অবেলায় – উপন্যাস- বুদ্ধদেব গুহ

রান্নাঘরে অরা ও বৃহস্পতি সকালের ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যস্ত। রান্না বৃহস্পতি করে। অরা নির্দেশ দিয়ে দেন। মেয়েটি বুদ্ধিমতী আছে। যা অরা শেখায় তাই শিখে নেয়। কড়াইশুটির চপ, তাঁর শাশুড়ির রেসিপির ভুনিখিচুড়ি, তাঁর মায়ের রেসিপির চাওমিয়েন, কষা মাংস, মোমো, পাটিসাপটা ও সব-ই শিখে নিয়েছে।

তৃষা আর চুমকির জন্যে চিজ-টোস্ট বানাবেন বলে চিজ গ্রেট করছিলেন অরা। দু-জনেই তখনও ঘুমোচ্ছে। আজ রবিবার। কাল রাতে চুমকি দেরি হওয়াতে এখানেই থেকে গেছিল। চুমকিরা সল্টলেক-এ থাকে। অরাই চুমকির মাকে বলে দিয়েছেন ফোনে। অতরাতে ট্যাক্সি নিয়ে সল্টলেকে যাওয়াটা আজকাল নিরাপদ নয়।

এমন সময়ে ফোনটা বাজল।

অরা বললেন, আমার হাতজোড়া। ধরো তো গিয়ে ফোনটা বিস্পতি। আর কর্ডলেসটা নিয়ে এসো। তারপর মেয়েদের তোলে গিয়ে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের রকম-ই অমন। রাত দুটোর আগে শুতে যাবে না, বই পড়বে, গান শুনবে, টিভি দেখবে, হিহি-হাহা করবে, তারপর ঘুমোবে।

অরারা অন্যভাবে মানুষ হয়েছেন। রাতে যদি কখনো শুতে দেরিও হয় ঠিক পাঁচটাতে ঘুম ভেঙে যায়। অবশ্য একদিক দিয়ে ভালো। সকালের দু-তিন ঘণ্টা সময়ই তাঁর নিজস্ব সময়। কিছু পড়বার, একটু গান গাইবার, কারওকে চিঠি লিখবার। তবে তিনি যাঁকে নিয়মিত লিখতেন সেই অগ্নিভ রায় এখন কলকাতাতেই চলে এসেছেন নাগপুর ছেড়ে। তাঁরও ভোরে ওঠার অভ্যেস। কোনো কোনোদিন অগ্নিভকে সকালের ফালিটুকুতে ফোনও করেন– অগ্নিভও করেন প্রায়-ই। সারাদিনটা ভালো কাটে যেন, এনে অন্যের সঙ্গে সকালে কথা বললে।

বিস্পতি কর্ডলেসটা এনে দিয়ে বলল, যাই, দিদিদের তুইলে দিই আসি গে।

–ফোনটা কে করেছেন?

— ওই।

–‘ওই’ মানে কী হল?

–ওই অগ্নিবাবু।

–অগ্নি নয়, অগ্নিভ।

–ওই হল গা। বুইজতে পাইরলেই তো হল।

চিজ-এর স্ল্যাবটা রান্নাঘরের টেবিলে নামিয়ে রেখে অরা বললেন, বলছি।

-কী করছ? ও প্রান্ত থেকে অগ্নিভ বললেন।

–মেয়েদের ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছি।

–আমার জন্যেও বানিয়ো। আমি আসছি আধ ঘণ্টার মধ্যে।

–আজকাল তো দেখছি ডুমুরের ফুল হয়েছ। টালিগঞ্জে বুঝি কোনো গার্লফ্রেণ্ড হয়েছে নতুন?

–আজ্ঞে না। আমার ওল্ড ইজ গোল্ড। তা ছাড়া, এই বুড়োর দিকে চাইছে আর কে?

–চলে এসো। কাল চুমকি রাতে এখানে ছিল। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল।

-ফাইন। বুড়ো হয়েছি বলেই অল্পবয়সিদের সঙ্গে মিশতে ভালো লাগে। ওদের জগত্তাই আলাদা। যে-জগতের মধ্যে আমরা ঢুকতে পারব না। আর তাই-ই হয়তো ওরকম মনে হয়। জীবনেও যদি মোটরগাড়ির মতো ব্যাক গিয়ার থাকত তবে বেশ হত।

–বয়সে বুড়ো হলেই কি মানুষ বুড়ো হয়। চারধারে কত যুবক-বুড়ো দেখি।

–তা হয়তো ঠিক। মনের বয়স আমার পনেরোতেই আটকে আছে।

–ভয় তো সেজন্যেই।

-–ভয়টা কীসের?

অরা একটু চুপ করে রইল। তারপরে বলল, সকালেই এমন কথার ফুলঝুরি ফোঁটাতে শুরু করলে।

-সকালে কি কেউ ফুলঝুরি ফোঁটায়? এখন তো ফুল ফোঁটানোর সময়। ঠিক আছে। আসছি আমি।

তারপর বললেন, আমাদের রাস্তার মোড়ের মিন্টুর দোকানে দারুণ অমৃতি বানায়। নিয়ে যাচ্ছি এক কেজি। তারপর-ই বললেন, অমৃতি ছাড়া কিছু আনব কি? দোকানটাতে ভালো হিঙের কচুরিও করে।

–না। একদম না। তৃষা এবং চুমকি ঘি-এর কোনো জিনিস-ই মুখে দেয় না।

–সত্যি। পৃথিবীটা কেমন বদলে গেল। স্নানটা করেই যাচ্ছি।

–এসো। ছাড়ি এখন?

–হ্যাঁ।

অরা অন্য দশজনের মতো ফোনের রিসিভার তুলে বলে না, হ্যালো বা ইয়েস। বলে, বলছি।

.

০২.

তৃষা আর চুমকি নাইটির ওপরে ড্রেসিং গাউন পরে বসার ঘরে এল। তৃষা বলল, বিস্পতিদি, মা কোথায়?

–তিনি তো আন্নাঘরে।

-–মা আবার রান্নাঘরে কী করতে গেলেন। দেখেছিস চুমকি। তোর জন্যেই স্পেশ্যাল কোনো আইটেম বানাচ্ছে হয়তো।

-ভারি খারাপ। আমি কি খেতে এসেছি? কোথায় মাসিমার সঙ্গে একটু গল্পটল্প করব, মাসিমার গান শুনব। তা না।

তৃষা বলল দাঁড়া, দেখে আসি। বলে, কিচেনের দিকে গেল। কিচেনে ঢুকে তৃষা বলল, ঘি টি দিয়ে কিছু কোরো না মা। চুমকি মুখেও দেবে না।

–হুঁ। তা ঘি তো আজকাল রাখিই না বাড়িতে বলতে গেলে। সামান্য থাকে, গাওয়া ঘি। খিচুড়ি বা ফেনাভাতের সঙ্গে পাতে খাওয়ার জন্যে। সবকিছুই তো হোয়াইট অয়েলেই রান্না হয়।

এমন সময়ে চুমকির মোবাইলে কোনো মেসেজ এল। মেসেজটা দেখে খুশি হল চুমকি।

আমাদের ছেলিবেলায় শুধু কুকুরদের-ই ঘি সয় না জাইনতাম। আইজকালকার ছেইলে মেয়িদের বুইজতে পারি না–

বিস্পতি বলল, নিজের মনে।

তৃষা ফিরে এল বসার ঘরে।

মা তোর জন্যে চিজ টোস্ট আর সুজির হালুয়া করছেন। বেশ লবঙ্গ, তেজপাতা, ভালো করে ঘি-টি দিয়ে।

-ঘি?

আতঙ্কিত চোখে বলল চুমকি।

–ইয়েস ঘি।

অরা বসবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, হালুয়াতে আর কী ঘি! তোর অগ্নিকাকা আসছেন অমৃতি নিয়ে। সঙ্গে হিঙের কচুরিও আনছিলেন। মানা করেছি।

চুমকি উত্তেজিত হয়ে বলল অগ্নিকাকা আসছেন। গ্রেট। এই রবিবারের সকালটা একেবারে জমে যাবে। কী বলিস তৃষা?

তৃষা বলল, সত্যি। অগ্নিকাকাকে পছন্দ করে না, এমন কারওকে আমি দেখিনি, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে। তবে উনি নিজে বলেন, ওঁর কোনো মিত্র নেই, সব-ই শত্রু।

–বাজে কথা।

অরা বলল।

তারপর বলল, মানুষটার শত্রু-মিত্র কারওকে নিয়েই কোনো মাথাব্যাথা নেই। অমন উদাসীন মানুষ আমি তো আর দেখিনি।

অরা একটু চুপ করে থেকে চুমকিকে বলল, তবে তোমার মেসোমশায়, মানে তৃষার বাবা ঠাট্টা করেই বলতেন ও একটা মিচকে শয়তান। আ গ্রেট ইমপোস্টর। তবে আমার নিজের কিন্তু তা কখনো মনে হয়নি। হরিহর আত্মা বলতে যা বোঝায় ওঁরা তাই ছিলেন দু-জনে অথচ দু-জনের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল-ই বেশি ছিল। উনি গান-বাজনা ভালোবাসতেন না তেমন, রেডিয়োতে ক্ল্যাসিকাল গান হলে বলতেন, আরে বন্ধ করো এই কুকুরের কান্না।

–কী বলছেন মাসিমা আপনি! এমন হতেই পারে না।

চুমকি বলল, অবিশ্বাসের গলাতে।

-কেন পারবে না। ক্ল্যাসিকাল গান ভালো না বাসলেই কি একজন মানুষ অমানুষ হয়ে যান? ‘মানুষ’ নানা উপাদান দিয়ে তৈরি। অনেক কিছুকে বাদ দিয়ে এবং অনেক কিছু নিয়েই একজন মানুষ। সবাই-ই কি আর রবীন্দ্রনাথের ‘পূর্ণ মনুষ্যত্ব’র স্বর্গে পৌঁছোতে পারেন? খন্ড মানুষও অবশ্যই মানুষ। আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ-ই তো খন্ড মানুষ। পূর্ণ মনুষ্যত্বকে একটা আদর্শ হিসেবে সামনে রাখাটা ভালো কিন্তু তা অর্জন করা বড়ো কঠিন।

এমন সময়ে বসবার ঘরের কোণাতে রাখা ল্যাণ্ড-লাইনটা বাজল।

অরা বললেন, দেখ তো তৃষা, কে করল?

তৃষা ফোন তুলেই একগাল হেসে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ হর্ষদ। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। ইটস ভেরি নাইস অফ ইউ। ফুল পাঠিয়েছে? এখনও পাইনি। পাব নিশ্চয়ই। কী আর করব? কাল রাতে চুমকি এখানে ছিল। অনেক রাত অবধি গানটান হল। শি ওয়াজ ইন হার এলিমেন্টস।

–কে? অগ্নিভ কাকা? না উনি কাল আসেননি। আজ আসছেন একটু পরে আমাদের জন্যে অমৃতি নিয়ে।

তারপর একটু থেমে বলল, ভালো বলেছ তো।

-–মা কি জানেন?

–জানি না? জিজ্ঞেস করছি। তুমি মায়ের সঙ্গে কথা বলবে? দিচ্ছি।

বলো হর্ষদ। অরা বললেন। তোমার সব খবর ভালো? শুনেছ তো এখন এখানে প্লেজেন্ট ওয়েদার। কী বললে? ওখানেও প্লেজেন্ট ওয়েদার? তবে এ-বছর বৃষ্টি তো তেমন হল না, শীতও পড়ল না। যা গরম পড়বে এরপর ভেবেই আতঙ্কিত হচ্ছি।

–কোথায় যাচ্ছ ছুটিতে? মাথেরান-এ? যাও যাও ঘুরে এসো। তোমার মেসোমশাই বলতেন, পরের জন্মে বিয়ে করে মাথেরান-এ হানিমুন করতে আসব। সত্যি দারুণ-ই সুন্দর জায়গা। একা গেলে ভালো লাগবে? ও বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছ? যাও, ঘুরে এসো। নাও তৃষার সঙ্গে কথা বলো। কলকাতাতে আসছ কবে? পুজোর সময়ে? ফাইন। মা-বাবা ভালোই আছেন তো? তৃষা তো গেছিল গত সপ্তাহেই।

তৃষা রিসিভারটা মায়ের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল, হর্ষদ উই উইল বিট ইট আপ হোয়েন ইউ কাম। কোথাও সকলে মিলে বেড়াতে যাব। কোনো জঙ্গলে-টঙ্গলে, মা অগ্নিভকাকা সকলকে নিয়ে। মাসিমা মেসোমশাইও কি যাবেন?

–বোধ হয় নয়। মা-বাবার বস্টনে যাওয়ার কথা আছে দিদি-জামাইবাবুর কাছে।

–তুমি একা থাকবে?

–একা কেন? নন্দন তো থাকবে। কলকাতাতে এলে ওই তো আমার গার্জেন হয়।

তারপর তৃষা বলল, ওকে। বাই। থ্যাঙ্কস আ লট হর্ষদ।

ফোনে শব্দ করে একটা চুমু খেল তৃষাকে হর্ষদ। বলল, তুমি আমাকে একটা খাও।

তৃষা গলা নামিয়ে আদুরে গলাতে বলল, না-আ-আ। মা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

বলেই, ফোন ছেড়ে দিল। বলল, পরে ফোন করব মোবাইলে।

ফোন ছাড়তেই অরা বলল, কী বলছিলরে হর্ষদ?

–কী আবার বলবে। একনম্বরের পাজি ছেলে।

–বলছিল কী বল না?

–বলছিল ফোনে চুমু দাও।

অরা এবং চুমকি হেসে উঠলেন ও উঠল।

অরা বললেন, আই অ্যাডোর হর্ষদ। একটা দারুণ প্রাণবন্ত ছেলে। তা তোর মা কি এতই ব্যাকডেটেড যে, তুই ফোনে শব্দ করে একটা চুমু খেলে রাগ করত?

তারপর বললেন, তোদের এই দোষ, জানিস তো?

–কী?

–তোরা ভাবিস যে, আমরা জন্ম থেকেই বয়স্ক। আমাদের যেন, কৈশোর বা যৌবন ছিল না। তোদের অনুভূতি যেন, আমাদের ছিল না। তোদের যেন আমরা বুঝতে পারি না একেবারেই।

–ওরকম করে বোলো না মা। তোমরা কি বয়ফ্রেণ্ডদের ফোনে শব্দ করে চুমু খেতে?

-না, তা অবশ্য খেতাম না। আমাদের সময়ে ভালোবাসায় গোপনতা ছিল, তাই তার মাধুর্য ছিল বেশি। সবকিছুই সব অনুভূতিই আজকের মতো ‘বাজারি হয়ে যায়নি।

প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে তৃষা বলল, আজকে ভ্যালেন্টাইনস ডে। জান মা?

–কে জানে বাবা। আমাদের ছেলেবেলায় তো এসব শুনি টুনিনি। এই গ্লোবাইলাইজেশনের যুগে কত কীই যে, ঘটছে!

এমন সময় রুরু ফেডেড জিনস এবং একটা গেঞ্জি পরে একেবারে চান-টান করে বসার ঘরে এল গাইতে গাইতে–”তোমার দেখা নাইরে তোমার দেখা নাই।”

চুমকি ওকে দেখে একটু ব্লাশ করল।

রুরু বলল তৃষাকে, বুঝলি দিদি, তোর বন্ধুটা আনসিভিলাইজড।

-কোন বন্ধু?

–আরে এই যে, চুমকি বোস।

–এই চুমকি, তোর চেয়ে বয়সে বড়ো। সম্মান দিয়ে কথা বল।

–পুরো সম্মান দিয়েই বলছি। বয়সে ছোটোবড়োতে কী আসে যায়। উইসডম’ হচ্ছে আসল। তা ছাড়া, জান না? আজকাল পশ্চিমি দেশে ট্রেণ্ড এসেছে যে, অধিকাংশ ছেলেরাই তাদের চেয়ে বয়সে বড়ো, মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করছে, বিয়ে করছে।

তৃষা বলল, থাকিস তো মায়ের হোটেলে। কাজকর্ম কর, রোজগার-টোজগার কর, নিজের পায়ে দাঁড়া, তারপর তো বিয়ের স্বপ্ন।

-দেখ দিদি, তোকে ওই সিউডো-ইনটেলেকচুয়াল হর্ষদাটা একেবারে জাদু করে রেখেছে। প্রেমের সঙ্গে বিয়ের কী সম্পর্ক? প্রেমটা একটা এটার্নাল ব্যাপার আর বিয়েটা তাতে বাঁধন দেয়। তবে এই বিয়ে ব্যাপারটাই পৃথিবী থেকে উঠে যাবে একদিন। তোর বন্ধু একটা বেরসিক। পড়াশুনোতে ভালো হতে পারে। দেখতেও ভালো হতে পারে। দেখ আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে-সাতসকালে মোবাইলে মেসেজ পাঠালাম কিন্তু রেসপন্স-ই করল না।

তৃষা চেপে ধরল চুমকিকে।

–এ কী রে! সকালের মেসেজটার শব্দ পেয়েছিলাম। সেটা যে, রুরুর-ই মেসেজ ভাবতেও পারিনি।

চুমকি বলল, বাচ্চা ছেলেরা কত দুষ্টুমিই না করে। তা বলে সবসময়েই কি কান মুলে দিতে হয়?

রুরু, অরাকে বলল, দেখেছ মা। তুমি দিদির এই বন্ধুকে ভালো মেয়ে বলতে পারো কিন্তু এমন হার্টলেস মেয়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

সকলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। চুমকি বলল, সম্পর্ক ছিলটাই বা কবে যে, আজ না থাকার কথা উঠছে?

-তাই? ঠিক আছে চুমকি। তুমি ভাবো তুমি অনেক জানো কিন্তু আসলে যে, কিছুই জানো না তা পরে বুঝবে। আমার নাম রুরু। একদিন আমিই হব তোমার গুরু।

–এবার চল আমরা একে একে চান করে নিই।

–না, আগে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নাও তারপর চানে যাবে। অগ্নিকাকা এই এসে পড়লেন বলে।

অরা বললেন।

তারপর গলা তুলে বললেন, বিস্পতি, পেঁপে আর আপেলগুলো কেটে ফেল ততক্ষণ। চিজ টোস্টগুলো আমি গিয়েই ভাজছি। তোমরা কেউ দুধ কর্নফ্লেকস খাবে কি? তাহলে বিস্পতিকে দুধ গরম করতে বলি।

রুরু বলল, আমি খাব। তবে ঠাণ্ডা দুধ দিয়ে।

তোমরা কেউ ‘রিয়্যাল’-এর ফুট জুস খাবে? পেয়ারা আর টোম্যাটো জ্যুস আছে।

চুমকি বলল, এতসব কি খাওয়া যায় মাসিমা? তারপর অগ্নিকাকা আবার অমৃতি আনছেন।

–তাও মাত্র এককেজি।

রসিকতা করে বললেন অরা। তারপর বললেন অগ্নি হচ্ছেন তৃষার বাবার বিপরীত মেরুর মানুষ। তোদের বাবা হলে, গুনে গুনে আটটা আনতেন চারজনের জন্যে। তবে খুব ‘হিসেবি’ ছিলেন বলেই অসময়ে তোর বাবার মৃত্যুর পরে আমরা ভেসে যাইনি। সংসারে সব জিনিসের-ই ভালো দিক মন্দ দিক থাকে।

রুরু বলল, বাবাকে আমার ভালো করে মনেই নেই। আমি তো তখন আড়াই বছরের ছিলাম, না-মা?

–হ্যাঁ। আর চুমকি ছিল পাঁচ বছরের। তোর বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে তোর অগ্নিকাকা দু-মাসের ছুটি নিয়ে নাগপুর থেকে এসে ঝড়ের মধ্যে হাল ধরেছিলেন।

চুমকি বলল, নাগপুরে অগ্নিকাকা কী কাজ করতেন?

-উনি প্রথমদিকের এনভায়রনমেন্ট সায়ান্টিস্ট। উনি আর তোর বাবা একইসঙ্গে বস্টনে পড়াশুনো করেছিলেন। তোর বাবা পড়েছিলেন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে আর উনি এনভায়রনমেন্ট নিয়ে।

–নাগপুরে কোথায় পড়াতেন? চুমকি জিঞ্জেস করল।

–নিরিতে।

-–’নিরি’টা কী জিনিস?

রুরু বলল।

–‘নিরি’ মানে ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। তোদের অগ্নিকাকা তখন ডিরেক্টর ছিলেন, পরে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন। বহুদিন এম.ডি. ছিলেন রিটায়ার করার দিন পর্যন্ত। নাগপুরেই সেটল করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমাদের-ই কারণে কলকাতাতে এসে সেটল করলেন।

অগ্নিকাকা বিয়ে করেননি কেন মাসিমা?

–তা কী করে বলব? বলো মা। তিনি বলেন, সময় করতে পারেননি। তা ছাড়া বিয়ে করার মতো কেউ নাকি আসেইনি তার জীবনে।

–কলকাতায় তো প্রায়-ই আসতেন।

–হ্যাঁ। আমরা এখানে চলে আসার পর। তার আগে খঙ্গপুরে আসতেন। ‘আই আই টি’-র ফ্যাকাল্টি ক্যাম্পাসে আমাদের বাংলোতে তো জায়গার অভাব ছিল না। তবে সেখান থেকে কলকাতাতে চলে আসতেন প্রায়-ই গানের টানে। চন্ডীদাস মাল ও দিলীপ মুখোপাধ্যায় মশায়দের কাছে পুরাতনি গানের তালিম নিতেন। রবীন্দ্রসংগীত শিখতেন সন্তোষ সেনগুপ্ত ও দেবব্রত বিশ্বাসের কাছেও, যতদিন ওঁরা ছিলেন। ওর কাছেই শুনেছি দিলীপ মুখোপাধ্যায় নাকি সাম্প্রতিক অতীতে গত হয়েছেন।

.

০৩.

ওরা ডাইনিং টেবিলে বসেছিল সকলে। অরার স্কুল শনি, রবি ছুটি থাকে। তাই সোমবার সকালে মানডে মর্নিং সিকনেস হলেও শনি, রবি বেশ রিল্যাক্সড থাকেন। ছেলেমেয়েরা খাওয়া শুরু করেছে এমন সময় ডোরবেলটা বাজল। রুরু গিয়ে দরজা খুলল। প্রতিবেশী অপালা এলেন। ব্যারিস্টারের বউ।

–এই যে অপালা মাসি, ভালো সময়েই এসেছ। আমরা ব্রেকফাস্ট করছি। এসো টেবিলে। বলেই বলল, তোমার হাতে ওটা কী?

–ওটা একটা রজনিগন্ধার মালা।

–কার জন্যে?

–তোমার মায়ের ভ্যালেন্টাইনের জন্যে। তিনি আজ নিশ্চয়ই আসবেন।

–আসবেন কী? এসে পড়লেন বলে। অপালা খাওয়ার ঘরে ঢুকতেই তৃষা বলল, আমার মায়ের ভ্যালেন্টাইন না তোমার। ভ্যালেন্টাইন অপালা মাসি?

অপালা সুরসিকা। বললেন, ধরো, না হয় দু-জনেরই।

চুমকি বলল দু-জন নারীর এক-ই ভ্যালেনটাইন হয় কি না তা দেখতে হবে। ইন্টারনেটে ব্রাউজ কোরো তো রুরু ব্রেকফাস্টের পর।

অরা বললেন, একটা বুড়ো মানুষকে নিয়ে তোরা কী ইয়ার্কি শুরু করলি। ভালো এবং বোকা মানুষটা শুনলে দুঃখ পাবেন।

–ভালো মানুষ অবশ্যই, তবে বোকা মানুষ কখনোই নন। তা ছাড়া, মানুষটার মধ্যে এমন একটা ক্যারিশমা’ আছে যে, তরুণীরাও সহজেই প্রেমে পড়তে পারে। অতসহজে

অগ্নিকাকাকে ডিসমিস করা সম্ভব নয়। করতে চাইলে, আমি প্রতিবাদ করব।

তৃষা কপট রাগের সঙ্গে বলল।

-আমিও।

রুরু বলল।

অপালা বললেন, আমিও।

চুমকি বলল, আমি একাই বা বাদ যাই কেন?

এমন সময় ডোরবেল আবার বাজল।

এবারে বিস্পতি গিয়ে দরজা খুলল। আপ্যায়ন করে বলল, আসুন আসুন আগুনবাবু। আপনার লেইগেই সক্কলে টেবলে বইসে আছেন। তা আমৃতি এইনেচেন তো।

–আনিনি আবার। সঙ্গে কিছু হিং-এর কচুরিও এনেছি। তুমিও খেয়ো বিস্পতি ভালো করে।

–এঁজ্ঞে।

অগ্নিও খাওয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকতেই সকলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

–আমি কি অসময়ে এলাম?

তৃষা বলল, তুমি যখন-ই আসবে তখন-ই সুসময়।

অরা চোখের ইশারাতে অপালাকে বললেন, কই অপা তোমার প্রেমের দানটা দাও এবারে।

অগ্নিভ একটু হকচকিয়ে গেলেন।

অরা বলল, অপালা কেমন মডার্ন দেখেছ। আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে তাই তোমার জন্যে রজনিগন্ধার মালা নিয়ে এসেছে।

বলতেই কলাপাতার মোড়ক খুলে অপালা অরাকে দিয়ে বললেন, নে তৃষা, এটা পরিয়ে দে ওকে।

তৃষা দুষ্টুমি করে বলল, মাথা খারাপ। তোমার ভ্যালেন্টাইনকে আমি মালা পরাব কোন দুঃখে? আমার বুঝি ভ্যালেন্টাইন নেই?

এ কথাতে সকলেই হেসে উঠলেন।

অপালা মালা খুলে অরাকে ডাকলেন, বললেন আয় অরা, আমরা দুজনেই পরাই।

অরা হেসে বলল, পৃথিবীর ইতিহাসে দু-জনে মিলে একজনকে মালা পরানোর কোনো নজির আছে বলে আমি জানি না। কিন্তু আমার স্বামী না হয় বহুদিন পরলোকে, তোমার ঘরের ডাকসাইটে ব্যারিস্টার ঘোষসাহেব জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র বাঁধাবেন না তো?

অপালা হেসে বললেন, আমার ঘরের পতিদেবতাটি রসকষহীন হলেও, এসব ব্যাপারে অত্যন্তই উদার। আমার ভ্যালেন্টাইনের ওপরে তার বিরূপ হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বরং উনি বেঁচে যাবেন।

–উনি কী করছেন?

-কী আবার করবেন? সকাল থেকেই মক্কেল-বিকেল নিয়ে কনফারেন্সে বসেছেন। চলবে বেলা একটা অবধি। তারপর খেয়েদেয়ে জমিয়ে ঘুম। দুপুরে ঘুমোয় অবশ্য শনি-রবিবারেই। যেদিন কোর্ট থাকে, সেদিন কোর্ট থেকে ফিরে ঘুমোয়। তারপর রাত আটটা থেকে আবার কনফারেন্স চলে রাত একটা অবধি।

–তুই যে, কেন ছেড়ে দিস না হাইকোর্টের ব্যারিস্টারকে তা, তুই-ই জানিস।

–ছাড়তে পারলে তো ভালোই হত, কিন্তু পারলাম কই? অভ্যেস হয়ে গেছে। দাম্পত্যটা একটা অভ্যেস। এ অভ্যেস কাটানো ভারি শক্ত।

তারপর বললেন, মানুষটার অনেক দোষ থাকতে পারে, তবে একটা মস্ত গুণ এই যে, তাঁর নিজের সব খামতি সম্বন্ধে উনি পুরোপুরি সচেতন। মানুষটার মধ্যে রোমান্টিসিজম-এর ‘র’ও নেই। সেজন্যে তার মনে কোনো অপরাধবোধও নেই। আমার কোনো স্বাধীনতাতেই তিনি হস্তক্ষেপও করেন না। সফল উকিল-ব্যারিস্টারেরা বোধ হয় সকলেই এরকম।

অগ্নিভ বললেন, বাঃ। ঘরে ঘরে এমন স্বামী হোক।

তারপর-ই কলাপাতা মোড়া মালাটি অপালার গলাতেই পরিয়ে দিয়ে গেয়ে উঠলেন—

“গাছে ফুল শোভা যেমন, হয় কি তেমন গাঁথলে মালা
গলায় দিলে ক্ষণিক মজা, তারপরেতেই হেলা ফেলা।
কোথা সে সৌরভ সুখ কোথা সে প্রফুল্ল
মুখ দুই অধরে রসভরে ভ্রমরে করে না খেলা
গাঁথলে মালা…”

সকলেই হইহই করে উঠলেন ও উঠল।

রুরু বলল, অগ্নিকাকা তুমি একটার পর একটা প্রেমের গান গেয়ে যাও। আজ যে ভ্যালেন্টাইনস ডে।

–আমার রোজ-ই ভ্যালেন্টাইনস ডে।

তারপর-ই রুরুকে বললেন, বাংলা ব্যাণ্ডের সেই গানটা তুই গা না।

–কোন ব্যাণ্ড?

–আহা, নাম টাম সব ভুলে যাই আজকাল। অনিন্দ্যর ব্যাণ্ড রে।

–ওঃ। গান ভালোবেসে গান।

–রাইট ইউ আর। অরা বললেন, চিজ টোস্টগুলো, অমৃতি এবং হিং-এর কচুরি সব যে, ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আগে সকলে খেয়ে নাও। তারপর গান হবে।

তারপর স্বগতোক্তির মতো বললেন, হিং-এর কচুরির সঙ্গে গাঢ় ছোলার ডাল বা ঝলঝলে আলুর তরকারি দেয় না তোমার দোকানে?

-–আমার দোকান হলে অবশ্যই দিত। কতদিন বলছি তোমাকে যে, চলো আমরা একটা দোকান দিই–সে দোকানে ক্ষীরের পাটিসাপটা, তোমার শাশুড়ির রেসিপির কড়াইশুটির চপ আর ঘুগনি বিক্রি করব শুধু। তাতেই বাড়ি-গাড়ি হয়ে যাবে।

-কথা পরে, আগে বসে পড়ো। কে কে চা খাবে আর কে কে কফি?

তৃষা বলল, মা, ড্রিঙ্কিং চকোলেট। ঠিক আছে?

-ঠিক আছে।

বলেই বললেন, অগ্নিভর আর অপালার দিকে চেয়ে–আজকালকার ছেলেমেয়েদের সময়ের বড়োই দাম। ঠিককে বলে “ঠি’, ইকনমিকসকে ‘ইকো’ দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসকে ডি. স্কুল, ফ্লেক্সিবলকে ‘ফ্লেক্সি’ এইসব।

তৃষা বলল, সময়’ কোথা সময় নষ্ট করবার মা। তোমাদের সময়ে তোমাদের হাতে অঢেল সময় ছিল।

–আমাদের সময়কার সময় ছিল শান্ত, মধুর, আমরা সময় নিয়ে কী করতে হয় তা জানতাম। আর তোরা সব ছটফট করা চড়াই পাখি, ডানার ঝাঁপটাতে সবসময়েই ধুলো ওড়াচ্ছিস।

–আর তোমরা?

–আমাদের ছিল শান্ত-গ্রীষ্ম দুপুরের ঘুঘুর ডাকের মতো সময়। তার মাধুর্য ইন্টারনেটে বসে আঙুল চালিয়ে তোরা কী করে বুঝবি?

অপালা বললেন, বুঝলে তৃষা, তোমরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জান, তবে এতজ্ঞানের প্রয়োজন সত্যিই ছিল কী ছিল না, তা একদিন তোমাদের বুঝতে হবে। জীবনকে ‘মধুর করতে এতজ্ঞান বোধ হয় বাধা হয়ে দাঁড়াবে তোমাদের কাছে। নিজেরাই এ কথা বুঝতে পারবে একদিন।

রুরু গেয়ে উঠলঃ ‘কে সারা সারা, হোয়াটেভার উইল বি, উইল বি।

তৃষার মোবাইল বেজে উঠল।

সেটটার দিকে তাকিয়ে বোতাম টিপে বলল, হর্ষদ? আবার কী হল? না ফুল তো আসেনি এখনও। পাঠিয়েছ যখন, আসবে নিশ্চয়ই। আমরা এখন ব্রেকফাস্ট করছি জমিয়ে, অগ্নিকাকা, অপালা মাসি সব এসেছেন, চুমকি তো রাতে ছিল-ই। রুরু আর কোথায় যাবে? এখনও তো ডানা গজায়নি ওর। আমি তোমাকে পরে ফোন করছি। বাই-ই।

.

০৪.

ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পরে ওরা সকলে বসার ঘরে এসে বসেছে। সকলের অনুরোধে অগ্নিভ গান ধরেছেন

‘প্রণয়’ পরম রত্ন, যত্ন করে রেখো তারে
বিচ্ছেদ তস্করে আসি যেন, কোনোরূপে নাহি হরে।
অনেক প্রতিবাদী তার হারালে আর পাওয়া ভার।
কখন যে, সে হয় কার কে বা বলিতে পারে।

অপালা বললেন, এটা কার গান?

–নিধুবাবুর, আবার কার? রামনিধি গুপ্ত। যিনি বাংলা টপ্পার জনক। নিধুবাবু অত্যন্ত বড়োমাপের কবিও ছিলেন। ওর গানে যেমন পানিং, তেমন কম রচয়িতার গানেই দেখা যায়। শব্দ চয়ন ও উদ্ভাবনও তেমন-ই। যেমন ‘অপ্রণয়’ এই শব্দটি।

অরা বললেন, একটি গানে বাসনাকুসুম’ শব্দটি পেয়েছিলাম। ওটিও কি নিধুবাবুর? না বোধ হয়। ইফফাত আরা খান-এর গলাতে, তখন উনি দেওয়ান ছিলেন না, এই শব্দটি, একটি গানে পেয়েছিলাম। “বাসনাকুসুম হৃদয়ে যা ছিল, সকলি ফেলেছি তুলিয়া বা ওইরকম কিছু।

চুমকি বলল, ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে আরও কিছু প্রেমের গান হোক অগ্নিকাকা। তারপর অরা মাসি রবীন্দ্রসংগীত বা অতুলপ্রসাদ গাইবেন।

–আজ আমার গলাটা ভালো নেই। তোমরা কেউ আমার গলাতে তিনটে চুমু খাও তো। ঠিক হয়ে যাবে।

অগ্নিভ বলল।

কার চুমু খাবেন?

–চুমু তো সকলের-ই খেতে ইচ্ছে করে। যে খাবে খাও।

–তবে আমিই খাচ্ছি।

চুমকি বলল।

-একে বলে চুমু-থেরাপি। সব রোগের চিকিৎসা করা যায় এই থেরাপিতে। বুঝেছ।

–এত আপনি শিখলেন কোথায়?

অপালা বলল।

-এই! একজীবনে কম কিছু তো করলাম না। অরাদের দেশ হাজারিবাগে, আমার এক মুসলমান গুরু ছিলেন। বাওয়ার্চিকে ‘বাওয়ার্চি’, হেকিমকে হেকিম, ইত্বরওয়ালাকে ইত্বরওয়ালা, তাঁর কাছ থেকেই এইসব বিদ্যা শিখেছি। আমি আর আশিস যখন হাজারিবাগে তোর মাকে দেখতে যাই, মানে আমি আর তোর বাবা, কাকাবাবু মেয়ে পছন্দ করার পরে তখন আশিসের সঙ্গেও তাঁর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম। হাজারিবাগ তো আমার পুরোনো ঠেক। খুব মজা হয়েছিল সেবারে। আমরা কানহারি পাহাড়ের মাথার ওপরের বনবাংলোতে ছিলাম।

তৃষা বলল, চলুন-না অগ্নিকাকা, আমাদের সকলকে নিয়ে একবার হাজারিবাগে। মামাবাড়ি তো আর নেই। দিদিমা তো আগেই চলে গেছিলেন, দাদুর মৃত্যুর পরে তো বাড়ি বিক্রিই হয়ে গেছে। বড়োমামা স্টেটস-এ চলে গেলেন পাকাপাকি, বাড়ি দেখাশোনারও কেউই ছিল না। মামার কাছে শুনেছি, কানহারি হিল রোড-এ ছিল সেই বাড়ি।

মা তো এখনও নস্টালজিক। লাল মাটি, শালবন, কানহারি, সীতাগড়া আর সিলওয়ার পাহাড় ঘেরা হাজারিবাগ-এর কথা উঠলেই মায়ের চোখ এখনও ছলছল করে ওঠে।

-চলো একবার। সকলে মিলে যাওয়া যাবে। রাজডেরোয়া ন্যাশনাল পার্ক-এর উলটোদিকে ‘শালপর্ণী’ বলে একটা দোতলা রেস্ট হাউস বানিয়েছে বনবিভাগ। কাছেই ঝরনাও আছে একটা। চড়ইভাতি করার আইডিয়াল জায়গা। তবে তোরা সকলেই যা ব্যস্ত। তোদের সকলকে একসঙ্গে একই সময়ে পাওয়াই তো অসম্ভব। আমি তো রিটায়ার্ড বুড়ো, আমার তো অঢেল সময় হাতে। গেলেই হল।

চুমকি বলল, বড়োবেশি কথা হচ্ছে। গান শুরু করো অগ্নিকাকা।

–চুমুটা খা আগে। বললাম না গলা খারাপ।

 চুমকি উঠে এসে নীচু হয়ে অগ্নিভর গলাতে গুনে গুনে এক, দুই, তিন করে তিনটি চুমু খেল।

অগ্নি একবার গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, বাঃ ওষুধে কাজ হল বেশ। বলেই শুরু করলেন–

সে কেনরে করে অপ্রণয়? তার উচিত নয়।
ওগো তারি সনে কভু বিচ্ছেদ নয়।
কখন কী বলেছি মানে
আমার আজ কী তা আছে মনে
ওগো তাই বলে কী মানে মানে
অভিমানে রইতে হয়?
সে কেনরে করে অপ্রণয়?
সখী গো, বোলো তারে, বোলো গিয়ে বুঝাইয়ে
ওগো পিরিতি করিতে গেলে, সুখ দুখ সইতে হয়।
সে কেনরে করে অপ্রণয়,তার উচিত নয়।
সকলে হইহই করে বাহবা দিল।

অগ্নি বললেন, আজ আর নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন না, ভালো জিনিস ‘অল্প’ বলিয়াই। ভালো।

তৃষা বলল, এবারে অপালা মাসি তুমি একটা গান গাও।

–মাথা খারাপ। এই গানের পরে! তার চেয়ে চল সকলে মিলে কোরাস গাই একটা।

–কোন গান গাইব অরা? তবে কোরাস নয়, তুই একাই গা।

–তা হবে না। তোরও গলা দিতে হবে।

ধর তো তুই।

অপালা গান ধরল,

খেলা যখন ছিল তোমার সনে, তখন কে তুমি তা কে জানত,
ছিল না ভয় ছিল না লাজ মনে, জীবন বয়ে যেত অশান্ত…

.

০৫.

অরার স্কুলে এখন ওকেই হেডমিস্ট্রেসের কাজ করতে হয়, যদিও ডেজিগনেশন সিনিয়র টিচার। হেডমিস্ট্রেস রিটায়ার করার পর, সেই পদের স্যাংশন আসেনি হায়ার সেকেণ্ডারি বোর্ড থেকে।

এবারে গরমটা বোধ হয় তাড়াতাড়িই পড়বে। পড়ানো ছাড়াও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজও কম থাকে না। স্কুলের পরে বড়োক্লান্ত লাগে। একটা গাড়ি থাকলে বেশ হত কিন্তু ভালোভাবে বাঁচতে আজকাল যা খরচ তাতে অরার পক্ষে গাড়ি কেনা সম্ভব নয়। গাড়ি কেনাটা আজকাল অতিসহজ কিন্তু ড্রাইভারের মাইনে, রানিং কস্ট এসবে অনেক-ই টাকার দরকার। ওর স্কুলের দু-জন টিচার গাড়ি কিনেও কিছুদিন পরে অনেক টাকা গচ্চা দিয়ে গাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, মিনির জন্যে লম্বা লাইন। একটা ট্যাক্সি নেবেন কি না, তা নিয়ে দোনামোনা করছিলেন। তৃষা বেশ ভালোকাজ করে, একটি অ্যাড এজেন্সিতে। খুব সুনামও করেছে। মাইনেও ভালোই পায়। রুরু এখনও ছাত্র। তবে প্রাইভেট টিউশন করে। আশিস বলতেন, ছেলেমেয়েরা হচ্ছে টোয়েন্টি ওয়ান ইয়ার্স গেস্টস। ওদের সাধ্যমতো প্যাম্পার করতে হবে। তবে আজকালকার সন্তানেরা একুশে পায়ে দাঁড়ায় না। তবু যতদিন কাছে থাকে ততদিন-ই সুখ।

ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে নাকটা মুছলেন। ওঁর নাক ভীষণ ঘামে। এমন সময়ে ওর পাশে একটি সান্দ্রো গাড়ি এসে দাঁড়াল। হালকা নীল রঙা গাড়ি। আজকাল যা দিনকাল। অচেনা লোক গাড়ি নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালে ভয় করে। অরার বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই কিন্তু দেখলে মনে হয় পঁয়তাল্লিশ। আয়নার সামনে দাঁড়ালে বা স্নান করার সময়ও, নিজেকে তেমন সুন্দরী বলে মনে হয় না। অন্যসব মেয়ের শরীরে যা-কিছু গর্ব করার থাকে তাঁর শরীরেও তাই-ই আছে। কিন্তু পুরুষের চোখ তাঁকে ‘সুন্দরী’ই দেখে। সুন্দরীমাত্রই কিশোরী বয়েস থেকে নানা বিপদের মধ্যে দিয়ে বড়ো হয়ে ওঠেন। এইসব বিপদের কথা শুধুমাত্র মেয়েরাই জানে। কখনো অপালাকে বলেননি, একদিন তার মহাদেব স্বামী ঘোষ সাহেবও একা বাড়িতে অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। প্রেমহীন শরীরে কখনো আকর্ষণ বোধ করেননি অরা। এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন ঘোষ সাহেবকে। তারপর থেকে অবশ্য আর কখনো দুঃসাহস দেখাননি। দুশ্চরিত্র পুরুষ মাত্রই ভীরু হয়। এমন-ই বিশ্বাস হয়েছে তার জীবনের মধ্য গগনে পৌঁছে।

–উঠে এসো অরা।

স্টিয়ারিং-এ বসা অগ্নিভ বললেন।

–এ কী! গাড়ি কবে কিনলে?

–আজ-ই ডেলিভারি পেয়েছি।

বাঁ-দিকের দরজাটা ঠেলে খুলে দিলেন অগ্নিভ।

সামনের সিটে বসতে বসতে অরা বললেন, গাড়ি কেনার কী দরকার ছিল? কী এমন দরকার তোমার গাড়ির?

–আমি কি আমার জন্যে কিনেছি?

গাড়ি ফাস্ট গিয়ারে দিয়ে বললেন অগ্নিভ।

-তবে কার জন্যে কিনেছ?

–তোমার জন্যে।

আনন্দে ও গর্বে অরার মুখটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

বলল, বাজে কথা বলার জায়গা পাও না।

-সত্যিই বলছি। তোমাদের বাড়িতে তো একটা গ্যারাজও আছে।

-তোমার কাছেই থাকবে গাড়ি। তুমিই ব্যবহার করবে। খঙ্গাপুরে তো গাড়ি চালাতে তুমি। এ.এ.ই.আই বা কোনো মোটর ট্রেনিং স্কুলে ক-দিন তামিল নিলেই তুমি আবার চালাতে পারবে।

-খড়গপুরে আলাদা ব্যাপার ছিল। তবে শুনতে পাই, এখন সেখানেও খুব ভিড়। কিন্তু আজকের কলকাতাতে গাড়ি চালানো আমার কম্মো নয়। তা ছাড়া, আমার ব্লাড প্রেশারও যে, হাই। গাড়ি চালাতে গেলে তা আরও বেড়ে যাবে।

-চলো, আজ তোমাকে প্রেশার নেমে যাওয়ার ইনজেকশান দেব।

-কোথায়?

অবাক হয়ে বললেন অরা।

-আমার বাড়িতে।

–কী যে, হেঁয়ালি করো, বুঝি না।

–বুঝবে।

নিজের বাড়ির দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন অগ্নিভ।

-কোথায় চললে তুমি?

–বললাম না, আমার বাড়িতে।

–এখন হুট করে কি যাওয়া যায়? বাড়িতে বিস্পতি বসে থাকবে। রুরুটা ফিরবে কলেজ থেকে। আমার কি কোনো স্বাধীনতা আছে?

–যে, নিজেকে পরাধীন করে রাখতে চায়, তাও নিজের হাতেই শিকল পরিয়ে, তাকে ‘স্বাধীন’ করতে পারে কোন শক্তি?

–তুমি বোঝ না?

–সব বুঝি।

-চলো অরা। আজ আমি কোনো কথা শুনব না। অনেক বছর অপেক্ষা করেছি আমি। বড়োকষ্ট হয় আমার। আমি এখনও যুবক আছি। তুমিও যুবতী। চলো, আজ আমরা পরীক্ষা দেব আর পরীক্ষা নেব।

–ছিঃ ছিঃ। এ কী হল, তোমার দু-যুগ পরে? তুমি তো এমন ছিলে না!

–চিরদিন-ই এমন-ই ছিলাম। কখনো প্রকাশ করিনি। কত কষ্ট যে, পেয়েছি। সব একা একা সয়েছি। এতে দোষের কী আছে?

-আশিস যদি থাকত তবে পারতে এমন করতে? ও জানলে কী ভাবত, কী বলত?

অরা বলল।

–ও নেই বলেই তো তোমাকে চাইছি আমি। তোমারও কি কষ্ট নেই অরা? পুরুষ মনে করে, শরীরের কষ্ট বুঝি তাদের-ই একার। মেয়েদের বুঝি নষ্ট নেই?

–নেই তা নয়। তবে মেয়েরা মেয়েবেলা থেকেই অনেক কষ্টকেই নীরবে মেনে নিতে শেখে। সবকিছুতেই পুরুষদের মতো অধৈর্য হয়ে ছটফট করে না।

-তুমি আমাকে অধৈর্য বলছ? পঁচিশ বছরের ধৈর্যটা কি ধর্তব্যের মধ্যে নয়?

–তুমি অবশ্য আমার শরীরটা দাবি করতেই পারো। গত পঁচিশ বছরে, তুমি আমার এবং আমার ছেলেমেয়ের জন্যে যা করেছ, তা অস্বীকার করার মতো অকৃতজ্ঞ আমি নই। কিন্তু.

–কিন্তু কী?

-তোমাকে তো আমি আমার মন দিয়েছি পুরোপুরিই। একজন মেয়ের পক্ষে যতখানি, যেমন করে দেওয়া যায় তেমন করেই। যাকে মেয়েরা মন দেয়, তাকে শরীর দিতে তাদের কণামাত্রও আপত্তি থাকে না। তোমরা পুরুষেরা এরকম-ই। তোমরা মেয়েদের শরীরটাকে তাদের মনের চেয়ে ‘দামি’ বলে মনে করো সবসময়েই। শরীর-বর্জিত আমাদের এই যে, অমলিন সম্পর্ক; এর মাধুর্য কি শরীরী সম্পর্ক হলে থাকবে?

-তুমি শরৎবাবুর নায়িকার মতো কথা বলছ অরা। তুমি যে, কত মহৎ আর আমি যে, কত নীচ তাই বলবার চেষ্টা করছ।

অরার দু-চোখ জলে ভরে এল।

বলল, তুমিও যদি আমাকে ভুল বোঝো তাহলে আমি কোথায় যাই বলো তো? তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? আমি মনে মনে এখনও তৈরি নই অগ্নি। তা ছাড়া ব্যাপারটা এমন চটজলদি হয়? এমন একটা সুন্দর ব্যাপার, বিশেষ করে তোমার সঙ্গে আমার–এরজন্যে প্রস্তুতি লাগবে না? বিছানা ফুলে ছেয়ে দিতে হবে, ধূপ জ্বালাতে হবে সন্ধে থেকে, আতর। গোলাপজলের বন্দোবস্ত করতে হবে। তুমি তো নিজেই আতরের স্পেশালিস্ট, রাশিদ খাঁ-এর “বাঁতো বাঁতো মে বিত গ্যয়ি রাত’–এর ক্যাসেট চালাবে নীচুস্বরে। আমরা কি জন্তু জানোয়ার? শরীরসর্বস্ব? আমাদের শারীরিক ব্যাপারটা স্বর্গীয় হবে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অগ্নিভ বলল, তোমার পরম সুন্দর স্বর্গীয় ব্যাপারটি ঘটবার আগে আমি নিজেই স্বর্গে চলে যাব। গিয়ে, আশিসের সঙ্গে মন্দাকিনীর পাড়ে বসে পেশেন্স খেলব।

অরা মৃদু হেসে অগ্নির কাঁধে হাত ছুঁইয়ে বলল, লক্ষ্মী সোনা, আর একটু সময় দাও আমাকে।

গাড়িটা লাল আলোতে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময় ফুটপাথে দাঁড়ানো রুরু চেঁচিয়ে উঠল ‘মা আ-আ’।

এয়ারকণ্ডিশাণ্ড গাড়ির মধ্যেও সেই ডাক পোঁছোল। অরা তাড়াতাড়ি অগ্নির কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে বাঁ-হাত দিয়ে কাঁচ নামিয়ে বলল, কী রে!

–এটা কার গাড়ি? তুমি কার সঙ্গে যাচ্ছ? কোথায়?

অগ্নি গলা তুলে বলল, উঠে আয় রুরু। তুই কোথায় এসেছিলি?

গাড়িতে উঠতে উঠতে রুরু বিস্ময়ের গলায় বলল অগ্নিভকে, একেবারে ব্ৰাণ্ড নিউ। কী দারুণ নতুন নতুন গন্ধ। কবে কিনলে? কীজন্যে কিনলে?

–আজ-ই কিনলাম। তোদের জন্যেই কিনলাম। গাড়ি চালানোটা শিখে নে। আঠেরো বছর তো হয়ে গেছে তবে আর কী?

অরা বলল এটাই বাকি। নিজে রোজগার করে গাড়ি কিনে, তারপর গাড়ি চালাবে।

বাঃ রে! আমার বন্ধুরা তাদের বাবার গাড়ি চালায় না বুঝি?

–অগ্নিকাকা তো, তোর বাবা নন।

-বাবার মতো তো!

-বাবার মতো আর বাবায় তফাত থাকে।

অগ্নিভর চোয়ালটা শক্ত হয়ে এল।

-কোথায় যাচ্ছ? অগ্নিকাকা? মাকে কোথায় পেলে?

-তোর মাকে দেখলাম, স্কুলের সামনে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। তাই নতুন গাড়িতে তুলে নিয়ে বললাম, আমার বাড়ি চলল। বিরিয়ানি আনিয়ে খেয়ে সেলিব্রেট করি।

–বাঃ রে। আমরা বুঝি বাদ? দিদি শুনলেও ফায়ার হয়ে যাবে।

–তাহলে আজ থাক। চল তোদের নামিয়েই দিয়ে আসি বাড়িতে।

–তাহলে পার্টটা কবে হচ্ছে?

–তোরা যেদিন বলবি সেদিন-ই হবে। বাড়িতে বিরিয়ানি না খেয়ে, যদিও আমাদের পাড়ার নতুন বিরিয়ানির দোকানটা দারুণ বিরিয়ানি করে, চল সকলে মিলে একদিন মেইনল্যাণ্ড চায়নাতে খেয়ে আসি।

-ও বাবাঃ। সে তো ভীষণ-ই দামি জায়গা।

–তোরাও তো আমার কাছে খুব-ই দামি। সেদিন চুমকি আর তোর অপালা মাসিকেও নিয়ে যেতে হবে। ঘোষ সাহেব নিশ্চয়ই যেতে পারবেন না।

–সব বড়ো ব্যারিস্টারদের সপ্তাহে একদিন-ই ছুটি। সেদিন কোনো কনফারেন্স রাখেন।, ওঁরা কেউই।

–কবে?

–শুক্রবার সন্ধেতে।

অরা বলল।

–তবে তাই হবে। কোনো এক শুক্রবার সন্ধেতেই করা যাবে। ভদ্রলোক আমার একটা বড়ো উপকার করেছিলেন। কিছুতেই ফিস নেননি। যদিও একবোতল ‘স্কচ’ জোর করে দিয়েছিলাম। সেটা তো ওঁর ফিস-এর তুলনাতে কিছুই নয়। তা ছাড়া, অপালাও আমাকে খুব ভালোবাসে।

–আর, মা বুঝি বাসে না?

রুরু বলল।

-সে-কথা তোর মা-ই জানে।

অগ্নিভ ওদের বাড়িতে নামিয়ে দিল।

অরা বলল, এককাপ চা খেয়ে যাবে না?

–তুমি তো জানো যে, যখন তখন চা খাওয়ার হ্যাবিটটা আমি কালটিভেট করিনি অধিকাংশ বাঙালির মতো। তা ছাড়া, সন্ধের পরে আমি চা-টা খাই না। আজ এই গাড়ি ডেলিভারি নিতে খুব-ই হ্যাঁপা গেছে। বাড়ি গিয়ে স্নান করে দুটো হুইস্কি খাব তারপর চন্দনবাবু দয়া করে যা, বেঁধেছেন তাই খাব।

–আমার এখানে হুইস্কি-টুইস্কি নেই। তবে খেয়ে যেতে পারো এখানে। আজ চাওমিয়েন আর ধোঁকার ডালনা করতে বলেছি বিস্পতিকে।

রুরু বলল, স্ট্রেঞ্জ কম্বিনেশান। তারপর বলল, এ মাসের তিনটি টিউশন থেকে যে-টাকা পাব তা দিয়ে, তোমার জন্যে একটা কিছু কিনে রাখব বাড়িতে অগ্নিকাকা।

–তুমি কি শুধু হুইস্কিই খাও? না রামও রাখব।

অরা বলল, তোমার ভেঁপোমি করতে হবে না। অগ্নিকাকার নাম করে বাড়িতে ওসব রেখে এই বয়েসে নিজেই পাঁড়মাতাল হয়ে উঠবে হয়তো।

রুরু বলল, মা-আ-আ। আমাদের বন্ধুরা যে, জলীয় তো বটেই, আরও কত কিছু খায় তা যদি তুমি জানতে! তোমার হিরের টুকরো ছেলেকে ওসব বোলো না।

গাড়ি থামিয়ে অগ্নি বলল, নাম এবারে।

তারপর বলল, আমার গাড়ির কী দরকার? তোদের গ্যারেজটা পরিষ্কার করে রাখিস রুরু। একজন ভালো ও বয়স্ক ড্রাইভার পেলে, গাড়িটাকে তোদের বাড়িতেই রাখব। তোদের ও তোদের মায়ের সুবিধে হবে। দিনে দিনে যা-অবস্থা হচ্ছে কলকাতা শহরের, বাসে মিনিবাসে যেতে তো কালঘাম ছুটে যায়। তোদের ফ্ল্যাটের গ্যারাজটা তো খালিই পড়ে থাকে।

অরাও গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল।

অগ্নি ডান হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে বাঁ-হাত তুলে বলল, চললাম।

বিদায় সম্ভাষণটা অরাকে বলল, না রুরুকে। অরা ঠিক বুঝতে পারল না।

একটা মস্ত দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। গাড়ির ব্যাকলাইটের আলোটা অন্য গাড়ির ভিড়ে হারিয়ে না-যাওয়া অবধি ফুটপাথেই স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল অরা। রুরু ডাকল, মা। রুরুর ডাকে সংবিৎ ফিরল অরার।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ