১৬.

সংজ্ঞাদের বাড়ি।

পাগু বলল, দিদি ওই দেখ অনিদা আসছে।

সংজ্ঞা বলল, মা কখন আসবে?

পাগু বলল, দেরি হবে মনে হয়। দাইমাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে বিষেণপুরের মন্দিরে। এ কৃদিন তো গাড়ি চড়ে চড়ে আসা-যাওয়া করে করে আমাদের অভ্যেসই খারাপ হয়ে গেছে। দু-মাইল পথকে মনে হয় কুড়ি মাইল।

অনিরুদ্ধ বলল, এই যে পাগু। কী করছ?

পড়ছিলাম। পাগু বলল।

অনিরুদ্ধ বলল, ভাইফোঁটা-টাইফোঁটা গেল এরই মধ্যে পড়াশুনো কীসের? ফোঁটা যখন তুমি দিয়েছ এবারে আমাকে, তখন তো প্রতিবারই দিতে হবে।

পাগু বলল, দেব। কিন্তু দিদি দিল না।

তোমার দিদি কি আর তোমার মতো ভালো? তোমার মন্দ দিদি কোথায়?

পাগু বলল, ওই তো ঘরে। দিদির আজ সকাল থেকে আবার জ্বর জ্বর হয়েছে।

অনিরুদ্ধ চিন্তিত হয়ে বলল, তাই?

 হ্যাঁ। যান না ঘরে। দিদি শুয়ে আছে।

কী হল আবার।

অনিকে দেখে উঠে বসে সংজ্ঞা বলল, তেমন কিছু না। ম্যালেরিয়া তো! রিল্যাপস করল বোধ হয়।

অনিরুদ্ধ বলল, যাবার আগে তোমার কাছে বিদায় নিতে এলাম। দুপুর থেকে গোছগাছের ঝামেলা থাকবে। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। যাবার আগে আবারও অসুখ বাধালে?

ও কিছু না। ভালো হয়ে যাব। তা ছাড়া ডাক্তারবাবুর ঠিকানা তো আছেই মায়ের কাছে। প্রয়োজনে সুরজদাদাকে বাসে করে পাঠিয়ে দেব। রাঁচি।

দেখো তো! দেখি, জ্বর কত! বলেই, সংজ্ঞার হাতটি হাতে তুলে নিল। কবজিতে আঙুল রেখে বলল, তা একশো মতো হবে। ইশ।

ওরকমই থাকে আমার এমনিতেই। ভাবনার কিছু নেই।

না থাকলেও ভাবব। ভালো থেকো। পোঁছেই চিঠি দেব। বড়ো করে লিখো। খুব সুন্দর চিঠি লেখো তুমি।

তুমি উত্তর দেবে না?

আমি পারি না। চিঠি লিখতে তো পারি না। তা ছাড়া লজ্জাও করে।

কীসের লজ্জা?

নিজেকে খোলামেলার লজ্জা। আমি এমনই। সবাই কি একরকম হয়? তুমি রিয়াকে লিখে দেখো। কী সুন্দর উত্তর দেয় ও। ও যেমন কথা বলে তেমনি চিঠি লেখে। বড়ো আশীর্বাদ আছে ঈশ্বরের ওর ওপরে।

ওকে তুমি বলেছ কিছু আমার চিঠির কথা?

না গো। আমি কিছুই বলিনি। কিন্তু ও আমার চোখ দেখেই বুঝেছে।

তুমি ওকে খুব ভালোবাসো, না?

বাসি।

ও তোমাকে খুবই ভালোবাসে।

কষ্টটা সেজন্যেই। তোমাকে আমার যতখানি ভালো লাগে ওর তার চেয়েও অনেক বেশি ভালো লেগেছিলো। ও আমার থেকে সবদিক দিয়েই ভালো। এখনও ভেবে দেখলে পারতে।

সংজ্ঞা বলল।

অনিরুদ্ধ বলল, ভাবাভাবি সব শেষ। তবে কাউকেই দুঃখ দিতে কষ্ট হয় আমার।

কলকাতা পৌঁছে সুন্দর একটি চিঠি দিয়ে ওকেও। বুঝিয়ে। আমার খুব খারাপ লাগছে, জানো। সংজ্ঞা বলল।

জানি। এবারে একটু ওঠো। যাবার আগে তোমাকে একটু আদর করে যাই।

যেন অনেক অনিচ্ছাতে বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা দিয়ে উঠে দাঁড়াল সাগু। অনি ওকে বুকের মধ্যে নিয়ে চুমু খেল। লজ্জায়, ভালো লাগায় সংজ্ঞা অনির বুকে মুখ গুঁজল।

পাগু পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই ওদের আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থাতে দেখেই ঘর ছেড়ে বেরিয়েই চেঁচিয়ে বলল, দি দি মা-আ-আ এসে গেছে-ছে-এ-এ-এ।

ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন রে পাগু? তোর মা কি হারিয়ে গেছিল? বললেন নীহার।

পাগু বলল, না। অনিদা এসেছে।

নীহার বললেন, অনি? কোথায়?

ওই ঘরে। বলেই পাগু বলল, দিদির সঙ্গে কথা বলছে, তুমি এখন যেয়ো না।

নীহার কী বুঝলেন তিনিই জানেন। বললেন, অনিকে বলিস, পুজোর প্রসাদ ও ফুল নিয়ে যাবে।

.

১৭.

সকাল দশটা হবে। রিয়া বারান্দাতে বই নিয়ে বসেছিল। বইয়ের পাতা ভোলা কিন্তু মন অন্য দিকে। ও বাগানের দিকে চেয়েছিল। মুখ বিমর্ষ, অন্যমনস্ক। হেঁটে-হেঁটে এসে গেট খুলে অনি ঢুকল।

অনিরুদ্ধ বলল, কী হচ্ছে?

রিয়া বলল, এই! পড়া পড়া খেলা করছি।

যতদিন খেলা যায় ততদিনই তো ভালো।

 তা ঠিক। খেলা ভাঙার খেলা।

তুমি সেই গানটা জানো? ঋতু গুহ দারুণ গান এই গানটি।

কোন গান?

 খেলার সাথি, বিদায় দাও, গেল যে খেলার বেলা

না। বড্ড কঠিন গান। আমি জানি না।

 তাহলে সহজ কোনো গান গাও।

রিয়া শুরু করল, আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে, তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে …খালি গলায় একলাইন গাইল।

দেবব্রত বিশ্বাসের রেকর্ড আছে, না?

রিয়া উত্তর না দিয়ে গান থামিয়ে অনির মুখে চেয়ে রইল।

তারপর বলল, তোমার এবারের আসাটা নানা কারণেই তোমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তাই না?

অনিরুদ্ধ বারান্দার সিঁড়িতে বসে পড়ে বলল, হয়তো। তারপর বলল, আর তোমাদের কাছে?

রিয়া বলল, হয়তো।

অনিরুদ্ধ বলল, যাবার আগে তোমাকে বলে যাওায় দরকার যে, তোমাকে আমার খুব। ভালো লেগেছে রিয়া।

মুখ তুলে বলল রিয়া, সত্যি?

সত্যি।

মিথ্যে কথাও এমন সুন্দর করে বলো তুমি যে, সত্যি বলে ভুল হয়।

মিথ্যে কেন? মিথ্যে হতে যাবে কেন?

সত্যি নয় বলে মিথ্যে।

 একটু চুপ করে থেকে রিয়া বলল, অন্য কথা বলো।

অনিরুদ্ধ বলল, কী কথা?

রিয়া বলল, অন্য যেকোনো কথা। তোমার কথা, সাগুর কথা, ভজুকার কথা, এমনকী মালির আঠালি-ধরা কুকুরটার কথাও। শুধু আমার কথা ছাড়া।

অনিরুদ্ধ বলল, তোমার কী হয়েছে রিয়া?

 রিয়া বলল, কিছু তো হয়নি।

এমন সময় সাইকেলে করে মদনকে আসতে দেখা গেল। মদন সাইকেল থেকে নেমে গেট খুলে একটি গজলের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে ঢুকল। সাইকেলটাকে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে অনিকে দেখতে পেয়েই তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার চোখে অনিরুদ্ধর দিকে তাকাল।

অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে উঠে হাতজোড় করে বলল, নমস্কার।

 মদন বলল, পরণাম। নোমোস্কার অনিরুদ্ধবাবু। মজেমে হ্যায় না আপ?

অনিরুদ্ধ বলল, মজেমে কি না জানি না। তবে খারাপ নেই।

 মদনকে দেখে রিয়া উঠে দাঁড়িয়েছিল। ওর মুখ শুকিয়ে গেছিল।

মদন রিয়াকে বলল, রিয়া বহিন, তোমার সঙ্গে আমার একটি পেরাইভেট কথা আছে।

অনিরুদ্ধ বলল, ওঃ সরি! আমি চলে যাচ্ছি।

রিয়া বলল, না, না, আপনি যাবেন কেন? আমিই মদনদার সঙ্গে বাগানে যাচ্ছি। বলেই রিয়া সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নেমে মদনের কাছে গিয়ে ওকে নিয়ে গেটের কাছে চলে গেল।

 মদন বলল, বীরজু পাঠিয়েছে আমাকে। ব্যাপার কী?

বীরজু বলল যে, ওর নিজের আসার বাধা আছে। প্রোগ্রাম ঠিক আছে কি না তা জানতে পাঠাল আমাকে। মদন বলল।

রিয়া একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, তুমি এসেছ খুব ভালো হয়েছে মদনদা। কী করে খবরটা পাঠাই তা ভেবে ছটফট করছিলাম। আজকের প্রোগ্রাম ক্যানসেল হয়েছে বলে দিয়ে। আজ নয়, কাল, ঠিক ওই সময়েই।

মদন জিজ্ঞেস করল, কোন সময়ে?

 রিয়া বললে, বিকেল পাঁচটাতে।

 কোথায়?

তা সব বলা আছে।

তুমি এসব কী করছ তা আমি জানি না রিয়া। ও শালা করতে পারে না এমন কাজ নেই। তুমি ওর সঙ্গে এমন নির্জনে দেখা করলে কোনদিন তোমার লাশ উদ্ধার করতে হবে আমাকে। পরে দোষ দিয়ো না।

রিয়া গলার হাড়ের লকেটটা ডান হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে তুলে দাঁতে কামড়ে বলল, দান দেওয়া হয়ে গেছে। ফেরাবার আর উপায় নেই।

কোনো উপায়ই কি নেই?

আছে কি না তা তোমার সঙ্গে পরশু সকালে আলোচনা করব।

তুমি একবারটি যদি আসো তো ভালো হয়।

 মদন বলল, আসব।

তারপর বলল, মাসিমা এসব জানেন? কোনোরকম সাহায্যের দরকার হলে আমাকে খবর পাঠিয়ো। কাজটা তোমার ঠিক হচ্ছে না। তারপর অনিরুদ্ধর দিকে আঙুল তুলে বলল, এই শালা ফসলি বটেরের জন্যে তোমার এত কিছু করার দরকার কী? এ চিড়িয়া তো দু চারদিনের জন্যেই, হাওয়া হয়ে যাবে। এ তোমার কে?

রিয়া অঞরুদ্ধকণ্ঠে বলল, কেউ নয়। কেউ নয় মদনদা।

 মদন বলল, তাহলে? অজীব লেড়কি হচ্ছ তুমি মাইরি।

 রিয়া বলল, জানি।

মদন বলল, তাহলে এই বলব? প্রোগ্রাম ঠিক। আজ নয়, কাল, একই জায়গায় বিকেল পাঁচটাতে।

রিয়া বলল, হ্যাঁ। এখন তাই বলবে। তারপর তুমি পরশু সকাল দশাট নাগাদ এসো।

 ঠিক। এখন চলি। মাসিমাকে পরণাম বলে দিয়ো।

বলেই, অনির দিকেও হাত তুলে বলল, পরণাম।

অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে উঠে আবারও জোড়হাতে নমস্কার করে বলল, নমস্কার।

 মদন বললে, ছোকরা, বড়ো খানদানের আছে রে?। সাচমুচ রহিস। আচ্ছা লেড়কা।

রিয়া মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না। ওর দু-চোখের কোণে জল টলটল করে উঠল।

রিয়া ফিরে এলে অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়াল। মুখে কিছু বলল না।

রিয়া বলল, কিছু জিজ্ঞেস করলে না আমাকে?

অনিরুদ্ধ বলল, কী ব্যাপার? তোমাদের প্রাইভেট ব্যাপারে আমার কৌতূহল থাকা কি উচিত?

জীবনে কি অনুচিত কর্ম একটিও করোনি?

তা বলতে পারি না। হয়তো অনেকই করেছি। তবে সজ্ঞানে নয়।

 থাক মদনদার কথা। এরাই তো আমার কাছের লোক, আপন। কলকাতা শহরের বড়োলোকের ছেলে অনিরুদ্ধ বোসই বরং স্বপ্নের মানুষ, কল্পনার মানুষ, কাল সকালেই যে চলে যাবে এখান থেকে। কল্পনা নিয়ে তো মানুষ বাঁচে না, তাকে বাস্তবের সঙ্গেই ঘর করতে হয়।

সংজ্ঞাকে তুমি খুব ভালোবাসো, না?

কে বলল?

সংজ্ঞাই বলেছিল, বলেছে বার বার।

বাসি।

খুবই ভালোবাসো।

 রিয়া বলল, কতখানি যে ভালোবাসি তা তুমি বুঝতেও পারবে না কোনোদিন। হয়তো সাগু নিজেও নয়।

অনিরুদ্ধ বলল, আমি যদি এখানে আবার আসি?

আসতে পারো। গামারিয়া তো আমার জমিদারি নয়। ইচ্ছে করলেই আসবে। তোমরা পুরুষমানুষ, এই পৃথিবী তো তোমাদেরই জন্যে। যেখানে খুশি যখন খুশি যেতে পারো একা একা।

তুমি খুশি হবে? যদি আবার আসি।

হব।

তোমাকে চিঠি লিখব কলকাতা থেকে।

 কী লিখবে? আমাকে তোমার খুবই ভালো লেগেছে? ইচ্ছে হলে লিখবে। পোস্ট-অফিসও তো আমার জমিদারি নয়। ডাকবাক্সে চিঠি ফেললে, খামে আমার নাম লেখা থাকলে, তা আমার কাছে আসবেই। ঠেকাব কী করে?

উত্তর দেবে তো?

 উত্তর দেওয়াই তো ভদ্রতা। বাবা মায়ের কাছে এই শিক্ষাই তো পেয়েছি।

তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ রিয়া। কেমন করে কথা বলছ আজ।

আমি প্রথম থেকেই এমন। তুমিই বুঝতে পারোনি।

 তারপরই বলল রিয়া, ওঃ সরি। জিজ্ঞেসই করিনি তোমাকে কিছু খাবে কি না?। কফি খাবে?

অনিরুদ্ধ বলল, নাঃ। মাসিমা কোথায়?

মহিলা সমিতির মিটিং আছে। সেখানে গেছেন। জিশানপুরে। কিছু খাবে কি না বললে না?

অনিরুদ্ধ রিয়ার ডানহাতটি নিজের ডান হাতে তুলে নিয়ে হাতের তেলোর পিঠে আলতো করে চুমু খেল শব্দ করে।

বলল, এই তো খেলাম।

রিয়ার সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল ভালো লাগায়। তীব্র এক আবেশে ও অবশ হয়ে গেল।

এমন সময় হঠাৎ-ই উঠে দাঁড়িয়ে অনিরুদ্ধ বলল, চলি রিয়া। আবার হয়তো দেখা হবে। ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না তোমাকে। অনেকই পেয়েছি। মাসিমাকেও বোলো।

রিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কাল সকালে ক-টায় বেরোবে?

ইচ্ছে আছে আটটা নাগাদ। তবে ঠাকুমা ও ঠাকুরদা কি অত তাড়াতাড়ি তৈরি হতে পারবেন?

আমরা, মা ও মেয়ে সাড়ে-সাতটাতেই পৌঁছে যাব। কর্তব্য ও কৃতজ্ঞতাবোধে। তাই কালকে তো দেখা হবেই।

তারপরও হয়তো হবে। অনিরুদ্ধ বলল।

পরের কথা পরে। রিয়া বলল।

.

১৮.

নির্জন বন। ওপরে হেমন্তের নীলাকাশ। একটি পায়ে-চলা কাঁচা রাস্তা, লাল মাটির, এবড়ো খেবড়ো এঁকে-বেঁকে গিয়ে সরে গেছে শিমুলতলি থেকে অন্য দিকে।

বীরজু সিং সাইকেল চালিয়ে এসে নামল শিমুলতলিতে।

তারপর বসল একটা পাথর দেখে। সোনালি ব্যাণ্ডের সোনালি হাতঘড়িতে সময় দেখল। তাকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। রিয়ার মতো সামান্য একটি মেয়ের এই নির্জনে তার সঙ্গে একা দেখা করার দুঃসাহস যে হবে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। মেয়েটা কি তাকে মেরে ফেলতে চায়? সঙ্গে দলবল নিয়ে আসবে কি? সেই হিরো কে? তার জন্যেও বীরজু তৈরিই আছে। কোমরে গোঁজা চোরাই পিস্তলটাকে ছুঁয়ে দেখল। তারপর ট্যাঁক থেকে খুলে গুলি-ভরা ম্যাগাজিনটা বের করে দেখে নিয়ে আবার পুরে দিল।

সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে থলেটা টেনে নিয়ে নতুন বোতল বের করল মহুয়ার। ছিপি খুলে ঢকঢক করে ঢালল মুখে।

একটু পরই সাইকেলের টায়ারের কিরকির আওয়াজ কানে এল কাঁকুড়ে মাটির ওপর। মোষের মতো মোটা গলা তুলে দেখল সত্যিই আসছে মেয়েটা। একটা লাল শাড়ি পরেছে। কালো শায়া দেখা যাচ্ছে প্যাডলের ওপর পায়ের ওঠনামাতে। রিয়া এসে নামল।

রিয়া হাতজোড় করে বলল, ম্যায় আপসে মাফি মাঙ্গনে আয়ি হুঁ।

মাফি? হামার কাছে মাফি মাঙ্গলে কী হবে? যাদের সামনে বেইজ্জতি হয়েছিল হামার, তারা তো জানতেও পারবে না। মাফি মাঙ্গলে ভরত সাহুর পানকা দুকানকি সামনেহি মাফি মঙ্গনে পড়েগি। সবকো সামনে।

আমি আপনার কাছে একটি ভিক্ষা চাইতে এসেছি বীরজু মহারাজ। তার জন্যে যা দাম চান, আমি দেব।

বীরজু হেসে ফেলল। আচ্ছা বোলিন তুনে। বীরজু মহারাজ। বীরজু মহারাজ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সুন্দরী রিয়ার উজ্জ্বল দুঃসাহসী চোখে কিছুক্ষণ। তারপর বলল, কওন চিজ কি ভিখ? ভিখ কাহে মাংগেগি তু?

হাঁ। ভিখ। উও হিরোকি হাত পায়ের সব তোড় দেনা পড়েগা আপকি। এমন করে ভেঙে দেবেন যাতে ও কোনোদিনও গাড়ির স্টিয়ারিং না ধরতে পারে। না পারে চিঠি লিখতে।

তাতে তুমহার ফায়দা কী?

আছে।

আর হামার ফায়দা?

বীরজু কুতকুত করে হেসে বলল।

তুমি যা চাও।

নজদিকমে তো আও জারা। খাড়া খাড়া বাঁতে থোরি হোতি হ্যায়।

রিয়া সাইকেল শুইয়ে রেখে মাটিতে এক পা এক পা করে বীরজুর কাছে এগিয়ে আসতেই বীরজু খপ করে তাকে ধরে তার কোলে বসিয়ে কামার্ত শিয়ালের মতো চুমু খেল।

রিয়া প্রতিবাদ করল না। হাসিমুখে বলল, এহি হ্যায় অ্যাডভান্স পেমেন্ট। বাকি মিলেগি কাম হোনে পর।

ইতনি থোরি ইডভান্স পেমেন্টস সে বড়া কাম হোগা নেহি। ঔর দো কুছ।

রিয়া বললে, শুনিয়ে, আজ নেহি। আপনার বিশ্বাস তো হোল যে, আমি কথার খেলাপ করব না।

উক বাত সাহি। বাতকি খিলাপ হোনেসে হাঃ হাঃ হাঃ। স্রিফ হামই নেহি। হামারা চেলা লোগভি তুমকি ছেড়ফাড় করেগা. ই সমঝ রাখনা।

ওরা কয়েকদিন পরই কলকাতা ফিরে যাবে। তার মধ্যে যা করার তা করতে হবে। সময় বেশি নেই।

বীরজু বলল, ওর সঙ্গে যদি অন্য মেয়েটা থাকে?। তোমার দোস্ত।

আমার কোনো দোস্ত নেই! থাকলে, তারও ওই অবস্থা করে দেবে। রিয়া বলল।

বীরজু বলল হেসে, মেয়েদের বেলা শাস্তির রকমটা অন্য হবে। সে যা করবার দিমাগ লাগিয়ে হামি ঠিক করে দেব। কিন্তু কায়দামতো তাদের পাব কোথায়?

ওরা শিগগিরই কাতকির ঝরনাতে পিকনিক করতে যাবে। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। পথে গাছ ফেলে বা পাথর ফেলে আটকাতে পারেন।

বীরজু মোটর সাইকেলের চাবি দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, ওরা যদি বাইপাস দিয়ে বেরিয়ে আসে?

আমি সঙ্গে থাকব অন্য গাড়িতে। বাইপাস দিয়ে বেরোবে না যে, সে দায়িত্ব আমার।

তবে কখন থেকে থাকব?

এখন তো সন্ধে হয় পাঁচটাতে। আপনি পাঁচটা থেকে থাকবেন, কবে, তা আমি জানাব।

ঠিক আছে। এখন আর একবার এসো। আহা। তোমার ঠোঁট তো নয়, যেন মুজাফফরপুরের লিচি। বলেই, রিয়াকে আর একবার কোলে বসিয়ে এমন করে চুমু খেল যে, রিয়া যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল।

ছেড়ে দিল বীরজু ওকে।

মনে মনে বলল, শালা! পয়সা দিয়ে যে মেয়েদের সঙ্গে শোয়া যায় তারা অনেক ভালো। ছল্লা কম। এদের যত্ত ফালতু সব ঝিকঝকমারি। শালার ডাল গলাতে এত ঝক্তি ব্যস্ত পুরুষের পোষায় না।

.

১৯.

রিয়াদের বাড়ি।

অনি এবং অনিদের বাড়ির সকলেই এসেছেন নেমন্তন্নে। সব ঘরে আলো জ্বলছে। কন্টেসা গাড়িটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরেই ডিনার সার্ভ করা হবে। সাগুর মা রান্নাঘরে গেছেন রিয়ার মাকে সাহায্য করতে। রিয়াও সেখানে ছিল। সাগুও আজ এসেছে। তবে দুর্বল। সাগু রান্নাঘরে ঢুকে বলল, মাসিমা আপনি আর মা এখানে? মাসিমা, আপনাকে ওঁরা খুঁজছেন। মা, তোমরা বরং বসবার ঘরে গিয়ে ওঁদের সঙ্গে কথা বলো, আমি আর রিয়া মিলে সব ঠিক করে দিচ্ছি।

রিয়ার মা নলিনী বললেন, ঠিক তো সবই করা হয়ে গেছে রে! এখন ফ্রায়েড রাইসটাই শুধু গরম করে নিলেই খাবার সার্ভ করে দিতে পারি।

সাগু বলল, আমরা তাহলে অন্যান্য সব ডিশগুলো খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিই?

নলিনী বললেন, তা দাও। আর নীহার, তুমি বরং গিয়ে ওদের সঙ্গে একটু কথা বলো। কেউ তো কারও বাড়ি শুধু খেতেই আসে না। গল্প-গুজব আদর-আপ্যায়ন এই তো সব।

নীহার বললেন, সত্যিই তো। তবে তুমিও চলো না। তুমিই তো আসল। তোমার

নেমন্তন্নেই তো ওঁরা সবাই এসেছেন। মেয়েরাই করে নেবে যেটুকু বাকি আছে।

নলিনী বললেন, তোমার মেয়ে হয়তো পারবে। আমার মেয়ে তো পটের বিবি। একদিন একটি ওমলেট ভাজতে বলেছিলাম তাতেই শাড়িতে আগুন ধরিয়ে বসেছিল। একগেলাস জল গড়িয়ে খায় না! তা রান্না করবে! কী যে বলব তোমাকে।

নীহার বললেন, অমন করে বোলো না। তোমার মেয়ের যে আরও কত গুণ! কী ভালো গান গায়, কী ভালো নাচে।

সে গুণে তো ভাত সেদ্ধ হবে না। বিয়ে হলে কী যে করবে এ মেয়ে। কোন রাজপুত্র যে একে বিয়ে করার জন্যে বসে আছে কে জানে। নলিনী বললেন।

নীহার বললেন, তা কে বলতে পারে বলো? কার জন্যে যে কে বসে থাকে, না থাকে তা কি বলা যায়? সবই তো কপালের ব্যাপার। চলো, আমরা যাই। সাগু রইল তাই আমার চিন্তা নেই কোনো।

ওঁরা চলে যেতেই সাগু হাত দিয়ে ফ্রায়েড রাইসটা একটু নেড়েচেড়ে হাঁড়িতে টং টং করে দুবার বাজাল।

কী ব্যাপার রে সাগু? এতক্ষণ ভিড়ের মধ্যে জিজ্ঞেসই করতে পারিনি…

আমিও তো তাই জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম। তোর কী ব্যাপার? আমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলছিস না আজ। মনে হচ্ছে আমাকে যেন অ্যাভয়েড করছিস।

তোকে? ওমা! কেন?

ভাবলেশহীন মুখে রিয়া বলল। তারপর বলল, তোর চোখ দুটো আজ খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কী যেন খুব একটা খুশির ঘটনা ঘটে গেছে তোর জীবনে। তুই সবসময়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছিস। একটু আগে সুমিতা মাসিমা যখন ডাকলেন তোকে, তুই শুনতেই পেলি না, কী হয়েছে কী তোর?

ডান হাতে হাত ধরে বাঁ-হাতে রিয়াকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল হঠাৎ-ই সংজ্ঞা রিয়ার গালে।

হঠাৎ? এত পুলক কীসের? বলেই, রিয়া গান ধরে দিল, চেষ্টা করে, ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে, কে জানে কার কথা সে যায় শুনিয়ে…

সংজ্ঞা বলল, তুই আমার বন্ধু তো?

সন্দেহ আছে কোনো? এখনও?

গলাটা ঠাণ্ডা নিষ্পণ শোনাল রিয়ার। তু

ই আমাকে ভালোবাসিস? আমার ভালো হলে তুই খুশি হোস?

 এতেও কি কোনো সন্দেহ আছে? ব্যাপারটা কী তাই খুলেই বল না?

ব্যাপার এখনও বলার মতো কিছুই হয়নি, কিন্তু যেটুকু খুশির ঘটনা ঘটেছে, আমি তার আদৌ যোগ্য নই। আমি যদি তুই হতাম, তাহলে মানে; তুই যদি আমার জায়গায় থাকতিস তবে বিশ্বাস কর, এইমুহূর্তে আমি নিজের কারণে যত না খুশি তোর কারণে তার চেয়ে অনেকই বেশি খুশি হতাম। জানি না, একথা তুই বিশ্বাস করবি কি না!

রিয়া বলল, বিশ্বাস না করার কী আছে? তবে ব্যাপারটা কী?

বলেছি তো! ব্যাপার কিছুই নয়। তবে বলার মতো সময় হলে তোকেই সবচেয়ে আগে বলব। তুই আমার এত বন্ধু, এত বড় হিতাকাঙ্ক্ষী, তোকে বলব না তো কাকে বলব বল?

দেখ ফ্রায়েড রাইস গরম হল? আমাদের কথার তোড়ে পুড়েই না যায়।

 আর মিনিট দুয়েক। তুই গিয়ে বরং ডাক সকলকে। তারপর আমি ফ্রায়েড রাইস নিয়ে যাচ্ছি। পরোটাগুলো তো গরমই আছে, না রে?

হ্যাঁ হ্যাঁ। মা এসব বিষয়ে খুব খুঁতখুঁতে। মা বলেন, ঠাণ্ডা খাবার, অতিথিকে তো দূরস্থান, কুকুরকেও দিতে নেই।

তুই কি সত্যিই কোনো কিছু রান্না করিস না, না ইচ্ছে করে না?

রিয়া বলল, দুর দুর। ইচ্ছে তো করেই না। পারিও না ছাই।

 মাসিমা যা বললেন শুনলি? বিয়ে হলে কী করবি?

বিয়ে করতেই ইচ্ছে করে না আমার। আর যদি কখনো করিও তখন পাঁউরুটি মাখন খেয়ে থাকব। মেয়ে হলেই যে হেঁসেল ঠেলতে হবে তার কোনো মানে নেই। বিয়ে করলে আমার বরকে দিয়ে রান্না করাব আর নিজে চাকরি করে পায়ের ওপর পা তুলে বসে বরের রান্না খাব।

অনিরুদ্ধ রান্নাঘরের পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়ে বলল, রান্না করতে জানাটা কিন্তু মেয়েদের। মস্ত গুণ।

ওরা দুজনেই চমকে উঠল ওদের পেছনে অনিরুদ্ধর গলার স্বরে।

সংজ্ঞা বলল, তুমি বড়ো মেয়েলি। রান্নাঘরে কী করতে এলে?

রান্না হল কি না দেখতে। হয়ে গিয়ে থাকলে ভজুকাকে গিয়ে নিয়ে আসব। তিনি তো একা বসে রাম-নাম করছেন। স্বয়ং রামচন্দ্রেরও এত বড়ো ভক্ত কখনো ছিল কি না সন্দেহ। অনিরুদ্ধ বলল।

রিয়া বলল, রান্না হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে ভজুকাকে নিয়ে এসো। আর যে মেয়েকে তুমি বিয়ে করবে সে ভালো রান্না জানে কি না তা পরখ করে নিয়েই বিয়ে কোরো। আমি তো আমার বরকে দিয়েই রাঁধাব।

.

২০.

খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে সকলের। যোগেনবাবু আর নীপবালা আগেই চলে গেছেন। একটু খেয়ে। রাতে এঁরা খুবই কম খান।

ভজুকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পান খেতে খেতে বললেন, বাঃ বাঃ যা খেলাম না বউদি। ভিভালুটা যা বেঁধেছিলেন কী বলব। এমন আর জন্মে খাইনি।

রিয়া বলল, বড়ো বানিয়ে বানিয়ে কথা বলেন ভজুকা আপনি।

ভজুকা বলল, থর্থি বলতি–পান মুখে থাকাতে এমন করে বললেন তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাছের গোড়ায় পিক ফেলে এসে বললেন, ভজুকা মিথ্যে বলে না।

রিয়া বলল, এটা সবচেয়ে বড়ো মিথ্যা।

অনিরুদ্ধ বলল, তাহলে কাল ক-টায় তুলব তোমাকে রিয়া?

রিয়া বলল, যটায় ঠিক আছে। কিন্তু আজ দুপুর থেকেই আমার প্রচন্ড মাথা ধরে আছে। আমি বোধ হয় যেতে পারব না। পিকনিকে।

সংজ্ঞা বলল, সে কী রে রিয়া? আমার শরীর এখনও এত দুর্বল তা নিয়েই আমি যাচ্ছি আর তুই যাবি না কী? তুই না গেলে আমিও যাব না।

তাহলে পিকনিক-এ গিয়ে কাজ নেই। কী বলো ভজুকা? তোমরাই বললে এত সুন্দর জায়গা না গেলে জন্ম বৃথা হবে। আবার তোমরা বলছ..

তাহলে পিকনিক বন্ধই থাক। আমার তো শরীর খারাপই। তা ছাড়া রিয়াও যখন যেতে পারবে না বলছে। সংজ্ঞা বলল।

রিয়া বলল, ভজুকা, আপনারা তো আবার পরশু ভোরেই বেরোবেন কলকাতার উদ্দেশে। কালকে এসব ঝামেলা না করাই ভালো। তা ছাড়া সুমিতা মাসিমা তো যেতে পারছেনই না।

অনিরুদ্ধ বলল, ঠিক আছে তাহলে।

সুমিতা বললেন, হ্যাঁ। পরে যদি কখনো আসি আবার তখন…

রিয়া বলল, আবারও কি আসবেন এই বাজে জায়গায়?

সুমিতা বললেন, কী যে বলো মা! জায়গার ভালো-মন্দ কি শুধু জায়গা দিয়ে হয়? যে জায়গাতে মানুষেরা বাস করেন সে জায়গার ভালো-মন্দ তাঁরাই ঠিক করেন। এত আনন্দ পুজোতে বাইরে এসে খুব কমই করেছি। কী বলল ভজু ঠাকুরপো?

অনিরুদ্ধ বলল, ঠিক বলেছ তুমি মা!

ভজুকা বললেন, তা ঠিক। পাগুর বিনুনিতে একটা টান লাগিয়ে বললেন, পাগুকে তো আর সব জায়গায় পাব না।

সকলে হেসে উঠলেন। ওঁরা গাড়ির দিকে এগোলেন।

অনিরুদ্ধ বলল, চলুন নীহারমাসিমা। মা, তুমি ডানদিকে যাও, ওঁদের তো আগে নামাতে হবে।

 রিয়া বলল, পিকনিকটা বন্ধ করাতে খুব ভালো হল সব দিক দিয়েই। কালকে যদি সময় পাও তবে একবার দেখা করে যেয়ো আমাদের সঙ্গে অনিদা। কাল সকালে রওয়ানা হবার আগে আমরা গিয়ে সি-অফ করব।

সংজ্ঞা বলল, নিশ্চয়ই। আমরাও সব্বাই আসব। চলি রে রিয়া। খুব খেলাম কিন্তু মাসিমা।

নলিনী বললেন, ও বাবা। সাগুও দেখি আমাদের থ্যাংক ঊ্য বলছে রে! দেখেছিস রিয়া?

রিয়া বলল, দেখেছি মা!

অন্যমনস্ক গলায় বলল রিয়া।

চ্যাটার্জিসাহেবের বাড়ির সামনে নীহার, নলিনী, সাগু পাগু এবং রিয়া দাঁড়িয়ে ছিল। অনিদের পুরো পরিবারই গাড়িতে উঠে পড়েছেন। কন্টেসাটি চালাচ্ছেন মুকুন্দবাবু আর অনি মারুতিটি।

দুটি গাড়ির এঞ্জিনই গুঞ্জরন করে উঠল।

সুমিতা বললেন, তাহলে আসি ভাই।

যোগেনবাবু দু-হাত জড়ো করে নমস্কার করে বললেন, চললুম। সক্কলকে নমস্কার।

পাগুর চোখ ছলছল করছিল। বলল, দাদু আপনারা আবার আসবেন তো?

যোগেনবাবু বললেন, আমি না এলেও এঁরা সবাই-ই আসবেন। আমি আর কদিন আছি বলো?

বড়ো গাড়িটা আগে ছেড়ে গেল। অনি গাড়ি গিয়ারে দিয়েই রেখেছিল। অ্যাকসিলারেটরে চাপ দেওয়ার আগে সংজ্ঞার চোখে একবার চোখ রাখল। দুটি চোখের দৃষ্টি দিয়ে দুটি চোখকে চুমু খেল। সেই চাউনি দৃষ্টি এড়াল না রিয়ার। রিয়ার দিকে মুখ একবার ঘুরিয়েই রওয়ানা হল।

এতদিন যেন কোনো দ্রুতগতি, বহু-অঙ্কের কোনো একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। এই সকালবেলার একআকাশ আলোর মধ্যে যেন সেই নাটকের শেষাঙ্ক শেষ হল। গাড়ি দুটির চাকায় চাকায় লাল ধুলো উড়ল, শুকনো পাতা। ছাতারে পাখিরা ডেকে উঠল দল বেঁধে ছ্যা: ছ্যা: ছ্যা: করে। যেন রিয়াকেই বলল। চমকে উঠে বাউণ্ডারির বেড়ার লাগোয়া পুটুস ঝোঁপগুলোর দিকে তাকাল রিয়া, যেখান থেকে ছাতারেরা ডেকে উঠল।

নলিনী বললেন, কী করে যে কেটে গেল একটা দিন! ভাবাই যাচ্ছে না।

সত্যি! নীহার বললেন।

তারপর বললেন, চলো এগোই। এ ক-দিনে গাড়িতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, হাঁটতে যেন ইচ্ছাই করছে না আর।

সত্যি। এবার নলিনী বললেন।

সংজ্ঞা পিছিয়ে পড়েছিল গেটের কাছে। নলিনী বললেন, এবারে পা চালিয়ে বাড়ি গিয়ে বই নিয়ে বোসো রিয়া। নেচে গেয়ে তো অনেকই দিন নষ্ট করলে। তুমি এগোও। আমি নীহারদের বাড়ি একটু বসে যাব।

রিয়া মনে মনে বলল, জীবনটাই নষ্ট হল, আর কটা দিন। বলেই, অন্য কাউকেই কিছু আর না বলে বাড়ির দিকে বড়ো বড়ো পা ফেলে এগোল। একলা হয়ে যেতেই এতক্ষণ চেষ্টা করে ভুলে-থাকা একটি ভয় তার বুকে ফিরে এল। বীরজু সিং-এর সঙ্গে সে তঞ্চকতা করেছে। বীরজু সিং এবং তার নেকড়ের দল কি সত্যিই তাকে ছিঁড়ে খাবে?

 চলে যাওয়ার সময় অনির সঙ্গে সাগুর চোখের যে নীরব কথা হল তার কথা ভাবছিল রিয়া। সাগুর প্রেমোজ্জ্বল মুখ! নিজের জন্যে ভারী কষ্ট হতে লাগল রিয়ার। সে নিজের কারণে কখনোই এমন অনুকম্পা বোধ করেনি।

প্রসাদ সাহেবের বাড়ির গেটের কাছে আসতেই দেখে অন্ধ বিসপাতিয়া তার দশ বছরের ছেলের হাত ধরে গান গাইতে গাইতে গেট দিয়ে বেরোচ্ছে। বিসপাতিয়া সপ্তাহে একদিন রিয়াদের মহল্লাতে গান গেয়ে ভিক্ষা চাইতে আসে। বড়ো সুরেলা গলা ওর। বেশির ভাগ দিনই ও মীরার ভজন কি সুরদাসের ভজন গায়। যাই গাক না কেন ওর গান শুনে চোখে জল এসে যায়। গান যে প্রাণেরই এক প্রতিরূপ তা বিসপাতিয়ার গান গান শুনলে বোঝা যায়। ওর গান কানে এলে অন্য কিছু করার উপায়ই থাকে না। সবকিছু ছেড়ে উৎকর্ণ হয়ে ওর গান শুনতে হয়ই। আজ বিসপাতিয়ার কী হয়েছে কে জানে সে ভজন না গেয়ে একটি ঠুংরি গাইতে গাইতে আসছে। গান্ধার বর্জিত যোগিয়া রাগের কোমল নি এই সকালবেলার আলোয় ব্যথার সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে। হাতের লাঠির ওঠাপড়াতেই তাল ও মাত্রা ঠাহর করে নেয় বিসপাতিয়া।

রিয়া চলা থামিয়ে গানটির কথাগুলি শোনার চেষ্টা করল।

আনমিলো একবার
গহরা নদীয়া ম্যায় তর না জানু।
মেরে সাজন যো রহে উসপার
 আনমিলো একবার।

গানের কথাগুলি যেন বুকের মধ্যে তিরের মতো এক এক করে বসে যেতে লাগল রিয়ার। চোখদুটি ঝাঁপসা হয়ে এল। সামনে পেছনে চেয়ে দেখল, পথে কেউ চেনা লোক আছে কি না! ভাগ্যিস কেউ নেই।

রিয়া বড়ো বড়ো পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল ওদের বাড়ির দিকে। বিসপাতিয়া যখন বাড়ির সামনে আসবে তখন বাড়ি থেকে পয়সা পাঠিয়ে দেবে কালিয়া দাদাকে দিয়ে।

যতই এগিয়ে যেতে লাগল ততই ওই যোগিয়ার যোগিনী সুরের বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে লাগল যেন। গানের সুর তখনও স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে যদিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে ঠিক তখনই দূরাগত এক বীভৎস আওয়াজে চমকে উঠল রিয়া। আর দু-পা এগোতেই দেখতে পেল বীরজু সিংকে। মোটর সাইকেলের কুৎসিত আওয়াজ তুলে সে এগিয়ে আসছে। তার গায়ে একটি লাল ফুলহাতা জামা, পরনে কালো প্যান্ট, গলায় হলুদ রুমাল এবং চোখে কালো চশমা। তার দু-পাশে দুজন করে অনুচর। তারাও মোটর সাইকেলে। চড়াই বেয়ে উঠে আসছে পাঁচটি মোটর সাইকেল তার কানে গানের রেশ মুছে দিয়ে তীব্র গাঁ গাঁ আওয়াজ করে এক দুর্দমতম দুঃস্বপ্নের মতো।

একবার ভাবল দৌড়ে ফিরে যায় সংজ্ঞাদের বাড়িতে। যদিও ও জানে যে, সেখানে আশ্রয় নিলেও তার এযাত্রা নিস্তার নেই। আজকে ফিরে যাওয়ার জন্যে আসেনি বীরজু সিং। তারপরই ভাবল, দৌড়ে বাড়ির মধ্যে গিয়ে সব দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু ওর পা দুটি অবশ হয়ে গেল। গেটের সামনে যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমনই অনড় দাঁড়িয়ে রইল। পাঁচটি মোটর সাইকেলের আয়নাতে রোদ পড়ে চমকিয়ে উঠছিল রিয়ার সেই মুহূর্তের বুকেরই মতন। যূথবদ্ধ জানোয়ারের মতো মোটর সাইকেলগুলো গাঁ-গাঁ-গাঁ শব্দ করে উঠে আসছিল, তবু রিয়ার কান ভরে গেল তার পেছন থেকে আসা বিসপাতিয়ার স্নিগ্ধ, বিষণ্ণ। গানে।

আনমিলো একবার
গহরা নদীয়া ম্যায় তর না জানু।
মেরে সাজন যো রহে উসপার
আনমিলো একবার।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ