দ্বিপ্রহরে আহারাদি সারিবার পর শয্যায় গা এলাইয়া শুইয়া কোনক্ষণে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন তাহা ধৃতিকান্তর স্মরণ নাই।

যখন নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন বেলা আর নাই। বাহিরে অন্ধকার ছাইয়া আসিয়াছে। উন্মুক্ত বাতায়নের মধ্য দিয়া বাহিরের হিমভাব কক্ষে প্রবেশ করিতেছে। বাটীর বাহিরে পথে কাহারা কথা কহিতেছে, তাহাদের খন্ড খন্ড অসংলগ্ন সংলাপ কর্ণে আসিতেছে।

নিদ্রা চক্ষে এখনও জড়াইয়া আছে। ধৃতিকান্তর এমন কোনো রাজকর্ম অথবা শূদ্রকর্মও নাই যে, এক্ষণেই তাঁহাকে উঠিয়া পড়িতে হইবে।

ধৃতিকান্ত পাশ ফিরিয়া শুইলেন।

বহুদিন পর মুনাব্বর, মৃত আসগরের ভাতিজা অদ্য আসিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে। যে কক্ষে রেশমি নৃত্যগীতের রেওয়াজ করিয়া থাকে ও ইদানীং ক্কচিৎ-কদাচিৎ কাহাকেও গান শুনাইয়া থাকে সেই কক্ষ হইতে সারেঙ্গির সুর ভাসিয়া আসিতেছে। তৎসঙ্গে তবলার আওয়াজও ভাসিয়া আসিতেছে।

এখন পর্যন্ত গান শুরু হয় নাই। তবলা ও সারেঙ্গি বাঁধিয়া লইতেছে, উহারা রেশমির সহিত সংগত করিবার নিমিত্ত!

ধৃতিকান্ত বোধ হয় পুনরায় ঘুমাইয়া পড়িয়া থাকিবেন।

কিন্তু রেশমির সুর-কায়েমি আওয়াজ ধীরে-ধীরে তাঁহার অচেতন মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে অতিসযতনে অবচেতন হইতে চেতনমধ্যে ফিরাইয়া আনিল।

রেশমিকে যেন পুরানো দিনের স্মৃতিসকল পাইয়া বসিয়াছিল। ইদানীং ধৃতিকান্ত উপস্থিত থাকাকালীন যে-গানই সে গাহিতেছিল তাহা ধ্রুপ দ, ধামার, গজল, ঠুংরি বা খেয়াল যাহাই হউক না কেন, সব-ই বহুপরিচিত অনেকানেক স্মৃতি-বিজড়িত পদের গীত।

ধৃতিকান্ত অন্ধকার কক্ষে একাকী শুইয়া ভাবিতেছিলেন যে, অতীতের কোনো মুহূর্তে একটি গানের সহিত কত কিছুই না মাখামাখি হইয়া থাকে। এক-এক কলি গাহিলে স্মৃতিপটে যেন কোনো অদৃশ্য ব্যক্তি একটির পর একটি অতীতদিনের ছবি প্রক্ষিপ্ত করে। সুরের আরোহণ অবরোহণের সহিত কতদিনের কত সুখ-স্মৃতি দুঃখ-স্মৃতি, উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায় আজিকার অন্ধকার বর্তমান মহাকাশে জ্বলিয়া উঠিয়াই পরক্ষণেই কক্ষচ্যুত তারকার ন্যায় নির্বাপিত হইয়া যায়।

রেশমি একটি গজল শুরু করিয়াছে। বহুগীত বহুশ্রুত সেই গজলটি। তথাপি যেন, তাহা কখনোই পুরাতন হইবার নহে।

রকিব সে যে, উয়ো বসো
কনার করতে হ্যায়।

জ্বলা জ্বলাকে হামে বেকারার করতে হ্যায়।

ভীমপলশ্রী রাগের উপক্রমণিকা ভর করিয়া পদবদ্ধ এই গজলটি একসময়ে ধৃতিকান্তর বড়োপ্রিয় গান ছিল।

শুধুমাত্র যে, গজলটিই প্রিয় ছিল তাহাই নহে। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছাইয়া রেশমির সুরেলা, মাজা, সাবলীল কণ্ঠে গীত এই গজলের পদগুলি ধৃতিকান্তর বক্ষে বড়োই বিষণ্ণতার ভাবের উদ্রেক করিল। এতাবৎকাল এই গজলটিকে তিনি স্রেফ একটি গজল বলিয়াই জানিতেন, তাহার পদগুলির তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা ধৃতিকান্ত রেশমির উজালা জবানে যেন এত বৎসর পরে এই প্রথম স্পষ্টভাবে হৃদয়ংগম করিলেন।

এই গজল কোনো ব্যর্থ প্রণয়ীর সাম্প্রতিকতম দুঃখ ও ক্ষোভের ভাষা সুরের মাধ্যমে বড়োই প্রাঞ্জলভাবে ব্যক্ত করিতেছে।

পদগুলির অর্থ এই–যে, লোক-পরম্পরায় ব্যর্থ প্রেমিকা এই খবর পাইয়াছেন যে, তাঁহার প্রেমিক, তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বীকে না করিতে পারিয়া অবশেষে সেই মর্মঘাতী সংবাদটি প্রেমিকার কর্ণে পৌঁছাইলেন।

গজলের সুর ধীরে-ধীরে সমস্ত বাটী ভরাইয়া তুলিতেছিল। প্রতিকক্ষে, প্রশস্ত অলিন্দর খিলানে-খিলানে ধৃতিকান্তর শূন্য হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন তাহা কাঁদিয়া ফিরিতেছিল।

ধৃতিকান্ত সেই সুরের মধ্য দিয়া, পদের মধ্য দিয়া, ভীমপলশ্রীর মধ্য দিয়া রেশমি এক বৎসর তাঁহাকে যাহা বলে নাই, হয়তো বলিতে পারে নাই বলিয়াই বলে নাই, যাহা সে নিজমুখে কখনোই বলিতে পারিত না; সেই বক্তব্য বড়োই আনন্দ এবং বড়োই বেদনার সহিত বুঝিলেন।

রেশমির কারণে, রেশমিকে যাহা চাহিত তাহা দিতে না পারিয়া দিনান্ত বেলায় তিনি যারপরনাই ক্লিষ্ট বোধ করিতে লাগিলেন।

গজলের কলিগুলি ঘুরিয়া-ফিরিয়া তাঁহার মস্তিষ্কের কোশে-কোশে পাতিবদ্ধ চাতকপক্ষীর ন্যায় তীক্ষ্ম চঞ্চদ্বারা ঠোকরাইতে লাগিল।

সেই দুঃখময় আনন্দের বেদনাতে ধৃতিকান্ত তাঁহার দুই পোড়া চক্ষুতে বড়োই জ্বালা অনুভব করিতে লাগিলেন।

কিয়ৎকাল পর ধৃতিকান্ত শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া চটি-গলাইয়া প্রায় নিঃশব্দে বাটীর বাহিরে চলিয়া গেলেন।

একটি রিকশা লোকোমোটিভ ওয়ার্কস-এর দিক হইতে আসিতেছিল। রিকশায় উঠিয়া তিনি প্রয়াগ ঘাটে পৌঁছাইয়া এক ঘণ্টার কড়ারে একটি নৌকা ভাড়া করিয়া গঙ্গাবক্ষে ভাসিয়া পড়িলেন।

মাঝি একজন বৃদ্ধ। হয়তো ধৃতিকান্তর-ই সমবয়সি হইবে।

ধৃতিকান্ত তাঁহার নিজের প্রতিকারহীন বিষণ্ণতা ভুলিবার নিমিত্ত মাঝির সহিত কথোপকথন শুরু করিয়া তাহার সুখ-দুঃখের সংবাদ লইতে লইতে ভাসিয়া চলিলেন।

দুঃখ সকলের-ই থাকে। ধনী, দরিদ্র, ভাগ্যবান, অভাগা সকলের-ই। মনুষ্য জন্ম লইলেই প্রত্যেককে বহুবিধ দুঃখের শরিক হইতেই হয়। সেই সমস্ত দুঃখ হইতেও বেশি দুঃখময় এই সত্য যে, প্রত্যেকেরই দৃঢ় ধারণা জন্মায় যে, তাহার ন্যায় দুঃখী অন্য কেহই আর এ সংসারে নাই। তাহার দুঃখ বুঝিবার মতন মনুষ্যও এ ধরাধামে সে ব্যতীত আর দ্বিতীয় কেহই নাই। কিন্তু ধৃতিকান্ত অন্যজনের, সে যেই-ই হউক না কেন, দুঃখের খোঁজ করিয়া তাহা চিরদিন-ই বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, অন্যের দুঃখ বুঝিয়া, সেই দুঃখে আন্তরিকভাবে দুঃখিত হইয়া নিজ জীবনের সমুদয় অপসারণযোগ্য ও অনোপসারণযোগ্য দুঃখের ভার লাঘব করিয়া লইতে পারিয়াছেন।

ইহা তাঁহার বড়ো কম লাভ নহে।

ধৃতিকান্তর ন্যায় খুব কম ব্যক্তিই জানিয়েছেন যে, অন্যের দুঃখের আরশিতে নিজের দুঃখ প্রতিবিম্বিত করিলে স্বীয় দুঃখের ভার ও রং অনেকটাই ফিকা হইয়া আসে।

মাঝি পুরানো দিনের বারাণসীর কথা কহিতেছিল। তাহার যুবক পুত্র যে, গতবৎসর, বসন্ত রোগে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিল তাহার প্রসঙ্গে কহিল যে, তাহার যুবক-পুত্র থাকিলে তাহাকে নদীবক্ষে আজ অশক্ত শরীরে বইঠা বাহিতে হইত না।

ধৃতিকান্ত ভাবিলেন, সেই যুবক-পুত্র বাঁচিয়া থাকিলে যে, এই বৃদ্ধ মাঝিকে অন্য প্রকার দুঃখ দিত না, তাহার-ই নিশ্চয়তা কী ছিল?

উত্তরবাহিনী গঙ্গার বারিরাশি ছলাৎছলাৎ করিয়া নৌকার সম্মুখভাগে লাগিতেছিল। দূরে দূরে বিভিন্ন ঘাটের প্রতিফলিত আলো দৃশ্যমান হইতেছিল জলের উপর। বাতাস বহিতেছিল।

সেই মূহূর্তে ধৃতিকান্তর অকস্মাৎ মনে হইল যে, মৃত্যুর ন্যায় মহান আর কিছুই হইতে পারে না। এই বৃদ্ধ মাঝির যুবক-পুত্র কখনো জানিবে না যে, সে মরিয়া গিয়া তাহার পিতার স্মৃতিতে কী অম্লান নিষ্কলুষ অমরত্বর আসনে আসীন রহিয়াছে। মৃত্যু’ সাধারণকে বড়োই অসাধারণত্ব দান করে। সমস্ত সমালোচনা, ভুল বুঝাবুঝি এবং গ্লানির উর্ধ্বে পৌঁছাইয়া মৃত ব্যক্তি পরমশান্তিতে নিদ্রা যায়। জীবিতাবস্থায় যাহারা তাহাকে জীবন্থত করিয়া রাখিয়াছিল, সেই তাহারাই মৃতের শোকের হাহাকারে আকাশ-বাতাস মথিত করিয়া তোলে।

নদীবক্ষে ভাসিতে ভাসিতে ধৃতিকান্তর স্মৃতিতে তাঁহার যৌবনকালের বারাণসীর কথা উদিত হইল।

সেই বিন্ধ্যপর্বতোপরি অবস্থিত বাংলায় ধৃতিকান্তর সহিত রেশমির যে-সাক্ষাৎকার ঘটিয়াছিল তাহাই যে, শেষসাক্ষাৎকার নহে, তাহা পাঠককে বলা নিষ্প্রয়োজন।

সেই সাক্ষাৎকারের কয়েক বৎসর পরের কথা।

ধৃতিকান্ত মাতৃপূজার সময় বারাণসীতে উপস্থিত ছিলেন। প্রতিমা বিসর্জনের দিবস দশাশ্বমেধ ঘাট, প্রয়াগ ঘাট ইত্যাদি ঘাটের পথে গোধূলিয়ার মোড় হইতে প্রতিঘাট পর্যন্ত আলোয় আলোয় আলোকিত পথ বাহিয়া যে, লক্ষ লক্ষ সহাস্য কলকণ্ঠ, নারী, শিশু ও পুরুষের স্রোত উৎসাহিত আনন্দের সহিত প্রবাহিত হইত সেই বিচিত্র ও অনিঃশেষ জনরাশির দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে চাহিয়া থাকিতে ধৃতিকান্তের বড়োই ভালো লাগিত।

বারাণসীতে অবস্থানকালে প্রভাতে উঠিয়া তিনি কুস্তির আখড়ায় উপস্থিত হইতেন। বারাণসীর নামি নামি পালোয়ানের সহিত কুস্তি লড়িতেন। স্বেদ ঝরাইয়া, নৃত্যগীতজনিত রাত্রি জাগরণের কারণে যে, শারীরিক স্থবিরতা তাহা হইতে মুক্ত হইবার নিমিত্ত প্রত্যহই ব্যায়াম করিতেন।

পাঠক! হয়তো জানিবেন যে, আজিকার বারাণসী এবং তৎকালীন বারাণসীতে আশমান জমিন ফারাক ছিল।

আনন্দময়ী মায়ের ঘাট হইতে আরও বহুদক্ষিণে আসিয়া এই নদীবক্ষে যেরূপ এক নদী আসিয়া মিশিয়াছে, সেইরূপ উত্তরে মোগল সরাইয়ের নিকট আসিয়া মিশিয়াছে আর একটি নদী। অসী এবং বরুণা। প্রাকৃতিক বিধানকে লঙ্ঘন করিয়া যেস্থলে গঙ্গা উত্তরবাহিনী হইয়াছেন, সেই নদীর মধ্যবর্তী অংশ বারাণসী’ নামে অভিহিত।

গঙ্গা, বরুণা ও অসী আজিও যেমন প্রবাহিত হইতেছে, সেদিনও তেমন-ই প্রবাহিত হইত। কিন্তু সেদিনের বারাণসীর রহিস আদমিদিগের জীবনযাত্রা অন্যপ্রকার ছিল।

তৎকালে যাঁহাদের নিকট অর্থ ছিল, তাঁহাদের ধমনি বাহিয়া বহুদোষের সহিত একটি, হয়তো বা একটিমাত্রই গুণ বাহিত হইত। যাহার নাম খানদান।

পূর্বেই বলিয়াছি যে, অভিজাত মনুষ্যদিগের দোষের অন্ত ছিল না, কিন্তু তাঁহাদের ধমনিবাহিত খানদান-এর মধ্যে তাহাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন-ই কিছু পরিলক্ষিত হইত যাহা আজিকার ধনী চূড়ামণিদিগের কোনোক্রমেই কবলিত হইবার নহে।

তৎকালে চওকের পথে পদব্রজে যাইয়া ডাল-কা-মন্ডির গলির নিকটস্থ হইলেই তৎক্ষণাৎ ঘুঙুর ও সারেঙ্গির আওয়াজ কর্ণে ভাসিয়া আসিত।

ইত্বরের দোকানিরা বেলজিয়ান কাটগ্লাসের ডিকানটারে খসস-চম্পা-জুই-মুসক-ফিরদৌসি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার ইত্বরে-ইত্বরে ছয়লাপ করিয়া করিয়া সূচ্যগ্র গুম্ফ নাড়িয়া স্বচ্ছ আদ্দির পাঞ্জাবি পরিধান করিয়া চোস্ত বারাণসীর ভাষায় মৃদুকণ্ঠে কথোপকথন করিতেন।

প্রতিচওকে ও চবুতরায় এবং মোড়ে-মোড়ে মঘাই পানের দোকানগুলিতে দেওয়াল বিস্তৃত আরশিতে পথ-বাহিত নর-নারীর ছবি ফুটিয়া উঠিত। খুশবু-ভরা জর্দা সহযোগে তাম্বুল চর্বণ করিতে করিতে সেযুগের অলস সন্ধ্যায় রসিকের মন ফুলের সুবাসে ভাসিয়া তরণী-তন্বী তওয়ায়েফদের ঘুঙুরের শব্দের দিকে নির্দ্বিধায় ধাবিত হইত।

রুপোপজীবিনী, দেহপসারিনি ও প্রকৃত তওয়ায়েফে সেদিন আশমান-জমিন ব্যবধান ছিল। তাঁহারা বংশপরম্পরায় সংগীতকে এক মোহময় সুগন্ধি পরিবেশে এমনভাবে কোনো নম্র পেলব পক্ষীর ন্যায় পিঞ্জরাবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন যে, তাহা বলিবার নহে।

যে-বৎসরের কথা ধৃতিকান্ত ভাবিতেছিলেন সেই বৎসরের এক চন্দ্রালোকিত পূর্ণিমার রাত্রি। গঙ্গাবক্ষে সেই রাত্রিতে শত শত বজরা ভাসিয়া বেড়াইতেছে। প্রতিবজরায় ফরাশ বিছানো হইয়াছে। তাকিয়া, ইত্বরদানি, গড়গড়া, রৌপ্যনির্মিত তাম্বুলকরঙ্ক, বিচিত্র গন্ধী বহুরঙা ফুল, তম্বুরা, তবলা, সারেঙ্গি, শরাব, নদীমধ্যের মিঠা বাতাস সব মিলিয়া-মিশিয়া কী যে, এক অমরাবতীর আবহাওয়া সৃষ্টি করিয়াছে তাহা বলিবার নহে।

কোনো বজরায় তওয়ায়েফ কেবলমাত্র আলাপ শুরু করিয়াছেন। চন্দ্রালোক গঙ্গাবক্ষে প্রতিফলিত তাঁহার তিলফুলসদৃশ নাসিকার হীরকখন্ডে প্রতিবিম্বিত হইয়া কোমল ঝিকিমিকি আভা ছড়াইতেছে। কোথাও বা আলাপ সমাপনান্তে তান শুরু হইয়াছে। কেহ-বা দ্রুতলয়ে মিঠা ও ভরাট জবানে গজল গাহিতেছেন। কেহ-বা বিলম্বিত লয়ে ধামার অথবা ধ্রুপদ। দূর হইতে সেই ধামারের ঠাঁট নদীবক্ষে ভাসিয়া-ভাসিয়া না জানি কোন অচেনা দেবলোকের পানে চলিয়াছে।

কোনো বজরা সুরের নেশায় বেদম বুদ, শব্দহীন, উৎসাহের, উৎসারের পর স্তব্ধ।

কোথাও-বা শ্রোতারা শরাবের নেশায় অচেতন শয্যাসীন, তথাপি তওয়ায়েফ নাচিয়া গাহিয়া একাকী সাথসংগতিদিগের সহিত আপন কর্তব্য করিয়া যাইতেছেন।

ধৃতিকান্ত সেই রাত্রে বন্ধুবর্গের সহিত একটি বজরামধ্যে বসিয়া ভাবিতেছিলেন যে, এ বিচিত্র দেশে সাম্যবাদ যদি কোথাও কখনো থাকিয়া থাকে, তাহা প্রথমদিন হইতে সংগীত জগতেই ছিল এবং আছে।

এই নিক্কণিত শিহরিত শব্দের জগতে কেহ কখনো অন্যকে বঞ্চনা করিয়া একেলাই সমস্ত আনন্দ চুরি করিয়া নিজের পেটিকাবদ্ধ করিবার চেষ্টা করে না। কেহ যদি-বা সেই চেষ্টা করিয়াও থাকে, তাহা হইলেও অন্যদের সহিত কখনো আঁটিয়া উঠে নাই। এই ছন্দ-বদ্ধ মধুর শব্দময় জগতে সকলেই দাবিদার। প্রত্যেকের-ই সমান অধিকার। নদীবক্ষে সেই শান্ত সুন্দর সন্ধ্যায় যে-আনন্দ উৎসারিত বিকীরিত হইতেছিল তাহার ভাগ সকলেই সমানভাবে বাঁটিয়া লইয়া নিজ নিজ অন্তর কোমলগান্ধার বা শুদ্ধ রেখাবের ইত্বরে মাখামাখি করিয়া লইয়াছে।

এই আনন্দধামের অনিঃশেষ যাত্রায় কোনো যাত্রীই একে অন্যের পশ্চাতে পড়িয়া নাই। প্রত্যেকেই হস্তে হস্ত রাখিয়া, এক হৃদয়ের সঙ্গে অন্য হৃদয়ের যোগসূত্র স্থাপন করিয়া, এক ই সঙ্গে এই অনির্বচনীয় অনিন্দ্যসুন্দরের ঈঙ্গিত গন্তব্যে অলস মন্থরতায় যতিহীন ভাসিয়া চলিয়াছে।

ধৃতিকান্ত যেন একাকী আবেশের ভিতর ছিলেন।

মাঝি একাকী স্বগতোক্তির ন্যায় কথা বলিয়া যাইতেছিল। হয়তো বাতাসের সহিত, হয়তো-বা জলের সহিত।

এক বৃদ্ধ অন্য বৃদ্ধর সঙ্গ পাইলে যেরূপ সোচ্চার হইয়া উঠে, সেরূপ আর কাহারও সঙ্গলাভে হয় না। অভিজ্ঞ বৃদ্ধব্যক্তিমাত্রের-ই বলিবার ন্যায় অনেকানেক বক্তব্য বক্ষমধ্যে জমা হইয়া থাকে; কিন্তু বলিবার লোকের অভাবে সেই জমার ঘর শূন্য হয় না।

ধৃতিকান্তর অনাড়ষ্ট ব্যবহারে তাহার বদ্ধ-বক্তব্যের উৎসমুখ খুলিয়া যাওয়ায় সেই বৃদ্ধ মাঝির অব্যক্ত সমস্ত কথা স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারে উৎসারিত হইয়া বাহিরে আসিতেছিল।

ধৃতিকান্ত শুধাইলেন, মাঝি, বহুদূরে আসিয়া পড়িলাম। এক্ষণে তরী ফিরাও।

ধৃতিকান্তর কণ্ঠস্বরে মাঝির স্বগতোক্তির ঘোর কাটিয়া গেল। ধৃতিকান্তর স্বপ্নাবেশও।

তরীখানি একে একে মণিকর্ণিকা ঘাট, চৈতসিং ঘাট, অহল্যাবাই ঘাট, দশাশ্বমেধ ঘাট হইয়া প্রয়াগ ঘাটের দিকে ধীরে-ধীরে আগাইতে লাগিল।

অকস্মাৎ দূরাগত গুম-গুম শব্দে ধৃতিকান্ত দূরে তাকাইয়া দেখিলেন মুঘলসরাইয়ের সেতুর উপর দিয়া একটি যাত্রীবাহী রেলগাড়ি কলিকাতা অভিমুখে যাইতেছে। বোধ হয় দিল্লি-কালকা মেল হইবে। বহুদূর হইতে আলোকিত কামরাগুলি দিয়াশলাই-এর খোলের ন্যায় দেখাইতেছিল।

ওই অপস্রিয়মাণ আলোকিত রেলগাড়ির প্রতি চাহিয়া সহসাই ধৃতিকান্তর দীর্ঘশ্বাস পড়িল। কেন যে পড়িল তাহা, নিজেও তিনি বুঝিলেন না। কলিকাতায় তাঁহার আপনজন বলিতে কেহই নাই, পৃথিবীর অন্যত্রও হয়তো নাই। যে একমাত্র জন ছিল সে নিজহস্তে তাঁহাকে দূরে ঠেলিয়া পর করিয়া দিয়াছে বহুবৎসর পূর্বেই।

ধৃতিকান্তর বক্ষের অভ্যন্তর হইতে কে যেন অকস্মাৎ কহিল যে, এ জীবনে তাঁহার আর কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হইবে না।

রিকশা হইতে অবতরণ করিয়া ধৃতিকান্ত যখন মাহমুরগঞ্জের বাটীতে আসিয়া পৌঁছিলেন, তখন রাত্রি গম্ভীর হয় নাই; কিন্তু সমগ্র মহল্লা নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছে।

মুরতেজা আসিয়া দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিল।

সিঁড়ি উঠিতে-উঠিতে ধৃতিকান্ত বুঝিতে পারিলেন যে, গান থামিয়া গিয়াছে। মুনাব্বর সারেঙ্গিওয়ালা ও তবলচিও বিদায় লইয়াছে।

দ্বিতলে পদার্পণ করিয়াই ধৃতিকান্ত দেখিলেন, রেশমি বারান্দায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

রেশমির তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তি ধৃতিকান্তর একেবারেই অপরিচিত বলিয়া বোধ হইল। এই প্রকার ভঙ্গিমায় ও এইপ্রকার অভিব্যক্তির সহিত তিনি রেশমিকে কখনো দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখেন নাই।

রেশমি উন্মুভরে কহিল, তুমি ভেবেছ কী? এটা কি সরাইখানা? একমুহূর্তে ধৃতিকান্তর মুখমন্ডল ভস্মপ্রায় হইয়া গেল। উত্তর করিবার পূর্বেই রেশমি কহিল, যখন ইচ্ছা হবে তখন ফিরবে; আমি তোমার কে যে, নিজের শান্তি নষ্ট করে না-খেয়ে, না-দেয়ে তোমার খিদমদগারি করব? কী ভেবেছ তুমি আমাকে?

ধৃতিকান্ত জবাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করিতে চাহেন নাই, কিন্তু কিছু একটা বলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে রেশমি পুনর্বার চিৎকার করিয়া কহিল, কলকাতায় তোমার এতসব পেয়ারের লোক থাকতে মরার সময়ে আমার এখানে জ্বালাতে এলে কেন?

রেশমি যে, এমন করিয়া কখনো ভাবিতে বা বলিতে পারে তাহা ধৃতিকান্ত কদাপি স্বপ্নেও ভাবেন নাই।

ধৃতিকান্তর বাকরোধ হইয়া গেল, কী বলিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। বলিবার যোগ্য তাঁহার কোনো কথা ছিলও না।

কেবল অস্ফুটে কহিলেন, আমাকে মাপ করে দিয়ো।

কহিয়াই, ধৃতিকান্ত নিজকক্ষে গিয়া দ্বার ঠেলিয়া দিয়া, শয্যায় গিয়া শুইয়া পড়িলেন।

রিকশা করিয়া ঘাটে গমন, নৌকায় বসিয়া থাকা এবং পুনরায় রিকশায় সজোরে আন্দোলিত হইতে-হইতে ফিরিয়া আসিয়া এবং সিঁড়ি-ভাঙিয়া উঠিয়া ধৃতিকান্ত বড়োই পরিশ্রান্ত বোধ করিতেছিলেন।

ইদানীং একটুকুতেই তিনি শ্বাসহীন হইয়া পড়েন। উদরে অত্যন্ত বেদনা বোধ করেন।

তিনি তেপায়ায় রক্ষিত জলের পাত্র হইতে জলপান করিয়া কক্ষের বাতি নিবাইয়া দিলেন।

কী করিবেন, কী করা উচিত ভাবিয়া না পাইয়া বারংবার ঘুমাইয়া পড়িবার চেষ্টা করিলেন।

কিন্তু নিদ্রা অত সহজে আসিল না।

ধৃতিকান্ত বহুবার এই পার্শ্ব হইতে ওই পার্শ্বে ফিরিলেন, এক হইতে একশত অবধি গণনা করিলেন, যূথবদ্ধ বহুমেষকে বহুবার লম্ফ প্রদানপূর্বক প্রাচীর অতিক্রম করিতে দেখিলেন।

তথাপি নিদ্রা আসিল না।

বাহিরে পাহারাদারের বাঁশি বাজিয়াই যাইতে লাগিল। সেই বাঁশির সুর পুনরায় রাত-চরা পক্ষীর স্বরের ন্যায় ধৃতিকান্তর চেতনামধ্যে কত কী কহিতে লাগিল।

ধৃতিকান্ত শয্যাপরি চক্ষু মুদিয়া শুইয়া রহিলেন।

কতক্ষণ যে, ওইভাবে শুইয়াছিলেন স্মরণ নাই।

বহুক্ষণ পর যেন মনে হইল যে, বাহির দ্বারের ভারী পর্দায় খসখস শব্দ হইল।

ধৃতিকান্ত চক্ষু মেলিয়া দেখিতে পাইলেন যে, রেশমি একটি রেকাবিতে পেঁপে কাটিয়া লইয়া, স্বহস্তে শরবত তৈয়ার করিয়া কক্ষে প্রবেশ করিল।

জলের পাত্রটি বাতায়নের নিকটস্থ মেজ-এর উপর রাখিয়া সেই রেকাবি ও শরবত-এর পানপাত্র তেপায়ার উপর নামাইয়া রাখিল।

তাহার পর ধৃতিকান্তকে কিছুমাত্র বলিবার সুযোগ না দিয়া ও নিজেও কিছুমাত্র বলিবার চেষ্টা না করিয়া শয্যাপার্শ্বের মেঝেতে হাঁটু মুড়িয়া বসিয়া পড়িয়াই শায়ীন ধৃতিকান্তর বক্ষে মস্তক নামাইয়া উচ্চস্বরে ক্রন্দন করিয়া উঠিল।

ধৃতিকান্ত তাহার মস্তকে ও পৃষ্ঠে তাঁহার দুই হস্ত রাখিলেন। সস্নেহে তাহার পৃষ্ঠদেশে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন।

সেই মূহূর্তে আপনাকে বড়োই নীচ, ইতর, অপদার্থ ও অকৃতজ্ঞ বলিয়া মনে হইল ধৃতিকান্তর। তথাপি তিনি কিছুই কহিলেন না।

রেশমি তাহার বক্ষমধ্যে পিঞ্জরাবদ্ধ বহুবৎসরের নিরুদ্ধ আবেগকে এক্ষণে এত বৎসর পর নিঃশেষে অর্গলমুক্ত করিতে পারিল দেখিয়া তিনি আশ্বস্ত বোধ করিলেন।

রেশমি বহুক্ষণ ধরিয়া ক্রন্দন করিল।

কখন যে, সেই উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনের বেগ প্রশমিত হইয়া এক ক্ষীণ গুঞ্জরণের স্বরে নামিয়া আসিয়া ধীরে ধীরে স্তিমিত হইয়া স্তব্ধ হইয়া গেল তাহার হিসাব দুইজনের কেহই রাখিলেন না ও রাখিল না।

রেশমি শান্ত হইলে ধৃতিকান্ত কহিলেন, আমি সরে যাচ্ছি, তুমি আমার পাশে শোও।

রেশমি পঞ্চদশী বাধ্য বালিকার ন্যায় ধৃতিকান্তর বাক্যানুসারে তাঁহার পার্শ্বে শুইয়া পড়িল, কিন্তু ধৃতিকান্তর প্রতি মুখ ফিরাইল না।

ধৃতিকান্ত দক্ষিণ হস্তে তাহার কটি বেষ্টন করিয়া কহিলেন, আজ কীসের জন্য এত কষ্ট না পেলে তুমি রেশমি? আমি তো নতুন করে কোনো কষ্ট তোমাকে দিইনি।

রেশমি কোনো উত্তর করিল না।

–কথা বলবে না?

ধৃতিকান্ত শুধাইলেন।

তথাপি রেশমি নিরুত্তর রহিল।

ধৃতিকান্তও কথা বলিবার জন্য আর তাহাকে পীড়াপীড়ি করিলেন না। তাহার কটি বেষ্টন করিয়া তাঁহার নিজের ক্ষয়িষ্ণু বক্ষে যতখানি উত্তাপ ও উষ্ণতা অবশিষ্ট ছিল তাহা দ্বারা পরমস্নেহে রেশমিকে ঘিরিয়া রহিলেন।

কেহই আর কোনো কথা কহিলেন না বা কহিল না।

বহুক্ষণ পর, রেশমি আবেগকম্পিত কণ্ঠে শুধাইল, তোমার-ই জন্যে গান গাইছি শুনেও, তুমি কেন আমাকে না বলে চলে গেলে?

ধৃতিকান্ত উত্তর দিলেন না।

রেশমি পুনরায় কহিল, উত্তর দেবে না?

ধৃতিকান্ত তাহাকে অধিকতর নিবিড়ভাবে বেষ্টন করিয়া কহিলেন, না।

-কেন দেবে না উত্তর?

যুগপৎ আশ্চর্য এবং বিরক্ত হইয়া গ্রীবা ঘুরাইয়া রেশমি ধৃতিকান্তকে শুধাইল।

–দেব না। কারণ দেওয়ার মতো কোনো উত্তর নেই বলে।

ধৃতিকান্ত এ-জীবনে যাহা কখনো কাহাকে মুখ ফুটিয়া শুধান নাই, যাহা বাক্যে প্রকাশ করা কখনো পছন্দও করেন নাই, অকস্মাৎ তাহাই কহিয়া বসিলেন।

কহিলেন, তুমি আমাকে বড়োবেশি ভালোবাসো, না রেশমি?

রেশমি উত্তর করিল না।

কিন্তু ধৃতিকান্তর বক্ষসংলগ্না রেশমির মহুল-ফুল শরীরে এক আশ্চর্য কম্পন উঠিল বলিয়া তাঁহার বোধ হইল। রেশমির সমস্ত শিহরিত সত্তা নিরুত্তরে, নিরুচ্চারে ধৃতিকান্তর অন্তরে এক অভূতপূর্ব আবেগের সঞ্চার করিল। এই আবেগের সমতুল কোনো আবেগ ধৃতিকান্তর সান্নিধ্যে ও প্রেমে অন্য দ্বিতীয় নারীতে সঞ্চারিত হইতে ইহজীবনে তিনি দেখেন নাই।

ধৃতিকান্ত অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত বোধ করিলেন।

বাহিরে পাহারাদারের বাঁশি বাজিয়া যাইতে লাগিল।

যিনি জীবনে প্রায় সমস্ত কিছুকেই হারাইয়া বসিয়াছেন, সেই ধৃতিকান্ত যাহাকে তাহার বক্ষমধ্যে জীবনের অন্তিমকালে নিঃসংশয়ে ও বিনা চেষ্টাতেই পাইলেন, তাহাকে পাহারা দিয়া বসিয়া থাকিবার কোনোরূপ প্রয়াস করিলেন না। কিন্তু তাহাকে বড়ো সোহাগে সমস্ত অন্তরের নীরব শুভেচ্ছা ও প্রীতিতে অভিষিক্ত করিলেন।

রেশমি জানিল না, ধৃতিকান্ত পূর্বেও যেরূপ বিশ্বাস করিতেন, এক্ষণেও সেইরূপ করেন যে, পাহারাদারির ন্যায় এরূপ অর্থহীন বৃত্তি আর কিছুই হইতে পারে না।

এক গভীর সুখময়তার আবেশের বৃত্ত পরিক্রমা করিতে-করিতে অকস্মাৎ সেই বিহ্বল বৃত্তের ব্যাস হইতে বাহিরে আসিয়া রেশমি কহিয়া উঠিল, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে একবার চুনার আর বিন্ধ্যাচলে যেতে বড়ো ইচ্ছে করে।

ধৃতিকান্ত অস্ফুটে কহিলেন, হঠাৎ এই ইচ্ছে?

–এমনিই। তুমি আসার পর থেকেই এ-কথা ভাবছি।

তাহার পর কহিল, যাবে তো?

–তুমি যদি খুশি হও তো যাব।

–তবে শিগগিরই একদিন চলো।

–আমাকে নিয়ে গিয়ে কী লাভ? না পারব অতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকতে না পারব হাঁটতে।

–সব পারবে। আমি তোমার পাশে থাকলে তুমি সব পারবে।

ধৃতিকান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন।

যাহার মুখে এ-কথা তিনি শুনিলে আনন্দে বিবশ হইতেন, সে তাঁহাকে কখনো এরূপ করিয়া কহিল না। একবারও কহিল না যে, আমি তোমার পার্শ্বে থাকিয়া তোমার সব দুঃখ হরণ করিব।

অথচ, যে তাহা কহিল, তাহার নিকট হইতে ভালো ব্যবহার ব্যতীত আর কিছুর-ই প্রত্যাশা তাঁহার ছিল না।

সংসারে বোধ হয় এইরূপ-ই ঘটে। যাহার নিকট হইতে যাহা বড়ো তীব্র বেদনার সহিত কামনা করা যায়, সে তাহা কখনোই দেয় না। আর যে, অন্যজনে তাহা দেয়, বড়োই আনন্দমিশ্রিত বেদনার সহিত; সেই অন্যজনের নিকট হইতেও তাহা গ্রহণ করা যায় না।

ধৃতিকান্ত চুপ করিয়া রহিলেন।

রেশমি পুনর্বার কহিল, তাহলে বৃহস্পতিবার খাওয়া-দাওয়া করে বেরিয়ে পড়ব আমরা, বুঝেছ? সকালে উঠেই মুরতেজাকে বলে গাড়ির বন্দোবস্ত করে রাখব। তুমি কিন্তু ‘না’ বলতে পারবে না।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, বেশ যাব। তোমার যখন ইচ্ছে হয়েছে।

রেশমি ধৃতিকান্তর বক্ষলগ্না হইয়াই শুইয়া রহিল।

উঠিয়া আর নিজকক্ষে গেল না।

রেশমি বড়োই শান্তিতে ঘুমাইল সে রাত্রিতে, বড়োনিবিড় আনন্দে।

কিন্তু ধৃতিকান্তর চক্ষে কোনোক্রমেই নিদ্রা আসিল না। সমস্ত রাত্রি বাহিরের সেই পাহারাদারের বাঁশি তাঁহার মস্তিষ্কমধ্যে অনুরণিত হইয়া ফিরিতে লাগিল।

প্রত্যুষে উঠিয়াই রেশমি স্নান সারিয়া লইল। তাহার পর দাসীকে আনাজ কুটিতে বলিয়া ধৃতিকান্তর নিমিত্ত নিজহস্তে রন্ধন করিল।

ভোজনে বসিয়া ধৃতিকান্ত কিছুই ভোজন করিতে পারিলেন না।

রেশমি তাঁহার সম্মুখে মেঝেতে বসিয়া ধৃতিকান্তর ভোজনের তদারকি করিতেছিল।

অদ্য তোরঙ্গ হইতে বহুপুরাতন একটি হরিদ্রাবর্ণ টাঙাইল তাঁতের শাড়ি বাহির করিয়া রেশমি তাহা পরিধান করিয়াছিল। পূর্বে ধৃতিকান্ত যখন-ই কলিকাতা হইতে আসিতেন রেশমির নিমিত্ত বহু তাঁতের শাড়ি লইয়া আসিতেন।

কহিতেন, তোমাকে তাঁতের শাড়ি পরলে বড়োভালো দেখি আমি। রেশমি উত্তরপ্রদেশীয় মুসলমান। বঙ্গরমণীরা যেরূপ করেন, সে সেরূপ তাঁতের শাড়ি, পছন্দ করিত না। কিন্তু ধৃতিকান্ত তাঁহাকে তাঁতের শাড়িতে ভালো দেখেন বলিয়া, ধৃতিকান্তর উপস্থিতিতে সে প্রায়ই তাঁতের শাড়ি পরিধান করিত। সেসব আজি হইতে বহুবৎসর পূর্বের কথা।

এতবৎসর পরেও যে, রেশমি ধৃতিকান্তের পছন্দ-অপছন্দর কথা এমন করিয়া মনে করিয়া রাখিয়াছে, তাহা স্বচক্ষে দেখিয়া ধৃতিকান্ত বড়োই খুশি হইলেন।

রেশমি কহিল, আমাকে ভালো দেখাচ্ছে?

ধৃতিকান্ত কহিলেন, তোমাকে সব সময়েই ভালো দেখায়।

হলে কী হয়? রেশমি কহিল।

তাহার পর অভিমানভরে কহিল, যতই ভালো দেখাক, তোমার সেই তার মতো তো কখনো দেখলে না আমাকে।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, আবারও সেই কথা কেন? সে দোষ এ পোড়াচোখের। তোমার নয়।

কিয়ৎ পরে কহিলেন, অন্যের সঙ্গে চিরজীবন নিজের তুলনা করে বার বার নিজেকে ছোটো করো কেন? তোমার জায়গা তোমার-ই। আমার হৃদয়ে তোমার যে, আসন আছে তাতে অন্য কেউ কখনো বসতে পারে না; পারেনি। তোমার নিজের আসনে তুমি বসতে চাও না কেন?

রেশমি দুষ্টামিভরা চক্ষে ইশারা করিয়া হাসিয়া কহিল, অন্যের আসনে যে, আমার বড়ো লোভ। নিজেরটা তো নিজের বলেই জানি। আর জানি বলেই তো যা নিজের নয়, হবে না– হল না কখনো; তাতেই আমার এত লোভ। আমি যে মেয়ে।

ধৃতিকান্ত হাসিয়া কহিলেন, বললেই তো আর হল না। আমি জানি তুমি লোভীর চেয়ে অনেক বড়ো। তুমি তাকে বারবার হারিয়ে দিয়েছ। তোমার লোভকে পায়ে মাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই একজনকেও পায়ে মাড়িয়েছ। এ শুধু তুমি বলেই পেরেছ; পারলে।

রেশমি হাসিয়া কহিল, হয়তো হারিয়েছি। কিন্তু হার-জিত তো কতরকমের-ই আছে। তাই তো ভাবি, তাকে হারিয়ে তবুও তার কাছে চিরদিন হেরেই রইলাম। খুদার কি ‘তামাশা’ বলো?

ধৃতিকান্ত কিছুই না বলিয়া বারান্দাসংলগ্ন গোসলখানায় হস্ত ধুইবার নিমিত্ত উঠিয়া গেলেন।

.

০৬.

শরৎ চলিয়া গিয়াছে। হেমন্তও যাই-যাই করিতেছে। শীতের আগমনি গান নিক্কণিত প্রকৃতিতে ধ্বনিত হইতেছে।

উড়ন্ত ধুলায় শীতের শুখা খুশবু ভাসিতেছে। বাতাসে রুক্ষ টান টান ভাব। পথিপার্শ্বের কর্ষিত ভূমিতে কিরি ও বাজরার সমারোহ। বাজরা এই বৎসর বড়োই ভালো ফলিয়াছে। বাজরার খেতে কাকতাড়ুয়া। চাষিপুত্র ক্যানেস্তারা পিটাইয়া অনধিকার প্রবেশকারী, তাহাদের পরিশ্রমে ফলানো বাজরার ভাগীদার বগারী পক্ষীর ঝাঁককে খেদাইতেছে। বগারীর ঝাঁক, ঝাঁকি দিয়া দিয়া মুহূর্তমধ্যে এক-ই কম্পমান শরীরে, দিক হইতে দিক পরিবর্তন করিয়া, দিকচক্রবালে বিন্ধ্যপর্বতশ্রেণির উদ্দেশে উধাও হইয়া যাইতেছে।

নিকটেই কোনো গ্রামে গম-ভাঙা-কল মধ্যাহ্নের মন্থর শীতার্ত বাতাসে পুপ-পুপ-পুপ-পুপ স্বরের একঘেয়েমি ছড়াইয়া দিতেছে। কোথাও বা প্রান্তরের মধ্যে ঊর্ধ্বমুখে উট চলিয়াছে, না জানি কোন বিষণ্ণ চিন্তায় কুঁদ হইয়া। খুঁটাবদ্ধ লম্ব-কর্ণ শ্বেতচর্ম বকরির শরীরে শীতের রোদ পিছলাইয়া যাইতেছে। সে উজ্জ্বল চোখ তুলিয়া পটাপট শব্দে কান নাড়াইয়া মহানন্দে খড় খুঁটিয়া খাইতেছে।

বকরি-ইদের বিশেষ দেরি নাই। সে জানে না যে, তাহার দিন ঘনাইয়া আসিয়াছে।

গাড়ি চলিতেছে। মুরতেজা চালকের পার্শ্বে। রেশমি ও ধৃতিকান্ত পশ্চাতের আসনে।

ধৃতিকান্তর যাহাতে কোনোরূপ কষ্ট না হয় তাহার নিমিত্ত রেশমি বন্দোবস্তর ত্রুটি করে নাই। তাকিয়া, পানীয় জল, বহুক্ষণ ধরিয়া ভিজাইয়া রাখা চিড়ার সহিত বিশেষ দোকানের দধিও লইয়াছে। নিজের জন্য লইয়াছে কেবলমাত্র সেই রৌপ্যনির্মিত হংসসদৃশ তাম্বুলকরঙ্গ এবং সূক্ষ্ম কারুকার্যময় নরম বাদামি মলিদা! ফিরিবার পথে শীতের মোকাবিলা করিবার নিমিত্ত জর্দাসহযোগে ঘন ঘন তাম্বুল চর্বণ করায় অভিমানী ওষ্ঠদ্বয়ে এক সুন্দর রক্তিমাভা ফুটিয়া উঠিয়াছে।

.

গাড়ি চলিতেছে।

গাড়ি ক্রমশ বিন্ধ্যপর্বতশ্রেণির নিকটবর্তী হইল।

বিন্ধ্যাচল বারাণসী হইতে মাত্র পঞ্চাশ মাইল। মির্জাপুর হইয়া যাইতে হইবে।

ধৃতিকান্তর মনে পড়িয়া গেল সেই প্রবাদটি, কথানাম মির্জাপুরি বগলমে ছুরি।

এক সময়ে উত্তরপ্রদেশের এই জেলার অত্যন্ত দীর্ঘ লোকেরা দীর্ঘতর তৈল-মর্দিত বংশদন্ড হস্তে লইয়া সদাসর্বদা ঘুরিয়া বেড়াইত এবং সেই দন্ডের ব্যবহারে বিন্দুমাত্র বিলম্বের বা আইন-কানুনের ধার ধারিত না।

গাড়িতে দুই ঘণ্টার পথ। রেশমি কহিয়াছে পথে চুনারে থামিবে। তাহার পর বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দির ও অষ্টভুজার মন্দির দর্শন করিবে।

সে জাতিতে মুসলমান। কিন্তু হিন্দুর দেব-দেবীর প্রতিও তাহার সমান ভক্তি। হিন্দুধর্মের প্রতি তাহার আকর্ষণ ধৃতিকান্তর কারণে হয় নাই। প্রকৃতপক্ষে রেশমি আধা-হিন্দু-আধা মুসলমান। তাহার রাজন্য পিতা হিন্দুই ছিলেন। সে কারণেই হয়তো তাহার মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মের প্রতিই সমান মমত্ব জন্মিয়াছে। তদব্যতীত নুরুন্নেসার যৌবনকালে মুসলমান গুণগ্রাহী এবং হিন্দু-গুণগ্রাহী তাঁহার প্রায় সমান-ই ছিল।

রেশমির এই মনোভাব প্রথম হইতেই বৃতিকান্ত জ্ঞাত আছেন। কিন্তু তিনি নিজে যেহেতু কোনো ধর্মই মানেন না–রেশমিকে এ বাবদে কখনোও উৎসাহিত অথবা নিরুৎসাহ করেন নাই।

দেখিতে-দেখিতে চুনারে পৌঁছানো গেল। চুনার দুর্গের অভ্যন্তরে গাড়ি রাখিয়া যে-স্থলে পূর্বে বন্দিশালা ছিল, সে-স্থলে পৌঁছাতে ধৃতিকান্তর সবিশেষ কষ্ট হইল। মুরতেজা, রেশমি, তাঁহাকে প্রায় বহন করিয়াই সে-স্থলে লইয়া গেল।

সেই দুর্গপ্রাচীরে বসিয়া বিন্ধ্যপর্বতোপরি অধুনা পরিত্যক্ত বাংলাটি পড়ন্ত আলোয় দৃশ্যমান হইতেছিল।

রেশমি ও ধৃতিকান্ত নির্বাক দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকাইয়া বসিয়া রহিলেন। কেহই কোনো কথা কহিলেন না।

পাঠক! এইরূপ মুহূর্ত সকলের জীবনেই কখনো-কখনো আসে। কে আর না জানে যে, সেইসব মুহূর্তের বাক্যহীনতা বড়োই বাঙময় রূপ লইয়া চিত্তমধ্যে প্রকাশিত হয়!

বহুনিম্নে গঙ্গামাইর বক্ৰশান্ত হেমন্তর অপরাহ্রে রৌদ্রালোকিত রূপটি চক্ষু কাড়িয়া লয়। বহুদূরে নদীপার্শ্বে সেচ-বিভাগের তত্ত্বাবধানে জল তুলিবার নিমিত্ত যন্ত্র লাগানো হইয়াছে। সেই যান্ত্রিক শব্দ জলের উপর দিয়া ভাসিয়া আসিতেছে। নদীবক্ষে ও পিঙ্গল বালুচরের উপর চক্রাকারে যুগলে চক্রবাক উড়িতেছে। তাহাদের ‘কোঁয়াক-কোঁয়াক’ স্বর এতউচ্চ হইতে শুনা যাইতেছে না সত্য, কিন্তু ধৃতিকান্ত কল্পনায় তাহা শুনিতে পাইতেছেন।

দুর্গের অপর পারে যে, পেলব পিঙ্গল বালুচর দৃশ্যমান হইতেছে তাহামধ্যে তিনি একবার চক্রবাক শিকার করিতে গিয়া চোরাবালিতে পড়িয়া প্রায় সমাধিস্থই হইয়াছিলেন।

কত কথাই-না মনে আসিতেছিল। খন্ড-খন্ড, পরম্পরা-বিবর্জিত কত-শত স্মৃতি যে, এই হেমন্তের পড়ন্তবেলায় মস্তিষ্কের মধ্যে জলজ বালুচরের গন্ধের সহিত স্বর্ণবর্ণ চক্ৰবাকের মৎস্যগন্ধী ডানা বাহিয়া ভাসিয়া আসিয়া তাঁহার সমস্ত বোধকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছিল তাহা একমাত্র ধৃতিকান্তই জানেন।

ইদানীং কালে ধৃতিকান্ত গান একেবারেই গাহেন না। তথাপি এইক্ষণে তাঁহার বড়োপ্রিয়। বহুগীত রবিবাবুর সেই বহুপুরাতন গানটির কথা মনে পড়িতেছিল

ও গান গাস নে, গাস নে,
যে দিন গিয়েছে চলে,
সে আর ফিরিবে না,
তবে ও গান আর গাস নে।

রেশমি স্বগতোক্তি করিল, কত কী মনে পড়ছে জান?

ধৃতিকান্ত নিঃশব্দে হাসিলেন।

নিঃশব্দে কহিলেন জানি; জানি।

এই দিগন্ত বিস্তৃত ঘন অরণ্যানী বেষ্টিত, সূর্যদেবের অনুরোধানুসারে আনত পর্বতশ্রেণির মধ্যে অশ্বপৃষ্ঠে ধাবমান তাঁহার সেই যৌবনের তেজোদীপ্ত দিনগুলির কথা বারংবার মনে পড়িতে লাগিল ধৃতিকান্তর।

দুর্গের ফটকের নিকট একদল যুবক উচ্চস্বরে কী কারণে না-জানি হাসিতেছিল।

অকস্মাৎ সেই হাস্যরব ধিক্কারের ন্যায়, এক প্রচন্ড সুতীব্র পরিহাসের ন্যায় তাঁহার বক্ষে আসিয়া বিধিল।

ধৃতিকান্ত অতীত হইতে চক্ষু ফিরাইয়া সেই যূথবদ্ধ যৌবন-গরবী অনভিজ্ঞ যুবকদের পানে তাকাইলেন।

ধৃতিকান্তর ধারণা হইল, উহারা জানে না যে, কী মহামূল্য অথচ ক্ষণস্থায়ী ধন উহারা বক্ষমধ্যে, ধমনিমধ্যে বহিয়া বেড়াইতেছে। এক্ষণে গত হইয়াছে বলিয়াই ধৃতিকান্ত বুঝিতে পারেন, যৌবন’ কী সম্পদ! ওই যুবকদের তাহা পুরামাত্রায়ই আজিও বিদ্যমান আছে। হয়তো আছে বলিয়াই উহাদের পক্ষে এই অমূল্য সম্পদের মূল্যায়ন করা অদ্য সম্ভব নহে। তিনি যখন যুবক ছিলেন, তখন তিনি ভাবিয়াছিলেন যে, চিরদিন তিনিও যুবক-ই রহিবেন।

ধৃতিকান্তর মনোভাব বুঝিতে পারিয়া হঠাৎ রেশমি কহিল, উঠবে?

চলো। ধৃতিকান্ত কহিলেন।

মুরতেজা ও রেশমি যখন তাঁহাকে ধরিয়া ওই দুর্গশিখর হইতে অবতরণ করিতে সাহায্য করিতেছিল, সেই সময় ওই যুবকদিগের মধ্যে হইতে একজন এমনকিছু কহিল যে, ধৃতিকান্ত বুঝিতে পারিলেন তাঁহার শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও এই বেড়াইবার শখ সম্বন্ধে সেই যুবক কটাক্ষ করিল।

ধৃতিকান্ত শুনিয়াও শুনিলেন না।

কিন্তু রেশমি শুনিল।

রেশমির যৌবন ও রূপ লইয়াও উহাদের মধ্যে কেহ কিছু বলিল। বৃদ্ধ, অশক্ত ধৃতিকান্তর পার্শ্বে সুন্দরী এবং যৌবনবতী রেশমি যে, সম্পূর্ণই বেমানান, ইহাই তাহারা বুঝাইতে চাহিল।

রেশমি অত্যন্ত বিরক্তকণ্ঠে চালককে কহিল, গাড়ি সত্বর চালাইয়া চলো। আমরা অষ্টভুজার মন্দিরে যাইব।

সেই উদ্দাম, অসভ্য, গর্বিত যুবকেরা যাহা কহিয়াছিল, তাহা বিন্দুমাত্র মিথ্যা নহে।

এবং মিথ্যা নহে বলিয়াই তাহা ধৃতিকান্তকে বড়ো বাজিল।

বহুক্ষণ তিনি নিশ্ৰুপ রহিলেন।

তাহার পর রেশমিকে কহিলেন, তুমি আমাকে নিয়ে এসে ভালো করোনি।

রেশমি কহিল, সে আমার ব্যাপার। আমি বুঝব।

বলিয়াই, মুরতেজা ও চালকের অলক্ষ্যে ধৃতিকান্তর শিরা-বহুল শীর্ণ শীতল দক্ষিণ হস্তখানি নিজের কোমল ভরন্ত উষ্ণ হস্তে লইয়া নিজক্রোড়ে স্থাপন করিল।

তাহার পর ফিসফিস করিয়া প্রায় ধৃতিকান্তর কর্ণকুহরে মুখ লইয়া কহিল, ওরা চেঁচিয়ে যা বলল, তাই-ই তুমি শুনলে, আর যা-আমি না-চেঁচিয়ে চিরদিন বলে এলাম, তা কি কখনোই শুনতে পেলে না?

ধৃতিকান্ত উত্তর না দিয়া রেশমির হস্তে স্বীয়হস্ত দ্বারা মৃদু চাপ দিলেন।

রেশমি ধৃতিকান্তের অঙ্গুলিগুলি লইয়া স্বীয় অঙ্গুলিসমূহে একীভূত করিল।

গাড়ি চলিতে লাগিল।

বেলা পড়িয়া আসিয়াছিল। খাদের সুরে বাঁধিয়া-লওয়া কোনো বাদ্যযন্ত্রের তারের ন্যায় প্রথম শীতের ভীরু বাতাস পড়ন্ত বেলার রোদকে তাহার অঙ্গুলিতে লঘুভাবে স্পর্শ করিয়া যাইতেছে।

সেই অদৃশ্য তারবাহিত শীতার্ত ধ্বনি এই বিধুর অপরাহ্বে চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে।

মির্জাপুর শহরকে দক্ষিণে রাখিয়া গাড়ি সোজা এলাহাবাদের পথে ছুটিয়া চলিল।

বাম দিকে রেণুকোটের পথ চলিয়া গিয়াছে বিন্ধ্যপর্বতশ্রেণিকে অতিক্রম করিয়া। অতীতের যে, সময়কার বিভিন্ন ঘটনা, বন্ধু-বান্ধবদের মুখাবয়ব, এই সায়াহ্নে ধৃতিকান্তর মনে পড়িতেছিল সেই সময়ে এই সমস্ত পটভূমি কত না ভিন্ন ছিল। অসংখ্য পিচরাস্তা ছিল না, অগণ্য মনুষ্য ছিল না। পৃথিবীতে এমন কোলাহল, দৌড়াদৌড়ি শুধুমাত্র জীবিকান্বেষণের নিমিত্তই সূর্যোদয় হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এমন চক্ষু-লজ্জাহীন হুড়াহুড়ি ছিল না।

তখনও ধনী-দরিদ্র-মধ্যবিত্ত সকলেই নিজ-নিজ সামর্থ্য ও কর্মের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করিত। কিন্তু সে সময়ে জীবিকা’ই আজিকার ন্যায় জীবনের সব কিছুকেই অধিকার করিয়া মনুষ্যের সমস্ত অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে নাই। তৎকালে কখনো-সখনো কৃচিৎ-কদাচিৎ এই অনিঃশেষ দৌড় হইতে নিজেকে কিয়ৎক্ষণের জন্য থামাইয়া কিছু ভাবিবার থাকিলে তাহা আপনমনে ভাবিবার অবকাশ হয়তো ছিল। শহর, এমনকী গ্রামেরও জীবনযাত্রা লক্ষ করিয়াও আজিকাল ধৃতিকান্তের প্রায়শই মনে হয় যে, এক্ষণে সমাজের বিভিন্ন স্তরের অনেকের-ই অনেক কিছু হইয়াছে, হাওয়াই গাড়ি হইয়াছে, টেরিলিনের ট্রাউজার হইয়াছে, প্রচন্ড শব্দময়তার মস্তকপীড়ার উদ্রেককারী সভ্যতার নবতম অবদান ট্রানজিস্টার রেডিয়ো পৌঁছিয়াছে গ্রাম-গ্রামান্তরে কিন্তু নিস্তব্ধতার শব্দে নিবিড় কাকলিমুখর সেই বিধুর সায়াহ্নগুলি এই পৃথিবী হইতে কে বা কাহারা যেন, সজোরে নিমূল করিয়া চিরতরে উপড়াইয়া লইয়া গিয়াছে।

দেখিতে দেখিতে গাড়ি শিউপুরার লেভেলে ক্রসিং-এর নিকট আসিয়া পড়িল। দক্ষিণপার্শ্বে পথের কিছু অভ্যন্তরে বিন্ধ্যাচল রেলস্টেশনের সবে জ্বলিয়া-উঠা বাতি দৃশ্যমান হইতেছে।

সামান্য আগাইয়া বামে ঘুরিয়া পর্বতের পাদদেশে অষ্টভুজার মন্দিরের নীচে পৌঁছিয়া গাড়ি দাঁড়াইল।

ধৃতিকান্তর স্মরণ হইল যে, পূর্বে এস্থলে বহুবানর দেখা যাইত। কালীকুয়া হইতে যখন প্রত্যহ ভৃত্য পানীয় জল আনিতে যাইত তখন প্রায়শই বানরেরা উপদ্রব করিত।

রেশমির সহিত পাথরের সিঁড়ি উঠিতে উঠিতে ধৃতিকান্ত চতুর্দিকে তাকাইতে লাগিলেন। পূর্বে এ-স্থান অনেক বেশি নির্জন ছিল। এক্ষণে মন্দিরের পথের পার্শ্বে ঘর-বাড়ি দোকান-পাট ইত্যাদি হইয়াছে কিছু কিছু।

পর্বতোপরি মন্দিরের প্রায় মধ্যপথে একটি ভুজিয়া ও পেড়ার দোকান।

ধৃতিকান্ত রেশমিকে কহিলেন, তুমি ঘুরে এসো, আমি এখানে বসে একটু জল খাই। কত বছর ‘কালীকুঁয়ার’ জল খাইনি।

রেশমি কহিল, আচ্ছা।

ধৃতিকান্ত হঠাৎ শুধাইলেন, দেবীর কাছে কী চাইবে?

রেশমি গ্রীবা ফিরাইয়া হাসিল।

সেই আসন্ন সায়াহ্নের হরিদ্রা এবং স্বর্ণমিশ্রিত আলোক, রেশমির সুন্দর মুখশ্রী, তাহার হাসির আশ্চর্য পবিত্র ভাবটি ধৃতিকান্তর বড়োই মধুর লাগিল। তাঁহার মনে হইল, এরূপ মনোযোগের সঙ্গে গত দুই যুগের মধ্যে রেশমির প্রতি তিনি কখনো তাকাইবার অবসর পান নাই। অথবা তাকাইতে ইচ্ছা করেন নাই।

রেশমি হাসিয়া কহিল, তা বলব কেন! আমার চাওয়া আমার-ই।

তাহার পর কহিল, একটা কথা বলব, বিশ্বাস করবে?

–কী কথা?

–কোনো মন্দিরে বা অন্য কোথাওই আমি নিজে কখনো নিজের জন্যে কিছুই চাইতে যাইনি। কখনো না।

ধৃতিকান্ত বিস্ময়ে শুধাইলেন, তাহলে কী চাও?

রেশমি কহিল, বিশ্বাস করো, কোনো বিশেষ কারও জন্যে নয়। সকলের জন্যে। আমার চারপাশের সমস্ত লোক, আমার বারান্দায় খাঁচার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা ময়নাটার জন্যে, আমার বুড়ো-হয়ে যাওয়া বেড়ালটার জন্যে, প্রত্যেকের যাতে ভালো হয়, যাতে তারা ভালো থাকে, শুধু এইটুকুই বলি।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, তোমার সব কটা বুড়ো-হওয়া বেড়ালের কথাও মনে থাকে? যেটা খুব বেশি বুড়ো ও অথর্ব হয়ে পড়েছে, সেটার কথাও বলো?

রেশমি রাগ কহিল। করিল, চুপ করো।

কহিয়াই, পাহাড়ের প্রায় আড়াই সিঁড়ি বাহিয়া উঠিতে লাগিল।

ধৃতিকান্ত সেইদিকে অনেকক্ষণ তাকাইয়া রহিলেন।

রেশমিকে বড়োই সুন্দর দেখাইতেছিল।

সত্য কথা বলিতে কী, রেশমির ন্যায় শারীরিক ও আত্মিক সৌন্দর্যবর্তী কোনো নারী তিনি ইহজীবনে দেখেন নাই। কিন্তু তথাপি রেশমিকেও সহজে হারাইয়া দিয়া একজন অতিসাধারণ মোটামুটি সুশ্রী নারী কেমন করিয়া কোন নিরুচ্চারিত মন্ত্রবলে যে, তাঁহার সমস্ত জীবনের উপর এরূপ জবরদখল লইল, কোন অস্ত্রে যে, সে রেশমিকে পর্যন্ত পরাস্ত করিল, তাহা ধৃতিকান্ত ভাবিয়া পাইলেন না।

এক্ষণে সূর্যাস্তকালে এই দেবমন্দিরের সম্মুখস্থ রক্তকায় প্রস্তরাবৃত সিঁড়িতে বসিয়া, মাছরাঙার ন্যায়, আকাশের পানে তাকাইয়া ধৃতিকান্তর এমন বোধ হইল যে, এ-জীবনে রেশমিকে অন্যজনের ন্যায় ভালোবাসিতে পারিলে, তাঁহার জীবনের সূর্যাস্তর রং হয়তো এইরূপ না-ও হইতে পারিত।

পরক্ষণেই তিনি দোকানির হস্ত হইতে জল লইয়া, পান করিয়া তাহার সহিত আলাপ জমাইয়া তুলিলেন।

নানকু পানওয়ালা নামে এক পানওয়ালা ছিল বহুবৎসর পূর্বে নীচের শিউপুর বস্তিতে। সে কি এক্ষণেও আছে? ধৃতিকান্ত দোকানিকে শুধাইলেন।

দোকানি কহিল, সে কোনো পারিবারিক কারণে পরম-অভিমানভরে তাহার দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসরের ব্যবসা ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে স্বগ্রামে।

কেন? ধৃতিকান্ত শুধাইলেন।

দোকানি কহিল, নানকু বৃদ্ধবয়সে জুয়াড়ি হইয়া পড়িয়াছিল।

ধৃতিকান্ত অবাক হইলেন।

যে, সূর্যোদয় হইতে মধ্যরাত্র পর্যন্ত সটান বসিয়া থাকিয়া পেঁড়া ও মঘাই পান বিক্রয় করিয়া এতকষ্টের, এতস্কেদের রৌপ্যমুদ্রা সঞ্চিত করিল, সেই কিনা শেষবয়সে জুয়াড়ি হইয়া সেই রৌপ্যমুদ্রা নিজহস্তে বরবাদ করিয়া ফেলিল!

ধৃতিকান্ত তৎক্ষণাৎ নিজের শরাবি হইবার কথা স্মরণ হইল। নানকুকে অত সহজে বাতিল করিতে তাঁহার মন চাহিল না।

কার্য হলে কারণ থাকেই।
একটা কিংবা অনেকগুলো,
কারণগুলো ধুনে ধুনে
বুক করেছে পেঁজা তুলো।

ধৃতিকান্তর মনে পড়িল।

মনে মনে তিনি কহিলেন, নানকু ভাইয়া তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তোমাকে আমি ভুল বুঝিনি। তোমার বাইরেটা দেখেই দুনিয়া তোমার বিচার করল। তোমার সঙ্গে আমার আর এ-জন্মে দেখা হবে না। দেখা হলে তোমার বাইরের অভিমানের ছাই টুসকি দিয়ে ঝেড়ে ফেলে তোমার অন্তরের আগুনের আসল চেহারাটা হয়তো দেখতে পেতাম।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল।

অমাবস্যার আর দেরি নাই। স্তব্ধ মহাকাশে নীহারিকামন্ডলী একে-একে আপন শরীরের বিবিধরঙা ঔজ্জ্বল্য লইয়া প্রকাশিত হইতে লাগিল।

ধৃতিকান্ত গাছগাছালিতে, পর্বতমালার প্রস্তরে-প্রস্তরে ফিসফিস শব্দে হিমকণা ঝরিয়া পড়িবার শব্দ অভ্যস্ত কর্ণে শুনিতে পাইতেছিলেন।

বহুক্ষণ হইয়াছে রেশমি গিয়াছে। তাহার ফিরিয়া আসিবার লক্ষণমাত্র নাই।

দোকানি পেড়া প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত, কড়াইয়ের দুগ্ধ জ্বাল দিতেছিল। কাষ্ঠের উনানে দাউদাউ করিয়া প্রজ্বলিত অগ্নিতে সেই দুগ্ধ ফুটিবার শোঁ-শোঁ এবং জ্বলন্ত কাষ্ঠের ফুটফাট আওয়াজ সেই অন্ধকার-সন্ধ্যার নির্জনে শৈত্য বহুগুণ বাড়াইয়া তুলিয়াছিল।

দোকানির আবক্ষ ঘোমটা প্রলম্বিত স্বাস্থ্যবতী যুবতী স্ত্রী, একটি শিশুকে সঙ্গে লইয়া অগ্নির পার্শ্বে আসিয়া আসন্ন শীতের প্রকোপ হইতে রক্ষা পাইবার নিমিত্ত কুন্ডলী পাকাইয়া বসিল। তাহার রন্ধনকর্ম বোধ হয় ইতিমধ্যে সম্পন্ন হইয়াছে। সে তাহার স্বামীকে হাতা-খুন্তি ইত্যাদি আগাইয়া দিয়া সাহায্য করিতে লাগিল।

নৃত্যরত অগ্নিশিখা ধৃতিকান্তর মস্তিষ্কমধ্যে, এক ঘোরের সৃষ্টি করিয়াছিল। ধৃতিকান্ত সেই লেলিহান অগ্নিশিখার প্রতি এবং এই শীতের রাত্রে বড় কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি হইয়া বসিয়া থাকা দম্পতি ও শিশুটিকে লক্ষ করিয়া ভাবিতেছিলেন, ইহাকেই বোধ হয় ‘সংসারসুখ’ বলে। সংসার কি এমন-ই নৈকট্য ও উষ্ণতায় ভরাট রহে? নিরবধিকাল?

শিশুটি আবদার করিয়া দোকানিকে কী কহিল।

তাহার মা তাহাকে তিরস্কার করিল। কিন্তু দোকানি হাত বাড়াইয়া লাড়ুর থলি হইতে একটি লাড়ু তুলিয়া সস্নেহে পুত্রের হাতে দিল।

সেইমুহূর্তে পিতা, শিশু ও মাতা তিনজনের মুখমন্ডল-ই এক স্বর্গীয় মধুর হাসিতে ভরিয়া উঠিল।

হঠাৎ-ই ধৃতিকান্তর সমস্ত সত্তা বাহিরের সেই অন্ধকার রাত্রির ন্যায়, এক অন্ধকার বায়বীয় শূন্যতায় ভরিয়া উঠিল। ধৃতিকান্ত ভাবিলেন, এইরূপ গৃহলগ্না স্ত্রী, বড়ো কাছাকাছি উষ্ণ জীবন, পুত্র-কন্যার আন্তরিক প্রীতি তাঁহারও কি কাম্য ছিল? তাঁহার দ্বারা, এই সুখের ভাগীদার হওয়া এজন্মে হইল না। কিন্তু কেন?

অকস্মাৎ চোখ তুলিয়া ধৃতিকান্ত দেখিলেন যে, রেশমি তাঁহার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং তাঁহার-ই দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া অপলকে সেই দরিদ্র দোকানির জীর্ণ দোকানের মধ্যে যে-ঐশ্বর্য তাহার পানে লুব্ধদৃষ্টিতে চাহিয়া আছে।

ধৃতিকান্ত অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া রহিলেন।

রেশমি তাঁহার স্কন্ধোপরি হাত রাখিয়া কহিল, যাবে না?

ধৃতিকান্ত অস্ফুটে কহিলেন, চলো।

মন্দিরের সিঁড়ি বাহিয়া রেশমির হাতে হাত রাখিয়া অন্ধকারে পথ দেখিয়া নামিতে নামিতে ধৃতিকান্ত ভাবিতে লাগিলেন- সুরের আরোহণ-অবরোহণের ন্যায়-ই মনুষ্যজীবনেও আরোহণ-অবরোহণ থাকে। পদের অস্থায়ী অন্তরা এবং আভোগের ন্যায়, মনুষ্যজীবনেরও ধাপে-ধাপে এই মন্দিরের সিঁড়ির ন্যায়, কোনো অদৃশ্য বিধাতা যেন, মাপ-জোক করিয়া রাখিয়াছেন। একদিন-না-একদিন যতই বিলম্বিত লয়ে তান বিস্তার করা হউক না কেন, এই জীবনে ‘সম’-এ সকলকেই ফিরিয়া আসিতেই হয়। যে, সময়ে সম’-এ না ফিরে, সে হারাইয়াই যায়। তাহার আর ফিরিবার কোনোই পথ থাকে না।

অনেক রাত্রি হইয়া যাওয়ায় রেশমি কহিল, বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দিরে আজ আর নাই-বা গেলাম।

পরক্ষণেই ধৃতিকান্তকে শুধাইল, নাকি যাবে?

ধৃতিকান্ত কহিলেন, মন্দিরে গেলেও, আমি তো আর ঢুকতাম না। তোমার ইচ্ছে না হলে গিয়ে লাভ কী?

-তাই-ই ভালো। তোমার শরীর ভালো না। এ পথও ভালো না। এতরাত হবে ফিরতে ভাবতে পারিনি। চলো ফিরেই যাই।

এই বলিয়া চালককে, বারাণসী ফিরিয়া যাইতে আজ্ঞা করিয়া রেশমি গাড়ির শার্সি উঠাইয়া মলিদা মুড়িয়া বসিল। মলিদার একভাগ ধৃতিকান্তর হাঁটুর উপর বিছাইয়া দিয়া কহিল, তোমার শীত করছে না তো?

রেশমি পার্শ্বে থাকিলে অদ্যাবধি যে, ধৃতিকান্তর কখনো শীত করে নাই একথা এইমুহূর্তে ধৃতিকান্ত বড়ো নিবিড় আনন্দের সহিত বুঝিলেন। কিন্তু মুখে কিছুই কহিলেন না। সমস্ত বাক্যই প্রকাশ করিবার নিমিত্তও নহে। প্রকাশ করিলেই যে, সব কিছু প্রকাশিত হয় এমনও নহে। বরঞ্চ এমন অনুভবের শরিক কখনো-কখনো হইতে হয় যাহা, অপ্রকাশিত রাখিলেই বড়বেশি প্রকাশিত হয়। বরং প্রকাশ করিলেই, সেই অনুভবকে যথার্থ মূল্য দেওয়া হয় না।

ধৃতিকান্ত বড়োই আশ্চর্যান্বিত বোধ করিতে লাগিলেন। রেশমি সম্বন্ধে এতকথা এমন করিয়া এ-জীবনে কখনোই তিনি ভাবেন নাই। কখনো যে, ভাবিবেন; তাহা ভাবেন নাই।

গাড়ির মধ্যে রেশমির বড়োকাছ ঘেঁসিয়া বসিয়া, তাহার মুখ নিঃসৃত ইত্বরের খুশবুর মধ্যে কুঁদ হইয়া বসিয়া ধৃতিকান্ত ভাবিতেছিলেন যে, বুঝিলেন তিনি সমস্ত কিছুই; কিন্তু বড়োই বিলম্বে বুঝিলেন।

কথায়-কথায় কখন যে, গাড়ি মোগলসরাইয়ের ব্রিজের উপর উঠিয়া আসিল কেহই খেয়াল করে নাই।

পাশ্ববর্তী রেলের ব্রিজের উপর দিয়া ঝমঝম শব্দে একটি যাত্রীবাহী গাড়ি চলিয়া যাইতেছিল।

রেশমি চালককে শুধাইল, ই কওসি গাড়ি যা রহি হ্যায়?

চালক কহিল, দেল্লি-কালকা’ মেল। কলকাত্তা যা রহি হ্যায়।

ধৃতিকান্ত সেই আলোকিত কামরাগুলির প্রতি হঠাৎ মুখ ফিরাইলেন।

অকস্মাৎ-ই তিনি অন্যমনস্ক হইয়া পড়িলেন।

পাঠক! আপনি কি জানেন? কলিকাতা বারাণসী হইতে কতদূর?

আপনি তাহা যদি না জানেন, তাহা হইলে আমি বলি, বারাণসী হইতে কলিকাতা যত দূর, কলিকাতা হইতে বারাণসী ঠিক ততটাই দূর।

–ততটাই দূর!

ধৃতিকান্ত একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন। কলকাতার গাড়ি আলো জ্বালাইয়া, বাঁশি বাজাইয়া ঝমঝম শব্দে তাঁহার সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রে ‘ঝমঝম’ আওয়াজ তুলিয়া মিলাইয়া গেল।

ধৃতিকান্তর নাসারন্ধ্র বকুল ফুলের গন্ধে ভরিয়া উঠিল।

হঠাৎ ধৃতিকান্ত রেশমিকে কহিলেন, তুমি একদিন বলেছিলে, তুমি আমার আগে মরে গেলএ তোমার কবরে আমি যেন, রোজ লাল গোলাপ দিই। কিন্তু তোমার আগে আমি মরে গেলে কী ফুল দেবে; তা তো কখনো শুধোওনি তুমি।

পরক্ষণেই কহিলেন, শুধোবে না?

রেশমি বহুক্ষণ ধৃতিকান্তর চক্ষে চাহিয়া রহিল।

অনেক–অনেকক্ষণ পর কহিল, আমি জানি, তাই কখনো জিজ্ঞেস করিনি।

মোগলসরাই ব্রিজ হইতে নামিয়া বাম দিকে ফিরিয়াই গাড়ি দ্রুত বারাণসীর পথে ছুটিয়া চলিল।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ