি পাশ ফিরে চোখ বুজে ভাবতে লাগলাম। না জানি কত কী ঘটনা ঘটবে সামনের একমাসে। বিশুদা আছে, তাই বাবা-মা যে নেই সেকথা মনেই হচ্ছে না। একবার কালিম্পং গিয়েছিলাম আমার মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে। সেবারও বাবা-মা ছিলেন না। আমার কিন্তু কোনও অসুবিধাই হয়নি।

আমি জানি এবারও হবে না। কাজের মধ্যে দেখতে দেখতে একমাস পেরিয়ে যাবে।

এই ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুম এসে গেছে, টেরই পাইনি।

<

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়