বাসনা কুসুম – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

জগা মুকুজ্যে সেরেস্তাতে বসে নথি ঘাঁটছিলেন। এখন সকাল আটটা।

চানু পান্ডে তার সামনে বসেছিলেন। জগাদার জুনিয়র তিনি। জগাদা লাতেহার কোর্টে প্র্যাকটিস করেন। ফৌজদারি উকিল।

ঘর-ভরতি দু-ভাঁজ করা মান্ধাতার আমলের ধুলো-পড়া সব ব্রিফ। লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা। ফৌজদারি আইনের কিছু বইপত্র। অল ইণ্ডিয়া ট্যাক্স রিপোর্টস-এর কিছু প্রাচীন সংখ্যা। চামড়া বাঁধানো। সে চামড়াও ফেটে-ফুটে গেছে।

চানু পান্ডে বললেন, সুও-মোটু মুভ করা কি ঠিক হবে স্যার? ইস্যুটার ওপরে যে, কোনো ডিসিশন নেই। রেশিয়ো অফ সাব-সাইলেন্সিও অ্যাপ্লাই করবে না?

চানু পান্ডে-ই প্রথমে দেখেছিলেন শিরীষকে।

বললেন, আইয়ে। আইয়ে, পাধারিয়ে, শিরীষবাবু।

শিরীষ তখনও বারান্দাতে।

জগা মুকুজ্যে বললেন, ওকে চানু। লেটস কল ইট আ ডে। ঠিরিঠ রেয়ারলি কামট ডিজ ডেজ।

নব্যভারতবর্ষে এখন ওকালতি করতে আর পড়াশোনা না করলেও চলে। আইন, জনগণের সমতাতেই প্রায় নেমে এসেছে। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই। সহজলভ্য হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের বক্তৃতাতে যেমন করে বলেন, ঠিক তেমন-ই। তাঁরাই তো দেশের রাজা, হুজৌর; মাই-বাপ। এখন মামলা জিততে উকিলের ওকালতি, এমনকী তথ্যও না জানলে চলে।

প্রকৃতই স্বাধীন হয়ে গেছে ভারতবর্ষ!

মক্কেলের যদি পয়সা থাকে, তবে সে খুন, বলাকার, বা ডাকাতি করলেও আইনের হাত; তার ইজ্জত, দামি জামার ভেঙে-যাওয়া ইস্ত্রির মতোই ঠিক-ঠাক করে দেয়। আইন তার কেশাগ্রও স্পর্শ করে না। আর যাঁর পয়সা নেই, বা যিনি নব্যভারতের রীতিনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি এখনও, আইনের সাঁড়াশি যে কী, তা তিনি হাড়ে-হাড়েই টের পান। আইনের মতো তামাশা’ আজ আর দু-টি নেই।

তবে জগা মুকুজ্যে অন্য ধাঁচের মানুষ, অন্য জগতের মানুষ। পাঁকের মধ্যে বাস তিনি করেন বটে কিন্তু সত্যিই ‘পঙ্কজ’ হয়ে ফুটে থাকেন। তাঁর মতো সরল ও সজ্জন মানুষ এ যুগে বিরল। হয়তো সেই কারণেই পসারও তাঁর সুবিধের নয়। তাতে কোনোই দুঃখ নেই জগাদার। কারণ, জগাদা আর মাধাদা দুই ভাই-ই ব্যাচেলার। দায়দায়িত্ব বলতেও কিছুই নেই। নেশার মধ্যে জগাদার দাবা এবং মাধাদার পাখি-টাখি শিকার। বড়ো জন্তুজানোয়ারের ধার মাড়ান না। নিজেই মারেন, কখনো ন্যাঙ্গোটিয়া দোস্ত’ বানওয়ারিলালও। নিজেরাই ছাল চামড়া ছাড়ান, কখনো-সখনো নিজেরাই রাঁধেন। তারপরে দাদা-ভায়ে-দোস্তে মিলে-মিশে খান। তবে মাধাদার দোনলা বন্দুক-নিঃসৃত অতিস্বল্পসংখ্যক গুলিকেই ‘মনোয়া-মিলন’-এর ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-ই বন্দুকের লক্ষ্যর সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখেছে। তাতে মাধাদার কোনো দুঃখ নেই। লজ্জাও নেই।

ওঁরা দু-ভাই-ই একটু দার্শনিক ধরনের। সাধারণের সুখ-দুঃখ ওঁদের ছোঁয় না। এজন্যেই শিরীষের খুব ভালো লাগে এঁদের। সময় পেলেই এঁদের সঙ্গ করে শিরীষ।

এঁদের কোনো পূর্বপুরুষ নাকি কলকাতার কাছের বিখ্যাত হুড়কোহাটের বিখ্যাত মুকুজ্যে পরিবারের সন্তান ছিলেন। হুড়কোহাটের সাবেক বাড়িতে এখনও নাকি বহুমূল্য রাইফেলের গুলিতে নিহত এক বারফটকা বাঘের সামনে শিকারের খাকি পোশাক-পরা, টুপি-মাথায়, মাল্যবান পূর্বসূরির ছবি দো-তলার বারান্দাতে টাঙানো আছে। মাধাদা বলেন সে-কথা। যদিও তিনি কখনো হুড়কোহাটে যাননি। জগাদা একবার গিয়েছিলেন। তাও এমন বয়সে, যখন ঘনঘন পেন্টুলন খসে যায়। জগাদাই হাসতে হাসতে জানিয়েছিলেন শিরীষকে এই তথ্য এক দিন।

নিজেকে নিয়ে রসিকতা করার মানুষ ক্রমশই কমে আসছে এই পৃথিবীতে।

মানুষের জীবন যে, আকাঙ্ক্ষা আর আকাঙ্ক্ষিত বস্তু আহরণের চেষ্টাতে গলগঘর্ম হয়ে কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে আদৌ নয়, এই অমোঘ কিন্তু অধিকাংশ অধুনা মানুষের কাছেই অজানা সত্যটা এই দুই ভাই শুধু উপলব্ধিই যে করেছেন তাই নয়, রীতিমতো ট্যাঁকস্থও করেছেন। তাই দু-ভাইকেও শ্রদ্ধা করে শিরীষ। এঁদের দুজনের জীবন-ই স্ত্রী-ভূমিকাবর্জিত। স্ত্রী-চরিত্রের অভাবও যে, তাঁরা কখনো অনুভব করেছেন এমনও মনে হয়নি কখনো শিরীষের, এঁদের নাটুকে-জীবন শিশুকাল থেকে কাছ থেকে দেখেও।

একজন বয়স্ক কাজের লোক, মন্টুরাম কাহার এঁদের দুজনের খিদমদগারি করে আসছেন। ঠিক কত বছর যে হল, তা জগাদা-মাধাদা-ই সঠিক বলতে পারেন না, আর শিরীষ জানবে কোত্থেকে?

মন্টুদাদা কানে বেশ কম শোনেন। তবে যখন কোনো কথা শুনতে ইচ্ছে করেন না, তখন ই কম শোনেন। ইচ্ছে করলেই শুনে ফেলেন। মন্টুদাদার বাঁ-কানটা ডান কানের চেয়ে বড়ো এবং দু-কানের গহ্বরেও লিটপিটিয়ার ঝাড়ের-ই মতো সাদা-কালো লোমের ঝাড় ফ্লাওয়ারিং পট থেকে ঝুলে-থাকা লাভা-লেগাঁও-এর অর্কিডের মতোই ঝুলে থাকে। ক্কচিৎ-কদাচিৎ তাতে উদবাস্তু পোকা-মাকড়েরাও আশ্রয় নেয়। কিন্তু ‘মাতৃধাম’-এ, জগাদা-মাধাদাদের এই পৈতৃক নিবাসে; মন্টুদার কথাই শেষকথা। ভাঁড়ারের চাবি থেকে আলমারির চাবি, ধোপর হিসেব থেকে মুদির ফিরিস্তি, ওষুধের থলে থেকে ইসবগুলের ভুসি এইসব-ই থাকে। মন্টুদাদার কাছেই।

সংসারটা চলে জগাদার অনিয়মিত ওকালতির রোজগারে। কিছু জমি-জিরেতও আছে পুনয়ার দিকে। ভাগে দেওয়া আছে। তাও দেখাশোনার ভার মন্টুদাদার ওপরেই। তার-ই ফসলের আয় থেকেই যতটুকু শখ-আহ্লাদ। অভাবও নেই; বাহুল্যও নেই।

মাধাদা নির্ভেজাল বেকার। তবে মাঝে-মধ্যে ‘চাকরি-চাকরি’ খেলা করেন। কিন্তু দুইভায়েতে বেজায় ভাব। মাঝ-মাঝেই জগাদার কাছে মাধাদা গালাগাল যে, খান না এমন নয়। তবে তা তাঁর বেকারত্বর কারণে কখনোই নয়। এবং রামের মতো অগ্রজের দেওয়া কোনো গালাগালিতেই, তা যদি অন্যায়ও হয়; তবুও কখনোই মনেও করেন না মাধাদা কিছুমাত্রই।

জগাদার জিভে একটু আড়ষ্টতা আছে। বাচ্চাদের মতো ‘ট’ ‘ট’ করে কথা বলেন তিনি। যেমন ‘কেমন আছ’-কে বলেন ‘কেমন আট?’ ‘তাল্পর’কে বলেন ‘টাপ্পর। এজন্যেও শিরীষের খুব মজা লাগে জগাদার কথা শুনতে। ওঁরা দু-ভাই এই পিতৃমাতৃহীন শিরীষকেও খুব-ই পছন্দ করেন। স্নেহ করেন অকৃত্রিম। প্রায়-ই ওঁদের সঙ্গে খেয়ে যেতে বলেন। ভালোমন্দ রান্না হলে তো অবশ্যই বলেন। ওঁদের বড়োবাড়িতে এসে পাকাপাকিভাবে থাকতেও বলেছেন বহুদিন, যেহেতু শিরীষ একলা থাকে। কিন্তু পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে আসতে চায়নি ও। মা বাবার স্মৃতি ছড়ানো আছে সেখানে। তা ছাড়া বুড়ি-মাই কোথায় যাবে? সেই অতিসাধারণ রূপের কিন্তু দিব্য-সুন্দর মনের বৃদ্ধা, অশক্ত, বিধবা মহিলার তো শিরীষ ছাড়া কেউ-ই নেই। শিরীষ যতদিন দু-টি ডাল-রুটি খাবে, বুড়ি-মাইকেও খাওয়াবে। ওই শেষবন্ধন শিরীষের।

অবশ্য কালু কুকুরও আছে। কুকুরের জীবনের গড় দৈর্ঘ্য ও মানুষের জীবনের গড় দৈর্ঘ্য বিবেচনা করলে কালু আর শিরীষ সমবয়েসি।

বাড়ি ছেড়ে, জগাদা-মাধাদাদের নিবাস ‘মাতৃধাম’-এ না-আসার আরও কারণ আছে। শিরীষের বাড়ির পেছনেই পাহাড়তলির জঙ্গল। তারপরেই পাহাড়। ওর কবিমন বড়োই আনন্দে থাকে ওই পরিবেশে। তা ছাড়া, মাতৃধাম’ ‘মনোয়া-মিলন’ বাজারের-ই মধ্যে। নানা মাড়োয়ারির এবং দু-একজন বিহারির পাইকারি দোকান। খোলের গন্ধ, গুড়ের গন্ধ, কেরোসিন তেলের গন্ধ। আর সারাদিন বয়েল গাড়ি, ট্রাক, আর বাইরে দাঁড় করিয়ে-রাখা মস্ত দাঁড়িপাল্লাতে হরেকরকমের বস্তা ওজনের ধাঁই-ধল্পর আওয়াজ; শোরগোল।

এমন জায়গাতে, একেবারে বাজারের মধ্যে থাকার সুবিধে থাকতে পারে অনেকইরকম কিন্তু অসুবিধেও কম নয়।

শিরীষের ভালো লাগে না।

শিরীষ ‘মাতৃধাম’-এর বাইরে চওড়া কিন্তু ধূলি-ধূসরিত লাল সিমেন্টের বারান্দার ওপর সাইকেলটাকে তুলে মোটা গোলাকৃতি লাল সিমেন্টের থামে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বসবার ঘরে ঢুকল। সেই ঘরটি-ই সেরেস্তা জগাদার।

সোনালি ফ্রেমের হাফ-আই গ্লাসের চশমা থেকে চোখ দু-খানি ভুরুর সঙ্গে তুলে, কাঁচ টপকে, জগাদা শিরীষের মুখে ফোকাস করে বললেন, এই ডে ঠিরিঠ! এটো, এটো! টোমার কটাই ভাবটিলাম এটক্কন। ফোনটাও খাডাপ।

কেন? আমার কথা কেন জগাদা?

না, মানে, মাডাটা গেটে বানোয়ারিলালকে টঙ্গে নিয়ে টোড়ি আর লাটেহাড়ের মডের কোনো ডায়গাটে। করগোট ঠিকার করটে। মটলা-টটলা বেটে রাকটেও বলে গেঠে মন্টুডাডাকে। এডিকে গেঠে, ঠেই কোন বোরে কি ড্যাকো, একনও টো পিরল না। ডেকেটো! চাট্টে বেড়ে গেল। কিন্তু একনও পিরল না। এ টো বড়ো টিন্টার কটা হল। ব্যাপারটা ইনভেট্টিগেট করটে হট্টে। পান্ডেকে বললুম ডাও, এটু কোঁজ কভো। কিন্টু ঠে বলটে, টার ঠালি এটেটে টার বাড়িতে, ঠুটুরবাড়ি, গুমিয়া টেকে; তাই ঠে ডেটে পাট্টে না।

যাওয়ার দরকার-ই বা কী জগাদা? আর আন্দাজে যাবেনটাই বা কোথায়? কোন বাদাড়ে বা টাঁড়ে খরগোশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁরা, তা জানাই-বা যাবে কেমন করে? খরগোশ তো সব টাঁড়ের গর্তেই থাকে, যেখানেই পুটুস বা ঝাঁটিজঙ্গলের ঝাড়। আমাদের বাড়ির পেছনের টাঁড়েই কত খরগোশ-তিতির আছে। তো দূরে যাওয়ার দরকারটাই বা কী ছিল?

শিরীষ বলল, একটু বিরক্তির গলাতেই।

টা ঠিক। কিন্তু টিন্টাও টো হয়। ঠোটো বাই বলে কটা। টাও পাঁচটা নয়, ডটটা নয়; একটা মাট্রই বাই। বলো?

হাসিই পেল শিরীষের। কিন্তু হাসি সামলে বলল, ছোটো হলেও এমন কিছু ছোটো তো নয়। আমার চেয়ে কমপক্ষে বছর পনেরোর বড়ো তো হবেন-ই।

কত বয়স হবে মাধাদার? আটত্রিশ-উনচল্লিশ? শুধোল শিরীষ।

আরে বায়া, বয়েট কী আর বয়েটে হয়! ও ডে বড্ড ঠেলেমানুট। ওর কোনো অভিজ্ঞটাই টো হল না। ডট বঠরের খোকাটাই আটে একনও।

তা, আপনি আজীবন খোকা করে রাখলে আর মাধাদা বড়ো হবেন কী করে? চিন্তা করবেন না, এসে গেলেন বলে। সন্ধে অবধিও না এলে মন্টুদাদাকে দিয়ে আমাকে একটা খবর পাঠাবেন।

একন টো বোটো। কী কাবে? টা? না টাণ্ডা কিছু?

নাঃ। কিছুই খাব না জগাদা।

পান্ডেবাবু বললেন, ম্যায় তব চলে স্যার।

ডাও, ডাও। ঘরমে মেহমান আয়ি হ্যায়, আরে, জরুকি বহিন; ডলডি ডাও। রুপিয়া পয়সাকি কুচ জরুরত হ্যায় টো লে যাও পান্ডে।

নেহি স্যার। কাল-ই তো আপনে দিয়া। বহত সুক্রিয়া।

আরে টিনেমাকো ডায়ালগ মট ঢাড় ইয়ার। ডাও। ডের হো রহি হ্যায়।

আচ্ছা! তব ম্যায় চলে। আচ্ছা, শিরীষবাবু, চলে।

আচ্ছা পাভেজি।

শিরীষ বলল।

পান্ডেজি তাঁর স্কুটারে করে চৈত্রমাসের পথের লাল ধুলো আর হালুইকরের দোকানের সামনের পথের এঁটো শুকনো পাতা উড়িয়ে চলে গেলে শিরীষ বলল, জগাদা, মাধাদা লাতেহারে একটা চাকরি পেয়েছিলেন তার কী হল? কিছুদিন আগে তো স্টেশনে দেখাও হয়েছিল আমার সঙ্গে। হেসে বললেন, চাকরি করছি যে, শিরীষ। ছোট্ট অফিস। ঝামেলা নেই। মনে হচ্ছে, এবারে থিতু হয়ে বসব। দাদার ঘাড়ে সারাজীবন। বিবেকে বড়ো দংশন হয়।

এটা কত নম্বর চাকরি হল তোমার মাধাদা?

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

তা সম্ভবত এক-শো পনেরো কিংবা ষোলো। চাকরি তো দাদা কম ঠিক করে দেয়নি। আর কতরকমের-ই বা চাকরি! কিন্তু আমার শিরাতে রয়েছে হুড়কোহাটের মুকুজ্জেদের রক্ত, জমিদারি রক্ত; কারো চাকর হতেই যে, ভালো লাগে না। কী করব বলো শিরীষ?

জগাদা হাসলেন একথা শুনে। বললেন, হাউ টুইঠ! জগাদা মাধাদারা যতই আয়েশি হোন না কেন, এদিকের বাঙালিরা কিন্তু কুঁড়ে নন। আসলে, মনোয়া-মিলন’-এ থাকলেও মনে মনে এখনও তাঁরা হুড়কোহাটে-ই রয়ে গেছেন।

পান্ডেবাবু মাঝে মাঝেই বলেন শিরীষকে, আররে শিরীষবাবু, বাঙালি আদমি বনতা হ্যায় বাঙালকা বাহার যা কর।” শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়। মিথ্যে নয় বলেই এ নিয়ে ঝগড়াও করেনি কোনোদিন।

নিজের চিন্তাতেই কুঁদ হয়ে ছিল শিরীষ। ও এরকম-ই।

ঝিঁঝি মাঝে মাঝে হেসে ওকে বলে, কী হল রে তোর? তুই কি চাঁদে চলে গেলি?

হ্যাঁ। ও এরকম-ই। ও ওর-ই মতো। অন্য কারো মতোই নয়।

টাকরি টো বালোই করটিল।

স্বপ্লেখিতের মতো চমকে উঠল শিরীষ জগাদার কথাতে।

তাহলে? আবার কী হল? চাকরিতেও তো খুব খুশিও ছিলেন মাধাদা মনে হয়েছিল তার কথা শুনে।

টাও টেল।

তবে?

পোটোম ভুডিন আপিট গেল। আই ওড ভেরি হ্যাপি। টাপ্পরডিন ডেকি আপিট ডাট্টে না।

বললুম, কী ব্যাপার ড়ে মাডা? আপিটে গেলি না?

টা মাডা বললে, ডাডা, পেটের নীটোতে ব্যটা করটে।

আমি বললুম, ডাড়া! ডাড়া! টোকে নাক্স-বোমিকা ঠাট্টি এনে ডিট্টি। কেয়ে নে। টঙ্গে টঙ্গে বালো হয়ে ডাবি।

টা, ওটুড টো এনে ডিলাম। বিকেলের ডিকে বলল, ব্যটা নেই।

তারপর?

টাপ্পরডিনও ডেকি মাডা আপিটে ডাট্টে না। আমি কোর্টে বেরুট্টিলুম ডকন, টকন বললুম, মাডা আড কী হল?

টা, ঠে বলল, ডাডা। ওপর-পেটে বিটন ব্যটা। টা ঠুনে, এনে ডিলুম ওকে ওপর পেটের ব্যটার ওঠুডও। বললুম, কাঁটকলার ঢোল ডিয়ে পুরোনো টালের বাট বেঁড়ে ডিটে বল মন্টুডাডাকে। কেয়ে, টুয়ে ঠাক।

তারপর?

টাপ্পরডিনও ডেকি মাডা অপিসে ডাট্টে না, বুডলে ঠিরিঠ। টকন আমার টণ্ডেহ হল। টণ্ডেহ পোটম ঠেকেই হট্টিল কিন্টু টকন টা ঘনীভূট হল।

কী বললেন জগাদা?

শিরীষ শুধোল।

বললুম, টণ্ডেহটা ঘনীভূট হল।

টেডিন লাটেহারের কোর্টে মামলা ঠেঠ করে গেলুম মাডার আপিটে। টা, আপিট বণ্ড। ডেকলুম, বাইরে ডরভাটে মঠুবড়ো টালা ডুলটে একটা। এক কামডাড আপিট। টালা ভোলা মানেই লাল বাটি ডেলে ডাওয়া। না টো কী? বলো ঠিরিঠ?

তা তো বটেই জগাদা। তারপর?

কী করি? ডেকলুম, মাডার আপিটের ঠিক উলটোডিকেই একটা ডড্ডির ডোকান। ডু-ডন কাবুলি-ডড্ডিপা-মেঠিনে বঠে বঠে ঝররররর ঠব্দ করে কী ঠব ডেন ঠেলাই করে ডাট্টে। ঢড়ের মটো, ঢর্নার ঠবডর মোটো ঠবড।

কাবুলিওয়ালার দর্জির দোকান? বলেন কী জগাদা? আছে নাকি? জন্মে দেখিনি। তারা তো হিং, সুরমা এসব-ই বেচে। নয়তো সুদের কারবার করে।

শিরীষ মজা পেয়ে বলল।

এ বিপুলা পিটিবীর কটটুকু ডানো টুমি বায়া? আমি-ই বা কটটুকু ডানি? ডা বলটি, ঠোনো।

হ্যাঁ। তারপর?

টাপ্পর টাডের-ই গিয়ে ঠুডোলুম, বাইঠাব, উলটোদিকে যে, আপিটটা ঠিল, টার কী হল?

একডন কাবুলি, পা-টালানো ঠামিয়ে আমার ডিকে হাট টালিয়ে বলল, ওকিলবাবু, আপিট টো ঠা স্রিফ ডো আডমিকা। হেডবাবু ঔর অ্যাটিটট্যান্ট! অ্যাটিটট্যান্ট, রুলার ডেকে হেডবাবুকি শারপর অ্যায়সা ঠোক ডেল, যো হেডবাবু চলে গেল হটপিটালমে।

আঁ? হটপিটালমে?

জি হাঁ।

আমি বন্ধু, ডাহান্নমে ডান হেডবাবু। মাডার টাকরিটা ঠেল অ্যাটিটট্যান্টের। টাই, আমি ঠুডোলুম, আর অ্যাটিটট্যান্ট? টার কী হল?

তারপর?

শিরীষ উত্তেজিত হয়ে শুধোল।

হাঃ। হাঃ হাঃ। করে হাসল সেই কাণ্ডাহারের কাবুলি। বললেন, অ্যাটিটট্যান্ট টো অ্যাবস্কণ্ডিং। ঔর হেডবাবু হটপিটালমে।

বোচো টালে! ঠাডে কি বায়া আমার নীচের পেটে ওপর পেটে ব্যটা বলে ঠুয়ে ঠাকে?

মাধাদার অফিস আর খুলবে না?

খুলবে কী? হেডবাবু ঠেল নগর-উন্টারির এক ঠেঠ। ঠে হটপিটাল ঠেকে ছাড়া পেয়ে ট্রেট নগর-উন্টারি। মাডার বিরুচ্ছে কেঠ পজ্জন্ট করল না। অবশ্য ঠরকার ঠেকে করেঠেল কিন্টু আমি ডরা-কড়া কড়ে টাকে ‘নিপ্ট-ইন-ড্যা-বাড’ কড়ে ডিলুম।

এমন সময়ে পাশের শর্মা ডাক্তারের ডিসপেনসারি থেকে একটি ছোকরা, তার নাম বিহারি; দৌড়ে এসে বলল, ফোন হ্যায় ওকিল সাহাব!

কাঁহাঠে রে?

টোড়িসে।

কওন কিয়া?

কোই আনজান আদমি। কহতে কী যো মাধবাবু বহত খাতরে মে হ্যায়।

খাটরা? কওন নয়া খাটরারে বাবুয়া?

ম্যায় ক্যা জানু ওকিল সাব?

ডাও বায়া ঠিরিঠ, একটু ডেনে এটো। আমি টটক্ষণে একটু মকরঢ়বজ মেড়ে, কেয়ে আটি। কী খাটরারে বাবা!

শিরীষ উঠে গিয়ে ডাক্তারখানাতে ঢুকল। বলল, পরনাম ডাক্তারসাব।

পরনাম শিরীষ। মজেমে হ্যায় না?

জি হাঁ। মজেমে।

রিসিভার তুলে নিয়ে শিরীষ বলল, বলিয়ে জি। হুয়া ক্যা?

আপ কৌন?

আরে বলিয়ে না জি, হুয়া ক্যা?

মাধাইবাবু হ্যায় না ‘মনোয়া-মিলন’ কি? ফওজদারি ওকিল, ট’ ‘ট’ করনেওয়ালা জগাইবাবুকি ভাই…।

হাঁ হাঁ। সমঝ গ্যয়া। বলিয়ে না জি। আগে বাড়িয়ে।

মাধবাবুনে ঔর উড়কি দোস্ত বানোয়ারিলালজি, মনোয়া-মিলনকি, কাপড়ওয়ালা…

হাঁ হাঁ। মুঝে মালুম হ্যায়। খরহা শিকার খেলনে গ্যয়া থা…

খরহা?

হ্যাঁ। ঔর ক্যা?

বলেই, ও-প্রান্তের মানুষ বললেন, অব সমঝা।

ক্যা সমঝা আপনে?

খরহা? খরহা তো মানহুশ হোতা হ্যায়। কোই রহিস খানদানিকি আদমিকি লায়েক শিকার নহি হ্যায় জি… অর্থাৎ, খরগোশ তো অপয়া। কোনো ভদ্রলোকের যোগ্য শিকার হল খরগোশ? ছ্যাঃ।

আপ ক্যা বকোয়াস কর রহা হ্যায় জনাব, জারা খুল কর তো কহিয়ে, আসলিমে হুয়া ক্যা?

জগাবাবুনে ভইষ শিকার কিয়া। ভইষ! লেহ-লটকা। হাঃ।

ভইষ! হা রাম!

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল শিরীষের। স্থানমাহাত্মে।

জি হাঁ। ম্যায়নে অ্যাইসিহি শুনা। ঔর দুসরা জানোয়ার ভি হোনা শকতা।

জগাদা মাঝে মাঝেই পান্ডুকটা, হরিয়ালটা, তিতিরটা, বটেরটা, খরহা বা জংলি মোরগটাও শিকার যে, না করেছেন তা নয়। কোনো বজরঙ্গবলীর কোনো কুক্ষণের দৈবাদেশে হঠাৎ উৎসারিত হওয়ায় শরীরের এবং মস্তিষ্কের মেটাবলিজম-এ কীসব অদৃশ্য অঘটন পটিয়সী কান্ড-মান্ড ঘটিয়ে অচানক জগাদাকে মোষ-শিকারিতে উন্নতি করে দিল তা ভেবে ও যারপরনাই উল্লসিত, উত্তেজিত, উৎকণ্ঠিত এবং যাবতীয় ‘উঃ’ হয়েই পরক্ষণেই একেবারে কাঠ হয়ে গেল।

এ যে গো-হত্যা। মোষও তো গবাদি পশু।

টেলিফোনের ওপাশ থেকে দৈববাণী হল, মুঙ্গালাল শেঠকি ভইষ পোকরাকি বগলমে ঘাস চুনচুনকে খতা থা। মাধবাবু ভারি ঔর নামি জঙ্গল, ভাগলপুরকি ভাইষালোটনকি জংলি ভই শোচকর হম্মচকে উসহিকি উপ্পর গোলি ঠোক দিহিন। হা রাম।

এবার নতুন করে অবাক হওয়ার পালা শিরীষের।

বলল, মর গ্যয়া ভইষ? অব ক্যা হোগা? বি. জি. পি. ওয়ালালোগোঁকে পত্তা লগ যানে সে?

ওপাশ থেকে চাপা হাসি শোনা গেল। তারপর পুনঃবাণী। লেহ লটকা। ভইষ কা, স্বপ্ন কি ভইষ হো, যো বটের-মারনেওয়ালি গোলিসে পটক যায়ে গা? অচানক? হুঃ।

আরে ইয়ার, হুয়া ক্যা? বাতাও তো সাহি।

ঔর হোগা ক্যা? যে হোনেকা থা, ওহি হুয়া।

শেঠ মুঙ্গালাল, মাধবাবু ঔর বানোয়ারিলালকো উনকি হাভেলিমে ভর দিহিস। আজ তো ইতোয়ার। কাল কোতোয়ালিমে কেস চড়ে গা। আভি জগা মুকার্জি ওকিলকো আনে বলিয়ে ভাইয়াকো ছোঁড়ানেকি লিয়ে, নেহি তো জান কয়লা হো যায়গা দোনো হান্টরসাবকি। না দানা, না-পানি। ঔর কুছ বাদ-বাদ ধাদ্দারধ্বানি!

ভইষালোটনওয়ালা ভইষ মরা তো নেহি না ভাই?

আররে নেহি জি। ভইষকো শিংমে তো গোড়াসি গুদগুদিহি লাগা হোগা। ঔর ক্যা? অজীব আদমি হ্যায়, ভাই তু। জবরদস্ত জংলি ভইষ মারনা বাচ্চোঁকা কাম হ্যায় ক্যা?

ফোন নামিয়ে রেখে জগাদার কাছে গিয়ে সব বৃত্তান্ত বলল শিরীষ।

জগাদা বললেন, এই নিয়ে টেট্রিশ বার।

কী?

‘বেল’ ডিয়ে মাকে ঠাড়ানো। একন ডেকি। ঠেঠ কী বলে? অবঠ্য আমাকে ঠেনেন উনি। একটা কেঠ করেছিলাম ওঁর পক্ষে। ম্যাজিটট্রেটও অবঠ্যই টেনেন।

তা, যাবেন কীসে? অতদূর? এখন তো ট্রেনও নেই।

কেন? চৌপান এক্সপ্রেস। একন-ই টো এটে ডাবে ট্রেন। টুমি বরং আমাকে টোমার ঠাইকেলে করে এটু টেঠনে পৌঁঠে ডাও ঠিরিঠ। আমারটা টায়ার পাংটার হয়ে পড়ে আটে।

ফিরবেন তো আজ রাতেই?

আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। বিকেলের গাড়িটেই ফিরে আটব।

চলুন, তাহলে আপনাকে পৌঁছেই দিয়ে আসি স্টেশনে।

শিরীষ বলল।

.

শীত শীত করছে যে রে।

ঝিঁঝি বলল, ওদের বাড়ির কাঠের গেটটা বাইরে থেকে বন্ধ করতে করতে।

শিরীষ নিজের সাইকেলটা প্রাচীন একটি ইউক্যালিপ্টাস গাছের গোড়াতে হেলান দিয়ে রেখেছিল। ডান হাতে সাইকেলটার হ্যাঁণ্ডল ধরে সেটাকে টেনে নিয়ে বলল, তুই তো এখানে নতুন নোস। তোরও তো জানার কথা। পয়লা বৈশাখ অবধি রাতে চাদর গায়ে দিয়ে শুতে হয়। সন্ধের পরেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগবে। আর সকালেও, রোদ ওঠার আগে। এ তোদের কলকাতা? না রাঁচি? রাঁচির আবহাওয়া একসময়ে অন্যরকম ছিল। এখন তো যেকোনো শিল্পনগরীর মতোই হয়ে উঠেছে প্রায়। এত লোক, এত রিকশা, এত গাড়ি; এত আওয়াজ। সপ্তাহে একদিন যাই বইয়ের জন্যে কিন্তু তাতেই দম একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কেন? রাতে চাদর লাগেনি?

হ্যাঁ। তা লেগেছিল। তবে ভোর হওয়ার পরেও যে, লাগবে তা বুঝতে পারিনি।

কোথায় বসবি? ক্যারিয়ারে, না রড-এ?

কোথায় বসলে তোর সুবিধে হবে চালাতে?

যেখানে তোর খুশি, বোস।

তাহলে রডেই বসছি।

তোর লেডিজ সাইকেলের কী হল?

দু-একদিনের মধ্যেই এসে যাবে।

চালাতে ভুলে যাসনি তো?

সাইকেল চালানো আর সাঁতার একবার শিখলে কেউ কখনো ভোলে না।

তাই?

হ্যাঁ। ব্যাপারটা ব্যালান্সের। ‘ব্যালান্স’-এর বাংলা কী রে?

ভারসাম্য।

আর ‘ইকুইলিব্রায়াম’ কথাটার?

সেটা তো অর্থনীতির জাৰ্গন। এমন চৈত্রর উষাকালে অর্থনীতি না-হয় থাকলই এখন।

তাহলে থাক।

আয়, উঠে বোস। বলেই, শিরীষ সাইকেলটা একটা গোলাকৃতি পাথরের পাশে নিয়ে গিয়ে, নিজে উঠে বসে, দুই ঊরু ও পা শক্ত করে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে বলল, আয়।

উঠে বসতে গিয়েই ঝিঁঝি শিরীষের প্রায় বুকের ওপরেই এসে পড়ল, ভারসাম্য হারিয়ে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই অস্বস্তিতে বলে উঠল, দেখেছিস। একটু হলেই পড়ে যেতাম!

ওঠাটা সম্পূর্ণই তোর নিজের ইচ্ছাধীন ছিল। কিন্তু পড়াটা নয়। পড়ার আশঙ্কা থাকলেই জড়িয়ে ধরতাম তোকে। পড়তে তোকে দিতাম থোড়িই!

সেই আশঙ্কাটা ছিল বলেই তো আতঙ্কিত হয়েছিলাম। পড়লে তো পড়তাম তোর গায়েই!

তাই?

বলল শিরীষ। ভারি ভালো কথা বলে ঝিঁঝি। অনেকে বলে, শিরীষও বলে। শিরীষ নিজে যদিও তা মনে করে না। তবে একথা ও জানে এবং মানেও যে, কথা বলা বা চিঠি লেখা বা গান গাওয়া বা ছবি আঁকা এইসব-ই শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। এবং একমাত্র মানুষকেই বিধাতা এইসব বিশেষ মানবিক গুণপনাতে সম্পৃক্ত করেছিলেন। মানুষ যদি চৰ্চা দিয়ে, মনোযোগ দিয়ে, যত্ন দিয়ে এইসব গুণপনার উৎকর্ষসাধন করতে পারে তাহলে মন্দ কী!

নীল-ডুংরি অবধি কি সাইকেল যাবে?

নাঃ।

তবে?

সাইকেল রেখে দেব পাহাড়তলিতে।

চুরি হবে না?

মনোয়া-মিলনে চোর নেই।

চোর নেই, এমন জায়গা এখন ভারতবর্ষে আছে নাকি?

আছে আছে। অনেক-ই আছে। চোর-জোচ্চোরের ভিড় সব শহরে-নগরে। গ্রাম-গঞ্জ, এমন সব শুনসান জংলি এলাকা এখনও অপেক্ষাকৃত ভালো আছে।

মা তো সেইজন্যেই কলকাতা ছেড়ে এসেছিলেন।

কাকিমা বুদ্ধিমতী।

আর কাকিমার মেয়ে?

তার ‘বুদ্ধি’র পরীক্ষা তো নিইনি এখনও। পরীক্ষা আগে হোক, তারপর ফল জানাব।

আচ্ছা।

বলল ঝিঁঝি, চাপা কৌতুকের সঙ্গে।

ভারি ভালো লাগছিল শিরীষের। চৈত্র-শেষের এইসব আলো-ফোঁটা সকালে কোথা থেকে যে, একটা মিষ্টি, হরজাই-গন্ধমাখা হাওয়া ছাড়ে। আসলে, হাওয়াটা থাকেই। সারারাত-ই থাকে। নিজেরা ঘরবন্দি থাকে বলেই উদোম হাওয়াটা এমন সর্বাঙ্গে আদর বুলোতে পারে না। কতরকম নাম-জানা এবং না-জানা পাখি ডাকছে এই সকালকে স্বাগত জানিয়ে। গন্ধের আভাসের মতো এই গন্ধ, শব্দের আভাসের মতো এই শব্দ, এই আলতো চুমুর মতো এলোমেলো ছুঁয়ে-ছাওয়া এই হাওয়া; সব মিলেমিশে দিনের এই সময়টুকুতে অত্যন্ত নীচ, ইতর চরিত্রের মানুষকেও সম্ভবত মহৎ, উদার, ক্ষমাময় করে তোলে। সব শত্রুতা, নীচতা, খলতা, ঈর্ষা, কুটিলতা, ধর্মান্ধতা যেসব দোষের কারণে মানুষের মতো এমন মহৎ-প্রাণও অমানুষ হয়ে ওঠে, সেসবের সবকিছুই ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে।

ঝিঁঝির বাবা, যাকে ইংরিজিতে বলে ‘ফিলদি-রিচ’, তাই ছিলেন। তাঁকে দেখেছে শিরীষ ওর কৈশোরে। এবং দু-একবার ছাড়া, দূর থেকেই। শিরীষের বাবাই যেতেন ঝিঁঝির বাবার কাছে, যখন উনি আসতেন ‘মনোয়া-মিলন’-এ বছরে একবার কী দুবার; কলকাতা থেকে। শিরীষের বাবা স্বপ্নময় যখন এক আত্মীয়র বিয়ে উপলক্ষে কলকাতায় গেছিলেন, তখন গেছিলেন ঝিঁঝিদের বাড়িতে। ফিরে এসে, উত্তেজিত হয়ে ঝিঁঝিদের বৈভবের গল্প করেছিলেন শিরীষের মাকে।

কিশোর শিরীষ অবাক হয়ে শুনছিল।

শিরীষের বাবার চরিত্রে অনেক ভোগ, বাসনা, অর্থ, ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তিরও লোভ ছিল। যশ-এর আকাঙ্ক্ষা অবশ্য ছিল না। কারণ, বুদ্ধি রাখতেন বলেই জানতেন যে, যশ’ ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। চাইলেই তা সবসময়ে পাওয়া যায় না এবং চালাকির দ্বারা পেলেও সেই যশ রাতের হাসনুহানার গন্ধের মতোই সকালে মরে যায়। এই কারণে, শিরীষ তার বাবাকে অপছন্দ না করলেও খুব একটা পছন্দও করেনি কোনোদিন। কিন্তু ওর মা, মালিনী ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য চরিত্রের, কোনোরকম পার্থিব ব্যাপারেই তাঁর বিন্দুমাত্র লোভ ছিল না। তখন থেকেই মা রাঁচির অথবা ডালটনগঞ্জের লাইব্রেরি থেকে নানারকম বই আনাতেন, রেকর্ড কিনিয়ে আনাতেন। গ্রামোফোনও ছিল মায়ের, শিরীষের যেমন ক্যাসেট-প্লেয়ার। সাহিত্য, গান, জীবনের যা-কিছু সুন্দর দিক শিরীষের, তা তার মায়ের-ই দান। মা নিশ্চয়ই মুক্ত হয়ে গেছেন।

অন্ধকার রাতে তারাভরা আকাশে চেয়ে মায়ের হাসিকে খোঁজে শিরীষ। হিন্দুধর্মে বলে যে, আত্মা অবিনশ্বর। যদি সে-কথা সত্যি হয়, তবে মায়ের আত্মাকে আর কখনোই ফিরে আসতে হবে না এখানে। বাবা হয়তো ফিরে এসেছেন আবার। তাঁর চেয়ার-টেবিল, তাঁর জমি-জিরেত, তাঁর বনের গাছ কেটে পয়সা উপার্জনের ব্যবসা ছাড়াও গরিব-গুরববাদের সর্বস্বান্ত করার সুদের ব্যবসা, যে-কথা বড়ো হওয়ার পরে জেনে বড়োই লজ্জিত বোধ করেছে শিরীষ তার বাবার জন্যে; এ সবকিছুই ছিল তাঁর প্রাণ। এর বাইরে, খাওয়া-দাওয়া, হুই-হল্লা, অর্থ-চিন্তা ছাড়া বাবার জীবনে আর কিছুই ছিল না। বরং এইজন্যেই তাঁর লোভের হাতেই তাঁকে মরতেও হল। ‘পাপের বেতন মৃত্যু’। পুনুয়ার জঙ্গলের পাশে তার বাবার যে জমি এবং ভান্ডার ছিল, সেই জমির ভাগচাষিকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত করায়, নকশাল ছেলেরা প্রচন্ড গরমের মধ্যে একদিন সন্ধের মুখে টাঙ্গি দিয়ে কুপিয়ে শিরীষের বাবাকে কেটে ফেলে। সেইদিন থেকেই বাবার সেই ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত দেহের ভয়াবহ স্মৃতি আর মানুষের পার্থিব জিনিসের প্রতি তীব্র কামনা-বাসনা শিরীষের চোখে যেন, সমার্থকই হয়ে গেছে। লোভ, যে-কোনোরকম লোভ দেখলেই ও চিনতে পারে। বাবার মৃতদেহের কথা মনে হয়।

এইমুহূর্তে সত্যিই ভারি ভালো লাগছে শিরীষের। তার বুকে, প্রায় পিঠ লাগিয়ে বসে-থাকা ঝিঁঝির গায়ের গতরাতে-মাখা পাউডারের, অথবা কোমর-ছাপানো খোলা চুল থেকে উড়ে আসা মাথার তেলের অথবা অন্য কোনো প্রসাধনের হালকা গন্ধ উড়ছে নাকের সামনে। কোনোদিনও ওর পঁচিশ বছর বয়েসে ও কোনো সমবয়েসি বা অসমবয়সি যুবতী-শরীরের এতকাছে আসেনি। শুধু কৃষ্ণপক্ষের মধ্যরাতের কালপেঁচার বুক কাঁপানো ডাক অথবা হায়নার বুক-হিম-করা অট্টহাসি অথবা শুক্লারাতের পাগল-করা পিউ-কাঁহা, বা পাগল-হওয়া কোকিল বা বসন্তবৌরির চন্দ্রাহত, বিপন্ন-বিস্ময়ের তীব্র তীক্ষ্ণ রোমাঞ্চ জাগানো ডাক-ই নয়, যুবতী-শরীরের সান্নিধ্যও যে, একজন যুবকের কাছে সমান বিপজ্জনক এবং রোমাঞ্চকর এই সত্যটি সম্বন্ধে সে, সম্পূর্ণ অনবহিত ছিল।

অবশ্য ভাবছিল ও, কতটুকুই বা ও জানে! তবে এটুকু বুঝতে পারছে সাতসকালে যে, যে নীলপাখির বাসস্থান দেখানোর অভিপ্রায়ে চলেছে ঝিঁঝিকে নিয়ে নীল-ডুংরির টোংড়িতে আজ এই স্নিগ্ধ, সুগন্ধি ভোরে, সেই আশ্চর্য রহস্যময় নীলপাখির-ই মতো, প্রকৃতির-ই মতো নারীও সমান রহস্যময় প্রতিটি পুরুষের কাছে। পুরুষের তাবৎ জ্ঞান-বুদ্ধি, নারীর তাবৎ স্বাধীনতা-আন্দোলন এই আশ্চর্য রহস্যের কোনোদিন-ই কোনো হেরফের হয়তো করতে পারবে না। শিরীষের এই সুন্দর মুহূর্তে এও মনে হচ্ছিল যে, বিশ্বের নারীরা নারী-প্রগতির সব আন্দোলন ইচ্ছে করলে এবং সিরিয়াসলি বিবেচনা করলে বন্ধও করে দিতে পারতেন। কারণ, বিধাতা সৃষ্টির সময়ে তাঁদের-ই পুরোপুরি জিতিয়ে রেখেছেন। পুরুষ চিরদিন-ই ভঙ্গুর। সস্তা কাঁচের বাসনের মতো। তাঁদের যা বল, পুরুষের সেটাই দুর্বলতা। পুরুষ যখন নারীর ভুরুভঙ্গিতে, কটাক্ষে, চিকন গলার স্বরে, তার অন্যরকম ভয়ানক, পুরুষের পক্ষে অত্যন্ত-ই বিপজ্জনক শারীরিক সৌন্দর্যে এবং নমনীয় মানসিক কমনীয়তায়, মমত্বে, মাতৃত্বে এবং বন্ধুতায়ও পুরুষদের চিরদিন-ই অঙ্গুলিহেলনে চালনা করেই এসেছে তখন আর সেই চিরহেরো-প্রজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করার তাঁদের দরকার-ই বা কী ছিল?

এটা কী গাছ রে শিরীষ?

এটা কুসুমগাছ।

গাছের-ই নাম কুসুম? বাঃ।

হ্যাঁ।

এখন এদের পাতা সব ঝরে গেছে। ন্যাড়া। আরও ক-দিন বাদে বৈশাখের গোড়াতে এদের ডালে ডালে নতুন পাতা আসবে। পাতাগুলোর রং যে, কী সুন্দর তোকে কী বলব! লালের তো বহুরকম হয়। লাল, গোলাপি, মরচে-লাল, ইট-লাল, ফর্সা গালের-লাল, রক্ত লাল, টিয়া-ঠোঁট লাল, পোস্টাপিস-লাল, আরও কতরকম লাল। কিন্তু কুসুমগাছের নতুন-আসা পাতার যে-লাল সেই লালের কোনো তুলনা বা বর্ণনা কোনো কাব্য-সাহিত্যেই পাবি না। যেমন পাবি না, বৈশাখের ওই সময়ের বা শীতের সময়ের বন-জঙ্গলের সবুজের বর্ণনা।

মানুষে জানে, সবুজ শুধু সবুজ-ই!

কিন্তু আমাদের দেশে বনে-পাহাড়ের লাল, সবুজ আর হলুদের যে, কতরকম হয়, সেই কথাটা একজন লেখকও লিখলেন না। কিন্তু তুই দেখিস, আমি যখন লিখব, তখন আমি ঠিক-ই লিখব।

ঝিঁঝি চুপ করে রইল। সে বুদ্ধিমতী মেয়ে। বুঝল যে, শিরীষকে এখন কথাতে পেয়েছে। এই তোড়ে এখন বাধা দিতে নেই।

শিরীষ বলল, ঈশ্বর সব মানুষকে-ই চোখ দিয়েছেন, নাক দিয়েছেন, কান দিয়েছেন, একটি করে মনও দিয়েছেন, কিন্তু দেখতে বা গন্ধ নিতে বা শুনতে বা ভাবতে ক-জন মানুষ সত্যিই পারে? বল? আমি খুব ভাগ্যবান রে ঝিঁঝি। এই জঙ্গলের-ই মতো, এই সকালের-ই মতো তোকেও আস্তে আস্তে একটু একটু করে চিনছি। আমার খুব সৌভাগ্য।

ঝিঁঝি মনে মনে বলল, কেউ-ই কাউকে চেনে না। চেনা কি অতসোজা?

তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল দু-জনেই। নির্জন, প্রায় নিস্তব্ধ, শুধুমাত্র হাওয়ার অদৃশ্য হাতে ঝাঁট-দেওয়া শুকনো পাতার গড়িয়ে যাওয়ার মৃদু শব্দ আর প্রভাতি পাখির ডাকের অনুচ্চ শব্দে ছিদ্রিত এই সকালকে সাইকেলের চেনের ক্যাঁচ ক্যাঁচ’ শব্দ আর লাল মোরাম মাটির ওপরে টায়ারের গড়িয়ে যাওয়ার মৃদু ‘কুড়মুড়’ শব্দ বিরক্ত করতে লাগল।

শিরীষ স্বগতোক্তি করল, চেনটায় তেল লাগাতে হবে। সময়ই পাই না।

ঝিঁঝি উত্তর দিল না কোনো। কিছু কথা থাকে, স্বগত; তার উত্তর হয় না।

একটু পরে ঝিঁঝি বলল, ওই নীলপাখি দুটি কি সব বছরেই আসে?

কোনো ঠিক নেই, আদিবাসীরাই জানে না। তা আমি কী করে বলব। তবে, যে-বছরে আসে, সে-বছরে নীল-ডুংরির টোংড়ির নীচে পাহাড়তলিতে মস্ত মেলা বসে। সারাদিন বিকিকিনি চলে। তারপর সন্ধের পরে হাঁড়িয়া খায় সকলে আর সারারাত নাচে। দিনের যে সময়ে পাখিরা গাছে থাকে তখন টোংড়ির দিকে কিন্তু যায় না একজনও। পাখিরা বিরক্ত হবে বলে। যে-বছরে ওই পাখি দুটো আসে, সে-বছরে খেতি-জমিনে ভেলকি লাগে। গেই, বাজরা, মাড়য়া, কাড়ুয়া, সরগুজা, কুলথি, আর অড়হর-এর খেতে সবুজ-বিপ্লব ঘটে যায়। সবুজ আর হলুদের মারদাঙ্গা লেগে যায় জমিতে, ঢালে; এমনকী টাঁড়েও। টাঁড়ে টাঁড়ে অগুনতি পলাশ, শাল এবং নানা হরজাই গাছের নতুন চারা আসে। খরগোশের, হরিণের কানের মতো তাদের বড়ো বড়ো সবুজ পাতারা হাওয়াতে ইতি-উতি লটরপটর করে। নড়ে চড়ে। সে-বছর, পাকা-ফসলের গন্ধে ম ম করে হাওয়া। বাজরাখেতে শুয়োর ঢুকে, ঘোঁতর ঘোঁতর করে। ঢোকে কিতারীর খেতেও। সারারাত বাঁশিতে ঢেউ খেলানো সুর তুলে চাঁদে অন্ধকারে রাত জাগে ‘রাখোয়ার’ ছেলেরা। পাহাড়তলির এধার-ওধার থেকে মাদল আর ধামসা বাজে রাতের বেলা, আর দোলানি সুরের ঘুমপাড়ানি গান ভেসে আসে এগ্রাম-সেগ্রাম থেকে। এতসব কারণেই এই নীল চিড়িয়াদের মনোয়া-মিলনের আশপাশের সব বস্তির মানুষেরা ‘দেবদেবী’ জ্ঞান করে। বনদেওতার থানে যেমন পুজো চড়ায় সকলে, তেমন-ই যে, প্রাচীন মস্ত শিমুল গাছটার ডালে ওরা এসে ওদের স্বল্পকালের আশ্রয় নেয় সেই শিমুলের গুঁড়ির কাছেই ওরা পুজো চড়িয়ে যার যার নীরব প্রার্থনা জানিয়ে শালপাতার দোনাতে করে তাদের নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়ে আসে। কেউ বাড়িতে বানানো ছাতুর লাড়ু, কেউ কোনো ফল, কেউ-বা একটু দুধ বা দই, কেউ হালুইকরের দোকান থেকে কিনে-আনা কোনো মিষ্টি। ওদের ধারণা, সাতসকালে নীলচিড়িয়ারা ওই নৈবেদ্যর কিছুটা গ্রহণ করে আর কিছুটা ঠুকরে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে উড়ে চলে যায় সারাদিনের মতন কোনো অজানা বন বা প্রান্তরে, বিকেলে বেলা পড়লে আবার ফিরে আসবে বলে।

তাদের মূলবাস যেকোনো মহাদেশে বা এদেশের-ই কোথায় সে-খবর কেউ রাখে না। কয়েকদিনের জন্যে আসে; ক্কচিৎ-বসন্তে, আবার ফিরে যায়।

সকাল আটটা-ন-টা নাগাদ যারা পুজো চড়িয়েছিল, তারা টোংড়ির সেই শিমুলতলিতে এসে নজর করে কার কার নৈবেদ্য নীল চিড়িয়ারা গ্রহণ করল। যাদের করল, তারা নিজেদের ভাগ্যবান বলে মনে করে। যাদেরটা ঠুকরে ফেলে-ছড়িয়ে গেল, তারা আবার দুপুরে এসে নতুন করে নৈবেদ্য চড়িয়ে যায়। তুই কখনো দেখেছিস নিজচোখে ওই পাখিদের?

ঝিঁঝি শুধোল।

কাউকে বলিস না কিন্তু। দেখেছি একবার।

কেন? বলব না কেন?

ওই পাখিদের বুড়হা-করম’-এর থানের পূজারি ছাড়া নিজচোখে আর নাকি কেউই দেখেনি। আরে ওই পাখি নিজচোখে দেখেছিল বলেই তো সে আজ বুড়হা-করম-এর পূজারি। তার এত খেতি-জমিন, কাঁড়া-বয়েল। এত রমরমা। ওই পাখি সকলকে থোড়াই দেখা দেয়।

কী করে তাহলে দেখলি তুই? তা দেখলিই যদি তো, তুইও বুড়হা-করমের পূজারির মতো বড়োলোক হয়ে গেলি না কেন? তোর পেট-চালাবার জন্যে চিরাঞ্জিলাল মাড়োয়ারির গদিতে বসে তোর খাতা লেখার দরকার কী ছিল?

না, না। ওসব করিস না। নিজের মেহনতের কামাই ছাড়া আমি খাই না। সে যদি দু-টি শুখা রুটিও হয়, সেও ভালো।

চল, এবার নামতে হবে ঝিঁঝি। সাইকেলটা এখানেই কেলাউন্দা ঝোঁপের মধ্যে রেখে যাব।

ঝিঁঝি নামল। শিরীষ সাইকেলটাকে পুঁতিপথ থেকে একটু বাঁ-দিকে ঢুকিয়ে শুইয়ে রাখল ঝোঁপের ওপর। যেই-না শোয়ানো, অমনি ডানায় ডানায় ভররর-র-র-র শব্দ করে একদল তিতির উড়ে গেল। ঝিঁঝিকে ভীষণ চমকে দিয়ে। হালকা খয়েরি-রঙের তিতিরগুলো যে, এমন জোরে উড়তে পারে জানতই না ঝিঁঝি। এতকাছ থেকে দেখেওনি কখনো আগে। তবে ডাক শুনেছে। ওদের বাড়ির পেছনের জঙ্গলেই রোজ সকাল-সন্ধেতে ডাকে। ওদের ইংরিজি নাম, Patridge’। ও জানে। কারণ, ওর মায়ের কাছে শুনেছে ঝিঁঝি যে, এই তিতির আর তিতিরের বাচ্চার মতো দেখতে একরকম পাখি, যার স্থানীয় নাম বটের, ইংরিজি ‘Quail, শিকার করতেই তার বাবা আসতেন এখানে। বাড়িটাও বানিয়েছিলেন শুধু সেই শখেই। বাড়িটা যেখানে, তার চারদিকেই মহুয়া বন ছিল একসময়ে। এখনও আছে কয়েকটি মহীরুহ। বাবা শখ করে বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘মহুয়া’, তাই।

কী রে! চমকে গেলি যে!

চমকাব না। যদি আমার নাকে-মুখে উড়ে আসত? কীরকম একটা গন্ধ ওদের গায়ে। তাই না?

ওরা আবর্জনা এড়িয়ে চলে। তোর কাছে আসত না আদৌ।

শিরীষের রসিকতায় না মজে ও বলল, এগুলো কী ধরনের পাখি? পাখি তো গাছে বসে থাকে, মাটিতে বসেছিল কেন, গাছে না বসে?

তিতিররা বোধ হয় গাছে বসেই না। আমি তো দেখিনি কোনোদিনও বসতে। বটেরদেরও দেখিনি। এই তিতিরগুলোর ইংরিজি নাম ‘Grey Patridge’। তবে হ্যাঁ, অন্য একরকমের তিতির আছে, তাদের গায়ের রং কালো; সে-কারণে তাদের নামও ‘কালি তিত্বর’। এখানে তাদের দেখেছি, ঝোঁপঝাড়ের ওপরে বসে ভীষণ মনখারাপ-করা ডাক ডাকতে; সারাদুপুর।

তাই?

হুঁ। আয় ঝিঁঝি, এবারে পাহাড়ে চড়ি। দেখ, রোদ উঠে গেছে এখন তবুও কেমন মনোরম লাগছে। অবশ্য জানি না, হয়তো তুই সঙ্গে আছিস বলেই এতটা ভালো লাগছে।

বলেই বলল, তোর কেমন লাগছে?

দা-রু-ণ। তবে সেটা তোর সঙ্গগুণে আদৌ নয়। প্রাকৃতিক কারণেই। নিছক-ই পরিবেশের প্রভাবে। প্রকৃতি, পরমাপ্রকৃতির সুষমাতে।

আমি তো প্রকৃতি নই। আমি পুরুষ। প্রকৃতি তো তুই।

কথা তো শিখেছিস অনেক। তা সেই নীল পাখিগুলো কেমন করে দেখলি, কী করে দেখলি, তা বল একটু।

হ্যাঁ। সেদিন পাখি দেখতে আসিনি আমি আদৌ। ওই পাখির কথা জানতামও না। নীল ডুংরি পাহাড়ের টোংড়ির ওপরে আমার বাবার বানানো একটা ঘর আছে। তোর বাবাও, মানে কাকাবাবুও শিকার করার জন্যে এসেছেন এখানে অনেকবার। শুনেছি, মায়ের কাছে। বাবা যখন কাঠ-বাঁশের ঠিকাদারি করতেন তখন কাজের সুবিধের জন্যে এই ঘরটি বানিয়েছিলেন। অব্যবহারে, অযত্নে, ঘরটা প্রায় ভেঙেই গেছে। তবে মাথার ওপরে ছাদ এখনও আছে। যদিও পাশের কাঠের দেওয়ালগুলো ফেটে-ফুটে রোদে-জলে চৌচির হয়ে গেছে। কিছু কিছু খুলে খালেও পড়ে গেছে। তবু কখনো মন খারাপ হলে কিংবা মন খুব ভালো থাকলে আমি ওই ঘরে চলে যেতাম। এখনও যাই। গিয়ে, চুপটি করে বসে থাকতাম। কবিতা লিখতাম কখনো। গরমের দিনে জংলি আম পেড়ে খেতাম। জংলি জামও। শীতে কেলাউন্দা, জংলি পেয়ারা।

একদিন সারাটা দুপুর এখানে থেকে বিকেল বিকেল নেমে আসছি টোংড়ির সেই ঘর থেকে, এমন সময়ে হঠাৎ-ই মাথার ওপরে বড়ো বড়ো ডানার ‘সপসপ’ শব্দ শুনে চমক খেয়ে দেখি দু-টি মস্তবড়ো নীল পাখি উড়ে গেল আমার মাথার ওপর দিয়ে। অমন পাখি জীবনে দেখিনি। প্রথমে ভাবলাম, ময়ূর। কিন্তু ময়ূরের গায়ের রং তো ময়ূরের-ই মতো। তা ছাড়া, এমন স্নিগ্ধ নীল, নীলকণ্ঠ পাখিরও নেই। চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম।

নাঃ! সত্যিই অমন পাখি আমি আগে দেখিনি। ময়ূরের মতো অতবড়ো নয় পাখি দুটো। তাদের ল্যাজও নেই ময়ূরের মতো। ময়ূরের গলার মতো লম্বাও নয় তাদের গলা। আয়তনে, হেমন্তের পাকা ধান-খাওয়া বড়ো জংলি মোরগেরও আড়াই-তিনগুণ হবে পাখি দুটো। দেখতে লাগলাম। এমন সময়ে ওদের মধ্যে যেটা বড়ো, সম্ভবত মদ্দা, পুরুষ যেটি, সেটি ডাকল কুউক-কুউক’ করে। আশ্চর্য বিষণ্ণ সে ডাক! মনে হল, যেন কোনো সদ্য-বিধবার চাপা-কান্না। ওই পাখি দু-টির ঠোঁটদু-টি কিন্তু উজ্জ্বল বাদামি। অনেকটা হাঁসের মতো। তবে জোড়া নয় কিন্তু। আর পুরুষ পাখিটার মাথার ওপরে গাঢ় নীল রঙের ঝুঁটি। কাকাতুয়ার মতো নয়। বুলবুলির মতোও নয়। একেবারে তাদেরই মতো।

তারপর?

তারপর-ই পাখি দুটো বড়ো আদরে-যত্নে-সোহাগে একে অন্যের পালক ঠোঁট দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে লাগল। এবারে মেয়ে পাখিটাও ডাকল, কুউক-কুউক’ করে। অনেকক্ষণ ধরে দেখে যখন আশ মিটল আমার, তখন আমি পাহাড়ে নামতে শুরু করলাম। তখন বৈশাখের মাঝামাঝি। পর্ণমোচী জঙ্গল পাতলা হয়ে এসেছে। ডুংরি থেকে নেমে আসবার সময় নীলা-ঝোরাটা পেরিয়ে ফিরতে হবে। ছোটো-বড়ো নানা আকারের সাদা-কালো-বাদামি পাথর ছড়ানো আছে নদীর বুকময়। যেহেতু গরম পড়ে গেছে, সন্ধের মুখে মুখে বড়ো বড়ো সাপ, চিতা এবং বড়োবাঘও জল খেতে আসত ওই ঝোরাতে; তা ছাড়া, ভালুকও ছিল জঙ্গলে অনেক, বিশেষ করে গরমের সময়ে আম খাওয়ার জন্য তাদের হুড়োহুড়ি লেগে যেত। তাই, আমি তাড়াতাড়ি নেমে আসতে লাগলাম।

বাড়ি ফিরে সালিম আলির বই খুলে লণ্ঠনের সামনে বসে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। নাঃ। অমন কোনো পাখির ছবি-ই নেই তাতে। অমল হোম মশায়ের বাংলার পাখি’ বইটিও দেখলাম।

বা রে! বাংলার পাখি বিহারে পাবি তা ভাবলি কী করে?

বা রে! বাংলার পাখি কি বিহারে আসতে পারে না? পাখিদের জন্যে তো রাজ্যের সীমানা নেই কোননা! ভাষার সীমানাও নেই! তাদের জন্যে আলাদা গভর্নর বা মুখ্যমন্ত্রীও নেই। তাদের ডানা তাদের যেখানে নিয়ে যায় সেটাই তাদের দেশ। এইজন্যই তো কেবল-ই আমার ইচ্ছা করে পাখি হয়ে যেতে।

তারপর?

ওই পাখি দুটি যে, আদিবাসীদের কাছে অমন মঙ্গলের দ্যোতক তাও তো জানতাম না। বাবাও কখনো আমাকে বলেননি ওই পাখিদের কথা। বাবা হয়তো জানতেন। জানি না, জানতেন কি না! মার কাছেও কখনো শুনিনি। কিন্তু পরদিন যখন আবার একবার দেখার লোভে প্রথম বিকেলের দিকে চলেছি ওই দিকে, দেখি, একজন দু-জন করে আদিবাসী চলেছে হাতে বুনো গাছের পাতার দোনা নিয়ে, ওই দিকেই। স্ত্রী-পুরুষ প্রত্যেকেই স্নান করে, পরিষ্কার কাপড় পরেছে।

ওদের সঙ্গেই এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় চলেছে ওরা? তখন ওদের-ই কাছে সব শুনলাম ইতিবৃত্ত। সেই প্রাচীন শিমুলটা, যার উঁচু-ডালে আগের দিন পাখি দুটোতে বসেছিল, সেটার কাছে গিয়ে দেখি, শিমুলের গুঁড়িতে সিঁদুর লেপেছে ওরা।

বলেই, থেমে গিয়ে বলল, শিমুলের গুঁড়ি দেখেছিস কখনো? নীচের দিকে অনেক ভাগ থাকে। বড়োগাছের গুঁড়িতে ওই ভাগগুলো এমন-ই হয় যে, এক-একটির কাঁধে পাঁচ-ছ-জন পূর্ণবয়স্ক মানুষও লুকিয়ে থাকতে পারে।

তারপর?

তারপর দেখলাম, আদিবাসীরা সেই গুঁড়ির সব কটি ভাগেই দগদগে লাল সিঁদুর লাগিয়েছে। আর বুনোপাতার দোনার নৈবেদ্য সাজিয়েছে প্রত্যেকটি খাঁজের মধ্যবর্তী জমিতে। বনফুল দিয়েছে ছড়িয়ে।

ওদের কাছেই শুনলাম যে, পাখি দুটো এসেছে মাত্র দু-দিন হল, বারোবছর, মানে একযুগ পরে।

বা-রো বছর পরে?

ঝিঁঝি অবাক হয়ে বলল।

হ্যাঁ রে, নইলে বলছি কী!

ওদের মধ্যেই দু-জন নাকি বনশুয়োর শিকার করতে এসেছিল এদিকের দোলাতে। তারাই পরশু প্রথম দেখে পাখি দুটোকে। উত্তেজনাতে রাতে ঘুমোতে পারেনি। কাউকে তাদের সৌভাগ্যের কথা বলতেও পারেনি। উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্যে হাঁড়িয়া খেয়ে দু-জনেই প্রায় বারো ঘণ্টা মড়ার মতো ঘুমিয়েছিল। প্রকৃতিস্থ হলে ফিসফিস করে জানিয়েছে একে ওকে। আর তারপরেই এই পরব। ওদের ভাষায় ওই পাখিদের ওরা বলে, জাডুগুণা। ওদের মিথোলজিতে নাকি আছে ওই ‘জাডুগুণা’, পরম-মঙ্গলকারী, মঙ্গলবাহী পাখিদের কথা।

আমাকে দিবি ওদের বই? যে বইয়েতে ‘জাডুগুণার’ কথা আছে?

ঝিঁঝি জিজ্ঞেস করল।

পাগলি তুই! আদিবাসীদের কোনো হরফ নেই। লেখ্য ভাষা নেই। মনে মনে ওদের ধর্মকর্ম, মিথোলজি, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ভালো-মন্দ এমনি করেই বয়ে আসছে ওরা বংশ পরম্পরাতে। তবে শুনেছি, আগেকার দিনের ইংরেজ আই-সি-এস অফিসার, ফরেস্ট সার্ভিসের অফিসার, এবং ইংরেজ ও জার্মান মিশনারিদের মধ্যে অনেকেই ওদের ভাষা, সংস্কার, সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় আচার-বিচার সম্বন্ধে অনেক সব প্রণিধানযোগ্য বই লিখে গেছেন।

তাই? ভারতের সব আদিবাসীদের বেলাতেই কি এক-ই নিয়ম?

তা আমি বলতে পারব না। আমি কতটুকুই বা জানি বল? আমি শুধু এদের কথাই বলতে পারি।

তারপর শিরীষ বলল, তোদের বাড়িতে যে-কাজের লোকটা আছে, ঝাণ্ডু, ফাগুয়া-বস্তিতে থাকে, ও-ও আদিবাসী। ওই এক-ই উপজাতির। সময় পেলে, ওর সঙ্গে বসে গল্প করিস। দেখবি, কত কী জানতে পাবি ওদের বিষয়ে। শিখতে পাবি। ওরাই তো এদেশের আদি ও অকৃত্রিম মানুষ!

আরে! এইটিই কি তোর সেই নীলা-ঝোরা?

হ্যাঁ, এইটিই।

বাঃ! বাঃ! পাথরগুলো কেমন রে। কত্ত বড়ো বড়ো। কুচকুচে কালো। দেখলেই ভয়। করে। ঠিক ভয় নয়; কী যেন।

হ্যাঁ। এখন গরম বলেই জেগে রয়েছে, চ্যাটালো-চ্যাটালো বুক চিতিয়ে। বর্ষার সময়ে, যখন তোড়ে জল বয়ে যায়, এই নদী দিয়ে, তখন মনে হয় অগণ্য দাঁত বের করে রয়েছে নদীটা।

তাই?

হ্যাঁ। পালামৌ জেলাতে তো আছিস। ‘পালাম্যু’ শব্দটার মানে জানিস?

মানে, ওরিজিন?

না। কী? তুই জানিস?

জানি, মানে, একটা বইয়ে পড়েছিলাম। ‘পালামৌ’ শব্দটি আসলে একটি দ্রাবিড় শব্দ। এই ঝাণ্ডুদের পূর্বপুরুষেরা এসেছিল দক্ষিণ ভারত থেকে। পালা হচ্ছে ‘পল-আম্ম-উ’ এই তিনটি অক্ষরের সমষ্টি। মানে হল, দাঁত বের করা নদী।

ও হ্যাঁ, আমিও তো পড়েছি এইকথা, একটি উপন্যাসে। তবে যিনি লিখেছেন তিনি তো ঔপন্যাসিক। ‘নৃতত্ত্ব’ সম্বন্ধে উনি কী জানেন?

আমিও ওই বই থেকেই জেনেছি। তবে, তুই ঠিক-ই বলেছিস। বাংলা ভাষার ঔপন্যাসিক তো! এবং পশ্চিমবাংলার! গুল-গপ্পো চালিয়েছেন হয়তো! এসব কিন্তু তুই পশ্চিমি দেশের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে কখনো পাবি না। তাঁরা উপন্যাস লেখেন যদিও, তবুও তা কত তথ্য নির্ভর, বাস্তব। কত পড়াশুনো থাকে তাঁদের অনেকেরই।

তা হতে পারে। কিন্তু উপন্যাসের মধ্যে বাস্তবের সঙ্গে কল্পনাও তত মিশিয়ে দিতে হয়। নইলে তো ইতিহাস, ভূগোল, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব সবকিছু-ই সাহিত্য হয়ে উঠতে পারত। হয় যে না, তার কারণ, একজন প্রকৃত ঔপন্যাসিক-ই জানেন কী করে বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশেল দিতে হয়। সাহিত্যিক; তাই ঐতিহাসিক, ভূগোল-বিশারদ, নৃতত্ত্ববিদ এবং পুরাতত্ত্ববিদ সকলের-ই শ্রদ্ধার পাত্র। তাই নয় কি?

সেটা ঠিক। তবে একটু দাঁড়া। একটু জিরিয়ে নিই। হাঁফিয়ে গেছি।

তা ঠিক। চড়াইটা এখানে প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি। দাঁড়াই একটু।

বিশ্রাম নেওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে, ওরা দু-জনে ওই প্রাচীন শিমুল গাছটিকে দেখে নিয়ে যখন শিরীষের বাবার ভগ্নপ্রায় এককালীন ডেরাতে গিয়ে পৌঁছোল তখন ওরা দুজনেই ঘেমে-নেয়ে গেছে।

বোস এখানে, আরাম করে, ঝিঁঝি। বলল শিরীষ।

দেখ, এই পাথরটা আমার চেয়ার আর এইটা হচ্ছে টেবিল। এখানেই বসে বসে আমি কবিতা লিখি। ভাবি।

কার কথা ভাবিস?

তা তোকে বলব কেন? ভাবনা শুধু মনেই থাকে। তা প্রকাশ করে ফেললেই, মুখেই হোক, কী সাদা পাতায় কালি দিয়ে, তা আর নিজের থাকে না। সকলের হয়ে যায়। তাই আমার ভাবনা মনেই থাকুক।

ঝিঁঝি চেয়ে রইল শিরীষের চোখে মুখে কিছু বলল না।

হাওয়াটা এখন আরও জোর হয়েছে। ঝরা-পাতারা রাতের শিশিরে সকালে ভিজে ছিল বলে তাদের গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজটা নরম ছিল। এখন পাতাগুলো রোদে শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাওয়াতে মচমচ করে শব্দ হচ্ছে পাথরের ওপরে, পাথরের ঘষটানিতে। হাওয়াটা গরমও হচ্ছে আস্তে আস্তে। আর মাসখানেক পরে এই হাওয়ার-ই নাম হয়ে যাবে ‘লু’।

শিরীষ গদিতে বসেছিল গতকালের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে। তবে তাড়াতাড়িই চলে যাবে কাজ শেষ করে।

বাজারে সবসময়েই একটা নৈর্ব্যক্তিক শোরগোল থাকেই। মিশ্র আওয়াজ। দূর সমুদ্রের চাপা গুমগুমানির মতো। অথচ কাছের-ই আওয়াজ। তার-ই মাঝে মাঝে পুনমচাঁদজির তিনকন্যার কোনো কন্যার চিকন নারীকন্ঠের স্বর সমুদ্রতটের কোনো একাকী সিগাল বা টার্ন বা স্যাডপাইপারের তীক্ষ্ণ, তীব্র, স্বল্পস্থায়ী চকিত আৰ্তির-ই মতো যেন সেই একঘেয়ে শোরগোল ছাপিয়ে কানে আসে। কিন্তু ভালো করে উৎকর্ণ হওয়ার আগেই আবার সেই ক্ষণিকের ব্যতিক্রম, একঘেয়েমির বোবা নিয়মে চাপা পড়ে যায়।

শিরীষের টেবল-এর ঠিক সামনেই একটা জানলা। যদিও গরাদ দেওয়া। সেই জানলা দিয়ে, চিনি, কেরোসিন এবং ভোজ্যতেলের হোলসেল ডিলার মেসার্স মুঙ্গিরাম চিরাঞ্জিলালের মুনিম পুনমচাঁদজির বাড়ির উঠোনটা দেখা যায়। উঠোনটা ন্যাড়া কিন্তু পেছনেই একটা বড়ো আমলকী গাছ আছে। ভেতরে আছে একটা জবা। এদিকে সব-ই বাজার-দোকান। গাছগাছালি বেশি নেইও। তাদের মানায়ও না এখানে। ময়দা, নানারকম ডাল, কেরোসিন ও সরষের তেল, দিশি ঘি, খোল এবং ভুসির মিশ্র গন্ধ বাতাসে ভুরভুর করে। কাজটাও, এই পরিবেশের-ই মতো। অত্যন্তই একঘেয়ে। ক্যাশবই লেখা, তাও পেটি-ক্যাশ। আর তার ভাউচার, ইন্টারন্যাল ডেবিট-নোটসুদ্ধ; নিজে হাতে তৈরি করা। পেটি-ক্যাশ বই ইমপ্রেস্ট সিস্টেম-এ রাখা হয়। মেইন ক্যাশিয়ার পনেরো হাজার করে ক্যাশ দেন। কামনার পেটি ক্যাশ বুকে প্রত্যেকটি অ্যাকাউন্ট হেড-এর নাম লেখা থাকে। কিছু অ্যাকাউন্ট অবশ্য আছে যা কনসলিডিটেড। যেমন, জেনারেল চার্জেস, পোস্টেজ অ্যাণ্ড স্টেশনারি ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিকলামে প্রতিটি খরচ পোস্টিং করে সপ্তাহান্তের টোটাল টেনে জেনারেল লেজারেও সেই অ্যাকাউন্টে পোস্টিং করে দিতে হয় শিরীষকেই।

যেমন বিদ্যা তার, তেমন-ই কাজ। এবং তেমন-ই মাইনে। তবে শিরীষ বি. কম.-এর পরে আর পড়াশুনা করেনি বলেই যে, তার জীবন বৃথা হয়ে গেছে এমন কথা সে কখনোই বিশ্বাস করেনি। শুধুমাত্রই বি.কম. হলেও অ্যাকাউন্ট্যান্সিটা সে, যেকোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের মতোই জানে। অনেক পাশ-করা অ্যাকাউন্ট্যান্ট দেখেছে ও, মামুলি জার্নাল-এন্ট্রি পাশ করতে যাঁদের কালঘাম ছুটে যায়। স্পাইসার পেগলার বা পিকলস বা অন্য দিশি অ্যাকাউন্ট্যান্টদের বই মুখস্থ করে তিনঘণ্টায় ছ-খানি ব্যালান্স শিট মিলিয়ে দিয়ে যাঁরা ছাপটা পান। কিন্তু অ্যাকাউন্ট্যান্সি জানেন না। অথচ অ্যাকাউন্ট্যান্সির মতো সহজ সাধারণ-বুদ্ধির বিজ্ঞান কম-ই আছে।

তবে এখনকার সময়ের পরীক্ষা অনেক কঠিন হয়ে গেছে বলে শুনেছে। একে বিজ্ঞান না বলে শিরীষের ইচ্ছে করে দর্শন’ বলতে। জীবনের সব ক্ষেত্রেই অ্যাকাউন্ট্যান্সির অন্তর্নিহিত মূল সত্যর মতো সত্য আর কিছুই নেই। একটি ডেবিট হলে একটি ক্রেডিট হয় বা দিতে হয়। কষ্ট করলে, কেষ্ট মেলে। ভালোবাসলে, ভালোবাসা পাওয়া যায়, নিজে সুখী হতে হলে প্রায়শ-ই অন্যকে দুঃখ দিতে হয়।

জীবনে অ্যাকাউন্ট্যান্সির মতো সত্য গার্হস্থ্য-বিজ্ঞানও আর দু-টি নেই বোধ হয়।

শিক্ষাব্যবস্থার ওপরে শিরীষের বিন্দুমাত্রও হাত থাকলে এদেশের ছেলে-মেয়েকে, বিশেষ করে মেয়েদের, স্কুলের নীচুতলাতেই এলিমেন্টারি অ্যাকাউন্ট্যান্সি শেখাবার বন্দোবস্ত করত ও। ভারতের মতো গরিব দেশে, সুযোগহীন দেশে, যদি প্রত্যেক ছেলে-মেয়েই নিজের মাতৃভাষা আর ইংরিজিটা মোটামুটি লিখতে-পড়তে পারত আর এলিমেন্টারি অ্যাকাউন্ট্যান্সি জানত তাহলেই তাদের হিল্লে হতে পারত। আজকের দিনেও ক-জন ভারতীয় ছেলে-মেয়ে বি. এ. বা বি.এস.সি. পর্যন্ত পড়াশুনো চালাতে পারে? চালাতে যদিও-বা পারে, তারা কী শেখে? কতটুকু শেখে? যা, তাদের জীবনে প্রকৃত কাজে আসে? ক-জন কম্পিউটার-ট্রেনিং নিতে পারে? নিতে পারলেও ক-জন চাকরি পায়? পেলেও, তারা সমাজের কত ভাগ? কত পার্সেন্ট?

শিরীষ বাংলা, ইংরিজিতে অত্যন্ত ভালো, ছেলেবেলা থেকেই। কিন্তু অঙ্কে কাঁচা। সাহিত্য ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে ওর বিশেষ উৎসাহ নেই। ইতিহাস এবং ভূগোল অবশ্য ব্যতিক্রম। ফলে, পরীক্ষার ফল সে, কোনোদিন-ই ভালো করেনি। তাই সে ব্যর্থ। ছাত্র হিসেবে, দিশি শিক্ষাব্যবস্থাতে।

বি. কম. পড়তে বলেছিলেন বাবাই, জোর করে। যদি চাকরি জুটে যায়, সেইজন্যে।

‘অ্যাকাউন্ট্যান্সি ব্যাপারটা ওর খারাপ লাগেনি কিন্তু সব অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষার বেলাতেই একটা গাধামি আছে বলে মনে হয় ওর। সেটা যাঁরা সিলেবাস নির্বাচন করেন এবং প্রশ্নপত্রও লেখেন তাঁদের কোনো গূঢ় উদ্দেশ্যসাধনের জন্যে কি না তা, ও বলতে পারে না কিন্তু সি. এ. পরীক্ষাতেও যখন তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় ইনশিয়োরেন্স, ব্যাঙ্ক, হোল্ডিং কোম্পানি (যখন ছিল), লিমিটেড লায়াবিলিটির নানারকম সাধারণ কোম্পানির ব্যালান্সশিট তৈরি করতে হয়, তাকে কেরানি বৃত্তির চরমতর উদাহরণের পরাকাষ্ঠা বলেই শিরীষের মনে হয় চিরদিন, মেধা বা বুদ্ধির পরীক্ষা বলে কোনোদিনও মনে হয়নি। এও হতে পারে যে, যাঁরা এইসব পেশায় জাঁকিয়ে বসে নিজেদের আসন ও অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সুরক্ষিত করে রেখেছেন তাঁরা চান না যে, এইসব পেশাতে বেশি প্রতিযোগীরা আসুন। এলে, তাঁদের ভাতে কম পড়লেও পড়তে পারে। এসব শিরীষের-ই ধারণা। যে-ছেলে বি.কম. পরীক্ষায় কোনোমতে পাশ করেছে তার মুখে এসব কথা মানায় না।

তবুও এসব কথা ওর অনেক বি.এ. পাশ এবং সি. এ.-ফেল বন্ধুদের মুখেই ও শুনেছে। এবং শুনে, তাদের সাপোর্ট করেছে।

শিরীষের কোনোদিনও অর্থনৈতিক সাফল্যকে প্রকৃত ‘সাফল্য বলে মনে হয়নি। তবুও ওর ধারণা যে, যাঁরা প্রকৃতই কৃতী, তাঁদের প্রতিযোগীর সংখ্যা কম না বেশি, তাতে কিছুমাত্রই এসে যায় না। তাঁরা সবার আগেই থাকেন। কিন্তু যাঁদের নিজেদের সম্বন্ধে ‘প্রত্যয় নেই, বিশ্বাস নেই নিজেদের যোগ্যতাতে; জীবনের সবক্ষেত্রেই তাঁরাই এমন সব নেতিবাচক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার স্বপ্নদেখা তরুণের স্বপ্ন, তাদের মা-বাবার আশা, ধূলিসাৎ করে দেন হয়তো, তাঁদের নিজেদের মুখের গ্রাসের পরিমাণ যাতে ছোটো না হয়ে যায়, সেই চিন্তায়। এই পুরো দৃষ্টিভঙ্গিটাই ভুল। অন্যায়। কিন্তু শিরীষের কী ক্ষমতা? সে তো এদেশের লক্ষ লক্ষ সাধারণ বি.কম পাশ মুহুরিগিরি করিয়েদের-ই একজন।

পুনমচাঁদবাবুর তিনটে মেয়ে। মেয়েরা কেউ যে দেখতে ডানাকাটাপরি তা একেবারেই নয়, তাঁর স্ত্রীও মারা গেছেন গতবছর তিনদিনের জ্বরে। মেয়েরাই রাঁধে, বাড়ে, আচার বানায়, পাঁপর বানায়, কাপড় কাঁচে, ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে, চুল বাঁধে উঠোনে রোদের মধ্যে, সামনে দেওয়াল-আয়না নিয়ে বসে। বাড়িতে সম্ভবত একটিই আয়না। আয়না নিয়ে তাই কন্যাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যায়।

পুনমচাঁদজি-ই একদিন শিরীষকে ডেকে বলেছিলেন, তাঁর বড়োমেয়ে গুঞ্জনকে একটু লেখাপড়া শেখাতে। ওরা কেউ-ই লেখাপড়া জানে না। তাই সপ্তাহে দু-দিন শিরীষ গুঞ্জনকে সামান্য ইংরিজি ও অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়ায়। অ্যাকাউন্ট্যান্সি শেখানোতে অবশ্য ভীষণ আপত্তি ছিল পুনমচাঁদজির। বলেছিলেন, আমার মেয়ে তো আর চাকরি করবে না। দু-একটা ইংরিজি শব্দ বলতে পারলে লোকে বলবে মেয়ে আমার এক্সপার্ট’ আছে।

দোষ কী চাকরি করলে?

আমাদের সমাজে মেয়েরা চাকরি করে না। চাকরি-করা মেয়েকে কেউ বিয়েই করবে না। মেয়েরা ঘর সামলাবে, বাচ্চার মা হবে, যা তাদের কাজ। বড়ি দেবে, আচার বানাবে, রোজগেরে স্বামীর দেখভাল করবে। আবার কী? বিয়ে দিতে হবে। তিন মেয়ের-ই বিয়ের বয়েস হয়ে গেছে। গুঞ্জনের বয়স তো প্রায় ঝিঁঝিদিদির মতো।

তবে দিচ্ছেন না কেন বিয়ে?

হাঃ।

বড়ো করুণ হাসি হেসেছিলেন পুনমচাঁদজি।

বলেছিলেন, শিষবাবু, (শিরীষকে ‘শিষবাবু’ বলেই ডাকেন পুনমচাঁদজি) আমাদের সমাজে একটি মেয়ের বিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা লাগে, জানেন কি? আর আপনাদের তো ধারণা মাড়োয়ারিমাত্রই বড়োলোক। আমাদের সমাজে যা গরিবি, যা বঞ্চনা, যা অত্যাচার সে-সম্বন্ধে কোনো ধারণই করতে পারবেন না আপনারা।

পাঁচ লাখ টাকা! বলেন কী?

শিরীষ অবাক হয়ে বলেছিল।

জি হাঁ। নইলে আর বললাম কী! আমার যদি একটা বড়োছেলে থাকত তবে রোজগার তো সে করতই তার ওপরে তার বিয়ে দিয়ে যে-টাকা পেতাম তা দিয়ে, অন্তত একটা মেয়ে পার করতে পারতাম। রামজি সে কৃপাও করলেন না আমাকে। মওত-এর পর মুখে আগ দেবার জন্যে ভি কেউ রইল না। বোংশো রোক্ষা হল না।

আপনি এত টাকা পাবেন কোথা থেকে?

রামজি-ই জুগিয়ে দেবেন। আমি কোথা থেকে পাব? একটা ছেলে পেয়েও ছিলাম। মেয়ের বিয়ের কথা শেঠকে বলেছিলাম। আসলে বলছি, গোতত পাঁচ বসর থেকেই। শেঠ বললেন, তিনি নিম-করৌঞ্জের একটা তেলকল আর চুনের ভাঁটি করবেন সেই চক্করে টাকার বড়োই টান চলেছে। আমার স্ত্রী তো মেয়েদের চিন্তা করতে-করতেই চলিয়ে গেলেন। আমি যে, কী করব তা রামজি-ই জানেন?

আপনার মতো সাধারণ অবস্থার মানুষের মেয়ের বিয়েতেও অত টাকা লাগবে? এ যে, ভাবাই যায় না।

পাঁচ লাখ না হলেও দু-তিন করে তো লাগবে! আমাদের সমাজে ‘টাকা’-ই একমাত্র জিনিস শিষবাবু, যা মান, সম্ভ্রম, খাতির, প্রতিপত্তি সব এনে দেয়। টাকাই ইজ্জত। আপনাদের মতো নয় আমাদের সমাজ। আমরা শুধুমাত্র গণেশজি আর লক্ষ্মীজির-ই পূজারি।

হয়তো সেকারণেই ওই দুই দেবদেবী আমাদের কলা দেখিয়ে আপনাদের-ই কুক্ষিগত হয়ে আছেন।

তা হতে পারে। তা ছাড়া, আমাদের মতো খাটতে তো পারবেন না আপনারা। আপনারা একটু ফাঁকিবাজ আছেন। তবে আপনারা কবিতা লেখেন, গান করেন, ছবি আঁকেন, সোরাস্বােতীর সেবা করেন। আর চাঁদিই হল আমাদের কবিতা, গান, ছবি; সব।

আপনারাই তো এখন বিহার-ওড়িশার মালিক বনে গেছেন শুধুমাত্র টাকা এবং উদ্যোগের জোরে। ডি-ফ্যাকটো’ রুলার। বাংলার তো বটেই!

ছিঃ ছিঃ।

দু-কানে দু-হাত ছুঁইয়ে পুনমচাঁদজি বলেছিলেন, উপসাব বলবেন না। আপনাদের অনেক গুণ আছে, যা আমাদের নেই। আপনাদের সমাজে অনেক বিয়ে-ই পণ ছাড়া হয়। শিক্ষার গুণেই এটা হয়। আমাদের সমাজে যতই শিক্ষা থাকুক, টাকা ছাড়া মেয়ের বিয়ে কখনোই হয় না।

শিরীষ বলেছিল, আপনি এই গর্তে বাস করেন বলেই এমন ভাবছেন, এ-কথা ঠিক নয়। এখন শিক্ষাতেও তো আপনারা আমাদের পেছনে ফেলে দিয়েছেন। শুধু ব্যবসায়ী নন, ইণ্ডাস্ট্রির মালিক-ই নন, ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ার, সলিসিটর, উকিল, সব-ই তো এখন হচ্ছেন আপনারা এবং আমাদের চেয়ে ভালোই হচ্ছেন। যে-সমাজে টাকার জোর আছে ওইসব কাজে তাঁরা অগ্রাধিকারো পান সহজে।

ছোড়েন শিষবাবু উসোব বড়ো বড়ো কথা। আমি শুধু আমার কথাই জানি। চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না শিষবাবু। কী বলব আপনাকে।

গুঞ্জন আর তার দু-টি বোন কিন্তু ভারি ভালো। তাদের যৌবন আছে, খিদে আছে, লোভ আছে, আনন্দর সাধ আছে, কাম আছে, এসব তাদের চোখ দেখেই বুঝতে পারে শিরীষ। থাকাই তো স্বাভাবিক! অন্য দশজনের যা আছে, ওদেরও তা তো থাকবেই। অথচ ওদের কোনো প্রয়োজনের বা চাহিদার নিবৃত্তির কোনোই বন্দোবস্ত নেই। পেটের খিদেটা মোটামুটি মেটে। পরনের পোশাকও অতিমোটামুটি। কোনো বাহুল্যর কথাই ওঠে না। কিন্তু অন্য কোনোকিছুই…

প্রতিবছরেই শরতে আমলকী গাছটার পাতা ঝরে, ঝুরঝুর হাওয়ায়। আবারও পাতা আসে। চকচক করে নতুন সেই পাতারা শীতের রোদে। রোদ চমকায় তাদের মসৃণ গা থেকে। আবারও ফল ফলে। কিন্তু গুঞ্জন আর তার বোনেরা প্রতিবছর পাতা ঝরিয়েই আছে শুধু। কোনো নতুন চিকন পাতাতেই তাদের শরীর-মন নতুনত্ব পায় না। পাচ্ছে না। তাদের কচি সতেজ মনগুলি টাঁড়ের মধ্যের বাজ-পড়া শিমুল গাছের-ই মতো দু-পাশে হাত ছড়িয়ে ‘হা হা’ করে ঠাঠা-রোদে, ঝড়ে-জলে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রাণের কোনো সম্ভাবনাই আর নিহিত নেই বলে মনে হয় তাদের মধ্যে। তারা যেন, মৃতের চেয়েও মৃত। অথচ প্রশ্বাস নেয় এবং নিশ্বাসও ফেলে।

পেটি-ক্যাশ-এর ভাউচার লিখতে লিখতে অনবধানে চোখ ওদিকে চলে গেলেই শিরীষ ওই তিনকন্যার কথা ভাবে। কী হবে মেয়েগুলোর?

পুনমচাঁদজি মুনিমজি। মুঙ্গিরাম তাঁর শেয়ার বেচে দিয়ে রাঁচিতে, ময়দাকল খুলেছেন। চিরাঞ্জিলাল মালিক এখন। শেঠ চিরাঞ্জিলালের একনম্বরের দু-নম্বরের সব হিসাব-ই পুনমচাঁদজির নখদর্পণে। তাঁর-ই কোমরে থাকে লোহার মস্ত সিন্দুকের চাবির গোছা। চাব’ কোম্পানির। ব্রিটিশ আমলের। সে-আলমারি উঠিয়ে নিয়ে যেতে কুড়ি-পঁচিশজন মানুষ লাগবে। তা ছাড়া, তা গাঁথাও আছে সিমেন্ট দিয়ে, গদিঘরের পাকা-দেওয়ালের সঙ্গে। তাতে কত যে, টাকা থাকে। একদিন দেখেছিল শিরীষ। পাঁচশো টাকার নোটগুলো ফিনফিনে। সবজে সবজে। এক-একটা নোটের বাণ্ডিলে পঞ্চাশ হাজার টাকা। গোটা-দুই বাণ্ডিল অবহেলায় জিনের প্যান্টের দু-টি হিপ-পকেটে ফেলে রাখা যায়। এক লক্ষ টাকা! একজন গড়পড়তা ভারতীয়র সারাজীবনের উপার্জনের চেয়েও বেশি। পুনমচাঁদজি, শেঠ চিরাঞ্জিলালের নির্দেশে ওইসব লক্ষ লক্ষ টাকা কত সহজে নাড়েন-চাড়েন, শেঠকে হিসেব দেন, চাষিদের দাদন দেন, ফরোয়ার্ড পারচেজ করেন। গেঁহু, বাজরা, মকাই ধান, অড়হর, সরগুজা, কিতারী, সরষু ইত্যাদি।

মধ্যপ্রদেশের কোনো জঙ্গলে যেন, কিছুদিন হল মার্বেল পাহাড়ের ইজারা নিয়েছেন শেঠ। তাই প্রায়-ই তাঁকে সেখানে যেতে হয়। শেঠ-এর বড়োছেলে পবন দিল্লিতে পড়াশুনো শেষ করে আসছে। এসে যাবে আর দিন দশেকের মধ্যেই। সে জে.এন.ইউ. থেকে ইকনমিক্স-এ বি.এ. করেছে। তারপর কম্পিউটার কোর্স শেষ করেছে। সে-ই এসে মার্বেল এক্সপোর্ট-এর ব্যবসা চালু করবে। পবন-এর প্রত্যাবর্তন নিয়ে মুঙ্গিরাম চিরাঞ্জিলালের পুরো প্রতিষ্ঠানে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। পবনের বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে পাটনার বড়োশেঠ বোকালিয়ার বাড়িতে। এক শরিকের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে। সে যে কী পেল্লায় ব্যাপার হবে তার-ই জল্পনা-কল্পনা চলছে বহুদিন হল। পবন নাকি এখানে রিফ্যাক্টরি কারখানাও খুলবে। বিহার ফিনানশিয়াল কর্পোরেশন-এর সঙ্গে কথাবার্তাও হয়েছে। চাঁদোয়া-টোড়ির দিকে টাঁড়ের মধ্যে পঞ্চাশ একর জমিও কেনা হয়ে গেছে। এখন যেখানে ফাঁকা টাঁড়, ঝাঁটিজঙ্গল, ঝোঁপঝাড়, মধ্যে মধ্যে খোয়াই আর ক-টি প্রাচীন মহুয়া, সেখানেই অচিরে গড়ে উঠবে ফ্যাক্টরি, রিফ্যাক্টরির। চিমনি উঠবে টেরাকোটা রঙের। ইটও তৈরি হবে নানারকম টেরাকোটা শেড এর। কুলি-লাইন বসবে। দোকান-বাজার ধাবা, ভাঁটিখানা, ধোপা, নাপিত। পেটের-তলার ধন-ভাঙিয়ে খাওয়া মেয়েছেলের ঘর। মানে, যেসব নইলে কোনো ইণ্ডাস্ট্রিই সম্পূর্ণতা পায় না, তার সব-ই থাকবে সেখানে। ম্যানেজারের ফুলের কেয়ারি-করা লনঅলা বাংলো, তার চেয়েও সরেস ডিরেক্টরস বাংলো। বাবুদের ঘুপচি, আলো-হাওয়া-হীন এলা-রং-করা মনমরা, ম্লান কোয়ার্টার। আর খাপরার চালের কুলি-লাইন। দারিদ্র্য, মাতলামি, চিৎকার, অশ্লীলতা; এই সব কিছুই হবে। শিল্পপ্রসূত।

সব-ই দেখতে পায় মনের চোখে শিরীষ। শিরীষ অনেক ভেবে-টেবে শেঠের কাছে একদিন আর্জিও জানিয়েছে যে, কারখানা যখন হবে তখন রিফ্যাক্টরির কাছে একটি পান বিড়ির দোকান দেবে ও। হিসেব করে দেখেছেও ও যে, যে-কোনো ব্যবসাই চাকরির চেয়ে ভালো। কলকাতায় থাকাকালীন ওর দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে যে, ওর এক বন্ধুর সামান্য-শিক্ষিত জামাইবাবু আলুর চপ-এর দোকান দিয়ে তাঁর অন্যান্য ইঞ্জিনিয়র, ডাক্তার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট ভায়রা-ভায়েদের চেয়ে অনেক বেশি রোজগার করছেন। তাও ছুটির দিন ছাড়া সকালে দোকান খোলেন-ই না। অন্যদিন বিকেলে ৪-টে থেকে রাত ৮টা। মানুষ, সাইকেল, গাড়ির লাইন লেগে থাকে দোকান খোলার আগে থেকেই।

অঢেল টাকা, ট্যাক্স-না-দেওয়া। আর টাকার চেয়ে বড়ো কৌলীন্য আজ বাঙালি সমাজেও বা কী আছে? পুনমচাঁদজি জানেন না যে, সরস্বতাঁকে ছেড়ে লক্ষ্মীর মন পেতে গিয়ে বাঙালি না পেয়েছে লক্ষ্মীকে, আর হারিয়ে ফেলেছে সরস্বতাঁকেও। মাড়োয়ারি সমাজের কাছাকাছি এসে গেছে নব্যমানসিকতাতে। শেঠ, পানের দোকানের জন্যেও সেলামি চেয়েছেন পনেরো হাজার। নইলে প্রস্তাব দিয়েছেন ওর বাড়িটা যদি শেঠকে লিখে দিতে পারে তাহলে খুব ভালো জায়গাতে দোকানঘর নিজেই বানিয়ে দেবেন উনি। সব-ই লেন-দেনের ব্যাপার। যেমন দেবেন, তেমন নেবেন।

তারপর হেসে বলেছিলেন, যা কাজ করছেন, তাই করুন। যা আপনাদের কাজ। কেরানিগিরি। বেওসাই যদি বাঙালিরা করতে জানত, তবে কি কলকাতার মালিক হইয়ে যেতাম আমরা?

কথাটা শোনার পর থেকেই দোনামনা করছে শিরীষ। তা ছাড়া মা-বাবার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি। স্টেশনও বেশি দূরে নয়। পরে এর দাম-ই কত হয়ে যাবে। বাড়ি-জমির দাম কখনোই পড়ে না। সোনার দামের মতো। তা ছাড়া যদি কোনোদিন কোনো দৈব-দুর্বিপাকে ওরও মতিভ্রম হয় বিয়ে করার তখন ও থাকবে কোথায় বউ নিয়ে? রিফ্যাক্টরির কারখানায় পানের দোকানে?

কত কিছু ভাবনা আসে-যায় মাথার মধ্যে। হাত দুটো কাজ করে যায়। ট্রাক-হায়ার ডেবিট, কুলি চার্জেস-লোডিং-আনলোডিং-এক্সপেনসেস, ট্রাভেলিং এক্সপেনসেস। স্টাফ-ওয়েলফেয়ার’ ডেবিট অর্থাৎ অফিসের কর্মচারীদের জন্যে জুগনুর দোকানের ভাঁড়ের চা, দিনে দু-বার। আর কিছু নয়।

তার-ই গালভরা নাম ‘স্টাফ-ওয়েলফেয়ার এক্সপেনসেস’।

শেঠ-এর নতুন বাড়ি বানাচ্ছে জিউপ্ৰসাদ আগরওয়াল। রাঁচির রাতু রোডের ডোকরা কনট্রাক্টর। সে গতবছরে এক বর্ষার দিনে গদিতে শেঠ-এর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভুলে ছাতাটা ফেলে গেছিল। শেঠ শিরীষকে দিয়েই সেই ছাতা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রাঁচিতে। রাঁচিতে শেঠ-এর অন্য অনেক-ই কাজ নিয়েও গিয়েছিল শিরীষ। তবু সেদিনের যাতায়াতের বাসভাড়াটা শেঠ, ঠিকাদার জিউপ্রসাদের নামেই ডেবিট করে দিতে বলেছিলেন। অর্থাৎ তার পাওনা থেকে ওই টাকাটা কাটা যাবে, যা ছাতার দামের প্রায় সমান-ই।

একেই বলে ডেবিট আর ক্রেডিট।

এমনিতে বাইরে থেকে দর্শন হিসেবে দেখলে অ্যাকাউন্ট্যান্সির মতো মহান দর্শন খুব কম ই আছে কিন্তু গভীরে ঢুকে পড়ে দেখতে গেলে যখন এইসব ময়লা-কুচলা বেরিয়ে পড়ে তখন মন ভারি খারাপ করে দেয়। মনে বলে, এখনও যাদের কোনো পদার্থ আছে; তাদের।

পবন, মুঙ্গিরাম চিরাঞ্জিলালের প্রিন্স অফ ওয়েলস, একমাত্র ছেলে, যে মনোয়া-মিলনে আসছে, এ-নিয়ে শিরীষের পরিচিতর বৃত্তে সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত পুনমচাঁদজির কন্যারাই। বিশেষ করে গুঞ্জন। এ-কারণেই সপ্তাহ দুই হল গুঞ্জনের পড়াশুনোতে কোনোই মন নেই। পবন কেমন দেখতে? লম্বা না বেঁটে? সজ্জন না দুর্জন? ফর্সা না কালো? এইসব প্রশ্নই তার একমাত্র প্রশ্ন এবং অন্য বোনেরা নীরবে সেইসব প্রশ্নকে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলে তাদের চোখের আলোতে।

শেঠ বোকালিয়ার বাড়ির মেয়েটিই-বা কেমন দেখতে? তার সঙ্গে পল্লবী যোশীর বেশি মিল না মাধুরী দীক্ষিতের? এইসব প্রশ্নই করছে নানাজনকে ওরা সবসময়। কতদূর পড়াশোনা করেছে সে মেয়ে?

গুঞ্জনেরা যে-জ্ঞান চায়, সেই জ্ঞান শিরীষের কাছে নেই। শিরীষের টি.ভি. নেই। কেনার সামর্থ্যও নেই। টি.ভি. দেখতে তার ভালো লাগে না। তার ধারণা, টি.ভি.র নেশা একবার ধরে গেলে মানুষের চিন্তাশক্তি এবং কল্পনাশক্তি একেবারে শেষ হয়ে যায়। টিভির ছোঁয়াচ তাই ও বাঁচিয়েই চলে। এবং চলে বলেই, গুঞ্জনের প্রশ্নর একটা উত্তরও তার ঝুলিতে থাকে না।

গুঞ্জন ডান হাতের পাঁচটি আঙুল নেড়ে তাকে সামারিলি ডিসমিস করে দিয়ে বলে, আপ একদম বেকামকা আদমি হ্যায় শিসবাবু। অজীব আদমি হ্যায় আপ। সাচমুচ।

এই ‘সাচমুচ’ শব্দটি এমন করে উচ্চারণ করে গুঞ্জন যে, শিরীষের মনে গুঞ্জনের বুকের মধ্যে তো বটেই, শিরীষেরও বুকের মধ্যে ভুজিয়ার মতো, ভাজা পাঁপরের মতো, কুড়কুড়ে, CRISP কোনো মুচমুচে বোধ, বোধ হয় শব্দ করে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।

কী, কখন, কোথায়, কেন, কবে? কোন মানুষের বুকের মধ্যে যে ভাঙে, গুঁড়োয়, শব্দ করে অথবা নিঃশব্দে; তা সেই মানুষ-ই পূর্বমুহূর্তে জানতে পারে না, তা জানবে কী করে!

পোস্টিং করতে করতে আর ভাউচার লিখতে লিখতে শিরীষ ভাবে যে, শেঠ চিরাঞ্জিলালের ছেলে পবন যেন, প্রিন্স চার্লস। কোন ডায়নার সঙ্গে প্রিন্স চার্লস-এর বিয়ে হবে এই জল্পনা কল্পনা ও স্বপ্নে পৃথিবীর কোটি কোটি মেয়ে যেমন উত্তেজিত ছিল একসময়ে, তেমনই উত্তেজিত থাকে সবসময়েই এখন গুঞ্জন এবং তার বোনেরাও।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ