১১.

রমেন চলে গেছে প্রায় চার-পাঁচদিন হল।

 বিয়ের পর আমি কখনো একা থাকিনি। এই প্রথম একা একা। সত্যি কথা বলতে কী রমেন যখন কলকাতা যাবে বলেছিল তখন এই ভেবে খুব ভাল লেগেছিল যে অন্তত দু একদিন কোনোরকম ভয় বা সংকোচ না করে সুশান্তকে আমার কাছে পাব। মুখীকে ছুটি দিয়ে দিলেই হবে–তারপর আমি কয়েক ঘণ্টার জন্যে পুরোপুরি সুশান্তর হয়ে যাব। ও ওর নরম ছেলেমানুষি সৎ চোখ দিয়ে লজ্জামাখা মুখে আমাকে দেখবে, আমার সমস্ত আমিকে– আর শিউরে শিউরে উঠবে ভালোলাগায়, সেদিন যেমন উঠেছিল। আমার ভাবতেই ভালো লাগছে আমার মধ্যে এমন জাদু আছে যে, আমাকে দেখেই কেউ অমন করতে পারে। সুশান্তটা বড় ছেলেমানুষ। বড় ছেলেমানুষ ও। ও যা বলেছিল, তা সেদিন আমি বিশ্বাস করেছিলাম। আমি বিশ্বাস করেছিলোম যে, ওর জীবনে আমিই প্রথমা। এ কথাটা শুধুই বোঝার কথা, অনুভবের কথা, প্রমাণ করার কথা নয়।

 ভেবেছিলাম; অনেক কিছু ভেবেছিলাম। এই ভাবনা মনে আসাতে প্রথমে মনে মনে নিজেকে খুব বকেছিলাম। আমি কি খারাপ মেয়ে? আমার কি চরিত্র ভালো নয়? তারপরই মনে হয়েছিল চরিত্র মানে কী? চরিত্র বলতে কী বোঝায় এই ভাবনাটা আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছিল। নিজেকে বলেছিলাম, চরিত্র কথাটার যেমন একটা সাধারণ সমাজ-স্বীকৃত মানে আছে, তেমন প্রতিটি মানুষ-মানুষীর চরিত্রই আলাদা। যাত্রাদলের বিবেকের মতো, সমাজের এককালীন প্রতিভূদের মতানুসারে যারা চরিত্রর ব্যাখা চার খোঁটার মধ্যে সীমিত রেখেছেন, আমি তাদের দলে নই।

আমি যা ভাবি, যা করি, আমি যেরকম প্রতিক্রিয়াশীল, তার ওপর আমার চরিত্র নির্ভর করে। অন্য কথায়, সেইটাই আমার চরিত্র। অবশ্য একথা সত্যি যে, আমার প্রথম প্রেমিক, আমার স্বামীর মধ্যে আমি যা চেয়েছিলাম, তা যদি পেতাম, আমি যদি এমন ভাবে বঞ্চিত না হতাম, তাহলে হয়তো আমার চরিত্র যে-কোনো তথাকথিত চরিত্রর মতোই হতেও পারত। কিন্তু আমি আমার জীবন দিয়ে, জীবনের ভুল দিয়ে, জীবনের সমস্ত নিখাদ অনুভূতি দিয়ে বুঝেছি যে, সেই সমস্ত চরিত্রে বা কোনো কাঁচের আলমারিতে রাখা অভিধানে কিছুই খোঁজার নেই। চরিত্রর ব্যাখ্যা প্রতিটি মানুষের কাছেই আলাদা আলাদা। তার জীবনের প্রাপ্তি, আঘাত, আনন্দ, বেদনা তার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তার চরিত্রকে বদলে দিতে বাধ্য। প্রত্যেকের চরিত্রই জলের মতো। জীবনের আকার অনুপাতে, আকারের ঢালমতো তা গড়িয়ে যায়। তাকে তার সামাজিক ও পৌরাণিক ব্যাখ্যার বদ্ধতায় কখনো ধরে রাখা যায় না। হয়তো ধরে রাখা উচিতও নয়। যারা সেই বদ্ধতায় বিশ্বাস করে, তারা চরিত্রের ব্যাখ্যা ঠিক রাখতে গিয়ে নিজেদেরই বেঠিক করে, বদলে ফেলে। নিজেদের জীবনে চরিত্ররক্ষার মিথ্যা অবক্ষয়ী প্রাপ্তিহীন যুদ্ধে তারা নিজেদের শুধু কাতরই করে, ক্ষুব্ধই করে। এ পৃথিবীর কাছে তাদের পাওয়ার থাকে না কিছুই। তাই আমি ঠিক করেছি, আমি বাঁচব। সুশান্তর কথামতো আমি নিজের সুখের জন্যেই বাঁচব–আর কারও জন্যেই নয়।

আসলে এ সময়ে সুশান্ত জামশেদপুরে থাকলে খুব ভালো হত। কিন্তু রমেন যেদিন গেল, তার পরদিন ভোরে সেও ট্যুরে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেনি ময়ূরকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল শুধু একটা। এখন আমার স্বামীও নেই, প্রেমিকও নেই। আমি এখন একা, রক্ষীহীন; প্রেমহীন। এমনভাবে কি কোনো মেয়ে থাকতে পারে? সুশান্তকে জানার আগে আমি জানতাম না যে আমার জীবনও এত স্পর্শকাতর, এত আনন্দ-ভিখারি। কোনো শরীর নয়, কাউকে বুকের মধ্যে পাওয়া নয়, এই বোধটা একটা দারুণ অন্যরকম বোধ। যে-বোধ শরীরের আনন্দের চেয়ে অনেক তীব্র। যে বোধ, যে উষ্ণতার বোধ একজনের সমস্ত শীতার্ত কষ্টকে এক আশ্চর্য মসৃণ দামি আরামে ভরে দিতে পারে।

 মুখী ঘর পরিষ্কার করে মুছে, কী রান্না হবে তা জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। আমি শোবার ঘরে আমার পড়ার টেবিলের সামনে দু-হাতের তেলোয় মুখ রেখে জানালার পাশে বসেছিলাম। রান্নার কথা মুখীকে বলেছিলাম। যা হয় কিছু রাঁধতে। আমার একার জন্যে কোনোরকম ঝামেলা করতে ভালো লাগে না আমার। আজ সকাল থেকেই কুঁড়েমি লাগছিল। মাঝে মাঝে আমার এমন হয়। কিছুই করতে ভালো লাগছিল না। বসে বসে পরপর তিনকাপ চা খেয়েছিলাম, পরীক্ষার খাতার বাণ্ডিল সামনে খোলা ছিল–একটাও খাতা দেখা হয়নি দেখা হবে শিগগিরই যে, এমন সম্ভাবনাও দেখছি না। সেদিন নমিতাদি ভালো বলেছিলেন। বলেছিলেন, তোরা সব নতুন নতুন দিদিমণি হয়েছিস, তোদের উৎসাহই আলাদা। আমরা আর কি তোদের মতো করে খাতা দেখি? বিশেষ করে আজকালকার ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষার খাতা। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, তাহলে কী করে দেখেন? কোনো বিশেষ কায়দা আছে কি?

নমিতাদি দুটো পান মুখে দিয়ে, দু-আঙুলে একটু সুগন্ধি জর্দা উঠিয়ে অনেক উঁচু থেকে মুখে ফেলে পান-জবজবে গলায় বলেছিলেন, আছে।

আমি শুধিয়েছিলাম, সেটা কী?

নমিতাদি বলেছিলেন, আমার বাড়ির পেছনে, আমার চাকরের থাকার একটা খাপরার ঘর আছে। বাণ্ডিলসুষ্ঠু খাতা তার ছাদে ছুঁড়ে মারি। যেগুলো ছাদে থেকে যায় সেগুলো পাস; আর যেগুলো গড়িয়ে পড়ে যায়, সেগুলো ফেল।

নমিতাদির কথা শুনে টিচার্সরুমের আমরা সকলে হি-হি করে হেসে উঠেছিলাম।

নমিতাদি সেই হাসিতে যোগ দিয়ে বলেছিলেন, ঠাট্টা নয়, পরীক্ষা করে দেখিস, প্রত্যেকটা খাতা আলাদা করে দেখলেও ওর চেয়ে ভালো কিছু ফল হয় না।

স্কুলের সকলে বলে নমিতাদির সঙ্গে স্কুলের সেক্রেটারির অ্যাফেয়ার আছে। আমার বিশ্বাস হয় না। নমিতাদির বড়ছেলের বয়েস সতেরো, মেয়ের বয়েস পনেরো, নমিতাদির নিজের বয়েস বেয়াল্লিশ, সেক্রেটারির বয়স বাহান্ন এবং তাঁর বড়োছেলের বয়েস বাইশ। বিশ্বাস হয় না। কিন্তু রত্না বলেছিল, ওর নিজের চোখে দেখা। জানি না, হয়তো হবে। নমিতাদির জীবনে আনন্দের একটা সুপ্ত ফন্তুধারা আছে। নইলে উনিও হয়তো অন্যান্য সিনিয়র দিদিমণিদের মতো খিটখিটে, গোমড়ামুখো হয়ে যেতেন। জীবন সম্বন্ধে এত উৎসাহ থাকত না হয়তো, এত হাসতে পারতেন না সময়ে অসময়ে, মনটা হয়তো এত উদার থাকত না। জীবনে নিয়মবদ্ধতা না থাকলে, সংসারের কৃপণ হাতায় আনন্দের জলপান না করলে, এবং সামাজিক সমাজের আড়ালে কোনো গোপন সম্পর্ক থাকলেই কি মানুষ এমন উদার হয়? হাসিখুশি হয়? তারাই কি একমাত্র লোক যারা জীবনের একঘেয়েমি ও দৈনন্দিনতার মধ্যে থেকেও এক আশ্চর্য আনন্দের ভাগীদার হয়? জানি না আমি। এখনও জানি না। সুশান্তকে আমি এখনও তো তেমন করে পাইনি, তাকে আমার নিজের করে জানি না।

যদি সত্যিই রমেন ক্যানাডা চলে যায়, তাহলে তো আমারও একদিন না একদিন যেতেই হবে। কিন্তু যতদিন না যাই ততদিন সুশান্ত কি আমার একাকীত্ব ভরিয়ে রাখবে সবদিক দিয়ে? আমার যদি সুশান্তকে বেশিরকম ভালো লেগে যায় তাহলে কি আর আমার ক্যানাডা যাওয়া হবেই না? সুশান্তর মধ্যেই সমস্ত পৃথিবী প্রত্যক্ষ করতে হবে? সুশান্ত কি আমাকে তেমন করে চায়? বুঝি না, ও বড়ো গভীর, ওর চোখের চাউনির কোনো তল নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় ওকে বুঝি আমি, পরমুহূর্তেই মনে হয় যে ওকে বুঝি না। ও যেন কীরকম। হেঁয়ালির মতো।

জানালার পাশে বসে কত কি ভাবতে ভাবতে একেবারে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, এমন সময়ে মুখী এসে বলল, দিদিমণি চিঠি।

রমেনের চিঠির আশা করছিলাম আমি। একদিন বলে গেল যাওয়ার সময়, আর এখনও ফেরার নামটি নেই; কোনো খবরও নেই। কিন্তু না। দুটি চিঠির মধ্যে একটি বাবার লেখা। অন্যটির হাতের লেখা তেমন চেনা নয়।

প্রথমে বাবার চিঠিটি খুললাম। গতকাল লেখা চিঠি। বাবা লিখেছেন, বাবা ভালো আছেন (আমি জানি যে কথাটা সত্যি নয়)। তারপর আমার খবর জানতে চেয়েছেন। শেষে লিখেছেন, রমেন কি কলকাতায় এসেছে? ওঁর বন্ধু, আমার পরমেশকাকা যিনি রেসের বুকমেকার, তিনি নাকি রমেনকে রেসের মাঠে দেখেছেন। বাবা বলেছেন, যে রমেশকাকা নিশ্চয়ই ভুল দেখেছেন কারণ রমেন কলকাতায় এসেছে অথচ ওঁর সঙ্গে দেখা করেনি, এ হতে পারে না।

অন্য চিঠিটা খুলতেই আনন্দে আমার বুক ধক করে উঠল। সুশান্ত লিখেছে পাটনা থেকে। ছোট্ট সুন্দর হস্তাক্ষরে, কিন্তু কী সুন্দর যে চিঠি।

২.৫.৭৩

নিরুপমা,

অনেক জায়গা ঘুরে কাল এখানে এসেছি। এখানে গরম আরও বেশি। কিংবা জানি না, আমার হয়তো বেশি লাগছে। কারণ জামশেদপুর ছাড়া ইদানীং এই উত্তপ্ত পৃথিবীর আর কোথাওই আমার ভালো লাগে না। একমাত্র ওখানেই আমার একটি ওয়েসিস আছে, টলটলে শান্ত নীল জল, খেজুর গাছের ছায়াঘেরা, একমাত্র সেখানে জীবনের কোনো বেদুইন ডাকাতকেই আমার ভয় করার নেই।

তুমি কি জানো সে ওয়েসিসের খবর? তুমি কেমন আছ? ভালো থেকো, সবসময়ে ভালো থেকো। সবসময়ে সুন্দর করে সেজে থেকো, বুঝলে?

পরশু ফিরব। পাটনা থেকে গজাধর মন্ডির বিখ্যাত দোকানের তিলের খাজা নিয়ে যাব তোমার জন্যে। ছোটো মেয়েরা আর কী কী ভালোবাসে জানি না। লাল নীল রিবন? ক্যাডবেরি চকোলেট? লেয়ারি চুড়ি?

এসব কিছুই নিয়ে যাব না, তবে এেলয়ারি চুড়ির মতোই ভঙ্গুর একটি ভীষণ দামি জিনিস তোমাকে ইতিমধ্যেই দিয়েছি। তাকে খুব সাবধানে রেখো। তোমার নরম ভালোবাসার চোখ থেকে, তাকে তোমার মন থেকে একমুহূতাঁর জন্যে সরালে, তাকে উপেক্ষা করলে, তা ঝুন ঝুন করে কাঁচের চুড়ির মতোই ভেঙে যাবে।

তুমি কি জানো, সে জিনিস কী? কী তার নাম? ইতি–তোমার কাছের সুশান্ত।

চিঠিটিকে বার বার পড়লাম। কতবার যে পড়লাম, তার ঠিক নেই। এতবার পড়েও আশ মিটল না। সুশান্ত সুন্দর কথা বলে জানতাম। ও যে এমন সুন্দর চিঠি লেখে, কেউ যে এমন সুন্দর করে চিঠি লিখতে পারে; তা আমার জানা ছিল না।

 চিঠিটিকে কোথায় রাখব, কী করে যত্নে রাখব ভেবে পেলাম না। সেসব পরে ভাবা যাবে। এক্ষুনি, এই মুহূর্তে চিঠিটিকে আমার বুকের ভাঁজে গুঁজে রাখলাম, লুকিয়ে। আপাতত সুশান্ত, এবং আমাকে ঘিরে তার সব সুন্দর উজ্জ্বল সমস্ত ভাবনাগুলি এখানে ঘুমিয়ে থাকুক। এর চেয়ে নিভৃততর নিশ্চিন্ততর সুন্দরতর কোনো ঠাঁই তো মেয়েদের নেই!

 সুশান্তর চিঠিটিকে তুলে রেখেই আমার বাবার চিঠির কথা মনে পড়ল। চিঠিটি আরেকবার পড়তেই বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল। রমেন একদিনের জন্যে কলকাতা গিয়ে রেসের মাঠে কী করছে? এতদিন হল যখন ওখানে আছেই তখন বাবার সঙ্গে দেখাই বা করল না কেন? আমার মনের মধ্যে অনেক খারাপ ভাবনার প্রস্তাবনার ঝড় উঠল, কিন্তু তাদের আমি দূর-দূর ছাই-ছাই করে তাড়ালাম। তাদের বললাম, আমার মনটাই ছোটো, আমিই মানুষকে বিশ্বাস করি না, মানুষের ভালোত্বে, সততায় বিশ্বাস করি না তাই তো আমার কপালে এত দুঃখ।

যে ভাবনাগুলো মনের মধ্যে ভয়-দেখানো মুখোশ পরে উঁকিঝুঁকি মারছিল সেগুলোর দিক থেকে মুখ সরিয়ে আমি আবার সুশান্তর চিঠিটির কথা ভাবলাম। সুশান্ত লিখেছিল সে পরশু আসবে–দু-তারিখের চিঠি। আর আজ চারতারিখ।

 সুশান্ত আসবে, আজ আসবে, অথবা এসে গেছে ইতিমধ্যেই। এই ভাবনাটা আমাকে তখনকার মতো ভীষণভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমার মন বলতে লাগল, আজ যেন রমেন না আসে, রমেন যেন আজ না আসে। আমি তো আইনত রমেনেরই; কিন্তু আমি তো সুশান্তর বে-আইনের। এই বেইমানির অথবা বে-আইনির আনন্দর জন্যে আমার সমস্ত মন উন্মুখ হয়ে রইল।

সেদিন আমি খুব ভালো করে চান করলাম। অনেকদিন আগে একদিন সেন আমার শরীর ছুঁয়েছিল বলে খুব ভালো করে চান করেছিলাম, আমার শরীরের অণু-পরমাণু থেকে সেনের ছাঁয়ার কালিমা মুছে ফেলার জন্যে। আজও আমি ভালো করে চান করছি। কিন্তু আশ্চর্য! সম্পূর্ণ অন্য কারণে। আজ একজন আমার শরীর ছোঁবে বলে আমার শরীরের অণু-পরমাণুতে যেন কোথাও কোনো কালিমা না থাকে সে জন্যে আমি চান করছিলাম। আমি নিরুপমা, আমার মনের মধ্যের নিরুপমের জন্যে আমি নিজেকে নির্দ্বিধায় প্রস্তুত করছিলাম। মনের মতো শরীরেরও প্রস্তুতি লাগে। লাগে না?

আমি ঠিক করেছিলাম যে, নিজে থেকে আমি সুশান্তর খোঁজ নেব না। কেন জানি না, একরাশ লজ্জা এসে আমার সমস্ত মন ছেয়ে ফেলল। মনে হতে লাগল যে, আমার কী দায়? সে যদি সত্যিই তেমন করে আমাকে চায়, তো সে-ই আসুক। আমি একজন মেয়ে। আমি নির্লজ্জতা ভালোবাসি, কিন্তু, তা অন্যের মধ্যে। আমরা নিজেরা তা বলে অমন নির্লজ্জ হতে পারি না। এটা আমাদের দোষও নয়; গুণও নয়। ভগবান আমাদের এমনি করেই তৈরি করেছেন। আমরা কী করব?

সুশান্ত এসেছে কি আসেনি আমার জানার উপায় ছিল না। তবু, আন্দাজেই আমি মুখীকে বলেছিলাম, তুই তো ছুটি-ছাটা পাস না, যা তুই বিকেলের শো-তে সিনেমা দেখে আয় তোর বরের সঙ্গে। বলে, ওকে পয়সাও দিয়ে দিলাম। বললাম, ন-টা-সাড়ে নটার মধ্যে ফিরে আসিস কিন্তু।

মুখী চলে যাওয়ার পরই আমি চান করতে ঢুকেছিলাম। চান করে বেরিয়ে অনেক অনেকক্ষণ ধরে আয়নার সামনে বসে সাজলাম। আলমারির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা কালো-জমি লাল পাড়ের ধনেখালি শাড়ি বের করলাম–সঙ্গে ম্যাচ করা কালো ব্লাউজ একটা। লাল পুঁতির একটা মালা বের করলাম ড্রয়ার খুঁজে। শাড়ি-টাড়ি পরে বড়ো করে কালো টিপ পরলাম, ঠোঁটে হালকা করে ভেসলীন লাগালাম।

 সাজা যখন শেষ হল তখন আয়নার সামনে একবার দাঁড়িয়ে ভালো করে নিজেকে দেখলাম। কলেজে পড়ার সময়ে যেমন মাঝে মাঝে দেখতাম নিজেকে। সত্যি বলছি, ভারি গর্ব হল। আমি নিরুপমা চৌধুরি সেই ছোটোবেলার প্রজাপতির মতো, কাঁচপোকার মত গুনগুন করা দিনগুলোতে ফিরে গেলাম যেন। মনে হল, যা সাজা হয়েছে এই-ই ভালো হয়েছে। এর চেয়ে বেশি সাজলে বেমানান হত, সুশান্তর কাছে আমার মনটা বড়ো বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ত। মেয়েদের এতখানি স্পষ্ট হতে নেই; কোনো ব্যাপারেই বোধহয় নয়। অস্পষ্ট থাকার মধ্যেই মেয়েদের সব জারিজুরি। যে-মেয়েরা এটা না বুঝেছে তারা এখনও কিছুই বোঝেনি।

হঠাৎ একটা কথা মনে হয়ে আমার খুব হাসি পেল। যদি সুশান্ত সত্যিই এসে থাকে, যদি সত্যিই একটু পরে এখানে আসে। আমার কাছে আসে, তাহলে এই এত কষ্ট করে পরা শাড়ি, এত কষ্ট করে সাজা আমার সমস্তই একমুহূর্তে মাটি হবে। আমার সমস্ত আবরণ, আভরণ; নিরাবরণতাতে পর্যবসিত হবে। কিন্তু তাই কী? নিরাবরণ হওয়ার জন্যেই তো এত আবরণ! নির্লজ্জতাই কি সমস্ত লজ্জার শেষ গন্তব্য নয়?

সাজগোজ শেষ করে বসবার ঘর এসে রাস্তার দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে সুশান্তর বাড়ির দিকে চাইতে লাগলাম। কেন জানি না, আমার মন কেবলই বলতে লাগল সুশান্ত এসেছে। কেন জানি না, মন বলতে লাগল যে আমি যেমন করে সুশান্তর জন্যে নিজেকে তৈরি করলাম, সুশান্তও বুঝি আমার জন্যে তেমনি করে নিজেকে তৈরি করছে। করছে কি? ছেলেরাও কি মেয়েদের মতো এত রোমান্টিক হয়? সব ছেলে হয় না; যেমন রমেন। কিন্তু কেউ কেউ হয়; যেমন সুশান্ত। সুশান্ত জানে, কী করে কাউকে চাইতে হয় কী করে কাউকে পেতে হয়। সুশান্ত নিশ্চয়ই জানে যে চাওয়াটাও, পাওয়ার মতোই একটা দারুণ আর্ট। সব মেয়েরা এমন পুরুষকে পছন্দ করে কি না জানি না। কিন্তু আমি করি।

জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম ময়ূর একবার দরজা খুলে বেরোল, একটু পরে হাতে দেশলাই আর সিগারেট নিয়ে ফিরে এল।

আমার মনটা আনন্দে নেচে উঠল। তাহলে সুশান্ত নিশ্চয়ই ফিরেছে। খুব জানতে ইচ্ছে হল, সুশান্ত এখন কী করছে?

একটু পরেই দেখি সুশান্ত বাইরে বেরল। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। বেরিয়েই আমাদের বাড়ির দিকে আসতে লাগল।

আমার হৃৎপিন্ডটা লাফিয়ে আমার গলায় উঠে এল। হিন্দি সিনেমাতে একেই বোধহয় ‘দিল-ধড়কানো’ বলে। কী করব, কী করা উচিত আমি ভেবে পেলাম না। তাড়াতাড়ি আমি জানালা থেকে সরে এসে এ সপ্তাহের ‘দেশ’টা নিয়ে সোফায় বসে পড়লাম, যেন কত মনোযোগ সহকারে ‘দেশ’ পড়ছি।

 সুশান্ত আসতেই, দরজায় বেল টিপতেই, আমি তক্ষুণি দরজা খুললাম না। ইচ্ছা করে ওকে একটু দাঁড় করিয়ে রাখলাম, যাতে ও আমার আগ্রহ বুঝতে না পারে।

দরজাটা খুলতে গেলাম ‘দেশ’টা হাতে নিয়েই, যেন সুশান্ত আসবে এমন কথা আমার জানাই ছিল না।

দরজাটা খুলেই, যেন খুব অবাক হয়েছি এমন ভাবে বললাম, বেড়ানো হল?

আমার মুখ যাই-ই বলুক, ওকে দেখে যে আমি খুব খুশি হয়েছি এ ভাব কিন্তু গোপন রইল না আমার মুখে।

ও অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। মুখের দিকে নয়, চোখের দিকে।

 তারপর বলল, রমেনবাবু ফেরেননি?

আমি মাথা নাড়লাম।

ও বলল, আজ ফেরার কথা আছে?

আমি আবার মাথা নাড়লাম।

ও তাড়াতাড়ি বলল, মুখী কোথায়?

আমি অস্ফুটে বললাম বাইরে।

পরমুহূর্তে সুশান্ত দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল। তারপর আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে সোজা শোবার ঘরের দিকে চলল।

আমি হাত-পা ছুঁড়তে লাগলাম, মুখে অস্ফুটে বলতে লাগলাম,, না; এই না। আমার মুখ সুশান্তর বুকের কাছে ছিল। সুশান্ত কী সাবান মাখে জানি না, ওর বুকের লোম থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ বেরুচ্ছিল। আমি হাত পা ছুঁড়ছিলাম, মেয়েসুলভ ন্যাকামি করছিলাম, যেরকম ন্যাকামি আমরা অন্য মেয়েদের মধ্যে দেখলে ধিক্কার দিই, ঠিক সেইরকম ন্যাকামি। আসলে আমরা সব মেয়েরাই বেসিকালি ন্যাকা–আমাদের রক্তের মধ্যে ন্যাকামি আছে, ন্যাকামি থাকে–আর আমরা জানি যে পুরুষরা, সব পুরুষই সময় বিশেষে এই ন্যাকামি দারুণ পছন্দ করে।

 সুশান্তর নাকের পাটাটা ফুলে উঠেছিল। ওর গরম প্রশ্বাস পড়ছিল আমার মুখে। সুশান্ত অবুঝ হয়ে গিয়েছিল।

আমাকে খাটের ওপর এনে শোওয়াবার পর এত অবিশ্বাস্য কম সময়ের মধ্যে পুরো ব্যাপারটা এমন এ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্সের মধ্যে ঘটে গেল যে আমি ভাবতেও পারিনি।

আমার লজ্জানত আমার মধ্যে একটা অন্য আমি বাস করে। তাকে আমি এতদিন চিনতে পারিনি। সেই লজ্জানত আমার মধ্যে থেকে এক অদ্ভুত লজ্জাহীন আমি জেগে উঠেছিলাম, আমার শরীরের অণু-পরমাণু, আমার শিরায়-শিরায় এক দারুণ উদ্দীপনা সবে জেগেছিল, আমি এক প্রলম্বিত আনন্দের জন্যে নিজেকে অনেক ঘণ্টা ধরে তৈরি করেছিলাম, কিন্তু দেখলাম সুশান্তর এই রোমান্টিক চড়ুই পাখির সোহাগ আমাকে ভীষণভাবে অস্থির করে তুলেছে মাত্র। আমার মধ্যে এক দারুণ আগুন জ্বলে উঠেছে–তাকে নেবানো আমার একার পক্ষে অসম্ভব। আমার পাগল-পাগল লাগছিল। কেমন লাগছিল তা বোঝাতে পারব না।

সুশান্ত বিছানার এক কোনায় শুয়েছিল মুখে হাত ঢেকে, ওর নিজের একার স্বার্থপর আনন্দে বুঁদ হয়ে। ওকে দেখে আমার সেই মুহূর্তে ঘেন্না হচ্ছিল। ও শুধু নারীশরীরকে জাগাতেই জানে, ঘুম পাড়াতে জানে না।

 আমি জানতাম যে ও অনভিজ্ঞ। তাই ওকে প্রথমবার ক্ষমা করে দিলাম আমি। অনেকক্ষণের যতির পর সুশান্ত, আমার আনাড়ি খেলোয়াড়, আমার পেলব বেলাভূমিতে খেলতে নামল, কিন্তু আবারও ও ব্যর্থ হল।

আমি ভরা শ্রাবণের কদম্বগন্ধি কোনো বানের ভরসায় আমার নরম নৌকো ভাসিয়েছিলাম –অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু জোয়ার এল না, পালে হাওয়া লাগল না; আমার সমস্ত নৌকোখানা শুকনো চড়ার গ্লানির মধ্যে, ঠাঠা-রোদের মধ্যে নোঙর করাই রইল। সুশান্ত নৌকো বাইতে জানে না, হাল ধরতে জানে না, কোন দিকে স্রোত, কোনদিকে জোয়ার ও কিছুরই খোঁজ রাখে না।

বারেবার ও ব্যর্থ হল।

আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, সুশান্তদের দূর থেকে অ্যাডমায়ার করা যায়, ওদের সঙ্গে সাহিত্যালোচনা করা যায়, নন্দনতত্ত্ব, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কিন্তু ওদের নিয়ে জীবনে সুখী হওয়া যায় না। রমেন এবং সুশান্ত কেউই আমাকে সুখী করতে পারেনি, পারবেও না। প্রথমজন তার ক্রুডনেসের জন্যে, তার ভন্ডামির জন্যে, তার নোংরা প্রস্তাবনার জন্যে, তার অশোভনতার জন্যে, দ্বিতীয়জন তার বাড়াবাড়ি রিফাইনমেন্টের জন্যে, তার ইনডায়রেক্টনেসের জন্যে। জীবনের মধ্যে একজনের পায়ে শুধু ভালো ও জোরালো শট আছে–কিন্তু সে ড্রিবল করতে জানে না, তার স্টাইল নেই। অন্যজন শুধু স্টাইলসর্বস্ব, তার পায়ে জোর নেই, গোলের সামনে এসেও গোল করতে পারে না সে।

সুশান্তর একটা হাত আমার কোমরের ওপর রাখা ছিল। সুশান্ত পাশ ফিরে শুয়েছিল। ও নিজের আনন্দে নিজে মগ্ন হয়েছিল।

সুশান্তর চোখের উজ্জ্বলতার মধ্যে আমি এক দারুণ স্বার্থপরতার আগুন দেখছিলাম। ওকে আমি ইতিমধ্যেই ঘৃণা করতে আরম্ভ করেছিলাম।

হঠাৎ কে যেন দরজায় ধাক্কা দিল, তারপর কে যেন কলিংবেল টিপল জোরে জোরে।

আমরা দুজনেই ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। আমি উঠে বসতেই সুশান্ত কোনো গৃহপালিত জন্তুর মতো আমার খোলা বুকের কাছে উঠে এল।

আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরালাম।

আবার দরজায় ধাক্কা পড়ল জোরে জোরে।

আমি তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পরে চুল ঠিক করে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালাম। ভেতর থেকে বিরক্তির গলায় বললাম, কে?

ওপাশ থেকে কে যেন জড়ানো গলায় বলল, আমি।

আমি কে?

আমি সেন।

কী চাও তুমি?

আমি আপনাকে চাই। আমি শুধু আপনাকে চাই।

 আমি দৌড়ে গিয়ে বেডরুমের দরজাটা বাইরে থেকে টেনে বন্ধ করে দিয়ে এসে দরজা খুললাম।

সেন দমকা হাওয়ার মতো ভেতরে ঢুকল। ওর মুখ দিয়ে গন্ধ বেরুচ্ছিল।

সেন হাসছিল, বলল, একটা খুব সুখবর দিতে এলাম। কারখানার পর সোজা এখানে আসছি। না এসে পারলাম না। তাই-ই এলাম।

আমি বললাম, তুমি মদ খেয়েছ?

সেন অপরাধীর মতো মাথা নাড়ল।

আমি ধমকের গলায় বললাম, কেন খেয়েছ? সেদিন না কত কী বলেছিলে, তোমার দায়িত্ব। কর্তব্যের কথা? সব ভুলে গেলে? এত তাড়াতাড়ি?

 সেন বাইরের দরজাটা ভেতর থেকে ভেজিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জড়ানো গলায় বলল, সেকথা আপনি বুঝবেন না।

তারপরই বলল, আমি বড়ো কদর্য দেখতে না বউদি? আমাকে দেখলেই আপনার ঘেন্না হয়? তাই না?

কেন জানি না, আলোর নীচে দাঁড়িয়ে সেনের সেই কুৎসিত অথচ সরলতামাখা মত্ত মুখের দিকে চেয়ে আমার ভেতরটা যেন কেঁপে উঠল। ভয় পেয়ে আমি বললাম, ঘেন্না করি না; ঘেন্না করব কেন?

সেন অনুনয়ের সঙ্গে বলল, তাহলে আমার কাছে একটু আসুন বউদি, আমার সামনে একটু আসুন, আপনাকে একটু ভালো করে দেখি। একটা দারুণ ভালো খবর দিই আপনাকে।

আমি ধমকের সুরে বললাম, না! কেউ এসে পড়বে। ওরকম কোরো না।

সেন অনুনয় করে বলল, প্লিজ, বউদি প্লিজ।

আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

সেন বড়ো যত্নে, বড়ো আদরে, বড়ো সাবধানে আমার মুখটা ওর দু-হাতে নিল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, এক অবরুদ্ধ, অরুদ্ধ শিশুসুলভ কামনা ওর সমস্ত শরীরময় থরথর করে কাঁপছে।

সেন অনেকক্ষণ ওর রুক্ষ হাতে আমার নরম মুখটা ধরে রইল। তারপর যেন ওর সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল, সেদিন ওকে যে অপমান করেছিলাম সেকথা মনে পড়ে গিয়ে যেন ও কুঁকড়ে গেল। ও বোধহয় আমাকে চুমু খেতে চেয়েছিল, বোধহয় একমুহূর্তের জন্যে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল, কিন্তু মত্ত অবস্তাতেও নিজেকে ও সামলে নিল। সামলে নিয়ে আমার দুটি হাতের পাতা ওর দুটি হাতে তুলে নিয়ে কী যে উষ্ণতার সঙ্গে তার ঠোঁটে ছোঁয়াল, কী বলব?

এমনসময়ে হঠাৎ শোওয়ার ঘর থেকে একটা আওয়াজ হল।

মুহূর্তের মধ্যে সেনের চোখের স্বপ্নময় ভাব বদলে গেল। কী এক বিষাদ ও বিরক্তির ভাবে ওর চোখ ভরে গেল। ও আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, ও ঘরে কে? রমেনদা কি ফিরে এসেছে?

আমি মাথা নাড়ালাম। বললাম, কেউ না। বেড়াল-টেড়াল হবে।

সেন হঠাৎ আমার মুখের দিকে একাগ্রভাবে চেয়ে বলল, আপনার চুল এলমেলো কেন? ও ঘরে কে?

আমি রাগের গলায় বললাম, কী পাগলের মতো বকছ। কিন্তু আমার বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে গেল। আমি ওর হাত ধরে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বললাম, এসো, তোমার কী চাই বল আমার কাছ থেকে। কী চাই?

সেন ওর পা দুটো ফাঁক করে আলোর তলায় দাঁড়িয়ে এক দারুণ হিমেল হাসি হাসল আমার মুখে চেয়ে। বলল, কিছু চাই না। আমার কিছুই চাই না।

 বলেই ধীরে ধীরে ও বেডরুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

 আমি চিৎকার করে বললাম, কী হচ্ছে কী?

 সেন আমার কথায় কর্ণপাত করল না।

এগিয়ে গিয়ে একঝটকায় বেডরুমের দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলল।

 আমিও ওর পেছনে পেছনে গেলাম। আমার মাথার ঠিক ছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি কী করব, কী আমার করা উচিত।

বেডরুমে বেডলাইটটা জ্বলছিল। খাটের বেডকভারটা লন্ডভন্ড অবস্থাতেই ছিল।

হঠাৎ সেন থমকে দাঁড়াল।

সেনের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও দেখলাম, মেঝেতে সুশান্তর চটি-জোড়া পড়ে আছে এবং আমার ও রমেনের জোড়া ওয়াড্রোবের দরজার ফাঁক দিয়ে সুশান্তর পাঞ্জাবির কোনার কিছুটা বেরিয়ে আছে।

সেন আমার মুখের দিকে তাকাল।

আমি মুখ নামিয়ে নিলাম। সেদিন আমি ওকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম; আজ ওর দিন।

সেন বলল, বেড়ালটার চেহারা দেখব নাকি?

আমার বুকের মধ্যে ধ্বক ধ্বক করছিল। আমি ওর দিকে অপরাধীর চোখে তাকালাম।

সেন তেমনি জড়ানো গলায় বলল, না। থাক। ছিঁচকে মেনি বেড়ালের মুখ অন্ধকারেই থাক। ও মুখে আলো না পড়াই ভালো।

আমাদের কথাবার্তা সুশান্ত নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু সুশান্ত কোনো কথা বলল না, ভেতর থেকে বেরিয়েও এল না।

হঠাৎ সেন ঠাস করে আমার গালে একটা চড় মারল।

আমার মাথাটা ঘুরে গেল। ওর পাঁচ আঙুলের দাগ আমার গালে গম্ভীর হয়ে বসে গেল।

ওর গলার জড়ানো ভাব কেটে গেল। ও যেন হঠাৎ আমার চেয়ে, রমেনের চেয়ে, সুশান্তর চেয়ে, অনেক বড়ো হয়ে গেল। ও স্পষ্টভাবে কেটে কেটে বলল, নিরুপমা, আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। রমেনদার মতো নয়, তোমার এই বেড়ালের মতো করেও নয়, আমার সবকিছু দিয়ে। যা কিছু আমার ছিল বা আছে বা হবে তার সবকিছু দিয়ে।

তারপর একটু থেমে বলল, তোমাকে আমি যেখানে বসিয়েছিলাম মনে মনে, তুমি সেখানে বসার যোগ্য নও। তুমি আমার ভালোবাসা পাবার যোগ্য নও।

এই বলেই সেন সোজা দরজা খুলে বেরিয়ে চলে গেল।

আমার দু-চোখ প্রথমে জলে ভরে গেল। তারপর দু-গাল বেয়ে দরদরিয়ে জল পড়তে লাগল। আমি দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে খাটের কোনায় বসে পড়লাম।

সেন আমাকে বউদি বলে ডাকত। সেন, আজকে আমার সঙ্গে এক অদ্ভুত ব্যবহার করে গেল। এমন ব্যবহার করল ও, এমন দ্বিধাহীনতায় আমাকে চড় মেরে গেল যে, আমার সমস্ত পুরোনো মরচে-পড়া জানা, আমার সমস্ত বোধ, ঝনঝন করে বেজে উঠল।

আমি কতক্ষণ যে অমন ভাবে বসেছিলাম, আমি জানি না।

অনেকক্ষণ পর ক্যাঁচ-কোচ আওয়াজ করে আলমারির দরজা খুলল। ভেতর থেকে সুশান্ত চোরের মতো ভয়ার্ত মুখ বের করে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, চলে গেছে?

আমি জবাব দিলাম না।

আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে, আমার অভিশপ্ত জীবনকে, আমার অল্প বয়েসের দম্ভকে অভিশাপ দিচ্ছিলাম।

সুশান্ত আবার মুখ বের করে বিরক্তির গলায় ফিসফিস করে বলল, বল না? চলে গেছে কি না?

 আমি তবুও জবাব না দেওয়াতে ও আলমারি খুলে বেরোল। চটি দুটো পরল। তারপর আমার দিকে একবারও না চেয়ে, আমার চড়-খাওয়া গালের দিকে একবারও না তাকিয়ে বলল, আমি চলি, আবার হয়তো কে এসে পড়বে, বলেই হন হন করে বেরিয়ে চলে গেল।

 চলে-যাওয়া সুশান্তর দিকে তাকিয়ে ওর সমস্ত কিছুর জন্যে এক দারুণ ঘৃণায় আমার শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। ওকে আমি যা দিয়ে দিয়েছি তা আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু ওকে আমি ভুল করে তা দিয়ে ফেলেছি বলে, আমার নিজের ওপরও এক অদ্ভুত ঘৃণা হতে লাগল। আমার মন কেবলই বলতে লাগল যে, আমার বুঝি সব কিছুই এমনি করে হারিয়ে যাবে, যা কিছু আমার ছিল, আমার বলতে যাই-ই ছিল; সব। সব; সব।

.

১২.

আজ কুড়ি দিন হল রমেন কলকাতা গেছে। আজ অবধি তার কোনো চিঠি আসেনি আমার কাছে। বাবার আরেকটা চিঠি পেয়েছিলাম তাতে উনি লিখেছিলেন যে পরমেশ কাকা রমেনকে পরের সপ্তাহেও রেসের মাঠে দেখেছেন।

এতদিনে আমার যা বোঝার ছিল, সবই বোঝা হয়ে গেছে। বুঝতে যে কষ্ট হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো, কিন্তু তবুও বুঝতে হয়েছে। রমেন আমাকে সব দিক দিয়ে, সর্বতোভাবে নিঃস্ব রিক্ত করে গেছে। আমি তো এমনিতেই নিঃস্ব ছিলাম। কিন্তু বার বার ওকে সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও, ওকে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও কেন যে নিজেকে বার বার এতভাবে ছোটো করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল সেটাই আমার বুদ্ধির বাইরে।

গতকাল থেকে আমি কেবলই ভাবছি, ভাবছি কী করা যায়। কী আমার করা উচিত।

সুশান্তর মধ্যের মেয়েমানুষটা সেদিন সব দিক দিয়ে এমনভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। আমার কাছে, আমার চোখের সামনে, যে তারপর থেকে সুশান্তর সঙ্গে আর কোনরকম সম্পর্ক রাখার ইচ্ছা ছিল না। অথচ ওর সবই ছিল। শিক্ষা, দীক্ষা, রুচি, সভ্যতা, এমনকী সততাও ছিল। অথচ তবু ও এমন এক পরীক্ষায় ফেল করল, এমন এক স্বার্থপরতাময় জগতের আভাস দেখতে পেলাম ওর মধ্যে যে ওকে আর আমার ভালো লাগা সম্ভব নয়। আশ্চর্য! সুশান্তর ওপর মনে মনে আমি অনেকখানি নির্ভর করতে শুরু করেছিলাম। কতখানি যে, তা সুশান্ত নিজেও জানে না।

 আমার জীবনে হয়তো কারও অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে গেছে। নইলে যাতেই আমি হাত দিই, যাকেই আমি আপন করে পেতে চাই, সে-ই কেন এমনভাবে ঠকায় আমাকে। এমনভাবে ব্যর্থ করে নিজেকে ও আমাকে?

গতসপ্তাহ থেকেই বর্ষা নেমেছে জামশেদপুরে। গরমটা অনেক কম। গাছে-গাছে খুদে-খুদে কচিকলাপাতা-রঙা নতুন পাতা গজিয়েছে। কদমা-সোনারি লিংকসের শুকিয়ে-ওঠা রুক্ষতার মধ্যে এখন নতুন নতুন ঘাস গজিয়ে উঠেছে। সোনাঝুরি গাছগুলোর পাতাগুলো রোদ পড়লে চকচক করে। এখনকার শান্ত নিস্তব্ধ ঠাণ্ডা দুপুরগুলো ভারি ভালো লাগে।

বাইরের প্রকৃতি শান্ত স্নিগ্ধ হয়েছে, কিন্তু আমার অন্তরের প্রকৃতি বড়োই বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে। অথচ খুব তাড়াতাড়ি আমার একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ রমেনের কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থেকে যাবার কথাটা আমাদের বাড়িতে আর বেশিদিন চাপা থাকবে না। হয়তো বাবা অথবা কোনো দিদি-জামাইবাবু আমাকে না জানিয়েই ব্যাপারটার সরেজমিনে তদন্ত করতে এসে হাজির হবেন এখানে ঝুপ করে। তাই যদি হয়, তাহলে এতদিন আপ্রাণ চেষ্টায় যে সত্যটাকে গোপন রেখেছিলাম, সেটা হঠাৎই ফাঁস হয়ে যাবে, বড়ো মর্মান্তিকভাবে।

জানি না কেন, কিছুদিন থেকে, মানে সেনের আমাকে চড় মারার পর থেকেই সেনের কথা আমার বার বার মনে পড়ছিল। রমেন আমাকে ভালোবাসেনি, সুশান্ত আমাকে তার নিজের সংকীর্ণ মেনি বেড়ালের ভালোবাসায় ভালোবেসেছিল, সে ভালোবাসা আমার গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। তবে কি ওই কুদর্শন ছেলেমানুষ সেনই আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসে? তাকেই কি আমার এই জটিল মনের কোনো অবচেতন কোণে আমি আসন দিয়েছি আমার অজ্ঞাতসারে? অতীতের কোনো অজানা মুহূর্তে? এও কি সম্ভব?

কী জানি? আগে ভাবতাম আমি কত বুঝি, কত জানি। ভাবতাম, বাবা, মা, দাদা, দিদিরা সব, সব ব্যাকডেটেড, প্রি-হিস্টোরিক ফসিল। ভাবতাম, আমি যা জানি, আমি যা বুঝি সেটাই ঠিক। অন্যরা সকলেই ভুল। তখন আমার নিজের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল–নিজেকে, নিজের বিচার-বুদ্ধিকেই একমাত্র বিশ্বাস করে অন্য সকলকেই অবহেলায় অবিশ্বাস করেছিলাম।

আজ আমার স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা বা লজ্জা নেই যে, আমার সেই এককালীন কংক্রিটের বিশ্বাসের ভিত আজ বড়ো নড়বড়ে হয়ে গেছে। নিজের ওপর আগের মতো নির্দ্বিধায় ভর করার সাহস আমার নষ্ট হয়ে গেছে।

আমার এই অল্পবয়েসি জীবন, আমার সুন্দর শরীর এবং সরল অপাপবিদ্ধ মন এমন, এমন সব অসততা, ছল, চাতুরি প্রবঞ্চনার মধ্যে দিয়ে গত দু-বছরে পার হয়েছে যে একটা পরমসত্য বড়ো মর্মান্তিকভাবে বুঝেছি। দুঃখ এইটুকুই যে এ সত্য বোঝার জন্যে বড়ো বেশি। দাম দিতে হল। বুঝেছি যে, জীবনের কোনো জানাই, কোনো বিশ্বাসই, কোনো বোধই স্থাবর নয়। জীবন যেমন নদীর মতো বহমান, তেমন বহমান আমাদের সব বিশ্বাস, সব জানা, সব বোধ। গতকাল যেটাকে সত্য বলে জেনেছি, আজকেই সেটাকে মিথ্যা বলে জানছি। গতকাল যা নির্ভুল বলে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করেছি, আজকে সেই বিশ্বাসের অযৌক্তিকতাতে নিজেরই হাসি পেয়েছে।

একথা সত্যি যে আমি হেরে গেছি। নিজের কাছে নিজে বারবার হেরে গেছি–তবু বাইরের কারও কাছে আমি হারিনি, হারতে চাইনি কখনো। বাইরের কারও কাছে এখন অবধিও হারিনি। জানি না আমার কপালে কী আছে। আধুনিকই হই আর লেখাপড়াই শিখি, কপাল অতিক্রম করার কোনো শক্তি আমার আছে বলে আমি মনে করি না।

এখন বারে বারেই মনে হয় মেয়ে হয়ে জন্মানো, সুন্দর নারীশরীর নিয়ে জন্মানো যেমন এক দারুণ আশীর্বাদ, তেমন এক দারুণ অভিশাপও বটে। আমার সুন্দর শরীর না থাকলে রমেন আমার প্রতি আকর্ষিত হত না। নইলে রেসের মাঠের কিম্ভুতকিমাকার নামের অনেক ঘোড়ার মতো একটি ঘর্মাক্ত ঘোড়ার মতো ও আমাকে বেছে নিয়ে আমার ওপর বাজি লাগাত না। জানি না, আমাকে বিয়ে করা নিয়েও ও কারও সঙ্গে ভাও লাগিয়েছিল কি না। রেসে জেতার পর যেমন জুয়াড়িদের যে ঘোড়া তাকে জেতাল সে সম্বন্ধে আর কোনো ঔৎসুক্য থাকে না। তেমন বিয়ের আমার সম্বন্ধেও রমেনের কোনো উৎসুক্য ছিল না। যা ছিল, তা নিরুপমা চৌধুরি নামের মেয়েটির প্রতি কোনো বোধই নয়, তার সুন্দর শরীরটার প্রতি এক অদ্ভুত লোভ। যা কেবল পুরুষদেরই একচেটে। পুরুষদের চাওয়া, বড়ো নোংরা চাওয়া।

মন বিবর্জিত, মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সমস্ত কারুকাজহীনতার মধ্যে রমেন শুধুই একটি ভালো-ফিগার মিষ্টি-মুখের শরীর চেয়েছিল। এখন বুঝি, আজ বুঝি, ও আমাকে আমার জন্যে কখনো চায়নি।

রমেনের পরে আমার এই আশ্চর্য অভিশপ্ত জীবনে এল সুশান্ত-রূপকথার রাজপুত্রের মতো। ভাবলেও অবাক লাগে। সুশান্ত সম্বন্ধে মনে মনে কত না কল্পনার ছবি এঁকেছিলাম। আমি যা চাই, আমি যা স্বপ্ন দেখেছি সবই সুশান্তর মধ্যে দেখতে পেতাম। এখনও আবার ভাবতে কষ্ট হয় যে, এতদিন ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা মানসিকতা কেমন একমুহূর্তের একটা ঘটনায় মাকড়সার জালের মতো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

শারীরিক ব্যাপারে সুশান্তর অক্ষমতা একটা বড় ব্যাপার হলেও সেটা কিন্তু আমি কখনোও বড়ো করে দেখতাম না। আমার মনে হয়, কোনো মেয়েই দেখে না। হাজার হাজার সুখী মেয়ে আছে যারা এ বাবদে সুখী নয়, সুখী হয়নি। কিন্তু তাদের স্বামীরা তাদের আরও এমন কিছু জীবনে দিয়েছে যে তারা এইদিকের অপূর্ণতা অনায়াসে ভুলে গেছে। সেই অন্য অনেক কিছু বলতে যে শুধু টাকা-পয়সাই পড়ে তা নয়। টাকা-পয়সা, স্বচ্ছলতা এসব ভীষণ দরকারি; কিন্তু এর চেয়েও বড়ো জিনিস চাইবার থাকে আমাদের পুরুষদের কাছ থেকে। কথাটা কী করে বোঝাব জানি না। হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেলে, যখন ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে আসে, ঝড়ের রাতে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে যখন বুকের মধ্যে চমক দিয়ে বাজ পড়ে, অতর্কিতে যখন খাটের তলা থেকে কুৎসিত আরশোলা ডানা মেল ফরর-র-র ফরর র-রা করে ঘরময় উড়ে বেড়ায়, ঠিক তখন, ঠিক সেই মুহূর্তে আমি বা অন্য যে-কোনো মেয়ে যার দিকে দৌড়ে যাই, যার হাতে হাত রাখতে চাই, সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হয়ে, নিজেদের দেশি-বিদেশি ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি, আমাদের সব ইণ্ডিপেনডেন্স ও লিবারেশানের গুমর ভুলে গিয়ে আমরা যাদের বুকে আছড়ে পড়ে যাদের ওপর নিঃশর্ত নির্ভরতায় নির্ভর করি–একমাত্র তারাই তা দিতে পারে; যা মেয়েরা চায়।

 শীতার্ত দিনের উষ্ণতা, অন্ধকারে আলো, অনিশ্চয়তার মধ্যে নিশ্চয়তা এবং আমাদের কাছে সবচেয়ে যা বড়ো, সেই অন্তরের অনাবিল অবলম্বন যে পুরুষ দিতে পারে, মেয়েরা তাকেই পুরুষ বলে মানে। তাকেই তার নরম শরীরে, তার ভঙ্গুর কম্পমান মনে আদর করে বরণ করে নেয়।

এত কথা মনে হচ্ছে এই জন্যেই যে, সুশান্তর আচরণে, তার চোরের মতো আসা, ধরা পড়া এবং চোরের মতো পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে এমন এক কাপুরুষতা ছিল, এমন এক বিশ্রী ব্যাপার ছিল যে, তার সেই ক্ষণিকের ব্যবহার, তার আগের এতদিনের ছবি আমার কাছে একেবারে মলিন করে দিল। ও মলিন হয়ে গেল সেনের পটভূমিতে। হঠাৎ করে আবিষ্কার করে বসলাম আমি যে, যে-লোকটা কাউকে, নিছক ভালোবাসার দাবিতে, বিনা ভূমিকায়, বিনা আড়ম্বরে ঠাস করে চড় লাগাতে পারে–আর যাই-ই হোক সে লোকটার মধ্যে মেকি কিছু নেই। এসব লোক কথায় কথায় রবার্ট ফ্রস্ট বা টি এস এলিয়ট বা জীবনানন্দ আওড়ায় না, এরা আধুনিক ফিল্ম-এর ওপর অথরিটি বলে নিজেদের দাবি করে না, এরা পৃথিবীর তাবৎ শিল্পবোধ ও রুচিজ্ঞানকে এদের সিগারেট ধরা আঙুলগুলির মধ্যে বন্দি করে রেখেছে বলে বিশ্বাস করে না–এরা সাদামাটা লোক–এরা কেউ ইঞ্জিনিয়র, কেউ কেরানি, কেউ পিয়োন, কেউ ডাক্তার–কিন্তু এরা একটা বাবদে সমান–তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি পেশা বৃত্তি যাই-ই হোক না কেন–এরা নিজেদের ওপর, এদের প্রত্যেকে নিজের নিজের ওপর বিশ্বাস রাখে। এদের প্রত্যেকের আত্মবিশ্বাস আছে।

 আমি নারীজাতির প্রতিনিধি নই, সকলের কথা আমি জানি না–আমি আমার কথা জানি। এই-ই আমার মত। যে পুরুষের সমস্ত ব্যাপারে তার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস নেই, সে কাউকে ভালোবাসার শখ রাখে, কিন্তু তার চোখের সামনে তার ভালোবাসার জনকে অন্য লোক মেরে যেতে পারে, তেমন লোককে ভালোবাসা নিরুপমা চৌধুরির পক্ষে সম্ভব নয়।

সুশান্তটা একটা থার্ডক্লাস ফ্লপ। ও একটা ভন্ড। রমেনের মতো ক্রুড ভন্ড নয়; রিফাইনড ভন্ড। এদের উচিত বালিগঞ্জ পাড়ার মেগিয়া-স্লিভস ব্লাউজ পরা কোনো বড়ো লোকের ইনসিপিড নেকুপু মুনু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা। নিরুপমা সুশান্তর জন্যে নয়।

কিন্তু ওকে যা দেবার তা তো দিয়েই দিয়েছি। তার পুনরাবৃত্তি হবে না, কিন্তু তা তো আর ফেরানোও যাবে না।

মনে মনে এত কথা বললাম বটে, কিন্তু কখনো-সখনো সুশান্তর কথা ভেবে মনটা একটু একটু খারাপও হচ্ছিল। ওর টানা-টানা কালো চোখ দুটি আমার চোখের সামনে ভাসছিল। তারপর মনে মনে নিজেই নিজেকে বললাম, দুপুরবেলায় খোঁটায় বাঁধা গোরুদের চোখও তো ওরকম হয়।

আমি জানি না আমি কী করব? নিরুপমা চৌধুরি আর কতবার, কতবার, কতবার এমন করে ভুল করবে? প্রতিপদে-পদে কতদিন নিজের জীবনটাকে এমন হোঁচট খাওয়াতে খাওয়াতে এগিয়ে নিয়ে যাবে–আর কতদিন? নিরুপমা, তুমি কি চিরদিন ভুলই করবে? চিরটা দিন; চিরটা কাল?

 সেনের ভাবনাটা আমাকে আজ দুপুর থেকে ভীষণ পেয়ে বসেছিল। সেনের ঠিকানা আমাদের ঠিকানার খাতায় লেখা ছিল। দু-বার সেই ঠিকানাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম। কী করব বুঝতে পারলাম না। জীবনে এমন সময় অনেক আসে যখন কী করব বা কী করা উচিত তা কেবল নিজেকেই ঠিক করতে হয়। নিজের পাশে দাঁড়াবার বুদ্ধি দেবার মতো কেউই থাকে না তখন। আমার স্কুলও খুলে এল বলে। রমেন যদি সত্যিই আর না ফিরে আসে তাহলে আমায় কোনো হোস্টেলে গিয়ে উঠতে হবে। একা আমার পক্ষে এরকমভাবে থাকা সম্ভব নয়। কোনোও দিক দিয়েই নয়। তারপর বুঝেসুঝে কোলকাতাতেই চলে যেতে হবে লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে।

আজ কখন যে উদভ্রান্তর মতো সেনের ঠিকানার দিকে বেরিয়ে পড়েছিলাম সন্ধের মুখে, আমি নিজেই জানি না। যখন সাইকেলরিকশা নিয়ে ঠিকানা চিনে পৌঁছোলাম তখন সন্ধে সাতটা। সেনকে পাওয়া গেল না, একজন মাদ্রাজি ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এসে বললেন যে, সেন সাহেব নতুন বাসায় উঠে গেছেন তাঁর চাকরিতে উন্নতি হয়েছে বলে। ভদ্রমহিলা সেই নতুন বাসার ঠিকানাও দিলেন।

অনুমানে বুঝলাম যে, ভদ্রমহিলার স্বামী রমেনদের কারখানাতেই কাজ করেন। আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করাতে আমি বললাম, আমি সেনের কাজিন হই।

সেই নতুন ঠিকানা অনেক দূর এখান থেকে–পশ পাড়ায়। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। একবার ভাবলাম বাড়ি ফিরে যাই, আর একবার ভাবলাম, না এখনই যাই ওর কাছে।

তারপর রিকশা ঘুরিয়ে নিয়ে এগোলাম নতুন ঠিকানার দিকে।

এ ক-দিন দিন-রাত ভাবনা-চিন্তায় আমার শরীরটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল–চোখ বসে গিয়েছিল–খাওয়া-দাওয়ারও অনিয়ম হয়েছে খুব–রাতে প্রায় বেশির ভাগ দিনই খাই-ই নি কিছু। ঘুমোতেও পারিনি।

রিকশাটা গিয়ে যেখানে দাঁড়াল সেটা রীতিমতো বড়লোকি জায়গা।

রিকশাওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে রেখে, ওর বাড়ির পাশের একটা পানের দোকানের আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলাম। এ ক-দিনে একেবারে হতশ্রী হয়ে গেছি আমি। আমাকে চেনা যায় না একেবারে! কিন্তু উপায় নেই–সেনের সঙ্গে একবার দেখা করা আমার বড়ো দরকার। নিজেকে বোঝার জন্যে। ওকে বোঝার জন্যে।

দরজার কলিংবেল টিপলাম।

বেয়ারা এসে দারুণ সাজানো-গোছানো একটি ড্রইং রুমে এনে আমাকে বসাল। বলল, সাহাব আভি কারখানাসে আয়া। আপ তসরীফ রাখিয়ে। উনোনে নাহানে গ্যায়া।

আমি বললাম, ঠিক হ্যায়।

 ব্যাপারটা আমার একটু অবাক অবাক লাগছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যে কারখানায় সেনের এমন কী উন্নতি হল যে ওই বাড়ি থেকে একেবারে এই বাড়িতে উঠে এল? হঠাৎ মনে হল, ভুল ঠিকানায় আসিনি তো! লোকটিকে আবার ডেকে ভালো করে শুধোলাম, সেনের নাম, সেনের কোম্পানির নাম।

সব ঠিক ঠিক মিলে গেল।

 ড্রইং রুমটার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। একটি বড় সোফা সেট, একটা গ্লাস টপ দেওয়া গোল সেনটার টেবল। মেঝেতে হালকা সবুজ-রঙা কার্পেট। চতুর্দিকে

স্বাচ্ছল্যর সঙ্গে সুরুচির ছাপ পরিষ্কার। আমার বড়ো ইচ্ছা ছিল এমন একটা বসবার ঘর থাকুক আমার। বড়ো ইচ্ছা ছিল। রমেনকে নিয়ে আমি যা যা স্বপ্ন দেখতাম, তার মধ্যে এও একটা স্বপ্ন।

 বসে বসে ভাবছিলাম, সেনও রমেনের মতোই ইঞ্জিনিয়ার। তবে পড়াশোনায় সেন খুব ভালো ছিল, রমেনের কাছে শুনেছি আমি। হয়তো ভালো করে কাজ করেছে, সভাবে খেটেছে, হয়তো ফাঁকি দেয়নি। রমেনদের কোম্পানি সরকারের নয়; খুব বড়োও নয়, তাই এখনও যোগ্যতার ও সতোর দাম আছে এসব জায়গায়।

এত সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ভেতরের প্যাসেজ থেকে চটির আওয়াজ শুনতে পেলাম।

 সেন পায়জামা আর আদ্দির পাঞ্জাবি পরে পর্দা সরিয়ে ঘরে এসে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল।

 পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ ও

 তারপর থতমত খেয়ে বলল, তুমি! আপনি! কী মনে করে?

আমিও উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারলাম না। বললাম, এমনিই। কোনো দরকার নেই। এমনিই।

সেনের দিকে তাকিয়ে সেনকে যেমন ও যতখানি কুৎসিত দেখাত আগে, ততখানি দেখাল না। মনে হল, যে ছেলেটির মোটরসাইকেলের পিছনে বসে আমি বেড়াতাম, এ সে নয়। এ অন্য কেউ। সেই নাবালক ছেলেমানুষ কবে যেন সাবালক বীরপুরুষ হয়ে গেছে। পুরুষমানুষদের কৃতিত্বর পটভূমিতে তাদের বিচার করলে, তাদের চেহারাটা মানে চোখ মুখ নাক গায়ের রং বোধ হয় আলাদা করে চোখে পড়ে না; যা চোখে পড়ে তা বোধ হয় তাদের ব্যক্তিত্ব। কেন জানি না, যেদিন আমাকে সেন চড় মেরেছিল, সেদিনও ওর চেহারাটা খুব ব্যক্তিত্বময় বলে মনে হয়েছিল আমার।

অনেকক্ষণ আমি সেনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সেন যেন আদেশের সুরে বলল আমায়, বোসো।

তারপরই বলল, তোমাকে তুমিই বলছি, কারণ বয়সে তুমি আমার চেয়ে সামান্য ছোটোই হবে। রমেনদার সম্পর্কে তুমি আমার বউদি হতে–সে সম্পর্কটা যখন আমাদের কেউই আর মানি না তখন তোমাকে তুমি বলার কোনো বাধা দেখি না।

আমি বসে পড়লাম।

সেন বলল, তুমি কিছু খাবে?

আমি বললাম, না।

না কেন?

ও একথাটাও আদেশের সুরে বলল।

আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম। বললাম, শুধু চা।

 সেন বেয়ারাকে ডেকে বলল, সিরিফ চায়ে লাও। আর কিছু যে আনতে বলল না, তা আমি লক্ষ করলাম।

তারপর বলল, রমেনদার খবর জানো?

আমি মাথা নাড়লাম।

তুমি কি আমার কাছে তার খবর জানতে এসেছ?

আমি আবার মাথা নাড়লাম।

 ও বলল, তাহলে কেন এসেছ? কেন?

আমি বললাম, জানি না।

আমি মুখ নীচু করে রইলাম। পরমুহূর্তেই আমি বুঝতে পেলাম যে, আমার দু-চোখ জলে ভরে গেছে।

 সেন আমার দিকে অপলকে তাকিয়ে ছিল। শুকনো চোখে। ওর চোখে অনুশোচনা, সমবেদনা বা বিস্ময় কোনো কিছুই ছিল। ফারনেসের পাশের হাওয়ার মতো ওর চোখ দিয়ে এক আশ্চর্য গরম হলকা বেরোচ্ছিল। ওর চোখে কোনো ভাবালুতা ছিল না।

সেন আমার সঙ্গে কোনো কথা বলল না। সমস্তক্ষণ শুধু আমার চোখে চেয়ে রইল।

একটু পরে বেয়ারা ম্যাটস-পাতা ট্রেতে বসিয়ে, সুন্দর টি-কোজীতে ঢাকা টি-পটে চা নিয়ে এল।

সেন উঠে এসে আমার পাশে বসল। নিজে হাতে চা ঢালল। তারপর বলল, চিনি ক-চামচ?

 আমি বললাম, তোমার?

ও আবার নিজের জায়গায় গিয়ে স্বগতোক্তির মতো বলল, সারাদিন কারখানায় থেকে শরীর এত কষে যায় যে কিছু ভালো লাগে না।

আমি বললাম, একটা করে বিয়ার খাও না কেন? ফিরে এসে? গরমের দিনে?

সেন অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে।

তারপর বলল, কে আনায়? কে দেয়? নিজের জন্যে কখনো কিছু করিনি ছোটোবেলা থেকে, অভ্যাস নেই, ভালোও লাগে না।

আমি কথা বললাম না আর।

কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, উঠি।

সেন বলল, বেশ। বলে উঠে দাঁড়াল। একবারও বলল না আবার এসো, বলল না যে ও খুশি হয়েছে। বলল না আর একটু বোসো।

ও দরজা অবধি এসে দরজা খুলে দিল।

 দরজা খুলতেই দেখি একটা সাদা স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির পাশে কোম্পানির নীলাভ ইউনিফর্ম পরা ড্রাইভার।

ড্রাইভার এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল আমার জন্যে।

সেন বলল, মেমসাব রিকশাসে যায়েগী–তুম গাড়ি গ্যারাজমে লাগা দেও।

রিকশাওয়ালা একটু দূরে দাঁড়িয়েই ছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে আসতে লাগল।

এমনসময়ে সেন আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, এটা ভদ্রলোকের পাড়া এখানে বাজারের মেয়েরা যাওয়া-আসা করে না। এমন করে আর এসো না, বুঝলে?

আমার কান দুটো গরমে ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। ওর দিকে না তাকিয়ে, ওকে কিছু না বলে আমি রিকশায় উঠে বসলাম।

রিকশাওয়ালা রিকশা চালিয়ে দিল।

একবার পিছন ফিরে দেখলাম সেন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে তখনও সেই শুকনো আগুনের হলকা। মুখে কোনো ভাব নেই। ভাবলেশহীন কঠিন আত্মমগ্ন মুখ।

সেদিনও রাতে আমার খাওয়া হল না। রাত তিনটে অবধি বিছানায় ছটফট করলাম আমি। তারপর মনস্থির করে ফেললাম। ঠিক করলাম, কালই সকালের স্টিল-এক্সপ্রেসে কলকাতা যাব। আমাদের বাড়ি গিয়ে উঠব। এতদিনে আমার মাথা উঁচু করে থাকার দিন বুঝি সত্যিই শেষ হয়ে গেছে। যে-বাড়ি থেকে একদিন সানাইয়ের আওয়াজের মধ্যে সকলকে কাঁদিয়ে এসেছিলাম, সে-বাড়িতে কাল দুপুরের রোদে চিলের কান্নার মধ্যে ভীরু পায়ে চোরের মতো ফিরে যাব। বাবার পা জড়িয়ে ধরে বলব, বাবা আমি ভুল করেছিলাম, বলব, বাবা তুমি আমাকে চাবুক মারো, চাবুক মেরে আমার পিঠের চামড়া তুলে দাও।

অন্য মেয়ে হলে হয়তো এ অবস্থায় আত্মহত্যা করত। কিন্তু আমি যে এই সুন্দর পৃথিবীকে বড়ো ভালোবাসি, আমার এই এক ও একমাত্র জীবনকে যে আমি বড়ো ভালোবাসি। আমি যে নিজেকে নিজে হাতে মারতে শিখিনি। মারার কথা ভাবিওনি কখনো। এ জীবনে সকলে কি আমাকে ঠকাতেই এসেছিল? আমর কি এই-ই প্রাপ্য ছিল পৃথিবীর কাছ থেকে? আর কিছুই কি আমার পাওয়ার ছিল না কারও কাছে?

 রাত তিনটে নাগাদ উঠে মুখ-হাত ধুয়ে আমার সুটকেসটা গুছিয়ে নিলাম আস্তে আস্তে। আপাতত একটা সুটকেস নিয়েই যাই। তারপর দাদা-দিদিদের কারও সঙ্গে ফিরে এসে সব বন্দোবস্ত করব।

ভোর পাঁচটার আগেই অন্ধকার থাকতে থাকতে মুখীকে উঠিয়ে একটু চা করতে বললাম। তারপর আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে মুখীকে পাঠালাম কালীবাড়ির মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি ডেকে আনতে। মুখী চলে গেলে দরজা বন্ধ করে স্যুটকেস নিয়ে বাইরের ঘরে বসে থাকলাম আমি। আমার অস্পষ্ট অজ্ঞাত ভবিষ্যতের মধ্যে।

এই সময়ে সুশান্তর কথা আমার ভীষণ মনে হচ্ছিল। ওরও হয়তো দুঃখ হয়েছে আমার জন্যে। ও-ও নিশ্চয়ই ওর মতো করে আমাকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু ও বড়ো পুথি-পড়া বিদ্বান, ও বড়ো স্বার্থপর, ও বড়ো ভীরু–ওর মতো ছেলের ওপর জীবনে একবার ভুল করার পরও দ্বিতীয়বার নির্ভর করা যায় না। ওরা দূর থেকে মেয়েদের মন কাড়তে পারে, মেয়েদের সহানুভূতি পেতে পারে; কাছ থেকে নয়। ওদের নিয়ে একঘরে বাস করা যায় না। ওরা অন্তরে পুরুষ নয়, ওরা পোশাকি পুরুষ।

কলিংবেলটা বাজল। বাইরে ট্যাক্সি থামার শব্দ হয়েছিল একটু আগে। ট্যাক্সি পেতে মুখীর দেরি হয়নি।

আমি সুটকেসটা হাতে করে এসে দরজা খুললাম।

 দরজা খুলেই অবাক হয়ে গেলাম।

দেখি, সেন দাঁড়িয়ে আছে–কালকের সন্ধেয় যে পোশাক পরেছিল, সেই এলমেলো হয়ে যাওয়া পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে।

সেনের চুল উশকো খুশকো, হাতে গাড়ির চাবি। পেছনে ওর সাদা ছিপছিপে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।

সেন বলল, আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আশ্চর্য তুমি যে তৈরি হয়ে আছ? তুমি কি জানতে যে আমি আসব?

আমি অন্যদিকে চেয়ে বললাম, মুখীকে ট্যাক্সি ডাকতে পাঠিয়েছি। স্টিল এক্সপ্রেসে আমি কলকাতা যাব এখুনি।

সেন দরজাটা ভেজিয়ে দিল। আমার পথ আগলে বলল, তুমি কোথাওই যাবে না; তুমি এখন তোমার নিজের ঘরে যাবে; নিজের সংসারে।

আমি বললাম, পথ ছাড়ো। আমি সারারাত ঘুমোইনি। রসিকতা বোঝার মতো শরীর বা মনের অবস্থা নেই আমার।

সেনের চোখ দুটো আবার কাল রাতের মতো শুকনো হয়ে গেল।

ও বলল, আমিও সারারাত ঘুমোইনি। রসিকতা আমি করছি না। অন্তত তোমার সঙ্গে করিনি কখনো।

ইতিমধ্যে মুখী এসে গেল ট্যাক্সি নিয়ে।

 সেন মুখীকে বলল, আমিই পৌঁছে দেব দিদিমণিকে স্টেশনে।

বলেই, আমাকে কিছু বলতে দেবার আগেই পকেট থেকে পার্স বের করে ট্যাক্সি ওয়ালাকে দুটো টাকা দিয়ে দিল। তারপর গাড়ির বুট খুলে আমার স্যুটকেসটা পেছনে তুলে সামনের বাঁ-দিকের দরজা খুলে দিল আমার জন্যে। খুলে, দাঁড়িয়েই থাকল।

আমি মুখীর দিকে তাকালাম।

মুখী কী বুঝল জানি না। মুখী আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

 আমি মুখ বাড়িয়ে বললাম, বাড়ি ছেড়ে যাস না মুখী, সাবধানে থাকিস।

গাড়িটা স্টার্ট করেই সেন বলল, মুখীর জন্যে মন খারাপ হল?

আমি বললাম, না। আমার আবার মন খারাপ। আমার কারও জন্যেই মন খারাপ হয় না।

সেন হাসল। এই প্রথম হাসল ও আমার সামনে বহুদিন পরে।

আমি পাশ থেকে ওর মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। হাসলে ওকে আরও ছেলেমানুষ দেখায়।

 ও বলল, আজ হয় না, একদিন হয়তো হবে। কে বলতে পারে?

তারপরই বলল, মুখীকে আমরা কালই এসে নিয়ে যাব। মুখীর বরকেও। ও নইলে তোমার দেখাশুনো করবে কে?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথায়?

 তোমার বাড়িতে। তোমার নিজের ঘরে–তোমার চিরদিনের ঘরে।

আমি ভর্ৎসনার গলায় বললাম, কী ছেলেমানুষি করছ তুমি! ওসবের মানে বোঝো? আমার জন্যে তোমার এতসব ঝড়-ঝাঁপটা সইবার দরকার কী? আমি এমনি করেই বেঁচে থাকব আমার জীবন অভিশপ্ত হয়ে গেছে। আমাকে চলে যেতে দাও। এমন ছেলেমানুষি কোরো না। তা ছাড়া তোমার সঙ্গে তো আমি কখনো ভালো ব্যবহার করিনি–তুমি আমার সম্বন্ধে এত নিঃসন্দেহ কী করে হলে? আমি তোমাকে পছন্দ করি যে, তুমি তা জানলে কী করে?

সেন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, এখনও জানিনি। তবে একদিন যে করবে, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমাকে সুযোগ দাও তুমি। তোমাকে আমি প্রথম দিন থেকে ভালোবাসি। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, কিন্তু আমি প্রমাণ করব আমার ব্যবহারে যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তা ছাড়া তোমাকে যখন এমন করে ভালোবেসেই ফেলেছি তখন আমার চোখের সামনে তোমাকে নষ্ট হতে দিতে পারি না। তুমি যদি আমাকে ছাড়া, আমাকে ঘৃণাভরে চড় মেরেও সুখী হতে, সুখে থাকতে সবদিক দিয়ে, তাহলে আমার দুঃখ আমি একাই বয়ে বেড়াতাম। তোমার ওপর কোনোরকম দাবি করতাম না। কিন্তু এখন এ শুধু দাবি নয়, এ আমার কর্তব্যতে দাঁড়িয়েছে।

আমি বললাম, আমার প্রতি তোমার কোনো কর্তব্য নেই। তোমার অনেক দায়িত্ব আছে, তুমি ছেলেমানুষ, তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, তুমি কেন আমার জন্যে নিজেকে নষ্ট করবে? নিজের জীবন নষ্ট করবে?

নষ্ট নয়। নষ্ট নয়। আমি নিজেকে সার্থক করব। তুমি দেখো। সেন বলল। তুমি দেখো নিরুপমা।

দেখতে দেখতে আমরা ওর বাড়ির সামনে এসে পৌঁছোলাম।

বেল টিপতেই বেয়ারা এসে আমার সুটকেস ভেতরে নিয়ে গেল।

সেন আমার হাত ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে এল। ঢুকে বলল পছন্দ তো? এই-ই তোমার বসবার ঘর। তারপর খাবার ঘর, ভাঁড়ার ঘর, গেস্ট রুম, সব দেখিয়ে আমাকে বেডরুমে নিয়ে এল।

বলল, এই তোমার বেডরুম। আর বাথরুমটা পছন্দ?

বলেই বিরাট ঝকঝঝকে মোজাইক করা গিজার-লাগানো বাথটাব বসানো বাথরুম দেখাল। বেডরুমের এয়ারকণ্ডিশনার চালানোই ছিল। সেটাকে বন্ধ করে দিল ও। তারপর হঠাৎ সেন দরজাটা বন্ধ করে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। বলল, বড় কষ্ট পেয়েছ না নিরু, পৃথিবীর হাতে তুমি বড় কষ্ট পেয়েছ না?

তারপরই আমার গালে ওর হাত বুলোতে বুলোতে বলল, সেদিন তোমার গালে কি খুব লেগেছিল? ইশ-শ বেচারি। তোমাকে চড় মেরে আমি নিজে যে কত কষ্ট পেয়েছিলাম তা যদি তুমি কখনো জানতে! তুমি যে সেদিন আমাকেও বড় কষ্ট দিয়েছিলে।

দরজায় কে যেন টোকা দিল।

দরজা খুলে বেয়ারাকে সেন বলল, পেছনের বারান্দায় লনের পাশে চা দিতে।

বেয়ারা চা দিতে এসেছিল।

 বেডরুমের জানালা দিয়ে বারান্দাটা দেখা যাচ্ছিল। চওড়া সাদা টাইলের বারান্দা–সাদা রং-করা রট-আয়রনের চেয়ার-টেবল। লনে অনেকরকম ফুল করেছে মালি। আমি আনমনে বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

ভাবছিলাম, আমার মধ্যেও যেমন কতরকম ফুল ফুটছে এক এক করে। আমি সেই সুগন্ধি ফুলেদের ফোঁটা ভীষণভাবে উপলব্ধি করছিলাম। আমার কিছুতেই কিছু বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমার চারপাশের সব কিছু, সব ঘটনা অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছিল।

আমার বড়ো ভয় করছিল।

 সেন আমার ঘোর ভাঙিয়ে বলল, আমি জানি, আমি দেখতে ভালো নয়, হয়তো কোনদিক দিয়েই আমি তোমার যোগ্য নই, কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে চাওয়ার মধ্যে কোনো ফাঁকি নেই, কোনো চালাকি নেই। আমি আর যাই-ই হই, আমি ভন্ড নই নিরুপমা। তুমি যা দেখছ, যা শুনছ সবই সত্যি! তারপর একটু থেমে বলল, এই সবে শুরু। তুমি আমার সঙ্গে থাকলে, আমার পাশে থাকলে আমি জীবনে অনেক বড়ো হব; সার্থক হব। সেদিনও আমি ভুলে যাব যে, তুমি আমার পাশে ছিলে বলেই আমি বড়ো হয়েছি! আমি তোমার ওপর অনেক ব্যাপারে, জীবনের সমস্ত নরমক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করব। তুমিও সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে পারো আমার ওপর বাইরের ব্যাপারে। যা কষ্ট পেয়েছ; পেয়েছ। আজ থেকে তোমাকে আমি সবরকম কষ্ট থেকে আড়াল করে রাখব। তুমি দেখো। দেখো তুমি নিরুপমা। আমার সোনা।

আমি যেন অসুস্থ, যেন দুর্বল, যেন নিজের পায়ে আমার ভর নেই নিজের, এমনি করে আমার বাহু ধরে বারান্দার দিকে আমাকে নিয়ে যেতে যেতে সেন আস্তে আস্তে বলল, আমি চাই, আমার কাছে দু-দিন থাকার পর তুমি কলকাতায় তোমার বাবার কাছে যাও। আমি সব বন্দোবস্ত করে দেব। ওখানে গিয়ে তুমি ঠাণ্ডামাথায় সব ভেবে দেখো। তোমার দিক দিয়ে তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত–এখনও এবং ভবিষ্যতেও। যতখানি সময় চাও, আমি দেব; কিন্তু সময় নিয়ো। তোমার দিক দিয়ে তাড়া করার প্রয়োজন নেই কোনো। যা করবে, ভেবে কোরো।

তার পর বলল, আমার কথা বলতে পারি যে, আমার দিক দিয়ে ভাবাভাবি সব শেষ।

আমি মনে মনে বললাম, এক্ষুনি আমি বাবার কাছে যাব না।

 কিন্তু মুখে কিছুই বললাম না। আমি জানি, বাবার কাছে পরাজিত হয়ে না যেতে পারলেই আমি সুখী হই।

সেন মাঝরাস্তা থেকে আবার বেডরুমে ফিরে এল। ফিরে গিয়ে দেওয়ালজোড়া ওয়াড্রোবটা খুলল।

বলল, তোমার দিকটা খালি আছে। তোমার মনস্থির হলে তোমার জিনিস দিয়ে এটা ভরে দেব। তোমার পুরোনো জীবনের কোনো জিনিস এখানে এনো না। আমি নতুন–তোমাকে সব নতুন নতুন জিনিসে ভরে দেব। আর দেখো! এই ওয়াড্রোবে কাউকে লুকিয়ে রেখো না কিন্তু; কোনো বেড়ালকেও না।

আমার ভীষণ লজ্জা হল। আমি জবাবদিহি করতে যাচ্ছিলাম।

সেন আমার মুখে হাত চাপা দিল। বলল, না। পুরোনো কথাও ভুলে যেতে হবে। আমি কিন্তু ভুলে গেছি। আমি কিছু মনে করিনি, মনে রাখিনি–আমি যে তোমাকে ভালোবেসেছি নিরুপমা। আমার ভালোবাসার প্রকাশটা হয়তো বড়ো বুনো, বড়ো জংলি কিন্তু আমি যে। তোমাকে ভালোবাসি, এতে কোনো ফাঁকি নেই।

 এই অবধি বলে, সেন আমার দিকে এক অদ্ভুত আদুরে চোখে চেয়ে রইল।

যে ছেলেটিকে, যে নাবালক ছেলেটিকে একদিন চড় মেরেছিলাম। আমি, তার দিকে তাকাতে আজ আমার ভীষণ লজ্জা করতে লাগল। ও যেন সবদিক দিয়ে এ কয়েকমাসে আমার চেয়ে কত বড়ো হয়ে গেছে। ও যেন আমার নমস্য হয়ে গেছে। আমার সম্মানের যোগ্য হয়ে গেছে। আমি ভাবতে পারছিলাম না কী করে এমন হল; এত তাড়াতাড়ি কী করে হল। এত তাড়াতাড়ি সব কিছু কী করে বদলে যায়?

সেন আমার দিকে ওর দু-হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওর চেখে এক আশ্চর্য দৃষ্টি ছিল।

আমি স্বেচ্ছায়, ধীর পায়ে, সুস্থমস্তিষ্কে, এক শান্ত কুয়াশাহীন আনন্দে ভেসে হেঁটে গিয়ে ওর বুকে নিজেকে আত্মসমর্পণ করলাম।

জানি না। আমি কি আবারও ভুল করলাম? নিজের মনে আমি নিজেকে বললাম, তুমি কি আর একটিও ভুল সইতে পারবে? আর একটি ভুলও? নিরুপমা?

কী করে ও আমার মনের ভাবনা জানতে পেল জানি না। সেন আমার সিঁথিতে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে বলল, নিরুপমা, তুমি ভুল করোনি। দেখো, তুমি দেখো, এবারে তুমি ভুল করোনি।

আমি চুপ করে থাকলাম; আমি জানি না। একমাত্র কালই বলতে পারবে, ভবিষ্যই বলতে পারবে; আমি ভুল করলাম না ঠিক করলাম।

 সেনের বুকের আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই আমার মনে হল, এই ঠিক ভেবে ভুল করা এবং ভুল ভেবে ঠিক করা, এইসব ভুলের দুঃখ, সব ঠিক করার আনন্দ, এই টুকরো টুকরো সুখ ও দুঃখ নিয়েই তো আমাদের জীবনে। মনে হল, কারও জীবনেই, কেউ কাউকে সুখের গ্যারান্টি দিতে পারে না। জীবনে বেঁচে থাকতে হলে প্রতিনিয়ত দুঃখ হয়তো পেতেই হয়–তবুও এই অনেক দুঃখের মধ্যে যেটুকু সুখ যে ছিনিয়ে নিতে পারে, সেই-ই সুখী; সেই-ই তা পেল। যে ছিনিয়ে নিতে পারল না; পেল না। এর কোনো বিকল্প নেই।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ