সত্যি সত্যিই সন্ধ্যে লাগতে-না-লাগতেই অভী এসে পৌঁছেছিল ওদের বাড়িতে।

কাকা তখনও আসেন নি। কাকীমা বাড়ি ছিলেন।

সারা সকাল ও দুপুর ধরে কাকীমাকে সাহায্য করেছে বাবলি। ভিনিগারে সালাড ভিজিয়ে রেখেছে, চপের পুর বানিয়েছে, ফ্রায়েড রাইসের বন্দোবস্তু করেছে। আসল আসল পদ কাকীমা নিজেই বেঁধেছিল। বাবলি শুধু আনারসের চাটনিটা বেঁধেছিল।

কাকার কথামতন বীয়ার আনিয়ে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল। ফিশফিঙ্গার সব ঠিক-ঠাক করে রেখেছিল, কাকা এলেই গরম ভেজে দেবে ওদের–যাতে বীয়ারের সঙ্গে খেতে পারেন ওঁরা।

চারটে বেজে যেতেই কাকীমা বলেছিলেন, তুই এবার হাউসকোট ছেড়ে গা-টা ধুয়ে নে বাবলি। অভী যদি তাড়াতাড়ি সত্যিই আসে, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলবে কে? আমার সবকিছু করে চান-টান সেরে আসতে দেরি হবে অনেক।

বাবলি বলেছিল, দাঁড়াও কাকীমা, স্যালাডটা সাজাই। তারপর বসবার ঘরে, খাওয়ার টেবিলে ফুল সাজাতে হবে না বুঝি?

খুব ভালো করে ফুল সাজিয়েছিল সব ঘরে বাবলি। দিল্লির এক জাপানী ভদ্রমহিলার ‘ইকেবানা’ স্কুলে কিছুদিন ক্লাসে করেছিল ও। অনেক কিছু শিখেছিল, কি করে কোন পাতার সঙ্গে কি ফুল কেমনভাবে সাজাতে হয়। আজ যেমন যত্ন করে মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে ফুল সাজাতে বসল বাবলি, তেমন যত্ন ভরে কখনও সাজিয়েছে বলে ওর মনে পড়ল না।

কাকীমা শেষে ধমক লাগালেন। বললেন, কি রে? তুই চান করতে যাবি কি যাবি না?

চান করে উঠে সাধারণ অথচ খুব সুন্দর করে সাজলো বাবলি। একটা সাদা খোল লাল পাড়ের টাঙ্গাইল শাড়ি পরল ও। সঙ্গে লাল রঙা ব্লাউজ। চুড়ো করে খোঁপা বাঁধল। মধ্যে ফলস-খোঁপা ভরে। আলমারি খুলে রুবীর দুল পরল, রুবীর মালা একটা। চুলে হেয়ার স্প্রে লাগালো। গায়ে হাল্কা করে ইন্টিমেট। তারপর লাল গোলাপ জল একটা চুলে, কানের পেছনে। চোখে কাজল লাগাল। লাল টিপ পরল সিঁদুরের; কপালে।

সাজা শেষ হলে, আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সিন্ডারেলার মতো আয়নাকে শুধাল, বল তো আয়না, কে বেশি সুন্দরী? ঝুমা না বাবলি? বলো না আয়না?

আয়নার কাছ থেকে কোনো জবাব পাবে না জানত বাবলি। কিন্তু আয়নার সামনে মুখ উঁচু করে দাঁড়িয়ে, নিজের দিকে নিজের সুতা, সুসজ্জিতা, সুগন্ধি শরীরের দিকে তাকিয়ে বাবলির খুব পছন্দ হল নিজেকে। দাঁতে দাঁত চাপলো বাবলি। বলল, ঝুমা-তুই জানিস না। তুই জানিস না। তোকে আমি হারিয়ে দেব। তোকে আমি বলে বলে হ্যান্ডজ্ঞাউন হারাবো।

অভী যখন এল, তখন বাবলির প্রসাধন শেষ হয়ে গেছে। তবুও ইচ্ছা করে নিজে দরজা খুলতে গেল না বেলের আওয়াজ শুনে। কিষাণ সিং গিয়ে দরজা খুলে বসাল অভীকে, বসবার ঘরে।

মিনিট পাঁচেক পরে, যেন জানেই না অভী কখন এসেছে, এমনভাবে বাবলি বসবার ঘরে ঢুকে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ওমা! কখন এলেন?

অভী কথা বলল না। একদৃষ্টে বাবলির দিকে চেয়ে রইলো।

অনেকক্ষণ–অনেকক্ষণ চেয়ে রইল।

বাবলির সেই সন্ধ্যেবেলার শান্ত, স্নিগ্ধ উজ্জ্বল চোখ দুটি ওর দু’চোখ ভরে রইল। অভীর হঠাৎ মনে হল, এইরকম কোনো শান্ত স্নিগ্ধ দৃশ্য বুঝি ও আগে কখনও দেখে নি। ওর মনে হল এই জন্যেই বিবাহিত পুরুষেরা বুঝি অফিসের পর বাড়ি ফেরার জন্যে এত পাগলের মতো করে। তারপর সকলের জন্যেই কি এমন দৃশ্য অপেক্ষা করে থাকে? জানে না অভী। যদি থাকেই, তাহলে বলতে হয় বুদ্ধিমান লোক মাত্রেরই বিয়ে করা দরকার।

বাবলি পর্দার কোণায় দাঁড়িয়েছিল স্থাণুর মতো।

অনেকক্ষণ কেটে গেল। তবুও যখন অভী কথা বলল না, বাবলি হাসল। বলল, কি দেখছেন এমন করে? আমি কি সাদা বাঘ?

অভী বলল, না। এমনিই দেখছি। আপনাকে ভালো দেখাচ্ছে। এই গরম হাওয়ায় চোখে জ্বালা ধরে গিয়েছিল ট্যাকসিতে আসতে আসতে। চোখ জুড়িয়ে গেল আপনাকে দেখে।

তারপর চুপ করে থেকে বলল, আপনি কি সকলের জন্যেই এমন সুন্দর করে সাজেন?

বাবলি রেগে গেল। বলল, সকলের জন্যে মানে? আপনার কি ধারণা রোজই আমি এমন করে সেজে থাকি নতুন নতুন অতিথির জন্যে?

তারপর বলল, আমাকে এমন অসম্মানজনক কথা বলার অধিকার আপনাকে কে দিল? আমি তো দিই নি।

অভী প্রথমে অবাক হল। তারপর হেসে ফেলল।

বলল, নাঃ, আপনি বড় ঝগড়াটে। আমার মা একটা কথা বলতেন আমার এক কাকীমা সম্বন্ধে। বলতেন, ও বাতাসের সঙ্গে ঝগড়া করে। কথাটার মানে বুঝতাম না। আপনাকে দেখে এতদিনে বুঝলাম, বাতাসের সঙ্গে ঝগড়া করা কাকে বলে।

বাবলির মুখ অভিমানে গোলাপী হয়ে গিয়েছিল।

অভী কথা ঘোরাবার জন্যে বসবার ঘরের কোণার কটেজ-পিয়ানোটা দেখিয়ে বলল, আপনি বাজান? পিয়ানো?

বাজাতাম। কাটা জবাব দিল বাবলি।

বলেই, উল্টোদিকের সোফায় বসে পড়ল।

অভী বলল, পিয়ানো শুনতে আমার দারুণ লাগে। ডো-রে-মী-ফা সো লা-টি-ডো।

বাবলি ঠাট্টা করার গলায় বলল, সাউন্ড অব মিউজিক দেখেছিলেন বুঝি? নইলে সা-রে-গা-মার ইংরাজি নাম শুনে এত শিহরণ হবে কেন?

অভী অপ্রতিভ হয়ে বলল, আপনি লোককে খুব অপদস্থ করতে পারেন। ইচ্ছে করে অপদস্থ করেন যখন-তখন। এমন করে খুব আনন্দ পান আপনি, না?

তারপরই বলল, বাজান না বাবা এত করে বলছি।

বাবলি বলল, থাক, অত পিয়ানো শুনে কাজ নেই।

একটু পরে বলল, কি খাবেন বলুন? কাকা আপনার জন্যে বীয়ার আনিয়ে রাখতে বলেছিলেন। ফ্রিজে আছে। আনি? খান ততক্ষণ, কাকা না আসা পর্যন্ত।

অভী বলল, বাঃ, নিমেষদার খুব দূরদৃষ্টি আছে তো। দিল্লির এই গরমে বীয়ার খাওয়া মন্দ না। তবে কিছু মনে করবেন না, আমি খাব না। আমার পৈটিক গোলযোগটা এখনও আছে।

বাবলি বলল, শুধু পৈটিক নয়, মনে হয় মানসিক গোলযোগও আছে।

ইতিমধ্যে কাকা এলেন।

এসেই বললেন, কি হে? কখন এলে?

–এই একটু আগে। বলে অভী উঠে দাঁড়াল।

কাকা বললেন, রাজীব আর সোমা এল না? ওদের এত করে বললাম।

অভী ওকালতি করল, বলল, ওয়েস্ট জার্মানীর অ্যামবাসাডরের বাড়ি ওদের একটা নেমন্তন্ন আছে, না গেলেই নয়।

কাকা টাই খুলতে খুলতে বললেন, তাহলে আর কি করবে? বাবলির আমবাসাডর কি ওয়েস্ট জার্মানীর অ্যামবাসাডরকে টেক্কা দিতে পারে?

বাবলি আবার রেগে উঠে বলল, বাবলির অ্যামবাসাডর মানে?

কাকা হেসে বললেন, বাবলির প্রতিভূ, আবার কি? আমি, আমি অন্য কেউ নই।

বলেই বাবলির দিকে চেয়ে বললেন, তুই অত চটে যাচ্ছিস কেন? বাবলি বলল, না। আমার এরকম রসিকতা ভালো লাগে না।

কাকা অভীর দিকে চেয়ে চোখ নাচিয়ে বললেন, ভেবেছিলাম রাজীবের ভাইটা ভদ্র সভ্য। একা ঘরে বসে আমার অবলা ভাইঝিকে কি বলেছ হে ছোঁকরা যে, ভাইঝি আমার এমন চটিতং হয়ে আছেন? ওয়ার্থলেস্ তুমি? আমার মতোই ওয়ার্থলেস। কি করে মেয়েদের প্লিজ করে কথাবার্তা বলতে হয় তুমি কিছুই জান না। শেখ নি কিছুই।

তারপর সোফায় বসে পড়ে বললেন, বুঝলে অভী, আজ বাবলির মেজাজ গরম হওয়ার কারণ আছে। সকালবেলাতেই এক বুড়ো পাঞ্জাবী ভদ্রলোক অনেক মিঠাই মণ্ডা ফলটল নিয়ে হাজির বাড়িতে। জানা গেল বাবলির অ্যাসেসী–তাঁর ইনকাম ট্যাকসের কেস বাবলির কাছে। বাবলির কাছেই শুনলাম, বাবলি নাকি কি সব গোলমাল-টোলমাল ধরে ফেলেছে ব্যালান্স-সীটে।

ভদ্রলোক বাড়ি আসাতে বাবলি তো চটে গেল। ভদ্রলোককে অপমান করে তাড়িয়ে দিল বাড়ি থেকে। বুড়োর চোখে জল এসে গেল। বুড়ো বার বার বললেন যে, তোমার কাছে কোনো ফেভার চাইতে আসি নি আমি। আমার এক মেয়ে ছিল, হুবহু তোমার মতো দেখতে। তা-ই তোমাকে আমার বড় মায়া পড়ে গেছে। আমাকে এমন করে তাড়িয়ে দিয়ো না।

কিন্তু বুঝলে ভায়া, একে অফিসার তার উপর কড়া অফিসার-ইন্দিরা গান্ধীর দিল্লিতে এমন মেয়েদের দৌরাত্ম্যর কথা তো সে বুড়ো জানে না। সে অন্ধ অপত্যস্নেহে ভর করে বাড়িতে এসেছিল। অ্যাসেসীরা কেউ-ই যে মানুষ নয়, তারা যে সকলেই সন্দেহ করার, ভয় করার, অবিশ্বাস করার লোক, এ কথাটা বাবলি বোধহয় ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছে।

অভী বলল, বাবলিকে, বাবলির দিকে চেয়ে, সত্যিই তাড়িয়ে দিলেন?

কাকা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ–তাড়িয়ে দিল–সমস্ত মিষ্টি ফলটল সমেত। আমার আবার মিষ্টি খুব ফেভারিট।

অভী বলল, এতক্ষণে বুঝলাম, উনি এত রেগে রয়েছেন কেন।

কাকা বললেন, বোঝ নি। কিছুই বোঝ নি। ও আসলে রাগল বুড়ো চলে যাওয়ার পরে।

আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম যে, বুড়োর ব্যালান্স-সীটে গোলমালটা কিসের? তখন বাবলি যা বলল তাতে বুঝলাম যে বাবলি ছেলেদের মন টন যতটা বোঝে একাউন্ট্যান্সীটা ততটা বোঝে না। ভদ্রলোককে ও মিছিমিছি অপমান করল। আমার কাছে একথা শোনামাত্র ও সেই যে রাগল, তারপর থেকে রাগের পারা আর নীচে নামে নি।

বাবলি রেগে উঠে দাঁড়াল এবার।

বলল, কাকা, ভালো হচ্ছে না। একজন আউটসাইডারের সামনে আমার অফিস সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা আমার মোটেই পছন্দ নয়। বলেই, বাবলি রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কাকা কোটটা তুলি নিয়ে অভীর দিকে চোখ ফিরিয়ে দুষ্টুমির হাসি হেসে বললেন, কেমন বুঝলে হে?

তারপর টাইটা খুলে ফেলে বললেন, বাগ মানানো খুব শক্ত; আর সমস্ত মজাটা তো সেইখানেই। তবে আমার ভাইঝির মতো মেয়ে হয় না—জেম্‌ অফ্‌ আ গার্ল। সব দিকে দিয়ে।

তারপর ফিসফিস করে বললেন, আমি ঘাস খাই না তোর দাদার মতো। তোর পছন্দ ভালো লেগে থাক্। আরে তেজী ঘোড়াকে বাগ মানানোর মজাই আলাদা–দু চার বার চাটটি খাবি, চদি ফেটে যাবে–তাতে কি? মরদের বাচ্চা হবি তো তেজী ঘোড়ায় চাপবি। তুইও কি তোর দাদার মতো ভালোমানুষ নাকি? তুইও কি দা র‍্যাম্ব? মেয়েদের কথায় উঠবি বসবি?

অভী কিছু জবাব দেবার বা ভালো করে বোঝবার আগেই কাকা উঠে দাঁড়িয়ে কোট কাঁধে ঝুলিয়ে বাবলির ঘরের দিকে গেলেন।

অভী শুনতে পেল, বাবলিকে উনি বললেন, ওরে, বাইরের লোক ঘরে বসে আছে। সে তো আর ভেতরের ঘরে আসতে পারে না। যা যা, তুই ই যা। নেমন্তন্ন করে লোকে অতিথির সঙ্গে এমন ব্যবহার করে?

তারপরই কাকা জোরে জোরে রবীন্দ্রনাথের গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে নিজের ঘরের দিকে গেলেন—‘ওরা পরকে আপন করে, আপনারে পর।’

একা ঘরে বসে দাদার বন্ধু নিমেষদাকে দেখে-শুনে অভী হেসে উঠল। বেজায় রসিক আর সরল তো ভদ্রলোক। সত্যিই দাদার সঙ্গে কোনো মিলই নেই।

বাবলি একটু পরে ফিরে এল ঘরে বাচ্চা মেয়ের মতো মুখ ফুলিয়ে। ঝুপ করে বসে পড়ল সোফায়।

অভীর ওকে দেখে আশ্চর্য লাগছিল। ও যে গম্ভীর বুদ্ধিমতী, ম্যাচিওরড মেয়েটিকে জানত তার সঙ্গে এ বাবলির কোনোই মিল নেই।

বাবলি মুখ ফিরিয়ে বসে ছিল।

অভী বলল, আপনাকে এমনিতেই সুন্দর দেখায়, রাগলে যে এত সুন্দর দেখায় তা জানতে পেতাম না আজ আপনার বাড়ি না এলে।

তারপর বলল, একটা কথা বলব?

বাবলি মুখ তুলে বলল, কি?,

–মেয়েদের সেন্স অব হিউমার কম। আমি কিন্তু ভেবেছিলাম আপনি তার ব্যতিক্রম। আপনার দারুণ সেন্স অব হিউমার আছে বলেই আমার ধারণা ছিল। আপনিও যে অন্য মেয়েদের মতো, তা আমার জানা ছিল না।

বাবলি বলল, অন্য কথা বলুন।

–কি কথা?

ইতিমধ্যে কাকীমা ঘরে এসে ঢুকলেন।

অভী দাঁড়িয়ে উঠে বলল, কেমন আছেন বৌদি?

কাকীমা জবাব না দিয়ে বাবলিকে ভর্ৎসনার গলায় বললেন, তুই কি রে বাবলি? এতক্ষণ ওকে বসিয়ে রেখেছিস, বীয়ার-টিয়ার কিছু দিস নি?

বাবলি ঠাট্টার গলায় বলল, পৈটিক গোলযোগ।

অভী বলে উঠল, না না বৌদি, খাব। আপনি বললে খাব।

বৌদি তক্ষুনি বেরিয়ে গিয়ে কিষাণ সিং-এর সঙ্গে ফিরে এলেন, ট্রে-তে ঠাণ্ডা বীয়ারের বোতল, বীয়ার মাগ বসিয়ে সঙ্গে ফিশ-ফিঙ্গার নিয়ে প্লেটে।

তারপর সেগুলো নামিয়ে রেখেই আবার চলে গেলেন বোধহয় দাদাকে জামাকাপড় দিতে।

বাবলির ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল। ও ভাবল, কাকীমা বীয়ারটা নিজেই আনতে পারতেন কিন্তু মেয়েরা নিজেরা পানপাত্র ও সুরা নিয়ে এলে বুঝি সাকী সাকী মনে হয়।

বাবলির হাসিটা অভীর চোখে পড়ে থাকবে। অভী শুধাল, আপনি হাসছেন কেন?

–এমনিই। বাবলি বলল, এমনি হাসছি।

বলেই উঠে এসে অভীকে বীয়ারের বোতল খুলে বীয়ার ঢেলে দিল।

বলল, খান।

তারপর বলল, আমার কথায় খাওয়া গেল না, কাকীমা বলতেই খাওয়া হল। বেশ বেশ।

অভী হাসল। বলল, আপনি খাবেন একটু শ্যান্ডি?

বাবলি ঠোঁট বেঁকাল।

বাবলি বলল, আমার ওসব মেমসাহেবী ভালো লাগে না।

অভী একথায় মনে মনে খুশি হল।

পরমুহূর্তেই ভাবল, এখনও ও নিজে বেশ পুরাতনপন্থী ও স্বার্থপর আছে। নিজেরা সব কিছু করে, করতে পারে, কিন্তু মেয়েরা সেই জিনিস করলে চোখে লাগে; অপছন্দ হয়। হয়তো ও গোঁড়া, হয়তো ও পুরাতনপন্থী কোনো বিশেষ ব্যাপারে কিন্তু তবুও অভীর খুব ভালো লাগল জেনে যে, বাবলি ড্রিংক করে না।

বাবলি বলল, যেন ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই, আপনি যদি বিয়ে করেন, তাহলে আপনার স্ত্রীর ড্রিংক করা আপনি পছন্দ করবেন?

অভী কি ভাবল একটা তারপর বলল, বোধ হয় না।

বাবলি বলল, জানতাম। সব ছেলেরাই একরকম।

–মানে? বলে অভী চোখ তুলে তাকাল।

বাবলি বলল, সব ছেলেরাই পরস্ত্রীর ড্রিংক করাটা পছন্দ করে, নিজের স্ত্রীরা ড্রিংক করুক এটা কোনো আধুনিক ছেলেরই পছন্দ নয়।

অভী নিজেকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করল না। চুপ করে রইল।

হঠাৎ বাবলি কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, তাহলে কাল চলে যাচ্ছেন? সকালের ফ্লাইটে?

–না। বিকেলের ফ্লাইটে। যাবেন এয়ারপোর্টে?

–না। বাবলি বলল, গিয়ে কি হবে? আরো কত লোক তো যাবে। অভী বলল, কত লোক নয়। দাদা-বৌদি ও আমার দু-একজন বন্ধু বান্ধব। আপনি যদি বলেন, তাহলে তাদের সকলকে যেতে মানা করে দিতে পারি। তাহলে কি আপনি খুশি হবেন?

–আমি তো তা বলি নি।

–তাহলে কি? আপনি যদি এতই একা-একা থাকা ভালোবাসেন তাহলে আসুন ইম্ফলে। সেখানে আপনাকে সব সময় কম্পানি দেবো। আমি ছাড়া আপনার কাছে আর কেউই থাকবে না। আপনি আমাকে জানার, কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাবেন।

তারপরই গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, পরীক্ষায় তো আমি ফেলও করতে পারি। পরীক্ষা আপনার নেওয়া উচিত।

বাবলি হাসল।

আলো-ভরা বসবার ঘরে লেমন-ইয়েলো ফোম-লেদারের সোফায় বসে থাকা বাবলিকে সত্যিই ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল।

বাবলি বলল, আর আমি? আমারও পরীক্ষায় বসতে হবে তো।

অভী মুখ তুলল। বলল, হয়তো আপনি পরীক্ষায় না বসেই পাস করে গেছেন।

বাবলি বলল, না। তা কেন হবে? সেটা ঠিক নয়। কোনো সময়েই কোনো অনুযোগ যেন না থাকে। কোনো ভুল বোঝাবুঝি যেন না থাকে। আমি পরীক্ষায় বসতে চাই। আপনারই মতো।

অভী বীয়ার মাগে এক চুমুক দিয়ে বলল, বেশ তো। তা-ই-ই হবে। দুজন পরীক্ষার্থী এবং দুজনই পেপার-সেটার। পরীক্ষাটা কেমন হবে তা ই ভাবছি। কোনোরকম নেপোটিজম হবে না তো?

বাবলি হেসে ফেলল। বলল, জানি না।

তারপর কাকা এলেন চান করে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। এসেই বীয়ারের গ্লাসে এক বড় চুমুক লাগিয়েই বললেন, আয় বাবলি, আমরা দুজনে সেই গানটা গাই।

অভী বলল, অবাক গলায় বাবলির দিকে তাকিয়ে, আপনি গানও গান নাকি?

বাবলি লজ্জা পেল। মাথা নাড়াল। বলল, না না।

তারপর কাকার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, কি হচ্ছে কাকু? তুমি এসেই আবার গণ্ডগোল শুরু করলে?

কাকা গম্ভীর হবার ভান করে বললেন, হ্যাঁ, এখন তো আমিই যত গণ্ডগোলের গোড়া। আমাকে এখন সমূলে উৎপাটন করার সময় হয়েছে। তোমার। কাকার দিন ফুরিয়েছে।

বাবলি কথা ঘোরাবার জন্যে বলল, তুমি আর কাকীমা অভী থাকতে থাকতে একবার ঘুরে এস না ইম্ফল?

কাকা বললেন, কেন, আমার বন্ধুর ছোট ভাইয়ের ঘাড়ে কেন উঠব, তোর মেসো-মাসীর অমন শক্ত ঘাড় থাকতে? উঠলে, ওদের কাছেই উঠব। যা কিপ্টে তোর মেসো। যাব তো ভেবেছিকতবার, একবারও কি নেমন্তন্ন করল?

বাবলি বলল, কীই-ই-ই খারাপ তুমি কাকু। কতবার মাসী ও মেসো লিখেছে তোমাকে। তুমি ভীষণ খারাপ লোক।

কাকা আরেক ঢোক বীয়ার গিলে বললেন, এখন সব খারাপ লাগবে। কাকাকে ভালো লাগার দিন ফুরিয়ে গেছে। কি বল্ বাবলি।

একটু পর কাকীমা এসে বসলেন।

অভীকে বললেন, যখন খেতে ইচ্ছে করবে, তার পনরো মিনিট আগে বলবে অভী, আমি আর বাবলি সব ঠিকঠাক করব, কেমন?

অভী বলল, আচ্ছা।

তারপর অনেক গল্পগুজব হল। ইম্ফলের গল্প, কোহিমার গল্প। কোহিমা থেকে ডিমাপুর যাওয়ার পথে ওদের সেই নাগা কাঠুরের কুঁড়েতে রাত কাটাবার গল্প।

গল্পে গল্পে অনেক রাত হল। একসময় কাকীমা উঠে গেলেন। বাবলিও গেল কাকীমাকে সাহায্য করতে।

তারপর খেতে বসল ওরা সকলে।

খেতে বসে অভী বলল, বাঃ, ফুল কে সাজিয়েছে বৌদি? ভীষণ সুন্দর সাজানো হয়েছে কিন্তু! আপনি?

বৌদি বললেন, আমি নই, বাবলি।

বাবলি! অভী ভাবল।

বাবলি মনে মনে খুশী হল। ও ভালো ফুল সাজায়, একথা ও জানে। সে জানায় কোনো নতুনত্ব নেই। কিন্তু পুরুষদের, বেশির ভাগ পুরুষদের চোখেই এসব পড়ে না। তাদের বেশির ভাগই জানে না, কি করে মেয়েদের এবং মেয়েদের নিজস্ব মেয়েলি গুণ স্বীকার করতে হয়। বাবলির ভেবে ভালো লাগল যে, অভী অন্য দশজন ছেলের মতো নয়।

গল্প-গুজব করতে করতে ওরা সকলে একসঙ্গে বসে খেল।

খাওয়া শেষ হতে প্রায় এগারোটা বাজল।

অভী খাওয়া শেষ করে উঠেই বলল, এবার কিন্তু আমাকে উঠতে হবে। তারপর কাকার দিকে ফিরে বলল, নিমেষদা, ফোনে আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দেবেন?

কাকা ধমকে উঠে বললেন, তোমার কি ব্যাপার বল তো? তুমি কি আমার চাকরিটা খাবে? বাড়িতে গাড়ি থাকতে তোমাকে যদি এখন ট্যাক্সি করে যেতে দিই, তাহলে বাবলি কি আমাকে আস্ত রাখবে?

তারপরই কাকা গাড়ির চাবিটা দিয়ে বাবলিকে বললেন, এবার যা, অতিথির সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিস, এখন তার পাপ স্খলন করতে যা, অভীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়।

বাবলি বলল, আমি কেন? তুমিই যাও।

কাকা বললেন, ও তো প্রায় খায় নি কিছুই। কিন্তু আমি? আড়াই বোতল বীয়ার, তার ওপর গাণ্ডে-পিণ্ডে খাওয়া–আমি এখন কোথায় নড়ছি না বলেই চারধার দেখে নিয়ে যখন দেখলেন কাকীমা রান্না ঘরে, তখন নির্ভয়ে বললেন, আমি এখন আমার বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোব বাবা। তোমাদের যেখানে যাবার যাও।

বাবলি গ্যারেজ থেকে যখন কাকার সাদা রঙাফিয়াট গাড়িটা বের করল, তখন এগারোটা বেজে পনরো।

বাবলি বেশ জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল। দিল্লিতে রাত এগারোটা অনেক রাত। দিল্লি কোলকাতার মতো নয়। এখানে সকলেই সকাল-সকাল খেয়ে শুয়ে পড়ে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা এত দূর যে, বড় কেউ একটা রাতে বেরোয় না। হু হু করে হাওয়া লাগছিল চোখে মুখে। বীয়ার এবং খাওয়া-দাওয়ার পর অভীর ঘুম ঘুম পাচ্ছিল।

কোন পথ দিয়ে বাবলি যাচ্ছিল, অভী জানে না। পথটার দুধারে বড় বড় গাছ। সুন্দর দেখাচ্ছে রাস্তাটা, মার্কারী ভেপার ল্যাম্পগুলোতে ভীষণ মোহময় স্বপ্নময় লাগছে।

হঠাৎ অভী বলল, গাড়িটা থামান তো বাঁদিকে!

বাবলি বলল, কেন? কি হবে?

অভী যেন আদেশের সুরে বলল, থামাতে বলছি, থামান।

বাবলি এই স্বরে অভ্যস্ত ছিল না। অভী যে ওকে আদেশ করতে পারে, বাবলি ভাবতে পারে নি। কিন্তু বাবলির খুব ভালো লাগল। বাবলিকে ছোটবেলা থেকে কেউ কখনও আদেশ করে নি। কারো আদেশ মানার মধ্যে যে এত আনন্দ তা ওর জানা ছিল না। ও যে কারো আদেশ বিনা প্রতিবাদে মানতে পারে, এ কথাও নিজে জানত না।

বাবলি গাড়িটা থামালো বাঁদিক ঘেঁষে। গাড়ি থামিয়ে বলল, থামিয়েছি।

অভী বলল, গাড়ি বন্ধ করে দাও।

বাবলির হঠাৎ মনে হল, অভীর কী হল? নেশা হয় নি তো? বাবলিকে বিনা ভূমিকায় এমন তুমি করে সম্বোধন করছে কেন ও?

কথা না বলে বাবলি বলল, করেছি, বন্ধ করেছি।

অভী কোনো কথা না বলে বাবলির দিকে সরে এল। সরে এসে, দুহাতে বাবলির মুখটা ধরে ওর চোখে চুমু খেল।

বাবলি বাধা দিল না, মানা করল না, বাবলির সমস্ত শরীর এক আশ্চর্য আবেশে অবশ হয়ে এল।

বাবলি অস্ফুটে বলল, উঁ উ উউ…।

অভী তারপর দুহাত দিয়ে বাবলিকে জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরে, বাবলির ঠোঁটটাকে নিজের ঠোঁটের মধ্যে নিয়ে একেবারে শুষে নিল। শুষে, নিতে লাগল।

বাবলির হাত আলগা হয়ে এল স্টিয়ারিং থেকে। কখন ও যে তা করল ও তা জানে না, বাবলির অজান্তে বাবলির হাত দুটি অভীর গলা জড়িয়ে ধরল। বাবলি তা সজ্ঞানে করলনা। বাবলির মস্তিষ্কের কোষে কোনো অজ্ঞাত আদেশ বাজল নীরব স্বরে। বাবলি তার দুটি লতানো হাতে, তার নরম শরীরের সব সুগন্ধ সব স্নিগ্ধতা সব নম্রতা এই প্রথম, জীবনে এই প্রথম। একজন পুরুষের সবল কঠিন বুকে সঁপে দিয়ে, নিজের ঠোঁটের সব স্বাদ, মিষ্টিত্ব একজন পুরুষের সিগারেটের গন্ধেভরা রুক্ষ ঠোঁটে সমর্পণ করে। নিজে ধন্য হল।

কতক্ষণ ওরা ওভাবে ছিল ওরা জানে না।

দূর থেকে, পেছন দিক দিয়ে একটা গাড়ি আসছিল।

তার হেডলাইটের আলোর বৃত্ত দুটি বাবলির গাড়ির আয়নার মধ্যে দুটি ছোট বিন্দু থেকে ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল।

পেছনের গাড়ির আলোটা দ্রুত বড় হচ্ছিল, দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছিল। এবার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল।

অভী বাবলির বুকের ভাঁজে মুখ রেখে বিড়বিড় করে বলল, ইম্ফলে আসবে তো?

বাবলি যেন ঘুমের মধ্যে ঘোরের মধ্যেই বলল, আসব আসব। তুমি দেখ; ঠিক আসব।

তারপর ওরা সরে গেল।

বাবলি গাড়ি স্টার্ট করল।

এমন সময় পেছনের গাড়িটা ওদের ওভারটেক করেই ওদের একেবারে সামনে ব্রেক কষে দাঁড়াল।

হঠাৎ ওরা অবাক হয়ে দেখল, বাবলির কাকা এবং অভীর নিমেষদা ট্যাক্সি থেকে নামলেন। তারপর পান চিবোত চিবোতে ওদের গাড়ির দিকে এগিয়ে এলেন। তারপর ঝুঁকে পড়ে অভীর দিকের জানালা দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে অভীর কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, সাবাস্ ছোঁকরা, তুমি তো রীতিমত ফাস্ট ওয়ার্কার হে!

তারপরই বাবলিকে বললেন, এতদিনে তুই গাড়ি চালাতে শিখেছিস। খুব খুশী হলাম।

অভী গাড়ির দরজাটা খুলে দিতে যাচ্ছিল পেছনের।

নিমেষদা বললেন, পাগল! আমি কি অমন বেরসিক? তোমাদের কাকীমা বললেন দিল্লিতে মেয়েরা আজকাল খুব আনসে–তুমি ট্যাক্সি নিয়ে যাও, ফেরার সময় বাবলির সঙ্গে ফিরো–একা একা রাতে ওর এতখানি পথ আসা ঠিক হবে না।

বুঝলি বাবলি, তোর কাকীমা বুঝতে পারে নি যে বিপদ ছিল যাওয়ার পথেই; ফেরার পথে না।

অভী আবার বলল, নিমেষদা, আসুন না; উঠে আসুন।

কাকা বললেন, আমি আগে পাইলটিং করে যাচ্ছি। তোমাদের বাড়ির নিচের পানের দোকানে মুস্কিপাতি জর্দা দিয়ে দুটো মঘাই পান খাব। তোমরা আস্তে আস্তে এস। তাড়া নেই। টেক ইওর ওন টাইম। দ্য নাইট ইজ ভেরী ইয়াং।

ট্যাক্সিটা এগিয়ে যেতেই বাবলি চাপা হাসি হাসল।

বলল, কাকুটা এত অসভ্য না!

বাবলি কথা শেষ করতে পারল না, বাবলির মুখ বন্ধ করে দিল অভী চুমু খেয়ে।

বাবলি আনন্দে, নতুন অস্বস্তিতে ছটফট করে উঠল। বলল, আর না। এখন আর না। প্লিজ, এখন আর না অভী; এখন আর না।

অভী ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল, বল, ইম্ফলে আসবে তো? বাবলি অভীর বুকে মুখ রেখে বলল, আসব আসব। তুমি দেখো, ঠিক আসব। আসি কিনা দেখো!

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ