মাধুকরীর ভূমিকা

প্রথম সংস্করণের নিবেদন

সম্পাদনা করা সত্ত্বেও হয়তো অনেক খুঁতই রয়ে গেল। আশা করি, পাঠক-পাঠিকারা আমাকে মার্জনা করবেন।

“মাধুকরী” যে ভবিষ্যৎ-প্রজন্মর পাঠকদের জন্যে লিখেছি তাতে আমার নিজের কোনওই সন্দেহ নেই। তবে এই প্রজন্মর অনেক পাঠক-পাঠিকাও এই উপন্যাস হয়তো আগ্রহ সহকারেই পড়বেন। কারণ, বর্তমানই গড়িয়ে গিয়ে ভবিষ্যতে পৌঁছয়।

এই উপন্যাস লিখতে বহু মানুষেরই সাহায্য পেয়েছি। মধ্যপ্রদেশ সরকারের ট্যুরিজম ডেভলাপমেন্ট করপোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শ্রী বি. কে. বাগচী আমাকে অনুরোধ করেছিলেন মধ্যপ্রদেশ সম্বন্ধে বাঙালি পর্যটকদের জন্যে বাংলা ভাষায় একটি বই লিখতে। সবরকম পৌনঃপুনিক সরকারি আতিথ্য এবং সাহায্যরও ঢালাও বন্দোবস্তর কথাও উনি অঙ্গীকার করেছিলেন। এমনই একটি বই, ইংরিজি ভাষাতে, বিখ্যাত কবি এবং ঔপন্যাসিক ডম মরেসকে দিয়ে ওঁরা লিখিয়েছিলেন কিছুদিন আগেই।

বাগচী সাহেবের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারিনি এই জন্যে যে, আমার পক্ষে বারংবার মধ্যপ্রদেশে যাওয়া এবং দীর্ঘদিন থাকা, ওই বই লেখার জন্যে সম্ভব ছিল না। লেখা আমার পেশা নয়, নেশা। পেশার কাজে কম ব্যস্ত থাকতে হয় না আমাকে এবং কম ঘুরেও বেড়াতে হয় না প্রতি মাসেই। তা ছাড়া পর্যটকদের জন্যে পুস্তিকা কোনও সৃজনধর্মী লেখকই সহজে লিখতে রাজি হন না। সুখের কথা এই যে, যে উদ্দেশ্যে বাগচী সাহেব এই প্রস্তাব করেছিলেন, তা মধ্যপ্রদেশ সরকারের কোনওরকম সাহায্য ছাড়াই সিদ্ধ হয়েছে। যদিও মাধুকরী পর্যটকদের হিতার্থের পুস্তিকা নয়, তবুও এই উপন্যাসের মাধ্যমে বাঙালিরা মধ্যপ্রদেশকে নতুন করে হয়তো আবিষ্কার করেছেন। বাগচী সাহেব গত এক বছরে দুবার চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন যে, ওঁদের ট্যুওর ঘোষিত হলে তাতে সাড়া পাবেন কিনা? গত পুজোর আগে যখন মধ্যপ্রদেশ সম্পর্কিত প্রদর্শনীর ব্যাপারে কলকাতায় এসেছিলেন উনি, তখন দেখাও করেছিলেন। অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। সত্যিই মধ্যপ্রদেশ এতই বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর রাজ্য যে এর পটভূমিতে আরও অনেককিছু লেখার ইচ্ছা আছে আমার, সময় হলে।

“মাধুকরী”তে অসংখ্য বাঙালি এবং বিদেশী ভাষাভাষি কবি, সাহিত্যিক এবং প্রবন্ধকারের কবিতা, লেখা এবং বইয়ের উল্লেখ করেছি। সকলের নাম এবং সব বইয়ের তালিকা দিলে হয়তো প্রকাশককে বই আরও এক ফর্মা বাড়াতে হবে। দামও বাড়বে বইয়ের। তাইই, তা থেকে নিরস্ত হলাম। কিন্তু উল্লিখিত কবি সাহিত্যিক ও প্রবন্ধকাররা ছাড়াও অনেক মানুষেরই ব্যক্তিগত সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছিল। অনেক লেখকের বই-এর সাহায্যে আমার শোনা-জানা নানা তথ্যর অভ্রান্ততা যাচাই করে নিতেও হয়েছে। তাঁদেরও সকলের নামোল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বল্পজনেরই উল্লেখ করছি নীচে। যাঁদের নাম বাদ পড়ে গেল তাঁরা নিজগুণে আমাকে মার্জনা করবেন এইই প্রার্থনা।

“হাটচান্দ্রা” ও “রাইনা” বলে মধ্যপ্রদেশে কোনও জায়গা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু মাধুকরী’র হাটচান্দ্রা, রাইনা, কিবুরু এবং সান্দুর সম্পূর্ণ আমারই কল্পিত। এ কথা এই জন্যেই জানালাম যে, ইতিমধ্যে চারজন পাঠিকা এবং ছ’জন পাঠক মধ্যপ্রদেশের ওই অঞ্চলে গিয়ে হন্যে হয়ে ‘হাটচান্দ্রা খুঁজে এবং না পেয়ে ফিরে এসে আমাকে ‘হাটচান্দ্রার সঠিক অবস্থান কোথায় তা জানতে চেয়ে চিঠি লিখেছেন। যাতে আর কেউই অযথা হয়রান না হন তাইই এই স্বীকারোক্তি।

পৃথু ঘোষ, রুষা, উধাম সিং, ইদুরকার, ভুচু, সাবীর মিঞা, শামীম, মৌলভী গিয়াসুদ্দিন, কুর্চি এবং অন্যান্য সব চরিত্রই সম্পূর্ণই কল্পিত চরিত্র। মধ্যপ্রদেশের কোথাও বা অন্যত্রও এইসব নামে কোনও চরিত্র থাকলে তা সম্পূর্ণই দুর্ঘটনাপ্রসূত। ব্যতিক্রম, একমাত্র এক সময়ের শিকারি দেবী সিং, মুক্কির কানহা সাফারি লজ-এর তৎকালীন ম্যানেজার প্রসাদ সাহেব, বাগচী সাহেব, লাওলেকার সাহেব এবং পারিহার সাহেব। তবে তাঁদের নামগুলিই সত্যি। কথোপকথন ইত্যাদি সবই কল্পিত।

দেবী সিং-এর কাছেই তার মৃত প্রতিযোগী ঠুঠা বাইগার গল্প শুনি। মৃত, অদেখা; ঠুঠা বাইগাকে পুনরুজ্জীবিত করেছি মাধুকরীতে। দেবী সিংএর সঙ্গেই বানজার বামনি গ্রামে গোন্দদের নাচও দেখতে যাই এক রাতে। আমিই নাচের বন্দোবস্ত করি। সঙ্গে প্রসাদ সাহেবকেও নিয়ে গেছিলাম। জঙ্গল সম্বন্ধে ওঁর দারুণ ভীতি ছিল। সে রাতেই বানজার নদীর উপরের সাফারি লজ-এর কাচ-ঘেরা সুন্দর বার’-এ বাগচী সাহেব, লাওলেকার সাহেব এবং পারিহার সাহেবের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেন প্রসাদ সাহেব যখন বানজার বামনি থেকে ফিরি। ওঁদের সঙ্গে আলাপও আকস্মিকই।

দিগা পাঁড়ে নামটি আমার খুবই পছন্দর। আজ থেকে বছর তিরিশ আগে হাজারীবাগে দিগা পাঁড়ে বলে একজন ডাকাতের দৌরাত্ম্য ছিল। পরে শুনেছি, সে নাকি ধরাও পড়ে। ‘দিগা পাঁড়ে’ শীর্ষক একটি ছোটগল্পও লিখেছিলাম বহুদিন আগে। সেই দিগা পাঁড়েকেই ‘মাধুকরী’তে সন্ত দিগা পাঁড়ে করে এনেছি।

আপনারা যদি কেউ মুক্কির কানহা সাফারি লজ-এ যান তবে সানজানা সাহেবের বাড়ির কেয়ারটেকার দেবী সিং-এর খোঁজ করবেন। অবশ্য যদি সে বেঁচে থাকে। সে হয়তো আমাকে ভুলে গেছে কিন্তু তাকে বলবেন যে, ‘মাধুকরী’র মাধ্যমে সে এবং তার মৃত সহযোগী এবং প্রতিযোগী ঠুঠা বাইগা আপনাদের স্মৃতিতে অনেকদিনই হয়তো বেঁচে থাকবে।

এ ছাড়াও, কৃতজ্ঞতা যাঁদের কাছে, বিভিন্ন কারণে, তাঁদের নামের তালিকা নীচে দিলাম—(১) ডম মরেস (২) পরিমলকুমার দাস, পাচপেডি, জব্বলপুর (৩) নির্মলকুমার দাস, কলকাতা (৪) এস সুব্রহ্মনিয়ম, বম্বে (৫) সোহনলাল ব্যাহাল, কলকাতা (৬) কুলদীপ ব্যাহাল, মুরহু, রাঁচী (৭) সুব্রত চ্যাটার্জী, চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কলকাতা (৮) অরূপরতন ভট্টাচার্য (9) শঙ্খ ঘোষ (১০) রামঅওতার পানকা, মালা (১১) ডঃ জয়ন্ত সেন, কলকাতা (১২) বিজয়া পাণ্ডে, রবীন্দ্রপুরী, বারানসী (১৩) মাধব সাহা, বরানগর (১৪) বাসন্তী সান্যাল, বাগচী ভবন, আগ্রা (১৫) মনি সেন, মারহাটাল, জব্বলপুর (১৬) মমতা লাহিড়ী, ছত্রিশগড়দুহিতা, কলকাতা (১৭) জ্যোতিভূষণ চাকী (১৮) পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, অল্টসেন্টার, ঘাজিয়াবাদ (১৯) ডঃ রনেশ ভৌমিক ও ডঃ দেবব্রত মৈত্র (২০) কৌশিক লাহিড়ী, ফ্রেজার রোড, বর্ধমান (২১) অরুণ বাগচী, কলকাতা (২২) বিজয় চক্রবর্তী, কলকাতা (২৩) অমিয়নাথ সান্যাল, কৃষ্ণনগর, (২৪) অনিলচন্দ্র মিত্র (২৫) ডঃ ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় (২৬) আইগর আকিমুশকিন, মস্কো (২৭) রেভারেণ্ড স্টিফেন ফুস, বম্বে (২৮) রেভারেন্ড নি. পনেট, রাঁচী (২৯) অচিন্ত্য গঙ্গোপাধ্যায়, রাঁচী (৩০) আর. কে. বিশ্বাস, ডাল্টনগঞ্জ (৩১) মিহির সেন, হাজারীবাগ এবং কলকাতা (৩২) অনন্তকুমার বিশ্বাস, কলকাতা (৩৩) রেভারেন্ড লাওনেল বারোজ, রাঁচী (৩৪) নবকুমার ব্যানার্জী, কাটিহার (৩৫) চণ্ডীদাস মাল, টপ্লাগায়ক, বালী, হাওড়া (৩৬) অসীমকুমার সিনহা, বেলঘরিয়া (৩৭) ছন্দা বসু, কলকাতা (৩৮) অধ্যাপিকা করবী ভট্টাচার্য, কলকাতা (৩৯) স্বপন সিনহা, বোলপুর, বীরভূম (৪০) শচীন দাস, কলকাতা (৪১) শ্রীপঙ্কজ দত্ত, কলকাতা এবং (৪২) শ্রীরাধাকান্ত শী, কলকাতা।

পরিশেষে একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, বাড়িতে আমার স্ত্রী ঋতু ও কন্যাদ্বয়, ত্রিনাথ ডাকুয়া এবং অফিসে আমার ভ্রাতা বিশ্বজিৎ, পি. এল. চৌমল, গৌতম গাঙ্গুলী, কঙ্কা লাহিড়ী এবং হরেন্দ্রনাথ সুরের অসীম ধৈর্য ও সহযোগিতা ছাড়া মাধুকরী’ আদৌ লেখা সম্ভব ছিল না।

প্রকাশ ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে ‘মাধুকরী’র প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স-এর শ্রীদ্বিজেন্দ্রনাথ বসু (বাদলবাবু), আর্ট ডিপার্টমেন্টের জয়ন্ত ঘোষ এবং সঞ্জয় দে এবং চিত্তরঞ্জন দে’র সহযোগিতা, উৎসাহ এবং কঠোর পরিশ্রমের কারণেও তাঁদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।

‘দেশ’-এর প্রতি-কিস্তিতে অনুজ সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় চমৎকার অলঙ্করণ করেছিলেন। আমার তো ধারণা ওঁর সুন্দর অলংকরণের কারণেই আপনারা মাধুকরী’ পড়তেন।

সুন্দর অলংকরণ করেছেন অনুজ নির্মলেন্দু মণ্ডল, তাঁকেও অজস্র ধন্যবাদ।

প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন, শ্রদ্ধেয় সুধীর মৈত্র। মাধুকরী’র যদি কদর হয় তাহলে তা সুধীরবাবুর প্রচ্ছদগুণেই হয়তো হবে। তাঁকেও অশেষ ধন্যবাদ।

বিনত
বুদ্ধদেব গুহ
কলকাতা
২২-১২-৮৫ রবিবার

 

নতুন মুদ্রণের ভূমিকা

‘মাধুকরী’ পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় সাতাশির বইমেলাতে। দশ বছর পরে এই রয়্যাল সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। গত দশ বছরে এই উপন্যাস বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

‘মাধুকরী’ উৎসর্গ করেছিলাম “একবিংশ শতাব্দীর নারী ও পুরুষদের”। তখন অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে, দশ বছর পরে এই উপন্যাসের অস্তিত্ব থাকবে তো?

অগণ্য পাঠক-পাঠিকা তাঁদের উষ্ণ হৃদয়ের ও বিনম্র শ্রদ্ধার যে-পুরস্কার দিয়েছেন তা আমার শিরোধার্য। মাধুকরী’ হারিয়ে যাবার মতন উপন্যাস নয়। কোনও পুরস্কারই কোনও উপন্যাসকে কালজয়ী করে না, করেন শুধু পাঠক-পাঠিকারাই। এই সরল সত্যটিই পুরস্কারের ভারে ন্যুজ অনেক লেখকই বোঝেন না। সেটা দুঃখের কথা।

‘মাধুকরী’ রয়্যাল সাইজ-এ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে অক্ষর বড় হয়েছে। অনেক। পড়তে সুবিধে হবে অবশ্যই। কিন্তু দামও হয়ে গেছে দুশো টাকা। এই দাম দিয়ে বই কিনবেন কিনা তা অনেকেই ভাববেন। কিন্তু সবিনয়ে বলব, অন্যান্য অনেক জিনিসের থেকে বইয়ের দাম এখনও তুলনামূলকভাবে কম।

নিজের জন্যেই কিনুন অথবা প্রিয়জনকে উপহারই দিন ‘মাধুকরী’ তিনপুরুষ ধরে পড়তে পারবেন। শিক্ষিত মানুষের কাছে প্রকৃত ভাল উপন্যাসের মতন আজীবন সঙ্গী আর কিছু নেই। এ ছাড়া অপারক লেখকের আর কীই বা বলার আছে! আপনাদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ।

বুদ্ধদেব গুহ
পোস্ট বক্স নং ১০২৭৬
কলকাতা ৭০০০১৯
২৯ জুন, ১৯৯৭

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ