০৫.

 প্রায় মাস দুয়েক হয়ে গেল এখানে। অফিসের কাজ বেশ গুছিয়ে এনেছে। মিলনিতেও যাচ্ছে প্রতি শনিবার। যাচ্ছে আর পোকা যেমন ধীরে ধীরে মাকড়সার জালে আটকে যায় তেমনই আটকে যাচ্ছে নমিত, আটকে যাচ্ছে ওর অমোঘ নিয়তির বিনি-সুতোর ফাঁসে।

সকালে চান-টান করে নিয়ে ব্রেকফাস্টও সেরে নিল! চৈতালি বউদি ছুটির দিনে ভালো কিছু করেন। কাজের জন্যে ও রান্নার জন্যে দুটি মেয়ে আছে যদিও, তবু ছুটির দিনগুলোতে, নমিত দেখেছে যে, তিনি নিজে হাতে কিছু না কিছু করেনই। চৈতালি বউদির রান্নার হাতটিও বড়ো ভালো। যাই করুন না কেন দারুণ স্বাদ হয়।

রান্না যে মেয়েদের কত বড়ো গুণ, পুরুষের হৃদয় জয় করার কত সহজ পথ যে তা, এই সরল সত্যটা আজকাল ক-জন মেয়েই বোঝেন! ডালপুরি, আলুর দম, নয় তো লুচি, বেগুনভাজা, কুমড়োর হেঁচকি, পায়েস, নয়তো সুজির মোহনভোগ, ভালো করে গাওয়া-ঘি ঢেলে, তেজপাতা, লবঙ্গ, কিশমিশ দিয়ে, সুজিটাকে কড়া করে লাল করে ভেজে নিয়ে, বেশি চিনি দিয়ে। নয়তো অন্যকিছু।

খাওয়ার সময়ে সামনে বসে থাকেন চৈতালি টেবলে। বলেন, মোহনভোগ খেলে গায়ে জোর হয়। ভালো করে খান।

গায়ের জোর দিয়ে কী করব? আমি তো বন্দরের কুলি নই। কারও সঙ্গে মারামারিও করতে যাচ্ছি না। মস্তিষ্কের জোরেই চলে যাবে বউদি।

চৈতালি রহস্যময় চোখে বলেন, গায়ের জোরের অনেকই রকম হয়। বিয়ে তো একদিন করবেন। সেদিন বুঝবেন।

কথাটা বুঝেও, না-বোঝার ভান করে নমিত। চৈতালির বয়স হবে নমিতেরই মতন। দুটি বাচ্চা। মেয়েটি তেরো বছরের, ছেলেটি তিন বছরের। কিন্তু বাচ্চাদুটি যতখানি না প্রেমজ তার চেয়ে বেশি কামজ বলে মনে হয়। প্রেম ব্যাপারটা বোধ হয় অমলবাবুর অভিধানে নেই। ক জনের অভিধানেই বা আছে? বিশেষ করে পুরুষের অভিধানে। নমিতেরও দাম্পত্যে প্রেম থাকবে কি থাকবে না তা বোঝা যাবে শুধু বিয়ের পরেই। অবশ্য নমিতই বা কতটুকু বোঝে? তা ছাড়া দাম্পত্য ব্যাপারটা বড়োই গোলমেলে। বাইরে থেকে অত সহজে কিছু বোঝাও যায় না।

একটি গাড়ি এল। সাদা অ্যাম্বাসাডর।

চৈতালি বলল, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে।

হুঁ।

খাওয়া প্রায় শেষ করে এনে লুচি দিয়ে সন্দেশ খেতে খেতে বলল নমিত।

কোথাও যাবেন?

কোথাও তো যাবই।

বেশ মজার কাজ আপনাদের কিন্তু কোথায় যাবেন আজ?

হাইলাকান্দি।

বাঃ।

বা: কেন?

কী মজা। অত বড়ো গাড়িতে একা একা যাবেন, কত জায়গাতে ঘুরবেন। আমাকে তো একদিন নিয়ে গেলেই পারেন সঙ্গে। অবশ্য আপনার দাদাও একটা মারুতি বুক করেছে।

বাঃ। খুব ভালো।

নমিত বলল।

 তারপর বলল, আপনাকে নিয়ে গেলে অমলদা মাথা ভাঙবেন না?

তার খেয়ালই থাকবে না, থাকে না। আমি হচ্ছি ক্যালেণ্ডারের না-বদলানো পাতা। যখন বসন্ত আসে তখনও শীতকালের পাতাই ঝোলে। এ বাড়িতে একটিই ঋতু, একই নিয়ম।

তিনি কোথায় গেছেন?

প্রতিরবিবার সকালে যেখানে যান।

কোথায়?

তাসের ঠেক-এ। জুয়া খেলবে। সেখানেই একগাদা ছাইভস্ম গিলে এসে রাক্ষসের মতন খাবে। তারপর ঘুমোবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কোলবালিশ জড়িয়ে। অজুহাত হল, সপ্তাহে রোজই রাতে যারা হুইস্কি খায় তাদের রবিবারের সকালে বেশ ভালো পরিমাণ বিয়ার খেতে হয়। তাতে নাকি সিস্টেম flushed হয়ে যায়। কিডনি ভালো থাকে। যত্তসব। কুলথ কলাই খেলেই হয়! রবিবার সন্ধেবেলাটাতে অবশ্য বাড়ি থাকে। একটু কাজের কথাটথা হয় তখনই। রিন্টু-মিন্টিকে একটু আদর-টাদর করে।

আর? আপনাকে?

 নমিত বলল, শেষগ্রাস মুখে পুরতে পুরতে।

না সেসব কিছু নেই। এখন ভাইবোনের মতন সম্পর্ক।

 তাই? ভাই-বোন?

 হ্যাঁ। সত্যিই!

মাঝে মাঝে নমিতের ভয় হয় যে, সে কোনো জালে জড়িয়ে পড়ছে না তো? একই পোকা কত মাকড়সার জালে পড়বে? তা ছাড়া সব জালেরই বুনোন যে আলাদা আলাদা। অমলদাদের অবস্থা যথেষ্টই ভালো। শুনেছে, তাঁরা উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার আলিপুরদুয়ারের মানুষ। সেখানে নাকি শহর থেকে অনেক মাইল দূরে জমি-জমাও আছে। সেখান থেকে আয়ও হয় মন্দ নয়। ব্যাবসার আয়ও খারাপ নয়। টিনের সাব-ডিলারশিপ আছে। কাঁচা টাকাও রোজগার কম হয় না। আসলে ওর মনে হয়, অমলবাবু ওকে পেইং গেস্ট রেখেছেন আয় আশ্রয়ের জন্যে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি সিকিউরিটির কারণে। চৈতালি বউদি বাচ্চাদের নিয়ে একাই থাকেন রাত দশটা-এগারোটা অবধি। বিপদ-আপদ অসুখ-বিসুখ। বাড়িতে একজন পুরুষমানুষ থাকলে সুবিধে হয়। অথবা কে জানে কেন রেখেছেন? অন্যের মন বোঝার মতো ক্ষমতা নমিতের নেই। তা ছাড়া চৈতালির করুণ একাকিত্বটা ওর চোখে পড়ে। সে অপ্রত্যক্ষভাবে অনুযোগও জানায়।

কিন্তু আশ্চর্য! অমলবাবু কিন্তু কখনও কিছু বলেন না। কালই সকালে দেখা হয়েছিল। বললেন, কী ব্রাদার, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হচ্ছে না তো? চৈতালি কিন্তু মহা কেপ্পন। কষ্ট হলে আমাকে জানাবেন। আর মশারি টাঙিয়ে শোন না কেন? এই গুডনাইট-ফুডনাইটের লং-টার্ম এফেক্ট কী তা তো কেউ পরীক্ষা করে দেখেনি। নাকি দেখেছে? জানি না। পরে হয়তো জানা যাবে দীর্ঘদিন এইসব ব্যবহার করার পরে হয়তো ব্রঙ্কিয়াল-ট্রাবল ডেভেলাপ করে গেল। ক্যানসারও হতে পারে। কে বলতে পারে! ক্যান্সার-ম্যান্সার যে কী থেকে হয় তা কি এখনও মানুষ জেনেছে?

মশারি টাঙালে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।

নমিত বলেছিল।

হাসলেন খুব জোরে অমলবাবু।

বললেন, ব্যাচেলার-এর আবার দমবন্ধ কী? আগে বিয়ে করুন তারপরে বুঝবেন দমবন্ধ হওয়া কাকে বলে। গলায় এমন ফাঁস পড়বে যে, দম কাকে বলে তা ভুলেই যাবেন।

তারপরই বললেন, চলি।

নমিত খাওয়া সেরে উঠল। খাওয়ার ঘরের কোনাতে লাগানো বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে বলল, হাইলাকান্দি থেকে কিছু আনতে হবে আপনার জন্যে?

বেসিনের ওপরের আয়নাতে চৈতালির মুখের ছায়া পড়েছিল। ফর্সা গোলগাল মুখ। বড়ো সিঁদুরের টিপ কপালে। মুখ দেখলে মনে হয় বুদ্ধি নেই। কিন্তু মুখ খুললেই বোঝা যায় প্রখর বুদ্ধিমতী এবং রসিকা রমণী। মনে হয়, খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষীও।

 গাড়িতে বসে একটা সিগারেট ধরাল। প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু কাল রাতে মেঘাদার বাড়ি থেকে বেরিয়েই কুড়িটার দুটো প্যাকেট কিনেছে। আর ছাড়া বোধ হয় হল না সিগারেট।

ড্রাইভার বলল, কোন রাস্তা দিয়ে যাবেন স্যার হাইলাকান্দি? হাইলাকান্দিই যাবেন তো?

ভাবছি।

ড্রাইভার এঞ্জিনটা স্টার্ট করেছিল। বন্ধ করে দিল। ডিজেলের এঞ্জিন। ধ্বকধ্বক আওয়াজ করে একটা।

নমিত বলল, অম্বিকাপটিতে চলো একবার। হাইলাকান্দির পথে।

 কার বাড়ি যাবেন?

 তুমি কি চিনবে নাম বললে? ইনকাম ট্যাক্সে কাজ করেন, মেঘনাদ…

ও মেঘাদা! মেঘাদাকে কে না চেনে! আমার বাড়িও অম্বিকাপট্টিতেই যে। চমৎকার মানুষ। উনিই তো আমাদের পাড়ার প্রাণ। নিজে ব্যাচেলার কিন্তু তাঁর মতো বিরাট পরিবার খুব কম বিবাহিতরই আছে। সুখে-দুঃখে সকলের পাশে থাকেন। আমাদের পাড়াতেই ইনকাম ট্যাক্সের একজন নোটিশ সার্ভার থাকে। আর একজন বি কম পাস উকিল। কী পয়সাটাই না কামায় স্যার। উরি: ফাদার। কিন্তু মেঘাদা মেঘাদা! প্রকৃতই সজ্জন ব্যক্তি।

ভালোই হল। চলো তাহলে।

 এঞ্জিন স্টার্ট করে গাড়ির চাকা গড়াল ড্রাইভার।

তোমার নাম কী ভাই?

আমার নাম মদন।

মদন কী?

এই পদবি ব্যাপারটা তুলে দিলে ভালো হয় না স্যার? আমি শুধু মদনই যদি থাকি তাতে কি আপনার আপত্তি আছে?

না, আমার আপত্তির কী?

আপনি আমাকে বলতে পারেন স্বপন মদন।

মানে?

মানে আমার বাবার নাম স্বপন আর মায়ের নাম মীনাক্ষী। আমার একমাত্র বোনের নাম চামেলি। তার নাম দিয়েছি আমি মীনাক্ষী চামেলি।

বা:।

বলল নমিত।

তারপর বলল, তোমার যদি বোন না থাকত? তুমি যদি একমাত্র সন্তান হতে তবে কী নাম রাখতে তোমার?

কেন? স্বপন মীনাক্ষী মদন।

বা:

বলে, হেসে উঠল নমিত।

মদন বলল, এই জাতপাত আর পদবিতেই দেশটা গেল।

হুঁ।

নমিত বলল।

তারপর মনে মনে বলল, শুধু এতেই নয়, আরও অনেকই কারণ আছে দেশটা যাওয়ার। কিন্তু এখন এসব কথা নিয়ে মাথা ঘামাবার মতন মানসিকতা ওর নেই। দেশ তো গেছেই। অথবা জন্মায়নি। পঞ্চাশ বছর যদি গর্ভধারণের পক্ষে যথেষ্ট সময় না হয়, তবে আর কিছু বলার নেই। যাকগে যাক। দেশ গেলে যাক, তার সরোজা থাকলেই হল।

শীত যাই যাই করছে। তবে বসন্ত এখনও আসেনি। আসবে। ভাগ্যিস আসবে বসন্ত। প্রতিবছরই আসে। সবিনয় নিবেদন নামের একটি পত্রোপন্যাসে পড়েছিল যে, বসন্ত Familiarity breeds contempt এই ইংরেজি প্রবাদটি জানে বলেই হয়তো এসেই পালিয়ে যায়। বাস্তবে সে দীর্ঘস্থায়ী হয় না কিন্তু কল্পনাতে আঁটে। আসুক আসুক, বসন্ত আসুক। এবারে সে এলে আর পালাতে দেবে না।

এইসব ভাবতে ভাবতেই বড়োরাস্তায় এসে পড়ল গাড়ি তারপর চলতে লাগল। জোরে। রবিবার বলে ট্র্যাফিক বেশি নেই। গাড়ির পেছনের সিট-এ শরীর এলিয়ে বসল নমিত। ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যে বসে, রাতে ঘুম-না-হওয়া, চান করা এবং বেশ ভালো ব্রেকফাস্ট খেয়ে ওঠা নমিতের চোখ দুটি ঘুমে বন্ধ হয়ে এল। বন্ধই হয়েছিল।

একসময়ে স্বপন মদন বলল, নামবেন না স্যার?

ও চোখ খুলে বলল, কোথায়?

 তারপরই দেখল মেঘাদার বাড়ি পৌঁছে গেছে। যে-পথে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়, এক সময়ে সেইসব পথই গাড়িতে অতিক্রম করলে তার দূরত্ব অকস্মাৎ নস্যাৎ হয়ে যায় সময়ের মাপে।

এসে তো পড়ল। এখন? নামবে কি? কী করবে নমিত?

দারুণ সপ্রতিভ, ইন্টার কলেজিয়েট ডিবেটে ফাষ্ট হওয়া নমিত, বড়ো অপ্রতিভ, ভীত, হয়ে গেল, ক্রুদ্ধ কুকুর দেখা বিড়ালনির মতন। শরীরের সব রোম শুয়ে গেল। বুক ধ্বকধ্বক করতে লাগল। ওর মধ্যে যে, এই নাম-না-জানা সাংঘাতিক অসুখটি ছিল, তাকে এতদিন অনবধানে লালন-পালন করছিল, সে খবর তো কই তাদের পুঁদে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ড: মুখার্জি কখনো তাকে জানাননি।

 মেঘাদা এখন কী করছেন কে জানে? যদি বাড়িতে না থাকেন? সরোজা যদি একা থাকে? ওরে বাবা:! সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা ভাবতে পর্যন্ত পারছে না নমিত। ও ভাবছিল, কেন যে মরতে শিলচরে এল? এল তো এল, কেন যে মেঘাদার সঙ্গে আলাপ হল? আর কেনই বা তাঁর বাড়িতে আসতে গেল?

নামবেন না স্যার?

স্বপন মদন বলল।

 ভাবছি।

তবে এলেন কেন? যদি নামবেনই না!

না। ভাবছি। অসুবিধে আছে।

তারপর বলল, মদন, তুমি ভাই গিয়ে একটু দেখে এসো তো মেঘাদা আছেন কি না? আসলে নামলেই দেরি হয়ে যাবে তো। আমার অফিসের ছেলেরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে হাইলাকান্দিতে।

বেশ!

বলে, স্বপন মদন নেমে গেল স্টিয়ারিং ছেড়ে। দিনের বেলা এই সময়ে তো আসেনি একবারও। তাই তেমন করে লক্ষ করেনি যদিও প্রতি শনিবারই এসেছে। এসেছে, অথচ সরোজাকে কখনো একা পায়নি। একা পেলে কী করবে বা কী বলবে তা নিয়ে ভাবেওনি কিছু অথচ ভারি ইচ্ছে করেছে একটু একলা পাওয়ার।

চারটি সিঁড়ি আছে দেখল নমিত বাড়িটার সামনে। গেট-এর ওপরে আর্চ করা দুটি ম্যাজেন্টা রঙা বোগোনভিলিয়া দু-পাশে। ফুল ফুটেছে খুবই। ছোট্টই বাগান। ভালোবাসার বাগান বোধ হয় ছোট্টই হয়। এই বাগানের পেছনে সরোজাকে দেখতে পেল ও মনে মনে। তারপরই ভাবল, ভালোবাসা ছাড়া কোনো বাগানেই ফুল ফোটে না। সে মনের বাগানই হোক কি ফুলের বাগান। একপাশে মুসাণ্ডা। নলি বাঁশের ঝাড়। লালপাতিয়ার ঝাড়। ইংরেজি নামটা মনে পড়ছে না এক্ষুনি। বড়োপিসির যোধপুর পার্ক-এর লন-এ আছে অনেকগুলো, দেওয়ালের পাশ বরাবর। আশ্চর্য! বরাক উপত্যকার মতন বাঁশের রাজত্বে কেউ শখ করে বাড়িতে বাঁশ লাগায়? কাঁঠালি চাঁপার গাছ। রাতে এসব লক্ষ করেনি।

 নমিত গাড়িতে বসে ভাবছিল যে, আমরা যাই দেখি তারমধ্যে কমকিছুই লক্ষ করি। দেখা নানারকম হয়, তা ফুলের বাগান কি কুশিয়ারা নদী বা সরোজার মুখোনি, যাই-ই হোক না কেন! মনে পড়ল, সাইকেলগুলো আর মোটর সাইকেলটা চাঁপা গাছের নীচেই রাখা থাকে প্রতিশনিবার।

একজোড়া মৌ-টুসকি পাখি রঙ্গনের ঝাড় থেকে উড়ে গেল শিশুর মুঠিভরা ভালোবাসার মতন।

দরজাটা খুলে গেল। কে খুলল কে জানে!

স্বপন মদন ফিরে এসে বলল, মেঘাদা বাড়িতে নাই।

নেই?

 ভারি ভয় পেয়ে গেল নমিত।

তারপরই বলল, চলো, চলো হাইলাকান্দি। দেরি হয়ে গেল আমার।

স্বপন মদন যখন গাড়িটা ব্যাক করছিল তখনই নমিত দেখতে পেল যে, ভেতর থেকে খোলা দরজাটার কপাট দুটো কেউ নিঃশব্দে বন্ধ করে জানলার পেছনে এসে দাঁড়াল। তখনই দেখল, জানলার সামনে ঘন-সন্নিবিষ্ট মাছি-গোলাপের লতা। শেষরাতের স্বপ্নের মতন ফিকে গোলাপি ফুল ফুটে আছে। ছায়ার মতন ঘরের অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল সরোজা জানলার সামনে। ছায়ার রং দেখে মনে হল নমিতের যে, গতরাতের শাড়িটিই পরে আছে সে। তার মানে, স্নান করেনি এখনও। সরোজা স্নান করবে এই কথাটা মনে হতেই নমিতের সারাশরীর শিরশির করে উঠল।

হায় শরীর। এই শরীর!

 ভাবল! নমিত।

তারমধ্যে এই শিরশিরানো শরীর যে ছিল, তা কালকে রাতের আগেও জানত না ও। ভেবেছিল, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, অ্যাডভার্টাইজমেন্ট, কম্পিউটার সায়েন্স এসব গুলে খেয়ে সে একটি সর্বজ্ঞ হৃদয়হীন Robot হয়ে গেছে। ভেবেছিল, তার জীবনে কেরিয়ার, সাকসেস এবং আলটিমেটলি বোর্ড-রুম-ই একমাত্র গন্তব্য। তার গন্তব্যর তালিকার মধ্যে সদাই পান খাওয়া বাঙাল ভাষায় কথা বলা ইনকাম ট্যাক্সের এক বড়োকেরানি মেঘাদার বাড়িও যে, আদৌ ঢুকে পড়তে পারে সেকথা একবারও দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।

কবিতার সঙ্গে অবশ্য সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারেনি। এবং সেইটাই হয়েছিল কাল। কবিতা বড়ো সাংঘাতিক বস্তু। ওর বন্ধু জীবকের ভাষাতে, যাকে বলে A snake in the grass। বোঝা যায় না যে আছে। কামড়াবার আগে একেবারেই বোঝা যায় না।

গানও গেয়েছে স্নানঘরে। কিন্তু বুদ্ধদেব গুহর মতো Trash Romantic গল্প লেখা লেখকদের লেখা-টেখা পড়া ছেড়ে দিয়েছিল বহুদিনই। তার এই অশেষ বুদ্ধিজীবীর নির্মোক যথেষ্ট দুর্মর হয়ে উঠেছিল বলেই সবিশেষ বিশ্বাস জন্মেছিল ওর। কিন্তু এখন দেখছে যে, ভেতরে ভেতরে ও যথেষ্টই প্রাকৃত আছে। রোমান্টিক।

 এসব কী? ছিঃ ছিঃ। অভাবনীয় সব ব্যাপার-স্যাপার। ছি :! না, না, ছি :।

গাড়িটা যখন বড়োরাস্তাতে এসে পড়ল তখন গাড়িতে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল একটি সুদর্শন ছেলে। খদ্দরের হালকা হলুদ-রঙা পাঞ্জাবি পরা একটি সুদর্শন তরুণ সাইকেল জোরে চালিয়ে ঢুকছিল মেঘাদাদের বাড়িরই গলিতে।

স্বপন মদন একটা খারাপ গালাগালি দিল। ছেলেটা শুনতেও পেল না।

স্বপন মদন বলল, হালায় প্রেমে পড়েছে নির্ঘাত। মরবে একদিন। ওকে বাঁচাতে পারে এমন সাধ্য কোনো দেবদেবীরই নেই।

একটুর জন্যে যে প্রাণটা যেতে পারত সেই কারণে ছেলেটির কিন্তু কোনো উত্তাপ ছিল না। হলুদ বালবের নিশানের মতন তার পাঞ্জাবির কোনা ফাল্গুনের প্রভাতি হাওয়াতে উড়িয়ে দিয়ে সে গলিতে ঢুকে পড়ল। হঠাৎ চিনতে পারল নমিত তাকে। দুর্বিনয়। সার্থকনামা দুর্বিনয়। প্রথম দেখাতে মেঘাদার বাড়ির ল্যাংটো বালব-এর নীচে যতখানি সুদর্শন বলে ভেবেছিল, ও আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি সুদর্শন। অত্যন্ত লম্বাও। ও নিশ্চয়ই সরোজার কাছে যাচ্ছে। জানে নিশ্চয়ই যে, মেঘাদা থাকবেন না এই সময়ে বাড়িতে।

দিলে না কেন চড়িয়ে?

স্যার? কিছু কইলেন কি?

বলছি, অমন দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতন সাইকেল চালায়, দিলে না কেন চড়িয়ে তোমার গাড়ি তার ওপরে।

তার উপায় কী আছে বলেন? এই দেশে গাড়িতে যে চড়ে বা গাড়ি যে চালায় সব দোষই তো তারই। সে সবসময়েই দোষী। আমার বাবার কাছে শুনেছি যে ব্রিটিশ আমলে এমন ছিল না। মানুষের প্রাণে একটা ভয়ডর বলে ব্যাপার ছিল। আইনের শাসন ছিল।

তা ঠিক। কিন্তু তখন চোর-ডাকাত ঘুসখোর ঘুসের দালাল বা যেকোনো দালালেরই গাড়ি ছিল না। তখন যাঁরা গাড়িতে চড়তেন তাঁদের সম্মান ছিল। সমীহ করত পথের মানুষ তাঁদের। সেটাও একটা ব্যাপার। তা ভুলে গেলে চলবে কেন?

সেটা অবশ্য ঠিকোই কইছেন স্যার। বাবাকে বলব আমি আজ বাড়ি ফিরে একথা।

.

০৬.

আজ বুধবার। বেশ কয়েকটি বই ও ম্যাগাজিন ও একটি ক্যাসেট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মেঘাদা একটি ছেলেকে দিয়ে গতকাল নমিতের অফিসে। শনিবারের এখনও অনেকই দেরি। কী করে যে রবি থেকে মঙ্গল কেটে গেল তা নমিতই শুধু জানে। আগামীকাল ব্যাঙ্ক হলিডে আছে। নমিতের অফিসও বন্ধ। হয়তো ইনকাম ট্যাক্সও বন্ধ। বন্ধ না হলেই ভালো। মেঘাদার বাড়ি পৌঁছে বলতে পারবে মেঘাদার কাছেই এসেছিল, ভেবেছিল বাড়ি থাকবেন উনি। আজ ছুটি তো! সেই জন্যে।

মিথ্যাচারে অভ্যস্ত নয় নমিত। এখনও নয়! জানে না, কোনোদিন হয়তো হয়ে উঠবে। যদি হয়ে উঠতে হয় তবে ওর মতন সুখী আর কেউই হবে না। আজকাল যারা মিথ্যে বলে, মিথ্যাচার করে না সেইসব মানুষকে সকলেই বোকা বলে। কিন্তু শুধুমাত্র বোকারাই জানে, মানে, যারা শুধুমাত্র সতোর কারণেই বোকা বলে গণ্য আজকের পৃথিবীর কাছে, সেই বোকামির আনন্দ। সেই শুদ্ধ আনন্দর স্বরূপ অশুদ্ধ চালাক মিথ্যাচারীরা তাদের সমস্ত প্রাপ্তির বিনিময়েও কোনোদিনও জানতে পারবে না, মিথ্যাচারীও নয় বলেই ওর বলা মিথ্যেটা আদৌ সত্যর মতো শোনাবে না যে, তা ও জানে। তবু…। চেষ্টা করবে।

কাল সকালে ও যাবেই সরোজার কাছে।

মেঘাদার পাঠানো বইগুলি নেড়েচেড়ে দেখছিল। যতই দেখছিল ততই অবাক হচ্ছিল ও। কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধর মান এই প্রত্যন্ত প্রদেশের শহরে যে এরকম উঁচু হবে সে সম্বন্ধে ওর কোনোই ধারণা ছিল না। সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন তো কত জায়গাতেই হয়। কিন্তু সেই সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকাটা নেড়েচেড়ে দেখে, লেখাগুলি পড়ে, চমৎকৃত হয়ে গেছিল ও। পড়তে পড়তে রাত দুটো হয়ে গেছিল।

অধিবেশন-সভানেত্রী অনুরূপা বিশ্বাসের একটি লেখা আছে স্মরণিকাতে। বরাকের সাহিত্যর সূচনা থেকে প্রাক স্বাধীনতা।

 কবি অশোকবিজয় রাহা, যাঁর বিখ্যাত দুটি লাইন আশৈশব শুনে এসেছে তার মায়ের কাছে।

হঠাৎ দেখি আরে!

আধখানা চাঁদ আটকে গেছে টেলিগ্রাফের তারে।

 সেই কবির দেশও যে, এই বরাক উপত্যকায় তা জানা ছিল না নমিতের। তাঁর একটি কবিতা অনুরূপ বিশ্বাস উদ্ধৃত করেছেন তাঁর নিবন্ধে :

দূর থেকে দেখেছি সেদিন ধূম্রদেহ হাফলং পাহাড় অতিকায় দনুর সন্তান লাফ দিয়ে উঠে গেছে অর্ধেক আকাশে কোমরে জঙ্গল গোঁজা, সূর্যের মাকড়ি জ্বলে কানে দূর শূন্যে বল্লম উচানো।

বা:

নিজেই নিজের মনে বলেছিল, নমিত।

আর একজন কবি করুণারঞ্জন ভট্টাচার্য।

রামেন্দ্র দেশমুখ্যও যে এই কাছাড়েরই মানুষ তাও জানত না নমিত। আসলে জানত এই বরাক উপত্যকা সম্বন্ধে অতিসামান্যই। যখন প্রোমোশনে বদলি হয়ে আসে এখানে তখন মন ভারি খারাপ হয়ে গেছিল। এখন বুঝতে পারছে এখানে এসে যে, কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস বা রাসবিহারী অ্যাভির আর ল্যান্সডাউনের মোড়ের সুতৃপ্তি এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভির কফি হাউস অথবা আনন্দবাজার বা দেশ-এর ঘরের বাইরে থেকেও, এই এতদূরের যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন শহরে বাস করেও তাঁরা শুধু কাব্য-সাহিত্য-সংগীত মনজ্ঞই নন, তাঁদের গুণের মান কলকাতার শিরোপা-পাওয়া অনেক কবি সাহিত্যিক গায়কের চেয়ে অনেকই উঁচু।

করুণারঞ্জন ভট্টাচার্যর একটি কবিতা থেকে অনুরূপা বিশ্বাস উদ্ধৃতি দিয়েছেন :

ক্রেনে ভারী বস্তু টেনে তুলে নিয়ে ফেলার মতন। চতুর্দিকে কান্ডকারখানা আবাদ হাসছে, মধ্যে দীর্ঘ রেলপথ। গানের কুয়াশামাখা সমতট। সমতল সমতটে, দু-ধারে চন্দনবৃক্ষ, শিরীষ অর্জুন, ঝাউগাছ, মাঠ চলে গেছে, উঁচু-নীচু, দূরে নীল পাহাড়ের দিকে। মনোরম ট্রেনে মমতার ইস্টিশন পর পর প্রেমডুবি বাজাও, বাউল পার হও? জোড়াগঞ্জ ছেড়েছি কবেই ওই বাউলকৃষ্ণচূড়া গাঁ-র অনন্ত ট্যুরিস্ট আমি- ওই ট্রেনের প্যাসেঞ্জার।

অনুরূপা দেবী তাঁর প্রবন্ধের শেষে লিখছেন :

সেসব দিন আজ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে রামেন্দ্র দেশমুখ্যর চোখে ঘোর লাগা শিলচরের পথের দু-পাশে অজস্র বকুল ঝরানো, অপরাজিতার নীল মেলা, কাঞ্চনের বর্ণসুষমা, সুরভি মাতাল কবিতার দিনগুলিও।

কিন্তু কবিতা হারিয়ে যায়নি। কবিরাও যাননি হারিয়ে। দিন বদলের পালায় তাঁরা বদলে নিলেন নিজেদের আর বদলে গেল কবিতাও। এলেন নতুন কবিদল। শিলচরকে কবির শহর করলেন তাঁরা। তবে সে প্রসঙ্গ আসবে পরে।

কলকাতায় বসে, কলকাতায় সব উচ্চম্মন্য কবি-সাহিত্যিকদের লেখা পড়ে নমিত কখনোই জানেনি যে, বাংলা ভাষার জন্যে যখন বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে দুজন শহিদ হয়েছিলেন এই বরাক উপত্যকাতেই শহিদ হয়েছিলেন, তেরো জন। তার মধ্যে অধিকাংশই টিন-এজার। তরুণীরাও ছিলেন। বুকের রক্ত দিয়ে যাঁরা ভাষার স্বাধীনতার দাম দিলেন তাঁদের পরম অবহেলিত করে রাখল মূলবাংলার ভূখন্ড এবং তার রাজধানী কলকাতা। এর চেয়ে গভীর লজ্জা আর কী হতে পারে?

কলকাতায় একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে এই লজ্জার ভাগ নমিতেরও অবশ্য নেওয়া উচিত।

ভাবছিল নমিত।

এখানের কবি দিলীপকান্তি নস্করের একটি কবিতাও অনুরূপা দেবী উদ্ধৃত করেছেন তাঁর অভিভাষণে। সেই কবিতাটি পড়ে মাথা হেঁট হয়ে যায় লজ্জাতে–

আমি কোত্থেকে এসছি, তার জবাবে যখন বললাম :

করিমগঞ্জ, অসম

তিনি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন

বাঃ বেশ সুন্দর বাংলা বলছেন তো!

আমি আর কী বলতে পারি,

ওকে ঠিক জায়গাটা ধরিয়ে দিতে গিয়ে বললাম

 বাংলা ভাষার তেরো শহিদের ভূমিতে আমার বাস;

তখন তিনি এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থেই

আমাকে ভিরমি খাইয়ে দিয়ে বললেন

ও। বাংলাদেশ? তাই বলুন!

এই তিনি কিনি তা নমিত জানে না। তবে কলকাতায় অধিকাংশ আঁতেলই যে এই তিনিরই মতন সে বিষয়ে নমিতের কোনো সন্দেহ রইল না আর।

এখানে আসার পর থেকে একটি নাম অনেকের মনেই অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনেছে। সেই নামটি বিজিৎ চৌধুরির। তিনিই সভাপতি ছিলেন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক সমিতির ওই সম্মেলনের। স্মরণিকার প্রত্যেকটি প্রবন্ধই সুলিখিত, চিন্তার বাহক এবং দ্যোতক। একটিও ছাপার ভুল নেই কোথাওই। বানান ভুলও নেই বললেই চলে।

মনে মনে অশেষ কৃতজ্ঞ হল নমিত মেঘাদার কাছে। স্মরণিকা ছাড়াও যেসব বই তিনি পাঠিয়েছেন তা হল বরাকপারের গল্প। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ গল্পকার প্রয়াত ভানু সেনগুপ্ত, করুণারঞ্জন ভট্টাচার্য এবং শঙ্কর গুপ্ত, ১৯৫১-১৯৬০ মহীউদ্দিন, অতুলরঞ্জন দেব এবং কামাল উদ্দিন আহমেদ, ১৯৬১-১৯৭০ শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী, অপরেশ ভৌমিক, গণেশ দে, অরিজিৎ চৌধুরি, নিখিলেশ ভট্টাচার্য এবং সুভাষ কর্মকার, ১৯৭১-১৯৮০ বদরুজ্জমান চৌধুরি, প্রয়াত অনুশ্রী সেন, নারায়ণচন্দ্র চক্রবর্তী এবং মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন, তারও পরে ১৯৮১-১৯৯০ জয়া দেব, শুভঙ্কর চন্দ, দেবব্রত চৌধুরি, সাবিউদ্দিন চৌধুরি এবং আশিফ, রহুল নাথ-এর একটা করে গল্প সংকলিত হয়েছে। এবং যেহেতু গল্পগুলি বড়ো নয়, নমিত পড়ে ফেলতে পারল। গল্পগুলির মান নিঃসন্দেহে উঁচু। সবচেয়ে বড়ো কথা বরাক উপত্যকার গন্ধ আছে সেইসব গল্পতে। এই গল্প সংকলনটি ওই সম্মেলনের নাম থেকেই প্রকাশিত।

 শ্রী দেব বইগুলির সঙ্গে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন সম্ভবত মেঘাদার অনুরোধে। লিখেছিলেন :

প্রীতিভাজনেষু,

আপনিও যে আমাদেরই একজন হয়ে উঠেছেন তা জেনে খুবই আনন্দ হচ্ছে। আমাদের দেওয়া-নেওয়ার অনেক কিছুই আছে। ফিরে গিয়ে কলকাতার কবি সাহিত্যিকদের বলবেন যে, আমাদের এই উপেক্ষিত তৃতীয় ভুবন তাঁদের দয়া বা করুণার ওপরে নির্ভর করে ছিল না, নেই, এবং থাকবেও না। বঙ্গভাষার ইতিহাসে যে তিনটি যুগের কথা আমরা জানি, কল্লোল যুগ বা কৃত্তিবাস যুগ-এর মতন কোনো যুগ নয় সেই সব যুগ, তা হল গৌড়ীয় যুগ, নদীয়া যুগ এবং কলিকাতা যুগ। ত্রিপুরারাজমালা, সঞ্জয়ের মহাভারত, অনন্তরামের রামায়ণ প্রভৃতির তথ্যরাশি যথাযথভাবে আবিষ্কৃত হলে ও তা নিয়ে গবেষণা হলে একথা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার হবে যে, সাহিত্যে কলিকাতা যুগের জন্মের অনেকই আগে (গৌড়ীয় যুগেই) শ্রীহট্টর সাহিত্যচেতনা ও সাহিত্যকর্ম নিজস্ব প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

একটি কথা বলব নমিতবাবু। কিছু মনে করবেন না। আপনি উচ্চশিক্ষিত তায় কলকাতার বুদ্ধিজীবী তাই বলতে ভয় হয়। কথাটা হচ্ছে এই যে, জ্ঞানের সীমা চিরদিনই ছিল, অজ্ঞতার সীমা কোনোদিনও ছিল না। আপনারা কলকাতাবাসীরা চিরদিনই অন্যদের সম্বন্ধে উদাস। আপনারা কূপমন্ডুক। সর্বজ্ঞ। তা না হলে, কলকাতার তিনশো বছর নিয়ে আপনারা বালখিল্যর মতন লাফালাফি করতে পারতেন? যদি আমাদের ইতিহাস জানতেন, যদি জানতেন যে, কটক শহরের বয়স দু-হাজার বছর এবং গৌহাটির তিন হাজার বছর। আপনারা কলকাতার আঁতেলরা জানেনও না আপনাদের সম্বন্ধে আমাদের, ওড়িশাবাসীর এবং অসমবাসীদের কী ধারণা। চোখ খুলুন আপনারা, কান পাতুন, প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে উৎসুক হোন।

এই প্রত্যন্ত প্রদেশে পড়ে থেকে মাতৃভাষার জন্যে বুকের রক্ত দিয়ে এখনও আমরা এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার যে হব না সে বিষয়ে এখনও নিঃসন্দেহ নই। আমাদের নিজস্ব ভাষার অধিকার সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকার তো বটেই, এমনকী পশ্চিমবঙ্গ সরকারও তেমনভাবে অবহিত নন। এর চেয়ে বড়ো দুঃখ আর কী হতে পারে? আপনি এখন আমাদের মিলনির সভ্য হয়েছেন তাই আপনাকে এত কথা বলতে সাহস পেলাম। অপরাধ নিজগুণে মার্জনা করবেন। আগামী শনিবার আপনার গান শোনার জন্যে তীব্র আগ্রহ থাকল।

প্রীতি জানবেন।

ইতি অ, দ।

 চিঠিটি পড়ে নমিতের লজ্জা আরও বাড়ল। ও ভাবছিল যে, প্রথমদিনেই নিধুবাবুর নানান দেশের নানান ভাষা বিনে স্বদেশি ভাষা পুরে কি আশা এই গানটি গেয়ে ভালোই করেছিল। যাঁরা বুকের রক্ত দিয়েছেন মাতৃভাষার জন্যে, তাঁদের মুখেই তো এই গান মানায় সবচেয়ে বেশি।

অন্যান্য বইয়ের মধ্যে ছিল বরাক উপত্যকার বাঙালি-হিন্দু সমাজের বিবাহের চালচিত্র। অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। শিলচর মহকুমা পরিষদ প্রকাশিত বিজন কুসুম। শ্রীহট্ট কাছাড়ের পাহাড়ি গান আছে তাতে। লোকসাহিত্যের নানা টুকিটাকিও আছে।

 অনুরূপা বিশ্বাসের উনিশে মে আয়ুষ্মন হও এবং ছড়া দিলাম ছড়িয়ে। ছবিদ্রস্তা সম্পাদিত ত্রৈমাসিক কবিতা পত্রিকা মা-নিষাদ। প্রবাহ। সম্পাদক নলিনীরঞ্জন নাথ। লালা নামক একটি জায়গা থেকে প্রকাশিত।

নমিতদের কলকাতার পাড়ার লালাদাকে বলবে ফিরে গিয়ে ও কলকাতাতে যে, তাঁর নামে বরাক উপত্যকাতে একটি জায়গা আছে। আর দিলীপকান্তি নস্করের মাতৃভূমি, বাংলাভাষা মা। সুজিত চৌধুরির ভূমিকা সংবলিত। পি টি এস-এ ছাপা। চমৎকার প্রোডাকশন।

ধীরে ধীরে সব কটি বই-ই পড়বে নমিত। লালন মঞ্চ নামের আরও একটি পত্রিকা ছিল।

যে ছেলেটি বইগুলি এনেছিল, সে বলে গেল সামনের শনিবার আরও অনেক বই মেঘাদার বাড়িতে নমিতকে দেওয়া হবে।

অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদ কাছাড়ের বাঙালিদের বাংলা ভাষা প্রেমকে আদৌ যে ভালো চোখে দেখছেন না সেকথা এইসব নানা পত্রপত্রিকাতে স্পষ্ট। চক্রান্ত চালু আছে। নমিত ভাবছিল যে, এবারে কলকাতাতে ফিরে কলকাতার কবি-সাহিত্যিক, যাঁদের ও চেনে তাঁদের অবহিত করার চেষ্টা করবে। যদি না তাঁরা ইতিমধ্যেই অবহিত থাকেন এ বিষয়ে। কিন্তু তাঁরা কী করবেন, না করবেন সে বিষয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাঁরা তো নিজেদের মান, যশ, পুরস্কার নিয়েই সারাদিন সারামাস সারাবছর ব্যস্ত থাকেন। একচক্ষু হরিণেরই মতন। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশেরই কোনরকম দায়বদ্ধতাই নেই। তাঁদের সময় কোথায় সুদূর বরাক উপত্যকার গর্তে বাস করা মন্দভাগ্য বাঙালিদের কথা ভেবে সময় নষ্ট করবার? পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও কি কিছুমাত্রই করণীয় নেই এই কালো মেঘ অপসারণের ব্যাপারে?

কবি-সাহিত্যিকেরাও তো কলম ধরলে পারেন। A pen is mightier than a sword. এ কথা কে না জানে! কিন্তু কলকাতার কোনো কবি-সাহিত্যিক এসব কথা লিখবেন? অসম সরকার যদি তাঁদের বই অসমে ঢাকা নিষিদ্ধ করে দেন! কাব্য-সাহিত্য চর্চাও তো এখন সম্পূর্ণই এক ধরনের সুযোগসন্ধানী মানুষের কুক্ষিগত হয়ে গেছে। যাঁরা ভেলিগুড়ের ব্যাবসারই মতন কাব্য-সাহিত্যকেও এক ধরনের ব্যাবসা বলে মনে করেন। এইসব বিপজ্জনক Extra curricular activity-তে শামিল হলে ভাতে অথবা মদে হাত পড়বে না!

শিলচরে এসে আর একটা জিনিস দেখে খুবই ভালো লাগছে নমিতের। কলকাতার মতন মদের সংস্কৃতিটা এখনও এখানে এসে জাঁকিয়ে বসেনি। অত্যন্তই আনন্দের কথা সেটা।

নমিত নিজে যে মদ মাঝে-মধ্যে খায় না তা নয়। কলকাতাতে খেত। তবে মদ খাওয়ার মধ্যে কখনো কোনো বাহাদুরি দেখেনি। জীবনে বাহাদুরি করার অনেকই ক্ষেত্র আছে। মদ খাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি আছে বলে কখনোই মনে করেনি ও। বাবার পয়সাতেও কোনোদিনও খায়নি।

তবে শিলচরের মানুষে মদ কম খেলেও অমলবাবু সম্ভবত একাই ভারসাম্য রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছেন। অমলবাবু মানে যাঁর বাড়িতে নমিত পেয়িং গেস্ট আছে। অবশ্য এখানে আর মাস দুয়েক থাকতে হবে।

তাদের কোম্পানি শিলচর, হাইলাকান্দি এবং করিমগঞ্জে নিজেদের জমি কিনে ফেলেছে। বাড়ি তৈরির কাজও শুরু হয়ে গেছে। আগের ম্যানেজার এই বাড়ি তৈরি বাবদে বেশ কিছু টাকা তছরূপ করাতেই তাঁকে অপসারিত করে সেন সাহেব রাতারাতি, প্রায় উইদাউট নোটিশে নমিতকে শিলচরে পাঠিয়েছেন।

নমিত সঙ্গী-সাথির অভাবে এখানে এসে মদ আর খাচ্ছে না। না খেয়ে চমৎকার আছে। শরীরে অনেক স্ফূর্তি অনুভব করছে। ভালো আছে। ভালো থাকতে হবে ওকে। চাকরির ভবিষ্যৎ এবং সরোজার কথাও ভেবে।

কালকে বউদিকে ও একটা চিঠি লিখবে কলকাতাতে সরোজার কথা জানিয়ে। ঠিক করল। বউদি ওর সমবয়েসি। বান্ধবীর মতন। দেওর-বউদির সম্পর্ক মনে হয় জামাইবাবু-শালির সম্পর্কের চেয়েও অনেকই মধুর। যদি সম্পর্কটি স্বার্থগন্ধহীন এবং কামগন্ধহীন রাখা যায়। নমিত ভাগ্যবান এ বাবদে।

.

০৭.

মেঘাদা বাড়িতে আছেন কি না বোঝা গেল না। হয়তো ওঁদের অফিস খোলা। পোস্ট অফিস তো ভোলাই আছে।

ভাবছিল নমিত।

সাইকেল রিকশা থেকে নেমে দুরু দুরু বুকে মেঘাদার বাড়ির দরজাতে দাঁড়িয়ে বেল টিপল। তখন বেলা সাড়ে দশটা হবে।

একটা মেয়ে এসে দরজা খুলল। খুলতেই ভেতর থেকে একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে এল।

ও আমার সোনা। কাঁদে না। কাঁদে না। লক্ষ্মীসোনা। এই তো হয়ে গেল।

কার গলা? সরোজার কি? জানবে কী করে? সরোজার গলা তো চিনে রাখতে পারে এমন করে শোনার সুযোগ হয়নি তার।

সেই কণ্ঠস্বরই বলল, কে রে পিমা?

 একজন ভদ্রলোক। দাদুকে চাইছে।

নাম জিজ্ঞেস করতে পারছিস না? দেখছিস না আমি কী করছি?

 আপনার নাম?

মেয়েটি ফিরে এসে বলল।

 নমিত। নমিত মুখার্জি।

 দরজাটা আধখোলা রেখেই বোকাবোকা দেখতে পিমা নামক মেয়েটি চলে গেল। তার বয়স হবে ন-দশ বছর।

দরজাটা আধখোলা ছিল বলেই সরোজা বলতে পারল না যে দেখা করবে না। আবার নমিতকে বাইরে দাঁড় করিয়েও রাখতে পারল না। অগত্যা সরোজা বলল, ভেতরে নিয়ে আয় বাবুকে। বসতে বল। চেয়ার এগিয়ে দে। কবে যে এসব শিখবি! সত্যি! আমার হয়ে গেল বলে।

 নমিত ভেতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বোকার মতন বলল, মেঘাদা নেই?

দু-হাঁটু জোড়া করে মাটিতে বসে সরোজা সামনে একটি প্লাস্টিকের লালরঙা গামলাতে মাস তিন-চারেকের একটি উলঙ্গ পুরুষ শিশুকে সাবান দিয়ে চান করাচ্ছিল।

সরোজা বলল, জেঠু যে নেই তা বুঝি আপনি জানতেন না? আজ তো ওঁর অফিস ছুটি নেই।

ও! না। আমি জানতাম না। আমার অফিস তো ছুটি। তাই ভেবেছিলাম হয়তো ওঁর অফিসও…..

হয়তো আবার কী? আপনি তো জেঠুর কাছে আসেননি।

তবে কা-কাকার কাছে?

দারুণ সপ্রতিভ নমিত অপ্রতিভ হয়ে বলল।

 আমার কাছেই এসেছেন। কিন্তু তাতে অপরাধের তো কিছু হয়নি।

 একটি হলুদ আর কালো জংলা কাজের একটি কটকি-শাড়ি পরেছিল সে। বাঁ-পায়ের পাতার কাছে কালো শায়ার আভাস দেখা যাচ্ছিল। হলুদরঙা একটি হ্যাঁণ্ডলুম-এর ব্লাউজ। কপালের ওপরে চুল এসে পড়েছে। দু-হাতে শিশুটিকে তুলে ধরে সরোজা ওর মুখে চোখ না রেখেই বলল, বসুন। আমার হয়ে যাবে এখুনি।

কথা না বলে, নমিত বসল একটি চেয়ারে। বাইরে থেকে জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছিল ঘরে। চেয়ারটা যেখানে পাতা ছিল সেখানেই সেদিন মেঝেতে বসেছিল দুর্বিনয়। বুঝল যে, শনিবার সব চেয়ারটেয়ার সরিয়ে মেঝেতেই শতরঞ্চি পাতা হয়। শুধুমাত্র মেঘাদার ইজিচেয়ারটা পাতা থাকে।

সরোজা পাশে রাখা ভোয়ালে তুলে নিয়ে শিশুটির আপাদমস্তক ভালো করে মুছল। সরোজা যখন দুটি হাত উঁচু করল তখন নমিত দেখল তার বগলতলি ঘামে ভিজে গেছে। দেখামাত্রই নমিতের সারাশরীরে বিদ্যুৎচমকের মতন শিহরন খেলে গেল।

চমকে উঠল সে নিজের অব্যক্ত অভব্যতাতে। ভাবল, আজ অবধি তো কত অসমবয়েসি নারীশরীর দেখেছে, তাদের ব্লাউজ-ঢাকা বগলতলিতে চোখও পড়েছে কিন্তু কখনও তো এমন অস্বস্তি বোধ করেনি সারাশরীরে। কী যে হল নমিতের! এই রোগের চেয়ে তো যেকোনো অন্য রোগ ভালো ছিল। ওলাওঠা, জণ্ডিস, সাংঘাতিক বিলিরুবিনের, কিন্তু এ রোগ কী রোগ?

সোজা বলল, বসুন আপনি, আমি আসছি। বলে, ভেতরে গেল শিশুটিকে নিয়ে।

একটু পরে পিমার কোলে জামাকাপড় পরিয়ে, পাউডার মাখিয়ে, কপালে কাজলের টিপ পরিয়ে বাচ্চাটিকে নিয়ে এসে দরজা খুলে পিমাকে বলল, সাবধানে যাবি। ফেলে যদি দিস তো তোর হবে। তুই যে একটা একনম্বরের টেকি। আর বউদিকে বলবি যে, সন্ধেবেলা যাব।

আমি কি এক্ষুনি ফিরে আসব দিদি, না মাকে একবার দেখে আসব? জ্বর বাড়ল কি না কে জানে!

দেখেই আয়। তবে খুব দেরি করিস না। ওষুধটা ঠিক সময়মতো খাচ্ছে কি না দেখিস। বার্লির টাকাটা নিয়েছিস তো? নাকি ড্রেসিং টেবিলের ওপরেই ফেলে এলি?

পিমা বলল, না না, নিয়েছি।

পিমা চলে গেলে নমিত বলল, ওকে ছেড়ে দিলেন। বাড়িতে তো আর কেউই নেই।

না। কেন একথা? কেউ নেই মানে? আমি তো আছি।

আপনাকে পাহারা দেবার তো কেউই রইল না।

কেন? আপনিই তো রইলেন। তা ছাড়া আমি তো একাই একশো।

ও।

বোকার মতো বলল, নমিত।

তারপরই বলল, কিন্তু আমার লোভকে কে পাহারা দেবে?

আপনার লোভকে? কীসের লোভ? যে লোভই হোক কোনোই চিন্তা নেই। আমি পাহারা দেব।

হেসে বলল, সরোজা।

হাসলে যে কী সুন্দর লাগে তাকে!

ভাবল, নমিত।

পরক্ষণেই বল নিজেকে খুব। কী যে হয়ে গেল ওর। কিতা যে অইল! হায়! হায়!

আপনি এত লাজুক কেন? লজ্জা তো মেয়েদেরই ভূষণ।

আমাকে তো সকলেই খুব স্মার্ট, আউট-স্পোকেন বলেই জানে।

হয়তো। কিন্তু রবিবারে, সাদা অ্যাম্বাসাডরে করে এসে জেঠু নেই শুনেই পালিয়ে গেলেন কেন ভয়ে পালিয়েই যদি যাবেন তবে এলেনই বা কেন?

নমিত মুখ নীচু করে একটু চুপ করে থেকে বলল, সেই তো হচ্ছে কথা। তা কি আমি নিজেই জানি!

কী?

এই কেনই বা এলাম আর কেনই বা পালিয়ে গেলাম।

তারপরই বলল, আমি নাই বা এলাম, দুর্বিনয় তো এসেছিল রবিবারে। আসেনি?

ঝরনার মতন হেসে উঠল সরোজা। তার চুল আবারও এসে পড়ল তার কপালে, গালে।

খুব ইচ্ছে করল নমিতের যে, নিজের দু-হাত দিয়ে যতনভরে সরিয়ে দেয় সেই কেশভার সরোজার কপাল আর মুখ থেকে।

সরোজা হাসতে হাসতে বলল, আপনি সত্যিই ছেলেমানুষ। দুর্বিনয়ের সঙ্গে আমার কী? ও তো একটা দুধের শিশু।

ও কিন্তু আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে। শিশু যেমন মাকে ভালোবাসে হয়তো তেমন করেই। শিশুর কাছে মা যেমন আগল-খোলা তেমন তো অন্য কারও কাছেই নন!

কী করে জানলেন?

কী?

যে দুর্বিনয় আমাকে ভালোবাসে।

প্রথমদিনই যে বুঝেছি। আপনি যে আমার গান ভালো বললেন তাতে ও কী ভীষণ রেগে গেল! ওর মুখচোখের ভাবই কেমন বদলে গেল তা কি আর আমি লক্ষ করিনি!

তাই? তাতে কী হল? কত মানুষই তো কত মানুষকে অসম্ভব ভালোবাসে। সংসারে ক জনের ভালোবাসা পরিণতি পায়? কত পার্সেন্টের? কারওকে একতরফা ভালবাসলেই তো আর হল না, অন্য পক্ষের ভালোবাসাও তো পেতে হবে।

দুর্বিনয়ের মতন চমৎকার ছেলেকে ভালোবাসেন না আপনি?

অবাক হয়ে বলল, নমিত।

ভীষণ ভালো লাগে ওকে। হয়তো ভালোবাসি। কিন্তু ছোটো ভায়ের মতন। ভালো লাগা আর ভালোবাসা কি এক? ভালো, জীবনে এক-দুজনকেই বাসা যায়। ভালোবাসা বড়ো কষ্টের নমিতবাবু। কারওকে ভালো না বাসাই ভালো। আপনি কি কখনো ভালোবেসেছেন কারওকে?

নমিত চুপ করে রইল।

সরোজা বলল, যাক। এইসব দুঃখকষ্টর প্রসঙ্গ এখন থাক। আপনি এসেছেন। আপনাকে জনারণ্যের মধ্যে তো পাওয়া যাবেই, সেদিন যেমন পাওয়া গেছিল, এমন একার করে তো রোজ রোজ পাওয়া যাবে না।

 তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, কী খাবেন বলুন?

কিছু না।

তা কী হয়? জেঠু শুনলে রাগ করবেন।

আপনি যা-কিছুই করেন বা করেন না, সবই কি আপনার জেঠুরই জন্যে?

মিথ্যে বলব না আপনাকে। সব না। জেঠুকে সব কথা বলিও না। সবকিছুই জেঠুর জন্যে করিও না।

জীবনে সত্যকে পছন্দ করে অনেক মানুষই কিন্তু সত্য ছাড়া মিথ্যা কখনও একটিও বলে না এমন কেউই কি আছে?

জানি না। তবে যা দোষের নয়, যা পাপের নয়, তারমধ্যে লুকোনোর কী থাকতে পারে? আপনি তো আমার পাপ নন, অন্ধকার নন, আপনি যে আমার মস্ত পুণ্য, আমার আলো।

বাঃ।

কী বা:?

 আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন। নিজে একটু-আধটু কবিতা লিখি, জেঠুর কল্যাণে এত কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে মিশি, একটু গুছিয়ে কথাও যদি বলতে না পারি তাহলে আর কী করলাম!

অধিকাংশ কবিরা চমৎকার কথা বলতে পারেন মনে মনে, নিজের সঙ্গে নিজে, একা একা অথবা কলম হাতে, সাদা খাতার সঙ্গে। কিন্তু কথা আপনার মতন গুছিয়ে একমাত্র উকিল ব্যারিস্টারেরাই বলতে পারেন। যাঁদের মধ্যে অনেকের কথাই শুধু কথারই কথা অবশ্য। এবং যাঁদের অধিকাংশ কথাই যে সত্যি নয় সেকথা তাঁরা নিজেরাও জানেন।

তাই কি?

তাই নয়? ভালো কথা বলতে পারা ওই উকিল-ব্যারিস্টারেরাই তো দেশটাকে ডোবাল। সেই শুরু হয়েছিল জিন্না আর গ্রেট জওহরলাল নেহরু দিয়ে। আজ অবধিও তার জের চলছে।

আপনি একটু বসুন। আমি একগ্লাস শরবত করে নিয়ে আসি। নাকি, চা খাবেন?

আপনার কি ধারণা হয়েছে যে, এই ছুটির দিনে সকালে মেঘাদার অনুপস্থিতিতে আপনার কাছে আমি চা কিংবা শরবত খেতেই এসেছি?

 না। তা নয়। হয়তো অন্য অনেক কিছুই খেতে এসেছেন। আজকে মাংস হয়েছে। খেয়ে যাবেন? গন্ধরাজ লেবু আছে। কড়কড়ে করে আলু ভাজা। মুসুর ডাল। কাঁচালঙ্কা আর কালোজিরে সমবার দেওয়া। খাবেন?

না:।

 বেশ। তাহলে এই বসলাম আপনার সামনে। খোলসা করে বলুন তো কেন আপনি এসেছেন? আর কেনই বা গত রবিবারে এসেছিলেন? জেঠুর সঙ্গেই দরকার তো আজ অবধি জেঠুকে তা বলেননি কেন যে, রবিবারে এসেছিলেন সকালে।

কী করে জানলেন আপনি?

কী?

যে বলিনি আমি মেঘাদাকে?

 জেতু কি তাহলে বলতেন না আমাকে? সাতকথা শুনিয়ে দিতেন। বলতেন, অসভ্য হয়েছ। কেন বসালে না? কেন চা খাওয়ালে না? জেঠুকে আপনি মোটেই বলেননি। তার মানে, জেঠুর কাছে আসেননি আপনি আদৌ সেদিন।

না।

 কী না?

আসিনি।

 তবে? আমার কাছে এসেছিলেন?

হ্যাঁ।

কেন?

নমিত কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইল সরোজার চোখে।

 বাইরে ঘুঘু ডাকছিল, বুলবুলি, দাঁড়কাক ডাকছিল চ্যাগারের ওপরে বসে। একটি সাইকেল রিকশা প্যাঁক প্যাঁক করে চলে যাচ্ছিল, যেন কোনো রাজহাঁস। পাশের বাড়ির রেডিয়োতে কণিকা ব্যানার্জির গান বাজছিল দূরে কোথায়, দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে। নমিতের মনে হচ্ছিল ওর জানা স্যাটেলাইট আর কম্পিউটারের জগৎ যেন হঠাৎ স্থির হয়ে গেছে। আর কোনোদিনও নড়বে না। স্থবির একেবারে। আর কোনোই দৌড়াদৌড়ি নেই ওর বাইরের জগতে। ভেতরে জগতে তো নেই-ই। ও এইরকম কোনো ঘুঘু আর বুলবুলি-ডাকা, হাওয়াতে গাছগাছালির ছায়া-নড়া জগতেরই বাসিন্দা হতে চেয়েছিল শিশুকাল থেকে, যখন মায়ের কোলে শুয়ে রূপকথার গল্প শুনত, যখন কিণ্ডারগার্টেন স্কুলের নার্সারি ক্লাসে পড়ত তখন থেকেই, যে জগতে জাগতিক অভাব আছে, অপূর্ণতা আছে হয়তো অনেকই কিন্তু অভাববোধ নেই, খাই-খাই নেই, দীর্ঘশ্বাস নেই, যেখানে মাদুর পেতে বসে সরোজার মতন কোনো নারী তার খুব কাছে বসে রবীন্দ্রনাথের গান গায়, অনেক দিয়েছ নাথ, আমা? অনেক দিয়েছ নাথ।

সরোজা বলল, আপনি কিন্তু জবাবটা দিলেন না।

কোন কথার?

কেন এসেছিলেন আমার কাছে?

নমিত ওর দু-চোখে দু-চোখ রেখে বলল, খুব ভালো লেগে গেছে আপনাকে। জানেন, বলেই, কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল।

বাঃ।

মুগ্ধতার সঙ্গে বলল, সরোজা।

বাঃ কেন?

এমন শুদ্ধ পবিত্র প্রেমের কথা আজকালকার কম ছেলে-মেয়েই বোধ হয় ভাবতে পারে! প্রেম বলতে তো আজকাল সকলেই শুধু শরীরটা বোঝে।

কী জানি!

নমিত বলল।

 তারপর বলল, প্রেম কি কোনোদিনও শরীরে ছিল? শরীর অনেকই সময়ে প্রেমের অনুগামী হয়তো হয়, কখনো কখনো। অবচেতনে হয়তো শরীরের কামনা থাকেই, হয়তো তীব্র হয়েই থাকে, কিন্তু তা বলে শরীরটা তো আগে নয়।

কখনোই নয়। আগে আলাপ, তারপরে তো তান, বিস্তার, ঝালা।

 বলেই বলল, আপনাকে আমারও খুব ভালো লেগেছিল। আমিও সারারাত ঘুমোতে পারিনি সে প্রথম রাতে। কী বোকা-বোকা, না? এই বয়েসে!

আমি জানতাম।

অবাক হয়ে বলল সরোজা, কী করে?

জানতাম। আমি এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবছিলাম যে, সে আমার কথা সেইমুহূর্তে যদি নাই ভাবে তবে আমার সব কষ্ট পাওয়াই তো বৃথা।

তাই?

 বলেই, আবারও ঝরনার মতন হেসে উঠল সরোজা। আবারও তার ঘনকালো কেশভার কপালে গালে ভেঙে পড়ল। আবারও খুব ইচ্ছে করল নমিতের যে, নিজের দুটি হাত দিয়ে পরমযত্নে সরোজার চুলের গোছ সরিয়ে দেয়।

একদৃষ্টিতে, বোবা মুগ্ধতাতে চেয়েছিল নমিত সরোজার চোখে।

কী দেখছেন?

আপনার চোখে একটু চুমু খাব?

 ইচ্ছে হলে খান। পারমিশান নেবার কী আছে? আমাদের দেশের শাস্ত্রে চোখে চুমু খাওয়া তো অপরাধের মধ্যে গণ্য নয়। কী মূর্খ মানুষগুলো! চোখই যে মানুষের মনের আয়না, শরীরের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রবেশদ্বার, এই সহজ কথাটা গবেটগুলোর মাথাতে কেন যে আসেনি, কে জানে!

 নমিত চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে সরোজার কাছে নীচু হয়ে ওর দু-হাত দিয়ে কপাল থেকে চুল সরিয়ে দু-চোখের পাতার ওপরে চুমু খেল। মুখে শব্দ করে।

চোখ বুজে ফেলল সরোজা।

বলল, উ-উ-উ-উম।

পরক্ষণেই উঠে পড়ে বলল, আমি একটু আসছি।

 ওকে দেখে নমিতের মনে হল, সরোজার বুঝি জ্বর হয়েছে।

মনে পড়ে গেল ওর, কোথায় যেন কবে পড়েছিল যে, মানুষের জ্বরের অনেকরকম হয়। তারমধ্যে একটা রকমের নাম কামজ্বর।

একটু পরে সরোজা ফিরে এল। এসে বসল আবার নমিতের সামনের চেয়ারে।

শরীর খারাপ লাগছে?

না।

তবে?

-আপনি অত্যন্ত বিপজ্জনক পুরুষমানুষ।

কেন?

কারও চোখের চুমুতেই কোনো নারীর হৃদয় গলে যায়, শরীর গলে যায় এমন কোনো বিপজ্জনক পুরুষের কথা তো কোনো গল্প-উপন্যাসেও পড়িনি।

পুরুষ মাত্রই বিপজ্জনক। তা ছাড়া আগামী দিনের কোনো কবি-সাহিত্যিক হয়তো লিখবেনও আমার কথা। কে বলতে পারে! সাহিত্য তো অ্যাকাউন্ট্যাসি নয়, যে, একটা ডেবিট হলে একটা ক্রেডিট হবে এমন নিয়ম তাকে মেনে চলতেই হবে। সাহিত্য বারোমেসে ফুলের গাছ। তার ফুল ফোঁটার কি বিরাম আছে কোন?

আপনার নামটিও খুব সুন্দর। কিন্তু মানে কী? পরদিন অনেক অভিধান ঘাঁটলাম। তাও পেলাম না। ভেবেছিলাম দুর্বিনয়কে বলব, মানে জেনে আসতে।

কেন, ওকেই কেন? অন্য কারওকে নয় কেন?

নমিত হাসিমুখে বলল।

বা: রে! ও যে আমার উত্তীয়। আমি চাইলে ও স্বর্গ থেকে পারিজাত ফুল নিয়ে আসতে পারে, দিনের আকাশে ও সার সার তারা ফুটিয়ে দিতে পারে। শুধু আমার চাইবারই অপেক্ষা।

তাই?

 হ্যাঁ।

অথচ আপনিই ওকে ভালোবাসেন না। হাউ ক্রুয়েল!

–না। শুধু আমিই নই। কালে কালে, যুগে যুগে, শ্যামারা কোনোদিনও উত্তীয়দের ভালোবাসেনি। ভালোবেসেছে বজ্রসেনদেরই।

ভেরি মিন অফ ইউ। কিন্তু কেন?

 কী জানি! আমরা হয়তো ওরকমই। যারা সব সমর্পণ করে আমাদের পায়ে তাদেরই আমরা আমাদের ক্রীড়নক করি। যারা আমাদের উপেক্ষা করে, তাদের জন্যেই ঘর ছাড়ি। তাদের পায়ে আছড়ে পড়ি। হায়! এ কী সমাপন!

এক আকাশ আলোভরা সকালবেলা এগারোটাতে কারও চোখে চুমু খাওয়াটা কি সর্বস্ব সমর্পণের মধ্যে গণ্য হবে?

নমিত বলল।

আবারও ঝরনার মতন হেসে উঠল সরোজা।

বলল, আপনি সত্যিই খুব ভালো কথা বলেন। তবে গানটা গান আরও ভালো। আজ একটা গান শোনাবেন? শোনাবেন তো?

শনিবার শোনালে হবে না?

না।

আদুরে গলাতে বলল সরোজা।

কেন না? না কেন?

সে গান তো সকলের গান হয়ে যাবে।

এ গান হবে আমারই একার, নিজস্ব। একা ঘরে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে, চানঘরে চান করতে করতে, আমি আমার সেই একলার গানের কথা মনে করব। সেই গানের সুর আর কথা চিরুনির আঁচড়ের মতন, আদুরে পোষা কুকুরির কামড়ের মতন আমার স্নায়ুতন্ত্রীতে ঝনঝন করে উঠবে, সাবানের ফেনার মতন আমার সর্বাঙ্গে বুদবুদ তুলবে, সে গান কারও সঙ্গেই ভাগ করে নিতে হবে না আমাকে।

নমিত চুপ করে রইল।

ভাবছিল, কারও মুখের কথাও যে, শৃঙ্গারের চরম হতে পারে একথা এর আগে কখনোই জানত না। মুখের কথাও যে, সুরভিত উদ্যানের মতন হতে পারে, তা সত্যিই জানা ছিল না ওর।

বললেন না, আপনার নামের মানে?

সরোজা আবারও বলল।

আমার নামের মানে, নম্রতা। নমিত।

আর কারও কি আছে এই নাম? কখনো শুনিনি।

 আমি তো আর কেউ নই। আমি যে আমিই! একমেবাদ্বিতীয়ম।

তারপর বলল, তবে আমার জ্ঞাতসারে এই নাম আর একজনেরও আছে।

কার?

 পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী শ্রীযোগেশ বর্মনের সেক্রেটারির।

তাই? কী করে জানলেন? চেনেন বুঝি?

চিনি মানে, একদিন ফোন করেছিলেন একটা প্রয়োজনে উনি। আমি যখন ওঁকে বললাম, বললেন, যাক আর একজন নমিত পাওয়া গেল তাহলে।

উনি বললেন, খুব সাবধানে থাকবেন।

কেন?

আমি শুধালাম।

নমিত বলল।

উনি বললেন, একজন ঔপন্যাসিক আমার নাম শুনে বলেছেন যে, কোনো উপন্যাসের নায়কের নাম দেবেন উনি নমিত।

তাই?

নমিত বলল।

 বাঃ। ভালোই হল। নায়ক যদি পছন্দের না হয় তবে সেই নমিত আমি বলে চালিয়ে দিতে পারেন আত্মীয়-পরিচিতদের কাছে।

হেসে উঠল সরোজা। নমিতও।

নমিত বলল, আপনার নামটিও খুবই আনকমন। সরোজা। শুনিনি কখনো।

আমার মতন যারা সাধারণ, তাদের বাবা-মায়েরা অনেক ভেবেচিন্তে হয়তো আমাদের নাম দেন তাদের সাধারণত্বের গ্লানি লাঘব করতে।

সে কথা তো আমার সম্বন্ধেও বলা যেতে পারে। এবারে মানেটা বলুন।

 সরোজা মানে, সরসীতে যার জন্ম। পদ্ম।

 বাঃ। সরোজিনী নামটি শোনা যায়। সরোজ তো শোনা যায়ই। কিন্তু সরোজা ভারি আনকমন নাম।

যাই বলুন, তা বলে পুরুষেরও পদ্ম নাম হলে কেমন কানাছেলের নাম পদ্মলোচন মনে হয়। হয় না?

সরোজা বলল।

 সরোজার কথাতে দুজনেই আবারও হেসে উঠল একই সঙ্গে।

 একটা গান শোনান না। হুট করে কে চলে আসবে।

কে?

 পিমা আসতে পারে, দুর্বিনয় আসতে পারে। কী যে জ্বালায় না আমাকে ছেলেটা! যখন তখন ঘামাচির মতন কবিতা জন্মাবে তার মাথাতে আর দৌড়ে আসবে সাইকেলে চড়ে। শোনো শোনো সরোজাদি। তোমাকে নিয়ে এখনই কবিতা লিখেছি।

বাঃ। তবে তো গর্বিত হওয়ারই কথা আপনার!

মোটেই নয়।

কেন নয়?

কারণ, ওর কবিতার মধ্যে খুব কম কবিতাই কবিতা-পদবাচ্য হয়।

বাঃ। এই কথা তো বড়ো-ছোটো যেকোনো কবির বেলাতেই প্রযোজ্য। কবিরা যেসব কবিতা লিখে গোল্লা পাকিয়ে ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে ফেলে দেন সেগুলো জড়ো করা গেলে তা রি-সাইক্লিং করে একটা বড়ো পেপারমিল চালানো যেত।

কাটাকুটি বা ছেঁড়াঘেঁড়ি না করলে কেউ কি কবি হতে পারেন? বাতিল করার মধ্যেই তো সব সৃষ্টির বীজের উন্মেষ নিহিত থাকে। Failures are the Pillars of Success. এই কষ্টটাই তো সৃষ্টির আনন্দ। ছবি ছিঁড়ে ফেলা, কবিতা গোল্লা পাকিয়ে ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে ফেলে দেওয়া, গান তোলার পরও সংযমী হয়ে যতক্ষণ না পারফেক্ট রেণ্ডিশান হচ্ছে ততক্ষণ সে গান যতই ইচ্ছা করুক তবুও না-গাওয়া, এইসব কষ্টরই তো আর এক নাম সৃষ্টিশীলতার আনন্দ।

তা হবে। কিন্তু আমার তো প্রাণ যায়। তা ছাড়া ওকে কত বলি যে, তুই তোর সব কবিতাই বা আমাকে নিয়েই লিখবি কেন? আমি কি মাধুরী দীক্ষিত? কিছু কবিতা বানরী বা ঘোটকী বা কুকুরি বা অন্য প্রজাতির কোনো স্ত্রীলিঙ্গকে নিয়ে লেখ। না, তা নয়। সে শুধু আমাকে নিয়েই লিখবে। একদিন সরোজাকে নিয়ে লেখা ওর সব কবিতা আমি কোনো সরসীতেই নিক্ষেপ করে দেব। দেখবেন আপনি।

কোন সরসীতে?

মানে?

 যৌবন সরসীও তো আছে।

বাজে কথা রাখুন।

 দুর্বিনয়কে তা বলে বলবেন না যেন সেসব কথা। আহত হবে।

না। তা জানি। ও যেমন পাগল। হয়তো আত্মহত্যাই করে বসল। আর পুলিশে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে গেল। যেসব কবিতা আমাকে সে দিয়েছে কম করে তার দশগুণ তো তার বাড়িতে আছে।

ওর বাড়িতে কে কে আছেন?

 কেউই নেই। শুধু ওর বিধবা মা। দুর্বিনয়ের বাবা খুবই অল্প বয়সে মারা যান। ওদের দু তিনটে চা বাগান ছিল। ওর জেঠুরা মিলে সব ঠকিয়ে নিয়ে নেন। ওর তখন দু-বছর বয়েস।

মায়ের বাড়িতে কেউ মুরুব্বি ছিলেন না?

ছিলেন। শুনেছি ওর নিজের বড়োমামাই মোটা টাকা খেয়ে জাল উইলের এগজিকিউটর হয়ে ওদের সর্বনাশ মসৃণ করেন।

এরকমও হয়!

এরকমই তো বেশি হয় নমিতবাবু। সংসার তো এইরকমই।

নমিতবাবুর বাবুটা কর্তন করলে হত না? বাবু তো আমি কোনোকালেই ছিলাম না।

 থাক না।

কেন? থাকবে কেন?

 প্রথমত, শুনতে ভালো লাগে। দ্বিতীয়ত, বাধা হিসেবে থাক। দূরত্ব হিসেবে থাক। দুর্গমতার প্রতীক হিসেবে থাক। যে পথে বাধা নেই, যে পথ সুগম, সেইপথে গন্তব্যে পৌঁছানোর মধ্যে কোনোই আভিজাত্য নেই।

তাহলে শুধু বাবু কেন? আগেকার দিনে যেমন বলা হত, শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু এমন কিছু বললে হয় না?

সরোজা হেসে বলল, না। আমার পক্ষে বাবুই যথেষ্ট।

আর আমি কী বলে ডাকব? আপনাকে?

মনে মনে পেঁচি, খেদি, কুঁচি, কেলি যা খুশি তাই বলেই ডাকবেন। বাইরে সরোজাই বলবেন। সরোজা বলেই তো আমার পরিচিত আত্মীয়রা সকলেই ডাকেন। আজকের মতন একান্তে দেখা হলেই শুধু আমাকে অন্য কোনো নামে ডাকতে পারেন। শুধু আমিই জানব সেই নামটা। অভিজাত কোনো নাম।

যদি আয়েষা বলে ডাকি? বেশ অনেক যুগ পিছিয়েও যাওয়া হবে বঙ্কিমবাবুর কাছে। আর নামটি অভিজাতও হবে।

বেশ নাম।

 তবে আয়েষাই থাক।

তা থাক। তবে আয়েষা নিজে কতদিন থাকে তা কে বলতে পারে।

মানে?

মানে নেই। সব কথার মানে খুঁজতে নেই। আমি ভাবছি, আপনাকে আমি আলপিন বলে ডাকব।

খুব জোরে হেসে উঠল নমিত।

 বলল, জন্মজিবুর কবিতাটি কিন্তু অসাধারণ। আসলে আলপিন নয়, তোমার চেরা।

মানুষটিও মজার। এ বাড়িতেই আলাপ হয়ে যাবে কখনও। হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, লালা, কত জায়গা থেকেই যে কবি, চিত্রী, গায়কেরা আসেন আমাদের বাড়িতে, জেঠুকে সকলেই ভালবাসেন। এই পৃথিবীতে স্বার্থহীন ভালোবাসা বাসার মানুষ যে বড়োই কমে এসেছে। এই শনিবার অনেক তরুণী আসবে। আসতে ভুলবেন না যেন আপনি। আপনার জন্যেই বিশেষ ভিড় হবে। তাদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে এই আলপিন হয়তো আপনাকে খোঁচা দেবে না আর।

তারপরে একটু চুপ করে থেকে বলল, সত্যি! আপনিও দুর্বিনয়ের মতন ছেলেমানুষ। বড়ো হড়বড়িয়া আপনি। একি তাসের দান যে, ফস-স করে ফেলে দিলেন। অন্যদের কার হাতে কী আছে বোঝার চেষ্টা করুন একটু। প্রয়োজনে শাফলিং-এর সময় জোচ্চুরি করুন। জীবিকাতে জোচ্চুরি করছে যখন শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষ তখন জীবনেও না হয় করলেন একটু-আধটু।

জীবনে যারা জোচ্চুরি করে তারা জীবন চাপা পড়ে মারা যায়।

 নমিত বলল।

জীবিকার জোচ্চোরেরাও মারা যায়। তবে পরের প্রজন্মের হাতে। দৌড়টা অনেক লম্বা। হাজার হাজার মিটারের দৌড় তো। অনেক ল্যাপ দৌড়োতে হয়। সাদা চোখে বোঝা যায় না, এই যা।

এবারে আমি উঠব।

 কেন? তাড়া কীসের? কেউ কি বসে থাকবে আপনার জন্যে? জেঠুর কাছে শুনেছি আপনি পেয়িংগেস্ট আছেন এক জায়গাতে। জেঠু বলেছিলেন আপনার গৃহস্বামিনী নাকি…

কী?

না। সে জেঠুর কাছেই শুনবেন। খেয়েই যান। এখানে খেয়ে যান।

না।

কেন? বার বার না বলছেন কেন?

একদিনে এত সুখ সইবে না। আস্তে আস্তে সওয়াতে হবে।

তাই?

 হ্যাঁ।

 কিন্তু আমাকে গান না শোনালে যেতে দেব না।

বেশ। একটা গানের কথা শনিবার থেকে কেবল-ই মনে হচ্ছিল।

কার গান?

এটাও নিধুবাবুর।

বেশ। শোনান। তার আগে আমি দৌড়ে গিয়ে এককাপ চা করে নিয়ে আসছি। এককাপ চা খেয়ে, গলা ভিজিয়ে তারপরেই গানটা শোনান। এতক্ষণ রইলেন, কিছু খেলেন না।

কেন? চোখে যে চুমু খেলাম।

সেটা তো ফাঁকি।

আমি তো পূর্ণতা বলেই জানলাম।

সরোজা ভেতরে যাওয়ার একটু পরেই বাইরের ভেজিয়ে রাখা দরজাটা কে যেন জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলল। শব্দ করে উঠল পাল্লা দুটো।

পাশ ফিরে তাকাল নমিত।

দেখল দুর্বিনয়। দুর্বিনয়ের মুখে, বলা বাহুল্য, বিনয় ছিল না। সে নমিতের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ভালো?

হ্যাঁ।

কতক্ষণ?

অনেকক্ষণ।

 কী করতে?

আপনি যা করতে।

মানে?

কবিতা শোনাতে এবং …

এবংটা কী?

 কবিতার রসদ সংগ্রহ করতে।

 তাই?

চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, দুর্বিনয়।

 ক-টা কবিতা শোনালেন?

সুযোগ পেলাম কই?

 কেন? বললেন যে অনেকক্ষণ এসেছেন।

আপনি অনেকক্ষণ বলতে কতক্ষণ বোঝেন তা আমি কী করে বুঝব!

ও।

আসলে সরোজা সর্বক্ষণই তো আপনার কথাই বলে গেলেন। আমার কথা বলি বা দুটি। কবিতা শোনাই তার সুযোগ আর পেলাম কোথায়?

বাজে কথা বলছেন।

সত্যি বলছি। বাজে কথা বলে আমার লাভ?

সত্যি?

সত্যি

দুর্বিনয়ের মুখচোখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ভারি সুন্দর চেহারা দুর্বিনয়ের। চেহারার মধ্যে এক বিশেষ আভিজাত্যর ছাপও আছে। ওর মুখে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল নমিত। সরোজার যাকে ভালো লাগে, সে কি খারাপ হতে পারে!

দুর্বিনয় বলল, সরোজাদি আসার আগে আমি কি কবিতা শুনতে পারি না একটা দুটো? আপনার?

পারবেন। শনিবার। আজ নয়। সব কবিতা তো সকলের জন্যে নয়ও। এত বোঝেন আর এটুকু বোঝেন না?

তা ঠিক।

আপনি আপনার সরোজাদির এত ভক্ত কেন?

নমিত বলল।

বলব?

বলুন।

এমন মেয়েলি মেয়ে আমি আর দেখিনি।

বাঃ। আপনি কবির মতনই বললেন কথাটা। মেয়েলি মেয়ে। ভারি সুন্দর করে বললেন।

 আপনার গানের কথা শিলচর শহরের সবাই জেনে গেছেন।

দুর্বিনয় বলল।

 তাই? তবে তো বিপদ হল।

বিপদের মধ্যেই তো সম্পদ থাকে।

আপনি বয়েসে তরুণ, সুদর্শন, বড়ো চাকরি করেন, কবিতা লেখেন, কবিতা পড়েন, তার ওপরে এমন গানও গান। তাই এই শনিবারে শিলচর শহরের তরুণীরা মেঘাদার বাড়ি রেইড করবেন।

তবেই তো সর্বনাশ। বিপদ তেমন বেশি সংখ্যাতে এলে তারমধ্যে থেকে সম্পদ কি বাছা সম্ভব হবে?

হবে হবে। এমন এমন সব মহিলা আসবেন যে, দেখবেন তাঁদের কাছে আপনার সরোজাকেও বাঁদি বলে মনে হবে।

তাই? আমি নিজে তো বান্দা। আমার বাঁদিই ভালো লাগে। আপনার মতো রাজপুত্র তো আমি নই যে, স্বয়ংবরসভায় নিমন্ত্রণ পাব।

কী বলেন! আপনার জন্যে স্বয়ংস্ত্রী সভা হবে।

এমন করে বলবেন না। শিলচর শহর এবং তার রমণীকুল সম্বন্ধে এই ক-দিনে আমার যে ধারণা হয়েছে তা অতিউচ্চ। আপনার কথাতে আমি কিছুই মনে করিনি। কিন্তু বোকা লোকে এর কদর্য অর্থ করতে পারে। শিলচরের মেয়েদের কি বিয়ে করা ছাড়া আর অন্য কোনো কাজ নেই? আমার তো ওঁদের অত্যন্ত গুণী, অন্তর্মুখী এবং আত্মসম্মান জ্ঞান-সম্পন্না বলেই মনে হয়েছে। ওঁরা অত্যন্ত শালীন এবং সভ্যও। কলকাতার অনেক তরুণীদের মতন ফাজিল নন আদৌ।

এরা তো একটু কনসার্ভেটিভ।

দুর্বিনয় বলল।

যাঁদের কনসার্ভ করার কিছু থাকে তাঁরাই কনসার্ভেটিভ হন।

তাই? বাঃ। বেশ বলেছেন তো কথাটা।

 নমিতের মনে হল, দুর্বিনয়ের শৈত্য একটু একটু করে গলছে। অবশ্য তা গলাবার জন্যেই সে তাপের সৃষ্টি করেছিল। নমিতকে দুর্বিনয় হয়তো আর এনিমি নাম্বার ওয়ান বলে ভাবছে না।

দুর্বিনয় বলল, আপনার গানের কিন্তু তুলনা নেই। দিনে কতক্ষণ রিওয়াজ করেন?

মাসে এক-দু-দিন, বাথরুমে।

বাজে কথা।

রিওয়াজ অন্যভাবে হয়। সপ্তাহে ছোটোবোনের সঙ্গে সকালে অন্তত দু-দিন ঝগড়া করি একেবারে তারাতে। তাতেই যা রিওয়াজ হয়। দু-জনেরই।

বোন কী গান গান?

 রবীন্দ্রসংগীত।

দুর্বিনয় হেসে বলল, বাজে কথা।

কী?

ঝগড়াটাই রিওয়াজ।

 মারি-বিস্কিট আর চা নিয়ে ঢুকল সরোজা।

দুর্বিনয়ের দিকে চেয়ে বলল, কী রে! কখন এলি? তাই গলা পাচ্ছিলাম ভেতর থেকে। ভাবছিলাম কে হতে পারে এই অসময়ে। তুই ছাড়া আর কে হতে পারে!

আমার গলাটা না হয় নমিতবাবুর মতো সুন্দর নয় কিন্তু তা বলে তুমি আমার গলাটা চিনতেই পারলে না, এ খবরে আমি আদৌ খুশি হলাম না কিন্তু।

তো কী করা যাবে!

সরোজা বলল।

নমিত বুঝতে পারল যে, নমিতের সামনে সরোজা দুর্বিনয়ের সঙ্গে ফর্মাল হচ্ছে। বুঝে, দুঃখ পেল। উঠে দাঁড়িয়ে সরোজাকে বলল, দুর্বিনয় সাইকেল চালিয়ে এসেছে। তেষ্টাটা ওরই বেশি পাওয়ার কথা। চা-টা ওকেই দিন। আমি আজ উঠি।

 সে কী! একজনের জন্যের জিনিস অন্যজনকে দেব কেন? আর দিলেই বা সে তা নেবে

সরোজা বলল।

 নমিত বলল, এই কেনর কোনো উত্তর হয়তো নেই কিন্তু সকলেরই জীবনে জীবনময় অনুক্ষণ এমনটিই ঘটছে। একজনের জন্যে যা সংরক্ষিত তা অন্যজনে পাচ্ছে। অথবা পেতে চাইছে। এই নিরবধি বহমান প্রবাহকে আপনি ঠেকাবেন কী করে! সত্যিই উঠব আমি।

সরোজা আহত যতটা হল, রেগে গেল তার চেয়ে বেশি। বলল, সত্যিই খাবেন না? চা?

না।

কঠিন স্বরে বলল নমিত।

 কেন স্বরে কাঠিন্য লাগল ও নিজেই বুঝল না। কিন্তু লাগল।

 চায়ের ট্রেতে হাতে দাঁড়িয়ে থেকেই সরোজা বলল, নমিতবাবু, আপনার বয়েস কত?

বয়েস কি বয়েসে হয় সরোজা দেবী?

তবে? কীসে হয়?

অভিজ্ঞতায়।

বাঃ। ঠিক বলেছেন স্যার। এই কথাটাই তো আমি সরোজাদিকে বোঝাতে পারি না। কত ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করি। রাইট ইউ আর। বয়েস বয়েসে হয় না। হয়, অভিজ্ঞতায়।

বলেই, সরোজার দিকে ফিরে বলল, দেখলে সরোজাদি।

সরোজা বলল, তুমি চুপ করো দুর্বিনয়। আমি ব্যস্ত আছি। চান করতে যাব। রান্নাও বাকি আছে একটু। শিউলি বউদির বাচ্চাটাকে চান করাতে এনেছিলাম।

কেন? উনি নেই?

 থাকবেন না কেন?

তবে?

আমার ভালো লাগে, তাই।

ওঃ।

চায়ের ট্রে-টা সেন্টার টেবলে নামিয়ে রেখে সরোজা নমিতের দিকে ঘুরে বলল, তাহলে? ঠিক আছে। খাবেনই না যখন, তখন

বলেই দরজা বন্ধ করার জন্যে দরজার দিকে এগোল।

দুর্বিনয় অবিশ্বাসের গলাতে বলল, আমিও যাব? এখুনি? সত্যিসত্যি?

কী মুশকিল! আমার কি চান-খাওয়া নেই? তোমার কবিতা শোনানোর মানুষ কি একমাত্র আমিই? পাগল করে দেবে তুমি আমাকে!

আহত হল দুর্বিনয়। বিশেষ করে নমিতের সামনে অমন রূঢ় কথা বলাতে। বড়ো হোক, ছোটো হোক, তরুণ হোক কি প্রাচীন হোক, কবিমাত্রই জানেন তাঁর কবিতাকে অপমান করলে বুকে কেমন বাজে। কবিতার মান-অপমান যে ব্যক্তির মান-অপমানের চেয়েও অনেকই বড়ো, অনেকই অন্যরকম!

এই শনিবার আসছেন তো নমিতবাবু?

দুর্বিনয় বলল, নমিতের সঙ্গে দরজার দিকে যেতে যেতে।

 বলতে পারিছি না।

সেকী? কেন?

এই শনিবার কিন্তু আমি থাকব না বাড়িতে দুর্বিনয়। জেঠুর এক বন্ধুর মেয়ের বিয়ের প্রথম বার্ষিকী শনিবার। আমাকে সেখানে যেতেই হবে।

সরোজা বলল।

বাঃ। তুমি না থাকলে কী করে হবে?

দুর্বিনয় শিশুর মতন বলল।

হবে। তোমাদের মিলনির আমি কে? তা ছাড়া, আমি কি চিরদিনই তোমাদের ঝি-গিরিই করব? আমার নিজস্বতা বলতে কি কিছুই নেই?

নমিত এসবের মধ্যে একটিও কথা বলল না। দু-হাত জড়ো করে নমস্কার করে বলল, চললাম। ভালো থাকবেন। আমার ওপরে রাগ করবেন না।

কেন? রাগ করব কেন? কী কারণে?

উষ্মার সঙ্গে বলল সরোজা।

শুধুমাত্র যথার্থ কারণেই যদি সবসময় রাগ করতেন বা অন্য কেউও করত, সংসারে তবে আর দুঃখ ছিল কী?

বলেই, দরজা দিয়ে বাইরে এল ও।

দুর্বিনয় বলল, একটা রিকশা পাঠিয়ে দেব মোড় থেকে?

 না, না, আমি ধরে নেব।

 তাহলে চলুন মোড় অবধি আমিও হেঁটে যাই আপনার সঙ্গে।

কোনো উত্তর দিল না নমিত।

 বলল, আজ তোমার ছুটি? তোমাকে তুমিই বলছি। তুমি অনেকই ছোটো।

 হ্যাঁ। হ্যাঁ। তাই তো বলবেন। আমরা সকলেই আপনার অ্যাডমায়ারার হয়ে গেছি গান তোমার আজকে ছুটি?

আমার কোনোদিনই ছুটি নেই।

 কী করো তুমি দুর্বিনয়?

 আমার একটা ছোট্ট দোকান আছে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রী বলতে পারেন। দুজন ছেলে আছে। হেল্পার। মালিক আমিই।

তুমি কি ইলেকট্রিকাল এঞ্জিনিয়ার?

ইঞ্জিনিয়ার-টিঞ্জিনিয়র নই। ডিপ্লোমা নিয়েছিলাম একটা। স্কুল ফাইনালের পরে আর পড়াশুনো করতে পারলাম কই? মাকে খাওয়াতে তো হবে। আমার ইতিহাস বলব আপনাকে একদিন।

দুঃখের ইতিহাস? বঞ্চনার ইতিহাস তো?

ঠিক ধরেছেন। কী করে বুঝলেন?

না। আমি শুনব না। তুমি কারওকেই ওসব বোলো না।

 অবাক হয়ে চলা-থামিয়ে ও বলল, কেন বলুন তো? একথা কেন বলছেন?

যাঁদের তুমি এসব কথা আজ অবধি বলেছ তাঁদের মধ্যে কেউই কি তোমার জন্যে কিছুমাত্র করেছেন?

না। তা করেননি।

তবে নিজেকে ছোটো করবে কেন? এই সমাজে নিজস্বার্থ ছাড়া কেউ কারও জন্যে কিছুই করে না। অন্যের বিপদে বড়ো আনন্দ হয় যে অধিকাংশ মানুষের। তোমার দুরবস্থা যাতে প্রলম্বিত হয়, তাই চায় মনে মনে প্রত্যেকে।

কেন?

তোমার অসুবিধে না থাকলে, দুঃখ না থাকলে তাদের তুমি সেসব কথা বলবেই না তো আর! কুকুরকে বিশ্বাস করে এল সবকিছু, পথের গোরু-ছাগলকেও। কিন্তু মানুষকে কখনো বোলো না। ডাঁটে থাকবে কলার তুলে। যতই কষ্ট থাক। এরা সব শক্তের ভক্ত নরমের যম। এরা কেউই তোমার হিতার্থী নয়।

 সত্যি! ঠিকই বলেছেন। এমন করে আমাকে কেউ বলেনি।

তোমার দোকানটা কোথায় দুর্বিনয়?

 চার্চ রোড-এ।

কোথায় কোথায় কাজ করো? মানে, তোমার কাস্টমার কারা?

যেখানেই পাই। যে আসে তার কাজই করি। বাড়ির ওয়্যারিং-এর কাজ পেলে তো হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, লালা, উধারবন্ধ, কোথায় না চলে যাই! প্রফিট ভালো থাকে তো তাতে! আর শহরের মধ্যে তো কোনো জায়গাই বাদ নেই। মালুগ্রাম, শ্রীমাপুরী, তারাপুর, চার্চরোড, অম্বিকাপট্টি, গুরুচরণ কলেজের এদিক-ওদিক। যে ডাকে, তার ডাকেই সাড়া দিই।

তোমার পার্মামেন্ট ক্লায়েন্ট নেই কোনো?

না। পার্মানেন্ট থাকবে কী করে। প্রয়োজন হলেই না ডাকবে।

তা কেন? মাস মাইনে দিয়েও রাখতে পারে। মেটেরিয়াল সাপ্লাই করবে তারা। তোমার লেবারের জন্যে একটা বাঁধা টাকা দেবেন ওঁরা প্রতিমাসে।

তাই? হয় নাকি এমন?

হয় বই কী? তোমার কার্ড আছে?

হাঃ। আমার আবার কার্ড। একটা টাইপ করে সাইক্লোসটাইল করে নিয়েছিলাম। ছিল তো একটা মানিব্যাগে। কাজে তো লাগে না। দাঁড়ান দেখি।

বলে, দাঁড়িয়ে পড়ে, ম্যানিব্যাগ থেকে বের করল একটা কুঁকড়ে-যাওয়া কাগজ। দিল, নমিতকে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা মোড়ে পোঁছোল।

 রিকশা ডাকল একটা দুর্বিনয় নমিতের জন্যে।

নমিত বলল, তাও ভালো যে ভালো লাগে না বলেনি রিকশাওয়ালা।

হেসে ফেলল দুর্বিনয়। বলল, হ্যাঁ এই আমাদের একদোষ। ভালো লাগে না শিখে গেছেন আপনি?

রিকশাতে উঠতে উঠতে নমিত বলল, নিজের ব্যাবসার সময়ে কবিতা লিখো না। কবিতার জন্যে আলাদা সময় বের করে নেবে। যারা বলে, ব্যাবসা করে বা চাকরি করে বা পেশায় থেকে কবিতা লেখা যায় না, তারা বাজে কথা বলে। সবকিছু করেও সবকিছু করা যায়। সময়ের আর তোমার ইন্টারেস্টের ঘরগুলোকে ভাগ করে নিতে হবে। যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না?

কী করে? মানে, ভাগ করব কী করে?

 তোমাকে শিখিয়ে দেব। এই নাও আমার একটা কার্ড। কোনো টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে একদিন এসো।

কোথায়?

অফিসে বা বাড়িতে যেখানে খুশি। কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসবে। বাড়িতে আমার ফোন নেই। ফোনটা অফিসেই কোরো। অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে এলে দেখা করব না। তবে এ বাড়ি শিগগিরই ছেড়ে দেব। নতুন বাড়িতে ফোন থাকবে।

বেশ।

বলেই দুর্বিনয়, সাইকেলে উঠে বাঁ-দিকের পথে চলে গেল, হাত তুলে বিদায় নিয়ে।

রিকশায় যেতে যেতে নমিতের গায়ে হাওয়া লাগছিল। বসন্ত আসবে আসবে করছে। ভোরের দিকে হাওয়া ছাড়ে একটা। কোকিল ডাকে মাঝরাত থেকে পাগলের মতন।

বেশ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল নমিত। কেন যে আসার আগে সরোজাকে কষ্ট দিয়ে এল। যাকে ভালোবাসে তাকে কি কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায় ও? বউদি একথা প্রায়ই বলে। বলে, তোমার অদ্ভুত স্বভাব নমিত। আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি খুব আনন্দ পাও, না? তুমি একজন Sadist.

নমিত ভাবে যে, সে নিজেই জানে যে, নিজে কত কষ্ট পায় সেই অন্যদের কী করে বোঝাবে! জানে না। ও বড়োই কমপ্লিকেটেড। নিজেকেই বোঝে না নিজে তায় অন্যকে বোঝাবে কী করে। সরোজা যদি সত্যিই না থাকে শনিবারে তবে মেঘাদার বাড়িতে ও যাবেই না। ওর মনে হল, শুধু ও কেন? একথা জানতে পারলে আগে, অনেকেই হয়তো আসবে না।

.

০৮.

 কাল রাতে একটা নাটক দেখতে নিয়ে গেছিল হিমাশিস ভট্টাচার্য এবং দেবাশিস দাস। ভারি ভালো ছেলে ওরা।

হিমাশিস থাকে সুভাষনগরে আর দেবাশিসের বাড়ি নরসিংতলাতে। এরা দুজনেই খুবই সাহিত্যমনস্ক! এদের সঙ্গে নমিতের আলাপ হয়েছিল বুধবারে শ্রীপ্রভাস সেন মজুমদারের বাড়িতে। উনি শিলচরের ডাকসাইটে উকিল। নমিতদের কোম্পানির একটা পেটেন্ট-এর মামলা নিয়ে তাঁর কাছে যেতে হয়েছিল নমিতকে। ভালোই হয়েছিল। নমিত জানত না যে, বরাক উপত্যকা সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রভাসবাবুই।

একজন চিত্রীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ওখানেই। নাম মৈনুদ্দিন চৌধুরি। উনি ওই সম্মেলন উপলক্ষেই এসেছিলেন শিলং থেকে। বাড়ি যদিও শিলচরেই। খুব ইন্টারেস্টিং মানুষ। শিলং-এ গিয়ে ওঁর স্টুডিয়ো দেখার নিমন্ত্রণ করলেন।

শহিদ দিবস দেখতে এসেছিল এক নবীন দম্পতি। নাম অনুপ আর অরুন্ধতী সেন। অনুপ শিলচরের দূরদর্শন কেন্দ্রতে আছে। চমৎকার ছেলে।

সঞ্জীব আবার গান-পাগল। নিজেও গায়ক। নমিত গান গেয়েছিল তা মিলনির কারও মুখে শুনেছিল সে। আগেই নাটক দেখতে গিয়ে আলাপ হয়ে গেল।

.

ওদের বারে বারেই বলল নমিত যে, ওদের ভাষাতেই ওর সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু ওরা শুধু হাসে। আর ক-দিন এখানে থাকলেই ভাষাটা শিখে নেবে নমিত। নমিত তা জানে। সব ভাষারই উচ্চারণ এবং টানটোনই হচ্ছে আসল। কান না থাকলে ভাষা শেখা যায় না। গানও যখন কান দিয়েই শিখেছে, গানের ব্যাকরণ গুলে শেখেনি, তখন এই কাছাড়ি ভাষা বা সিলেটি ভাষাও অবশ্যই শিখতে পারবে। সব ব্যাকরণের প্রতিই নমিতের এক তীব্র অসূয়া আছে। হয়তো ও সর্বার্থেই অশিক্ষিত বলেই।

ওর কলকাতার বন্ধু ডিনা মালহোত্রা বলত, The easiest way to learn a language is to fall in love with a girl who speaks the language.

নমিতও হেসে বলত, For love making, body language is the only universal language which has no language barrier, very much like instrumental music.

তাতে ডিনা হেসে উঠে ওর পিঠে চাপড় মেরে বলত, ইউ আর আ জিনিয়াস-কি বাচ্চা। আর কথাটার ওপর জোর দিয়ে বলত। কলকাতা ছেড়ে এসেছে বলেই কলকাতার নানা টুকরো-টাকরা কথা মনে পড়ে মাঝে মাঝেই।

শহিদ দিবস নাটকটা স্থানীয় উপভাষাতেই লেখা। লিখেছেন বিশ্বজিৎ চৌধুরি। তিনি একটি ছোটো চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। পেশাতে নাকি ভদ্রলোক এঞ্জিনিয়ার। চমৎকার নাটক। এত অল্প খরচেও যে কোনো নাটক মঞ্চস্থ করা যায় তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। কলকাতার প্রযোজক-নির্দেশকদের উচিত শিলচরে এসে ওইসব নাটক দেখা।

ভাষা আন্দোলনের জন্যে শহিদ যিনি হলেন তাঁর বিধবাই না খেয়ে থাকেন আর শহিদ দিবসে সেই প্রখ্যাত শহিদকে নিয়েই রাজনীতিকদের, পাড়ার মাস্তানদের কী লীলা খেলা! Pointless নাটক নয়। অত্যন্ত বাস্তববাদী meaningful নাটক। অভিনয়ও প্রত্যেকেরই চমৎকার। বিশেষ করে যে মহিলা মৃত শহিদের স্ত্রীর ভূমিকাতে অভিনয় করেছেন এবং মৃত শহিদের একসময়ের বন্ধু, কুম্ভীরাশ্রু ফেলা ধূর্ত স্বার্থপর রাজনীতিক নেতার ভূমিকাতে যে ভদ্রলোক অভিনয় করেছেন তিনিও অনবদ্য। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম মনে করে রাখেনি। অথচ রাখাটা উচিত ছিল।

স্থানীয় উপভাষায় লেখা আরও নাটক দেখার ইচ্ছের কথা বলল নমিত হিমাশিসদের। ওরা বলল দেখাবে। এও বলল যে, নসিব নামের একটা নাটক এই উপভাষাতে রচিত প্রথম নাটক। শ্রীঅনন্ত দেব নাকি ওটি লেখেন। উনিশশো আশিতে তা প্রথমবার মঞ্চস্থ হয়। এ ছাড়াও শকুনর ছাও, ধর্মনগরের ড. নাথের লেখা, দেবব্রত চৌধুরির কুঠার, চিত্রভানু ভৌমিকের যাইতাস কই, আইজও আন্দাইর, লালমোহনের সংসার এবং তীর্থংকর দত্তর লেখা উত্তরাধিকার ইত্যাদি। বরাক উপত্যকাতে এই উপভাষাতে লেখা নাটক সম্বন্ধে। নাটকের দলগুলি এবং দর্শকদের বিশেষ উৎসাহ দেখা যাচ্ছে নাকি সাম্প্রতিক অতীত থেকে।

দেখা যাওয়ারই কথা। ভাবছিল নমিত। এই উপভাষার ওপর পুরো দখল না-থাকা সত্ত্বেও তার বুঝতে খুব একটা অসুবিধে তো হল না! এই ভাষা ভারি মিষ্টি এবং আন্তরিক। অবশ্যই শিখবে সে। এবং শিখতে পারলে সরোজাকে একদিন এই ভাষা অনর্গল বলে চমকে দেবে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হল। তার কারণও ছিল। নাটকের পরে হিমাশিসরা সকলেই যে যার মতন চলে গেল। নমিতাদের কোম্পানির এক বড়ো ডিস্ট্রিবিউটর মি. বরজাতিয়া এসে হল থেকেই তাকে নিয়ে গেছিলেন তাঁর হোটেলে। গৌহাটি থেকে এসেছেন তিনি তিনদিনের জন্যে।

অনেকদিন পরে হুইস্কি খেল নমিত। বেশ বেশিই খেল। তারপর তিনিই তাঁর প্রাইভেট ট্যাক্সিতে নমিতকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

বরজাতিয়া সাহেব বললেন, বাংলাদেশ থেকে স্মাগলড হয়ে-আসা হুইস্কি। জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেল।

নমিতের মনে হয় স্কটল্যাণ্ডের ওই কোম্পানি যত বোতল হুইস্কি না তৈরি করেন তার চেয়ে বেশি বোতল শুধুমাত্র বম্বেতেই বোধ হয় বিক্রি হয়। এই সব স্মাগলড স্কচ খাওয়ার চেয়ে চুল্লু খাওয়াও ভালো। নমিতের মস্তিষ্কের, হয়তো পায়ের ভারসাম্য একেবারেই হারিয়ে গেছে।

ওর একতলার ফ্ল্যাটে একটা বড়ো বসার ঘর, শোয়ার ঘর, অ্যাটাচড বাথরুম। বসার ঘরের লাগোয়া একটি চওড়া বারান্দা। বাগানের দিকে মুখ করা। গ্রিল দিয়ে ঘেরা। সেদিক দিয়েও তালা খুলে ঢোকা যায়। বসবার ঘরে এবং শোয়ার ঘরেও চাবি দিকে লক করা যায়। একটি চাবি আছে বাড়িওয়ালা অমলবাবুর কাছে। ওর কাছে ডুপ্লিকেটটা।

আজ নমিতও অমলবাবু হয়ে গেছে। বেশ ভালো নেশা হয়েছে বুঝতে পারছে। বার বারান্দা দিয়ে না ঢুকে সে ভেতর বারান্দা দিয়েই ঢুকে পড়ল। এদিক দিয়েও ঢোকা যায়। অথচ কোনোদিনও ঢোকে না। কিন্তু চাবিটা পকেট থেকে বের করে বার বার ঘুরিয়েও দরজাটা খুলতে পারল না। চোখে ভালো দেখতেও পাচ্ছিল না। কেবলই নমিতের ওর বউদির কথা আর সরোজার কথা মনে পড়ছিল। মাথাটা ভার হয়ে আছে।

এমন সময়ে, আধো-অন্ধকারের মধ্যে কে যেন ওকে নরম হাতে সরিয়ে দিয়ে চাবিটা খুলে দিল। সে বোধ হয় একতলাতেই ছিল। অথবা গাড়ির শব্দ শুনে দোতলা থেকে নেমে এসেছিল? কিন্তু কে? তারপর ওকে প্রায় বুকে জড়িয়ে এনে বিছানাতে শুইয়ে দিল সে। শুইয়ে দিল না বলে, বলা ভালো যে ফেলল। তারপরে সে-ই নমিতের জুতো-জামা সব খোলাল। এমনকী গেঞ্জি এবং ভেতরের ব্রিফও।

খুবই ঘুম পাচ্ছিল নমিতের। কী ঘটতে যাচ্ছে অথবা কে তা ঘটাচ্ছে তা বুঝতে পারছিল না ও। বোঝবার ইচ্ছেও ছিল না। অনভ্যস্ত কোনো চুলের তেলের আর পাউডারের গন্ধ তার নাকে আসছিল। মেয়েলি ঘামের অচেনা গন্ধ। এখন তো তেমন গরম নেই। তবু ঘাম? নরম, খুব নরম বুকের পরশ। তার ঠোঁটের ওপরে চেপে-ধরা নরম কামুক ঠোঁটের চাপ? আর তার ঊরুসন্ধিতে ঘন ঘন বিস্ফোরণ। কারা ঘটাচ্ছে? উল্কা নাকি? ঝুনু চৌধুরিদের চা বাগানেও কি ULFA রা আক্রমণ করবে? খুন করবে নমিতকে? কিন্তু সে তো প্রাণদায়িনী ওষুধেরই ব্যাপারী। এইসব প্রাণঘাতিনী প্রক্রিয়া কে বা কারা করছে তার ওপরে? আর করছেই বা কেন? তাজ্জব কি বাত!

এখন, তার খাটের ওপরে, তার শরীরের ভেতরে যে ভূমিকম্প উঠেছিল, রিখটার স্কেলে কেউ কি মাপল? কে মাপল?

তা থেমে গেছে। লাভা উৎক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। নানা ধাতব ছাই উড়ে উড়ে পড়েছে। চারপাশে। তবে সাদা। ট্যালকম পাউডার।

কে এত পাউডার মাখে কে জানে! নাকি কোনো ময়দা-কলের মালিক?

নমিতের বউদি বলে, বেশি পাউডার মাখলে স্কিন নষ্ট হয়ে যায়। বউদি তুহিনা মাখে। হাতে, পায়ে, মুখে। ভারি মিষ্টি গন্ধ। আর স্নান করার আগে অলিভ অয়েল। ইটালিয়ান। সারাবছর। ভারি মসৃণ চামড়া বউদির। সরোজা কী মাখে কে জানে!

তার যখন ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছিল, মানে, নমিতের অনেকই সেবা করেছিল বউদি। খুবই কাছে থাকত তখন। ওডিকোলন-জলের পটি দিত। তাকে জড়িয়ে ধরে থাকত। বউদি খুব ভালো। শালীন। মণিপুরের লকটাক হ্রদের মতো শান্ত স্থির। যেখানে ফুমডির ওপরে নাচুনে হরিণরা খেলা করে। হ্রদ নিজে স্থির থাকে। হ্রদ সুন্দর, সুগন্ধি, শান্ত। | কিন্তু এই সাদা-রঙা ভূমিকম্পটা কোথা থেকে এল, তারপর কোথায় যেন চলে গেল। নমিত আধো-জ্ঞানে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ।

 বাগানে পেঁচা-পেঁচানি উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ঝগড়া করছিল। বাগান থেকে মিশ্ৰফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। দূরের হাইওয়ে দিয়ে একটা ওভারলোডেড ট্রাক কঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। মোড়ে পৌঁছে তারপর বাঁক নিল তারাপুরের দিকে। তারপরই সব নিস্তব্ধ। রাতে শুনশান। তারপরেই নমিতের বালব ফেড-আউট করে গেল। আর কিছুই মনে ছিল না।

সকালে ঘুম যখন ভাঙল, তখন অনেকই বেলা। ও বেল দিলে তবে চা দিয়ে যায় কাজের ছেলেটি। বেল দিল একসময়ে। ছেলেটি আসবে। তার নাম হারু। চা দিতে এল। সঙ্গে মুড়ি আর দু-কোয়া বড়ো রসুন। রোজ খায় নমিত। দাদার দেখাদেখি।

বেল দেওয়ার আগেই আতঙ্কিত চোখে মেঝেতে ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে থাকা সব একবার দেখে নিয়েই জামা-কাপড়-গেঞ্জি-মোজা-ব্রিফ সব ওয়াড্রোবে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। তারপর রাতের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে নিয়ে দরজাটা খুলে দিল চাবি ঘুরিয়ে। আশ্চর্য! সকালে তালা কোনোরকম আপত্তি করল না। তালাদের মানসিকতা বোঝা দায়। রাতে এই তালাগুলো, সব শালা তালা, অদ্ভুতভাবে বিহেভ করে। আলো ফুটলেই লক্ষ্মীসোনা। যাচ্ছেতাই!

চা এল। চা খেল। এও একটা অভ্যেস। এই অভ্যেসই মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু।

কিন্তু কাল রাতে কী হয়েছিল?

 এইজন্যেই হয়তো নমিতের বাবা বলতেন, মদ খুবই খারাপ জিনিস। মদ কখনো ছোঁবে না। এমনিতে তেমন ছোঁয়ও না। তবে কলকাতায় কবি-সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধবেরা আবার মদ না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাদের কবিতা বেরোয় না। খিচুড়ি দিয়ে রাম, পার্শে মাছ আর আলুপোস্ত দিয়ে জিন, পাঁঠার চাট-এর সঙ্গে হুইস্কি এইসবই আঁতেলপনারই একটা বিকাশ। থুড়ি, পেকাশ।

নমিত স্নান করল ভালো করে। তারপর অফিসের জামাকাপড় পরে যখন ব্রেকফাস্ট খেতে গেল খাবার ঘরে, দেখল বউদি। মানে অমলবাবুর স্ত্রী। কাল রাতে তিনি ছাড়া আর কে ছিল একতলাতে?

বললেন, শরীর খারাপ?

নমিত বলল, না তো! মুখ না তুলেই বলল।

তার গলাতে গভীর বিরক্তি ঝরল।

 কাল কোথায় গেছিলেন রাতে?

কাজ ছিল।

কিছু চুরি গেছে কি আপনার? কাল রাতে?

চুরি? নাঃ। জানি না।

গেছে।

কী?

পরে জানতে পাবেন।

অমলদা নেই বাড়িতে?

না। তিনদিনের জন্যে গতকাল আইজল-এ গেছেন।

ও।

তারপর অমলবাবুর স্ত্রী বললেন, আজ আপনি কখন ফিরবেন অফিস থেকে? আমি আনিয়ে রাখব। আপনার দাদা যা খান। ঘরেই সব মজুত থাকতে পথে-বিপথে ঘোরা কেন? নাকি অন্য কোনো ব্র্যাণ্ড খান আপনি? দাদা খান রয়্যাল চ্যালেঞ্জ।

আপনাদের বাড়ি যেন কোথায়? সুলসুলি না কোথায় যেন? অমলদা প্রতিরাতেই যে জায়গার নাম করে নামতা পড়েন সে জায়গা কোথায়? বরাকভ্যালির কোনদিকে?

 সে জায়গা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতে। আমাদের বাড়ি ডায়মগুহাবড়ার কাছে।

ইশ। অশিক্ষিত। অশিক্ষিত। আটারলি অশিক্ষিত। আটরলি বাটারলি অশিক্ষিত। ভাবল নমিত।

ও ভাবল, অশিক্ষিত আর শিক্ষিত নারীর শরীর কি আলাদারকম হয়?

তারপর ভাবল, না :! শরীর তো পৃথিবীর সব নারীরই একইরকম। কিন্তু সেই শরীরের সাজ, তার ক্রিয়া-বিক্রিয়া, তার চাওয়া-পাওয়া সবই অন্যরকম। শুধু নারীর শরীর কেন? পুরুষের শরীরেরও। দুজনেই তো মানুষ। শুধু দু-রকমের মানুষ।

দুটো ডিম-এর ওয়াটার-পোচ আর চারটে টোস্ট নিয়ে এল হারু। জ্যাম, জেলি এবং মাখনের পাত্র। গোলমরিচ, নুন। একটা আস্ত পেঁয়াজ, দুটি কাঁচালঙ্কা। জেনারাল উইংগেট এরই মতন ও পেঁয়াজ ভক্ত।

উনি এবারে হারুকে বাইরে পাঠালেন। বললেন, যা, বাজারটা করে নিয়ে আয়। যা, যা বলছি। টাকা আর থলিয়া রান্নাঘরের টেবিলের ওপরে রাখা আছে।

হারু চলে গেল থলিয়া নিয়ে। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল।

দুধ খাবেন? কেলেগের সিরিয়াল এনে রেখেছি। নতুন বেরিয়েছে।

নমিত ভাবল যে বলে, বেরিয়েছে অনেকই দিন। ডায়মণ্ডহাবড়ার কাছের সুলসুলিতে পৌঁছোতে হয়তো বহুত দিন লেগে গেছে। ওঃ গশ! ডায়মণ্ড হাবড়া।

তাঁর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নমিত বলল, আমি আর এখানে থাকব না।

 কেন? ভালো লাগেনি?

 চাবি দিয়ে তোক পাঠিয়ে দেব। আমার মালপত্র সব নিয়ে যাবে।

আপনার দাদা আসা অবধিও থাকবেন না?

না।

হঠাৎ মহিলার চোখ দুটো জলে ভরে এল। মুখ নামিয়ে নিলেন। নিজের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলেন ওপরের ঠোঁট দিয়ে। তারপরই শব্দ না করে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।

চোখ তুলে দেখল নমিত। দেখে কিন্তু মনে হল না যে, অভিনয় করছেন মহিলা।

নমিতের ভেতরে কোথায় যে কী ঘটে গেল। ওর সামনে কেউ কাঁদলে ওর বুকের ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। কিন্তু কত রক্ত ঝরাবে ও! পৃথিবীতে কাঁদে এমন মানুষই তো বেশি। চারদিকেই তো কান্নাই। হাসে আর ক-জন? তাও অতিসামান্য কান্নাই দেখা যায়, বেশিটাই দেখা যায় না হিমবাহর মতন। চোখের আড়ালেই থাকে।

তারপরই উনি কাছের একটি চেয়ারে এসে বসে বললেন, আমি জীবনে এত সুখী কখনো হইনি।

তারপর একটু চুপ করে থেকে অত্যন্ত দ্বিধার সঙ্গে বললেন, আপনার কোনো কলঙ্ক লাগবে না। মানে, বিপদ হবে না। আমার লাইগেশান করানো আছে।

তারপর আবারো থেমে বললেন, আমি ভারি দুঃখী নমিতবাবু। আমি ভিখারি। মানুষ অপরিচিত ভিখারিকেও ভিক্ষা দেয়। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি তো আর কারও কাছেই ভিক্ষা চাইনি এপর্যন্ত। অসহ্য হয়েছিল। আর কী বলব। বড়ো লজ্জা করে।

তারপরেই নমিতকে একেবারে চমকে দিয়ে সেই সামান্য শিক্ষিতা, টিভির পোকা, শুধুমাত্র সিনেমা-ম্যাগাজিনপড়া মহিলা বললেন, মানুষ মনের প্রেম ছাড়াও যেমন বাঁচে না, শরীরের ভালোবাসা ছাড়াও বাঁচে না। আমার যে দুটোর একটাও নেই নমিতবাবু।

নমিত স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল অমলবাবুর স্ত্রীর ফর্সা গোলগাল একটু মোটা-সোটা মুখের। দিকে। হাতের গড়নও গোলগাল। নমিতের মায়ের হাতের গড়নও ওইরকম ছিল। মহিলার পায়ের গড়ন কি বুকের গড়ন কেমন তা কাল অজ্ঞানাবস্থাতে দেখেনি। তবে ইচ্ছে করলেই আজ সজ্ঞানে দেখতে পারবে। যদি ইচ্ছে করে।

আপনি সম্পূর্ণই মুক্ত। যে ভিখারিনি ভিক্ষা নেয় তার কি কিছুমাত্রও দাবি থাকে সেই দাতার ওপরে? তা ছাড়া আর তো দুটো রাত। ও তো ছেলে-মেয়েদেরও নিয়ে গেছে। আইজল দেখাতে। কাজের মেয়ে দুটোকে আমি ছুটি করে দিয়েছি।

আপনি আইজল দেখেছেন?

না। আপনি?

না।

 আমাকে নিয়ে আপনি একবার যাবেন?

নমিত ভাবল, মহিলার মাথার গোলমাল আছে। নয়তো নিম্ফোম্যানিয়াক।

সবাইকেই নিয়ে গেলেন, আপনাকে নিয়ে গেলেন না কেন অমলবাবু?

আমি কি মানুষ? দোতলার বারান্দায় দাঁড়ের মধ্যে যে চন্দনা পাখিটা আছে তাকে কি কোথাও নিয়ে যায় আপনার অমলবাবু? পুত্রার্থে ভার্ষা। কথাটা শোনেননি? আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। অমলবাবুর একটি উনিশ বছরের রাখন্তি আছে। তার কাছ থেকেই রাত করে ফেরে সপ্তাহে ছ-দিন। তাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে।

বলেন কী

হ্যাঁ।

কিন্তু রাখন্তিটা কী জিনিস?

ওই হল। রাখন্তি, রাখনি, রক্ষিতা, রাঁঢ় কত নামই তো আছে। রাখন্তি বলে, নদে জেলাতে। রাখনি বলে হুগলি জেলাতে। কৃষ্ণের যেমন শত নাম, তাদেরও তো শত লীলা আর শত নাম।

ছেলে-মেয়েরা জানবে না? তাকেও নিয়ে গেলেন কোন আক্কেলে?

ছেলে-মেয়েরা জানলেও কিছু বলবে না।

বলবে না? বলেন কী আপনি?

কেন বলবে? The king can never do any wrong. বাবার নেকনজরে থাকলে তারা কী না পাবে? মা তো রোজগার করে না। আমাকে ওরা ভালোবাসবে কেন? এখনও ছটো আছে বলে একটু যা বাসে। যতই বড়ো হবে ততই বাবাগত প্রাণ হয়ে উঠবে। ওদের বাবা যদি আমাকে সম্মান দিত, একটু ভালোবাসত, তবেই না ওরা বাসত।

একটু চুপ করে থেকে উনি বললেন, আমরা স্ত্রী-স্বাধীনতা, এই সেই নানা কথা পড়ি, কাগজে, টিভিতে দেখি, কিন্তু যতদিন না পশ্চিমি দেশের মেয়েদেরই মতন এদেশের মেয়েরা রোজগার না করছে ততদিন এসব ফাঁকা বুলি। স্ত্রী স্বাধীনতা আছে রাজা-মহারাজাদের ঘরে আর গরিব-গুরবোদের ঘরে। জঙ্গলের আদিবাসীদের মধ্যে। আমরা তো বিনি মাইনের রাখনি।

তারপর বললেন, নমিতবাবু, আপনি মানুষটি বড়ো ভালো। শুধু দেখতেই যে আপনি ভালো তাই নয়। প্রথম যেদিন আপনি এলেন সেইদিন থেকেই আমি মনে মনে আপনার সেবাদাসী।

ছিঃ

 বিরক্ত হয়ে বলল নমিত।

চা-টার তলানিটুকুও উত্তেজনাবশে খেয়ে ফেলে উঠে পড়ল নমিত।

ওকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে অমলবাবুর স্ত্রী বললেন, ফিরে আসবেন তো?

নমিত মুখ না তুলেই বলল, দেখি।

 প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে উনি বললেন, আসবেন না?

ভেবে দেখব। বলে, নমিত বেরিয়ে গেল।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ