চবুতরা – উপন্যাস- বুদ্ধদেব গুহ

অদ্য মুসলমানদিগের কোনো তেওহার হইবে।

দলে দলে তাহারা কুর্তা-পাজামা পরিধান করিয়া পদব্রজে, রিকশায়, সাইকেল-রিকশায় ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কসের দিকে চলিয়াছে। তাহাদের কলকন্ঠে, সাইকেলের টুং-টাং ঘণ্টা-ধ্বনিতে সামনের পথটি মুখরিত। যেইরূপ শব্দ ভাসিয়া আসিতেছে, তদ্রূপ ধুলা।

গতকল্য মহাধুমধামের সহিত দশেরা উৎসব সম্পাদিত হইয়াছে।

বর্ধমানের মহারাজার অধুনা-জীর্ণ ও প্রায় নিষ্প্রদীপ বিশাল প্রাসাদের গাত্র-ঘেঁষিয়া একাদশীর চন্দ্রটিও ভীরু লজ্জাবতী দ্বিধাগ্রস্ত বালিকার ন্যায় সবেমাত্র উঁকি দিয়াছে। পথের গন্ডগোল সত্ত্বেও এই ভগ্নপ্রায় পুরাতন গৃহের দ্বিতলের বহুথামবিশিষ্ট প্রশস্ত বারান্দায় কী এক বিষণ্ণ নিথর নিস্তব্ধতা বিরাজ করিতেছে। গৃহে এক্ষণে কেহই উপস্থিত নাই। মুরতেজা পর্যন্ত তেওহার উপলক্ষে ছুটি লইয়া চলিয়া গিয়াছে। বারান্দার এককোণে অপুষ্ট একটি শ্বেত মার্জার নিজেকে সম্পূর্ণ গুটাইয়া গোলাকৃতি করিয়া একটি পাপোশের উপর ঘুমাইয়া রহিয়াছে। ধৃতিকান্তর ন্যায় এই মার্জারটিও এমন-ই একটি বয়সে আসিয়া পৌঁছিয়াছে যে, যেখানে পৌঁছাইলে সংসারে আর কাহারও নিকট হইতে কিছুই প্রত্যাশার থাকে না।

ধৃতিকান্তও এই মার্জারটির ন্যায় আরামকেদারাতে হেলান দিয়া ফুটি-ফুটি চন্দ্রালোকলিপ্ত আকাশপানে চাহিয়া আছেন। তাঁহার দৃষ্টি কোনো বস্তুবিশেষে নিবদ্ধ নাই। এই দৃষ্টি সুপ্ত রাতের স্মৃতিচারণের দৃষ্টি। যে-দৃষ্টি মেলিয়া কোনো নিঃসঙ্গ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা একা চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারেন এবং থাকেন।

মার্জারটি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। হাই তুলিল। দক্ষিণ হস্ত দক্ষিণ কর্ণের নিকট তুলিয়া লইয়া কিছুক্ষণ মৃদু খসখস আওয়াজে কান চুলকাইল। তাহার পর আবার ঘুমাইয়া পড়িল।

ধৃতিকান্তরও ঘুম-ঘুম পাইতেছিল। যেন তাঁহার গাত্রোত্থান করিবার সময় হইয়াছে। কিছুক্ষণ পর-ই রথযাত্রা চৌমহনী পার হইয়া গোধূলিয়ার মোড় অতিক্রম করিয়া চওকের পথ ধরিয়া তিনি সেই ঠাণ্ডাই-এর দোকানে গিয়া দাঁড়াইবেন। তিলের নাড়ুর আকৃতির একটি ভাঙের গুলিসহযোগে একগ্লাস বাদাম-পেস্তার শরবত সেবন করিবেন। এবং তাহার পর তাঁহার দুই যুগ পূর্বের অতিপরিচিত এক তাম্বুলওয়ালার দোকান হইতে প্রায় বিবর্ণ চার খিলি মঘাই তাম্বুল, গিলা-সুপারি ও খুশবুভরা পিলাপাত্তি জর্দাসহযোগে মুখে পুরিয়ে হাঁটিতে হাঁটিতে অথবা টলিতে টলিতে আবার গৃহাভিমুখে ফিরিয়া আসিবেন।

দাঁত দুই-একটি পড়িয়াছে, অন্যগুলি নোটিশ দিয়াছে; তাই ইদানীং গিলা-সুপারি ব্যতীত পান খাওয়া সম্ভব হয় না ধৃতিকান্তর।

তিনি এমন-ই এক শারীরিক অবস্থায় রেশমির নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন যে, সে অবস্থাতে ডাক্তারেরা শয্যাত্যাগ করিতে পর্যন্ত নিষেধ করেন।

এ সংসারে আপনার বলিতে ধৃতিকান্তর কেহই অবশিষ্ট নাই। শারীরিকভাবে অনেকেই আছেন। কিন্তু তাঁহাদের কাহারও সহিতই আর আত্মিক কোনো যোগাযোগ নাই। সেই অর্থে রক্তসূত্রে বা ব্যাবহারিক সূত্রেও আত্মীয় বলিতে আজ আর তাঁহার কেহই নাই।

রেশমির কাছে আসিয়া ভালো করিয়াছেন কী মন্দ করিয়াছেন তিনি জানেন না। এইটুকু জানিয়াই খুশি আছেন যে, রেশমি সত্যই আনন্দিত হইয়াছে। তাঁহার দর্শন লভিয়া বা সঙ্গ পাইয়া যে, কেহ আনন্দিত হইতে পারে এই বিশ্বাস আজ আর তাঁহার নাই। যাহা বিশ্বাসের বাহিরে, তাহা সত্য বলিয়া জানিয়া জীবনের অন্তিম সময়ে বড়োই আনন্দলাভ করিয়াছেন ধৃতিকান্ত।

কিন্তু অদ্য গৃহে ফিরিয়াই বা কী হইবে?

অদ্য রেশমি নাই। মির্জাপুরে তাহার বহুপুরাতন এক বান্ধবীর অসুস্থতার সংবাদ পাইয়া সে চলিয়া গিয়াছে। মোটরগাড়িতেই রওয়ানা হইয়াছে প্রত্যুষে।

এযুগে সেইসব বিচিত্র ‘ঝমঝম’ শব্দের ঘোড়ার গাড়ির আর কদর নাই। সেইসব অশ্বকুলের বেশিই মরিয়া গিয়াছে, কেহ কেহ পিঁজরাপোলে, কেহ বা ভাড়ার টাঙা টানিতেছে।

ধৃতিকান্তর হঠাৎ-ই মনে হইল যে, কিছুই আর নাই। সেই শরীর নাই, সেই কামনা নাই, সেই ঐশ্বর্য নাই, সেই তীব্র ভালোবাসা নাই। সেযুগের সেই ধৃতিকান্তর আজ আর কিছুমাত্রই অবশিষ্ট নাই।

তবুও রেশমিকে এখনও কচি-কদাচিৎ মুজরায় বাহির হইতে হয়।

যে চিকন পক্ষীর স্বরে একদিন বসন্তের সকালের আমেজ লাগিত, সেই স্বরে আজ শীতের ধোঁয়াশার অস্পষ্টতা। তবুও বিন্ধ্য পাহাড়ের উপর বাদামি চিকারা হরিণের পালের ন্যায় পায়ে পায়ে ধুলা উড়াইয়া প্রেম-প্রেম খেলা, অবশ অভ্যাস, কৃতজ্ঞতাবোধ সব মিলিয়া-মিশিয়া এখনও ক্কচিৎ-কদাচিৎ রেশমিকে পা মুড়িয়া বসিয়া কানের উপর হাত চাপিয়া দিয়া গান গাহিতেই হয়।

সারেঙ্গির ছড় আজিও কাঁদিয়া কত কী কহে।

পুরাতন সারেঙ্গিওয়ালা আসগর তাহার নীল চোখ, তীক্ষ্ণনাসা ও মেহেন্দি-রাঙানো শ্মশ্রুসমেত কবে কবরে চলিয়া গিয়াছে। তাহার ভাতিজা মুনাঝর-ই আজকাল সারেঙ্গিবাদক।

মুনাব্বরের কবজিতে জোর আছে–আওয়াজ ভোরের আলোর ন্যায় স্পষ্ট, কিন্তু আসগরের মধ্যে হৃদয়ের সঙ্গে সারেঙ্গির ছড়ের যে, যোগসূত্রটি ছিল তাহা ধৃতিকান্ত মুনাব্বরের মধ্যে দেখিতে পান নাই।

ইদানীংকার এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের অনেক কিছুই গুণাবলি আছে যাহা ধৃতিকান্তদের কখনো কুক্ষিগত ছিল না। কিন্তু ধৃতিকান্তর বারংবার-ই মনে হয় যে, তাঁহাদের প্রজন্মের স্ত্রী-পুরুষের মধ্যেও বহুকিছু গুণাবলি ছিল, যাহা এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে তিনি একেবারেই দেখেন না।

ধৃতিকান্ত অত্যন্ত ক্লান্তির সঙ্গে লক্ষ করিয়াছেন যে, ইহাদের যশের জন্য কাঙালপনা আছে, জীবনে তামসিক, জাগতিক ও রাজসিক সব কিছুকেই মুষ্টিবদ্ধ ও কুক্ষিগত করিবার তীব্র বাসনা আছে, কিন্তু সেই বাসনার সুষ্ঠু পরিপূর্ণতা ও তাহাদের তাবৎ জাগতিক ও অজাগতিক প্রার্থনার পরিপ্লতির নিমিত্ত যে, সাধনা ও কৃচ্ছসাধনের প্রয়োজন, সেই ক্লেশ স্বীকার করিবার মনোবৃত্তি বা অবকাশ তাহাদের আদৌ নাই।

তাহারা বিনা-মহড়াতেই মঞ্চে উপস্থিত হইয়া বাজিমাত করিতে বদ্ধপরিকর। বিনা পরিশ্রমে সচ্ছল হইতে অতি-আগ্রহী। ভোগের আনন্দর প্রকৃত রসাস্বাদনের নিমিত্ত যে, পূর্ববর্তীকালীন ত্যাগের প্রয়োজন তাহাতে তাহারা সম্পূর্ণ বিমুখ। তাই তাহাদের মানসিক কাঠামোগুলি বড়োই নড়বড়ে বলিয়া প্রতীয়মান হইয়াছে তাঁহার চক্ষে। অনবধানে ঠেলা মারিলেই সেই কাঠামো, ইহাদের চারিত্রিক কাঠামো যেন রামলীলার রাবণের প্রজ্বলিত মূর্তির ন্যায় মড়মড় শব্দে খসিয়া পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে আলো নিবিয়া যায়, অন্ধকার ছাইয়া ফেলে, নাসিকা ধূম্র ও ভস্মর কটুগন্ধে ভরিয়া উঠে।

ধৃতিকান্ত ঠিক জানেন না।

হয়তো তিনি ভুল।

হয়তো জীবনের চবুতরার শেষ সীমানায় পৌঁছাইয়া যৌবনকে অথবা যৌবনের যা-কিছু সুন্দর, সাবলীল, অনায়াসলব্ধ ধর্ম তাহাকেই অবজ্ঞা করিবার, তাচ্ছিল্য করিবার একটা স্বাভাবিক নীচ অথবা অন্যায় প্রবৃত্তি তাঁহার মধ্যে উদিত হইয়াছে।

এইসব যোগাযোগহীন পরম্পরা বিবর্জিত নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে ধৃতিকান্তর মুখে এক আশ্চর্য হাসি ফুটিয়া উঠিল। এইরূপ হাসি বুঝি অভিজ্ঞ, মূলত সৎ ও সরল মনুষ্যের অধরেই ফোটে।

এইপ্রকার অকারণ হাসির মাধ্যমে পৃতিকান্তর ন্যায় সাধারণ রক্তমাংসর মানুষ-ই অন্যকে ক্ষমা করিয়া নিজের শত্রু-মিত্র বন্ধু-পরিজন সকলের সব নীচতা, ইতরতা নিঃশর্তে ক্ষমা করিয়া নিজের অজ্ঞাতেই নিজের পারিপার্শ্বিকের আবিল আবহাওয়া হইতে নিজেকে এক অনাবিল ঐশ্বরিক স্নিগ্ধ মমতায় অভিষিক্ত করিতে সক্ষম হন।

তেওহারের শারদসন্ধ্যায় বিষণ্ণ বিরক্ত ইদানীং নিস্পৃহ ধৃতিকান্তর মুখমন্ডলের কার্নিশে সেই ক্কচিৎ দেবদুর্লভ হাসি অনেকক্ষণ ধরিয়া একাদশীর চন্দ্রের ন্যায় ঝুলিয়া রহিল।

.

০২.

রেশমি বাইজিকে কবে প্রথম ধৃতিকান্ত দেখিয়াছিলেন আজ তাহা মনে পড়ে না।

সন, তারিখ ইত্যাদি আর কিছুই মনে নাই, মনে আছে শুধুই ক্ষণটি। চুনারের দুর্গে দাঁড়াইয়া যাঁহারা গঙ্গামাইয়ের দুর্গ-নিম্নবর্তী শান্ত, বক্র, বড়ো উদাস রূপটি প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ কখনো পাইয়াছেন, তাঁহারা সকলেই দূর বিন্ধ্যপর্বতশ্রেণির শীর্ষে একটি ভগ্নপ্রায় ডাকবাংলা দেখিয়া থাকিবেন। দুর্গের পথপ্রদর্শক পাঠককে নিশ্চয় ইহাও বলিয়া থাকিবে যে, ওই বাংলা কোনো নৃপতির ছিল। নৃপতি যখন মৃগয়ায় আসিতেন তখন ওই বাংলায় উঠিতেন। তৎকালে ওই দুর্গ ও দুর্গ-পাশ্ববর্তী সমস্ত অঞ্চলসমূহ ও বিন্ধ্যপর্বতশ্রেণি ঘন অরণ্যানী পরিবেষ্টিত ছিল। তৎকাল বলিতে পাঠক কী বুঝিলেন জানি না। কিন্তু ধৃতিকান্ত যে-সময়ের কথা ভাবিতেছিলেন তাহা অদ্য হইতে কমপক্ষে ত্রিশ বৎসর পূর্বেকার কথা।

সেই রাত্রি, সেই ক্ষণটি ধৃতিকান্তর মনে আমৃত্যু বাঁচিয়া থাকিবে।

কৈশোরের টাটু ঘোড়া যখন পুরুষের শরীরের সকল অস্বস্তি লইয়া মুখের গুটিকয় সেই অস্বস্তির সিলমোহর মোহরাঙ্কিত করিয়া বাহককে মধ্য-যৌবনের তেজোময় বল্গাহীন শ্বেত অশ্বে স্থানান্তরিত করিয়া নিষ্কৃতি পায় সেই যমাদমি মুহূর্তের বেশ কিছুকাল পর ধৃতিকান্তর সহিত রেশমির প্রথম সাক্ষাৎকার।

পূর্ণিমার রজনি। আদিগন্ত গঙ্গামাইর সর্পিল মসৃণ শরীর চন্দ্রালোকে চিক চিক করিতেছিল। দিবাবসানে মৃগয়া সাঙ্গ করিয়া একটি শ্বেত ‘ওয়েলার’ অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হইয়া ঢিলা বলগা হস্তে ধৃতিকান্ত ধীরে ধীরে তাঁহার আবাল্য বন্ধুর সেই বাংলাভিমুখে ফিরিতেছিলেন। নিম্নে প্রবাহিত গঙ্গামাইয়ের অপরূপ শোভা আর সুনীল আকাশের পটভূমিতে দর্পভরা চুনার দুর্গের অন্ধকার ছায়া ধৃতিকান্তর চক্ষে এক আশ্চর্য সৌন্দর্য-ছবি রচনা করিয়াছিল।

এমন সময় হঠাৎ, একেবারেই হঠাৎ সেই বাংলা হইতে নারীকন্ঠের সুর সারেঙ্গির আওয়াজ, তবলা ও ঘুঙুরের আওয়াজের সহিত মিশ্রিত হইয়া ধৃতিকান্তর কর্ণে প্রবেশ করিল।

কোনো চিকনকন্ঠী তওয়ায়েফের সুরেলা মাজা আওয়াজ সেই চন্দ্রালোকিত সান্ধ্য প্রকৃতিকে কী এক ঐশ্বরিক আনন্দে ভরিয়া দিতেছিল।

তওয়ায়েফের গলা, তম্বুরার আওয়াজ, জোড়া সারেঙ্গির সুরে দূর হইতে হোরি ধামারের বটি আর ঢোঁড়ন আর মোড়ন আর লচাও ধৃতিকান্তর সমস্ত সত্তা আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল।

অদেখা তওয়ায়েফের গলার সুর পুরাপুরি কায়েম ছিল আর তারসঙ্গে ছিল ঘষা-মাজা বাঢ়ত-বহলাওবার পারিপাট্য।

সেই নির্জন নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় বিন্ধ্যপর্বতশ্রেণির অরণ্যানী গঙ্গামাইয়ের লচক, সমস্ত মিলিয়া তওয়ায়েফের বিলমপদ আস্তাইতে ধৃতিকান্তকে ফিরদৌসি ইত্বরের খুশভরা এক ধ্যানমগ্নতায় নিমগ্ন করিয়া ফেলিল।

কখন যে, সহিসের হস্তে বলগা সমর্পণ করিয়া বন্দুক-বাহকের হস্তে ভারী দোনলা রাইফেল তুলিয়া দিয়া ধৃতিকান্ত ম্যায়ফিলে প্রবেশ করিলেন, তাঁহার হুঁশ ছিল না। কখন যে, শিকারের পোশাক-পরিহিত অবস্থাতেই তিনি ম্যায়ফিলের তাকিয়ায় হেলান দিয়া বসিয়া পড়িয়াছিলেন তাহাও ধৃতিকান্তর স্মরণ নাই।

ধৃতিকান্ত সবেমাত্র আসন লইয়াছেন, এমন সময়ে তওয়ায়েফ এক নূতন তির ছুড়িলেন।

সেই তিরের আন্দাজ আর চমকে ধৃতিকান্ত তিরবিদ্ধ শিঙাল হরিণের ন্যায় অবশ হইয়া জাজিমের একপার্শ্বে অর্ধশায়ীন অবস্থায় তাকিয়ায় মুখ খুঁজিয়া পড়িয়া রহিলেন।

তওয়ায়েফ হঠাৎ দাঁড়াইয়া উঠিয়া বিদ্যুৎচমকের ন্যায় নাচিয়া একখানি দরবারি রাগের তেরাণা গাহিয়া ম্যায়ফিলে সকলকে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ ও চমৎকৃত করিয়া ফেলিল। সেই গান ও নাচের চমক সেই বিজলির খেলে, সেই বাইজির জাদুকরীর ন্যায় অঙ্গ-ভঙ্গিমায় ম্যায়ফিলের তাবৎ মুর্দা-দিল আদমিদের মুহূর্তমধ্যে জিন্দা-দিল আদমিতে রূপান্তরিত করিয়া দিল।

যখন গান থামিল তখন রাত কত কেহই জানেন না।

ম্যায়ফিল নিস্তব্ধ হইলে ধৃতিকান্ত বলিয়া উঠিলেন, সব ঝুট হ্যায়।

তওয়ায়েফ এতাবৎকাল দীর্ঘকায় অত্যন্ত সুদর্শন ধৃতিকান্তর ম্যায়ফিলে উপস্থিতি তেমন করিয়া লক্ষ করে নাই, কারণ সে বড়ো সুন্দর এক গভীরতার সাধনায় লিপ্ত ছিল।

‘সব ঝুট হ্যায়’–বাক্যটিতে ম্যায়ফিলে উপস্থিত প্রত্যেকে একইসঙ্গে ধৃতিকান্তর পানে চাহিলেন।

ধৃতিকান্ত কাহারও দিকে দৃকপাত না করিয়া তওয়ায়েফের কুঞ্চিত যুগল- ও সুরমাচৰ্চিত চক্ষু লক্ষ্য করিয়া আবার বলিলেন, সব ঝুট হ্যায়।

নবীনা তওয়ায়েফের পার্শ্বে উপবিষ্ট তাহার মাতা তাহার বিস্মিত বিব্রত অভিজ্ঞ চোখ মেলিয়া বাম হস্তের তর্জনী দ্বারা বাম গন্ডে আঘাত করিয়া বলিলেন, ঝুট হ্যায়?

কিঞ্চিকাল পর আবারও কহিলেন, ক্যা ঝুট হ্যায়?

বিন্ধ্যপর্বতোপরি সেই বাংলার অধীশ্বরও আবাল্য বন্ধুকে উদ্দেশ করিয়া কৌতুক ও বিস্ময়ের চক্ষে ধৃতিকান্তকে শুধাইলেনঃ ঝুট ক্যা হ্যায় ইয়ার? ইয়ে গানা ঝুট হ্যায় ক্যা তেরি খোয়ব ঝুট হ্যায়; না ইয়ে হুসন ঝুট হ্যায়?

ম্যায়ফিলে উপস্থিত প্রত্যেকের অধরপ্রান্তে হাসির রেখা ফুটিল।

ধৃতিকান্ত কহিলেন, তাহা নহে। যে উর্দুশায়ের আমি এতাবৎকাল সত্য বলিয়া জানিতাম, তাহা আজ মিথ্যা বলিয়া প্রতিপন্ন হইল।

দোস্ত বলিলেন, শুনাও তো সাহি!

ধৃতিকান্ত আবৃত্তি করিলেন:

মাশুম নজরকা ভোলা পন
উও দিল লুভানা ক্যা জানে?
যো খুদ নিশানা বনতি হ্যায়
উও তির চালানা ক্যা জানে?

অর্থাৎ যাহাদের মন কাড়িবার নিমিত্ত পুরুষরা সদাই ব্যস্ত, তাহারা পুরুষের হৃদয় কাড়িবার কীই বা জানে? যাহারা নিজেরাই লক্ষ্য, তাহারা শর সন্ধানের কী জানিবে?

‘উমদা, উমদা। ওয়াহ; ওয়াহ’ ইত্যাদি ধ্বনি উঠিল চতুর্দিক হইতে।

রেশমি তওয়ায়েফ ঘাড় কুঁকাইয়া ধৃতিকান্তর রসবোধের প্রতি কুর্নিশ জানাইয়া, রসিককে নজরানা দিলেন।

এই সময়ে ধৃতিকান্তর বন্ধু কহিলেন, তুম ভি কুছ শুনাও ইয়ার। গানা কুছ তো শুনাও।

পানপাত্র হস্তে রাখিয়া হাসিয়া হাসিয়া কহিলেন। আসর এতক্ষণ নারীসুলভ বসন্তের নরম আমেজে মাখামাখি হইয়াছিল। এক্ষণে পুরুষসুলভ বর্ষার ঘনঘটা কিছু তো আমদানি করো বন্ধু।

ধৃতিকান্ত মস্তক নীচু করিয়া বসিয়া রহিলেন। নিরুত্তর। কিয়ৎক্ষণ পর হঠাৎ রেশমি বাইজিকে উদ্দেশ করিয়া ধৃতিকান্ত কহিলেন, ম্যায় ঔর কিসিকো ইলতিমাস না মানুঙ্গা, না কিসিকি কাতর করুঙ্গা, মগর সিফ আপ ইলতিমাস করেঙ্গে ঔর ফরাময়েঙ্গে ত মৈ’ গানে বৈঠঙ্গে।

অর্থাৎ, অন্য কারও অনুরোধেই আমি গাহিব না, আর কাহাকেও খাতির করিব না, শুধু আপনাকেই, হে সুন্দরী, সুগন্ধি সুতনুকা গায়িকা, শুধু আপনার-ই অনুরোধে, আপনার-ই আদেশে, আমি গাহিতে পারি।

রেশমি বাইজি তখন সপ্তদশী। সেই বয়সেই সে, বহুমুজরা লইয়াছে, বহুমাল্য পাইয়াছে, বহুরহিস পুরুষের চিত্ত জয় করিয়াছে–কিন্তু সেই কৃষ্ণসার হরিণীর মতো চঞ্চলা, আসকলপক্ষীর ন্যায় স্তন্যসম্পন্না ও কোকিলকণ্ঠী কৃষ্ণকলি গানেওয়ালি নাচনেওয়ালির সেই সপ্তদশী জীবনে এতবড়ো সম্মান, এমন সরল আন্তরিকতার সঙ্গে আর কখনো তাহার কস্তুরীসম হৃদয়ে বর্ষিত হয় নাই।

পাঠক! ‘প্রেম’ চিনিয়া লইতে পুরুষের প্রায়শই ভুল হয়, কিন্তু নারীর হয় না। মোহ, কাম ও প্রেমের মধ্যে যে, সূক্ষ্ম পার্থক্য তাহা নারীরা যেমন করিয়া বোঝে, তেমন করিয়া কোনো মূর্খ পুরুষ কখনোই বুঝিবে না।

রেশমি বহুক্ষণ ধৃতিকান্তর সুন্দর সুপুরুষ মুখাবয়বে চাহিয়া বলিয়াছিল। আজ মুঝকো আপনে বড়ি ইজ্জত দিয়ে হে।

ধৃতিকান্ত আপন কোলের উপর তানপুরা টানিয়া লইয়াছিলেন। একপার্শ্বে আসগর মিয়া, অন্যপার্শ্বে আমজাদ সারেঙ্গি লইয়া প্রস্তুত। তবলচি রেহমানও তবলা বাঁধিয়া লইল।

তওয়ায়েফের সাথ-সঙ্গীরাই সংগত করিবে। কিন্তু এইস্থলে ধৃতিকান্ত তো গান গাহিতে আসেন নাই, আসিয়াছিলেন মৃগয়ায়। মৃগয়ায় আসিয়া এমন নিপুণ শিকারির হাতে যে, নিঃশেষে শিকার হইবেন, তাহা তিনি একবারও ভাবেন নাই।

ধৃতিকান্তর এত বৎসর পরও সেই সন্ধ্যায় গীত কলি কয়টির কথা ঘুরিয়া ফিরিয়া মনে পড়ে। এমন করিয়া, এ জীবনে ধৃতিকান্ত আর কখনো সমস্ত হৃদয় ঢালিয়া গাহিতে পারেন নাই। জীবনের যে, সামান্য ফালিটি অবশিষ্ট আছে, তাহাতে তেমন করিয়া গাহিবার সম্ভাবনাও আর দেখেন না।

সেই কলিটি রেশমি বাইজির হয়তো আরও বেশি করিয়া মনে পড়ে। রেশমিই জানে।

ধৃতিকান্ত গাহিয়াছিলেনঃ

ইস ইশককে মখতমে মিলতা হ্যায় সবখ পহলে
গর বসলকি খুবায়িশ হো তো হসতিকো ফনা কর না।

অর্থাৎ পেয়ারের পাঠশালার প্রথম যে পাঠ সে পাঠ এই-ই। যদি মিলন-পিয়াসী হইয়া থাকো যদি প্রত্যাশা করো সত্য মিলনের; তবে তোমার ‘আপন’ বলিতে যা কিছু তোমার, আপনার সমস্ত মমত্ব, আপনার প্রতি সব ভালোবাসা, অহং সমস্ত কিছু ধুলায় ফেলিতে হইবে। মিটাইয়া দিয়া সবকিছু নিশ্চিহ্ন করিতে হইবে।

এই-ই প্রেমের সর্বপ্রথম পাঠ।

.

সেই চন্দ্রালোকিত যৌবনমন্ডিত ইত্বরগন্ধি রাত্রিতে, যে-গান ধৃতিকান্ত গাহিয়াছিলেন তাহার স্বর–বড়োই খুশবুভরা, সুরখোয়াবি সাচ্চা স্বর।

পাঠক! প্রেমের স্বর তো চিরদিন-ই সাচ্চাই হইয়া থাকে। সাচ্চাইয়ের পুরস্কার তো সাচ্চাইতেই মিটে, আর ঝুটাই-এর পুরস্কার ঝুটাইতে।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ