দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর একটু জিরিয়ে নিয়ে যখন অভী আর বাবলি ঝুমার হোটেলে এল, তখন ম্যানেজার বললেন যে, ঝুমা খুব জরুরি কাজে নাকি বেরিয়ে গেছে। একটা চিঠি দিয়ে গেছে ওঁর কাছে।

ম্যানেজার অভীর হাতে চিঠিটা দিলেন, কিন্তু বাবলি চিঠিটা ছোঁ মেরে অভীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে খুলল।

অভী অবাক-হওয়া মুখে তাকাল আড়চোখে বাবলির দিকে।

বাবলি চিঠিটা নিজে একবার মনে মনে পড়ল।

তারপর জোরে জোরে অভীকে পড়ে শোনাল।

মণিপুর হোটেল

অভীদা,

এক বিশেষ ব্যক্তিগত কাজে একটু বেরোতে হচ্ছে আমায়। তোমাদের সঙ্গে লটাকে যাওয়া হবে না। তোমরা লাক থেকে ফিরে এলে আশা করি কাল সকালে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।

কিছু মনে করো না। হ্যাভ আ নাইস টাইম। ইতি–

ঝুমা।

পুনশ্চ : বাবলি, তোকে আলাদা করে লিখলাম না। আশা করি বুঝবি।

অভী ভালো করে চিঠিটার মানে হৃদয়ঙ্গম করার আগেই বাবলি বলল, ছিঁড়ে ফেলব?

অভী চমকে উঠল।

অন্যমনস্ক ছিল ও।

বলল, যা খুশি।

বাবলি বিনা বাক্যব্যয়ে চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে বলল, চল, এবার তোমার লাক্ না কোথায়? ঝুমা যখন যাবেই না তখন আর কি করা যাবে?

অভী স্বগতোক্তির মতো বলল, চল।

বলেই, হোটেলের অন্য পাশের গেট দিয়ে গাড়ি বের করল।

অনেকক্ষণ অভী কোনো কথা বলে নি।

বাবলি বলল, এমন রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকবেন বলেই কি আমাকে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনেছিলেন?

অভী হাসল।

তারপর বলল, তোমার এই সম্বোধনের কায়দাটা বেশ। কথার ভাব অনুযায়ী কখনও “তুমি” কখনও “আপনি”। এই গুরুচণ্ডালি ব্যাপারটা আমার পছন্দ নয়।

বাবলিও হাসল।

বলল, বেশ। এবার থেকে চণ্ডালের ভাষাই ব্যবহৃত হবে।

গাড়ি চলছিল হু হু করে। উপত্যকাটার চারিদিকে মাথা উঁচু পাহাড়।মিজো পাহাড়, নাগা পাহাড়। শরতের রোদ লুটিয়ে আছে পাকা ধানের ক্ষেতে। বাতাসে ফসলের গন্ধ, রোদে অভ্র কুচির ঔজ্জ্বল্য-মিষ্টি মিষ্টি ঠাণ্ডা।

অভীর পাশে, গায়ের পাতলা চাঁদরটা টেনে-টুনে জড়িয়ে বসে, বাঁ হাতটা জানালায় রেখে বাবলি অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে চলেছে।

যে-স্বপ্ন কৈশোরে পা দেওয়ার পর থেকে সব মেয়েই দেখে, বাবলির জীবনের সেই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার ঝিম্ ধরা আনন্দে বুঁদ হয়ে বসে আছে।

কত মাইল পথ ওরা এসেছে জানে না বাবলি।

সারা পথ, মাঝে মাঝেই বাবলি আদুরে কাকাতুয়ার মতো কিছু একটা বলে উঠেছে, অভী হু-হাঁ করে জবাব দিয়েছে। স্টীয়ারিং-এ বসা অবস্থায়। রাস্তার দিকে নজর রেখেছে বরাবর।

হঠাৎ বাবলি বলল, আমি একটু গাড়ি চালাব। কী সুন্দর রাস্তা।

অভী নিরুত্তাপ গলায় বলল, বেশ তো!

বলেই, পথের বাঁ-দিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দরজা খুলে বাবলির জায়গায় এল বাঁ-দিকে।

বাবলি গিয়ে স্টীয়ারিং-এ বসল।

আসলে অভীর মনের মধ্যে তখন অনেক কিছু ভাঙচুর হচ্ছিল।

অভী ভাবছিল, প্রত্যেক মানুষের মনই বুঝি ল্যাবরেটরীর ক্রুসিবল-এর মতো। তাতে নানা মনজ রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটেকত কিছু মিশ্র অনুভূতি–তার মধ্যে কত কিছু সত্য প্রমাণিত হয়, কত মিথ্যা অপ্রমাণিত হয়।

অভী ভাবছিল, মানুষের মনের মতো দুর্জয় জিনিস পৃথিবীতে বুঝি আর কিছুই নেই।

আজ সকালে এয়ারপোর্টে যাবার আগে পর্যন্ত ও জানত, বিশ্বাস করত যে, ভালোবাসার প্রকৃতি বুঝি একই রকম। তার চেহারা সরলরেখারই মতো। নিজের মনের এক গোপন কেন্দ্র থেকে অন্য মনের কেন্দ্রে সে রেখা সোজাই বুঝি পৌঁছয়। এ পথে যে এত চড়াই-উত্রাই বাধা-বিপত্তি; ও কখনও জানত না।

ঝুমাকে তার ভালো লাগত। সেই ভালোলাগায় কোনোমাত্র খুঁত ছিল না। কিন্তু সে ভালোলাগা একটা ওয়াটার-টাইট ভালোলাগাই ছিল। তার মধ্যে ভালোবাসার কোনোরকম আদ্রর্তাই চুঁইয়ে আসে নি। কিন্তু আজ সকাল থেকে বাবলির এই আশ্চর্য ব্যবহার, বিশেষ করে ঝুমার প্রতি, এবং কিছুটা অভীর প্রতিও; ঝুমা সম্বন্ধে অভীকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। বাবলি সম্বন্ধেও।

ঝুমাকে ও একজন সুন্দরী, দারুণ স্মার্ট, চমৎকার কারসেশানিস্ট সঙ্গি নী হিসেবেই চেয়েছে। একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দারুণ বোন হিসেবে। ঝুমার দিক থেকেও দাদার বন্ধুসুলভ যে ব্যবহার ও পেয়েছে তাতে একবারের জন্যেও ওর মনে সন্দেহ হয় নি যে, ঝুমার মনে তার জন্যে বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি আছে, অথবা থাকতে পারে। কিন্তু ঝুমার বাবলির হাতে এইরকম করে দুঃখ পাওয়া দেখে অভীর বারবার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেছে। ও যখন স্কুলে পড়ে তখন ও একটা সুন্দর ছটফটে সাদা পায়রাকে ধরেছিল ছাদের আসে থেকে–তারপর রাতে নিজের শোবার ঘরের মেঝেতে ঝুড়ি চাপা দিয়ে রেখে দিয়েছিল সোহাগ করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দ্যাখে তারই আদরের বেড়ালটা সেই পায়রাটার ছিন্ন-ভিন্ন রক্তাক্ত পালক ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রাখে নি। অভী না-পেরেছে তার সুন্দর ভালোলাগার পায়রাটাকে বাঁচাতে, না-পেরেছে তার আদরের বেড়ালটাকে লাঠি পেটা করতে। কিন্তু মনে মনে সে তার পোষা বেড়ালটার প্রতি এক দারুণ স্তব্ধ অভিমানে নিরুপায় নীরবতার মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে থেকেছে।

আজকে বহু বছর পরে অভীর মনে সেই ছোটবেলার ভাবনাভরা নিরুপায় অভিমান আবার যেন বুকময় ফিরে এসেছে। ও কি করবে, কি ওর করা উচিত, অভী কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না।

সামনে লক্‌টাক লেকের জল দেখা যাচ্ছে। বেলা পড়ে এসেছে। শেষ সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে জলে। লেকের ওপারে নাগা পাহাড়ের পুঞ্জীভূত অবয়ব এক অতিকায় রোমশ প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো আকাশে মাথা-ছোঁওয়ানো উঁচু পিঠে রোদ পোয়াচ্ছে যেন। মিজো পাহাড়গুলোকেও দল-বাঁধা ডাইনোসরের পিঠ বলে মনে হচ্ছে।

অভী ওদিকে চেয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেল আবার।

ও ভাবছিল, প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ হলে জীবনটা অনেক ঝামেলা বিবর্জিত হত। সারাদিন পশুচম গায়ে জড়িয়ে পাথরের মুগুর হাতে ঘুরে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় গুহায় ফিরে একটু কাঁচা মাংস ঝলসে খেয়ে নারী-শরীর নামক এক জৈবিক আচারের রসাস্বাদন করে কী সরল সোজা সুখে জীবনটা কাটাতে পারত। যত দিন গেছে, মানুষ যত সভ্য হয়েছে, তার বুকের মধ্যের বায়বীর সত্তার মন নামক ইনট্যানজিবল ব্যাপারটা দিনে দিনে ক্রমশই জটিল হয়ে উঠেছে। আজকের দিনের অভীর মতো শিক্ষিত মার্জিত মানুষ তার পারিপার্শ্বিকের অনেক কিছু জেনে ফেলেও, চাদে পদক্ষেপ করেও, নিজের থেকে দূরে, আরও দূরেই শুধু সরে গেছে। বাইরের পৃথিবীকে আপন করেছে, কাছে টেনেছে; কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের বুকের মধ্যের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন যোগাযোগহীন দুস্তর ব্যবধানের বিন্দু বিন্দু দ্বীপের মতো হয়ে উঠেছে অনবধানে। এখন মানুষ লক্ষযোজন দূরের কথা মুহূর্তে শুনতে পায় নিজের ইচ্ছায় চাবি টিপে; পায় না শুধু নিজের বুকের শব্দ শুনতে; তাকে বুঝতে।

হঠাৎ বাবলি বলল, ঐ পিলারটা কিসের?

স্বপ্নোত্থিতের মতো অভী বলল, এটাই তো নেতাজী মেমোরিয়াল। আই এন-এ ফৌজের সঙ্গে এইখানে ব্রিটিশ সেনাদের যুদ্ধ হয়েছিল। সামনে যে ছোট্ট বাড়িটা দেখছ, ওটার মধ্যে নথিপত্র রাখা আছে, চল দেখবে।

বাবলি গাড়িটা থামিয়ে, গাড়ি থেকে নামল।

বাঁ দিকে একটা টিনের চালাঘর। ডানদিকে পাকা ইমারত। চালাঘরটার মরচে-পড়া টিনের ছাদ মেশিনগানের ও স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে রয়েছে।

অভী বলল, দেখেছ? গুলির দাগ! এখনও স্পষ্ট।

ওরা আই-এন-এ মেমোরিয়াল দেখে যখন বেরুল তখন সন্ধ্যে হব হব।

কিছুদূর গাড়ি চালিয়েই ওরা লাক্ লেকের উপরের ছবির মতো সুন্দর বাংলোয় এসে পৌঁছল।

উঃ, কী দারুণ!

বাবলি স্বগতোক্তি করল।

বলল, গতবার মেসোমশাই এখানে যে কেন নিয়ে আসেন নি, জানি না।

অভী বলল, কি জানি?

বাবলি বলল, অনেকক্ষণ থেকে আপনার মুড অফ্ দেখছি। আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে না করলে, বলবেন না।

অভী হাসল। বলল, বাঃ, তা কেন? কি যে বলো?

বাবলিরও নিজেকে অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করছিল। ও যে এই ইম্ফলে এসে কী মুশকিলেই পড়ল, তা বলার নয়।

অভী বলল, বাংলোটা সত্যিই সুন্দর। এখানে তোমাকে নিয়ে আসব অনেকদিন থেকে তা ঠিক করে রেখেছিলাম। আজ সত্যিই আসা হল। তোমার যে ভালো লেগেছে তাতেই আমি খুশি।

বাবলি বলল, জলের মধ্যে মধ্যে ঐ যে আলোগুলো জ্বলছে ওগুলো কিসের আলো?

অভী বাংলোর বারান্দায় ফিরে দাঁড়িয়ে লেকের দিকে তাকাল।

তখন পাহাড় পেরিয়ে শেষ বেলার ম্লান লালিমা আধো অন্ধকারে বিস্তৃত সীসে রঙা গালচের মতো লাক হ্রদের উপর ছড়িয়ে পড়েছে।

ও একটু চুপ করে থেকে বলল, এগুলো দারুণ ব্যাপার। হ্রদের মধ্যে কচুরিপানার মতো একরকমের পানা হয়। সেই পানাগুলো ছোট ছোট ভাসমান দ্বীপের মতো ভেসে বেড়ায়, হ্রদের বুকে। এই পানার দ্বীপে পাতার ঘর বাঁধে জেলেরা, মাছ ধরে, আফ্রিকান ক্যানোর মতো ছোট ছোট নৌকায়–মাছ জমা করে দ্বীপের উপর–তার উপরেই রাঁধে বাড়ে ভেসে ভেসে, ঐখানেই খায়-দায়। ক্লান্ত হলে ঘুমোয়।

তারপর থেমে বলল, একটু চুপ করে থাক, একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাবে?

বাবলি চুপ করে রইল।

সত্যিই শুনতে পেল অদ্ভুত একটা গম্ভীর আওয়াজ ভেসে আসছে হ্রদের মধ্যে থেকে, বাংলোর চতুর্দিক থেকে। শব্দটা অনেকটা ডুং ডুং-ডিং ডিং মতো। কিন্তু ধাতব শব্দ নয়। শব্দটা ভোতা। এবং একটা শব্দ নয়, অনেকগুলো শব্দ। সবদিক থেকে আসছে। ভোতা বলে, এবং জলের গা বেয়ে আসছে বলে খুব ভারী বলে মনে হচ্ছে শব্দগুলোকে। আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে সেই ডুং-ডিং শব্দ বাবলির মনে কি এক অনামা-অজানা অনিশ্চিত, ভয়ের সঞ্চার করল।

বাবলি অভীর বাহুর কাছে ঘন হয়ে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে শুধোল, এ কিসের শব্দ।

অভী হেসে উঠল।

অনেক, অনেকক্ষণ ধরে হাসল অভী। বাবলি ভাবল। অনেকক্ষণের গুমোট কাটল। এই বাংলোর দেওয়ালে-দেওয়ালে অভীর হাসিটা যেন অনেক লোকের হাসি হয়ে গম্‌গম্ করে উঠল ঘরময়।

অভী বলল, জেলেরা তাদের মাছ-ধরা নৌকোর উপরে বৈঠা দিয়ে আওয়াজ করছে। যাতে মাছেরা দৌড়াদৌড়ি করে। মাছেরা ভয় পেয়ে দৌড়াদৌড়ি করলে তারা সহজে জেলেদের পেতে-রাখা জালে গিয়ে পড়বে।

বাবলি তখনও আচ্ছন্ন হয়ে ছিল।

অস্ফুটে বলল, কী অদ্ভুত শব্দ!

অভী হ্রদের বুকে হাওয়ায় কঁপা ভৌতিক আলোগুলোর দিকে চেয়ে বলল, আমি পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি, এমন অদ্ভুত শব্দ কখনও শুনি নি।

বাবলি বলল, আমি তোমার মতো দেশ ঘুরি নি কিন্তু এমন শব্দ আমিও কখনও শুনি নি। শব্দটা ভীষণ ভয়ের। শিরদাঁড়া ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

অভী বলল, আমার পাশে দাঁড়িয়েও? সেটা আমার পক্ষে ইনসাটিং। বাবলি আদুরে গলায় বলল, উঁ-ম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্।

ডাকবাংলোর বসার ঘরে অন্ধকার নেমে এসেছিল।

বাবলি বলল, আলোটা জ্বেলে দাও না। আমার বড় ভয় করছে।

অভী আলো জ্বালতে গেল। কটু করে শব্দ হল সুইচের। বলল, লোডশেডিং।

ও মা! তবে কি হবে?

ভয়ার্ত গলায় বলল বাবলি।

বাবলির কথা শেষ হতে-না-হতে চৌকিদার একটা বড় কেরোসিনের সেজবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকল। তার দুহাতে-ধরা বাতির আলোয় দেওয়ালে তার ছায়া পড়েছিল। লোকটার ছায়াটা কদাকার, ভয়াবহ। লোকটাও।

আলোটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখার পরই ঘরের অন্ধকার যেন অনেক বেড়ে গেল। আলোটা চৌকিদারের মুখে পড়ল। এরকম একটা মুখ এর আগে কখনও দেখে নি বাবলি। মুখটা বড় নিষ্ঠুর কিন্তু নৈব্যক্তিক। তবু মুখটা কি রকম যে, তা বাবলি প্রথমে বুঝে উঠতে পারল না। মানে, ব্যাখ্যা করতে পারল না।

তারপরই বাবলির মনে হল, যেন বুঝতে পেরেছে। লোকটার মুখে এমন একটা ভাব আছে যে মনে হয় লোকটার সঙ্গে কোনোরকম কমুনিকেশানই সম্ভব নয়। লোকটা এই পানার দ্বীপের মতো একটা দ্বীপ। বিচ্ছিন্ন। তার চারধারে যোগাযোগহীনতার জল।

লোকটা কথা বলল অভীকে উদ্দেশ্য করে।

কি ভাষায় বলল, বাবলি বুঝল না।

লোকটার মুখে কথা বলার সময় কোনোরকম অভিব্যক্তি ফুটে উঠল না।

অভী জবাবে অজানা ভাষায় কি সব বলল। লোকটা নমস্কার করল না। হাসল না। বাবলির মনে হল, লোকটা ভীষণ দুর্বিনয়ী ভূতুড়ে। হয়তো এইরকম ডুং-ডিং আওয়াজ শুনে শুনে হ্রদের জলের উপর রাতের পর রাত একা একা ভৌতিক আলো জ্বলা দেখে দেখে লোকটাও বোধহয় একরকম অস্বাভাবিক হয়ে গেছে।

অভী বলল, তোমার একটু অসুবিধে হবে একে নিয়ে, এ মিজো। মিজো ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানে না ও। তোমার যা কিছু দরকার আমায় বোলো।

হতাশ গলায় বাবলি বলল, বেশ!

অভী বলল, চান করবে তো?

বাবলি বলল, করতে পারি, যদি জল গরম থাকে।

–জল গরম করে দেবে। লোক তো আছে।

–তা আছে। বাবাল বলল, কিন্তু তাকে তো আমার ভাষা বোঝাতে পারব না।

–আমাকে তো পারবে। অভী সপ্রতিভভাবে উত্তর দিল।

বাবলি উত্তর দিল না। অভীর দিকে চেয়ে রইল।

অভী ঘরের বাইরে গেল। বোধহয় লোকটাকে ডাকতে।

বাবলির একা ঘরে ঐ ভূতুড়ে পরিবেশে বসে বড় গা-ছমছম করতে লাগল। বাইরে হ্রদের উপরে সেই আওয়াজগুলো ধীরে ধীরে যেন জোর হতে লাগল। নৌকোগুলোর অন্ধকারতর ছায়া অন্ধকার জলের উপর প্রাগৈতিহাসিক কোনো জলচর জীবের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। ভাসমান ভূতুড়ে দ্বীপগুলোর মধ্যে-মধ্যে কতকগুলো জ্বলে-ওঠা নিভে যাওয়া আলোর দিকে তাকিয়ে বাবলির মনে হল ও যেন শার্লক হোমসের কোনো নবতম অ্যাডভেঞ্চারের পটভূমিতে এসে পৌঁছেছে।

অভী আসতে দেরি করছে।

বাবলি ওর মনটাকে ঐ জলজ ভয়াবহ আবহাওয়া থেকে তুলে এনে সাহসের তোয়ালে দিয়ে মুছে নিল। তারপর খুশী খুশী চোখ তুলে নিজের মনের দিকে চেয়ে আদুরে নীরবতায় শুধোল, তোমার চান করা না-করা নিয়ে অভীর এত মাথাব্যথা কেন? অভী কি আজ তোমাকে শারীরিকভাবে চায়?

একথাটা ভাবতেই বাবলির কানের লতিতে, গালে, বুকের মধ্যে রক্ত যেন দাপাদাপি করে উঠল। বাবলির সমস্ত বাবলি ছলাৎ করে চলকে উঠল মনের গভীর গোপন অন্তঃপুরে।

শরীরের শরিক এর আগে কেউ হয় নি বাবলির।

ও উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে ওর স্বাভাবিক সংস্কারজাত কিছুমানা ছিল। আসলে এ বিষয় নিয়ে এর আগে ও বিশেষ ভাবে নি। বিয়ের আগে একথা ভাবার অবকাশ যে ঘটবে, সেকথাও ভাবে নি। তবে বাবলি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা। বিয়ের আগে শরীরের ভাগীদার কেউ হলেই যে তার চারিত্রিক পতন হল একথা ও কখনও মানে নি। কারণ চরিত্রের ব্যাখ্যা তার কাছে যা, তার সঙ্গে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের চরিত্রের ব্যাখ্যা মেলে না। কারো সঙ্গে স্বেচ্ছায়, স্বাধিকারে ও আনন্দে শরীরের আনন্দ ভাগ করে নিলেই যে নৈতিক অধঃপতন ঘটে তা বাবলি আরো অনেকানেক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা মেয়ের মতই মেনে নিতে রাজী নয়। এও ও ভাবে না, বা বলে না যে, বিবাহ-পূর্ব শারীরিক সংসর্গের মধ্যে কোনো বাহাদুরি বা আধুনিকতা আছে। জীবনে যা সহজ, স্বাভাবিক আন্তরিকতা ও রুচিশীলতার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় বা দেওয়া যায় তার কিছুমাত্র পেতে বা দিতে কখনও বাবলির দ্বিধা বা দৈন্য ছিল না। অভীকে তার ভালো লেগেছে। শুধু যে ভালো লেগেছে তাই-ই নয়, অভীকে সে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে চলেছে অতি শীগগিরি। তাই আজ এই আশ্চর্য ভৌতিক পরিবেশে অভী তার পুরুষসুলভ অবুঝপনায় যদি বাবলির কাছে কিছু অগ্রিম চায় তাহলে তা না দেওয়াটা অসমীচীন হবে বলে মনে হল বাবলির। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই হুণ্ডি কেটে দেনাপাওনা নথিভুক্ত করতে হবে যে, এমন কথা নেই। হৃদয়ের ক্ষেত্রে তো কখনোই নয়। এ বাবদে অনেক দাদন দিতে হয়, অনেককে; অনেকবার। অনেক অগ্রিম দেয় ঋণ ধুলোয় ফেলাও যায়। আবার অনেক জমাও পড়ে প্রাপ্তির ঘরে, সে জমার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তার ছোট্ট জীবনে বর্তমানটাকেই বড় দায়ী বলে মনে করে এসেছে বাবলি। বর্তমানকে আঙুরের মতো নিঙড়ে বাঁচতে চেয়েছে ও ভবিষ্যৎ বা অতীতের জন্যে কণামাত্র হিসেব না করেই।

সত্যি কথা বলতে কি, অনেক মাস আগে নাগাপাহাড়ের উপরে কোহিমা-ডিমাপুরের পথে সেই কাঠুরের ঘরের হঠাৎরাতে অভী বাবলির কাছে সংশয়হীনতার সঙ্গে প্রমাণ করেছে যে, সে শুধু শিক্ষিত পুরুষই নয়; সে অভিজাতও। তার মধ্যে আপস্টার্ট হ্যাংলামি একটুও নেই। অন্য মেয়েরা পুরুষের মধ্যে কোন্ গুণকে সবচেয়ে বড় গুণ বলে মনে করে তা জানে না বাবলি, জানতে চায় না। কিন্তু ওর কাছে যে পুরুষের চরিত্রে ঔদার্য ও সহানুভূতি না থাকে তাকে কোনোমতেই ভালো লাগানো যায় না। সে রাতে অভীকে ও আহ্বান জানিয়েছিল–একজন শীতার্ত, সভ্য, বিব্রত, লজ্জিত সুন্দর পুরুষকে। কিন্তু অভী বোধহয় রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা আদপে পছন্দ করে নি। সে রাতে অভীর চরিত্রের একটা বিশেষ দরজা বাবলির কাছে খুলে গেছিল–যে দরজা ও বহু পুরুষের মধ্যেই দেখবে বলে আশা করে না; করে নি।

ওর ভাবনায় জাল ছিঁড়ে দিয়ে অভি ঘরে ঢুকল। বলল, জল গরম হচ্ছে। চল, তোমার ঘর দেখবে চল।

বাবলি উঠল। কিন্তু ‘তোমার ঘর’ কথাটাতে বেশ আশ্চর্য হল। এখানেও কি অভী আলাদা ঘরে শুতে চায় নাকি? এক ঘরে শোওয়ার মধ্যে দোষ কি? পাশাপাশি খাটে শুয়ে গল্পও তো করা যেতে পারে? তাছাড়া এই ভূতুড়ে পরিবেশে, এই নির্জনতার মধ্যে ও একা ঘরে শুতেই পারবে না। ভয়েই মরে যাবে।

কিন্তু একথা অভীকে বলবে কি করে? ও যে অভীর সঙ্গে এক ঘরে শুতে চায়-সম্পূর্ণই নিরাপত্তার কারণে হলেও একথা মেয়ে হয়ে ওর পক্ষে কি করে বলা সম্ভব? ও মনে মনে আশা করেছিল যে, এইবারে অন্তত অভী তাকে লজ্জা থেকে বাঁচাবে। আলাদা ঘরে শুয়ে নিজেকে কি ও চরিত্রবান বলে প্রমাণিত করতে চায়? এখনও কি মিল ক্লাস মরালিটি কাটিয়ে উঠতে পারল না? একে একধরনের হীনমন্যতা বা বাহাদুরি-প্রবণতা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। ভালো সাজার ও ভালো ছেলে বলে নাম কেনার এ কি অর্থহীন মূর্খ প্রয়াস? অভীর আত্মবিশ্বাস কি এতই কম? যা তারই একান্ত, যাতে তার সহজ অধিকার তা সে হাত বাড়িয়ে নেবে না কেন? যে-সব পুরুষের মুখে শিশুর মতো খাবার তুলে দিতে হয় তাদের বাবলি প্রাপ্তবয়স্ক বলে মনে করে না। কেড়ে-কুড়ে ফেলে-ছড়ে খাওয়ার মধ্যে একটা দামাল অগোছালো ভাব আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটাই পুরুষের স্বভাব। পুরুষ পুরুষোচিত না হলে ভালো লাগে না। অভীর এই দ্বিধার কথা। ভেবে–অবাক হল বাবলি।

ঘরটা ভালো। সবই ভালো। কিন্তু…। ভীষণ ভয় করবে বাবলির।

ঘরে ঢুকে লণ্ঠনটা তুলে ধরে ভালো করে ঘরটা বাবলিকে দেখাল অভী। মুখে বলল, পছন্দ?

বাবলি উত্তর দিল না।

অভী কিছুক্ষণ বাবলির অপ্রতিভ মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ বলল, কি? ভয় করবে বুঝি?

বাবলি হেসে ফেলল, লজ্জা, আনন্দ, স্বস্তি সব মিলিয়ে দারুণ এক আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল বাবলির মুখ। ভারী সুন্দর দেখাল বাবলিকে।

বাবলি অভীর বাহুতে মাথা ছুঁইয়ে ঘন হয়ে এল অভীর কাছে। হাসল একটু।

বুদ্ধিমান অভী সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল বাবলি কি বলতে চায়।

ও বলল, কোনো ভয় নেই বলেই নিজের বুকে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, দারোয়ান পাহারা দেবে।

বাবলি হাসল। বলল, শুধুই পাহারা তো?

অভী বলল, শুধুই পাহারা।

তারপর একটু ভেবে বলল, কিন্তু ভাবছি, আমার লোভকে কে পাহারা দেবে?

অসভ্য! বাবলি বলল। বলেই, মুখ ফিরিয়ে নিল।

বাবলি চান করে নিয়েছে গরম জলে। চান করে উঠে একটা লেমন ইয়েলো ভয়েলের শাড়ি পড়েছে। সঙ্গে ঐ রঙের ছোট হাতার প্লেট-মুড়ে সেলাই করা লোকাটের ব্লাউজ। অভী চান করতে গেছে। ও সোফায় বসে আছে। আলোটা হঠাৎ জ্বলে উঠল। খুশী হল বাবলি।

খাট দুটো আলাদা আলাদা নয়। একেবারে জোড়া-লাগানো। সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল বাবলি। তারপরই ওর তলপেটে ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াতে লাগল। ওর একবার মনে হল এখানে না এলেই বোধ হয় ভালো হত। আরেকবার মনে হল যে, ভাগ্যিস এসেছে।

অভী পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বাথরুম থেকে বেরুল। বেরিয়েই বলল, ফাইন্। এবার তো চা-টা দিয়ে যাওয়ার কথা। লোকটা কি করছে বল তো? আলোও এসে গেছে।

বাবলি ঠোঁট উল্টে বলল, আমি কি করে বলব?

অভীই বলল, ঐ যে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

লোকটা ট্রে-সুদ্ধ চায়ের পট নামিয়ে রেখে গেল। নামিয়ে রেখেই একবার চকিতে তাকাল বাবলির দিকে। বাবলির কেমন গা-ছম্ছ করে উঠল। সেই ছমছমানি ঝেড়ে ফেলে ও চা তৈরি করতে লাগল।

অভী বলল, চিনি ক’ চামচ জান তো?

বাবলি হাসল, বলল, জানি।

অভী কপট কৌতূহলের সঙ্গে বলল, তুমি কি সবই জান আমার সম্বন্ধে? কি আমার পছন্দ, কি অপছন্দ?

বাবলি চায়ের পেয়ালা অভীর হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, সব জানি না; কিছু কিছু জানি।

চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে অভী বলল, রাতে বেশ গরম হবে বলে মনে হচ্ছে। আমি কিন্তু মশারি টাঙিয়ে শুতে পারি না–আর পাখাও ফুলস্পীডে চালিয়ে শুতে পারি না। মেঘলা করেছে আকাশে, তাই এত গরম।

বাবলি উত্তর দিল না।

অভী একবারও জিজ্ঞেস করল না যে, মশারি না টাঙিয়ে শুলে বা পাখা ফুলস্পীডে চালালে বাবলির কোনো অসুবিধা হবে কি না; হয় কি না।

অভীর বাবলি সম্বন্ধে এই স্বাভাবিক ও প্রাসঙ্গিক ঔৎসুক্যের অভাব বাবলিকে শুধু অবাকই নয়, একটু দুঃখিতও করল।

চা খেতে খেতে ও ভাবছিল যে, ও কোনোদিনও মশারি না টাঙিয়ে শুতে পারে নি। যতই গরম হোক না কেন। ঘরের কোণায় একটি মশাও যদি একবারের জন্যেও পিন্ করে ওঠে তাহলেই নিছক টেনশনে ও মশা কামড়াতে পারে এই ভয়েই ওর সারারাত ঘুম হয় না। পাখা ‘অন’-এ চালালে তো ওর নিঃশ্বাসই বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া ছোটবেলায় মা মারা যাবার পর থেকে বাবলি চিরদিনই একা ঘরে শুতে অভ্যস্ত। অন্য কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তির সুবিধা অসুবিধার সঙ্গে মানিয়ে চলা তার কখনও প্রয়োজন হয় নি। জীবনে এই প্রথম। এই সন্ধ্যেবেলা ওর হঠাৎ মনে হল যে, লক্ষ লক্ষ কোটি বিবাহিত মানুষকে স্ত্রী বা স্বামীর কতরকম সুবিধা-অসুবিধাই না মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়। চা-এর কাপ নামিয়ে রেখেই বাবলির হঠাৎই মনে হল যে, বিয়ে ব্যাপারটা বেশ কঠিন বিয়ে মানেই হানিমুন নয়, গাড়ি চালানো স্বামীর পাশে বসে হু-হুঁ হাওয়ায় বেড়িয়ে বেড়ানো নয়। এর মধ্যে যে এত সব সহজ অথচ জটিল জোড়-মেলানোর ব্যাপার আছে তা বাবলির জানা ছিল না। মনে মনে ওর কাকীমার প্রতি, ওর পরিচিত বিবাহিতা বান্ধবী ও আত্মীয়াদের প্রতি সম্মান বেড়ে গেল। মুহূর্তে ও ভাবল, আশ্চর্য! ওসব কথা কেউ ওকে বলেও নি। ওরও কখনও মনে হয় নি। সামান্য মশারি ও পাখা যে ব্যক্তিস্বাধীনতার পথে এতবড় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে কি করে, তা বাবলি ওর সমস্ত মেধা দিয়ে বুঝতে পারল না।

এটা সেটা নানা গল্প করতে লাগল ওরা দুজনে।

চা খাওয়ার পর, চৌকিদার চায়ের বাসন নিয়ে গেলে, অভী উঠে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পিছন থেকে এসে বাবলির গ্রীবায় আলতো করে চুমু খেল।

বাবলি শিউরে উঠল ভালো লাগায়। মনে মনে বলল, পারফেক্ট। ছোটবেলা থেকে যত ইংরিজি ছবি দেখেছে, গ্রেগরী পে থেকে ওমার শরীফ তারা তাদের সমস্ত নায়িকাকে–সে লিজ টেলরই হোক আর অড্রে হেপবার্নই হোক ঠিক এইভাবেই চুমু খেয়েছে। এমন রোমান্টিক পুরুষালী কায়দায় সুন্দর আদরই ও আশা করেছিল অভীর কাছ থেকে। বড় ভালো লাগল বাবলির। ও মুখ নামিয়ে নিল ভালো লাগায়।

অভী বলল, পাহারাদারটা এখন থেকেই চুরি করতে শুরু করেছে–এই সন্ধ্যেবেলাতে–রাত বাড়ালে কি যে করবে তা কিন্তু সে নিজেও জানে না।

বাবলি মুখ ঘুরিয়ে বলল, তুমি ভীষণ অসভ্য।

অভী দরজাটা খুলে দিতে দিতে বলল, তোমার যা ইচ্ছা, যতটুকু ইচ্ছা আমাকে বোল।

বাবলি জবাব দেয় নি। চুপ করে থেকে ভেবেছে যে, ও কোনো দিনও বাড়ির রান্নার ঠাকুরের কাছ থেকেও কিছু চেয়ে খায় নি।ও বড় অভিমানিনী। ওর নিজের ইচ্ছার বা অনিচ্ছার কথা কখনও মুখ ফুটে কাউকে বলে নি। বলবেও না কখনও। অভী যদি ওকে বুঝতে না পারে? কি ও চায় আর কি চায় না তা জানতে না পারলে বাবলির সমস্তটুকু বাবলিকে অভী কখনও বুঝবে না; পাবেও না। কাছে থেকেও অভী তাহলে চিরদিন দূরেরই থেকে যাবে। যতটুকু অভী পাবে, তা বাবলির টুকরো-টাক্রা।

বাবলির বড় ভয় হল; অভী কি তাকে তেমন করে বুঝতে পারবে? যদি না পারে?

ওরা কথা থামালেই বাইরের ডুং-ডিং শব্দটা সমস্ত পরিবেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল।

বাবলি তাই আদুরে গলায় বলল, গল্প কর, তুমি কত কি জান, কত দেশ ঘুরেছ, গল্প কর না বাবা।

অভী বলল, গল্প করতে ভালো লাগছে না। এই সময় এই মুহূর্তটুকুকে দারুণ ভালো লাগছে। কিন্তু…।

–কিন্তু কি? বাবলি শুধোল।

ঝুমার জন্য মনটা খারাপ লাগছে। বড় ছোট লাগছে নিজেকে। একটু থেমে বলল, তোমার লাগছে না?

বাবলি মুখ নামিয়ে নিল। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।

তারপর বলল, আমি তো ছোটই। তোমার মতো মহৎ তো নই–আমার নতুন করে ছোট লাগার কোনো কারণ নেই।

অভী উত্তর দিল না।

বাবলি বলল, চুপ করে কেন? কিছু বল।

বাবলির ভিতরটা শরীরের ভিতর, মনের ভিতর এতক্ষণ, মানে চান করে ওঠার পর থেকে এই আসন্ন অভিসারের রাতের জন্যে উন্মুখ হয়েছিল। ওর অন্তরে শরীরে যে এত ফুটেওঠার অপেক্ষায় অপেক্ষমান দারুণ সুগন্ধি সব কুঁড়ি ছিল ও নিজেও কখনও জানে নি। একটু আগেই বাবলি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে জানে বলে বিশ্বাস করত। কিন্তু ও এখন এই মুহূর্তে জানছে যে, নিজেকে ও কখনোই সম্পূর্ণভাবে জানে নি, জানত না। কেউই কি তা জানে? জীবন যত এগোয়, যতই দিন যায়, পরতে পরতে জানাগুলো খুলতেই থাকে, খাচে-খেচে। পাড়েতে আঁচলাতে কত বিস্ময়, কত আশ্চর্য সব আবিষ্কার যে লুকিয়ে থাকে–আতরের মিষ্টি গন্ধের সঙ্গে, ন্যাপথলিনের উগ্র গন্ধের সঙ্গে তা বাবলি কখনও জানে নি। হীরের মতো মনের এক এক কোণে অন্য মনের এক এক কোণ থেকে আলো পড়লেই কত যে আলো ঝমলিয়ে ওঠে তা যতক্ষণ না ওঠে ততক্ষণ জানাও যায় না।

বাবলি ভাবছিল যে, একটু আগেও ও অন্য বাবলি ছিল। সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। ভালোবাসা, ভালো লাগার উত্তেজনায় আকুল কোনো পাপড়ি মেলা ফুলের মতো। অথচ অভীর এই একটা কথায় ওর ভিতরের শরীর মনের গোপন পাপড়িগুলি কার অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে যেন গুটিয়ে গেল, এমনভাবে গুটিয়ে গেল যে ওর মনে হল তাদের বোধহয় অনেকদিন আর চেষ্টা করেও খোলা যাবে না!

শরীর মনের কুলুপের চাবি হারিয়ে গেছে।

বাবলি শাড়ির আঁচলটা ভালো করে বুকের সামনে টেনে নিয়ে বসল, গ্রীবা ঢেকে। অভীকে যে আদর করতে অনুমতি দিয়েছিল তার জন্যে মনে মনে ধিক্কার দিল নিজেকে। ইম্ফলে আসার জন্য, ভুল লোককে ভুল করে ভালোবাসার জন্যে নিজেকে তিরস্কার করল মনে মনে।

হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে অভী বলল, তুমি কবিতা ভালোবাস?

–মানে? বাবলি নৈর্ব্যক্তিক গলায় শুধোল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে।

–কবিতা ভালোবাসো কিনা জিজ্ঞেস করছি।

অভী সহজ গলায় আবার বলল।

–হঠাৎ কবিতার কথা? ‘আশ্চর্য পতন’-এর কবিতার কথা বলছ?

অভী হেসে ফেলল। বলল, না। তারপর বলল, বরার্ট ফ্রস্ট আমার প্রিয় কবি। এই মুহূর্তে ফ্রস্ট-এর একটি কবিতা মনে পড়ছে খুব।

বাবলি বলল, ফ্রস্ট আমি বিশেষ পড়ি নি। তবে জওহরলাল নেহরুর দৌলতে ওঁর একটি কবিতা প্রায় সকলেই জানেন। কবিতাটির নাম মনে নেই–কিন্তু ঐ যে সব লাইন আছে না–প্রমিসেস্ টু কীপ ইত্যাদি।

অভী বলল, কবিতাটির নাম :

Stopping by wood on a Snowy Evening কিন্তু এখন আমার অন্য একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে ভীষণ।

–কি কবিতা? বাবলি শুধোল।

–The Road not taken! অভী বলল।

–কি কবিতাটি–শুনি?

অভী আবৃত্তি করল—

Two roads diverged in a yellow wood.
And sorry I could not travel both
And be one traveler, long I stood
And looked down one as far as I could
To where it bent in the undergrowth;
Then took the other, as just as fair,
And having perhaps the better claim,
Because…

এই অবধি বলতেই বাবলি ঝঝিয়ে উঠল। এমনভাবে এর আগে ও অভীর সঙ্গে কখনও কথা বলে নি।

অভীর মনে এতদিন পরে এতকিছুর পরেও যে ওর সম্বন্ধে এখনও এত দ্বিধা আছে একথাটা বুঝতে পেরে ও অপমানিত বোধ করল।

বলল, এর পরের অংশ শোনবার ধৈর্য আমার নেই। সব কাজের পেছনেই কারণ একটা থাকে। কবির কারণ আর তোমার কারণ নিশ্চয়ই এক নয়। কিন্তু তোমার কাছে তো আমি কারণ শুধোই নি। নিজেকে আমার কারণে ছোট করছ কেন? ঝুমার কারণে ছোট হয়ে, হীন বোধ করে, তুমি যদি আনন্দিত হও সেইটেই আমার কাছে অনেক কারণ। কারণের বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন কি?

অভী হেসে উঠল, বলল, সবকিছুই তুমি বড় তাড়াতাড়ি পার্সোনাল করে ফেল। কবিতাটার শেষটা শোন। ভালো লাগবে। শোন :

I shall be telling this with a sigh
Somewhere ages and ages hence :
Two roads diverged in a wood, and I–
I took the one less travelled by,
And that has made all the diference.

বাবলি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ডিফারেন্সও বুঝলাম, কিন্তু for good or for worse?

সে তো জানা যাবে ভালোই। তার আগে কি জানা যাবে?

বাবলি একটু পরে আপন মনে হেসে উঠল।

অভী বলল, হাসছ কেন?

আমারও একটা কবিতা মনে পড়ল। হঠাৎ।

–কি কবিতা? কার কবিতা? অভী শুধোল।

বাবলি বলল, বহুদিনের কবিতা–হুঁইটম্যানের–লিভস অব গ্রাস্-এর। Song of myself এর কটা লাইন।

কোন্ লাইন? উৎসুক গলায় অভী শুধোল।

 বাবলি জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার তারাভরা রাতের আকাশে চেয়ে ভারি বেহিসাবী গলায় আবৃত্তি করল লাইন কটি :

There was never any more inception then there is now,
Nor any more youth or age than there is now;
And will never be any more perfection than there is now,
Not any more heaven or hell than there is now

লাইন কটি আবৃত্তি করতে করতে নিজের গলার আবেগ ও গভীরতায় বাবলি নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আবৃত্তির মধ্যে মধ্যেই ওর মনে হল ও জীবনে একটা বিশেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ওর হঠাৎই মনে হল, আসলে কেউ কারো কাছে হারে না; কাউকে হারায়ও না। হার যেটা আসল হার; সেটা নিজের কাছেরই হার। বাবলি ভগবান নামক অদৃষ্ট, নিরাকার, কোনো বিশেষ ক্ষমতাবান পুরুষ অথবা নারীর উদ্দেশ্যে যার অস্তিত্বে তার তেমন বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস কিছুই ছিল না–কৃতজ্ঞতা জানাল এ কারণে যে, সে নিজের কাছে কখনও হারে নি নিজের বুকের মধ্যে হার স্বীকার সে কখনও করে নি–এ মুহূর্তেও করবে না।

ওর মনের মধ্যে ভাবনাটা দানা বাঁধতেনা বাঁধতে অভী বলে উঠল, হুইটম্যানও আমার খুব প্রিয় কবি–

What will be will be well–for what is well,
To take interest is well, and not to take interest shall be well.

মাঝপথে অভীকে থামিয়ে দিয়ে বাবলি বলল, বাঃ, কী চমৎকার! কোন্ কবিতা এটা?

অভী অবাক হয়ে বলল, কেন, Leaves of Grass এই আছে–To think of time.

বাবলি সহজ হল এতক্ষণে। নিজের মনের গুমোট কাটিয়ে উঠে হাসল। বলল, তুমি বুঝি দেশী কবিদের কবিতা একেবারেই পড় না?

অভী কথাটার খোঁচা এড়িয়ে গিয়ে বলল, পড়তে কোনো আপত্তি নেই। তবে ইংরেজী কবিতাই বেশি পড়েছি। এটা দোষ বলে যেমন মানতে রাজী নই; গুণ বলেও দাবি করি না।

বাবলি উত্তর দিল না কোনো।

ওর কেবলই মনে হচ্ছিল যে গতবার ইম্ফলে এসে এবং ইম্ফল ডিমাপুর যাওয়া অবধি সমস্তক্ষণ বাবলিই ওদের দুজনের আকাশে সূর্যের মতো দেদীপ্যমান ছিল। আপারহ্যান্ড ওরই ছিল। অভীকে তখন একজন ভালো কিন্তু বোকা-বোকা হীনমন্যতায় ভোগা ছেলে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু তারপর ওর বিষয়ে সবকিছু জেনে, অভীর সঙ্গে মিশে, তাকে নিজের হৃদয় প্রায় কিছুমাত্র বাকি না-রেখেই সমর্পণ করে, এবং ইম্ফলে এসে ঝুমাকে দেখার পর থেকে অভীই এখন এই ছোট্ট আকাশে ঝকমক করছে। ওকে এত বেশি বুদ্ধিদীপ্ত, এত বেশি আত্মবিশ্বাসী ও এতই উচ্চমন্যতায় ঘেরা বলে মনে হচ্ছে যে, ওকে বুঝি আর আগের মতো ভালো লাগছে না। মেয়েরা যাকে ভালোবাসে, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন; সেই ভালোবাসার জন মেয়েদের চোখে চিরদিনই ছেলেমানুষ। এবারে বাবলি লক্ষ্য করছে যে অভীর মধ্যের সেই ছেলেমানুষী নির্ভরশীল সত্তাটি যেন বিনা নোটিশে ক্লাস পালিয়ে কোথাও চলে গেছে। এমনকি প্রক্সি দেওয়ার জন্যেও তার ভিতরে অন্য কোনো দ্বিতীয় সত্তাকে উপস্থিত রেখে যায় নি।

বাবলি মনে মনে অভীকে বলল, যখন তুমি নির্দ্বিধায়, নিঃশর্তে আমাকে চেয়েছিলে একমাত্র আমাকেই; তখন আমি সাড়া দিয়েছিলাম। আজ যখন তোমার মনে আমার সম্বন্ধে দ্বিধা এসেছে, তুমি আমার পাশে বসে, আমাকে আদর করতে করতে ঝুমার কথা ভাবছ তখন আমারও সেই নিঃশর্ত ভালোবাসা আমি ফিরিয়ে নেব। তুমি যত বড়ই হও না কেন, যত মেয়েই তোমাকে চাক না কেন, তুমি আমাকে প্রথমে হারিয়ে দিয়ে পরে দয়া করে জিতিয়ে দেবে এমন দান আমি চাই না। বাবলি চায় নি কখনও এমন দান। তুমি আমায় সম্পূর্ণ চেন না অভী।

অভী ভাবছিল; বাবলির মনটা এর চেয়ে অনেক বড় ও উদার হওয়া উচিত ছিল। ভাবছিল, সব ছেলেরাই বোধহয় মনের দিক দিয়ে মেয়েদের চেয়ে স্বভাবত উদার হয়। ব্যতিক্রম হয়তো আছে কিন্তু এইটেই সাধারণ নিয়ম।

ঝুমার প্রতি যে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে, করা হল এবং বাবলির এই খারাপ ব্যবহারের দায়িত্ব যে অভীতেও বহুলাংশে বর্তাল একথা অভী অস্বীকার করতে পারে না। ইম্ফলের মতো ছোট জায়গায় যেখানে ঝুমার কোনো বন্ধু বান্ধব নেই, ভালো সিনেমা নেই হোটেলের আশেপাশে কোনো একা-মেয়ের পক্ষে হেঁটে বেড়াবার উপায় পর্যন্ত নেই; সেখানে এখন ও কি করছে, কি ভাবে সময় কাটাচ্ছে, অভী না ভেবে পারল না।

অভী কিছুতেই বাবলির দিকে প্রসন্নতার সঙ্গে তাকাতে পারছিল না। বাবলিকে ওর বড় নীচ বলে মনে হচ্ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, ঝুমার সম্বন্ধে ওর মনে অন্য কোনো রকম অনুভূতি ছিল না কিন্তু বাবলি আসার পর থেকে বাবলি ঝুমার সঙ্গে অত্যন্ত নিষ্প্রয়োজনীয়ভাবে খারাপ ব্যবহার করায় ঝুমাকে ও এক নতুন আলোয় দেখতে আরম্ভ করেছে। সহানুভূতি, সমবেদনা, অনুকম্পা সমস্ত মিলিয়ে এক দারুণ অনুভূতি। এর মানেও কি ভালোবাসা? অভী জানে না। কিন্তু ওর মনে বাবলির জন্যে যে উঁচু আসন ছিল সেই আসন থেকে বাবলি নিজেই ধুলোয় নেমে এসেছে তার অস্বস্তিভরা দীনতায়। এবং ঝুমা অভীর প্রতি তার অনাসক্তি ও বান্ধবীর প্রতি সৌজন্য এমন সংযমের সঙ্গে প্রকাশ করেছে যে, সে অনায়াসে উঠে এসেছে। অনেক উঁচু আসনে, নিজের কোনো রকম চেষ্টা ছাড়াই।

.

মুরগীর ঝোলটা চৌকিদার ভালোই বেঁধেছিল।

মুগের ডাল, কড়কড়ে ক’রে আলুভাজা, মুরগীর ঝোল আর ভাত। সময় ওদের দুজনের বুকে বড় ভারী হয়ে ছিল। অভী নানা গল্প করছিল, মানে করার চেষ্টা করছিল। বাবলিকে হাসাচ্ছিল, ঝুমার কথা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছিল; কিন্তু যতই চেষ্টা করছিল ততই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল।

খাওয়া-দাওয়ার পর অভী বলল, চল, একটু পায়চারি করি বাইরে।

বাবলি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল। যা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। চাঁদনী রাত হলে কথা ছিল।

–তবে? কি করা হবে এখন? অভী শুধোল।

বাবলি আবারও কাটা কাটা কথায় বলল, আমি ঘুমোব। আমার খুব ঘুম পেয়েছে।

–এত তাড়াতাড়ি? অবাক গলায় বলল অভী।

–তাছাড়া কি করার আছে এখানে? তুমিই বল?

–তা ঠিক। লজ্জিত গলায় অভী বলল। গলার স্বরে প্রকাশ পেল যে বাবলিকে এই লটা লেকে এনে কষ্ট দেওয়ার জন্যে ও দুঃখিত।

বাবলি বলল, এখানে মসলা-টসলা পাওয়া যাবে না, না? না হলে পান হলেও চলত ফর আ চেঞ্জ।

অভী বলল, পানের দোকান আছে নীচে–তবে এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। তা ছাড়া এখানের পান তুমি খেতে পারবে না। মজা সুপুরী দিয়ে খায় ওরা–উৎকট গন্ধ। মসলাও নেই।

তারপর বলল, একটা সিগারেট খাও তার চেয়ে। মুখটা ভালো লাগবে।

বাবলি হাত বাড়িয়ে বলল, দাও।

অভী এগিয়ে এসে সিগারেটটা ধরিয়ে দিল বাবলিকে।

বসবার ঘর থেকে ওরা শোবার ঘরে এল।

এসেই বাবলি বলল, খাট দুটো এমন বিশ্রীভাবে জোড়া লাগানো। আলাদা করা যায় না?

অভী বাবলির চোখের দিকে চেয়েও চোখ নামিয়ে নিল।

তারপর বলল, দেখি।

চৌকিদারকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে টানাটানি করেও খাট আলাদা করা গেল না। পায়াতে স্ক্রু মেরে জোড়া লাগানো ছিল খাট দুটো।

অসহায়ের মতো অভী তাকাল বাবলির দিকে একবার। তারপরই অভীর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এল। কি ভাবল অভী সেই-ই জানে।

অভী বলল, এক কাজ কর। তুমি একা খাটে শোও, আমি শোফাতে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেব, আমার অভ্যেস আছে। আসলে তুমিই তো ভয় পাচ্ছ। নইলে তো দুজনে দুঘরে স্বচ্ছন্দে শোয়া যেত।

–সেটাই মুশকিল। বাবলি বলল। তারপর বলল, তুমিই খাটে শোও–আমি শোফায় শুচ্ছি।

শক্ত গলায় অভী বলল, না। তা হয় না। তুমি অতিথি।

–ক্ষণিকের অতিথি। বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিল বাবলি।

অভী চোখ তুলে দেখল বাবলির চোখের কোণ যেন ভিজে উঠেছে। কিন্তু পরক্ষণেই দেখল যে, শুধু আদ্রতাই নয়, তাতে আগুনও আছে।

বাবলি সিগারেটটা শেষ করে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বলল, আমি শুয়ে পড়লাম। বড্ড ঘুম পেয়েছে।

–যা ইচ্ছা। অভী বলল, আমি তো জোর করে জাগিয়ে রাখতে পারি না তোমাকে।

বাবলি দেওয়ালের দিকে মুখ করে, অভীর দিকে পিছন ফিরে শুয়ে পড়ল। স্যুটকেশে নাইটি এনেছিল, বুকের মধ্যে করে তার সঙ্গে অনেক সখ, কল্পনা, ভালোলাগা স্বপ্ন এসবও এনেছিল। কিন্তু শাড়ি ছেড়ে নাইটি পরার অবকাশ বা ইচ্ছা তেমন হল না। বুকের মধ্যের সুন্দর সব স্বপ্নগুলোকেও। নিঃশ্বাস চাপা দিয়েই রাখতে হল।

অভী সোফায় বসে আর একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটটা হাতে ধরে একদৃষ্টিতে বাবলির পিছন-ফেরা শায়িত শরীরের দিকে চেয়ে রইল।

বাবলি কালো হলে কি হয়, ওর গায়ের চামড়ায় ভারী একটা মসৃণ উজ্জ্বলতা আছে। আলোতে, বাবলির কোমরের উপরে রাখা হাতটাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল।

অভী ভাবছিল।

বাবলির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বাবলির প্রতি এক ব্যাখ্যাহীন ঘৃণায় ওর মন ভরে উঠল। অভীর মনে হল ঝুমা শুধু বাবলির চেয়ে বহুগুণ বেশি সুন্দরীই নয় শারীরিকভাবে–ঝুমার আত্মিক সৌন্দর্যই অনেক বেশি। বাবলির মতো নীচু, ঈর্ষাকাতর মনের কাউকে স্ত্রী করার কথা ভাবতে পারে না অভী। এত কাছে থেকে, এই ঈর্ষাকাতর নোংরামির মধ্যে বাবলিকে হয়তো না দেখলেই ভালো হত। বাবলি সম্বন্ধে দুর্বলতাটা তবুও হয়তো বেঁচে থাকত ওর মনে।

ইচ্ছা করলে, এবং একটু অভিনয় করলে, আজ রাতে এই প্রসন্নতার মধ্যে একটি কুমারীশরীরের স্বাদ পেতে পারত অভী। এ পর্যন্ত অভী কোনো নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে নি। এমনকি কোনো প্রাপ্তবয়স্কা নারীর শরীর অনাবৃত অবস্থায়ও দেখে নি। কিন্তু যে-সব পুরুষ শরীরকে মন থেকে বিযুক্ত করে দেখে ও শরীরকে মৃতদেহের মতো করে পেতে চায় তাদের দলে পড়ে না অভী। মনের ভালোলাগা সঙ্গে না নিয়ে অন্য শরীরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না অভী। সে যে শরীরই হোক না কেন।

কিন্তু বাবলি বড় মোহময় ভঙ্গিমায় শুয়ে আছে। সুন্দর সুগঠিত পিঠ–টেনিস খেলে খেলে বাবলির চেহারাতে বড় মিষ্টি একটা বাঁধুনি এসেছে। কোমরটার কাছের উৎরাইয়ে ঢেউ খেলে গেছে। তারপরেই উঁচু হয়ে উঠেছে সুডৌল নিতম্বের চড়াই।

অভী সমস্ত শরীরে হঠাৎ বড় একটা জ্বালা অনুভব করল। এক অননুভূত অস্বস্তি। অভীর ইচ্ছা হল বাবলির কাছে যায়–ওর পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে–ওর ছাই-ছাই কবুতরী বুকে মুখ ডুবিয়ে বলে, বাবলি, আমাকে ক্ষমা কর–ঝুমার কথা আমি আর মুখেও আনব না। মনে তো নয়ই।

খুব দ্রুত অভী নিজের কাছে হেরে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে সম্পূর্ণভাবে হেরে গেল নিজের কাছে।

সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ছুঁড়ে ফেলে ও সোফা ছেড়ে ধীরে ধীরে বাবলির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তারপর খাটে উঠে বাবলির কাছে এল। ও জানত যে, বাবলি জেগে আছে; জেগে থাকবে। ও এও জানত যে, আজ সারারাত ওদের দুজনের কেউই ঘুমোতে পারবে না, যদিও সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন কারণে। অভী বাবলির বাহুতে, যেখানে ব্লাউজের হাতটা শেষ হয়েছে, সেখানে হাত রাখল।

বাবলি চোখ খুলে, মুখ ঘুরিয়ে চকিতে বলল, কি? কি চাও অভী?

বাবলির গলায় আনন্দ, স্বস্তি; জয়ের স্বর ঝরে পড়ল। তার সঙ্গে পরাজয়ের সুরও।

অভী হঠাৎ কি যেন দেখতে পেল বাবলির চোখে। যা একমাত্র মেয়েদের চোখেই লুকানো থাকে।

সাপ দেখার মতো অভী সেই চোখ দেখে চমকে উঠল।

পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল অভী। খাদের মধ্যে পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেল একটুর জন্যে।

অভী বলল, কিছু চাই না। তুমি কতখানি রাগ করেছ তাই দেখলাম।

তারপরেই কথা ঘুরিয়ে বলল, জ্বরের মাত্রার মতো রাগের মাত্রা মাপার জন্যেও একটা মিটার-টিটার থাকলে ভালো হত। তাই না?

বাবলি হাসল না।

বলল, আমার কিন্তু সত্যিই ঘুম পেয়েছে। বিশ্বাস কর।

পাছে ও নিজের কাছে আবারও হেরে যায়, সেই ভয়ে বাবলির কাছ থেকে সরে এল অভী। বাবলিকে পাহারা দেওয়ার কথা ভুলে গিয়ে নিজের মধ্যের আদিম, পুরুষালি; নারীর শরীরের প্রতি স্বাভাবিক লোভকে পাহারা দেওয়ার জন্যে ও ওর নিজের বুকের মধ্যের সমস্ত শুভ বোধগুলোকে জাগিয়ে তুলল। ওর রুচি, ওর শিক্ষা, ওর অসাধারণত্বর গর্বকে জাগিয়ে তুলে প্রত্যেকের হাতে একটা করে সম্মানের তরোয়াল ধরিয়ে দিয়ে মনে মনে। বলল, আমি একটু বেচাল হয়েছি তো অমনি আমাকে কেটে ফেলো তোমরা। বুঝেছ?

.

আরও একটা সিগারেট খেয়ে, পাখাটাকে অন্ করে দিয়ে, বড় বাতি নিবিয়ে দিয়ে ঘেরাটোপের মধ্যের টেবল বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল অভী সোফার উপর।

বাবলি কথা না বলে, পায়ের কাছে রাখা লাইঝাম্পিটাকে তুলে নিয়ে আপাদমস্তক মুড়ে শুয়ে পড়ল। অভীকে জোরে পাখা চালাবার জন্যে কোনোরকম অনুযোগ জানাল না। বাবলির দুচোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরতে লাগল। এত জল চোখের মধ্যে কোথায় লুকিয়ে ছিল বাবলি জানে না। কিন্তু এত কান্না বহুদিন ও কাঁদে নি।

পাখাটার শব্দ ছাপিয়ে বাইরের হ্রদ থেকে ডুং-ডিং-ডিং-ডিং শব্দগুলো গম্ভীর জলতরঙ্গের মতো বাজতে লাগল। বাবলির মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে গেল।

বাবলির ছোটবেলার কথা মনে হতে লাগল। মায়ের কথা। মায়ের মৃত্যুর কথা। বাবার কথা। ওর সমবয়সী মাসতুতো বোন পরমার বিয়ের কথা–গতবছরে। পরমার স্বামী সুজয় ছেলেটি বেশ–কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়র বোম্বের কোন ফার্মে যেন কাজ করে। পরমা কি সুখী হয়েছে? বিবাহিত জীবনের সুখ কি বাইরে থেকে কাউকে দেখে বোঝা যায়? পরমা আর সুজয়কে খুব সুখী বলে মনে করত বাবলি। এবার ওরা দিল্লি ফিরলে ভালো করে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করবে। পরমার নাকি বাচ্চা হবে। বাচ্চা হওয়া মানেই কি ধরে নিতে হবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দারুণ সুখের? কত কি জানত না, বুঝত না, ভাবত না বাবলি। এই ইম্ফলের একটা দিন, ঝুমার মতো, অভীর মতো taken for granted ছেলের আশ্চর্য ব্যবহার কত কি শেখাল বাবলিকে। জীবনে কোনো কিছুই বোধ হয় taken for granted নয়। কোনো সম্পর্কই নয়। প্রতিটি সম্পর্ককেই তিল তিল করে গড়তে হয় বুঝি প্রতিদিন–এই গড়ার চেষ্টা না থাকলেই বুঝি তা ভেঙে পড়ে, ফিকে হয়ে যায়; বাবলি ভাবছিল। কিন্তু পুরুষ জাতটাই বড় বাজে। অভীকেও রোম্যান্টিক ভেবেছিল, ভালো ভেবেছিল, কিন্তু এখন দেখছে সব পুরুষই এক। সেই সমারসেট মমের মিস স্যাডি টমসনের গল্পের মতো–ওরও বলতে ইচ্ছা করছে–পুরুষমাত্রই শুয়োর। বড় নোংরা, বড় আনরোম্যান্টিক শরীরসর্বস্ব ওরা। ঝুমার শরীরটাই দেখল অভী; আমার মনটা দেখতে পেল না।

ঘুম কারোরই হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু শেষ রাতের দিকে অভীর ক্রমাগত পাশ ফেরার উশখুশ শব্দ, বাবলির চুড়ির রিনরিন সবই থেমে গেল। ওরা দুজনেই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

নাগাপাহাড়ের ঘন জঙ্গলের ভিতর মিথুংদের সবে ঘুম ভেঙেছিল। বড় বড় পাহাড়ী দাঁড়কাক কর্কশ গলায় ডাকাডাকি শুরু করেছিল। অভী চোখ খুলল। চোখ খুলেই দেখতে পেল বাবলি অকাতরে ঘুমোচ্ছে। বড় করুণ বাবলি দেখাচ্ছে বাবলিকে। লাইঝাম্পিটা সরে গেছে। ডান পায়ের হাঁটু অবধি দেখা যাচ্ছে বাবলির শাড়ি সরে গেছে।

অভী উঠে বসল। উঠে বসে বাবলির খাটের পাশে এসে দাঁড়াল। বাবলির দু’চোখের কোণে কান্নার দাগ-গাল বেয়ে জল পড়েছে, সমস্ত মিলে মিশে মা-মরা বাবলিকে বড় অসহায় বলে মন হল অভীর। হঠাৎ, একেবারে হঠাৎই ওর বুকের মধ্যেটায় কি যে মুচড়ে উঠল। গলার কাছে একরাশ অনামা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠল। অভী যেন সেই মুহূর্তেই প্রথম বুঝতে পারল যে, বড় আশা করে, বাবলি ওর কাছে এসেছিল। ওর ওপর বাবলি তার সমস্ত সমর্পণে বড় অসহায়ভাবে নির্ভর করেছিল। সেই নির্ভরতার, সেই আশ্বাসের কোনো দাম দেয় নি অভী।

অভী এই প্রথম ভোরে ভেবেই পেল না কি করে ও এত নিষ্ঠুর হল–কোন্ দুবুদ্ধিতে ভর করে এমন নিষ্পাপ সরল সহজ মেয়েটার সঙ্গে এমন কঠিন ব্যবহার করল কাল রাতে?

অভী ডাকল, বাবলি, এ্যাই বাবলি!

বাবলি সাড়া দিল না।

অভী খাটে উঠে ওর বুকের মধ্যে এমনভাবে ঘুমন্ত বাবলির আড়ষ্ট শরীরটাকে টেনে নিল যে, বাবলি ঘুমের মধ্যে চমকে উঠল। চমকে উঠে ওর চোখের সামনে অভীকে দেখে ওর সমস্ত শরীরে অভীকে অনুভব করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

অভী বলল, কাঁদে না, লক্ষ্মী সোনা, আমি খুব খারাপ, ভীষণ খারাপ; আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।

বাবলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিল, আমি খারাপ, আমি দেখতে ভালো না, তুমি তো সবই জানতে, সব জেনেশুনেও আমার সঙ্গে এমন করলে কেন? আমি তোমার কি করেছিলাম?

অভী চুমুতে চুমুতে বাবলির সব কান্না শুষে নিল। বলল, আর কখনও করব না; তুমি দেখো, আমি আর কখনও ভুল বুঝব না তোমাকে।

প্রথম ভোরে এক নতুন সুগন্ধি রাতের জন্ম হল। সেই রাত অবার কখন ভোর হবে তা ওরা জানে না। দুটি সুস্থ, শুচি, প্রেমবিহ্বল মানব-মানবী তাদের দুজনকে দুজনে এক আশ্চর্য আনন্দের মধ্যে আবিষ্কার করল। আমলকী বনে হরিণ-হরিণীর মতো তারা খেলে বেড়াতে লাগল। হারিয়ে যেতে লাগল, হারিয়ে দিতে লাগল, ধরা দিল নিজেকে, খুঁজে পেল অন্যকে।

চৌকিদার বোধহয় অনেকবার ধাক্কাধাক্কি করেও শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে দুপুরের জন্যে যা-খুশি তাই রান্না চাপিয়ে দিয়ে বাবুর্চিখানার সিঁড়িতে বসে হুঁকো খাচ্ছিল।

এমন সময় একটা ট্যাক্সি এসে ঢুকল ফটকের মধ্যে।

ঝুমা আর বাবলির কাকুমণি নামলেন ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে দিলেন।

কাকা বললেন, কই ঝুমা, ওরা কি গায়েব হয়ে গেল না কি?

ঝুমা হেসে বলল, গাড়ি তো রয়েছে-গায়েব হলেই হল? বোধহয় হাঁটতে-টাটতে বেরিয়েছে।

চৌকিদারের মুখে সাহেব মেমসাহেব ঘুম থেকেই ওঠে নি শুনে কাকা ঘড়ি দেখলেন। তারপর ঝুমাকে বললেন, আমার ঘড়িটা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। ক’টা বেজেছে দেখত ঝুমা।

–পৌনে একটা।

–তবে তো ঘড়ি ঠিকই আছে।

ঝুমা হাসল। বলল, ঘড়ির কি দোষ?

–তা ঠিক। কাকা বললেন।

তারপর ভাবলেন, বিয়ের পর উনি নিজে কি করতেন, টেবল ঘড়িটাকে উপুড় করে খাটের তলায় রেখে দিতেন।

পরক্ষণেই ভাবলেন, কিন্তু এদের তো বিয়ে হয় নি। এরা যে দেশটাকে আমেরিকা করে ফেলল।

.

অভী চোখ মেলে বলল, এ্যাই! আরো ঘুমোবে? বাইরে অনেক বেলা।

–হোক! বাবলি বলল।

–হোক। অভী বলল, বাবলির ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে।

এমন সময় দরজায় কে যেন দমাদ্দম করে ধাক্কা দিল।

বাবলি একলাফে উঠে জামাকাপড় পরতে লাগল। ভয়ে উত্তেজনায় ও একেবারে চুপসে গেল।

অভী তাড়াতাড়ি করে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে নিতে নিতে ফিস্‌ফিস্ করে বলল, কার কি? তুমি আজ বাদে কাল আমার স্ত্রী হবে। হবে কি? হয়ে তো গেছই।

অভী দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, কে?

ওপাশ থেকে জবাব এল, তোমার যম।

বাবলি চমকে উঠল। কিন্তু গলাটা খুব চেনা চেনা মনে হলেও, চিনতে পারল না।

অভী দরজা খুলে একটা পাল্লা ফাঁক করল।

বাবলি সেই আধখোলা দরজা দিয়ে দেখল একটা লোমশ হাত এগিয়ে এসে অভীর হাত ধরল। তারপর হাত ধরেই অভীকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে গেল।

পরমুহূর্তে ঝুমা দরজা ঠেলে হৈ হৈ করে ঘরে ঢুকেই খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, কী পাজীরে তুই বাবলি! এই জন্যেই আমাকে নিয়ে আসতে আপত্তি ছিল?

বাবলির মুখ কঠিন দেখাল।

বলল, তোর সঙ্গে কে? পুলিশ?

ঝুমা তখনও হাসছিল।

বলল, পুলিশ নয়; শুনলি না, যম। আমি তোকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি। শিগগিরি বাইরে আয়।

–আমি এখনও মুখ ধুই নি। তৈরি হই নি। বাইরে যেতে পারব না এখন।

–তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বলেই, ঝুমা আবার হাসল।

ঝুমা বলল, সব পরে হবে, এক্ষুণি বাইরে আয়।

ঝুমার সঙ্গে বসবার ঘরে ঢুকেই কাকুমণিকে দেখে বাবলি একদৌড়ে ভিতরে পালিয়ে এল।

কাকা ওখান থেকে হাঁক ছাড়লেন, ঝুমা, ধরে নিয়ে এস তো এক নম্বর কালপ্রিটকে।

ঝুমা আবার ধরে নিয়ে এল বাবলিকে।

কাকা বললেন, ভেবেছিস্ কি তোরা? এটা কি আমেরিকা?

তারপর অভীর দিকে ফিরে বললেন, তুমি যে আমাকেও হার মানালে হে ছোঁকরা। তোমাকে তো ভারতরত্ন দিতে হয়। চল এবার। বিয়ে করার মজা কত বুঝবে হাড়ে হাড়ে। ভদ্রলোকে বিয়ে করে? বিয়ে করার আর মেয়ে পেলে না? এমন বিক্ষু মেয়েকে কেউ বিয়ে করে?

বাবলি ঝুমার দিকে তখনও কঠিনভাবে তাকাচ্ছিল।

হঠাই বাবলি কাকুমণির দিকে ফিরে বলল, কিন্তু তুমি এখানে? কি করে? ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছি না।

–কি করে আবার? তোমাদের ম্যাচমেকার এই যে ঝুমা দেবী তিনিই সব অনর্থের মূল। আচ্ছা, এমন কথাও কেউ টেলিফোনে বলে? আমাকে কাল দুপুরে ট্র্যাঙ্ককলে বলল, বাবলি এসেই প্রচণ্ড জ্বরে পড়েছে, একশ পাঁচ জ্বর-কালকে সকালের ফ্লাইটেই চলে আসুন। তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল যে, যে মেয়ে সুস্থ অবস্থায় বাড়ি থেকে সকালে বেরুল-দুপুরের মধ্যে তার একশ পাঁচ জ্বর হওয়া সম্ভব নয়। জ্বর তো আর জেট প্লেন নয়।

তারপর ঝুমার দিকে চেয়ে বললেন, কিন্তু তুমি যা ভেবেছিলে ঝুমা; সব ভুল। এখন তো নিজের চোখেই দেখছ।

ঝুমা হাসছিল। ও মুখ নামিয়ে বলল, তাই-ই তো দেখছি। আসলে এসব হৃদয়-টিদয়ের ব্যাপার, কাকা, আমি কিছুই বুঝি না।

চা খেতে খেতে কাকা বিস্তারিত বললেন। ঝুমা এয়ারপোর্টে আনতে গেছল কাকাকে।

ঝুমার ধারণা হয়েছিল যে, অভী ও বাবলি যেমন অসিলেটিং টাইপ ও ছেলেমানুষ; তাতে ওদের সম্পর্কটা ঝুমার এখানে থাকার কারণেই চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। কাকা না এলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। এবং সেই কেলেঙ্কারির জন্যে ঝুমাই দায়ী থাকত সারাজীবন।

কাকা বললেন, দেখলে তো ঝুমা, এসেই বরং কেলেঙ্কারিটা বাধালাম। থাকগে–আমি তো কালই চলে যাচ্ছি–তুমিও তো আমার সঙ্গেই যাচ্ছ। তাই–ই না ঝুমা?

ঝুমা বলল, হ্যাঁ।

বাবলি ধরা-পড়া গলায় বলল, আমার একা ঘরে শুতে ভয় করল–তাই…।

কাকা বললেন, ফারস্ট ক্লাস। ন্যাকামিতে তুই তোর কাকীমাকেও হার মানালি।

তারপর বললেন, ঝুমা পঞ্জিকাটা?

ঝুমা হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা পঞ্জিকা বের করল। তারপর ভালো করে দেখে বলল, মাঘ মাসের প্রথমেই যে দিন?

–হ্যাঁ। হ্যাঁ। কত তারিখ? কাকা বললেন।

–পাঁচ।

–বেশ! ঐ দিনেই হবে। তবে আজ থেকে কতদিন হল?

–প্রায় মাস দুয়েক। ঝুমা বলল।

কাকা অভীর দিকে ফিরে বললেন, আশা করি এই দু’মাসের মধ্যে আবার কোনো বিঘ্ন-টিঘ্ন ঘটিয়ে বসবে না। লাড্ডন স্কুল অব ইকনমিকসে সব কিছু শেখায় না, বুঝেছ?

তারপরই বাবলির দিকে ফিরে বললেন, আমার নেকুপুষুমুনু আদুরে মেয়ে কি বলে?

বাবলির কান লাল হয়ে উঠল।

কাকা বললেন, ভয় নেই কোনো, এক আমি আর ঝুমাই জানলাম এসব কুকীর্তির কথা–ঘটক আর যে কন্যাসম্প্রদান করবে যে–কন্যার বাবা অথবা পাত্রের দাদার কানে এসব যাবে না, এটুকু ভরসা আমার উপর করতে পারো।

কাকা চা-টা খেয়ে বললেন, জায়গাটা একটু সার্ভে করে আসি। তারপর সিগারেট ধরিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

অভী চান করতে গেছিল।

ঝুমা আর বাবলি বাংলোর বসার ঘরে বসেছিল।

ঝুমা হাসতে হাসতে বলল, কি রে বাবলি? এখনও কি রাগ করে থাকবি আমার উপর?

বাবলি মুখ তুলল। ঝুমার হাতটা নিজের হাতে নিল।

আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় ওর চোখে জল এসে গেল।

বাবলি বলল, তুই আমাকে বড় ছোট করে দিলি ঝুমা। তোর সম্বন্ধে লোকে যা বলত, তাই শুনেছিলাম; বিশ্বাস করেছিলাম।

ঝুমা গম্ভীর গলায় বলল, লোকে তো কতকিছুই বলে রে! আমি বড়টড নই; ভালোও নই। যা রটে; তার কিছু তো বটে।

তারপর একটু থেমে বলল, আসলে কি জানিস, একজন মেয়ে হিসেবে কাউকে ভালোবেসে, কারো উপর মনেপ্রাণে নির্ভর করার পরও, সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্যে যখন একটা জীবন নষ্ট হয়ে যেতে বসে, নষ্ট হয়ে যায়–তখন বড় লাগে রে। ভুল বোঝাবুঝির খেসারত আমি আমার জীবন দিয়ে দিয়েছি। আমি জীবনে অনেক কিছু পেয়েছিলাম রে বাবলি,–অনেক পুরুষের স্তুতি, ভালোবাসা। কিন্তু ভালোবাসা পাওয়া আর ভালোবাসা ধরে রাখা এক নয়। আমি অনেক পোড়-খাওয়া মেয়ে। আমার জন্যে একজন আত্মহত্যা করেছিল। তুই জানিস। সেও ভুল বোঝাবুঝি। আমার এখন সবই সয়! আমার যা সয়; তোর তো কখনও সইত না। আমার যা সইবে–তোর পক্ষে তা কল্পনা করাও মুশকিল।

তারপর একটু থেমে বলল, আমি বড় কিছুই করি নি। তোর মধ্যে আমাকেই দেখতে পেয়ে হয়তো আমি নিজেকেই এমনি করে বাঁচাতে চেয়েছিলাম।

অভী চান করে এল।

বাবলি বলল, তুমি ঝুমার কাছে বোস। আমি চান করতে যাই।

অভী এসে ঝুমার পাশে বসল।

ঝুমা খোলা দরজা দিয়ে বাইরে চেয়েছিল। দুপুরের রোদে লকটা হ্রদের জল রুপোর মতো চিকচিক্ করছিল। নাগা ও মিজো পাহাড়শ্রেণীকে খুঁয়ে ছুঁয়ে দেখাচ্ছিল।

অভী ডাকল, ঝুমা।

ঝুমা বলল, উঁ।

অভী ঝুমার হাতটা ওর নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলল, ঝুমা, শোন।

ঝুমা যেন অনেক দূরে চলে গেছিল।

ঝুমা যেন অনেক দূর থেকেই বলল, অভীদা, বাবলিটা ভারি সরল মেয়ে; ভালো মেয়ে, ওকে চিরদিন ভালোবেসো।

অভী আবার বলল, ঝুমা, একটা কথা শোন।

ঝুমা মুখ না ফিরিয়েই বলল, আমাকে যদি তোমার কিছুমাত্র ভালো লেগে থাকে তবে সেই ভালো লাগাটা আর আলাদা করে রেখ না। আমার জন্যে যাই তোমার মনে থাকুক না কেন, যদি আদৌ কিছু থাকে, তবে সেটুকুকেও মিশিয়ে দিও। বাবলির মধ্যেই থেকে যাব আমি তোমার কাছে চিরদিন।

এটুকু বলেই, অভীর দিকে মুখ ফিরিয়ে ঝুমা একটু হাসল, বলল, কথা দিচ্ছ তো অভীদা?

অভী আশ্চর্য চোখে ঝুমার মুখে চেয়ে থাকল।

ঝুমার মুখের সৌন্দর্যের গভীরে কোথায় যেন কোনো এক গভীরতর মানসিক সৌন্দর্যের উৎস ছিল। ওর সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকেই অভী তার আভাস পেয়েছে–কিন্তু আজ সকালে সেই সৌন্দর্যকে যেন পরম সত্যের মধ্য দিয়ে নিজের বুকের অন্তস্থলে উপলব্ধি করল।

অভী কোনো কথা বলল না।

অভীর দু’চোখের সামনে বসে থাকতে থাকতে ঝুমার মুখের হাসিটা বিকেলের পড়ন্ত রোদের মতো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এল। কিন্তু সে হাসি সম্পূর্ণ মুছে যাবার আগেই ঝুমা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, মুখে কিছুই না বলে।

তারপর অভীকেও আর কিছু বলার বা শোনার সুযোগ না দিয়ে, কাকর ছড়ানো পথে কিরকির শব্দ তুলে গেট পেরিয়ে অভীর চোখের সামনে থেকে ফেড্‌-আউট করে গেল।

বাবলি মুখে সাবান দিয়েছিল। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে দিতে চোখ পরিষ্কার হতেই ও বাথরুমের জানলা দিয়ে দেখতে পেল, ঝুমা বাংলোর গেটের পাশে একটা রাধাচূড়া গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে লাক্ হ্রদের দিকে চেয়ে আছে।

হঠাৎ বাবলির মনে পড়ল যে, আজ মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষাতেও ঝুমা বাবলিকে জিতিয়ে দিয়ে কত অবহেলায় বাবলিকে আবার ও হারিয়েই দিল।

বাবলি বুঝতে পারল যে, এ হার স্বীকার না করে ওর উপায় নেই। বুঝতে পারল যে, জীবনে প্রত্যেক মানুষকেই এক বা একাধিক পরীক্ষায় হারতেই হয়।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ