চান্দ্রায়ণ – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

এরকম কখনোই হয় না। অসময়ে এমন বৃষ্টি নেমেছে যে, মনে হচ্ছে বর্ষাকাল। সাতদিন হয়ে গেল। বাড়ির পেছনের নালা দিয়ে এমন তোড়ে জল বইছে যে, মনে হচ্ছে শ্রাবণ মাস। সারাপৃথিবীর আবহাওয়াই বদলে গেছে। শীতে গরম, গ্রীষ্মে বর্ষা, হেমন্ত-বসন্ত বোঝাই যায় না, তবে শরৎকালটা এখনও বোঝা যায়, এই যা সান্ত্বনা।

সবে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশ এখনও অন্ধকার। প্রায় সাতদিন হল রোদ ওঠে । পুরুণাকোটের পাটকিলে-রঙা ধুলোর পথ এখন পিচের হয়ে গেছে। বর্ষাকালে পথের মাটি থেকে যে-গন্ধ উঠত আগে, তা আর ওঠে না। তবু দু-পাশেই মাটি আছে আর আছে বনের পাদদেশে। কচি গাছের ঝাড় হয়েছে বড়োগাছের পায়ের কাছে। তাতে ফুল এসেছে। সুন্দর। মাঝে মাঝেই ময়ূর ডেকে উঠছে বনের মধ্যে নিক্কণ’ তুলে। একটা মন্থর বনগন্ধবাহী হাওয়া বয়ে আসছে লবঙ্গী পাহাড়ের দিক থেকে। ভারি আলসেমি মাখা সে-হাওয়াতে। কোনো কাজকর্মতেই মন বসে না এমন আবহাওয়াতে। অথচ কাজ করতেই হয়। পেট বড়ো জ্বালা!

আতশের স্কুলটা কাছেই। ও কটক থেকে বি. এড. পাশ করে জেলাসদর অঙ্গুলের একটি স্কুলে ইংরেজি পড়াত। ছিলও স্কুলটা ভালোই। করতপটার ওই স্কুলের সেক্রেটারি মাধব মিশ্র অঙ্গুলের বিমল বোসকে চিনতেন। আতশের বাবাকেও চিনতেন। খুব আদর্শবাদী মানুষ। এমন মানুষ এ যুগে বিরল। এই স্কুল পত্তনের আগে থেকেই বিমলজেঠুর মাধ্যমে মাধব মিশ্র আতশের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাকে হেডমাস্টার করে তাঁর নতুন স্কুলে নিয়ে আসেন। মাইনেও দেন প্রায় দু-গুণ। তা ছাড়া পূর্ণ স্বাধীনতা। সবসুদ্ধ শ-খানেক ছেলে পড়ে ওই স্কুলে। করতপটা খুব-ই ছোটো জায়গা। তবে কিছু ছেলে-মেয়ে পুরুণাকোট থেকেও পড়তে আসে। সবসুন্ধু পাঁচজন শিক্ষক। সবাই ওড়িয়া। আতশরাও প্রায় ওড়িয়াই হয়ে গেছে। দু পুরুষ হয়ে গেল অঙ্গুল-এ বাস। তাদের কলকাতার আত্মীয়স্বজনেরা, যদি কখনো এদিকে আসেন, অথবা ও যদি কখনো বছর দু-তিন অন্তর কলকাতাতে যায়, তখন ওর বাংলা উচ্চারণ নিয়ে ওঁরা ঠাট্টা করেন। আতশ মজা পায়। তার বাংলাতে ওড়িয়া টান থাকলেও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ওড়িশার এই পাহাড়জঙ্গলে থেকেও যোগাযোগ রাখে পুরোপুরি। কটক থেকে বাংলা কাগজ ও কটকের বাংলা বইয়ের দোকান থেকে বাংলা বইও আনায় সে নিয়মিত।

লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন, দেশভাগের সময়ে নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, নিজেদের বিনা দোষে পূর্ববাংলা ছেড়ে প্রাণ ও মান নিয়ে সব সম্পত্তি ছেড়ে নিরুপায়ে চলে আসেন ওরাও তেমন-ই এসেছিল বরিশাল থেকে। কলকাতায় ওদের যেসব আত্মীয়স্বজন ছিলেন, গরিব এবং অবস্থাপন্ন, তাঁরা সবাই আতশের পরিবারের ছ-জনকে পাকাপাকিভাবে রাখতে গররাজি হন। তাঁদের কোনো দোষ দেননি আতশের বাবাও। কারণ কলকাতাতে হঠাৎ করে ছ-জন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সহজ কথা ছিল না। ছ-জন মানুষের জন্য কমপক্ষে তিনটি ঘরের দরকার ছিল। কলকাতায় তিনটি বাড়তি ঘর, খুব কম মানুষের বাড়িতেই থাকত। তাঁরা আশ্রয় দিতে পারেননি বলে, তাঁদের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কোনো হেরফের হয়নি।

তখন আতশ-এর বাবা, ওঁর এক বন্ধুর পরামর্শে ঢেনকানলে চলে আসেন। বাবামস্ত বড়ো এক পাটকলের অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। দেশভাগের সময় বয়সও তিরিশের কোঠাতে ছিল। ঢেনকানলে এসেই তিনি চৌদুয়ারের আই. পি. পি.-র কাগজ কল-এ একটা চাকরি পেয়ে যান, জুনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্টের। চেনকানল থেকে চৌদুয়ারে বাসে যাতায়াত করতেন। কাজটা ভালোই ছিল এবং যথেষ্ট মাইনে। তারপর ধীরে ধীরে নিজের কঠোর পরিশ্রম, বুদ্ধি ও সততোর জোরে অনেক-ই উন্নতি করেন। পছন্দমতো জমি কিনে বাগান ও বাড়ি করেন। তবে বাড়ি করেন ঢেনকানলে নয়, অঙ্গুলে। রিটায়ারমেন্টের বছর দশেক আগেই।

আতশ-এর জন্ম দেনকানলেই। তাই ওর সব বন্ধুবান্ধব, খেলার সাথি পরিচিত জন সবাই ওড়িয়াই ছিলেন। তবে বাঙালিও ছিলেন কয়েকঘর। বহিরাগত তাদের পরিবারকে স্থানীয় অধিবাসীরা পরমমমতায় গ্রহণ করে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তার দুই দিদির মধ্যে ছোড়দির বিয়ে হয়েছে সম্বলপুরের একটি ওড়িয়া ছেলের সঙ্গে। সে পড়তে এসেছিল ঢেনকানলে। দিদিকে ভালোবেসে বিয়ে করে। এখন সম্বলপুর–অঙ্গুল নতুন রেলপথের একটি ছোটোস্টেশন রেঢ়াখোল-এর রেল-এর স্টেশনমাস্টার। কথা হচ্ছে সম্বলপুরের কাছেই বামরা স্টেশনে সে বদলি হয়ে যাবে শিগগিরি। বড়ো স্টেশন অন প্রোমোশন। আর বড়দির বিয়ে হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে। জামাইবাবুদের পাটের ব্যবসা ছিল। সচ্ছল অবস্থা। বড়দি ক্লাস নাইন অবধি পড়েছিল। তবে দেখতে অত্যন্ত সুন্দরী হওয়াতে বিয়ে হতে অসুবিধে হয়নি।

ঠাকুরদা ও ঠাকুমা দেশ ছেড়ে আসার দুঃখ ভুলতে না পেরে পাঁচবছরের মধ্যেই দু-জনেই দেহ রাখেন। বাবাও নেই। মা আছেন। মা খুব-ই একা হয়ে গেছেন। বিশেষ করে আতশ অঙ্গুল ছেড়ে করতপটাতে চলে আসার পরে। কিছুটা সময় অঙ্গুলে নিজেদের বাড়ির বাগান টাগান দেখাশোনা করে কাটান। গতবছর অবধি পুরোনো একটা পরিবার ওদের বাড়িতেই থাকত। ওদের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। মায়ের দেখাশোনা করত এবং ওদের ওপরেই বাড়ি ছেড়ে, মা বছরের বেশিরভাগ সময়ই দুই দিদির কাছে পালা করে থাকতেন। আতশের বিয়ের বয়স বহুদিন-ই হয়ে গেছে। কিন্তু এই করতপটার জঙ্গলের পরিবেশে ওর মন বসে গেছে। এই জঙ্গুলে জায়গাতে কোনো শিক্ষিত মেয়েই পাকাপাকিভাবে থাকতে রাজি নয়। এখানে সিনেমা হল নেই, অন্য কোনো বিনোদনও নেই। তবে টিভি তো এসে গেছে বহুদিন-ই অঙ্গুলে। কিন্তু আতশ টিভির-পোকা মেয়ে পছন্দ করে না, নিজেও টিভি দেখেই না বলতে গেলে। তা ছাড়া করতপটাতে তার বাড়িতে অবশ্য বিজলি আলোও নেই। নানা কারণেই বিয়েটা ঘটে ওঠেনি। মা যতদিন আছেন, বিয়ে করলেও তার স্ত্রীকে মায়ের কাছেই থাকতে হবে অঙ্কুলে। আতশ যাবে মাঝে মাঝে, নয়তো সে, আসবে মাঝে মাঝে। আজকালকার কোনো মেয়েই শাশুড়ির সেবাদাসী হয়ে থাকতে চায় না। বিয়ে না হওয়ার সেটাও আর একটা কারণ। তা ছাড়া, মায়ের সঙ্গে বনিবনা হবে কি না, তাই বা কে বলতে পারে। তাই আতশ ভাবে, বেশ আছে। তবে আতশেরও মরূদ্যান আছে। তাদের পাশের বাড়ির মেয়ে, নলিনী। নলিনী চাঁদ। তাদের দুজনকেই দু-জনের পছন্দ। তবে তার পড়াশুনো এখনও শেষ হয়নি। শেষ হলে কী হবে কে জানে!

এই করতপটার একদিকে মহানদীর ওপরে টিকরপাড়া, পুরুণাকোট হয়ে। পুরুণাকোটে, এর আগে গেলে টুল্টবকা, ডানদিকে গেলে বাঘবমুন্ডা। টিকরপাড়াতে ফেরিতে নদী পেরিয়ে ওপারে গেলে দশপাল্লা বৌধ আর ফুলবাণি। ফুলবাণি বেশ উঁচু। গরমের দিনে ছোটোখাটো হিল স্টেশনের মতো ঠাণ্ডা, যদিও বরফ পড়ে চিৎ কদাচিৎ। বরফে ঢাকা পাহাড় ধারে কাছে নেই। করতপটা ও পুরুণাকোটের মধ্যে একটা পথ চলে গেছে পাহাড়ে পাহাড়ে লবঙ্গীতে। লবঙ্গী হয়ে রায়গড়া। এই লবঙ্গীর উপত্যকাতে গদাধরের কাছে শুনেছে, সক্ট-উড-এর এক প্রজাতি আছে। তাদের গায়ের রং মসৃণ সাদা। তাদের নাম গেন্ডুলি। গ্রীষ্মদিনে চাঁদনি রাতে গাছগুলোকে মনে হয় একদল বিবসনা শ্বেতাঙ্গিনি যেন, হাতছানি দিয়ে ডাকছে। গা ছমছম করে।

স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক কামিনী পট্টনায়কের বাড়ি দশপাল্লাতে। তার মুখে নাম শুনেছে বিরিগড়ের। দশপাল্লার টাকরা গ্রাম থেকে বুরুসাই হয়ে যেতে হয় বিরিগড়। মস্ত উঁচু পাহাড় সে। যেখানে খন্দ আদিবাসীরা থাকে। তাদের পূর্বপুরুষেরা মেঘে চড়ে এসে বিরিগড়ে বাসা বাঁধে। বছরে তারা নাকি মাত্র একবার নীচে নেমে দশপাল্লার রাজাকে খাজনা দিয়ে যেত নইলে সমতলের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফুলবাণিতেও খন্দ আদিবাসীরা থাকে। খন্দদের বাস উঁচু পাহাড়ে। অদ্ভুত তাদের রীতিনীতি নাকি।

এই পরিবেশ এবং আবহে আতশের নেশা ধরে গেছে। আজকাল অঙ্গুলে ওর যেতে ইচ্ছে করে না। নেহাত মায়ের জন্যেই যায়। নলিনীর জন্যেও। নলিনী যখন থাকে। অঙ্গুলের আশপাশেও ভালো জঙ্গল ছিল আগে। এখনও আছে কিছু। ঢেনকানল-এর রাজবাড়িটা একটা খুব উঁচু ন্যাড়া পাহাড়ের ওপরে। গল্প আছে যে, প্রজাদের আর হাতি দিয়ে সব বড়ো বড়ো পাথর বইয়ে নিয়ে সেই পাহাড়ের চূড়াতে প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন রাজার পূর্বপুরুষরা। হাতিদের চোখ দিয়েও নাকি জল গড়িয়েছিল এ-কঠিন কাজ করতে। মানুষদের চোখ দিয়ে তো গড়িয়েই ছিল।

আতশ-এর মনে হয়, ওড়িশার বিভিন্ন করদ রাজ্যের রাজারা গরিব, সহায়হীন, সরল প্রজাদের ওপরে যে-প্রকার অত্যাচার করেছেন, তার নজির সারাভারতবর্ষেই নেই। অথচ কখনো তেমন বিদ্রোহও হয়নি। রাজন্যপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পরে এখন রাজাদের সেই বর্বরতা আর নেই। কিন্তু সেই রাজাদের জায়গায় এসেছে অন্য অত্যাচারীরা। বড়ো ব্যবসায়ীরা, বাঁশ ও কাঠের ঠিকাদারেরা। আতশের প্রায়ই মনে হয়, একদিন-না-একদিন এই গরিবদের চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাসের অভিশাপে তাদের অতিবড়ো শাস্তি পেতে হবে। জানে না, আতশের এই খুশিময় ইচ্ছে মিথ্যেও হতে পারে। ভগবান-টগবান সব বোগাস। থাকলে এত দীর্ঘদিন ধরে গরিবেরা এমন করে বঞ্চিত হত না। এত পাপও জমতে পারত না নানা ঠিকাদারের ঘরে ঘরে।

আশ্চর্য! ওড়িশাতে জনযুদ্ধ বা এম.সি.সি. বা নকশালরাও কোনোদিন শিকড় গাড়েনি। অথচ তাদের-ই এখানে সবচেয়ে প্রথমে আসা উচিত ছিল। কেন আসেনি, তা ভেবে অবাক হয়।

স্কুলের পাঠ্যবইতে এসব বিষয় থাকে না কিন্তু আতশ আর তার অধিকাংশ সহকর্মী অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একটা বিদ্রোহের বীজ পুঁতে দেওয়ার চেষ্টা করে। তার ছাত্রদের বদ্ধমনা না করে মুক্তমনা করতে চায়। ছাত্ররা অতসব ইজম-ফিজম বোঝে না। বোঝে যে, অনেকদিনের এই অত্যাচারের বোঝাটাকে তাদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। এই ভাবনাটার বীজ যদি, তাদের মধ্যে একবার বপন করে দিতে পারে তবেই ভবিষ্যতে কাজ হবে। আর কোনো প্রজা কাঁদতে কাঁদতে বিনা পারিশ্রমিকে, বিনা খাদ্যে কখনো পাথর বয়ে পাহাড়ে উঠবে না, রাজার বাড়ি বানাবার জন্যে।

‘বাজাজ’-এর একটা মোটরসাইকেল কিনেছে আতশ গতবছর অঙ্গুলের ডিলার পট্টনায়েক কোম্পানির কাছ থেকে। সহজ কিস্তিতে। বিমলজেঠু বলে দিয়েছিলেন। বিমল বোস বহুদিনের বাসিন্দা অঙ্গুলের এবং নিজে বাঙালি হলেও ওড়িয়া সমাজে তাঁর খুব-ই প্রতিপত্তি। যদিও ব্যবসাদার, কিন্তু সৎ ব্যবসাদার। কর্মচারীদেরও ঠকান না। তাদের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ান। সেই কারণেই তাঁকে এক বিশেষ চোখে দেখে আতশ।

করতপটা গ্রাম থেকে পুরুণাকোটে যাওয়ার পথে বাঁ-দিকে একটা পাহাড়ি নালা পড়ে। গ্রীষ্মে তির তির করে বয়। এখন বর্ষাতে কলরোলে জল চলেছে নুড়ি-পাথর গড়িয়ে নিয়ে। এই নালার-ই পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথ। স্কুলটা তার ভাড়াবাড়ির কাছেই। তাই স্কুলে যেতে মোটরসাইকেল নেয় না। স্কুলটা বড়োরাস্তা থেকেও বেশি দূরে নয়। দূরে হলে বাস থেকে নেমে বাইরের ছাত্রদের স্কুলে আসতে অসুবিধে হত। যদিও বাস-ভাড়া দেওয়ার মতো সামর্থ্য তাদের কম জনের-ই আছে। সকলেই প্রায় মাইল পাঁচেক হেঁটে আসে, হেঁটে ফেরে। খুব ইচ্ছে করে ছেলে-মেয়েদের কিছু টিফিন খাওয়াতে। ন-মাসে ছ-মাসে খাওয়ায়ও কিন্তু রোজ পারে না।

বাইধর নামের একটি তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে আছে। ও-ই বেঁধে-বেড়ে দেয়, জামাকাপড় ধুয়ে দেয়। ছেলেটা বাধ্য। ব্যবহারও খারাপ করে না। তার বাড়ি লবঙ্গী যাওয়ার পথে পম্পাশরে।

যেহেতু সে হেডমাস্টার তাই তাকেই সবচেয়ে আগে পৌঁছোতে হয় স্কুলে। আতশ নিজে নিয়মানুবর্তী, তাই স্কুলের মাস্টারমশাইরা এবং ছাত্ররাও যাতে “নিয়মানুবর্তী’ হন এবং হয়, সেদিকে সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখে। বড়ো বড়ো শহরের অনেক স্কুলেও এরকম নিয়মানুবর্তী নয়, শিক্ষক এবং ছাত্ররা। এ-বাবদে আতশের গর্ব আছে। তার স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ভালো ফলও করে। পঞ্চম শ্রেণি অবধি আছে তাদের স্কুলে। কম ছাত্র বলে পড়াশোনাও যথাসাধ্য যত্ন করে করায় ছাত্র-ছাত্রীদের। ছাত্রই বেশি, ছাত্রী সবসুন্ধু সাতজন এক-শো জনের মধ্যে। তবে ছাত্রীরা ছাত্রদের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী। অনেক যুগ ধরে যে-সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে এসেছে সেই সুযোগ পাওয়াতেই যেন, ওরা তার পূর্ণ সদব্যবহার করতে চায় এখন। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই এই পঞ্চম ক্লাস অবধি পড়েই পড়াশুনো ছেড়ে দেয়। আর্থিক কারণে আর পড়তে পারে না।

আতশ-এর স্কুলের খুব সুনাম এই অঞ্চলে। অনেক ছেলে-মেয়েই এই স্কুলে পড়তে চায় কিন্তু মাধববাবু এবং আতশও চান না এবং চায় না যে, এর চেয়ে বেশি ছাত্র এ-স্কুলে আসুক। এলে, তাদের যথাযোগ্য মনোযোগ দেওয়া যাবে না। মাধববাবু একজন আদর্শবান মানুষ। এই যুগে ‘টাকা’ই যখন সকলের একমাত্র কাম্য ও প্রার্থনার, সেই যুগে মাধব মিশ্রের মতো মানুষ কম-ই দেখা যায়। তাঁর বড়োভাই যাদব মিশ্র ইনকাম ট্যাক্সের কমিশনার। প্রচন্ড ঘুসখোর বলে তাঁর কুখ্যাতি আছে। এখন চেন্নাইতে বদলি হয়ে গেছেন। বড়োভাই-এর জীবনযাত্রা ও মানসিকতার সঙ্গে মাধববাবুর এক্কেবারেই মেলে না বলেই তিনি পৈত্রিক নিবাস ছেড়ে অঙ্গুলের সিমলিপদা অঞ্চলে, আতশদের বাড়ির কাছে একটা ভাড়াবাড়িতে চলে এসেছেন অনেকদিন হল। তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। তাঁর ছেলে-মেয়েরা বড়োভাই-এর ছেলে মেয়েদের জীবনযাত্রাতে প্রভাবিত হয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে এমন ভয়েই উনি চলে এসেছেন। মাধববাবুর স্ত্রী একসময়ে বছর তিনেক শান্তিনিকেতনে পড়েছিলেন। তাঁরও খুব-ই ইচ্ছা নির্জন জায়গাতে অনেকখানি জমি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের আদর্শে একটি শিক্ষায়তন গড়ে তোলেন। সমআদর্শে বিশ্বাসী মানুষ বেশি পাননি এবং অতখানি জমি ও আনুষঙ্গিক সব কিছুর জন্যে যত অর্থর দরকার তাও জোগাড় হয়ে ওঠেনি বলেই, তাঁর স্বপ্ন এখনও পূরিত হয়নি। তবে আতশ এবং অন্যান্য অনেক শিক্ষকের-ই পূর্ণ সমর্থন আছে ওই স্বপ্নকে সফল করে তোলার জন্যে। বড়োস্কুল না করে, মাধববাবু এমন ছোটো ছোটো চারটি স্কুল করেছেন। একটি চৌদুয়ারে, একটি ঢেনকানলে, একটি অঙ্গুলে এবং আর একটা অঙ্গুল থেকে সম্বলপুর পথের রেঢ়াখালে।

ওদের স্কুলে সবসুদ্ধ আটটি ঘর। সায়ান্স নেই, তাই ল্যাবরেটরির প্রয়োজন হয় না। তবে লাইব্রেরিটি ভালো। শুধুই আর্টস স্ট্রিমের বই পড়ানো হয় এই দীনবন্ধু স্কুলে। অঙ্গুলে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হতে চলেছে শুধুমাত্র আর্টস স্ট্রিমের জন্যে। এই বিজ্ঞানের যুগে এ, এক দারুণ পদক্ষেপ। এই স্কুল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাফিলিয়েশান চাইবে। দীনবন্ধু স্কুলে’ র সব ঘরে দেওয়ালে একটি করে বোর্ডে লেখা আছে “Literature Makes A Person.

আর্টস স্ট্রিমের নানা বিষয় ছাড়াও গান, ছবি আঁকা ইত্যাদিও শেখানো হয় আতশের স্কুলে। এসবের জন্যে একজন টিচার আছেন। তিনি অস্কুল থেকে বাসে করে এসে চারদিন ক্লাস নেন। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ওসব ‘সুকুমার বৃত্তি জাগিয়ে তোলাটাই আসল উদ্দেশ্য। শিক্ষা, সুরুচি সব এই বয়েসেই গড়ে ওঠে, তাই।

রবীন্দ্রনাথ যে, পূর্ণ মনুষ্যত্ব’র কথা বলতেন তার ওপরে খুব জোর দিতে বলেন মাধববাবু। বলেন, আমার স্কুলে যেন, শুধুমাত্র জীবিকার জন্যে পড়াশুনা শেখানো না হয়। “You should bring the horse near the water and make it thirsty.’ Santa Crostat যেন, জেগে ওঠে ছাত্রদের মধ্যে।

আতশ তার বাড়ির বাইরের বারান্দার কাঠের চেয়ারে বসে বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির শোভা দেখছিল। গন্ধ নিচ্ছিল দু-নাক ভরে। বাড়ির পেছনের নালা দিয়ে জোরে জল বয়ে যাচ্ছিল ‘ঝর ঝর করে। সন্ধের পরে যখন, প্রকৃতি নির্জন ও নিশ্ৰুপ হয়ে যায় তখন, এই শব্দটা ক্রমশ জোর হতে থাকে। ঘুমপাড়ানি গানের মতো শোনায় তখন ঝরনার শব্দ। অনেকগুলো বড়ো বড়ো কনকচাঁপার গাছ আছে নালাটার ও-পাশে। চাঁপার গন্ধে ম ম করে বন। বিশেষ করে রাতে।

জঙ্গলের ঠিকাদার পাল্টবাবুদের মুহুরি গদাধর আসছিল সাইকেল চালিয়ে। সে এখন ছুটিতে এসেছে। বর্ষাকালে তো জঙ্গলের কাজ বন্ধ থাকে। জঙ্গল আবার খুলবে অক্টোবরের গোড়াতে। তাই গদাধরের ছুটি এখন। গদাধরের কাছেই জঙ্গলের নানা গল্প শোনে আতশ। অঙ্গুল আধা-শহর জায়গা। জঙ্গলের এতসব গোপন খবর যেহেতু ও অঙ্কুলের বাসিন্দা, তার জানার কথা নয়। তা ছাড়া, বি. এড. করার সময়ে তাকে কটকেও থাকতে হয়েছে বেশ কিছুদিন।

গদাধরকে বলেছে আতশ, স্কুলে পুজোর ছুটি যখন হবে, এবার পুজো পড়েছে অক্টোবরের শেষে, তখন গদাধরের সঙ্গে যাবে সে জঙ্গলে। থাকবে গিয়ে দিন পনেরো। গদাধর বলেছে কোনো অসুবিধা নেই। ট্রাক যায় প্রতিদিন, যে-জঙ্গলেই কাজ হোক-না-কেন। তাকে ট্রাকে করে নিয়ে গিয়ে ট্রাকে করেই ফেরত পাঠিয়ে দেবে।

গদাধরের কাছ থেকেই জঙ্গলের নানা গল্প শোনে। তাকে দেখলেই ডেকে বসিয়ে ওমলেট আর চা খাওয়ায়। ওর তো একার সংসার–কখনো-কখনো খাইয়ে দেয়। বাইধরও খুশি হয়ে খাওয়ায় কারণ গদাধরের বাড়িও পম্পাশরেই। কোনো কোনো রবিবার বাইধর গদাধরের সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে চলেও যায় পম্পাশরে।

নানা জায়গা থেকে বড়ো বড়ো ঠিকাদারেরা আসেন নিলামে জঙ্গল ডেকে নিতে। জঙ্গল ডাকবার আগে তাঁদের লোকেরা সেইসব জঙ্গলে গিয়ে কী কী গাছ আছে, কত গাছ আছে তাদের চেহারা-ছবি কেমন, সেসব সম্বন্ধে সরেজমিন তদন্ত করে ফিরে এসে মালিকদের রিপোর্ট দেয়। কত দামে কোন জঙ্গল ডাকলে কত লাভ থাকবে তার একটা মোটামুটি হিসেব করে নিয়ে নিলাম ডাকেন তাঁরা। তবে দুর্গম পাহাড়ি বনের অভ্যন্তরের সব জায়গাতে পৌঁছোনো যায় না। অনেকটা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাতে আন্দাজেই ঠিক করে নিতে হয় জঙ্গলের প্রকৃতি। তা ছাড়া, জঙ্গলের গভীরে পৌঁছোনোর মতো রাস্তাও তো থাকে না। যে ঠিকাদার যে-জঙ্গল কিনবেন তাঁকেই পথ তৈরি করে নিতে হয়। পথ তৈরি করা হয়, বিশেষ করে পাহাড়ে, অধিকাংশ সময়েই হাতির পথকে অনুসরণ করে। হাতিদের অসাধারণ বুদ্ধি। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই বুঝে কোথা দিয়ে উঠলে পাহাড়ে সবচেয়ে কম পরিশ্রমে ওঠা যায়, হাতিরা তা ঠিক করে নিয়ে, নিজেদের চলাচলের পথ বানায়। ঠিকাদারের লোকেরা সেই পথ-ই যথাসম্ভব মনে করে, চওড়া করে জিপ ও ট্রাক যাওয়ার উপযুক্ত করে নেয়।

জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে যেখানে গাছ কাটা হয়, সেখানে গাছের কান্ড ও মোটা মোটা শাখা ও প্রশাখাকে ট্রাকের সাইজমতো কেটে ফেলে কাবাড়িরা। তারপর মোষ দিয়ে বা বলদ দিয়ে সেই কাঠ টানিয়ে এনে পথের পাশে উঁচু জায়গাতে থাক দিয়ে রাখা হয় যাতে ট্রাকে সেইসব কাঠ তুলতে সুবিধে হয়। পাহাড় যেখানে খুব খাড়া সেখানে খালি ট্রাক উঠে আসতে পারে না। ট্রাকের চাকা জমি আঁকড়াতে পারে না। তখন বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে ট্রাক বোঝাই করে তারপর ট্রাক পাঠানো হয় পাহাড়ে। পাহাড়ে পৌঁছেলে সেইসব পাথরগুলো আবার ট্রাক থেকে নামিয়ে ট্রাক খালি করে কাঠ বোঝাই করা হয়। গোরু-মোষ দিয়ে কাঠ ডেসপ্যাঁচ পয়েন্টে টানিয়ে আনার প্রক্রিয়াকে বলে ‘ঢোলাই’ করা।

এসো এসো গদাধর।

আপ্যায়ন করে বসায় আতশ গদাধরকে।

গদাধরের পরনে খেটো ধুতি। গায়ে খাকি শার্ট একটা। কোনো বাবুর ব্যবহৃত শার্ট বলেই মনে হয়। শার্টটার কায়দা আছে। গোটা ছয়েক পকেট। ডান কাঁধের কাছে ছিঁড়ে গেছে। পায়ে হাট থেকে কেনা প্লাসটিকের পাম্প শ্য। ছাতাটা সাইকেলের রড-এর সঙ্গে নারকোলের দড়ি দিয়ে বাঁধা। মুখে গুন্ডি পান।

গদাধর খুব খুশি হয় আতশ ডাকলে। স্কুলের হেডমাস্টার বলে কথা। সে নিজেও পঞ্চমফেল। মানে, ক্লাস ফাইভের পরীক্ষাও পাশ করতে পারেনি। তবে অঙ্কে মাথাটা তার ভারি সাফ। প্রতিবছর এই যে, এতগাছ কাটা হচ্ছে, তারপর টুকরো করা হচ্ছে তার প্রতি বর্গফিটের হিসেব একটা খাতাতে লিখে রাখে সে, জঙ্গলের ক্যাম্পে। তারপর কত বর্গফিট লগ কটকে গেল তারও হিসেব রাখতে হয়। জঙ্গলের ক্যাম্পের সে-ই ম্যানেজার-কাম অ্যাকাউন্ট্যান্ট। গাই-বলদের দেখাশোনা, কাবাড়িদের দেখাশোনা, তাদের হপ্তা দেওয়া, কটক থেকে টাটা মার্সিডিজ ট্রাক চালিয়ে আসা পাইলট সাহেব আর তাঁর খালাসির খাওয়া-দাওয়া দেখা, রাতে শোয়ার ব্যবস্থা করা, এসব-ইতার-ই কাজ। গরমে তারা অবশ্য ট্রাকেই শুয়ে পড়ে রাতে। শীতকালে অন্যত্রই শুতে হয়।

আরও কত কাজ। কী রান্না হবে–চাল ডাল তেল নুনের হিসেব রাখা–বাবুরা এলে তাঁদের খিদমদগারি করা–কাজ কী কম? তবে মন্দ লাগে না। স্বাধীনতা? স্বাধীনতা থাকলে কাজের বোঝা সহজেই বওয়া যায়। এত মানুষে যে, থেকে থেকে, তাকে ‘গদাধরবাবু, গদাধরইভাই বলে ডাকে, তার সব আদেশ মান্য করে এরমধ্যে একটা মায়া আছে। যারা জানে, তারাই জানে।

গদাধর সাইকেলটা বারান্দার ভেতরে উঠিয়ে রাখে–যদি আবার বৃষ্টি নামে। তারপর হেডমাস্টারবাবুর উলটোদিকের চেয়ারে বসে নানা গল্প জুড়ে দেয়। তার আটচল্লিশ বছরের জীবনে তিরিশটা বছর–প্রতিবছর কটকের মঙ্গলাবাদের বাসিন্দা পাল্টববাবুদের নেওয়া জঙ্গলে জঙ্গলেই কাটিয়ে দিল। কত জায়গার নাম জানে। কতরকম অভিজ্ঞতা। তবে পাল্টববাবুরা কটক থেকেই কন্ট্রোল করা যায়, এমন সব জঙ্গল নিতে ভালোবাসেন। বাবুদের নানারকম ব্যবসা। তবে জঙ্গলের ব্যবসাটা মেজোবাবুই দেখেন। খুব ঠাণ্ডা বুদ্ধির মানুষ। কারোকে খুন করলেও এমন-ই ঠাণ্ডাভাবেই করবেন যে, কাকপক্ষীতেও জানতে পারবে না। তবে ছোটোবাবুর বড়ো গরম, সাহস বেশি। একবার কালাহাণ্ডিতে এক জঙ্গল নিয়েছিলেন জঙ্গলের কাজ করবেন বলে। সেই জঙ্গল ডাকতে হয়েছিল কালাহাণ্ডির রাজধানী ভবানী পাটনাতে গিয়ে। সে-জঙ্গলের রকম-ই আলাদা।

-কেন?

আরে বাবু, মানুষখেকো বাঘে ভরা সে জঙ্গল। আমাদের পাঁচজন কাবাড়িকে খেয়ে দিল যখন, তখন কাজ বন্ধ করে ফিরে এসেছিলাম আমরা। বড়োবাবু খুব বকেছিলেন ছোটোবাবুকে। বলেছিলেন, আমার চারলাখ টাকা জলে ফেললে আর শুধু তাই নয় পাঁচটা মানুষকে বাঘে খাওয়ালে।

যারা মরল তারা কোথাকার লোক?

সব এদিককার-ই লোক। তারা দু-পুরুষ ধরে কাজ করছে বাবুদের কাছে। বাপে গাছ চাপা পড়ে মরল বা বাপকে বাঘে খেল বা গয়ালে গুঁতোল-পটল তুলল–তো বারো-তেরো বছরের ছেলে ধুতির ওপরে গামছাটা জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে কুড়ুল নিয়ে চলে এল বাপের জায়গাতে কাজ করতে।

বারো-তেরো বছরের ছেলে। বলল কী গদাধর?

হঁ আইজ্ঞাঁ। না এলে খাবে কী? মা ভাই-বোন যে, সব না খেয়ে মরবে।

তা যে, পাঁচজন কুলি মরে গেল তাদের ক্ষতিপূরণ দিলে না, মানে দিলেন না, তোমাদের বাবুরা?

দিলেন বই কী! সে দিক দিয়ে ওঁরা খুব-ই ভালো।

কত করে দিলেন?

সে অনেক টাকা বাবু।

কত বলো-না?

আ-ড়া-ই হাজার।

বলো কী? একটা প্রাণের দাম আড়াই হাজার?

আমাদের প্রাণের দাম কী অত নাকি? পাঁচশো টাকা পেলেই যথেষ্ট বলে মনে করে কাবাড়িরা। আড়াই হাজার টাকা রাখবে কোথায়? কী করবে তা দিয়ে? অনেকে অবশ্য এক-দুই গঁঠ জমিও কিনে ফেলেছিল সে-টাকা দিয়ে বুদ্ধি করে। ভবিষ্যতে কাজে লেগেছিল।

ওড়িশার সব জায়গাতেই জমির মাপকে ‘গুঁঠ’ বলে, না? মায়ের কাছে শুনেছিলাম বাংলায় জমির মাপ হয় বিঘা দিয়ে।

বাংলায় কী হয় জানি না। আমাদের এখানে গুঁঠ।

এমনি করে নানা গল্প করতে করতে বেলা গড়ায়। আকাশ আরও কালো করে আসে। ‘ঝুরুঝুরু’ করে হাওয়া বইতে থাকে একটা। বাঁশবনে কটকটি’ শব্দ ওঠে। কুম্ভাটুয়া পাখি ডাকে ‘গুব-গুব-গুব’ করে। পাহাড়তলির ঝিলের কাছ থেকে কালো আকাশের পটভূমিতে একঝাঁক সাদা কুন্দু বকফুলের মালার মতো দুলতে দুলতে একবার ছেঁড়া-মালা হয়ে আবার জোড়-লাগা গোড়ের মালার মতো ভেসে যায় উত্তর থেকে দক্ষিণে। বনের গভীর থেকে তক্ষক ডেকে ওঠে। “ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক’। বড়ো গেকো ডাকে নদীর ওপার থেকে ট্রাক-ট্যুউ ট্রাক-ট্যুউ ট্রাক-টু’ করে। নদীর ওপারের পেছনের গভীর বন থেকে তার দোসরা সাড়া দিতে থাকে। কোথায় যেন, কেয়ার ঝোঁপ আছে–বাতাসে কেয়ার গন্ধ ভাসে আর ওর বাড়ির পেছনেই যে, মস্ত কনকচাঁপার গাছটা তা থেকে টুপটাপ করে চাঁপাফুল ঝরে পড়ে পৃথিবীকে গন্ধে ভরে দেয়। আর তারপর-ই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। দুপুরেই ঘোর অন্ধকার।

আতশ বলে, কী করে যাবে এই বৃষ্টিতে পম্পাশরে! সে যে-অনেকখানি পথ। তা ছাড়া পাহাড়ে তো সাইকেল চালাতেও পারবে না। তোমাকে সাইকেল টেনে টেনে যেতে হবে। থেকে যাও, তোমার গল্প শুনি। বাইধরকে বলছি আমাদের জন্যে খিচুড়ি চাপিয়ে দেবে। সঙ্গে মুসুর ডালের বড়া…পেঁয়াজি, কড়কড়ে আলুভাজা, কেমন?

গদাধর বলে, হঁ আইজ্ঞাঁ। এ-বছর সাপের বড় উপদ্রব হয়েছে। বেলাবেলি ফিরতে হবে।

তা ফিরো।

গরমের ছুটিতে আতশ অঙ্গুলে এসেছে। মা খুব খুশি। যদিও ওর কর্মস্থল করতপটা থেকে অঙ্গুলে আসাটা এমন কিছু কঠিন নয় তবু ওর স্কুল খোলা থাকলে আসা কঠিনও হয়। শনিবার বিকেলে এসে সোমবার ভোরের বাসে ফিরে যেতে হয়। তবে ও তো মোটরসাইকেলেই যায়। ছোটো স্কুল হলেও সে হেডমাস্টার। তাই নানা দায়দায়িত্ব তো থাকেই। তা ছাড়া, শুধুই টাকা রোজগারের জন্যে ও কাজ করেও না। স্কুলের শিক্ষকমাত্রই যে মানুষ গড়ার কারিগর’– একথাটা ও বোঝে এবং কথাটাকে বিশেষ গুরুত্বও দেয়। যদিও স্কুলটি ছোটো এবং ক্লাস ফাইভ অবধি।

ড়িশার এই ছোটোশহরে আতশ নিজের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। এখানে বাংলা কাগজ কষ্ট করে পেতে হয়। কটক অথবা সম্বলপূর হয়ে আসে। দু-দিন পরে পায়। তবুও রাখে। মায়ের বাংলা সাহিত্যে খুব-ই উৎসাহ। তবে বলেন যে, আজকালকার লেখকদের অধিকাংশ লেখাই অপাঠ্য। কী যে, ছাতা-মাথা লেখেন এঁরা। বাংলা ছাড়াও একটি ওড়িয়া কাগজ এবং একটি ইংরেজি কাগজ রাখা হয় সারাবছর-ই বাড়িতে।

ওদের বাড়িটা একতলা। বসার ঘর ও আলাদা খাবার ঘর ছাড়া চারটি শোয়ার ঘর। বাবা অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন বলেই, যা-কিছুই করেছেন তা হিসেব করে। অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলেও তাঁর কিন্তু রুচি ছিল খুব সুন্দর। এবং শখও ছিল নানারকমের। দু-বিঘা জমির ওপরে বাড়ি করার সময়েই প্ল্যান করে নানা গাছ লাগিয়েছিলেন গেটের দু-ধারে। দু-পাশে দু-টি বটল ব্রাশ-এর গাছ। ভেতরে বসন্তি, চাঁপা, নাগকেশর, অগ্নিশিখা, শিউলি, ইত্যাদি গাছ। ফলের মধ্যে আম, কালোজাম, জলপাই, চেরি, আতা, ফলসা ওইসব গাছ। ঝোঁপের মধ্যে রঙ্গন, হাসনুহানা, রক্তকরবী, জুই। ওড়িশার জঙ্গল থেকে কন্টা বাঁশ গাছ এনেও লাগিয়েছিলেন বাউণ্ডারি ওয়ালের পাশে। সব গাছ-ই এখন বড়ো হয়ে গেছে। ফলগাছগুলোতে গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্তে নানা পাখির মেলা বসে। বাঁশঝাড়ের নীচে নীচে কুম্ভাটুয়া’ পাখিরা তাদের বাদামি কালো চিকন শরীর নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পোকা ধরে খায়। টিয়া, ময়না, কোকিল আসে যায়। ছাতারে আছে একঝাঁক যাদের ইংরেজি নাম ‘সেভেন সিস্টার্স’। কুম্ভাটুয়া পাখিগুলোকে মা কুবো’ বলেন। বাংলাতে নাকি ওই নাম তাদের। চড়ই, শালিক, ঘুঘু বাস্তু হয়ে থাকে আর থাকে একটা মস্ত বড় দাঁড়াশ সাপ জলপাই গাছের গোড়াতে। ইঁদুর ধরে খায় সে। শীতের দুপুরে একটা কেটে-ফেলা কনকচাঁপা গাছের কাটাগুড়িতে কুন্ডলী পাকিয়ে সে রোদ পোহায়। কখনো-কখনো সে পাখি ধরেও খায়। মা তখন রাগ করেন তবে ওর কোনো ক্ষতি করেন না। সাপটা বাবার আমল থেকে আছে। যা কিছু বাবার স্মৃতি বহনকারী তার সবকিছুকেই মা সযত্নে বাঁচিয়ে রাখেন।

বাবা বাইরের বারান্দার ডেক-চেয়ারে বসে ছুটির দিনের সকালে সম্বলপুর থেকে আনানো ‘অম্বুরি’ তামাক দিয়ে গড়গড়া খেতে খেতে কাগজ পড়তেন আর বিকেলে ঘুম থেকে উঠে পাখিদের ডাক শুনতেন। গ্রীষ্মদিনে পাখিদের স্নান করার আর তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে বার্ড বাথ বানিয়েছিলেন বাড়ির চারদিকে। পাখিরা আরাম করে স্নান করে তাতে। তা থেকে জল খায়। আজও খায়। পৃথিবী থেকে পাখির সংখ্যা যতই কমে আসছে, কমে আসছে এই অঙ্গুল শহর থেকে, তখন তাদের এই বাড়ির অভয়ারণ্যে ভিড় ক্রমশই বেড়েছে। বর্ষাকালে টুকটুকে লাল স্কার্লেট মিনিভেট পাখিরা আসে জোড়ে। গোল্ডেন ওরিওন বা বেনে-বউ, পিউ-কাঁহা বা ব্রেইনফিভার পাখি বসন্তের কামতি দুপুরে অবিরত ডেকে ডেকে আতশের কামকেও চাড়িয়ে দিয়ে যায়।

ওদের বাড়ির নাম ‘তিয়াসা। কারো বাড়ির নাম-ই এমন দেখা যায় না। কিন্তু বাবা, মায়ের সঙ্গে পরামর্শ না করেই এই নাম দিয়েছিলেন। মা কিছু মনে করেননি। বলতেন, আমার খুশি তো সব ব্যাপারেই মেনে নিয়েছেন তোদের বাবা, একটা ব্যাপারে না-হয় নিজের মত খাটালেন-ই।

বড়দি ছোড়দি বলত, কিন্তু তিয়াসা কেন? এমন উদ্ভট নাম কখনো শুনিনি। আমাদের স্কুলের মেয়েরা খ্যাপায়। বলে, কীসের তিয়াসা রে’?

মা বলতেন, তাদের বলবি যে, জীবন-তিয়াসা। বলবি, প্রত্যেক মানুষের জীবন-ই এক পিয়াসা বা তিয়াসা। এ-কথা উপলব্ধি করার মতো গভীরতা সকলের থাকে না। এই বলে, বকে দিবি ওদের।

দিদিরা হাসত। বলত, বকব।

সকাল থেকে দু-কাপ চা খেয়েছে আতশ। এবারে জলখাবার খাওয়ার সময় হয়েছে। পটা এসে বলল, চালন্তু রাজাবাবু, মা ডাকচি। নলিনীদিদি আসিলানি।

আতশ-এর মা শিশুকাল থেকেই একমাত্র ছেলেকে ‘রাজাবাবু’ বলে ডাকেন বলেই কাজের লোকজনেরাও তাই বলে ডাকে।

কেব্বে আসিলা নলিনীদিদি? বলল, আতশ। তা ঘণ্টাভর হইথিবে।

নলিনী এক ঘণ্টা হল এসেছে অথচ ওর কাছে আসেনি। অভিমান হল আতশের। আতশের মায়ের যেমন প্রিয় নলিনী, নলিনীরও তেমন-ই প্রিয় আতশের মা। বয়েসের কত ব্যবধান কিন্তু দু-জনে যখন মুখোমুখি বসে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা গল্প করেন, হেসে গড়ান, তখন দেখে মনে হয় দুই প্রিয়সখীই বুঝি। একজন অসমবয়েসি মেয়ের সঙ্গে অন্য একজন মেয়ের যেমন সখ্য তেমনটি দু-জন পুরুষের মধ্যে কখনো হয় না।

আতশ খাওয়ার ঘরে গিয়ে খাবার টেবিল ও চেয়ার টেনে বসল। দেখল, নলিনী লাগোয়া রান্নাঘরে আলু আর কুমড়োর হেঁচকি করছে কালোজিরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে–যেমনটি আতশ খেতে ভালোবাসে। আর লুচি ভাজছেন।

কতক্ষণ এসেছ?

আতশ জিজ্ঞেস করল নলিনীকে।

এই তো এলাম।

পটা যে বলল, এক ঘণ্টা হল এসেছ!

তাহলে তাই। কেন? জবাবদিহি করতে হবে নাকি?

স্নিগ্ধা বললেন, এই শুরু হল তোদের খুনশুটি।

আতশ বলল, আমি তোমার কে যে, আমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে তোমার?

তবে তো জানোই! জেনে-শুনেও বলা কেন?

অভ্যেসে বলি।

বদভ্যাস ত্যাগ করো।

তোমার কলেজ কবে খুলবে?

সকলের-ই যখন খুলবে। গ্রীষ্মের ছুটির পরে।

মাধব বিশ্ববলের কাছে কোচিং নিতে যাও না আজকাল?

কথাটার মধ্যে নিছক জিজ্ঞাসাই নয়, একটু যেন ঈর্ষারও গন্ধ ছিল।

নলিনী তার খঞ্জন পাখির মতো কুচকুচে কালো দুটি চোখের মণি নাচিয়ে বলল, যাই তো! প্রায় রোজ-ই যাই। না গেলে আমার ঘুম-ই হয় না।

তাই?

বলল, আতশ।

নলিনী বলল, এবারে ছুটিতে এসে একদিনও যাওনি তুমি মাধবদার কাছে?

আমি কী করতে যাব? আমি তো মাধবের ছাত্র নই।

তা নও কিন্তু মাধবদাদা তোমার সহপাঠী তো বটেই।

ওরকম সহপাঠী তো অঙ্গুল শহরে আমার কতই আছে। ঢেনকানলেও আছে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, দেশের কী অবস্থা হল। যত বাজে ছাত্র তারা সবাই অধ্যাপক হয়ে গেল, অন্য কিছু হতে না পেরে।

তুমিও তো স্কুলমাস্টার।

আমি তো খুবই খারাপ ছাত্র ছিলাম। খারাপ হলেও ভালোর ভান তো করিনি কখনো।

কেন? থার্ড ক্লাস এম. এ.-রাই তো ভালো অধ্যাপক হয়ে এসেছে চিরদিন। ভালো পরীক্ষার্থী হওয়া আর ভালো শিক্ষক হওয়ার মধ্যে তফাত আছে।

বলেই বলল, যাকগে তোমার সঙ্গে এখন কথা বলব না। আলু-কুমড়োর ছেচকিটা ভালোমতো নামাই, তারপর খাওয়ার টেবিলে বসে কথা হবে।

বলেই, স্নিগ্ধার দিকে চেয়ে বলল, ও মাউসি। তুমি কতগুলো লুচি বেলেছ? পুরো শিমলিপদার মানুষের খাওয়া হয়ে যাবে।

আরে আমার উপোসি ছেলেই তো খাবে গোটাকুড়ি। বেচারি কী খায় আর না খায়–একা থাকে আর ওর দেখাশোনা যে, করে সে বাইধর পিলাটা একেবারেই রাঁধতে জানে না। তাই যখন কাছে থাকে তখন একটু পছন্দসই খাবার বেঁধে খাওয়াই।

নলিনী বলল, আমরা ভারতীয়রা খেয়ে আর খাইয়েই, সবটুকু সময় নষ্ট করলাম। We believe that the only way to the heart is through the stomach.

স্নিগ্ধা বললেন, আমাদের প্রজন্ম আর কতদিন থাকবে? আমাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তো এসব পাট যাবে। তখন তোমরা ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড-এর মতো ব্যাগেল আর চিজ খেয়েই থেকো।

ব্যাগেল-এর কথা তোমাকে কে বলল? নলিনী জিজ্ঞেস করল।

পাশের বাড়ির কালু। সে তো এখন স্টেটসে থাকে। ইয়র্কের কাছেই। বাল্টিমোরে।

ব্যাগেল আমার খেতে ভালো লাগে না। যখন মনট্রিয়ালে দিদির কাছে গেছিলাম তখন খেয়েছি।

নলিনী বলল।

তারপর বলল, ওটা ইজরায়েলি রুটি একরকম। পুরো পশ্চিমে সকলেই খায়। পরে হয়তো আর খাবে না। যখন যার ওপর নেকনজর পড়ে ওরা তাই করে।

আতশ বলল, আসলে পশ্চিমি দেশে জুতো-সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবকিছুই নিজেদের-ই তো করতে হয় আর প্রত্যেকেই ভীষণ টেনশানে থাকে, প্রত্যেককেই সপ্তাহে পাঁচদিন ভীষণ-ই কাজ করতে হয়, সে ছাত্ৰই হোক, কী চাকুরে। তাই খাওয়া নিয়ে অত ঝামেলা ওদের পোষায় না। তবে সপ্তাহে দু-একদিন যখন, বাইরে রেস্তোরাঁতে খায় তখন এমন-ই পেট ভরে খায় যে, পরে দু-দিন উপোস করে।

স্নিগ্ধা বললেন, তোর যত বাজে কথা।

নলিনী বলল, না মাউসি। কথাটা ঠিক-ই বলেছে আতশ।

সকলে মিলে খেতে বসে নানা গল্প করছিল। আতশ বলল, কোনো আচার নেই মা?

স্নিগ্ধা বলল, নেই। তবে আমের আচার বানাচ্ছি। আর ক-দিন রোদ পেলেই হয়ে যাবে।

নলিনী বলল, তেঁতুলের আচার খাবে?

কোথায়?

আমাদের বাড়িতে আছে। বউদি করেছে। লঙ্কার আচারও আছে। আমি এখুনি নিয়ে আসছি। যাব আর আসব।

সে কী? লুচিগুলো সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে যে।

স্নিগ্ধা উদবেগের সঙ্গে বললেন।

যাবে না যাবে না, বললাম না, যাব আর আসব?

দাদা বউদি বসে চা খাচ্ছিল। বউদি বলল, কী হয়েছে রে? মাউসির হার্ট-অ্যাটাক হল নাকি?

না-না। দুটো পাত্র দাও তো!

পাত্র? কী করবি?

আচার নিয়ে যাব। আতশ খেতে বসেছে। তোমার হাতের আচার ওর খুব পছন্দ, খুব-ই ভালোবেসে খায়।

চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে নলিনীর বউদি নন্দা ওর সঙ্গে ভাঁড়ার ঘরে যেতে যেতে বলল, আতশ তোর চেয়েও ভালোবেসে খায় আচার?

এমন বাজে কথা বলো-না! তুমি বড় বাজে কথা বলো বউদি।

কপট রাগের সঙ্গে বলল নলিনী। তারপরেই দুটো কাঁচের বাটিতে করে আচার নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

নন্দা বলল, জলখাবার খাবি তো? তাড়াতাড়ি আয়। আমি চিড়ের পোলাউ করছি আজ।

ওখানেই খেয়ে আসব বউদি।

নলিনী চলে গেলে, নলিনীর দাদা নন্দন বলল, এত ভালো ভালো ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ করলাম। ওরা নলিনীর পড়াশোনারও কোনো ব্যাঘাত ঘটাতেন না। অত অবস্থাপন্ন সব ঘর। ছেলেও তো একটি নয়, তিন-তিনটি। দেখতে-শুনতে, স্বভাব-চরিত্রে সকলেই ভালো। বাড়ি, গাড়ি, বাগানবাড়ি, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান–তা মেয়ের পছন্দই হল না।

তুমি বড়ো অবুঝ।

নন্দা বলল।

বাড়ি, গাড়ি, বাগানবাড়িকে তো বিয়ে করবে না? নলিনী যে, আতশকে পাগলের মতো ভালোবাসে।

হাঃ। করতপটার প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার!

তাতে কী? প্রকৃতি ভালোবাসে বলে ও তো ইচ্ছে করেই ওই চাকরি নিয়ে গেছে। বি. এড. ছেলে, ও কি কটক, ভুবনেশ্বর, সম্বলপুরে চাকরি পেত না? তা ছাড়া একমাত্র সন্তান না হলেও ও তো একমাত্র ছেলে। দুই দিদি আর বিধবা মায়ের চোখের মণি। আর ওদের বাড়িটা কী সুন্দর!

…গাছগাছালি, যেন তপোবন। আর আতশের মতো ছেলে হয় আজকের দিনে? যখন বহির্মুখীনতাই হচ্ছে যুগের হাওয়া, সে-যুগে অমন অন্তর্মুখী ছেলে আমি তো আর দেখি না। সবসময়ে পড়াশোনা করছে, গান গাইছে, ছবি আঁকছে। আমি তো ওরকম একটা স্বামী পেলে বর্তে যেতাম।

তা করোই না বিয়ে। আমি তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। আমার বোনটা বেঁচে যাবে। আতশ! আনসোশ্যাল। একটা বুকওয়ার্ম। আমি তো ওকে ওর ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি। ও তো পুরুষ নয়, মেয়েই।

সূক্ষ্মরুচির পুরুষেরা একটু মেয়েলিই হয়।

হ্যাঁ। তোমাকে বলেছে।

তুমি কী করে বুঝবে? তুমি যে, একটি আকাট। ব্যবসা বোঝো, সম্পত্তি বোঝো, টাকা বোঝে। আমার শ্বশুরমশায়ের মতো অতবড়ো লেখকের যে, কী করে তোমার মতো বেরসিক ছেলে হল ভেবেই পাই না।

তা তো বটেই। আছ তত ভালো! সূক্ষ্মরুচির ছেলেদের আমার দেখা আছে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। বউকে একটা শাড়ি কিনে দিতে পারে না, অভাবে দিন কাটে। তোমার আর্থিক সাচ্ছল্য আছে বলেই এত বড়ো বড়ো কথা বলতে পারো। বিয়ের পরে একদিনও কি হেঁটে কোথাও গেছ?

যাইনি। কিন্তু সে তো তুমি যেতে দাওনি বলে। তোমার অসম্মান হবে, আমি কোথাও হেঁটে গেলে। আশ্চর্য! কী অদ্ভুত সম্মানজ্ঞান। হেঁটে যেতে, রিকশাতে যেতে, কত স্বাধীনতা। আমার বিয়ের আগের দিনগুলোই ভালো ছিল। টাকাই জীবনে একমাত্র প্রার্থনার জিনিস নয়। বিয়ের পরে আমার সব স্বাধীনতাই চলে গেছে।

বললাম-ই তো! টাকার পাহাড়ের ওপরে বসে থাকো, দাস-দাসী-দারোয়ান-ড্রাইভার তুমি অভাবী মানুষদের দুঃখের কথা জানবে কী করে?

যাকগে! প্রসঙ্গ বদলাও! রবিবারের সকালে ঝগড়াঝাঁটি ভালো লাগে না। সপ্তাহে এই একটা দিন-ই তো থাকো বাড়িতে। ছেলে-মেয়ে থাকলে তাও সময়টা তাদের নিয়ে কেটে

ছেলে-মেয়ে হয়নি বিয়ের আটবছর পরেও সে কি আমার দোষ?

কার দোষ তা জানব কী করে? তুমি তো ভালো করে পরীক্ষাই করালে না। তোমার পরীক্ষা তো একেবারেই করালে না। ছেলে-মেয়ে না হলে, সব দোষ তো চিরদিন মেয়েদের ই হয়। তাদের বদনাম দেওয়া হয় বাঁজা বলে। পুরুষশাসিত সমাজে এই-ই নিয়ম। আমার দ্বারা হল না তা, আর একটা বিয়ে করো। নইলে অ্যাডাপ্ট করো–এতই যখন ছেলে মেয়ের শখ। এখন কত লোক-ই তো অ্যাডাপ্ট করছে। নইলে আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন করাও। সারোগেট মাদার ঠিক করো। আমি কিছুই মনে করব না–আমাকে শুধু সবসময়ে ও-জন্যে এমন বাক্যবাণে বিদ্ধ কোরো না। সত্যি বলছি, ভালো লাগে না আমার। আমার বাপের বাড়ির অবস্থা ভালো হলে আমি ফিরে যেতাম সেখানে। দুই ভাই নিজেরাই নিজেদের সংসার টানতে পারে না, মাকে ভালো করে দেখতে পারে না–আমার যাওয়ার পথ তো সব বন্ধ। কেন যে, মরতে ভগবান এই রূপ দিয়েছিলেন আমাকে। রূপ না থাকলে তো তোমার বাবা আমাকে আনতেন না। একটা জিনিস ভেবে আমার অবাক লাগে। নলিনীর মতো মেয়ে, তোমার বোন হল কীভাবে? তার মতো সূক্ষ্মরুচির, সুরসিক, আত্মমর্যাদাজ্ঞানসম্পন্ন, সুশ্রী মেয়ে, তার মতো সাহিত্য ও গান-বাজনা ভালোবাসা মেয়ে যে, তোমার বোন তা ভাবা পর্যন্ত যায় না। এক মা-বাবার যে, কতরকম সন্তান-ই হয়।

আমাকে কাগজগুলো ভালো করে পড়তে দাও। এম. সি. সি.র ছেলেরা ওড়িশাতেও নাকি গোলমাল শুরু করেছে। কটকে, সম্বলপুরে, চেনকানলে-অঙ্গুলে শুরু করতেই বা কী?

আমি মরি আমার চিন্তাতে আর তোমার যত আজেবাজে কথা সকালবেলাতে।

নন্দা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। রান্নার লোক, বেয়ারা, আয়া থাকলে কী হয়, নিজে তদারকি না করলে কিছুই সুষ্ঠুভাবে হয় না। কপিলাশ! কপিলাশ!’ বলে রান্নার ঠাকুরকে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে এগোল নন্দা।

রান্নার ঠাকুরের নাম কপিলাশ। রাউরকেল্লার কাছে বাড়ি ওর।

আতশদের খাওয়া হয়ে গেল। লুচি, কুমড়ো-আলুর হেঁচকি, তেঁতুল আর লঙ্কার আচার দিয়ে ওদের জলখাবার খাওয়া হয়ে গেলে স্নিগ্ধা বললেন, গতকাল মাসের বাজার এসেছে। আমায় এখন সেসব গুছিয়ে রাখতে হবে। দু-শিশি কাসুন্দি পাঠিয়েছে যতীনবাবুর স্ত্রী। আমাদের এখানে খাবার লোক কোথায়? আতশের তো আসার সঙ্গে সঙ্গেই যাওয়ার সময় হয়ে গেল। শাকটাক হলে কাসুন্দি দিয়ে ভাত মেখে খাই মা-ছেলেতে। দু-বোতল পড়ে থেকে নষ্ট হবে। তুই নিয়ে যা নলিনী একবোতল।

নলিনী বলল, দাদা খুব ভালোবাসে। খুব খুশি হবে। খাবার টেবিলের ওপরে রেখে দাও মাউসি, আমি যাওয়ার সময় নিয়ে যাব।

তারপর নলিনী আর আতশ, আতশের ঘরে গেল। ঘরময় বই, খাটের ওপরে বই, মেঝেতে বই।

নলিনী বলল, তুমি যদি কোনোদিন বিয়ে করো তখন, তোমার বউ শোবে কোথায়? বই-ই তো দেখছি তোমার বউ।

আমি তো সাধারণ মেয়ে বিয়ে করব না। বই’-ই হবে আমাদের দুজনের মধ্যের সেতু। সেও আমার-ই মতো ভালোবাসবে বই, উচ্চাঙ্গসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত। তাই বিছানার বই নিয়ে আমার চিন্তা নেই।

না হলেই ভালো। বলেই বলল, মার্কেজের এই বইটা তো দেখিনি। নেরুদারও। নতুন আনালে?

হ্যাঁ। ভুবনেশ্বরে একটি নতুন বইয়ের দোকান হয়েছে। নাম ‘দ্য প্রিন্ট ওয়ার্ল্ড’।

কোথায়, দোকানটা?

ভুবনেশ্বরে যে-মাঠে বইমেলা হয়, তার সামনের রাস্তায়। ঠিকানাটা লেখা আছে, ফোন নাম্বার ও ই-মেইল নাম্বারটা কিন্তু ফেলে এসেছি করতপটাতে। ওখানে অর্ডার দিলে ওরা ভি. পি. পি.-তেবই পাঠিয়ে দেয়। ও ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি তো ভুবনেশ্বরেই থাকো। তবে এদুটো তুমি নিয়ে যাও। আমি যাওয়ার আগে দিলেই হবে। না দিলেও রাগ করব না। আমার পড়া হয়ে গেছে। এখানে তো নানা জিনিস পড়ি-মুশকিল হয় করতপটাতে। সেখানে তো কিছুই নেই। ভালো লাইব্রেরি তো দূরস্থান।

স্কুলের লাইব্রেরিতেও কিছুই নেই? তা সেখানে মরতে গেলে কেন? চাকরি তো আরও অনেক পেয়েছিলে?

মরতে গেলাম অনেককে বাঁচাব বলে।

মানে?

মানে, আমরা তো ভাগ্যবান নলিনী। তুমি আমার স্কুলের ছেলে-মেয়েদের যদি দেখতে, তারা কীভাবে থাকে? কী খায়? কী পোশাক পরে? যদি জানতে তবে বুঝতে পারতে আমরা কত বড়ো ভাগ্যবান। ভাগ্যবান যেমন, তেমন, স্বার্থপরও বটে। শুধু আমরাই ভালো থাকব, ভালো পরব, ভালো খাব আর দেশের নব্বইভাগ মানুষ মনুষ্যেতর জীবনযাপন করবে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরেও এটা কি কাজের কথা?

তুমি দেখছি কমিউনিস্টদের মতো কথা বলছ।

আমাদের দেশে সাচ্চা কমিউনিস্ট আছে নাকি? সব বুলিবাজ, মুখোশধারী। তুমি বলতে পারো আমি এম. সি. সি.-দের মতো কথা বলছি, জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর মতো কথা বলছি।

তারা কী কথা বলে? দাদার কাছে গতরাতে শুনলাম, তারা নাকি, ওড়িশাতেও আস্তানা গাড়ছে। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, এসব রাজ্যে তো বহুদিন-ই হল এরা ঘাঁটি গেড়েছে। এই তো কিছুদিন আগে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুকে ল্যাণ্ডমাইন দিয়ে তারা প্রায় মেরেই ফেলেছিল। উনি প্রাণে বেঁচেছিলেন কিন্তু অন্য অনেকের প্রাণ গেছিল। ওরা মানুষ মারে কেন? মিটিং-মিছিল করতে পারে না? অত্যাচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না?

হাসল আতশ।

বলল, মিটিং-মিছিল, ঘেরাও করে নিজেদের শ্লাঘাকে সুড়সুড়ি দেওয়া যায় শুধু। বন্দুকের নল দিয়ে যা হয়, তা হয় না। হলে, ওরা কেউই অস্ত্র হাতে তুলে নিত না। আর আইনের কথা বলছ তুমি? সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ সেই কবে বলে গেছিলেন, আইন! সে তো তামাশামাত্র। বড়োলোকেরাই কেবল পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে। রবীন্দ্রনাথও কি লিখে যাননি? ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। অন্য পথ খোলা থাকলে ওরা এই বিপজ্জনক পথে যেত না। সত্তরের দশকে আমরা যখন প্রায় শিশু তখন, কলকাতার মেধাবী ছেলেরা নকশাল হয়ে যায়নি?

তা গেছিল। কিন্তু সে-আন্দোলন তো দমন করা হয়েছিল। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত গুপ্তর নেতৃত্বে রাইফেল আর রিভলবার দিয়ে তরতাজা বহুছেলেকে গুলি করে মেরে সে-আন্দোলন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশি অত্যাচারে কত ছেলে পঙ্গু হয়ে গেছিল। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে আমেরিকাতে চলে গেছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য আন্দোলন থেকে অ্যাবাউট টার্ন করে বুর্জোয়াও হয়ে গেছিল। তাদের কারো কারোকে দেখবার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যা-ই বলো, আমার হয়েছে।

তবে? আন্দোলন করে লাভ কী? যদি তা নিভেই যায়?

লাভ আছে নলিনী! আগুন নিভলেও ছাই থাকে, পুড়ে যাওয়ার স্মৃতি থাকে, হয়তো সব নেভে না, স্ফুলিঙ্গ থাকেই, যে-স্ফুলিঙ্গ থেকে পরে, আবার বড়ো আগুনের সৃষ্টি হতে পারে, হয়।

নলিনী চিন্তিত মুখে বলল, জানি না। তোমার জন্যে আমার বড়ো ভয় করে।

ভয়? ভয় কেন করবে নলিনী? আমার জন্যে গর্বিত হবে। নিজের একার জন্যে, নিজের নিজের বউ, সন্তান নিয়ে সুখী হওয়া তো খুবই সহজ। ছিমছাম ফ্ল্যাট, সুরক্ষিত চাকরি, কনভেন্টে পড়া বব-কাট চুলের তম্বী স্ত্রী, মারুতি ৮০০ গাড়ি, এই তো আজকের দিনের ‘উচ্চিশিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের পরমকামনা। আর সে-কামনাতে নিরন্তর আগুন জ্বালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়া। তারা তা করছে তাদের মুনাফা বাড়াবার জন্যে। দেশের বা দেশের অধিকাংশ মানুষদের কথা কি কোনো খবরের কাগজ বা টেলিভিশন চ্যানেল ভাবে? টেলিভিশনের পর্দায় বা সিনেমাতে মডেলদের পোশাক-আশাক, বাড়িঘর-এর যে, ছবি গাঁ-গঞ্জের মানুষ দেখে-তাতে তাদের মনে তুমুল খিদের সৃষ্টি হয়। সবরকম খিদে। সকলের-ই সব পেতে ইচ্ছে করে তা পাওয়ার যোগ্যতা তাদের থাক আর নাই থাক। এই বিকৃত খিদের-ই ফল আমরা দেখতে পাই, রোজ সকালে কাগজ খুললে বা টিভির নিউজ চ্যানেলে খবর দেখলে এবং শুনলে। এত ধর্ষণ, এত চুরি-ডাকাতি, এত খুন কী আর এমনি হয়? আগে তো হত না। সাধারণ গরিব গ্রামীণ মানুষকে পুরোপুরি বিপথচালিত করছে এই বিজ্ঞাপন-নির্ভর নানারকম মিডিয়া। এতে বড়োলোকের আরও টাকা হচ্ছে আর গরিব আরও গরিব হচ্ছে।

নলিনী অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।

তারপর বলল, তোমার কথা শুনলে রক্ত গরম হয়ে যায়, বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করে। আজকে সন্ধেবেলা এসো-না আমাদের বাড়ি, দাদাকে বলবে।

হাসল আতশ।

বলল, কিন্তু বলে লাভ হবে না। এসব কথা শোনবার ধৈর্য ও মানসিকতা নন্দনদার নেই। শুধু নন্দনদা কেন? সুখে-থাকা কারোর-ই নেই। বলে লাভ নেই। নন্দনদা ভাববে, আমিও ‘জনযুদ্ধ’ গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছি। অথচ আমি সেই গোষ্ঠীর একজনকেও চিনি না। তারা ওড়িশাতে ঘাঁটি গেড়েছে কি না তাও জানি না। যদিও আমি চাই যে, তারা ঘাঁটি গাড়ক। আমাদের এমন সুন্দর দেশটা কিছু খল, ভন্ড, বক্তৃতাবাজ রাজনীতিকের অপার লোভে ক্রমশই আমাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ এই দেশকে আমরা সোনার দেশ করে গড়ে তুলতে পারতাম। সব দলের নেতাদের-ই কোটি কোটি টাকা আর মুখে গরিব জনতার প্রতি জনদরদ। আর কতদিন সইবে বলো তো গরিবরা? তারা কি এমনি করেই মরতে জন্মেছিল এই সোনার ভারতবর্ষে? কী বলো তুমি?

আমি কিছু বুঝি না। লক্ষ্মীটি আতশ। এবারে এই প্রসঙ্গ বন্ধ করো। এসো আমরা একটু অন্য কথা বলি।

বলেই বলল, আমাকে একদিন মা সমলেশ্বরীর মন্দিরে নিয়ে যাবে, তোমার মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে?

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল আতশ। তারপর বলল, অতখানি পথ মোটরসাইকেলের পেছনে বসে যেতে তোমার কষ্ট হবে।

নলিনী মুখে না বলে বলল, অতখানি পথ তোমাকে জাপটে ধরে বসে যাব সেইটাই তো হবে আমার আনন্দ।

আতশ বলল, কবে যাবে ঠিক করো। গাড়ি ভাড়া করে নেব। মাও যেতে পারবে। নন্দা বউদিও যদি যেতে চায় তো যেতে পারবে। চলো, পথে রেঢ়াখখালে ননার দোকানে জমিয়ে দুপুরের খাবার খাব। ভোরে বেরোলে, মহানদীর ওপরের হিরাকুঁদ ড্যাম দেখে, সমলেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিয়ে, সম্বলপুর শহর, বুড়লা ঘুরে আমরা সন্ধে সন্ধেতে ফিরে আসব অঙ্গলে।

বেশ। তাই হবে। নলিনী বলল। তারপর বলল, আমাকে তোমার করতপটার বাড়িতে যেতে বললে না তো একদিনও। ইচ্ছে তো করে। খুব-ই করে। কিন্তু আমি যে, একা থাকি। লোকে কী বলবে? তার চেয়ে একদিন চলে এসো নন্দা বউদি আর মাকে নিয়ে। থেকে যেয়ো দু-তিনদিন। খুব মজা হবে।

আদুরে গলাতে নলিনী বলল, না। আমি একাই যাব।

তুমি একটা পাগলি। অবশ্য সে জন্যেই তোমাকে এত ভালোবাসি।

তারপরে বলল, সম্বলপুরে যেতে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেক মাইল পথ যেতে হবে। কোথাও বাইক খারাপ হয়ে গেলে, তোমার বিপদ হতে পারে। আমারও। তাই গাড়ি ভাড়া করে নেব।

কী বিপদ?

আমার বিপদ হতে পারে মানে টাকাপয়সা, মায় বাইকটা পর্যন্ত ছিনতাই হতে পারে। আরও বিপদ হতে পারে, তোমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে। দেশটা সভ্য হওয়ার বদলে দিনে দিনেই আগের থেকেও অনেক বেশি অসভ্য হয়ে উঠছে। জঙ্গলের মধ্যে তোমাকে একা পেলে তোমাকে নিয়ে যা-খুশি করতে পারে খারাপ মানুষ। তবু একথা বলব যে, গ্রামের বা জঙ্গলের মানুষের মধ্যে এখনও কিছু মনুষ্যত্ব আছে। শহরের মানুষদের মধ্যে একেবারেই নেই। তবে জঙ্গলের বা গ্রামের মানুষও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে টি. ভি. দেখে দেখে। কোনো সরকার-ই যে, কেন টিভির বিজ্ঞাপন আর টিভির নানা চ্যানেলের নানা অনুষ্ঠান সেন্সর করছে না, করছে না সিনেমাকেও তা আমার বুদ্ধির বাইরে। মানুষের ষড়রিপুর এমন বাড়বাড়ন্তর মুখে যে, এইসব বিজ্ঞাপন, টিভি সিরিয়াল আর সিনেমাই, একথা কবে বুঝবে দেশের হর্তা-কর্তারা তা ভগবান-ই জানেন।

নলিনী বলল, তাহলে গাড়িতেই যাব।

হ্যাঁ তাই চলো। তুমি নন্দা বউদি আর মায়ের সঙ্গে কথা বলে তারিখটা ঠিক করে ফ্যালো। তার আগে চলো একবার কটকে যাই। মা বলছিলেন, বহুদিন কটকের কটকচন্ডীর মন্দিরে পুজো দেন না। আমারও একবার কটকের গুলি-বন্দুকের দোকান ‘কে, সি. দাঁ’-তে কাজ আছে। দুই কাজ-ই হয়ে যাবে।

গুলি-বন্দুক দিয়ে তুমি কী করবে?

না, বাবার বন্দুকটা তো বাবার জীবদ্দশাতেই আমার নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছিলেন, কটক থেকে লাইসেন্স করিয়ে। তখন অঙ্গুল তো আলাদা ডিস্ট্রিক্ট ছিল না। কটকের সাব ডিভিশন ছিল। বন্দুকটা বিদেশি–ইংলিশ অথবা জার্মান হবে। নাম ‘জেকো। যা গুলি ছিল, সব পুরোনো হয়ে গেছে। লাইসেন্সে অনেক গুলিই পাওনা হয়েছে। কিছু নতুন গুলি তুলে আনব।

কী গুলি আনবে? মানে কী মারার গুলি?

সে ওঁদের কাছে জিজ্ঞেস করে নেব। কিছু পাখি মারার গুলি, কিছু হরিণ, শম্বর মারার গুলি, আর কিছু বাঘ, ভাল্লুক মারার গুলি।

মানুষ মারার গুলি আনবে না তো?

মানুষ তো সবচেয়ে কমজোরি, নাজুক প্রাণী। তাকে তো চড়াই পাখি মারার গুলি দিয়ে মারলেও সে মরে যায়। তবু জিজ্ঞেস করব, দোকানের কালাবাবুকে। জানি না আজও বেঁচে আছেন কি না। বাবার সঙ্গে গেছিলাম সে-দোকানে বছর পনেরো আগে একবার। তখন আমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি কটকের র‍্যাভেনশ কলেজে।

তা সবরকম-ই শিকার-ই তো এখন বেআইনি। গুলি দিয়ে কী করবে?

তা ঠিক। কিন্তু দেশে কোন আইনটা মানা হচ্ছে বলতে পারো? আইন যদি মানাই হত তবে দেশের জেলখানাগুলোতে আর জায়গা থাকত না। সব জায়গাতে নতুন নতুন জেলখানা বানাতে হত। শুয়োরদের মতো জনসংখ্যার বৃদ্ধি হয়েছে গত পঞ্চান্ন বছরে। সে তুলনায়, স্কুল, হাসপাতাল এবং জেলখানাও কি বৃদ্ধি পেয়েছে? জজসাহেবরা রায় দিচ্ছেন নানা মামলাতে, ফৌজদারি অথবা সিভিল মামলাতে, তা কার্যকর করছে না অ্যাডমিনিস্ট্রেশান, অধিকাংশ রাজ্যেই। নইলে, তুমি ভাবতে পারো, দাগি চোর-ডাকাতেরা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে নির্বাচন জিতে সংসদ বা বিধানসভার সভ্য এমনকী মন্ত্রীও হন কী করে? তাঁদের বিবেকে ‘লজ্জা’ বোধ বলে যে, কোনো বস্তু নেই, দেশের জনগণেরও কি ‘সহ্যশক্তির কোনো সীমা পরিসীমা নেই? আসলে, কিছু মনে কোরো না, সকলেই তোমার দাদা নন্দনদার-ই মতো অথবা আমার-ই মতো। নিজের ব্যবসা, নিজের রোজগার ঠিক আছে, স্ত্রী আর বোনকে নিয়ে সুখে আছেন। বড়োস্ক্রিনের টিভিতে নানা ক্যাসেট বা সি.ডি.তে দেশি-বিদেশি সব ছবি দেখছেন, বউদিকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে সফট পর্নো। নিজের সুখের তো কোনো বিঘ্ন ঘটছে না। দেশের যাই হোক-না-কেন। অসুবিধে যা-হচ্ছে, তা তো গরিবদের-ই। ওঁদের তা নিয়ে ভাববার প্রয়োজন-ই বা কী? আমিও মাস গেলে মাইনের চেক পাচ্ছি। রান্না এবং দেখাশোনার লোক আছে, ঝরনার পাশে চমৎকার বাড়িতে থাকি, স্কুলের হেডমাস্টারি করি–আমার স্কুলের ছেলেমেয়েরা যে, কেরোসিনের অভাবে রাতে পড়াশুনো করতে পারে না, রোজ জঙ্গলপাহাড়ের বিপজ্জনক নির্জন পথ দিয়ে পাঁচ-সাত মাইল হেঁটে আসে হেঁটে ফেরে স্কুল থেকে, দু-বেলা ভরপেট খেতে পায় না, তাদেরও তো আমরা বুলিবাজ, ভন্ড, অসৎ রাজনীতিবিদদের মতো মানুষ করে তোলবার জন্যেই লেখাপড়া শেখাই। শুধুমাত্র সিলেবাসে, যা আছে তাই-ই যদি পড়াই তাদের, তাহলে বাঁদরে দেশ ছেয়ে যাবে–মাধব যেমন পড়ায় তোমাদের। শিক্ষা’ বলতে যে, শুধুই বর্ণ-পরিচয় নয়, নানা বিষয়ে পন্ডিত হওয়া নয়, শিক্ষা মানে যে, চরিত্রগঠন ও শিক্ষা মানে যে, আদর্শবাদ রবীন্দ্রনাথের আদর্শ পূর্ণ মনুষ্যত্ব’র সাধনা এসব কথা, ক-জন স্কুল-শিক্ষক বা কলেজের অধ্যাপক জানেন? শিক্ষা নিয়ে ভাবেন ক-জন? পশ্চিমবঙ্গে তো শুনি শিক্ষার নামে প্রহসন চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও অনেকে ঠগ এবং ভন্ড বেরোচ্ছেন–তুমি এই শিক্ষকমন্ডলীর কাছ থেকে কোনো শিক্ষার আশা করতে পারো?

নলিনী বলল, তোমার মধ্যে বড়োবেশি তিক্ততা জমে উঠেছে, বড়োবেশি ক্ষোভ এবং যন্ত্রণা। বুঝেছ আতশ?

তা তো জমেছেই। অস্বীকার করি না তা।

তোমার এইসব প্রলয়ংকরী ধ্যানধ্যারণা সমাজের বা দেশের কতটুকু ভালো করবে তা আমি জানি না। কারণ, তোমার ক্ষমতা যে, অতিসামান্য। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি যে, হাসিখুশি রসিক, জীবনকে দারুণ ভালোবাসা একজন মানুষের ভেতরটা এইসব, ভাবনা, চিন্তা কুরে কুরে খেয়ে যাচ্ছে। তুমি মানুষটাই যদি নষ্ট হয়ে যাও, ভেঙে পড়ো, তাহলে দেশ ও দশের কী হল-না-হল তা দিয়ে তোমার কী লাভ হবে আতশ? আমার-ই বা কী লাভ হবে?

দ্যাখো নলিনী, আমরা সকলেই নিজের নিজের ‘লাভ’-এর কথাই ভাবি বলেই তো দেশের আজ এই অবস্থা। আমার শিক্ষা, বিদ্যা এবং বুদ্ধি দিয়ে দেশের এবং দশের কোনো উপকার-ই যদি না করতে পারি তবে তো আমার সব শিক্ষাই বৃথা গেছে বলতে হবে।

কিন্তু তোমার এই ভাবনা-চিন্তা তোমার ব্যক্তিগত জীবনটাকে যে, নষ্ট করে দিচ্ছে তোমার অনবধানে তা কি তুমি ভেবেছ একবারও?

তা কেন হবে? আমার ব্যক্তিগত জীবন আমার-ই থাকবে। তবে আমার মতো অন্যরকম মানুষের জীবনসঙ্গিনী কোনো নারী যে, হতে চাইবে না তা আমি জানি। তা কী করা যাবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতমা নারীর থেকেও আমার দেশকে আমি যে, বেশি ভালোবাসি। আমার ব্রতে, আমার যজ্ঞে যদি কেউ শামিল হয় কোনোদিন তবেই দাম্পত্য হবে আমার, নইলে এমন-ই একা একাই কেটে যাবে বাকিজীবন।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, জানো নলিনী, যে-মানুষ একা থাকতে না পারে, যার বেঁচে থাকার জন্যে অন্য পুরুষ বা নারীর প্রয়োজন হয়, বলতে হবে তার মনুষ্যত্ব পূর্ণতা পায়নি।

তাই?

তাই তো! কথাটা ভেবে দেখো।

তারপর বলল, এতকিছু যে পড়ো, তা নিয়ে কখনো ভাবো কি? পড়ার চেয়ে ভাবাটা অনেক-ইবেশি জরুরি। আমরা প্রত্যেক মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষিত মানুষ, অন্ধকার সমুদ্রে একা একা নৌকো বাইছি। কোন দিকে চলেছি তা আমরা নিজেরাই জানি না। যেটাকে গন্তব্য বলে জানি, সেটা হয়তো অনিশ্চিত অথবা অবর্তমান। মরীচিকা!

নলিনী চুপ করে রইল অনেকক্ষণ।

আতশ বলল, কী হল? কথাগুলো পছন্দ হল না বুঝি?

পছন্দ হল। খুব-ই হল। কিন্তু তোমার জন্যে আমার খুব ভয় করছে।

ভয়? কেন ভয় কেন?

না, তুমি এতটাই ওয়ার্কড-আপ, উত্তেজিত হয়ে রয়েছ যে, ভয় হয় তোমার হার্ট-অ্যাটাক হবে, নয়তো তুমিও এম.সি.সি. বা জনযুদ্ধে যোগ দেবে।

সে-ভয় তোমার অমূলক। তাদের আমি কারোকেই চিনি না। তা ছাড়া, যতদূর জানি এই মুহূর্তে তারা এই অঞ্চলে আসেওনি। তা ছাড়া আমার মতো তিরিশ পেরোনো মানুষকে ওরা দলে নেবেই বা কেন? ওদের টগবগে-রক্তের পুরুষ ও নারীর দরকার, সতেরো-আঠারো থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশ। যে-বয়সে মানুষের অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা থাকে না–যখন সহজেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। আর হার্ট-অ্যাটাক আমার হবে না। হার্ট-অ্যাটাক হয় ঈর্ষা থেকে, অর্থচিন্তা থেকে, বিদ্বেষ থেকে, পরের ক্ষতি করার চিন্তা থেকে বা কোনো গভীর উদবেগ থেকে। আমার তো সবসময়েই আনন্দ। “আনন্দম! আনন্দম! আনন্দম’! এই আমার জীবনের মন্ত্র। না, আমার হার্ট-অ্যাটাক হবে না, তুমি নিশ্চিন থাকতে পারো।

নলিনী বলল, তোমার সঙ্গে অনেক কথা ছিল। আজ আর কোনো কথাই হবে না। পরে আসব আর একদিন। আমাদের বাড়িতে এসো একদিন। বউদি বলেছিল, কবে যেতে পারবে জেনে আসতে।

নন্দা বউদি যেদিন খাওয়াবেন। তবে ওঁর সামনে যেতে ভয় করে।

কেন?

বাবাঃ যা রূপ! মনে হয়, আগুনে পুড়ে যাব।

তারপর-ই বলল, তুমিও তো কম রূপসি নও। কিন্তু তোমার সৌন্দর্য কাঁঠালিচাঁপার মতো স্নিগ্ধ আর নন্দা বউদি যেন, অগ্নিশিখা। অমন সৌন্দর্যকে ভয় করে। মনে হয়, পুড়িয়ে দেবে বুঝি।

নলিনী হেসে বলল, বই দু-টি আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি করতপটা ফেরার আগে এখানেই পড়ে ফিরিয়ে দেব। বউদিকে গিয়ে তোমার কমপ্লিমেন্টস দেব।

তারপর বলল, তুমি যে, বউদিকে ভয় পাও সে-কথা বলব বউদিকে? বলতে পারো। তাতে বউদি খুশিই হবেন। মেয়েমাত্রই পাবক। দগ্ধ করাতেই তাঁদের আনন্দ।

সব মেয়েই কি সেরকম?

না, সব মেয়ে নয়। তোমার মতো স্নিগ্ধ, সুগন্ধি অগ্নিনির্বাপক খুব কম মেয়েই হয়। বলল,

আতশ।

চলি।

বলে, ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এল নলিনী।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ