ঘণ্টেবাবু আজ ডালটনগঞ্জেই ফিরে এসেছেন পা একটু ভালো হওয়াতে। সুনীতিদের বলে এসেছেন যে, সময়মতো পৌঁছে যাবেন রাতের গাড়ি করে ডালটনগঞ্জ থেকে। এখান থেকে কলকাতায় খবরটাও করে আসবেন। বলেছেন।

নীলোৎপলরা না আসাতে মনে মনে ঘণ্টেবাবু বেশ শঙ্কিতই হয়ে আছেন। ব্যাপারটা যে, কী ঘটেছে তা উনি জানেন না।

তবে বডোকাকুকে, মানে নীলোৎপলের বাবাকে না-জানিয়েই তিনি এই সম্বন্ধটি করেছেন। ওঁকে যে, জানাননি তাঁর কারণও ছিল। উনি হয়তো এককথাতেই ‘না’ করে দিতেন। কারণ উনি সুমন ব্যানার্জি, মানে ঝিঁঝির বাবাকে চিনতেন। সাহেবিভাবাপন্ন সুমন ব্যানার্জির জীবনযাত্রা আর ওঁর জীবনযাত্রাতে আকাশ-পাতাল তফাত ছিল। তা ছাড়া সুমন ব্যানার্জি ব্যবসায়ী হলেও, উচ্চশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। উনি কোটিপতি কিন্তু অশিক্ষিত বড়োবাবুকে পাত্তা দিতেন না। তখন থেকেই রাগ ছিল চাপা।

কিন্তু নীলোৎপল শিক্ষিত আধুনিক ছেলে। ক্লাব-বাজি করে। তার এয়ার কণ্ডিশাণ্ড গাড়িতে দারুণ মিউজিক-সিস্টেম আছে। গাঁক-গাঁক আওয়াজ ছাড়ে সেটা। দিনরাত ইংরিজি গান বাজে তাতে। আর নীলোৎপলের বাবা, বড়োবাবু এখনও খেটো ধুতি পরেন। গায়ে বহরমপুরি বাফতার পাঞ্জাবি, হিরের বোম বসানো। হাতে তাবিজ-মাদুলি। নাচন-খ্যাপা’, নেদো কার্তিক’, হসন্তি-মা’ ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক গুরু আর মায়ের পদপ্রান্তে বসে থাকেন সপ্তাহান্তে দু-দিন। নামকীর্তন করেন। তবে নীলোৎপল জানে কি না তা ঘন্টেমামা জানেন না, তাঁর একজন পঁচিশ বছর বয়সি অশিক্ষিতা কিন্তু অপরূপা রক্ষিতাও আছে গল্ফ-গ্রিনে। আলাদা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। ঝিং-চ্যাক এয়ার-কণ্ডিশাণ্ড ক্যাটক্যাটে-লাল মারুতি গাড়ি। সপ্তাহে দু-দিন তার কাছে সন্ধেবেলা গিয়ে ঘণ্টা দু-তিন কাটান বড়োবাবু। তারপর বাড়ি পোঁছে মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সদ্য মা-হারানো বকনা-বাছুরের মতো সকাতরে কই গো, গিনি, বড়োগিন্নি কই? বলে নীলোৎপলের মা হৈমপ্রভাকে ডাকতে ডাকতে ওঠেন। যেন সারাদিন স্ত্রীকে না দেখে পিপাসার্ত বড়ো বড়োবাবু, একজন, যাকে বলে একেবারে সম্পূর্ণ মানুষ। মদ ছাঁন না। নেশার মধ্যে শুধু একটু পান। লাল-রঙা টিনের, বাবা জর্দা দিয়ে। ছ-শো’, নম্বর।

তাঁকেই না-জানিয়ে তাঁর ছোটোভাইকে বলে নীলোৎপলের জন্যে সম্বন্ধ করার কথাটা জানলে তাঁর ‘খেপচুরিয়াস’ হয়ে যাওয়ারই কথা। কিন্তু বহুবছর হয়ে গেছে ঘণ্টেমামার সঙ্গে বড়োবাবুর তো কোনো যোগাযোগ-ই নেই। সেজোবাবুই জঙ্গল দেখেন। তিনিই ডালটনগঞ্জে আসেন। তা, তিনি বড়োবাবুকে বলেছেন কী বলেননি তা ঘন্টেবাবুর জানার কথা নয়। সেজোবাবু, বড়োবাবুর ছোটোশালা এবং নীলোৎপলের-ই আসার কথা ছেল মনোয়া-মিলনে। কী যে-ঘটে গেল নেপথ্যে হঠাৎ করে, যার জন্যে ওঁরা আসা ক্যানসেল করে দিলেন তার কোনো হদিশও পাওয়া যাচ্ছে না ডালটনগঞ্জে বসে। ফোন আসে যায় না প্রতিদিনেই। কুরিয়ারও যায় আসে। ফোনে সেজোবাবুকে পায়নি। নীলোৎপলকেও নয়। তাই কুরিয়ার মারফত একটা চিঠি লিখে পাঠালেন আজ সকালেই ঘণ্টেবাবু, সেজোবাবুকে।

হৈমল্লা,

ডালটনগঞ্জ, রবিবার

সম্মানপুরঃসর নিবেদনমিদং পরম-পূজনীয় সেজোবাবু,

পত্রে আপনাদিগের কুশল প্রার্থনা করি।

বহুদিন আপনি ডালটনগঞ্জে আসেন নাই বলিয়াই এই পত্র প্রেরণ করিতেছি।

গত বুধবারে ‘মনোয়া-মিলন’-এ আপনাদের সাদরে অভ্যর্থনা করিবা-নিমিত্ত ন্যায্য-বিধায় আমি স্টেশনে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ কোথা হইতে কী হইয়া গেল, বিনামেঘে বজ্রপাতের ন্যায় খবর আসিল স্টেশন মাস্টারের তরফ হইতে যে, আপনারা শুভযাত্রা স্থগিত করিয়া আগামী বৃহস্পতিবার পুনঃস্থির করিয়াছেন।

এই সন্দেশ-জ্ঞাপনার্থেই এই পত্র প্রেরণ করিতেছি যে, অধম পুনরায় বৃহস্পতিবার ঠিক ওই সময়েই ‘মনোয়া-মিলন’ স্টেশনে উপস্থিত থাকিবে এবং উষ্ণতার সহিত আপনাদিকের অভ্যর্থনা করিবে।

শালাবাবুর নিমিত্ত এক বস্তা পাকা পেঁপে এবং এক ঝুড়ি কাঁচাকলাও সংগৃহীত হইয়াছিল। আবারও হইবে। কোনোরূপ কষ্ট আপনাদিগের হইবে না। আশা করি, এতদিনে ভগবদ কৃপায় আপনার সেজোকন্যার (ধুপিমা) তৃতীয়া কন্যার সর্দিজ্বর ভালো হইয়া গিয়াছে। জানাইয়া নিশ্চিন্ত করিবেন।

ইতি–

আপনাদিগের যুগান্তকারী সেবক শ্রীঘণ্টাকর্ণ মিত্র

চিঠিটা চলে যাওয়ার পর-ই খেয়াল হল, চিঠিতে অনেক-ই ভুল রয়ে গেল।

গত পঁচিশ বছরে এই প্রথম একটি চিঠি লিখলেন। আত্মীয়স্বজনদের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পত্রযোগে যা-সম্পর্ক তা স্ত্রী শেফালিই করেন। ক্লাস নাইন অবধি রমেশ মিত্র স্কুলে পড়েছিলেন। স্কুল তো ভালোই ছিল। পড়াশোনাতেও ভালো ছিলেন। অর্থাভাবে পড়াশুনো আর চালাতে পারেননি। ইংরিজি ও বাংলা হাতের লেখাটি খুব সুন্দর। গোটা গোটা অক্ষর। ভাষাও ভালো।

একটা চিঠি লিখতে যে, এত পরিশ্রম ও উত্তেজনা হয়, সে-সম্বন্ধে ঘণ্টেবাবুর কোনো ধারণা ছিল না। শব্দটা বোধ হয় যুগান্তকারী’ নয়, যুগযুগান্তরের’ হত। সংস্কৃততেও ভুল ছিল। সেজোবাবুর স্ত্রী আবার বাংলাতে বি.এ.। যদিও কম্পার্টমেন্টাল। তবুও তো বি.এ. পাশ। কলকাতা ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি-হোল্ডার বলে কথা! তাঁর চোখে ভুলগুলি সব প্রকট হয়ে উঠবে, যদি এ-চিঠি তাঁর গোচরীভূত হয়। যদি সেজোবাবু তাঁকে দেখান। সেজোবাবুও বাড়ি ফেরার সময়ে সেজোগিন্নি’ ‘সেজোগিন্নি’ হাঁক ছাড়তে ছাড়তে ওঠেন কি না, তিনটি সিঁড়ি বেয়ে, তা ঘণ্টেবাবুর জানা নেই। বড়োলোকদের ব্যাপার-স্যাপার-ই আলাদা।

উঠোনের পেঁপে গাছে বসে কাক ডাকছিল। অলক্ষুণে দাঁড়কাক। কাল কী উত্তরে আসবে কলকেতা থেকে তা কে জানে। মাঝে তো আর মাত্র তিনটি দিন।

বসার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দু-খাবলা তেল থাপ্পড় মেরে মেরে লাগালেন টাকে এবং গোটা তিরিশেক চুলে। তারপর রান্নাঘরের দিকে চেয়ে হাঁক দিলেন, কী এমন রাঁধছ গো পোলাউ-কালিয়া? শেফালি?

একবার ইচ্ছে হল, বড়োবাবুর-ই মতো বড়ো গিন্নি’ বা ‘বড়ো-বউ’ বলে হাঁক ছাড়েন। পরক্ষণেই পাছে শেফালি ভিরমি খান, তাই সামলে নিলেন।

বললুম, পায়ে একটু আয়োডেক্স লাগিয়ে দে যাও, তা শুনতেই পেলে না।

কী আর রাঁধব। যেমন আনবে তেমন-ই তো রাঁধব। পোলাউ-কালিয়া রাঁধতে যে, জানি না তা তো নয়! কিন্তু সেসব রান্না তো কবেই ভুলে মেরে দিয়েছি।

কী রাঁধলে? এত অবান্তর কথা কেন?

কাঁচা কলাই-এর ডাল। আলু পোস্ত। নিম-বেগুন ভাজা আর লাউ এর হেঁচকি।

ঠিক এমন সময়ে দরজার কড়া নড়ে উঠল খট-খট করে।

কে এল আবার এই দুপুরে বারোটার সময়ে?

ঘণ্টেবাবু গিয়ে দরজা খুলেই মুখ ব্যাজার করলেন। জিতেন। ডাক্তার মদন রায়ের একমাত্র ছেলে। ঠিকাদারি করে। বড়োলোক বাপের বড়োলোক ছেলে। নিজের রোজগারও মন্দ নয়। ছেলেটাকে ভালো লাগে না ওঁর।

তবে নিজের বয়েস হয়েছে কি না জানেন না, আজকালকার ছেলেদের কারোকেই পছন্দ হয় না ওঁর।

শেফালির কাছে তাঁর অনুপস্থিতিতে যে, সে আসে যায়, সে খবর তাঁকে দিয়েছেন উলটোদিকের বাড়ির গোরু-ঘোড়ার ডাক্তার জনার্দন পাঁড়ে। শেফালির সঙ্গে তাঁর নিজের বয়েসের তফাত প্রায় পঁচিশ বছরের। শেফালির এখন পঁয়ত্রিশ বছর বয়স আর তাঁর ষাট হতে চলল।

কী ব্যাপার জিতেন? অসময়ে? আমায় তো দোকানে পাওয়াই সোজা। সারাদিন তো সেখানেই থাকি।

আপনার কাছে আসিনি ঘণ্টেদা। এসেছি বউদির কাছে।

বলেই বলল, কোথায়? বউদি কোথায় গেলে। তোমার জিনিস এনেছি।

এনেছ?

না তো কী?

কী? জিনিসটা কী?

সন্দিগ্ধ গলাতে শুধোলেন ঘণ্টেবাবু।

এসব আপনার সাবজেক্ট নয় দাদা। চন্দ্রাবলী রুদ্রর পুরাতনি বাংলা গানের ক্যাসেট আর সুমন চ্যাটার্জির আধুনিক গানের।

তাই?

শেফালি, উৎফুল্ল গলায় বললেন।

গান আবার পুরোনো নতুন হয় নাকি? গান গান।

ঘণ্টেবাবু বললেন।

ঘণ্টেদা, এ তো আপনার বিড়ি-পাতা নয়। গানের অনেক-ই রকম হয়।

শেফালি কথা ঘুরিয়ে বললেন তুমি তো আনলে। কিন্তু শুনব কীসে? আমার কি ক্যাসেট প্লেয়ার আছে? তোমারটা ধার দেবে তো দু-একদিনের জন্যে?

তাও এনেছি।

তোমারটা তো। কবে ফেরত নেবে?

ফেরত নেব না।

তার মানে?

তার মানে তোমার জন্মদিনের প্রেজেন্ট। নতুন একটা কিনে এনেছি তোমার জন্যে। সকালেই দেওয়া উচিত ছিল। বাসটা এত দেরি করল পথে। চান্দোয়াতে একটা ট্রাক উলটে গেছে। পিঁপড়ের মতো সারি দিয়ে সব বাস-ট্রাক-প্রাইভেট দাঁড়িয়ে গেছে।

আজ তোমার জন্মদিন নাকি?

ঘণ্টেবাবু একটু অবাক এবং বিরক্ত হয়ে শেফালিকে শুধোলেন। এইসব ব্যাপার বড়োমানুষদের বাড়িতে আর ব্রাহ্মবাড়িতে হয় বলেই জেনে এসেছেন। গরিবের ঘোড়ারোগ!

শেফালি বললেন, ছাড়ো তো। আমি আবার একটা মানুষ! তার আবার জন্মদিন!

আমাকেও তো বলেনি কখনো কবে তোমার জন্মদিন? অথচ ওকে…।

আমি বলেছি থোড়াই। ওই জেনে নিয়েছে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে। কখন যে, অজানতে বলে ফেলেছি নিজেই। আসলে, গতবছর বড়োজামাইবাবু চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিটা যখন আসে তখন জিতু ছিল। পড়াচ্ছিল ছুটকিকে। তাই ও জেনে যায়। ছুটকির কাছ থেকে।

ছুটকিকে ও-ই পড়ায় নাকি আজকাল?

হ্যাঁ। ও পড়াশোনাতে কত ভালো তা জানো না বুঝি? পালামৌ ডিস্ট্রিক্টে সেকেণ্ড হয়েছিল স্কুল ফাইনালে। বি.এ.-তে সেকেণ্ড-ক্লাস থার্ড।

বি.এ. কীসে করেছিল জিতেন?

ইতিহাসে।

ইতিহাসে বি.এ. করে সরকারি ঠিকাদার।

ইয়েস। এই দেশটার নাম ভারতবর্ষ। পেটের জন্যে ভূগোলের এম.এ. জুতো পালিশ করে, সাহিত্যের এম.এ. মটন-রোল এর দোকান দেয়। এখানে শিক্ষা একটা প্রহসন।

তুমি কি জিজ্ঞেস করেছিলে কখনো মেয়ের কোনো সাহায্যের দরকার আছে কী নেই? কোন ক্লাসে পড়ে বলো তো ছুটকি? শেফালি বললেন ঘণ্টেবাবুকে।

ওই হবে, সিক্স বা সেভেন।

না। ক্লাস ফাইভে।

রাখো তো ওসব কথা। আর এই দ্যাখো। ইশ। খারাপ-ই হয়ে গেল বোধ হয় গরমে।

জিতেন বলল।

ওটা কী আবার?

শেফালি বলল, হাসিমুখে।

কেক। কেক। কলকাতার ‘ক্যাথলিন’ থেকে এনেছি। জন্মদিনে কি কেক না হলে চলে? এই দ্যাখো পঁয়ত্রিশটা মোমবাতি আছে। ছোট্ট ছোট্ট। সন্ধেবেলা কেক কাটবে। সাজুগুজু করে থাকবে। কী বলেন ঘণ্টেদা? আমি আসব। ছুটকির আর পাগলার ক-জন বন্ধুও আসবে। মাংসর চপ আর ঘুগনি নিয়ে আসব আমি। মা বানাচ্ছেন সারাদিন ধরে মুঙ্গুলীর সঙ্গে বসে। মাকে যে, বউদি তুমি কী জাদু করেছ তুমিই জানো।

মাসিমাকে প্রণাম করে আসতে হবে গিয়ে একফাঁকে।

হেসে বললেন, শেফালি।

ঘণ্টেদা, আপনি কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। বিকেল বিকেল।

হুঁ।

ঘণ্টেবাবু বললেন।

তারপর বললেন, আমি তাহলে চানটা সেরেই নিই। তুমি বোসো। ওকে একটু শরবত টরবত।

না, না। তবে আদা-লবঙ্গ দিয়ে এককাপ চা যদি করে দিতে পারো বউদি, তাহলে খাব। তোমার চায়ে যে, কী মিশিয়ে দাও তা তুমিই জানো। মা রোজ বলে আমাকে। বলে, আমার চা মুখে রোচে না তো, যা না শেফালির কাছে গিয়েই খা। যা রেগে যায় না মা!

শেফালি বলল, ছিঃ! মাকে এসব ব্যাপারে দুঃখ দিতে হয়? আর তোমার মায়ের মতো মা।

মস্ত এবং লম্বাটে উঠোনের অপর প্রান্তের কুয়োতলায় গিয়ে লাটাখাম্বা নামিয়ে দিয়ে বালতিতে জল তুলে ঝপাঝপ করে মাথায় ঢেলে তারপর একবালতি জল তুলে কুয়োর বাঁধানো গোলাইতে বসে সাবান মাখতে লাগলেন ঘণ্টেবাবু মনোযোগ সহকারে। পায়ের ব্যথাটা এখনও আছে।

পেঁপেগাছের ডালে বসে দাঁড়কাকটা আবারও ডাকল। বড়ো কর্কশ, অলক্ষুণে ডাক এই দাঁড়কাকেদের।

জিতেন রান্নাঘরের দরজায় মোড়া পেতে বসেছে গিয়ে। শেফালির কাছে। উনুনের আঁচে শেফালির মুখটাকে ও দেবীপ্রতিমার মতো দেখে।

বাড়িতে কেউই থাকে না, এই সময়ে। ঘণ্টেবাবু ছুটিতে আছেন, তাই।

ঘণ্টেবাবু সাবান মাখতে মাখতেই ব্যাপারটা লক্ষ করলেন। ওঁর তো মনোয়া-মিলন’-এই থাকার কথা ছিল। এই ছেলেটা সব খবর-ই রাখে। শেফালিই দেয় নিশ্চয়ই। নইলে এই সময়ে আসবে কেন? ওঁর কোনো আসক্তি বা বিরক্তি কিছুই আর নেই। শারীরিক ব্যাপার শেফালির সঙ্গে বহুবছর হলই নেই। ওঁর কোনো তাগিদ-ই নেই। সেদিন বিড়ি কোম্পানির পেঁচো বলছেল, ডায়াবিটিস হলে, তাগিদ কমে যায়। উপেও যায় নাকি। একবার রক্তটা আর ইউরিনটা চেক করাতে হবে। ভাবেনও করাবেন। কিন্তু হয়ে ওঠে না। পয়সাও লাগবে অনেক। তবে রোগাও হয়ে যাচ্ছেন। পিপাসাও বোধ করেন আজকাল খুব। একটুতেই ক্লান্ত হয়ে যান। মেজাজও বড়ো খিটখিটে হয়ে গেছে। করতে হবে, কিছু একটা।

ব্যাগ থেকে একটি শাড়ি বের করে জিতেন গলা নামিয়ে বলল, এই শাড়িটা পরবে কিন্তু সন্ধেবেলায় চান-টান করে। আর এই নাও।

কী?

সাবান। এই সাবান দিয়ে চান করবে। তোমার চান করে-ওঠা গায়ের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে।

এই নাও।

তুমি কি পাগল। এটা কী?

সেন্ট। দিশিই! বিলিতি পেলাম না।

আমার ভীষণ খারাপ লাগে জিতু।

কেন?

তুমি কেন, আমাকে এতকিছু দাও? তুমি কি খুব বড়োলোক?

বড়োলোক কি মানুষ পয়সাতে হয়? বড়োলোক হয় মন’-এ! আমি তো বড়োলোক-ই। মস্ত বড়োলোক।

তোমাকে আমি তো কিছুই দিতে পারি না। তবে তুমি কীসের জন্যে দাও এতকিছু?

আমি তো কিছুই চাইনি তোমার কাছে কখনো। এখনও চাইনি। যা পাই তাতেই তো ভীষণ খুশি থাকি।

যখন চাইবে? মানে যদি চাও, তখনও তো দিতে পারব না।

তখনকার কথা তখন-ই হবে। কিন্তু তুমি তো কিছু কমও দাও না আমাকে বউদি।

তুমি যা দাও, তার কণামাত্রও তত ফেরত দেবার ক্ষমতা আমার নেই।

তুমি আমাকে যত বোকা ভাবো অত বোকা আমি নই। সবাই কি সব জিনিসের দাম বোঝে? আমি বুঝি।

তুমি একটু হস্তিমূর্খ। ডালটনগঞ্জ শহরে শয়ে শয়ে সুন্দরী কুমারী মেয়ে তোমার অপেক্ষায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তুমি এই বুড়ির জন্যে যে…

খবরদার। তুমি বুড়ি! আর কী দেখেছি সে, আমার চোখ-ই জানে। চোখ তো প্রতিদিন কত নারীকেই দেখে। পথে ঘাটে, বাজারে দোকানে বাসে ট্রেনে, স্টেশনে স্টেশনে অফিসে, অন্যের বাড়িতে কিন্তু সকলকেই কি ভালো লাগে! তবে, কখন, কোন জায়গায় কার যে, কাকে ভালো লেগে যায় তা শুধু বিধাতাই জানেন। এসব কথা থাক। এখন চা-টা দাও। খেয়ে পালাই। তুমি না বললে আমাকে যে, ঘণ্টেদা বৃহস্পতিবার ফিরবেন। মানে আগামী বৃহস্পতিবার। ইশ এক্কেবারে কট-রেডহ্যাণ্ডেড।

কথা তো তাই ছিল। অনেক আগেই ফিরে এসেছে।

আবার কবে যাবেন?

কথা আছে, পরশু।

তাই?

হ্যাঁ। কিন্তু তাতে তোমার কী? বেল পাকলে কাকের কী?

কাকের কী? তা পরজন্মে কাক হয়ে জন্মিয়ে, তাহলে জানতে পাবে। বেল পাকলে কাকের কী’ –এই প্রবাদ মানুষের-ই বানানো। পাকা-বেলের মোটা আস্তরণে ঠোকর মেরে মেরে কাকের ঠোঁটের যে, কী সুখ হয় তা শুধু কাক-ই জানে। মানুষে কী জানবে! মানুষের মতো সবজান্তা জ্ঞানীও বিধাতা আর বানাননি। সর্বজ্ঞ একেবারে।

তোমার ক্যাসেট-প্লেয়ারটা রাখতে পারব না।

কেন?

অশান্তি হবে।

তা হোক।

আমি ইনস্টলমেন্টে কিনেছি। ফিলিপস-এর একজন বড়ো অফিসার আমার এক বন্ধুর দাদা। উনি সস্তাও করে দিয়েছেন অনেক।

যারা সব জিনিস-ই সস্তায় চায় তাদের আমার ভালো লাগে না। তারা নিজেরাই সস্তা।

তোমাকে তো সস্তায় চাইনি। তোমার দাম আমি বুঝি। এটা ব্যবহার কোরো। প্রতিমাসে তোমাকে দুটো করে ক্যাসেট এনে দেবে।

চা খাও।

লাটাখাটা বড়ো কাঁচকোঁচ শব্দ করে। সাবান দেওয়া হয়ে গেলে আবারও দু-বালতি জল তুলে স্নান করলেন ঘণ্টেমামা। মনে হচ্ছে কোথায় যেন, ময়লা লেগেছে। শরীরের কোথাও তো দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু লেগেছে অবশ্যই। ঘিনঘিন করছে গা। মনটা খিঁচিয়ে রয়েছে ঘণ্টেবাবুর।

জিতেন বলল, আমি এখন আসছি। সন্ধেবেলায় আসব। তুমি পাগলাকে একটু পাঠিয়ে দেবে। দু-জনে মিলে নিয়ে আসব। চপগুলো মা গড়ে দেবেন। তুমি শুধু গরম গরম ভেজে নেবে এখানে। তেলও নিয়ে আসব আমি সিলড টিন। আজ না হয় আমিই ভেজে দেব। তোমার জন্মদিন। সেজেগুজেরান্নাঘরে ঢুকলে তুমি ঘেমে-নেয়ে যাবে। টিনের চালের রান্নাঘর।

বলেই, বলল, চললাম বউদি। শুভ জন্মদিন।

রান্নাঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে জিতেন গলা তুলে বলল, চলি ঘণ্টেদা। বিকেলে দেখা হবে।

আচ্ছা।

রান্নাঘরের দিকে স্নান করে গামছা ছেড়ে নতুন লুঙ্গি পরে হঠাৎ-ই ঘণ্টেবাবু ভূতগ্রস্তর মতো মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন।

এসেই বললেন, আমাকে খেতে দাও। আজ এখুনি খেয়েই যেতে হবে বিড়ি কোম্পানিতে। একটা জরুরি খবরের অপেক্ষাতে আমি। ঝিঁঝির বিয়েটা এখানে না-হলে, আমার এক্সটেনশানটাও হয়তো হবে না। তখন কী যে, হবে!

বলেই বললেন, ওটা তো ক্যাসেট-প্লেয়ার। আর ওটা কী?

শাড়ি।

আর ওটা?

সেন্ট।

সেন্টও?

আর ওটা?

ওটা সাবান।

হ্যাঁ। তুমি কি ও ছোকরার রাঁড়?

হঠাৎ মাথায় রক্ত চড়ে গেল ঘণ্টেবাবুর।

শেফালি বললেন, দ্যাখো, ভদ্রলোকের মতো কথা বলে। তুমি কোনোদিন হাতে করে এতবছরে আমার জন্যে একটি জিনিসও এনেছ? নিজের পছন্দের খাবার ছাড়া?

চুপ করো তুমি। ভদ্রতা শেখাচ্ছ আমাকে? রাঁড়ের সঙ্গে কে আর কবে ভদ্রলোকের মতো কথা বলেচে! তুমি ঘরে বসে বেশ্যাবৃত্তি করবে আর আমি চুপ করে থাকব?।

মুখ সামলে কথা বলল। যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বোলো না। ভালোবাসার তুমি কী বোঝা? এখন না হয় বুড়ি হয়েছি, যৌবনেও কি বুঝতে?

না, তা আমি কী করে বুঝব? সব বোঝে তোমার নাগর। ও ছোকরাকে বলে দিয়ে আর একদিনও যদি ও ঢোকে আমার বাড়িতে তাহলে আমি মেরে ওর মাথা ফাটিয়ে দেব। দাঁত ভেঙে দেব।

ইশ কত্ত সাহস। মেরে দ্যাখোই না। ওর গায়ে হাতে দিয়ে দ্যাখো একবার।

কী! এত্ত সাহস। রাঁড়-এর আবার এতবড়ো মুখ? দাঁড়াও তোমার নাগর নয়, তোমাকেই দেখাচ্ছি। বলেই, তেড়ে গিয়ে ঘণ্টেবাবু জোরে মারলেন এক চড় শেফালিকে। শেফালি প্রায় মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিলেন কিন্তু পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে রান্নাঘর থেকে খুন্তিটা তুলে নিয়ে ধেয়ে গেলেন তাঁর স্বামীর দিকে। তাঁর মাথার ঠিক ছিল না।

প্রথমে ওই রণরঙ্গিণী মূর্তি দেখে ঘণ্টেবাবু একটু পেছিয়ে গেলেন। তারপর নিজের প্রাণ বাঁচাতেই খুন্তিটা শেফালির হাত থেকে কেড়ে নিলেন। নিয়েই কান্ডজ্ঞানরহিত হয়ে খুন্তিটা চেপে ধরলেন শেফালির দুর্মর ঠোঁট দু-টির ওপর। এবং খুন্তির ধার সম্বন্ধে তাঁর কিছুমাত্রও জ্ঞান ছিল না বলেই শেফালির ওপর এবং নীচের ঠোঁট দু-খানি প্রায় দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। রক্তে শাড়ি জামা ভেসে যেতে লাগল।

শেফালির ওই রূপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে ঘণ্টেবাবু নিজেই গ্যাঁদা ঝোঁপের কাছে গিয়ে অনেকগুলোপাতা ছিঁড়ে দু-হাতে কচলে গ্যাঁদার রস লাগিয়ে দিতে গেলেন নিজে হাতে স্ত্রীর ঠোঁটে। কিন্তু এক ঝটকা মারলেন শ্রীমতী। বলতে গেলেন, তুমি আমাকে ছোঁবে না, ছোঁবে না। কিন্তু নাক দিয়ে খোনা, নাকি-নাকি স্বর বেরোল, চোঁবে না চোঁবে না। ঝটকা-মারা সত্ত্বেও ঘণ্টেবাবুর দশাসই নড়াতে না পেরে হালকা ছিপছিপে শেফালি নিজেই পড়ে গেলেন রান্নাঘরের বারান্দাতে। পড়ে যেতে, কপালেও খুব লাগল।

দাঁড়কাকটা তখনও পেঁপে গাছের ডাল ছেড়ে উড়ে যায়নি। সে ভাবছিল, মানুষ-মানুষী কত অসহায়। কী করুণ তাদের অবস্থা। বেশ আছে, সে কাক আছে। এই মানুষদুটোর দু জনেরই কারো-ই কোনো দোষ নেই। অথচ যা-ঘটল তা না ঘটলেই বায়সবাবু খুশি হতেন। কিন্তু ঘটল।

এক একজন মানুষের এককরকম বাসনা-কামনা, চাওয়া-চিন্তা, কিন্তু সেই বাসনা-কামনা, চাওয়া-চিন্তা পূরিত হয় কতজনের? পাকা-বেল নিয়ে মানুষ কাকেদের ঠাট্টা করে অথচ মানুষেরা নিজেরা কি জানে যে, পাকা বেল নিয়েই তাদের সকলের-ই কারবার!

জামাটা গায়ে গলিয়ে, মাথায় চিরুনির দু-চকিত থাপ্পড় কষিয়ে, ঘণ্টেবাবু খররোদে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

শেফালি রান্নাঘরের দাওয়াতে রক্তাক্ত হয়ে পড়েই ছিলেন। হয়তো বা জ্ঞানও হারিয়ে থাকবেন। কিন্তু ঘণ্টেবাবুর শেফালির প্রতি, কিছু কম ভালোবাসা ছিল না জিতেনের চেয়ে। কিন্তু ভালোবাসার বড়ো অধিকারবোধ আছে। সকলের ভালোবাসার-ই। সেই অধিকার-বোধে ধাক্কা লাগলে গভীর ভালোবাসাও প্রলয়ংকরী ঘৃণাতে রূপান্তরিত হতে পারে, একমুহূর্তে।

পায়ের ব্যথার জন্যে সাইকেল এখনও চালাতে পারেন না ঘণ্টেবাবু।

আস্তে আস্তে ধুলোর মধ্যে হেঁটে যাচ্ছিলেন পা টেনে টেনে, বিরক্ত, ক্ষুধার্ত, রিক্ত, বঞ্চিত খোঁড়া-গোরুর মতো। কাছারির সামনে লম্বুবাবুর সঙ্গে দেখা। বহুদিনের জান-চিন। তিনি রসিক মানুষ। গাড়ি করে একবার রাঁচিতে যাচ্ছিলেন, জিপ গিয়ে সোজা সেঁধিয়ে যায় চাস রোদে পেছনের আলো জ্বালিয়ে-না-রাখা পার্ক-করা একটা ট্রাকের পেছনে। বাঁ-পাটি হাঁটুর নীচ থেকে ভেঙে যায়। ক্রাচ নিয়ে চলেন। কিন্তু তাঁর মনের ফুর্তি কমেনি একটুও।

লম্বুবাবু স্বভাবসিদ্ধ রসিকতকায় বললেন, কী হল ঘণ্টে? এই দুপুরে? বিড়ি বাঁধতে চললে নাকি? বউ কি আজ ভাত রাঁধেনি? খাবার টাইমে এমন বিবাগি?

হঠাৎ-ই ঘণ্টেবাবু, তেলে-বেগুনে জ্বলে-উঠে বললেন, আমার তো বউ আছে একটা। তোর তো…। আজ যাসনি? রাঁড়ের বাড়ি?

ঘণ্টেবাবু এমনিতে নির্বিরোধী মানুষ। কখনো মুখ খারাপ করেন না। কিন্তু রসিক লম্বুবাবুও কাছারির পথে অন্য দশটা লোকের সামনে অমন বিনা কারণে অপমানিত হয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বললেন, জিতেন রয়েছে বুঝি তোর বাড়িতে এখন? তাই ল্যাজ গুটিয়ে পাইল্যে এলি। তুই শালা পুরুষ! বউ বেচে খাস।

ঘণ্টেবাবু বিদ্যুৎস্পৃষ্টর মতো বললেন, আজকে ঘাঁটাস না আমাকে লঘু। খুন হয়ে যাবি আমার হাতে। আমার মন ভালো নেই।

হ্যাঁ মন আর ধন যেন, শালা তোর একার-ই আছে। আমি তো আর পুরুষ নই।

ধন থাকলেই পুরুষ হয় না।

দু-জনেরই যে, ভোকাবুলারির জোর এমন তা দু-জনেরই জানা ছিল না!

যা। যা! মেলা জ্ঞান দিস না। যা, বিড়ি বাঁধগে যা দাঁড়া তোকে আমি ফিট করছি।

অভুক্ত, ঘণ্টেবাবু কিন্তু কোম্পানির দিকে গেলেন না। ধীর, আহত পায়ে, খোঁড়া-গোরুর মতো এগোতে লাগলেন জিতেনের বাড়ির-ই দিকে। আশ্চর্য!

যখন পৌঁছোলেন, পোঁছোতে সময় লাগল অনেক-ই, সাইকেল-রিকশা নিতে পারতেন কিন্তু সামর্থ্যে কুলোয় না তাই পা দু-টিকে টেনে টেনে ধুলো-পড়া পথে হেঁটে গেলেন অতখানি পথ। জিতেন তখন খেতে বসেছিল। ছোকরা চাকরটা বলল, বসুন বাবু। জিতুবাবু খাচ্ছেন। আপনার কী হয়েছে বাবু? চোখ দুটো লাল।

ঘণ্টেবাবু বললেন, না। আমি ওই পিপ্পলগাছটার নীচে দাঁড়াচ্ছি। তুমি খবর দিয়ো জিতেনকে। বসব না।

জিতেন এঁটো-হাতেই দরজাতে এসে একবার দেখল, পিপ্পলগাছের নীচে দাঁড়ানো ঘণ্টেবাবুর দিকে। তারপর সময় একটুও নষ্ট না করে, এঁটো হাতেই এল ওঁর কাছে। গাছতলায় একটা চায়ের আর পান-বিড়ির দোকান ছিল। সেখানে কয়েকজন লোক বসে দাঁড়িয়েছিল। ঘণ্টেবাবুকে একটু পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে জিতেন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? দাদা? আপনার মুখ-চোখ এমন কেন?

ঘণ্টেবাবু, কেউ শুনল কি না তার তোয়াক্কা না করে, যেন প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যেই বললেন, তোমার বউদিকে আমি মেরেছি। ঠোঁট দুটো কেটে দু-ফাঁক হয়ে গেছে। মাথাও ফেটে গিয়ে থাকবে।

হতবাক হয়ে জিতেন বলল, মেরেছেন! কিন্তু কেন?

মারটা তোমাকেই মারতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পাকে-চক্রে শনি ভর করেছিল আমায়। মারটা খেল শেফালিই।

তা, আমার মারটা কবে হবে?

হবে। পরে হবে। এখন তাড়াতাড়ি ডাক্তার নিয়ে যাও। যদি তুমি শেফালিকে সত্যিই ভালোবাসো।

আর আপনি?

আমি কোম্পানিতে যাব। কাজ আছে। আমার কী? সে তো তোমাকেই ভালোবাসে। আমার কী দায়? তুমিও তো তাকে ভালোবাসো। কী? অস্বীকার করতে পারো কি, সে-কথা?

আমি বউদিকে ভালোবাসি। কিন্তু আপনি বাসেন না? বলুন?

বাসি। কিন্তু সে বোঝে না।

বোঝেন। ঠিক-ই বোঝেন।

ভালোবাসার অনেক পরত থাকে জিতেন। পুরোনো ভালোবাসা একদিন মলিন হয়ে যায়, ফিকে হয়ে যায়; ইমারতের রঙের মতো, তার ওপরে নতুন করে চুন ফিরোতে হয়। নতুন হয়ে ওঠে বলেই, পুরোনো যে, যা; তা বাতিল না হলেও; চাপা পড়ে যায়। আমিও চাপা পড়ে গেছি জিতেন।

বলেই, তাড়াতাড়ি বললেন, এই কথাটা যদি আমি স্বীকার করতাম তবে, তোমার বউদির গায়ে হাত দিতাম না। বিশ্বাস করো, কথাটা এক্ষুনি আমার মাথায় এল; এই রোদের মধ্যে হেঁটে আসতে আসতে। তা ছাড়া, কেই বা হারতে…

আপনি চলুন। খেতে বসবেন। আমি যাচ্ছি বউদির কাছে রামরিচ ডাক্তারকে নিয়ে।

নাঃ। খাব না। তুমি যাও।

খিদে পায়নি?

পেয়েছিল। এখন মরে গেছে। একটা দারুণ আবিষ্কার করলাম জিতেন একটু আগে। জান?

কী? মানুষের মনের প্রশান্ত-সাগরে কলম্বাসের অ্যামেরিকা আবিষ্কারের চেয়েও বড়ো আবিষ্কার।

বলেই, ঘণ্টেবাবু হাসলেন।

জিতেনের মনে হল, মাথা খারাপ হয়ে গেছে বোধ হয় ঘণ্টেদার। অথচ ঈশ্বরের দিব্যি। শেফালিকে শুধুমাত্র মনের সঙ্গই দিয়েছে। অন্য কোনো সম্পর্কই জিতু আর শেফালির মধ্যে ছিল না। সেই সম্পর্কর জন্যে মনের গভীরে প্রোথিত এক অদৃশ্য কাঙালপনা যে, দু-তরফেই ছিল না এমন কথা জোর করে বলতে পারে না ও। কিন্তু ভবিষ্যতে হয়তো কিছু হলেও হতে পারত, সেই ঘটনাই হয়তো ঘণ্টেদা নিজেই ত্বরান্বিত করে দেবেন আজকের এই ঘটনাতে।

কে বলতে পারে!

ভারি কষ্ট হতে লাগল জিতেনের শেফালির জন্যে। তার নিজের জন্যেও। এবং সবচেয়ে বেশি, ঘণ্টেদার জন্যে। জিতেনও একদিন ছেলে-মেয়ের বাবা হবে, স্ত্রীর স্বামী; তারও একদিন ষাটবছর বয়েস হবে। এবং তখন, তার মোটামুটি বিধিবদ্ধ নিরুপদ্রব জীবনে যদি, হঠাৎ কোনো জিতেনের আবির্ভাব হয় তাহলে সে কী-যে করবে তখন, তা জোর করে বলতে পারে না। ও শিক্ষিত। সবকিছু ‘নৈর্ব্যক্তিক যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করতে শিখেছে।

হাত ধুয়ে, সাইকেলটা বের করবার সময়ে জিতুর মা শুধোলেন, খাওয়া ফেলে কোথায় চললি?

শেফালি-বউদির খুব বিপদ। আজ বোধ হয় আর জন্মদিনটা করতে পারবেন না ওঁরা।

সে কী! ঘুগনি যে, হয়ে গেছে এক গামলা। চপও সব গড়া শেষ, কিশমিশ, আর চিনাবাদামও দিয়েছি ভেতরে তোর কথামতো, শেফালি ভালোবাসে বলে।

উত্তর না দিয়ে, সাইকেলটা নিয়ে দরজা খুলে জিতেন জোরে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল ঘণ্টেবাবুর পাশ দিয়ে। যেন, শেফালি ঘণ্টেবাবুর স্ত্রী নয়। জিতেনের-ই স্ত্রী!

দাঁড়াকাকটা তখনও বসেছিল পেঁপেগাছটার ডালে।

গাছ আর পাখিরা সব মানুষের সব, লুকোছাপা-দেওয়া ঘটনার সাক্ষী থাকে। অনেক সময়ে বেড়াল অথবা কুকুরেরাও থাকে।

ঘণ্টেবাবু বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই খোলা দরজা দিয়ে যে, পাটকিলে-রঙা কটা চোখের একটা বেড়ালনি ঢুকে বারান্দাতে রক্তের মধ্যে পড়ে-থাকা শেফালির পাশ কাটিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল, সেটা একটা বজ্জাত। মানুষের বা অন্য প্রাণীর ‘অসহায়তা’র সুযোগ যারাই নেয়, তারাই বজ্জাত।

কাকেদের চোখের মণিগুলি আজকালকার সাইন-পেনের রিফিলের ডগার মতো ঘোরে। ‘রোটেট’ করে। কাকটা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখছিল। কাক জঙ্গলে পাখি নয়। গ্রাম গঞ্জের কাছে-থাকা চিতাবাঘের-ই মতো মানুষের জীবনযাত্রার সব খুঁটিনাটিই তাদের নখদর্পণে। তা ছাড়া ওই কাকটা ত্রিকালজ্ঞও বটে।

জিতেন যখন, রামরিচ ডাক্তারের কাছে গেল, তখন সে সবে খেয়ে দেয়ে একটু শোবার বন্দোবস্ত করছে। সকালে রোগী দেখতে গেছিল রাংকাতে। একদম ‘থকে গেছে।

জিতেন তাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে, নিজেই তার ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে, তার নিজস্ব রিকশাতে রাখল।

বলল, খাতরা বন-গ্যায়া ইয়ার। ভাবিজিকে মারপিট কিয়া। বহুত খুনভি নিকলা। দাদা গ্যয়া কোতোয়ালিমে ডাইরি করেনেকো লিয়ে।

কওন অ্যাইসো কিয়া?

কোই ডাকু–বদমাশ হোগা। ম্যায় ক্যায়সা জানু?

রেপ তো নেহি না কিয়া?

আজীব আদমি হ্যায় তু ডাগদার। যানে সে, পুছনেসে, তবহি না পত্তা চলেগি। তু ডাগদার হো। দুসরেকি বিবি থোরি বাতায়েঙ্গি মুঝকো রেপকি বারেমে।

চাল। তেরা ভাবিজিনে আজ ছাতুকি লিট্টি বানায়ি থি। আজ শালা এহি ধুপমে লওটা-লওটা পানি পিতে পিতে ম্যায় মর যায়েগা। তেরা পেয়ারি ভাবিজি জান-পুছ কর আজ-ই রেপড হুয়ি। শালা দুসরি জনমমে ডগদার কভভি নেহি বনুঙ্গা।

চাল চাল। পানিকি ক্যা কম্মি। পানিসে নাহা দেখা তুঝকো, অব চাল তো জলদি রামরিচ।

জ্ঞান এসে গিয়েছিল কয়েক মিনিট পরেই শেফালির।

রাগ, দুঃখ এবং লজ্জাতে ওঁর ইচ্ছে করছিল মাটিতে মিশে যান।

এটা ঠিক যে, কিছুদিন হল একটু বাড়াবাড়িই করছিলেন, মানুষটির কী দোষ! রিটায়ার করবে। এক্সটেনশন পাবে কী পাবে না, এই চিন্তাতে ঘুম হয় না। পাগলা গতবারেই হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করেছে। আর ছুটকি তে ক্লাস ফাইভেই। যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন খেতে পেতেন না শেফালিরা। চারবোনের মধ্যে ও তৃতীয়। দিদিদেরও ওইরকমভাবেই পার করেছিলেন বাবা। বাবাও নিরুপায় ছিলেন। তবে এত ছেলে-মেয়ে কেন হয়েছিল মা-বাবার সে-কথা বড়ো হওয়ার পরে ভেবেছে। ওঁরা তো নিজেদের ইচ্ছেতে পৃথিবীতে আসেননি। অন্যর ইচ্ছেতে, অন্যের ক্ষণিকের সুখের-ফসল হিসেবে উপনীত হয়ে আশৈশব এই গ্লানির জীবন কেনই বা বইতে হবে? তা ভেবে পাননি। শেফালির একমাত্র দাদা গুণ্ডামি করতেন। সমাজ, সভ্যজীবনের সুযোগ দেয়নি। মারাও যান, একদিন পুলিশের গুলিতে। ওয়াগন ব্রেকারদের দলে ভিড়ে। সেই সময়ে এই মানুষটাই এই বিহারের ডালটনগঞ্জে সামান্য চাকরি করা ঘণ্টে মিত্তির-ই, বলতে গেলে, তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন এসে। না করলে তাঁর স্থান ‘সোনাগাছিতে’ও হতে পারত। কথাটা ভাবলেও বুক ধড়ফড় করে। বড়োলোক ছিলেন না কোনোদিনও। বিশেষ গুণও ছিল না কোনো। তবু ডাল-ভাত তত খাওয়াতেন। সৎপথের কামাই। মানুষটার অন্য দোষ কিছু ছিল না। আসলে চারিত্রিক ‘দোষ’ বলতে যা সাধারণত সাধারণে বোঝে, তা আসে অতি-স্বাস্থ্য এবং বৈচিত্র্য-প্রীতি থেকে। তা, মানুষটার নড়েবড়ে স্বাস্থ্যে আর একঘেয়ে জীবনের অভ্যস্ততায় সেইসব ঝামেলা’ কোনোদিন ছিল না। তাঁকে অন্য কোনো মেয়ের কখনো ভালো লাগেনি। সাতপাকে-বাঁধা পড়ে খোঁটায়-বাঁধা গোর আর চাষের বলদের মতো জীবন কাটিয়ে এসেছেন শেফালি এতদিন। সাচ্ছল্য যে কী, আর্থিক, মানসিক, শারীরিক; তা জিতেন-ই এসে বোঝায়। নইলে শেফালির মনে কোনো অভাব বোধ ছিল না। এই জীবনে জিতেন-ই এসে…

কিন্তু জিতেনকে যে, শুধু ভালোই লাগে শেফালির তাই নয়, জিতেনের জন্যেই শেফালি আজকে বেঁচে আছেন।

ঘণ্টেবাবু এক্সটেনশন না পেলে হয়তো জিতেনের সাহায্যেই প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ সংসার চালাতে হবে। ছেলে-মেয়ে দুটোও আছে। শুধু যে, ভালোলাগা-ভালোবাসাই ছিল জিতেনকে প্রশ্রয় দেওয়ার পেছনে তাও না, নিজের নিরাপত্তাবোধও হয়তো কাজ করেছিল অনবধানে।

অত্যন্ত ভালো করেই জানেন তা শেফালি।

উঠে, রান্নাঘরের দেওয়ালে মাথাটা হেলান দিয়ে বসলেন শেফালি। একবার ভাবলেন, আয়নায় গিয়ে দেখেন ঠোঁটের অবস্থাটা। পরক্ষণেই ভাবলেন, নিজের ভালোলাগা ভালোবাসার এমন রক্তাক্ততা নিজে চোখে দেখতে পারবেন না।

আসলে খুন্তিটা তো উনিই এনেছিলেন। দোষটা তাঁর-ই। খুন্তির ক্ষমতা জানার কথা তো ঘণ্টেবাবুর ছিল না। তা ছাড়া, এই প্রায় জড়ভরত, থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-ঘোড়, নিজের বউ-ছেলেমেয়ে-ময় ষাটবছরের মানুষটার বুকের মধ্যে তাঁর প্রতি এখনও এত ভালোবাসা আছে জেনেও অবাক হয়ে গেলেন শেফালি। ঘৃণা বা রাগ তো শুধু ভালোবাসা থাকলেই আসে! এই সরল কথাটা এর আগে এমন করে কখনো ভাবেননি বা জানেননি শেফালি!

মানুষটার আজ আর যৌবন নেই। এ-কথা ঠিক। এক নবীন, সচ্ছল, সুশ্রী, প্রেম-জর্জর যুবককে তাঁর স্ত্রীর এত ঘনিষ্ঠ হতে দেখে রাগ তো তাঁর হতেই পারে! সেই ঘনিষ্ঠতার রকম যাইহোক-না কেন!

ঠিক এইসময়েই জিতেন ঢুকল ডা. রামরিচ দুবেকে নিয়ে।

শেফালির পক্ষে কথা বলা মুশকিলও ছিল। রক্ত জমে গেছিল। উনি কিছু বলার আগেই জিতেন বলল, তোমার কথা বলতে হবে না বউদি! বদমায়েশরা ক-জন এসেছিল? একজন না বেশি?

অবাক হয়ে চাইলেন শেফালি জিতেনের দিকে।

আঙুল তুললেন। তর্জনী দেখালেন, এক।

একজন। যাকগে। দাদা গেছেন থানায় ডাইরি করতে। দাদার কাছেই শুনে আমি ডাক্তার নিয়ে এলাম। কিছু কি নিয়েছে? গলার হার, বা হাতের চুড়ি? অ্যাই তো! তোমার ডান হাতের বালা তো নেই। বুঝেছি। দেখেছ, কালশিরা পড়ে গেছে!

শেফালির সবসময়ে পরার মতো ছিলই মাত্র একগাছা বালা। বাঁ-হাতে পরত সেটি। ডান হাতে শুধুই শাঁখা।

শেফালি বুঝল, কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিন্তু সেটা যেন, তার স্বামীর বিরুদ্ধে না হয়, এটাই মনে মনে প্রার্থনা করছিল।

ঠিক সেই সময়েই কাকটা ‘কা-খা-কা-খা’ করে স্বগতোক্তি করল।

বলল, মানুষগুলিকে প্রাণী হিসেবে যত খারাপ ভাবতাম, আসলে তারা তত খারাপ নয়। এই প্রাণীদের এখনও ভবিষ্যৎ আছে।

.

বেলা পড়ে এসেছিল। ঘণ্টেবাবু পথে পথে অভুক্ত অবস্থাতে ঘুরে ঘুরে কী করা উচিত, কী করা কর্তব্য, কিছুই ঠিক করতে না পেরে, একটি সাইকেল রিকশা, জিতেনদের বাড়ির কাছ থেকেই ধরে, ওদের বাড়ি গিয়ে, জিতেনের মাকে বললেন, বউদি জিতেন আমাকে পাঠাল কীসব আপনি বানিয়েছেন তা নিয়ে যেতে।

বাঁচালে ভাই। আমি তো ভাবলুম সব ফেলাই যাবে। সময়মতোই এসেছ। এখুনি টিভিতে সিনেমা আরম্ভ হয়ে যাবে। তা কখনো-সখনো আসো না কেন? তোমার দাদা থাকতে তো…। তোমাকে পথ দিয়ে যেতে দেখি, ক্কচিৎ-কদাচিৎ। একদিন এসো। শেফালি অবশ্য আসে মাঝে-মাঝেই।

নানা ঝামেলাতে থাকি। রিটায়ার করার সময়ও হয়ে এল।

অবশ্য তোমাদের সব খবর-ই পাই জিতেনের কাছে। বড়ো লক্ষ্মীবউ পেয়েছ তুমি ভাই! এমন রূপগুণের মেয়ে পুরো ডালটনগঞ্জে একজনও নেই। আর কী ভালো যে, গান গায়। পুরোনো দিনের গান, আজকালকার গান। আমি আবার গান পাগল যে!

গান গায়? আমার স্ত্রী?

কথাটা পুনরাবৃত্তি করতে গিয়েও চেপে গেলেন ঘণ্টেবাবু।

ফুলশয্যার রাতে যে-গান শুনেছিলেন তাই। গান-ফান ওঁর ভালোও লাগে না। জঙ্গলে জঙ্গলে থাকেন। ওসব বিলাসিতা তাঁর জন্যে নয়। শেফালি তো কই, কখনো তাঁকে গান শোনাননি! অবশ্য শুনতে না চাইলে শোনাবেন-ই বা কেন!

বউদিই সব গুছিয়ে-গাছিয়ে দিলেন।

ঘণ্টেবাবু দেখছিলেন, বউদির বয়স প্রায় তাঁর মতোই হবে। এবং বউদি এখনও যথেষ্ট সুন্দরী। হঠাৎ ওঁর মনে হল, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে, আজকে ওঁর সংসারে জিতেনের যে-ভূমিকা, ঠিক সেই ভূমিকা তাঁরও হতে পারত এই সংসারে।

জিতেনের অনেক-ই গুণ আছে। ওঁর কোনোক্রমে একটি চাকরি করে বনে-বাদাড়ে পড়ে থেকে কোনোক্রমে সংসার প্রতিপালন করে ওঁর মধ্যে জীবনের কোনোক্ষেত্রেই উপচে দেওয়ার মতো যৌবন, রূপ বা গুণ কোনোদিন ছিল না। যা হওয়ার নয়, তা হয়নি। জিতেনকে ঈর্ষা করাটা শুধু মূর্খামি নয়। বড়ো দৈন্যেরও কথা। নীচতা।

ঘণ্টেবাবু যখন, নিজের বাড়ির সামনে সাইকেল রিকশা থেকে নামলেন, পাতলা চাদর ঢাকা-দেওয়া গড়া-চপ-এ-ভরা মস্ত বারকোশ আর ঘুগনির হাঁড়ি নিয়ে, তখন ছুটকি দৌড়ে এসে বলল, বাবা! জানো আজ আমাদের বাড়ি ডাকাত পড়েছিল। মাকে কীরকম মেরেছে। একেবারে রক্তারক্তি।

ডাকাত? বলিস কী রে?

হ্যাঁ বাবা। একজন বদমাশ ডাকাত।

বলেই বলল, এগুলি কী বাবা?

আজ যে, তোদের মায়ের জন্মদিন।

হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমরা তো জানিই। জিতুকাকু তো বলে রেখেছিল।মা যে, বিকেলে কেক কাটবে না বলছে! জিতুকাকুর এনে-দেওয়া নতুন শাড়িও পরবে না।

পরবে রে পরবে। পাগলা গেল কোথায়? দাদাকে ডাক। এগুলি সব নামাতে হবে। তোদের বন্ধুরা আসবে কখন?

এসে পড়বে।

তোর জিতুকাকু কোথায়?

কোতোয়ালিতে ডায়েরি লেখাতে গেছে। তুমি কোথায় ছিলে?

আমি?

কী উত্তর দেবেন, ভেবে পেলেন না ঘণ্টেবাবু।

শোওয়ার ঘরে, খাটের ওপরে শুয়ে ছিলেন শেফালি। ঘরে ঢুকে, ধারে কাছে কেউ নেই দেখে নিয়ে, ছেলে-মেয়েরা রান্নাঘরে সব গুছিয়ে রাখছিল; ঘণ্টেবাবু বললেন, আমাকে ক্ষমা কোরো। এই কান ধরছি।

শেফালি কেঁদে ফেললেন। তারপর-ই বিছানা থেকে উঠে, হঠাৎ-ই ঘন্টেবাবুর মচকানো পায়ে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।

ওঠো ওঠো। করো কী তুমি! ইশ। কী অবস্থা করেছি তোমার। আমি একটা পাষন্ড।

তারপরে কেউ কোনো কথা বললেন না কয়েক মুহূর্ত।

দাঁড়কাকটা কোথা থেকে ফিরে এসে, মহোল্লাসে ডাকতে লাগল ‘খবা-খবা-খবা-খবা’।

ডেকেই, উড়ে চলে গেল।

যেন বলে গেল, ভালো থেকো মানুষেরা, সুখে থেকো; মঙ্গল হোক সকলের।

ঘণ্টেবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে পাগলা, ছুটকি, রান্নাঘরে শেকলটা দিতে ভুলিস না।

হ্যাঁ বাবা। বেড়াল তো ভাত-ডাল খেয়ে গেছে দুপুরে এসে।

ঘণ্টেবাবু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

মনে মনে বললেন, ভয় এই বেড়ালগুলোকেই।

এমন সময় জিতেন এল।

এসো এসো জিতেন। এসো। আজ তুমি না থাকলে, কী যে, হত! তুমি জানলে কী করে?

আমি তো প্রায়-ই আসি বউদির সঙ্গে গল্প করতে দুপুর-বেলায়। ঘর ফাঁকা হলেই সুড়ৎ করে-ঢাকা বেড়ালের-ই মতো। কিন্তু আজ এসেছিলাম ভাগ্যিস। না এলে, কী হতে পারত বলুন তো ঘণ্টেদা! এতক্ষণ তো পড়োশিরাও সকলে ছিলেন। এই তো গেলেন সব একে একে। ডালটনগঞ্জ জায়গাটাও কলকাতা-দিল্লি-মুম্বাই হয়ে উঠল। ছিঃ।

আমি একটু আসছি। তুমি বোসো তোমার বউদির কাছে। নতুন শাড়ি পরবে না বলেছেন নাকি? দ্যাখো তুমি। তোমার কথা শোনেন।

ঘণ্টেবাবু চলে যেতেই জিতেন বলল, শাড়িটা পরে ফ্যালো বউদি। একটু সাজো। যাও, তাড়াতাড়ি চান করে এসো। আমি চপ ভেজে দেব।

শেফালি বললেন, যা সুন্দর ছিল, পবিত্র ছিল, যা, ঘিরে এত স্বপ্ন ছিল আমার, সব আজ নোংরা হয়ে গেল। অথচ, তারজন্যে তুমি একটুও দায়ী নও।

চুপ করে থাকল জিতেন।

শেফালি বললেন, তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো জিতু?

তুমি…। হঠাৎ আজ এই প্রশ্ন?

আমার জন্মদিনে আমাকে একটি উপহার দেবে?

কী?

কথা দাও যে, আমার সঙ্গে তুমি আর কোনো সংশ্রব রাখবে না। তোমার জন্যে দারুণ মেয়ে দেখেছি আমি। নাম, ঝিঁঝি। পছন্দ?

তোমার ঘণ্টেমামা তার বিয়ের জন্যেই দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছেন মনোয়া-মিলনে। তুমি ওঁর সঙ্গে চলে যাও। নিজে দেখে এসো। খুব বড়োঘরের মেয়ে। পড়তি ঘর। মাসিমার খুব পছন্দ হবে। গান জানে। শিক্ষিতা। সুরুচিসম্পন্না।

জিতু চুপ করে রইল।

কী হল? কথা দাও দাও কথা।

জিতেন ঘর ছেড়ে উঠে চলে গেল।

ঘণ্টেবাবু বললেন, কী হল হে? তোমার বউদি কী বললেন?

জিতেন বলল, যে-ডাক্তার বউদিকে দেখতে এসেছিলেন, রামরিচ দুবে, তাঁর স্ত্রীর খুব অসুখ। আমার যেতে হবে এখুনি। কাউকে বলবেন চপগুলো ভেজে নেবেন। পরে যোগাযোগ করব আমি ঘণ্টেদা। বউদিকে খাওয়ার পরে ওষুধ খেতে হবে, ঠোঁটে ওষুধ লাগাতে হবে। মনে করে সব…চলি।

ঘণ্টেবাবু কিছু বলার আগেই জিতু চলে গেল।

শেফালি বুঝতে পারলেন সব। উনি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন অনেক কথা। ইফফাত আরা খান আঙুরবালার একটি গান গেয়েছেন ক্যাসেটে শুনতে।

‘প্রেম-পূজা আজি সাঙ্গ করেছি, প্রতিমা ফেলেছি ভাঙিয়া
বাসনাকুসুম হৃদয়ে যা ছিল সকলি দিয়েছি জ্বালিয়া—’

কার লেখা কে জানে? সম্ভবত নজরুল-এর।

.

রাত গভীর। হঠাৎ কীসের ডাকে যেন, ঘুম ভেঙে গেল শিরীষের।

প্রথমে বুঝতে পারেনি কীসের ডাক। অনেক সময়ে সত্যি কোনো শব্দ নয়, শব্দহীন কোনো ডাকে, কারো ডাকে, এমনি করেই, আজ রাতে শিরীষের যেমন ভাঙল, তেমন করেই ঘুম ভেঙে যায় সব মানুষের-ই।

‘মানুষ’ বলেই, মানুষ অন্য মানুষের শুধু মুখের ডাক-ই নয়, মনের ডাকও শুনতে পায়। এই কষ্ট বা আনন্দ মানুষ হয়ে জন্মানোর অগণ্য কষ্ট বা আনন্দের মধ্যে বিশিষ্ট। যাঁরাই শুধুমাত্র মানুষের অবয়বের প্রাণী নন, মনুষ্যপদবাচ্য প্রাণী, তাঁরাই এই চাপা, প্রতিকারহীন কষ্ট বা আনন্দের কথা জানেন।

ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘুম ভেঙে গেল ঝিঁঝির, ঘুম ভেঙে গেল গুঞ্জনের, ঘুম ভেঙে গেল জিতেনের ডালটনগঞ্জে। এবং ঘন্টেমামারও। ঘণ্টেমামার স্ত্রী শেফালিরও ভাঙল ঘুম। তখন রাত নিঝুম।

বাহ্যিক, শ্রবণ-জগতের কোনো-না-কোনো শব্দ হয়তো সেইমুহূর্তে প্রত্যেকের কানেই গিয়েছিল। কিন্তু সেটা নিতান্তই গৌণ। ঘুম ভাঙল প্রত্যেকের-ই, চৈত্র-শেষের গভীর রাতের, না-গরম না-ঠাণ্ডার শান্তির ঘুমের অশান্তি ঘটিয়ে, কারণ, তারা মানুষ, তাই। মানুষমাত্রেরই বড়োই অশান্তি।

একটা কাল-পেঁচা ডাকছিল পাহাড়তলি থেকে। কাল-পেঁচার গুরু-গম্ভীর ডাক বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটোতে থাকে। যারা এই ডাক শোনেনি কখনো তারা ভয়ে কুঁকড়ে যাবে। কাল পেঁচা, অত্যন্ত গভীর বনের বাসিন্দা। এই পেঁচাটা এখানে থাকে না। কোনো কোনো বছরে, এই সময়টাতে কোথা থেকে যেন, উড়ে আসে এবং মাসখানেক থেকে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। যেমন ক্কচিৎ আসে এবং চকিতে চলে যায় নীল-টোংড়ির শিমুলচুড়োর নীল পাখিরা, তেমন-ই। অবশ্য তারা আসে যুগের পর একবার। অনেক বছর ঘুরে।

সাধারণ পেঁচার ডাক সন্ধের পর-ই প্রায় রোজ-ই শোনা যায়। কিচি-কিচি-কিচির’ শব্দ করে ডাকতে ডাকতে, উড়তে উড়তে তারা চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে ঝগড়া করে। নিত্যদিন কখনো-কখনো কোনো দুধলি চাঁদের রাতে গরিব গৃহস্থর মনে অনেক সুখ-কল্পনা জাগিয়ে দিয়ে ধবল লক্ষ্মীপেঁচা উড়ে এসে বসে। বাড়ির-ই কোনো গাছে। ছমছম করে জ্যোৎস্না। ঝমঝম করে গরিব গৃহস্থর সাচ্ছল্যর আশা তার দুরুদুরু বুকের মধ্যে। কখনো তার সাচ্ছল্যর সুখ-কল্পনা সত্যি হয়। অধিকাংশক্ষেত্রেই হয় না। তাতে লক্ষ্মীপেঁচার কিছুমাত্রই যায় আসে না। ঈশ্বরের বা খোদার-ই মতো। তাঁরা ভালো করলেও সাধারণ মানুষে তাঁদের মান্য করে, খারাপ করলেও করে। তাঁরা দুজ্ঞেয় বলেই তাঁরা অবশ্যপূজ্য, প্রণম্য। ভক্তির সঙ্গে ভয়ও জাগিয়ে রাখেন বলেই, তাঁরা নিয়ত-স্মর্তব্য।

কাল-পেঁচা ডাকে, তার ডাক অনুরণিত হয় পাহাড়ে পাহাড়ে, বনে বনে, পাহাড়তলি যেখানে গড়িয়ে গিয়ে পশ্চিমে, অদেখা; বিস্ময় এবং ভয় জাগানো মস্তিষ্কের মধ্যে জমা-থাকা বিচিত্র সব নামের বনে গিয়ে মিশেছে, সেদিকে গড়িয়ে যায়। ভাইষালোটান, গিমারিয়া, চাহাল-চুঙরু, ইটখোরি-পিতিজ, রাংকা বনগাঁওয়া, কাঠকামচারি ইত্যাদি ইত্যাদি সব অরণ্য, ভূগোলের সব জ্ঞান ও নির্দেশ অমান্য করে অথবা বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এর প্রতীকী, লবটুলিয়া, নাড়া বইহার গহন-বনের মধ্যের সরস্বতী-কুন্ড, ইত্যাদির-ই মতো মনের মধ্যে জেগে-থাকা চিরকালীন সব আরণ্যর স্তব্ধ, সতত-অপস্রিয়মাণ দিগন্তের দিকেই গড়িয়ে যায়। আধো-ঘুমে, আধো-জাগরণে বুনোমোষেদের দেবতা, তখন কল্পনায় চোখের সামনে শিং নাড়ানো, অতিকায় বন্য-মহিষের পিঠে-বসা ‘টাঁড়বারো’, এসে দাঁড়ান। প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আবাস গুহাগাত্রের, আশ্চর্য ম্যাঙ্গানিজ-আকরের রঙের মতো লাল রঙে আঁকা সব ছবির প্রাগৈতিহাসিক জানোনায়ারেরা, আর উলঙ্গ, নয়তো পশুচর্ম-পরিহিত নৃত্যরত প্রাগৈতিহাসিক, মনোলিথিক, প্যালিয়োথিক যুগের শিকারিরা; ‘ধেই-ধেই তাতা থইথই’ নাচতে থাকে। কত কত শতাব্দী পিছিয়ে যায় শিরীষ। ও যেখানে থাকে। ওর মধ্যের প্রাগৈতিহাসিক আদিম মানুষটি ওর মস্তিষ্কের একাংশের দখল নিয়ে, তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মড়ার খুলির টুকরোর মতো।

সেই টুকরোর-হওয়া একটি অংশ নিয়ে দারহা-কিচিং ভূতেরা গেন্ডুলি খেলে আর অন্য অংশ দ্রৌপদীর মতো কোনো রমণীর অখন্ড-দৈর্ঘ্যর শাড়ির প্রান্তের মতো আধুনিকতার খোঁটায় আটকে গিয়ে থেকে, মনকে সম্পূর্ণভাবে প্রাক-ইতিহাসের মধ্যে নগ্ন অথবা মগ্ন হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখে। ও আলুথালু বেশে, বিস্রস্ত কেশে, ফুটি-ফাটা মস্তিষ্কে কোনো অতলান্ত শীতল সমুদ্রের গহনের উষ্ণজলের চোরা-রাজপথে পড়ে, স্রোতের টানে দ্রুত ফিরে আসতে থাকে আবার মনোয়া-মিলন’-এরদিকে, যেখানে প্রাগৈতিহাসিক কোনো বন্য বস্তু নেই, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাধ্য এবং বশ-করা গৃহপালিত কুকুর আছে; কালু। যে, শিরীষের-ই প্রতীক্ষায় বনের দিকে মুখ উঁচু করে, কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। বনের মধ্যে থেকে উঠে-আসা হাওয়ার মধ্যে যে, তার মনিবের শরীরের গৃহপালিত গন্ধ খোঁজে।

সেই মাহেন্দ্রক্ষণে থাকে এক নারীও, সে নগ্না নয়, পশুচর্ম পরিহিতা নয়; কাঁচা রক্ত মাংস-খাদক নয়; যে, অনেক শতাব্দী ধরে তার আদিমতাকে, তার নগ্নতাকে, সভ্যতা-নামক, পরিশীলন-নামক, কৃষ্টি এবং রুচি নামক নানা ভঙ্গুর, সামান্য আঘাতেই ছিন্নভিন্ন হওয়া, কিন্তু আপাত-দুর্ভেদ্য নির্মোকে, আবরণে, অন্তর্বাসে, কাঁচুলিতে, শায়াতে, ব্লাউজে, শাড়িতে বিভিন্ন ভাষার জ্ঞানে বিভিন্ন বিষয়ের অধীত-বিদ্যায় মুড়ে রেখেছে নিজেকে; সেই নারীর নাম ঝিঁঝি, ঘুমের মধ্যে পাশ-বালিশ চেপে ধরে শিরীষের কথা মনে করে, সেই বালিশেই চুম্বন আঁকছে। সে, এই ঘুম ভেঙে-যাওয়া গভীর রাতে।

মানুষ আসলে বোধ হয় এখনও আদিম যুগেই বাস করে। তার আধুনিকতার বা সভ্যতার বা বিজ্ঞানমনস্কতার যথার্থ বিশ্লেষণ এখনও হয়নি। হয়তো হবেও না কোনোদিনও। তার আবরণটি এখনও যথেষ্ট পুরু হয়নি। যা-কিছুই সহজ ছিল, সোজাসুজি ছিল, আকাশের মতো, বাতাসের মতো, নদী আর বনের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারে উৎসারিত সুঘ্রাণের মতো; তার সবকিছুই কত গোলমেলে কুটিল, দুর্গম, দুর্ভেদ্য; নাগালের বাইরের করে তুলেছে, আধুনিকতা, সভ্যতা, তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত এই শিরীষ আর ঝিঁঝির মতো। জিতেন আর শেফালির মতো, গুঞ্জন আর ঘণ্টেমামার মতোই বড় অসহায় মানুষেরা! একবিংশ শতাব্দীতে পা-দেওয়া বিজ্ঞানমনস্ক কম্পিউটার-বিশারদ গর্বিত কিন্তু অভিশপ্ত মানুষেরা!

শিরীষ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঘুম ভেঙে।

কালুও ফেলল একটা।

তারপরেই শিরীষের দু-পায়ের ওপরে শরীরের ভার চাপিয়ে দিয়ে আবারও কালু ঘুমিয়ে পড়ল।

সারমেয়রা খুব-ই ভাগ্যবান। একসঙ্গে কোনো দুঃখ বা আনন্দের ভাবনা বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না ওরা। কোনো ভাবনাই তাই পীড়িত করতে পারে না, ওদের মনকে কখনোই। তাই মানুষের মতো কষ্ট পায় না ওরা।

শিরীষ ভাবল, কালু কী ভাগ্যবান, যে, সে মানুষ নয়। এখনও কতশত যোনিসম্ভূত হয়ে, কত জন্ম পার করে তাকে, মানুষ-জনম পেতে হবে কে জানে! যতদিন না পাচ্ছে, ততদিন মনুষ্যোচিত বোধের সব দুঃখ থেকেই ও বেঁচে গেল। এ-জন্মের মতো বেঁচে গেল। ও জানে না কী বাঁচা বাঁচল ও।

ঝিঁঝি উঠে একবার বাথরুমে গেল। কোনো-কোনোদিন এবং রাতেও শরীরের মধ্যে একধরনের গরম বোধ করে। এই রহস্যের তল পায় না ও। এই কি সুনীতির ভাষায়, কী যেন? রিকিঝিকি? তাই? কে জানে! তবে এই কষ্টটা আজকাল একেবারেই যে, বোঝে না ও, তাও নয়! বোঝে একটু একটু! কিন্তু এইকষ্ট নিরসনের কোনো পথের হদিশ ওর কাছে নেই। তবে একথা ঠিক যে, এমন এমন সময়ে, ওর শিরীষের কথা খুব-ই মনে হয়। বিশেষ করে খালি-গায়ের, আগুনের মতো গায়ে-রঙের বুকভরতি সতেজ কালো কোঁকড়ানো-চুলের শিরীষের কথা। তার সরু কোমর আর চওড়া বুকের কথা। একজন পুরুষ আর একজন নারী তাদের দুজনের শরীরের খেলনাপাতি নিয়ে কোন খেলা যে, খেলে, কেমন করে যে, খেলে, তা যেমন, কল্পনাতে জানে ঝিঁঝি আবার হাতেকলমে জানেও না। কিছু কিছু জানা থাকে, স্বাদ থাকে, সাধ থাকে; যা পরের মুখে ঝাল খাওয়ার-ই মতো, পরস্মৈপদী আদৌ হয় না। স্বশরীরের স্বীয় অনুভূতিতে তাকে পঞ্চমেন্দ্রিয় দিয়ে না ছুঁলে তার আনন্দ অথবা দুঃখ অজানাই থেকে যায়।

ঝিঁঝি বাথরুম থেকে ফিরে এসে শুল। কিন্তু ঘুম হল না। পাহাড়তলিতে শালফুলের গন্ধ, করৌঞ্জের গন্ধ, মহুয়ার গন্ধ, নানা মিশ্র গন্ধ নদীর সামান্য সোঁদা গন্ধর সঙ্গে মিশে গিয়ে থম’ মেরে আছে। মাঝে মাঝেই একটা দমকা হাওয়া, শিরীষের কুকুর কালুর-ই মতো ছটফটে, আচমকা এসে, রিলে-রেস-এ দৌড়োনো স্কুলের মেয়ের মতো সেই জমে-থাকা গন্ধ সমষ্টিকে উড়িয়ে নিয়ে এদিকপানে এসে ঘাপটি-মেরে দাঁড়িয়ে-থাকা অন্য কোনো নবীন, সদ্যোজাত হাওয়ার হাতে তুলে দিচ্ছে, যে আবারও সেই গন্ধবাহী অদৃশ্য দামাল রুমাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এই পৃথিবীর ছোট্ট এককোণ থেকে অন্য কোনো কোণের কোনো শান্তশ্রী প্রান্তকে সুরভিত করবে বলে। ঝিঁঝিদের বাড়ি ‘মহুয়ার’ হাতার বাগানে আমের মুকুল আর কাঁঠালের মুচি এসেছে। তাদের গন্ধেও ‘ম-ম’ করে সারারাত। এই চৈত্রশেষের চাঁদের আলোয় ফুটফুট করা মধ্যরাত মাঝরাত তারার বিছানাতে শুয়ে ওর-ই মতো ছটফট করে। হয়তো এই রাতেরও কোনো মনের মতো পুরুষ আছে, যার সঙ্গে মিলনে তার অনেক-ই বাধা। তাই রাতেরও রিকিঝিকি হয়।

রাত্রি, অবশ্যই নারী। এবং নারী যদি হয় তবে এই রাতও ঝিঁঝির মন-শরীরের সব কথা অবশ্যই বুঝবে।

.

গুঞ্জন ঘুমের মধ্যে একবার বিড়বিড় করে উঠল। ওরা তিনবোনে একঘরেই শোয়। গদিঘরের গদির মতো মস্ত বিছানার ওপরে ঢালা ফরাশ পাতা। একঘরে শোয় বটে, এক মা বাবার গর্ভে এবং ঔরসে তাদের জন্মও বটে কিন্তু কতই না তফাত তাদের একে অন্যের মধ্যে!

হাসনুহানার গন্ধ পাচ্ছিল গুঞ্জন। যে হাসনুহানা শিরীষকে দিয়েছিল তার-ই অন্যভাগ নিজের বালিশের নীচে নিয়ে ঘুমিয়েছিল। প্রতিরাতেই শুতে যাওয়ার আগে স্নান করে গুঞ্জন ভালো করে। শরীরের সারাদিনের গ্লানি ও ক্লেদ ধুয়ে আসে। সারাদিন ধরে শরীরে যে, ময়লা-কুচলা জমে তার কণামাত্র নিয়েও সে, ঘুমের জগতে প্রবেশ করতে চায় না। সারাটা দিন ও রাতের কিছুটা আবিলতায় অবশ্যই মাখামাখি হয়ে যায় কিন্তু শয্যাহীন গুঞ্জনের শরীর মনে আবিলতার কণামাত্রও থাকে না।

স্বপ্ন দেখতে দেখতে গুঞ্জন মাঝে মাঝে শিশুর মতো দেয়ালা করে। কিন্তু আজ হাঁউ-মাউ করে কেঁদে উঠল।

তিন্নি মড়ার মতো ঘুমোচ্ছিল। জানলও না।

মুন্নি তাকে এক ঠেলা মেরে বলল, নেকি হয়েছে একটা! কতবার বলেছি যে, বুকের ওপর হাত রেখে শুবি না, তা কথা কে শুনছে!

গুঞ্জন জেগে থাকলে মনে মনে ভাবত, মুন্নি-তিন্নি বড়ো নিষ্ঠুর। যেসব মেয়ে তাদের জীবনে পুরুষের ভালোবাসা পেয়েছে তারা বড়ো দয়ালু হয়, নরম হয়; স্নিগ্ধ হয়। তাহলে মুন্নি-তিন্নি সিং-চাচার শালাবাবুর বড়োলোক ছেলেদের কাছ থেকে যা পায়, তা বোধ হয় ভালোবাসা নয়; অন্যকিছু। ভালোবাসা কাকে যে বলে, তা জানে ক-জন পুরুষ? ক-জন নারীই বা তা সঠিক জানে? একটা গন্ধ পেল শিরীষ নাকে। এ-গন্ধ, রাতের হাওয়ার হাত ধরে ছুটে আসা বন-গন্ধ নয়। অন্য এক ধরনের গন্ধ।

হঠাৎ-ই মনে পড়ল ওর, কাল শেষবিকেলে গুঞ্জনের দেওয়া হাসনুহানার কথা। পাশ ফিরে শুয়ে বালিশের তলা থেকে ফুলগুলো বের করল। সুন্দর টাটকা সাদা নরম ফুলগুলো খয়েরি এবং কালো হয়ে গেছে এখন। যদিও গন্ধই প্রমাণ করছে যে, যখন তারা সাদা ছিল, নরম ছিল; তখন তাদের নাম ছিল হাসনুহানা।

এমন-ই বোধ হয় হয়। ফুলও ভালোবাসার-ই মতো। তার ওপরে ঢাকা-চাপা পড়লে, বেশি চাপ পড়লে, আলো-হাওয়া থেকে সরিয়ে এনে, তাকে চেপে-ঢেকে অন্ধকারে রাখলে সে, এমন শুকিয়ে খয়েরি-কালোই হয়ে যায়। ভালোবাসা ঢাকা-চাপার নয়, লুকোছাপার জিনিস।

শিরীষ ভাবল, ঝিঁঝি কি জানে এই কথাটি?

.

শেফালিরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঠোঁটের যন্ত্রণায়। পাশে ঘণ্টেবাবু নামক একজন পুরুষ শুয়ে আছেন। যিনি তাঁর স্বামী। লুঙ্গিটা সরে যাওয়াতে শেফালির বহুবছর অদেখা, পুরুষাঙ্গটি দেখা যাচ্ছে, কমিয়ে রাখা লণ্ঠনের স্তিমিত আলোতে। পুলিপিঠের মতো দেখতে, পুরুষের অনুত্তেজিত জননেন্দ্রিয়র মতো কুদৃশ্য কোনো বস্তু পৃথিবীতে আর কিছু আছে বলে, মনে হয় না শেফালির। পুরুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংবলিত এই মানুষটা জাগতিকার্থে তার স্বামী। বিগত বহুবছর একই বিছানাতে তাঁদের রাত্রিবাস। সমাজে তাঁদের দুজনকে অঙ্গাঙ্গি বলেই জানে সকলেই। অথচ সবচেয়ে মজার কথা এই যে, নিস্তরঙ্গ, ভালোবাসা-হীন, ঝগড়া-হীন এই দাম্পত্য যে, আদৌ বেঁচে নেই সে-সম্বন্ধে দম্পতির একজনও ওয়াকিবহাল নন। ঘণ্টেবাবু তাঁর চাকরি, তাঁর রিটায়ারমেন্ট, তার সম্ভাব্য বা অসম্ভাব্য এক্সটেনশান এবং তাঁর বিপুল অসহায়তা এবং রিটায়ারমেন্টের পর, কী হবে এই ভাবনাতেই সবসময়ে ঝুঁদ থাকেন। যতই মাসের একতারিখ এগিয়ে আসতে থাকে ততই মাথার তিরিশটা চুলের সংখ্যাও হ্রাস পেতে থাকে। কী করে কী হবে? পাগলা ও ছুটকির স্কুলের মাইনে, দুধের দাম, চাল, ডাল, তেল, নুন; শেফালির শাড়ি-জামাও সব-ই প্রায় ছিঁড়ে-খুঁড়ে গেছে; নিজের কথা ভাবার সময় বা বিলাসিতা আর নেই। কিন্তু কী হবে?

শেফালি ভাবেন, তেল যতটুকু আছে তাতে কাল অবধি চলে যাবে কোনোক্রমে। পঞ্চাশ টাকা কেজি, হয়ে গেছে সরষের তেলের।

জুনিয়র পিসি সরকারের ম্যাজিক দেখেছিল একবার রাঁচিতে। ওয়াটার-অব-ইণ্ডিয়া। এক ইগ্লাসে অনন্ত জলরাশি। যতবার-ই উপুড় করে ঢালা যাক-না-কেন, জল অফুরান-ই থাকে যেন কামধেনু। তেমন-ই অয়েল-অব-ইণ্ডিয়া (ইণ্ডিয়া অয়েল নয়) এই ধরনের একটি ম্যাজিক যদি শিখে নিতে পারতেন উনি জুনিয়র পি.সি সরকারের কাছ থেকে!

প্রত্যেক মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মহিলাই ভাবেন সংসার চালানো আর আধুনিকতম বৃহত্তর এরোপ্লেন ‘কনকর্ড’ চালানোতে কোনো তফাত নেই। অথচ তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের এই সংগ্রাম, দুর্গম পবর্তারোহণ বা এরোপ্লেনের মহিলা-পাইলট হওয়ার, খবরের মতো খবরের কাগজের খবর হয় না কোননাদিনও। খবরের কাগজগুলো, প্রত্যেকটি কাগজ-ই; চিরদিনই বাহির-পানে চেয়ে থাকে খবরের জন্যে, ভিতর-পানে চেয়ে দেখবে এমন চোখ-ই নেই কারো। প্রতিদিন কত খবর-ই যে, একটা সাধারণ সংসারের মধ্যে ধুলোয় পড়ে নষ্ট হয়, ঘটে। সেসব খবরের প্রত্যেকটিই সর্বজনীন, বিশ্বব্যাপ্ত! কারণ, ব্যক্তির সমষ্টি নিয়েই ‘বিশ্বজন’ এ-কথা বোঝার মতো ক্ষমতা খবরের কাগজের মাথা-মোটা মালিক এবং সাংবাদিকদের একজনেরও নেই। লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেলে শেফালি সাংবাদিক-ই হতেন। লেখাপড়াতে খারাপ তো ছিলেন না আদৌ। প্রতিবছরেই ফাস্ট হতেন। সামর্থ্যের অভাবে বাবা আর পড়াতে না পেরে নিতান্ত নিরুপায় হয়েই বয়েসে ওর চেয়ে, পঁচিশ বছরের বড় ঘণ্টেবাবুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে ‘খেতে-পরতে তো পাবে।

মৃত্যুর সময়ও বাবা আক্ষেপ করেছিলেন শেফি, তোকে পড়াতে পারলে তুই ইন্দিরা গান্ধি হতে পারতি। আমার-ই দোষ।

পৃথিবীর বৃহত্তম ডোমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট ইণ্ডিয়ার, যে-দেশের জনগণের প্রতিভূরা’ জনগণের পয়সাতে রাজা-মহারাজার মতো জীবনযাপন করেন। সেই দেশের-ই ঘরে ঘরে কত কোটি শেফালিরা যে, তাদের সব মেধা ও বুদ্ধি ও সাফল্যের পর্বতশৃঙ্গ আরোহণের সব স্বপ্নকেই শুধুমাত্র গর্ভধারণ, সন্তান-পালন এবং পতি-সেবাতেই কবরস্থ করল তার হিসাব কি নেবেন সেইসব নেতারা?

শেফালির বাবা ভুলে গিয়েছিলেন যে, শেফালি পড়বার সুযোগ পেলেও কখনোই ইন্দিরা গান্ধি হয়ে উঠতে পারত না। ইন্দিরা গান্ধি, মতিলাল নেহরুর ছেলে জহরলাল নেহরুর কন্যা। একটা ‘ক্লাস’-এর ব্যাপার আছে-না? একটা ‘ঐতিহ্য’? অর্থ এবং সুযোগ-ই এই সমাজের সমস্ত ঐতিহ্যের মূলে।

শেফালি জানতেন সে-কথা। বাবা যে, কত-বড়ো বোকা তা মৃত্যুর সময়েও নতুন করে প্রমাণ করে গেলেন।

শেফালির অন্ধকার ভবিষ্যহীন জীবনের আকাশে জিতেন-ই একফালি চাঁদ। একমাত্রও। মাঝে মাঝে মেঘে ঢাকা পড়ে যায় বটে, তবে ফিরে ফিরে দেখাও দেয়।

অথচ শেফালির বিন্দুমাত্র রাগ বা ক্ষোভ নেই ঘণ্টেবাবুর ওপর। সে বেচারিও তো শেফালির-ই মতো পৃথিবীর এই বৃহত্তম ডেমোক্র্যাসির, এই বুলি-কপচানো, ভন্ড, রাজনীতিক নেতাদের দেশে গড্ডলিকার মতো স্রোতে-ভাসা, পরম নির্বুদ্ধি শুয়োরের মতো, বংশবৃদ্ধিকারী জনগণের মূঢ়তার-ই শিকার।

জীবনে, মানুষের মতো বাঁচতে হলে সকলকেই যে, ইংরিজি জানতেই হবে বা পড়াশুনোতে ভালো হতে হবে, বা কোনো পার্টির সদস্য হতে হবে তার তো কোনো মানে ছিল না! শেফালি পড়াশুনোতে ভালো ছিলেন। ঘণ্টেবাবু ছিলেন না। তাতে কী যায় আসে। এই পড়াশুনোর প্রকৃত তাৎপর্যটিই বা কী? মরা-পাঁঠার গায়ে কলকাতা কর্পোরেশনের কসাইখানার ছাপের-ই মতো সমান দাবি তো এইসব ডিগ্রি-ফিগ্রির। কী শেখানো হয় স্কুল কলেজে? সে-শিক্ষাতে ‘মনুষ্যত্ব’র কি বিকাশ হয়? আর যেসব জায়গাতে ভালো শিক্ষা দেওয়া হয়, সেখানে ক-জন সাধারণ মানুষ-ই বা যেতে পারে?

এতসব গভীর কথা-টথা ঘণ্টেবাবু জানেন না, জানতে চান না। মানুষটা সাদা-সরল, অত তলিয়ে বোঝার ক্ষমতা নেই তাঁর, কিন্তু ঘণ্টেবাবুর সঙ্গে তাঁর মালিকপক্ষের নীলোৎপল বা তার কাকার বা বাবার সচ্ছলতার, মান-প্রতিপত্তির যা-ব্যবধান তার জন্যে ঘণ্টেবাবু দায়ী নন আদৌ। দায়ী এই সমাজব্যবস্থা।

শেফালি লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেলে হয়তো এমন চাকরি বা ব্যবসা করতে পারতেন যে, নীলোৎপলের পুরো পরিবার তাঁর অধীনে কাজ করতেন। বা হাত-কচলাতেন সামনে দাঁড়িয়ে। এমন মেধা এবং বুদ্ধি ছিল শেফালির। কিন্তু তাঁর একমাত্র দোষ ছিল তিনি গরিবের মেয়ে। এতবড়ো দোষ তো আর নেই এদেশে! এই ব্যবধান, এই বিধান তো সমাজব্যবস্থার-ই তৈরি! বেচারি ঘণ্টেবাবুর কোনো দোষ নেই। শেফালি জানেন। প্রতিদিন আঠারো ঘণ্টা খাটেন মানুষটা। এই বয়েসেও। বনে-পাহাড়ে-করে মূল খুঁড়ে-খাওয়া বন-ভালুকের-ই মতো ঘুরে বেড়ান সকাল থেকে রাত কেন্দুপাতার সন্ধানে, কুলি মজুরদের সামলে। মালিক কম রোজ দিলে টাঙ্গি পড়ে চিরদিন ঘণ্টেবাবুদের-ই টাকে। তাঁর তো দোষ নেই। মানুষটা যদি, কুঁড়ে হতেন, কাজ না করতেন, তবে হয়তো তাঁকে দোষ দেওয়া যেত কিন্তু তা তো নন! তাই গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে দিনে আঠারো ঘণ্টা খেটেও যদি সাচ্ছল্যের মুখ তিনি এ-জীবনে কোনোদিনও না দেখে থাকেন তবে তাঁকে দোষী করা যায় না। দোষী তাঁর মালিকেরাই। দোষী এই সমাজব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা।

বিহারের কোনো পার্টিতে নাম লিখিয়ে নিলেই নিঃসন্দেহে এতদিনে রমরমা হয়ে যেত তার। কালার টি ভি, মোটরসাইকেল, ভি. সি. আর! রাজনীতি করতে, না লাগে শিক্ষা, না ভব্যতা; না পরিশ্রম। ধূর্তামি-নষ্টামি থাকলেই চলে যায়। আর সেই রাজনীতিকরা অশিক্ষিত, অমানুষ, ভেড়চাল’-এর, শুধুমাত্র মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসম্পন্ন জীবগুলোর হাতেই আজকে দেশের স্টিয়ারিং। এবং এই স্টিয়ারিং, যে, দেশকে কোন জাহান্নামে নিয়ে যাবে তা, সেই মানুষগুলোই জানে।

নাঃ! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল শেফালির।

যাওয়ার আগে আজ জিতেন শেফালির কেটে-যাওয়া, ফুলে-ওঠা, যন্ত্রণাদায়ক বীভৎস ঠোঁটে একটি আলতো চুমু খেয়েছিল। চুঃ’ করে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলেছিল, তোমাকে আমি ভালোবাসি বউদি।

ওই একটি শব্দ, ভালোবাসি’ শেফালির মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছে।

একথা অজানা ছিল না তাঁর কাছে যে, বারুদের স্কুপের ওপরেই বসেছিলেন তিনি এতদিন। তিনি অবশ্যই জানতেন। বারুদ নিয়ে খেলছেন যে, তা জানতেন কিন্তু কেউই তাতে দেশলাই ঠোকেনি। আজ জিতেন দেশলাই-কাঠিটি জ্বালাল। যেন, ছেলেবেলার কালীপুজোর রাতে আশ্চর্য-গন্ধ-লাল-নীল-দেশলাই জ্বালাল। কোনো নিষ্পাপ পুরুষ-শিশু। রং-মশাল বা তারাবাজি জ্বালাবে বলে।

পরক্ষণেই ঘটে দুর্ঘটনা। আলোয় আলোয় চোখ বেঁধে গেল।

চৈত-বোশেখের বনে দাবানল জ্বলতে দেখেছে, শেফালি তেহার বা বেতলার আশ-পাশের পাহাড়ে। বিয়ে হয়ে, বিহারের এই নগণ্য অখ্যাত শহরে এসে থিতু হওয়ার পরে। কিন্তু সেই দাবানল যে, তাঁর নিজের মস্তিষ্কের মধ্যেও এমন করে ছড়িয়ে যাবে কোনোদিন, তা দুঃস্বপ্নেও আগে ভাবেননি।

প্রত্যেক মানুষ-ই বোধ হয় বারুদের স্কুপের ওপরেই বসে থাকেন সারাজীবন। শেফালির -ই মতো; কেউ লাল-নীল-দেশলাই নিয়ে এসে কোনো অবহেলাতে তাতে অগ্নিসংযোগ করবে বলে। আগুনের কতরকম হয়, প্রতীক্ষা কত না দীর্ঘ এবং বিচিত্র হয়, দাবানলও কত শীতল হয়, কখনো কখনো; তা যিনি জানেন তিনি জানেন।

হ্যাঁ। কখনো কখনো।

শেফালির ঠোঁটে খুব-ই যন্ত্রণা হচ্ছিল। উঠে বাথরুমে গেলেন শেফালি। ফিরে এসে, ওষুধটা খাবেন ভাবলেন। ব্যথা বাড়লে, ডাক্তার যে-ওষুধটা খেতে বলে গিয়েছিলেন।

বাথরুম থেকে ফিরে কী মনে করে ওষুধটা আর খেলেন না।

ওঁর যন্ত্রণার সঙ্গে জীবনের প্রথম চুমুর অপরাধের, পরকীয়ার লজ্জাকর সুখ মিশে আছে। যে! ব্যথার উপশম হলেই, সেই অনুভূতিটা হারিয়ে যাবে। থাক, আজ রাতভর ব্যথাটা থাক-ই। জ্বরও থাক। প্রায় ভুলে-যাওয়া একটি মনোরম অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কল্পনাতে অন্য কোনো অভিজ্ঞতার কথা মনে করার চেষ্টা করবেন বাকি রাত শেফালি, যে-অভিজ্ঞতার, গত প্রায় পনেরো বছরে একবারও পুনরাবৃত্তি হয়নি ঘণ্টেবাবুর সঙ্গে। থাক, জ্বর থাক।

জিতেনের প্রেমময়, সুন্দর, নবীন, নিষ্পাপ মুখটা মনে করে চোখ বুজলেন শেফালি।

ডাক্তারেরা কতটুকু জানেন? কী জানেন মানুষের মনের? একগাদা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে দিয়ে গেছেন। টেডভ্যাক ইনজেকশন। আরও কীসব।

ডাক্তারেরা কি জানেন যে, কাম-জ্বর বলেও একধরনের জ্বর আছে? যে-জ্বর রাধার হত? কৃষ্ণ-ভাবনায়?

ঘণ্টেবাবু বললেন, ঘুমের মধ্যে, না বাবু? আমি তো মাল লোড করে দিয়েছিলাম বাবু বিষেণ সিং-এর ট্রাকে। না বাবু। চাকরিটা খাবেন না বাবু। বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে পথে বসে যাব। না বাবু।

শেফালি কনুইয়ে ভর করে উঠে বসে ঘণ্টেবাবুর চোখের দিকে চেয়ে দেখলেন। দেখেই…। দু-চোখের কোণে জল। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে গেলেন তিনি। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই। ঘণ্টেবাবু চোখের পাতা মেললেন।

বললেন, কী হল? ব্যথা কি বেড়েছে? ওষুধ দেব?

না, না।

বলেই, শুয়ে পড়লেন শেফালি, অনেক বছর পরে; ঘণ্টেবাবুর কোল ঘেঁষে।

কোনো মানুষ যখন নিরুপায়, অসহায় হন, তাঁর নিরুপায়তা বা অসহায়তার নিরসনের ক্ষমতা যাঁর হাতে নেই, এমন মানুষের পক্ষে সেই মানুষকে সান্ত্বনা দিতে যাওয়াটা তাকে অপমান করারই নামান্তর।

তাই বুদ্ধিমতী শেফালি বিরত থাকলেন। কিছুমাত্রই বলা বা করা থেকে।

শেফালি তার খুব-ই কাছ ঘেঁষে আজ হঠাৎ শোওয়াতে ঘণ্টেবাবু বাঁ-পাশ ফিরে শুয়ে শেফালির কোমরের ওপরে ডান হাতখানি রেখে একটি গভীর নিশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাকে বিয়ের দিন থেকে শুধু কষ্টই দিয়ে এলাম।

শেফালির বাহুতে ঘণ্টেবাবুর চোখ-গড়ানো জলের ফোঁটা পড়ল।

চমকে উঠলেন শেফালি।

যে-চোখে জিতেনের সুন্দর, সজীব, প্রেমময় মুখের স্বপ্ন আঁকা ছিল একমুহূর্ত আগে সেই চোখ দু-টিই মুহূর্তের মধ্যে তাঁর অযোগ্য স্বামী ঘণ্টেবাবুর জন্যে, এক গভীর কষ্টে জলে ভরে গেল।

শেফালি অস্ফুটে বললেন, কষ্ট কীসের?

তা ছাড়া, বিয়ে করে কষ্ট তুমিও তো কম পাওনি!

দেওয়ালের গায়ে একটা বড়ো কালো টিকটিকি একটা ছোট্ট পোকার দিকে খুব আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিল। পোকাটা বোকা।

শেফালি ভাবছিলেন, মানুষ হয়ে জন্মানো বড়োই কষ্টের। ভারি কষ্টের। বড়ো বিচিত্র মানুষের এই মন। তাঁর মাথার মধ্যে বুকের মধ্যে যে, কতগুলো মানুষে একইসঙ্গে ঘর পেতেছে! তাঁদের সকলকে তিনি চেনেনও না পর্যন্ত। একজনের সঙ্গে অন্যজনের কোনো সম্পর্কই নেই। আশ্চর্য! অথচ সবাই আছে জড়িয়ে-মড়িয়ে, যাত্রাদলের গ্রিনরুমের অভিনেতা অভিনেত্রীদের মতো। কে যে,কখন কোন, বেশে এসে, কোন ভূমিকাতে জীবনের মঞ্চে হঠাৎ প্রবেশ করবে তা কেউই আগে থাকতে জানে না। এই যাত্রাতে কোনো অধিকারী নেই। নির্দেশক নেই। ক্ল্যারিওনেটবাদকও নেই।

তবে, এই যাত্রায় বিবেক অবশ্যই আছে।

সে মাঝে-মাঝেই সাদা পোশাক পরে এসে গান গেয়ে যায়।

ভাগ্যিস বিবেক আছে।

শেফালি, তার কোমরে-রাখা ঘণ্টেবাবুর হাতটা, তাঁর গোবেচারা স্বামীর হাতটা; নিজের বুকের কাছে টেনে নিলেন তাঁর ডান হাত দিয়ে। অনেক বছর পরে।

পবননন্দন আগরওয়ালার বাড়ির পেটা ঘড়িতে রাত দুটো বাজল।

ঢং। ঢং।

.

দেখতে দেখতে আরও দু-টি দিন কেটে গেল।

গত বৃহস্পতিবারে সুনীতি আনন্দিত, উত্তেজিত হয়ে নীলোৎপলদের আসার অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু এ-সপ্তাহে বৃহস্পতিবার যতই এগিয়ে আসতে লাগল ওঁর হাত-পা যেন ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল। ঘণ্টেবাবুও যদি সময়মতো না আসেন তাহলে যে, তিনি ওই অপরিচিত মানুষদের নিয়ে কী ফাঁপরেই পড়বেন সে-কথা ভেবেও অত্যন্তই অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর।

.

শেঠ চিরাঞ্জিলালের গদিঘরে বসে কাজ করতে করতে শিরীষ প্রার্থনা করেছিল যে, বৃহস্পতিবার যেন না আসে এই সপ্তাহে আদৌ। তার আগেই যেন, পঞ্জিকাতে আদ্যন্ত বদল ঘটে যায়। কোনো দৈবী-প্রক্রিয়ায়। বৃহস্পতিবার সম্বন্ধে তার অস্বস্তি ছিল দুটি কারণে। প্রথমত নীলোৎপল এবারে নিশ্চয়ই আসবে এবং সম্ভবত তার কাছ থেকে ঝিঁঝিকে সে কেড়েও নিয়ে যাবে শহর কলকাতায়। যেখানে, মানুষ একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না।

দ্বিতীয়ত বৃহস্পতিবার আবারও এলেই তাকে পড়াতে যেতে হবে গুঞ্জনকে। মুখোমুখি হতে হবে তার। এবং সেই মুখোমুখি হওয়া তার জীবনে নদীর এক প্রধান বাঁকের-ই মুখোমুখি হওয়া। গেলে, কী যে হবে তা ও নিজেই জানে না। না-গেলে কী হবে, তাও জানে না।

ও জানে না, ঝিঁঝির ওর প্রতি ভালোলাগাটা কতখানি গভীর এবং সেটা আদৌ ঘর-বাঁধার মতো জোরালো কি না!

কিন্তু গুঞ্জন, তার নিজের মনের কথা অত্যন্ত স্পষ্ট করেই প্রকাশ করেছে শিরীষের কাছে। শুধু স্পষ্টভাবে প্রকাশ-ই করেনি, অত্যন্ত সুন্দরভাবেও করেছে; যেমন করে, খুব কম মানুষ ই করতে জানে। ইংরিজিতে একটা কথা আছে-না? “To say it with Flowers!” নরম সুগন্ধি হাসনুহানা ফুলকে তার নরম, ভীরু ভালোবাসার বাহন যে, মেয়ে করতে জানে, তার ভালোবাসার রকমটাও নিশ্চয়ই ফুলগন্ধীই হবে।

তা ছাড়া, যখন-ই নরাধম’-এর কথা মনে হয় শিরীষের তখন-ই মনে হয়, একটা হুলো বেড়ালের মুখ থেকে নরম, ধুকপুক-বুক-এর কোমল অথচ দৃঢ় কবুতরটিকে বাঁচানো এখন ওর নৈতিক দায়িত্বও বটে। নরাধমকে ও প্রথম দর্শনের ক্ষণ থেকেই অপছন্দ করে এসেছে বলেও এই কর্তব্যটি ও সানন্দেই করতে চায়। গুঞ্জনকে বিয়ে করে ও গুঞ্জনদের সমাজের পণপ্রথার বিরুদ্ধে জাজ্বল্যমান বিদ্রোহের উদাহরণও হয়ে উঠতে পারে। রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক নেতাদের মতো শুধুই কথার ফুলঝুরির উৎসার নয়, কাজে করেই ও দেখাতে পারে। নরাধমদের চোখের সামনে ও গুঞ্জনকে নিয়ে সুখে ঘর করে অনুক্ষণ তার মুখে, না মেরেও থাপ্পড় মারতে পারে। শিক্ষার বাহ্যিক আড়ম্বর বা ইংরিজি জ্ঞানের অর্থহীন ঔজ্জ্বল্য ছাড়াও যে, একজন মানুষ পুরোপুরি শিক্ষিত, সভ্য ও ভদ্র হতে পারে, তার মূর্ত প্রমাণ গুঞ্জন। যতটুকু না শিখলেই নয়, তা শিখিয়ে নেবে শিরীষ গুঞ্জনকে, ধীরে ধীরে। শুধু রাঁধুনি আর নর্মসহচরীই নয়; গুঞ্জনকে সে প্রকৃতার্থেই জীবন-সঙ্গিনী হিসেবে গড়ে নেবে।

প্রেম জিনিসটা বোধ হয় আকাশ থেকে পড়ে না, এই কথাটি শিরীষ ক্রমাগতই ভাবছে। তা বোধ হয় জমিতেই ফলে। এবং সেই জমিটি হচ্ছে দয়া, মায়া, প্রীতি, সহমর্মিতা, সখ্যতা, সমরুচি এবং অনেক সময়ে অনুকম্পাও। এইসব জমিতে কোন শুভক্ষণে অজানিতে যে, হঠাৎ ওই প্রেম অঙ্কুরিত হয় অন্য মনের বর্ষার প্রথম বর্ষণে তা বোধ হয় না জানে, সেই জমি নিজে; না জানে বৃষ্টি। গুঞ্জনের মুখ থেকে, পুনমচাঁদবাবুর মুখ থেকে, ওদের সমাজের সব কথা শোনার পরে, নরাধমকেও কাছ থেকে জানার পরে, শিরীষের মনে গুঞ্জনকে বাঁচানোর জন্যে, একধরনের ‘শিভালরি’ উঁকি-ঝুঁকি মারছে যেন, সেই বিকেল থেকেই। জীবন যৌবনের প্রতিমূর্তি কোনো কাল্পনিক সাদাঘোড়ায় চড়ে, বর্শা-হাতে, বর্মে, অঙ্গদে, কুন্ডলে, শিরস্ত্রাণে, সেজে, পুরোনো দিনের কোনো বীর যোদ্ধার-ই মতো সে বর্শার ফলাতে নরাধমকে এবং গুঞ্জনদের সমাজের অন্যায় অবিচারকে গেঁথে ফেলে গুঞ্জনকে সেই ঘোড়াতেই, তার সামনে বসিয়ে, ঘোড়া ছুটিয়ে টগবগিয়ে চলে আসতে ইচ্ছে করে ওর। বীরত্ব, ন্যায় এবং শুভবোধের প্রতীক হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে ওর, যেসব গুণপনা আজকাল নাবাল-জমির তৃণকণার-ই মতো ধূর্তামি, ধাষ্টামির ছাগলেরা অবিরতই মুড়িয়ে খাচ্ছে, যেসব গুণপনা আজকের দিনে মূখামির-ই নামান্তর।

কিন্তু তবুও প্রচন্ড সুখের কথা এই যে, আজও পৃথিবীতে শিরীষের মতো কিছু মূর্খ বেঁচে আছে, হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে এবং শুধুমাত্র সেই মূর্খরাই জানে; মূর্খামিতে কী গভীর সুখ। ‘সতোর মধ্যে কী অন্তর্লীন শান্তি। রাতের ঘুম। সৎ-সাহসের মাধ্যমে অনাগত দিনের প্রজন্মর বড়ো অভাগা মানুষদের জন্যে বিরাট স্বরাট এক, সতেজ শ্যামল ঋজু মহীরুহর সুপ্তবীজ এখনও গোপনে রোপণ করা যেতে পারে। শিরীষের মনে হয় যে, এই প্রজন্মর সব মানুষের ই অবশ্যপালনীয় কর্তব্য আগামী প্রজন্মকে কিছু দিয়ে যাওয়া। এইসব বোধের কণামাত্রও যদি আগামী প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে চারিত করে দিতে পারে, জারিত করে দিয়ে যেতে পারে শিরীষ তার ব্যক্তিগত জীবনের দৃষ্টান্ত দিয়ে; তবে বড়ো খুশি হবে ও। তার চেয়ে বড়ো উত্তরাধিকার আর কীই বা রেখে যাওয়ার থাকতে পারে তার নিজের সন্তান এবং উত্তরসূরিদের জন্যে!

শিরীষের গভীর বিশ্বাস আছে যে, চিরদিন-ই সততা, ভালোত্ব, বীরত্ব এবং সৎ-সাহসেরই জয় হয়েছে। এবং ভবিষ্যতেও হবে। এই অসৎ, নীচ, সস্তা, টাকা ও ধূর্তামি-সর্বস্ব পৃথিবীতে বাস করেও শিরীষ এই বিশ্বাসকে তার অন্তরের গভীরে প্রোথিত করে রেখেছে।

গুঞ্জন এখন তার ‘অ্যাসিড-টেস্ট। মানুষ কী অমানুষ, তা প্রমাণ করার পরমপরীক্ষাতে কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎ-ই বসতে বাধ্য করেছে এই স্বল্পচেনা, অন্যপ্রদেশীয়, অন্য তরঙ্গমালার গুঞ্জন তাকে। এই পরীক্ষাতে কোনো ডিভিশন বা ক্লাস নেই। শুধুমাত্র পাশ আর ফেল আছে। এই পরীক্ষাতে ফেল করলে, শিরীষের ভবিষ্যৎ-জীবনের সব সুখের মধ্যে অনুক্ষণ একটি সরল, নিষ্পাপ, অভাগী মেয়ের দীর্ঘশ্বাস জড়িয়ে থাকবে। যে-আনন্দে, যে সুখে, অন্যের দীর্ঘশ্বাস’ জড়ানো থাকে তা আজীবন বয়ে বেড়ানো বড়োই অস্বস্তির। অমন আনন্দ বা সুখ কখনোই চায়নি শিরীষ।

শিরীষকে না হলেও ঝিঁঝির সহজেই চলে যাবে। শিরীষের চেয়ে সর্বার্থেই অনেক ভালো ছেলে, নীলোৎপল, রক্তোৎপল, শ্বেতোৎপলেরা এসে ঝিঁঝিকে সসম্মানে নিয়ে যাবে কিন্তু বেচারি গুঞ্জনের তো শিরীষ ছাড়া আর কেউ-ই নেই! গুঞ্জনের বাঁচা এবং এবং মরার মধ্যে একমাত্র সেতু যে, এখন সে-ই।

তা ছাড়া, ঝিঁঝির ওপরে অভিমানও যে, ওর কিছু জমেনি; তাও নয়। ঝিঁঝি তো একমুহূর্তের জন্যেও শিরীষের ওপরে নির্ভর করেনি। সে-কারণেই শিরীষের বিন্দুমাত্রও দায়িত্ব-কর্তব্য থাকার কথা নয় ঝিঁঝির প্রতি। ঝিঁঝি বোকাও নয়। ঝিঁঝির যদি, তার প্রতি বিন্দুমাত্র দুর্বলতাও থেকে থাকে তবে তারসঙ্গে সম্মানেরও ছিটেফোঁটা জড়িত থাকবে এই প্রত্যাশাই ছিল শিরীষের। শিরীষকে কণামাত্র সম্মান করলে, তার স্বামীর জন্য পেঁপে-কাঁচকলা বাহকের কাজে নিয়োজিত করত না ঝিঁঝি তাকে। ঝাণ্ডুর সমগোত্রীয় ভেবে স্টেশনে ডিউটি দিতে বলত না আগন্তুকদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে! শিরীষ যে, কোনোদিনও নীলোৎপল বা যেকোনো উৎপলের সমকক্ষ হতে পারে না, ও যে, এই জঙ্গল-পাহাড়ের কটুগন্ধী পুটুসফুল-ই মাত্র, পদ্ম নয়; তা ঝিঁঝি এবং কাকিমা প্রমাণ করে দিয়েছেন। এই সত্য সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার পর থেকেই ঝিঁঝির প্রতি এক গভীর অভিমান-ই শুধু নয়, তীব্র এক বিরক্তিও বোধ করেছে এ ক-দিন হল।

রাগ হয়েছে শিরীষবাবুর।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ