১৩.

 হীরু সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে হাঁক দিলেন। শরীর আজকাল বোঝায় যে আগের দিন আর নেই।

হেমপ্রভা সারাসকাল কেঁদেছেন। চোখমুখ ফুলে গেছে। পরি আজই বম্বে গেছে সকালের ফ্লাইটে। ফ্লাইটটা খুব ভোরে নয়। তার আগে পরি যা বলে গেছে হেমপ্রভাকে তাতে তাঁর আর বেঁচে থাকার কোনোই ইচ্ছে নেই।

ওঁর মুখ দেখেই হীরু বুঝলেন যে, সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে। হেমপ্রভা নিজের ঘরের লাগোয়া বারান্দাতে বসেছিলেন বেতের চেয়ারে। এই বারান্দাটা পেছনের দিকে। এতে বসেও গানুবাবুদের বাড়িটা দেখা যায়। তবে এদিকটা অন্য দিক। মার্বেলে পাড় বাঁধানো পুকুর। তার চারপাশে নারকোল গাছের সারি। রঙ্গন, জবা, নানারকমের। টগর ইত্যাদি গাছ। বেলগাছ আছে একটি মস্ত বড়ো। তার নীচে ছোট্ট শিবমন্দির। কর্তামা বাঁ-হাতটি কোমরে রেখে এখনও দুজন বামুনঝির সাহায্যে কঁকিয়ে কেঁদে একবার ডাইনে ঝুঁকে আর একবার বাঁয়ে ঝুঁকে রোজ সকালে এদিকে আসেন। পুকুরে চান করার পর পুজো দিয়ে ফিরে যান।

এদিকেও অনেক পাখি আছে তারা যদিও পোষা নয় কিন্তু প্রায় পোষাই হয়ে গেছে। তাদের জন্যেও আলাদা করে নানারকম দানা, গম, চাল, ফল ইত্যাদি দেওয়া হয়।

হীরুবাবু কখন যে পেছন থেকে এসে পাশের চেয়ারে বসেছেন খেয়ালও করেননি হেম। মোক্ষদা যখন হীরুকে জিজ্ঞেস করল, চা দেব কি বাবু? তখনই মুখ ফিরিয়ে হীরুকে দেখতে পেলেন উনি। দেখতে পেয়ে, আবারও মুখ ফিরিয়ে বাগানের দিকে উদাস চোখে চেয়ে রইলেন।

মোক্ষদা উত্তর না পেয়ে এবং হেমপ্রভার থমথমে মুখের দিকে চেয়ে নিঃশব্দে চলে গেল।

আকাশ মেঘে ঢেকে রয়েছে। হাওয়া দিচ্ছে পুব দিক থেকে। গানুবাবুদের বাগানের নানা গাছ থেকে বর্ষার ফুল উড়ে আসছে হাওয়াতে। এখনই বৃষ্টি নামবে।

হীরুকে দেখেই দু-চোখ বেয়ে অঝোরে জল নামল আবারও হেমপ্রভার।

কী হল কী তোমার? হেম?

 হীরু সহানুভূতির গলাতে শুধোলেন।

হেম বললেন, পাখিদেরও ঘর থাকে। থাকে ফুলেরও।

মানে? হীরুবাবু বললেন।

আজ। পরি…। বলেই কান্নাতে ভেঙে পড়লেন হেম।

কী? কী করেছে তোমার পরি? দেব-না তার ডানা কেটে!

সে তো ডানা-কাটাই। হেম বললেন।

কী বলেছে কী? গলা নামিয়ে হেম বললেন, বলেছে, তুমি যে ওর বাবা, তা ও জানে। আমি এত বছর আমার-তোমার সম্পর্কটা লুকিয়ে রেখে স্থিরব্রতর জন্মদিনে মিথ্যে করে ওকে দিয়ে তার ছবিতে প্রণাম করিয়েছি। জিষ্ণুকে মিছিমিছি কাকার মেয়ে বলে পরিচয় দিয়েছি ওর। ও জিষ্ণুকে বিয়ে করতে চায়। ওদের দুজনের মধ্যে কোনোরকম রক্তসূত্রের আত্মীয়তা তো সত্যিই নেই।

হীরু অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন, বাগানের দিকে চেয়ে।

অনেকক্ষণ পর মুখ ফিরিয়ে বললেন, বিয়ে যদি করতে চায় করুক না হেম। তাতে তোমার আপত্তি কীসের?

এত বছর, এত কষ্ট করে ছেলে-মেয়ের মতো মানুষ করে তুললাম ওদের, আর সবই বৃথা যাবে? তোমার কষ্ট? ওরা কেউই নয় আমাদের?

আমার কোনো কষ্ট নেই হেম। তা ছাড়া আনন্দও তো কম ছিল না, যখন ছিল। শুধু কষ্টর কথাটাই মনে করলে চলবে কেন এল।

তুমি সায় দিচ্ছ এই বিয়েতে?

হ্যাঁ। আমার পূর্ণমত আছে এতে। আমি দাঁড়িয়ে থেকে এ-বিয়ে দেব। আমার মেয়ের বিয়ে আমি দাঁড়িয়ে দেব না তো, কে দেবে?

লোকে কী বলবে?

এই লোকের কথা ভেবেই তো তুমি আমাকেও বিয়ে করোনি হেম। পরির পিতৃপরিচয় গোপন করেও স্থিরব্রতর মৃত্যুর দু-তিন বছর পরে বিয়ে করলে আজকে তোমার এবং আমার এরকম চোর হয়ে থাকতে হত না সমাজের কাছে। তা ছাড়া, প্রথম থেকেই সত্যি কথাটা প্রকাশ করে দিলে আজকে পরিকে আমার মেয়ে বলে আমিও তো সম্মানের সঙ্গে দাবি করতে পারতাম। আমাদের সমস্ত জীবনটাই পরের বাড়ি গিয়ে চুরি করে পুতুল খেলা বলে মনে হত না জীবনের শেষে এসে।

ঠিকই বলেছ তুমি।

হেম বললেন, অঞরুদ্ধ কণ্ঠে।

একটু পর হীরু বললেন, জিষ্ণু জানে?

জানে কি আর না? তা ছাড়া বিয়ের বাকিই বা কী আছে এল। মেয়ে-তো আদ্ধেকটি রাত জিষ্ণুর ঘরেই কাটায় আজকাল। যখন ফিরে যায় তখন আমি বন্ধ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওর পায়ের শব্দ শুনি। দরজা খুলে কিছু যে বলব, সে-সাহস হয়নি আমার এতদিন। কাল রাতে, আর না থাকতে পেরে দরজা খুলে বলেছিলাম : কী হচ্ছে পরি? এসব কী হচ্ছে?

হুম। তাতে কী বলল পরি?

 পরি বলল, শাট-আপ।

 বলল, চরিত্রগুলো পালটে দিয়ে দেখো। মনে করো হীরুকাকু যখন আমাদের বাড়িতে থাকত তখন হীরুকাকুর ঘরে তুমি যাচ্ছ রাতের বেলা। আমি তখন ছোটো ছিলাম মা। কিন্তু তুমি যতক্ষণ না ফিরে আসতে আমি ভয়ে ঘুমোতে পারতাম না। আজ তুমি ভয়ে ঘুমোতে পারছ না, আমি যতক্ষণ জিষ্ণুর ঘর থেকে না ফিরি।

আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

পরি হাসতে হাসতে এবং জানো, টলতে টলতেও ওর ঘরে গিয়ে দরজা দিয়েছিল। সভ্যতা, সমাজ, লোকভয়, গুরুজনের প্রতি ভয়-ভক্তি সবই উবে গেল কি এমন করে? এই অল্প ক-টা বছরে?

হীরুবাবু বললেন, গেছে বই কী! অস্বাভাবিকও নয়। বদলটাই তো নিয়ম। তাকে মেনে নেওয়াটাই আধুনিকতা!

বলেই হাঁক দিলেন, ও মোক্ষদা। মোক্ষদা কোথায় গেলে?

ভেতর থেকে মোক্ষদা সাড়া দিল। সে এলে বললেন, আমাদের দুজনকেই একটু চা খাওয়াও দেখি। চিনি দিয়েই দাও ভালো করে আমাকে। আর একটা ওমলেটও বানিয়ে দিয়ো।

 মোক্ষদা চলে গেলে, হেম বললেন, চিনি খাচ্ছ কেন?

আর কী হবে ভয়-ভাবনা করে? এখন যে ক-দিন বাঁচব নির্ভয়ে বাঁচব।

হেম চুপ করে রইলেন।

 হীরুবাবু বললেন, তোমার অত চিন্তার কী এল তো? আমার তো মাথা গোঁজার জায়গা একটা আছে। নাকি? তোমার যদি সেখানে যেতে লজ্জা করে তাহলে তোমাকে শাঁখা-সিঁন্দুর পরিয়েই নিয়ে যাব। বিয়ে করে, বউ করেই নিয়ে যাব। তাহলে তো খুশি? যে আমার বউ-ই আসলে, তাকে না-হয় তিরিশ বত্রিশ বছর পরেই বিয়ে করব। কী এল বউ?

হেমের চোখে তখনও জল ছিল। কিন্তু তারমধ্যেই হেসে উঠলেন।

হীরু ওঁর পিঠে হাত রাখলেন।

হেম হাতটা তুলে নিজের কোলে রাখলেন। বললেন, আমরা কি পাপ করেছিলাম? হ্যাঁ গো?

আমি তো তাকে পুণ্য বলেই জানি। তুমি পাপ ভাবছ কেন?

 মোক্ষদা ভেতরের বারান্দা থেকে গলা-খাঁকরে ট্রেতে বসিয়ে চা ও ওমলেট নিয়ে এল।

বলল, চিনি আলাদা করেই এনেছি, যেমন মায়ের জন্যে আনি। দুধও। কতটা দেব বাবু?

আমি নিয়ে নেবোখন। আর শোনো মোক্ষদা। শ্ৰীমন্তকে ডাকো। এখনও বাজার বন্ধ হয়নি। এখানে না পেলে শ্যালদায় যেতে বলবে মিনি ধরে শ্ৰীমন্তকে। বলবে, দেড় কেজির একটি ভালো বড়ো ইলিশ মাছ নিয়ে আসবে। আর তুমি রাঁধবে। টক দইও আনতে বোলো। একটু কচুর শাক। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে। একটু ছোলা দিয়ো তাতে। যাও। শ্ৰীমন্তকে পাঠিয়ে দাও তাড়াতাড়ি আমার কাছে একবারটি।

শ্ৰীমন্ত এসে দাঁড়াতেই হীরুবাবু শ্ৰীমন্তকে টাকা দিয়ে বললেন, শ্ৰীমন্ত, তুমি আগে আমাকে দু-বোতল ব্ল্যাক-লেবেল বিয়ার এনে দিয়ে যাও তো শা-র দোকান থেকে।

সেটা কী বাবু?

মদ। গিয়ে বললেই দেবে। ওটা দিয়ে গিয়ে, তার পর চট করে বাজারটা সেরে এসো। একটা বোতল ফ্রিজ-এ রেখে অন্য বোতলটা খুলে একটা গ্লাস দিয়ে আমাকে দিয়ে যাবে। কী বলবে?

আপনি বাবু? মদ?

হ্যাঁ গো শ্ৰীমন্ত। আমি। লুকোছাপার দিন আর নেই। পরি খাচ্ছে, জিষ্ণুও বাড়ি বসেই, আমাদের ছেলে-মেয়েরা; তা আমি বুড়োমানুষ একটু না হয় খেলুমই। আজ ভালো করে খেয়ে ঘুম লাগিয়ে জিষ্ণু ফিরলে, তার সঙ্গে একবারটি দেখা করে তার পরই যাব। যাও শ্ৰীমন্ত। দেরি কোরো না।

শ্ৰীমন্ত চলে গেলে হেম বললেন, তুমি আবার এসব খেতে নাকি? শীতকালে একটু আধটু ব্রাণ্ডি ছাড়া আর তো কোনো দিন কিছুই দেখিনি।

তুমি আমার কতটুকু দেখেছ হেম? তা ছাড়া, অতীতের কথা ছাড়ো, বর্তমানের কথা এল।

এমন সময়ে কড় কড় শব্দে বাজ পড়ল। তার পরেই বৃষ্টি নামল মুষলধারে। চারধার অন্ধকার করে।

বা:

হীরুবাবু বললেন, বৃষ্টির দিকে চেয়ে।

আমি যাই জানলা বন্ধ করি গে।

হেম উঠতে গেলেন।

আহা চা-টা রসিয়ে রসিয়ে খেয়েই যাও। অ্যাই দেখো। শ্ৰীমন্তকে পান আনতে বলতেই ভুলে গেলুম!

পান মোক্ষদার কাছে আছে।

 জর্দা?

 বাবা? এক শো বিশ তো? আমার কাছে রাখা আছে।

আহা! তবে তো কোনো কিছুরই অভাব নেই।

 তোমার কচুর শাক হতে সময় নেবে কিন্তু। নিক-না। আমার তোমার হাতে এখন সময়ের তো আর কোনো অভাব নেই, অঢেল সময়।

.

১৪.

 আজ শনিবার। পূর্ণিমা।

পিপি গত দশ-বারোদিন হল এখানেই আছে। কাকিমা খুবই খুশি সঙ্গী পেয়ে। পরি কিন্তু কোল্ড এবং ইনডিফারেন্ট। কুরুভিল্লাকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে পরি। কলকাতা থেকে বদলি নিয়ে ও চলে যাচ্ছে সামনের শনিবারই। ব্যাঙ্গালোরেই থাকবে। তবে কোম্পানির বসকে বিয়ে করে সেই কোম্পানিতেই চাকরি করার বিস্তর অসুবিধেও আছে। তাই ওদের গ্রুপেরই একটি সাবসিডিয়ারিতে জয়েন করেছে পরি– অ্যাজ মার্কেটিং ম্যানেজার।

পরির জীবনে সব ঘটনাই হঠাৎ ঘটে। জিষ্ণুকে ও যেমন হঠাৎ-ই কাছে টেনেছিল তেমনই কুরুভিল্লাকেও টেনেছে। টেনে জিষ্ণুকে দূরে ঠেলেছে।

পরি সেদিন বলছিল জিষ্ণুকে যে, কুরুকে এ-বাড়িতে আনা যায় না। হি ইজ সো ফ্যাবুলাসলি রিচ। লেটেস্ট মডেলের মার্সিডিস ছাড়া চড়ে না, স্কচ ছাড়া খায় না, আর যে বাড়িতে থাকে সে তোমাকে কী বলব জিষ্ণু। ভিলা। টেরাকোটা টালির ছাদ। পোশিও। টেরাস। গার্ডেন। অর্কিড-হাউস। সুইমিংপুল। ভাবাই যায় না। আ কমপ্লিটলি আউট অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড প্লেস।

একটু থেমে শ্বাস ফেলে বলেছিল, লাইফ ইজ ফর লিভিং জিষ্ণু। নট ফর ব্রুডিং।

তার পরই বলেছিল, জানো, তোমার মতো আগে কাউকেই দেখিনি, তাই তোমাকেই সবচেয়ে ভালো বলে জানতাম। কিন্তু তোমার চেয়েও ভালো যে কেউ আছে বা থাকতে পারে, তোমার চেয়েও হ্যাণ্ডসাম, তা চিন্তারই বাইরে ছিল। তা ছাড়া পুরুষের সবচেয়ে বড়ো সৌন্দর্য কী তা জানো? বিত্ত, সম্পদ, এবং ক্ষমতা। জিষ্ণু বলেছিল, যশ?

যশও। কিন্তু যশস্বী তো সবাই হতে পারে না।

পরি নিজে খুশিতে ডগমগ। কিন্তু বাড়িসুদ্ধ সবাই পরির জন্যে দুঃখিত। পরি কুরুভিল্লাকে বলেছে, ওর মা-বাবা নেই। গভর্নেসের কাছে মানুষ।

কুরুভিল্লা নাকি বলেছে যে, সে শুধু পরির জন্যেই পরিকে বিয়ে করছে। পরির বংশপরিচয়, কুষ্ঠি-ঠিকুজিতে সে আদৌ ইন্টারেস্টেড নয়। শি এলন ইজ মোর দ্যান এনাফ টু ফিল হিজ লাইফ।

পরি বলেছিল, কুরুভিল্লা মানুষটাও খুব একলা। মাফিয়াটাইপ ব্যাবসা চালায়। শনিবারে শুধু একবার একজিকিউটিভদের মিট করে। অন্য সময়ে নিজেকে নিয়েই থাকে। নিজের সুখ, নিজের শখ, নিজের আত্মাদ। জীবন উপভোগ করতে জানে মানুষটা। অথচ কী অল্প বয়েস।

সাউথেই চলে যাও তোমরা।

পরি বলেছিল জিষ্ণুকে, এবারে সাউথের ফ্ল্যাটটা নিয়েই নাও জিষ্ণু। দেরি কোরো না। মা তো হীরুকাকার সঙ্গে নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে থাকছেনই। আর যে নতুন আপদটিকে বাড়িতে এনে তুলেছ তাকে অবিলম্বে বিদেয় করো। নইলে, করুণা, দয়া, সমবেদনা, অনুকম্পা এসবের ককটেল-এ কখন দেখবে যে, পেরেম হয়ে গেছে। বাঙালিদের এই পেরেম ব্যাপারটার কোনো মাথামুন্ডু নেই। কখন যে কোথায়, কার সঙ্গে; কেন হয়ে যায় তা, বলা ভারি মুশকিল। আমাকে দেখে বুঝছ না? আজকাল বিয়ে-ফিয়ের ঝামেলাতে না যাওয়াই ভালো। যদি করোই তবে বিয়ে করবে তোমার লেভেলের কমপক্ষে এক বা দু-লেভেল ওপরে।

হুঁ।

জিষ্ণু বলেছিল।

পরির সঙ্গে ইদানীং কনভার্সেশান চলে না। পরির সলিলোকিই শুনতে হয় একতরফা।

ওর ঘরের লাগোয়া বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল জিষ্ণু। আকাশে মেঘ নেই। ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। পরিও এসে দাঁড়িয়েছিল পাশে। ওদের বাড়ির সকলেরই মন একটা কারণে খারাপ। খুবই খারাপ। গানুবাবুদের বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে। গাছগাছালি, সবুজ, পেটাঘড়ির আওয়াজ, আমির খাঁ সাহেবের দরবারি কানাড়া, ভীমসেন যোশীর ভূপালি, ছবি ব্যানার্জির কীর্তন, গোপাল চট্টোপাধ্যায়ের টপ্পা, এ টি কানন সাহেব আর মালবিকা কাননের গান এসব আর শোনা হবে না, তাঁদের স্বকণ্ঠে দিনরাতের বিভিন্ন প্রহরে। পাখি ডাকবে না আর। পুকুর ভরাট হবে। বৃষ্টিশেষের হাওয়ায় বাতাবি ফুলের গন্ধ আসবে না ভেসে।

সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে মালটিস্টোরিড বাড়ির নির্মাতা। সাল্লু অ্যাণ্ড চৌধুরি। কনট্রাক্টরস অ্যাণ্ড প্রোমোটারস। আর্কিটেক্টস : রহমুতল্লা অ্যাণ্ড বিসমিল্লা। বড়ো বড়ো সার্চলাইট লাগানো হয়েছে। বাড়ি ভাঙা ও গাছ কাটা শুরু হয়ে গেছে। সকাল ছ-টা থেকে রাত দশটা অবধি রোজ কাজ চলেছে। এতক্ষণ ইলেকট্রিক করাতের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল একটানা। গাছ কাটা হচ্ছে ক্রমাগত। স্নায়ু ঝনঝন করছে এই বাড়ির সকলের ওবাড়ির মেঝে থেকে মার্বেল তোলার ঠকাঠক আওয়াজে।

গানুবাবুরা এ বাড়িতে এখন আর কেউই নেই। বাড়ি ভাঙার আগেই সকলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের ধনসম্পত্তি, বহুমূল্য হিরে-জহরত, তাঁদের বৈশিষ্ট্য এবং যাবতীয় গর্ব এবং দম্ভমেশা বিনয় নিয়ে সাউথের ম্যাণ্ডেভিলা গার্ডেনস-এর নবনির্মিত একটি মাল্টিস্টোরিড বাড়িতে তিনটি চার হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের দখল নিয়েছেন তাঁরা। তার পরের হিসেব-নিকেশের কথা পাড়ার লোকে কেউ জানে না। এখানকার নতুন বহুতল বাড়ি শেষ হলেও এখানে আর ফিরবেন না তাঁরা। সাউথেই থাকবেন।

কর্তামা নাকি জীবনে প্রথমবার লিফটে চড়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলেন। ছোটোছেলে বলেছিল কর্তামাকে! সাউথে থাকতে অনেক হ্যাঁপাও আছে। এটুকু না পোয়ালে চলবে কী করে? মানুষ তো এবারে চাঁদে গিয়েও থাকবে শুনছি। সেখানে তো আরও হ্যাঁপা।

ওরা চলে যাওয়াতে পাড়ার লোকে কেউই দুঃখিত হননি। কারণ তাঁরা এপাড়ার এবং এ গলির মানুষদের মানুষ বলেই গণ্য করতেন না। সকলেরই দুঃখ হয়েছে অন্য কারণে। দুঃখ, একটা যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে, সবুজের শেষচিহ্নও নিশ্চিহ্ন হচ্ছে বলে।

বাইরে বোর্ড লেগেছে। সেল। সেল। সেল। প্রকৃত বার্মা সেগুনের দরজা, জানালা, কড়ি বরগা, ইটালিয়ান মার্বেল, অ্যান্টিক ফার্নিচার, লেজারার্স কোম্পানির।

হঠাৎ গদ্দাম শব্দ করে সারাপাড়া কাঁপিয়ে, মাটির সঙ্গে তার বহুবছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে মুখ থুবড়ে পড়ল বিশাল কনকচাঁপা গাছটি।

 জিষ্ণু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বর্ষায় ফুলে ফুলে ভরে যেত। গন্ধে ম ম করত সারাপাড়া। কত বছরের, কত সুখ-দুঃখের সাথি এই গাছটি। মনটা বড়োই খারাপ হয়ে গেল।

পরি বলল, জানো জিষ্ণু ব্যাঙ্গালোরে যে-বাড়িতে যত গাছ আছে সেই অনুপাতে কর্পোরেশান ট্যাক্সে ছাড় দেয়? আর এখানে মালটিস্টোরিড বাড়ির প্ল্যান স্যাংশান করার সময়ে গাছ–কাটার বা গাছ লাগানোর কোনো শর্তই আরোপ করা হয় না। পুরো শহরটা মরুভূমি আর কংক্রিটের পাহাড় হয়ে গেল দেখতে দেখতে। কারোরই মাথাব্যথা নেই। আবহাওয়া, বিহারের মতো হয়ে গেল।

ভালোই করেছ ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে। মানুষের মতো বাঁচতে তো পারবে।

মোক্ষদাদি এসে ওদের খেতে ডাকল।

খাবার টেবিলে পরি ও জিষ্ণুর সঙ্গে খেতে বসে না পিপি। ওদের টুকটাক পরিবেশন করে। বলে, কাকিমার সঙ্গে পরে খাবে। একদিন চিতলমাছ বেঁধে খাইয়েছিল ও। হীরুকাকা সেদিন খেয়েছিলেন। এবং খেয়ে খুব প্রশংসা করেছিলেন। জিষ্ণুও। পরি, মাছের ভক্ত আদৌ নয়।

পিপি অল্প কদিনেই কেমন আস্তে আস্তে এ-বাড়ির মেয়ে হয়ে উঠছে। তবে কুণ্ঠা ও হীনম্মন্যতা এখনও পুরোপুরি যায়নি। মোক্ষদাদির ঘরটার রং ফিরিয়ে মোক্ষদাদিকে একতলার গেস্ট রুমটি দেওয়া হয়েছে। দোতলাতেই থাকবে ওর নিজের যৎসামান্য ফার্নিচার এনে চার পাঁচ দিন পর থেকে পিপি। কাকিমাকে বলেছিল, মাসে হাজার টাকা করে দেবে।

কাকিমা তাতে বলেছেন, অত টাকা দেবে কেন? পাঁচ-শো করে দিলেই যথেষ্ট। সেটাও তোমার আত্মসম্মানেরই জন্যে। কিছু না দিলেই কিন্তু খুশি হতাম আমি। এত লোক খাচ্ছি। আমরা, আর একটা পেটের জন্যে, কী আর বাড়তি খরচ?

পিপি নাকি বলেছে, তা কী হয় কাকিমা? সব কিছুই বার বার করে হারিয়ে এতদিনে নতুন ঘর পেলাম। আপনার কাছে থাকতে পেলাম, মা পেলাম, নিরাপত্তা..

আর এম কে বলে পিপির মাইনেও সাড়ে তিন করে দিয়েছে জিষ্ণু। কোম্পানির আয় এখন খুবই ভালো। আর এম মানুষটিও ভালো। সেনগুপ্ত সাহেবই যা…।

আশ্চর্য! কতরকমের মানুষই না থাকে সংসারে। একটি অসহায় মেয়ের সর্বনাশ করতে না পেরে, কী নিপুণভাবে তার চরিত্রহনন করেছিলেন! চরিত্রখেকো কোম্পানি লিমিটেড বলে একটি কোম্পানি খুললে পারেন ভদ্রলোক। সুমন্ত্রর মৃত্যুর পর জিষ্ণুর চোখে আর চাইতে পারছেন না সেনগুপ্ত সাহেব। জিষ্ণুও চায়নি তাঁর চোখে। খারাপ লোকদের চোখে যত কম চাওয়া যায় ততই ভালো।

রাতে খাওয়ার পরে সে-রাতে পরি জিষ্ণুর ঘরে এল। দু-হাতে জিষ্ণুকে জড়িয়ে ধরে আশ্লেষে অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেল। তার পর বলল, গুড নাইট। তুমি আমার প্রথম প্রেমিক জিষ্ণু। চিরদিনই থাকবে। কুরু একটু ট্যাঁ-ফোঁ করলেই তোমার কাছে ফিরে আসব। আমার জায়গা যেন খালি থাকে। মনে রেখো একথা।

জিষ্ণু ভাবছিল, কুরুকুলে না বনিবনা হলে পান্ডবের কাছে ফিরে আসবে– এ কেমন আবদার!

পরিকে সত্যি সত্যিই রাঁচি পাঠানো দরকার। পিকলুর স্ত্রী খুশির মতো মিথ্যে মিথ্যে নয়। খুশিকেও সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে যাতে তার সব সম্পত্তি তার হাতেই তুলে দেওয়া যায়, তার জন্যে উকিল সলিসিটর ডাক্তার সকলের সাহায্য নিয়ে যা করা দরকার তার সবরকম চেষ্টাই শুরু করে দিয়েছে জিষ্ণু। জিষ্ণুর সঙ্গে যদি খুশির যোগাযোগ একটু বেশি থাকত তবে হয়তো পিকলুটা এমন করে নষ্ট হয়ে যেত না। পিকলুর ওপরে প্রচন্ড রাগ হয় জিষ্ণুর। আবার ভীষণ দুঃখও হয়। ওর একমাত্র বন্ধু ছিল সে। প্রাণের বন্ধু। এরকম তো ও ছিল না। পিকলুর মতো ভালো, সুরুচিসম্পন্ন, নম্র, ভদ্র মানুষ জিষ্ণু কমই দেখেছে এ-জীবনে। অথচ পিকলু!

কোম্পানি ওকে দুটি এয়ারকণ্ডিশনার অ্যালট করেছে। এখানে এ-বাড়িতে তা লাগানো যায় না। লাগালে, পাড়ার সকলের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যাবে। গানুবাবুদের মতোই হয়ে যাবে ওরা। নাঃ, ওকেও সাউথেই চলে যেতে হবে। যেখানে কেউ কাউকে বেশি প্রশ্ন করে না। বম্বের মতো। যে-পাড়া পুরোপুরি কসমোপলিটান। যেখানে অতীত নিয়ে কারোরই কোনো বিড়ম্বনা নেই। সাউথে না গিয়ে উপায় নেই আর। যেতেই হবে।

খাওয়া-দাওয়ার পর শুয়ে শুয়ে ভাবছিল জিষ্ণু যে, আগামীকাল একবার বিকেলের দিকে তারিণীবাবুর বাড়ি যাবে। পিপির স্বামী-কন্যার মৃত্যুর পর পিপির ব্যাপারে এতখানিই জড়িয়ে পড়েছিল ও যে, মামণির কথা সত্যিই মনে ছিল না। যে কাছে থাকে, কাছাকাছি থাকে, তার দাবিই বোধ হয় অগ্রগণ্য হয়। কে জানে? জিষ্ণু বুঝতে পারে না নিজেকে। তা ছাড়া পিপিকে তো সে অনেক দিন ধরেই জানে। অনেক বছর। যদিও সে জানা অফিসেরই জানা। একজন ব্যস্ত চটপটে কম্পিটেন্ট সেক্রেটারি হিসেবেই। ঘরোয়া পিপিকে তো সে চিনত না। অফিসে যে সর্বক্ষণ তার কাছে থাকে, তাকে আড়াল করে রাখে নানা উপদ্রব থেকে; তার মিটিং, কনফারেন্স, লাইফ ইনশিয়োরেন্স প্রিমিয়াম, ককটেইল বা লাঞ্চ বা ডিনারের সব এনগেজমেন্ট, অ্যাপয়েন্টমেন্ট এবং দায়-দায়িত্বর কথা, যে-মানুষটি মনে করিয়ে দিয়ে এসেছে এত বছর হল তাকেই বাড়িতে কাকিমার পাশে হালকা প্যাস্টেল-রঙা তাঁতের ডুরে শাড়ি পরে ঝিঙে-পোস্ত খেতে দেখে অবাক হয়ে যায় জিষ্ণু। প্রত্যেক নারীর মধ্যেই অনেকগুলি নারী থাকে। সাপের খোলস বদলের মতো তারা খোলস বদলে বদলে নতুন নতুন চেহারাতে প্রতিভাত হয়। সাপ বদলায় ঋতুতে। নারী বদলায় প্রহরে। এই তফাত।

পাগলি পরি জিষ্ণুর জীবন থেকে সরে যাওয়াতে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এখন সিরিয়াসলি ভাবার সময় এসেছে জিষ্ণুর। মাঝে মাঝেই ওর সত্যিই একলা লাগে বড়ো। মনের কাছাকাছি কাউকে চায়। যার সঙ্গে বসে একসঙ্গে গান শুনতে পারে, নানা বিষয়ে আলোচনা করতে পারে, ইচ্ছে করলে যাকে আদরও করতে পারে সমাজ বা বিবেকের কুটি ছাড়া; এমন কেউ।

ওর মনোজগতে সাম্প্রতিক অতীতে অনেকই পরিবর্তন এসেছে। পুষির স্মৃতি যেন আস্তে আস্তে ক্রমশই হালকা হয়ে আসছে। তারই আসনে মামণি এবং পিপি, হয়তো বেশি করেই পিপি এসে বসেছে। চোখের আড়ালে গেলে মনের আড়ালেও চলে যায় মানুষ। এই রূঢ় সত্যকে উপলব্ধি করেছে জিষ্ণু।

 দোতলার সিঁড়ি থেকে ওআর পিপি যখন অফিস যাবে বলে তৈরি হয়ে নামছিল, তখন কাকিমা সেদিন হীরুকাকাকে বলছিলেন ওদের দুটিকে ভারি মানায় কিন্তু। পিপি যেমন সুন্দরী, বুদ্ধিমতীও তেমনি। আমার তো ওকে পুষির চেয়েও বেশি পছন্দ।

আঃ সেদিন আমায় যা কাঁকড়া বেঁধে খাওয়ালে না! কী ভালো যে রেঁধেছিল হেম।

হীরুকাকু বলেছিলেন।

 দ্রুত নেমে এসেছিল সিঁড়ি দিয়ে জিষ্ণু। কে জানে পিপি শুনতে পেল কি না!

আজই শ্ৰীমন্তদার কাছে শুনেছে শ্ৰীমন্তদাকে সঙ্গে করে পিপি ফাইভ-স্টার হোটেলের হাউসকিপিং স্টাফের মতো জিষ্ণুর ঘরে এসে গতকাল সব গোছগাছ করে গেছিল নাকি পিপি। ঘুমের ওষুধগুলো নাকি ও-ই শ্ৰীমন্তদাকে দিয়ে জোর করে ফেলিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, শ্ৰীমন্তদা তোমার দাদাবাবু রাগ করলে বোলো যে, আমিই ফেলে দিয়েছি। তার পরও যদি আমাকে ডাকেন তবে আমিই যা বলার বলব।

জিষ্ণু ডাকেনি পিপিকে। কিন্তু বুঝতে পারছে যে, একটু একটু করে ও জমি খোয়াচ্ছে। মেয়েদের যুদ্ধর কৌশলটা এমনই। তরোয়াল বা বন্দুকের হঠাৎ আঘাতে জেতা তাদের ধর্ম নয়। প্রকৃতি যেমন করে মানুষের কাছ থেকে ধীরে ধীরে তার কিশলয়ের পতাকা উড়িয়ে রুক্ষ শূন্যতার ওপরে দখল নেয়, মেয়েরাও তেমন করেই নেয় পুরুষের ওপরে। প্রকৃতি সবচেয়ে বেশি করে প্রতিভাত হন তো নারীতেই! সুমন্তর মৃত্যুর পর থেকেই কী যেন একটা ঘটছে জিষ্ণুর মধ্যে। লিউকোমিয়ার মতো কোনো অসুখ। ক্রমশই ও ভীষণ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অথচ জ্বর নেই, পেটে ব্যথা নেই, মাথাধরা নেই। ভালো লাগছে না ওর। ও বড়ো ভয় পাচ্ছে। এ দারুণ এক আনন্দমিশ্রিত ভয়।

পিকলু মাঝে একদিন অফিসে ফোন করেছিল। জিষ্ণু মানা করে দিয়েছে পিপিকে কোনো নন-বিজনেস বা পার্সোনাল কল দিতে। অপারেটরকে বলে দিয়েছে ডায়রেক্টলি যেন সব কল জিষ্ণুকেই দেয়। কিছুদিন অসুবিধে হলে হবে। মানা করেছে কেবল পিকলুরই ভয়ে। পিকলু আবার পিপিকে কী না কী ভয় দেখাবে, কে জানে!

পিকলু বলল, কী রে জিষ্ণু? আছিস কেমন?

 ভালো। তুই?

আমি যেমন থাকার তেমনই আছি।

খুশি কেমন আছে?

 কে?

খুশি।

ইয়ার্কি করছিস?

 ইয়ার্কি কেন মারব?

তোর কথার মানে বুঝছি না।

রাঁচিতে তাকে পাগল সাজিয়ে বন্ধ করে রেখেছিস তার সম্পত্তি হাতাবি বলে? তুই কোথায় নেমে গেছিস পিকলু? ছিঃ ছিঃ। চিন্তা করতে পারিস?

ও, ওই মাগিটা বুঝি তোকে বানিয়ে বানিয়ে এইসব বলেছে? কালনাগিনি ঘরে তুলেছিস তুই। একদিন বুঝবি এখনও বন্ধুর কথা না শুনলে। কলকাতা শহরে এমন লোক নেই যার সঙ্গে ও শোয়নি। কতটুকু চিনিস তুই ওকে?

বন্ধুই বটে। কী ভাষার ছিরি! ছি! ছি!

একদিন যে এই লোকটা ওর বন্ধু ছিল, একথা মনে করেও জিষ্ণুর ঘেন্না হয় আজকাল।

 আমার টাকাটা? কী করবি?

টাকা তোকে আমি দেব না তো বলেছি। কোনো টাকাই দেব না।

শোন, পাঁচ হাজার নয়। তোর কাছে আমি পঞ্চাশ হাজার চাই। নইলে তোর বাড়ির সব কেচ্ছা আমি কলকাতা শহরময় ময়লার গাড়ি করে ছড়িয়ে বেড়াব। তুই কত বড়ো রেসপেক্টেবল হয়েছিস তখন বোঝা যাবে।

আমার কোনো গোপন কথা নেই। ব্ল্যাকমেইল করে সুবিধে হবে না। বরং জেলে যাওয়ার জন্যে তুই তৈরি হয়।

তৈরি হয়েই আছি। তোর জ্ঞান না দিলেও চলবে।

 দেখ পিকলু, খারাপ মানুষ পৃথিবীতে চিরদিনই ছিল এবং থাকবে। কিন্তু কী করে এমন হয়ে গেলি? নষ্ট হয়ে গেলি?

ভালোই বলেছিস। হাঃ। জীবন, সময়, পরিবেশ, উচ্চাশা– এইসবই নষ্ট করে দিল বোধ হয়। হাঃ। তুইও যেমন করে নষ্ট হয়ে গেলি জিষ্ণু। নষ্ট হওয়ার নানারকম হয় তা বুঝি। জানিস না?

উচ্চাশা! এটাই কারণ বলছিস? তা ছাড়া অত হাঃ হাঃ করছিস কেন? যাত্রা-টাত্ৰা করিস নাকি আজকাল?

সকলেই যাত্রা করে। তুইও করিস। তবে স্টেজে করিস না, এই-ই যা। কারণ না হওয়ার কী আছে? আমার কি ইচ্ছে করতে পারে না, তোর মতো এয়ার-কণ্ডিশানড মারুতিতে ওয়েল ড্রেসড বিজনেস-স্যুট পরে এসে এয়ার-কণ্ডিশনড অফিসে বসে কাজ করি? বাড়িতে নিজের কাজিন-এর সঙ্গে শুই। অফিসে সেক্রেটারির সঙ্গে। তিন-চার মাসে একবার করে ফরেনে যাই? একদিনের কাজ সাত দিনের ছুটি। বড়ো বড়ো কথা বলি। বন্ধুরা টাকা চাইলে তাদের জ্ঞান দিয়ে ফিরিয়ে দিই। ইচ্ছা করে কি না? বল? এটা কি আমার উচ্চাশা নয়? এটাই তো হাইট অফ উচ্চাশা। তুই তো পড়াশুনোতে আমার চেয়েও খারাপ ছিলি। নেহাত ইংরিজিটা একটু ফরফর করে বলতিস। ইংরিজি বলতে পারলেই যদি মানুষ শিক্ষিত হত তবে তো পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথের ফ্রেঞ্চ-ক্যাপ আর টোব্যাকো বিক্রেতারাও সকলেই শিক্ষিত। আমার টাকা চাই জিষ্ণু। টাকা থাকলে এই সমাজে এই শহরে, এই দেশে লোকের মুখে থু থু দিয়ে, লাথি মেরে আরামে বেঁচে থাকা যায়। যেমন করেই হোক, আমার টাকা চাই-ই। বাই হুক আর বাই ক্রুক। টাকার চেয়ে বড়ো সুখ আর নেই।

তুই বড়ো লম্বা লম্বা সেন্টেন্স বলিস আজকাল। অসহ্য।

হাঃ।

আবারও যাত্রার নায়কের মতো হাসল পিকলু।

অসহ্য। মনে মনে বলল জিষ্ণু।

পাশ ফিরে শুল জিষ্ণু।

পিপি সব কটি ঘুমের ওষুধ ফেলে দিয়ে ঠিক করেনি। হয়তো সবগুলো ফেলেওনি। বলেছিল, দিদি নিজের কাছে বোধ হয় রেখে দিয়েছে কিছু। সত্যিই আজ ঘুম আসছে না। রাত একটা বেজে গেল। পিকলুর কথা মনে হতেই। আরও কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে শেষে বিছানা ছেড়ে উঠল ও। কাকিমার ঘরে গিয়ে টোকা দিল।

কে?

আমি জিষ্ণু।

কী হয়েছে রে?

 কাকিমা, পিপিকে এল না, একটা ট্রাপেক্স দিতে। সব ওষুধ নাকি ও নিয়ে রেখেছে। বলেছে ঘুমের ওষুধ রোজ খাওয়া ভালো নয়। ঘুম আমার কিছুতেই আসছে না।

কী ওযুধ বললি?

ট্রাপেক্স টু।

 জিষ্ণুর গলা শুনে পরিও দরজা খুলে বেরোল। দাঁড়িয়ে থাকল নিজের দরজার সামনে জিষ্ণুর দিকে তাকিয়ে।

পিপিও ততক্ষণে দরজার কাছেই, কিন্তু কাকিমার আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘর থেকে বেরোয়নি জিষ্ণুর সামনে। রাতে কাকিমা পিপিকে সঙ্গে করে নিয়ে শুচ্ছেন ক-দিন হল। পরির মধ্যে যা-পাননি তা হয়তো পিপির মধ্যে পেয়ে কাকিমা এমন করছেন। কে যে কার মধ্যে কী পায় তা কি অন্যে বলতে পারে?

পরি বলল, ট্রাপেক্স ছাড়াও অন্য নানারকম ঘুমের ওষুধ তো হয়।

 আছে তোমার কাছে?

দোনামনা করে বলল জিষ্ণু।

আছে ঘরে যাও। আমি যাচ্ছি। গিয়ে খাইয়ে আসছি। জিষ্ণু বুঝল যে, কথাটা দ্ব্যর্থক। এবং কাকিমার সামনে পরি এরকম একটি দ্ব্যর্থক কথা উচ্চারণ করবে, তা ভাবতেও পারেনি।

 পিপি অপরাধীর গলায় বলল, ওষুধগুলো আমি সত্যিই ফেলে দিয়েছি। তবে বায়োকেমিক ওষুধ দিচ্ছি আমি। আমার কাছে আছে।

 বলেই, ঘরের ভেতরে গিয়ে ক্যালি-ফস সিক্স এক্স-এর একটি শিশি, বের করে আনল ওর বালিশের তলা থেকে। বলল একটু টেপিড ওয়াটারে গোটা আষ্টেক বড়ি ফেলে গুলিয়ে খেয়ে নিন। এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বেন। কোনো খারাপ এফেক্টও নেই।

টেপিড-ওয়াটার এত রাতে কোথায় পাব?

ওঃ। যা গরম। এমনি জলেই হবে। প্লেইন ওয়াটারে আমিই গুলিয়ে দিচ্ছি। তাতেই কাজ হবে।

 পিপি ডাইনিং স্পেসে এল কিন্তু শুধু নাইটি পরে আছে বলে আলো জ্বালাল না। কিন্তু কাকিমার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে বেডলাইটের আলো এসে পড়েছিল সেখানে। বোতল থেকে কাপে জল ঢেলে, ক্যালি-ফস মিশিয়ে একটি চামচ দিয়ে নেড়ে তার পর জিষ্ণুকে দিল।

বলল, তিতিকে যখন কনসিভ করি তখন পারুলদি বলেছিলেন আমাকে এ ওষুধের কথা। খুব ভালো ওষুধ।

 তিতির কথা মনে পড়তেই ওর নাম উচ্চারণ করতেই পিপি গম্ভীর হয়ে গেল।

পিপি ওর কাছে আসতেই আশ্চর্য হয়ে গেল জিষ্ণু। একেবারেই বোঝা যায় না অন্য সময়ে, কী চমৎকার দুটি জলপিপির মতো বুক পিপির। পুষি বা পরি কারো বুকই পিপির বুকের মতো সুন্দর নয়। পিপির নাইটির নীল স্বপ্নঘেরা বুক দেখে জিষ্ণুর বুকের মধ্যেটা ধ্বক করে উঠল।

পিপিও বুঝতে পেরেছিল জিষ্ণুর চোখের কথা। তাড়াতাড়ি খালি কাপটি নিয়ে চলে গেল। তার পর কাপটি ডাইনিং টেবিলে রেখে ঘরে গিয়ে দরজা দিল। কাকিমাও সম্ভবত মুগ্ধ বিস্ময়ে তাঁর ঘর থেকে আসা-আলোতে পিপিকে দেখছিলেন। পিপি বুঝতে পেরেছে অবশ্যই। মেয়েদের যে অনেকগুলোচোখ।

পরদিন ঘুম থেকে উঠল বেশ দেরি করে। সারাসকালটাই আলসেমি করে কাটাল। পরি কলকাতায় থাকলে হীরুকাকা বেশি আসেন না। কেন আসেন না, কে জানে।

এ-বাড়ির সকলে খাওয়া-দাওয়াটা একসঙ্গেই করে। চিরদিন। কাকিমার শিক্ষা। এবং টেবিলেই। বে-জায়গাতে খাওয়া কাকিমার বড়োই অপছন্দ। পরি ব্রেকফাস্টের পরই বেরিয়ে গেল। বলল, অনেকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। নানারকম কাজও আছে। ওয়াইণ্ডিং-আপ প্রসেস চলছে এখন। কলকাতার পাট গুটিয়ে আনছে ও।

অফিস থেকেই গাড়ি এসেছিল পরির।

পিপি একবার এসেছিল জিষ্ণুর ঘরে। একটি সাদা খোল আর মেরুন-রঙা পাড়ের শাড়ি পরে। ছোটোহাতার ব্লাউজ। তাও মেরুন-রঙা। এর আগে জিষ্ণুর ঘরে কখনোই আসেনি ও।

বলল, ঘুম কি হয়েছিল? রাতে?

 হ্যাঁ। থ্যাঙ্ক ইউ। তবে ওষুধগুলো সব না ফেললেও পারতে।

ও বলল, বড়ো ভয় আমার ঘুমের ওষুধকে। আপনি রোজ বরং ক্যালি-ফসই খাবেন। আমি এনে দেব। কোনো ব্যাড-এফেক্ট নেই।

ব্রেকফাস্ট সেরে এসে বারান্দায় বসেছিল জিষ্ণু। গানুবাবুদের বাড়ি ভাঙা দেখছিল। এত ধুলো উড়ছে যে বারান্দায় বসা তো যাচ্ছেই না ইদানীং। বারান্দার এবং ঘরের সব দরজা জানালা পর্যন্ত বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে ইদানীং।

পিপিও কিছুক্ষণ সে-দিকে উদাস চোখে চেয়ে রইল।

জিষ্ণু বলল, বসবে না?

না। কাজ আছে। মাসিমাকে সাহায্য করতে হবে রান্নাতে।

কর্তব্য?

না আনন্দ। সব কর্তব্যই তেতো নয়।

তা ঠিক।

 তার পর চলে যাওয়ার আগে হেসে বলল, জানেন? স্লিপিং ট্যাবলেটস খাওয়ার অনেক রকম ব্যাড-এফেক্টস আছে। তার মধ্যে একটা আমার সব চেয়ে বেশি অপছন্দ।

কী সেটা?

 স্বপ্ন দেখা যায় না। স্বপ্নকে আটকে দেয় ঘুমের ওষুধ।

তাই? এটা জানতাম না তো।

 ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করবেন। স্বপ্নও না দেখতে পেলে মানুষ বাঁচবে কী নিয়ে?

জিষ্ণু নীরবে একবার পিপির মুখে চাইল। ভাবল, তা ঠিক। সকাল বেলার আলোয় আলোকিত বারান্দায় ওর সবে চান করে ওঠা আমলা তেলের গন্ধমাখা পিঠময় ভেজা চুল ছড়ানো স্নিগ্ধ চেহারাখানি শরতের চিকন দিঘির মতো টলটল করছিল।

পিপি বলল, আসি।

নীরবে মাথা নোয়াল জিষ্ণু। ওকে বসার জন্যে পীড়াপীড়ি করল না। বসতে বলার সময় আসেনি এখনও। চলে-যাওয়া পিপির দিকে পেছন থেকে চেয়ে জিষ্ণু ভাবছিল।

পিপি চলে যেতে যেতে তার নিতম্বে এবং তার ঘাড়ের কাছে কাছে জিষ্ণুর চোখের পরশ অনুভব করছিল। ওর অগণ্য অদৃশ্য অনুভূতি বোধের একটি দিয়ে। পিপি ভাবল, পুরুষরা ভালোই হোক কি মন্দ, অর্থবান কি দরিদ্র সাধু কি লম্পট; কিছু কিছু ব্যাপারে তারা সবাই এক। এটা যেমন দুঃখের; তেমনই সুখের।

লাঞ্চের সময়ে পরি এসেছিল। কাকিমার অনুরোধে। লাঞ্চ খেয়েই বেরিয়ে যাবে বলে।

দুপুরটাতেও খাওয়া-দাওয়ার পর খুব ঘুমোল জিষ্ণু।

আজ কেন যে এত ঘুম পাচ্ছে কে জানে। মেঘলা আবহাওয়া, গানুবাবুদের বাড়ি ভাঙার ফ্রাস্ট্রেশান, এবং কোনো বিশেষ কারণহীন গভীর এক শান্তি। এই শান্তি বেশ কিছুদিন ধরেই অনুভব করছে ও। পিপি এখানে আসার পর থেকেই।

দারুণ সরষে-মুরগি বেঁধেছিল পিপি। কাকিমা বেঁধেছিলেন রুই-এর মুড়িঘণ্ট। মোক্ষদাদি ইলিশ মাছের টক। পরি চলে যাবে বলে আয়োজন অথচ সে তো মাছ দেখলেই থু: খু: করে। বলে, রাবিশ! প্রায় সব মাছই ওয়াক-থু : করে শুধু চিকেনটা দিয়ে একটু ভাত খেয়ে উঠে গেল।

 পিপিকে বলে গেল, ইউ রিয়্যালি কুক ওয়েল পিপি। বাই দ্য ওয়ে, হোয়াট আর ইউ কুকিং?

 পিপি একটু অপ্রতিভ হল কথাটাতে। কাকিমা বিরক্ত। জিষ্ণু আহত। কিন্তু পরির নিজের অ্যাটিটুড কুডনট কেয়ারলেস।

পরির একথাটাও দ্ব্যর্থকই শুধু নয়, কথাটাতে অপমানও ছিল।

ঘুম থেকে উঠে আয়েশ করে চা খেয়ে কিছুটা হেঁটেই এগোল জিষ্ণু। ভেবেছিল, তারিণীবাবুর বাড়ি পর্যন্ত পুরোটা না হেঁটে কিছুটা গিয়ে তার পর ট্যাক্সি ধরবে। আবার কী মনে করে ঠিক করল পুরোটাই হেঁটে যাবে। বাড়ি থেকে আজকাল হাঁটা বিশেষ হয় না। বেরোবার আগেই পিপিকে বাইরে যাওয়ার পোশাকে দেখেছিল একঝলক। শুধিয়েছিল, কোথাও বেরোবে?

হ্যাঁ। কাকিমার সঙ্গে কালীবাড়ি যাব আমি।

পিপি বলেছিল।

ও।

পিপি বাড়িতে একরকম সাজে, একরকম কথা বলে, একরকম হাঁটে, একরকম করে তাকায়, আর ও-ই যখন অফিসে থাকে ওর হাই-হিল জুতো পরে হাঁটা-চলা, কথা-বলা তাকানো সবই আমূল বদলে যায়। চেনাই যায় না সেক্রেটারি পিপিকে বাড়ির পিপি বলে আদৌ, বরং অবাক লাগে জিষ্ণুর। পরিকে দেখে, পিপিকে দেখে বোঝে যে, একজন মেয়ের মধ্যে একাধিক মেয়ে থাকে। পুষিকে দেখেও বুঝত।

তারিণীবাবুর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেই দেখল মোড়ের কাছে একটি বড়ো জটলা। প্রথমে ভাবল, আজ রবিবার, কোনো রাজনৈতিক দলের মিটিং-টিটিং হবে হয়তো। কলকাতার রাজনীতি মানেই তো গলাবাজি আর দুর্নীতি। কিন্তু যতই এগোতে লাগল ততই বুঝতে পারল যে, এ-রাজনৈতিক দলের রোদে দেওয়া কাসুন্দির হাঁড়ির উচ্ছ্বাস নয়, ভন্ডামির পরাকাষ্ঠা নয়, সত্যিই কোনো কারণে জনতা অত্যন্ত উত্তেজিত। এ বক্তৃতাবাজি শোনার জন্যে জমায়েত হওয়া জনতা নয়। বোমাবাজির জন্যে তৈরি হচ্ছে এরা। এমন সময়ে একটি পুলিশের গাড়িও এসে দাঁড়াল সেখানে। উত্তেজিত জনতা পুলিশের গাড়ির গায়ে চড়থাপ্পড় মারতে লাগল জোরে জারে। গাড়ি থেকে একজন অফিসার নেমে জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। তার গায়েও দু-চার ধাক্কা দিল জনতা।

পা চালিয়ে এগিয়ে গিয়ে একেবারেই স্তম্ভিত, হতবাক হয়ে গেল জিষ্ণু। ফুটপাথের ঠিক পাশেই তারিণীবাবু পথের ওপরে পড়ে আছেন হাত-পা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে। তাঁর মাথাটা পথের সঙ্গে থেতলে এক হয়ে গেছে। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসে এক জান্তব প্রতিবাদের মতো চেয়ে আছে এই শহরের সর্বংসহ মানুষদের দিকে। আর তাঁর এক-দেড় গজ দূরেই তাঁর প্রিয় কুকুর ভুলো। ভুলো। ভুলের কালো গায়ের ঘন চুলগুলি লাল রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে।

মিনিবাস?

জিষ্ণু দাঁত চেপে শুধোল ইশ ইশ করতে-থাকা পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে।

না। প্রাইভেট বাস। ড্রাইভার বাস নিয়ে পালিয়ে গেছে। তার পর কিছুদূর গিয়েই বাস থেকে নেমে ড্রাইভার কনডাক্টর পথের ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেছে।

আপনারা কী করছিলেন? উত্তেজিত কিন্তু পরাস্ত স্বরে জিষ্ণু বলল।

ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমি কি ওই বাসে ছিলাম নাকি?

 ভদ্রলোক আর কী বললেন গোলমালে শোনা গেল না।

দেড়-শো জন যাত্রীর একজনও তাদের ধরবার কথা ভাবেননি?

জনতা বাসটাতে আগুন ধরবার চেষ্টা করেছিল।

 ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বললেন।

 ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এসে আগুন নিভিয়ে দিয়ে চলে গেছে।

অন্যজন বললেন।

পুলিশের গাড়ি ডেড-বডি তুলে নিয়ে এখন মর্গে যাবে।

আর একজন বললেন।

 জিষ্ণু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

একজন বললেন, বারাসতের বাস।

অন্যজন বললেন, নাম্বারটা লিখে রেখেছি। এই নাম্বার। পুলিশকেও দিয়েছি।

জিষ্ণু নাম্বারটা টুকে নিল পকেটের ছোটো ডায়রিতে। কিন্তু ও জানে যে, কিছুই হবে না। বেচারি সার্জেন্ট কী করবেন। দেড়-শো জন যাত্রীর মধ্যে কারোরই যদি বিবেক বলে কিছু না থেকে থাকে, তাঁদের একজনও যদি বাসটি সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে ড্রাইভারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার কথা না ভেবে থাকেন তবে এমন করে রোজ রোজ মানুষ মরাই ভালো। তারিণীবাবু, পুষি কেউই ওঁদের কেউ নন। কিন্তু একদিন ওঁদের ভীষণ কাছের কেউও এমনি করেই মারা যাবেন। সেদিন হয়তো ওঁরা বুঝবেন যে, আমরা সকলেই সকলের। অন্যের বিপদ অন্যের আনন্দও যে ওঁদেরও বিপদ ওঁদেরই আনন্দ। যতদিন না একথা সকলে বুঝছেন ততদিন এমনি করেই রাজনৈতিক নেতা, কর্পোরেশন, পাড়ার মাস্তান, পিকলুর মতো চোর গুণ্ডা বদমাশ এবং পুলিশও এমনি রামরাজত্ব চালিয়েই যাবে। নিজেদের বাঁচালে তবেই ওঁরা নিজেরা বাঁচবেন। এবার স্বপ্নে নয়, বাস্তবেই মারতে হবে ড্রাইভারকে। ভাবল জিষ্ণু। আইন যে-দেশে তামাশা আর যে-তামাশা শুধু বড়োলোকেরাই পয়সা খরচ করে দেখতে পারে সেখানে আইন নিজের হাতে না তুলে নিয়ে কোনো উপায়ই নেই। এ-দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নয়। বাঁচার এখন এই একমাত্র পথ। টেররিজম। টেররিজম ইজ দ্য ওনলি ওয়ে আউট। কবিতা লেখার দিন আর নেই।

মামণির কাছে কি যাবে একবার? ভাবল জিষ্ণু। কী বলবে গিয়ে তাকে? কী সান্ত্বনা দেবে? মামণি তার কে? হয়তো হতে পারত। এখন মামণির চেয়েও আরও অসহায় পিপি মামণির জায়গা নিয়েছে। তবে যাবে নিশ্চয়ই। মামণির বিয়ের দায় অনবধানে এখন জিষ্ণুর ওপরেই বর্তে গেল। পরে যাবে। কালকে শ্মশানেও যাবে। দুর্ঘটনায় বা অপঘাতে মৃত্যুর ভয়াবহতার চেয়েও লাশকাটা ঘরে যাওয়া আরও ভয়ময় অপঘাত।

কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে ড্রাইভারকে বলল, ভিক্টোরিয়া।

 প্ল্যানেটোরিয়ামের কাছে যখন ট্যাক্সিটা এসেছে তখনই হঠাৎ জিষ্ণু লক্ষ করল যে, তার ট্যাক্সির ঠিক পেছনে পেছনে অন্য একটা ট্যাক্সি। সেটা আসছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরেই। আগে দেখতে পায়নি ও। এখন দেখল, সামনের সিটে পিকলু বসে আছে।

কখন এল ওই ট্যাক্সিটা? তারিণীবাবুর বাড়ির মোড়ের থেকেই কি ওরা পিছু নিয়েছিল? নাকি ওদের গলি থেকেই কেউ ফলো করছিল ওকে?

জিষ্ণু একবার ভাবল, ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে বলে যে, বাড়ি ফিরে যেতে। তার পরই ঠিক করল যে, না। অন্যায়কারীর শরীরে বল থাকতে পারে বুকে তার বল থাকে না। পিকলু কী করতে চায় দেখবে ও।

ভিক্টোরিয়ার পেছনের গেটে নেমে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল জিষ্ণু। ও ট্যাক্সি থেকে নামতেই পেছনের ট্যাক্সি থেকে পিকলু এবং আরও দুজন লোক নামল। একজন লুঙ্গি-পরা। অন্যজন পাজামা। দেখে মনে হল, বিহারি মুসলমান।

পিকলু ওকে হাত তুলে জিষ্ণুকে বলল, হাই! যেন মস্ত সাহেব।

কী রে! ময়ূরপুচ্ছ-পরা কাক।

মনে মনে বলল জিষ্ণু।

মুখে বলল, কী ব্যাপার?

বেড়াতে এসেছিস তো? আমিও। চল, ভেতরে যাই।

 তখনও বেলা ছিল। দিনের আলোতে অনেক সাহস থাকে। সৎ সাহস তো নিশ্চয়ই।

 জিষ্ণু বলল, চল। তার সঙ্গে এরা কারা?

রমজান আর জাহাঙ্গির। আমার শাগরেদ।

রেস-এরও বটে, ডিমলিশনেরও বটে। আজ এরা ডিমলিশনের শাগরেদ।

রমজান-এর চুল ছোটো করে ছাঁটা। বাঁধানো দাঁত। কাকের মতো কালো গায়ের রং। গায়ে নীল টেরিলিনের শার্ট। দেখলেই মনে হয় স্মাগলার। আর জাহাঙ্গিরকে দেখতে ঠিক নিউ মার্কেটের মুসলমান ফলওয়ালাদের মতো। এরা দুজন কি পাকিস্তানের চর? ইদানীং অনেক মানুষকে দেখে যাদের সঙ্গে ভারতের ভালোমন্দর কোনো যোগাযোগই নেই। এদের সংখ্যা রোজই বেড়ে যাচ্ছে। আতঙ্ক বোধ করে জিষ্ণু।

ওরা হাঁটতে-হাঁটতে যে-গাছতলায় জিষ্ণু পিকলুকে শুইয়ে টাইয়ের ফাঁস লাগিয়েছিল সেই গাছটার কাছেই এল।

পিকলু বলল, আয় বোস।

ওর কথায় সম্মোহন ছিল।

 তোর সঙ্গে কথা আছে।

জিষ্ণু বলল।

এই সময়ে জিষ্ণু একবার ভাবল গলা ছেড়ে লোক ডাকে। তার পরই ভাবল, দৌড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ভয়ে নয়, এক আশ্চর্য একরোখা জেদ ওর পা দু-টিকে ও কণ্ঠকে অনড় নিঃশব্দ করে দিল। ও মনে মনে বলল, পিকলুর মতো একটা বদমাইশের কাছ থেকে পালিয়ে যাবে ও? না। পালাতে শেখেনি জিষ্ণু।

 জিষ্ণু বলল, তুই এখনও নিজেকে বদলাতে পারতিস। তুই কী করে, এমন কী করে হয়ে গেলি রে পিকলু?

তুইও যেভাবে।

পিকলু বলল, মুখে ক্রুর হাসি নিয়ে।

আমি বদলাইনি। কিছু পরিবর্তন হয়েছে আমার পরিবেশে, অবস্থায়; এই পর্যন্ত। জিষ্ণু বলল।

আমারও তো তাই-ই।

বলেই, বলল, পিকলু, চিনাবাদাম খাবি জিষ্ণু? সেই কলেজের দিনের মতো?

না:।

 তোর মনে আছে? লা দোলচে ভিতার সেই কথাটা। টু ডাই উইথ আ ব্যাঙ্গ অ্যাণ্ড নট উইথ আ হুইম্পার? তুই খুব পছন্দ করতিস কথাটা।

এখনও করি।

করিস? ফাইন।

 পিকলু ওর সামনে বসল। লোক দুটো দু-পাশে। বেলা দ্রুত পড়ে আসছিল। ছোটো ছেলে মেয়েরা খেলা করছিল। তাদের গলার সজীব সুন্দর পাখির মতো স্বর ভেসে আসছিল জিষ্ণুর কানে। পিপির মেয়ে তিতির বয়েসি ছেলে-মেয়েই সব। তাদের মা-বাবারা কি জানেন কলকাতা কী এক ভয়ংকর জায়গা হয়ে গেছে? এমনভাবে বাচ্চাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত। নয়? খুন হয়ে গেলে, চাপা পড়ে মরে গেলে যারা চাপা দেয় বা যারা খুন করে সেইসব ড্রাইভার এবং খুনিদের কারোরই শাস্তি হয় না এখানে? যেখানে মানুষ পথে মরে পড়ে থাকে আর তার পাশ দিয়ে পাইলট-কারের পিলে-চমকানো আওয়াজ ছড়াতে ছড়াতে মিনিস্টারের লাল আলো জ্বালানো গাড়ি হুস করে বেড়িয়ে যায়।

অন্ধকার হয়ে গেল। পিকলু ওর ট্রাউজারের পকেট থেকে কী একটা জিনিস বের করল।

বলল, পারিস চিনতে?

কী?

তোর টাইটা। আমাকে দিয়েছিলি না?

 দিয়েছিলাম।

জিষ্ণু বলল, বলেই বলল, এবারে, এই লোকগুলোকে যেতে বল। তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে পিকলু।

ওরা যাবে কী করে? ওরা যে ডিমলিশ করতে এসেছে তোকে। ডিমলিশান-এক্সটিংশান ইউনিটের লোক। ওদের আজ অফ-ডে। আজ তো রেস নেই।

 বলেই, হঠাৎ টাইয়ের ফাঁসটা পিকলু জিষ্ণুর গলায় পরিয়ে দিল। রমজান জিষ্ণুর মুখটা চেপে ধরল। সাঁড়াশির মতো হাত। ওরা তিনজনে জিষ্ণুকে তিন দিক দিয়ে এমন করে ঘিরেছিল এবং স্বাভাবিকভাবে উঁচুস্বরে কথা বলছিল যে, দশ হাত দূর দিয়ে ইভিনিং-ওয়াক করা কোনো মানুষেরও কোনো সন্দেহ হল না। কেউই তাকাল না ওদের দিকে।

পিকলু ফাঁসটা আস্তে আস্তে শক্ত করতে লাগল জিষ্ণুর গলাতে। তখনও জিষ্ণু দু-পা দিয়ে ওর বুকে লাথি মারতে পারত। কিন্তু মারল না। এই পৃথিবীতে এই শঠ, তঞ্চক, খুনি, নোংরা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মতো কোনো বিশেষ কারণ বা উদ্দীপনা ও সেই-মুহূর্তে বোধ করছিল না।

 জিষ্ণুর মনে হল হীরুকাকা, কাকিমা, পুষি, পরি, মামণি, পিপি ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখছে। দেখছে ভুলোও। আহা! ওরা প্রত্যেকেই জিষ্ণুর চেয়েও অনেক বেশি অসহায়। জিষ্ণু কাছে থাকলে ওদের…। জিষ্ণুর ওপরে অনেকই মানুষ কম-বেশি নির্ভর করেছিল, ভরসা করেছিল ওর ভালোত্বে। কিন্তু…

হীরুবাবু আর হেমপ্রভা ঘরের পেছনের বারান্দায় বসেছিলেন।

গানুবাবুদের বাড়ির একদিকের ছাদ ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে-বাড়ি, যে-বাগান তৈরি করতে কত দীর্ঘদিনের পরিশ্রম, ভালোবাসা, কল্পনা লেগেছিল তা কত সহজে এবং কী কম সময়ে ভেঙে কেটে নষ্ট করে ফেলা হল। শব্দ, ইট, চুন, সুড়কি, ধুলো ছিন্নভিন্ন করে দিল স্নিগ্ধ বর্ষারাতের চাঁদের রাতের শান্তি।

হেম বললেন, আমার মনটা ভারি খারাপ হয়ে আছে গো। জানো।

কেন?

পিপি মেয়েটা কালীবাড়িতে গিয়ে আজ দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে এমন কাঁদল যে, কী বলব! এতটুকু মেয়ে!

কোথায় সে?

জানি না, কোথায় বেরুল আবার।

ওকে একা বেরুতে দিয়ো না। জানোই তো সব।

হেমপ্রভা কথা বললেন না কোনো! ওঁর মনটা ভালো লাগছিল না বিকেল থেকেই। পটলদের বাড়ির চিলেকোঠা থেকে একটা কালো বেড়াল কাঁদছিল।

 মেয়েটার কষ্ট চোখে দেখা যায় না গো!

কষ্ট কার নেই এল। কষ্ট দেখা যায় তখনই যখন তা জীবনের ওপরে ভেসে ওঠে। কষ্ট, কষ্টই। ভেতরেই তা থাকুক অথবা বাইরেই আসুক। বুকের মধ্যে কষ্ট নেই এমন মানুষ কি একজনও আছে? অন্যর কষ্টকে যে ছুঁতে পেরেছ এই তো ঢের হেম। ক-জন মানুষ তা পারে?

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ