তটিনী ও আকাতরু – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

ইটা কী জানোয়ার? বাপ রে! বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির মতো ব্যাপার দ্যাখতাছি।

আকা বলল। খাঁচার কাছে বনবিভাগের, যে-ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিল, তিনি বললেন, এই হচ্ছে ক্লাউডেড লেপার্ড। এদের লেজ শরীরের থেকেও লম্বা হয়।

তাই?

তটিনী কিছু না বলে, সানগ্লাসটা খুলে, ডানদিকের ডাঁটিটা নীচের দিকে দাঁতে কামড়ে ধরে সেদিকে চেয়ে রইল।

সে খাঁচার পাশে অন্য খাঁচায় একটি মাদি শম্বর। ছোটো। দু-তিনটি হরিণ। একটা বেশ বড়োচিতাবাঘ। এদের কেউ বাচ্চা বেলায় ধরা পড়ে, কেউ বড়ো হওয়ার পরে। ক্লাউডেড লেপার্ডটা নাকি, এক বুড়িকে আহত করেছিল।

বনবিভাগের সেই ভদ্রলাক বললেন।

তারপর বললেন, লেজ সবচেয়ে বেশি লম্বা হয় অবশ্য স্নো-লেপার্ড-এর।

কোথায় পাওয়া যায় স্নো-লেপার্ড?

তটিনী জিজ্ঞেস করল।

বরফ-ঘেরা পর্বতে। নামেই তো আবাসের ঠিকানা।

অবনী বলল।

অবনী মিত্তির আলিপুরদুয়ারের নন্দাদেবী ফাউণ্ডেশনের সদস্য। পবর্তারোহী। পাহাড়ে চড়েন। বন, বন্যপ্রাণী, ফুল, পাখি, প্রজাপতি ভালোবাসে, তার ওপর সংস্কৃতি এবং নাটক ও সংগীতমনস্ক। তাই ওই, বিনিপয়সার গাইডের কাজ করছিল ওদের। পেশাতে স্কুলমাস্টার। পেশাটা শখ। এমনিতে বাড়ির অবস্থা বেশ সচ্ছল।

এসেছে ওরা ভাড়া গাড়িতেই। অবনীর সঙ্গে ওর বন্ধু আকাতরুও জুটে গেছে। তটিনী রায় ও মৃদল দাশ এখানে তিনদিন রেস্ট নিয়ে ধুবড়িতে যাবে। সেখানেও বায়না আছে পরপর চারদিন। যাত্রার নাম হলুদ গোলাপ’। একটি কুড়িয়ে-পাওয়া কানীন বালিকাকে নিয়ে উত্তাল মেলোড্রামা।

যাত্রাতে আজকাল অনেক-ই পয়সা। কিন্তু মাঝে মাঝেই বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে হয়। ‘পয়সা’ই জীবনের সব নয়। তটিনী এ-কথা জানে।

জলপাইগুড়ি জেলার বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্পের রাজাভাতখাওয়ার ওয়াইল্ড লাইফ ইনফরমেশন সেন্টার থেকে বাংলোতে ফেরার সময়ে পথের ওপরে Rescue Centre’ করেছেন বক্সা টাইগার প্রোজেক্টের কতৃপক্ষ, তার-ই খোঁজে তারা বেরিয়েছিল।

ফাল্গুনের শেষ। পারুল গাছে ফুল এসেছে সিঁদুরে লাল। অশোক গাছেও। এখানে মাদার গাছ নেই। নিম্ন আসামের গোয়ালপাড়া বা ধুবড়ির দিকে মাদারের স্নিগ্ধ লালে চোখে ঘোর লাগে। গরম পড়ে গেছে। খুব একচোট ঝড়-বৃষ্টি হয়ে যাওয়াতে আজ আবহাওয়াটা বেশ নরম।

ইনফরমেশন সেন্টারে ঢুকেছিল ওরা মেইন গেট দিয়ে। ড্রাইভার নগেনকে বলে দিয়েছিল গাড়ি নিয়ে বাংলোতে ফিরে যেতে বড়োরাস্তা দিয়েই। আকার সঙ্গে ওরা Rescue Centre-টি দেখে বনবিভাগের নানা কর্মচারীদের দু-দিকে ঘরের মাঝের মাটির পথ বেয়ে, পোস্ট অফিস হয়ে, স্টেশনের কিছুদূর দিয়ে লাইন পেরিয়ে একটি বড়ো বাঁশঝাড় ডান দিকে রেখে বাংলোতে পৌঁছে খাওয়াদাওয়া করে আজই চলে যাবে জয়ন্তী। জয়ন্তীর বন-বাংলোতেই থাকবে।

আলিপুরদুয়ারে পর পর চাররাত, হলুদ গোলাপ’ যাত্রাপালা করে তটিনী রীতিমতো ক্লান্ত। কাল রাতেই প্রথম ঘুমিয়েছে ভালো করে। আজ সকাল থেকেই বেশ তাজা লাগছে ওর নিজেকে।

তটিনী একটা খড়কে-ডুরে তাঁতের শাড়ি পরেছে। খয়েরি জমির ওপরে কালো ডোেরা। কালো পাড়। দীর্ঘ বেণীতে দু-তিনটি রুপোর কাঁটা। তাতে চুটকি লাগানো। গলাতে অ্যানোডাইজড স্টিল-এর একটি পুরোনো দিনের ডিজাইনের বিছে-হার। বাঁ-হাতে রুপোর হালকা মকরবালা। ডান হাতে টাইমেক্স-এর কালো ব্র্যাণ্ডের কালো ডায়ালের ঘড়ি। ডায়ালে রেডিয়াম আছে। কাল রাতে যখন, আলো নিভিয়ে ওরা সকলে রাজাভাতখাওয়ার বাংলোর বারান্দাতে বসেছিল, তখন-ই চোখে পড়েছিল আকার। তটিনীর দু-পায়ে রুপোর পাঁয়জোর। দু-পায়ের মধ্যমাতে রুপোর চুটকি। তার গায়ের রংটি ফিঙের মতন কালো কিন্তু মেক-আপ নিলে খুব-ই ফর্সা। যখন যাত্রা করে না তখন, মেক-আপ নেয় না তটিনী। কিন্তু কাটা কাটা নাক চিবুক। ছোট্ট কপাল। দিঘল দু-টি কালো চোখ। কাজল পরেছে গাঢ় করে। মনে হচ্ছে চোখ তো নয়, যেন একজোড়া ফিঙে। পলকে পলকে স্পন্দিত হচ্ছে। আলো প্রতিসারিত হচ্ছে উজ্জ্বল কালো দুটি চোখের মণি থেকে।

ওর মুখে এবং চোখের দৃষ্টিতে ভারি এক শান্তশ্রী আছে, বৃষ্টির পরে মুথা-ঘাসে ভরা গাঢ় সবুজ মাঠের মতন।

তটিনীর শরীরের কাছে এলেই, ওর গা থেকে দারুণ এক গন্ধ পায় আকা। গায়ে কী সেন্ট মাখে সে, কে জানে! কখনোও তার বুকের আঁচল হঠাৎ খসে গেলে অথবা ইচ্ছে করেই সে, কখনোও খসিয়ে দিলে, যেমন একটু আগেই দিয়েছিল, ফলসা-রঙা সুডৌল মতন স্তনসন্ধি, যেন, পৃথিবীর সব আলো-আঁধারি রহস্যের খনি হয়ে ওঠে। সেদিকে চোখ পড়তেই পারুল আর অশোকের লালে লাল হওয়া বৈশাখের নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আকার মাথা ঘুরতে থাকে বনবন করে। বমি বমি পায়।

কালকে এখানে আসার পর থেকে নয়, তার চারদিন আগে থেকেই, মানে, যেদিন থেকে যাত্রাদলটি এসেছিল আলিপুরদুয়ারে, আকার খাওয়াদাওয়া সব-ই গেছে।

ফি-বছর ম্যালেরিয়া হয়, বার দুই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছিল। জণ্ডিস, কালাজ্বর, কী হয়নি ওর! কিন্তু এমন অসুখে সে, জীবনে পড়েনি আগে। বুকের মধ্যে ভারি একটা কষ্ট। আবার, ভারি একটা আনন্দও। মাঝে মাঝেই হু হু করে উঠেছে আকার বুকের মধ্যেটা। খিদে-তৃষ্ণা চলে গেছে পুরোপুরি। তার ওপরে তটিনী যখন, ওর মুখটি তুলে, তার চোখের মধ্যে নিজের দু-চোখ, টায়ে টায়ে রেখে তাকায়, এমন-ই করে, যাতে চাউনি একটুও উপছে পড়ে না যায়, তখন আকার মনে হয়, ও আর বাঁচবেই না। রোদটা হঠাৎ-ই ঠাণ্ডা মেরে যায়। জগৎসংসার সব, মিথ্যে বলে মনে হয়। কিছুই ভালো লাগে না আকার।

কে জানে! এই অসুখের নাম কী?

পায়ে পায়ে ওরা যখন, রেললাইনের কাছে পৌঁছে গেছে, হঠাৎ-ই চোখে পড়ল ডান দিকে পোস্ট অফিস। পোস্ট অফিস দেখেই বোধ হয়, তটিনীর খাম কেনার কথা মনে পড়ল।

বলল, একটা চিঠি লিখতে হবে।

চলুন, ভেতরে যাই সকলে। নাকি আকাই গিয়ে নিয়ে আসবে?

না না। চলুন সকলে মিলে যাই। কাজ কী এখানে আমাদের? তা নেই। কিন্তু ওদিকে মৃদুলবাবু, আপনার হিরো তো বাংলোর দোতলার বারান্দাতে একা বসে কাপের পর কাপ চা খেয়ে, শিডনি শিলডন পড়ে পড়ে হেদিয়ে গেলেন। দেরি হলে ভারি রাগ করবেন।

অবনী বলল।

রাগ করলে তো আমার-ই ওপরে করবেন।

তটিনী বলল।

তটিনী হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, মোটে তো সাড়ে এগারোটা। আশ্চর্য! মনে হচ্ছে। কতক্ষণ হল যেন, বেরিয়েছি। দেড়টা দুটোর আগে কোনদিন খাই দুপুরে? আর রাতে তো কথাই নেই। যাত্রা যেদিন থাকে সেদিন তো মেক-আপ-টেক আপ তুলে খেতে করতে সেই একটা-দেড়টাই হয়।

আপনার হিরোও কি ওই সময়েই খান রোজ? বেড়াতে বেরিয়ে?

মৃদুল আমার হিরো নন, হলুদ গোলাপ’ যাত্রার নায়িকা শুক্লার প্রেমিক, বসন্ত। আমার নাম তো তটিনী। মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর মৃদুলবাবু শুক্লার কেউ-ই নন। তটিনীর তো নন-ই! জীবনে আমার কোনো নায়ক নেই। তা ছাড়া উনি বেড়াতে বেড়িয়ে কখন খান, তাও আমার জানা নেই কারণ আমি আর উনি একসঙ্গে কোথাও-ই যাইনি বেড়াতে এর আগে। হলুদ গোলাপ’-এর আগে আর কোনো পালাও করিনি ওঁর সঙ্গে।

হাউ স্যাড।

অবনী বলল।

কেন? স্যাড কেন?

পোস্ট অফিসে ঢুকতে ঢুকতে তটিনী বলল।

না। আপনার মতন মহিলারও জীবনে, কোনো নায়ক নেই কথাটা।–

তটিনী অবনীর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, দর্শকদের বা উদ্যোক্তাদের কিন্তু উচিত নটনটীদের মঞ্চের ভূমিকাতেই নিজেদের ঔৎসুক্য সীমিত রাখার। ব্যক্তিগত জীবনটাতে উঁকিঝুঁকি না মারাই ভালো নয় কি?

অবনী বলল, বিলক্ষণ। কিন্তু সংসারে যা-ঘটে তার কতটুকুই বা ভালো বলুন? যাঁরা পাদপ্রদীপের আলোতে থাকেন তাঁদের ফুলের মালা আর প্রণামের সঙ্গে এইসব অত্যাচার একটু-আধটু সহ্য তো করে নিতেই হয়।

তারপর বলল, আপনার মতন মেয়েরও যদি নায়ক না থাকে, তবে থাকবে কার?

নেই মানে, আছে নিশ্চয়ই। এই পৃথিবীর-ই কোনো কোণে। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হয়নি আমার।

তটিনী বলল।

আকার বুকটা ভেঙে গেল।

আকাকেই পরমুহূর্তে তটিনী বলল, কী বলেন আকাবাবু?

তারপর-ই বলল, আপনার মতো স্মার্ট সুন্দর ইয়াং পুরুষের নাম, আকা কে রাখল বলুন

আমার বড়োমায়ে রাখছিল।

 সরল, ভালোমানুষ হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ Die Hard বাঙাল আকা বলল।

‘বড়োমা’ মানে?

বড়োমা বোঝলেন না? বড়োমা মানে, আপনারা যারে কন জ্যাঠাইমা, তাই।

ও।

খাম আছে?

পোস্ট অফিসের ভেতর ঢুকে অবনী জিজ্ঞেস করল।

এক ভদ্রলোক, একাই কাউন্টারের পেছনে, কাঠের ছোটোটেবিলের সামনে ততোধিক ছোটো একটি চেয়ারে বসে একগাদা কাগজের ওপরে মান্ধাতার আমলের একটি হাতঅলা লোহার স্ট্যাম্প দিয়ে, বড়োস্ট্যাম্প প্যাডের কালিতে জোরে ঠাপ্পা মেরে তারপরে আরও জোরে স্ট্যাম্প করছিলেন, সেই কাগজগুলিতে।

ওদের দেখেই ভদ্রলোক উঠে এলেন।

 বললেন নমস্কার।

অত্যন্ত উত্তেজিত এবং কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত গলাতে বললেন, আপনি তটিনী দেবী নন?

হঃ। এতক্ষণ লাগে নাকি চিনতে?

আকা বলল ওঁকে, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে।

তা নয়, মঞ্চে তো সাজেপোশাক আলাদা থাকে, মেক-আপ, টেক-আপ থাকে। তাই!

আপনি ‘হলুদ গোলাপ’ যাত্রা দেখলেন কোথায়? আলিপুরদুয়ারে?

ভদ্রলোক লম্বা, একটু গোলগাল চেহারা, মুখে তিন-চারদিন, না-কামানো খোঁচা-খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি, একটি নীল-রঙা হাফ-শার্ট, খাকি প্যান্টের ওপরে পরা, একটি উইলসন বলপেন গোঁজা শার্টের বাঁ-দিকের বুক-পকেটে। পোস্কাপিসের দেওয়ালে রামকৃষ্ণদেবের একটি ছবি এবং ঠিক তার উলটোদিকেই মুরশিদাবাদের ‘মৃণালিনী’ বিড়ি কোম্পানির একটি ক্যালেণ্ডার।

মাস্টারবাবু তটিনীকে বললেন, আজ্ঞে না ম্যাডাম। আমি দেখেছি আপনাকে হ্যাঁমিলটনগঞ্জে। যখন আপনাদের ‘মনমোহন অপেরা’ গেছিল গতবছর তখন। আমার ফেমিলি তো সেইখানেই থাকে। ছুটিতে সেখানে গেছিলাম গতবছরের আগের বছরে পুজোর সময়ে।

একবছর আগে দেখেও মনে রেখেছেন আমাকে! কী পালা যে, নিয়ে গেছিলাম আমরা সেবারে হ্যাঁমিলটনগঞ্জে তা তো আমার নিজের-ই মনে নেই!

‘ভানুমতী’।

তাই তো। তা আমাকে মনে রেখেছেন, আশ্চর্য!

আকা বলল, আপনারে একবার দ্যাখলে কি কারো পক্ষেই ভোলা সম্ভব?

মাস্টারবাবু বললেন, তা ঠিক।

আকা বলল, আপনের নাম কী মাস্টারমশয়?

আমার নাম শ্রীদেবেন্দ্রনাথ বসু। অরিজিনালি আমি আপনাদের কলকাতার বালিগঞ্জের-ই মানুষ মশাই। আমার ছেলেবেলা কেটেছে সেখানেই।

তারপর, পাছে রাজাভাতখাওয়া পোস্টমাস্টার যে, কলকাতার বালিগঞ্জের-ই বাসিন্দা এ কথা কলকাতার কেউ অবিশ্বাস করেন তাই যেন বললেন, রায়বাহাদুর নগেন বোস-এর নাম শুনেছেন কি?

অবনী না শুনেও বলল, হ্যাঁ।

তিনিই হচ্ছেন গিয়ে আমার সাক্ষাৎ ন-ঠাকুরদা। দাদু জ্যাঠতুতো ভাই যদিও।

অবনী বলল, ও, তাই বুঝি?

একটু চা খাবেন-না?

দেবেনবাবু শুধোলেন।

চা?

তটিনী অবাক হয়ে গেল।

স্ট্যাম্প আছে, এক টাকার? অথবা খাম?

নাঃ।

খুব-ই লজ্জিত হয়ে বললেন উনি। স্টক ফুরিয়ে গেছে, তবে আসার কথা আছে, দিন সাতেকের মধ্যে। পোস্টকার্ড আর ইনল্যাণ্ড নিতে পারেন।

খাম বা স্ট্যাম্প নাই-বা থাকল, চা তো আছে।

অবনী বলল।

শুনেই মাস্টারমশাই হাঁক দিলেন, এই মা! চা আন তাড়াতাড়ি। ওঁদের সকলকে দে। আমাদের আজ কী সৌভাগ্য! স্ট্যাম্প না থাকল তো কী হল? তটিনী দেবী এবং এতসব গণ্যমান্য মানুষ এসেছেন আমার পোস্ট অফিসে।

অবনী বলল, এটা তো আপনার বাড়ি নয়, অফিস। আপনি কেন আতিথেয়তা করবেন?

কেন করব না, তাই বলুন! আপনাদের মতন মানুষদের পায়ের ধুলো কি রোজ রোজ পড়বে এই জঙ্গুলে রাতভাতখাওয়ার ছোট্ট পোস্ট অফিসে।

জায়গাটার নাম রাতভাতখাওয়া হল কেন বলুন তো?

তটিনী বলল। শুনেছি, বহুদিন আগে কুচবিহারের রাজা ভুটানের রাজাকে এখানে ভাত খাইয়েছিলেন।

মাস্টারমশাই বললেন।

কেন? জামাই তিনি? না শ্বশুর?

আকা বলল, আউজ্ঞা তা নয়। যুদ্ধ লাগছিল ত দুই রাজার মইধ্যে। যুদ্ধে যখন সন্ধি হইল গিয়া তখনে হেই দুই রাজা একলগ্যে বইস্যা ইখানে ভাত খাইছিলেন। তাই, ই জাগার নাম রাজাভাতখাওয়া।

তারপরেই তটিনীকে বলল, আপনে দ্যাখেন নাই যে, ইনফরমেশন সেন্টারের দেওয়ালে একখান ফাস ক্লাস রঙিন ছবি আঁকাইছেন কলকাতার থনে আর্টিস্ট আইন্যা, বিস্ট সাহেব?

বিস্ট সাহেব কে?

তটিনী আবার প্রশ্ন করল।

বিস্ট সাহেব হইলেন গিয়া বক্স-টাইগার প্রোজেক্টর। তাঁর রাইজ্যেই ঘুরতাছেন আপনেরা আর তাঁর-ই নাম জানেন না? অবনীদাটা থার্ড ক্লাস। কইবা ত ওনাদেরকে।

এমন সময় বাইরে থেকে পায়জামার ওপরে খাকি শার্ট-পরা এক মাঝারি উচ্চতার ভদ্রলোক একটি ভাঁজ-করা খাম-এর মধ্যে কিছু কাগজপত্র বগলে নিয়ে ঢুকলেন। মুখে পান। জর্দার গন্ধ বেরোচ্ছে।

দেবেনবাবু বললেন, এই যে রেবতী, ঠিক সময়েই এসেছ। ইনিই হলেন সেই তটিনী দেবী। ‘ভানুমতী’ পালার কথা বলেছিলাম-না তোমাকে? গতবছরের আগের বছর পুজোর সময়ে হ্যাঁমিলটনগঞ্জে গেছিলেন ওঁরাই। আর এ-বছর, এই সময় আলিপুরদুয়ারে এসেছিলেন।

ওঁকে চিনুম না দাদা! আপনার মুখে ত হেই নাম-ই কৃষ্ণনাম আছিল বহুদিন।

নবাগম্ভক বললেন।

অবনী কারেক্ট করে বলল, রাধানাম বলুন। জেণ্ডার ভুল করছেন কেন?

সকলেই সেই কথাতে হেসে উঠলেন এবং উঠল।

এই সময়টা কি যাত্রার পক্ষে উপযুক্ত? প্রায় রোজ-ই তো ঝড়-বৃষ্টি হয়।

দেবেনবাবু বললেন।

আকা বলল, ইনি হইতেছেন সাক্ষাৎ জগদম্বা। ম্যাঘ, বিদ্যুৎ সর্বক্ষণ ওঁর শাসনেই থাহে। এমনিই কইতাছি না। চারদিন মানে, চার রাইত পরপর হইল যাত্রা, তাও সার্কিট হাউসের সামনের মাঠে। কুননারকম উপদ্রব-ই ত হয় নাই। না ঝড়, না বাতাস, না জল।

ও, আলাপ করিয়ে দিতে ভুলে গেছিলাম। ইনি হলেন রেবতীভূষণ ভৌমিক। পোস্টম্যান।

পোস্টমাস্টার দেবেনবাবু বললেন, নবাগন্তুককে দেখিয়ে।

রেবতীবাবু দু-হাত তুলে নমস্কার করলেন।

করেই আকার দিয়ে চেয়ে বললেন, আপনারে য্যান চিনা-চিনা লাগে! আপনের বাড়িও কি সলসলাবাড়িতে?

না। আমার বাড়ি হইল গিয়া আলিপুরদুয়ারে। আর এই অঞ্চলে আসল-যাওন তো লাইগ্যাই আছে। তা ছাড়া, আমরা পেরতি বচ্ছর-ই জয়ন্তী ছাড়াইয়া ভুটান পাহাড়ে মাউন্টেইনারিং-এর ক্যাম্প করি না! ছুটো-ছুটো ছাওয়াল-মাইয়াদেরও তো লইয়া আসি আলিপুরদুয়ার থিক্যা। দ্যাখছেন নিশ্চয়ই!

পোস্টম্যান রেবতীবাবু এবারে একটু ভেবে বললেন, বুঝেছি, বুঝেছি। আপনে আলিপুরদুয়ারের তপনবাবুর লগে আসেন ত!

হ। ঠিকেই ধরছেন।

পোস্টমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, কোন তপনবাবু?

আরে, আলিপুরদুয়ারের অ্যাসিস্ট্যান্ট পাবলিক প্রসিকুটার।

অ। বুঝেছি। টাক মাথা তো।

আউজ্ঞা। এক্কেরে টাক না, কিছু চুল এহনও আছে। তবে পিছনে।

অবনী জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায় রেবতীবাবু?

মানে, দ্যাশ কই ছিল, তাই জিগান ত?

হ। বাড়ি মানে তো দ্যাশ! ওই হইল আর কী!

দ্যাশ তো আছিল মইমনসিংহ। এহনে থাহি সলসলাবাড়িতে। উদবাস্তু। বোঝেন-ই তো!

হ। হ। বুঝেছি। আমরাও ত তাই-ই। মানে উদবাস্তুর পোলা আর কী! না-বোঝনের আছেটা কী?

মাস্টারমশয়ের বাড়ি তো বললেন হ্যাঁমিলটনগঞ্জ। আলিপুরদুয়ার থেকে যেতে পথে কী

একটা জায়গা পড়ে-না, কী যেন, নাম?

তটিনী বলল।

পড়ে তো! আটিয়াবাড়ি। গারোপাড়া ভাতখাওয়া টি এস্টেট হয়ে, কালচিনি হয়ে ডিমা নদী পেরিয়ে যেতে হয়।

মাস্টারমশাই যেন, বলতে বলতে স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠলেন।

মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তটিনীর। বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ আটিয়াবাড়ি। মনে আছে, আমরা বাস দাঁড় করিয়ে চা আর শিঙাড়া খেয়েছিলাম সেখানে।

তটিনী বলল, স্মৃতিচারণ করে।

আপনি আগে কোথায় ছিলেন মাস্টারমশাই?

এখানে আসার আগে?

হ্যাঁ।

অবনী জিজ্ঞেস করল।

আজ্ঞে, আগে ছিলাম পানাতে।

পানা? সেটা কোথায়?

তটিনী জিজ্ঞেস করল।

একেবারে ভুটানের বর্ডারে। ভুটান দেখা যায় সেখান থেকে। বাসরা আর পানা এই দুই নদীই বেরিয়েছে ভুটান থেকে। ওঃ। নাইনটি-টুতে সে কী বন্যা! বন্যায়…

ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অবনী বলল, চা তো খাওয়া হল, আপনাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। এবারে আমরা এগোই। কী বলেন মাস্টারমশাই? রোদ চড়া হয়ে যাবে।

তটিনী বলল, হ্যাঁ।

মাস্টারমশাই হাঁক দিলেন, মান্তু। ছাতাটা নিয়ে মেমসাহেবের মাথার ওপরে ধরে পৌঁছে দিয়ে আয় বাংলো অবধি।

তটিনী বলল, আপনি কি পাগল হলেন? কিছু লাগবে না। চলি তাহলে। আচ্ছা, খুব ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনাদের।

তারপর-ই বলল, এই মাকে আমি দশটা টাকা বকশিস দিতে পারি কি চা খাওয়াবার জন্যে?

দশ টাকা? সে কী! অত টাকা দেবেন কেন?

আমার কাছে দশ টাকার দাম নেই, তা ছাড়া চেঞ্জও নেই। কিন্তু আপনি অনুমতি দিলেই দিতে পারি। অনুমতি দিলে খুব-ই খুশি হই।

দিন। যখন বলছেন।

মাস্টারমশাই দেবেন্দ্রনাথ বসু বললেন।

পোস্টম্যান রেবতীবাবু বললেন, আজ সকালে কার মুখ দেইখ্যা উঠছিলি রে ছুঁড়ি?

মান্তু নামক মেয়েটি নির্বিকার নিরুত্তাপ মুখ মাটির দিকে নামিয়ে চুপ করে রইল।

আমরা এবারে যাই।

অবনী বলল।

ইনল্যাণ্ড, খাম কিছুই নিলেন না তো চিঠি লিখবেন কী করে?

মাস্টারমশাই বললেন।

তটিনী ঘুরে দাঁড়িয়ে, একটি পুরুষ-হনন হাসি হেসে বলল, চৈত্রদিনের ঝরা পাতায়।

অবনী বলল, ব্রাভো! ব্রাভো! এই নইলে আপনি নায়িকা। আপনি বর্ন-হিরোইন। সাধে কি গেটেদা বলেন যে, তটিনীর কারোর-ই ডিরেকশনের দরকার নেই। ও হচ্ছে ন্যাচারাল অ্যাক্টেস।

দু-হাত তুলে ওঁদের নমস্কার করে তটিনী বাইরে বেরোল। পেছনে পেছনে অন্যরা।

অবনী বলল, যাঁরা চিঠি বিলি করেন, মানে, এই পোস্টম্যানেরা কতবড়ো কাজ করেন, তাই-না? এঁরাও তো আমাদের-ই মতন মানুষ। এঁদেরও আমাদের মতন সুখ-দুঃখ থাকে, সংসার থাকে, ছেলেমেয়ে থাকে, এঁরা নিছক-ই আমাদের দুঃখ বা আনন্দের ডেলিভারি মেশিন নন। তাই-না? জীবনে আজ এই প্রথম প্রত্যেক পোেস্টম্যানের মধ্যে যে, আমাদের-ই মতন, একজন মানুষ’ও থাকেন, তাঁকেই আবিষ্কার করলাম।

তটিনী বলল, হুঁ।

আকা বলল, ক্যান? আমার জন্যে নয়? আজ না-হয় আমি স্যা চাকরি ছাইড়া দিছি, একদিন ত চিঠি বিলিও করছি, ঘরে ঘরে ঘুইর্যা।

করেছেন। না?

তটিনী বলল।

করি আর নাই? কত মানুষের কত খবর লইয়া লাড়াচারা করছি! হা! স্যা আছিল একদিন।

তটিনীর আসলে মনে পড়ে গেছিল ওর নিজের ছেলেবেলার কথা। ওর বাবা মেদিনীপুরের এক অখ্যাত সাব-ডিভিশনের এক অখ্যাত দুর্গম গ্রামের একটি পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার কাম-পোস্টম্যান ছিলেন। সে তার বাবার বিনি-মাইনের ঝিই ছিল মাত্র। অতিমোটা ভাত, মোটা কাপড়ের বিনিময়ে সে, তার মাতাল বাবার সব প্রয়োজন মেটাত। রান্নাবান্না করত, সেবা-শুশ্রূষা। একেবারে শিশুকালে–হারানো তার বাবার সঙ্গে কোনোরকম আত্মিক যোগ ছিল না। অনেক মেয়ের-ই থাকে না। ওর বয়েস যখন ওই দশ-এগারো বছরের মার-ই মতন ছিল, সেইসময়েই গ্রামের মহাজন শ্ৰীমন্ত জানা মেদিনীপুর শহরে ভালো কাজ দেবে, সুখে রাখবে, এই লোভ দেখিয়ে মাতাল বাবাকে মোটা টাকা দিয়ে, মা-মরা তটিনীকে তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে গেছিল। তারপরের সেইসব গ্লানি আর ক্লেদ-ভরা দিনগুলির কথা মনে পড়ে যাওয়াতেই ওর মন ভারী হয়ে এল।

মান্তু দাঁড়িয়েছিল দরজার একপাশে মাস্টারমশাই আর পোস্টম্যানবাবুর থেকে তফাতে, অপরাধীর মতন। তটিনী পেছন ফিরে চেয়ে একবার দেখল মান্তুকে পূর্ণদৃষ্টিতে।

তারপর হাত তুলল। বা-ই-ই করার মতন করে। কিন্তু মুখে কিছুই না বলে, মনে মনে বলল, আসি। যেন, বিদায় নিল। ওই মান্তুর কাছ থেকে যেমন, ওর ছেলেবেলার নিজের কাছ থেকেও তেমন-ই।

হঠাৎ-ই ঘুরে দাঁড়ানো তটিনীর মরালীর মতন গ্রীবা দেখে আকা আবারও কষ্ট পেল। চৈতি হাওয়াতে।

আন্দোলিত কয়েকটি এলোমেলো অলকচূর্ণ সেই তন্বী সুঠাম গ্রীবার সৌন্দর্য হঠাৎ-ই আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

পোস্ট অফিসের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে, পেছন ফিরে অবনী দেখল, দরজাতে দাঁড়িয়ে থাকা দেবেনবাবুর খাকি ফুল-প্যান্টের তিনটি বোম-ই খোলা। হয়তো ওরা যাওয়ার ঠিক আগেই বাথরুম থেকে এসেছিলেন। ভুল হয়ে গেছিল লাগাতে। ভুলোমনের পুরুষমাত্রকেই এমন নানা এমবারাসমেন্টের মধ্যে পড়তে হয়। একজন পুরুষ হিসেবে, দেবেনবাবুর সমব্যথী হল অবনী।

ভাবছিল, পুরুষও যদি পুরুষকে ফেলে দেয়, বিনা দোষে, তবে সে-বেচারারা, এই পুরুষ নিগ্রহর যুগে যায় কোথায়?

আকাও ভাবছিল, মস্ত ভুল হয়েছিল তার তটিনীর সঙ্গে এবারে এই বক্সার জঙ্গলে আসা ল্যাংবোটের মতন, খিদমদগারের মতন। আর বাঁচা হবে না! মরবে সে এবারে। একেবারেই মরবে।

দূরে ভুটান পাহাড়ের মেঘের মতো নীলচে শরীর দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গলের মাথা ছাড়িয়ে। আস্তে একটা হাওয়া বইছে। হাওয়ার চেয়েও আস্তে আলতো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তটিনী ভাবছিল, তার সমস্ত জীবনটাই ভুল। যৌবন আর কত বছর থাকবে? এবার থিতু হওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে একটা। তবে, জীবনে নিজের চেষ্টাতে, নিজের চাঁদমুখের জোরে ঈশ্বরের অশেষ আশীর্বাদে সে অনেক-ই দূরে চলে এসেছে। এই এতখানি পথ আসাটা তার কাছে একদিন সত্যিই অভাবনীয় ছিল। কী করে মোটামুটি ইংরেজি বাংলা শিখেছিল, যিনি তার মধ্যে সাহিত্য-বোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন, সুরুচি, সেই চালকলের মালিক নারীদেহ-বিলাসী মোটা কুৎসিত মানুষটার কাছেও, শুধু এই কারণেই আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।

প্রত্যেক মানুষের-ই মধ্যে ভালো-মন্দ থাকেই। যদিও শুধু ভালো, শুধুই মন্দ মানুষ দেখেনি যে, জীবনে ও তাও নয়। একথা ঠিক যে, সাহিত্যই তাকে তার আজকের যতটুকু প্রাপ্তি তার পারায় সবটুকুই দিয়েছে। বাংলা গল্প উপন্যাস পড়ে সে, নিজেকে গড়ে-পিটে নিয়েছে। তার সেই প্রথম বাবু প্রাণধন খাঁ পয়সাওয়ালা হলেও শিক্ষিত ছিলেন।

বাবু বলতেন, মুনিয়া রে! Literature makes a person. সাহিত্য পড়। তার চেয়ে বড়োশিক্ষা আর নেই।

শরীর-ভাঙিয়ে খাওয়ার মধ্যে লজ্জার কিছু দেখেনি ও। কিন্তু নিদারুণ অসহায়তা অবশ্যই দেখেছে। সেই জীবিকা যে, অতিস্বল্পমেয়াদি তাও ও জেনেছে। এবং জেনে, শরীরের চেয়ে মনের ওপরে, গুণের ওপরে, ক্রমশই অনেক-ই বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।

সে একাই জানে, শুধু সে একাই, এই দীর্ঘ, দুর্গম, বন্ধুর পথের দু-পাশে কী ছিল?

লোভ কিন্তু আদৌ বেশি নেই ওর। ও একজন সাদা-সিদে, ভালোমানুষ, কম বুদ্ধিসম্পন্ন সচ্চরিত্র পুরুষ চায়, যার সঙ্গে ঘর বেঁধে ও, বাকিজীবনটা কাটাতে পারে। একটি কোলজোড়া ছেলে। তারপরে একটি মেয়ে। ব্যস।

আর কিছু চাইবার নেই ওর জীবনের থেকে। চারবার অ্যাবর্শন করতে হয়েছে ওকে। প্রথমবার চোদ্দো বছর বয়সে, শেষবার সাতাশ বছর বয়সে। সহবাস আর দাম্পত্যর মধ্যে তফাত যে, কী, তা ও বোঝে। তার সঞ্চয়ের সুদ থেকে, আড়ম্বর করে নয়, সাদামাটাভাবে কেটে যাবে বাকিজীবন। গুমা-হাবড়াতে দশ কাঠা জমিও কিনে রেখেছে। এখন…

তবে পুরুষ দেখে ওর ঘেন্না ধরে গেছে, পুরুষ জাতটার-ই ওপরে। শুয়োরের জাত এই পুরুষ।

হাঁটতে হাঁটতে তটিনী ভাবছিল, ওর পায়ে পায়ে মুগ্ধ, বাধ্য কুকুরের মতন হেঁটে-আসা আকা মানুষটি কিন্তু বেশ! ভালো নাম আকাতরু রায়। আজব নাম। মানুষটি এক-শো ভাগ খাঁটি মানুষ। আর তটিনী বুঝতে পেরেছে যে, তাকে মানুষটা পাগলের মতন ভালোবেসে ফেলেছে। একমাত্র নির্বুদ্ধি মানুষেরাই, সৎ, উদার, নিজ স্বার্থবোধহীন পুরুষেরাই এমন করে ভালোবাসতে পারে কোনো নারীকে, প্রথম দর্শনেই। তবে এখনও জানে না ও, এটা ভালোবাসা না মোহ না কাম! অনেক সময়েই এই তিনের মধ্যে তফাত করা ভারি কঠিন হয়ে ওঠে। অনেকবার দেখেছে ও। অধিকাংশ পুরুষেরাই স্বভাবে শুধু শুয়োর-ই নয়, গর্দভও বটে। তা ছাড়া, পুরুষের ভালোবাসা আর মুসলমানের মুরগি পোষা সমগোত্রীয় ব্যাপার-ই।

ঠিক সেই সময়েই পারুল গাছের মগডাল থেকে একটা কোকিল ডেকে উঠল খুব জোরে, কুহু-কুহু-কুহু’ করে।

তটিনীর বুকের মধ্যেটা চমকে উঠল।

আকা নাক তুলে উঁচু পারুল গাছটার মগডালে চোখ সরু করে আকুল হয়ে খুঁজতে লাগল। ওর চোখে রোদ পড়েছে। পাখিটা যে, কোথায় তা কিছুতেই ও দেখতে পাচ্ছে না।

তটিনী ভাবছিল, বেচারা! বোকা মানুষটা জানেই না যে, কোকিলটার বাসা মানুষটার নিজের-ইবুকের মধ্যে।

.

০২.

যখন রাজাভাতখাওয়া বন-বাংলোতে এসে পৌঁছোল ওরা, তখন প্রায় বারোটা বাজে।

মৃদুলের সামনে টেবিলটার ওপরের অ্যাশট্রেটা সিগারেটের টুকরোতে ভরে গেছে। সে কালকের THE STATESMAN-টা পাশের চেয়ারে সরিয়ে রেখে, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাবাঃ! হল তোমাদের ইনফরমেশন সেন্টার দেখা! এত ইনফরমেশন জড়ো করলে তা স্থানান্তরিত করতেও তো পুরোসপ্তাহ লাগবে।

তটিনী মৃদুলের উলটোদিকের চেয়ারে বসে বলল, সত্যি! কত কীই-না জানলাম, দেখলাম। গেলে পারতেন আপনিও।

থ্যাঙ্ক ইউ। আমার নিজের মধ্যে এত ইনফরমেশন জমে আছে যা, হজম করতে বহুযুগ লেগে যাবে। আমি আমাতেই টইটম্বুর।

সত্যি! আপনি ভারি ভালো কথা বলেন কিন্তু মৃদুলবাবু। আপনি নিজেই একটা কিছু লিখুন না।

কী?

নাটক, শ্রুতি নাটক, নয়তো যাত্রা।

লিখলেই হত। মাঝে মাঝে শুধু যাত্রার ডায়ালগ-ই নয়, সিনেমার ডায়ালগও এমন বোকা বোকা অপার অশিক্ষিতর মতন শোনায়, নিজে লিখতে ইচ্ছে যে-হয় না, তা নয়। প্রায়-ই মনে হয়, রেগেমেগে খাতা-কলম নিয়ে বসে যাই।

তারপর?

তারপর আর কী! লিখতে কোনো কিছু যে, পারি এই ভাবনাটাকে ফোঁড়ার মতন লালন করতে খুব ভালো লাগে আমার। ইচ্ছে করলেই, মানে, যে-জিনিস আমার করতলগত, তা করে ফেললেই পুরো মজাটাই মাটি হয়ে যায় বলে মনে হয়।

অবনী বলল, তা ছাড়া, একেবারে ঝুলও তো হতে পারে! সেই ভয়টাও থাকে।

মৃদুল হেসে বলল, তাও বটে!

জানেন, আকাতরু’ গাছ দেখলাম আমরা।

আকাতরু? গাছের নাম আকাতরু?

তাহলে আর বলছি কী? লালি, দুধে লালি, চাঁপ, চিকরাসি, গামহার, কাট্টুস, উদাল, ঝিমুনি আর খয়ের। খয়ের গাছও দেখলাম তো!

অবনী বলল।

না, না। সেসব গাছের নাম তো আমরা জানিই! কিন্তু যেসব গাছ এখানেই প্রথম দেখলাম সেগুলোর কথা শুনি। ভারি আশ্চর্য সব নাম তো! তা আকাতরু গাছ দেখতে কেমন?

বলেই ডান হাতের তর্জনী নির্দেশ করে বলল, আচ্ছা, এই গাছটা কী গাছ? এই যে, আমাদের বাংলোর গেট-এর ডান পাশে?

আকা বলল, ইটারেই তো কয় গামার। বা, গামারি।

অবনী বলল, আমাদের এখানে বলে গামার বা গামারি কিন্তু বিহারে এবং মধ্যপ্রদেশে বলে গামহার। জানিস আকা?

তাই?

ইয়েস।

তা আকারু গাছ কেমন, তা তো বললেন না?

মৃদুল শুধোল আকাকে।

জামগাছ দ্যাখছেন।

জামগাছ? না তো। গাছ দেখিনি তবে খেয়েছি। কালোজাম। গোলাপজাম।

শ্যামবাজারের মৃদুল আকাশ থেকে পড়ল।

হায়! হায়! জামগাছও দ্যাখেন নাই?

না।

খাইলে কী হয়? আকাতরু, জামগাছের-ই মতো মস্ত গাছ-পাতাগুলান কিন্তু ঠিক পাকুড় গাছের পাতার মতন। পাকুড় গাছ দ্যাখছেন তো?

পাকুড় গাছ? নাঃ।

খাইছে। এ তো মহা সাহেবেরে লইয়া পড়লাম দ্যাখতাছি।

তারপর বলল, মস্ত বড়ো বড়ো গাছ হয় আকাতরু। সাদারঙা আমের বোলের মতন ফুল ফোটে, মার্চ-এপ্রিল মাসে আকাতরু গাছে।

এখন-ই তো মার্চ মাস।

তয় দেখবেন। চোখ খুইল্যা থাককেন য্যান?

ইংরেজি, মানে বটানিকাল নামে জানেন নাকি? আকাতরুর?

মৃদুল সংকোচভরে আকাকে আবার জিজ্ঞেস করল।

আমি জানুম কোথনে? তবে কল্যাণ দাস সাহেবে আর ভগবান দাস সাহেবে এই বাংলোতেই বইস্যা কয়দিন আগে কথা কইত্যাছিল, আমি শুইন্যা লইছি। খালি শুইন্যাই লই নাই, টুইক্যাও থুইছি। তা না হলে আমার-ই ব্রেন তো। হঃ। এক্কেরেই বেগ-বেগা!

‘বেগ-বেগা’টা আবার কী বস্তু?

মানে, আমার ব্রেনে যা কিছুই ঢোকে, তা বেগে ঢুইক্যাই আবার তৎক্ষণাৎ বেগে বাইরাইয়া যায়, বোঝলেন কি না!

কী? মানে, বটানিকাল নামটা কী?

HEYNEE TRIJUGA.

হেইল হিটলার-এর মতন শোনাল যে!

অবনী বলল।

সে এক, ইংরেজ সাহেব আছিল B. Rox. স্যায় নাম থুইয়া গ্যাছে গিয়া ওই গাছের।

তিনি কোথায়? সেই রক্স সাহেব?

কেডা জানে তা কবে মইর‍্যা ভূত হইয়া গ্যাছে গিয়া।

কল্যাণ দাসটা কে?

বাবাঃ। তিনি ত হইলেন গিয়া অ্যাডিশনাল ডি.এফ.ও। এ.ডি.এফ. কইলে আবার মহা চইট্যা যান গিয়া। তিনিই ত সব। ডিরেক্টরে রোজ আসেন থোরি।

অ্যাডিশনাল ডি.এফ.ও.-ও তো এ.ডি.এফ.ও.-ই।

তা ঠিক। কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্ট ডি.এফ.ও.ও, এ.ডি.এফ.ও। তাই পুরাডা না কইলে তাঁর মানহানি হয়।

তাই?

আসলে কী আর হয়? তিনি ভুল কইর‍্যা ভাবেন, যে হয়।

আর ভগবান দাস সাহেব?

তিনি শিলিগুড়ির থনে আইছিলেন। সিলভিকালচারের এ.ডি.এফ.ও।

ও।

তারপর-ই বলল, এইসব কথা থাউক। এহনে কয়েন, এঁচড় কি খাইবেন? ফাসকেলাস এঁচড় হইছে বাবুর্চিখানার পিছনের গাছে।

এঁচড় তো অমৃত।

মৃদুল বলল।

গাছপাঁঠা।

অবনী বলল।

তাহলে কই যাইয়া নর্বুরে।

নর্বুটা কে?

আরে? তারেই চিনলেন-না? এই বাংলোর চৌকিদার-কাম-কুক-কাম-কেয়ারটেকার। হোয়াট নট? তার পুরা নাম হইতাছে নর্বু তামাং।

এতসব কথা আকা বলছিল বটে মৃদুল আর অবনীর সঙ্গে কিন্তু তার সমস্ত বাক্যাড়ম্বরের লক্ষ্য ছিল তটিনী।

কী যে হবে আকার, আকা জানে না।

তটিনী, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটি চটির মধ্যে ঘষতে ঘষতে বলল, আপনার নাম যে, আকা, সে কি ‘আকাতরু’ থেকেই?

তটিনী তাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলতেই ছাইচাপা আগুন যেমন, ফুঁ দিলেই দপ করে জ্বলে ওঠে, আকা তেমনি করে জ্বলে উঠল।

বলল, হ। বড়মায়ে তো তাই কইতেন। মস্ত গাছ তো! ভাবছিলেন আমিও মস্ত হইব বুঝি মানুষের মইধ্যে, আকাতরুর-ই মতন।

হয়েছেন-ই তো।

মৃদুল বলল।

হঃ। স্যা তো চেহারায়। মানুষ আর হইতে পারলাম কই? বনমানুষ-ই রইয়্যা গ্যালাম।

তটিনীর হাসি পাওয়ার কথা ছিল আকার এই কথাতে। কিন্তু অন্যদের মুখ স্মিতহাসিতে ভরে উঠলেও তটিনী হাসল না।

একটু চুপ করে থেকে ও বলল, আপনারা সবাই কখন খাবেন?

তুমি যখন খাবে। তুমিই একমাত্র মহিলা দলে। তোমার ইচ্ছেতেই সব হবে।

মৃদুল বলল।

বাঃ তা কেন? একদিকে পুরুষের সমান বলে দাবি করব আর অন্যদিকে নেকুপুযুমুনু হয়ে সব সুযোগ নেব, তেমন মহিলা আমি নই। না, বলুন-না?

অবনী বলল, কী রে আকা? যা না নীচে একবার। নর্বু তামাং না, কী নাম বললি, তাকে একবার জিজ্ঞেস করে আয়, ক-টা নাগাদ তৈরি হয়ে যাবে লাঞ্চ। আর আঁচড়ের লোভ যখন জাগিয়েই দিলি আমাদের মনে, তখন দেখিস যেন…

আরে কুনোই চিন্তা নাই তর। এঁচড়টা আমিই রাঁধুম।

তবেই সেরেছে। মুখে দেওয়া যাবে না।

তারপর তটিনীর দিকে ফিরে বলল, যা ঝাল আর তেল দেবে আকা!

তারপর বলল, তোর গুণপনা দেখাবার আরও অনেক জায়গা পাবি, জয়ন্তী, সাম্রাবাড়ি, বক্সাদুয়ার, ভুটানঘাট। অদ্যই তো আর শেষ রজনি নয়। কিন্তু যেখানে বাবুর্চি আছে সেখানে তোর হাতের রান্না খেতে আদৌ রাজি নই আমি।

ঠিক আছে।

আকা বলল।

আকা সিঁড়িতে ‘ধপ ধপ’ শব্দ করে নীচে নেমে গেলে, মৃদুল স্বগতোক্তির মতন বলল, ভেরি গুড সোল। আপনার বন্ধু মানুষটি একটি ওরিজিনাল। ভারি ভালো। ওঁর কোনো ‘প্রোটোটাইপ’ এই ধরাধামে খুঁজে বের করা যাবে বলে মনে হয় না।

তারপরেই বলল, করেন কী ভদ্রলোক? মানে অকুপেশান কী?

পরোপকার।

যাঃ। সত্যি বলুন-না।

সত্যিই পরোপকার। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। অথচ বড়োলোক যে, তাও আদৌ নয়। একটা বই-এর আর স্টেশনারির দোকান আছে আলিপুরদুয়ার বাজারে কিন্তু সেখানে সে, দিনের মধ্যে দু-ঘণ্টা থাকে কি না সন্দেহ। বাকি সময়টা সত্যিই দশের উপকার করে বেড়ায়। ‘স্বার্থগন্ধহীন উপকার। আলিপুরদুয়ার এবং আশপাশে ও হয়তো আজ অবধি শ-খানেক মড়া পুড়িয়েছে, পনেরোটি মেধাবী কিন্তু গরিব ছেলেকে পড়াশুনা শিখিয়ে পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, জনা কুড়ি দুঃস্থা মেয়ের ভালো বিয়ে দিয়েছে। একমাত্র মিডওয়াইফ-এর কাজটাই করতে পারে না অথবা করতে দেওয়া হয় না সহজবোধ্য কারণে। তা নইলে, ওর মতন সেবাশুশ্রূষা হয়তো সদরের হাসপাতালের কম ট্রেইনড নার্স-ই জানে!

কুড়িটি মেয়ের বিয়ে দিলেন আর নিজের বিয়ে?

তটিনী জিজ্ঞেস করল।

ওই তো! করল কোথায় আর?

কেন?

বিয়ে করেন না কেন?

কেন? বলে, হেসে ফেলে অবনী।

হাসছেন কেন?

তটিনী বলল।

অবনী বলল, সময় তো যায়নি।

তারপরে বলল, আকা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা আউড়ে ডান হাতটা হাওয়ায় নেড়ে নেড়ে বলে, মোর তরে যদি কেউ প্রতীক্ষিয়া থাকে/সেই ধন্য করবে আমাকে।”

তারপরেই বলে, হে বন্ধু “আয়”।

বাক্যটা তো “হে বন্ধু বিদায়”।

তা তো জানাই। কিন্তু ও বলে, হে বন্ধু আয়। তারপর বলল, কাঙাল তো আমিও। কিন্তু ওর মতন, হোল-হার্টেড হোলসাম বাঙাল’ পাওয়া ভার।

এইকথাতে ওরা সমস্বরে হেসে উঠল।

রিফিউজি হয়ে এসেছিলেন, ওর বাবা-মা ফরিদপুর থেকে। আমার বাবার কাছে গল্প শুনেছি। আমরা পূর্ববঙ্গীয় হলেও আলিপুরদুয়ারে দেশভাগের আগে থেকেই থিতু হয়েছি। আমার বাবা ভারি ভালোবাসতেন আকাকে। বলতেন Gem of ও Boy. যখন আসেন, তখন ও ছিল কিশোরী বয়েসের মায়ের স্বপ্নে আর পুতুল খেলাতে। উনিশ-শো বাষট্টিতে ওর জন্ম। বড়োদাদারা সব অবস্থাপন্ন। কিন্তু আলাদা হয়ে গেছে। একজন গোয়ালপাড়ার গৌরীপুরের প্রফেসর। অন্যজন ধুবড়ির বড়ো কন্ট্রাক্টর। শুধু ওই ছোটো থেকে গেল। ওর বৃদ্ধা মার সব দায়িত্ব ওর-ই। পরোপকার করে আর মায়ের যত্ন করে। মানুষ না-হওয়া আকাই ‘মানুষ’-এর ভূমিকা পালন করে গেল। শুধু করলই না, ও আদর্শ মানুষের দৃষ্টান্তস্বরূপ।

বড়োভায়েরা দেখেন-না? মাকে?

ওই ওপর ওপর।

পড়াশোনা?

আকা স্কুল ফাইনালের পরে আর পড়েনি বটে কিন্তু প্রচুর পড়াশোনা ওর। বন-জঙ্গল খুব ভালোবাসে। আলিপুরদুয়ারের “নন্দাদেবী ফাউণ্ডেশন” আর “ঋজুদা ফ্যান ক্লাব”-এর সক্রিয় সদস্য। প্রতিশীতে ভুটানের সীমান্তের পাহাড়ে বাচ্চাদের দল নিয়ে যায়। ও যেহেতু অজাতশত্রু, ওর দোকানের বিক্রি খুব-ই ভালো। ওর সাহায্যকারী, যে-ছেলেটি দোকান দেখে, সে বই আর স্টেশনারি জিনিস বিক্রি করেই হিমসিম খেয়ে যায়। তা ছাড়া প্রায় পঞ্চাশটি পরিবারের মাসের সব স্টেশনারি যায় ওর-ই দোকান থেকে। গৃহিণীরা লিস্ট করে পাঠিয়ে দেন। সাইকেল-ভ্যানে করে ও, বাড়ি বাড়ি আর একটি ছেলেকে দিয়ে তা সাপ্লাই করে ধারে। মাস শেষ হলে টাকা দেন, ওর পাতানো বউদি, মাসিমা, পিসিমা, বোনেরা, দিদিরা।

আকা গর্ব করে বলে, দ্যাখ অবনী, ক্রেডিটে কারবার করি বটে, কিন্তু এক পয়সাও মার যায়নি আজ অবধি।

আমি বলি, তা যাবে কেন? তুই তো প্রায় কস্ট প্রাইসেই দিস সবকিছু, সকল-ই। প্রফিট আর কতটুকুই রাখিস? সস্তাতে হয়, তাই সকলেই নেন।

তাতে কী বলেন উনি?

তটিনী বলল।

বলবে আবার কী? জিভ কেটে বলে, ছিঃ ছিঃ। যা বাজার। প্রত্যেকের সংসার চালানোই যে, এক বিষম ব্যাপার। বেশি প্রফিট করে কী করব? আর আমার সংসার তো শুধু আমার এবং আমার মায়ের। আমাদের প্রয়োজনটাই বা কতটুকু? কিন্তু ওর ব্যবসার যা ভল্যুম, তাতে ও ন্যায্য প্রফিট রাখলে এতদিনে গাড়ি কিনতে পারত, দো-তলা পাকাবাড়িও করে ফেলতে পারত সহজেই। তার ওপরে খয়রাতিও তো কিছু কম নয়। সাইকেল চড়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা কিন্তু সবসময়েই পরিষ্কার পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়ায় যখন, তখন মনে হয়, দেবদূত এল সাদা পক্ষীরাজে চড়ে। এ যুগে ওর মতন, চরিত্র সত্যিই দেখা যায় না।

বাঃ।

তটিনী বলল, স্বগতোক্তির মতন।

তারপর বলল, এরকম চরিত্র থিয়েটারেই দেখা যায়, বাস্তবেও যে, আছেন তা জানা ছিল না।

কী যে বলো তটিনী! যাত্রা থিয়েটারে সিনেমাতে এখন ভালো বলতে কোন চরিত্রই বা দেখতে পাও? একটাও কি পাও? সমাজের, জীবনের যত কাদা, তাই নিয়েই তো আমাদের মাখামাখি।

সত্যি!

অবনী বলল।

কাদা মাখতে বা তাতে ডুব দিতেও দোষ নেই। যদি কখনো সেই পঙ্কে ‘পঙ্কজ’ও ফুটত দু-একটি।

মৃদুল বলল।

ঠিক।

তটিনী বলল।

এমন সময়ে সিঁড়িতে আবার ধপ ধপ’ শব্দ হল। ঋজু, কালো, প্রায় ছ-ফিট লম্বা আকা উঠে এল দো-তলার বারান্দাতে নীচ থেকে।

ওর পায়ের শব্দ শুনেই ওর সম্বন্ধে আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছিল ওরা।

কী বুঝলি?

অবনী বলল।

কী? আকা বলল।

আরে তোর নৰ্ব তামাং কী বলল?

নর্বু বলল, দেড়টার সময়ে টেবিলে খাবার লাগিয়ে আমাদের খবর দেবে।

মেনু কী?

অবনী বলল।

হেঁটে বেশ খিদে হয়েছে, না? কিন্তু যা ঘেমে গেছি। আমার কিন্তু স্নান করতে হবে।

তটিনী বলল।

তা ছাড়া ফ্রেশ, আন-পলিউটেড পরিবেশ। তার একটা এফেক্ট নেই। আমার কিন্তু বেশ । ভালো লেগেছে এই, আলিপুরদুয়ার আর দুধ-ভাত-খাওয়া।

মৃদুল বলল।

তটিনী হেসে উঠল জোরে। বলল, দুধ-ভাত-খাওয়া নয়, রাজা-ভাত-খাওয়া। ভুটানের রাজা আর কুচবিহারের রাজার মধ্যে জোর যুদ্ধ লেগেছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধশান্তি হয়েছিল। এখানেই। আর দুই রাজাই একসঙ্গে তাঁবুতে বসে ভাত খেয়েছিলেন বলেই জায়গার নাম হয়ে গেছে রাজাভাতখাওয়া। কুচবিহার তো কাছেই, ভুটানও তাই।

অবনী বলল মৃদুলকে, আপনি তো নড়লেন-ই না বারান্দা ছেড়ে গেলে, দেখতে পেতেন ‘ওয়াইল্ড লাইফ ইনফরমেশন’ সেন্টারের একটি দেওয়ালে চমৎকার রঙিন ছবি মানে, মানে ফ্রেসকোর আঁকিয়েছেন বিস্ত সাহেব।

বিস্ত সাহেব কে?

উনি ছিলেন, বক্সা টাইগার প্রোজেক্টের ফিল্ড ডিরেক্টর। এখন চলে গেছেন কনসার্ভেটর (হিলস) হয়ে দার্জিলিং-এ। ওঁর সময়েই এই ইনফরমেশন সেন্টারটি তৈরি হয়েছে। বিস্ত সাহেব এবং ঋজুদা ফ্যান ক্লাবের তপন সেন ইত্যাদিদেরও খুব ইচ্ছে ছিল কলকাতা থেকে “জঙ্গলের লেখক” বুদ্ধদেব গুহকে এনে ওই সেন্টারটির উদবোধন করানোর কিন্তু তিনি কাজে বম্বে চলে যাওয়াতে এবং উদবোধনের তারিখ আগেই স্থিরীকৃত হয়ে যাওয়াতে বর্ষীয়ান ও শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক, উত্তরবঙ্গের-ইবাসিন্দা অমিয়ভূষণ মজুমদারকে সসম্মানে এনে তাঁকে দিয়েই ওটি উদবোধন করানো হয়।

অবনী বলল।

তাই?

হ্যাঁ।

তা বুদ্ধদেব গুহ জংলি লেখক না, জঙ্গলের লেখক?

তা জানি না। একবার কাগজে পড়েছিলাম মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘জঙ্গলের লেখক বলে অভিহিত করেছেন ওঁকে।

জংলিও বলতে পারতেন।

ছাড়ুন তো! বুদ্ধদেব গুহ এমন কেউ নন যে, তাঁকে নিয়ে সকালটা নষ্ট করতে হবে।

আপনি কি কোনো লেখা পড়েছেন ওঁর?

আকা বলল।

না। সাহিত্যিক বিচারে বই যে, পড়তেই হবে তার কি মনে আছে? উনি বুর্জোয়া এবং বুর্জোয়াদের লেখক এইটুকু জানলেই যথেষ্ট।

আঁতেল মৃদুল দু-শো পার্সেন্ট আত্মপ্রত্যয় এবং যুক্তির সঙ্গে বলল।

আকা বলল, বিস্ত সাহেব মানুষটা ফাস কেলাস। বাড়ি দেরাদুনে কিন্তু বাংলা কন এক্কেরে বাঙালির মত, আর বই-ও যা পড়েন। কী আর কম! বিশেষ কইর‍্যা বন-জঙ্গলের বই-এর, যারে কয় “পুকা” উনি তাই।

‘পুকা’টা কী বস্তু?

মৃদুল বলল।

অবনী হেসে উঠে বলল, পোকা।

তাতে ওরা সকলেই হেসে উঠল।

‘মেনু’টা কী তা তো বলবি।

ছিম্পল-এরই উপর করতাছে। যেমন কয়্যা দিছি।

তা-ও। কী কী বল-না?

অবনী বলল।

এই হলুদ পোলাউ, যারে কয় বাঙালি পোলাউ, একটু মিষ্টি মিষ্টি, শিলবিলাতি আলু ভাজা, নারকোল, ছুটো-ছুটো চৌকো-চৌকো কইর‍্যা কাইট্যা তা ডালের মধ্যে ফ্যালাইয়া ছোলার ডাল। বকফুল ভাজা। তেকাটা মাছের ঝাল। বোরোলি মাছের ঝোল। কচি পাঁঠার মাংস। পুদিনা পাতা, ধইন্যা আর কারিপাতা একসঙ্গে কইর‍্যা বাটতে কইছি, চাটনি হইব। আর তটিনী দেবীর লইগ্যা পুস্ত বাটা। সঙ্গে হাঁসের ডিম সিদ্ধ।

মৃদুল ঠাট্টা করে বলল, মাত্র এই? আর কিছুই বললেন না রাঁধতে?

নাঃ। কইলাম-ই তো! ছিম্পল-এর উপরেই কয়্যা দিছি। রাতে জয়ন্তীতে ভালো কইরা হইবখন। সেই বাংলার চৌকিদার অজয় ছেত্রী, নর্বুর চাইয়া বয়সেও বড়ো আর ইক্সপিরিয়েন্সডও বটে। ফাস কেলাস ডিনার খাওয়াই আজ।

বলেই, তটিনীর দিকে ফিরে বলল, আর আপনে দই খাইতে ভালোবাসেন, তাই আপনার লইগ্যা আনছি বাণেশ্বরের দই।

কোথায় পেলি?

অবনী হাসল, অবাক হয়ে।

আরে! লোক পাঠাইয়াছিলাম যে, কুচবিহারে। বাণেশ্বর। ম্যাডাম খাইতে ভালোবাসেন।

আপনাকে কে বলল?

তটিনী বলল।

কী?

যে, আমি দই খেতে ভালোবাসি?

তটিনী আবার বলল।

আমি জানি। আপনেরা যখন ছার্কিট-হাউসে কাল রাতে ডিনার খাইতেছিলেন তখন তো আমিই আড়ালে থাইক্যা সব খাবার-দাবার এক এক কইর‍্যা পাঠাইতেছিলাম আপনাগো। নাইলে বাবুর্চি বাণেশ্বরের দই পাইথ কোনে?

মৃদুল বলল, তার আগে এগুলো কী জিনিস একবার ব্যাখ্যা করে বলুন।

কী জিনিস?

ওই যে বললেন, শিলবিলাতি আলু, তেকাটা মাছের ঝাল, আর বোরোলি মাছের ঝোল? হাঙর তিমিও খাওয়াবেন না তো?

মৃদুল কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।

অবনী বলল, এইসব-ই ইখানকার স্থানীয়। তেকাটা মাছ বা বোরোলি মাছ, ডিমা, নোনাই কালজানি, রায়ডাক ইত্যাদি নদীতে হয়। ছোটোমাছ, কিন্তু দারুণ স্বাদ। আর শিলবিলাতি আলুও এই অঞ্চলের স্পেশ্যালিটি, হয়ও শুধু বছরের এই সময়টাতেই।

বিশেষত্ব কী?

অবনী বলল, খুব ছোটো ছোটো হয় আলুগুলো। আঁশফলের চেয়েও ছোটো। একেবারে নিটোল গোল। খেতেও ভারি ভালো।

বাঃ।

আপনাদের এইসব অঞ্চলে, কত যে, অবাক-করা সব ভালো লাগার জিনিস আছে।

শুধুই ভালো লাগার। ভালোবাসার নেই?

তটিনী চুপ করে রইল।

আকা মনে মনে বলল, হায়রে! চোখে কেবল শিলবিলাতি আলু আর বাণেশ্বরের দই-ই পড়ল, চোখের সামনে এই যে, মস্ত এই আকাতরু, প্রায় মহিরুহর-ই মতন, তাকেই চোখে পড়ল না।

তটিনী বলল, খেতে যখন দেরিই আছে অনেক, তখন আমি আর একবার চানটা করেই ফেলি।

অবনী বলল, সে কী? সকালে তো করলেন।

সে তো কাকচান। আপনারা সব তৈরি হয়ে তাড়া লাগালেন। ঘুম থেকেও দেরি করে উঠেছিলাম। কী সুন্দর ঠাণ্ডা ছিল রাতে! আমার তো দুটো কম্বল লেগেছিল। কে বলবে, মার্চের শেষ। কলকাতাতে তো পাখা চলছে সরস্বতী পুজোর পর থেকেই।

কিন্তু মজা দেখেছ? রোদ উঠলেই চারদিক গরম হয়ে গেল।

মৃদুল বলল।

তা ঠিক।

তটিনী বলল।

এখানে থেকে গেলে হত বাকিজীবন।

মৃদুল বলল।

আপনি?

বলে, হাসল তটিনী।

কেন? আমি নই কেন?

বাবাঃ, আপনার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস, শনিবারের রেস-এর মাঠ, রবিবারের দুপুরে লেক-ক্লাবের ভডকা-সেশান, আড্ডা। আপনি তো ইনটেলেকচুয়াল। আপনি কি…এসব কথারই কথা। আর…

আর কী?

আর তো আমার জানা নেই। যতটুকু জানি, তাই বললাম। আপনি হোড়াই থাকতে পারবেন এমন জায়গাতে। আর কলকাতায় প্রতিমুহূর্তের প্রতিযোগিতা। পিকলু ব্যানার্জি বা বুলু চৌধুরী যেন, জনপ্রিয়তাতে, যশে, বুদ্ধিজীবীদের জগতের নানাপ্রকার ক্ষমতার ক্রিয়াবিক্রিয়াতে আপনাকে ছাড়িয়ে না যায়, তাও তো দেখতে হবে। সব সময়েই পায়ের পাতার ওপরে ভর দিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যে। এই যে, অভ্যেস আপনার। সকাল থেকে সন্ধে এই তো একমাত্র এক্সারসাইজ। আপনি পারবেন এই শান্ত ঘটনাবিহীন জায়গাতে থাকতে? কোন কাগজ আপনার কোন ভূমিকা সম্বন্ধে কী লিখল, তা না জানলে রাতে আপনার ঘুম-ই হবে না। তা ছাড়া, যাতে ভালো লেখা হয় সেজন্যেও তো কলকাঠি নাড়তে হবে, অঢেল মদ খাওয়াতে হবে। মদ-ই তো আপনার তরল অস্ত্র। কত শত্রুকে নিধন করলেন আপনি আজ অবধি তা দিয়ে।

মৃদুলের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এল। বলল, তাই? তুমি আজকাল অনেক বুঝছ তো তটিনী। এসব কি অনিমেষের শেখানো কথা?

ভুল মৃদুলবাবু। আমি কারো তোতা নই। কারো শেখানো কথাই আমি বলি না। আমি যেখানে পৌঁছেছি, সেখানে অনেক উঁচুনীচু পথ নিজপায়ে হেঁটে এসেই পৌঁছেছি। কেউ-ই আমাকে সাহায্য করেনি।

মৃদুল বিদ্রূপের গলাতে বলল, তোমার তো তুমি-ই আছ। এক-শোতে এক-শো নম্বর তো সেখানেই। আমার তো…

অবনী কথা ঘুরিয়ে বলল, মৃদুলবাবুর কথা জানি না। তবে অনেকেই টেনশানকে, স্ট্রেসকে, গালাগালি করেন বটে কিন্তু স্ট্রেস এবং টেনশান ছাড়া কি আধুনিক কোনো মানুষ আদৌ বাঁচতে পারে? ‘টেনশান’-ই তো টানটান করে রাখে মানুষকে, আধুনিক মানুষের জীবনকে। এ-কথা অবশ্যই ঠিক যে, প্রতিযোগিতা না থাকলে, সব সময়েই দৌড় না থাকলে, হেরে যাওয়ার, সর্বক্ষণ-ই পিছিয়ে পড়ার আতঙ্ক না থাকলে, মানুষ কী আদৌ এগোতে পারত? জীবনের কোনোক্ষেত্রেই? অমনভাবে বাঁচলে স্থিতপ্রজ্ঞ, সর্বজ্ঞ, নাদুসর্বস্ব বুদ্ধদেব হয়ে যেত।

তুমি কোন বুদ্ধদেবের কথা বলছ?

বুদ্ধদেব আর ক-জন আছেন? যিনি বোধিলাভ করেছিলেন তিনিই তো একমাত্র বুদ্ধ। আদি এবং এক নম্বর।

আজকাল বুদ্ধদেব বললে, একনম্বর বুদ্ধদেবের কথা কারোর-ই মনে পড়ে না। দু-নম্বর বুদ্ধদেবেই দেশ হয়ে গেছে, সরোদিয়া, চিত্রপরিচালক, মন্ত্রী, লেখক, এমনকী পাঁঠার কারবারিও।

পাঁঠার ব্যবসাদারের নামও আছে বুদ্ধদেব?

আছে বই-কী। আমাদের আলিপুরদুয়ারে বুদ্ধ মজুমদার নেই?

হ। হ। আছে জলপাইগুড়ির ফ্যামাস রাইটার সমরেশ মজুমদারের কী য্যান, ডিসট্যান্ট রিলেশান হয়।

আকা বলল।

আরে আসলে হয়তো হয় না কিছুই। কোনো মানুষের একটু নাম-টাম হলেই, গুড়ের ব্যবসায়ী, পাঁঠার ব্যবসায়ী সকলেই তার “আত্মীয়” এবং “গ্রেট ফ্রেণ্ড’ বলে দাবি করে। অথচ জলপাইগুড়ির মানুষ সমরেশ মজুমদার হয়তো এই আত্মীয়র কথা জীবনেও শোনেননি।

যাক গে। আপনারা দু-নম্বর বুদ্ধদেবদের নিয়ে থাকুন। আমি চানে যাই, গানে যাই-এর মতন?

মানে?

ও, অল ইণ্ডিয়া রেডিয়ো-এর এফ.এম. চ্যানেলের প্রোগ্রাম শোনেন-না বুঝি? “ভোরাই”, আলাপন”, আজ রাতে?”

না তো!

সে কী? আজকাল তো সেটাই ক্রেজ।

তাই? শুনতে হবে তো।

শুনলে, তবেই জানতেন। “গানে যাওয়া” বা “চানে যাওয়া যে, কত্তরকম হয়।

মানে?

সেখানে অনেকেই ন্যাকা পুরুষ ও মহিলার গলা শুনবে, যাদের জন্যে, হয়তো শিগগিরি বাংলা ভাষাটিই বিনা কারণে বিকৃত হয়ে যাবে। ন্যাকা মহিলা তাও সহ্য হয়, ন্যাকা পুরুষ দেখলে আমার গা বমি-বমি করে। এঁদের মধ্যে অনেকেই প্রত্যেক শব্দের শেষ অক্ষরটিকে নিয়ে রাবারের বেলুনের মতন টানটানি করে, টেনে লম্বা করে ফুলিয়ে যাচ্ছেতাই করে দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন এমন চললে তাদের-ই মতন শ্রোতারাও অনবধানে বিকৃত হয়ে যাবে।

অবনী বলল, কত দিকের কত বিকৃতি আর রোধ করবেন আপনি মৃদুলবাবু? ‘বিকৃতিই তো এখন জীবনের সমার্থক হয়ে গেছে।

মৃদুল একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তা ঠিক। তারপর-ই বলল, একটা ইন্টারেস্টিং খবর দেখেছেন অবনীবাবু?

কোথায়?

THE STATESMAN-এ।

নাঃ। আমি কোনো খবরের কাগজ পড়ি না।

কেন?

অকারণ সময় নষ্ট হয় বলে, তাই। টিভি-ও দেখি না। শুনে হয়তো অবাক হবেন আপনি, আজকালকার খবরের কাগজের ইণ্ডাস্ট্রি, পুরোপুরিই বিবেক এবং কর্তব্যজ্ঞানরহিত। দেশ ও দশের প্রকৃত ভালো নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্রই মাথাব্যথা নেই। পাটের অথবা গুড়ের অথবা নরকঙ্কালের ব্যবসা ছেড়ে তাঁরা দয়া করে খবরের কাগজ যে, কেন করতে এলেন ভেবে পাই না। পয়সা ছাড়া তাঁরা আর কিছুই বোঝেন না।

আর যা বোঝেন, তা হল বাঁদরকে শিব বানানো আর শিবকে বাঁদর।

যাত্রার বিজ্ঞাপন দেখতে, পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখতে যাঁরা কাগজ পড়েন তাঁরা পড়ুন। আমার বিন্দুমাত্রও দরকার নেই।

চেয়ার পেছনে সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তটিনী বলল, অবনীবাবু, আপনি মানুষটি কিন্তু ওরিজিনাল। দশজনের মতো নন।

মানে, প্রোটোটাইপ নন আর কী!

মৃদুল বলল।

অনেক ভাবনা-চিন্তা করেন, বাছবিচারও। খুব-ই ভালো।

বাছবিচার না করলে আপনাকে এবং অবশ্য মৃদুলবাবুকেও খুঁজে-পেতে আমাদের আলিপুরদুয়ারে নিয়ে আসব কেন কলকাতা থেকে? যাত্রার কোম্পানি অথবা নটনটীর কী অভাব ছিল?

হ। এটা তুই ঠিক-ই কইছস।

আমি তাহলে যাই। আপনারা তো সকলেই সকালেই স্নান সেরে নিয়েছেন। আবারও করবেন না কেউই নিশ্চয়ই।

না। যাও তটিনী। তুমি তটিনী! কোথায় তুমি অন্যকে চান করাবে না, নিজে চললে চান করতে।

উত্তর না দিয়ে তটিনী ওর ঘরে গিয়ে দুয়ার দিল ভেতর থেকে। স্নানঘরটি বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া। সকালেই চানঘরটা খুবই পছন্দ হয়েছে ওর। ঘেমেও গেছে খুব-ই। খুব ভালো করে চান করবে। চানঘর পছন্দ না হলে, চান করতে ইচ্ছেও হয় না ওর। গান গাইতেও নয়।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ