০৫.

ব্যানার্জিসাহেবের ওপেল অ্যাস্ট্রা, ছাই-রঙা। ড্রাইভারের নাম বিহারি। জিপটা চালাবে কর্বুর-ই নিজে। সঙ্গে রহমতকে নিয়েছে। বিচিত্রবীর্য লোক। একাধারে ড্রাইভার, ক্লিনার, বাবুর্চি এবং বডি-গার্ড। ওড়িয়া আর হিন্দি দুইয়েতেই সমান দখল। তা ছাড়া ব্যক্তিত্বও আছে। জঙ্গলের । মধ্যের বনবাংলার চৌকিদারেরা আর আজকাল আগের মতো নেই। তাদের দিয়ে ঠিকমতো কাজ করিয়ে নেওয়া বাহাদুরির কাজ। রহমত ভালো নার্সও। একবার মনোহরপুরে শিকারে গিয়ে জ্বরে, বেহুশ হয়ে গিয়েছিল কর্বুর। রহমত শুধু সেবাই করেনি, বহাল তবিয়তে বড়োবিলে ফিরিয়েও নিয়ে এসেছিল।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, কর্বুরকে, তুমিও এ গাড়িতেই এসো। জিপ তোমার ড্রাইভার চালিয়ে নিয়ে আসুক। এখন তো জিপের দরকার নেই। আপত্তি আছে?

–তা নেই। কর্বুর বলল, আমি সামনে বসি?

না। ব্যানার্জিসাহেব বললেন, পাইপের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে।

তারপর বললেন, আমি মোটা মানুষ, সামনেই কম্ফর্টেবল ফিল করি। তুমি ওদের সঙ্গে পেছনেই বোসো-না বরং।

বেশ।

গৈরিকা বলল, আপনাকে স্যাণ্ডউইচ করি?

–মানে?

-মানে, আমরা দুজনে দু-দিকে বসি জানলার পাশে। দেখতে দেখতে যেতে পারব তা হলে। আপত্তি আছে?

কর্বুর মনে মনে বলল, এমন আলগা ভদ্রতার মানে কী? বাবা আর মেয়েতে যা নিজেদের ইচ্ছে তা তো করছেন-ই। মাঝে মাঝে একটা করে আপত্তি আছে? প্রশ্ন করার কী দরকার?

শুধু বলল, যেমন আপনাদের খুশি।

পদ্মা এবং কর্বুরের মা-বাবাও এসেছিলেন, ওদের সকলকে সি-অফ করতে ঠাকুরানি পাহাড়ের ওপরে।

রহমত-এর জিপে মুরগির ঝুড়ি, আনাজের বস্তা, চাল, ডাল, তেল, নুন, লঙ্কা এবং যাবতীয় মশলা। একটি পাঁচ-ছ কেজির পাঁঠা। সাদা-রঙা। চা, কফি, বিস্কিট, চিজ Knor এর স্যুপ প্যাকেট, নুডলস ইত্যাদি জিপের পেছনে বোঝাই করা।

কর্বুর বলল, আমি বরং গাড়িটা চালাই। আপনাদের ড্রাইভার আমাদের ড্রাইভারের সঙ্গে আসুক। ওকেও একা আসতে হবে না, আর এ-গাড়িতেও ওরা দু-জনে পেছনে হাত-পা ছড়িয়ে যেতে পারবেন।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সেটা মন্দ হবে না।

পেছন থেকে ঐশিকা বলে উঠল, গাড়ির পেছনের সিটটা তো বিছানা নয়, যে হাত-পা ছড়িয়ে যেতেই হবে। তবে আপনার যদি আমাদের সঙ্গে পেছনে বসতে আপত্তি থাকে, সে কথা বললেই তো হয়।

এবারে কর্বুরেরও মনে হল যে, কিছু বলা দরকার। বড়োই খলবল করছে দু-বোন। পায়ের নীচে ঘাস গজাতে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

শৈশবে মাতৃহীন মেয়েদের যত ভালো করে ব্যানার্জিসাহেব মানুষ করেছেন বলে শুনেছিল কর্বুর ওর কাকির কাছে, আসলে তেমন ভালো করে মানুষ হয়তো করতে পারেননি উনি। মেয়ে দু-টি বেশ অভব্য আছে। এবং প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই সপ্রতিভ। আদরে আদরে একেবারেই গোবর হয়েছে।

কর্বুর হেসে বলল, আমি এই পাড়াগাঁ বড়োবিল-এ থাকি বলেই ভাববেন না যে, মেয়েদের সঙ্গে মিশতে কোনোরকম আড়ষ্টতা আছে আমার। আপনারা যা ভাবছেন, তা ভুল।

বলতে বলতেই জিপের দিকে গিয়ে রহমতচাচাকে যা বলার বলে, ওঁদের ড্রাইভার বিহারিকে জিপের সামনের সিট-এ বসিয়ে দিয়ে, নিজে এসে ওপেল-এর ড্রাইভিং সিট-এ বসল।

বসেই, এঞ্জিন স্টার্ট করল।

ঐশিকা বলল, আড়ষ্টতা যে নেই, তা তো কাল নাটক করার সময়েই দেখলাম।

কর্বুর বলল, নাটক তো জীবন নয়। দুটো আলাদা ব্যাপার।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সফিস্টিকেটেড গাড়ি, চালাতে অসুবিধে হবে না তো তোমার?

কর্বুর অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিয়ে গাড়ি সামনে গড়িয়ে দিয়ে বলল, চালাই তো। আমাদের আছে একটা। সাদা রঙের।

–ওপেল অ্যাস্ট্রা?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন দাদুর একটা ওপেল ক্যাপিটান-ও ছিল। ওপেল অ্যাস্ট্রার চেয়ে অনেক-ই বড়ো। লেফট হ্যাঁণ্ড ড্রাইভ। আমি ওতেই গাড়ি চালানো শিখেছিলাম এই রহমতচাচার-ই কাছে।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, আই সি।

হয়তো ভাবছিলেন, কুরুবক সেন যেমন, নরম-সরল-বিনয়ী-ভদ্র তার ভাইপো কর্বুর ঠিক সেরকম নয়।

-তোমার বাবা মা কাকিমা তো দেখলাম একটা টাটা সাফারিতে এসেছিলেন। আরও গাড়ি আছে নাকি তোমাদের?

-একটা ইণ্ডিকা আছে আমার। গতসপ্তাহেই পেয়েছি। কাকার তো ফিয়া সিয়েনা আছে। নিশ্চয়ই জামশেদপুরে দেখেছেন। মারুতি এস্টিম-এ রহমতচাচা মায়ের ও কাকিমার ডিউটি করে, দিদিরও, যখন আসে দিদি। তা ছাড়া বাজার-দোকান করার জন্যে একটা মারুতি ভ্যানও আছে। পেছনের সিটটা খুলে ফেলা হয়েছে। বাজার বইবার সুবিধার জন্যে। তা ছাড়া একটা ফিয়াট-উনোও নিয়েছেন বাবা।

–বাঃ। আগেকার দিনের রাজারাজড়াদের ঘোড়ার শখ ছিল একসময়ে, তোমাদের দেখছি গাড়ির শখ।

–তা জিপটার কথা বললেন না? ওটা বুঝি ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না?

গৈরিকা বলল।

–ওটাকে কি ঠিক গাড়ি বলা চলে?

–তবে ওটা কী?

ঐশিকা বলল, পেছন থেকে।

-ওটা পক্ষীরাজ।

কর্বুর বলল।

সকলে হেসে উঠলেন একইসঙ্গে। গাড়ির মধ্যের আবহাওয়ার গুমোটটা এয়ারকণ্ডিশনার চালানো থাকা সত্ত্বেও ঠিক কাটছিল এতক্ষণ। এবার মনে হল যেন কাটতে শুরু হল।

হঠাৎ ঐশিকা বলল, কাল রাতে আপনাকে কিন্তু সত্যিই নবাব-নবাব-ই দেখাচ্ছিল। নাটকে।

-তাই? থ্যাঙ্ক ইউ। নাটকের নবাব।

তারপর বলল, মেক-আপম্যানের বাহাদুরি আর ভাড়া-করা পোশাকের দৌলতে অনেক বান্দাও সহজেই চেহারাতে নবাব বনতে পারে, কিন্তু ডিমেন্যুরেও নবাব বনা বোধ হয় অতসহজ নয়।

–আপনার চেহারা এবং ডিমের দুইয়েতেই নবাব-নবাব লাগছিল।

এবারে গৈরিকা বলল।

কর্বুর আবারও বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।

তারপর বলল, আমি তো নবাব-ই। অন্যরকমের নবাব।

-কোথাকার নবাব?

–সারাণ্ডার জঙ্গলের নবাব। কারও-কোয়েল-কয়নার উপত্যকার এই Land of seven hundred hills-এর নবাব আমি। শালমহুয়ার জঙ্গলের নবাব।

–কোয়েল নদীর নাম তো শুনেছি কিন্তু কারো বা কয়নার নাম তো শুনিনি। ওইসব নামেও নদী আছে বুঝি? জানতাম না তো!

-এই বিপুলা পৃথিবীর কতটুকুই বা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব? আমি এখানে থাকি। বলেই হয়তো জানি।

–তা কেন? ডিসকভারি চ্যানেল বা ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেল দেখলে তো, ঘরে বসে অনেক-ই জানা যায়। বিপুলা পৃথিবীর সর্বত্রই যে, নিজের পায়ে হেঁটে ঘুরতেই হবে তার কী মানে?

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

-তা হতে পারে। কিন্তু নিজের পায়ে না ঘুরলে আবার কোনো জায়গাই তেমন করে দেখাও হয় না। যাকে বলে, To have a feel of the place. সেই অনুভূতিটা হয় না আদৌ টিভি দেখে।

সেটা অবশ্য ঠিক-ই।

ব্যানার্জিসাহেব কর্বুরের কথায় সায় দিলেন।

মেয়েদের কেমন লাগছে তা বলতে পারবেন না, ব্যানার্জিসাহেব গতরাতে বাজবাহাদুরের চরিত্রে কর্বুরের অভিনয় দেখে এবং আজ এইটুকু সময়ের মধ্যেই তাকে যতটুকু দেখেছেন তাতেই ছেলেটিকে ভালো লাগতে আরম্ভ করেছে ওঁর। নিজের ছেলেবেলার কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে যেন। নো ডাউট, দিস ইয়াং ম্যান ইজ কোয়াইট আ Guy! আসলে, নিজেকে মানুষ যত ভালোবাসে তত তো আর কারওকেই বাসতে পারে না। কারও সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেলেই তাকে ভালো লেগে যায়।

মনে মনে বললেন, উনি।

গৈরিকা বলল, মহড়া নাটকটির কিন্তু বেশ ডেপথ আছে। নাটকের মধ্যেও নাটক ছিল একটা। থিমটা খুব-ই প্র্যাকটিকাল।

-কোয়াইট আনইউজুয়ালও।

 ঐশিকা বলল।

-সত্যিই তো আমাদের সকলের জীবন-ই এক-একটি মহড়া। ক-জনের জীবনে জীবনের নাটক শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়? রিহার্সালই তো সার। আইডিয়াটা সত্যি খুবই অরিজিন্যাল। সন্দেহ নেই।

-ওই ভদ্রমহিলা কে?

ঐশিকা জিজ্ঞেস করল।

 –কোন ভদ্রমহিলা?

–যিনি রূপমতীর ভূমিকাতে অভিনয় করলেন? গানও তত বেশ ভালোই গান মহিলা দেখলাম।

–দেখলাম কী? শুনলাম বল।

 গৈরিকা বলল।

–ওই হল।

–মহিলা ঠিক নন। বয়সে আপনাদের-ই মতো হবে শিখী। ওর নাম শিখী রায়। ক্ল্যাসিকাল গান শেখে বড়োজামদার হেরম্ববাবুর কাছে। হেরম্ব চ্যাটার্জি। আগ্রা ঘরানার গাইয়ে। বিজয় কিচলু রবি কিচলুদের গুরুভাই। কুমারপ্রসাদ মুখার্জিরও।

-কই? হেরম্ব চাটুজ্যের নাম তো কখনো শুনিনি। গানও শুনিনি কখনো।

-শোনবার তো কোনো কারণ নেই। হেরম্ব জ্যাঠারা তো they also ran-এর দলেই পড়েন। বাণিজ্যিক সাফল্যের মুকুট তো তাঁদের মাথায় ওঠেনি। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতাতেও থাকেন না। তাই তাঁদের আপনারা চিনবেন কী করে!

-তা ছাড়া এসব প্রাগৈতিহাসিক গানও শোনেন নাকি আপনারা? আপনারা তো সম্ভবত নচিকেতা, সুমন, লোপামুদ্রাদের আধুনিক গান-ই শোনেন বাংলা গান আদৌ শুনলে। ইণ্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল মিউজিক তো এখন কাকুর এই জিপগাড়ির-ই মতো অ্যান্টিক ব্যাপার হয়ে গেছে।

–আপনি বড়োবেশি Surmise করে নেন মশায়। আপনি একটু বেশি ওভার কনফিডেন্টও। আধুনিকতার ওপর আপনার রাগ আছে মনে হয়।

–আধুনিকতার ওপরে রাগ নেই। যে মানুষ আধুনিক নন তিনি অশিক্ষিত। তবে আধুনিকতা আর ছদ্ম-আধুনিকতার মধ্যে তফাত তো আছেই। থাকবেও চিরদিন।

-আপনি বুঝি ইণ্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল গানের খুব ভক্ত? ওয়েল। বাহার আর বসন্ত এই দুই রাগের মধ্যে তফাত কী তা বলতে পারবেন?

–আজ্ঞে না। আমি জলবসন্ত আর আসল বসন্তর মধ্যের ফারাকটা জানি।

তারপর বলল, ওইসব গান শুনলেও আপনারা কোনো কোটিপতির বাড়িতে বা রবীন্দ্রসদনে বা কলামন্দিরে বা সংগীত রিসার্চ আকাঁদেমিতে শোনেন। হেরম্ব চাটুজ্যেদের খোঁজ আপনারা রাখেন না। কোনোদিন রাখবেনও না। ক্ল্যাসিকাল ইণ্ডিয়ান মিউজিক আপনাদের কাছে জামদানি শাল, জড়োয়ার গয়না, এম. এফ. হুসেইনের ছবির-ই মতো, নিছক-ই Status Symbol.

গৈরিকা বলল, আপনি তো মহা ঝগড়াটে লোক মশায়। আমার মা একটা কথা বলতেন, বাতাসের গলায় দড়ি দিয়ে ঝগড়া করা। আপনাকে দেখে মায়ের সেই কথাটা মনে পড়ছে।

হেরম্ববাবু প্রসঙ্গে আপনি আগ্রা ঘরানার কথা বলছিলেন না?

আপনি আবার এসব ঘরানা-টরানার কথাও জানেন নাকি?

খুব বেশি ঘরানা তো নেই। তা ছাড়া কুমারপ্রসাদ মুখার্জির কুদরত রঙ্গি-বিরঙ্গি বইটি কেউ পড়ে ফেললেই তো মোটামুটি জেনে ফেলতে পারেন।

তারপর বলল গৈরিকা, সেটি আবার কী বই?

–সেটি ভারতীয় মার্গ সংগীত এবং গাইয়েদের নিয়ে লেখা একটি অসাধারণ বই। না পড়ে থাকলে, অবশ্যই পড়বেন। আনন্দ পাবলিশার্স-এর বই। তা ছাড়া, রসবোধ কাকে বলে তা বুঝতে পারবেন বইটি পড়ে।

–কোন কুমারপ্রসাদ? ধূর্জটিপ্রসাদের একমাত্র পুত্র যিনি?

ব্যানার্জিসাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

–হ্যাঁ।

 –আরে তাকে তো আমি চিনতাম। কোল-ইণ্ডিয়াতে ছিলেন না?

 –ছিলেন-ই তো। আমার বাবাও সেই সুবাদে চেনেন।

পড়তে হবে তো।

তারপর কর্বুর বলল, অমিয়নাথ সান্যালের স্মৃতির অতলে বইটি পড়েছেন?

না তো।

–ইউ হ্যাভ মিসড সামথিং ইন ইয়োর লাইফ। জিজ্ঞাসার বই, মানে প্রকাশক। অবশ্যই পড়বেন সে বইটিও।

-আজকাল বেশি জানার তো প্রয়োজন নেই। বইয়ের ব্লাব, সিডি বা এল.পি-তে গায়ক গায়িকার যে পরিচিতি থাকে, সেই পরিচিতিটুকু পড়ে নিলেই তো পন্ডিতি করা যায়। ঠেকাচ্ছেটা কে? আসল পন্ডিতেরা আমাদের মত এইরকম নকল পন্ডিতদের দাপটে লজ্জাতে আজকাল ঘরেই থাকেন কুলুপ এঁটে। ইকনমিস্ট গ্রেশাম সাহেবের সেই Maxim এখন জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়ে গেছে। শুধুমাত্র অর্থনীতিতেই নয়।

-কী? মানে কোন Maxim?

— Bad money drives away good money.

–যা বলেছ ভাই। কার-রে-ক্ট।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

পরক্ষণেই ভাবলেন, কর্বুর যদি ভবিষ্যতে তাঁর জামাই হয়, তাহলেও কি তাকে ভাই বলেই সম্বোধন করবেন? সত্যি। নিজেকে নিয়ে চলে না। যদি..

তারপরই বললেন কর্বুরকে, তোমার কি কোনো ডাকনাম নেই বাবা? কর্বুর, কর্বুর করে বার বার ডাকতে যে, আমার ডেঞ্চার খুলে যাচ্ছে।

কর্বুর হেসে বলল, বাড়িতে সকলে আমাকে কবু বলেই ডাকেন।

–দ্যাটস মাচ বেটার।

–কর্বুর মানে কী? কোনো দিশি শব্দ?

 গৈরিকা জিজ্ঞেস করল।

–শব্দটা বাংলাই। কিন্তু শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত বাঙালিরা তো আজকাল বাংলা জানাটাকে লজ্জাকর ব্যাপার বলেই মনে করেন। তাঁরা অনেক শব্দর-ই বাংলা জানেন না অথচ ইংরেজি অথবা ফ্রেঞ্চ প্রতিশব্দ জানেন।

–আপনি বাপির-ই মতো বড়োজ্ঞান দেন মশায়! মানেটা বলুন-ই না। তা ছাড়া বাপি ঝগড়ুটে নন, আপনি একনম্বর ঝগড়টে।

ঐশিকা বলল।

–কর্বুর মানে বহুবর্ণ। মানে বুঝলেন? মাল্টি-কালারড। চিত্র-বিচিত্র।

–বাবা! নামটা কে রেখেছিলেন আপনার? খুব-ই থটফুল মানুষ তো উনি।

–আমার দাদু। হি ওয়াজ আ গ্রেট ম্যান।

এদের খুনশুটির হাত থেকে বাঁচার জন্যে ব্যানার্জিসাহেব বললেন, কবু, আমরা প্রথমে কোথায় যাচ্ছি?

কুমডিতে। আজকে সারাদিন কুমডিতেই থাকব। রাতেও। তারপর কাল ব্রেকফাস্ট করে থলকোবাদে যাব। তারপর…

–তারপরের কথা আগে বলবেন না প্লিজ। আমরা একটু সাসপেন্স-য়েই থাকতে ভালোবাসি।

-সেটা মন্দ বলিসনি। আমি প্রথমবার যখন States-এ যাই তখন পথে দেড়শো মাইল সামনে বৃষ্টি হচ্ছে কি হচ্ছে না, ট্রাফিক জ্যাম আছে কি নেই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে কি হয়নি, সব-ই টিভি স্ক্রিন-এ ফুটে উঠতে দেখে বড়ো বিরক্তি ধরেছিল। আমাদের দেশে যখন গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে আমরা পুরোনো দিনের গাড়িতে বেরোতাম, তখন ভূমিকম্প হবে না বন্যা, বজ্রপাত না শিলাবৃষ্টি, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্রই না জেনে মহানন্দে যেতাম। অজ্ঞতারও এক বিশেষ আনন্দ আছে। বেশি জানলে সেই নির্মল আনন্দ মাটি হয়।

ঐশিকা বলল, এই ইন্টারনেট ই-মেইল-এর যুগে সাসপেন্স জিনিসটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। সবাই সবজান্তা। কারোরই অজানা কিছুই নেই। ভবিষ্যৎ-এ কুয়াশা নেই, ঝকঝকে রোদ্দুর। জীবনে কোনো রহস্য নেই। না, আমরা কিন্তু একটু প্রাচীনপন্থী। একটু কম জেনেই আমরা খুশি থাকি।

-বেশ। এ তো আনন্দের-ই কথা।

 কর্বুর বলল।

–আপনার নাটকটা কিন্তু আমাকে রীতিমতো হন্ট করছে।

ঐশিকা বলল।

–হন্ট করাটা তো ভালো নয়। Haunt শব্দের মানেটা তো বিশেষ সুবিধের নয়। ভেবেছিলাম, বাংলাটা ভালো করে শেখেননি, তাই কথায় কথায় ইংরেজি ফুটোচ্ছেন। যখন ইংরেজি শিখেছেন তখন ইংরেজিটাও তো ভালো করে শেখেননি মনে হচ্ছে।

একটু অপ্রতিভ না হয়ে ঐশিকা বলল, ভুলটা ধরেছেন আপনি ঠিক-ই। অনেক শব্দ ব্যবহার করতে করতে আমরা তার আসল মানেটাই ভুলে যাই। রাইট ইউ আর!

কর্বুর অবাক হল একটু। যাকে বলে প্লেজেন্টলি সারপ্রাইজড। ঝগড়া লাগার বা অপমানিত হওয়ার যখন যথেষ্টই কারণ ছিল তখন নিজের ভুল একবাক্যে স্বীকার করে নিল ঐশিকা। এটা একটা মস্ত গুণ বলতে হবে।

–তক্ষ রায়ের চরিত্রটা, মানে গতরাতের নাটকে, কিন্তু অসাধারণ। বিশেষ করে তাঁর Introspection, যেখানে উনি স্বগতোক্তি করছেন, বলছেন, রূপমতীর বয়স হবে না কোনোদিন-ই।তক্ষ একদিন বৃদ্ধ হবে,। লোলচর্ম, গলিত, নখদন্ত কিন্তু রূপমতী রয়ে যাবেন তেমন-ই রূপমতী। তেমন-ই রইবে তাঁর গর্বিত গজগমনের পদক্ষেপ, তাঁর ব্রীড়াভঙ্গি। তাঁর গানের গলা। বয়স ছুঁতে পারবে না তাঁর কিছুকেই।

গৈরিকা বলল।

–ক্লাসিক হয়ে যাবেন রূপমতী, চিরকালিনী হয়ে থাকবেন, নুট হামসুন-এর উপন্যাসে গ্রোথ অফ দ্যা সয়েল-এর মতো, বিভূতিবাবুর আরণ্যক-এর মতো।

ঐশিকা বলল।

-বাবাঃ। আপনি আরণ্যকও পড়েছেন নাকি? বিভূতিভূষণের কী ভাগ্য!

–ইয়েস স্যার।

–সারাণ্ডা বিভূতিভূষণের খুব প্রিয় জায়গা ছিল। বিশেষ করে মনোহরপুর।

–আমরা যাব না?

–যাওয়ার কথা তো আছে। তা বিভূতিভূষণের আর কোনো বই পড়েছেন?

–আর একটা পড়েছিলাম। একটি ভারি মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস, নাম দুই বাড়ি। বলেই বলল, আপনি পড়েছেন?

-না তো।

–ওইসব বই স্কুলে থাকতেই পড়েছিলাম। তারপর পড়াশুনোর যা চাপ পড়ল, বাংলার চর্চা আর রাখতে পারলাম কই?

-রাখা উচিত ছিল। কর্বুর বলল।

–জ্ঞান দেবেন না তো মশাই। আমরা মেয়েরা রান্নাঘরে গলদঘর্ম হয়ে সারাদিন আপনাদের জন্যে রান্না করব, দুপুরে যখন আপনারা আপিস-এ গিয়ে রাজা-উজির মারবেন, দরজাতে লাল আলো জ্বেলে আড্ডা মারবেন আর আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারি বলবেন, হি ইজ ইন আ কনফারেন্স তখন আমরা শরৎবাবুর উপন্যাস পড়ব বিছানাতে শুয়ে, বাংলা গান শুনব, উত্তমকুমারের ছবি দেখব টিভিতে, বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখব, আর আপনাদের গুরুজনেরা, সাহেব আপনাদের জন্যে পাত্রী দেখতে এসে বেশ বাঙালিআনাতে সম্পৃক্ত মিষ্টি মেয়ে পছন্দ করে যাবেন। না, চিরদিন-ই তো তা হতে পারে না। এখন আমরাই আপিস করব, উপার্জন করব, বাইরের জগৎ সামলাব আর পুরুষেরাই আলু-পোস্ত আর তেল-কই রান্না করে রাখবে আমাদের জন্যে। দুপুরে সুনীল গাঙ্গুলি, দিব্যেন্দু পালিত অথবা শংকরের বাংলা উপন্যাস পড়বে। আমরা ভীষণ-ই টায়ার্ড হয়ে বাড়ি ফেরার আগে ঘরে এয়ারকণ্ডিশনার চালিয়ে রাখবে, স্নানঘরে গিজার চালিয়ে রাখবে, বাড়ি পৌঁছেলে সেজেগুজে পারফিউম মেখে, আমাদের হাসি মুখে চা করে দেবে, নাইটি গোছ করে রাখবে বাথরুমে। এক্কেবারে সুইটি-পাই নেকুপুষুমুনু আদর্শ স্বামী হবে সব। ঘোরতর বাঙালি। ফুলেল তেল মাখবে মাথায় আমাদের জন্যে।

গৈরিকা বলল, ঠিক বলেছিস তুই। ওয়াক্সিং করবে, হেয়ার রিমুভার ইউজ করবে।

ঐশিকা বলল, দিন পালটাচ্ছে স্যার। বহুহাজার বছরের অব্যেস-টব্যেস সব পালটাতে হবে এবার পুরুষদের। স্বামী এবং স্ত্রী ভূমিকার অদলবদল হবে।

গৈরিকা বলল, কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?

–যারা না শুনতে পায় তারা বদ্ধ কালা। কালের রথের চাকাতে চাপা পড়ে মরা ছাড়া তাদের গতি নেই।

ঐশিকা বলল।

কর্বুর বলল, আমার তো মনে হয়, আর দশ-পনেরো বছরের মধ্যে বিয়ে ব্যাপারটাই অ্যাজ অ্যান ইনস্টিটিউশান আর থাকবেই না, সচ্ছল, উচ্চশিক্ষিত সমাজে। আপনারা মিছেই আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখছেন। আমরা পুরুষেরা, আপনাদের, আমাদের অমনভাবে হিউমিলিয়েট করার সুযোগ-ই দেব না আর সম্ভবত।

–কেন একথা বলছ তুমি কবু? বিয়ে উঠে যাবে কেন? সেটা মন্দ হবে না?

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

-বলছি স্যার…-

-স্যার-স্যার আবার কী…

–না, আপনি কাকুর বস।

–বস তো কাকুর অফিসে। তা ছাড়া আমি তো তোমার বস নই। বরং তুমি আমার বস এখন। তোমার গার্জিয়ানশিপেই তো জঙ্গলে যাচ্ছি। তুমি আমাকে আমার ডাকনামেই ডেকো। ঘোলা বলেই।

–না। সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। বাধো-বাবধাও ঠেকবে। আমি বরং আপনাকে ব্যানার্জিসাহেব বলেই ডাকব।

-ব্যানার্জিকাকুও বলতে পারো।

–ব্যানার্জিসাহেব-ই ভালো।

–তো এখন বলল, কেন তোমার এরকম মনে হয়?

–আমার একার মনে হয় না। এও কালের-ই যাত্রার ধ্বনি। অদৃষ্টের লিখন। ভবিতব্যং ভবেতব্য। মানুষ বড়োই স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে, বড়োই আত্মকেন্দ্রিক। তার স্বাতন্ত্র্যবোধ এমন ই এক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত সচ্ছল সমাজে, মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জোয়ার আসার পরে, পুরুষ ও নারীর রুচি এতই বেশি সূক্ষ্ম অথবা স্থূল হয়ে যাচ্ছে, যদিও ভিন্ন ভিন্ন রকম, তাতে এক ছাদের নীচে দু-জন মানুষের বাস করাই মুশকিল হবে। এই প্রগতির গতি রোধ করা না গেলে একটা সময় আসবেই যখন মানুষে আর live together-ও করবে না। মেলামেশা হবে, শারীরিক সম্পর্কও থাকবে। কিন্তু স্ত্রী ও পুরুষে থাকবে আলাদা আলাদা ছাদের নীচে।

 গাড়ির মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এল।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, গম্ভীর গলায়, তোমার তাই মনে হয়?

আজ্ঞে।

বাপি, তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে, শেষের সে দিন ভয়ংকর ভেবে তুমি মুষড়ে পড়ছ। তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার মেয়েরা তোমার না-থাকা ছেলেদের চেয়েও অনেক ভালো করে দেখবে তোমাকে। তা ছাড়া তুমি তো আমাদের বাবা-ই শুধু নও, তুমি যে আমাদের মা-ও।

-এরজন্যে কি মেয়েদের শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই দায়ী বলে আপনি মনে করেন স্যার?

ঐশিকা ফৌজদারি আদালতের উকিলের মতো প্রশ্ন করল কর্বুরকে।

-না, তা নয়। দায়ী আমি কোনোপক্ষকেই করছি না। দায়ী যদি কারওকে করতে হয় তবে এই সময়কেই করতে হয়। আমরা আগের প্রজন্মের তুলনাতে অনেক-ই বেশি অধৈর্য হয়ে গেছি। যা-কিছুই পাওয়ার, তা আমরা এখুনি চাই। Right now! কোনো কিছুর জন্যেই অপেক্ষা করার সময় নেই আমাদের। জীবনের সবক্ষেত্র থেকেই ধৈর্য ব্যাপারটা উবে যাচ্ছে। Most Volatile of all Qualities.

বাপিদের সময়ে জীবন এত তো টেনশান-এরও ছিল না। দাম্পত্যজীবন শুরুও হত অনেক তাড়াতাড়ি। পুরুষ রোজগার করত, বাইরেটা সামলাত, আর মেয়েরা আনন্দে সংসার করত, ছেলে-মেয়ে মানুষ করত। পুরুষ ও নারীর ভূমিকাটা কমপ্লিমেনটারি ছিল। আজকের মতো এমন কমপিটিটিভ ছিল না। বাইরেও প্রতিযোগিতা, ঘরের মধ্যেও প্রতিযোগিতা। সবসময়েই এখন দুজনেই দু-জনের প্রতিযোগী। হারতে কেউই রাজি নয়। হাম কিসিসে কম নেহি মানসিকতা ছিল না। মানিয়ে নেওয়াটা ছেলেবেলা থেকেই মায়েরা শেখাতেন মেয়েদের। মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে কোনোরকম হীনম্মন্যতাও ছিল না। এখন তেমন আর হয় না, তাই সুখী হওয়াটাই ভারি কঠিন হয়ে গেছে।

ঐশিকা বলল, দুঃখ দুঃখ গলায়।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, সুখ যে কী, সুখ যে কাকে বলে, তা তো ভুলেই গেছিস তোরা। হয়তো কখনো জানতেও চাসনি। এখন মানুষের জীবনে আরাম আর সুখ এক হয়ে গেছে। সিনোমিনাস। ছেলেবেলায় বাট্রাণ্ড রাসেল-এর বই পড়েছিলাম, তাতে উনি লিখেছিলেন, উই ডু নট স্ট্রাগল ফর এগজিস্টেন্স, উই স্ট্রাগল টু আউটশাইন আওয়ার নেবারস। আরও চাই আরও আরও। প্রতিবেশীর যা আছে, তার চেয়ে আমার বেশি চাই। তোমাদের চারখানা গাড়ি আছে তো আমার সুখী হওয়ার জন্যে অন্তত পাঁচখানা গাড়ি চাই-ই-চাই। মানুষের পয়েন্ট অফ ভিউই সব গোলমাল হয়ে গেছে। সবকিছু জড়িয়ে মড়িয়ে hotch potch হয়ে গেছে।

একটু চুপ করে থেকে বললেন, রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতা ছিল না? একটা? যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।

–ঠিক।

কর্বুর বলল।

তারপর বলল, এই ইউনাইটেড স্টেটস দেশটাই জীবনের সমস্তক্ষেত্রে সারাপৃথিবীর পরিবেশটাকেই দূষিত করে দিল। এইডস-এর চেয়েও মারাত্মক এই রোগ। শব্দদূষণ, বায়ু দূষণ এসব এই মানসিকতার দূষণের সঙ্গে তুলনীয়ই নয়। মানুষ যদি নিজেকেই নষ্ট করে ফেলে তাহলে তার টাকাপয়সা, বাড়ি-গাড়ি, নির্মল পরিবেশ দিয়ে হবেটা কী?

ঠিক-ই বলেছ তুমি কবু।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন।

তারপর দুই মেয়েকে একটু ভংসনার সুরেই বললেন, অনেক তত্ত্বকথা হয়েছে। এবারে একটু চুপ করে দু-পাশের দৃশ্য দেখো।

পথের পাশের গাছগুলো দেখিয়ে গৈরিকা কর্বুরকে জিজ্ঞেস করল, এই গাছগুলো কি সব ই শাল?

–অধিকাংশই। সারাণ্ডার শালবন তো বিখ্যাত।

সাহেবরা কি সত্যিই পাহাড়গুলো এক এক করে গুনেছিল যে, সারাণ্ডাকে বলা হয়। ল্যাণ্ড অফ সেভেন হান্ড্রেড হিলস?

ঐশিকা জিজ্ঞেস করল।

শুনেছি তো তাই।

ব্যানার্জিসাহেব বললেন, গোঁজামিল ব্যাপারটা তো ওদের চরিত্রানুগ ছিল না। ওদের অনেক গুণও ছিল কিন্তু আমরা দোষগুলোকেই বড়ো করে দেখেছিলাম। ওরা চলে যাওয়ার পরে এখন ওদের গুণগুলো দীপ্তি পাচ্ছে।

-তা হবে। আমরা তো আর সেই প্রজন্মের সাহেবদের দেখিনি।

ঐশিকা বলল।

.

০৬.

কুমডি বাংলোটা ছোটো। বনবাংলোর তুলনাতে একটু চাপা। কিন্তু সুন্দর। তবে বনবাংলোর যা সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ, চওড়া বারান্দা তা এই বাংলোতে নেই। কেন নেই, তা জানে না। কর্বুর।

বাংলোর সামনে থেকেই পথ ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীতে। সেই নদীর ওপর বাঁধ বাঁধা হয়েছে একটা। ছেলেবেলাতে যখন আসত তখন বাঁধ ছিল না। ওই পথ-ই চলে গেছে থলকোবাদ।

কুমডিতে পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল। ভালো-মন্দ খেতে খেতে আরও দেরি। শুধু বনভ্ৰমীই তো নন ওঁরা, বনভ্রমণ কাম চড়ইভাতি করতেই এসেছেন। এঁদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলে লাভ নেই যে, বনভ্রমণ আর বনভোজন এক নয়। বললে, ভাববেন জ্ঞান দিচ্ছে। এমনিতে তো জ্ঞানদাতা উপাধি পেয়েই গেছে।

খাওয়া-দাওয়ার পরে ব্যানার্জিসাহেব শুয়েছেন। তিনটি ভদকা খেয়েছিলেন গন্ধরাজ লেবু দিয়ে। তারপর সুগন্ধি ভাত, বেগুনভাজা, ভাজা মুগের ডাল, নারকোল-কুচি দেওয়া, পাহাড়ি নদীর পাড়হেন মাছ ভাজা মুচমুচে, বড়োবিল থেকে আনা কচি-পাঁঠার মাংস, হাতুহাতুর দোকানের রাবড়ি।

ঘুম, কর্বুরেরও পেয়েছিল। কারণ, খেতে বসে দুই কন্যা তো শুধু গন্ধ শুঁকেই উঠে গেলেন, ফিগার-কনশাস এমন-ই। জমিয়ে খেলেন ব্যানার্জিসাহেব আর কর্বুর-ই। তা ছাড়া গতরাতের নাটকের পর আলাপ-আলোচনাতে এবং বাড়ি ফিরেও খাবার টেবিলে বসে বাবা, মা আর কাকির সঙ্গে গল্প করতে করতে খেতে অনেক-ই দেরি হয়েছিল।

কাল সারারাত যেন এক ঘোরের মধ্যে ছিল। রূপমতী-রূপী শিখীর প্রসাধিত আলো-পড়া মুখটি রাতে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। সে কাল একটা পারফিউম মেখেছিল তার নাম নাকি রেড ডোর রেড ডোর-এর সুগন্ধে ম ম করছিল শিখী। প্রত্যেক মেয়ের মধ্যেই অনেকজন মেয়ে থাকে বোধ হয়। এক এক সময়ে এক এক জন বাইরে আসে। সেই বিভিন্নরূপী বিভিন্ন সত্তার কোন জনের হাতে যেকোনো পুরুষ কখন অনবধানে বধ হবে তা একমাত্র বিধাতাই জানেন। পুরুষমাত্রের-ই যা দুর্বলতা, তাই নারীমাত্ররই বল। একটু দেখা, একটু ছোঁয়া, একটু বিলোল চাউনি, একটু হাসি, একটু অভিমান দিয়ে যেকোনো নারী অবহেলে যেকোনো পুরুষকে বধ করতে পারে। এ বিধাতার-ই চক্রান্ত। পুরুষকে ভঙ্গুর করে তিনিই গড়েছেন। আসলে Fragile মেয়েরা নয়, পুরুষেরাই।

শিখীকে কাকির কেন অত অপছন্দ বোঝে না কর্বুর। কর্বুরের তো খারাপ লাগে না মেয়েটিকে। তা ছাড়া তাদের শিকড়ও এ অঞ্চলে পোঁতা। এই প্রাকৃতিক পরিবেশে লোহা আকরের নীল আর ম্যাঙ্গানিজ আকরের লালের গুঁড়ো এবং নদীর বুকের সোনার গুঁড়ো নিয়ে খেলা করেছে ছেলেবেলাতে। শাল, মহুয়ার ছায়াতে ঘুরেছে। সারহুল উৎসবে হো-মুণ্ডাদের সঙ্গে নেচেছে। ছোট্ট কিন্তু নিরুপদ্রব শান্ত এক জগতে নির্মোকের মধ্যে মানুষ হয়েছে। দিল্লি আহমেদাবাদে পড়তে যায়নি। বড়ো চাকরিও করবে না। ঘরোয়া বউ হবে। স্বাবলম্বনের নেশাতে মেতে অজানিতে উদ্ধত হয়ে উঠবে না। সে হয়তো খুশি হবে পরনির্ভরতাতেই। তার স্বামীর স্ত্রী, হাউসওয়াইফ বলে পরিচয় দিতে সে, লজ্জিত হবে না। কর্বুরের সন্তানের মা হবে। কর্বুরের পছন্দসই রান্না করবে ছুটির দিনে। কর্বুরও তার হাউসওয়াইফ স্ত্রীর সবরকম সুখবিধান করবে। দু-জনে একসঙ্গে কবিতা পড়বে, রবীন্দ্রসংগীত গাইবে, আলুচাট এবং ঘুগনি খাবে। দু-জনেই দু-জনের ওপর প্রচন্ড নির্ভরশীল হবে। নির্ভরতা তো শুধু আর্থিক-ই হয় না, কত ব্যাপারেই মানুষ পরনির্ভর হয়।

আগেকার দিনে স্বামীরা রোজগার করত আর স্ত্রীরা ঘর সামলাত। দু-জনের সুস্থ ও খুশি দাম্পত্যজীবন, অবসর, হাসিগল্পের সময়, ছেলেমেয়েদের নিজের পছন্দমতো মানুষ করে তোলাতেই তাদের সব আনন্দ-আহ্লাদ ছিল। সন্তানদের মানুষ করার শিক্ষা নিয়েই ভাবতেন তাঁরা, তাদের নিছক টাকা রোজগারের মেশিন করে তোলাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। অর্থ আর সুখ যে সমার্থক নয়, এইসব কথা আজকালকার কম ছেলেমেয়ে এবং তাদের মা বাবারাই বোঝেন। কর্বুরের মনে হয়, বিয়ের পরে সুখী আমাদের হতেই হবে, দু-জনের দু জনকে মেনে নিতেই হবে, To burn the bridges behind অ্যাটিটিউড নিয়েই দম্পতিকে এগোতে হবে বিয়েকে সফল করার জন্যে। তাহলেই কথায় কথায় ছাড়াছাড়ি– বিচ্ছেদ হবে না। বিধাতা আর কোন মানুষকে সর্বগুণসম্পন্ন করে গড়েছেন? একজনের মধ্যে অন্যজন যা চায় তার সব সে কখনোই পাবে না, এটা মেনে নিয়েই অস্বস্তিটুকুকে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু গৈরিকা ঐশিকারা এতই উচ্চশিক্ষিত এবং উপার্জনক্ষম, তাদের কি অত ধৈর্য থাকবে মানিয়ে নেওয়ার? হাম কিসিসে কম নেহি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চললে সম্পর্কটা চিরদিন-ই প্রতিযোগিতার-ই থাকবে, পরিপূরক হয়ে ওঠা হবে না কখনোই একে অন্যের একজীবনে।

গৈরিকা শুয়েছে বাবার পাশে। বাবাকে ছেড়ে কিছুদিন পরেই চলে যাবে বলেই হয়তো বাবার একটু বেশি কাছে থাকতে চায় সে। কে যে কী করে, কেন করে, তা তো সে নিজে ছাড়া অন্য কেউই বোঝে না।

কর্বুর, বাংলোর গেট থেকে একটু দূরে মহুয়াগাছের নীচে একটা ইজিচেয়ার চৌকিদারকে দিয়ে আনিয়ে নিয়ে তাতে বসে আছে। তার কোলে রামচন্দ্র গুহর লেখা Savaging. The Civilized বইটি খোলা আছে। ভেরিয়ার অ্যালউইনের ওপরে লেখা বই। শিখীই বইটি দিয়েছে কবুকে। মহড়া চলাকালীন।

এ ক-দিন, মানে, যতদিন মহড়া চলেছিল মহড়া নাটকের, ততদিন যেন একটা নেশার মধ্যেই ছিল ও। নাটক মঞ্চস্থ হয়ে যাওয়ার পরে দুর্গাবাড়ির মন্ডপ খোলার সঙ্গে সঙ্গে সব-ই কেমন ফাঁকা-ফাঁকা। গোরু চরবে বাইরে, দুর্গাবাড়ির ভেতরে চড়ুইদের সভা, মাঝে মাঝে দাঁড়কাক অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের মতো এসে চড়ুইদের তাড়া দিয়ে যাবে। তেমন-ই হচ্ছে আজ নিশ্চয়ই।

চোখদুটো খোলা বইয়ের পাতাতে নিবদ্ধ ছিল কিন্তু বইয়ের পাতা সে দেখছিল না। দেখছিল, একটি কাঠবেড়োলি শরতের দুপুরের নরম রোদে কোথা থেকে কী একটা ফল নিয়ে এসে তাকে কবজা করার চেষ্টা করছে। রোদ আর ছায়ার ঝিলিমিলি চলছে নদীর জলে, ঘাসে পাতায়। বর্ষার পরে জল পেয়ে মহুয়াগাছের শাখাতে-উপশাখাতে পাতাগুলো সতেজ সবুজ হয়েছে। চোখ বইয়ের ওপরে পড়ছিল মাঝে মাঝে কিন্তু মন তার ঘাসফড়িং-এর মতো সেই আলোছায়ার শতরঞ্জির ওপরে এক্কা-দোক্কা খেলছিল। একা-একা।

হঠাৎ-ই চমকে উঠল, কী করছেন? শুনে।

দেখল, ঐশিকা।

কখন যে গেট খুলে এতটা হেঁটে এসেছে, শব্দ পায়নি। শীত বা গ্রীষ্ম হলে শুকনো পাতার মচমচানি শুনতে পেত।

ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে উঠল কর্বুর।

বলল, বসুন।

ঐশিকা হাসল।

রহস্যময়ী হাসি।

সেই প্রথমবার ভালো করে লক্ষ করল কর্বুর ঐশিকাকে। খাবার টেবিলে ও পাশে বসেছিল। যে পাশে থাকে, তাকে ঠিকমতো দেখা যায় না। খাওয়ার টেবিলে অথবা জীবনেও। একে অন্যের মুখোমুখি হতে হয়। এই সত্যটা হঠাৎ হৃদয়ংগম করল ও।

-কী বই এটা?

–Savaging The Civilized.

–কার লেখা?

রামচন্দ্র গুহ।

প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে ঐশিকা বলল, আপনি খাবেন?

–কী?

–হজমি।

–না।

–একটা না হয় আমার অনুরোধে খেলেন-ই।

–দিন। আপনারা দু-বোন দুপুরে খেলেন তো না, যেন শুকলেন। ওই খাবার হজম করার জন্যেই হজমি খেতে হচ্ছে?

-হজম করার জন্যে নয়।

–তবে খাচ্ছেন কেন?

–অব্যেশ।

 ইচ্ছে করে স-কে শর মতো উচ্চারণ করল।

ঐশিকা বলল, ইজিচেয়ারে না বসেই।

বলল, আপনি না বসলে, এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো আমায় চলেই যেতে হয়। নাটক করে করে নাটুকে হয়ে গেছেন।

তারপর-ই বলল, আচ্ছা আমি না হয় ইজিচেয়ারের হাতলটার ওপরেই বসছি। যা লম্বা হাতল। ভেঙে যাবে না তো?

–ভাঙবে না। তবে হাতল না বলে পাতোল বলাই ভালো। সাহেবরা শিকার করে এসে ক্লান্ত হয়ে এই হাতলটা লম্বা করে দিয়ে পা তুলে দিয়ে আরাম করত।

–পা তুলে দিলে আরাম হয় বুঝি?

–হয় না? ব্লাড সার্কুলেশন রিভার্সড হয় তো। আরাম হতেই হবে। যেদিন থেকে হাঁটতে শিখি আমরা সেদিন থেকেই তো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ক্রমাগত রক্তকে টানছে নীচের দিকে। পা তুলে থাকলে হৃদয় আরাম পায়।

জিভ দিয়ে হজমিটাকে মুখের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে ঐশিকা হঠাৎ টাক করে জিভ দিয়ে একটা শব্দ করল। আশ্চর্য! কাঠবেড়ালিটা এতক্ষণ ওদের কথাতে ভয় পায়নি একটুও। ওই টাক শব্দতেই ভয় পেয়ে দৌড়ে চলে গিয়ে একটা আমলকী গাছে উঠে গেল।

–কী সুন্দর! না?

ঐশিকা সেদিকে তাকিয়ে বলল।

ঐশিকা একটু পরে বলল, সত্যি। আপনি কত জানেন। এমন জ্ঞানী পুরুষমানুষ আগে কখনো দেখিনি। এতদিন ভাবতাম, আমার বাপিই একমাত্র জ্ঞানী।

–আপনার বাপি কি পুরুষমানুষ নন?

–বাপি পুরুষমানুষ ছিলেন নিশ্চয়ই আমার মায়ের কাছে। আমার কাছে তিনি শুধুই বাপি। উভলিঙ্গ। বাবাও বটে মাও বটে।

তারপর বইটা তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই দেখতে পেল যে, শিখী দিয়েছে বইটা কর্বুরকে।

–শিখী কে?

–মার রূপমতীর ভূমিকাতে যে মেয়েটি অভিনয় করেছিল। বললাম না আসার সময়ে!

–ওঃ। শি ইজ ভেরি গুড। দেখতেও যেমন সুন্দরী অভিনয়ও তেমন-ই ভালো করেন।

–আমার তো ধারণা মেয়েমাত্রই ভালো অভিনেত্রী।

–তাই?

–হুঁ।

-কেন মনে হয়?

–মনে হয়।

–বোকা বোকা হল কথাটা। আপনার মতো বুদ্ধিমানের মুখে মানাল না।

–আমি বুদ্ধিমান সেকথা আপনাকে কে বলল?

–বলেছেন অনেকেই।

–কে বলুন না?

তাদের মধ্যে একজন পদ্মাদি।

কাকির মতটা মত বলে ধর্তব্য নয়।

–আমি অন্যের মতে সায় দিই না কখনো। নিজের মতেই চলি।

–তাহলে বলছেন কেন?

–বলছি, নিজের মতটাও তাই বলছে বলে।

-কেন?

–আপনার মুখ-ই বলে যে, আপনি বুদ্ধিমান, আপনার চোখ, আপনার কথাবার্তা। কী পুরুষের কী নারীর, বুদ্ধির প্রসাধনের মতো কোনো প্রসাধন-ই আর নেই। বুদ্ধিই আপনার মুখটিকে প্রসাধিত করেছে।

–আপনারও।

–তাই? ভাগ্যিস বললেন।

–আপনি তো দেখছি খুব ওভার-কনফিডেন্ট নিজের সম্বন্ধে।

–নিজেদের ওপর কনফিডেন্স-এর অভাবেই তো মেয়েরা এত হাজার বছর ধরে আপনাদের তাঁবেদারি সয়েছে, এখনও সইছে ইসলামিক সব রাষ্ট্রে, তাই কনফিডেন্সটা মেয়েদের পক্ষে অত্যন্তই জরুরি।

ঐশিকা একবার ইজিচেয়ারের ডান হাতলে আর একবার বাম হাতলে বসছিল।

–আপনি তো ভারি চঞ্চল। মনে হয় কিণ্ডারগার্টেনের ছাত্রী।

-তাই? ভালোই তো। যতদিন ছোটো থাকা যায়। বড়ো আর বুড়োর মধ্যে বিশেষ তফাত আছে কি? আজ যে বড়ো, কাল সে বুড়ো।

উত্তর না দিয়ে তাকিয়েছিল কর্বুর ঐশিকার দিকে।

বাঙালির তুলনায় বেশ লম্বা সে। একটা সাদা-কালো ডুরে তাঁতের শাড়ি পরেছে। সাদা ব্লাউজ। শ্যাম্পু করা প্রায় হাঁটুসমান চুল মেলে দিয়েছে পিঠের পরে। কালো টিপ পরেছে একটা। অ্যানোডাইজ করা লোহার একটা মটর মালা গলাতে। ওইরকম-ই বড়ো বড়ো দানার বালা বাঁ-হাতে। ডান হাতে কালো ব্যাণ্ডের সাদা ডায়ালের হাতঘড়ি। দারুণ একটা খুশবু উড়ছে। তা ঐশিকার চুল থেকে, না মুখ থেকে, না কানের লতি থেকে, না স্তনসন্ধি থেকে বুঝতে পারছে না কর্বুর। কিন্তু খুশবুটা উড়ছে বিলক্ষণ।

শিখীর পারফিউমের কথা মনে হল কর্বুরের। Red door। কিন্তু এই গন্ধটা আরও অনেক গাঢ়, প্রায় ঐন্দ্রজালিক।

-কী পারফিউম মাখেন আপনি?

–আমি ভারতীয় নারী। আতর মাখি। জীবনে বিদেশি পারফিউম মাখিনি।

–সত্যি?

–এটা আতরের গন্ধ? কী নাম এই আতরের?

–ভালো লেগেছে আপনার?

হুঁ।

-এর নাম ফিরদৌস। ভালো লাগলেই ভালো। পৃথিবীর সব গন্ধই তো পরপ্রত্যাশী।

–অনেকরকম হয় বুঝি আতর?

–নিশ্চয়ই। এক এক ঋতুতে এক এক আতর মাখতে হয়। তবে নিজের নিজের রুচি মতোই মাখতে হয়। যেমন আপ রুচিসে খানা, পর রুচিসে পিনা তেমন-ই প্রেমিক বা প্রেমিকা যে, গন্ধ ভালোবাসে সেই সুগন্ধিতে সুরভিত হওয়াই রেওয়াজ।

-যখন প্রেমিক বা প্রেমিকার মন জানা থাকে না?

হেসে ফেলে ঐশিকা বলল, তখন আপ রুচিসে। যেমন, আমি মেখেছি।

 কর্বুর লক্ষ করল যে হাসলে, ঐশিকাকে আরও অনেক বেশি সুন্দরী লাগে।

-কী কী আতর হয়?

জিজ্ঞেস করল কর্বুর।

–কতরকম। গরমে থসস, হিম্বা, গুলাব, শীতে অম্বর, মুশক, বসন্তে রাত-কি রানি, জুঁই আরও কতরকম আছে।

-কেনেন কোত্থেকে?

-আতরওয়ালা আসে জৌনপুর থেকে বছরে একবার। দিল্লি, মুম্বাই, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, ভোপাল, হায়দরাবাদ, ইলাহাবাদ নানা জায়গাতেই পাওয়া যায়। যে শহরেই একটি করে চাঁদনি-চওক আছে সেই শহরেই জানবেন আতরের দোকানও আছে অনেক। এটা তো মুসলমানি সংস্কৃতি। আসলে খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা, শিল্প-টিল্প, সুরভি-টুরভির চর্চা মুসলমানেরাই হিন্দুদের চেয়ে অনেক-ই বেশি করেছে। রাজা-মহারাজাদের চেয়ে নবাব বাদশাদের দাপট তো প্রবলতর ছিল দিল্লির দরবারে।

বলেই বলল, বাঃ। দারুণ লিখেছে তো আপনার শিখী?

–কী?

অবাক হয়ে বলল কর্বুর।

কর্বুরদা, কী করে কলঙ্কে যদি সে আমারে ভালোবাসে–শিখী।

–কই? তাই লিখেছে বুঝি? দেখি।

অবাক এবং একটু লজ্জিত হয়ে বলল কর্বুর।

দেখুন।

বলে, বইটা এগিয়ে দিল কর্বুরের দিকে।

তারপরেই বলল, বেচারি শিল্পী। যাকে এমন ট্যানজেন্ট-এ প্রেম নিবেদন করল সেই জানল না। হতভাগিনী আর কাকে বলে।

কর্বুর রেগে গেল।

বলল, প্রেম নিবেদন করবে কেন? নিশ্চয়ই কারও কবিতা কোট করেছে।

তা তো নিশ্চয়ই। নিজমুখে যে কথা বলতে সংকোচ হয় সেকথা পরের গাওয়া গান বা লেখা কবিতা দিয়েই বলে এসেছে চিরদিন-ই মানুষ একে অন্যকে। তবে কবিতা নয়, ওটি একটি গান। এবং অবশ্যই প্রেমের গান। আপনিই তো বললেন…।

তারপর একটু থেমে ভেবে বলল, আপনিই বললেন কি? না, পদ্মাদি? যে শিখী আগ্রা ঘরানার হেরম্ব চ্যাটার্জির কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখে।

বলেই বলল, কিন্তু ওই গানটি তো উচ্চাঙ্গ সংগীত নয়।

-তবে? নিম্নাঙ্গ-সংগীত?

কর্বুর বলল।

খুব জোরে হেসে উঠল ঐশিকা। ওর উচ্চকিত হাসি শুনে কাঠবেড়ালিটা আমলকী গাছ। থেকে নেমে এসে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে একটা কেলাউন্দার ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে গেল।

-এইজন্যেই বিজ্ঞজনেরা বলেন যে, কখনো রেগে উঠতে নেই। তবে যাই হোক, রাগের মাথায় বলে ফেলা আপনার কথাটা এবারে চালু করে দেব। নিম্নাঙ্গ সংগীত। দারুণ।

ঐশিকা বলল।

 তারপর বলল, ওই গানটা শোনায়নি আপনাকে শিখী কখনো?

না তো।

–শুনবেন? আমি জানি। শিখীর তরফে আপনাকে শোনাতে পারি যদিও শিখী জানতে পারলে রাগ করবে হয়তো।

-কেন? রাগ করবে কেন?

 –বা, তার তূণের তির আমার…

–আপনি বড়োই ফেনিয়ে তোলেন।

বিরক্তির গলাতে বলল কর্বুর।

–কী করব। নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ তুলতে হলে কিছু তো একটা করতে হয়ই।

কর্বুর বুঝতে পারছিল যে, ভেতরে ভেতরে সে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঐশিকা সত্যিই সুন্দরী। এতখানি সুন্দরী যে, তা আশ্চর্য! আগে একটুও বুঝতে পারেনি। তা ছাড়া সুন্দরীই শুধু নয়, প্রচন্ড রসবোধসম্পন্ন এবং রীতিমতো বুদ্ধিমতীও। দুষ্টুও আছে বেশ। কর্বুরের কলেজের বন্ধু বিনোদানন্দন পান্ডে মেয়েদের মধ্যে যে, গুণটিকে নামকিন বলত সেই গুণটিও তার মধ্যে যেন অধিক পরিমাণেই বিদ্যমান। সত্যি কথা বলতে কী, ঐশিকা যে কেন কাকিকে এমন করে বশ করেছে এখন তা বুঝতে পারছে একটু একটু। এতদিন বেশি মেয়েদের সঙ্গে মেশেনি যে কর্বুর, তা ঠিক-ই, মেয়েদের সম্বন্ধে তেমন কোনো বিশেষ আকর্ষণ বা ঔৎসুক্যও ছিল না। কাকিই ছিল তার ধারণা, মেয়েদের সম্বন্ধে। ঐশিকা যেন প্রথম বর্ষার ঝরনার বান-এর মতো সেইসব ধ্যান-ধারণা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার পায়ের নীচের মাটি ক্রমশ সরে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভাবনার কথা, এ পর্যন্ত অন্য কারওকেই দেখে বা কারও সঙ্গেই মিশে এমন শারীরিক আকর্ষণ বোধ করেনি আগে। ভেতরে ভেতরে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে, নিজের সম্বন্ধে বেশ উচ্চধারণাসম্পন্ন কর্বুর সেন।

কর্বুর চুপ করেই ছিল।

শরতের দুপুর। প্রকৃতির মধ্যে বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, বুনোহাঁস যেমন অবলীলায় নদীর বালি ছেড়ে জলে নামে এতটুকু ঢেউ না তুলে, তেমন করে। একটা কপারস্মিথ পাখি ডাকছে। নদীর এপার থেকে। স্যাকরার মতো ঠুকঠাক করছে। আর ওপার থেকে তার দোসর সাড়া দিচ্ছে। আর একটু বেলা পড়ে এলেই র‍্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গো তাদের ধাতবগলার তীক্ষ্ণডাক ডাকতে শুরু করবে। দিনশেষে নদীর ওপরে চমকে চমকে ডেকে বেড়াবে ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ।

সেইসময়ে হঠাৎ-ই একঝাঁক বুনোহাঁস নদীর বাঁধের জলে উড়ে এসে বসল।

–ওগুলো কী পাখি?

 ঐশিকা শুধোল।

-জলের পাখি। বুনোহাঁস।

–নাম কী?

–কটন টিল।

–কোথায় ছিল?

কে জানে?

–প্রতিবছর শরতের গোড়া থেকেই ওরা পৃথিবীর সব শীতার্ত দেশ থেকে উড়ে আসতে আরম্ভ করে আমাদের দেশে।

-কেন আসে?

–একটু উষ্ণতার জন্যে।

-তাই? হাঁসেরাও মানুষদের-ই মতো তাহলে।

–ওই নামের একটি উপন্যাস আছে। পড়েছেন কি? ম্যাকলাস্কিগঞ্জের পটভূমিতে লেখা। আমার খুব প্রিয় উপন্যাস।

কর্বুর সামনে বসে থাকা ঐশিকার চোখে চেয়ে বলল।

-তাই? কিন্তু পড়িনি।

–তারপর-ই কথা ঘুরিয়ে ঐশিকা বলল, স্যার বইটা পড়ে ফেলুন।

 –স্যার কেন? আমি কি মাস্টারমশাই?

–না সেজন্যে নয়। আমি যে, টিভি কোম্পানিতে জয়েন করছি একমাস বাদে, সেখানকার নিয়ম রপ্ত করছি। আমার মালকিন বলে দিয়েছেন, যাকেই ইন্টারভিউ করতে যাবে তিনি গোরু-ছাগল হোন কী প্রচন্ড প্রতিভাধর, সকলকেই স্যার বলে সম্বোধন করবে। অথবা ম্যাডাম। আর সবসময়েই পুরুষদের একটা বিশেষ দূরত্বে রাখার চেষ্টা করবে। পুরুষেরা হনুমানের জাত। দড়ি ঢিলে দিলেই ঘাড়ে এসে উঠবে। বিশেষ করে কবি সাহিত্যিকেরা। খুব সাবধানে হ্যাণ্ডল করবে তাদের।

-তার সঙ্গে আমার কী?

–না। বললাম-ই তো, স্যার বলাটা প্র্যাকটিস করছি আর কী।

 তারপর বলল, ওই হাঁসেরা কোন কোন দেশ থেকে আসে?

–কত দেশ। সাইবেরিয়া, রাশিয়া, বেলো-রাশিয়া, নর্ডিক-কান্ট্রিজ। প্রতিবছর-ই আসে আবার গরম পড়বার আগে আগেই ফিরে যায়। সব পরিযায়ী পাখি এরা।

পরিযায়ী মানে কী?

-মানে?

–মানে কী?

–ও। ইংরেজি প্রতিশব্দ না বললে তো আজকালকার উচ্চশিক্ষিত বাঙালিরা মানে ববাঝেন না অনেক বাংলা শব্দের-ই। কী বিপদের কথা।

–ওঃ। আপনি বাপিকেও হার মানাবেন দেখছি সার্মোনাইজিং-এ।

কর্বুর বলল, মাইগ্রেটরি। Migratory। বানান করে বলল তারপরে।

-কী কী হাঁস আসে?

-বললাম না, কত হাঁস। গার্গনি, পিনটেইল, ম্যালার্ড, পোচার্ড, পিংক-হেডেড পোচার্ড, গিজ, শোভেলার, বাহমিনি ডাকস, যাকে সংস্কৃতে বলে চক্রবাক আর বাংলাতে চখাচখি আরও কত পাখি।

–আপনি পাখি সম্বন্ধে যত জানেন গোরু-ছাগলদের সম্বন্ধেও কি ততই জানেন?

কর্বুর সাবধান হয়ে গেল।

-বলল, হঠাৎ এই প্রশ্ন?

না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। পরক্ষণেই বলল, কিন্তু এখানে জল কোথায়?

–এই সাতশো পাহাড়ের দেশে আকাল তো আছেই, এইসব জলের পাখি, জলা জায়গাতেই আসে, নানা হ্রদ-এ, ঝিলে-বিলে-বাদায়। ডাঙার পাখিও আছে অনেক, পরিযায়ী, মানে মাইগ্রেটরি। সারাণ্ডায় কোয়েল, কারও, কয়না ছাড়া নদী নেই। আর সেও সব পাহাড়ি নদী। জলের পাখি এখানে বেশি আসবে কেন?

-উষ্ণ হয়ে গেলেই তারা আবার ফিরে যায়?

–হ্যাঁ তাই। শুধু পাখিই কেন। মানুষও তো একটু উষ্ণতার জন্যেই ঘুরে মরে সারাজীবন।

-তা ঠিক। কিন্তু আমি আবার এমন মানুষও দেখেছি, বিশেষ করে পুরুষমানুষ, তারা তপ্ত খোলাতে হর্স-চেস্টনাট-এর বীজের মতো ভাজা হওয়ার পরও তাদের শীত কাটে না।

কর্বুর ঐশিকার দেওয়া বাম্পারটা খেলবে ঠিক করল। বলল, প্রয়োজনের তুলনাতে এবং বয়েসের তুলনাতে আপনার অভিজ্ঞতা একটু বেশি হয়ে গেছে। আপনার সারল্য চলে গেছে। আপনি টোটালি কনফিউজড হয়ে গেছেন। ব্যানার্জিসাহেব আপনাকে আদরে একেবারে গোবর করেছেন।

–অসার অথবা অসাড় যারা, তাদের তো ফুল-ফোঁটাবার জন্যে গোবরের সার-ই লাগে। কি? লাগে না?

কর্বুর চুপ করে থাকল।

–কী জ্যাঠামশায়ের মতো হাতল ইজিচেয়ারে বসে আছেন আপনি। চলুন-না নদীর দিকে একটু বেড়িয়ে আসি। চৌকিদার তো বলছিল, অন্ধকার হলেই গেট থেকে বেরোনো মানা।

-রাতে, জিপে করে বেরোব আপনাদের নিয়ে। সঙ্গে স্পটলাইট নিয়ে এসেছি। অনেক কিছু জানোয়ার দেখতে পাবেন।

-তাই? কিন্তু সে তো রাতে। আর্টিফিশিয়াল আলোতে। দিনের বেলায় দেখার মতো আনন্দ তো হবে না।

–তা হবে না। কিন্তু আপনি যতই সুন্দরী হোন না কেন, জানোয়ারদের তো আপনার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আপনাকে দেখতে বা দেখা দিতে তারা আড়াল ছেড়ে বেরোবে কি? তা ছাড়া এইসব অঞ্চলে হাতি অনেক। এবং ভাল্লুকও। এরা আনপ্রেডিকটেবল। প্রতিবছর-ই অনেক মানুষ মারা যায় এখানে তো বটেই, কিরিবুরু, গুয়া, মেঘাতিবুরু, নোয়ামুন্ডির খাদান এলাকার আশেপাশে।

–ধ্যুৎ। আপনি একটি রিয়্যাল জ্যাঠামশাই। ভয়েই মরলেন। আমি একাই যাচ্ছি।

–এখানে চুপ করে বসুন। বনের মধ্যে কতরকম শব্দ, গন্ধ, শুনুন, অনুভব করুন। জানেন কি? দেখা দুরকম হয়। এক, নিজে দৌড়ে বেরিয়ে দেখা আর দুই…।

বাংলোর গেট থেকে গৈরিকা চেঁচিয়ে বলল–ওই। তুই ওখানে। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আচ্ছা মানুষ তো তুই।

-তুইও আয় না দিদি।

গলা তুলে বলল, ঐশিকা।

তারপর বলল, তারপর?

-তারপর কী?

–ওই যে বলছিলেন, দুরকম দেখার কথা। দ্বিতীয়রকম দেখার কথা তো বললেন না।

–ও হ্যাঁ।

–নিজে বসে থেকেই যা কিছু দেখার, শোনার, গন্ধ নেওয়ার, সেসবকেই ধীরে ধীরে নিজের কাছে উঠে আসতে দিতে হয়, শীতের রাতে কুয়াশা যেমন নীচের খাদ থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসে তেমনি করেই প্রকৃতিও তার সব রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ নিয়ে আলতো পায়ে এসে আপনার কাছে ধরা দেবে, নিঃশর্তে।

ঐশিকা হাততালি দিয়ে উঠল।

 চমকে উঠল কর্বুর।

গৈরিকা কিছুটা এগিয়ে এসেছিল, বলল, কী হল?

–কী হল না, তাই বল। আরে ইনি তো পোয়েট। যা একখানা বর্ণনা দিলেন না। দ্বিতীয়রকম দেখার।

-কী বলছিস কী?

গৈরিকা আরও এগিয়ে এসে কর্বুরকে বলল, হাই।

-হাই!

বলল, কর্বুর।

-বাবা : আপনিও দেখি আমেরিকান হয়ে গেলেন। দিদি না হয় আমেরিকা যাবে বলে যাকে তাকে হাই! হাই! বলে প্র্যাকটিস করছে।

–চাকরি করবেন বলে আপনিও যেমন যাকে তাকে স্যার বলে যাচ্ছেন।

কর্বুর বলল।

ঐশিকা হেসে বলল, আহা। উপায় কী আছে? ভালো চাকরি। দারুণ স্যালারি দেয়। চাকরিটা রাখতে হবে তো। তাই স্যার বলা প্র্যাকটিস করছি। দোষ হয়েছে কি?

–কীরে! তুই এখনও আপনি-আজ্ঞে করে যাচ্ছিস? ব্যাপার তো ভালো মনে হচ্ছে না।

–কী করা যাবে। উনি যে স্যার।

ঐশিকা বলল।

কর্বুর বলল, দূরে রাখাই ভালো আপনি আজ্ঞে করে। পুরুষমাত্রই তো হনুমানের জাত।

-ওকথা তুই ওঁকেও বলেছিস।

–কথাটা আমার নয়, আমার মালকিনের।

–সত্যি, ওই, তুই ইনকরিজিবল। তুই এসেই, ওঁর সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছিস?

খুব-ই ঝগড়াটি বুঝি উনি?

কর্বুর, গৈরিকার দিকে চেয়ে বলল।

–সে আর বলতে। সেই ছেলেবেলা থেকেই।

–মেয়েবেলা বল দিদি।

–ওই হল।

–লক্ষণসমূহ দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়েবেলা শেষ হয়নি এখনও।

 কর্বুর বলল।

ঐশিকা বলল, এখন-ই শেষ হবে কী? সারাজীবন ধরে চলবে আমার মেয়েবেলা। আমি কোনোদিন বুড়ি হব না।

বলেই, গৈরিকাকে বলল, দিদি, তুই আমাকে বলছিস। আমার কী দোষ বল? আমি ওঁকে এদিক ওদিক খুঁজে দেখি, আমাদের ছায়া পাছে মাড়াতে হয়, তাই উনি বাংলা থেকে এতদূরে এই পেল্লায় গাছের নীচে হাতল-দেওয়া ইজিচেয়ারে বসে কোলের ওপরে একটা বই রেখে উদাস হয়ে চেয়ে আছেন দূরে। ছবিটা ভালো লাগল। নানারকম পাখি ডাকছে। কাঠবিড়ালি দৌড়াদৌড়ি করছে, সুগন্ধ থমথম করছে চারদিকে, তারইমধ্যে স্যার এত উদাস কেন তাই দেখতে এসে কারণটা আবিষ্কার করলাম।

–কী কারণ?

গৈরিকা একইসঙ্গে ঐশিকা আর কর্বুরের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল।

–কারণটি ওই বইয়ের মধ্যে আছে। শিখী, ওরফে মার রূপমতী স্যারকে লিখেছেন : কর্বুরদা, কী করে কলঙ্কে যদি সে আমারে ভালোবাসে।

–তাতে তোর কী হয়েছে?

দিদিগিরি ফলিয়ে গৈরিকা দেড় বছরের ছোটোবোনকে বলল।

–আমার কিছুই হয়নি। কিন্তু হতে তত পারত।

–এমন হেঁয়ালি কথা আমার ভালো লাগে না। আপনার লাগে?

উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই বলল, কর্বুর কারও নাম হয়? বলব বলছিস? আমিও স্যার?

-বলছিই তো।

–যদি বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেন।

–দেন তো দেবেন। যদির কথা নদীতে ফ্যাল। আমি তাহলে স্যারের মনের অবস্থাটা বর্ণনা করার জন্যে রবে ঠাকরের একটা গানই গেয়ে ফেলি।

–রবে ঠাকরেটা আবার কী ব্যাপার?

–মহারাষ্ট্রের বাল ঠাকরে আর আমাদের রবে ঠাকরে। দুই জাতের আইডেন্টিফিকিশেন মার্ক। বলেই, গান ধরে দিল ঐশিকা

হেলাফেলা সারাবেলা একী খেলা আপন সনে।
এই বাতাসে ফুলের বাসে-মুখখানি কার পড়ে মনে।
আঁখির কাছে বেড়ায় ভাসি কে জানে গো কাহার হাসি।
দুটি ফোঁটা নয়নসলিল রেখে যায় এই নয়নকোণে।
কোন ছায়াতে কোন উদাসী দূরে বাজায় অলস বাঁশি,
মনে হয় কার মনের বেদন ভেসে বেড়ায় বাঁশির গানে।
 সারাদিন গাঁথি গান কারে চাহে, গাহে প্রাণে
 তরুতলে ছায়ার মতন বসে আছি ফুলবনে।

গান শেষ হলে তিনজনেই অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল।

গান, যদি তেমন ভালো গাওয়া হয়, তবে তার অভিঘাত চুমুর মতন বা থাপ্পড়ের মতনও হতে পারে। শ্রোতাকে তা স্তব্ধ করে দেয় একেবারে।

নিস্তব্ধতা খানখান করে ভেঙে দিয়ে কী একটা পাখি পাগলের মতো ডেকে উঠল। পেছনের জঙ্গল থেকে।

দুই কন্যাই চমকে উঠল সেই ডাকে।

–কী পাখি ওটা?

–হুপী।

কর্বুর বলল।

–বাঃ বাঃ। ভয় পেয়ে গেছিলাম।

 গৈরিকা বলল।

–সত্যি। আপনি কত কী জানেন স্যার। আপনাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।

ঐশিকা বলল।

-আমিও তাই। একইসঙ্গে এত রূপ। আপনার গান শুনতে শুনতে ভাবছিলাম যে, যে মেয়ে এত ভালো, মানে এইরকম ভাবের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারে, সে এমন ইংরেজি-নবিশ হয় কী করে! পরিযায়ীর মানে, যাকে Migratory বলে বোঝাতে হয়।

–হয়। হয়। আসলে জানতে পারেন না। একজন মানুষের মধ্যে অনেকজন মানুষ থাকে। আপনি পৃথু ঘোষকে চেনেন না?

-বাবা : আপনি আবার মাধুকরীও পড়েছেন দেখছি। বাংলা সাহিত্যও পড়েন?

–হ্যাঁ স্যার। পৃথু ঘোষ বলেনি কি ওয়াল্ট হুইটম্যানকে উদ্ধৃত করে?

–কী?

 Do I contradict myself?
Very well then…I contradict myself
 l am large…l contain multitudes.

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ