গতকাল অফিসে জয়েন করেছে বাবলি।

দিল্লির মথুরা রোডে সেন্ট্রাল রেভিন বিল্ডিংসয়ে বাবলির অফিস।

লম্বা করিডরের দু’পাশে সারি সারি ঘর। বাবলির ঘরের সামনে ছোট বোর্ড ঝুলছে বার্নিশ করা। তার ওপরে সাদায় লেখা–মিস বি. সেন, আই-আর-এস।

সেদিন তিন-চারটে হিয়ারিং ছিল।

বেশ নার্ভাস লাগছিল বাবলির। কথা খুব কম বলছে। ব্যালান্সশীট ও প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট দেখে দেখে যা যা ডিটেইলসয়ের দরকার নিয়েছে। ধারের জন্য কনফার্মেশন লেটারস ব্যাঙ্কের ওভারড্রাফট-এর লিমিটের চিঠি। গ্রস মুনাফার স্টেটমেন্ট। সানড্রি ডেটরস, সানড্রি ক্রেডিটরস-এর লিস্ট পারচেজ ও সেলের লিস্ট-পঁচিশ হাজার টাকার উপর। ইত্যাদি ইত্যাদি।

উকিলদের মুখ দেখে বাবলি পরিষ্কার বুঝতে পারছে যে, তাদের মুখে একজন আকাট রংরুটের সামনে যে তারা বসে আছেন এ ভাব পরিস্ফুট।

বাবলি মনে মনে হেসেছে। বলেছে, কিছুদিন যাক। ও কাজ পিক-আপ করে নেবে। ওর আশ-পাশের ঘরে অনেক প্রমোটি অফিসার আছে, বয়সে বড়। ভালো কাজ জানেন। ও আই-আর-এস ডাইরেকট রিক্রুট–তাই ওদের অনেকের চেয়ে ও সিনিয়র, কারণ ও ক্লাস-ওয়ান হয়েই জয়েন করেছে। ও জানে ডিপার্টমেন্টে বেশ মনোমালিন্য আছে এ ব্যাপারে। কিন্তু সেটা ওর দোষ নয়–নিয়মের দোষ।

মাঝে মাঝে ওর মনে হয়েছে যে এই রকম প্রকারভেদ করাটা অন্যায়। তাই প্রত্যেক সিনিয়র অথচ ক্লাস-টু অফিসারের সঙ্গে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করেছে ও। ও জানে, কাজ শিখতে হলে এঁদের সাহায্য ওর দরকার হবে।

ওর অফিসের যিনি বড়বাবু, বয়স্ক একজন টাকমাথা ভদ্রলোক– হরিয়ানার ভদ্রলোক। তাকে দেখে, কথাবার্তা শুনে বাবলির মনে হয়েছে যে তিনি বাবলিকে নিয়ে খুব খুশী। কার্যত তিনিই এখন থেকে অফিসার কারণ এই অল্পবয়সী বাঙালি মেয়েটি এখনও কাজ কিছুই জানে না। তিনি যা ইচ্ছে করবেন তাই বাবলিকে দিয়ে সই করিয়ে নেবেন। বাবলি তাই প্রথম থেকেই সাবধানে আছে কিছু না বুঝে না-জেনে সই করবে না।

আজ সকালেই একটা রিফান্ড অর্ডার সই করাতে এনেছিলেন উনি। চল্লিশ হাজার টাকার। বাবলি ভাবল, এত বড় রিফান্ড অর্ডার সই করবার জন্য এত সকালে ভদ্রলোকের এত তাড়াহুড়ো কেন? বাবলি বলল, পরে হবে। ফাইল-টাইল দেখে নেব একবার।

বড়বাবু বললেন, কমিশনার বলেছেন রিফান্ড ফেলে রাখা চলবে না।

বাবলি বলল, তা হোক।

বাবলি জানতো না যে চাকরির দ্বিতীয় দিনেই এরকম নাজেহাল হবে।

একটু পরে ইন্সপেকটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার তাকে ডেকে পাঠালেন। ভদ্রলোক গুজরাটি, ভীতু চেহারা। একরকমের চেহারা হয় না, যাদের দেখলেই মনে হয় চাকরি রাখতেই বেচারারা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন; জীবনের অন্য কোনো দিকে কোনো বিষয়ে আর কোনো ঔৎসুক্য অবশিষ্ট নেই। সেরকম।

ভদ্রলোকের মেজাজ রুক্ষ। বোধহয় স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা নেই, অথবা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন।

উনি বললেন, আপনি কিসের জন্য রিফান্ড ভাউচার সই করেন নি? কমিশনারের কাছে অ্যাসেসীর উকীল কমপ্লেন করেছেন। আপনি কি মনে করেন আপনি নিজের টাকা দিচ্ছেন অ্যাসেসীকে?

বাবলি আমতা আমতা করল।

বলল, তা নয়। আমি ফাইলটা দেখে নিয়ে দিতে চাই–একটু সময় লাগবে স্যার।

উনি বললেন, আমি বলছি ম্যাডাম, এখুনি দিয়ে দিন।

বাবলি বলল, তাহলে আপনি লিখিত অর্ডার দিন স্যার।

ভদ্রলোক অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। বললেন, আপনার সাহস তো কম নয়। কাল জয়েন করেই তো অনেক কথা শিখেছেন। অত কথায় কাজ নেই। এখুনি দিতে বলছি, দিন। লিখিত অর্ডার পাবেন না।

বাবলি বলল, তা হলে সময় লাগবে। ফাইল না দেখে আমি দেবো না।

ভদ্রলোক এবার চুপ করে গেলেন।

বললেন, আপনি যেতে পারেন।

বাবলি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই বুঝল কাজটা ভালো করে নি। কারণ ইনিই বাবলির কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট লিখবেন, যার ওপর ওর উন্নতি নির্ভর করবে। কিন্তু বাবলি মনে মনে বলল, যা হবে, তা হবে। নিজে লিখে দেবেন না, খালি টেলিফোনে আর মুখে মুখে ছড়ি ঘোরাবেন–তাতে হবে। না। রিফান্ড অর্ডার সই করবে বাবলি, পরে কোনো গোলমাল হলে এ-জি অডিট ধরবে তাকে। ঝামেলা হলে বাবলিরই হবে। ওঁদের কি?

বাবলির সহকর্মীরা সকলেই বলছিলেন যে অফিসারদের কাজ করার ইচ্ছা প্রায় সবই নষ্ট হয়ে গেছে গুচ্ছের রিপোর্ট-রিটার্নের ঝামেলায় আর এই অডিটের মাতব্বরীতে। বেশির ভাগ রিটার্নই ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলা যায়। তা সরকারের পয়সা। নষ্ট হয় অফিসারদের আত্মবিশ্বাস, করদাতাদের বিশ্বাস সরকারের ওপর। এ সময়ে আসল কাজ করলে অনেক কাজ করা যেত।

বাবলি মনে মনে ভাবে, (যেমন সমস্ত তরুণ অনভিজ্ঞ লোকই নির্দ্বিধায় ভাবে যে) সে নিজের হাতে হাল ধরলে, যখন ও উঁচু পদে যাবে তখন এসব অব্যবস্থা ঠিক করে দেবে।

কিন্তু দুদিনেই বাবলি বুঝতে পারছে যে সরকারি চাকরিতে নিজের কর্মদক্ষতা, নিজের স্বাধীনতা, নিজের মতামত নিয়ে টেকা যায় না। একটি বিরাট মেশিনের, যে মেশিনের কোনো কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই, কিছু উৎপাদনের ক্ষমতা নেই, তার একটা ছোট্ট অনামা যন্ত্র হিসেবে তাকে সারাজীবন এখানে সেঁটে থাকতে হবে। মাসান্তে কিছু টাকার জন্য।

দুদিনেই বাবলির ঘেন্না হয়ে গেছে এই চাকরির ওপর।

এখন ওর এই-ই জীবন। অফিস করে। বাড়ি আসে। বাড়ি ফিরে ভালো করে গা-ধোয়া, তারপর কাকা কাকীমার সঙ্গে জমিয়ে বসে চা খায়। তারপর নিজের ঘরে অথবা দোতলায় বারান্দায় বসে থাকে আলো নিভিয়ে।

দিল্লিতে এই জুন-জুলাই মাসটাই সবচেয়ে খারাপ। এমন ভ্যাপসা গরম পড়ে যে সে বলার নয়। অবশ্য বৃষ্টি হলেই খুব প্লেজেন্ট।

ওদের বাড়ি হাউজ-খাস এনক্লেভে। বারান্দায় বসে দূরের কঁকা জমি, পোড়োবাড়ি চোখে পড়ে। ও যখন ছোট ছিল, তখন এসব বাড়ি হয়ে যায় নি চতুর্দিকে। বিকেলে রুক্ষ মাটি আর পাথুরের জমিতে গজিয়ে-ওঠা নানান গাছ-গাছালির আড়াল থেকে তিতিরের ডাক শোনা যেত–যখন সন্ধ্যে হয়ে আসত। বেশ নিরিবিলি ছিল তখন অঞ্চলটা।

মনে পড়ে যায়, ও যখনই একা থাকে তখনই মনে পড়ে যায় অভীর কথা। বারান্দায় অন্ধকারে বসে প্রায়ই অভীর কথা ভাবে বাবলি। বেশ খারাপ আছে অভী। এতদিন হয়ে গেল একটা চিঠি লিখতে পারল না ওকে। ও যে লিখতে পারত না, তা নয়। কিন্তু ওর লজ্জা লজ্জা করে। লজ্জা করাটা মেয়েদের ধর্ম। মেয়েদের স্বভাব। লজ্জা ভাঙাটা পুরুষদের কর্তব্য। তা-ই প্রথম চিঠি অন্তত অভীই লিখতে পারত। পত্রালাপের সূত্রপাত ঘটলে তারপর বাবলি কিপ আপ করত।

কে জানে? ঝুমা দেবী ইতিমধ্যেই তার কুহকজাল ছড়িয়েছেন কি না অভীর ওপর। ওসব মেয়ে সব পারে। ওদের কাজই এই। ভালো ভালো ছেলের মাথা খাওয়া। বাঘিনীর মতো এক এক করে মাথা খেয়ে ওরা নম্বর গোনে। গতযৌবনা হয়ে গিয়ে বারান্দার মোড়ায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে যৌবনে ওরা কতজনের মাথা চিবিয়ে খেয়েছিল, কতজনকে পাগল করেছিল, কতজন ওদের জন্য আত্মহত্যা করেছিল, কতজনের ঘর ভেঙেছিল ওরা, তার হিসাব করে।

বাবলি জানে না ওরা কী চায়? বোধ হয় ওদের পুরুষ ভোলানোর ক্ষমতা বারংবার প্রয়োগ না করলে ভোতা হয়ে যায়; মরচে পড়ে যায়। তাই বোধহয় ওরা কোনো সময় নিশ্চেষ্ট থাকতে পারে না।

গতকাল বাবলি ইন্দিরা চাওলাকে ফোন করেছিল, ও দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়াচ্ছে। ইন্দিরার সঙ্গে ঝুমার যোগাযোগ আছে। ইন্দিরাই বলছিল যে, ঝুমা ইম্ফল যাবে বেড়াতে। সামনের মাসে গিয়ে নাকি পনরো দিন থাকবে। জায়গাটা নাকি চমৎকার লাগে ওর।

বাবলি কি করবে জানে না। ও কি অভীকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে? ভালোবাসা মানে কি? কারো জন্য মন খারাপ হওয়া? কাউকে বার বার মনে পড়া? কারো সঙ্গে নিজের মতের মিল হওয়া, নিজের রুচির মিল, সখের মিল হওয়া? জানে না, বাবলি তা জানে না।

তবে বাবলি এ কথা বোঝে, ঝুমার সঙ্গে দমদম এয়ারপোর্টে দেখা না হলে, কাকা অভীর এত প্রশংসা না করলে, অভীর প্রতি তার যে দুর্বলতা জন্মেছিল সেটা ও ভুলে যেতে পারত। অভীকে ছেড়ে এসে আউট-অফ সাইট, আউট-অফ-মাইন্ডে বিশ্বাস করবে ভেবেছিল। কিন্তু সে বিশ্বাস আর রইল না। চোখের বাইরে সে থাকতে পারে, কিন্তু মনের বাইরে সে নেই; মনের মধ্যে সব সময়ই ঘোরে ফেরে।

ভিতর থেকে খাওয়ার ডাক এল। বাবলি খাওয়ার ঘরে গিয়ে যে চেয়ারে ও রোজ বসে, সে চেয়ার টেনে বসল।

কাকা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে এলেন চানটান করে। গল্প-গুজব করতে করতে খাওয়া শেষ হলে কাকীমাকে কাকা বললেন, আমার সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করে আনো তো ড্রয়ার থেকে, শোওয়ার ঘরের।

কাকীমা উঠে যেতেই কাকা চোখ বড় বড় করে বললেন, কি খাওয়াবি বল?

বাবলি অবাক হল। বলল, কেন? কিসের জন্য?

কাকা বললেন, অভী আসছে তিন দিনের জন্য দিল্লিতে। দিল্লি ইউনিভার্সিটির একটা সেমিনারে। অগস্টের প্রথম সপ্তাহে। এখনও দু’মাস।

তারপরই বললেন, কি বুঝলি?

বাবলি মুখের ভাব একইরকম রেখে বলল, আসছে তো আসছে। তোমার বন্ধুর ভাই আসছে তাতে তুমি উল্লসিত হও। আমার তাতে কি?

কাকা, কপট বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, সে কি রে, তোর কোচোয়ান আসছে, তোর বডিগার্ড–তোর এত দেখাশোনা করল আর তুই নেমন্তন্ন করবি না।

বাবলি বলল, তুমিই তো আমার গার্জেন। নেমন্তন্ন করলে তুমিই করবে।

কাকা বললেন, আমিই গার্জেন। তা হলে বেশ। এ কথাটা ভবিষ্যতে মনে করে রেখ। গার্জেনের পারমিশন ছাড়া এক পা এদিক-ওদিক করেছ তো পা ভেঙে দেব।

বাবলি আনন্দে, লজ্জায় সব কিছু মিলিয়ে হেসে উঠল। বলল, হ্যাঁ, পা ভাঙতে দিচ্ছি তোমাকে।

পরদিন বাবলির কাছেও চিঠি এল বাবলির মাসীর, ইম্ফল থেকে।

উনি লিখেছেন :

বাবলি,

অভী দিল্লি যাচ্ছে। তিনদিন থাকবে। ওকে একদিন ভালো করে নেমন্তন্ন খাওয়াস। তোর জন্য এত কিছু করেছে ও। তুই তো কম জ্বালাস নি। ওর সঙ্গে নিমেষ (কাকার নাম) আর বাণীর (কাকীমার নাম) জন্য দুটো মণিপুরী খেস পাঠাচ্ছি। ওদের বলিস, মাঝে মাঝে চিঠি দিস না কেন? তোর যে কী স্বভাব বুঝি না। যখন কাছে থাকিস, তখন তো সব সময় গলায় ঝুলে থাকিস। মনে হয় আমায় না দেখলে একদিনও বুঝি বাঁচবি না। আর চোখের আড়াল হলে মনে করার উপায় থাকে না যে একসময় মাসী বলে কাউকে চিনতিস!

–ইতি রূপু মাসী।

বাবলি চিঠি পড়ে মনে মনে লজ্জিত হল। সত্যিই ওর বড় দোষ। চিঠি লিখতে যেন জ্বর আসে গায়ে।

.

অগাস্টের প্রথম সপ্তাহ। দু’মাস বাকি আছে এখনও।

বাবলি একটা দারুণ কাজ করল। কাকাকে ধরে কাকার এক বন্ধুর মাধ্যমে (যিনি দিল্লি জিমখানা ক্লাবের মেম্বার) জিমখানা ক্লাবে টেনিস খেলার বন্দোবস্ত করে ফেলল, তার গেস্ট হিসাবে।

কাকা খুশী হলেন। কাকীমা খুশী হলেন না। বললেন, যখন খেলাধুলার বয়স ছিল, তখন ঘরে বসে বই পড়েছিস, এখন বুড়ো বয়সে হাত-পা ভাঙার দরকার কি?

যে যাই-ই বলুক, বাবলির স্বভাব নয় নিজের অমতে চলা কি অন্যান্য কারোরই মতামত গ্রাহ্য করা। তাই সে ছুটির দিনে অনেকক্ষণ এবং উইকডেজ-এ সকালে রোজ এক ঘণ্টা করে টেনিস খেলা শুরু করে দিল। মার্কারের সঙ্গে খেলত। বেশ লাগত। সকালের রোদে দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে হার্ড-কোর্টের মোরামের গন্ধ, টেনিস বলের গন্ধ, হাওয়াতে বেড়ার ধারের লতানো ফুলের ভেসে আসা গন্ধ এসব মিলে ভারী ভালো লাগতে লাগল বাবলির। দুঃখ হল, এতদিন কোনো খেলাধুলা করে নি বলে।

এক মাস পরেই নিজের ঘরে নিজেকে অনাবৃত করে দেখল, বাবলির চেহারায় সূর্যের আশীর্বাদ লেগেছে। কলার বোনের কাছে, দু’বুকের ওপর দিকটা–ঘাড় গলা সব রোদে পুড়ে বাদামী হয়ে গেছে। বাদামী হয়ে গেছে। পায়ের নীচে পায়ের যে অংশটুকু অনাবৃত থাকে।

বাবলির সমস্ত শরীরে মনে একটা নতুন পুলক লেগেছে। শুধু বসে থাকতে বা দাঁড়িয়ে থাকতে বা শুয়ে থাকতেই যে এত আনন্দ, যারা কখনও খেলাধুলা করে নি, তারা বোধহয় কখনও জানে নি।

বাবলির ওজন কমে গেছে এক কেজি দু’সপ্তাহেই। খেলার সঙ্গে সঙ্গে ডায়াট কন্ট্রোলও করছে ও। পুরো দু’মাস খেলার পর মার্কার গ্যারান্টি দিয়েছে পাঁচ কেজি কমে যাবে।

মুখে বেশি মাংস থাকলে মানুষের মুখের অভিব্যক্তি নষ্ট হয়ে যায়। আশ্চর্য! বাবলি এতদিন এসব নজর করে দেখে নি।

রোজ সকালে ক্লাবে খেলে, তারপর ক্লাবেই চান করে জামাকাপড় পরে বাবলি যখন ওখান থেকেই সোজা অফিস যেত, তখন দারুণ ফ্রেশ লাগত বাবলির। চৰ্চন করে খিদে পেত। সমস্ত শরীর হাল্কা হাল্কা মনে হত।

অফিসে পৌঁছে সকাল-সকাল ক্যান্টিন থেকে টোস্ট আর ডিম আনিয়ে খেত। লাঞ্চে বাড়ি থেকে কাকীমা কিষাণ সিংকে দিয়ে খাবার পাঠাতেন। হট কেসে করে।

বাবলির দিনগুলো এমনি করে হৈ হৈ করে হেসে খেলে কাজ করে কি করে যে কেটে যাচ্ছিল তা বাবলি জানে না।

বাবলি এখন কিছুই জানে না। জানতে চায় না। বাবলির সমস্ত মন এখন উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে ক্যালেন্ডারের দিকে। অগাস্টের তিন তারিখটা ও সবুজ পেন্সিল দিয়ে রাঙিয়ে রেখেছে ওর অফিসের ডায়েরীতে।

তিন তারিখে অভী আসবে। চার এবং পাঁচ তারিখের জন্য বাবলি ক্যাজুয়াল লিভের দরখাস্ত দিয়ে রেখেছে। বাবলি জানে না কেন, বাবলির মন বলছে যে, ঐ দু’দিন ওর ছুটি নেওয়ার প্রয়োজন হবে। আর তখন যদি না পায়, তাই আগে থেকেই বাবলি ছুটি চেয়ে রাখছে।

বাবলি এখন অগাস্টের তিনটি দিনের প্রতীক্ষায় বেঁচে আছে। অনিমেষে সেই দিকেই চেয়ে আছে।

বাবলি ভাবে, বাবলিটা, সেই ডোন্টকেয়ার বেপরোয়া, স্বনির্ভর বাবলিটা কেমন বোকী-বোকা হয়ে গেছে। নিজের আনন্দ, নিজের সুখ, নিজের সমস্ত অস্তিত্বের জন্য মনে মনে কেমন অসহায়ের মতো অন্য একজন দূরের লোকের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাকে। একজন ক্যাবলা-লোকের ওপর : এমন স্মার্ট বাবলির।

.

দেখতে দেখতে অগাস্টের তিন তারিখটা সত্যিই একদিন এসে গেল।

সময়ের যে পাখা আছে। সময় যখন ওড়ে, উড়তে চায়, তখন সবুজ দিনগুলোকে মুখে করে কোনো হলুদ পাখির মতো সময় উড়ে যায়।

।বাবলি প্রথমে ঠিক করেছিল কাকুর গাড়িটা নিয়ে নিউ-দিল্লি স্টেশনে যাবে অভীকে রিসিভ করতে। তারপরে ভাবল হয়তো সেটা বাড়াবাড়ি হবে। বাড়াবাড়ি হলেও বাবলি তবু যেত, যদি না কাকুর বন্ধু এবং তার স্ত্রী স্টেশনে যেতেন। অবশ্য তারা তো যাবেনই। অভী তো তাদেরই আপনজন, ও তো বাবলির কেউ না। কেউ হয়তো হবেও না। এসব অনেক কিছু ভেবে শেষ পর্যন্ত স্টেশনে না গিয়ে রোজকার রুটিন মতো ক্লাবে গেল বাবলি, তারপর অফিসে।

আজ ও আরো বেশিক্ষণ খেলল। ব্যাকহ্যান্ড ও ফোরহ্যান্ড স্ট্রোকগুলো যত ভালো করে পারে, যতখানি সুয়িং করে পারে নিল। খামোখা সারা কোর্টময় ও শৃঙ্গাররতা হরিণীর মতো ছুটোছুটি করে বেড়াল। ও যেন এই একদিনের খেলায়ই সুন্দরী হয়ে যাবে, ওর শরীরের যেখানে যেখানে এখনও যতটুকু বাড়তি মেদ আছে সেটুকু যেন একদিনেই ও ঝরিয়ে ফেলবে এমন ভাবতে লাগল।

অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই কাকীমা বললেন, অভী ফোন করেছিল। আজ এবং কাল ও খুব ব্যস্ত থাকবে, আসতে পারবে না। পরশুদিন রাতে ও খেতে আসবে এখানে। পরদিনই ইম্ফল চলে যাবে, সকালের প্লেনে। তুই কেমন আছিস জিজ্ঞেস করল। ও সন্ধ্যেবেলায় দিল্লি ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসরের বাড়িতে থাকবে তোকে সেখানে ফোন করতে বলেছে।

বাবলি মুখে বলল, কে এখন ফোন করবে? আমি এখন চান টান করব, কি খাব, তারপর ফোন করার কথা ভাবা যাবে। অত ব্যস্ত লোক যখন, তখন দয়া করে ফোনও না করলেই পারতেন।

কাকীমা হাসলেন। বললেন, তুই কি হাওয়ার সঙ্গেও ঝগড়া করবি নাকি?

বাবলি বলল, ফোন নম্বরটা কোথায় লিখে রেখেছ?

কাকীমা বললেন, টেলিফোনের সামনেই রাখা আছে, প্যাডে।

বাবলি বলল, থাক দেখা যাবে, ফোন করবো কিনা।

আসলে বাবলির তক্ষুনি ইচ্ছা করছিল ফোন করতে। কিন্তু ফোনটা বসার ঘরে এবং কাকীমা বসার ঘরে বসেই বই পড়ছেন। ভালো করে কথা বলা যাবে না কাকীমা থাকলে।

বাবলি ভাবল, একটু পরে নিরিবিলি দেখে ও ফোনটা করবে।

বাবলি চান করতে ঢুকল বাথরুমে।

শাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়ানোর পরই কাকীমা দরজা ধাক্কালেন। বললেন, অভী আবার ফোন করছে। তোকে চাইছে।

বাবলির সমস্ত শরীর আনন্দে থরথরিয়ে কেঁপে উঠল।

মুখে বিন্দুমাত্র উৎসাহনা দেখিয়ে বলল, বল যে আমি চান করছি, আমার বেরোতে দেরি হবে।

কাকীমা কি একটা বিরক্তসূচক কথা বললেন বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে, বোঝা গেল না। তারপর চলে গেলেন।

বাবলির সমস্ত মন গুনগুনিয়ে উঠল। বাবলি গান জানে না। জানলে ও খুশী হত। ওর মনে অনেক সুর আছে ও গান ভালোবাসে, কিন্তু ভগবান ওর গলায় সুর দেন নি। বাবলি সারা শরীরে সাবানের ফেনার বুদ্বুদ তুলে মনে মনে নিরুচ্চারে গান গাইতে লাগল।

চান করে বেরিয়ে জামাকাপড় সবে পরেছে, টেলিফোনটা আবার বাজল।

কাকীমা বোধহয় রান্নাঘরে গিয়েছিলেন, কি বাথরুমে গিয়েছিলেন, হয়তো ওঁদের ঘরে। বাবলি দৌড়ে গিয়ে ফোনটা ধরল।

হ্যালো। ওপাশ থেকে অভীর গলা শোনা গেল।

বাবলি যন্ত্রচালিতের মতো ওদের বাড়ির নম্বরটা বলল।

অভী লাজুক লাজুক গলায় বলল, বাবলির সঙ্গে কথা বলতে পারি?

বাবলি হাসি চেপে বলল, আপনার নাম জানতে পারি?

অভী বলল, আমার নাম অভী?

ও। বাবলি বলল। তারপর বলল, ভেবেছিলাম আমার গলার স্বরটা চিনবেন। আমি কিন্তু আপনারটা চিনেছিলাম।

অভী হাসল। বলল, আমিও চিনেছিলাম, তবে আপনার মেজাজ-টেজাজ কেমন আছে জানবার জন্যে প্রথমেই বলি নি যে আপনাকে চিনেছি।

বাবলির যেমন স্বভাব, ও হঠাৎ চটে উঠে বলল, কেন? আমার মেজাজটা কি দেখলেন আপনি? আর এতই মেজাজী লোক যদি আমি, তো আমাকে এতবার ফোন করা কেন?

অভী আবার হাসল। বলল, রাঃ রে, কর্তব্য নেই বুঝি? আপনি হলেন গিয়ে আমার বসের শালীর মেয়ে। আপনার খোঁজ নেওয়া আমার কর্তব্য নয়? আপনার জন্য আনারসের আচার পাঠিয়েছেন আপনার মাসীমা আর খেস্‌স্‌। এখন কি আপনি বাড়ি থাকবেন?

বাবলি বলল, আমি বাড়ি থাকব, কিন্তু শুনলাম তো আপনার আজ এবং কাল ফুরসতই নেই। পরশুদিনের আগে এখানে আসা নাকি আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।

সেরকম বলেছিলাম, কিন্তু প্রায় ঝগড়া করেই এখান থেকে নেমন্তন্ন না খেয়ে চলে যাচ্ছি। অনেক মিথ্যা কথা বলতে হল। আপনার জন্য।

আমার জন্য আপনাকে তো আমি মিথ্যা কথা বলতে বলি নি। আমার কথা ভেবে তো আপনার এত মাস ঘুম হয় নি। বেশ কথা শিখেছেন কিন্তু আপনি। এতখানি পথ আমাকে নিয়ে এলেন ইম্ফল থেকে ডিমাপুরে, তখন তো জানা যায় নি যে এত কথা বলতে পারেন এবং এত গুছিয়ে?

অভী একটু চুপ করে থাকল।

তারপর বলল, তা ঠিক। ওখানে জানা যায় নি। ওখানে আপনি থাকতে কিছুই জানা যায় নি। যা কিছু জানার, যা কিছু বোঝার, সব আপনি চলে আসার পর জানা গেছে, বোঝা গেছে। তাছাড়া মিথ্যা কথাটা হয়তো শুধু আপনার জন বলি নি।

তবে? কার জন্য বলেছিলেন?

অভী অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।

তারপর বলল, আমার জন্যেও। হয়তো শুধু আমারই জন্যে। আজ সকালে এখানে এসে অবধি আপনাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল। কেন হঠাৎ এই তীব্রতা আমার ইচ্ছার তা নিজেই জানি না। ভারী জানতে ইচ্ছে ছিল কেমন আছেন? বদলে গেছেন কি না?

পরক্ষণেই আবার অভী বলল, আপনার ইচ্ছে করে নি?

বাবলি বলল, কি ইচ্ছা?

–না, কোনো ইচ্ছা। কোনোরকম ইচ্ছা।

বাবলি আবার বলল, না। আমার কিছু ইচ্ছা করে নি। তবে আপনার যদি কোনো ইচ্ছা থাকে, তা পূরণ করার কথা কন্‌সিডার করতে পারি।

অভী হাসল। বলল, বাবাঃ, আপনি বেশ দাম্ভিক আছেন! কি ভাবেন বলুন তো আপনি নিজেকে? আমি কি একেবারেই ফেনা! আমার কি কোনো পরিচয়ই নেই? আমাকে এরা এখানে বক্তৃতা দিতে নেমন্তন্ন করে এনেছে, তা জানেন?

–জানি। তাতে আমার কি? আমার কাছে আপনি কি, একমাত্র সেটাই আমার জানবার। অন্য লোকে আপনাকে কি করল, না করল, কিভাবে জানল, তা জানতে আমি উৎসুক নই। আপনার কোনো রকম বক্তৃতা শুনতেই আমি রাজি নই।

তারপরই বলল, ফোনেই কথা বলবেন, না আসবেন?

অভী লজ্জিত হল। বলল, আসছি, আসছি। কিন্তু ডিরেকশনটা একটু দিন।

বাবলি কিভাবে ওদের বাড়ি আসতে হবে তা বলে দিল।

অভী ফোন ছাড়তে ছাড়তে বলল, আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছাচ্ছি। সিঁড়িতে লালরঙা কার্পেট পেতে রাখুন।

বাবলি হাসল, বলল, আচ্ছা।

অভী বলল, ফোন ছাড়ুন।

বাবলি বলল, না। আপনি আগে ছাড়ুন।

অভী কট্‌ করে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল।

বাবলি ফোন ছেড়ে অন্ধকার বারান্দায় এসে বসল।

বাবলির নিজেকে খুব দুর্বল, অসহায় বলে মনে হচ্ছিল। আনন্দ যে মানুষকে এত বিব্রত করতে পারে, তা ও জানত না। কারো সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলার মধ্যে যে এত বিবশকরা ভালোলাগা থাকতে পারে, তাও ও জানত না।

বাবলি বারান্দায় বসে থাকতে থাকতেই কাকার গাড়ি ঢোকার শব্দ পেল। সিঁড়িতে কাকার পায়ের শব্দটা অন্যদিনের তুলনায় একটু অন্যরকম মনে হল। কাকা যেন খুব তাড়াতাড়ি উঠছেন।

বাবলি বারান্দা থেকে তাড়াতাড়ি ভিতরে এল।

কাকাকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। কাকা বললেন, বাবি, তোর কাকীমা কোথায় রে?

–ঘরে। কেন কাকা? কি হয়েছে?

–না। আমাদের অফিসের বিমানবাবুর হঠাৎ সেরিব্রাল থ্রম্বসীস অ্যাটাক হয়েছে। ডক্টর সেনের নার্সিং হোমে পৌঁছে দিয়ে এলাম একটু আগে। অন্যরা নার্সিং হোমেই আছেন। আমাকে ভার দিয়েছে, তোর কাকীমাকে নিয়ে বিমানবাবুর স্ত্রীকে সঙ্গে করে নার্সিং হোমে যাবার।

এই অবধি বলেই কাকু এই যে, কোথায় গেলে, শুনছ’, বলতে বলতে দৌড়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন।

মিনিট দু-তিনের মধ্যে কাকা কাকীমা বেরিয়ে গেলেন।

কাকীমা বেরোবার সময় বলে গেলেন, কিষাণ সিংকে বলে রাখিস মুরগী, পুরো মুরগীটাই রাঁধতে, আর আমাদের খাবার রান্নাঘরে রেখে শুয়ে পড়তে। আমি গরম করে নেব। তুই খেয়ে শুয়ে পড়িস, বুঝলি, যদি আমাদের দেরি হয়।

কাকা কাকীমা বেরিয়ে যেতে বাবলির মনে খুব আনন্দ হল। একটা নীচ স্বার্থপর আনন্দ।

কাকার অফিসের বিমানবাবুকে বাবলি চেনে। ভদ্রলোক আশা করি ভালো হয়ে উঠবেন। ভদ্রলোকের ভালো হয়ে উঠতেই হবে, কারণ বাবলির প্রতি তিনি যে কনসিডারেশন দেখিয়েছেন তার তুলনা নেই। ঠিক যে সময় অভী আসবে তার একটু আগে কাকা-কাকীমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে হল তো তারই অসুস্থতার জন্যে বাবলিকে একা থাকার, একা একা অভীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিয়ে।

বাবলি ঠিক করলো বিমানবাবুর জন্যে খুব প্রার্থনা করবে ভগবানের কাছে।

কাকা-কাকীমা চলে যাবার পর বাবলি আর বারান্দায় বসে থাকতে পারল না। ও একটা বাঁধনী প্রিন্টের ছাপা শাড়ি পরে ছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলো। যদিও এ ক’দিন টেনিস খেলে ও যথেষ্ট রোগা হয়েছে, তবুও এই ছাপা শাড়িতে ওর ফিগারটা যথেষ্ট ভালো দেখাচ্ছে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ও নিজেকে নিয়ে নিজের ফিগার নিয়ে বিব্রত হতে হতে নিজেকে কারো চোখে, কারো সামনে সুন্দর করে তুলে ধরবার এই চিরন্তনী মেয়েলি প্রচেষ্টায় নিজে খুব লজ্জিত হল। ওর এতদিন ধারণা ছিল যে ও অন্যদের মতো নয়। তাহলে কি কোনো-কোনো ব্যাপারে, জীবনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সব মেয়েরাই একরকম?

অত ভাবার সময় নেই এখন বাবলির। তাড়াতাড়ি শাড়ি সায়া সব খুলে ফেলে একটা নীলরঙের সায়া একটা হাল্কা নীলরঙা সিল্কের শাড়ি বের করল।নীল ব্লাউজ। সিল্কের শাড়ি গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। রোগা দেখায় যারা মোটার দিকে; তাদের। তাড়াতাড়ি করে শাড়ি পরে ফেলে নীলরঙা মাদ্রাসী সিঁদুরের একটা টিপ পরে নিল ও। গায়ে একটু ‘ইন্টিমেট’ স্প্রে করে নিল।

শাড়ি পরা শেষ হতে না-হতেই কলিং বেলটা বাজল।

বাবলি দৌড়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। নিচে পৌঁছে দরজা খুলল।

অভী দাঁড়িয়েছিল দরজায়। একটা ছাই-ছাই রঙা টেরিকটের বিজনেস সুট পরে।

বাড়ির বাইরের আলোয় অভীকে খুব লম্বা বলে মনে হচ্ছিল, যত লম্বা ও, তার চেয়েও অনেক বেশি। বাবলির মাথাটা ওর বুকের কাছে ছিল।

অভী সিঁড়িতে লাল কার্পেট পেতে রাখতে বলেছিল। কিন্তু তার বদলে বাবলি ওকে এক সুগন্ধি ফিকে নীল অভ্যর্থনা দিল।

অভীর অবাক চোখে ও বাবলিকে চিনতে পারছিল না। সেই একটু মোটার দিকে মিষ্টিমুখের মেয়েটি যেন লকলকে সাপের মতো হয়ে গেছে। রংটা কালো হয়েছে আগের থেকে।কালো নয়, বাদামী। আর চোখ-মুখে, সমস্ত শরীরে কী দারুণ এক চিকন আভা লেগেছে।

অভী হাসছিল। কথা বলছিল না।

বাবলিও হাসছিল। বলল, কি? অত হাসার কি হয়েছে?

অভী বলল, না। এখন তো দেখছি বাংলা সাহিত্যের নায়িকা হতে কোনো বাধা নেই আপনার।

–মানে? ভুরু তুলে বাবলি জিজ্ঞেস করলো।

অভী হেসে বলল, এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? আপনি বলেছিলেন বাঙালি লেখকদের ওপর আপনার ভীষণ রাগ, কারণ নায়িকামাত্রই ফিগার ভালো হয়, দারুণ সুন্দরী হয়। এখন কিন্তু কোনো নিন্দুকও আপনার ফিগার ভালো নয়, একথা বলবে না।

বাবলি বলল, কি? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকা হবে? না ভিতরে যাওয়া হবে? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনিই যেন কোনো সাহিত্যিক; কি কবি। মানে আগে ছিলেন না; এখন হয়ে গেছেন।

অভী বাবলির পাশে পাশে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, মনে মনে সকলেই কবি। কারো কবিত্ব মনেই থাকে, আর কারো বা কাগজে। তফাত কি?

–আমি জানি না। তারপর বলল, এরকম দু’দিনের হ্যারিকেন ট্যুরে আসার কি মনে হয়? আপনার জন্যে আমি দু’দিন ছুটি নিয়েছিলাম, আপনি জানেন? আমার দু-দুটো দিনের ক্যাজুয়াল লীভ নষ্ট করলেন তো আপনি?

অভী অবাক হয়ে তাকাল।

তারপর ব্যথিত চোখ তুলে বলল, স্যরি, সত্যিই তো। ভেরী স্যরি। তবে কিছুই কি নষ্ট হয় বলে আপনি বিশ্বাস করেন? আমি কিন্তু করি না। কিছুই নষ্ট হয় না। সবই প্রাপ্তির ঘরে জমা পড়ে, জমা থাকে। কি? থাকে না?

–আমি অত জানি না।

বাবলি বলল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে। বসবার ঘরে গিয়ে বসল ওরা। বাবলি বলল, কি খাবেন বলুন?

অভী বলল, কিছু না। আপনার কি ধারণা কিছু খাওয়ার জন্যেই অন্য লোকের কাছে মিথ্যা কথা বলে আমি দৌড়ে এলাম এখানে?

বাবলি মুখ তুলে বলল, তবে? কেন এলেন? শুধুই কর্তব্য করতে?

বাবলির উজ্জ্বল কালো চোখ দুটি, তীক্ষ্ণ নাক, উঁচু হয়ে থাকা কণ্ঠার হাড় দুটো, রোদ-লাগা বুক, বুকের পেলব ভাজটি সমস্ত এক ঝলকে অভীর চোখে ভেসে উঠল। অভী চোখ নামিয়ে নিল।

বলল, না। আসতে ভালো লাগল। তাই এলাম। শুধু একজনের সামনে অনেকক্ষণ–অনেক–অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকব বলে চলে এলাম।

তারপর বলল, এসে অন্যায় করেছি? বাবলি মুখ নামিয়ে নিল। কথা বলল না।

দুজনেই কথা বলল না। দেওয়ালের মিউজিক্যাল ঘড়িটা টুং টাং আওয়াজ করে সাতটা বাজাল।

বাবলি বলল, সত্যিই কিছু খাবেন না?

–না। অভী বলল।

তারপর বলল, ভাবতেই ভালো লাগছে, আপনি ছোটবেলা থেকে এ বাড়িতে বড় হয়েছেন, খেলেছেন, দুষ্টুমি করেছেন, শ্লেট-পেন্সিলে অঙ্ক করেছেন–তারপর…।

–তারপর কি? বাবলি চোখ তুলে বলল।

–তারপর একদিন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরেছেন, তারপর এই হঠাৎ আজকের সন্ধ্যেয় এমন আশ্চর্য রহস্যময় একজন মেয়ে হয়ে আমার সামনে বসে আছেন। ভাবতেই দারুণ লাগছে।

বলেই, উঠে দাঁড়াল অভী। বলল, চলুন, আপনার ঘর দেখব।

বাবলি খুব খুশী হল। লজ্জাও পেল। আজ অবধি অন্য কেউ, অন্য কোনো পুরুষ, অভীর মতো পুরুষ বাবলি সম্বন্ধে এত উৎসাহ দেখায় নি।

ঘরে ঢুকেই বাবলি বলল, এই যে আমার মা-বাবার বিয়ের ছবি। মাকে আমি কখনও দেখি নি। ফটোতে ছাড়া।

অভী অনেকক্ষণ মনোযোগ সহকারে ছবিটি দেখল।

তারপর বলল, আপনার মুখ ঠিক আপনার মায়ের মতো।

বাবলি হাসল। বলল, হ্যাঁ, বাবা তাই বলেন।

পরক্ষণেই অভী থমকে দাঁড়াল অন্যদিকের দেওয়ালে তাকিয়ে।

আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ঐটি কার ছবি? কে?

বাবলি লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গেল।

দেওয়ালে খুব বড় করে এনলার্জ করা বাবলির চার বছর বয়সের একটা ছবি। ন্যাড়া-মাথা, ফোকলাদাঁত; ইজের আর নিমা পরে হাসছে।

এ ছবিটা যে এতদিন, এত বছর দেওয়ালের এ কোণায় টাঙানো ছিল, এতদিন এ-ঘরে থাকা সত্ত্বেও যে ছবিটাকে বাবলি কখনও আবিষ্কার করে নি, আজ অভীর চোখ দিয়ে তাকে, সেই ছোট্ট ন্যাড়ামুণ্ডি বাবলিকে হঠাৎ আবিষ্কার করে ও নিজেই ভীষণ লজ্জিত হল।

অভী খুব জোরে হেসে উঠল।

বলল, হাউ সুইট। কী দারুণ সুস্টুনি-মুস্টুনি ছিলেন আপনি ছোটবেলায়। রীতিমত কাড়লি। আদর করে দিতে ইচ্ছে করছে।

বাবলির কানের লতি দুটি লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

ও মুখ নামিয়ে নিল।

এ ঘরে অভীকে নিয়ে আসার জন্যে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিল।

অভী ওর দিকে চেয়ে বলল, কি হল? আপনি এখনও দারুণ কাড্‌লি। এখনও নিশ্চয়ই অনেকেরই আপনাকে আদর করতে ইচ্ছা করে।

ঠিক এমন সময় কিষাণ সিং ওর নোংরা দুর্গন্ধ পায়জামা আর গেঞ্জিটা পরে একটা ছালছাড়ানো মুরগীর গলা ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে বাবলির ঘরে ঢুকল। তারপর অভীর প্রতি বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট না দেখিয়ে বাবলিকে শুধোল, পুরা বানায়গা?

রাগে বাবলির গা জ্বলে গেল।

কিষাণ সিংয়ের এত জামাকাপড় আছে কিন্তু সেসব বাইরে বেরোবার জন্যে। রান্না করার সময় ও মরে গেলেও পরিষ্কার জামা পরবে না।

বাবলি তাড়াতাড়ি বিরক্তির সঙ্গে বলল, হ্যাঁ। আভি যাও।

কিষাণ সিং চলে যেতেই, অভী বলল, আপনি এত আপসেট হয়ে পড়লেন কেন? নোংরা জামাকাপড় না হলে রান্নার স্বাদ ভালো হয় না। দিল্লির মেয়ে, আর জানেন না যে, যে-ফুচকাওয়ালা বা ভেলপুরিওয়ালার দাদ নেই, নোংরা গামছা নেই, তার কাছে কেউ যায় না, কেউ খায় না?

বাবলি মুখ সিঁটকাল। বলল, ঈ-স-স-স। আপনি ভীষণ খারাপ।

তারপর ওরা দুজনেই বারান্দায় এল।

অভী বলল, এখানে বসতে পারি? ভীষণ প্লেজেন্ট বারান্দাটা দারুণ দৃশ্য কিন্তু, না? এখান থেকে?

বাবলি বলল, হ্যাঁ। তারপর অভী বেতের চেয়ার টেনে বসবার পর বাবলি শুধোল, বাতি জ্বালিয়ে দেব?

অভী বলল, না। থাক, অন্ধকারই ভালো লাগছে।

রাস্তার লাইটপোস্টে লাগানো মার্কারী ভেপার ল্যাম্পটা থেকে একটা ফিকে নীলচে বেগুনে আলো এসে বারান্দায় পড়েছিল।

অভী বাইরের দিকে চেয়েছিল।

দূরে গাছপালা আর পোড়া পুরানো দুর্গ-টুগগুলোর ধ্বংসাবশেষগুলো আধো অন্ধকারে মাথা উঁচিয়েছিল।

বাবলিও বাইরে চেয়েছিল।

মাঝে মাঝে দু’জনে দুজনের দিকে মুখ ফেরাচ্ছিল, তারপর চোখাচোখি হতেই দু’জনেই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। কেন যে, তা ওরা কেউ জানে না।

কেউই কোনো কথা বলছিল না এই মুহূর্তে অথচ একটু আগেই দু’জনেই কত প্রগলভ আলোচনা করেছিল, বলেছিল কত অর্থহীন ছেলেমানুষী কথা। এখন ওরা দুজনেই বোবা হয়ে বসেছিল।

ওরা কতক্ষণ ওভাবে বসেছিল বাবলির মনে নেই।

অনেকক্ষণ পর অভী বলল, কি করবেন ঠিক করেছেন?

কিসের? বাবলি বলল।

জীবনের। চাকরিতে তো ঢুকলেন। এরপর কি প্ল্যান আপনার? কিছু কি ঠিক করেছেন?

বাবলি বলল, কিছুই ঠিক করি নি। চাকরিটাও যে করব, এমনও মনস্থির করি নি।

অভী অবাক হল। বলল, সে কি? আই-আর-এস হলেন, ট্রেনিং নিলেন, জয়েন করলেন আর চাকরি করবেন না কেন?

বলি নি তো করব না। বলেছি, করবোই যে, এমন এখনও ঠিক নেই।

তারপরই বলল, উইমেন্স লিব্‌ সম্বন্ধে আপনার কি মতামত? আপনি কি মনে করেন মেয়েরা স্বাবলম্বী হলে, নিজেরা আয় করলেই তাদের পক্ষে স্বাধীন থাকা সম্ভব? তাদের নিজেদের ইচ্ছা মতন চলাফেরা করা সম্ভব?

অভী অবাক হল। বলল, এ তো আপনার নিজস্ব মতামতের ব্যাপার। কোনো পুরুষের মতামতের ওপর কোনো মেয়ে তার স্বাধীনতার প্রকৃতি নিশ্চয়ই ঠিক করে না। তবে, উপার্জনের সঙ্গে কিছু স্বাধীনতা তো থাকেই। এ কথা অস্বীকার করার উপায় দেখি না।

বাবলি বলল, জানি না। আমি হয়তো সেকেলে। অথবা অন্যভাবে বললে বলতে হয়, আমি হয়তো ফুল অব কনট্রাডিকশানস। আমার কিন্তু মনে হয় যে, মেয়েদের স্বাধীনতাটা পার্কে অথবা রাস্তায় লড়াই করে বা মাসান্তে কিছু টাকা রোজগার করে পাওয়ার নয়। কারণ সে ব্যাপারটা একটা সমষ্টিগত পাওয়া। কিন্তু জীবনে সমষ্টির দাম কতটুকু? বুঝতাম, মেয়েরা যদি বিয়ে করত, অন্য অনেক দেশের মেয়েদের মতো জাস্ট লিভ-টুগেদার করত! আজ এর সঙ্গে, কাল ওর সঙ্গে–তারপর এমনি করে সঙ্গীর পর সঙ্গীর সঙ্গে–তাহলেও বুঝতাম। যারা সে জীবনে বিশ্বাস করে, আমি তাদের দলে নেই। আমি ছোটবেলা থেকেই ঘরের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সুন্দর একটি থাকার জায়গা, এমন একজন স্বামী, যে সবদিক দিয়ে আমার চেয়ে ভালো, সবদিক দিয়ে বড় যাকে আমার সম্মান করতে একটুও দ্বিধা থাকবে না।

অভী বলে উঠেছিল, আর ছেলেমেয়ে?

বাবলিও সপ্রতিভতার সঙ্গে বলেছিল কমপক্ষে তিনটি ছেলেমেয়ে। ঘর ভর্তি কাজ। স্বামীর কাজ, বাচ্চাদের কাজ, এই নিয়েই আমি খুশী থাকব। এবং আমার স্বামীও আমার মধ্যে নিশ্চয়ই সম্মান করার মতো কিছু দেখবেন। আশা করি দেখবেন। তাহলেই আমি যে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, সে স্বাধীনতা পাবো বলে আমি মনে করি।

অভী অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।

বাবলি হেসে বলল, কি আমার লম্বা বক্তৃতা শুনে কি আপনি ঘুমিয়ে পড়লেন?

অভী বলল, ঘুমিয়ে পড়ি নি। ভাবছি। আপনি তাহলে আপনার মনোমত ঘরের জন্যে মনোমত স্বামীর জন্যে এমন চাকরিটাও ছাড়তে রাজী? আশ্চর্য! আজকাল এমন দেখা যায় না, শোনা যায় না বড়।

বাবলি হাসল। বলল, হ্যাঁ। ভারত সরকারের চাকরির চেয়ে আমি আমার স্বামীর চাকরি করা অনেক ভালো বলে মনে করি। তারপরই বলল, আঁদ্রে মোরোয়ার লেখা একটা বই আছে, ‘দ্য আর্ট অব লিভিং’। পড়েছেন!

অভী বলল, না।

যেখানে এক জায়গায় উনি বলছেন যে, ম্যাগনিচুড কোনো ব্যাপারই নয়। যে-কোনো পারফেক্ট জিনিসই পারফেক্ট। একজন গৃহিণী তার গৃহিণীপনায়, তার ভালোবাসায় তার সহনশীলতায় তার বুদ্ধিতে যদি তার ছোট্ট সংসারকে সুষ্ঠুভাবে চালিত করতে পারে, তবে তার কৃতিত্বের মধ্যে আর যে জননেতা কোনো বিরাট দেশের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ কৃতিত্বের সঙ্গে এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন, তার মধ্যে কৃতিত্বের মাত্রার কোনো তারতম্য নেই। দেশ চালানোর মতো ছোট্ট সংসার সুন্দরভাবে চালানোও একই রকম কৃতিত্ব। আমি সেই কৃতিত্বকে অনেক বড় বলে মনে করি। তবে জানি না, মনোমত ঘর, মনোমত স্বামী পাব কি না। মনোমত স্বামী না পেলে বিয়ে করাও হবে না, চাকরি ছাড়ার কথাও ওঠে না।

অভী হাসল। বলল, আপনার যোগ্য ছেলে কি ভারতবর্ষে আছে?

বাবলি হাসল। বলল, ঠাট্টা করছেন বুঝি?

অভী গম্ভীর গলায় বলল, ঠাট্টা করছি বলে মনে হল বুঝি আপনার?

বাবলি বলল, তাই-ই-ই তো। আমি কি, আমার যোগ্যতা কতটুকু, আমার রূপগুণের বাহার কতখানি, তা আমার নিজের তো অজানা নেই। আমি অত্যন্ত সাধারণ।

অভী বলল, না। আপনি তো রীতিমত ফ্যাসাদে ফেললেন। আপনার সঙ্গে আপনার যোগ্য কোনো ছেলের আলাপ করিয়ে দেওয়াটা দেখছি কর্তব্যে দাঁড়িয়ে গেল এখন। তারপরই একটু থেমে বলল, আলাপ করবেন? আমার এক বন্ধুর সঙ্গে? সে এখন দিল্লিতেই পোস্টেড। সে আপনার যোগ্য হলেও হতে পারে। আমার চেয়ে সে একশো গুণ ভালো, সব দিক দিয়ে। বলুন তো আলাপ করিয়ে দিই?

বাবলির খুব অপমানিত লাগল ওর নিজেকে। ছিঃ ছিঃ, ও কি নির্লজ্জের মতো অভীর কাছে নিজেকে নিবেদন করলো, আর অভী চালাকের মতো কথাটা এড়িয়ে গেল। ওর সঙ্গে আলাপ করাতে চাইলো অন্য কারো?

বাবলি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।

তারপর কেটে কেটে বলল, না। ধন্যবাদ। আমার জন্যে আপনার এত কষ্ট স্বীকার করতে হবে না। আমি নাবালিকা নই। আমার স্বামী নির্বাচনের ব্যাপারে আপনার সহায়তা না হলেও চলবে।

অভী চমকে মুখ তুলে তাকাল। তারপর লজ্জিত গলায় বলল, আইয়্যাম সরি।

আমি কথাটা কিন্তু সিরিয়াসলি বলেছিলাম। আন্তরিকভাবেই। আপনাকে কোনোভাবে আঘাত করতে চাই নি।

বাবলি হেসে ব্যাপারটা লঘু করে দিয়ে বলল, আঘাত আমার এত সহজে লাগে না। ছোটবেলায় মা-হারানো মেয়ে। ছোটবেলা থেকে অনেক আঘাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

কিছুক্ষণ পর, অভী কোনো কথা বলছে না দেখে বাবলি কথা অন্যদিকে ঘুরোবার জন্যে বলল, তাহলে পরশু রাতে খেতে আসছেন তো? কি কি,খেতে ভালবাসেন আপনি? এখানে তো ডিমাপুরের রসিদ আলি নেই। তবে, যদি বলেন কি খেতে ভালোবাসেন তাহলে আমি নিজে রান্না করবো। অফিস তো ভুল করে ছুটিই নিয়ে ফেলেছি। যখন ছুটি নিই, তখন বুঝতে পারি নি। যে আমার আপনার জন্যে যতখানি ভাবনা, আপনার তা নেই আমার জন্যে। ব্যাপারটা ছেলেমানুষী হয়ে গেছে। যাই-ই হোক অন্তত সারাদিন রান্না করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা যাব। এখন বলুন দয়া করে, কি খেতে ভালোবাসেন?

অভী এক দৃষ্টে অনেকক্ষণ বাবলির মুখের দিকে চেয়ে রইলো। আস্তে তস্তে একটা আলতো হাসি ওর মুখময় ছড়িয়ে পড়ল। বিস্ময়ের হাসি। যে হাসি ওর পক্ষে লুকানো সম্ভব ছিল না।

তারপর বলল, ভালো করে শুনুন কি কি খেতে ভালবাসি। নারকোল দিয়ে মুগের ডাল, ঝিঙে-পোস্ত, তেল-কই ধনেপাতা দিয়ে, আর আর আর–তারপর ভেবে বলল, আনারসের চাটনি।

বাবলি বলল, ব্যস্‌স। আর কিছুই ভালোবাসেন না?

অভী বলল, ভালো অনেক কিছু বাসি। কিন্তু এই-ই যদি খাওয়ান তা হলেই ভীষণ খুশী হব। আসল ব্যাপারটা কি জানেন? চিরদিন বাইরে বাইরে। একা একা থাকা, চাকর-বাকরের দয়ায় খাওয়া-পরা। আসলে যা ভালোবাসি, তা হচ্ছে খাওয়ার সময় কেউ সামনে বসে থাকুক, আমার সঙ্গে বসে খাক–তারপরে গল্প করতে করতে খাই–একজন কেউ থাকুক যে এটা-ওটা এগিয়ে দিতে পারে নুনটা, সস্‌টা—ব্যস্‌স–এতেই খুশী। আপনি আমার খাওয়ার সময় আমার সামনে বসে থাকবেন তো?

বাবলির বুকের মধ্যে কি যেন কি একটা ব্যথা মোচড় দিয়ে উঠল। বাবলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলল, নিশ্চয়ই বসব। তারপর বল, ইম্ফলে আপনার খাওয়া-দাওয়ার খুব অযত্ন হয় না?

অভী বলল, না না অযত্ন হবে কেন। আমার কাছে যে ছেলেটি আছে, সে চমৎকার। খুব আদর-যত্ন করে। তবু কোথায় যেন কি একটা বাকি থাকে। কি যেন নেই, কি যেন নেই মনে হয়। আপনাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না।

বাবলি বলল, না বললেও বুঝতে পারি।

অভী বলল, ইম্ফলে আর একবার চলে আসুন আপনি। সেবার এত অল্পদিন থাকলেন যে কিছুই তো দেখা হয় নি আপনার। তারপর আপনার সঙ্গে আলাপ হল একেবারে চলে আসার সময়–এসকর্ট হিসাবে। এবারে এলে বন্ধুত্বের দাবিতে আপনাকে যা যা দেখাবার আছে সব ঘুরিয়ে দেখাব। আমার বাংলোয় নিয়ে যাব। আসবেন?

বাবলি ক্যাজুয়ালি বলল, পুজোর সময় কি কলকাতা যাবেন?

অভী বলল, না। কলকাতা গিয়ে কি হবে? এবারেই মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মা তো এখন থেকে দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গেই থাকবেন বম্বেতে। আর কলকাতার আকর্ষণ যে বন্ধুরা–তারা তো সকলেই সারা পৃথিবীতে এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কলকাতার এখন আর কোনোই আকর্ষণ নেই আমার কাছে। ইম্ফলেই থাকব।

কি করবেন ছুটিতে একা একা? বাবলি শুধোল।

খাব, একটু লেখাপড়া করব নিজের সখের। টেনিস খেলব। আর ঘুমব।

হঠাৎ বাবলি বলল, আমি যদি পুজোর সময় যাই?

অভী আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠল। বলল, আসবেন? আসুন না। তাহলে তো গ্র্যান্ড হয়। আমারও ছুটি থাকবে। আপনাকে সবসময় কম্প্যানি দিতে পারব।

বাবলি বলল, কিন্তু পুজোর সময় মাসীমা-মেলোমশায় বোধহয় কলকাতা আসবেন। আমি তাহলে কোথায় থাকব? ভালো হোটেল আছে ইম্ফলে।

আছে, আছে। অভী বলল। হোটেল-দ্য-অভী। আমার হোটেলে থাকবেন। ফাইভ-স্টার হোটেল নয়। থাকতে কষ্ট হবে আপনার কিন্তু শোওয়ার ঘর, অ্যাটাচ বাথ এবং অন্যান্য সমস্ত সুবিধা পাবেন, প্লাস ট্যুরিস্ট গাইড পর্যন্ত। আসবেন তো?

তারপর বলল, আমি ভাবতেই পারছি না যে, আপনি সত্যি সত্যিই আসবেন। পুজোর তত বেশি দেরিও নেই। আর মাস দেড়েক। আমি তা হলে ফিরে গিয়েই আমার গাড়িটা একেবারে ঠিক-ঠাক করে ফেলব। খুব মজা হবে। প্লিজ আসুন।

বাবলি বলল, কথা দিতে পারছি না, তবে চেষ্টা করব। খুব চেষ্টা করব।

একটু পরে বাবলি বলল, একটা কথা বলবো আপনাকে?

আচ্ছা, ডিমাপুরের রাস্তায় আপনি যখন আপনার গাড়ির পিছনে আব্রাকাডাব্রা বলে আমার কথামতন লাথি মেরেছিলেন তখন সত্যিই কি আপনি ভেবেছিলেন যে ঐ মন্ত্রে গাড়ি চলবে? আপনি কি ওসবে বিশ্বাস করেন?

অভী হো হো করে হেসে উঠল।

বলল, ভালোই হল আপনিই কথাটা তুললেন বলে। দেখুন আপনি ইম্ফল থেকে বেরোনোর পর থেকেই আপনার কথাবার্তায় বুঝেছিলাম যে আপনি ভীষণ বুদ্ধিমতী। এও বুঝেছিলাম যে আপনার এই বুদ্ধিমত্তার জন্যে স্বাভাবিক কারণে আপনি গর্বিত। আমাকে বোকা বানিয়েও আপনি এক রকমের নিষ্ঠুর আনন্দ পাচ্ছিলেন। একথা যখন বুঝেইছিলাম, তখন কেন আর আপনার আনন্দ থেকে আপনাকে বিনা কারণে বঞ্চিত করি আমি? তা ই যা যা বলেছিলেন, যখনই বলেছিলেন তা-ই-ই করে আপনাকে খুশিমনে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। অন্যায় করেছিলাম কি?

বাবলির মুখটা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল।

বাবলি হাসির মতো শিস্ তুলে বলল, ঈ-স্-স্ আপনি কি খারাপ? আপনি জেনে শুনে অমন বোকা সেজে ছিলেন? কি ডেঞ্জারাস লোক আপনি বাবা!

হঠাৎ ঘড়ি দেখল অভী। বলল, ওরে বাবাঃ অনেক রাত হয়ে গেল–আমার বৌদি হাতে মাথা কাটবেন আমার। এবার কিন্তু উঠি, কেমন?

বাবলি বলল, যা ইচ্ছে।

অভী উঠতে উঠতে বলল, আমার যা ইচ্ছে। আপনার কোনো ইচ্ছে নেই?

বাবলি বলল, না। ইচ্ছা পূরণ না হলে সে ইচ্ছা থেকেই বা লাভ কি?

অভী ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল বাবলির দিকে। এক আশ্চর্য ভালোলাগা ও কৌতুকমেশানো হাসিতে ওর মুখ আবার ভরে উঠল। হঠাৎ অভী ডান হাতটা বাড়িয়ে বাবলির ডান হাতের পাতাটা ধরে ফেলল। তারপর বাবলির হাতটা ওর মুখের কাছে তুলে নিয়ে ওর ঠোঁট ছোঁওয়ালো বাবলির হাতে। বলল, কেন জানি না আপনাকে আমার খুব ভালো লেগে গেছে।

তারপরই হঠাৎ বলল, আমাকে ক্ষমা করবেন।

বাবলি মুখ নামিয়ে ছিল। বাবলির কানের লতি আনন্দে ভালোলাগায় লাল ও গরম হয়ে উঠেছিল।

বাবলি মুখ নামিয়েই রইল।

অভী ক্ষমা চাওয়ার গলায় বলল, আপনি রাগ করলেন?

না। বাবলি বলল।

অভী বাবলির একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ওর চোখের গভীরে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল। পরক্ষণেই অভী নীচু হয়ে বাবলির চোখের পাতায় চুমু খেল।

বাবলি একমুহূর্ত অভীর বুকের ওপর মুখটা নুইয়ে রাখল। পরমুহূর্তে ও ছিটকে সরে এল। ওর মনে হল ওর সারা শরীরে কি এক আগুন জ্বলে উঠেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে। যে আগুনের নাম জানে না ও।

বাবলি জানল না সেই মুহূর্তে যে এই আগুন আর কখনও নিভবে না। তুষের আগুনের মতো নিঃশব্দে ধিকিধিকি করে জ্বলবে। বাবলির শরীরের সমস্ত অণুপরমাণুতে। বাবলির মনের মলিকিউলে।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ