আমুর ডায়েরি-৩

বিকেলে মন্দিরাদের বাড়ি কড়াইশুটির কচুরি খেয়ে রাতে মালুদের বাড়িতে ডিনার খাওয়ার জায়গা ছিল না আর।

এখন রাত। অনেক রাত। বিকেলে ওরা সকলে মহিলার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করল কি না, কে জানে! মেয়েরা যখন কর্কশ হতে চায়, তখন পুরুষদের চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে।

বাইরে নানারকম গন্ধ। কাঁঠালের মুচির গন্ধ। আমের বোলের গন্ধ এখনও আসেনি হাওয়ায়। নানা ফুলের গন্ধের সঙ্গে মিশে গেছে মুচির গন্ধ। হরজাই ফুল। গাছপালা ঝাউ। তাদের গন্ধ।

বাইরে বারান্দাতে এতক্ষণ আলো নিভিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু ঘর-বারান্দার আলো নিভেলে কী হয়, গোলমুড়ি ক্লাবের আলো ঝলমল ক্লাব হাউস স্বপ্নপুরীর মতো চোখের সামনে জেগে থেকে স্বপ্ন দেখতে দেয় না।

আমি তো একজন সামান্য কবি। আমার সামান্যতার মাপ আমি ভালো করেই জানি। কবিদের অনেক-ই কষ্ট। গদ্য লেখকদের মতো প্রাপ্তিযোগ তাদের ঘটে না। জনপ্রিয়তাও তাঁদের মতো নয়। মনে হয়, আনন্দবাজারেই একটি প্রতিবেদনে একবার পড়েছিল, গদ্য লেখকের জনপ্রিয়তা অনেকটা ফুটবলারদের-ই মতো। অটোগ্রাফ-শিকারিরা তাঁদের হেঁকে ধরেন। ক্বচিৎ কিন্তু গভীর, অন্তর্মুখী পাঠক বা পাঠিকা খুঁজে খুঁজে একা কবিকে যখন, খুঁজে বের করেন ভিড়ের মধ্যে থেকে তখন, খাতাখানা বাড়িয়ে দিতেও তাঁর হাত কাঁপে। সই নিতে তো কাঁপেই। যেমন প্রকৃত কবি; তেমন-ই তাঁর প্রকৃত অনুরাগী।

আমি এখানে এসে যে, এতমানুষের ভালোবাসা, নিত্যসঙ্গ, সাহচর্য, আদরযত্ন পেলাম সেটা মানুষ হিসেবেই, কবি হিসেবে নয়। কিন্তু যে, আমিকে ওঁরা ভালোবাসলেন, সে-আমি তো আমার আসল আমি নই। আমার এই জ্বলজ্বলে মূর্তিটাই আমার আসল মূর্তি নয়। আমি বড়োদুঃখী। কবিমাত্রই দুঃখী। হয়তো দুঃখের কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বিলাস; কিন্তু অনেকটাই সত্যি। হয়তো প্রকৃত কবিমাত্রই জানেন যে, এই দুঃখের মধ্যে এক গভীর আনন্দও নিহিত থাকে। যিনি কবি, তাঁর পথ ভিড়ের পথের থেকে চিরদিন-ই আলাদা। যে-অমু ঘোষকে নীলডির মানুষেরা কাছ থেকে জানলেন, সেই অমু, কবি অমু নয়।

কিন্তু আমি এই নির্গুণ, নিরূপ অমু, এক মোটামুটি কবি, এখানে এবারে এসে, যা-পেলাম তার ঋণ শোধ করি এমন সাধ্য তো আমার নেই! জীবনের অনেক ঋণ-ই শোধ করা যায় না। তবু, স্বীকার’ তো করা যায়। যায় বলেই স্বীকার করি। অনেকে অবশ্য ঋণ ‘শিকার’ও করেন। আমি পারিনি। সবাই সব পারে না। সব ভালো, সব খারাপ।

শেয়া, শ্রমণা, জ্যোৎস্না, সোমা, পৃথা, ছবি এবং তোড়া। এবং আরও অসংখ্য মহিলারা বলেছেন, রোজ-ই বলছেন, কবি নাকি অনেক-ই তাঁরা দেখেছেন, আমার মতো মুখর কবি তাঁরা আর দেখেননি। এ-কথাটা আমার বাইরের আমিকে খুব-ই খুশি করেছে। সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার ভেতরের আমিকে করেনি। আমি বুঝে গেছি যে, আমার এই জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে যে, কবি হিসেবে, অন্তত বাংলা ভাষার কবি হিসেবে, আমি তত বড়ো নই। যাঁরা সত্যিই বড়ো, তাঁরা বাইরেও নির্জন; ভেতরেও নির্জন। এই নির্জনতার, নিঃসঙ্গতার বোবাকান্না থেকেই জন্ম নেয় ‘কবিতা। কবিতার মতো কবিতা।

তবু, যখন বড়োকবি হতে পারলাম-ই না, তখন এতমানুষের ভালোবাসাটা প্রত্যাখ্যান তো করতে পারি না। ভালোবাসাও তো একধরনের কবিতা। এখানের প্রত্যেক পুরুষ ও নারী, যাঁদের আমি কাছ থেকে দেখলাম, জানলাম, আমার প্রতি তাঁদের প্রত্যেকের ভালোবাসাও কবিতা। ভালোবাসার যেমন অনেক-ই রকম হয়, ভালোবাসার কবিতারও হয়।

আমি একথা জেনে বড়োশ্লাঘা বোধ করছি যে, আমার এই মানসম্মান, আদরযত্ন আমি বিত্তবান বা রূপবান বলে নয়। বিত্ত বা রূপ থাকলে এই ভালোবাসা হ্যাঁণ্ডিকাপে পাওয়া হত। তার মূল্য নেই কোনো। যা পেয়েছি তা যে, শুধু কবি-পরিচয়ের-ই জোরে এবং কবির মুখরতার জোরে এইটে ভেবেই বড়োভালো লাগছে।

আমি আজকে ভীষণ-ই খুশি। যেমন জামশেদপুরের জন্যে, এক শেষরাতে মন বড়ো উচাটন হয়েছিল বলে, রানিকেও না-বলে কয়ে চলে এসেছিলাম, তেমন-ই কাউকেই–বলে আমি কাল ভোরের ট্রেন ধরে ফিরে যাচ্ছি। কলকাতা। কী যেন নাম ট্রেনটার? স্টিল না ইস্পাত? গুলিয়ে যায় আমার।

আজ শেষবিকেলে টেলকো বাজারে পান খাওয়ার অছিলায় একবার গিয়ে ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে কথাও বলে রেখেছি। অ্যাডভান্সও দিয়ে এসেছি। সে আসবে ঠিক সকাল পাঁচটাতে। তখনও অন্ধকার থাকবে।

হঠাৎ-আসার-ই মতো হঠাৎ-যাওয়াতেও একরকম মজা আছে। কষ্টও আছে। নিখাদ মজা বা নিখাদ কষ্ট বলে তো কিছু নেই। সব-ই মিলেমিশে আছে, থাকে। সবকিছুর-ই মধ্যে।

তা ছাড়া আমাকে পালাতে হবে অগ্নিশিখার-ই জন্যে। আমি নিজেকে বুঝি। নইলে আরও দিনসাতেক এঁদের সকলের অতিথি হয়ে স্বচ্ছন্দেই থেকে যেতে পারতাম।

নির্জন ‘হু হু’ হাওয়া সমুদ্র পারের সি-গাল-এর বিধুর চমকানো ডাকের মতে, শীতের পড়ন্ত বেলায় ঝটি জঙ্গলের মধ্যে কালি তিতিরের উত্তেজিত ‘চিঁহা চিহা’ রবের তীব্র বিষণ্ণতার মতো কৃষ্ণপক্ষর মধ্যরাতের নিথর সবুজাভ তারাদের রহস্যের গাঢ় বেদনার মতো আমার মন নিশ্চিত সুখের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েই আজ করজোড়ে ছুটি চাইছে। ভালোবাসাবাসি ভালো; সমুদ্রের ঢেউ, জলের মধ্যে দাঁড়ানো কবির বুকের সামনে সেই, ঢেউ-এর নেচে যাওয়াও ভালো, ফুলের গন্ধ ভালো, পাখির ডাক ভালো, সব-ই ভালো; কারণ তারা এসে, প্রত্যেকেই ফিরে যায় বলেই। কোনো সৌন্দর্যই পুরোনো হলে আর সৌন্দর্য থাকে না। জাপানি ক্যালেণ্ডার বা নতুন শাড়ি ও পারফিউমের গন্ধভরা নতুন বউদির ই মতো। নীলডির মানুষেরা, তোমাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা গভীর থাকতে থাকতে আমি নেচে-যাওয়া ঢেউ-এর মতোই সরে যেতে চাই। আর কখনোই আসব না।

অমু ঘোষের মধ্যে যেমন, একজন পুরোপুরি কবি বাস করে, বাস করে একজন অকবিও! যে-বিদূষকের মতো মানুষকে হাসায়, যার মধ্যে কোনো আভিজাত্য নেই, যে-রিকশাওয়ালা থেকে সালদানা সায়েব, সকলের সঙ্গেই একমুহূর্তে বন্ধুত্ব করতে পারে; সকলকেই তার হৃদয়ের আসনে একাসনে বসায় নির্দ্বিধায়। সে কবি নয়। কবিরা মুখচোরা, লাজুক স্বভাবের হয়।

মুখর কবিদের মুখরতাও নীরব হওয়ার-ই জন্যে।

আমি অমু ঘোষ, ভালো কবি নই। কিন্তু ভালোমানুষ। আমি জানি, অগ্নিশিখা আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। হয়তো আরও কেউ কেউ বেসেছে। এক একজনের ভালোবাসার ভিন্ন ভিন্ন ধরন। কিন্তু অগ্নিশিখার ভালোবাসাটা অন্য কারো ভালোবাসার মতো নয়। দুর্বারও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে ভালোবাসা, সম্পূর্ণতার জন্যে উভয় পক্ষের কারণেই স্বীকৃতির গন্তব্যে পৌঁছোবে বলে পরিপ্লতি খোঁজে। অগ্নিশিখার কোরকের সুগন্ধি-স্নিগ্ধতা আমি সঙ্গে করে নিয়ে ফিরে যেতে পারি। কিন্তু অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করবে নিজেকে, যে-আগুনে সেই আগুনের তাপ থেকে তাকে এই নির্মোহ মুখর কবিই একমাত্র বাঁচাতে পারে। এই মুহূর্তে দূরে সরে গিয়ে।

দুর্বার খুব-ই ভালো ছেলে। চমৎকার তাদের একমাত্র সন্তান। শান্ত। অগ্নিশিখার ভালোবাসা আমি পেয়েছি। আমার ঠোঁটে এখনও তার সিক্ত ঠোঁটের সিক্ততা সিরসির করছে। নাকে পাচ্ছি তার স্তনসন্ধির পাউডারের গন্ধ, স্নিগ্ধতার ঘ্রাণ। তার চোখের পাতায় যখন, চুমু খেয়েছিল অমু ঘোষ তখন অগ্নিশিখার চোখের পাতার নীচের মণি আর কণীনিকাও তার ঠোঁটের পরশের জন্যে তিরতির করে কাঁপছিল। চাঁদের রাতে নির্জন পথে হাঁটার সময়, ওর হাতের পাতার পিঠে চুমু খাওয়াতে অগ্নিশিখা বলেছিল, অস্ফুটে ‘সাহেবদের মতো।

আমি, অমু ঘোষ, বলব, অশি, আমি সাহেবদের মতো নই; কবিদের মতো। জল্লাদের কাজ ফুলকে পিষ্ট করার। কবির কাজ ‘ফুল’কে ফোঁটানোর। অনেক-ই পেয়েছি আমি। অনেক-ই নিয়েছি।

এই স্তব্ধশীতের রাতে, ক্লাবের নাইটগার্ড আগুন জ্বালিয়ে তার কুকুরকে পায়ের কাছে নিয়ে বসে আছে। তোমার বাড়ি কাছে হলে আমি তোমার ঘরের বন্ধ জানলার সামনে গিয়ে এখন দাঁড়াতাম। চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ কল্পনায় তোমার কাছে থেকে ফিরে আসতাম। কিন্তু তোমাদের বাড়ি যে, অনেক-ই দূরে!

আমি জানি যে, তুমিও এইমুহূর্তে জেগে আছ। লেপের নীচে। দুর্বারের হাত তোমার কোমরে জড়ানো। তোমাকে আদর করার পর দুর্বার অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু তুমি তৃপ্ত হওনি। এই অতৃপ্তি তোমার নতুন। অশি, তোমার মধ্যে আমি এক নতুন অভাববোধ জাগিয়ে দিয়ে গেলাম। এই আমার দান। তোমাকে। যে-নারীর মনের মধ্যে কোনোরকম অভাববোধ নেই, তিনি শূকরীর মতো তৃপ্ত হয়ে নিঃশেষিত হয়ে গেছেন। তিনি নারী নন; যন্ত্র।

শুধু শারীরিক মিলনের তৃপ্তিটুকুই নয়, তোমার সমস্ত পরিবেশ, তোমার অস্তিত্ব, তোমার বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুকেই আমি আমার কবিতা লেখার আঙুলগুলি দিয়ে ছুঁয়ে গেলাম অশি। তোমাকে আরও অনেক কিছু, না দিয়ে তোমাকে দুঃখী করে গেলাম। তোমার ‘মানবী সত্তা’কে আমি জাগিয়ে গেলাম অগ্নিশিখা, যাতে তুমি জীবনে প্রকৃত অগ্নিশিখার-ই মতো নিভৃত, উজ্জ্বল নম্রতার নীরব আনন্দে ফুটে থাকো।

ভেবে দেখো, তোমাকে এর চেয়ে দামি আমি আর কীই বা দিতে পারতাম! তুমি যদি গান গাও তো এই দুঃখবোধ, তোমার মধ্যে এই অভাববোধ তোমাকে মস্তবড়ো গায়িকা করে তুলবে কোনোদিন। যদি ছবি আঁকো তুমি, তো ছবি আঁকতে বসে, তুমি আমার কথা ভাবতে ভাবতেই তুলি বোলাবে ইজেলে। তুলি হবে তোমার পাতলা ঠোঁট আর ইজেল হব আমি। নিরন্তর, অনাদিকাল ধরে আমরা পরস্পরকে কাছের, আরও কাছের করে পাব। এই পাওয়া, এই কাছে থাকাই তো আসল ঘনিষ্ঠতা। তাই-না?

আমি তোমাকে কোনোদিনও চিঠি লিখব না। তোমার নীরব চোখের প্রার্থনা মঞ্জুর-করা অথবা আমার-ই চুরি করে খাওয়া, চকিত চুমুর-ই মতো, আমার দু-হাতের পাতার মধ্যে তোমার হঠাৎ ভালো লাগায় শিশিরের মতো গলে যাওয়ার মতো, তোমার জীবনে আমি ক্ষণিকের স্মৃতি হয়ে থেকে যাব অশি। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে। যদি কোনো দুজ্ঞেয় কারণে আমাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলে থাকো তাহলে, সে-ভালোবাসাকে নিত্যতার, পৌনঃপুনিকতার পরশে দাম্পত্য সম্পর্কের মতো ব্যবহারে মলিন নিষ্প্রভ না করে, নির্মল চিরনতুন করে রেখো। আনন্দম! আনন্দম! আনন্দম!’

তুমিই একবার বলেছিলে, এবং এ-কথা অনেক মেয়েই বলে এখানের মালু, ছবি, পৃথা এরাও বলেছিল যে, যাকে ভালোবাসা যায় তাকে, ভুলেও বিয়ে করতে নেই। কথাটা মানি। আমি আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলব, যাকে ভালোবাসা যায়, তাকে বিয়ে না করলেও কখনোই তার সঙ্গে পূর্ণভাবে মিলিত হতে নেই। এটা মেয়েদের কাছে আরও বড়োব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-না? মায়ার খেলায়? ‘আশ মিটালে ফেরে না কেহ, আশ রাখিলে ফেরে।

পুরুষের আশ মিটে গেলে, পুরুষ তখন নবতর বিজয়ের খোঁজে বেরোয়। সব পুরুষই কবি নয় অমু ঘোষের মতো। আশ না মিটালেও অধিকাংশ পুরুষ, আশাভঙ্গ হয়ে অন্যত্র যায়। তারাও ফেরে না। পুরুষ জাতের চরিত্র তীক্ষ্ণ এবং পক্ষপাতহীনভাবে বিশ্লেষণ করেই আমার মনে হয় যে, আমাদের পূর্বসূরিরা যতখানি বাঁদর, তার চেয়েও বেশি কুকুর ছিলেন। অধিকাংশ পুরুষ-ই ভালোবাসার কিছুই বোঝে না অশি। অমু ঘোষ বোঝে। এবং বোঝে বলেই তুমি যখন, আজ ভোর-হয়-হয় শীতের রাতে তোমার স্বামীকে আলিঙ্গন করে শুয়ে থাকবে অভ্যাসবশে তোমার ওম-ধরা লেপের নীচে, আমি তখন রওনা হব স্টেশনের দিকে। তোমার জন্যে পৃথিবীর সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষা আর প্রীতি আর ভালোবাসা এই নীলডির আকাশ-বাতাসে আবিরের মতো ছড়িয়ে দিয়ে যাব, যাওয়ার সময়ে। এবারে হোলির দিনে সেই, আবির মাখামাখি করে হোলি খেলো তুমি!

দেখতে দেখতে শীত চলে যাবে। বসন্তের কোকিল যখন, কুহু কুহু করে ডাকবে তোমার বাগানে, আমের বনে যখন, মুকুল আসবে, তখন মনে পড়বে তোমার-আমার কথা। পড়বে, না? যখন গ্রীষ্মর প্রচন্ড দাবদাহে ঘুঘু সারাদুপুরে ‘ঘুঘুর র-র-র-ঘু–ঘুঘুরঘুউউ’ করে একটানা ডাক ডেকে যাবে, দরজা-জানলা বন্ধ প্রায়ান্ধকার একা-ঘরে বসে, বাইরের ‘লু’-এর ধুলো আর ঝরাপাতা ওড়ানো ‘ঝরঝরানি’ শব্দ শুনতে শুনতেও আমার কথা মনে হবে তোমার। বর্ষার দিনের কুর্চিবন উথাল-পাতাল করা গা-শিরশির হাওয়ার ফিসফিসানির মধ্যে তুমি যখন, দুর্বারের জন্যে খিচুড়ি আর আলু ভাজা আর শুকনো লঙ্কাভাজা ভালোবাসায় নিজে হাতে বেঁধে তার সঙ্গে খেতে বসবে তখন, তোমার মনে হলেও হতে পারে যে, তোমাদের খাবার টেবিলের জানলার পাশে আরও একটি প্লেট বেশি থাকলে মন্দ হত না!

কিন্তু যদি, আর একটি প্লেট বেশি রাখতেও আমার জন্যে, আমি কিন্তু এসে পড়লেও, প্রথমেই বলতাম আরও একটি প্লেট নেই কেন? মুম্বাইর সেই ছেলেটি কোথায়? যে তোমায় ‘ভাবিজি’ বলে ডাকে? যে-তোমার উত্তীয়?

আমার অশি। তোমাকে আমি ভালোবেসেছি। হঠাৎ। এখন। এই বয়সে! এমন হঠাৎ ভালোবাসা যে, হয়, হতে পারে; তা আমারও বিশ্বাসের বাইরে ছিল। তবু হল। অবিশ্বাসকে। কখনো বিশ্বাস করতে নেই। কখন, কার জীবনে যে, কী ঘটে যায় তা আগের মুহূর্তেও আমরা জানতে পারি না।

আমি তোমাকে ভালোবেসে লজ্জিত অশি। আমার বয়স আরও দশ বছর কম হলে, তোমার মতো কাউকে ভালোবাসার যোগ্যতা আমার থাকত। অমু ঘোষ যে, শুধুই একজন সাদামাঠা কবি। জাদুকর তো সে নয় যে, বয়স কমিয়ে দিতে পারে নিজের, কোনো দারুণ ভোজবাজিতে! কিন্তু ভালোবাসা যে, কোনোদিন-ই ‘যোগ্যতা’র বিচার করেনি। যোগ্যতা বিচার করে, ঠিকুজি-কুষ্ঠী মিলিয়ে রাজযোটক বিবাহ হলেও-বা হতে পারে, ভালোবাসা কোনোদিন-ই হয়নি। তবুও আমি বড়োই লজ্জিত তোমাকে ভালোবেসে। কারণ, তোমার অথবা অন্য কারো ভালোবাসা পাওয়ার-ই যোগ্যতা আমার নেই। আমি জানি তা। আয়নার সামনে দাঁড়াতে আমার লজ্জা করে। আমার কিছুই নেই। শুধু আমার মিডিয়োকার কলমটি ছাড়া। তুমি আমাকে ভালোবেসে হয়তো আমাকে নয়, কবিতাকেই সম্মান দিয়েছ আসলে। আমার কবিতাকেই নয়, পৃথিবীর সব কবিদের কবিতাকে। আমি অধম বলে তুমি উত্তম হবে না কেন? উত্তম বলেই তো দয়া করে অধমকে ভালোবেসেছে!

ভালো থেকো অগ্নিশিখা। দুর্বার, তুমিও ভালো থেকো। ভালো থেকো, মুম্বাই-টেলকোর সেই সুন্দর প্রাণবন্ত অদেখা ছেলেটি। ভালো থেকো শ্রেয়া, শ্রমণা, জ্যোৎস্না, ছবি, মালু, জয়িতা, পৃথা, সোমা। ভালো থেকো। বিবাহিতাদের স্বামীরা। ভালো থেকো অবিবাহিতাদের বা একা নারীদের প্রেমিকরা।

কাল সকাল আটটাতে দলমাতে যাওয়ার জন্যে, আমাকে তুলতে এসে যখন শুনবে তোমরা যে, আমি চলে গেছি তখন, নিশ্চয়ই তোমাদের খুব রাগ হবে আমার ওপর। বহুজনের কাছে শুনেছি যে, হাজার হাজার কাঞ্চন ফুলের গাছ আছে দলমা পাহাড়ে। এখন যদিও কাঞ্চন ফুল ফোঁটার সময় নয় তবু গাছগুলিই দেখে এসো আমার হয়ে। তাদের কবির আদর জানিয়ে। কিন্তু যখন, আমার অদেখা পাহাড়ের চুড়োয় বসে শীতের রোদে চড়ইভাতি করবে তোমরা, যখন ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠবে তোমাদের শরীর তখন, ধীরে ধীরে বুঝতেও পারবে যে, আপদ বিদায় হয়েছে, ভালোই হয়েছে।

কিছু আপদ থাকে, তারা যতক্ষণ কাছে থাকে; ততক্ষণ সম্পদ বলে ভ্রম হয়।

ট্যাক্সিটা যখন গল্ফ-লিঙ্কস-এর মাঠের মধ্যের পথ দিয়ে চলেছে তখন, অমু হঠাৎ দাঁড়াতে বলল ড্রাইভারকে। ড্রাইভার অবাক এবং কিঞ্চিৎ বিরক্তও হয়ে দাঁড় করাল ট্যাক্সিটা। আলোয়ান মুড়ি দিয়ে-বসা-তার সঙ্গীকে বলল, বিড়ি ছোড়বে এক।

অমু নেমে পড়ে ডান দিকে-বাঁ-দিকে তাকাল। বার বার। এখনও বেশ শীত। ক্লাবের আললাগুলোজ্বলছে। কিন্তু পুবের আকাশে ধীরে ধীরে ফুটছে আসন্ন সকালের অস্পষ্ট লালিমা।

হঠাৎ-ই মনে হল যেন, নিঃশব্দে গাছগুলিতে পাশে এসে দাঁড়াল অগ্নিশিখা।

নিজেই পালিয়ে যাচ্ছেন? ভীতু? আমি যে, পালাব বলেছিলাম আপনার সঙ্গে। কাল সারাদিন, আজ সারারাত শুধু এইকথাই ভেবেছি।

তোমার ভেতরের দিকে অনেক বাধা। পারবে না। যারা পালায় তারা, বলে পালায় না।

চলুন অমুদা! আমরা পালাই, এই নিয়মবদ্ধতা থেকে, এই ঘড়ি-ধরা সংসার থেকে। অন্য সকলের মতো না হয়ে চলুন, আমরা ব্যতিক্রম হই।

তুমি একটি পাগলি।

পাশে পাশে অগ্নিশিখা হাঁটছিল। এখন দু-একটি করে পাখি ডাকছে। পৃথিবী জেগে ওঠার আগে, সমুদ্রের বড়োঢেউ অতিকায় নীল পাটিসাপটার মতো পুঞ্জীভূত হওয়ার আগে, হঠাৎ নীল নাগের মতো কুন্ডলী ছেড়ে লাফিয়ে ওঠার পূর্বমুহূর্তে যেরকম থমথমে ভাব হয়, একধরনের বিপজ্জনক নৈঃশব্দ্য; ‘মবিডিক’ ‘সারফেস’-এ উঠে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে যেমন নৈঃশব্দ্য; এখন তেমন। এই নৈঃশব্দ্যে জীবন আর মৃত্যু মাখামাখি হয়ে থাকে।

অগ্নিশিখা বলল,আমার হাতটা একটু হাতে নিন অমুদা। আমার হাতের তেলের পিঠে সাহেবদের মতো আর একটা চুমু খান। তারপর চলুন, আমরা দৌড়ে যাই ভোরের সূর্যকে ছোঁব বলে।

অমু হাত বাড়িয়ে অগ্নিশিখার নরম সুগন্ধি হাতটা ধরতে গেল। ভোরের সোঁদা গন্ধ পথের শূন্যতা থেকে উঠে এল, ট্যাক্সি ড্রাইভারের বিড়িখেকো দুর্গন্ধ হাত। ট্যাক্সি ড্রাইভার অমুকে পাকড়াও করতেই এসেছিল।

বলল, টিশান যানা হ্যায় কি নহি? টিরেন ফেইল হো যায় গা আপকি। গাড্ডি খুল যায়েগি।‘

অমু সংবিৎ ফিরে পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ফিরল ট্যাক্সির দিকে। অগ্নিশিখা কোথাওই নেই। নিজের মিথ্যেসত্তাকে নিজের প্রকৃতসত্তার চেয়ে বড়ো করে তুলে এখন, ফিরে যেতে খারাপ লাগছে খুব-ই। ট্যাক্সিওয়ালাকে অমু বলল, সব খেলাতেই যে, খেলুড়ে ফেল করে ইয়ার; তার ট্রেইন তো মিস হতেই পারে!

ট্যাক্সিতে উঠতেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।

অগ্নিশিখা এখন গাঢ়ঘুমে। নিশ্চয়ই। আহা ঘুমোক! ঘুমোক! অমুর কাছে থাকলে তাকে তুলোর মধ্যে করে রাখত। তুলো কিনতে না পারলে সারাবসন্ত গ্রীষ্ম মাঠেঘাটে বীজফাটা শিমুলের দিগবিদিকে উড়ে-যাওয়া তুলো, কুড়িয়ে কুড়িয়ে আনত। অগ্নিশিখাকে সে, কোনোরকম কষ্টই দিত না।

ট্যাক্সিওয়ালার শাগরেদ কটুগন্ধ বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে বলল, সুব্বে সুব্বে পাগল পিসেঞ্জার উঠায়া উস্তাদ! দিন বহত-ই খারাপ নিকলে গা।

অমু শুনে বলল, পাগল নেহি হুঁ ম্যায়।

অগ্নিশিখা এখন, ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরল। ভেতরের জামা পরেনি। ফিকে হলুদরঙা ব্লাউজের সব বোম বন্ধ নেই। ব্লাউজের ভেতরে দু-টি ফুল ফুটে আছে। নিভৃত নিটোল; পেলব সুগোল; সুডৌল। ভরা-শ্রাবণের কদমের মতো। হলুদ, কোমল।

ততক্ষণে ট্যাক্সি নীলডির গাছগাছালি আর পাখিডাকা নির্জনতা ছেড়ে এক, শিল্পনগরীর পথে এসে পড়েছে। ভোঁ বাজবে একটু পরে। হাজার হাজার রাত-জাগা মানুষ টিফিন ক্যারিয়ার সাইকেলে ঝুলিয়ে ঘরমুখো ছড়িয়ে যাবে পিঁপড়ের মতো কারখানাগুলো থেকে বেরিয়ে। খিদে পাবে কারো, কারো তৃষ্ণা; কারো কাম। নিবৃত্তি আর খিদে, খিদে আর নিবৃত্তি; এর-ই নাগরদোলায় দুলবে এরা।

‘আ গ্যায়া।‘ ট্যাক্সিওয়ালা বলল।

হাঁটা হল না এবারে অগ্নিশিখার সঙ্গে হাতে হাত ধরে। চুমু খাওয়া হল না, হাতের পাতের পিঠে।

.

০৬. অমুর ডায়েরি-৪

তিস রুপাইয়া।

ট্যাক্সিওয়ালা বলল।

চারধারে শোরগোল। হাঁকাহাঁকি। ডাকাডাকি। কত জায়গায় যাওয়ার জন্যে, হাজার মানুষের দৌড়োদৌড়ি। অথচ এদের বেশির ভাগেরই প্রকৃত কোনো গন্তব্য নেই। বৃত্তের মধ্যেই দৌড়ে বেড়াচ্ছে সারাটা জীবন।

তিস রুপাইয়া।

ট্যাক্সিওয়ালা আবার বলল।

কুড়ি টাকা কাল দিয়েছিল। আরও ত্রিশ টাকা দিয়ে নেমে গেল ব্যাগটা হাতে করে। স্টেশনে ঢুকে সেকেণ্ড ক্লাসের টিকিট কাটল একটা। একটা সময় ছিল যখন, কখনো এসি ফার্স্ট ক্লাস ছাড়া ট্রেনে চড়ত না অমু। এখন সেই অমু ঘোষ মরে গেছে। কোনোই দুঃখ নেই অবশ্য সেজন্যে। সত্যিই নেই। আর্থিক অবস্থাটাba তার নিজস্বতা’কে একটুও বদলাতে পারেনি। অথচ ও জানে যে, অধিকাংশ মানুষকেই এই হেরফের প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করে। এবং জানে বলেই ওকে যে, প্রভাবিত করেনি, তা জেনে আনন্দিত হয়।

চা খেল এককাপ। তারপর ট্রেন এলে, জানলার দিকের একটি সিট দেখে গিয়ে বসল।

ছ-টা বাজছে। নীলডিতে এখন সকাল হয়েছে। দলমা রোড, ঝিলম রোড, ভিয়াস রোড, রভি রোড, খড়কাই রোড সব রাস্তার বাংলোগুলিতেই জীবন জাগছে ভোরের পাখির মতো। অস্ফুটে। যেমন প্রতিদিন-ই জাগে। পিকনিকে যাওয়ার প্রস্তুতিও চলছে কিছু বাংলোতে। আজ রবিবার।

ঠিক আটটাতে ওদের আসার কথা ছিল। গোলমুড়ি ক্লাবে। আটটার সময় ট্রেনটা কোথায় পোঁছোবে কে জানে? ঘাটশিলা? না ঝাড়গ্রাম?

অমু ঘোষের বাঁ-দিকের বুকে একটু ব্যথা ব্যথা করে উঠল। সঙ্গে ওষুধ নেই। কাল রাতেই ফুরিয়ে গেছে। বাঁ-দিকের কণ্ঠার কাছটাও ব্যথা ব্যথা করতে লাগল একটু।

পিঠটা এলিয়ে দিল সিটে অমু। ট্রেনটা ছেড়ে দিল।

টাটানগর স্টেশন থেকে নীলডির গাছগাছালির পাখপাখালি কিছুই দেখা যায় না। বোঝারও উপায় নেই যে, অমন সুন্দর একটি এলাকা আছে এই ইস্পাতনগরীতে।

বুকের মধ্যে ব্যথাটা ট্রেনের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্রতর হতে লাগল। কাল সারারাত-ই জেগেছিল ও। ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়ে যেন, লাফিয়েই নদীর ওপরের ব্রিজটা পেরোল। সেই ঝাঁকুনিতে ব্যথাটাও যেন, অসহ্য হয়ে উঠল। কুঁজো হয়ে গেল এতমানুষের ভালোবাসা পাওয়া অমু ঘোষ। মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। মনে হল, এবার ফেরার সময় হল। গবুর, ভূপেনবাবুর কথামতোই ‘এক্সপায়রি ডেট’ এসে গেছে।

মেঘের মতো দলমা রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে লাইনের বাঁ-পাশে। তার চুড়োয় ওঠার কথা ছিল ওর। হল না। সব চুড়োই এখন, ওর কাছে আউট-অফ-বাউণ্ডস হয়ে গেছে। টিরিং-এর কান্ট্রিহাউসে ক্যাণ্ডেল-লাইট ডিনারের লোভ দেখানো মহিলা জানেন না তা! মহিলা ব্রয়লার চিকেন চেনেন। প্রেম’ চেনেন না।

ট্রেনটা এবারে শহর ছাড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ল। সকালের রোদ শিশিরভেজা বন প্রান্তরে হাজার হিরের ঝিকিমিকি তুলেছিল।

অমু সোজা হয়ে বসল আবার। ওই ঠাণ্ডাতেও জানলাটা কষ্ট করে খুলে দিল। কিন্তু পরক্ষণেই অন্য যাত্রীদের আপত্তিতে বন্ধ করে দিতে হল। এখনও বেশ ঠাণ্ডা বাইরে। সমস্ত শরীরে,মনে অমুরও শীত। উষ্ণতা ছেড়ে যাওয়ার সময় এমন-ই হয়।

তবু ওই একঝলক হাওয়াতেই বুকের কষ্টটা কমল।

ট্রেন যতজোরে এগোতে থাকল, গাছপালা মাঠ-বাড়ি-পাহাড়ও ততই দ্রুত পিছিয়ে যেতে লাগল। এখন আর ইচ্ছে করলেও অমু পেছোতে পারবে না। ফেরা যাবে না নীলডিতে। হয়তো কোনোদিন-ই। ওই নীলডিতে।

একদৃষ্টে বাইরে চেসে বসে রইল অমু। কামরার বাইরেটা ক্রমশই উজ্জ্বল হতে থাকল। আর ওর ভেতরটা অন্ধকার।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ