বলা নেই কওয়া নেই, সেদিন সাত-সকালে শৈলেন এসে উপস্থিত। শৈলেন ঘোষ।

গেট খুলে ঢুকতে ঢুকতেই চেঁচিয়ে বলল, দাদা, খাওয়ার কি আছে? ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।

যখন কাছে এসে পেয়ারাতলায় চেয়ার টেনে বসলো তখন বললাম, কি খাবে বল?

ও বলল, কি খাব না তাই বলুন? আছে?

বললাম, কি চাই?

ইতিমধ্যে হাঁকাহাঁকিতে লালি এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।

শৈলেন নিজেই শুধোলো, কি আছে ঘরে?

লালি বলল, আন্ডা হ্যায়।

শৈলেন বলল, কঠো আল্ডা হ্যায়?

 লালি বলল, এক ডজন।

 তব ছেঠো আন্ডাকা ওমলেট বানাকে লাও, জলদি। ঔর চায়ে।

 লালি ওকে বোধহয় বিশ্বাস করল না। শুধোলো, ছে আন্ডাকা ওমলেট?

 শৈলেন বলল, হাঁ হাঁ। জলদি।

আমি ওর রকম দেখে হাসছিলাম।

ও শান্ত হয়ে বসার পর বললাম, অত ডিম খাওয়া কিন্তু শরীরের পক্ষে খারাপ। ডিমে ক্লোরোস্ট্রোল বাড়ায় জানো ত?

শৈলেন বলল, ক্লোরোস্ট্রোল কি দাদা?

বললাম, রক্তের ঘনতা; ক্লোরোস্ট্রোল বাড়লে স্ট্রোক হয়।

শৈলেন জোরে হেসে উঠল, বলল, ও সব বড়লোকদের অসুখ, যারা রোজ ভালো ভালো জিনিস খায় তাদের জন্যে। আমি কি রোজ সকালে নিয়ম করে ডিম খাই? মাসে একদিন খাই কি না সন্দেহ, খেলেও ডিমের কারী নয়ত ডিমসেদ্ধ, মাঝে মধ্যে। তাই একসঙ্গে ছটা আটটা ডিম খেলে আমাদের মত লোকের কিছুই হবে না।

আমি শুধোলাম, তোমাদের থিয়েটারের রিহার্সাল কতদূর এগোল? কালিপুজো ত এসে গেল।

ও বলল, আর বলবেন না, সব ঝুল। কি আর বলব, যেখানে তিনজন বাঙালি, সেখানেই পলিটিক্স, দলাদলি; কি হবে বলুন, কোনো ভালো কাজই কি করা যাবে?

কথা ঘুরিয়ে আমি বললাম, তোমাদের মধ্যে অভিনয় কে ভালো করে?

শৈলেন হাসল। বলল, অভিনয় আমাদের মধ্যে কে বেশি ভালো করে তা বলা মুশকিল। সকলেই ভালো করি। প্লাটফর্মে দেঁহাতী মুর্গী পাকড়ে পয়সা আদায় করার সময় নজর করে আমার অভিনয় দেখবেন; দারুণ। কেবল উত্তমকুমারের মত চেহারাটাই নেই, নইলে কি আর অভিনয় খারাপ করি।

আমি ওর কথার ধরনে হেসে উঠলাম।

 শৈলেন বলল, হাসি নয় দাদা, দারুণ সিরিয়াস ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি। নইলে এই সাত-সকালে চুপি চুপি এতখানি হেঁটে আসি?

দেখবেন স্টেশনের কেউ যেন না জানে যে, আমি একা একা আপনার কাছে এসেছি।

বললাম, ব্যাপারটা কি? খুলেই বল না?

শৈলেন বলল, দাঁড়ান, বুকে বল পাচ্ছি না। আমার এই টিকিট-চেকারের বুক এখন বিনা টিকিটে পাড়ি-দেওয়া মেল ট্রেনের প্যাসেঞ্জারের মত কাঁপছে–একটু দম নিয়ে নিই। সময় লাগবে। খেয়ে-দেয়ে গায়ে জোর করে নিই। একটু সময় দিন আমাকে।

আমার জীবনের পয়েন্টসম্যান এই গাড়িটাকে ভুল লাইনে ফেলে দিয়েছে; মুখোমুখি কলিশান অনিবার্য–এখন আপনি না বাঁচালে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

আমি জবাব দিলাম না। বুঝলাম, শ্রীমান শৈলেনকে কোনো একটা গোলমেলে ব্যাপারে পড়ে আমার কাছে আসতে হয়েছে। সময় হলে নিজেই বলবে।

কুয়োর দিকে বুধাই আর তার বোন মুঙ্গলি জল তুলে কি সব কাচাকাচি করছিল। ওদের হলুদ আর লাল শাড়ির রঙ সবুজ জঙ্গলের পটভূমিতে সকালের রোদে ভারী ভালো লাগছিল। নানারকম ছোট ছোট মৌ-টুশকি পাখি চেরীগাছে, ফলসাগাছে, কারিপাতার গাছে নাচানাচি করছিল। কোথা থেকে একদল হলুদ ফিনফিনে প্রজাপতি এসে অনেকক্ষণ থেকে পেছনের জঙ্গলের সামনের ঘাসভরা মাঠে আতো ডানায় ভাসছিল।

হঠাৎ একটা প্রজাপতি এসে শৈলেনের গায়ে বসল। কিছুক্ষণ বসে থেকেই উড়ে গেল।

শৈলেনকে যেন পাগলা কুকুর কামড়েছে এমন করে লাফিয়ে উঠে শৈলেন বলল, শালা, মরেছি। সরি দাদা, শালা বলে ফেললাম; কিন্তু মরেছি। আর বাঁচা হলো না।

আমি আবার হেসে ফেললাম ওর রকম দেখে, বললাম, হয়েছেটা কি? গায়ে প্রজাপতি বসা ত ভালো লক্ষণ।

শৈলেন বলল, ভালো লক্ষণ আপনাদের, আমার মত একজন একশ পঁয়ত্রিশ টাকা টেক-হোম মানির লোকের জন্যে বিয়ে নয়। পরক্ষণেই ও বলল, অথচ দারুণ বিয়ে করতে ইচ্ছে করে। মানে ঠিক বিয়ে করতে নয়, মানে কাউকে কাছে পেতে। মানে, মাঝে মাঝে ভাবি। এমন যদি কেউ থাকত কাছে-পিঠে, যার কাছে বড়কাকানার বড়সাহেবের কাছ থেকে বকুনি খেয়ে এসে সাহেবের শ্রাদ্ধ করা যায় মন খুলে, যার কাছে। নিজের ইচ্ছা, নিজের কল্পনা সব বুঁদ হয়ে বলা যায়, যাকে জড়িয়ে ধরে এই লাপরার শীতের রাতে সিল্কের ওয়ার-দেওয়া লেপের আরাম পাওয়া যায়। মানে, এমন কেউ যদি থাকত, যাকে সম্পূর্ণভাবে আমারই বলা যেত, যে সেজেগুজে থাকলেও আমার, কিছু না-পরে থাকলেও আমার, যে দিনে, রাতে, মাসে, বছরে, সারা জীবনে শুধু আমারই।

আমি হালকা গলায় বললাম, এ ত ভালো কথা, এমন কোনো লোক ত সহজেই পেতে পার–তোমার মত ইয়াং এলিজিবল ব্যাচিলর

তা পারি। শৈলেন বলল। তারপরেই বলল, সাহস হয় না। ভীষণ ভয় করে।

লালি ছটি ডিমের মধ্যে পেঁয়াজ, টোম্যাটো, কাঁচালঙ্কা, মেটের টুকরো সব দিয়ে একটা অতিকায় ওমলেট নিয়ে এল।

শৈলেন দেখে একটুও ঘাবড়াল না, বলল, বাঃ লালি, তোকে আর তোর ফ্যামিলিকে সারাজীবনের মতো রেলের টিকিট কাটতে হবে না–সে জিম্মা আমার। আজ যা খাওয়ালি, সে বলার নয়। আজকে এরকম কিছু একটা খাওয়ার দরকার ছিল।

আমি চা বানাতে বানাতে বললাম, এবার কাজের কথা বলো দেখি।

শৈলেন গল্প করে ওমলেট চিবোতে চিবোতে বলল, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে, এবার যা কাজ তা আপনার।

বলেই বুকপকেট থেকে একটা খাম বের করে বলল, এ চিঠির একটা জবাব লিখে দিন।

বললাম, এটা কি?

শৈলেন বলল, লাভ-লেটার। ব্যাপার বুঝুন, আমারও লাভ-লেটার আসে। নয়নতারা লিখেছে আমায় প্রেম নিবেদন করে।

বলেই বলল, আমি কি বাংলা লিখতে জানি? ডাবল-টি প্যাসেঞ্জারের চালান লিখতে পারি আমি; তাও ইংরিজিতে। বাংলা যে একেবারে লিখি না তা নয়, মাকে সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখি, শত কোটি প্রণামান্তে নিবেদন এই যে, মা, আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছ? তার সঙ্গে প্রতি চিঠিতে আরও দুটো লাইন থাকে।

আমি বললাম, দুটো লাইন কেন?

শৈলেন বলল, এক লাইন ওয়েদার রিপোর্ট, অন্য লাইনে মার্কেট রিপোর্ট।

অবাক হয়ে বললাম, মানে?

হতাশ হয়ে শৈলেন বলল, মানে বুঝলেন না? প্রথম লাইনে লিখি এখানে এখন শীত (কি প্রকার শীত তাও লিখি, বেশি, না কম, না মাঝামাঝি) অথবা গরম অথবা বৃষ্টি। দ্বিতীয় লাইনে লিখি, এখন কদু সস্তা, কি আলু সস্তা, কি বেগুন সস্তা। বুঝলেন?

বুঝলাম।

বুঝলেনই যদি, তাহলে আমার এই লাভ-লেটারের একটা যুৎসই উত্তর লিখে দিন দাদা। যাতে আমার সাঁটুলি এক চিঠিতে কাৎ হয়ে পড়ে।

শুধোলাম, সাঁটুলি মানে? সাঁটুলি কি?

সাঁটুলি জানেন না? সাঁটুলি মানে লাভার। এখানের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা বলে বার্ড। বার্ডি মানে পাখি; নরম গরম পাখি।

আমি হেসে উঠলাম।

শৈলেন আসা অবধি এত হাসাচ্ছে যে, সে বলার নয়।

ও বলল, কি দাদা? চিঠিটা খুলুন। এক্ষুনি জবাব দিতে হবে, যাতে আমি এগারোটার ডাকে পোস্ট করতে পারি।

অগত্যা চিঠিটা খুললামই।

প্রিয়তমেষু,

অই সুন্দর জাগা হইতে আসা অব্দি এবং অই মুখখানা দেখা অব্দি আমার চক্ষে ঘুম নাই। প্রতি অঙ্গ কাঁইদতাছে তোমার প্রতি অঙ্গ লাইগ্যা। ঘুম নাই, খাওন নাই; কিছুই নাই। তুমি কবে আইস্যা আমারে নিয়া যাবা। কবে তোমার কোর্টারে যাইয়া তোমারে ভাত রাঁইধা দিমু। আমার হকলডা তোমারে দিমু।

আমি তোমারে ভালো বাসি। তুমি কি মোরে খারাপ বাসো?

ইতি তোমারই নয়নতারা

চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম।

ততক্ষণে শৈলেন ওমলেট খাওয়া শেষ করে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে সুড়ৎ সুড়ৎ শব্দ করে চা খেতে আরম্ভ করেছে।

ও আমার মুখের অবস্থা দেখে আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, বরিশাল।

জানেন ত? আইতে শাল, যাইতে শাল, তার নাম বরিশাল?

পরক্ষণেই বলল, নয়নতারা কিন্তু বাংলা ভালোই লেখে, অন্তত আমার চেয়ে ভাল লেখে, কিন্তু ও জানে, আমরা তিন-পুরুষ জয়নগর-মজিলপুরের বাসিন্দা–শেষ পুরুষ বিহারের ভাগলপুরে। বাঙালকথা আমরা মোটে জানি না, বুঝি না; বুঝলেন দাদা। ও সেই জন্যেই এমন বাঙালভাষায় চিঠি লিখেছে ইচ্ছে করে।

চিঠিটা খারাপ হতে পারে, কিন্তু দাদা, আমার স্টেশনমাস্টারমশায়ের দিব্যি; মেয়ে ভালো।

ভালো মানে, আমার পক্ষে ভালো। শক্ত, সোমত্ত, গড়ন-পেটন ভালো, কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে জব্বর মুসুরির ডাল রাঁধে, ধনেপাতা দিয়ে চালতে যা মাখে না, উঃ কি বলব।

তেল-কই, সর্ষে-ইলিশ, উঃ কি বলব, জুতো, জুতো।

আমি বললাম, জুতো কি শৈলেন?

ওমা। জুতো জানেন না? জুতো মানে, কি বলব? জুতো মানে হচ্ছে গিয়ে লাজোয়াব।

নয়নতারার সবচে যা ভালো জানেন, তা হচ্ছে মনটা। একেবারে টাঁড়ের মত খোলা।

ও এখানে এসেছিল বেড়াতে ওর কাকা-কাকিমার সঙ্গে এক মাসের জন্যে। বড় দুঃখী মেয়ে–পাকিস্তান হয়ে যাবার সময় ওর তিন মাস বয়স–সেই সময় থেকে দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। ওর কাছে আমার এই পেপেগাছ লাগানো কোয়াটারই স্বর্গ–আর খুব হাসিখুশি মেয়েটা খুব গান ভালোবাসে বুঝলেন দাদা। আমার আর ডানাকাটা পরী বিদ্যাধরী দিয়ে কি হবে? যে আমার সামান্য সামর্থ্যে খুশি থাকবে, আমাকে ভালোবাসবে, আমার জন্যে ভাববে, শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি আর হুহু-হাওয়ার মধ্যে আমাকে দু হাতে জড়িয়ে থাকবে বুকের মধ্যে–সেই আমার কাছে অনেক দামী।

আমি খুব প্র্যাকটিক্যাল। আমি কি, কতখানি, এ পৃথিবীতে আমার চাহিদা, আমার যোগ্যতা কতটুকু, তা আমি বুঝে নিয়েছি। আমার এইই ভালো। নয়নতারা রাঁধবে বাড়বে, আমি গলা ছেড়ে গান গাইব, দুজনে হি-হি করে হাসব, হাটের মধ্যে হট্টামি করব, খাটের উপর হুল্লোড় করব–এই আমার ভালো লাগে।

সকলে আমাদের দেখে বলবে, ঢঙ দ্যাখো। সকলে যেই বলবে, আমরা আরো ঢঙ করব। ঢঙ আমার দারুণ লাগে। মেয়েরা যদি ঢঙি না হয় তাহলে কি আপনার ভালো লাগে দাদা?

আমি বললাম, আমার ভালো লাগার কথা এর মধ্যে আসছে কোথায়? তোমার ভালো লাগলেই ভালো।

তারপর বললাম, বিয়েটা করছ কবে?

 শৈলেন বলল, আমার ত এক্ষুনি করতে ইচ্ছে করছে। এমন বরফ-পড়া রাতগুলো চলে যাচ্ছে। আমার একটা দিনও আর নষ্ট করতে ইচ্ছা হয় না। যখনি দেখি পাতা ঝরে যাচ্ছে, শীতের হাওয়ায়, চারিদিক রুক্ষ, খড়ি-ওঠা, তখনি আমার বার্ধক্যের কথা মনে পড়ে যায়। যে কদিন যৌবন থাকে, বাঁচার জেদ থাকে ততদিন, ততদিনের প্রত্যেকটি দিন আমার প্রতিমুহূর্তও বাঁচতে ইচ্ছে হয়। সত্যিই দাদা।

তারপরই একটু থেমে, একটু লজ্জা পেয়ে শৈলেন বলল, আমি জানি, আমি একজন সামান্য লোক, সামান্য আমার রোজগার, সামান্য আমার যোগ্যতা, কিন্তু তবু দাদা আমি ত একজন সুস্থ শরীর, সুস্থ মনের মানুষ। এ বাবদে ত আমি কারো চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, গরীব নয়। তবে? আমার যদি দারুণ শখ থাকে, ভীষণ উৎসাহ থাকে, মানে আপনারা উচ্ছ্বাস না কি বলেন তাই; তাহলে আমি তেমন হৈ হৈ করে বাঁচবই বা না কেন?

তারপর একটু হেসে শৈলেন বলল, আমি এই জীবনকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার মত এত বোধহয় খুব কম লোকই ভালোবাসতে জানে। আমার মনে সব সময় ফূর্তি, আমি সব সময় হাসি, সব সময় গান গাই–তাই আমার এই ফূর্তি নয়নতারাকে পাশে নিয়ে আমি আরো বাড়াতে চাই। আমরা দুজনে দেখবেন একে অন্যকে কী দারুণ ভালোবাসি, কি মজাই না করি। কি যে বলব আপনাকে, আমার ভাবতেই ভালো লাগছে। আমি আর একা থাকব না, আমার সুখ এবং দুঃখের, আমার মন এবং শরীরের ভাগীদার আর একজন শীগগিরি আসবে।

আমি চুপ করে শুনছিলাম। ভাবছিলাম, প্রত্যেক লোককেই কখনো কখনো কথায় পায়-আমাকেও পায়–যখন যাকে পায় তখন তাকে বাধা দিতে নেই। এই ভণ্ডামি ও অভিনয়ের জীবনে সত্যি কথা স্বচ্ছন্দে সাবলীলতায় বলার সময় বড় একটা আসে না।

বাগানে একঝাঁক টিয়া এসে বসল। কিছুক্ষণ কাঁচা পেয়ারা কামড়ে, ফেলে, নষ্ট করে আবার উড়ে গেল অন্য কোনো বাগানের দিকে।

একটু পরে শৈলেন নিজের থেকেই বলল, নয়ন যখন ওর বরিশালিয়া ভাষায় কথা বলে না, ওকে দারুণ মিষ্টি লাগে–আমি ওকে চিরদিন ওর নিজের ভাষায়ই কথা বলতে বলব, আর আমি বলব আমার দোখনো ভাষা। যেখানে মনের মিল, শরীরের মিল, সেখানে ভাষা কি কোনো বাধা? কি দাদা?

তারপর আবারও শৈলেন কথা বলতে শুরু করল। ওর কথায় এখন কোনো যতি নেই। দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন কিছুই নেই।

ও যে এক দারুণ আনন্দের ঘোরে বলে চলেছে। প্রলাপ বকছে।

শৈলেন বলল, লাপরা হেসালং কঙ্কাতে এত লোক ছিল আমার জানা-শোনা, আমি এখানে চার বছর আছি, আমার জানা-শোনা কম নয়–তবু আমি আপনার কাছে ছুটে এলাম কেন জানেন?

বললাম, কেন? আমি চিঠির উত্তর দিতে পারব বলে?

ও বলল, না, না। ওটা একটা ছুতো। ওকে বিয়ে করব এবং ও আমাকে বিয়ে করতে চায় একথা আমরা দুজনে যখন একে অন্যে চোখের ভাষাতেই জেনে গেছি তখন আর চিঠির দাম কি? দরকারই বা কি? তার জন্যে নয়।

আজকে আমার মন বলছিল, আপনাকে এত সব কথা বলে হাল্কা হব, যাই হোক আপনি একজন লেখক। মানুষের মনের কারবারী আপনি। কারো মনে যদি তেমন দুঃখ হয়, বা আনন্দ হয় তখন আপনার মত কেউ হাতের কাছে থাকলে তার কাছেই ত ছুটে আসা উচিত। তাই না?

শুনেছি, আপনি কোলকাতায় বড় বড় মামলা-টামলা করেন, আপনার নাকি হাঁকডাক আছে–কিন্তু আমি সেজন্যে আসিনি। আপনার চেয়ে বড় বড় উকিল-ব্যারিস্টার অনেক এখানে এসেছে গেছে, তাঁদের দেখেছি; ভুলে গেছি।

কিন্তু যে লেখে, সে আমার কথা, নয়নতারার কথা, আমাদের মত লক্ষ লক্ষ অজানা অচেনা লোকের কথা যারা লেখে, সেইসব অসংখ্য হতভাগা লোক যা বলতে পারে না কিন্তু বুঝতে পারে, তারা যা বুঝতে পারে কিন্তু বলতে পারে না, সে সব কথা যাঁরা অক্লেশে বলে ফেলেন তাঁদের কথাই আলাদা। তাঁরা সেই অসংখ্য লোকের মস্ত আপনার লোক, সবচেয়ে কাছের লোক।

আজকের দিনটা আমার জীবনের এক দারুণ দিন দাদা। আপনার আশীর্বাদ নিতে এসেছি।

কি? আমি সুখী হবো না? আজ থেকে বহু দিন বহু যুগ আমি আর নয়নতারা খুশি থাকব না? দুজনে দুজনকে পেয়ে ভীষণ মজা করব না? বলুন? আপনি চুপ করে আছেন যে?

আমি কোন কথা বললাম না। একটু পরে বললাম, আর এক কাপ চা খাবে?

শৈলেন উত্তরে কিছু না বলে, হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠল, বলল, বেলা হয়ে গেল। কটা বাজে?

হাতঘড়ি দেখে বললাম, দশটা বেজে গেছে।

তাহলে এবার পালাই। কি বলেন? চিঠিটা লিখেই পোস্ট করে দেব।

 বললাম, এ ডাক ধরতে পারার সময় পাবে?

শৈলেন যেন কী এক দারুণ নেশা করেছিল। তার দুটি কালো চোখ সকালের রোদে ঝিকমিক করছিল-সমস্ত মুখ উৎসাহে আনন্দে ঝলমল করছিল।

ও বলল, সময় পাবো না?

কি বলেন দাদা? সময়কে এবার পকেটে পুরে রাখব, সময়ই আর পাবে না আমাকে, কোনোদিন পাবে না, দেখবেন।

বলেই বলল, চললাম। বিয়ের তারিখ ঠিক হলে নেমন্তন্ন করে যাব।

শেষ কথাকটি বলেই, শৈলেন জঙ্গলের পাকদণ্ডী দিয়ে বাড়ির পিছনের গেট খুলে ওরাঁও বস্তীর দিকে উধাও হয়ে গেল।

আমি চেয়ারে বসে বসে বেশ অনুমান করতে পারছিলাম শৈলেন মিলনোদ্যত কোনো শিঙ্গাল হরিণের মত দৌড়চ্ছে মাঠ পেরিয়ে–মহুয়াতলা দিয়ে-ঝাঁটি-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে।

হু-হু করে সকালের ঠাণ্ডা রোদ-লাগা হাওয়া লাগছে ওর মুখে-নাকে-বুকেও এক দারুণ জীবনীশক্তিতে নতুন করে সঞ্জীবিত হচ্ছে, পুরিত হচ্ছে প্রতিমুহূর্ত যে-শক্তি আমাদের সকলকে বাঁচিয়ে রাখে, সকলকে মহৎ করে, উদার করে; যে শক্তির জন্যে শৈলেনের, নয়নতারার, আমাদের সকলের, প্রত্যেকের বেঁচে থাকাই সার্থক—যার আরেক নাম, গোপন নাম; প্রেম।

.

১২.

সেদিন মান্দারে গেছিলাম। ডাক্তার-সাহেব পিঠে চড় মেরে বলেছিলেন, ওয়েল মিস্টার বাসু, ইউ নীডন্ট কাম টু মি এনি মোর। ইউ আর আ ফ্রি ম্যান নাউ। ইউ মে লিড ইউর নর্মাল লাইফ। উইশ য়ু অল দা বেস্ট।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যখন দাঁড়ালাম তখন বেলা দশটা বেজেছে। শীতের রোদ পীচের রাস্তায় পিছলে যাচ্ছে। সামনেই একটা গির্জা। দোকান বাজার।

ঘন ঘন বাস আসছে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে মালবোঝাই ট্রাক পিচের উপরে প্যাঁচ প্যাঁচ আওয়াজ তুলে। শুকনো পাতা উড়ছে হাওয়ায়, ঘূর্ণী উঠছে চায়ের দোকানের সামনে। শালপাতার ফেলে দেওয়া দোনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।

হাওয়ায় আমার চুল এলোমেলো হচ্ছিল। পায়জামা পাঞ্জাবি পরে গায়ে শাল-জড়ানো আমি, এই সুকুমার বোস, স্থাণুর মত দাঁড়িয়েছিলাম মিশন-হসপিটালের গেটের বাইরে।

ভাবতেও দারুণ লাগছিল যে আমি আজ স্বাধীন। মনে হচ্ছিল যে আমি যেন কোনো জেলখানার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।

পিছনে ফেলে-আসা টি বি হসপিটালের দুঃখময় স্মৃতি, এবং পরবর্তী সময়ের পদে পদের বাধায়-বাঁধা প্রতিদিনের অসুস্থতার বাসি স্মৃতি-ভরা জীবন, সবই যেন অনেক দূরে ফেলে এসেছি।

আমি যেন হঠাৎ-ছুটি-হওয়া কোনো যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামী। ছাড়া পেয়েই গরাদের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি।

আমার এই হঠাৎ-পাওয়া স্বাধীনতা নিয়ে আমি কি করব বুঝে উঠতে পারলাম না। স্বাধীনতা ও মুক্তির দায় বড় বিষম বলে মনে হল। এ নিয়ে আমি এক্ষুনি কি করব, বা কি আমার করা উচিত, তাও আমি ভেবে পেলাম না।

আস্তে আস্তে অন্যমনস্কভাবে সামনের চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়ালাম।

চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পাকৌড়া ও চা খেলাম। তারপরে বেশ করে খুশবুভরা জদা দিয়ে দুটো মঘাই-পান খেলাম। তারপর অনেকদিন পর একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে লাগলাম এক্ষুনি আমার কি করা উচিত।

ম্যাকলাস্কিগঞ্জে যেতে হলে এক্ষুনি একটা ট্যাকসি ধরে চলে যেতে পারি, কিন্তু আমার পা দুটো কিছুতেই সেদিকে যেতে চাইল না। আমার পার্সের ভিতরে একটা ঠিকানা লেখা ছোট্ট কাগজ ছিল, সেই কাগজটা বের করে ছুটির রাঁচীর ঠিকানাটা একবার দেখলাম। তারপর রতনলালের ডালটনগঞ্জীয়া বাস এসে দাঁড়াতেই কি এক অদৃশ্য ও অনামা টানে সেই বাসে উঠে পড়লাম।

রাতুর রাজার লালরঙা প্রাসাদের ধারঘেঁষা আমবাগানের পাশ দিয়ে বাস চলছিল।

ডানদিকে সেই বড় জলাটা। একদল হাঁস দূরে ওড়াউড়ি করছে। সকালের রোদ ওদের সাদা ডানায় পিছলে পড়ে চমকে উঠছে।

বাস চলেছে। একটানা গোঁ গোঁ শব্দ করে। সেটা চলেছে রাঁচীর দিকে, ছুটির দিকে।

রাচীর রাতু বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে একটা সাইকেল রিক্সা নিলাম। রিক্সাওয়ালা অনেকগুলো মোড় নিয়ে কেঁচোর-কোঁচোর করতে করতে এসে অনেকক্ষণ পর যেখানে থামল, সে জায়গাটা বেশ নির্জন।

একটা প্রকাণ্ড হাতাওয়ালা পুরোনো দিনের বিরাট বাড়ি। একতলা এবং দোতলার কিছুটা জুড়ে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের কোনো অফিস আছে। রিক্সাওয়ালা দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে, আমাকে বাড়িটার পিছনের দিকে নিয়ে গেল।

ভাড়া মিটিয়ে চওড়া ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে, দোতলার বারান্দায় প্রায় শেষ প্রান্তে একটি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

দারোয়ান বলল, এহি হ্যায় দিদিমণিকা ঘর, বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল।

বারান্দায় একটা শাড়ি মেলা ছিল। শাড়িটা আমার চেনা।

ঘরের দরজার কড়া নাড়তেই একটি স্থানীয় বৃদ্ধা এসে দরজা খুলল। হিন্দীতে বলল, দিদিমণি বাড়ি নেই। দুপুরে আসবে।

আমি বললাম, আমি দিদিমণির আত্মীয়। আমি দিদিমণির জন্যে অপেক্ষা করব। আমাকে বসতে দাও।

বুড়ির চোখে মুখে কোনো নরম ভাব দেখা গেল না। বেশ শক্ত গলায় বলল, হুকুম নেই হ্যায়। বলল, আপনি যেই হোন না কেন, নীচে গিয়ে অপেক্ষা করুন।

ভাবটা এমন যে, দিদিমণি এসে সরেজমিনে তদন্ত করে আপনাকে বেকসুর বলে সার্টিফিকেট দিলে তখন দিদিমণি নিজেই উপরে নিয়ে আসবেন আপনাকে। তার আগে বুড়ির পক্ষে আর কিছু করণীয় নেই।

আমি বললাম, একটু জল খেতে পারি?

ও বলল, একটু কেন, একঘড়া জল খাওয়াব, কিন্তু এখন নয়, দিদিমণি এলে। তারপরেই বলল, এখন মানে মানে নীচে যান, নইলে লছমন সিংকে ডাকব।

আমার চেহারা কখনও সুন্দর যাকে বলে তা ছিল না। তবে নিজের চেহারা সম্বন্ধে একটা দুর্বলতা কুৎসিত লোকেরও থাকে। আমারও ছিল। আমার ধারণা ছিল, আমার চেহারাটা আর যাই হোক অভদ্র বা চোর-ডাকাতের মত নয়। কিন্তু এই অচেনা বুড়ি আমার সঙ্গে যে ব্যবহারটা করল তাতে মনে মনে বিলক্ষণ দুঃখিত হলাম।

বুড়ি না হয়ে ছুঁড়ি হলেও না হয় তার অপমান হজম করা যেত কিন্তু এ অপমান বড় লাগল।

তবু ভেবে দেখলাম সীন ক্রিয়েট করে জোর করে ঘরে ঢোকার চেয়ে নীচে গিয়ে লছমন সিং-এর ছারপোকাওয়ালা খাটিয়াতে অবস্থান করা অপেক্ষাকৃত সম্মানের।

সিঁড়ি দিয়ে যখন নেমে আসছি, মাঝ-সিঁড়িতে এসে জানালার কাচে হঠাৎ আমার মুখটা দেখতে পেলাম। আমি নিজেই চমকে উঠলাম দেখে। রুক্ষ, উস্কখুস্ক চুল, বড় বড় দাড়ি (সেই কাল ভোরে দাড়ি কামিয়েছিলাম) পান-খাওয়া লাল ফাটা-ফাটা ঠোঁট এবং ঘোলাটে চোখ।

আসলে আমি ত কেউই হই না ছুটির। ওর মনের উদারতায়, সংস্কারহীনতায়, এই সমাজের বিরুদ্ধে ওরা বিদ্রূপময় বিদ্রোহে ভর করে ও আমাকে যে আত্মীয়তা দিয়েছে তার ত এদের চোখে কোনো স্বীকৃতি নেই।

এ সম্পর্ক ত শুধু ওর এবং আমার। এ সম্পর্কের যতটুকু দাম, যতটুকু নৈকট্য সে ত শুধু আমার এবং ছুটির কাছেই। বাইরের কেউই ত এ সম্পর্ক বুঝতে পারবে না। আমরা দুজনেই শুধু এ সম্পর্কে স্বীকার করেছি, শ্রদ্ধা করেছি, সমস্ত সামাজিক ঝড়ঝাপটা, ন্যাপাম-বোমা থেকে আড়াল করে রেখেছি। এ সম্পর্কের ত নাম নেই, একে ত ছাঁচে ফেলে কোনো বিশেষ আভিধানিক নামে ডাকা যায় না। এ যে এক দারুণ সম্পর্ক।

শুধু ছুটি জানে, আর আমি জানি। ছুটি আমার কে হয়।

বাড়ির ঝির এই সাধারণ স্থূল প্রশ্নের উত্তরে ত আমি কিছু বলতে পারব না। বললে বলতে পারতাম এক কথায়, ও আমার কে হয় না?

বৃদ্ধ দারোয়ান, যে আমাকে উপরে পৌঁছে দিয়ে এল, সে শুধোল, কি হল?

আমি বললাম, দিদিমণি নেই।

 ও চটে উঠে বলল, নেই ত কি? ঐ বদমায়েশ বুড়িটা আপনাকে বসতে পর্যন্ত বলল না!

আমি অবাক হয়ে দারোয়ানের মুখের দিকে তাকালাম।

কিছু বলার আগেই দারোয়ান একটা গালাগালি দিয়ে বলল, ও ওরকমই– সাধে কি আর ওকে আমি দেখতে পারি না। বলেই বলল, আপনি ঐখানেই বসুন। ঐ গাছতলায় চৌপাই পাতা আছে, ওতে গিয়ে বসুন। দিদিমণি দেড়টা-দুটোর সময় এসে যাবেন।

আমি বললাম, একটু জল খাওয়াতে পারবে দারোয়ানজী?

সে বলল, নিশ্চয়ই খাওয়াব। পিয়াসীকে জল খাওয়ানো, এ ত পুণ্যের কাজ। বলেই তার ঘর থেকে হাতে করে একটু আঁখি গুড় আর ঝকঝকে লোটায় করে একলোটা জল নিয়ে এল। আদর করে বলল, পীজীয়ে।

আশ মিটিয়ে জল খেলাম।

 দারোয়ানের ইচ্ছা ছিল আমার সঙ্গে একটু গল্পগুজব করে। বেচারার একা বসে বসে আর খৈনী টিপে টিপে বুঝি সময় কাটে না।

কিন্তু আমার তখন গল্প করার ইচ্ছা ছিলো না। শুধু ওর সঙ্গে কেন? কারো সঙ্গেই না। ওকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি গিয়ে চৌপাইতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম হাতের উপর মাথা দিয়ে।

যে-গাছের নীচে চৌপাইটা পাতা ছিল সেটা একটা খুব প্রাচীন নিমগাছ। রোদে ফিনফিনে পাতাগুলো ঝিলমিল করছে। একটু একটু হাওয়া আছে। মাঝে মাঝে একটা দুটো শুকনো পাতা হাওয়াতে ঘুরে ঘুরে কাঁপতে কাঁপতে নীচে নেমে আসছে।

অনেক পাখি এসে বসেছে গাছটাতে, অনেকে বাসা করে আছে। এরকম গাছতলা বড় শান্তির জায়গা।

ঐ গাছটার নীচে এই রৌদ্রালোকিত সচকিত কাকলিমুখর সকালে শুয়ে শুয়ে আমার মনে হল, আমি যেন ছুটিরই কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। যত ঝড়, যত ঝাপটা, যত কিছু অন্যায় অত্যাচার, যা কিছু ব্যক্ত বা অব্যক্ত ব্যথা সব পেরিয়ে এসে আমি এই দারুণ স্নিগ্ধ শান্তির ঘরে পৌঁছেছি।

ভগবান সাক্ষী করে বলতে পারি ওর কাছে কখনও আমি কোনো কিছু প্রত্যাশা করে আসিনি। ভিখিরীর মত কোনো কিছু চাইনি ওর কাছে। ও-ও আমার কাছে কিছুমাত্র চায়নি। কিন্তু সব কিছু দিতে চেয়েছে; যা ওর আছে, যা ও দিতে পারে। হয়ত আমরা দুজনে কেউই কারো কাছে কিছুমাত্র প্রত্যাশা করিনি বলেই সম্পর্কটা এমন সহজ হয়েছে। ছুটিকে দেখতে পাই আর না পাই, সব সময় ছুটি আমার সমস্ত মন জুড়ে থাকে। যখন ওকে এক বছর দেখিনি তখনও ও আমার সমস্ত মন জুড়ে ছিল।

প্রথম প্রথম মনে হত, আমি বোধহয় রমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছি। ছুটিও বলত, আমার মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে, মনে হয় আমার জন্যেই আপনার বিবাহিত জীবন এমন অশান্তির হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু আমি জানি, হয়ত ছুটিও জানে, আমরা দুজনেই সৎ ও হৃদয়বান বোকা বলেই এ কথা আমাদের মনে হয়েছে।

রমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাক এ আমি কখনও চাইনি। কিন্তু এ বাবদে আমার কিছু করার আছে বলে আমার আর মনে হয় না। মনে হয়, যা কিছু করার ছিল, শেষ হয়ে গেছে।

কিন্তু রমা আজ বহু বছর ধরে আমার সঙ্গে, আমার বন্ধুবান্ধব, আমার আত্মীয়স্বজন, আমার চেনা-পরিচিত সকলের সঙ্গে যা ব্যবহার করেছে এবং করে আসছে, তাতে মনে মনে তার থেকে সরে না এসে আমার কোনো উপায় ছিলো না।

কতদিন, কতদিন যে পিস্তলের নল মাথার কাছে ঠেকিয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে গেছি, কত যে দিন, সে আমিই জানি। পারিনি, কারণ আমি নিজেকে ভালোবাসি বলে নয়, পারিনি রুণের কথা ভেবে। আমার ছেলে, নিরপরাধ, সরল, অপাপবিদ্ধ ছেলে ত কোনো অপরাধ করেনি।

আমি না থাকলে ওকে ওর স্বাভাবিক ও সুস্থ অধিকার থেকে ঘৃণিতভাবে বঞ্চিত করা হবে। ওর প্রতি যা আমার করণীয় (শুধু টাকা-পয়সায় নয়) সবই আমার করা উচিত। এই কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। যত যন্ত্রণাই পেয়ে থাকি, যত কষ্টই পেয়ে থাকি, ভেবে দেখেছি, যতদিন না রুণের প্রতি আমার সব কর্তব্য শেষ হচ্ছে ততদিন এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার অনুচিত।

আমার জীবনটা যে আমারই, শুধু আমারই একার, রমার নয়, রুণের নয়, এমনকি ছুটিরও নয়–একমাত্র আমার–এই ভাবনাটা ছুটিই আমার মধ্যে সঞ্চারিত করেছে।

ছুটি আমাকে শিখিয়েছে জীবনের মানে কি? ছুটিই বলেছে, বার বার, কেউই অন্য কারো জন্যে, অন্য কারো কারণে বাঁচে না; অন্তত কারোরই সেরকমভাবে বাঁচা উচিত নয়। এও বলেছে সে যে, কেউই অন্য কারো দয়ায় নির্ভর করে বাঁচতে পারে না। বেঁচে থাকার এবং সুস্থ স্বাভাবিক ও সুখী মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের সকলের জন্মগত নয়, সে অধিকার আমাদের প্রত্যেককে তৈরি করে নিয়ে বাঁচতে হবে।

ও সব সময় বলে যে, জীবন একটা চলমান চাঞ্চল্যকর অভিজ্ঞতা, এতে স্থাবর বা স্থবিরের কোনো স্থান নেই।

বলে, আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই সত্যি। এই মুহূর্তটিই–যে মুহূর্তে আমি বা ছুটি বা অন্য কেউই বেঁচে আছি। আর সব মিথ্যা। বর্তমানের জন্যে অতীত অথবা ভবিষ্যৎ দুইকেই হাসিমুখে বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে।

ভাবলে অবাক লাগে যে, ছুটি এই অল্পবয়সে এত সব অরিজিনাল ভাবনা পেল কোত্থেকে? কি করে ও ওর সমসাময়িক অনেকের থেকে এমন দারুণভাবে আলাদা হয়ে অন্য একটা আনন্দময় জগত আবিষ্কার করে ফেলল? আর ফেললই যদি, ত আমার কোন্ সৌভাগ্যে ও আমার কাছে এল, আমি যখন কাঁটার মধ্যে, পাঁকের মধ্যে বসে, সামাজিক গালার শীলমোহরটা চিরদিনের মত গলায় ঝুলিয়ে সামাজিক সম্পর্কের ভীষণ ভারী পাথরটার চাপে অসহায়ভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছি, ঠিক সেই সময়ে ও কি করে এসে আমাকে মুক্ত করল!

ও কিসের টানে, আমার মধ্যে কি আবিষ্কার করে, কেন আমাকে হাতছানি দিয়ে আমার মূঢ়তা এবং স্বেচ্ছারোপিত অবশ মনের ভার থেকে স্বাধীন করল? ও কিসের জন্যে আমাকে পুলকভরে এই নতুন রোমাঞ্চময় সবুজ জীবনের উপত্যকায় ডাক দিয়ে বলল, আপনাকে বাঁচতে হবে। বলল, আর কারুর জন্যে নয়, নিতান্ত স্বার্থপরের মতই, আপনাকে আপনার নিজের জন্যেই বাঁচতে হবে।

একদিন ছুটি একটা দারুণ কথা বলেছিল। ওকে নিয়ে এক রবিবার একটা বড় হোটেলে খেতে গেছিলাম। ডাইনিং রুমের সাদা ফিনফিনে পদা ভেদ করে বাইরের আলো ঘরময় ছড়িয়ে গেছিল। বাইরে সবুজ লনের পাশে নীল সুইমিং পুলটা দেখা যাচ্ছিল।

ছুটি আমার সামনে মুখ নীচু করে বসেছিল।

 আমি বলেছিলাম, ওয়েল, আই থিঙ্ক ইউ হ্যাভ চোজেন আ রং পার্সন।

ছুটি মুখ তুলে বলেছিল, হ্যাভ আই? তারপর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে হেসে বলেছিল, আই ডোন্ট থিঙ্ক সসা।

আমি শুধিয়েছিলাম, তুমি কি বলতে চাও?

ছুটি কাঁটাচামচ নাড়তে নাড়তে বলেছিল, বলতে চাই না কোনোকিছুই, কিন্তু আমি আপনার ব্যাপারে কোনো ভুল করিনি। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়, ভাল-মন্দ বিচার করে, নিন্দা-অপবাদ সব কিছুর কথা ভেবেই আপনাকে ভালোবেসেছি। যে-সব মেয়ে সখের ভালোবাসা বাসে, আমি তাদের দলে নই। আমার ভালোবাসা উপায়হীন, কম্পালসিভ।

তারপর হঠাৎ মুখ নামিয়ে বলেছিল, একজন নামকরা ব্যারিস্টারের সঙ্গে তর্কে জিতব কিনা জানি না, তবে আমার মনে হয় আপনি আমাদের দুজনকেই ঠকাচ্ছেন। আপনি অতীতে বাস করছেন। একদিন যে ভালোবেসেছিলেন, একদিন যে বিয়ে করেছিলেন, সেই অতীতের স্মৃতিটা আমাদের বর্তমানের সমস্ত আনন্দটুকুকে, জীবনের সমস্ত স্বাদটুকুকে ঘোলা করে দিচ্ছে। এটা কি ঠিক?

একটু পরে ছুটি আবার বলেছিল, একটা কথা বলব সুকুদা?

মুখ তুলে বলেছিলাম, কি? বল?

কথাটা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে নিরানব্বই ভাগ লোকই অতীতের স্মৃতি অথবা ভবিষ্যতের সুখ-কল্পনা নিয়ে বাঁচি, মানে বাঁচতে চাই। আর এই বাসি ঠাণ্ডা অতীত ও জরায়ুর মধ্যের ঈষোদুষ্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে পড়ে, তাদের প্রত্যেকের বর্তমানটাই মারা যায়। কথাটা হালকা শোনাচ্ছে বুঝি? কিন্তু কথাটা হালকা নয়।

বর্তমানে মানে, জাস্ট একটা মুহূর্ত নয়। শুধু এই মুহূর্তই নয়। বর্তমানের বিস্তৃতি অনেক। বর্তমান মানে সমস্ত জীবন, আপনার আমার, সকলের প্রতিমুহূর্তের অস্তিত্ব। আমরা যদি প্রতিটি মুহূর্তই নিজেদের ফাঁকি দিই, একে অন্যকে ফাঁকিতে ফেলি, তাহলে সে জীবনের কি বাকি থাকে বলুন?

জানি না, কতক্ষণ এমন এলোমেলো ভাবনা ভেবে চলেছিলাম, হঠাৎ হুঁশ হল। লছমন সিং-এর গলার স্বরে। হয়ত রোদে শুয়ে থাকতে থাকতে এক সময় চোখ বুজে এসেছিল।

যখন চোখ খুললাম, দেখি ছুটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

একটা হাল্কা ছাই-রঙা সিল্কের শাড়ি পরেছে, গায়ে সাদা কার্ডিগান। ডান হাতের হাতাটা একটু গুটিয়ে তোলা কালো ডায়ালের একটা ঘড়ি। বাঁ হাতে একটি কাঁকন।

ছুটি ফুলে ফুলে হাসছিল। আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসতেই হাসি থামিয়ে বলল, কি হেনস্থা–সরি, সরি– ভেরী সরি।

আমি বললাম, এর চেয়ে তরোয়াল হাতে একজন খোজা প্রহরী রাখলেই ত পার। তোমার উদ্দেশ্য যদি এই-ই হয় যে, কোনো পুরুষ তোমার অন্দরমহলে পা দিতে পারবে না, তবে সেটাই আরো ভালো হত।

ছুটি আমাকে হাত ধরে টেনে তুলল।

বলল, চলুন চলুন, উপরে চলুন।

জানেন, আজ সকালে কাজে যাওয়ার সময় চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে চিরুনিটা হঠাৎ হাত ফসকে পড়ে গেল মাটিতে। তখনই জানি, আপনি আসছেন।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললাম, আমিই আসব কি করে জানলে? তোমার কাছে অন্য কেউ ত আসতে পারত।

উপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে ছুটি চাইল আমার দিকে, বলল, আমার জীবনে এখন শুধু একজনই আছে, সে আমার পরম পুরুষ। ভবিষ্যতের কথা জানি না। আপনি ত জানেনই, বর্তমান ছাড়া আমি আর কিছুই জানি না।

সেই বৃদ্ধা দরজা খুলে, ছুটি আমাকে ওরকম সসম্মানে নিয়ে আসছে দেখে বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ হলো না। বুঝলাম তার কাজ কেল্লা রক্ষা করা–সে করেছে।

আমি ঘরে ঢুকতেই সে বলল, পানি পীজিয়েগা?

 আমি হেসে ফেললাম, বললাম, নেহি।

 ছুটি বলল, হাসছেন কেন?

বললাম, তোমার প্রহরীকে জিগগেস কর।

ওর কাছ থেকে জল চাওয়া এবং প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কথা শুনে ছুটি আরেক চোট হাসলো।

বলল, জানেন ত, এ বাড়ির প্রায় সবটাই অফিস–কতরকম বাইরের লোক আসে যায়-তাই ও এরকম করে–ভালোই করে। আমি একা থাকি আর আমার পাশে একটি বিহারী পরিবার থাকে। ভদ্রলোকের একটা ছোটোখাটো ব্যবসা আছে ডুরান্ডাতে।

বাইরের ঘরটাতে বই ঠাসা। দুটি চেয়ার, একটা ছোট টেবল, টেবল ক্লথ পাতা হালকা সবুজ রঙের। দেওয়ালে ছুটির মায়ের এবং জীবনানন্দ দাশের ফটো।

বললাম, এ ফটো তুমি কোথায় পেলে?

ও চোখ নাচিয়ে বলল, পেয়েছি।

জীবনানন্দ দাশের ভক্ত অনেকেই দেখেছি, প্রায় সকলেই ওঁর ভক্ত, কিন্তু তোমার কাছেই ছবি দেখলাম।

ছুটি বলল, কেন, রবীন্দ্রনাথের ছবি ছাড়া অন্য কারো ছবি কি টাঙানো যায় না?

রবীন্দ্রনাথের উপর এত রাগ কেন?

রাগ ত নয়। শ্রদ্ধা করি। আমার ঠাকুমাকে যেমন করতাম। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা ভালোবাসার নয়। দুঃখের কথা এই যে, বাঙালিদের কালচারটা রবীন্দ্রনাথে এসেই থেমে গেছে। তারপর যা তারা করেছে, বলেছে, লিখেছে, সমস্তটুকু সম্বন্ধেই একটা কিছুই-নয় কিছুই-নয় ভাব।

আমি বলছি না যে এখন বাংলায় দারুণ কিছু লেখা হচ্ছে, কিন্তু অ্যাট লিস্ট যা লেখা হচ্ছে তার সঙ্গে আজকের জীবনের যোগ আছে।

আমি আজকের কথা জানি। আজকের ভালোবাসাকে দাম দিই। আপনি হয়ত এ কথা বললে দুঃখ পাবেন, কিন্তু দেখি রবীন্দ্রনাথের ফটো প্রতি বাড়িতে সানমাইকা-বসানো খাওয়ার টেবলের মত আজকাল একটা ফ্যাশানেবল আসবাব হয়ে গেছে।

আপনি কি মনে করেন যাঁরাই গুরুদেবের ছবি টাঙিয়ে রাখেন, যাঁরাই দরজায় শান্তিনিকেতনী পর্দা ঝোলান তাঁরাই সংস্কৃত? তাঁরাই একমাত্র লোক যাঁরা কালচার গুলে খেয়েছেন?

তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে পারব না।

 ছুটি হাসল, বলল, চেষ্টাও করবেন না। তারপরেই বলল, চা খাবেন?

আমি বললাম, না। এত বেলায় চা খাব না।

ছুটি তার প্রহরীকে ছুটি দিয়ে দিল। বলল, বিকেলে এসো।

বৃদ্ধা চলে গেলে ছুটি বলল, আমি এখন রক্ষীহীনা। অরক্ষিতা। আমি এখন আপনার। এখন আপনাকে বাধা দেওয়ার কেউই নেই।

আমি হাসলাম। বললাম, চান করোনি?

না। আমি ত জানি না আপনি আসবেন? হাত থেকে চিরুনি পড়ল বলেই ত আর আমি গণক নই যে ঐ সাতসকালে ঠাণ্ডায় চান করে ফেলবো। তা এক্ষুনি চান করে নেব, পাঁচ মিনিট লাগবে।…

তারপর বলল, আপনি চান করবেন না?

আমার এত বেলায় ঠাণ্ডা জলে চান করা ঠিক হবে না।

ঠাণ্ডা জল কেন, এক্ষুনি গরম জল করে দিচ্ছি।

না। কিছু করতে হবে না। তুমি আমার সামনে একটু চুপ করে বসো তো।

 এই বসলাম।

 বলে ছুটি এসে আমার সামনের চেয়ারে বসলো।

ওর কপালে ছোট ছোট চুল লেপ্টে ছিল–দুকানে দুটো কালো পাথরের দুল পরেছিল। ভারী সুন্দর দুল দুটি। চোখে হালকা করে কাজল লাগিয়েছিল। বড় করে কালো মাদ্রাজী সিঁদুরের টিপ পরেছিল।

আমি অপলকে ওর দিকে চেয়ে রইলাম।

কী যে ভালো লাগে, কী যে ভালো লাগে কী বলব। ওর কাছে এলে, ওর সঙ্গে দেখা হলে, ওর মুখোমুখী বসলে ভালো লাগায় যেন আমি মরে যাই।

ছুটিও অনেকক্ষণ আমার মুখে তাকিয়ে থাকল।

বলল, ভাবতেই পারছি না যে আপনি সত্যি সত্যি এসেছেন, আমার ঘরে বসে আছেন। কিন্তু একটু জানিয়ে আসবেন ত? কিছুই রান্না করিনি আজ, কি খাওয়াই বলুন ত আপনাকে?

আমি কোনো জবাব দিলাম না।

ছুটি বলল, চুপ করে আছেন যে?

ভাবছি, জীবনানন্দ দাশের পরে কার ছবি টানাবে দেওয়ালে তুমি।

বাবাঃ আপনি এখনও ভাবছেন এ নিয়ে? রবীন্দ্রনাথের ছবি না টানিয়ে কি এমনই অন্যায় করেছি?

আমি হাসলাম, বললাম, না, তা নয়, তবে ভাবছি।

ছুটি বলল, এক্ষুনি যদি জানতে চান ত বলতে পারি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি, তার পরে তুষার রায়ের ছবি। আমি সমালোচক নই, পণ্ডিত নই, আমার পছন্দ-অপছন্দ নেহাৎ একজন সিনসিয়র পাঠিকা হিসাবে। অতি সাধারণ পাঠিকা হিসাবে।

আপনি হয়ত বলতে পারেন, কাব্য-বিচারে এঁদের চেয়ে বড় কবি অনেকে আছেন, কিন্তু আমি ওঁদের লেখা ভালোবাসি কেন জানেন? ভালোবাসি এই জন্যে যে, ওঁরা ভণ্ড নন। দে আর অলওয়েজ ট্রু টু দেওয়ার ফিলিংস।

আমাদের পিতা-পিতামহদের জেনারেশানের পিছল ব্যাঙের গায়ের মত ঠাণ্ডা ভণ্ডামির পর এঁরা একটা উষ্ণ জৈবিক প্রাণবন্ত অভিজ্ঞতা। ওঁদের কাউকেই আমি চিনি না, ভবিষ্যতে ওঁরা আমার একসপেকটেশান ফুলফিল করবেন কি না তাও জানি না, কিন্তু বর্তমানে তাঁরা করেছেন। ওঁদের লেখা পড়লে মনে হয় আমাদের জেনারেশানেরই কেউ লিখছেন। যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন, তাই নিখাদ অনুভূতিতে ব্যক্ত করেছেন। আমার নিজের মতে, দিস ইজ আ গ্রেট থিং।

তারপর কেটু থেমে বলল, আপনার হিংসে হচ্ছে?

 আমি হেসে বললাম, হিংসে হবে কেন? কোথায় অখ্যাত আমি, আর কোথায় ওঁরা।

তবে তোমার কথা শুনে আশ্চর্য লাগছে আমার, কারণ আমারও ওঁদের দুজনের লেখা খুব ভালো লাগে এবং তুমি যে কারণ বলছ, সে কারণেই।

ছুটি বলল, আমি জানি না, তবে আমার মনে হয় লেখা-টেখা সম্বন্ধে অস্কার ওয়াইল্ড পিকচার অফ ডরিয়ন গ্রের ভূমিকায় যা বলেছিলেন, তা আজও সত্য। আপনি বলবেন হয়ত, অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী; কিন্তু আপনি জিজ্ঞেস করলেন, তাই আমার অল্প বিদ্যায় যা বুঝি, যা ভালো লাগে, তা-ই বললাম। আমার মতামত ত ছাপা হয়ে কোথাও আর বেরুচ্ছে না।

তারপর ছুটি বলল, চলুন ভিতরের ঘরে যাই। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করুন। আমি চট করে চান করে নিচ্ছি।

ভিতরের ঘরটা ছুটির শোবার ঘর। একটা ছোট্ট সোফা সেট। পরিষ্কার বেডকভার পাতা আছে টান টান করে। এ ঘরেও অনেক বই। এক কোণায় একটা আলনা।

ছুটি বলল, যান। তোয়ালে আছে, সাবান আছে, হাত-মুখ ধুয়ে আসুন। বেচারী। আমার জন্যে কত কষ্ট-দারোয়ানের চৌপাইতে ছারপোকা ছিলো না? ছিল। না?

আমি হাসলাম, বললাম, থাকলেও কামড়ায়নি।

বাথরুম থেকে বেরিয়েই দেখি ছুটি বাইরের শাড়ি ছেড়ে ফেলে একটা হলুদ আর লাল শান্তিপুরে ডুরে শাড়ি পরে ফেলেছে। জেঠিমা-পিসীমারা যেমন করে শাড়ি পরতেন, তেমন করে। কি মিষ্টি যে দেখাচ্ছে ছুটিকে, কি বলব।

আমি অমন করে তাকিয়ে আছি দেখে ছুটি বলল, কি হল?

ও বলল, চান করব বলে শাড়ি ছাড়লাম।

আমি বললাম, এদিকে এসো ত।

 ছুটির দুচোখ ভালো-লাগায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মুখে বলল, না। আসব না।

ওর গলায় খুশি ঝরে পড়ল।

আমি এগিয়ে গিয়ে ছুটিকে বুকের মধ্যে নিলাম, ছুটির নরম ভিজে মিষ্টি ঠোঁটের সমস্ত স্বাদু স্বাদ ও উষ্ণতা আমার ঠোঁট দিয়ে শুষে নিলাম।

ভালো-লাগায় ছুটি আমার বুকের মধ্যে শিউরে উঠতে লাগল।

আমি বললাম, দেখি; আমার দারুণ পায়রা দুটি দেখি।

 ছুটি বলল, অসভ্য।

মুখে অসভ্য বলেই ওর কাজলমাখা চোখে এক অনামা অসভ্য আশ্লেষের নিমন্ত্রণ জানাল।

ওর জামার মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ওর রেশমী কোমল স্নিগ্ধ শান্তি-ভরা সুডৌল বুক আমার হাতের সমস্ত পাতা দিয়ে ধরলাম।

আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল ভালো-লাগায়।

 ছুটি মুখ নামিয়ে ফেলল লজ্জায়।

আমি ছুটির কবুতরের লালচে ঠোঁটে আমার কালো ঠোঁট ছোঁয়ালাম।

ছুটি থর থর করে কাঁপতে লাগল, ভালো-লাগায়, ভীষণ এক ভালো-লাগায়। এই শীতের নিস্তব্ধ ছায়া-পড়া মধ্যাহ্নে ছুটির ও আমার সমস্ত একাকীত্ব, সমস্ত শৈত্য শুষে নিয়ে আগুনের ফুলকির উষ্ণতার ফোয়ারার মত কী এক দারুণ অনুভূতি আমাদের মনের মধ্যে উৎসারিত হল।

ছুটি অস্ফুটে, বোঁজা-চোখে বলতে লাগল, অসভ্য! অসভ্য! অসভ্য!

 তারপর ছুটি হঠাৎ বলল, ঊঃ, আর না। এখন আর না।

আমি দেখলাম, উত্তেজনায় ছুটির হাঁটু কাঁপছে থর থর করে।

ছুটিকে নিয়ে এসে আমি ওর খাটে বসিয়ে দিয়ে ওর চোখের পাতায় চুমু খেলাম। ওকে বুকে নিয়ে বসে রইলাম।

তারপর বললাম, যাও চান করে এসো তাড়াতাড়ি আমার কিন্তু খিদে পেয়েছে।

ছুটি উঠল না।

আরও অনেকক্ষণ আমার বুকে মাথা এলিয়ে ও বসে রইল।

ছুটি যখন চান করছিল, আমি ছুটির ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলাম। বই দেখছিলাম, নাড়ছিলাম-চাড়ছিলাম।

ছুটির ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারের উপর একটা বই ছিল, কবিতার বই। কবিতা ঠিক নয়; ছড়ার বই। তুষার রায়ের লেখা-নাম, গাঁটছড়া।

বইটা হাতে তুলতেই, পেজ-মার্ক হিসেবে একটা ছোট চিঠি চোখে পড়ল।

যে লিখেছে, তার হাতের লেখাটা অশিক্ষিতের মত, অনেক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

হিনু, রাঁচী
ছুটি,

বিজুদা তোমাকে এই ইনভিটেশন পাঠাতে বলল।

কামিং রবিবারে আমরা সকলে গৌতমধারায় পিকনিকে যাচ্ছি! পিংকু ও মিলিও যাচ্ছে।

আমাদের সকলেরই সিনসিয়ার ইচ্ছা যে তুমিও চল। আমাদের কোম্পানি যদি বোরিং লাগে, তাহলে অবশ্যই এসো।

শনিবার বিকেলে তোমার ওখানে যাব। তখন ডিটেলস-এ কথা হবে!

 তোমাকে সেদিন বিকেলে দেখলাম, রিক্সা করে আমাদের অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলে। একটা পিঙ্ক শাড়ি পরেছিলে। তোমাকে খুব ড্যাশিং দেখাচ্ছিল। তুমি জানো না, তুমি ক্যাজুয়ালি কত-লোককে মার্ডার কর!

বাই–সি ইউ সুন। ইয়োরস রুদ্র।

কেন আমার ও রকম মনে হল জানি না, আমার মনে ভীষণ ভয় হল। ঘরের কোথাও সাপ দেখলে লোকে যেমন আঁতকে ওঠে, আমি তেমনি আঁতকে উঠলাম। সে সাপ দাঁড়াশ কি গোখরো তা আমার জানা নেই, কিন্তু এই চিঠির মধ্যে সাপের গায়ের গন্ধ পেলাম আমি। মনে হলো, সাপটা আমার সব-হারানোর দিনে হঠাৎ পাওয়া সুখের, বুকভরা উষ্ণতার একমাত্র পাখিটিকে গ্রাস করার জন্যে এই শীতের দিনে বিশ্রাম নিচ্ছে, যাতে শীত কাটলে, ফায়ুন হাওয়া বইতে শুরু করলেই সে এই পাখির দিকে হাঁ বাড়াতে পারে।

বাথরুমের ছিটকিনি খোলার আওয়াজ হতেই আমি চোরের মত বইটি নামিয়ে রাখলাম।

কেন আমার নিজেকে চোর-চোর লাগল জানি না। কিন্তু লাগল।

আমি ছুটিকে সহজে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, ছেলেটি কে? কি করে? পিঙ্ক ও মিলি কে?

কিন্তু আমার মনে হল, সে সব নিতান্তই ব্যক্তিগত প্রশ্ন হয়ে যাবে। আমার কোনো অধিকার নেই ছুটিকে তার বন্ধু-বান্ধবীদের প্রসঙ্গে কিছু শুধোবার।

ছুটি সহজ চোখ তুলে আমার দিকে চাইল।

ওর সমস্ত শরীর থেকে সাবানের গন্ধ বেরোচ্ছিল। চোখ দুটি আরো উজ্জ্বল লাগছে। সমস্ত মুখে একটা স্নিগ্ধ প্রশান্তি।

তাড়াতাড়ি চুল ঠিক করে ঠোঁটে গালে একটু ভেসলিন বুলিয়ে নিয়ে, আইব্রোপেনসিল দিয়ে ভুরুটা ঠিক করে নিয়ে বলল, চলুন, খাবেন চলুন।

খাবার ও রান্নাঘরের বন্দোবস্ত করে নেওয়া হয়েছে পাশের বারান্দায়।

খুব আলো আছে বারান্দাতে।

তাড়াতাড়ি খাবার গরম করে নিয়ে টেবলে রাখল ছুটি।

বলল, ছুটির হাতের রান্না ত আর কখনও খাননি। খেয়ে দেখুন। দেখছেন ত, কত গুন আমার।

ধনেপাতা-সর্ষে দিয়ে কই মাছের ঝোল রেঁধেছিল ছুটি, পালংশাকের তরকারি, হিং দিয়ে ছোলার ডাল এবং স্যালাড।

আচারের টিনটা বের করল। বলল, আপনার ওখান থেকে ফিরে এসেই শহর খুঁজে ঐ আচার কিনেছি।

আমি বললাম, ওকি? সব মাছই ত আমাকে দিয়ে দিলে। তুমি কি খাবে?

ও-ও-ও।

বলে চোখ বড় বড় করে ছুটি ধমক দিল আমাকে। বলল, যা বলছি লক্ষ্মী ছেলের মত শুনুন। খান ত আপনি। রোজ যেন আসছেন। আমার কত সৌভাগ্য আজকে।

আমি হেসে ফেললাম, বললাম, থাক, বানিয়ে বলতে হবে না।

ও অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে, বলল, কেন? এ কথা বলছেন কেন? আমার সৌভাগ্য নয় কি?

আমি বললাম, আমি হয়ত আসি না, আসিনি কখনও–তোমার কত বন্ধু-বান্ধব, দাদারা আছেন, তাঁরা ত রোজই আসেন। আমার অভাব বলে ত কিছু বোধ করোনি তুমি। কখনও করেছ কি? কিন্তু আমি করি, সব সময়েই করি, বিশ্বাস করো; সত্যিই করি।

নুনের পাত্রে ছোট চামচ দিয়ে হিজিবিজি কাটতে কাটতে ছুটি আমার দিকে তাকাল।

তারপর বলল, মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনি ভীষণ বোকা। কিন্ডারগার্টেন ক্লাসের ছাত্রের চেয়েও বোকা।

বলল, আমার কাছে অনেকে আসে, এখানে এসে অনেকের সঙ্গে আমার আলাপও হয়েছে, ছেলে-মেয়ে সকলের সঙ্গে। আপনাকে ত বলেছি, আমি বর্তমান বিশ্বাস করি। ভবিষ্যতে কখনো আপনাকে পাব কি পাব না এই ভেবে গোমড়া মুখে আমার বর্তমানটাকে আমি মাটি করতে চাইনি। আমি হেসেছি, আড্ডা মেরেছি, পিকনিক করেছি, তা বলে কি আপনি মনে করেন, আপনি মুছে গেছেন আমার জীবন থেকে?

তারপর একটু থেমে ছুটি বলল, সুকুদা, আপনি বড় ব্যারিস্টার হতে পারেন, লেখক হতে পারেন, কিন্তু মেয়েদের মন এখনও আপনার বোঝা হয়নি।

আমি বললাম, এ জন্মে হবে বলেও আশা নেই।

একটু পরে ছুটি বলল, আমার কাছে অনেকে আসে, আমি অনেককে চিনি, তবে আপনার এটুকু জানা উচিত সুকুদা, যে তারা আপনার মত কেউ নয়। তারা আসে, বসবার ঘরে বসে চা-সিগারেট খায়, চলে যায়। আপনিই একমাত্র লোক যিনি আমার শোবার ঘরে এলেন, আমার খাটে বসলেন।

তারপর একটু থেমে বলল, ঘরে ও খাটে বসা ছাড়াও আপনার অধিকার আরো অনেক বেশি তা আপনি জানেন। আপনি আর অন্যরা যে সমান নয় এ কথা আমার বলতে হচ্ছে দেখে খারাপ লাগছে আমার। আপনি যেন কি রকম, অদ্ভুত।

আমি খেতে খেতে ছুটির টেবিলে রাখা বাঁ হাতের উপর হাত রাখলাম। বললাম, খাও। তুমি খাচ্ছ না কেন?

হঠাৎ ছুটি খাওয়া থামিয়ে বলল, আচ্ছা সুকুদা, কোনদিন আমি যদি আপনার মত করেই অন্য কাউকে চাই, তাহলে আপনি কি রাগ করবেন?

আমি জবাব দিলাম না। বললাম, তোমার সব প্রশ্নের জবাব ত তুমিই দাও। এ প্রশ্নের জবাবটাও দাও।

ছুটি বলল, প্রশ্নটা বোধহয় ঠিক হলো না। এ কথা বলা ঠিক নয় যে, আপনার মত করে কাউকে ভালোবাসতে পারব আমি। আসলে প্রত্যেকটা সম্পর্কই বিভিন্ন, তাদের প্রকৃতি, তাদের ডাইমেনশান সব বিভিন্ন। তাই এক সম্পর্কের সঙ্গে অন্য সম্পর্কের তুলনা বোধ হয় কখনো করা উচিত নয়। তাই না?

ঠিক তাই। আমি বললাম।

ছুটি বলল, থাক এসব কথা। আপনি আজ থাকছেন ত?

আমি বললাম, না, আমায় খেয়ে উঠেই বাস ধরতে ছুটতে হবে। যদি থাকতাম, তবে তোমার কাছে আজ নিজেই কিছু চাইতাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, এই চার দেওয়ালের মধ্যের আনন্দ আমার ভালো লাগে না।

ছুটি মুখ তুলে চাইল।

বলল, ঠিক বলেছেন। আমার কিন্তু তাই মত ছিল ছোটবেলা থেকে। প্রত্যেক মেয়েরাই জীবনে মিলিত হয় কোনো না কোনো পুরুষের সঙ্গে সারাজীবনে কত শত বার মিলিত হয়। কিন্তু প্রথমবারের মিলনই একমাত্র মিলন যা চিরদিন মনে থাকে।

জানেন, সুকুদা, আমার ভাবলে হাসি পায়। প্রত্যেক বিবাহিত মেয়েই ফুলশয্যার দিনে, অনেক রজনীগন্ধার গন্ধের মধ্যে, নতুন বিছানার নতুন চাদরের ইরিটেটিং গন্ধের মধ্যে, ডাঁই-করা উপহারের মধ্যে জীবনে প্রথমবার মিলিত হয়।

যেমন, বয়স হলে বিয়ে করতে হয়, যেমন বিয়ে করলে লালচেলি পরতে হয়, অভ্যাগতদের রাধাবল্লভী, ফ্রায়াড রাইস ও ফিস ফ্রাই খাওয়াতে হয়, তেমন ঐ নতুন বিছানায় শুয়ে, আনকোরা কোনো বরের কাছে কুমারীত্বও খোয়াতে হয়।

সত্যি। ভাবা যায় না।

শীতকালে হলে শার্টিনের ওয়াড়-দেওয়া লেপ গায়ে দিয়ে শুতে হয়, দরজা জানালা খোঁচ-খাঁচ সব সন্তর্পণে বন্ধ করে। গরমকাল হলে, বাঁই-বাঁই করে পাখা ঘোরাতে হয়। বুঝলেন, আমার ভাবলেই খারাপ লাগে। বিচ্ছিরি ব্যাপার।

তারপরই বলল, আপনি যা বললেন, সত্যি? তা সত্যি ত?

বললাম, সত্যি। তুমি দেখো, সত্যি কি না। কোনো ঘরের মধ্যে নয়, সূর্যকে সাক্ষী রেখে, একদিন আমি আকাশ, বাতাস, ফুল, পাখি সবাইকে সাক্ষী রেখে তোমার সঙ্গে মিলিত হব। যেদিন হব, তুমি যতদিন বাঁচবে, যতদিন ভাবতে পারবে, ততদিন সেই মুহূর্ত, সেই দিনটির স্মৃতি, তোমার মনে তোমার শরীরে লেখা থাকবে। তুমি দেখো, লেখা থাকবেই।

ছুটি শিউরে উঠল উত্তেজনায়। তারপর হেসে ফেলল, বলল, খেতে পারছি না আমি, এমন একসাইটেড হয়ে গেছি। আপনি এমন করে বলেন না, যেন নর্ম্যান্ডী অভিযানে যাচ্ছেন।

তারপর একটু থেমেই ও বলল, বোকা। এসব কথা মুখে বলতে নেই। যা করবেন, তা করে দেখাবেন। মুখে এসব একেবারেই বলতে নেই। বলা মানা।

বলে, ওর বাঁ হাতের পাতা আমার ঠোঁটের সামনে ধরল। ওর ফিনফিনে হাতের পাতার নরম গোলাপি রঙে আমার চোখ বেঁধে গেল। একটা গোলাপি ছায়ায় আমার চোখ ভরে গেল।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ