দীপিতা – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

কালীপুজো শেষ হয়ে গেছে। ভাইফোঁটাও চলে গেছে। দীপিতার কোনো ভাই নেই। বিয়ের আগে কলকাতাতে যখন বড়োমামার কাছেই থাকত বরানগরে, তখন মামাতো দিদির সঙ্গে মেজোমামার ছেলেকে ফোঁটা দিত। বিয়ের পর সেই যে, ডালটনগঞ্জে এসেছে তারপর থেকে মামা-মামিরাও দু-একটা চিঠিতে ছাড়া আর খোঁজ নেননি। দীপিতার শ্বশুরবাড়ি থেকেওসে কারণেই দীপিতার মামাতো ভাইকে কখনো ভাইফোঁটাতে আসতে বলা হয়নি।

দীপিতাদের মাতৃকুল বরিশালের। সেখানে ‘জামাইষষ্ঠী’ ব্যাপারটা নেই নাকি। সেই কারণে প্রতিবছর জামাইষষ্ঠী এলেই দীপিতাকে তার শাশুড়ির কাছে নতুন করে কথা শুনতে হয়। তার স্বামী অমল অবশ্য নিজে কিছু বলে না। প্রথম প্রথম ঠাট্টা করত। কিন্তু মনে কোনো দুঃখ রাখেনি। সে দিক দিয়ে মানুষটা ভালোই।

যে-মেয়ে শিশুকাল থেকেই আশ্রিতার মতো মানুষ হয়েছে মামাবাড়িতে, তার এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশারও ছিল না। অন্যকিছুর জন্যে শূন্যতাও বোধ করে না দীপিতা আর কিছুমাত্র। একমাত্র সাংস্কৃতিক-সাংগীতিক পরিবেশের অভাবটা ছাড়া।

কে জানে! সত্যিই কি করে না?

কলকাতাতে থাকাকালীন, স্কুল-কলেজের দিনগুলোতে একটা মুক্ত হাওয়ার মধ্যে কাটিয়েছিল। সাহিত্য, গান, নাটক-টাটক সম্বন্ধে একটা তীব্র উৎসাহ ছিল। পঁচিশে বৈশাখে জোড়াসাঁকোতে এবং রবীন্দ্রসদনে যেতই। দোলে অথবা পৌষোৎসব দু-একবার শান্তিনিকেতনেও গেছে বন্ধুদের সঙ্গে ও বড়োমামার মেয়েদের সঙ্গে। তবে শেষ গেছে, বছর দশেক আগে। বড়োমামা বলতেন, কলকাতার যত অশিক্ষিত বড়োলোক সব গিয়ে বাড়ি করেছে এখন শান্তিনিকেতনে। জায়গাটা একটা অশান্তিনিকেতন হয়ে গেছে। এ ভিড়ে আর গিয়ে দরকার নেই।

দীপিতা, ডালটনগঞ্জের নয়াটোলিতে তার শ্বশুরবাড়ির একতলার বারান্দাতে দাঁড়িয়েছিল। বাড়ির সামনে বাগান মতো আছে। বড়ো বড়ো পাঁচটি ইউক্যালিপটাস গাছ। গেটের দু-পাশে দু-টি কৃষ্ণচূড়া। এখন ফুল নেই অবশ্য। মস্ত বড়ো গেট-এর ফাঁক দিয়ে লাল মোরামের পথটা দেখা যায় স্টেশনের দিক থেকে এসে কাছারির দিকে চলে গেছে। তা দিয়ে সাইকেল রিকশা, সাইকেল, অটো ও ক্কচিৎ গাড়িও যায়। বিচ্ছিরি শব্দ করে মোটর সাইকেল বা স্কুটারও। মারুতি গাড়িও যায়, কিন্তু মারুতির ইঞ্জিনের কোনো শব্দই শোনা যায় না। হঠাৎ দেখা যায় যে, চলে গেল। গেট পেরিয়ে গেলেই দেখা যায় শুধু।

এই পথটা, বলতে গেলে প্রাইভেট। তবে শর্টকাট করার জন্যে অনেকেই এই পথে যাওয়া-আসা করে। এই ফাঁক দিয়ে দেখা নয়াটোলির এই পথটুকুই বলতে গেলে দীপিতার সঙ্গে বাইরের জগতের একমাত্র যোগাযোগ। মাঝে মাঝেই নিজেকে ওর বন্দিনি বলে মনে হয়।

এখন বেলা সোয়া চারটে বাজে। আজ রবিবার। নানারকম পদ রান্না হয় বাড়িতে। শাশুড়ির নির্দেশে একটি বা দুটি পদ দীপিতারও রান্না করতে হয়। বাড়িতে মানুষ খুব বেশি নেই। শ্বশুর, শাশুড়ি, তার স্বামী অমল। দেওরেরা কমল এবং বিমল। একমাত্র ননদ সিমলি। রান্নার জন্যে বিহারি ঠাকুর আছে, পাঁড়ে। বহুদিনকার লোক। শাশুড়ির জন্যে একমাত্র আয়া আছে। সুরাতিয়া। তার ছেলে ভিখু বাড়ির সকলের ফাইফরমায়েশ খাটে। শ্বশুরমশায়ের খাস-চাকর কাম-ড্রাইভার সুখরাম। সে বাড়িতেই থাকে। শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকে সে। শীতকালে রোদে বসিয়ে তেল মাখায়, গড়গড়ায় তামাক সাজে, শোয়ার আগে পা টিপে দেয়, ব্যাঙ্কে যায় চেক জমা দিতে বা টাকা তুলতে।

শ্বশুরমশায়ের গোয়েন্দাও বটে সুখরাম। সে থাকে গ্যারাজের পাশের ঘরে। বাড়িতেই খায়। তার দেশ লোহারডাগাতে। বয়স দীপিতার স্বামী অমলের-ই মতো। লোকটার চোখের চাউনি মোটে ভালো লাগে না দীপিতার প্রথম দিন থেকেই। যথেষ্ট বয়স হওয়া সত্ত্বেও সুখরাম বিয়ে করেনি। বাড়িতে নাকি মা আছে শুধু। ছুটিছাটাও নেয় না। বছরে সাতদিন ছুটি নেয় ছট পরবের সময়ে। বাসে করে চলে যায় লোহারডাগা। আবার ঠিক সময়মতো ফিরে আসে।

সুখরাম নাকি কথার খেলাপ করেনি কোনোদিনও। সেইজন্যেই দীপিতার শ্বশুর ব্রজেন কর মশায় তাকে অত পছন্দ করেন।

আজ সকালে একচোট বৃষ্টি হয়ে গেছে। ডালটনগঞ্জে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই দেখছে প্রতিবছর-ই দেওয়ালির পরে হয়। এরপর-ই শীত নামবে জব্বর। এই সময়ের রোদটাও মিষ্টি লাগে। এখানে গরমের সময়ে যেমন গরম, শীতের সময়েও তেমনি শীত।

ঘরে অমল ঘুমোচ্ছে। দীপিতাও ওর সঙ্গেই ছিল। আলতো করে নিজের কোমর থেকে অমলের বাঁ-হাতটা নামিয়ে, শাড়ি-ব্লাউজ ঠিক করে নিয়ে বারান্দাতে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে দীপিতা।

সপ্তাহে মাত্র এই একটা দিন-ই অমল দিনেরবেলা বাড়ি থাকে। তিরিশে জুন থেকে একতিরিশে অক্টোবর পর্যন্ত জঙ্গলের কাজ বন্ধ থাকে। দেওয়ালির পরেই কাজ আরম্ভ হয়। পয়লা নভেম্বর থেকে সব জঙ্গল খুলে গেছে। এখন অমলকে ও আরও কম পাবে কাছে। কাঠের গুদাম, চেরাইকল, বাঁশের ডিপো, ছড়িয়ে আছে, ওর শ্বশুরমশায়ের। ব্যাবসা প্রায় দু শো বর্গকিমি এলাকা জুড়ে। বছরভর কাজের সঙ্গে জঙ্গলের ওইসব কাজও দেখতে হবে অমলের উপর। দীপিতার দেওরেরা অনেক-ই ছোটো অমলের চেয়ে। একজন ক্লাস নাইনে পড়ে, অন্যজন ক্লাস এইটে। সবে। শ্বশুরমশাইও আর কাজ তেমন দেখেন না। পুরোনো কর্মচারী আছেন দু-তিনজন। তাঁদের-ই সাহায্যে অমল-ই পুরো ব্যাবসা দেখে এখন।

সারাদিন মন খুলে কথা বলার মতো কারওকেই পায় না দীপিতা। একমাত্র ননদ সিমলি নামধারী কলেজে পড়ে। মেয়েটা ভালো। কিন্তু পড়াশুনা, মাস্টারমশাই এবং বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তা ছাড়া শাশুড়ি পছন্দ করে না সিমলি বেশি সময় দীপিতার সঙ্গে কাটাক। মাঝে মাঝে পাশের বাড়ি, বিশ্বাসবাড়িতে যায়। সে, বাড়ির ছেলে ভোঁদাই অমলের চেয়ে একটু ছোটো। ভালো গজল গায় সে। তার মা এবং এক বিধবা পিসিই আছেন শুধু বাড়িতে। একমাত্র দিদির বিয়ে হয়েছে বেনারসে। তার নাম বাণী। সে মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি এলে বেশভালো লাগে দীপিতার। দীপিতাকে খুবই ভালোবাসেন ওঁরা। সাহিত্য, গান-বাজনা, সিনেমা, নাটকের আলোচনা হয় একটু। ওর গান শুনতেও ভালোবাসেন ওঁরা। দীপিতা যে, একসময়ে ভালো গান গাইত সে-কথাআজ মনে পর্যন্ত পড়ে না। তবে গান যার মধ্যে আছে, তার মধ্যে তা কচুরিপানার-ই মতো থাকে। মরেও মরতে চায় না।

দীপিতার শ্বশুরবাড়ি, কর-বাড়িতে গান গাওয়া মানা। বিয়ের পরে পরে কখনো-কখনো স্নানঘরে আনমনে গান গেয়ে উঠত দীপিতা। শাশুড়ি একদিন বলে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর আয়া সুরাতিয়াকে দিয়ে, এটা বাইজি-বাড়ি নয়। এখানে গান-টান না গাইলেই ভালো।

স্নানঘরের দরজাতে ধাক্কা দিয়ে সুরাতিয়া শাশুড়ির সেই আদেশ জারি করেছিল।

মরমে মরে গেছিল দীপিতা।

দীপিতা জানে না, কেন তার শ্বশুরমশায় কলকাতা থেকে তাকেই পছন্দ করে ছেলের বউ করে আনলেন তার পটভূমি জানা সত্ত্বেও। আর বড়োমামাই বা কী করে তাকে এমনভাবে এতদূরে নির্বাসন দিলেন! মেজোমামা যদিও আলাদা থাকেন পাকপাড়াতে, তিনিও তো কোনো আপত্তি করলেন না। ওর শ্বশুরবাড়ির ওপরে যত-না রাগ হয় দীপিতার, তার চেয়ে অনেক বেশি অভিমান হয় মামাদের ওপরে, বিশেষ করে বড়োমামার ওপরে। হাত-পা বেঁধে জলে ছুঁড়ে দেওয়ার-ই মতো করে তাঁরা বিসর্জন দিয়েছেন দীপিতাকে। বিয়ে, তাই দিতে পারলেন এমন ঘরে। আগে জানলে দীপিতা কোথাও পালিয়ে যেত। আত্মহত্যা করত। অমল মানুষটা যদিও খারাপ নয়, তাকে তার মতন করে ভালোও বাসে, কিন্তু ভালোবাসা জিনিসটা দু-জনের। একা একজনের ভূমিকা ধর্তব্য নয়। তাই দীপিতার প্রতিমুহূর্তেই মনে হয় এক জেলখানার কয়েদি সে।

ভালোমানুষ হওয়াটাই তো মানুষের একমাত্র গুণ নয়। অমলের মধ্যে কোনো রস-কষ নেই। সাহিত্য পড়েনি কোনোদিন। গান ভালোবাসে না। এক হাতে ক্যালকুলেটার আর অন্য হাতে নস্যির ডিবে নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়, তার বাবার সাম্রাজ্য রক্ষার জন্যে। নস্যি দু-চোখে দেখতে পারে না দীপিতা ছেলেবেলা থেকে। অমল দীপিতাকে যখন আদর করে, তাও করে ব্যাবসা করার-ই মতো করে, তড়িঘড়ি, তখন অমলের মুখ তার মুখের কাছে এলেই নস্যির গন্ধে দীপিতার বমি পেয়ে যায়।

বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়ে তার চোখ দুটো ঝাঁপসা হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝেই এমন হয়।

ওকি পাগল হয়ে যাবে? ভাবে দীপিতা। গুজরাটি চম্পকলাল শাহ, বিড়িপাতা কারবারির নতুন চারতলা বাড়ি থেকে খুব জোরে টিভি-তে হিন্দি সিনেমার আওয়াজ ভেসে আসছে। ওরা মাঝে মাঝে নানারকম আচার পাঠায় দীপিতাকে। ওদের বাড়িতেও দীপিতার সমবয়সি একটি বউ আছে। নাম নভনীত। সেও থাকত কলকাতাতেই। ভবানীপুরে। তাকেও মাঝে মাঝে তিনতলার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীপিতা। ওর মনে হয়, ও-ও দীপিতার মতোই দুঃখী। নভনীত কি কোনোদিন তিনতলার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পড়বে নীচের রাস্তায়? ভাবলেও শিউরে ওঠে দীপিতা ভয়ে। বুঝতে পারে না, ভয়টা নভনীতের জন্যে, না নিজের-ই জন্যে?

চম্পকলালদের একজন মুহুরি আছে, তার মান পোপটলাল। সে গদিঘরের পাশে একতলার একটি ঘরে থাকে। দীপিতাকে বারান্দাতে দেখলেই জানলার সামনে এসে দাঁড়ায় পোপটলাল। লোকটা খুব-ই অসভ্য আছে। একদিন ধুতির খুঁট তুলে দীপিতাকে দেখিয়েছিল। যদিও অতদূর থেকে দেখা কিছুই যায় না। আর দেখাবার আছেই বা কী ছাই পুরুষদের! কতরকমের বিকৃতিই যে, থাকে মানুষের! রাগে গনগন করতে করতে দীপিতা ভেতরে চলে আসে, পোপটলাল জানলার কাছে এসে দাঁড়ালেই। কিন্তু ভয়ে কারওকেই কিছু বলতে পারে না। যেমন তার শ্বশুরবাড়ি! শাশুড়ি অন্নদা ঠাকুরানি হয়তো বলতেন, তুমি দেখতে চাও, তাই লোকে দেখায়।

ছিঃ ছি! ভাবলেও গা ঘিনঘিন করে দীপিতার। এই যুগে এমন শ্বশুরবাড়িও হয় কারও? বরানগরে টবিন রোডের কাছে ছিল ওর বড়োমামার বাড়ি। মামাবাড়ির পরিবেশ আর এই পরিবেশের মধ্যে কোনোই মিল নেই। একমাত্র মেয়ে খুঁটিকে ও কী করে, যে মানুষ করে তুলবে এই পরিবেশে তা ভেবেই পায় না দীপিতা। ভাবতে ভাবতে মাথা ধরে যায়। তবে বড়োমামার বাড়ির পরিবেশের কথা ভেবেই বা লাভ কী? বড়োমামা তো সব জেনেশুনেই এমন করেছেন।

মেয়ের ডাক নাম রেখেছিল ‘কারো’। দীপিতার ভারি পছন্দসই নাম। বিহারের সারাণ্ডার জঙ্গলে তিনটি নদী আছে, কোয়েল, কারো, কয়না।

কিন্তু শ্বাশুড়ি নাতনিকে ডাকেন পুঁটি বলে। অতএব নাম পুঁটি হয়ে গেছে। ভালো নামও দেবে ঠিক করেছে চারুমতী। কিন্তু শ্বশুরমশাই বলেছেন স্কুলে নাম লেখাবেন সমলেশ্বরী। ওড়িশার সম্বলপুরে নাকি সমলেশ্বরীর মন্দির আছে। মা দুর্গার-ই আর এক নাম সমলেশ্বরী। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের চাকরি ছাড়ার পর সেই জঙ্গলেই প্রথমে কাঠের ঠিকাদারি নিয়ে তাঁর অবস্থা নাকি ফেরে। তাই প্রথম নাতনির নাম রাখতে চান সমলেশ্বরী। আর তিনি চাইলে তাতে আপত্তি করেন এমন মানুষ, ঘাড়ে একাধিক মাথঅলা, এ পরিবারে আর কে আছে?

দীপিতা বলেছিল অমলকে, তোমার বোনের নাম সমলেশ্বরী রাখলেই তো হত।

অমল বলেছিল, সিমলি নামেরও ইতিহাস আছে। সিমলিপালির জঙ্গলের জন্যেই তার নাম রেখেছিলেন সিমলি।

–সিমলিপাল বলো।

দীপিতা বলেছিল।

–না, এ তোমাদের কলকাতার কাছে সিমলিপাল নয়, এ সিমলিপালি, ওড়িশার-ই সম্বলপুর ফরেস্ট ডিভিশনের জুজুমার-এর কাছে। সেই জঙ্গলে, ময়ূরভঞ্জের রাজার ঠিকা নিয়েছিলেন নাকি তিনি। সেই ঠিকা, অতিসামান্য হলেও ব্রজেন কর-এর প্রথম স্বাধীন ব্যাবসা। তার আগে নাকি ওড়িশার বনবিভাগে রেঞ্জারের চাকরি করতেন ব্রজেন কর।

তার শ্বশুরমশায় মানুষটি বড়োঅদ্ভুত ধরনের। মুখ দেখলে মনে হয় অনেক মানুষ খুন করেছেন। এক আশ্চর্য ‘নিষ্ঠুরতা’ সারামুখে আঁকা আছে। খুব কম কথা বলেন। প্রয়োজনে এবং তাঁর মতের বিরুদ্ধাচরণ করলে, তাকে তো বটেই এমনকী নিজের ছেলে অমলকেও তিনি সম্ভবত খুন করতে পারেন। কোনো ব্যাপারে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা তো দূরস্থান, বিরুদ্ধাচরণ করার কথা মনে আনার কথা ভাবলেও দীপিতার রক্ত হিম হয়ে আসে।

ব্ৰজেনবাবুর কোনো বন্ধুবান্ধবও নেই। লোকমুখে শুনেছেন যে, গাড়োয়াতে তাঁর এক মুসলমান রক্ষিতা আছে। সে নাকি দীপিতার-ই বয়সি। এই কথা ভাবতেও ওর ঘেন্না করে। আগে সেই মেয়েটির মাও ছিল তাঁর রক্ষিতা। প্রতি শনিবার খাওয়া-দাওয়ার পরে ড্রাইভার সুখরামকে নিয়ে গাড়িতে করে তিনি বেরিয়ে যান। ফিরে আসেন রবিবার সকালে। দশটা সাড়ে দশটাতে। পাঁঠার মাংস সঙ্গে নিয়ে আসেন। গাড়োয়ার পাঁঠার মাংস নাকি খুব ভালো।

তার শাশুড়ি অন্নদাদেবী, যিনি দীপিতার সঙ্গে অকারণেই প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার করেন, তিনিও হয়তো শ্বশুরমশাইকে দীপিতা নিজে যেমন ভয় পায়, তেমন-ই ভয় পান। নানা হীনম্মন্যতা থেকেই হয়তো শাশুড়ির স্বভাবে এমন বিকৃতি এসেছে। কে জানে!

ভালো-খাওয়া, ভালো-পরা, বড়লোকের বাড়ির বউ হওয়ার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ও জাগতিক সুখ হয়তো আছে কিন্তু এমন ভয়ের জীবন, বন্দিদশার জীবন কার কাটাতে ভালো লাগে!

অন্ধকার প্রায় হয়ে এল। ভিখু চা নিয়ে এল দোতলা থেকে। বানানো চা খেতে বিচ্ছিরি লাগে দীপিতার। নিজের পছন্দমতো দুধ, চিনি, পছন্দমতো পাতলা লিকার না হলে চা খেয়ে কোনোদিনও আনন্দ পায়নি। বিয়ের পর পর আলাদা করে টি-পট-এ চা, মিল্ক পট-এ দুধ এবং সুগার পট-এ চিনি আনতে বলাতে শাশুড়ি বলেছিলেন, বউমা! এ বাড়িতে যে-নিয়ম চলে আসছে সেই নিয়ম-ই চলবে। তোমার জন্যে নতুন কোনো নিয়ম চালু হবে না।

এমন মানসিক অত্যাচারের মধ্যে বাঁচা যায় না। এত এবং এতরকম অত্যাচার-ই যদি করবেন এঁরা দীপিতার ওপরে, তবে অত ঢং করে বড়োছেলের বউ হিসেবে কলকাতা থেকে এই সুদূর পালামৌতে ওকে নিয়ে এলেন কেন? বারে বারেই গা-রিরি করে ওঠে বড়োমামা ও বড়োমামির ওপরে। কোনো খোঁজখবর নিয়েই ওঁরা…। দীপিতার মনে হয়, ওর প্রতি তাঁদের ভালোবাসাটা ছিল মুসলমানের মুরগি পোষার-ই মতো। অথচ ওঁরা ছাড়া দীপিতার ‘আপনজন’ বলতে তো আর কেউ-ই ছিলেন না। বড়োই অভিমান হয় ওঁদের ওপরে। ওঁদের ভালোবাসাটা কি ভড়ং ছিল, কিছুই বুঝতে পারে না দীপি। ভাবলে মাথার মধ্যে যন্ত্রণা হয়। দু-চোখ জলে ভরে আসে।

বারান্দা থেকেই ভিখুর হাত থেকে চায়ের কাপ দুটো নিয়ে ঘরে গেল দীপিতা। চা দিয়ে, অমলকে তুলে দিল।

বছরের এই সময় থেকে শীতের শেষ অবধি ডালটনগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কোয়েল নদীর পাশে অনেকে বেড়াতে যান। তারপর বেলোয়াটিকার এ প্রকাশের দোকানে ফুচকা খেতে যান। প্রকাশের দোকানের কাছাকাছি ভেলপুরি, বাটাটাপুরি, পোসা, ইডলি এসবও বিক্রি করে অনেকেই। সকলেই যার যার সাইকেল-ভ্যান নিয়ে আসে। তার ওপরেই দোকান। তাদের মধ্যেই বাল-বিধবা বাঙালি-বৃদ্ধা কাত্যায়নী মাসিও বসে পাটিসাপটা, ক্ষীরের পুলি, নারকোলের তক্তি এসব নিয়ে। কাত্যায়নী মাসি অবশ্য নয়াটোলির সব বাড়িতেই আসে।

কাত্যায়নীর সাইকেল-ভ্যান নেই। এক কানা ভাইপো আছে। তার নাম বিটকেল। এই বিটকেল আবার ভোঁদাই-এর খিদমদগার। যখন পিসির কাজ থাকে না তখন সে ভোঁদাই-এর ফাইফরমাশ খাটে। ওকে খুব স্নেহ করে ভোঁদাই। প্রয়োজন না থাকলেও কাত্যায়নী মাসির কাছ থেকে জিনিস কিনে বিশ্বাস বাড়ির ভোঁদাই অন্যদের বিলিয়ে দেয়। ও বলে, ভিক্ষে তো চায় না। মাসির আত্মসম্মান জ্ঞান আছে, অভাব যতই থাক-না-কেন।

বিটকেল-ই মাসির অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-কুড়ি সব বয়ে নিয়ে যায়। পিঠে তো গরম করতে হয় না, তাই সুবিধে আছে। পাছে গরমে পিঠেগুলো খারাপ হয়ে যায়, তাই বরফ কল থেকে এক চাঙড় বরফ কিনে সেইসব হাঁড়ি-কুড়ি কাত্যায়নী বরফের ওপর বসিয়ে রাখে। অবাঙালিরাই বেশি কেনে কাত্যায়নীর জিনিস। বাঙালিরা কখনো-কখনো, মুখ বদলাবার জন্য কিনে আগে মিষ্টি খেয়ে তারও পরে বুধিয়ার তেজপাতা-টেজপাতা দেওয়া সুগন্ধি গরম গোরখপুরি চা খায়। প্রবাসী বাঙালিরা এখনও বাড়িতে মিষ্টি-টিষ্টি বানান নানারকম। তাঁরা কলকাতার বাঙালিদের মতো অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান হয়ে যাননি। খুব-ই কষ্ট করে হলেও বাঙালিয়ানা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন।

বাঙালিরও যে, অনেক ভালো ভালো খাবার-দাবার, রান্নাবান্না ছিল, তা কলকাতার বাঙালিরাই বরং ভুলে গেছেন। বিহারের পালামৌ জেলার এই সদর শহর ডালটনগঞ্জের মুষ্টিমেয় বাঙালিরা যে, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন আপ্রাণ চেষ্টাতে, একথা অস্বীকার করা যায় না।

দীপিতা বলল, তার স্বামী অমলকে, চা খাওয়া হলে, অ্যাই নিয়ে যাবে নদীর পারে আমাকে একটু ফুচকা খাওয়াতে? তারপরে প্রকাশের দোকানে? চলো না গো!

তারপর বলল, জিপটা তো একমাত্র রবিবারেই বাড়িতে থাকে। তা আমি যে, মেয়েটাকে নিয়ে একটু কোথাও যাব, তা কি হবে? নিজেও বাড়ি থেকে বেরোবে না, আমাকেও বেরোতে দেবে না। অদ্ভুত পুরুষমানুষ তুমি! তাও যদি একটা ড্রাইভার থাকত তোমার জিপের, তাহলেও না-হয় হত!

–ড্রাইভার কোথায় পাব? আমি-ই ড্রাইভার, আমি-ই হেল্পার, আমি-ই মেকানিক। থাকলে তো ভালোই হত, জঙ্গলের পথেঘাটে অনেক উপকারে লাগত। যদি একজন হেল্পারও থাকত তাহলে বুঝতাম। আমার ইচ্ছেতে তো কিছু হবে না। তুমি তো সব-ই জানো।

–জানি বলেই তো বলি যে, তুমি পুরুষমানুষ নও।

তারপর বলল অমল, পাশের বাড়ির ভোঁদাইকে নিয়ে যাও-না। ওই তো টেবিলের ওপরে জিপের চাবিটা পড়ে আছে। আমি আর একটু গড়িয়ে নিই।

–ছেলেটির ভালো নামটি তো চমৎকার। অনিকেত। তোমরা সকলেই ওঁকে ভোঁদাই বলে ডাকো কেন বলো তো?

–বিশ্বাস কাকার আদরের রকম-ই তো ওরকম ছিল। আমরা কী করব? একমাত্র ছেলেকে আদর করে ডাকতেন ভোঁদাই। সেই শিশুকাল থেকে। তাই অমন চালাক-চতুর চৌকশ ছেলেও মুখে মুখে ভোঁদাই হয়ে গেছে সকলের কাছেই।

-এটা অন্যায়।

–যাকে ওই নামে ডাকা হয় তার আপত্তি না থাকলে তোমার এত আপত্তির কী কারণ?

–সকলের বরেরাই তাদের স্ত্রীদের নিয়ে যায় আর আমাকে পাশের বাড়ির ভোঁদাইয়ের সঙ্গে কেন যেতে হবে? লোকে কী বলবে! বাইরের লোকের কথা ছেড়েই দিলাম। তোমার মা-বাবা? তাঁরাও আড়ালে অনেক কিছুই বলেন। তা ছাড়া তোমার সাঙাত ভোঁদাই তো আর সত্যি সত্যিই ভোঁদাই নয়। সে বেশ বুদ্ধিমান-ই।

–কেন? একথা বলছ কেন? বুদ্ধিমান হওয়া কি খারাপ?

–না, তা নয়। তবে এসব ব্যাপারে তোমার পক্ষে বোকাদের ওপর নির্ভর করাই ভালো।

–কেন? ও কি তোমাকে কিছু…

–না, না, সেসব কিছু নয়। তবে কোনোদিন তো কিছু হলেও হতে পারে। এতখানি উদার হওয়া ভালো না। পুরুষের জাত-ই তো! তোমরা পুরুষেরা সবাই হনুমানের চেয়েও খারাপ।

অমল বলল, অমন করে বাইরের কারও সামনে আবার বলে বোসো না।

-কী বলব?

বি জে পি-র জন্যে এখন গোরু আর হনুমান সম্বন্ধে সবসময়ে মুখ সামলে কথা বলবে। কখন কার বিশ্বাসে আঘাত লাগে, কে বলতে পারে? জানোই তো যে, পবন-পুত্র হনুমানকে এখানে সকলেই দেবতাজ্ঞানে দেখে। এ তো তোমাদের কলকাতা নয়!

–তা হয়তো হবে। কিন্তু জানো তো? আমি সেদিন দিয়েছি হনুমানের শ্রাদ্ধ করে।

-হনুমানের শ্রাদ্ধ! কী করে? কেন করতে গেলে? কী সর্বনাশ!

-আরে বলো কেন? যখন-তখন পেছনের উঠোনের পাঁচিল টপকে লাফিয়ে এসে উঠোনে পড়ে দুড়দাড় করবে, একে-তাকে চড়-থাপ্পড় মারবে। মেয়েদের শাড়ি ধরে টানবে। গত সপ্তাহে তো একদিন সিমলিকেও জড়িয়ে ধরেছিল। মেয়েটা ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছিল। রায়দের বাড়ির মিনু বলছিল, জিরাডিয়ার এক অল্পবয়সি নতুন বউকে নাকি একটা ধেড়ে হনুমান ধর্ষণ করেছে সেদিন।

-আহা! কেষ্টর জীব। রামচন্দ্রর। করেছে না-হয় করেছে। তার ধেড়ে বর তাকে ধর্ষণ করলে দোষ নেই, যত দোষ ওই ধেড়ে হনুমানের-ই!

অমল বলল।

–তোমরা তো হনুমানদের দলেই ছিলে এবং আছ চিরদিন-ই।

দীপিতা বলল, কপট রাগের সঙ্গে।

কালেভদ্রে রবিবারের দুপুরে বড়ো আদর করে অমল দীপিতাকে। তবে ব্যাপারটা চিরদিন-ই একপক্ষের-ই একচেটে। দীপিতার ভালো লাগা মন্দ লাগাটা অবান্তর। শব-এর মতো শবাসনে শুয়ে অমলকে সবকিছু করতে দেয়। হনুমানের সঙ্গে সত্যিই কোনো তফাত নেই অমলের। দীপিতা ভাবে, সব পুরুষ-ই কি এরকমই? তবে ব্যাপারটার পরে শরীরটা ছেড়ে দেয়। আলসেমি লাগে। ঘুম পায়। তাই ঘুমোয় ও।

দিবানিদ্রার পরে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে অমল বলল, হনুমানের শ্রাদ্ধটা কী করলে শুনি?

-আরে! বৈদ্যনাথ দাওয়াখানার কজ-হার খান-না বাবা!

দীপিতা বলল।

–বাবা?

–হ্যাঁ-এ-এ। তোমার বাবা।

–আরে তোমার বাবা বলার কী দরকার? হ্যাঁ। বাবা তো খান-ই রোজ রাতে শোবার সময়ে। তোমার নিজের বাবা তো তোমার শিশুকালেই গত হয়েছেন। শুধু ‘বাবা’ বলতে বুঝি ইচ্ছে করে না?

দীপিতা উত্তর না দিয়ে ভাবছিল তার বাবার যে, স্মৃতিটুকু তার মনে দৃঢ়বদ্ধ আছে তার সঙ্গে ব্রজেন কর মশাইকে যে, একেবারেই মেলানো যায় না। মরে গেলেও শ্বশুরমশায়কে ও বাবা বলে ডাকতে পারবে না।

-এখন বাবার ব্যাখ্যা না করে হনুমানের ব্যাপারটা বলো।

স্বভাব-অধৈর্য অমল, বলল তার স্ত্রী দীপিতাকে।

ভিখুকে দিয়ে বড়ো বড়ো একছড়া মর্তমান কলা আনিয়ে খোসা আধখানা করে ছাড়িয়ে তার গায়ে ফুটো করে চামচ-চামচ কজ-হার তারমধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে খোসাতে হালকা করে ফেভিকল লাগিয়ে এমন করে সেঁটে দিয়েছিলাম যে, হনুমান তো দূরস্থান, রামচন্দ্রেরও সাধ্য ছিল না যে, কারসাজি ধরতে পারেন।

-তারপর?

-তারপর আর কী? হনুমান বাবাজি তো হুড়ম-দাড়ম করে পাঁচিলের ওপর থেকে গোলকিপারের মতো বডি-থ্রো মেরে পুরো কাঁদি নিয়ে লোপাট।

–তারপর?

–তারপরের দিনে তার অবস্থা যদি দেখতে!

–কীরকম?

–সে বড় করুণ অবস্থা। উঠোনের ও-পাশের বড়ো সাদাফুলের গাছটার এডালে ওডালে একবার দাঁড়ায় তো আর একবার বসে, গালে হাত দিয়ে শুয়ে থাকে, একেবারে চলচ্ছক্তিহীন, সারাদিন। ওই গাছটাতেই ওর আস্তানা ছিল কিনা!

-তারপরে?

–তারপর থেকেই এ-তল্লাট ছেড়েছে। আর একদিনও আসেনি। প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেল।

-বুঝবে। যেদিন তোমাকে ধর্ষণ করে এর প্রতিশোধ নেবে। ‘হনুমান’ বলে কথা।

অমল বলল।

দীপিতা মুখে কিছুই বলল না। কারণ, সব কথা মুখে বলার নয়। যেসব স্বামী তাদের স্ত্রীদের শুধু ধর্ষণ-ই করে, আদর কী করে করতে হয়, সোহাগ কাকে বলে, শৃঙ্গার কী? সে সম্বন্ধে যাদের কোনো ধারণাই নেই, যারা স্ত্রীর শরীরকে জমিদারির অঙ্গ বলে মনে করে, সেই শরীরকে যন্ত্রের মতো কর্ষণ করে, সেই স্ত্রীকে হনুমানেই ধর্ষণ করল না অন্য কেউ করল তাতে স্বামীর কী?

মাঝে মাঝে অমল স্বগতোক্তি করে, বুড়ো কি আর বয়সে হয়েছি! জীবন-ই বুড়ো করে দিল। এত পরিশ্রম কোনো মানুষের সহ্য হয়? আমার শরীরটা তো বুড়ো হয়েইছে, মনটাও বুড়িয়ে গেছে একেবারেই। কিছুতেই আর আনন্দ পাই না। এত বড়ো আর এত ছড়ানো ব্যাবসা। একা হাতে দেখা কি সম্ভব? বাবা তো…কমল আর বিমল যে, কবে এসে ব্যাবসাতে বসবে! তখন আমি একটু রিলিফ পাব।

–কেন? বাবা তো রোজ-ই অফিসে যান। বাবা কিছু দেখেন না?

দীপিতা জিজ্ঞেস করেছিল।

-বাবা তো যান একবার সন্ধের আগে আগে। হিসেবটা দেখতে যান। কত বাকি পড়ল, কত আদায় হল। মুহুরি জিতেনবাবুর সঙ্গে বসেন। কত এক নম্বরে দেখাবেন, কত দু-নম্বরে করবেন সেসব। চেকের পেমেন্ট তো দেখাতেই হয়। যা লাভ হয় ব্যাবসা থেকে তার দশভাগও তো দেখানো হয় না। টাকা-ফাঁকা গুনে, সঙ্গের থলেতে পুরে বাড়ি নিয়ে আসেন। বাবা এখন এ ছাড়া আর কী করেন? অবশ্য টাকার বদলে সরকার কী দেয়? গরিবদের ভালো করলেও না হয় হত। তবু তো যারা দেয়, তাদের টাকাতেই এতবড়ো দেশ চলে। এটা খারাপ। সরকার যার ভাত খায়, তাকেই কিল মারে। এমনটি হওয়া উচিত নয়।

তারপরেই বলল অমল, এসব কথা তুমি আবার বোলো না যেন কারোকে। মেয়েদের কিছু বলাই বিপদ।

-তা অত যে, টাকা রোজগার হয়, তুমি যে, গাধার মতো উদয়াস্ত খাটো, তা তোমাকে বাবা সেই পাঁচশো টাকাই তো দেন হাতখরচা। তাও তত তোমার একার জন্যে নয়, তোমার আমার পুঁটির তিনজনের সব খরচ-ই তার থেকে চালাতে হয়। তোমাকে দু-নম্বর থেকে কিছু দেন না বাবা?

–পাগল!

মিথ্যে কথা বলল অমল দীপিতাকে। তারপর-ই বলল, বাঃ। মাথার ওপরে ছাদ দিয়েছেন, খেতে দিচ্ছেন, পুজোতে, পয়লা বোশেখে নতুন জামা-কাপড় দিচ্ছেন আমাকে তোমাকে পুঁটিকে। এই তো যথেষ্ট। জিপগাড়ি দিয়েছেন।

–হুঁ:। সে তো কাজ করার জন্যে, তাঁরই ব্যাবসা দেখার জন্যে। জিপগাড়ি ছাড়া দিন রাত বন-জঙ্গলে দাবড়ে বেড়াতে পারতে? অত জায়গার কাজ সামলাতে পারতে একা হাতে? তোমার নিজস্ব কাজে বা আমাদের নিয়ে তো কোথাও-ই যেতে পারো না। তোমার জিপগাড়ি কোনো ব্যক্তিগতকাজে লাগে কি আমাদের? সকাল সাতটাতে বেরিয়ে যাও, আসো রাতন টায়। তার ওপর আজ রাঁচি, কাল পাটনা, পরশু শোনপুর, তার পরদিন হাজারিবাগ, তারও পরদিন মহুয়াডাঁর। তুমি থাকো ক-দিন ডালটনগঞ্জে? একা হাতে পুঁটিকে দেখে, তোমার মা বাবা, দুই ভাই আর বোনের মন জুগিয়ে চলতে আমার দমবন্ধ হয়ে যায়। একটু যে, গল্পের বই পড়ব একটা, তারও উপায় নেই। লাইব্রেরির মেম্বারশিপও ছেড়ে দিতে হল। তোমাদের কোনো কালচার নেই। তোমরা খোট্টা হয়ে গেছ। অবশ্য দোষ সব আমার-ই। বাপ-মরা গরিবের মেয়ে না-হলে কি আর কলকাতা থেকে এই ডালটনগঞ্জে নির্বাসিত হই? সব-ই আমার কপাল।

–কেন? লাইব্রেরি ছেড়ে দিয়েছ কেন?

–আমাকে বই কে এনে দেয়?

–কেন? কমল-বিমলকে বলো না কেন? সিমলিও তো এনে দিতে পারে।

-কমল বিমলের সময় কোথায়? ক্যারাম চ্যাম্পিয়নশিপ, ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ, অষ্টপ্রহর সাইকেল রেস, ভলিবল, ফুটবল, তারপর থিয়েটারের মহড়া। তা ছাড়া…

-তো ওরা পড়ে কখন?

পড়ে না-যে তা নয়, পড়ে। বেশি পড়েই বা কী করবে? তোমার বাবা তো কোনোক্রমে বি.কমটা পাশ করিয়েই ব্যাবসাতে বসাবেন। তোমাকে কি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়তে দিয়েছিলেন? তুমিই তো বলেছ যে, রাঁচির ‘মুখার্জি কোম্পানি তোমাকে আর্টিকেল্ড ক্লার্ক নেওয়ার ব্যাপারে রাজিও হয়ে গেছিলেন। টাকা রোজগার করাটাই তোমাদের পরিবারে সবচেয়ে বড়োগুণ।

অমল হঠাৎ চটে উঠে বলল, ‘পরিবার’ তুলে কথা বলবে না বলে দিচ্ছি।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, আমার কথা ছাড়ো। দশটা গাধা মরে একটা বড়োছেলে জন্মায়। আমার সঙ্গে ওদের কী তুলনা? ওরা তো রাজপুত্র। ওরা বড়োলোকের বেটা। বাবা কেমন ‘বেটা! বেটা’ বলে ওদের আদর করে ডাকেন, শোনো-না? আমি তো বড়োলোকের ‘বেটা’ ছিলাম না। আমি যখন জন্মেছিলাম তখন বাবা তো গরিব, সৎ, সামান্য মাইনের একজন বিট অফিসার। রেড়াখোলের জঙ্গলে তখন পোস্টিং ছিল শুনেছি বাবার।

তারপরে একটু চুপ করে থেকে দীপিতাকে বলল, তোমার দু-একটা কাজ তো ওরা করে দিতে পারে। আমি যখন পরিবারের ব্যাবসাতেই সারাদিন বাইরে বাইরে থাকি।

–কিন্তু আমার যে, ওদের কোনো কাজ করতে বলতেই ইচ্ছে করে না। তাও কমলটার স্বভাবটা ভালো। মিষ্টি ছেলে। যতটুকু করার তা তো ওই করে। বউদি বলে মানেও। বিমলটাকে তো কিছু বলতেই ইচ্ছে করে না। তার ওপরে যে, ক-টা টাকা তুমি আমাকে দাও তা থেকে বিমল প্রায় জোর করেই প্রতি সপ্তাহেই সিনেমা দেখার জন্যে আমার কাছ থেকে টাকা চায়। ওর ভয়ে তোমাকে বলতে পর্যন্ত পারি না। আর ওর যা বন্য স্বভাব, ভয়ে, ওকে নাও করতে পারি না।

–প্রতি সপ্তাহেই সিনেমা দেখে বিমল? বলো কী তুমি? কী সিনেমা দেখে?

–তা আমি কী করে জানব? আমাকে নিয়ে কি একদিনও সিনেমা দেখতে গেছ তুমি?

–আজকাল নাকি সব ভিডিয়ো-পার্লারে থ্রি-এক্স ছবি দেখায়?

চিন্তিত মুখে বলল অমল।

–সেটা কী জিনিস? ‘থ্রি-এক্স’?

–মানে পর্নোগ্রাফিক ছবি আর কী?

–মানে?

–আরে একেবারে উদোম ছবি। নায়ক-নায়িকার গায়ে একটু সুতোও থাকে না। তার ওপর নানারকমের পারভার্সন।

মনে মনে বলল, দেখতে তো ভালোই লাগে। সে নিজেও দেখে মাঝেমধ্যে। তাই জানে।

তারপর হেসে, গলা নামিয়ে বলল, চলো, একদিন আমরাও দেখে আসি।

-আমার দরকার নেই। তুমি দ্যাখো গিয়ে। যেমন ভাই, তেমন-ই তো হবে দাদা। তোমাদের পরিবারের রুচিটাই বিকৃত।

-অ্যাই! আবার! পরিবার তুলে কথা বোলো না। সাবধান! তা ছাড়া ‘রুচি’ ব্যাপারটা চিরদিন-ই ব্যক্তিগত।

-তাই? হবে।

‘সাবধান’ কথাটা এমন করে বলল অমল যে, ভয় পেয়ে গেল দীপিতা।

সেইমুহূর্তে দীপিতার মনে হল যে, সে বিমলের-ই দাদা।

ওর মনে পড়ে গেল বড়োমামা একটা কথা বলতেন, ‘Blood is thicker than water। কথাটা বোধ হয় ঠিক-ই।

-রুচি-ফুচি নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কোথায় পেলাম?

অমল বিরক্তির গলাতে বলল। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর-ই তো বাবা ব্যাবসাতে ঢুকিয়ে দিলেন। ব্যাবসা দেখতে দেখতেই তো কোনোক্রমে বি-কমটা পাশ করলাম। আমি তো চেয়েছিলাম চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ি। বড়ো কোম্পানিতে চাকরি করি পাশ করে। কিন্তু কাঠ, বাঁশ, ওয়াগন, রেক, ঢোলাই, লাদাই, কাটাই, চেরাই, কুলি-কামিন, মেট-মুনশি, এইসব নিয়েই তো কেটে গেল বছরগুলো। বাইশ বছর বয়সে বিয়ে হল। তখন তোমার উনিশ। তারপরে এই পাঁচ বছরেই বুড়ো। বিয়ের পরে পর একবার-ই তোমার বরানগরের বড়োমামার বাড়িতে গিয়ে যা-তিনদিন ছিলাম। তা ছাড়া তো লম্বা ছুটিও পেলাম না একদিনও। সব শখ-ই মরে গেছে এখন। জীবনে আনন্দ বলতে আর কিছুই নেই। প্রতি রবিবার একটু শুয়ে-ঘুমিয়ে গায়ের ব্যথা মারা ছাড়া আর কোনো আনন্দ-ই আমার নেই।

-আর আমার আনন্দ’ বলতে কী আছে?

–কেন? আমি।

-তা আছ। তবে তোমার আনন্দ আরও আছে।

–কীরকম?

–কেন? তোমার মা? হয়তো আরও আছে। যা, আমি জানি না। অমল বলল, মা তো আছেনই। মা তো সকলের-ই থাকে। কিন্তু তুমি আসার পরে মা যেন, আমাকে অনেক-ই দূরে ঠেলে দিয়েছেন। আগের মতো আর ভালোবাসেন না। এখন মায়ের কাছে কমল-বিমল-ই সব।

-আমি তো মা-বাবা-দিদিদের পাঁচ বছর বয়সে-ই হারিয়েছি। তুমি ভাব তাই। কোনো মা-ই কি তাঁর ছেলেকে পর ভাবতে পারেন?

–পারেন। পারেন। ইমরাত খান বলে যে, পুরুষ যখন যার বুকে মুখ রাখে, সে তার-ই বশ হয়। মা জানেন যে…

অদ্ভুত কথা, ঝাঁঝের সঙ্গে বলল দীপিতা।

অমল বলল, জানি না, মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা আমাকে একটি যন্ত্রের মতো ব্যবহার করছেন এবং করে যাবেন তাঁর পরিবারের ভবিষ্যৎ-এর জন্যে, পরিবারের সুরক্ষার জন্যে। এ ছাড়া আমার আর কোনো-ই ভূমিকা নেই। সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে হয়তো আমিও বেকার হয়ে যাব।

–বাবা তোমার কথা তো শতমুখে বলেন। সবসময়েই।

দীপিতা বলল।

-তাই নাকি? কীরকম?

বলেন, অমল-ই তো সব। অমল-ই তো ব্যাবসা দেখে। আমি তো এখন কিছু-ই আর করি না। অমল-ই মালিক।

অমলের মুখ এক কুটিল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেল।

বলল, বাবা তাই বলেন?

-তাই তো বলেন। আমার কাছেই বলেন। বলেন অবশ্য যখন আর কেউই সামনে থাকে না।

–আহা! কী বলেন তা বলো না।

অমলের ব্যবহার ভালো, কাজও সব শিখেই গিয়েছে। খুব খাটতেও পারে। আমার আর কী চিন্তা।

–তাই?

অমল বলল, উত্তেজিত হয়ে বিছানাতে উঠে বসে, মাথার বালিশটাকে কোলের কাছে নিয়ে। তারপরে হেসে বলল, মাই ফাদার ইজ এ গ্রেট ম্যান।

হাসিটা দুর্বোধ্য ঠেকল, দীপিতার চোখে।

একটু চুপ করে থেকে বলল, চলো, লুঙ্গিটা ছেড়ে ধুতিটা পরে নিই।

-কেন? হঠাৎ?

–আজ তোমাকে ফুচকা খাইয়ে-ই আনি প্রকাশের দোকান থেকে। তোমার এতদিনের শখ!

অ্যাম্বাসাডর গাড়ির ড্রাইভার সুখরাম বাড়িতেই থাকে। তবে বাবার অথবা বাবার নির্দেশমতো ডিউটি-ই সে করে। এ-বাড়িতে কারও অধিকার নেই অ্যাম্বাসাডর নিয়ে কোথাওই যাবার। এমনকী মায়েরও নয়। তবে সিমলিকে বাবা কিছু বলেন না। অনেক সময়ে বাবাকে না বলেই সিমলি গাড়ি নিয়ে যায়। দীপিতার শ্বশুরমশাই ব্ৰজেন কর অন্য ধাতুর মানুষ। ডিকটেটর। বাঘ। এক জায়গাতে যে, দু-টি বাঘ থাকতে পারে না কখনো, একথা তিনি প্রায়ই বলে থাকেন।

তবে সুখরাম ড্রাইভার জিপের টায়ার-ফায়ার প্রয়োজনে বদলে দেয়। খারাপ ব্যবহার করে না অমলের সঙ্গে। গ্যারাজে অ্যাম্বাসাডর আর জিপটা পাশাপাশি থাকে।

অমল লুঙ্গি ছেড়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে চাবিটা আর মানিব্যাগটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে জিপটা বের করল গ্যারাজ থেকে। দীপিতা তাড়াতাড়ি শাড়িটা ছেড়ে, মুখে একটু পাউডার বুলিয়ে আর চোখে একটু কাজল দিয়ে নিল। অমল দীপিতাকে তুলল, তুলে লেভেল ক্রশিং-এ আসতেই ভোঁদাই-এর সঙ্গে দেখা। পাশের বাড়ির ভোঁদাই।

ভোঁদাই বলল, গন্ধ-উন্ধ মেখে বউকে সাজিয়ে-গুজিয়ে কোথায় চললে গুরু?

অমল বলল, গুরু হয়তো ছিলাম এককালে। এখন যা দিনকাল পড়েছে, চেলার যা চেকনাই, তাতে বলতে হয় গুরু ‘গুড়’-ই রয়ে গেছে আর চেলা ‘চিনি’ হয়ে গেছে।

তারপর-ই বলল, যাবি নাকি? নদীর ধারে যাচ্ছি। ফুচকা খেতে। তারপর যাব প্রকাশের ওখানে।

-চলো। তুমি বললে গুরু, জাহান্নমেও যাব।

বলেই, দীপিতার গা ঘেঁষে সামনের সিট-এ উঠে বসে পড়ল ভোঁদাই। দীপিতা অমলের দিকে সরে এল। মুখে কিছু বলল না। দীপিতা জানে যে, ভোঁদাই তাকে খুব-ই পছন্দ করে। বেচারি। না হয়, বসল-ই একটু পাশে। দীপিতাও পছন্দ করে ভোঁদাইকে এবং তাদের বাড়ির সকলকে।

দীপিতা কলকাতার সুন্দরী মেয়ে। সুন্দর করে সাজে। সাবলীলভাবে কথা বলে। ভালো গান গায়, ডালটনগঞ্জের মতো শহরে ভোঁদাই-এর মতো অনেক পুরুষ-ই তার কাছে আসতে চায়। এটা বুঝতে পেরে ও খুশি যেমন, তেমন অস্বস্তিও বোধ করে। ভালো লাগার মতো পুরুষ এখানে দেখে কোথায়? তাকে হয়তো অনেকের ভালো লাগতে পারে কিন্তু তার কারোকেই ভালো লাগে না। একমাত্র ভোঁদাইকে ছাড়া। কিন্তু নামটা একেবারে যাচ্ছেতাই। ওর কি কোনো ভালো নাম নেই?

ফেরার পথে রেড়মাতে ভোঁদাই নেমে গেল ঝাণ্ডুরাম-এর পেট্রোল পাম্পে। বলল, একটু আড্ডা মেরে যাই।

ভোঁদাই-এর কোনো অকুপেশন নেই। ওর বাবা, অনাদিবাবুর অবস্থা খুবই ভালো ছিল। লোকমুখেই শুনেছে দীপিতা। তিনি মোটর ভেহিকেলস-এর ইন্সপেক্টর ছিলেন। অন্যান্য ব্যাবসাও ছিল। দু-হাতে পয়সা রোজগার করেছেন। যেমন শুনেছে যে, করেছেন তার শ্বশুর ব্ৰজেন করও, ওড়িশার বন বিভাগে চাকরি করে। এও শুনেছে, ভোঁদাই-এর বাবা মানুষটি খুব-ই ভালো ছিলেন।

সততা মানুষের মস্ত বড়োগুণ, কিন্তু সততা-ই মানুষের একমাত্র গুণ নয়। একজন সৎ মানুষও মানুষ হিসেবে অত্যন্ত খারাপ হতে পারেন আবার অসৎ মানুষও ভালো হতে পারেন। অনাদিবাবু অনেকের জন্যে অনেক-ই করেছেন নাকি। মায়া-দয়া ছিল। এবং প্রতিবেশী হলেও ব্ৰজেন কর-এর সঙ্গে তেমন মাখামাখি ছিল না। গত হয়েছেন বছর সাতেক হল। তা ছাড়া, মানুষটির গান-বাজনা, সাহিত্য এসব বিষয়েও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। নিজে ভালো এসরাজ বাজাতেন।

সব-ই অবশ্য শোনা কথা। দীপিতার বিয়ের আগেই উনি গত হয়েছেন। ভোঁদাইদের জায়গা-জমি আছে লাহোরের দিকে অনেক। কোম্পানির কাগজ-টাগজ ছাড়াও জমি থেকেও আয় খুব-ই ভালো। মঘাই পান, খুশবুদার জর্দা, ভালো গান শোনা, বাংলা সাহিত্য পড়া, ভালো হিন্দি সিনেমা দেখা আর মাঝেমধ্যে ইমরাত খানদের সঙ্গে রাতের চোরা শিকার, এই ই শখ ভোঁদাই-এর। মাঝেমধ্যেই চুরি করে শিকার করা হরিণের বা শম্বরের বা শুয়োরের মাংস পাঠায় ভোঁদাই, অমলদের বাড়িতে। তিতির-বটেরও পাঠায়। ক্কচিৎ মুরগি। তবে দীপিতা বা বাড়ির অন্য কেউ-ই শুয়োরের মাংস খায় না। শুধু অমল খেতে ভালোবাসে। তাই ভোঁদাই, অমলের জন্যে আলাদা করে রান্না করে পাঠায়। কচ্ছপের পিঠ-এর মতোই শুয়োরের নদনদে চর্বি কচকচ করে খেতে খুব ভালোবাসে অমল। তবে দীপিতা এইসব শিকার-করা মাংসের কোনো মাংসই খায় না। বলে, এইসব সুন্দর পাখি, হরিণ এসব কেউ-ই মারে। তা ছাড়া, মারা যখন বেআইনিও, তখন মারা-ই বা কেন?

দীপিতা বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে অমলের এইসব পশুপাখি খাওয়া দেখে আর বলে, তুমি একটি রাক্ষস।

–আমার কী? আমি তো আর মারিনি। অন্যে মেরে খাওয়ালে আমার দোষ কী? তবে কোনোদিন ওরা ধরে পড়লে কিন্তু জেলে যাবে। ইমরাত খান এক সাংঘাতিক চরিত্র। ওকে এড়িয়েই চলে অমল। ভোঁদাই যে, কেন ওর সঙ্গে যায় রাতের শিকারে, জানে না অমল। জীবিকা হিসেবে ইমরাত কী করে তা ঠিক কারোরই জানা নেই। ও নাকি আই. এস. আই এর স্পাই। ওর কাছে নাকি নানারকম আগ্নেয়াস্ত্র আছে। ইমরাত খান সত্যিই বিপজ্জনক মানুষ মনে হয়। তবে ভোঁদাই-এর অন্য কোনো নেশা বা দোষ-ই নেই। কখনো-সখনো একটু মহুয়া বা রাম খায়। বেহেড হয় না কখনোই।

ভোঁদাই-এর চরিত্রটা টু-টিয়ার। ওকে বাইরে দেখে যা মনে হয় ভেতরে ও তা আদৌ নয়। মাঝে মাঝেই, শিশুকাল থেকেই ওকে হেঁয়ালি হেঁয়ালি লাগে।

গত একবছর হল, অমলের কেবল-ই মনে হয় যে, ভোঁদাই দীপিতার প্রেমে পড়েছে। ভোঁদাই-এর মা ও পিসিমা দীপিতাকে খুবই ভালোবাসেন। ওকে ডেকে নিয়ে ওর গান শোনেন। অতুলপ্রসাদ ও রজনীকান্তর গান খুব-ই ভালো গায় দীপিতা। রবীন্দ্রনাথের গানও গায়। গল্পের বইও ধার দেন ওঁরা। কলকাতা থেকে অনেক পত্রপত্রিকা, দিশা-সাহিত্য, ‘তথ্যকেন্দ্র’ নবকল্লোল’, ‘উদ্বোধন’ আসে ওদের বাড়িতে। নানা লেখকের সমগ্র রচনাবলিও আছে কম নয়। তাই ওদের বাড়ির সঙ্গে দীপিতার বেশ মাখামাখি। এই ডালটনগঞ্জের বিহারি পরিবেশে, বিড়িপাতা, লাক্ষা আর বাঁশ-কাঠের কারবারিদের মধ্যে বাংলার সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং বাঙালিআনা শুধু ভোঁদাইদের বাড়িতেই বেঁচে আছে ভোঁদাই-এর মা-পিসিমার-ই জন্যে।

ভোঁদাই এখানকার পাঁকি রোড-এর ছেলেদের কলেজ, জি. এল. এ. কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেছে ইংরেজিতে, অমলের বি.কম. পাশ করার দু-বছর পরে। এখন সে কলেজে এম. এ.-ও পড়া যায়। তখন সে-সুযোগ থাকলে এম. এ. টাও করে নিত। খারাপ ছিল না ভোঁদাই আদৌ পড়াশুনোতে।

এখানে একটা কথা চালু আছে। যদি বহিরাগত কেউ এখানের কারওকে জিজ্ঞাসা করেন, লেখাপড়া কতদূর করা হয়েছে? তখন অন্যজনে বলবে, আমি L.L.P.P.

প্রথম-জন স্বাভাবিক কারণেই ভাববেন LL.P.P. বুঝি কোনো ভারী ডিগ্রিই হবে। কিন্তু আসলে L.L.P.P. ‘লিখ লোড়া, পল পাৰ্বল। অর্থাৎ, শিলনোড়া দিয়ে লেখে আর পড়ার মধ্যে পাথর পড়ার কথা জানে।

ভোঁদাইও অবশ্য অমলের-ই মতো আধা-বিহারি। পালামুর ঠেট উচ্চারণে বাংলা বলে ওরা। যারা কখনো শোনেনি, তাদের কানে আজব ঠেকে। ওরা তবু বলে ‘আমরা বাঙালি হচ্ছি। দুর্গাপুজো করছে, বিড়োয়া-সম্মিলনি, পুজোর পরে থিয়েটার, যাত্রা, কালীপুজো। এখনও কলকাতায় নববর্ষ যতখানি উদ্দীপনার সঙ্গে উদযাপিত না হয়, প্রবাসে তার চেয়ে ঢের বেশি উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। এই প্রজাতি বড়ো নস্টালজিক। পুরোনো শিকড়ের কথা এরা ভুলতে পারেনি। পারবেও না। প্রবাসী বাঙালিরা কলকাতার বাঙালিদের মতো আঁতেল, ঈশ্বর-অবিশ্বাসী, ধর্ম-বিমুখ এবং নিজস্বার্থপরায়ণ হয়ে ওঠেনি। এখনও অনেক-ই ভালোত্ব রয়ে গেছে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে।

তবে আগেকার দিনের মতো গর্ব করার মতো বাঙালি আজকাল প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যেও কম-ই দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গেই দেখা যায় না, তা প্রবাসের দোষ কী?

.

ভোঁদাই জিপ থেকে নেমে যাওয়ার পরে দীপিতা বলল, বছরে হয়তো একটা সন্ধে আমাকে নিয়ে বেরুলে, তবু সঙ্গে ভোঁদাইকে না জোটালে হত না?

কী বলতে চাইল দীপিতা তা ঠিক না বুঝেই অমল বলল, আরে! ছেলেবেলায় ফুটবল খেলেছি কত একসঙ্গে। পাশের বাড়ির পড়শি। ওদের বাড়িতেই তো পড়ে থাকতাম। একটা সময়ে। অনাদি কাকা খুব-ই ভালোবাসতেন আমাকে। বাবাও যেমন ভোঁদাইকে বাসেন। আজকাল ওকেও তো একটুও সময় দিতে পারি না। বিমল-কমল তো আমার চেয়ে দশ এগারো বছরের ছোটো। ওদের সঙ্গে তো বন্ধুত্ব হত না। এখনও হয় না হয়তো আরও বছর পাঁচেক পরে যখন ওরাও আর একটু বড়ো হবে, তখন হবে। কে জানে! হয়তো তখনও হবে না। বন্ধুত্ব হয় মনের মিল, ধ্যান-ধারণার মিল, শখের মিল থাকলে। রক্তের আত্মীয় হলেই কি, কেউ আপসে কারও বন্ধু হতে পারে?

তারপর বলল, তা ছাড়া, ভেবে দ্যাখো, ভোঁদাই-এর মনে তো দুঃখ হতে পারত ওকে যেতে না বললে।

-তোমার কাছে সকলের-ই দাম আছে, সকলের দুঃখর কথাই তুমি ভাবো, শুধু আমার ই কোনো দাম নেই।

-আরে তুমি যে, আমার ওয়াইফ। তুমি তো আমার-ই একটা পোর্শন। তোমার সঙ্গে আমার তফাত কোথায়? তোমার সঙ্গে আর কার তুলনা চলে? কোথায় তুমি কোথায় ভোঁদাই। তুমি বড়ো বোকার মতো কথা বলো আজকাল।

–বোকা তো আমি নিশ্চয়ই।

জিপ থেকে নেমে যাওয়ার আগে নদীর ধার থেকে ফেরার সময়ে ভোঁদাই বলেছিল, পরের শনিবার রাতে আমাদের বাড়িতে পিসিমার ছোটো জা-এর ছেলে আসছে। সে রাঁচিতে হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চাকরি নিয়ে এসেছে। ইঞ্জিনিয়ার ছেলে। কলকাতার। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে খড়গপুরের ‘আই. আই. টি’ থেকে। আগামী শনিবার রাতে তোমাদের দুজনের আমাদের ওখানে যেতে হবে। খেতেও হবে। মা ও পিসিমা বলে দিয়েছেন। সিমলিকেও বলব। কলকাতার ছেলে এসে আমাদের গোল দিয়ে যাবে তা হতে দেওয়া হবে না। আমাদেরও গোলকিপার আছে।

-মানে?

অমল বলেছিল।

-আমরাও টকরাব। সে যদি করারে যায় তো করার করব। দীপিতা বউদি আমাদের ডালটনগঞ্জকে রিপ্রেজেন্ট করবে। তাই কথা হয়েছে। কোন শালা বলে যে, এখানে ভদ্রলোকে থাকে না।

–বলে নাকি কেউ? কে বলে? সে শালার ঘাড়ে ক-টা মাথা?

অমল বলল, হাসতে হাসতে।

 ভোঁদাই বলল, তাদের মাফ করে দাও অমলদা। ‘পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়।

–তিনি কি একা আসছেন? তাঁর স্ত্রী আসবেন না?

দীপিতা শুধিয়েছিল।

–স্ত্রী থাকলে তো আসবেন? দাও না দেখে একটা ভালো মেয়ে। বয়স তো বেশি নয়। আমাদের চেয়ে ছোটো। তোমার বয়সি হবেন, যা শুনেছি।

মেয়ের অভাব কি বাঙালিদের মধ্যে? সস্তা বলতে তো একমাত্র মেয়েরাই।

ভোঁদাই বুঝেছিল যে, কথাটাতে একটু খোঁচা আছে।

দীপিতা বলেছিল, আগে পাত্রকে নিজচোখে দেখি। তারপর ঠিক করে দেব মেয়ে। কঠিন কাজ আর কী?

–দিয়ো তো। মা ও পিসিমাও তোমাকে বলবেন বলেছেন।

এই কথা রইল। তাহলে বিকেল-বিকেল-ই চলে এসো দু-জনে। পুঁটিকেও নিয়ে এসো।

-তোমার পিসিমার ছোটোজায়ের ছেলের নাম কী?

–ভালো নাম জিজ্ঞেস করিনি। ডাক নাম, কাট্টুস।

–কী নাম বললে?

–কাট্টুস।

-–ও মা! ‘কাট্টুস’ মানে কী?

–কারোর-ই ডাকনামের আবার মানে হয় নাকি?

অমল বলল, আছে আছে। ‘কাট্টুস’ একরকমের গাছের নাম। নর্থ বেঙ্গলে হয়। দুবেজি, ডি এফ. ও.-র কাছে শুনেছি। উনি ছিলেন কিছুদিন নর্থ বেঙ্গলের বক্সা ডিভিশনে।

ভোঁদাই বলল, তুমি চেন সে গাছ?

আমি চিনব কী করে? পালাম-রাঁচি-হাজারিবাগে ওসব গাছ নেই।

দীপিতা ভাবছিল, ও চেনে। মানে চিনত একজন কাট্টুসকে। তবে এই কাট্টুস সে কখনোই হতে পারে না। দীপিতার জীবন থেকে সেই কাট্টুস ভো-কাট্টা ঘুড়ির-ই মতো কাট্টুস হয়ে গেছে দীপিতার বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই।

তারপর মুহূর্তের জন্য ভাবল, স্বপ্নে কত কী ঘটে! যদি এই কাট্টুস সেই কাট্টুস হয়। সেও তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত।

দীপিতার সুখ-স্বপ্ন ভেঙে তাকে চমকে দিয়ে ভোঁদাই বলল, বউদি, তিনি নাকি গানও গান। তোমার সামনে গাইলেই মাল ক্যাচ হয়ে যাবে। একটু গলাটাও সেধে রেখো কিন্তু বউদি। দেখো ব্যাংলো-বিহারিরা যেন, পিয়োর কলকাত্তাইয়ার কাছে হেরে না যাই।

দীপিতা কথা না বলে, মুখ টিপে হেসেছিল। তারপর-ই গম্ভীর হয়ে গেছিল।

অমল বলেছিল, মেয়েলি-পুরুষ ছাড়া কেউ গান গায়! ধু…স।

ভোঁদাই হেসে বলেছিল, নিজের গলাতে রামছাগল বেঁধে রেখেছ তাই ও কথা বলছ। বড়ে গুলাম আলি সাহেব বা কালে খাঁ সাহেব কি মেয়েদের মতো দেখতে ছিলেন?

–তারা আবার কারা?

অমল বলল।

সে কথাতে ভোঁদাই এবং দীপিতা দু-জনেই একসঙ্গে জোরে হেসে উঠল।

অমল লজ্জা পেয়ে বলল, হাসবার কী আছে?

ভোঁদাই বলল, তোমার-ই বা লজ্জা পাওয়ার কী আছে? ওঁরা কি বলতে পারতেন পালামতে কতরকম বাঁশ হয়? অথবা কাট্টুস’ মানে কী? সবাই কি সব জানতে পারে? তবে গান-বাজনা ভালো না বেসে, জানতেই পারলে না কী মিস করলে জীবনে।

অমল চুপ করে থাকল।

বাড়িতে ফিরে দীপিতা গ্যারাজের সামনে জিপ থেকে নেমে ভেতরে গেল। অমল বলল, জিপটার হাওয়া চেক করিয়েই আসছি। কাল সকালেই টুটিলাওয়ার কাঠগোলায় যেতে হবে টোড়ি, বাঘড়া-মোড়, সীমারিয়া হয়ে। একেবারে ভোরে বেরোব। ডালটনগঞ্জ থেকে টোড়িই তো সাতান্ন মাইল। উলটোদিকে যেতে গেলে সকালে দেরি হয়ে যাবে। হটাও একটু দেখিয়ে নিতে হবে। মাঝে মাঝেই গোলমাল করছে। লুজ-কানেকশন হয়েছে বোধ হয়।

ঘাড় এলিয়ে, নিরুচ্চারে, ঠিক আছে বলে, দীপিতা যখন ভেতর-বাড়িতে গেল, দেখল ভিখুর মা সুরাতিয়া পুঁটিকে হাতে ধরে নিয়ে দোতলা থেকে নামছে। গম্ভীর মুখে সুরাতিয়া বলল, মা তোমাকে ডেকেছে বহুদিদি। না বলে-কয়ে কোথায় চলে যাও হুট করে?

দীপিতার খুব রাগ হল। সম্ভবত মাস দেড়েক পরে আধ ঘণ্টার জন্যে স্বামীর সঙ্গে বেরিয়েছিল। সে জন্যে…

দোতলাতে উঠতেই শাশুড়ি বললেন, তুমি কি স্বাধীন হয়ে গেছ বউমা। বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে একটু বলেও যেতে পারো না?

হাসিমুখেই দীপিতা বলল, মা! হঠাৎ-ই…

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনার ছেলে তো নিয়ে যায় না কোথাও-ই কোনোদিন। নদীর ধারে গেছিলাম একটু আর প্রকাশের দোকানে…।

–অতিভালো কথা। কিন্তু বাড়িতে তো একটা ছটো ননদ আছে। তার কথা কি মনে পড়ল না একবারও? তাকেও তো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতে! সাধ-আহ্লাদ তো তারও থাকতে পারে। আর আমার মেয়ে কি তোমার মেয়ের আয়া যে, তুমি আহ্লাদ করে বেড়োবে আর আমার মেয়ে তোমার মেয়েকে দেখবে?

গা জ্বালা করে উঠল দীপিতার। দীপিতা জানে যে, সিমলি প্রায় প্রতিসপ্তাহেই শ্বশুরমশাই এর অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে করে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে নদীর ধারে যায়। ফুচকা খেতে, বেড়াতে। মীরচাইয়াতে পিকনিক করতে। কিন্তু সিমলি কোনোদিনও বলেনি যে, বউদি তুমি যাবে? কিন্তু মুখে সেসব কথা কিছুই বলল না। শুধু বলল, পুঁটিকে তো আপনিই ভিখুর মাকে পাঠিয়ে চারটের সময় ওপরে নিয়ে গেছিলেন মা। তাই বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম আপনার কাছেই আছে।

-তুমি তো অনেক কিছুই বুঝতে পারো না বউমা। আর কবে বুঝবে তাও জানি না। তা ছাড়া, আজকাল মুখে মুখে কথাও খুব বলতে শিখেছ দেখছি। দেখেও তো কিছু বুঝতে শিখতে পারতে। তোমার না হয় ছেলেবেলাতে মা চলে গেছিলেন কিন্তু মামিমারাও কি সহবত বলে কিছুই শেখাননি তোমাকে?

এসব কথা এতভাবে শুনেছে দীপিতা যে, এখন আর গায়ে লাগে না। তা ছাড়া, যে মামাবাড়িতে বিয়ের পরে এতবছরে একবারও যায়নি–সেও যেতে চায়নি, তারাও যেতে বলেননি, সেই মামাবাড়ি সম্বন্ধে সব দুর্বলতাও যেন আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে।

কলকাতার মানুষেরা প্রত্যেকে-ই ভীষণ-ই ব্যস্ত থাকেন নিজের কাজ নিয়ে। তাঁদের এসব ফালতু সামাজিকতা করার সময় ও মানসিকতাও নেই। কিন্তু তাঁদের সেই নিরাসক্তির কারণে অসহায় দীপিতার জীবন যে, কত দুর্যোগময় হয়ে উঠেছে, সেকথা তাঁরা যদি জানতেন!

প্রতিবছর-ই শীতে আর জামাইষষ্ঠীর সময়ে শাশুড়ি নিয়মিত কথা শোনান। বলেন, কর্তাকে বলেছিলাম যে, বাঙাল বাড়িতে ছেলের বিয়ে দিয়ো না। তাও আবার বরিশালের বাঙাল! না, জেদ করে তাই দিলেন। বামুনের ডানা-কাটা-পরি মেয়ে পেয়ে তিনি সব ভুলে গেলেন। কবে নাকি তাদের কোন জামাই, জামাইষষ্ঠী খেতে গিয়ে মারা গেছিল সেই থেকে বুদ্ধিমানেরা জামাইষষ্ঠী-ই তুলে দিলেন। এরকম চোখের চামড়াহীন মানুষ হয়-ই বা কী করে কে জানে! জামাইষষ্ঠী নেই বলে কি ভাইফোঁটাও নেই? তোমাদের ভাই নেই বলে? যাদের আছে? তারা বুঝি কোঁচা দুলিয়ে দিদি বা বোনের বাড়ি ভাইফোঁটা নিতে আর খেতে যায় না প্রতিবছর? আশ্চর্য সব নিয়ম, কানুন বাবা। অজীব আদমি।

প্রথম প্রথম, বিহারে বহুদিন বসবাস করা তার শাশুড়ি অন্নদাদেবী যখন বিহারি উচ্চারণে ‘অজীব আদমি’ বাক্যটি দীপিতার পিতৃকুল-মাতৃকুলের মানুষদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতেন তখন ওর মনে হত হিন্দি সিনেমার ডায়ালগ শুনছে বুঝি। এখন আর তা মনে হয় না। ও নিজেও সত্যি সত্যি একজন ‘অজীব আদমি’ হয়ে গিয়ে অন্যের সব অজীবপনা মেনে নিয়েছে। একই কথা, সহস্রবার বললে যে, তার ধার বা ভার কমে যায়, তা কেন যে, দীপিতার শাশুড়ি-মা বোঝেন না, তা জানে না দীপিতা। মাঝে মাঝে নিজেকে অভিশাপ দেয় ও। মাঝে মাঝে নিজের ওপরে, শৈশবেই চলে-যাওয়া মা-বাবার ওপরে, তাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দেওয়া বড়োমামির ওপরে এমন তীব্র অভিমান হয় যে, মনে হয় রাতের বেলা উঠোনের গভীর কুয়োতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু পুঁটির জন্যেই পারে না। ও মরলে তো পুঁটির অবস্থাও ওর নিজের-ই মতো হবে।

কিছুই না-বলে মুখ নীচু করে শাশুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইল দীপিতা। শ্বশুরমশাই দোতলার বারান্দার ইজিচেয়ারে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বসে পা দোলাচ্ছিলেন। তিনি সব শুনছিলেন। সবসময়েই শোনেন। দীপিতার মনে হয়, উনি দীপিতার প্রতি নিক্ষিপ্ত এইসব বাক্যবাণ খুব-ই উপভোগ করেন আর বাইরে ভাব দেখান যে, এসব মেয়েলি ব্যাপারের উনি কিছুই বোঝেন না এবং বুঝতে চানও না। ওঁরা কে যে, কাকে কখন চালনা করেন তা বোঝা ভার। আর ওঁদের দুজনকেই চালনা করে অমলের ছোটোভাই বিমল। যত কুমন্ত্রণা, দীপিতার এবং অমলের নামে যতকিছু লাগানো সব-ই তার ছোটো দেওর বিমল-ই করে। তা জানে দীপিতা।

জীবনে অনেকের হাতে অনেক-ই কষ্ট পেয়েছে সে কিন্তু কারোকে ঘৃণা করেনি আজ পর্যন্ত। এই বিমলকে ছাড়া। এত অল্পবয়সি ছেলের যে, এমন নীচ ইতর চরিত্র হতে পারে তা বিমলকে নিজে চোখে না দেখলে দীপিতা হয়তো বিশ্বাস-ই করত না। আপাদমস্তক মিথ্যে দিয়ে মোড়া। স্কুলের কোনো মাস্টারমশায়কে ঘুস দিয়েই ও পাশ করে। হেডমাস্টারের বেকার ছেলেকে শ্বশুরমশায়কে বলে ছিপনাদোহরের ডিপোতে চাকরি করে দিয়েছে। গুণের ‘গ’ নেই অথচ নাম করার খুব ইচ্ছে। সমস্ত কিছুই ফাঁকি দিয়ে, বাবার টাকা এবং প্রতিপত্তি দিয়েই পেতে চায় বিমল। জীবনে চালাকির দ্বারা যে, কোনো মহৎ কর্ম হয় না –একথা ও বিশ্বাস করে না। টাকাই ওর জীবনের একমাত্র প্রার্থনা। টাকার বিনিময়ে যে, নামযশ কিনতে পারা যায় তাই ও শুনেছে। ফুটবল খেলে থার্ড ক্লাস কিন্তু গেমস টিচারকে ঘুস দিয়ে স্কুল টিমে চান্স পেয়েছে। যেটা দীপিতাকে আশ্চর্য করে, তা হচ্ছে এসব কিছু জেনেশুনেও শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে প্রশ্রয় দিয়ে যান, তার সব প্রয়োজনেই টাকা জুগিয়ে যান।

সুরাতিয়া দোতলা থেকে নেমে আসার আগে আগেই বিমল দোতলা থেকে নেমে স্কুটার নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। শ্বশুরমশাই নতুন ‘ভেসপা স্কুটার কিনে দিয়েছেন তাকে অথচ কমলকে দেননি। কমল হেঁটে স্কুলে যায়। ছোটোছেলে কি তাঁর কোনো গোপন কথা জানে? নইলে কী করে সে, ব্রজেন করের মতো ধুরন্ধর মানুষকে এমন করে বশে রেখেছে? ভেবে পায় না দীপিতা।

কিছুক্ষণ পরে দীপিতা বলল, আমি আসি মা?

-এসো। ছেলেটা সারাসপ্তাহ বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, ছুটির দিনে তার কাছে কাছে একটু থাকো, তাকে একটু সঙ্গ দাও, সুখী করো, পুরুষমানুষের অনেকরকম চাহিদা থাকে। তাহলেই কৃতার্থ হব আমি। সংসারের জন্যে তো কুটোটিও নাড়তে হয় না তোমায়। কাজের মধ্যে, পরি সেজে থাকা। তা যার সুবাদে পরি হয়েছ তাকে একটু দেখলেই কৃতার্থ হব আমরা।

হঠাৎ বহুবচনে গেলেন কেন অন্নদাদেবী তা বুঝল না দীপিতা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে মনে মনে ও ভাবছিল বড়োছেলের প্রতি কত যে, দরদ শাশুড়ির, তা তার জানা আছে। তাছাড়া পুরুষমানুষদের চাহিদা সম্বন্ধে এতই যদি জানেন, তবে ষাটোর্ধ্ব শ্বশুরমশাই যুবতী মুসলমান রক্ষিতার কাছে যাবেন কেন? ভাবলেও হাসি পায় দীপিতার। নাটক-নভেলে অনেক অশিক্ষিতা অত্যাচারী শাশুড়ির কথা পড়েছে দীপিতা কিন্তু জীবনেও যে, তার শাশুড়ির মতো শাশুড়ি এই আধুনিক সময়েও কারও থাকতে পারে, সেকথা মাঝে মাঝে ওর নিজের-ই বিশ্বাস হয় না। ওর মনে হয় ওর শাশুড়ির, শাশুড়ি বোধ হয় তাঁর ওপরে অত্যন্ত-ই অত্যাচার করতেন। দীপিতার প্রতি অন্নদার ব্যবহার তার-ই শোধ তোলার জন্যে। মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝা ভারি মুশকিল।

মুখে তখনও প্রকাশের ফুচকার আর গোরখপুরি চায়ের স্বাদটা ছিল কিন্তু শাশুড়ির বাক্যবাণে মুখটা যেন, তেতো হয়ে গেল।

আধখানা সিঁড়ি নেমেছে, এমন সময়ে পেছন থেকে কে যেন, দীপিতার হাত ধরল।

স্পর্শেই বুঝল যে, তার একমাত্র ননদ সিমলি। এই মেয়েটা অন্যরকম। এ বাড়ির মতো নয়। চেহারাতে মা কী বাবা কারও ছাপ নেই। ও ব্রজেন করের-ই মেয়ে যে, সে-সম্বন্ধে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। নিজে ও খুব-ই ছোটো হয়ে গেছে, কত নীচ হয়ে গেছে, নইলে এইসব ভাবনা ওর মনে আসে কী করে? নিজের জন্যে ভারি কষ্ট হয়ে দীপিতার।

পেছন ফিরে তাকাতেই সিমলি বলল, চলো।

তারপর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে বলল, দুঃখ কোরো না বউদি। আমি কিন্তু মাকে কিছু-ই বলিনি। আমি তো নিবেদিতাদের বাড়িতেই ছিলাম। একটু আগেই এসেছি। বলে থাকলে, বিমল-ই বলেছে। তুমি তো জানোই ওকে। ওকে আমি ভাই বলে স্বীকার করি না। ও কিছু না বললে, হঠাৎ এই আক্রমণ হবে কেন তোমার ওপরে। গেছ, বেশ করেছ। উলটে দু-কথা শুনিয়ে দিতে পারো না তুমি?

দীপিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার কোন জোরটা আছে যে, কিছু বলব আমি?

একতলাতে নেমে, দীপিতাদের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে সিমলি বলল, তোমাকে দেখে আমি একটা ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছি।

–কী?

–নিজে স্বাবলম্বী না হয়ে আমি কখনোই বিয়ে করব না।

–বিয়ে কি আমি আমার নিজের ইচ্ছাতে করেছিলাম রে সিমলি? না তুই-ই করতে পারবি? আমরা তো বিয়ে ‘করিনি’, আমাদের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভবিষ্যতে একটা সময় হয়তো আসবে, যখন মেয়েরা সত্যি-ই নিজেদের মতে ও ইচ্ছেতে বিয়ে করবে। আমাদের মতো তাদের বিয়ে দেওয়া হবে না।

সিমলি বলল, কালকে কলেজে নিবেদিতা বলেছিল যে, কলকাতাতে ও নাকি দেখেছে যে, একটা অটো-রিকশার পেছনে লেখা আছে—’নারীর সুখ স্বপনে, আর নারীর শান্তি শ্মশানে’।

তারপর হেসে বলল, সত্যি? তোমাদের কলকাতাতে কি এরকম সব লেখা থাকে নাকি অটোর পেছনে?

দীপিতা বলল, কী জানি রে! পাঁচবছর তো হয়ে গেল এসেছি কলকাতা থেকে। আর তো যাইনি। কী করে বলব বল? তবে তোর বন্ধু নিবেদিতা যখন বলেছে তখন নিশ্চয়ই তাই।

সিমলি বলল, আমি যাই একটু ভোঁদাইদাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। কাকিমা ডেকেছিলেন। ওদের বাড়িটা একেবারে অন্যরকম। ভারি ভালো লাগে আমার ওদের।

–ভোঁদাইকে বিয়ে করবি নাকি?

–মানুষটা তো ভালোই রসিক, কিন্তু ওসব এখনও ভাবার সময় আসেনি। স্বাবলম্বী হই আগে। তা ছাড়া ভোঁদাইদা আমার চেয়ে অনেক-ই বড়ো। আর শুধু বি. এ. পাশ।

–তোর দাদাও তো শুধুমাত্র বি. কম. পাশ।

–তুমি তো তা নও। আমার বরের আমার চেয়ে বেশিভালো হতে হবে না, তা না হলে চলবে? আমি তো নামধারী কলেজ থেকে এ বছর-ই, বি এ পাশ করে বেরোব।

–লেখাপড়া যে, সকলকেই অনেকদূর অবধি করতে হবে তার কী মানে আছে, কলকাতাতে আমি অনেক-ই লেখাপড়া করা খুব বড়ো বড়ো বদমাইশ ছেলে দেখেছি।

–সে যাইহোক। বলেছি তো, অন্য কারও ভরসাতে, নিজের মা-বাবার ভরসাতেও আমি বিয়ে করব না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তবেই করব। বিমল যেমন ছেলে, বাবার অবর্তমানে হয়তো দাদাকে, কমলকে আর আমাকেও তাড়িয়েই দেবে বাড়ি থেকে। ও একটা সাংঘাতিক ছেলে। বাবার প্রশ্রয়ে আরও সাংঘাতিক হয়ে উঠছে দিনকে দিন। ওকে আমি ভীষণ-ই ভয় পাই, ওর দিদি হলে কী হয়!

দীপিতা বলল, আমিও পাই।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ