সমুদ্রমেখলা – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

০১.

বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশির মধ্যের চারদিকে হাজার মাইল নীলিমার সীমানাঘেরা এই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। তারই মধ্যে একটি ছোট্ট দ্বীপ। ঘন জঙ্গলাবৃত এবং প্রায় এক লক্ষ নারকোল গাছ সংবলিত। দ্বীপের নাম দ্য হর্নেটস নেস্ট। সেই দ্বীপে একা থাকেন আহুক বোস। রবিনসন ক্রুসোর যেমন ফ্রাইডে ছিল আহুক-এরও তেমনি আছে ভীরাপ্পান। জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবই করে। হিন্দি আর ইংরেজির কিছু শব্দ বলতে পারে। তবে পুরোবাক্য নয়। যারা কাজের মানুষ তারা বেশি কথার মানুষ কোনো কালেই হয় না। বেশির ভাগ সময়েই মনোসিলেবল-এই কথা বলে ভীরাপ্পান।

তার মা থাকেন রস-আইল্যাণ্ডে। যখনই আহুক পোর্ট ব্লেয়ারে আসেন, সে তার জলি বোট-এর মতন বোটটিকে আহুকের আউটবোর্ড ইঞ্জিন লাগানো বড়ো বোট-এর পেছনে বেঁধে নিয়ে চলে আসে পোর্ট ব্লেয়ার পর্যন্ত। তার পর নিজের বোট নিয়ে চলে যায় রস আইল্যাণ্ডে। অবশ্য তার বোটেও আউটবোর্ড ইঞ্জিন আছে। তবে কমজোরি। আহুককে পোর্ট ব্লেয়ারে আসতে হয় গড়ে মাসে দু-বার। খাবার-দাবার জিনিসপত্র কিনতে। চিঠিপত্র যদি ক্কচিৎ আসে, তা নিতে। ডিজেল কিনতে। তাঁর ঠিকানা বলতেও বে-আইল্যাণ্ড হোটেল, পোর্ট ব্লেয়ার, আন্দামান আইল্যাণ্ডস। দক্ষিণ ভারতীয় ম্যানেজার বন্ধুস্থানীয়। সব কিছুই যত্ন করে রেখে দেন। তাঁরই প্রযত্নে সব আসে। হেড অফিসের কাগজপত্রও।

ভীরাপ্পানের বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। অবিবাহিত। এবং অত্যন্তই নারীবিদ্বেষী। আহুক এবং ভীরাপ্পানের সামাজিক, আর্থিক, মানসিক এবং শিক্ষাগত তল আদৌ সমান নয় বলেই ওর এই নারীবিদ্বেষের কারণ বিশদভাবে জিজ্ঞেস করেননি ওকে কখনোই আহুক। যদি করতেনও ভাষার দৈন্যর কারণে হয়তো বুঝিয়ে বলতেও পারত না ভীরাপ্পান। নিজে থেকে ভীরাপ্পানও কোনো দিন বলেনি। কোনো কারণ নিশ্চয়ই থেকে থাকবে। কিছু জিনিস, তা গুণই হোক, কি দোষ, প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব করেই রাখতে দেওয়া উচিত।

এইটুকু স্বাধীনতা প্রত্যেক নারী ও পুরুষেরই ন্যায্য বলে মানেন আহুক।

 পালাগুড্ডি ভীরাপ্পানও আহুক সম্বন্ধে সামান্যই জানে। যেমন আহুকও সামান্যই জানেন ভীরাপ্পান সম্বন্ধে। দুজনের মধ্যেই মালিক-কর্মচারী সম্পর্কের বাইরের এই যে কিছু রহস্য আছে, কিছু অজানা তথ্য, না-বলা-কথা, এতে আহুক খুবই স্বস্তি পান। হয়তো ভীরাপ্পানও পায়। নিজস্ব দোষ-গুণেরই মতন প্রত্যেক মানুষেরই কিছু রহস্যও, নিজস্ব করে রাখা অবশ্যই উচিত বলে আহুক মানেন। ওঁদের দুজনের কেউই অন্য জন সম্বন্ধে অত্যধিক কৌতূহল পোষণ করেন না। যেটুকু না জানলে চলে না, সেটুকুই জেনে নেন, নিয়েছেন। তাতেই খুশি দুজনেই।

রবিনসন ক্রুসো এবং ফ্রাইডে।

তবে আহুক পোর্ট ব্লেয়ারে না গেলেও ভীরাপ্পান প্রতি শনিবার ভোরে চলে যায় রস আইল্যাণ্ডে আবার চলে আসে রবিবার বিকেলে। তার বৃদ্ধা অশক্ত মাকে নিয়ে অবশ্যই চার্চ এ যায় সে। নারীবিদ্বেষী হলেও এমন মাতৃভক্ত মানুষ বেশি দেখা যায় না।

ভীরাপ্পান আগামীকাল বিকেলে ফিরে আসবে দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ। মায়ের কাছে দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা হবে রস আইল্যাণ্ড থেকে। আকাশের অবস্থা খারাপ থাকলে বা আবহাওয়া দপ্তর পতাকা ওড়ালে ওর সে-দিন আর আসা হয় না।

 এখানের জীবনে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। ওদের সম্পর্কটাও প্রভু-ভৃত্যর নয়। মালিক-কর্মচারীর হলেও সম্পর্কটা সমান সমান। পশ্চিমি দেশের এইরকম সম্পর্কেরই মতন। আহুকের তরুণী মালকিন চুমকির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটাও অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এবং পারস্পরিক সম্মানের ওপরে বাঁধানো। বাঁধন কিছু যদি বা থাকেও, অদৃশ্য বাঁধন, তাও ফসকা-গেরো। দু পক্ষের একপক্ষ টান মারলেই যাতে খুলে যায়, তেমন করেই বাঁধা।

একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। সেই যে বড়ো টুনা মাছটা, আহুককে ঘুরিয়ে মারছে আজ তিন মাস হল, তার জন্যে আজও প্রথম বিকেলেই তাঁর ক্যাটাম্যারনটি ভাসিয়ে মাঝসমুদ্রে এসে পৌঁছে হুইল-লাগানো বড়ো ছিপটা ফেলে বসে আছেন। এই বোট-এর এঞ্জিনটা মাঝে মাঝেই রক্ষিতাদের মতন বেইমানি করে। মাঝসমুদ্রে এই বেইমানি যেকোনো দিনই প্রাণহানির কারণ হতে পারে। যুবক বয়েসে পাঁচ-দশ মাইল সাঁতরে যাওয়া কিছুই ছিল না তাঁর কাছে কিন্তু যৌবন, এমনকী আহুক বোস-এর যৌবনও চিরস্থায়ী নয়। তখন যা যা পারতেন বা করতেন অবহেলে এখন আর তা পারেন না। পারেন না বলে এবং এই অমোঘ নিয়তিকে মেনে নিতেও পারেন না বলে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি ওঁর এক দুর্মর অভিমান আছে। যৌবন যদি চিরদিন নাই থাকল তবে সে-দান আদৌ দিলেন কেন তিনি? এখন না আছে মনের প্রেম, না শরীরের প্রেম, না যৌবনের দম্ভ। মাঝে মাঝেই এই জীবনকে দুর্বিষহ বলে মনে হয়। নিজের শর্তে না বাঁচলে বেঁচে কী লাভ? তাই আজকাল আত্মহত্যার ইচ্ছেটা কেবলই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

গোলাপি-রঙা নাইলন-এর লাইন আছে বহু লম্বা। বঁড়শি একবার গিললে চব্বিশ ঘণ্টা লাগুক কি আটচল্লিশ ঘণ্টা লাগুক সেই টুনাকে তিনি তুলবেন ঠিকই। ফাতনাটাও মস্ত বড়ো। এক অ্যামেরিকান সাহেব, তাঁর মালকিনের অতিথি হয়ে গত বছর এসেছিলেন এখানে, তিনি উপহার দিয়ে গেছেন। গাঢ় লাল-রঙা ফাতনা। সাহেবরা বলে Float। মাঝে মাঝে কোনো কৌতূহলী বড়ো হাঙর ফাতনাসুন্ধু লাইন কেটে নিয়ে যায়। তার পর কোন রাসভারী ই এন টি ডাক্তারের কাছে যে যায়, তা অবশ্য তাঁর জানা নেই।

বহু বছর সাহেবদের দেশে থাকা সত্ত্বেও এখন সাহেবদের সব কিছুকেই আহুক ত্যাগ করেছেন। ভাষাটাও ভুলতে পারলে সুখী হতেন। কিন্তু সাঁতার বা সাইকেল বা সংগম শেখার মতনই ভাষাও একবার শিখে ফেললে সেই লিপ্ততা ইলিশ মাছের গায়ের গন্ধরই মতন লেগে থাকে স্মৃতির আঙুলে। ছাড়তে চায় না সহজে।

 মাছটা ভারি সেয়ানা। আর মস্ত বড়োও। এত বড়ো মাছ, ভীরাপ্পান বলছিল, এ তল্লাটে কেউ নাকি দেখেইনি। একবার ভীরাপ্পানের নিজের ক্যাটাম্যারনের কাছাকাছি তাকে বাগে পেয়ে, এখানের জারোয়া বা ওঙ্গে উপজাতিরা যেমন করে হারপুন দিয়ে মাছ মারে, তেমনই করে ভীরাপ্পান তার হারপুন ছুঁড়েছিল। দড়ি বাঁধা ছিল হারপুন-এর সঙ্গে। মাছটা ভীরাপ্পানকে ক্যাটাম্যারন থেকে উপড়ে নিয়ে টেনে সমুদ্রের জলের গভীরে চলে গেছিল নীল তিমি মবি ডিক-এর মতন। দড়ি পায়ে জড়িয়ে গিয়ে, জলের নীচে দম বন্ধ হয়ে মারাই যেত ভীরাপ্পান যদি না, ভীরাপ্পানের মান্য সমুদ্রের দেবতা অশাণ্ডিমারু তাকে সময় মতন বাঁচাতেন। কোনোক্রমে সাঁতরে জলের উপরে উঠে এসে তার ক্যাটাম্যারনের কাছে ডুবতে ডুবতে, জল খেতে খেতে, সাঁতরে পৌঁছেছিল ও। ভাগ্যিস সমুদ্রের এই দিকটাতে হাঙর খুব বেশি আসে না। তা ছাড়া, ভীরাপ্পান জলের পোকা। তামিলনাড় তার দেশ বটে কিন্তু সে বড়োই হয়েছে ওড়িশার গঞ্জাম জেলার সমুদ্রপারের তেলুগু জেলেদের এক ছোট্ট গ্রামে। ওর গায়ে সমুদ্রের গন্ধ। এখন যেমন আহুক-এর গায়েও হয়ে গেছে। ওর চোখ দুটো জবাফুলের মতন লাল। সারাশরীরেই ওইরকমের জেল্লা–ফসফরাস-এর জেল্লার মতো। আহুক-এর শরীরও ধীরে ধীরে সেরকম হয়ে উঠছে। তার মধ্যে বিপদ দেখেন তিনি। শরীরকে খাইয়ে দাইয়ে, মশারি টশারি গুঁজে দিয়ে, পাশবালিশ এগিয়ে দিয়ে, ঘুম পাড়িয়েই এসেছিলেন উনি। হর্নেটস নেস্ট এর এই সামুদ্রিক প্রকৃতি এই অবেলাতে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে শরীরের। মাঝরাতে খিদে পাচ্ছে তাঁর। কী যে দেন খেতে! শরীর তো ব্রাজিলের পিরানহা মাছ নয় যে, নিজের প্রজাতিকে নিজে খেয়ে সুখী হবে। বড়োই বিপদে পড়েছেন। শরীরের কাঁকড়াগুলো সমুদ্রতটের লাল কাঁকড়াদের মতো যৌবনের ঢেউ সরে যেতেই বালির মধ্যে অগণ্য গর্তে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছিল। এখন যৌবনের ঢেউ সরে যাওয়ার পরে তারা এই সামুদ্রিক এবং প্রাকৃতিক অভিঘাতে আবারও বেরিয়ে পড়েছে। ইতিউতি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। যৌবন চলে গেছে ভরা কোটালের মতো দুই-পার ভাসিয়ে নিয়ে কিন্তু তার যন্ত্রণাকে প্রাণ দিয়েছে এই প্রকৃতি। বড়োই বিপদ তাঁর।

এখন গাছপালা, এই দ্বীপ এবং সমুদ্রই তাঁর জীবন। তাঁর মরণও হবে একদিন।

ভীরাপ্পানও স্থির বিশ্বাসে, ভারি গলাতে বলে সেকথা প্রায়ই। যদিও সে যুবকই। ফাতনাটা ঢেউয়ে দোলে। বিকেলের সমুদ্র কত কথা যে বলে, না-বলে ফাতনাটার সঙ্গে, আহুকের সঙ্গে! যাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমুদ্রের উপরে এমনি করে কাজে বা অকাজে বসে না থেকেছেন, তাঁদের পক্ষে এই নিরুক্ত সামুদ্রিক নীল-সবুজ কথার স্বরূপ জানা সম্ভব নয়।

 টুনা মাছটাও কথা বলে আহুকের সঙ্গে। দূরে ভেসে উঠে ঝলকে-ঝলকে পলকে পলকে দেখে আহুককে। তবে রোজ নয়, কোনো কোনো দিন। দুজনের মধ্যে সুখ-দুখের কথা হয়। এসব কথার খোঁজ সব মানুষে রাখে না। যা পাখি জানে, সমুদ্র জানে, মাছ জানে, তার সবই কি মানুষে জানতে পারে?

সব মানুষেই?

 মাঝে মাঝে ছোটো মাছ এসে ঠোকর দেয় ফাতনাতে। বুড়বুড়ি ওঠে না পুকুরের মতন সমুদ্রের সতত বহমান জলে। ফাতনার দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে রং না-পালটানো জলের নীচের নানা-রঙা প্রবালের প্রাসাদ পাহারা-দেওয়া গভীর গম্ভীর সুপুরুষ সমুদ্রের দিকে চেয়ে, সি-গালেদের আর টার্নদের বিষণ্ণ স্বগতোক্তি আর ক্কচিৎ হোয়াইট-বেলিড (White Belied) সি-ইগলদের তীক্ষ্ণ ডাকে চমকে উঠে ধ্যান ভেঙে যায় আহুক-এর। পরক্ষণেই আবার নিজের ভাবনাতে বুঁদ হয়ে যান।

মাছ যাঁরা কখনো ধরেছেন তাঁরাই শুধুমাত্র জানেন যে, সেই নেশার সব মজাই এই সীমাহীন ধৈর্যেরই মধ্যে। প্রকৃতি, তা সে গ্রাম-প্রকৃতিই হোক, নদী-খাল বিলের প্রকৃতিই হোক, কি সামুদ্রিক রহস্যময় প্রকৃতি, সব প্রকৃতিই ভালো বাওয়ার্চির রাঁধা বিরিয়ানির হাণ্ডি নিকালনারই মতন ধীরে ধীরে, এতে পরতে নিজেকে উন্মোচিত করে, ফড়িং-এর ওড়ার মধ্যে, কাঁচপোকার বুবু-কুঁইই ধ্বনির মধ্যে, ঘুঘুর আর বুলবুলির ডাকের মধ্যে, শীতের মধ্যাহ্নর মন্থর হাওয়ায় দূরের নদীর গেরুয়া চরে বসে-থাকা, স্বগতোক্তি-করা সোনালি চখা চখির শিহরতোলা শিস-এর মধ্যে দিয়ে অথবা দিগন্তলীন আকাশের নীচের দিগন্তনীল সমুদ্রর গভীর সম্মোহনী জলজ শান্তির অমোঘতার মধ্যে দিয়ে। এ জগতে থেকেও অন্য জগতে চলে যেতে হয় তখন। যাঁরা জানেন, তাঁরাই জানেন। এই জলজ মৎস্যগন্ধি অভিজ্ঞতার কথা অনভিজ্ঞ অন্যকে কখনো বলে বোঝানো যায় না।

ভীরাপ্পান বলে সমুদ্রের গভীরে নাকি অনেকই দেবতার বাস। আহুক শোনেন। এমনিতে ভীরাপ্পান মিতবাক। ক্কচিৎ নিজের মনে বলে চলে সেইসব দেব-দেবীর কথা। মুত্তেলামার, টোটম্মার কথা। তবে সমুদ্রের দেবতা নাকি অশাণ্ডিমারু, যিনি ওই খুনে টুনা মাছটার হাতের নির্ঘাত মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছিলেন ওকে। সমুদ্র শীতকালে যখন শান্ত থাকে তখন ক্যাটাম্যারন নিয়ে সমুদ্রের অনেক গভীরে চলে গেলে নাকি দেখা যায় স্বচ্ছ জলের নীচে একটা লাল পাহাড়। সেই পাহাড়ের গায়ে অশাণ্ডিমারুর থান। গায়ে যুগ-যুগান্তের শ্যাওলার পরত জমে জমে কালো হয়ে গেছে সে পাহাড়। কতরকমের ফাঙ্গি, অ্যালগি, প্ল্যাংকটন। তাকে ছোঁয়, ছুঁয়েই আবার ভেসে যায়। আর যেখানে যেখানে প্রবাল আছে সেখানে জলের নানা রং। সবজে, কালচে, লালচে, কমলাভ। মনে হয়, স্বপ্নেরই দেশ বুঝি। সেখানে জলের তলার সেই পাহাড়ের গায়ে রাজপ্রাসাদ। তাতে রাজকন্যা থাকে। সেই শ্যাওলা-ধরা নীলচে পাহাড়ের চারপাশে লক্ষ লক্ষ স্যামন আর সার্ডিন আর সুরমেই মাছের ঝাঁক ঘুরে বেড়ায়। টুনারাও। তাদের পাখনা নেড়ে নেড়ে নীল জলকে আরও নীল করে দেয় তারা। নীল জলের ওপর দিয়ে শীতের হলুদ রোদ এসে তেরছা হয়ে পড়ে ওদের গায়ে। বহুবর্ণ দেখায় তখন মাছের ঝাঁকেদের। সূর্যর অনাবিল আলোর দাক্ষিণ্যে প্রবালের রং ঠিকরে যায় ওদের রুপোলি গায়ে।

কখনো-সখনো টাইগার-শার্ক নিঃশব্দে প্রচন্ড বেগে এসে স্যামন-সার্ডিন আর সুরমেইদের ঝাঁককে তাড়া করে। আর সঙ্গে সঙ্গে বিছোনো রুপোর চাঁদরের মতন মাছের ঝাঁকেরা টুকরো টুকরো হয়ে দলছুট হয়ে গিয়ে চারদিকে বিভিন্নমুখী দলে ছড়িয়ে যায় জলের নীচে আলোর ঝলকানি তুলে। জলের নীচে উলটোপালটা গন্তব্যে ছোটো মাছ দৌড়োয়, বড়ো মাছ দৌড়োয়, আলো দৌড়োয় আর পেছনে পেছনে ছায়াও দৌড়োয় নিজের নিজের স্পন্দিত সত্তাকে তাড়া করে। আর তাদের গায়ের বিচ্ছুরিত আলো-ছায়া, জলজ, সবুজ অন্ধকারে, খসে-যাওয়া তারার ঔজ্জ্বল্যেরই মতন প্রতিসারিত হয় চতুর্দিকে।

বেশ লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলের উপরে দুলতে দুলতে বসে ভাবতে। হাওয়াতে যেন মাছের গন্ধ ভাসে। জলেও ভাসে। বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলের হাওয়াতে গা চিটচিট করে তেমন। কেন করে না আহুক জানেন না। এ তো আর দিঘা, পুরী, গোপালপুর, গোয়া বা কোভালাম নয়, এই দ্বীপপুঞ্জের চতুর্দিকে হাজার মাইল সমুদ্র। ভাবলেই দারুণ লাগে। দ্বীপ তো একেই বলে। এসব কি আর বালিগঞ্জের লেক-এর মধ্যের পানকৌড়িদের প্রাতঃকৃত্য সারার দ্বীপ! উপমহাদেশের গায়ে গা-ঠেকানো সমুদ্র আর চারদিকে হাজার হাজার মাইল সুনীল জলরাশির মধ্যে তফাত আছে অনেক। চারদিকে সীমাহীন জলরাশির বিস্তার এই অঞ্চলের দ্বীপবাসীদের মনে এক ধরনের অসহায়তার জন্ম দেয়। প্রকৃতি যে এখনও অমোঘ, মানুষ যে এখনও প্রকৃতির খেয়ালখুশির দাস, সেকথা অন্তরে অনুভব করে। ব্যারেন আইল্যাণ্ড আগ্নেয়গিরির দ্বীপ। কয়েক বছর আগেই সে অগ্ন্যুৎপাত ঘটিয়েছিল। কখন যে মেঘের গুরুগুরুর মতো ভূগর্ভেও গুরুগুরু রবে মাদল বেজে উঠবে তার পরে উৎক্ষিপ্ত হবে তরল আকর, আগুন আর ধোঁয়ার সঙ্গে, তা কে-ই বা বলতে পারে।

নানারকম অনিশ্চয়তা আছে এখানে। অমোঘ, পূর্বনির্ধারিত। মানুষের-নিয়ন্ত্রিত জীবন তাই ঘৃণাভরে পায়ে ঠেলে আহুক বোস জীবনের শেষবেলাতে এই দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ এসে বাসা বেঁধেছেন।

জমি, বাড়ি, নারী বড়ো পিছু টানে। সেই আবর্ত থেকে নিজেকে যে বিযুক্ত করতে পেরেছেন, একথা মনে করেই নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ান মনে মনে।

সামুদ্রিক মাছ এখানে অনেকরকম। সবরকমের নাম কি আর আহুক জানেন? হাঙরও আছে নানারকম। যেসব মাছ খায় এখানের মানুষে তারমধ্যে সুরমেই, কোরাই, ম্যাকারেল, সিলভার-বেলিজ, মানে রুপোলি পেট-এর মাছ, অ্যাকোরিজ, সার্ডিনস, সিয়ার ইত্যাদি আছে। সার্ডিনের মধ্যে দু-রকম দেখেছেন। জানেন না, হয়তো আরও নানারকম আছে। হারেমগুলা, আর ডুসুমেরিয়া অ্যাকুয়া। এ ছাড়াও আছে রেজ, বারাকুড়া, মুলেট। জেলি ফিশ। নানারকম অক্টোপাস। শামুক, মুসেলস। কাঁকড়া, চিংড়ি। আর কত নাম মনে করবেন!

মিষ্টি জল আছে অনেক দ্বীপেরই ভেতরে ভেতরে। পূর্ববঙ্গের উদবাস্তুরা আসার পর তাঁরা অনেক জায়গাতে পুকুরও কেটেছেন। মিষ্টি জলের মাছ খোঁজ করে জোগাড় করতে হয়, কালেভদ্রে অতিথি এলে। তখন ভীরাপ্পানকে জেলেদের দ্বীপে পাঠান। রুই, কাতলা, মৃগেল, ল্যাটা, শিঙি, কই ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। তবে এই নির্জন দ্বীপে সামুদ্রিক মাছই তাঁদের প্রধান খাদ্য। ভীরাপ্পান শুঁটকিও খায় যে-দিন সে শুঁটকি রাঁধে সে-দিন সামুদ্রিক হাওয়াতেও শুঁটকির গন্ধ ভাসে। একদিন খেয়ে দেখেছিলেন। বেজায় ঝাল। একেবারে লাল। কিন্তু আশ্চর্য! খাবার সময়ে কিন্তু তেমন গন্ধ পাননি। সব খাদ্য-পানীয়তেই রুচি তৈরি করতে হয়। তাঁর মনে আছে, শিশুকালে তাঁর এক উকিল মেসোর বাড়িতে এক মাড়োয়ারি মক্কেলের পাঠানো দই-বড়া খেয়ে বমি করে ফেলেছিলেন। কোনো কিছুতেই নাক সিটকোন না সারাপৃথিবী ঘোরা আহুক। কোনো কিছুতেই তীব্র আসক্তি যেমন নেই, অনীহাও নেই। যাকে ইংরেজিতে বলে to ride with the tide, তা-ই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। অবশ্য এতসব জেনেবুঝেও লাভ তো বিশেষ হয়নি। হলে কি ষাট পেরিয়ে এসে একা এই দ্বীপের বাসিন্দা হন?

তবে লাভ-ক্ষতির বিচার তো সকলের কাছে সমান নয়। পৃথিবীতে বড়ো বেশি মানুষ হয়ে গেছে, বড় বেশি কথা, আওয়াজ, গাড়ি-ঘোড়া, ট্রেন-প্লেন সেখানে, বড়ো লোভ, বড়ো বেশি কমিউনিকেশান। ফোন, ফ্যাক্স, মোবাইল, ই-মেল, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট। মানুষের বেশি টাকা রোজগার করার সুবিধে ছাড়া আর কোনো মহৎ উপকার এতে হবে কি না, জানেন না আহুক। তা ছাড়া, এই উদবৃত্ত সময় নিয়ে মানুষ কী করছে, তাও ভেবে দেখার সময় এসেছে।

আহুক মানুষটি বিজ্ঞান-বিরোধী। আজকাল এমন মানুষকেই অন্যে পাগল বলে। ছাগলও বলে, কারণ তিনি ঈশ্বর-বিশ্বাসীও।

আহুক কি বুড়ো হচ্ছেন? ষাট বছরে আজকাল কেউই বুড়ো হয় না। কিন্তু বুড়ো না হলে এমন এমন ভয়-ভক্তি জাগছে কেন মনে?

দূরে মাছটা ডান দিক থেকে বাঁ-দিকে গেল। পাজি আছে। একদিন ইসপার-উসপার হবে। এই টুনা মাছেরাও ম্যাকারেল পরিবারেরই। কিন্তু শিরদাঁড়াটা অন্যরকম। শিরদাঁড়াই তো আসল। মাছ কিংবা মানুষের। শিরদাঁড়াই তো, মেরুদন্ডই তো মানুষে মানুষে, মাছে মাছে পৃথকীকরণের একমাত্র উপায়।

এই মাছটা প্রায় চার মিটার মতন লম্বা। যদিও এদের প্রজাতি পাঁচ মিটার অবধি লম্বা হয়। এদের নাম ব্লু-ফিন টুনা। ওজনও হবে সাত কুইন্টালের ওপরে। সে যে-পরিমাণ জল সরায় চলার সময়ে দু-পাশে, ঘাই মারলে যে-জলস্তম্ভর সৃষ্টি হয়, তা দেখেই ভীরাপ্পানের এবং আহুকের অনুমান এসব। অনেক অন্ধকার রাতে তারাভরা আকাশের নীচে আহুকের বাংলার উঁচু বারান্দাতে ইজিচেয়ারে বসে আহুক ভীরাপ্পানের সঙ্গে মাছটাকে নিয়ে আলোচনা করেন।

কে জানে! মাছটাও হয়তো ওদের নিয়ে অন্য কোনো মাছের সঙ্গে আলোচনা করে। জীবনে যে-মাছটিকে ধরা যায়নি, যে ঈপ্সিত পুরুষ বা নারীকে পাওয়া হয়নি, তার কথাই মনে হয় শয়নে-স্বপনে-জাগরণে। এই এক আশ্চর্য স্বভাব মানুষের। পুরুষের। এবং নারীরও।

 ওই টুনা মাছটার পিঠটা নীলচে-কালো, আর পেটটা সাদা। সামনের ডানাগুলো ধোঁয়াটে কালো আর পেছনেরগুলো হালকা রঙের। আর পিঠের ওপরের ডানা এবং জননেন্দ্রিয়র কাছে গোঁফগুলোর রং হালকা-হলুদ। ধারগুলো কালো।

 দু-বছর হতে চলল আহুক-এর এই দ্বীপে নির্জনবাসের। কিন্তু খারাপ লাগে না। একটুও। সূর্যের আলো, হাওয়া, জল, ঝড়, সমুদ্র, সমুদ্রতট, দ্বীপের মধ্যের আদিম জঙ্গল এইসবে যেন নেশা ধরে গেছে পুরোপুরি। সারাপৃথিবী ঘুরে অয়ন সম্পূর্ণ করে শেষভাগে যেন বড়ো মনোমতো ঠাঁই-এ এসে থিতু হয়েছেন। আজকাল মাসে একবার পোর্ট ব্লেয়ারে গেলেও যেন হাঁপ ধরে যায়। বড়ো অকারণের কথা বলে শিক্ষিত অশিক্ষিত সব মানুষেই। তা ছাড়া, আদেখলা ট্যুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে। খালিগায়ের, শর্টস-পরা, ঘাড় অবধি কাঁচাপাকা চুল আর কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা তাঁর দিকে তাঁরা এমন করে চেয়ে থাকেন যেন, কোনো জেলের কয়েদ ভেঙে সদ্য-বেরোনো কোনো খুনি আসামিই তিনি। আয়নাও নেই একটিও এই দ্বীপে। আয়নাকে যে-পুরুষ চিরতরে তাঁর জীবন থেকে বিসর্জন দিতে পেরেছেন তিনিই সার্থক পুরুষ। আয়নার প্রয়োজন মেয়েদের। বিধাতা যাঁদের পাখির মতন, প্রজাপতির মতন, রুপোলি মাছের মতনই সুন্দর করে গড়েছেন, গড়েছেন ফুলের মতন করে।

মাছটা আর একবার হঠাৎ-ই অন্যমনস্ক, চিন্তাশীল আহুক-এর পেছন দিয়ে এসে অনেকটা সামনে দিয়ে আড়াআড়ি পার হল, তাঁর ভাসমান শান্ত সমুদ্রের ঢেউয়ে মৃদু দোদুল্যমান বোটটাকে। জলের নীচে সেই মাছটির দীর্ঘ ও সুন্দর কালো ছায়া দেখে বুঝলেন আহুক। জলের উপরিতল থেকে মাত্র হাতখানেক নীচ দিয়ে যাচ্ছে সে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার নীলচে-কালো দীর্ঘ শরীর। নীল জলের নীচে তাকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।

ভাবছিলেন আহুক, যার ছায়াই এত সুন্দর তার কায়া না জানি কী সুন্দর!

 কী হে? ভাবছটা কী? তুমি ভেবেছটা কী?

 আহুক বললেন তাকে, মনে মনে।

 তুমি কী ভাবছ?

মাছটাও যেন তার ফাতনা নাড়িয়ে আহুককে বলল।

কী ভাবো, তাই ভাবছি।

আমাকে ধরে তোমার কী লাভ? দুজনে মিলে আমাকে খেতে পারবে? ক-বছর লাগবে? শুঁটকি করে রাখবে বুঝি?

তোমার মতন সুন্দরকে কেউ অমন অপমান করতে পারে?

তবে?

তোমাকে খাবই না। এক টুকরোও না।

তবে?

তবে কী?

তোমাকে ধরার জন্যেই ধরব। যেহেতু তুমি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতে চাও। তা ছাড়া কথাটা কী জানো?

আহুক বলল।

কী?

কথাটা হচ্ছে এই যে, তুমি আমার নিস্তরঙ্গ শেষজীবনে একমাত্র চ্যালেঞ্জ। প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো পুরুষই কি বাঁচে? বাঁচার মতন বাঁচে? সারাজীবন মানুষের সমাজে অগণ্য শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে রমরম করে বেঁচে এসেছি। যখন সারাজীবনের প্রাপ্তি বসে বসে সুদখোর কৃপণ বুড়োর মতন ভোগ করার সময় এলো তখনই তো পালিয়ে এলাম সব ছেড়েছুঁড়ে।

কেন? তুমি কি পাগল?

মাছটি বলল।

অনেকেই তো তাই বলে। টিটিঙ্গিও বলত।

টিটিঙ্গি কে?

 আমার বউ।

সে কোথায়? আনোনি তাকে? থাকো তো একটা ঝাঁকড়া-মাথা দুর্গন্ধ নারকোল তেল-মাখা দৈত্যর মতন দেখতে পুরুষের সঙ্গে। বউ থাকতে কেউ…

বউ মরে গেছে আমার।

তুমি তো ভাগ্যবান। সবাই তো বলে, যে-পুরুষের বা মাছের বউ মরে সে ভাগ্যবান।

 সকলের কি সকলকে ভালো লাগে? তা ছাড়া, কোনো পুরুষ অথবা নারী বা মাছই কি অন্য একজন নারী ও পুরুষকে এক-শো ভাগ সুখী করতে পারে?

কোটি কোটি স্বামী-স্ত্রী তাহলে ঘর করছে কী করে? আনন্দে?

 ঘর করছে কেউ পঞ্চাশ ভাগ সুখে, কেউ ষাট ভাগ, সত্তর ভাগ, কেউ-বা নব্বই ভাগ সুখে। কেউ-বা দশ ভাগ সুখেও করছে। আর কেউ বা অসুখে। তা ছাড়া, আনন্দে কেউই করছে না। করছে নিছক অভ্যেসে। অভ্যেসটাকেই আনন্দ মনে করে মুখের স্বর্গে বাস করছে।

তার পর একটু চুপ করে আহুক বললেন, আসলে ব্যাপারটা কী জানো?

কী?

সুখী মানুষদের মধ্যে অধিকাংশই মূর্খ। আসলে, সুখ যে কাকে বলে, তা-ই তারা সাহস করে জানতে চায়নি। বেশি জানলেই বিপদ, বেশি জানলেই বড়ো দুঃখ। সুখী হতে হলে সাধারণ হতে হয়, পোকাদের মতন, কুকুর-বেড়ালের মতন এই তোমার মতন মাছেদের মতন। মানুষদের বড়োই কষ্ট। মানুষ হয়ে জন্মালেই কষ্ট। বাঁচাবে কে আমাদের? তা ছাড়া, আরও একটা ব্যাপার ছিল।

কী?

মানে, আমার দোষ ছিল।

কী দোষ?

আমাকে আরও অনেক মেয়ে ভালোবাসত।

তাতে কী?

টিটিঙ্গি মনে করত সে-ই আমার একমাত্র মালিক।

 তার দোষ কী? তুমিও কি মনে করতে না যে, তুমিই তার একমাত্র মালিক?

না। করতাম না। বিশ্বাস করো, করতাম না।

 তার পরে আহুক বলল, তুমি ছেলে না মেয়ে, টুনা?

জলে খিলখিল আওয়াজ তুলে হাসল মাছটা। বলল, আমি মেয়ে। সুন্দর নই, সুন্দরী।

তোমাকে টুনি বলে ডাকব তাহলে আমি।

ডেকো। নামে কী আসে যায়। তোমাকে টেনে নিয়ে যে-দিন সমুদ্রের তলায় চলে যাব নানারঙা প্রবালের মধ্যে, রং-বেরঙের ফুলের মধ্যে, সে-দিন তোমাকেও জড়িয়ে ধরব মানুষের মেয়েদের মতন। চুমুও খেয়ে দিতে পারি একটা। রাগ করবে নাকি?

না। চুমু খেলে কেউ কি রাগ করে? আশ্চর্য মাছ তো তুমি! থুড়ি, মানুষ। তার পর?

তার পর কী? তুমি তো জলের তলায় দমবন্ধ হয়ে মরেই যাবে।

তার পর?

তার পর তোমাকে হাঙরে খাবে, নয়তো ছোটো মাছে খাবে ঠুকরে ঠুকরে। সে বড়ো বীভৎস মৃত্যু।

তুমি আমাকে খাবে না?

না। আমি তো মানুষের মেয়ে নই যে, পুরুষমানুষকে খাব। ভাবছি তোমাকে চুমুও খাব না।

খাবে না?

না। তোমাকে মৃত্যুই চুমু খাবে।

তার পরই বলল, পুরুষমানুষ, তুমি আমার শান্তি নষ্ট করছ কেন, গত তিন মাস ধরে?

 তুমি বুঝবে না।

কেন বুঝব না?

 তুমি বুঝবে না। একজন পুরুষমানুষ সবচেয়ে বেশি করে বাঁচে বিপদের মধ্যে। পুরুষের মতন পুরুষ।

 তার পর বলল, কে জানে! আসলে, আমার অশান্তিকে দূর করার জন্যেই তোমার শান্তি নষ্ট করছি হয়তো।

তুমি বলছ, পুরুষমানুষ বাঁচার মতো বাঁচে শুধু বিপদেরই মধ্যে। কিন্তু কোনো পুরুষের যদি সত্যি কোনো বিপদ না থাকে?

তখন বিপদ তৈরি করে নিতে হয়। বিপদ ঠিক নয়, বলব, চ্যালেঞ্জ। কারো বিরুদ্ধে দ্বৈরথ।

বুঝেছি। তুমি যেমন আমার বিপদ হয়ে এসেছ অথবা আমি তোমার বিপদ হয়ে। থুড়ি, চ্যালেঞ্জ।

তবে, তুমি মেয়ে না হলেই আমি খুশি হতাম।

কেন?

মেয়েদের সঙ্গে পুরুষের তো লড়াই-এর সম্পর্ক নয়।

তো? কীসের সম্পর্ক?

আদরের, ভালোবাসার।

তোমার বউ টিটিঙ্গি না ফিটিঙ্গি তোমাকে ছেড়ে গেল কেন?

 টিটিঙ্গি তো মরে গেল। বেচারি। ছেড়ে গেছিল আমার প্রেমিকা, চিচিঙ্গা।

কেন?

সে, ভালোবাসার মানেই জানত না। ও ছিল দু-নম্বরি। জালি! আশ্চর্য! ভালোবাসার মানে কিন্তু খুব কম মেয়েরাই জানে। মাছেদের মেয়েরাও কি জানে?

টুনি হাসল যেন। জলের নীচে কুলকুচি করার মতন শব্দ হল।

কী? উত্তর দিচ্ছ না আবার হাসছ?

আহুক বলল।

টুনি বলল, পুরুষ মাছেদেরই জিজ্ঞেস কোরো। আমি কী করে বলব?

 তুমি আমাকে ডুবিয়ে মেরে খুশি হবে?

কারোকে মেরে কেউ কি খুশি হয় কখনো?

 তবে মারবে কেন?

 তুমি আমাকে মারতে চাও যে। আমাদের দুজনের মধ্যে একজনকে তো মরতে হবেই।

কেন? মরতে হবেই কেন?

 মৃত্যুকে মহান করার জন্যে।

আহুক চুপ করে রইল। উত্তর দিল না। বা, দিতে পারল না গভীর জলের মাছের এই গভীর কথার।

বেলা পড়ে আসছে। জলের রং সবুজ থেকে নীল, নীল থেকে কালো হয়ে উঠছে। যদিও এখন শুক্লপক্ষ কিন্তু তবুও রাত নেমে গেলে হর্নেটস নেস্ট-এর নড়বড়ে জেটিতে উঠতে অসুবিধে হয়। আহুক-এর বয়েস হয়েছে বলে নয়, ভীরাপ্পানেরও হয়। জেটি তো নামেই। মেরামত হয়নি বহুদিন। তা ছাড়া সবসময়েই ঢেউ থাকে তো। হর্নেটস নেস্ট-এ নানান অসুবিধে। নইলে জলদস্যুরাও কি এমন নাম দেয় দ্বীপের?

তার পর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ।

আহুক বললেন, তুমি একদিনও কামড় দাও না কেন আমার টোপ-এ?

তুমি যে-টোপ দাও তা তো আমি খাই না। আমি মাছই খাই না! ওই টোপ দেওয়ার বুদ্ধি তোমাকে কে দিয়েছে? ওই ঝাঁকড়া-চুলো? আমি তিমি-হাঙরের মতো প্ল্যাঙ্কটন খেয়ে বাঁচি। তুমি মানুষের মধ্যে যেমন অন্যরকম, আমিও মাছেদের মধ্যে অন্যরকম।

মাছ ছাড়াও তো অনেক কিছু দিয়ে দেখেছি। বঁড়শিতে গেঁথে। তাও তো তুমি খাওনি। তুমি কি নিখাকি মাছ?

আমি কী খাই আর কী খাই না, তাই যদি না জানো তবে কী করে আশা করো যে, তোমার বড়শিতে আমি চুমু খাব? হাঃ।

একটা হাওয়া উঠল। পেছনের আকাশের অবস্থা যে কখন আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে এসেছিল তা লক্ষ করেননি আহুক। শক্তিশালী আউটবোর্ড ইঞ্জিনটা স্টার্ট করলেন। কিন্তু স্টার্ট হল না। মাছ ধরতে যখন আসেন তখন বড়ো বোট নিয়ে আসেন না। তাঁর তরুণী সুন্দরী মালকিনের প্রতি তিনি যথেষ্টই বিবেচক।

রোদ মরে যেতেই হাওয়াটা হঠাৎ-ই ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এবং খুব জোরে বইতে লাগল এলমেলো। কালো, অথই জলে বড়ো বড়ো ঢেউ উঠতে লাগল। নৌকোর হালটা ঘুরিয়ে দিলেন আহুক। নইলে পাশ থেকে ঢেউ লেগে থেমে থাকা বোটটা হঠাৎ উলটেও যেতে পারে। প্রায়ই ভাবেন, একটা ক্যাটাম্যারনে উলটে যাওয়ার ভয় থাকে না। তা ছাড়া, এ তো আর নদী বা খাল-বিল নয় যে, বিপদ দেখে নোঙর করবেন। এখানে থামা নেই। শুধুই চলা। হয় চলো, নয় পঙ্গু, অসহায় স্থবিরের মতন জলে ডুবে মরো। কোনো মধ্যপন্থা নেই।

আবারও স্টার্ট করার জন্যে স্টার্টারের দড়ি ধরে টানলেন আহুক। কিন্তু এঞ্জিন তবু নীরব।

মাছটাকে যেন হঠাৎ-ই খুব কাছেই একবার দেখতে পেলেন উনি। মেয়ে মাছ। টুনা নয়, টুনি।

সে বলল, চললাম, আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে। তুমিই আমার প্রাণ আবার তুমিই আমার যম। তাই তো এত ভালোবাসি।

কাকে?

তোমাকে।

তার পরই টুনি বলল, স্টার্ট করো এবারে। স্টার্ট হবে।

তুমি কী করে জানলে?

আমি জানি যে! তুমি কি জানো, এইসব দ্বীপপুঞ্জের মানুষেরা, এইসব সমুদ্রের মাছেরা কত দেবতার দয়াতে বাঁচে?

না তো। সমুদ্রের দেবতার নাম কী ওদের?

জুরুইন। জুরুইন বড়ো সর্বনাশা দেবতা। যার বাস জলে। আর ওদের ঝড়ের দেবতা লুলুগা, উলুগারই আর এক নাম বলতে পারো। তোমাকে আর একবার কাছ থেকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই জুরুইনকে বলে তোমার ইঞ্জিনকে মেরে রেখেছিলাম আমি। তোমাকে দেখা হল, এবার যাও। আহা, যাওয়া নেই এসো। আবার এসো।

দেখলে কেমন?

 কী?

কী নয়, এল কাকে?

কাকে?

আমাকে।

ভালোই। পুরুষ পুরুষ। পুরুষ মেয়েলি হলে ভালো লাগে না।

টুনি অন্ধকার জলে একটি দীর্ঘ অন্ধকারতর অপস্রিয়মাণ, হিল্লোলিত ছায়া হয়ে মিলিয়ে যেতেই আহুক-এর বোটের ইঞ্জিন কথা বলে উঠল।

হালটা ঘুরিয়ে দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর দিকে চললেন আহুক।

কম্পাস একটা থাকে সবসময়েই বুকে ঝোলানো। যখনই সমুদ্রে নামেন। তবে প্রয়োজন। হয় না। উনি জানেন যে, যে-দিন প্রয়োজন হবে সে-দিন ওটা কাজে লাগবে না। এমনই হয়। উনি অনেক ঘাটের জল-খাওয়া মানুষ বলেই জানেন।

আজ সামনে রাত এবং দুর্যোগ। সামান্য আলোর আভাস এখনও আছে যদিও। বাঁ-হাতে হালটা ধরে ডান হাতে কম্পাসটা দেখে নিলেন আহুক একবার।

আধো-অন্ধকারে খড়ের সাদা টুপি মাথায় দেওয়া, দৃঢ়, সুন্দর গড়নের বাদামি পুরুষমানুষটি সাদা বোটটি চালিয়ে গুট গুট গুট গুট শব্দ করে পেছনের জলে ঢেউ তুলতে তুলতে এগিয়ে যেতে লাগলেন। মানুষটার ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো বসন নেই। কখনোই থাকে না। তবে চুল আছে। কাঁচা-পাকা। বুকভরা। আর মাথার পেছন দিকে। এবং Salt and Pepper দাড়ি-গোঁফ। নাপিতও নেই, আয়নাও নেই, এখানে।

মেয়ে মাছটা জলের উপরে একবার নাক তুলে সেই বয়স্ক কিন্তু সুন্দর পুরুষের ঘামে ভেজা-বগলতলির গন্ধ নিল দু-নাক ভরে। তার পর নিঃশব্দে হেসে, গভীর জলে চলে গেল তার সাদা পেট আর নীলচে-কালো পিছল পিঠে অতল জলের স্পর্শ এবং বিপরীত স্রোত অনুভব করতে করতে।

আহুক মনে মনে বললেন, মাছটা ভারি ভালো।

মাছটা এখন অনেকই নীচে চলে গেছে, যেখানে রোদ কখনোই পৌঁছোয় না। জল এখানে ভারি ঠাণ্ডা। আর এখন তো শীতকাল। যদিও শীত যাকে বলে, তা এখানে কখনো আসে না। ছাই আর বিস্কিট-রঙা প্রবাল সেই গভীরে। নানা-রঙা লতা-গুল্ম, গাছপালা, জলজ শ্যাওলা, ছত্রাক আর নানারকম ভাসমান প্রাণ। ঠাণ্ডা জলে মানুষের মেয়েরা সন্ধেবেলা যেমন গা পোয় তেমন করে সাঁতার কেটে কেটে তলপেট, বুকে, মুখে সমুদ্রের ফেনা ঘষে ঘষে মেয়ে মাছটি, যার নাম দিয়েছে আহুক বোস টুনি, চান করতে লাগল। চান করতে করতে, সুন্দর হতে হতে মানুষের মেয়েরাও যেমন বলে, তেমন করে মনে মনে বলল, পুরুষমানুষটা খুব ভালো। ওর সে চিচিঙ্গাটা নিশ্চয়ই বোকা অথবা পাজি ছিল। কেন যে ছেড়ে গেল! তার পুরুষ মাছটা যেমন ছিল, তেমনই।

টুনা মাছটা ভাবছিল, মানুষে আর মাছে কত মিল! বুদ্ধিতে যেমন, বোকামিতেও যেমন, পেজোমিতেও তেমন।

.

০২.

 অপরূপ সুন্দরী বলতে বাংলাতে চলিতাৰ্থে যা বোঝায় রংকিনী তা নয়। তবে তার গায়ের রংটি ফলসা আর বেগুনির মাঝামাঝি। তার গলার স্বরটি মৌটুসি পাখির মতনই মিষ্টি। ভারতের মতন এই ট্রপিক্যাল উপমহাদেশে যেহেতু অধিকাংশ মানুষের গায়ের রং-ই কালো, কুৎসিত মানুষও ফর্সা হলেই এখানে সুন্দর বলে গণ্য হয়। আবার যেহেতু অধিকাংশ মানুষই রোগা, সুতরাং মোটা মানুষকেও সুন্দর বলে মনে হয়। এটা অবশ্য পুরুষদের বেলাতেই বেশি ঘটে।

আশ্চর্য সব ধ্যান-ধারণা আমাদের।

রংকিনী ভাবে।

না, ও জানে যে, ও চলিতাৰ্থে সুন্দরী নয় তবে সে অবশ্যই ব্যক্তিত্বময়ী, মেধাবী, দৃঢ়চেতা। সৌন্দর্যর উপাদান চোখ, নাক, চিবুক যতটা নয়, বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্ব তার চেয়ে অনেকই বেশি। নারীর এইসব গুণের মধ্যে যেসব ব্যতিক্রমী পুরুষ সৌন্দর্য দেখতে পান রংকিনী তাঁদের চোখে অবশ্যই সুন্দরী।

শিশুকাল থেকেই সে স্বাধীনচেতা। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে তার আর্থিক স্বাধীনতা এবং অঢেল স্বোপার্জিত অর্থ তার সেই পুরোনো স্বাধীনতাবোধকে আরও দৃপ্ত করেছে। তার উদ্দেশ্যহীন, অসংযমী, বাস্তবজ্ঞানরহিত কিন্তু অবশ্যই সৃষ্টিশীল বাবা তাঁর নিজের সবরকম অপূর্ণতার, অসফলতার কারণে তাঁর জীবদ্দশাতে রংকিনীর শ্রদ্ধা পাননি কোনো দিনও কিন্তু এক ধরনের সহমর্মিতা পেয়েছিলেন। একে সহমর্মিতা বলবে, করুণা, তা রংকিনী নিজেই ঠিক জানে না। হয়তো দয়াই। দয়া পাওয়ার মতন কিছুমাত্রই পাননি সেই দুর্মুখ, ট্যাক্টলেস মানুষটি, বিবাহিতা স্ত্রীর ভালোবাসা, সন্তানদের সম্মান, রাষ্ট্রের পুরস্কার। একজন স্বেচ্ছাচারী পুরুষের যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেই অর্থ অথবা অন্য অনেক কবি-সাহিত্যিক-গায়কের মতন জনপ্রিয়তাও। না, কিছুই মানুষটা পাননি। আশ্চর্য! এইসবের প্রতি মানুষটার আকর্ষণও ছিল না বিন্দুমাত্র। রংকিনী জানে যে, সত্যিই ছিল না।

ও মনে মনে বলত তার বাবাকে অদ্ভুত লোক।

 তার বাবার মৃত্যুর পরে তাঁর অসংলগ্ন ডায়রি, তাঁর লেখা অসংখ্য না-পাঠানো চিঠি, অসমাপ্ত পান্ডুলিপি, শেষ না-করা ছবি, বহু গানের অর্ধসমাপ্ত স্বরলিপি এইসব দেখে রংকিনীর অপরাধবোধ জেগেছে মনে বার বার। মনে হয়েছে যে, তারা দু-ভাই-বোনে কেউই তাদের বাবার প্রতি ন্যায় করেনি। তাঁকে একটুও বোঝেওনি। তাঁর মূল্যায়নই করেনি। যথার্থ মূল্যায়নের কথা তো ছেড়েই দিল। যেহেতু তাদের মা-ই তাদের কাছের মানুষ ছিলেন, যেহেতু তিনিই তাদের জন্যে সব কিছু করেছিলেন, তাই তাঁর প্রতিই তাদের মমত্ব, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা ছিল অসীম। মাকে তারা দু-ভাই-বোনে Single Parent বলেই গণ্য করে এসেছে বাবাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে।

কিন্তু রংকিনীর বাবা অসমঞ্জ রায়ের মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতিটি বই জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠাতে তাদের পরিবারে মাসে লক্ষাধিক টাকা রয়ালটি আসে শুধুমাত্র একটিমাত্র প্রকাশক এর কাছ থেকেই। অন্যদের কাছ থেকেও কম আসে না।

কে জানে! সম্ভবত এই অভাবনীয় অর্থই চলে যাওয়া অসমঞ্জ রায়কে Posthumously খুব দামি করে তুলেছে রংকিনীর কাছে। চলে যাওয়া বাবার রয়ালটি আলোকবর্তিকা হয়ে তার বাবার নবমূল্যায়নে সাহায্য করেছে। বর্তমান পৃথিবীতে সব কিছুরই মূল্যায়ন সম্ভবত টাকা দিয়েই হয়। তবে একথাও সত্যি যে, তার বাবার লেখা একটি বইও রংকিনী আগে পড়েনি। পড়া আরম্ভ করেছে সাম্প্রতিক অতীত থেকে। এবং যতই পড়ছে ততই বড়ো অপরাধী বোধ করছে নিজেকে। বুঝেছে যে, তার চলে-যাওয়া বাবার প্রতি তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত অন্যায় করেছে। অথচ যে-মানুষ চলে গেছে তার জন্যে করার তো আর কিছুই নেই!

জীবদ্দশাতে অসমঞ্জু রায়কে একটি অসভ্য অবাধ্য বেড়ালেরই মতন দেখেছে ওরা। বহুবারই, অলস, ভোলাভোলা-প্রকৃতির মানুষটিকে তাঁর পরিবেশ ও প্রতিবেশ থেকে বহু দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসেছে, মায়েরই নির্দেশে। কিন্তু বাহ্যত অভিমানহীন তিনি, আবারও একদিন হঠাৎ-ই ফিরে এসেছেন পুরো পরিবারের চরম বিরক্তি ঘটিয়ে। নির্লজ্জর মতন হেসে বলেছেন, তোদের ছেড়ে কি বেশিদিন কোথাওই থাকতে পারি আমি? বিশেষ করে রংকিকে ছেড়ে?

মা বলেছেন, ঢং দেখে বাঁচি না।

 ভাই বলেছে, এল ফিরে, ইটার্নাল বোর।

শুধু রংকিনীই কিছু বলেনি। মানুষটার পয়েন্ট অফ ভিউ বোঝার চেষ্টা করেছে। যদিও নীরবে। ওদের মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে বাবার সপক্ষে সোচ্চারে কিছু বলার সাহস ওর ছিল না। বলবার প্রয়োজনও বোধ করেনি। মা-ই অধ্যাপনা আর ছাত্রী পড়িয়ে, বলতে গেলে সংসার খরচের সিংহভাগ চালাতেন। বাবা, কবিতা বা গান লিখে কখনো-সখনো সামান্য কিছু পেতেন। পেতেন ক্কচিৎ-কদাচিৎ ছবি বিক্রি করেও। অথবা ক্কচিৎ গান গেয়েও। কিন্তু নিয়মিত রোজগার বলতে কিছুই ছিল না তাঁর। আজ রংকিনীর বাবা অসমঞ্জ রায় বেঁচে থাকলে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা, অঢেল অর্থ নিয়ে অবশ্যই রীতিমতো বিব্রত হতেন। এই দুইয়ের কোনোটিই অসমঞ্জু রায়ের প্রত্যাশার যেমন ছিল না, প্রার্থনারও নয়।

আন্দামানগামী প্লেনের জানালার পাশে বসে, চলে-যাওয়া বাবার কথা, এতসব পুরোনো কথা কেন যে মনে পড়ছিল, জানে না রংকিনী। তার জীবনযাত্রা এমনই হয়েছে যে, কিছুমাত্র ভাবার সময়ই নেই। কাজের কথা ছাড়াও যে অন্য কোনো কিছুর কথা ভাবা যায় তা ও যেন ভুলেই গেছিল।

আজ সকালে ও বিছানা ছেড়েছিল শেষরাতে। এখনও ঘুম লেগে আছে চোখে। দিল্লির কি বেঙ্গালুরুর বা চেন্নাই ফ্লাইট ধরতেও তো অন্ধকার থাকতেই উঠতে হয়। কিন্তু সে তত কাজে যাওয়া। তখন একেবারেই Keyed-up হয়ে থাকে বিছানা ছাড়ার পর থেকেই। প্লেনে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে, এমনকী ব্রেকফাস্ট খেতে খেতেও প্রেজেন্টেশানের কাগজপত্র দেখে। ব্রিফিং-এর নোটস। কিন্তু আন্দামানে তো আর কাজে যাচ্ছে না! বারো মাস, দিন-রাত, সারাদেশে এবং বিদেশেও ছুটোছুটি এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরে এই ওয়েল-ডিসার্ভড হলিডেতে বেরিয়ে পড়ে, প্লেনে ওঠার পরই সিটবেল্ট বেঁধে নিয়েই তাই অজানিতেই ঘুমে এলিয়ে পড়েছিল রংকিনী। টেনশানে টানটান শরীর যেন হঠাৎ-ই ছেড়ে দিয়েছে। এলিয়ে পড়েছে, ভেঙেপড়া এলখোঁপারই মতন।

ব্রেকফাস্ট যখন সার্ভ করতে আরম্ভ করল স্টুয়ার্ডেসরা তখন পাশে-বসা চুমকি ওর হাতে এক ঠেলা মেরে বলল, কী রে রংকি, ব্রেকফাস্ট তো খাবি! তোকে দেখে মনে হচ্ছে গতরাতে বুঝি তোর ফুলশয্যাই ছিল।

ঘুম ভেঙে, চোখ খুলে অল্প হেসে বিড়বিড় করে রংকিনী বলল, আমার তো রোজই ফুলশয্যা। রাতেই বা ক-ঘণ্টা ঘুমোই।

তার পর হাই তুলে বলল, বাবাঃ। পুরো ছুটিটা শুধুই ঘুমোব আর রিল্যাক্স করব।

 চুমকি ওর সমস্যা বোঝে। সেও একাধিক বড়ো বড়ো পারিবারিক ব্যাবসা অত্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে এবং সাফল্যের সঙ্গে চালায় রংকিনীরই মতন, শুধু দেশের মধ্যেই নয়, সারাপৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে হয়। বললে, হয়তো অজ্ঞ মানুষেরা হাসবেন কিন্তু কথাটা সত্যি যে, কাজের জন্যে বিয়ে করার সময়টুকু তো বটেই কারোকে তেমন করে ভালোবাসার সময়টুকুও করে উঠতে পারল না। এই সমস্যা চুমকির একার নয়। আজকের দিনের অগণ্য ভারতীয় মেধাবী, স্বাধীন, স্বনির্ভর এবং স্বচ্ছল মেয়েদের অনেকেরই।

সাঁতার কাটবি না? স্যুইমস্যুট এনেছিস তো?

চুমকি জিজ্ঞেস করল রংকিনীকে।

তা এনেছি।

তবে আর কী। তবে আন্দামানে কিন্তু সাঁতার কাটার জায়গা নেই বিশেষ। এখানে সমুদ্রতট বলতে আমরা যা বুঝি, তেমন কমই আছে। তা ছাড়া জল হঠাৎ-ই গম্ভীর হয়ে গেছে। কোভালাম বা গোয়র মতন নয়। পুরীর মতনও নয়।

তাই?

হ্যাঁ।

খাওয়াটা কন্ট্রোলে রাখতে হবে তাহলেই হল।

 ফিগার কনশাস, গ্র্যাণ্ড-হোটেলের পিঙ্ক এলিফ্যান্ট আর তাজ-বেঙ্গলের ইনকগনিটোতে উইক এণ্ডে নাচতে যাওয়া সেক্সি চুমকি বলল।

 ব্রেকফাস্ট হয়ে গেলে রংকিনী আবারও ঘুম লাগাল। কত ঘুম যে জমে আছে না নেওয়া ছুটিরই মতন! হিসেব নেই তার। এবারে ওর সঙ্গে চুমকিও ঘুম লাগাল।

এখন মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে প্লেন। নীচের বঙ্গোপসাগর দেখাই যায় না। তা ছাড়া অত উঁচু থেকে সমুদ্রকে তো বোঝাই যায় না। সমুদ্র বলে বড়ো বড়ো ঢেউ ভেঙে পড়ায় যে-ফেনা আর বুদবুদ ওঠে তা সরু সরু সাদা অস্পষ্ট সাপের মতন দেখায় নীচের কালচে জল ভূমির ওপরে। চারদিকে আদিগন্ত কালো জলভূমির মধ্যে অমন হাজার হাজার সাদা সাদা কিলবিলে সাপ চোখে পড়ে। অবশ্য আকাশ যখন নির্মেঘ থাকে তখনই। প্লেন যখন অনেকখানি নীচে নেমে আসে তখনই শুধু সমুদ্রকে সমুদ্র বলে চেনা যায়।

ওরা দুজনেই গাঢ় ঘুমে ছিল। এমন সময়ে প্লেনের মধ্যেই হঠাৎ-ই একটা হুড়োহুড়ির শব্দ শুনে চোখ মেলতেই অডিয়ো-সিস্টেমে সিটবেল্ট বাঁধবার নির্দেশ এলো। প্লেনটা অনেকই নীচে নেমে এসেছে। সমুদ্র তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেই জলের ওপরে, তা ছাড়া বিভিন্ন ভঙ্গিমাতে, বিভিন্ন গড়নের সবুজ রোমশ প্রাণীর মতন নানা ভূখন্ডও দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। চাপ চাপ, ছোপ-ধোপ সবুজ। নিবিড় আদিম জঙ্গল, প্রাগৈতিহাসিক বনস্পতি। আরও নীচে নামলে বোঝা গেল যে, ঘনসন্নিবিদ্ধ ঘাস-পাতাতে মাটি দেখাই যায় না মোটে। শুধু দু-এক জায়গাতেই সিঁদুরে-রঙা মাটি চোখে পড়ে, ওড়িশার পাহাড়ে পাহাড়ে, মহুলসুখাতে, বন্ধ হয়ে যাওয়া Open Cast ম্যাঙ্গানিজ আকরের খনিগুলির সিঁদুর রঙের মতন। নইলে, শুধুই সবুজ আর সবুজ। ওপর থেকে দেখা সবুজ দ্বীপগুলির নরম স্নিগ্ধতা বড়োই নয়নলোভন।

এই তাহলে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ!

মনে মনে উত্তেজিত হয়ে ভাবল রংকিনী।

ওরা দুজনেই জানালাতে ঝুঁকে পড়ে বাইরে দেখতে লাগল। প্লেনের মধ্যের ওই দুপ-দাপ হুড়োহুড়িটা, অনেক যাত্রীই নিজের নিজের সিট ছেড়ে যে-দিকে সুন্দরতর দৃশ্য সে-দিকে জানালার দিকে ভিড় করার প্রবণতার জন্যেই হচ্ছিল। স্টুয়ার্ডেসরা মিষ্টিকথায় বকা-ঝকাতেও যখন যাত্রীদের সামলাতে পারছিলেন না তখন ক্যাপ্টেনকে নালিশ করে দেওয়ার ভয় দেখালেন। প্রত্যেককে সিটবেল্ট পরে নিজের নিজের সিটে বসে থাকতে নির্দেশ দিলেন তাঁরা কঠিন মুখে।

ক্যাপ্টেনও বললেন, অডিয়ো-সিস্টেমে যে, সকলে স্থিও হয়ে না বসলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

এমনভাবে প্লেনটা এ-পাহাড় সে-পাহাড়ের মাথা টপকে, বগলতলি দিয়ে, কান ঘেঁষে একবার ডান দিক একবার বাঁ-দিক, একবার উঁচু, একবার নীচু হয়ে উচ্চতা হারাতে হারাতে নামতে লাগল যে, সত্যিই মনে হল প্লেনের মধ্যে ওইসময়ে অমন হুড়-দাড় করলে, ভারসাম্য হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া আদৌ আশ্চর্য নয়।

তার পরেই, দুটো পাহাড়ের মাঝ দিয়ে গিয়ে দুটি পাহাড়ের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে হঠাৎ-ই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের স্তনসন্ধিতে উঁকি মারল জেট-এঞ্জিনের বোয়িং প্লেনটা।

চুমকি স্বগতোক্তির মতন বলল, তুই কি সেশ্যেলস দ্বীপপুঞ্জে গেছিস কখনো?

রংকিনী মাথা নাড়ল।

তার পর বলল, না। বেড়াতে আর কোন দেশেই বা গেছি! কাজে গেলে তো একমুহূর্তও অবসর জোটে না। একবার হাজারিবাগ আর একবার রিখিয়াতে বেড়াতে গেছিলাম। ওঃ, মনে পড়েছে। একবার বান্ধবগড়ে গেছিলাম। মধ্যপ্রদেশে।

রিখিয়া? সেটা আবার কোথায়?

চুমকি বলল, ভুরু তুলে।

যশিডির কাছেই। ইরামাসিদের বাড়ি আছে। সেখানে পাখি আছে অনেক। খুব নির্জন জায়গা। সুন্দর। যদিও একটু ন্যাড়া-ন্যাড়া।

ইরামাসি কে?

কবি বিষ্ণু দের বড়োমেয়ে।

ও! আমি চিনি না। আমি ক-জনকেই বা চিনি!

তার পর বলল, সেশেলস-এ বাবা একবার আমাদের নিয়ে গেছিলেন। তখন বাবা তানজানিয়ার ডার এস সালাম-এ কী যেন একটা টার্ন-কি প্রোজেক্ট করছিলেন।

সেশ্যেলস?

হ্যাঁ রে। সে যে কী পরির দেশ তোকে কী বলব। মাহে এয়ারপোর্টের ওপরে প্লেনটা যখন নামতে থাকে নানা সবুজ দ্বীপের মধ্যে মধ্যে, তখন যেন সমুদ্রের এক একরকম রং ফুটে ওঠে। স্বপ্নেও বুঝি এত সুন্দর দেশ দেখা যায় না।

মানে?

রংকিনী বলল।

মানে, কোরাল রিফস আছে তো জলের নীচে! কোনো জায়গাতে কোরালের রং গাঢ় সবুজ, কোথাও ফিকে নীল, কোথাও গোলাপি, কোথাও কমলা। সত্যি! দেখে মনে হয়, কোনো স্বপ্নের বা রূপকথার দেশেই বুঝি এলাম।

জলের নীচে রাজপুত্র নেই?

রংকিনী বলল।

আরে, রাজপুত্র তো আছে সব জায়গাতেই। আমরা এই পোড়ারমুখীরা খুঁজে পাই না, এই যা!

বলেই বলল, কোরাল-এর বাংলা কী রে, জানিস?

প্রবাল।

ও হ্যাঁ। তাইত। ভুলেই গেছিলাম।

 তার পর বলল, আমার বাবার একটি কবিতার বই ছিল : প্রবাল দ্বীপে একা। আশ্চর্য! অথচ জীবনে কখনো প্রবাল দ্বীপ দেখার সুযোগ হয়নি তাঁর।

রংকিনী বলল, হঠাৎ উদাস হয়ে গিয়ে।

 দেখেছেন। দেখেছেন। উনি নিশ্চয়ই দেখেছেন। তবে কল্পনায়। কবিরা তো আমাদের মতন রিয়্যাল, মানডেন জগতের বাসিন্দা নন। কল্পনাতে দেখাই তো আসল দেখা! ইয়াররা আনভিজিটেড! মনে নেই?

সেশেলস দেশটা কোথায়? রংকিনী জিজ্ঞেস করল।

এখন তো কেবল-টিভির দৌলতে সকলেই ঘরে বসে ট্রাভেল চ্যানেল খুলে সেশেলস-এ বেড়িয়ে আসে। তবে যে যাই বলুন, নিজের পায়ে ভর করে সেখানে গিয়ে দাঁড়ানো আর ঘরে বসে টিভিতে সেই দেশ দেখার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত আছে। নিজে পায়ে হেঁটে কোনো জায়গাতেই না ঘুরতে পারলে ইউ ক্যানট হ্যাভ দ্য ফিল অফ দ্য, প্লেস।

তা ঠিক। তবে জায়গাটা কোথায় তা তো বলবি?

পৃথিবীর ম্যাপে তোকে খুবই কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হবে। ভারত মহাসাগরে মরিশাস, জাঞ্জিবার আর আফ্রিকার মধ্যে সরষে দানার চেয়েও ছোটো গোটাকয় বিন্দু দেখতে পাবি। অনুবীক্ষণ দিয়ে দেখাই বোধ হয় সুবিধে।

কেন? ওরকম কেন?

ওইরকমই। জানি না, পৃথিবীতে অত ছোটো দেশ আর আছে কি না! অমন দ্বীপপুঞ্জ সম্ভবত আর নেই।

তার পরই বলল, ওই দ্বীপপুঞ্জের রাজধানীর নাম ভিক্টোরিয়া। দ্বীপের নাম মাহে। ছোটো হলে কী হয়! এত সুন্দর সমুদ্রতট পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরাও তো হার মানে। এক সময়ে জলদস্যুদের ঘাঁটি ছিল সেশেলস। এখনও ওখানকার নানা জায়গাতে, অনেক কোম্পানি ফ্লোট করে অনেকেই জলদস্যুদের পুঁতে রাখা গুপ্তধন খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করছে।

তাই?

ইয়েস ম্যাম।

রংকিনী বলল, সত্যি! তোর সঙ্গে যে, এয়াপোর্টে দেখা হয়ে যাবে তা ভাবতেই পারিনি। তোর তো পৃথিবীতে অদেখা দেশ খুবই কমই আছে। তা এত দেশ থাকতে তুই আন্দামানে আসা ঠিক করলি কেন?

আমি তো আন্দামানে প্রায় প্রতিবছরই আসি। ছুটি কাটাতে তো আসিনি। কখনো কখনো একাধিকবার। বিশেষ করে, গত পাঁচ বছরে। মানে, আসতে হয়ই। এটাও কাজ বলে ধরতে পারিস। আমার ঠাকুমার নারকোল গাছের বাগান ছিল এখানে। খুবই শিক্ষিতা কিন্তু বিষয়ী মহিলা ছিলেন তিনি। জলের দামে কিনেছিলেন আজ থেকে ষাট বছর আগে। একটি আস্ত দ্বীপ বুঝলি! গতবছর তো ঠাকুমা দেহ রেখেছেন। আমার বিয়ের যৌতুক হিসেবে ওই দ্বীপটি দিয়ে গেছেন আমাকে ঠাকুমা।

বিয়ের যৌতুক মানে?

মানে, আমার যবে এবং আদৌ যদি বিয়ে হয়। সেটা নাও হতে পারে। তবে সম্পত্তিটা হয়েছে।

তুই দ্বীপ-কুমারী! গোটা দ্বীপই যখন দিলেন তখন প্রবাল দ্বীপের রাজপুত্রও দিতে দোষ কী ছিল? গল্পর মতনই শোনাচ্ছে। সত্যি।

কয়েক লক্ষ নারকোল গাছই ছিল শুধু। অন্যান্য অগণ্য জংলি গাছ তো ছিলই। তা আমারই সম্পত্তি যখন তার দেখাশোনার দায় তো এখন আমারই।

তুই একটা পুরো দ্বীপের মালিক। ভাবা যায় না! পুরুষ হতাম যদি তো শুধু এইজন্যেই তোকে বিয়ে করতাম।

ছেলেবেলাতে ঠাকুমা নিজেই দেখাশুনো করতে আসতেন। আমাকেও নিয়ে আসতেন স্কুল বা কলেজ ছুটি থাকলে। তবে এবারে আমি আন্দামানে বেড়াতেও আসিনি, প্ল্যানটেশানের কাজ দেখতেও যাচ্ছি না। কারণ, একজন হোলটাইম ম্যানেজার রেখেছি। তিনি থাকতে কারোরই আর কিছুই দেখার দরকার নেই।

তবে কী করতে এসেছিস এবারে?

এবারে এলাম শুধু তাঁরই সঙ্গে দেখা করতে। জাস্ট টু সে হাই।

 বাবাঃ। এমন করে বলছিস যেন দর্শনে এলি কারো। কোনো দেব-দেবীরই বুঝি? আফটার অল, তিনি তো তোর কর্মচারীই, যে-নামেই ডাকিস না কেন তাঁকে।

ঠিক তা নয়, তা নয় রে রংকিনী। এমন অনেক কর্মচারীও থাকেন যাঁরা মালিককে ধন্য করেন এমন অনেক পুরস্কারপ্রাপকও যাঁরা পুরস্কারদাতাকেই মান দেন তা গ্রহণ করে।

কোনো বয়ফ্রেণ্ড? ওল্ড ফ্লেম? কে তোর সেই ম্যানেজার? রহস্যর গন্ধ পাচ্ছি।

তুই কলেজের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে একবার একটা গান গেয়েছিলি না? যতবার আলো জ্বালাতে চাই নিভে যায় বারে বারে। ফ্লেম একবারই জ্বলল না এখনও তার আবার ওল্ড আর নিউ। ভালোই বলেছিস তুই। হেসে বলল, চুমকি।

রংকিনী বলল, বাজে কথা বলিস না।

কী বাজে কথা! আগে আমরা জানতাম না? Sweet Seventeen yet unkissed. হায়। হায়। আমি এখন সুইট থার্টিফার অথচ ইয়েট আনকিসড। কেউ বিশ্বাস করবে? বল?

 রংকিনী হেসে উঠল চুমকির কথাতে। এইরকম করেই কথা বলে ও, সেই স্কুলের দিন থেকেই।

চুমকির বাবার বিশ্বজোড়া ব্যাবসা। কোটিপতি মানুষের মেয়ে, নিজেও নিজের দাবিতে কোটিপতি না হলেও মিলিয়নিয়র তো অবশ্যই। কিন্তু শিশুকাল থেকেই কোনোরকম চালিয়াতিই করতে দেখেনি রংকিনী চুমকিকে। চমৎকারভাবে মানুষ করেছিলেন মাসিমা তাদের এক ছেলে আর দুই মেয়েকে। এমন বড় একটা দেখেনি রংকিনী বাঙালি কোটিপতিদের মধ্যে, যদিও তার কাজের সূত্রে অনেক কোটিপতিদের সঙ্গেই মিশতে হয়েছে। ও হয়।

চুমকি বলল, সত্যি। আমরা এক্কেবারেই যা তা।

রংকিনী বলল, আমি তো তোর চেয়েও একবছরের বড়ো। প্রায় বুড়িই বলতে পারিস। বিয়ে-টিয়ে ছেড়ে দে, আজ পর্যন্ত একটা অ্যাফেয়ারই হল না।

শারীরিক অ্যাফেয়ারের কথা বলছিস?

দুস। সে তো কুকুরিদেরও হয় যখন তখন। মনের অ্যাফেয়ারের কথা বলছি। রিয়্যাল অ্যাফেয়ার।

এমন মুখ করে রংকিনী কথাটা বলল, যেন ধনেপাতা আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখা একপ্লেট চালতাই কেউ নিয়ে গেল ওর হাত থেকে ছিনিয়ে।

রংকিনী বলল, সত্যি! আমাদের মতন কেরিয়ার-গার্লদের বিয়ে-টিয়ে করা পোষায়ও না। এই তো রিমা বিয়ে করল সে-দিন!

কোন রিমা?

আরে প্রেসিডেন্সির। আবার কোন রিমা? বাচ্চাও হল। বাচ্চাটাকে একেবারেই দেখতে পারত না। হাউ জুয়েল অফ হার। লোকে কুকুরের বাচ্চাকেও ওর চেয়ে যত্ন করে মানুষ করে। বাচ্চা যখন ছ-মাসের তখনই তার বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। সে নাকি হোমো হয়ে গেছে। শ্যামল সেনগুপ্ত।আ স্টুপিড গাই। আমি অবশ্য একবারই মিট করেছি তাকে। কী করে যে রিমা অমন একটা শিং-হীন হামবাগ ছাগলকে বিয়ে করল জানি না।

ইশ। বলিস কী?। হাউ স্যাড।

আর স্যাড! সারাপৃথিবী জুড়েই তো এখন ছাগলদের রাজত্ব। হোমো আর লেসবিয়ানদেরও রাজত্ব। সমস্তরকম স্বাভাবিকতাকেই পশ্চিমি পৃথিবী বিসর্জন দিতে বসেছে। আমরাও অন্ধর মতন অনুগমন করছি তাদের। আমার আন্দামানে আসা তো এইজন্যেই। সেই মানুষটার সঙ্গে দুটো কথা বললেই আমি সঠিক পথের নির্দেশ পাই। আই ক্যান কারেক্ট মাই বেয়ারিংস। আই মিন ইট। রিয়্যালি!

রংকিনী একটু অবাকই হল। তাকিয়ে থাকল চুমকির মুখের দিকে। এমন সময়ে ওর বিস্ময়কে বোমার মতন বিস্ফারিত করে প্লেনটা ল্যাণ্ড করল।

ভেরি ব্যাড ল্যাণ্ডিং।

চুমকি স্বগতোক্তি করল।

 ব্রেকও করল ক্যাপ্টেন খুবই জোরে। পাখির ডানার মতন ডানা উঁচিয়ে প্লেনের ব্রেক যখন কাজ করে তখন দেখতে বেশ লাগে।

এয়ারপোর্টটি যথেষ্ট লম্বা নয় এবং সেইজন্যেই অত জোরে ব্রেক করতে হল হয়তো।

ভাবল, রংকিনী।

প্লেনটা ট্যাক্সিইং শেষ করে টারম্যাকের শেষপ্রান্তে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পার্কিং-বে তে এসে যখন নিশ্চল হল, ওরা নিজেদের হ্যাঁণ্ডব্যাগ নিয়ে উঠল সিট ছেড়ে।

প্লেনের বাইরে এসেই খুব ভালো লাগল রংকিনীর। ভারি শান্ত জায়গা। সমুদ্রের মধ্যে ঘন সবুজ পাহাড়ে আর জঙ্গলে ঘেরা দ্বীপ। মাঝে মাঝে সবুজ কাঁচুলি-ঘেরা লাল মাটির বুককে চিরে কালো পিচ-এর পথ চলে গেছে। শান্ত, নির্জন, অন্যরকম।

 রংকিনী স্বগতোক্তি করল, বা:! এতদিনে আসা হল আন্দামানে!

Bay Island Resorts-এর মাঝারি সাইজের বাসটি দাঁড়িয়েছিল এয়ারপোর্টের বাইরে। লাগেজ এলে, দুজনে নিজেদের লাগেজ শনাক্ত করার পরে হোটেলের লোকই লাগেজ নিয়ে গিয়ে বাসে তুলল। তার পর ওরা দুজনে হ্যাঁণ্ডব্যাগ হাতে সেই বাসের দিকে এগোল। ওপরে সুনীল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ। হু হু করে হাওয়া আসছে আড়ালে-থাকা সমুদ্র থেকে। অবকাশ, অবসর, নিজেকে, নিজের বড়ো ভালোবাসার শরীর এবং মনকে পুনরাবিষ্কারের ছুটি।

খুব জোরে একটি প্রশ্বাস নিল রংকিনী আকাশে মুখ তুলে।

ড্রাইভার এসে বসল ড্রাইভিং সিট-এ। বাসটা ছেড়ে দিল। মাসটা ডিসেম্বর হলে কী হয়, বেশ গরম। রোদ, এই সকালেই চড়া। তবে হু হু হাওয়া আছে। সমুদ্রপারে যেমন হয়। লক্ষ করল রংকিনী যে, এই হাওয়াটা আদ্র নয়, যেমন হবে ভেবেছিল।

কেন যে নয়, তা ও বলতে পারল না।

.

০৩.

 হর্নেটস নেস্ট দ্বীপ থেকে পোর্টব্লেয়ারে যখন কাজে আসতে হয় আহুককে তখন সে-দিনেই ফেরা যায় না বলেই রাতটা বে-আইল্যাণ্ড হোটেলেই থাকেন। তার মালকিন চুমকি রায়-এর তেমনই ইনস্ট্রাকশান দেওয়া আছে এই হোটেলে। টাকা তাঁকে দিতে হয় না। সই করে দেন বিল। কলকাতার অফিসে বিল চলে যায়, সেখান থেকেই পেমেন্ট আসে সরাসরি।

 ভোর কি হয়ে এল?

রেডিয়াম-দেওয়া হাতঘড়িটা বেডসাইড টেবল থেকে তুলে ইচ্ছে করলেই দেখতে পারতেন। কিন্তু দেখলেন না। সাম্প্রতিক অতীত থেকে সময়কে নিঃশর্ত ছুটি দিয়ে দিতে ইচ্ছে যায়। আসুক দিন, যখন তার খুশি, যদি তার ইচ্ছে হয়।

 রাতের বেলাই এইরকমই মনে হয় আহুক-এর। রাতে বিছানা ছেড়ে উঠলে, জানালার পাশে বা বারান্দাতে এসে দাঁড়ালে আজকাল প্রায়ই এরকম হয়। যৌবনের দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়, ছেলেবেলার বই-এর ওপরে সাঁটা জলছবিরই মতন। কিন্তু সেইসব ছবি অতীতকালের ছবি। স্মৃতির পান্ডুলিপিতে বহুবর্ণ কিন্তু প্রাণহীন প্রজাপতিরই মতন সেঁটে গেছে। আজ তারা উঠে এসে, জীবনে এঁটে বসবে যে, তার কোনোই উপায় নেই। সাধ্য নেই কারোই যে, সেইসব ছবি অতীত থেকে তুলে এনে তাঁর আজকের জীবনে ফিরিয়ে আনে। অন্য কারো তো নেই-ই, আহুক-এর নিজেরও নেই।

শেষরাতে আবারও উঠলেন তিনি পোর্ট ব্লেয়ারের এই বে-আইল্যাণ্ড হোটেলের সমুদ্রমুখী ঘরের বিছানা ছেড়ে! টয়লেটে গেলেন। নিশুতি রাতে ফ্লাশ-টানার শব্দে দু-একবার নিজেই চমকে উঠলেন। ভয় পেলেন যে, পাশের ঘরের মধুচাঁদা দম্পতির ঘুম বুঝি ভেঙে যাবে। হয়তো ভেঙে যাবে এই নিদ্রামগন দ্বীপের রাতের ঘুমও। লজ্জা হয়, নিজের ইনকনসিডারেশানের জন্যে, নিঝুম নিস্তব্ধ পরিবেশে এইরকম আকস্মিক জলজ শব্দ করার জন্যে। আসলে, দূর সমুদ্রে এক জনমানবহীন দ্বীপে একেবারে একা থেকে কনসিডারেশান ফর আদারস কথাটাই তিনি ভুলে যাচ্ছেন। জংলি স্বভাবের তিনি চিরদিনই ছিলেন। এখন নব্বই ভাগ জংলি হয়ে গেছেন স্বভাবে, চরিত্রে। আরও কিছুদিন থাকলে হয়তো আন্দামান নিকোবরের ওঙ্গে, শোম্পেন এমনকী জারোয়াদেরই মতো হয়ে যাবেন।

পুরোপুরি জংলি হওয়া বড়ো সুখের। মুশকিল এই আহুকদের মতন আধা জংলিদেরই!

জীবনের পথে বহুদূর হেঁটে আহুক বোস আজকে বুঝেছেন যে, একজন মানুষ, সে মানুষ যদি প্রকৃতই সৎ হন, যদি ভন্ড ও খল না হন, যদি মিথ্যাচারী হন, তবে তিনি নিজেকে যতখানি ঘৃণা করেন সেই ঘৃণা তাঁর প্রতি পৃথিবীর অন্য সকলের ঘৃণার যোগফলের চেয়েও অনেকই বেশি হয়। ব্যাপারটা বৈপরীত্যর সংজ্ঞা যদিও। কিন্তু সত্যি। এক-শো ভাগ সত্যি।

আশ্চর্য। তেষট্টি বছর বয়েসে পৌঁছে আজ কত কী-ই না ভাবেন, বোঝেন তিনি, যেসব ভাবনা পঞ্চাশে বা চল্লিশে বা তিরিশেও ভাববার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না। একজন পাঁচটি যুগ পার হয়ে এসে, নিজের আয়ুর প্রায় সবটুকুই খরচ করার পরে যা বোঝেন, যা জানেন, তা তার পক্ষে আগে ভাবা বা বোঝা বোধ হয় আদৌ সম্ভব হয় না। অথচ এমনই, নীতি এবং রীতি এই মনুষ্য জীবনের যে, তাঁর চেয়ে কমবয়েসি কারো হাতেই তাঁর জীবনময় অভিজ্ঞতার ছিটেফোঁটাও যে তুলে দিয়ে যাবেন যাওয়ার আগে, তাও হওয়ার নয়। হয়তো সব মানুষের চরিত্রই এই যে, অন্যের শিক্ষাতে শিক্ষিত হতে তাঁরা কেউই আদৌ চান না। যা তাঁরা শেখেন যতটুকু শেখেন, তা নিজেরই হাত পুড়িয়ে, ভুল কুড়িয়ে। আহুক-এর তাই যেমন অন্যের কাছেও শেখা হয়নি কিছু, তাঁর নিজের জীবনভর অভিজ্ঞতাও শেখানো হয়নি কারোকেই। সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, একজনও শিখতে চায়ওনি।

পোর্ট ব্লেয়ারের বে-আইল্যাণ্ড হোটেলের এই সমুদ্রমুখী ঘরটার একদিকে সিলিং থেকে নীচ অবধি কাঁচের স্লাইডিং-ডোর, যে-দিকে সমুদ্র। সেই কাঁচের দরজা খুললেই একটি সমুদ্রমুখী বারান্দা। পর্দাটা সরিয়ে, বাতানুকুল ঘরের ভেতরেই দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালেন উনি। শেষরাতে এখন বাইরের সমুদ্রর ওপরে এলমেলো হাওয়া, তবে গরম তেমন নেই। সন্ধের পরই ঠাণ্ডা হয়ে যায় যদিও তবু ওই হাওয়ার এলমেলোমি থেকে বাঁচতেই স্লাইডিং-ডোর টেনে এয়ার কণ্ডিশনার চালিয়েই শুয়েছিলেন। আইল্যাণ্ডটি ডান দিকে দেখা যাচ্ছিল একটি অন্ধকার পিন্ডর মতন হোটেলের সুইমিং পুল-এর পাশের ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে। আজ শুক্লা পঞ্চমী কিন্তু পূর্ণিমাতেও দূর সমুদ্রের দ্বীপকে রহস্যময় এবং কালোই দেখায় দূর থেকে।

এলমেলোমি আর অগোছালোমিই একদিন আহুক বোস-এর জীবনের নিশান ছিল অনেকই দিন। এখন এলমোলোমিকে উনি খুবই ভয় পান। জীবনের সবক্ষেত্রেই পা ফেলার আগে বহুবারই ভাবেন। সাহস কমে গেছে। কমে গেছে শরীরের বল। রিপুরা একে একে ঘুমোতে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে নিজেকে, নিজের পরিবেশ প্রতিবেশকে একটু গোছগাছ করে রেখে যেতে চান। যেন কেউই না বলতে পারে যে, মানুষটা পৃথিবীকে মলিন করে দিয়ে গেছিল। মনে পড়ে যায় যে, তাঁকে ছেড়ে যাওয়া স্ত্রী টিটিঙ্গি খুবই গোছানো ছিল। এই সংসারে কার যে কোনটা গুণ আর কোনটা দোষ তা যখন বোঝা উচিত তখন আদৌ বোঝা যায় না। বোঝা যায় অনেকদিন পরে। যখন সে মরে যায়, কী ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তখন ভুল শোধরাবার আর উপায় থাকে না কোনো। তখন বোঝেননি, বোঝেন এখন। অন্যকে বুঝতে বুঝতেই জীবন শেষ হয়ে যায়। প্রত্যেকেরই জীবন। সময়ে যদি বোঝা যেত তবে কী সুন্দরই না হত সকলেরই জীবন।

আজকে বিকেল থেকেই সমুদ্র ভারি অশান্ত। অবিরত বড়ো বড়ো ঢেউ ভাঙছে। কত যুগের অব্যক্ত প্রেম আর বিরহ, হাসি আর কান্না যেন গুমরে গুমরে ওঠে বালুবেলাতে সমুদ্রের ভেঙেপড়া ঢেউগুলির বুকের মধ্যে থেকে। ফসফরাস হঠাৎ হঠাৎ আলতো উজ্জ্বল হাত বুলিয়ে দিয়ে যায় ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্তের অগণ্য ঢেউয়ের মাথাতে আর গায়ে, কোনো নারীর চকিত প্রেমের অস্ফুট অভিঘাতের মতন। তার পর লোলচর্ম বুড়ির স্বগতোক্তির মতন বিড়বিড়–ফিস ফিস করে সমুদ্র চাপা কান্না কাঁদে, তটে গড়াতে গড়াতে। মৎস্যগন্ধি হাওয়াতে তটময় দৌড়ে-বেড়ানো কাঁকড়ারা তাদের ছোটো ছোটো বাঁকা হাতে সান্ত্বনা দিতে যায় চিরদিনের একা সমুদ্রকে। কিন্তু সমুদ্র সান্ত্বনা নেয় না কারোরই, যদিও সে জন্ম-একা, যদিও সে অনাদিকাল থেকেই এমনই নিরবধি নিরুচ্চারে কাঁদে।

এই বাবদেই আহুক বোস ভাবেন সমুদ্রর সঙ্গে তাঁর যেন মিল আছে কোথায়। সমুদ্র এবং তাঁর নিজের একলা বুকেও এপর্যন্ত অনেকই এঁটেছে। জীবনে অনেকই পেয়েছেন সমুদ্র এবং আহুকও। কিন্তু কোনো প্রাপ্তিকেই তাঁদের ক্ষুদ্র মালিকানার ঘোরাটোপে শুধুমাত্র নিজেদেরই কুক্ষিগত করে রাখবার মতন নীচ মনোবৃত্তি ছিল না তাঁদের দুজনের কারোরই। যা কিছুই সমুদ্র নেয়, তা আবার ফিরিয়েও দেয় অবলীলায়, সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে। সে ফুলই হোক, কি শব।

এমন এমন রাতে, আজকাল এমন এমন এলমেলো ভাবনা হঠাৎ-ভাঙা ঢেউয়ের মাথাতে ঝিলিক দিয়ে ওঠা ফসফরাস-এরই মতন হঠাৎ হঠাৎ-ই তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে জ্বলে উঠেই নিভে যায়।

 সমুদ্র মস্ত বড়ো, গহন, গভীর। অসীম তার রহস্য। সর্বগ্রাসী জিগীষা নিয়েও মানুষ এখনও তল পায়নি এই অতল রহস্যের। মধ্যরাতে সমুদ্রের দিকে চেয়ে উনি ভাবছিলেন, মানুষের ঔৎসুক্য বড়ো বেশি নোংরা। প্রকৃতির সব গোপন রহস্যই, সে তার নোংরা আঙুলে ছিঁড়ে ছেনে দেখতে চায়। মূর্খ পুরুষেরা জানে না যে, প্রকৃতির আর নারীর সব মাধুর্যই তাদের রহস্যময়তারই মধ্যে।

গতকাল দুপুরে পোর্ট ব্লেয়ারে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি অসময়ের ঝড়টা হঠাৎ-ই এসেছিল, প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে। ওই দুর্যোগের মধ্যে মনো-ইঞ্জিনের বোটে করে একা একা প্রায় কুড়ি knot দূরে তাঁর নিজের দ্বীপে পৌঁছোনোর চেষ্টা করা আর আত্মহত্যা করা সমার্থকই ছিল। তাঁর জীবন এখন শীতের সমুদ্রের মতন টানটান। পানাপুকুরের মতন স্থির, কোনো আলোড়ন আর উঠবে না তাতে, তবু আত্মহত্যাকরার কোনো ইচ্ছে নেই তাঁর। জীবনের গতি-প্রকৃতির কথা আগে থাকতে কেই বা বলতে পারে! কার জীবনে কখন যে কী ঘটে তা জানা যায় না বলেই তো এখনও জীবন এত ইন্টারেস্টিং।

যেমন হঠাৎ দুর্বার অভিমানের মতন সে-ঝড় এসেছিল দুর্বোধ্য প্রেমিকের মতন সে হঠাৎ ই চলে গেছে রাত নামার পর পরই। এখন মধ্যরাতের আকাশ পরিষ্কার। পোর্ট ব্লেয়ারের Bay-র শেষে সমুদ্রের বিভাজক পাহাড়টির শেষপ্রান্তের নিদ্রাহীন লাইট হাউসটির আলো নিশ্চিত নিখুঁত গতি এবং যতিতে সমুদ্র এবং এই পোর্ট ব্লেয়ারকে তীব্র ঝলকানির নিঃশব্দ চাবুক মেরে যাচ্ছে বারে বারে। সেই চাবুক পড়ছে তাঁর ঘরেও। আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেল-এর ওয়াচ টাওয়ারের প্রহরীরা একসময়ে আলোর চিরুনি বুলিয়ে বুলিয়ে সেখানকার দেশপ্রেমী মুক্তিকামী কয়েদিদের সারারাত ত্রস্ত এবং বিন্যস্ত করে রাখত। বহুদূরের বাতিঘরের আলোর চাবুক কার বা কাদের বিন্যস্ত করতে চায় কে জানে!

আর এক ঘুম দিয়ে উঠলেই ভোর হয়ে যাবে। সকাল চারটেতেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যেতেই ভোরের হাওয়াটা যেন জোর হয়। এই সময়ে চিড়িয়া টাঙ্গুতে থাকলে কত বিচিত্র সব পাখির স্বর শোনা যায়। পাখি অবশ্য তাঁর দ্বীপেও অনেকই আছে। তবে যে-পাখির খোঁজ করতে এই আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে আহুক এসেছিলেন সেই পাখির দেখা আজও পাননি। হয়তো পাবেনও না। জীবনের বেলা তো পড়ে এল। প্রত্যেক মানুষই সারাজীবন ধরে কোনো না কোনো পাখি খোঁজে। সেই পাখি হরেকরকম হয়। কেউ তার পাখিকে পায়, কেউ পায় না। কিন্তু খোঁজে সকলেই।

আবার তিনি শুয়ে পড়লেন পর্দাটা টেনে দিয়ে। বাতিঘরের এই চাবুক-মারা আলোটা সব কেমন বে-আব্রু করে দিয়ে যায়, অবিন্যস্তও।

প্রথম যৌবনের অভ্যেসবশেই আহুক সম্পূর্ণ নগ্ন না হয়ে শুতে পারেন না। দূরাগত দ্বীপের সেই প্রবল শক্তিশালী আলো তাঁর নগ্নতাকে তাঁর নিজের কাছেও উন্মোচিত করুক, তা চান না তিনি। এই রাতভর আলোর চাবুককে তিনি সহ্য করতে পারেন না। হিমালয়ান ভাল্লুকের মতন একজন রোমশ পুরুষও যে, এমন প্রজাপতির মতন লাজুক হতে পারেন একথা ভাবলে তাঁর নিজেরই হাসি পেয়ে যায়। সর্ব-উন্মোচনকারী আলোকে সইতে পারেন না। কারণ, এ আলো শুধু তাঁর শরীরই নয় মনের নিভৃত ঘরেও উঁকি মারে, গোপনীয়তাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে দেয়।

ভোর হবে আজও। প্রতিরাতেই শুতে যাওয়ার আগে পরদিন ভোরের জন্যে প্রার্থনা থাকেই প্রত্যেক মানুষেরই মনে। কার জন্যে কী যে বয়ে আনবে সেই ভোর, তা কে জানে!

দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুলেন আহুক। পাশের খাটের বালিশটিকেও টেনে নিলেন পাশবালিশ করে। আজ অনেক বছর হয়ে গেল বালিশের সঙ্গেই তাঁর শোওয়া। এই বন্দোবস্তেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন পুরোপুরি। বালিশের ওপরে মাথা দেওয়া মানুষের মুখ বড়োই অস্বস্তি ঘটায়। আরামের ব্যাঘাত ঘটায়। পুরোনো দিনে, লখনউয়ের নবাব পরিবারের স্ত্রী-পুরুষেরা সকলেই গল তাকিয়া ব্যবহার করতেন। হয়তো আজও করেন। পাশ ফিরে শোয়ার সময়ে গালের নীচে নীলনদের উপত্যকার কার্পাস তুলো দিয়ে বানানো সেই আতরগন্ধি রেশমি ওয়াড়-পরানো পাতলা বালিশ নিয়ে শুতেন তারা। দু-উরুর মাঝে পাশবালিশ তো থাকতই, একটু উষ্ণতার জন্যে।

এই মুসলমান জাতটার বড়ো ভক্ত আহুক। না, হাজারিবাগের ফিরদৌসী একদিন তাঁর প্রেমিকা ছিলেন বলেই নয়। অন্য নানা কারণেও। এই জাতটা বাঁচতেও যেমন জানে, মরতেও জানে। ত্যাগের চরম যেমন করতে জানে, ভোগেরও চরম। বড়ো জিন্দা দিল, মন-মৌজি জাত এই মুসলমানেরা। স্নান করা, খাওয়া-দাওয়া, শোয়া, গান-বাজনা মনের এবং শরীরের প্রেম সব ব্যাপারেই এঁদের এক বিশেষ স্বকীয়তা আছে। এঁরা নকলনবিশ আদৌ নন।

কে জানে! কেমন আছে হাজারিবাগের ফিরদৌসী? তারও তো ষাট বছর বয়েস হতে চলল। নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার। চুল পেকে গেছে নিশ্চয়ই। তবে ফিরদৌসীর চুল পাকলে পাকা পাটের মতন সোনালি হবে সে-চুল, শনের মতো সাদা হবে না। হয়তো কিছু দাঁতও পড়ে গেছে। চোখে উঠেছে চালশে চশমা। হয়তো। তা হোক। ভালোবাসার জনকে পাকা-চুলে, ভাঙা দাঁতে দেখতে আরও বেশি ভালো লাগে। কলপ যারা লাগায়, কী পুরুষ কী স্ত্রী, সেই মানুষগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ভন্ড হয়। আহুক, ভন্ডামির মতন ঘৃণা আর কিছুকেই করেন না। অথচ ভন্ডদেরই তো রাজত্ব এখন।

চারদিক সমুদ্র-ঘেরা এক নির্জন দ্বীপে থাকেন বলে সুখেই আছেন তিনি। নানারকমের সুখে। তাঁর মনের বনের মধ্যেই যেসব চেনা-অচেনা অন্য প্রাণীদের বাস তারা ছাড়া বাইরের কেউই পারে না তাঁর শান্তি নষ্ট করতে।

আবারও একসময়ে ঘুমিয়ে পড়লেন উনি নানা অসংলগ্ন ভাবনার এলমেলোমির অলিগলিতে হারিয়ে গিয়ে। যখন জাগবেন তখন আর স্বপ্ন থাকবে না কোনো। থাকবে না কোনোরকম অহংকারের বা হীনম্মন্যতার অস্পষ্টতাও। দিন বড়ো বেশি স্পষ্ট। রাতের বেলার তাঁর প্রতিরাতের নগ্নতারই মতন। নগ্নতা বা দিন সুখের এবং নিশ্চিন্তির হয়তো হতে পারে, আরামেরও হতে পারে, কিন্তু সুন্দর কখনোই নয়। যেখানে অথবা যাতে অস্পষ্টতা নেই, রহস্য নেই, অতিসামান্য হলেও, আড়াল নেই, তাকে সুন্দর বলে কখনোই মানা যায় না। আহুক অন্তত মানেন না।

কাল সকাল কি ওঁর জন্যেও সুন্দর কিছু বয়ে নিয়ে আসবে? নতুন কিছু? প্রতিরাতেই মাঝরাতে উঠে যখন দ্বিতীয়বার ঘুমোন তখন এই ভাবনা আসে তাঁর মাথাতে।

বিফল সুখ আশে জীবন কি যাবে? কবে আসিবে হরি, কবে পথ দেখাইবে অতুলপ্রসাদের সেই গানখানি মনে আসে। নীপুদিদি বড়ো ভালো গাইত গানটা। নীপুদিদি এখন কোথায় কে জানে! ভরা তেইশ বছর বয়েসে হাজারিবাগের রিফরমেটরির লেক-এ ডুবে মরেছিল। গলাতে পাথর বেঁধে, লাফিয়ে পড়েছিল জলের ওপরে ঝুঁকেপড়া একটা পিপ্পল গাছের ডাল থেকে। পাশের বাড়ির নীপুদিদি খুব ভালোবাসত আহুককে। জীবনে অনেক নারীর ভালোবাসাই পেয়েছেন আহুক আজ অবধি কিন্তু সে এক অন্যরকম

সমুদ্রে যখন মাছ ধরার জন্যে একটা নৌকো নিয়ে ভেসে যান আহুক, যখন সন্ধে হয়ে আসে, নীল-সবুজ জল যখন বিষণ্ণ কালো হয়ে ওঠে যখন সন্ধেতারাটা ওঠে সামুদ্রিক দিগন্তে তখন কোনো কোনো সন্ধেতে নীপুদিদি তাঁর সঙ্গে কথা বলে জলের নীচ থেকে। নীপুদিদি মাত্র দু-বছরের বড় ছিল আহুক-এর চেয়ে।

চারদিকে সমুদ্র-ঘেরা আন্দামানের এইসব দ্বীপে, এই নির্মম নির্জনতায় এখনও অনেকই রহস্য বেঁচে আছে। সেইসব রহস্য কখনো-কখনো ভয় পাওয়ায় মানুষকে কিন্তু অধিকাংশ সময়েই আনন্দও জোগায়। অনাবিল আনন্দ। সেই আনন্দকে এইসব দ্বীপের বিষণ্ণতারই মতন ব্যাখ্যা করে বলা যায় না।

বোঝাই যায় না, আর বলা!

.

০৪.

চুমকি আর রংকিনী পোর্ট ব্লেয়ারের একটি পাহাড়ের ওপরের বে-আইল্যাণ্ড হোটেলের রিসেপশনের একতলায় নীচের, সমুদ্রমুখী, দাওয়াহীন বসার ঘরে একেবারে রেলিং ঘেঁষে বসেছিল। যাতে, সমুদ্রর সবচেয়ে কাছে বসা যায়। এখান থেকে ঢিল ছুড়লেই সমুদ্র পড়ে। বাঁ-দিকে Bar৷ এই বার-এ হোটেলে যাঁরা থাকেন, তাঁরা ছাড়া বাইরে থেকেও কিছু মানুষে আসেন। তবে সভ্য-ভব্য। বার শব্দটাই যেমন অনেকের মনে ভীতির উদ্রেক করে তেমন ভীতিজনক নয় এই বার। বার-এ ভিড়ও খুব কম।

দুপুরের খাওয়ার পরে সেলুলার জেল দেখে এসে, আকুয়া-স্পোর্টস কমপ্লেক্স-এ সমুদ্রের মধ্যে স্পিডবোট চালানোর পর ওই হোটেলরই একটা টাটা-সুমে গাড়িতে চেপে ওরা হোটেলে ফিরে চান-টান করে এসে এখন বারান্দাতে বসেছে। সকালে প্লেন থেকে নামার পরে ব্রেকফাস্ট করে ঘুম লাগিয়েছিল। কী ঘুমেই যে ধরেছে ওদের! অবিরত টেনশানে টানটান স্নায়ু এই ছুটিতে, এই নির্জনতায় এই অবকাশে যেন একেবারে শ্লথ হয়ে গেছে। দিলরুবার তার সব ঢিলে করে দিলে কোনো ভ্যাবাচ্যাকা কাঁচপোকা তাতে উড়ে এসে বসলেও যেমন তা ঝংকৃত হয় না তেমনই এখন ওদের মন ঢিলে হয়ে গেছে। শায়ার বা সালোয়ারের দড়ি ঢিলে দিলে যখন মন শুধু ঢিলেই হয় না, প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত নানা ঘটনার জন্যেও তৈরি থাকে অথচ উদবিগ্ন থাকে না আদৌ, ওদের মনের অবস্থাও এখন প্রায় সেরকমই।

একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ার আরও অনেকই পুবে। তা ছাড়া এখানের চারিদিকেই হাজার মাইল সমুদ্র বলে তাতে দিনের আলো অনেকক্ষণ ধরে প্রতিফলিত, প্রতিসারিত হয়। তাই মনে হচ্ছে, সন্ধে নামতে নামতে কম করে সাতটা-সোয়া সাতটা হয়ে যাবে।

মিনিট পনেরো আগে পশ্চিমের আকাশ কালো করে বৃষ্টি এসেছিল। হাওয়া উঠেছিল এলমেলো। বন্দরে এখনও ড্রেজিং হচ্ছে মনে হয়। একটা ছাদওয়ালা দু-পাশ খোলা অদ্ভুত আকৃতির মোটরবোট গেরুয়া-রঙা বালি ভরতি করে বন্দরের দিক থেকে এসে বাইরের খোলা সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। কোথায় যে বালি ফেলছে তা হোটেলের বারান্দাতে বসে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ বাদে বাদে খালি বোটটা আবার ফিরে আসছে বন্দরের দিকে। কে জানে! সকাল থেকেই হয়তো যাতায়াত করছে বোটটা। ওরা দুপুরে দোতলার খোলা ডাইনিং রুমে বসে খাবার সময়েও লক্ষ করেছে। বৃষ্টি এখন থেমে গেছে কিন্তু আকাশে মেঘ আছে। সেই মেঘের আড়াল ভেদ করে এক আশ্চর্য সুন্দর কোমল আলো ফুটেছে যা বসন্তের রিক্ত বনের প্রাক-সন্ধের কনে-দেখা আলোর মতো নয়। এ আলোর রংটা ঠিক কমলা নয়, সাদাটে। কিন্তু অনেক বেশি বিধুর।

 রংকিনী ভাবছিল, এই আলোর রঙের নামটি পৃথিবীর কোনো শিল্পীর প্যালেট খুঁজেই পাওয়া যাবে না। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আঁকা এ ছবি। সামনের পাহাড়টি, ডান দিকের রস আইল্যাণ্ড, সামনের সমুদ্র সে যে কী এক আশ্চর্য সুন্দর বৈধব্যর বেশ পরেছে তা অবর্ণনীয়।

এমন সময় অশ্রুতপূর্ব একটা আওয়াজ করে একজোড়া বেশ বড়ো সামুদ্রিক পাখি রস আইল্যাণ্ডের দিক থেকে উড়ে বাঁ-দিকে গেল। ঝুঁকে পড়ে, পাখি দুটিকে দেখল ওরা। পাখি দুটির পেটটুকুই শুধু দেখতে পেল। রুপোলি পেট। মস্ত বড় বড়ো পাখি। তবে হাঁস নয়।

কী পাখি রে? জানিস?

 রংকিনী জিজ্ঞেস করল চুমকিকে।

 চুমকি বলল, এসব পাখি-ফাঁকি চেনেন মিস্টার বোস। যখন আলাপ হবে তখন বিবরণ দিয়ে জিজ্ঞেস করিস, তিনি ঠিক নাম বলে দেবেন।

তার পরে হেসে, দক্ষিণ-বাংলার ভাষায় বলল, পাখির মইদ্যে আমি চিনি শুধু মদনটাকী!

সেটা কী পাখি?

কে জানে? মাতলা নদী বেয়ে একবার বোটে করে পিকনিক-এ গেছিলাম। উঁচু ডাঙাতে বসে-থাকা পাখির নাম বলেছিল সারেং।

তাই?

বলেই, অন্যমনস্ক হয়ে গেল রংকিনী। কেন যে হল, তা ও নিজেই জানে না।

সেলুলার জেল-এর সিঁড়ি উঠতে উঠতে চুমকি নাম বলেছিল তার ম্যানেজারের। অদ্ভুত নাম। আহুক বোস। ডাহুক পাখির কথা শুনেছে। দেখেওছে কয়েকবার বহরমপুরের মামাবাড়ির পেছনের ডোবাতে। কিন্তু আহুক শব্দটি কখনো শোনেনি। কী মানে, তা কে জানে!

আহুক!

চুমকি সে ভদ্রলোক সম্বন্ধে অনেক কিছু উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বললেও একজন বৃদ্ধ ভাম সম্বন্ধে ওর কোনো ইন্টারেস্টই জন্মায়নি। বয়েসটা যদি পঁয়তাল্লিশের মধ্যেও হত তাহলেও না হয় পান্ডববর্জিত দ্বীপে একটা মেমোরেবল অ্যাফেয়ার হলেও হয়ে যেতে পারত। অনেকই বেলা বয়ে গেছে জীবনে অনবধানেই। অনেক সুদর্শন কৃতবিদ্য যুবক তাকে চেয়ে ফিরে গেছে। মনস্থির করতে পারেনি রংকিনী। প্রাইভেট সেক্টরে যে-ধরনের প্রতিযোগিতার এবং অত্যন্ত বেশি মাইনের চাকরি সে করে, তাতে কেরিয়ার আর বিয়ে একসঙ্গে সহবাস করে না। ও, এ জীবনে অন্য নদীতে ভেসে গেছে। এখন আর উজান বেয়ে ফেরা যাবে না। তাই এত এবং এতরকম যুবাকে অবহেলা করে আজ কোনো বুড়োর প্রতি কোনো কারণেই কোনো আকর্ষণ বোধ করার প্রশ্নই ওঠে না। রংকিনীর সময় বড়ো কমই বাকি আছে, হাতে। সেইসময় নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোনো ইচ্ছে অথবা উপায়ই তার নেই।

কী সুন্দর লাগছে, না রে রংকিনী?

চুমকি স্বগতোক্তির মতো বলল।

হুঁ।

রংকিনী বলল। স্বগতোক্তিরই মতো যেন অনেকই দূর থেকে।

তার পর বলল, কী করে সন্ধে হয়, কী করে ভোর আসে তা শুধু প্লেনের জানালা দিয়েই দেখি আজকাল। পৃথিবীটা যে এত সুন্দর তা ভুলেই গেছিলাম যেন। না থামলে কি এসব দেখা যায়? শুধু চলা আর চলা। অবিরত।

অনেক বছর আগে রিডার্স ডাইজেস্ট-এ একটি লেখা পড়েছিলাম, জানিস, হাউ ইভিনিং কামস। কার লেখা মনে নেই, কিন্তু লেখক ঠিক এই কথাটিই লিখেছিলেন। দিন কী করে আলোকিত হয় আর সেই আলো কী করে নেভে তা দেখার সময়টুকু আমাদের কারই বা আছে আজকাল! অথচ এইসবই আশ্চর্য আনন্দর আধার। সিম্পল, ইনোসেন্ট প্লেজারস। এসব দেখার চোখই হারিয়ে গেছে আমাদের।

রংকিনী বলল অনুশোচনার গলাতে, যা বলেছিস।

চুমকি একটু চুপ করে থেকে মুখ তুলে বলল, একটা গান শোনাবি রংকি? কতদিন তোর গান শুনিনি।

তার পর যেন হঠাই মনে পড়ে যাওয়াতে বলল, মনে আছে? স্কুলে আমরা রবীন্দ্রনাথের কালমৃগয়া করেছিলাম। তুই ঋষিপুত্র সেজেছিলি। কী সুন্দর দেখাচ্ছিল তোকে।

রংকিনীর মুখ, ফেলে-আসা ছেলেবেলার কথা মনে হওয়াতে এক আশ্চর্য সুন্দর হাসির আভাসে আভাসিত হল, বাইরের এই সুন্দর সামুদ্রিক সন্ধের বিধুর অনুপম আলোরই মতো।

রংকিনী বলল, মনে নেই আবার!

 বেলা যে চলে যায় ডুবিল রবি।
ছায়ায় ঢেকেছে ঘন অটবী।

আর তুই হয়েছিলি লীলা। তোকেও দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছিল।

ও দেখবি রে ভাই, আয় রে ছুটে, মোদের বকুল গাছে
 রাশি রাশি হাসির মতো ফুল কত ফুটেছে।
কত গাছের তলায় ছড়াছড়ি গড়াগড়ি যায়
ও ভাই সাবধানেতে আয় রে হেথা দিস নে দলে পায়।

ওরা দুজনে একসঙ্গে হেসে উঠল। বহুদিনের পুরোনো কথা মনে পড়ে যাওয়াতে রংকিনী বলল, মনে আছে চুমকি, তোর শাড়ি খুলে গেছিল স্টেজে।

খুব জোরে হেসে উঠল রংকিনী।

চুমকি বলল, মনে আবার নেই। মিস চ্যাটার্জি যা বকেছিলেন না! কান্নার চোটে আমার মেক-আপই গলে গেছিল।

সত্যি! ছেলেবেলার দিনগুলো যে কী ভালো ছিল, তাই না?

মেয়েবেলা বল। বলল, রংকিনী। তসলিমা নাসরিন কয়েন করেছেন শব্দটা।

তাই?

যে-দিনগুলো চলে যায় সেগুলোই সুন্দর। প্রতিদিনই আজকের চৌকাঠে পৌঁছে মনে হয় গতকালটি কী চমৎকার কেটেছিল।

তা ঠিক।

জানিস তো? মিস চ্যাটার্জির বডোমেয়ে রিমির ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছে?

ইশ! তাই? বেচারি।

এবং সে-কারণেই যার সঙ্গে তার বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেছিল তার পরিবার বিয়ে ভেঙে দেন। ডান দিকের বুক কেটে বাদ দিতে হয়েছে।

কী বাজে ব্যাপার। পুরুষগুলো আমাদের কী মনে করে বল তো? আমরা কি দুধেল গাই? একটি বুক কাটা গেছে বলে ওই বয়সের মিষ্টি মেয়েটিও বন্ধু হিসেবে গ্রহণীয়া নয়? আনথিঙ্কেবল।

 তার পরই বলল, গাইবি না একটা গান? তুই কিন্তু খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতিস। রিয়্যাল রবীন্দ্রসংগীত। আজকাল অনেক গায়িকা বাজারে ক্যান্টার করে বেড়াচ্ছে, কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে যে চিল-চিৎকারের অমিল আছে, গলা ভালো হলেই যে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া যায় না, একথাটাই তাঁরা বোঝেন না। সেদিন দীপালি নাগ বাংলা অ্যাকাডেমির একটা সেমিনারে বলছিলেন আজকাল চিৎকার করাটাই রেওয়াজ কিন্তু আগেকার দিনে বড়ো বড়ো মহিলা গাইয়েরা অনেকেই G Scale-এ গাইতেন। তাই?

হ্যাঁ রে।

এইসব হাস্যময়ী-লাস্যময়ীরা তো শুধু আধুনিক গান গাইলেই পারেন। নয় তো যাত্রাতেও চলে যেতে পারেন স্বচ্ছন্দে। বছরে কুড়ি-পঁচিশ লাখ রোজগার করবেন অনেকেই। এইসব নব্যযুগের রবীন্দ্রসংগীত গাইয়েরা, কী পুরুষ, কী নারী, একবছরেই যা রোজগার করছেন তা সারাজীবনেও সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, জর্জ বিশ্বাস বা সুবিনয় রায়রা করেননি। রবীন্দ্রসংগীত এদের কাছে নিছকই টাকা রোজগারের মেশিন। নিষ্ঠা, নিবেদন, শ্রদ্ধা কিছুই নেই।

 Bad money drives away good money, বুঝলি না! এখন জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইকনমিক্স–এর সেই Gresham সাহেবের Maxim-ই চালু হয়েছে। ওইসব গাইয়েদের মধ্যে অনেকের আবার ধারণা শুধুই রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে যাঁরা আজীবন সাধনা করলেন তাঁরা নাকি ঈর্ষায় কাতর হয়ে পড়েছেন নতুনদের রোজগার দেখে। বাংলাভাষাতে অনুকম্পা বলে যে একটা শব্দ আছে তা বোধ হয় এই নয়া-জমানার সর্ববিদ্যা পারংগম গায়িকারা জানেন না।

শুধু গায়িকাই কেন? তেমন তেমন লাঠি-ঘোরানো রঘু ডাকাতের মতন গায়কও কি এসে উপস্থিত হননি রঙ্গমঞ্চে? দাড়িওয়ালা গায়ক, গোঁফওয়ালা গায়ক, দাড়িগোঁফওয়ালা গায়ক। সবাই রবীন্দ্রসংগীতের অথরিটি। তাঁরা সব নতুন টার্গেটঅডিয়েন্স খুঁজে বেড়াচ্ছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যেন অন্তরীক্ষ থেকে তাঁদেরই শরণাপন্ন হয়েছেন, অ্যাড-এজেন্সিরই মতন, তাঁর গানের জনপ্রিয়তা বাড়াবার জন্যে। আসলে জনগণ বলতে রাজনীতির মানুষেরা যা বোঝেন, ওইসব গায়ক-গায়িকারা যা বোঝেন রবীন্দ্রনাথ তাঁদের জন্যে তাঁর গান কোনোদিনও বাঁধেননি। এই ইললিটারেটদের ডেমোক্র্যাসিতে প্রথম দিন থেকেই অশিক্ষিতরা এবং তাদের নিরন্তর ভোগলা-দেওয়া নেতারাই সর্ব-নিয়ন্তা হয়েছেন। Opinion of the massesz Option of the Quantitative মাসেস অ্যাণ্ড নট দ্যাট অফ দ্য Qualitative ফিউ-ই ম্যাটার করে।

এইসব গায়কদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এমনই ভূতগ্রস্ত দৃঢ়মতি, এবং নিজের বিশ্বাসে এমনই অনড় যে, বলছেন, যতদিন আমাকে ইট মেরে উড়িয়ে না-দেওয়া হচ্ছে ততদিন আমি গিটারের সঙ্গে এমন বিকৃত রবীন্দ্রসংগীতই গেয়ে যাব। তেমন তেমন গাইয়ের আবার তাবড় তাবড় রাজনৈতিক এবং সামাজিক পৃষ্ঠপোষকও জুটে গেছেন। তাঁরা Unanimous Resolution নিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের পিন্ডি না-চটকে তাঁরা আদৌ ক্ষান্ত হবেন না। বড়োলাকের শখ হিসেবে পৃষ্ঠপোষণ মন্দ শখ বলে গণ্য নয় কিন্তু পোষণ করার আগে পিঠটাকেও বাজিয়ে নেবেন না তাঁরা? সেটা কাছিমের পিঠ? না জেলিফিশের পিঠ তা তো দেখবেন।

এইসব গায়ক হয়তো জানেনই না যে, প্রকৃতই যাঁরা রবীন্দ্রানুরাগী এবং সংস্কৃতিসম্পন্ন তাঁরা ইট মারার দলে কোনো দিনও ছিলেন না। থাকবেনও না। অমন ইট-মারা সংস্কৃতির মানুষেরাই ওঁদের গান শুনতে আসেন। এবং আসবেন। তবে, কী আর করা যাবে? যাঁরা দলে আছেন, তাঁরাই আজ লাভবান। Iliterate Majority-কে তাঁদেরই মতো কিছু অসৎ ও দুষ্ট প্রকৃতির মানুষেরাই ভাঙিয়ে খাচ্ছেন। যেকোনো Tradition-ই গড়ে তুলতে লাগে বহুদিন কিন্তু তা ভাঙতে লাগে সামান্যক্ষণ। যাঁদের Conserve করার কিছু থাকে তারাই তো Conservative হন। অথচ এই বক্ৰগতি স্বার্থান্ধ মানুষদের মতেই তো রাজ্য চলছে, দেশ চলছে। স্থির পায়ে এগিয়ে চলেছে পরম সাংস্কৃতিক, সাংগীতিক, এবং সাহিত্যিক সর্বনাশের দিকে। তাতেও কি সাধ মেটেনি তাঁদের? বেচারি বুর্জোয়া রবীন্দ্রনাথকে কি ছেড়ে দেওয়া যেত না? এতদিন পরিত্যাজ্য হয়েই তো বেশি ছিলেন। হঠাৎ তাঁকে Ressurect করে এত হল্লা-গুল্লা কীসের?

তুই ঠিকই বলেছিস। কিন্তু এটাও ঠিক, যেসব পুরুষ ও মহিলা শিল্পী শুধুই রবীন্দ্রসংগীত গান, তাঁদের মধ্যেও প্রচুর আতা-ক্যালানে ও ফসস আছেন। তাঁরা অশিক্ষিতও বটেন।

আতা-ক্যালানে, ভোগলা, ফসস এইসব বিচ্ছরি শব্দ কোথা থেকে শিখলি রে তুই? তোর মুখে এসব বেমানান লাগে।

সবই শিখেছিলাম চামেলির কাছে। ভাষাতে যত নতুন শব্দ যোগ হয় ততই তো ভাষার যোশ বাড়ে। হলই বা তা স্ল্যাং।

যোশও কি বাংলা?

না। কিন্তু অন্য ভাষার শব্দ নিতেই বা বাধাটা কোথায়?

 রবীন্দ্রসংগীত যাঁরা গাইবেন তাঁদের রবীন্দ্রপ্রভাবিত হতে হবে যে, এটা মানি। রবীন্দ্রনাথের গদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ পড়তে হবে, সেই পূর্ণ মানুষটিকে জানার আন্তরিক আগ্রহ থাকতে হবে। তা না হলে, সেই রবীন্দ্রসংগীত নিছকই স্বরলিপি পঠন হবে নয়তো নিছক চ বা তথাকথিত রাবীন্দ্রিক ন্যাকামি। এই ন্যাকামির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নিজে কিন্তু কখনোই ছিলেন না।

আসল কথাটা রবীন্দ্রনাথকে যে বা যাঁরা ভালো করে না পড়েছেন, তাঁর রুচিতে আবিষ্ট না হয়েছেন, তাঁদের জন্যে রবীন্দ্রসংগীত কখনোই নয়। শিক্ষার সঙ্গে, সাহিত্যমনস্কতার সঙ্গে, সুরুচির সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত জড়িয়ে গেছে।

 তোর গলা আর গায়নভঙ্গি কিন্তু এখনও চমৎকারই আছে। গান ছাড়লি কেন?

ছাড়িনি ঠিক। এখনও শরীর ভালো থাকলে এবং মনে খুশি থাকলে চানঘরে গাই। শুধু গানই নয়, অনেক স্বপ্নই এখন শুধু চানঘরে বেঁচে আছে। আমি যেদিন নিজের বাড়ি বানাব সেদিন আমার বাড়ির মোট জমির দুই-তৃতীয়াংশ থাকবে বাগান আর বাকি এক তৃতীয়াংশর এক তৃতীয়াংশ হবে চানঘর। শিসমহলের মতন। নীচ থেকে আধমিটার ছেড়ে চার দিকের দেওয়াল তিনমিটার মোড়া থাকবে আয়না দিয়ে।

বাঃ দারুণ আইডিয়া তো। কিন্তু অমন চানঘরে একা চান করতে কি ভালো লাগবে?

বোকাই তুই একনম্বরের। দোকা হয়ে গেলে কি আর রোমান্স থাকবে অত? ঘোড়-বড়ি খাড়া খাড়া-বড়ি-থোড়। একা বলেই তো এত স্বপ্ন!

গান গাস না, তবু কী ভালোই গাইলি!

জানিস, যে-রাতে গানটা শুনলাম, সারারাত পুরবি যেন মূছনা তুলেছে আমার কানে অস্ফুট স্বপ্নের মধ্যে।

সত্যি, ভাব ব্যাপারটাই আজকাল অধিকাংশ গায়ক-গায়িকার গলাতে দেখি না। রবীন্দ্রসংগীতের কথা ছেড়েই দিলাম। যাঁরা সাহিত্যই পড়েন না তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান গাইবেন কী করে?

কখন যে বেলা পড়ে গেছে, আলো নিভে গেছে, সমুদ্রের জল কালো হয়ে গেছে। সামনের পাহাড়ের ডানপ্রান্তে লাইটহাউসের আলো জ্বলে উঠেছে। আলোটা ঘুরছে চক্রাকারে।

আজ বোধ হয়, শুক্লা পঞ্চমী, চাঁদ উঠেছে কিন্তু একফালি। মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। ভাঙা ঢেউয়ের মাথায় মাথায় লক্ষ লক্ষ রুপোলি আলোর সাপ নিয়ে খেলা করছে কোন অদৃশ্য অমোঘ সাপুড়ে।

এমনই হয়। স্কুলের দুই বন্ধুর যদি অনেকদিন পরে দেখা হয়, তাদের আর্থিক, সামাজিক, মানসিক স্থিতি যদি প্রায় একই তল-এর হয়, তবে গল্প আর শেষ হতে চায় না।

চামেলির খবর কী রে? যোগাযোগ কি আছে?

চামেলি হাওড়ার ব্যাটরা না কোথায় থাকত। পদবি ছিল কুন্ডু। ওর ঢালাইওয়ালা-ফিলদি রিচ হোঁদল-কুতকুত বাবার নাম ছিল ধ্বজা কুন্ডু। ক্লাস টেনে পড়তে পড়তেই ওদের পাড়ার একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রির সঙ্গে ও, বাড়ি ছেড়েছিল। মনে আছে? খুব ওরিজিনাল এবং প্রবল নিজস্বতার অধিকারী ছিল কিন্তু চামেলি। চোয়াড়ে চেহারা ছিল ছেলেটির। ইন্টারমিডিয়েট ফেল। কালো। মাথাভরতি চুল। লম্বা-চওড়া। আর ঘোর ক্যাবলা।

ঘোর ক্যাবলাটা আবার কী জিনিস?

ওমা। ক্যাবলার ক্লাসিফিকেশান নেই? ঘোর ক্যাবলা, ঘনঘোর ক্যাবলা, হোপলেস ক্যাবলা, আরও কতরকম আছে।

তাই?

নামও ছিল ভ্যাবলা।

এখন শুনেছি, ব্যাবসা করে খুবই বড়োলোক হয়েছে।

 তা আতা-ক্যালানে বলত কাকে চামেলি? আমার তো মনে পড়ছে না।

আরে আতা-ক্যালানে বলত ওদের পাড়ার একগাদা ফর্সা, ঘাড়ে-পাউডার দেওয়া, রাজেশ খান্নাকে নকল-করা লক্কা পায়রা ঢালাইওয়ালা, তেলকলওয়ালা, চালকলওয়ালা, পয়সাওয়ালাদের সব ছেলেদের, যারা ওকে বিচ্ছিরি হাতের লেখা এবং ভুল বাংলাতে লব লেটার লিখত।

আবারও জোরে হেসে উঠল রংকিনী।

বলল, সত্যি! তোর মনেও থাকে কিছু চুমকি!

ওরা দুজনে গল্পে মশগুল ছিল এমন সময়ে হঠাৎ দেখল একটা প্রকান্ড বড়ো এবং সাদা রঙা আলো-ঝলমল জাহাজ লাইটহাউসটা যে-পাহাড়ে আছে তার পাশ থেকে এসে নিঃশব্দে মোড় নিল। মনেই হচ্ছে না চলছে বলে, এত আস্তে আসছিল জাহাজটা। সম্ভবত জাহাজ যত বড়ো হয় ততই আস্তে চলছে বলে মনে হয়। কিন্তু সংক্ষিপ্ত হলে কী হয়, এমনই তার জোর যে, চতুর্দিকের সমুদ্রজলে এবং দ্বীপে-দ্বীপে তার অনুরণন উঠল। Bar থেকে বারম্যান-এর এক অ্যাসিস্ট্যান্ট দৌড়ে এসে ড্রইং রুম-এর কাঠের রেলিং ধরে দাঁড়াল।

বলল, হর্ষবর্ধন।

ওরাও দেখছিল। এই তাহলে কলকাতা থেকে সমুদ্রর মধ্যে দিয়ে আসা যাত্রীজাহাজ হর্ষবর্ধন!

শি শুড হ্যাভ কাম ও উইক ব্যাক। দেয়ার ওজ সাম ট্রাবল অ্যাট দ্য ক্যালকাটা পোর্ট। বারম্যান বলল।

হোয়াট ট্রাবল?

স্ট্রাইক অর বনধ, গো-স্লো অর সামথিং লাইক দ্যাট। টুমরো ইউ উইল গেট বিয়ার ফর ইয়োর শ্যাণ্ডি।

 ওরা বিকেলে ঘর্মাক্ত হয়ে ফিরে আসার পর লেমনেডের সঙ্গে বিয়ার মিশিয়ে শ্যাণ্ডি করে খাবে ভেবে বারম্যানের কাছে চুমকি বিয়ারের খোঁজ করছিল। বারম্যান বলেছিল, আমাদের বিয়ার হর্ষবর্ধনে আসছে। জাহাজ এলেই দেব।

বারম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্ট বলছিল, কলকাতা থেকে যেসব জাহাজ আসে সব এই দিক দিয়েই আসে আর ম্যাড্রাস থেকে যেসব জাহাজ আসে তারা বন্দরের অন্য পাশ দিয়ে আসে। হোটেল থেকে দেখা যায় না।

ধীরে ধীরে সাদা এবং আলোকিত হর্ষবর্ধন বাঁ-দিকের বাঁকে মিলিয়ে গিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার পোর্ট-এর দিকে এগিয়ে গেল। নোঙর করবে বলে।

জাহাজের বা এরোপ্লেনের বাঁ-দিকটাকে বলে পোর্ট-সাইড–পোর্টের বা জেটির দিকে থাকে বলে। চুমকি বলল।

আর ডান দিকটাকে বলে স্টারবোর্ড সাইড। জানি আমি।

তুই জানিস। অনেকেই জানে না। চুমকি বলল।

 ক-টা বাজে রে? রংকিনী বলল।

চুমকি তার রেডিয়াম-দেওয়া হাতঘড়ি দেখে বলল, দেখেছিস। মাই গুডনেস! কটা বাজে বল তো?

ক-টা?

নটা।

বলিস কীরে। ইশ। কী করে সময় যায়।

কী করে জীবন যায়!

চল খাই গিয়ে।

বলে, দুজনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ডাইনিং হল-এ উঠে গেল। ডাইনিং হলটাও নামেই হল। আসলে একটি খোলা বারান্দা। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া থাকলে অবশ্য ভেতরে বসে খাওয়ার জন্যে এয়ার-কণ্ডিশনড ঘরও আছে। তবে এখন ডিসেম্বর মাস। বর্ষার বৃষ্টি নেই বটে কিন্তু বৃষ্টি আসে, যখন তখন। তিন-শো পঁয়ষট্টি দিনে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে দু-শো পঁয়ষট্টি দিনই বৃষ্টি। রংকিনী ভাবছিল, ভরা শ্রাবণে এখানে একবার এসে শ্রাবণের রূপ উপভোগ করবে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে।

সেট-মেনু কিন্তু অনেক অলটারনেটিভ আছে। ওরা দুজনেই প্রন-ককটেইলস নিল। সুরমেই মাছ ভাজা। সঙ্গে টার্টার সস। তার পরে কাঁকড়ার একটি পদ। অবশেষে ফুট স্যালাড উইথ চকোলেট আইসক্রিম।

চুমকি বলল, আমি তো আর দু-দিন পরেই ভাগলবা। কিন্তু এইরকম ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, আফটারনুন টি আর ডিনার খেলে তোকে প্লেন থেকে ক্রেনে করে নামাতে হবে দমদম-এ পনেরো দিন পরে।

যা বলেছিস!

লাইটহাউসের তীব্র তীক্ষ্ণ আলোটা চক্রাকারে ঘুরছে। নির্ভুলভাবে বাতিঘরের আলোর রশ্মি ফিরে আসছে একই জায়গাতে নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে। আলোটা বোধ হয় ঠিক করেছে এ দ্বীপের কোনো রহস্যকেই আর রহস্য রাখবে না। অন্ধকারে থাকবে না কোনো কিছুই। গোপনও থাকবে না। সব কিছুকেই উন্মোচিত করবে এ। ওদের দুজনের লাগোয়া শোয়ার ঘরেও নিশ্চয়ই সারারাত এই আলো কী যেন খুঁজবে আঁতিপাতি করে।

ভাবছিল, রংকিনী।

বড়ো হওয়ার পর থেকে কখনোই অন্য কারো সঙ্গে, এমনকী কোনো নারীর সঙ্গেও শোয়নি রংকিনী। একা শোয়ার অভ্যেসেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে ও। পুরোপুরি। ভবিষ্যতে কোনো দিন যদি অন্য কারো সঙ্গে, বিশেষ করে কোনো পুরুষের সঙ্গে একখাটে শুতে হয়, তবে বোধ হয় ঘুমই আসবে না। নিজের নিভৃতি, গোপনীয়তা, নিতান্ত সব অতিব্যক্তিগত দুর্মর অভ্যেস কী করে বাঁধা দেয় দম্পতিরা একে অন্যের কাছে নিঃশর্তে, কে জানে তা! কী এমন থাকে দাম্পত্যে? দম্পতিরাই জানে হয়তো। ভাবলেও অবাক লাগে ওর।

 চুমকি বলল, কাল ভোরে বেরিয়ে জলিবয় আইল্যাণ্ড, পরশু লাঞ্চ-এর পরে আবারও চিড়িয়া টাঙ্গু, সকালে মিউজিয়াম, অ্যাকোরিয়াম, চিড়িয়াখানা এসব দেখে তার পর দিন দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ যাব।

কোথায়?

আমার দ্বীপে।

দ্বীপের নাম দ্য হর্নেটস নেস্ট? বলিস কী?

হ্যাঁরে। কোন পাগলা সাহেব বা জলদস্যু নাম দিয়েছিল কবে তা কী করে বলব? ঠাকুমা যখন দ্বীপটি কেনেন তখন তার এ নামই ছিল।

অবাক করলি তুই!

আমাকে কিন্তু সে-দিনই বেলাবেলি ফিরে আসতে হবে পরদিন সকালে প্লেন ধরার জন্যে। এই তিন দিনও তোর জন্যেই বেশি থাকতে হল আমায় এইখানে। ভাগ্যিস সকালে এসেই এস টি ডি-তে অফিসকে পেয়ে গেলাম এবং শনি-রবির সঙ্গে বনধ ও পেয়ে গেলাম। নইলে…।

আমি চলে গেলে তুই এখানে কী করবি একা একা?

ঘুমোব। কত ঘুম যে জমেছে কী বলব তোকে। ঘুমোব, খাব আর বই পড়ব। অনেক এনেছি সঙ্গে। কিনেছি সেই কবে কিন্তু পড়ার সময় পেলাম কোথায়? এখানে পড়ব।

ভালো।

বনধ-এর কথা আর বলিস না। যখন তখন পশ্চিমবঙ্গের এই বনধ-এর কালচার-এর জন্যে সারাপৃথিবীতে তো বটেই পুরো দেশেও লজ্জাতে মুখ দেখানো যায় না। মাসে ক-দিন কাজ হয় বল তো?

সত্যি! এই এক রীতি হয়েছে আজকাল সব দলের। যারাই বনধ ডাকে তারাই হয় শুক্রবারে ডাকে, নয় সোমবারে। সকলেই বুঝে গেছে আমরা কাজ ফাঁকি দিতে পারলে আর কিছুই চাই না। শান্তিনিকেতন, দিঘা, পুরী, বকখালি, বিষ্ণুপুর, গালুডি, গাদিয়ারায় বেড়িয়ে আসার এমন সুবর্ণ সুযোগ আর কি পাওয়া যায়? নিদেনপক্ষে শালি-ভায়রাভাই-এর বাড়ি নয়তো শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কাটাবার এমন Windfall সুযোগ!

এখন রাজনীতি বলতে আর রাজ্যের ভালো বোঝায় না, পার্টিদের ভালোই বোঝায়। বড়ো দুঃখের কথা।

রংকিনী বলল।

সত্যি। কাজ না করলে কোনো রাজ্যেরই কোনোরকম উন্নতিই কি হয়?

ওরা খেয়ে-দেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে যখন তখন এক বয়স্কা বাঙালি মহিলা সিঁড়ির সামনের টেবল থেকে বললেন, ওমা! চুমকি না?

চুমকি দাঁড়িয়ে পড়ে কিছুক্ষণ ভালো করে দেখে বলল, ও-ও-ও-ও। ভালো আছেন?

 হ্যাঁ। ভালো আছি।

তোমার স্বামী কোথায়? সঙ্গে এই মেয়েটি কে?

 ও আমার বন্ধু।

 আর স্বামী? এখনও বিয়ে হয়নি? এত বয়স হয়ে গেল।

 চুমকি শক্ত গলাতে সামান্য অভব্যতার সুর লাগিয়ে বলল, বিয়ে হয়নি বলবেন না, বলুন বিয়ে করিনি। আজকালকার শিক্ষিত, সচ্ছল, স্বাবলম্বী অধিকাংশ মেয়েদেরই বিয়ে হয় না। তারা নিজেরা ইচ্ছে করলে এবং তাদের পছন্দসই সেরকম রুপে-গুণে-যোগ্য পাত্র পেলেই তারা দয়া করে সেই পাত্রকে বিয়ে করে।

তার পর বলল, আমিও বিয়ে করিনি, আমার বন্ধুও নয়।

ভদ্রমহিলার সম্ভত তাঁর স্বামী অথবা সঙ্গীর সঙ্গে চুমকির আলাপ করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু চুমকি সে সুযোগই দিল না।

তবু গায়ে-পড়া ভদ্রমহিলা বললেন, উঠেছ কোথায়? আমরা উঠেছি সিনক্লেয়ারস-এ। এখানে ডিনার করতে এসেছিলাম।

আমরা এই হোটেলেই উঠেছি।

 চুমকি বলল।

বাবা: এ তো সবচেয়ে এক্সপেনসিভ হোটেল।

 হ্যাঁ। আমরা কিন্তু বাবা বা স্বামীর পয়সাতে এখানে এসে উঠিনি। নিজেদের টাকাতেই…

বলেই, রংকিনীর হাত ধরে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

রংকিনী ফিসফিস করে বলল, অমন অভদ্র ব্যবহার করলি কেন রে? ভদ্রমহিলা কে? ভদ্রমহিলা কি না জানি না। উনিই হচ্ছেন রূপকড়ার মাসি। সঙ্গের ভদ্রলোক ওঁর স্বামীর ম্যানেজার ছিলেন। ওঁর সঙ্গেই এঁর অ্যাফেয়ার। স্বামীকে নাকি দুজনে মিলে বিষ খাইয়ে মেরেছিলেন। লোকমুখে শুনেছি।

তারপরই বলল, কেন? খারাপ কী বলেছি? যার যেমন ব্যবহার পাওয়ার যোগ্যতা তার সঙ্গে সেরকম ব্যবহারই তো করা উচিত।

তাহলেও তুই বড়ো রুক্ষ হয়ে গেছিস চুমকি!

চুমকি বলল, হয় তো হয়েছি। জীবনই করেছে। আমি তো গরিব বাবার অরক্ষণীয়া কন্যা নই। বহুযুগ ধরে সমাজ যে-অপমান এদেশের মেয়েদের করেছে আমি সে-অপমানের শোধ তুলি সুযোগ পেলেই। শি ইজ আ হোর। এর চেয়ে ভালো ব্যবহার পাওয়ার যোগ্যতা তো ওঁর নেই।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ