০৭.

তাড়াহুড়োতে যখন অফিসে বেরিয়েছিল তখন কাকিমা পুজোর ঘরে এবং পরির ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। ঘুম তখনও ভাঙেনি বোধ হয়।

অফিস থেকে ফিরলে শ্ৰীমন্তদা খাবার ও চা দিল। শ্ৰীমন্তদা আজই দুপুরে ফিরেছে দেশ থেকে। কাকিমা ও পরি বাড়ি ছিল না। শ্ৰীমন্তদা বলল, কালীবাড়িতে গেছে।

 পাড়াতে একটি অশ্বত্থ গাছের তলায় কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন বছর পনেরো আগে সেলস ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের এক কর্মচারী। এখন তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। সেই মূর্তি নাকি খুবই জাগ্রত। শনি-রবিবারে বহুলোক লাইন দিয়ে মানত করেন ও পুজোও দেন। পথে যেতে আসতে দেখে জিষ্ণু। ভালো লাগে দেখে যে, এখনও অসংখ্য মানুষ নিজেদের দুঃখ-কষ্ট, দায়-দায়িত্ব প্রতিমার পায়ের কাছে কী নিশ্চিন্ত সমর্পণে নামিয়ে রেখে নিজেরা হালকা হতে পারেন। বিশ্বাসের ফল কী হয় না হয়, তা জানার ঔৎসুক্য ওর নেই। বিশ্বাসে যে-বিশ্বাস এখনও অগণ্য লোকে রাখেন- এইটে জেনেই ভালো লাগে। ওঁদের তবু আঁকড়ে থাকার আছে কিছু।

কাকিমা নাকি পরিকে নিয়ে ওই কালীবাড়িতেই গেছেন।

 চা খেতে খেতে জিষ্ণু ভাবছিল পরি নিশ্চয়ই নিজের ইচ্ছেতে যায়নি। কাকিমাই ধরে নিয়ে গেছেন। পরিকে জানে জিষ্ণু।

শ্ৰীমন্তদা চায়ের কাপ ও খাবারের প্লেট নিয়ে যাওয়ার সময়ে বলল, কী হয়েছে এল তো দাদাবাবু? মোক্ষদা বলছিল ভাইরাস জ্বর। তাই?

কী?

 আমি আজ দুপুর বেলা বাড়ি ফিরে দেখছি সারাবাড়ি থমথম করছে। দিদিমণি অফিসে যায়নি। এগারোটা নাগাদ একটা ফোন এল, দিদিমণি অগ্নিশর্মা হয়ে অনেক কথা বলল।

ফোনটা অফিস থেকে এসেছিল?

তা তো বলতে পারব না। মোক্ষদাদিও খুব চিন্তিত। মা কাউকেই কিছু বলেননি। আমাদের পক্ষেও জিজ্ঞেস করা উচিত নয়। তবে এমন তো কখনোই হয়নি। কাল কী হয়েছিল দাদাবাবু? আমরাও তো বাড়িরই লোক হয়ে গেছি এখন। তোমাদের ভালোমন্দে জড়িয়ে গেছি।

 জিষ্ণু চোখটা সরু করে মিথ্যেকথাটা বলল, বলল, কিছু তো জানি না শ্ৰীমন্তদা। আজ আমি উঠেছিলাম দেরি করে। এককাপ চা খেয়েই অফিসে দৌড়েছি।

ওবাড়ির চাঁপাবৌদি শুধোচ্ছিল আমায়, যখন বাজার থেকে ফিরছিলাম…

কখন?

এই তো একটু আগে গো।

 কী জিজ্ঞেস করছিলেন?

 বলছিলেন কাল নাকি পরিদিদি অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিল আর তুমি দরজা খুলেছিলে। পরিদিদি নাকি বেহুঁশ হয়ে রক-এর ওপরই বসে পড়েছিল।

আমি? আমি? লজ্জিত, মিথ্যেবাদী জিষ্ণু থতমতো খেয়ে বলল।

 তুমি কী বললে, শ্ৰীমন্তদা, চাঁপাবৌদিকে?

আমি বললাম, মেয়ে তো জ্বরে বেহুশ হয়ে ফিরেছিল। কালকে তো প্রাণটাই যেত! কী যে ভাইরাস জ্বর এসেছে শহরে।

আন্দাজে ঠিকই বলেছ।

জিষ্ণু বলল।

তার পরই কথা ঘুরিয়ে শ্রীমন্তদাকে বলল, কাকিমার আজকে পরিকে নিয়ে বাইরে যাওয়া উচিত হয়নি। এই জ্বর ভালুকের জ্বরেরই মতো। হঠাৎ আসে আবার হঠাৎ ছেড়ে যায়। এক শো পাঁচ উঠে যায় যখন আসে।

ছেড়ে গেলেও আবারও তো আসতে পারে?

তা তো পারেই।

 ছেড়ে গেলেও শরীর তো দুর্বল করে দেয়ই।

তা আর করে না?

এই তো মোক্ষদাদি বলছিল। তার দাসুদা একদিন তাকে দেখতে এসে এই রান্নাঘরের দাওয়াতেই প্রায় টেসে গেছিল। ঘ্যাঁচা ডাক্তারকে ডেকে এনে কোনোক্রমে বাঁচায়। যাই এল তাই এল, ঘ্যাঁচা ডাক্তার রিকশাওয়ালাদের কুঁড়ে কুঁড়ে সল্টলেক-এ বাড়ি করে ফেলল বটে কিন্তু ডাক্তার সে ভালো। কোনো দিনও এলপাথাড়ি চিকিচ্ছে সে করেনি।

হু। তা ঠিক।

 চিন্তান্বিত গলাতে জিষ্ণু বলল।

শ্ৰীমন্তদার কাছে জলজ্যান্ত মিথ্যেকথাটা বলে এবং বলার পর ধরা পড়ে যাওয়াতে বড়ো ছোটো লাগছিল খুবই। ভাবছিল মিথ্যে বলেন না বা বলতে হয় না যাঁদের এমন মানুষ হয়তো কমই আছেন কিন্তু পরের কারণে মিথ্যেবাদী সকলকে হতে হয় না ওর মতো। পরি অবশ্য তার, পর নয়। পরির কারণে ও একটা কেন, দশটা মিথ্যে বলতে পারে। মিথ্যে যারা হরদম বলে তাদের চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপে না। মনের পেশি একটুও শক্ত হয় না। সেসব মানুষ বোধ হয় খুনও করতে পারে অন্যকে ঠাণ্ডা মাথায়।

পায়জামা-পাঞ্জাবি দিব তো। চান করতে যাবে না?

হুঁ।

মা বলে গিয়েছেন যে, ওনাদের ফিরতে দেরি হলে তুমি খেয়ে নিয়ো।

তুমি তো আবার ঘুমের ওষুধ খাবে।

হুঁ।

কোনো চিঠি এসেছিল? ফোন?

 জিষ্ণু শুধোল।

চিঠি একটা এসেছে বটে। বলতে ভুলে গেছিলাম। আর ফোন করেছিল পুষিদির বাড়ি থেকে। মা ধরেছিলেন। আবার করবেন বলেছেন। আহা! পুষিমায়ের মুখটা মনে পড়লেই বুকটা হু হু করে ওঠে গো দাদাবাবু।

চিঠিটা আনো শ্ৰীমন্তদা। আমি স্নান করতে যাব।

 হ্যাঁ নিয়ে আসছি।

একটা খাম। কাঁপা-কাঁপা হাতে লেখা। হাতের লেখাটা অচেনা।

পেপার-কাটার দিয়ে কেটে, পড়ল জিষ্ণু।

কলিকাতা,
বুধবার

 বাবা জিষ্ণু, পরমকল্যাণীয়েষু,

তুমি আমার পুত্রসম তাই বাবা সম্বোধন করিলাম কিছু মনে করিয়ো না।

আমাকে হয়তো তুমি চিনিবে না। আমি তারিণীবাবু। তোমাদের অতি-মন্দভাগ্য বাড়িওয়ালা। গতমাসে আমি তোমার কাকিমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম বাড়ির ভাড়া যদি কমপক্ষে একশত টাকা বাড়াইয়া দেন, সেমত আর্জি লইয়া। তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা। তাঁহাকে রাজি করাইতে পারিলাম না। বারংবার তোমার অফিসের ফোন নাম্বার এবং ঠিকানা চাহিয়াও উনার নিকট হইতে তাহা সংগ্রহ করিতে পারিলাম না। সে-কারণেই তোমাকে উত্যক্ত করিতেছি। বাবা, আমাকে মার্জনা করিয়ে।

বর্তমানে তোমরা আমাকে মাসে একশত তিরিশ টাকা ভাড়া দাও। আমি পেনশান পাই তিনশত টাকা। গ্র্যাচুইটি প্রভিডেন্ট ফাণ্ড সমস্তই পুত্র-কন্যাদিগের প্রয়োজনে কমিউট করিয়া লইয়াছিলাম।

 তিরিশ টাকা ভাড়ায় আজ হইতে তিরিশ বৎসর পূর্বে এই বাটি তোমার কাকিমাকে দিয়াছিলাম হীরালালবাবুর মধ্যস্থতায়। হীরালাল অর্থে হীরুবাবু। টাকার তো আজ কোনো মূল্যই নাই। তাহা কাগজই হইয়া গিয়াছে। ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া আর বাঁচিবার ইচ্ছা রাখি না। দেশ তো দেউলিয়াই হইয়া গেল বাবা।

তোমার কাকিমা হৈম দেবী আমাকে কোর্টে কেস করিতে বলিলেন। নচেৎ তাঁহার পক্ষে কিছু করণীয় নাই। হীরুবাবুর নিকটও গিয়াছিলাম। উহার রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের বাটিতে। আমাকে প্রায় গলাধাক্কা দিয়াই বাহির করিয়া দিলেন। অথচ উঁহার ভৃত্য গদাধরের সহিত পানের দোকানে দেখা হওয়ায় সে কহিল, হীরুবাবুর নিজবাটির একতলার ভাড়াটিয়ার ভাড়া গত তিরিশ বছরে দশগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। তিরিশ বৎসর পূর্বে খাওয়া লইয়া একজনের মেসে থাকিবার খরচ পড়িত সাকুল্যে সাতাশ টাকা, আর তাহাই আজ সাড়ে-চারিশত টাকাতে আসিয়া পৌঁছাইয়াছে। কতগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে তাহা একবার বিবেচনা করিয়া দেখিবে বাবা। আমাদের এজমালি বাটির পার্শ্বস্থ মেস হইতেই আমি এই সংবাদ অথবা তথ্য অবগত হইয়াছি।

তোমরা যে-বাটিতে আছ, তাহা চার কাঠা জমির ওপর আমার পিতৃদেব তৈয়ারি করাইয়াছিলেন। একতলায় তিনখানি ঘর। এইরূপ মাপের ঘর আজকাল উত্তর কলিকাতার আধুনিক কোনো বাড়িতেই দেখা যাইবে না। এতদবতীত রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, খাওয়ার ঘর, ঠাকুর ঘর, মস্ত ছাদ, ছাদে চিলেকোঠা। পশ্চাতে ছোট্ট একটি বাগানও আছে। সেই বাগানে আজ হইতে চল্লিশ বৎসর পূর্বে আমি যে রক্তকরবী, জবা, কাঁঠাল, গোলাপজাম এবং আঁশফলের গাছ নিজহস্তে গ্লোব নার্সারি হইতে আনিয়া লাগাইয়াছিলাম তাহারা আজ মহীরুহ হইয়াছে। গাছগুলিকে এক বার দেখিবার সুযোগ পর্যন্ত পাইলাম না বাবা, নিজবাটি শুধুমাত্র বাটিই নহে, তাহা রক্তকণিকার অংশ। ভাড়াটিয়ার পক্ষে সেই বোধ যে, ঠিক কেমন তাহা কল্পনা করাও সম্ভব নহে।

 তোমার কাকিমা পনেরো হাজার টাকায় বাটি কিনিয়া লইতে চান কিন্তু ভাড়া বিনা মামলায় এক পয়সাও বাড়াইতে তিনি রাজি নন। হৈম দেবীর ন্যায় চেনা মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করিবার মতন মানসিকতা আমার নাই। আর্থিক অবস্থাও নাই।

আমি তোমার বাবা এবং কাকাকে চর্মচক্ষে দেখি নাই। তোমাদের অভিভাবক বলিয়া তোমার কাকিমা ও হীরুবাবুকেই আমি জানি ও চিনি। হীরুবাবু আমাদের পাড়ার ডাক্তারখানার বহুপুরাতন কম্পাউণ্ডার গোদাবাবুর বন্ধুবিশেষ। গোদাবাবুই তোমাদের সহিত হীরুবাবু মারফত আলাপ করাইয়াছিলেন। এ-সংসারে আজ আমার আপনার জন বলিতে একটি নেড়িকুত্তা (ভুলো) ছাড়া আর কেহই নাই। তোমাকে কয়েক বার আমি দেখিয়াছি গত পনেরো বৎসরে। কেন জানি না, মনে হইয়াছে তুমি সজ্ঞানে কাহাকেও ঠকাইতে অপারগ। আমার কাছে তুমি পুত্রবৎ। নিজ-পুত্ররা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াও কেহই আমাকে দেখে না। কন্যা দেখিতে চায়, কিন্তু তাহার নিজের অবস্থাই শোচনীয়। কলিকাতাতেও থাকে না। তাই অনন্যোপায় হইয়া তোমার-ই নিকট আমার আর্জি জানাইলাম। যদি দয়া করিয়া উপবাসে মরিবার হাত হইতে রক্ষা করো আমাকে এবং ভুলোকেও, তাহা হইলে তোমার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিব।

করুণাময় ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

বাত, প্রেশার ও হার্টের ঔষধ কিনিতেই মাসে প্রচুর টাকা চলিয়া যায়। নিজে খাইবার ও ভুলোকে খাওয়াইবার নিমিত্ত আর কিছুই থাকে না।

বাঁচিলে তোমার দয়াতেই বাঁচিব।

ইতি
আশীর্বাদক তারিণীকুমার চক্রবর্তী।

পুনশ্চ : তোমরা যে-বাটিতে আছ, সে, বাটির দলিল আমার নিকটই আছে। তুমি যদি ওই বাটি যথার্থই কিনিতে চাও, ভাড়া বাড়াইতে যদি তোমার প্রকৃতই অসুবিধা থাকে তাহা হইলে আমার নিকট হইতে তাহা লইয়া যাইয়ো। তুমি যাহা দিবে তাহাই ন্যায্য বলিয়া জানিব এবং গ্রহণ করিব। দলিল-দস্তাবেজে যেখানে যেখানে সহি করিতে বলিবে সেখানে সেখানে সহি করিয়া দিব।

 বাবা জিষ্ণু, জীবনে বহির্জগতের মানুষকে, নিজের স্ত্রীকে, নিজের সন্তানদের বিশ্বাস করিয়া বড়ো মর্মান্তিকভাবে ঠকিয়াছি। তাহাদের নিমিত্তই আজ আমি পথের ভিখারি। কিন্তু তবুও বিশ্বাস করিবার অভ্যাস ত্যাগ করিতে পারি নাই। তোমার কাকিমাকে যখন প্রথম দেখি এবং গোদা-হীরুবাবুর নিকট হইতে তাঁহার অসহায়তার কথা সব শুনি, তোমার পিতা-মাতার দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথাও, তখন মন বড়োই দ্রব হইয়াছিল। তাহা না হইলে সে যুগেও ওই বাটির ভাড়া মাত্র তিরিশ টাকা কখনোই হইত না। যাক। তাহার নিমিত্ত খেদ নাই। সংসারে কিছু মানুষ ঠকিতে আসে, আর কিছু মানুষ ঠকাইতে। তাহাতে পরমেশ্বরের দয়ায় যে ঠকিল তাহার কিছুমাত্র যায় আসে না। যে চিরদিনই ঠকিয়াছে তাহার ঈশ্বর-বিশ্বাস প্রকৃত, না মিথ্যা, তাহা যাচাই করিবার নিমিত্তই বোধ হয় ঈশ্বর আমার ন্যায় বিশ্বাসী মানুষকেও এমত পরীক্ষায় ফেলিয়া যাচাই করিয়া লইতে চাহেন। আমি তাঁহার শরণাগত। শেষবয়সে মিথ্যা বা তঞ্চকতার আশ্রয় লইয়া তাঁহাকে ত্যাগ করিতে চাহি না। তাহা হইতে অনাহারে আমার মৃত্যুও শ্রেয়।

 তোমার কাকিমা হৈম দেবীকে আমার ভক্তিপূর্ণ নমস্কার জানাইও। তুমি আমার আশীর্বাদ জানিয়ো। তোমার খুল্লতাত-জাতা ভগিনীকেও জানাইয়ো।

 আমি গোদা কম্পাউণ্ডারের নিকট হইতে জানিলাম যে, তুমি অত্যন্তই ব্যস্ত থাকো এবং অফিসের কাজে প্রায়ই বিলাত, আমেরিকা যাইতে হয়। যদি সময় সুযোগ করিয়া আমার এই নিবেদন দয়া করিয়া বিবেচনা করিয়া আমাকে জানাও, তাহা হইলে তোমার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিব।

ইতি
আঃ তারিণীকুমার চক্রবর্তী

বাথরুমে যাবে জিষ্ণু এবারে।

তারিণীবাবুর চিঠিটা পড়ে মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। গলির মধ্যে হলেও এত বড়ো বাড়ির ভাড়া উত্তর কলকাতাতেও আজকে হাজার দুই হওয়া নিশ্চয়ই উচিত ছিল। কাকিমা যখন ওদের মানুষ করে তুলেছিলেন তখন তাঁর হিসেবি হওয়া নিশ্চয়ই উচিত ছিল কিন্তু এখন জিষ্ণু যখন আশাতীত ভালো রোজগার করে এবং পরি করে তার চেয়েও বেশি, তার ওপরে বাবা ও কাকার এফ ডি ও কোম্পানির কাগজও নেই নেই করে কিছু আছে, তখনও কাকিমার এইরকম মানসিকতা ঠিক বোধগম্য হয় না জিষ্ণুর।

প্রথমজীবনে যেসব মানুষকে আর্থিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বা অর্থের অভাবে নানারকম অপমান অসম্মানের শরিক হতে হয়, তাঁরাই পরে লক্ষ্মীর কৃপাধন্য হলে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অনুদার হয়ে ওঠেন। এটা কেন হয় বুঝতে পারে না জিষ্ণু। ওর মনে হয় এর ঠিক উলটোটাই তো হওয়া উচিত ছিল।

বাথরুমই যা কম এ-বাড়িতে। তখনকার দিনে অ্যাটাচড-বাথ অস্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হত তাই, প্রত্যেক ঘরের সঙ্গে সংলগ্ন বাথরুম নেই। একতলায় একটি আছে। সেখানে শ্ৰীমন্তদা ও মোক্ষদাদি যান। দোতলার একটি বাথরুম ব্যবহার করে জিষ্ণু আর অন্যটি পরি ও কাকিমা।

বাথরুমে যাবে, ঠিক সেই সময়েই ফোনটা বাজল।

 শ্ৰীমন্তদা ধরে বলল, এটু ধরুন দয়া করে। উনি চানে যাচ্ছিলেন। গেলেন কি না দেখি।

রিসিভার টেবিলে নামিয়ে রাখবার আগেই জিষ্ণু গিয়ে ফোনটা ধরল।

ঘড়িতে দেখল ঠিক ন-টা। এবারে সময়ের ব্যাপারে আর ভুল করেনি পিকলু।

পিকলু বলল, কী রে? খুব ক্লান্ত? চান তবে সেরেই নে। আমি পরে ফোন করব। ফোন করার দরকারই বা কী? কাল তোর অফিসে কখন যাব বল?

কাল আসিস না।

তবে? কবে যাব?

আমার অসুবিধে আছে।

কী? ও-সপ্তাহে?

না।

তবে?

তোকে টাকাটা দিতে পারব না আমি পিকলু। এর আগে কোনো দিনও তো না করিনি। কোনো দিনও না। তুই না চাইতেই জোর করে দিয়েছি কত বার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে করিস। মনে পড়বে। আর চাস না। আমি পারব না।

কী বলছিস তুই জিষ্ণু! আমি যে ডুবে যাব রে! কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে ধার করেছি।

 তুই মিথ্যোকথা বলছিস আমাকে। পিকলু, তুই আমাকেও মিথ্যে বলছিস।

বাই গড বলছি। আগে যেসব টাকা দিয়েছিস তা ফেরত দিতে পারিনি বলে তোর রাগ হয়েছে জিষ্ণু? দুঃখ পেয়েছিস?

টাকা ফেরত দিসনি বলে দুঃখ পাইনি। তবে দুঃখ পেয়েছি।

কীসের দুঃখ?

সিঁড়ির মুখের ল্যাণ্ডিং-এ পরি এসে দাঁড়াল এমন সময়ে। ফোনে কথা বলতে বলতে কখন যে বেল বাজল, কখন শ্ৰীমন্তদা গিয়ে দরজা খুলল, খেয়ালই করেনি জিষ্ণু।

পরি একটি উজ্জ্বল তুতে-রঙা শাড়ি পরেছে। সাদা ব্লাউজ। দু-বিনুনি করেছে। ঝলমল করছে পুরো ল্যাণ্ডিংটা। পরি, পুষির চেয়ে অনেকই বেশি সুন্দরী। পুষির সৌন্দর্যে স্নিগ্ধতা ছিল, পরির সৌন্দর্যে তীব্র এক জ্বালা আছে। গা জ্বলতে লাগল জিষ্ণুর। পরি ওর খুড়তুতো বোন না হলে, কেউ না হলে খুব ভালো হত।

কীসের দুঃখ? জিষ্ণু?

পিকলু আবারও বলল।

কীসের দুঃখ যদি বুঝতেই পারতিস তবে তুই আজও মানুষই থাকতিস। প্লিজ পিকলু। রাগ করিস না। তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই রে। কোনো বন্ধু ছিল না। নেই।

খুশিও ঠিক সেইকথাই বলে। বলে, আমাদের থাকবার মধ্যে আপনজন একজনই আছে। সে জিষ্ণু।

জিষ্ণু চুপ করে থাকল। উত্তর দিল না পিকলুর কথার।

পিকলু বলল, ছেড়ে দিচ্ছি আজকে। তোর রাগ হয়েছে। পরে ফোন করে একদিন যাব। বাড়িতেই যাব। তাড়িয়ে দিবি না তো? আর সেদিন টাকাটা রেডি করে রাখিস। আমার দরকারটা মিথ্যে নয়। বিশ্বাস করিস।

না। তুই আর আসিস না আমার কাছে। তোকে আমি বিশ্বাস করি না।

তবে পরির কাছেই আসব। টাকাটার খুব প্রয়োজন আমার।

পরির কাছে কেন আসতে যাবি? প্রয়োজন থাকলেই যে সেই প্রয়োজন মিটবে তার তো কোনো মানে নেই। আমারও তো অনেক কিছুর প্রয়োজন। মেটাতে পারিস তুই?

 আমার সাধ্য কতটুকু যে, তা দিয়ে তোর প্রয়োজন মেটাব? তবে আমি যাব। সত্যিই দরকার আছে পরির সঙ্গে।

 কী দরকার? ওর ওপরেও কি দাবি আছে তোর? আমার ওপরে যেমন আছে? আমার কাজিন বলেই কি?

না। দরকার আছে। বললামই তো।

 দাবি না থাকলে তোর দরকারই বা ও মেটাতে যাবে কেন?

 হয়তো আছে দাবি। সে, ও বুঝবে। তুই যদি না দিস তো, ও দেবে। ও-ও তো রোজগার করে।

এলে, ফোন করে আসিস।

সে আমি বুঝব। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, যা দেখছি।

 মানে?

বললামই তো সে পরি বুঝবে। বললে বুঝবে। পরি বাড়িতে আছে? ফোনটা দে-না!

না।

ঠিক আছে। যেদিন যাব টাকাটা রেডি রাখিস।

কট করে লাইনটা কেটে দিল জিষ্ণু।

 পরি বলল, জিষ্ণু?

পিকলু।

কী বলছিল আমার সম্বন্ধে?

ও বলল, বাড়ি আসবে। তোমার সঙ্গে কথা আছে। তোমার ওপরেও ওর দাবি আছে। আমার কাছে টাকা চেয়েছিল। দিইনি।

তো?

 জানি না। দেব না বলতেই বলল, তোমার সঙ্গে দরকার আছে।

ওঃ। পরি বলল।

ব্ল্যাকমেইল করতে চায় বোধ হয়। তোমার সঙ্গে…?

 জিষ্ণু বুঝতে পারল, ল্যাণ্ডিং-এর সিঁড়ির সামনের অত আলোর মধ্যে দাঁড়িয়েও পরির মুখটা কালো হয়ে গেল।

পরি বলল, তোমার বন্ধুটি ভালো নয়। তোমাকে অনেক দিনই বলেছি জিষ্ণু।

জানি। মানে, এখন জানি।

পরি নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। পরি যদিও জিষ্ণুর খুড়তুতো বোন, আপন কাকার মেয়ে, পরিকে দেখেই ওর মধ্যে, মানে শরীরের ভেতরে কত কী ঘটে যায়। ও জানে, এ খুব অন্যায়, তবু।

পেছন থেকে ডেকে বলল, কাকিমা কোথায় গেলেন কালীবাড়ি থেকে?

কালীবাড়ি?

হ্যাঁ। শ্ৰীমন্তদা যে বলল, তোমরা কালীবাড়ি গেছিলে?

 না তো।

কে বলেছে? মা?

 হ্যাঁ।

মায়ের আর একটা মিথ্যে। আমরা নার্সিংহোমে গেছিলাম।

কাকে দেখতে?

কাউকে দেখতে নয়।

আমাকে দেখাতে।

তোমাকে?

হ্যাঁ। আমাকে!

তোমাকে? কেন? তোমার কী হয়েছে?

 আমাকে দেখাতে।

 আবারও বলল, পরি।

বলে, পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল জিষ্ণুর দিকে।

 এর পর আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না জিষ্ণু। বুঝল।

কাকিমা?

মা হীরুকাকার সঙ্গে একটু হেঁটে ফিরবে। পৌঁছে দেবে হীরুকাকা।

জিষ্ণু আর কথা বাড়াল না।

বাথরুমে নগ্ন হয়ে শাওয়ারের ঠাণ্ডা জলের ধারার নীচে দাঁড়াতেই কাল রাতের একঝলক দেখা পরির ঠেলে বেরোনো উজ্জ্বল সোনা-রঙের স্তন এবং পাকা কাবুলি আঙুরের মতো বোঁটাটি ভেসে উঠল। চোখ বুজে ফেলল জিষ্ণু। ভারি খারাপ, ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে জিষ্ণু। পুষির মৃত্যুর পর থেকেই ও কেমন যেন হয়ে গেছে। ও এখন যাকে তাকে খুন করতে পারে। রেপ করতে পারে নিজের খুড়তুতো বোনকেও। সারাদিন এয়ারকণ্ডিশানড ঘরে থেকে অফিস থেকে বেরিয়েই সারাশরীর যেন জ্বলতে থাকে। মিনিবাসের ড্রাইভারটাকে খুন না করতে পারলে ওর শরীর ঠাণ্ডা হবে না।

কে জানে! সত্যি সত্যি যদি খুন করতে পারে তাহলে এই অস্বাভাবিক তাপ আরও বেড়ে যাবে হয়তো। নিজেকে বুঝতে পারে না জিষ্ণু। শ্ৰীমন্তদার ভাষায় ও-ও এখন এক ভাইরাস জ্বরে ভুগছে।

ভীষণই অসুখ ওর।

.

০৮.

মে মাসের মাঝামাঝি হতে চলল। এখনও একফোঁটা বৃষ্টি নেই। কয়েক দিন ধরে বিহারের লু-এর মতো হাওয়া চলেছে কলকাতায়। তার ওপরে লোডশেডিং হয়ে গেছে প্রায় আধ ঘণ্টা হল।

তারিণীবাবুর ভাগে এই আদি বাড়ির যে-অংশটা পড়েছে তা একটেরে এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট। সাকুল্যে দেড়খানা ঘর। একফালি বারান্দা অবশ্য আছে। এ-বাড়ির বিভিন্ন অংশে বিভিন্নরকম জীবন বয়ে যায়। কোনো অংশর বাইরে স্নোসেম রং করা। কোনো অংশর জানলার লিনটেল-এ এয়ারকণ্ডিশনার চাপা গলায় গোঁ গোঁ করে। কোনো অংশে আবার দিনই যেন আর চলে না। তারিণীবাবুর চেয়েও সেইসব শরিকদের অবস্থা খারাপ।

 মেজো-শরিকের পাঁচুবাবু, কড়াইশুঁটির চপ আর বেগুনির দোকান দিয়ে বেশ টু পাইস করেছেন। উপরন্তু কর্পোরেশনে একটা চাকরিও করেন। চাকরির মাইনেটা বিনা খাটুনিতেই

 জোটে আর দোকানের রোজগারের গ্রস কামাই-ই বলতে গেলে নিট-মুনাফা। নিঃসন্তান পাঁচুবাবুর টাকার বড়ো গরম। তাঁর গিন্নি দিন রাত ভিডিয়ো দেখেন আর পটাটো চিপস খান। ইনকামট্যাক্স-ফ্যাক্সেরও কোনো বালাই নেই। তিনি মাঝে খুবই গরম হয়ে গিয়ে বলেছিলেন যে, পুরোবাড়ি একরঙা করে দেবেন। সব জানালা দরজারও একরঙ করবেন। যাতে বাইরে থেকে কোনো শালায় বুঝতে পর্যন্ত না পারে যে, বাড়িটা আর তাদের বাসিন্দাদের মধ্যে এত এবং এতরকম তফাত।

অবশ্য ন-শরিকের অবস্থাও খারাপ নয়। কিন্তু তিনি পকেটে হাত ঢোকান না নিজের প্রয়োজন ছাড়া। কিন্তু তাতেও সব শরিক রাজি হয়নি। মেজো-শরিকের বউ-এর সঙ্গে সেজো শরিকের বউ-এর কথা তো নেই-ই, মুখ দেখাদেখিও পর্যন্ত নেই। ছোটো-শরিক বলেছিলেন যে, চিড় যে লেগেছে এ-পরিবারে তা গোপন নেই। দেওয়াল ফাটিয়ে দিকে দিকে বট অশ্বথের চারাদের পাতায় পাতায় সেই চিড়ের-ই পতাকা উড়ছে। তাকে মেজোবাবুর পয়সা আছে বলেই যে ধামাচাপ দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এক শরিকে এয়ারকণ্ডিশানের হাওয়া খান, অন্য শরিকের মেয়ে-বউ দেওয়ালে খুঁটে দেয়, এটাই যখন ফ্যাক্টো তখন অ্যাক্টো করার দরকার কী? ঢের হয়েছে। আর থ্যাটার ভালো লাগে না।

অনেকই ভেবেটেবে দেখেছেন তারিণীবাবু যে, বড়োলোক আত্মীয়ের মতো আপদ, বাঙালির আর দুটি নেই। গরিব আত্মীয়র মতোও নেই। তবে বাঙালি হয়ে জন্মালে, গরিব থাকাই শ্রেয়। যারা বড়োলোক, তাদের মনের সুখে শালা-বাঞ্চোৎ বলে গালাগালি দেওয়া যায়।

আজ এই এজমালি বাড়িতে এমনিতেই উত্তেজনা প্রবল। কারণ ন-শরিকের বড়োছেলে আজ বিলেত যাচ্ছে। না না, কিছু পড়তে উড়তে নয়, নিছক দেশ দেখতে ন্যাংটো মেম দেখতে, ফুর্তি মারতে। সেইটেই তো অ্যাচিভমেন্ট! সারাজীবনে পোস্টিং-এর জায়গাগুলি ছাড়া আর কোথাওই যেতে পারেননি তারিণীবাবু। যাওয়া হয়ে ওঠেনি। জীবনটা যে কী করে এমন শেষ-অধ্যায়ে পৌঁছে গেল তা ভেবে, নিজেই অবাক হয়ে যান। একবার গয়া গিয়েছিলেন শুধু। তাও কর্তব্য করতে। মা-বাবার পিন্ডি দিতে।

তক্তপোশে শতরঞ্চির ওপর খালিগায়ে শুয়ে হাতপাখার বাতাস করতে করতে এই সব ভাবছিলেন তারিণীবাবু। তাও তো বিলেত গেল নিজের ছেলে ছাড়াও গুষ্টির কেউ। এতদিনে একজন বি জি এস। মানে বিলেত গিয়ে সাহেব। গর্বই হচ্ছে একরকম। ওঁর চক্রবর্তী গুষ্টির কারো কিছু ভালো হলেই তারিণীবাবু কেবল একটি কথাই বলেন : বাঃ। ঈশ্বরের কাছে বলেন মনে মনে, সকলেরই ভালো হোক। সকলেই সুখে থাকুক।

খাটের তলায় শুয়ে থাকা নেড়িকুত্তা ভুলো খুব জোরে একটা প্রশ্বাস ফেলে। যেন সায় দেয় তারিণীবাবুর কথায়! ওর নাকের ডগায় বসে-থাকা একটা কাঁটালে মাছি ফুৎকারে উড়ে যায়। আবার ফিরে এসে নাকে বসে।

সকলেই ভালো থাকুক, ভালো খাক; ভালো পরুক। সকলের ছেলে-মেয়েই মানুষ হোক। এ ছাড়া চাইবার আর কিছুই নেই তাঁর। একটা ব্যাপারে যে দুঃখ হয় না তা নয়। উনি চাকরিতে যখন ছিলেন, সে জামশেদপুর-গুয়া-খশুয়া লাইনেই হোক কি গোমো-ডালটনগঞ্জ লাইনেই হোক তাঁর নিকট এবং দুরের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীরা আণ্ডা-বাচ্চা নিয়ে তাঁর কাছে শীতের ছুটি বা গরমের ছুটিতে বেড়াতে যাননি এমন বড়ো-একটা হয়নি। তখন যতটুকু পেরেছেন যত্ন আত্তি করেছেন তাঁদের। মাছ-মাংস তখন খুবই সস্তা ছিল। যদিও মাছ পাওয়া যেত না সব জায়গায়। দুধও সস্তা ছিল। টাটকা তরি-তরকারি। আত্মীয়রা এক-এক দলে দশ-বারোজন করেও আসতেন। বেশি ছাড়া কম নয়। পাহাড়-জঙ্গল দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তাঁরা। সকালে বিকেলে দল বেঁধে হেঁটে বেরিয়েছেন। খিদেও হয়েছে খুব। কলকাতায় যা না খান তার তিনগুণ খেয়েছেন তৃপ্তি করে। তৃপ্তি তারিণীবাবুও কম পাননি খাইয়ে। জল সব জায়গারই ভালো ছিল। বিকেলের মধ্যেই সব খাবার হজম হয়ে গেছে। রাতে আবার সবাই মজা করে খেয়েছেন।

এইসব পুরোনো কথা, স্মৃতি ভাবতেই ভালো লাগে। যাঁরা যেতেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ আর নেই। অনেকে আবার আছেনও। কিন্তু তারিণীবাবু যখন হাত পুড়িয়ে স্টোভে সেদ্ধভাত চাপিয়ে একচড়া খান তখন একদিনও কেউ শুধোতে আসেনি তাঁর সেদ্ধ দেওয়ার মতো তরকারিটুকু আছে কী নেই? সংসারের এই অভাবনীয় ও অবিশ্বাস্য অকৃতজ্ঞতা এবং কৃতঘ্নতা তারিণীবাবুকে বড়োই ব্যথিত করে। কেন যে এমন হয় তা বুঝে উঠতে পারেন না। অবশ্য সবাই একরকম একথা বললে মিথ্যো বলা হয়। তাঁর খোঁজ করে ছোটোর ছোটোমেয়ে মামণি। ভারি ভালো মেয়েটা। অথচ এই ছোটো, ছোটোবউমা এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্যেই কিছুমাত্র করেননি তিনি। মানে সুযোগ পাননি। কিন্তু স্বভাবে মামণি একেবারেই মা লক্ষ্মী। পড়াশুনোতে ও গানেও খুবই ভালো সে। যে-ঘরে যাবে সে-ঘরই আলো করবে রূপে গুণে সেবা যত্নে। স্কুল-ফাইনাল অবধি পড়েছে ও। তার পর আর পয়সার অভাবে পড়া হয়নি। তিনটি বিষয়ে স্টার পেয়েছিল। স্কলারশিপও পেয়েছিল কিন্তু কলেজের বিলাসিতা করার সামর্থ্য ছিল না। যাতায়াতের ভাড়া, টিফিন, বই, এসব জোগাবার কেউই ছিল না। তারিণীবাবুর জ্বর হলে, মামণিই এসে সেবা-যত্ন করে। বার্লি জ্বাল দিয়ে আনে, থিন অ্যারারুট বিস্কুট। অথচ মামণির নিজের আর তার মায়ের যে দিন চলে কী করে তা স্বয়ং ঈশ্বরই জানেন!

 কাঠের তক্তপোশের ওপর তেলকালি হওয়া একটি পাতলা শতরঞ্চি। তারই ওপরে তারিণীবাবু পাশ ফিরে শুলেন। ঘামে গা জবজব করছিল বেলা একটার সময়ে। এখন হাওয়াটা শুকিয়ে গিয়ে পাক খাচ্ছে ঘূর্ণির মতো। ডালটনগঞ্জে বা চিপাদোহরে যেমন হত। কলকাতাটা কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। হাওয়াটা বেমক্কা ওড়াচ্ছে কলকাতার ধুলোবালি, শরিকের বাড়ির পাউরুটির মোড়ক, পায়রার পালক, কাকের গু, ঈর্ষা আর মনস্তাপ। ঠিক এইরকম গরম হাওয়া বইত মহুয়া-মিলন স্টেশানে। তিন মাস সেখানে পোস্টেড ছিলেন তিনি। ঝরঝর করে শুকনো শাল পাতা ঝড়ের আর ঝরনার মতো বয়ে যেত পাথুরে মাটিতে। ভেসে আসত দূর পাহাড় থেকে মহুয়া-করৌঞ্জ আর আরও কত নাম-না-জানা ফুলের গন্ধ। সুন্দরী আদিবাসী মেয়েরা রঙিন শাড়ি পরে কলকল করতে করতে চলে যেত। গিন্নি, তারিণীবাবুর অপলক দৃষ্টি দেখে বলতেন, টিকিট তো ওদের কারোরই চেক করো না। বদলে দেয় কী ওরা?

তারিণীবাবু খুব জোরে হেসে উঠতেন। বলতেন: ওগো, ওদের একটি হাসির দামে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর টিকিট পাওয়া যায়। তবে সে-সময়ে এই দেশ তো আর এই পরিমাণ স্বাধীন হয়নি। কিছু কড়াকড়ি, চক্ষুলজ্জাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা তখনও ছিল। টিকিট চাইতে হত নিশ্চয়ই কারো কারো কাছ থেকে। যারা ডেইলি-প্যাসেঞ্জার, তারা কলাটা, মুলোটা, একজোড়া ডিম, দূর থেকে আনা লেবু বা নারকোল, কখনো বা হাঁসটা-মুরগিটাও দিয়ে যেত। হাসি তো দিতই। উপরি। কোনোই খেদ নেই তারিণীবাবুর। এমনি অলস নিদ্রাহীন প্রহরে পুরোনো সেসব দিনের কথা ভেবেই কখন যে দিন শেষ হয়ে আসে খেয়ালই থাকে না আর আজকাল।

তারিণীবাবুর দুই ছেলে পরেশ আর সুরেশ মানুষ হয়েছে। কেউকেটা হয়েছে। সুখে আছে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে। এর চেয়ে আনন্দর আর কী হতে পারে? ন-শরিকের ওখান থেকে পরেশের ঠিকানা চাইতে এসেছিল। ঠিকানা, ফোন নাম্বার সবই দিয়ে দিয়েছেন। পরেশের মেমসাহেব বউ ছিল। ফোটো পাঠায় ওরা বছর বছর। নতুন নতুন বাড়ির; গাড়ির। বাড়ি গাড়ি পালটানোটা ওদের একটা ফ্যাশান। বউও পালটায় আবার কেউ কেউ বছর-বছর। শুনেছেন। পরেশ পালটেছে দু-বার। এখন তৃতীয় বউ। এই বউ পাঞ্জাবি। তার বাপ সে-দিন মারা গেল টেররিস্টের গুলিতে অমৃতসরে। তারিণীবাবু একটি ফরেন-লেটার জোগাড় করে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি দিয়েছেন। কলকাতায় নকশাল আন্দোলনের কথা লিখেছেন।

ভুলো হঠাৎ ভুক ভুক করে ডেকে বাইরের ঘরে দৌড়ে গেল।

কড়া নাড়ল কে যেন।

 এই অসময়ে, মানে সাড়ে তিনটের সময়ে কে এল?

মামণি অবশ্য আসে মাঝে মাঝে দুপুরের দিকে। তবে সে এলে ভেতরের দরজা দিয়েই এসে টোকা মারে। তাতেই অন্য শরিকেরা সকলে বলেন, তারিণীবুডোর বাড়িখানা হাতিয়ে নেওয়ার জন্যেই নাকি এত ভালোবাসার শো। মামণির শো।

বালিশের নীচ থেকে হাতঘড়িটি তুলে দেখলেন সাড়ে তিনটে। কী করে সময় যায়।

কড়াটা আবারও নাড়ল কেউ।

ভুলো ভুক ভুক করে পেছনের দু-পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সামনের দু-পায়ে দরজায় খচখচ আওয়াজ করতে লাগল।

 লুঙ্গিটা ভালো করে বেঁধে নিয়ে তারিণীবাবু দেওয়ালে ঝুলিয়ে-রাখা গেঞ্জিটা গলালেন পাঁজর-সার শরীরে। তার পর হাতঘড়িটা পরে খড়ম পায়ে গলিয়ে এগোলেন দরজা খোলার জন্যে। এগোতে গিয়েই আবার পিছিয়ে এসে দেওয়ালে ঝোলানো আয়নাতে চুলটা ঠিক করে নিলেন। টাকের ওপর একত্রিশ গাছি চুল আছে এখন কুল্লে। এবং মাত্র একত্রিশ গাছি আছে বলেই ভারি মায়া পড়ে গেছে ওদের ওপর। পনের দিন আগেও ছিল তেত্রিশ গাছি। চিরুনিটা একবার বুলিয়ে নিলেন টাকের ওপর সস্নেহে।

আবার কড়া নাড়ল কে যেন। এবার অধৈর্য হাতে।

দরজা খুলতেই তারিণীবাবু অবাক হলেন।

 বললেন, এ কী। হৈম দেবী যে! এ অসময়ে? কী সৌভাগ্য আমার। এই জীর্ণ দীন বাসে? হৈমপ্রভা তারিণীবাবুর যাত্রার ডায়ালগে জল ঢেলে দিয়ে বললেন, ভেতরে আসতে পারি কি?

আসুন, আসুন। নিশ্চয়ই।

বলে, আপ্যায়ন করে তাঁকে নিয়ে দেড়খানি ঘরের আধখানিতে বসালেন। একটি নেয়ারের ইজিচেয়ার। তাতে নীল-রঙা চাদর পাতা। সেখানেই তারিণীবাবুর বিশ্রাম। মধ্যে একটি ছোট্ট টেবিল, ল্যাজারাস কোম্পানির বানানো। ইটালিয়ান মাবে-এর টপ। এই টেবিলে তারিণীবাবুর বাবা-কাকারা তাস খেলতেন বসে। এখন তার দু-দিকে দুটি কাঁঠাল কাঠের চেয়ার। মেহগনির চেয়ারগুলাে সব ন-বাবু নিয়ে নিয়েছেন, শােলদার রথের মেলা থেকে কেনা এই কাঁঠাল চেয়ার দুটি। দেওয়ালে লাল কাপড়ের ওপর নীল সুতা দিয়ে কাজ করা তারিণীবাবুর স্ত্রীর দুটি সূচিকর্ম। ‘গড ইজ গুড’। এবং সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। বিয়ের পরে পরেই ভােলা সুরেন বাঁড়ুজ্যে রোডের ‘বোর্ন অ্যাণ্ড শেফার্ড’ ফোটোগ্রাফারের দোকানের একটি ফোটো। জোড়ে। বোর্ন অ্যাণ্ড শেফার্ডের পাশেই ছিল হোয়াইটওয়ে অ্যাণ্ড ল্যাডলোর দোকান। সে কী দোকান! ইস্টার্ন রেল কোম্পানির বড়োসাহেব সেই দোকান থেকে পাইপ আর টোব্যাকো কিনেছিলেন একদিন। বড়োসাহেবের পি এ-র কাছ থেকে শুনেছিলেন তারিণীবাবু। দোকানময় শুধু লাল মুখ, সাঁতরাগাছির ওলের মতো শরীর। গাঁক গাঁক করে ইংরিজি। ভয় লাগত রীতিমত।

আপনার সঙ্গে কথা ছিল।

হৈমপ্রভা বললেন।

 বলুন, হৈম দেবী।

এই চিঠি কি আপনিই লিখেছিলেন?

হ্যাঁ।

কত বড়ো সাহস আপনার?

আজ্ঞে ?

আপনার সাহস তো কম নয়।

আজ্ঞে, তা নয়। চশমাটা নিয়ে আসি? আপনাকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না হৈম দেবী। আমার আবার বাইফোকাল তো। কাছে দূরে কোনোটায় ভালো করে দে…

আমি স্বয়ংবর সভা করতে আসিনি তারিণীবাবু। অত ভালো করে আমাকে না দেখলেও চলবে।

আজ্ঞে।

দলিলটা কোথায়?

কীসের দলিল হৈম দেবী?

 ন্যাকামি করবেন না। এই চিঠিতে জিষ্ণুকে আপনি যে-দলিলের কথা লিখেছিলেন।

ও। সে দলিল আছে।

কোথায়? এক্ষুনি আমাকে এনে দিন।

আজ্ঞে, আমার কাছে মানে, আমার বন্ধু কাবুল মুখুজ্যের কাছে আছে।

 তাঁর কাছে কেন?

আজ্ঞে সেই যে আমার সলিসিটর।

 হেসে ফেললেন হৈমপ্রভা।

বললেন, এত বড়ো এস্টেট আপনার! সলিসিটর নইলে কি চলে?

আজ্ঞে!

কথার খোঁচাটা না বুঝেই বললেন তারিণীবাবু।

দলিলটা আনিয়ে রাখবেন। আমি একটা দলিল নিয়ে আসব। সেটিতে সই করে দেবেন। তার পর সলিসিটররাই করবেন যা করবার।

বাড়িটা তাহলে আপনি কিনবেন?

হ্যাঁ। কুড়ি হাজারই পাবেন। পুরো কুড়ি। একসঙ্গে অত টাকা কখনো দেখেছেন তারিণীবাবু?

কুড়িতে তো আমি দেব না।

তারিণীবাবু, নিজের গেঞ্জির তলাটা ধরে টান মেরে বাড়তি সাহস সঞ্চয় করে বললেন।

সে কী? এ তো বড়ো আশ্চর্য কথা! সে দিন আপনিই না বললেন তারিণীবাবু যে বাড়ি বিক্রি করা প্রয়োজন। প্রয়োজন শুধু আপনার পেনশানকেই সাপ্লিমেন্ট করার জন্যে?

 তাই তো ছেলে। মানে আইডিয়া তখন সেরকমই ছেলো। কিন্তু একটি বাড়তি প্রয়োজন জুটেছে। আমার মামণির বিয়ে দেওয়ার টাকা চাই।

কে মামণি?

সে আমার রূপে-গুণে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী-সরস্বতী অথচ টাকার জন্যে মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না।

অ। তা কত টাকা হলে আপনি বাড়িটা আমায় দেবেন?

ঠিক করিনি। মামণির মায়ের সঙ্গে বসে পরামর্শ করতে হবে।

কবে জানতে পারব?

কী কী ওঁর দেওয়ার ইচ্ছে। অমন মেয়েকে তো আর ন্যাংটোপোঁদে চেলি পরিয়ে বে দেওয়া যায় না। মেয়ের মতো মেয়ে যে সে। সাতটা দিন সময় দিন। ভেবে দেখি।

তারিণীবাবু বললেন।

দেব।

হৈমপ্রভা বললেন। ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে।

আপনি আমাকে চিঠি না লিখে জিষ্ণুকে চিঠি লিখেছিলেন কেন?

ওকে মানুষ হিসেবে ভালো বলে মনে হয়েছিল, তাই।

আমি মানুষটা বুঝি খারাপ?

আমি তো তা বলিনি।

ভবিষ্যতে এ-ব্যাপারে যা-আলোচনার তা শুধুমাত্র আমার সঙ্গেই করবেন এবং জিষ্ণু যদি আপনার কাছে আসে তাহলে ঘুণাক্ষরেও জানাবেন না যে, আমি নিজে আপনার কাছে। এসেছিলাম। এই চিঠিও আমি জিষ্ণুর ড্রয়ারেই রেখে দেব। যেখানে পেয়েছিলাম।

আপনি জিষ্ণুকে ভয় পান?

আমি সকলকেই ভয় পাই তারিণীবাবু। আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। কিন্তু আমার অবস্থা আর আপনার অবস্থায় বিশেষ তফাত নেই। এ-সংসারে আপনজন বলতে আমার কেউই নেই। যাদের জন্য জীবনপাত করলাম তারা আজ আমার কেউই নয়।

আমি আছি।

তারিণীবাবু হৈমপ্রভাকে আস্তে করে বললেন।

তার পর বললেন, এখানে সকলেরই একা-আসা একা-যাওয়া। বুঝলেন হৈম দেবী। আগে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতাম না। এখন সার বুঝেছি। সবসময়েই এই কথাটা মনে রাখা উচিত। দুঃখকে প্রশ্রয় দিলেই পেয়ে বসে। কচুরিপানারই মতো। আপনি কুকুর পুষবেন? আমার ভুলোরই বাচ্চা হয়েছে একটা। দেখবেন, নিজেকে আর একা মনে হবে না একটুও।

ভুলো কি মাদি কুকুর?

না। ভুলো সহবাস করেছিল। তার ইস্তিরির নাম পেঁচি। রাস্তার উলটোদিকের গ্যারেজ ঘরের ভেঁড়া-খোঁড়া পাটের রাশির মধ্যে সে আঁতুড় করেছে। তবে কুকুর পুষলে সবসময়েই তা মালিকের অপোজিট সেক্স-এরই পুষতে হয়। তবে তারা আরও বেশি ভালোবাসে।

অ। ভেবে দেখব। পুষলেও নেড়িকুত্তা পুষব কি না ভেবে দেখতে হবে।

কুকুররা সবই এক। মেয়েদেরই মতো।

কী বললেন?

 মানে, গায়ের রং, চুল, সাইজ, এমনকী… পেডিগ্রিতেই যা তফাত। নইলে সবাই একইরকম।

আপনি বড়ো বাজেকথা বলেন।

জল খাবেন হৈম দেবী? বড়ো গরম বোধ হচ্ছে বোধ হয় লোডশেডিং-এ। এ-ঘরে তো পাখা নেই। ভুলো, হাতপাখাটা।

বলতেই, ভুলো ভেতরের ঘরে গিয়ে হাত পাখার ডাঁটাটা মুখে করে নিয়ে এল।

তারিণীবাবু চট করে পাখাটা তুলে হৈমপ্রভাকে হাওয়া করতে লাগলেন।

উনি বললেন, থাক থাক। আমি এখুনি যাব।

যাবে তো সকলেই। এই তো পরশু বাঘাকে ইলেকট্রিক ফার্নেসে ঢুকিয়ে এলাম। জর্জকে কবর দিলাম গত সোমবারে। ইঞ্জিন-ড্রাইভার ছিল। সেই কানাডিয়ান ইঞ্জিন যখন প্রথম এল ভারতবর্ষে তখন জর্জই প্রথম তা চালিয়েছিল। মনে হয়, এই তো সেদিন। যাওয়ার কথা বলবেন না। মন খারাপ হয়ে যায়। সকলকে চলে যে, যেতেই হবে এর চেয়ে বড়ো সত্য আর নেই।

জল খাবেন একটু?

আবার বললেন তারিণীবাবু।

আমি জল ফুটিয়ে দু-বার ফিলটার করে খাই। জণ্ডিস হবে না তো? কত্বরকম ব্যাকটিরিয়া! কোথাকার জল? হেম, চিন্তিত গলায় বললেন।

ওই তো! রাস্তার ফুটপাথের। দেখাই যাচ্ছে। কোনো লুকোচাপা নেই। চমৎকার স্বাদ। পারগেটিভের কাজ করে। পায়খানা চমৎকার হয়।

ইশ! আপনি বড়ো বাজে ভাষায় কথা বলেন।

তাই? মাপ করে দেবেন। জীবনে বিলাসিতা থাকলে তবেই না, ভাষার বিলাসিতা থাকে। আপনি কি চা খাবেন? চায়ের সময়ও তো হল।

কোত্থেকে আনবেন?

 কেন? ঘণ্টের দোকান থেকে।

ভালো স্টেইনার আছে? কী চা? টি-ব্যাগ কি?

না, না কোনো ব্যাগ-ট্যাগ নয়। পুরোনো মোজা দিয়ে হেঁকে দেয়। সে-চায়ের স্বাদই আলাদা।

এবারে হেমপ্রভার মুখটি শক্ত হয়ে এল। বললেন, আমি উঠছি এবারে। চায়ের ঝামেলা আর করবেন না আপনি। কিন্তু বলুন আমি তাহলে কবে আসব আবার?

বলেছি তো, সাত দিন পরে। দলিলটা আনিয়ে রাখি। আর মামণির মায়ের সঙ্গে একটু কথাও বলে নিই। কত খরচা তিনি করতে চান সেটা জানা দরকার। জানেন হৈম দেবী, আমার ওপর কারোও দাবি নেই যেমন, তেমন আমারও কারোও ওপরে কোনোরকম দাবি নেই। কেউ যদি কিছু দাবি করে এখন আমার কাছে, আমাকে আপন মনে করে, ভারি ভালো লাগে। যতক্ষণ দাবিদারেরা থাকে ততক্ষণ উৎপাত বলে মনে হয়। আর যখন থাকে না, তখন নিজেকে বড়ো অদরকারি, অপ্রয়োজনীয় লাগে। অন্যর কাজে-লাগারই আর এক নাম যে জীবন তা রিটায়ার না করলে জানতেই পেতাম না বোধ হয়।

কিছুক্ষণ হেমপ্রভা একদৃষ্টে অনবরত পাখার বাতাস করে যাওয়া বৃদ্ধ তারিণীবাবুর মুখে চেয়ে থেকে, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলি।

আজ্ঞে। যাওয়া নেই আসুন। আর পরে যেদিন আসবেন ভাড়ার ব্যাপারটাও একটু বিবেচনা করে আসবেন। বাড়িটা বিক্রি আমি না-ও করতে পারি।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ