১১.

মুণ্ডাদের গ্রামে একজন করে পাহান থাকেন। পাহানই যেন ঈশ্বরের প্রতিভূ। সমস্ত সামাজিক ও ধার্মিক ক্রিয়াকান্ডতে তাঁদের মতই একমাত্র প্রণিধানযোগ্য বলে পরিগণিত হত। বিহারের রাঁচির কাছে মুরহু আর রাঁচির মধ্যে খুঁটি বলে একটি সুন্দর জায়গা আছে। যে রাস্তা খুঁটি হয়ে মুরহু চলে গেছে সেই রাস্তাই পৌঁছেছে গিয়ে চাঁইবাসাতে, টেবো ঘাট হয়ে। ওই অঞ্চলেই ছিল বীরসা মুণ্ডার বাস। বীরসা মুণ্ডার উলগুলান বা বিদ্রোহের কথা দেশের এবং ইংল্যাণ্ডের কাগজে পড়েছিলাম। এই বিদ্রোহের মূলই ছিল খুঁটকাট্টি নিয়ে। মুণ্ডাদের গ্রামগুলিকেও খুঁটকাট্টি বলা হত। গোত্র জাত বা গোষ্ঠীকে মুণ্ডারা বলে কিলি। খুট মানে উত্তরাধিকারও বটে।

হফফম্যান সাহেবের লেখাতে এই খুট আর কিলি নিয়ে বোধ হয় একটু ধোঁয়াশা ছিল। এক একটি কিলির আলাদা আলাদা কবর স্থান ছিল। তাদের বলা হত সানডিরি। কিলি নয়, প্রত্যেকটি খুঁটেরই বুনো জমির সংস্কার এবং তা বসবাসযগো করার ব্যাপারে, নতুন বসতি স্থাপনের ব্যাপারে, নতুন বসতি স্থাপনের ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা ছিল। হফফম্যান সাহেবের পরবর্তী পন্ডিতরাই এই সত্য পরে প্রতিবিম্বিত করেন। হফম্যান সাহেব নিজে মিশনারি ছিলেন বলে পাহানদের সম্বন্ধে ওঁর বিশেষ ঔৎসুক্য ছিল এবং হয়তো ওই ঔৎসুক্যবশেই পাহান-দের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার একটি বিশেষ ইচ্ছে ওঁর অবচেতনে কাজ করেছিল।

যে খুঁট আদিম অরণ্যর যতখানি জায়গা সংস্কার করে, চাষবাস ও বসবাসযোগ্য করে নিতে পারত ততখানি জমিই সেই বিশেষ খুঁট-এর দখলে থাকত। কোনো বিশেষ গ্রামের সবচেয়ে ক্ষমতাবানরা ছিল খুঁটকাট্টিদারেরা। তাদের প্রজা থাকত কিছু। আর থাকত ভূমিহীন শ্রমিক বা রাইয়তরা। তা ছাড়া কৃষিসমাজের প্রয়োজনীয় নানা জাত থাকত একটি খুঁট-এ। যেমন কুমোর, নাপিত ইত্যাদি। হফম্যান সাহেব পাহানদের সকলের চেয়ে বড়ো বলে বলেছেন। কিন্তু পাহানদের সম্বন্ধে অন্যত্র যা পড়েছি তাতে মনে হয় না, যে তিনি ঠিক কথা বলেছিলেন।

মুণ্ডারা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেই ছড়িয়ে আছে। শুধু বিহারের ছোটোনাগপুরেই নয়। বিহারে, ওড়িশাতে, পশ্চিমবঙ্গের কিছু জায়গাতে, মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকাতেও তাদের বাস। নর্মদার তীরের মান্দলার পুবে বসবাসকারী মুণ্ডাদের নিয়ে অনেক মুণ্ডাতত্ত্ববিদ যথেষ্ট কাজ করেছেন। তারমধ্যে ফাদার স্টিফেন ফুকস-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উনি কাজ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। ওই অঞ্চলের হয়ত গোন্দ ও ভূমিয়াদের ওপরে তাঁর কাজ কখনো পুস্তকাকারে প্রকাশিতও হবে ভবিষ্যতে। আমাদের এই বিশাল বিচিত্র সুন্দর দেশের আদিবাসীদের বৈচিত্র্য যত তাদের মিলও তত। এই মধ্যপ্রদেশের মুণ্ডা এবং গোরা অত্যন্তই সুন্দর। তাদের চেহারায়। দীর্ঘাকৃতি, চিকন, কাটা-কাটা নাক মুখের, দিঘল চোখের। হনসোর মতো সুন্দরী মেয়ে তো আমি সাগরপারের কম দেশেই দেখেছি। তার ত্বকের উজ্জ্বলতা, তার শরীরের বাঁধন ছাপানো উপচে-পড়া সৌন্দর্যের সঙ্গে সাগরপারের মেয়েদের মহার্ঘ্য সাজপোশাক, দুর্মূল্য সুরভি এবং প্রসাধন বাদ দিয়ে তাদের প্রায় অর্ধনগ্ন করে হনসোর পাশে দাঁড় করালে তাদের অনেকেই লজ্জায় অধোবদন হবে!

 না। আমার কোনো অনুশোচনা নেই, পরিতাপ নেই বিন্দুমাত্র। যে দেশের মানুষ আমি, সেই দেশের ধুলো, সেই দেশের বনবনানী, পাহাড়-উপত্যকা, প্রান্তর-নদীরই মতো তার নারীও আমাকে মুগ্ধ করেছে। আর অন্তর থেকে আমি বার বার জঙ্গলের একলা পথে হাঁটতে হাঁটতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই বিখ্যাত গানটি গেয়ে উঠি এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি। সবদিক দিয়েই এমন দেশ আর হয় না। যদি স্বাধীন হওয়া এই মাতৃভূমির নেতারা এই দেশকে আমারই মতো ভালোবাসেন এবং ঠিক পথে চালিত করেন তবে এদেশে সোনা ফলবে।

এই খুঁটকাট্টি ব্যাপারটি কিন্তু এদিকে নেই। বিহারের পালামৌ রোহটাস এবং ওড়িশার খন্দমালেই এই প্রথার চল ছিল। তা ছাড়া সব খুঁটকাট্টিদারই যে আদিবাসী এমনও নয় ওসব অঞ্চলে। জোর যার জমি তার সহজ এই নিয়মে অনেক অনাদিবাসীরাও খুঁটকাট্টিদার হয়ে উঠেছিলেন। মুণ্ডারা এক একটি এলাকাকে বলে ডিসুম। বীরসা মুণ্ডার উলগুলান-এর পরই খুঁটি সাবডিভিশানের পত্তন করেন ইংরেজরা। এর এলাকা ছিল দক্ষিণ-পুবের পোরাহাট এবং বুন্ডু পর্যন্ত। আজকেও ওইসব অঞ্চলে নিশ্চয়ই নিচ্ছিদ্র বন থাকার কথা, যে বনই আদিবাসীদের সমস্তরকম সামাজিক লৌকিক, অর্থনৈতিক এবং ধার্মিক ব্যবস্থার গোড়া। কোনোদিন যদি কোনো দুষ্টবুদ্ধি রাজনৈতিক নেতা অথবা স্বার্থান্ধ, নীতিবোধহীন, গরিবের ওপর অত্যাচারী অসৎ শাসকদের অদূরদর্শিতায় এই সরল আদিবাসীদের উত্তেজিত করে তুলে তাদের জীবনেরই সমার্থক বনকে বিনাশ করতে উদবুদ্ধ করা হয় তার চেয়ে দুঃখের আর কিছুই থাকবে না। বন শুধু আদিবাসীদেরই নয়, আমাদেরও অন্য মা। বন নিধন আর মাতৃহত্যা সমান পাপ। একদিন এই নব্য পৃথিবীর বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞ ভোগ্যপণ্যবিলাসী সংস্কৃতিতে ন্যুজ মানুষেরা হয়তো মাতৃহত্যাও করবে। পৃথিবীর আয়ু আর বেশি নেই। এই সুন্দরী মুমূর্ষ নারীকে আমাদের সেবায় যত্নে যদি বাঁচিয়ে রাখতে না পারি তাহলে আমাদেরও বাঁচার আর কোনো পথ থাকবে না।

আমি তো এই বন এবং বনকন্যাকে ভালোবেসেই অন্য এক সস্তা আরামের জীবন ছেড়ে এখানে চলে এলাম।

.

১২.

বৈশাখের প্রথমের মতো এত সুন্দরী, প্রকৃতিকে আমি খুব কম সময়েই দেখি বোধ হয়। না। অন্য কোনো ঋতুতেই সে এতখানি সুন্দরী নয়। ভোগী এবং যোগী যেন একাসনে বসেন বনে পাহাড়ে প্রান্তরের আনাচে-কানাচে। পলাশ, শিমুল, কুসুম, ফুলদাওয়াই, পিলাবিবি, কৃষ্ণচূড়া, নানা জাতের আকাসিয়া, জাকারাণ্ডারা যেমন লাল, গোলাপি, গাঢ় লাল, বেগুনি ও ফিকে বেগুনির আভায় আভায় আভাসিত করে দিগন্তরেখা, তেমনি আবার পাতা-ঝরা বনে বনে পাতা খসে গিয়ে পাতা গজায় নতুন। কত তাদের রঙের বাহার। সবুজ আর লালের যে, কত রকম হয় তা পৃথিবীর কোনো শিল্পীই এখনও ভাবতে পর্যন্ত পারেন না। বিধাতার মতো শিল্পী তো আর দেখলাম না!

আমাদের পর্ণকুটিরের পাশের পথে একটি পেয়ারা গাছ আছে। কে কবে লাগিয়েছিল জানা নেই। তার একটি পাতাও এখন অবশিষ্ট নেই। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় যখন আকাশে কতসব বিচিত্র রঙের নরম নিঃশব্দ হোরিখেলা চলে তখন আমি আমাদের মাটির ঘরের দাওয়াতে বসে সেই পত্রহীন গাছের উধ্ববাহু নিপণ ডালপালাগুলিকে আকাশের পটভূমিতে লক্ষ করি আর মুগ্ধ হয়ে যাই। কী যে সব সামান্য ছবি ফুটে ওঠে! কী দারুণ সব ফ্রেমিং! ভাবা যায় না। যিনি একটি পত্রশূন্য গাছ এবং মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে দেওয়া নির্মেঘ আকাশের পটভূমি নিয়ে এমন এমন সব অসামান্য ছবি আঁকেন তিনিই যে রঙের গুরু সে বিষয়ে মনে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না। মাঝে মাঝেই ঈশ্বরের কাছে সত্যিই বড়ো কৃতজ্ঞ বোধ করি। আমাকে দেখার চোখ দিয়েছিলেন বলে, ভাবার ক্ষমতা দিয়েছিলেন বলে এবং আপাত-তুচ্ছ জিনিসের মধ্যে অসামান্যকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন বলে।

যখন ইংল্যাণ্ড থেকে কন্টিনেন্টে গেছিলাম, সঙ্গে আমার ইংরেজ বান্ধবী ছিল মার্গারেট। আমরা সুইটজারল্যাণ্ড, অস্ট্রিয়া, ইটালি, স্পেন, হল্যাণ্ড, জার্মানি ইত্যাদি ঘুরে বেলজিয়াম পৌঁছে অস্টেণ্ড থেকে বোট ধরে ডোভার হয়ে ফিরেছিলাম। বান্ধবীর মনের সঙ্গ, তার শরীরের সান্নিধ্য, তার শরীরমনের আনাচেকানাচে অতপাতি করে কত খুঁজলাম রুদ্ধ-দুয়ার ঘরে অথবা উন্মুক্ত বাইরে। মার্গারেটের দুটি গজদন্ত ছিল। হাসলে গালে টোল পড়ত। শরীরের অনুপাতে স্তন দুটি ছোটো ছিল। ছোটো স্তনের নারীদের কামবোধ বেশি থাকে। জানি না। আমি যাদের দেখেছি তাদের কথাই বলতে পারি শুধু। আমার ধারণা অমূলকও হতে পারে। ও তখন বলত, এরপরের বারের ছুটিতে আমরা স্টেটস-এ যাব। তারপরের বার হাওয়াই। তার পরের বার বাহামা। তারপরের বার জাপান।

আমার আদর খেতে খেতে অথবা আমাকে আদর করা ওকে এবং হনসোকে দেখেও এখন আমার মনে হয় যে, খাজুরাহ কোনারকের দেশের শহুরে শিক্ষিত মেয়েরা আদর খেতেই জানে শুধু, আদর করতে বোধ হয় তেমন জানে না। তাদের আশৈশব শিক্ষা, সংযম, সংস্কার হয়তো তাদের বাধা দেয় এবং তাদের সঙ্গীদের তারা জীবনের এক পরমনমনীয়, সুন্দর ক্ষেত্রে বঞ্চিত করে রাখে। হনসোক দেখে আমার তাই-ই মনে হয়।

আমি উত্তর দিতাম না ওর কথায়। মাথা নেড়ে গাঢ়স্বরে বলতাম, বেশ! বেশ!

 ওকে বলে লাভ হত না কিছু। তাই-ই বলতাম না। এই ছোট্ট জীবনে, একটি জীবনে, শরীরে কত জায়গাতেই বা যাওয়া সম্ভব? কত দেশে? কতজন নারীর শরীরে?

মানুষ এবং পশুপাখিকে বিধাতা এই সীমাতেই বেঁধে রেখেছেন।

সুদূর সাইবেরিয়া বা অস্ট্রেলিয়া থেকে যেসব পরিযায়ী পাখি প্রতিবছর ভারতে আসে তারা আবার সাইবেরিয়া বা অস্ট্রেলিয়াতেই ফিরে যায়। লক্ষ লক্ষ মাছের এক একটি ঝাঁক শীতল জলের সমুদ্র থেকে সমুদ্রের জলের গভীরে যেসব হাইওয়ে আছে, আছে যেসব মুভিং স্টেয়ারস এসকালেটরস, তাতে করে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে পৌঁছে যায় কোনো উষ্ণ সাগরে, মিলনের জন্যে, ডিম ছাড়ার জন্যে। এইসবই শরীর দিয়ে যাওয়া কিন্তু শুধুমাত্র মানুষকেই মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি। তার যাত্রা, মনের গন্তব্য এবং মনের গতিতে কোনো বাঁধ নেই; বাধা নেই। কোনো হিন্দুস্থানি ওস্তাদের কণ্ঠসংগীতের তারার সপাট তানের মতো সে কখনো অতিদ্রুতপক্ষ, আবার সাগরবেলার একাকী সাদা সী-গালের ক্ষীণস্বরের মতো সে কখনো উদারায় অবস্থান করে। মুহূর্তের মধ্যে মানুষ যেখানে খুশি যেতে পারে, যেকোনো মানসিক ভাবনার রাজ্যে। তার যাত্রাপথে, গতিপথে, কোনো সাউণ্ডব্যারিয়ার নেই। আলোর গতি একসেকেণ্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল আর মনের গতির কোনো মাপই নির্ধারণ করা যায় না। হয়তো যাবেও না কোনোদিন। এইমুহূর্তে সে প্রেম, চাঁদে; পরমুহূর্তে সে সমরে, সূর্যে; আবার ক্ষণপরে সে বৈরাগ্যে, বৃহস্পতিতে। একজীবনে শরীর নিয়ে হাজার জায়গায় দৌড়ে না বেড়িয়ে মনকে যে দৌড় করিয়ে বেড়ায় তার মানবজীবন সার্থক। যারা একথাটাই বোঝে না তাদের জ্ঞানে এখনও ঘাটতি আছে বলতে হবে।

এই পাতা-ঝরা পাতা-গড়ার খেলা যখন বাইরের প্রকৃতিতে দেখি তখন ঘরে বসে সেই সব মানুষেরই লেখা পড়ি আমি। মানুষের মতো মানুষ যাঁরা। সর্বকালের সাহিত্যিক দার্শনিক সব।

দর্শনেরও কত ভাগ আছে। রাজনৈতিক দর্শন, অর্থনৈতিক দর্শন, সমাজ-সম্বন্ধীয় দর্শন, অধ্যাত্ম-দর্শন।

সাহিত্যেরও তো কত রূপ! সত্যিকারের সর্বকালীয় বড়ো সাহিত্যিকদের লেখার সঙ্গে যখন সর্বকালীয় বড়ো দার্শনিকদের লেখার তুলনা করি তখন একটা কথা আমার কাছে বার বার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রত্যেকের মধ্যে ঈশ্বরবোধকে লক্ষ করি। তা তিনি এমার্সনই হোন বা স্পিনোজাই হোন, আব্রাহাম লিঙ্কন বা মার্টিন লুথার কিং-ই হোন, গান্ধিই হোন কি বিবেকানন্দই হোন, বা টলস্টয় কিংবা রবীন্দ্রনাথই! অবাক হয়ে লক্ষ করি যে, যাঁর মধ্যে মনুষ্যত্ব, ভালোত্ব (ভালোত্বর ভান নয়) এবং আধ্যাত্মবোধ মূর্ত হয়ে না উঠেছে তাঁর একজীবনে হওয়ার মতো কিছুই হয়ে ওঠা হয় না। দাগ রেখে যাওয়া সেইসব মানুষের পক্ষে অসম্ভবই হয়। পৃথিবীর ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস তাই-ই বলে।

বড়ো হওয়ারও অনেকগুলি স্তর থাকে বোধ হয়। বিভিন্ন স্তরে, জীবনের বিভিন্ন পারংগমতার ক্ষেত্রে অসংখ্য গুণী ব্যক্তি যেকোনো সময়েই থাকেন। কিন্তু যাঁরা মানবজাতির, সর্বকালের সর্বদেশের চিরকালীন সম্পদ হয়ে বেঁচে আছেন আমাদের বুকে মহাকালের পরীক্ষা পাস করে তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যেই এই অধ্যাত্মবোধকে আমি অনুভব করি। মিছিমিছি ছুটোছুটি না করে, রবীন্দ্রনাথ বা বিনোদবিহারীরই মতো থিতু হওয়ারই আর এক নাম পরমগতিস্মানতা।

বাহির পথে বিবাগী হিয়া কিসের খোঁজে গেলি
আয়, আয়রে ফিরে আয়
পুরানো ঘরে দুয়ার দিয়া ছেঁড়া আসন মেলি
 বসিবি নিরালায়, আয়, আয় রে ফিরে আয়।

রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে।

আমি অতিসাধারণ মানুষ। নিজের সম্বন্ধে আমার কোনো মিথ্যে শ্লাঘা, অভিমান বা অহং নেই। আমার মনে হয় যাঁরাই আমাদের পূর্বসূরিদের রেখে-যাওয়া জ্ঞানের ধূলিকণাও একবার আঙুলে মেখেছেন তাঁদের কারও মধ্যেই প্রচারের প্রবৃত্তি থাকে না। যাঁরা নিজেদের চরিত্রের প্রকৃতি এবং ক্ষমতার সীমা সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ তাঁরাই নিজকালে নিজকাঁধে দামামা তুলে নিরন্তর বাজিয়ে বেড়ান। সেইসব তথাকথিত বিখ্যাত ও গুণী মানুষেরা ভুলে যান যে, কাল নিরবধি। পৃথিবীর সর্বশক্তিমান প্রবলতম কোনো মেডিয়াই কোনো মানুষকে প্রকৃত অমরত্ব দিতে পারে না। যাঁরা এইভাবে অমর হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান মৃত্যু অবধি তাঁদের বংশধরেরা পরে দুঃখের সঙ্গে দেখেন যে, তাঁদের কবর খোঁড়া হচ্ছে।

কোনো কোনো সময়ে আক্ষরিক অর্থে এবং কোনো কোনো সময়ে প্রতীকী অর্থে এই কবর খোঁড়া হয়।

কোনো দেশের কোনো কালের পাঠক এবং ভাবুক মানুষেরা কখনোই এত বোকা হন না যে সত্যকে, শাশ্বতকে, প্রকৃত গুণকে তাঁরা অস্বীকার করবেন। দীর্ঘ জীবন এবং মেডিয়ার দামামা কোনো মানুষকেই অমরত্ব দিতে পারে না। শতায়ু হওয়ার কামনা যখন আমরা করি কারও জন্যে, তখন আক্ষরিক অর্থে যতটা না করি তার চেয়ে অনেকই বেশি করি তার কীর্তি যেন তার মৃত্যুর পর শতবর্ষ অবধি অম্লান থাকে এই ভেবেই।

.

১৩.

শালডুংরিতে বাকি জীবন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কী ভালোই যে করেছি। আমার এই একটামাত্র জীবনকে ধীরেসুস্থে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করব। দৌড়ানো নয় কোনো জাগতিক উন্নতির জন্যে, প্রতিযোগিতা নয় কারও সঙ্গে, ঈর্ষা নয় কারও প্রতি, শুধু ঈশ্বরের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা, আমার পূর্বসূরিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে কী সুন্দর অনাড়ম্বর, সাধারণ, নিরুদবেগ হবে এই জীবন। ডিগ্রির দম্ভ নয়, মিথ্যা-শিক্ষার আস্ফালন নয়, প্রতিবেশীর চেয়ে ভাগ্যবান হওয়ার নোংরা গর্ব নয়, আমার আমিত্বকে পরিপূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়ে আমার শুধু আমারই বা কেন, পৃথিবীর সব মানুষেরই শিকড় খোঁজার চেষ্টা করে যাব বাকি ক-দিন।

ঈশ্বরের কৃপা হলে, এই গভীর অরণ্য পাহাড় বেষ্টিত ক্ষুদ্র পর্ণ-কুটিরে এই জংলি আমাকে আমারই কোনো উত্তরসুরি আবিষ্কার করবে। ঠিকই আবিষ্কার করবে। না না, প্রচারের কথা বলছি না, ভাবছিও না। আত্মপ্রচার নীচের ধর্ম। আমার ভাব-ভাবনা যদি এ পৃথিবীর অন্য একজন মানুষের কাজে আসে, তার জীবনকে সার্থকতর করে তুলতে সাহায্য করে তাহলেই আমার এই অগতানুগতিক জীবন সার্থক হবে। নিজের জীবন দিয়ে অন্যর আনন্দর সুখের এবং শান্তির জন্যে কিছুমাত্রও যদি না করে যাওয়া যায় তাহলে মানুষ হয়ে না জন্মে তো শুয়োর হয়ে জন্মালেই ভালো ছিল। শুধু আমার জীবনই নয়, কোনো মানুষের জীবনই তো নষ্ট করার নয়!

বাজাও তুমি কবি তোমার সঙ্গীত সুমধুর।
দ্রব জীবন ঝরিবে ঝরঝর নিঝর তব পায়ে
 বাজাও তুমি কবি…

অনেকদিন স্পিনোজা পড়িনি। আমার ভারি ভালো লাগে।

ষোলো-শো শতাব্দীর মানুষ ছিলেন। তাঁর চিন্তা ভাবনা, তাঁর দর্শন এই বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়ানো মানুষকেও কত নতুন এবং আশ্চর্য ভাবনাতে উদ্দীপিত করে।

 তখন পৃথিবীতে অবশ্য অনেক বেশি শান্তি ছিল, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব ছিল, সেলসম্যান, দালাল, বিজ্ঞাপন আর মেডিয়ার মানুষরা তখন সদম্ভে দাপিয়ে বেড়াত না পৃথিবীময়। ক্ষমতার লোভ, যেন-তেন-প্রকারেণ অর্জিত যশের লোভ, তাবৎ পৃথিবীর ওপরে কোনো বিশেষ দেশের একাধিপত্য করার লোভ মানুষকে, দেশের পর দেশকে এমন করে নষ্ট করেনি। ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল মানুষের, ধর্মভীরু ছিল মানুষ। আজ ধর্মবিশ্বাসী বা ঈশ্বর-বিশ্বাসী মানুষকে অগভীর মনুষ্যেতর তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী ঠাট্টা করে। তারা বলে ধর্ম আর কুসংস্কার এককথা। তার বোঝে না যে, ধর্ম আর রিচুয়ালস, সকাল-সন্ধে নিয়মের বেড়াজাল, পুজোর আচার-উপকরণ এক নয়। ধর্ম ছাড়া, ঈশ্বরবোধ ছাড়া মানুষ অমানুষ হয়ে ওঠে, যা আজ হয়েছে।

প্রত্যেকে ধর্মেরই দুটি স্তর থাকে। সে ধর্ম হিন্দু, মুসলমান, শিখ বা খ্রিস্টান যে ধর্মই হোক না কেন। সাধারণ মানসিকতার আপামর জনসাধারণের কাছে ধর্ম হচ্ছে এক বাইণ্ডিং ফোর্স। সাধারণের পক্ষে নিরাকার ঈশ্বরের ধারণা সম্ভব নয়। তাই তাদের জন্যে একসময়ে হিন্দুধর্মের প্রচারকরা অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক বিরাটত্বর পটভূমিতে মন্দির বানিয়েছিলেন। সমুদ্রপারে পুরী, মরুভূমির মধ্যে হিংলাজ, তুষারাবৃত গিরিশিখরের ওপরে কেদারনাথ, বদ্রীনাথ। বহমানা উত্তর-বাহিনী গঙ্গার তীরে বিশ্বনাথের মন্দিরে অসি ও বরুণার বারাণসীতে। দামাল ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের পাহাড়ে কামাখ্যা। প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্য ও বিরাটত্বর সামনে এসে দাঁড়ালেই সাধারণ মানুষের মনে, সে যে অতিদীনাতিদীন, সে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই ভাবটি জাগরূক করে।

 একমাত্র বিনয় এবং হিউমিলিটিই মানুষকে আত্মিক উত্তরণের পথে পৌঁছে দিতে পারে। আজকের দাম্ভিক, মূর্খ, নীচ, স্বার্থ-পরায়ণ, দ্বেষ ও ঈর্ষায় জর্জরিত মানুষ তাই ধর্ম কী ও কেন তা ভুলে যেতে বসেছে। শুধু তাই নয়, ধর্ম একটি কুসংস্কার-একথাও সদর্পে ঘোষণা করছে।

খ্রিস্টান ন্যূহ নৌকো বানিয়েছিলেন গ্রেট ডিলজের সময়। পৃথিবী পাপের ভারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তখন। প্রলয়ংকরী বন্যায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সব মানুষ ও প্রাণী, তাই নূহ তাঁর নৌকোতে উভয়লিঙ্গর এক একটি করে প্রাণী তুলে নৌকো ভাসিয়েছিলেন সৃষ্টি রক্ষা করতে। হয়তো সেই দিনের দিকেই আবারও এগোচ্ছি আমরা। বর্তমানে পৃথিবীর মানুষদের মানসিকতা দেখে তুলসীদাস, এবং অন্যান্য ভারতীয় সন্তদের লেখাতে যে, কলিযুগের বর্ণনা আছে, তা হুবহু মিলে যায়।

জানোয়ারের কোনো ধর্মের প্রয়োজন হয় না। ধর্ম এক মানসিক ঈপ্সারই বস্তু। মানুষের ধর্মই জানোয়ারের সঙ্গে মানুষকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। এই ধর্ম মানবিক ধর্ম। সব। ধর্মের মূল হচ্ছে যেকথা।

বুদ্ধদেব বলেছেন : মানুষের মনের প্রকৃতি হচ্ছে এক ঘন ঝোঁপের মতো। তারমধ্যে প্রবেশ করা এবং তাকে ভেদ করা বড় কঠিন। কিন্তু তুলনাতে জানোয়ারদের প্রকৃতি অনেক সহজ। তাদের বোঝাও সহজতর। তবু সাধারণভাবে মানবপ্রকৃতিকে আমরা মোটামুটি চার ভাগে ভাগ করতে পারি।

প্রথমভাগে পড়ছে সেইসব মানুষ; যারা ভুল শিক্ষার কারণে অনেক কিছুই করে, যা তাদের দুঃখই ডেকে আনে। দ্বিতীয়ভাগে পড়ছে তারা, যারা তাদের নিষ্ঠুরতার দ্বারা, তাদের চৌর্যবৃত্তি দ্বারা তাদের হনন করার প্রবৃত্তি অথবা অন্যান্য নানা নির্দয় কাজের দ্বারা অন্যদের কষ্ট দেয়। তৃতীয়ভাগে পড়ে তারা, যারা নিজেদের কষ্টের মধ্যে দিয়ে অন্যদের কষ্ট ডেকে আনে। তাদের নিজেদের সঙ্গে অন্যদেরও দুর্দশার মধ্যে ফেলে। আর চতুর্থভাগে হচ্ছে তারা, যারা নিজেরা দুঃখী হয় না এবং অন্যদেরও সুখী করে তোলে, বাঁচায় কষ্টের হাত থেকে।

এই চতুর্থ শ্রেণির মানুষেরাই বুদ্ধদেবের বাণী শিরোধার্য করে, লোভের, রাগের আর মূখামির শিকার হয় না কখনোই। তারা শান্তিতে বাঁচে দয়া আর প্রজ্ঞা নিয়ে। তারা চৌর্যবৃত্তি অথবা হননবৃত্তির আশ্রয় নেয় না।

 এই চৌর্যবৃত্তি বা হননবৃত্তি শুধু আক্ষরিক অর্থেই নয়। মানুষ চুরি করে ক্ষমতাবান হতে পারে, যশস্বী হতে পারে। অন্যের ভালোত্বকে, নির্মল চরিত্রকে হনন করতে পারে, তাও চুরি করে।

সেই চুরি এবং সেই হত্যা আক্ষরিক অর্থর চৌর্যবৃত্তি বা হননবৃত্তির চেয়ে কোনো অংশেই কম নিন্দনীয় নয়। অথচ ওইসব চোর আর খুনিতেই পৃথিবী ভরে গেছে এখন। আমার মনে হয় আমি এইরকম চরিত্রের মানুষদের মুখ দেখেই তাদের বুঝতে পারি। তাহা বাহ্যিক চেহারাতে সুন্দরই হোক কি কুৎসিতই হোক, ফর্সাই হোক কি কালোই হোক তারা কাছে এলেই আমার দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। এইসব চোর ও খুনিরা অন্যের চোখে সোজা করে চাইতে পর্যন্ত পারে না। তারা যেখানেই থাকে সেখানেরই পরিমন্ডলে এক অদৃশ্য কু-তরঙ্গ ওঠে। আর ভালো মানুষ, মানে এই চতুর্থ শ্রেণির মানুষরা যেখানেই যায়, যার সঙ্গেই ক্ষণিক মেলামেশা করে, সেই স্থানে এবং সেই মানুষের মনে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

ধম্মপদ-এর পাঁচ নম্বর শ্লোকে আছে যে ঘৃণাকে কখনোই ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না এই পৃথিবীতে। শুধু ভালোবাসা দিয়েই ঘৃণাকে অপসারিত করা যায়। এই হচ্ছে সুপ্রাচীন নিয়ম।

তেষট্টি নম্বর শ্লোকে আছে যে, যে বোকা নিজেকে বোকা জানে সে শুধুমাত্র সেই কারণেই বিজ্ঞ, যে বোকা নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবে সেই হচ্ছে আসল বোকা।

এক-শো তিন নম্বর শ্লোকে আছে যদিও কেউ হাজার রণক্ষেত্রে জেতে, হাজার মানুষকে পরাভূত করে, তবুও যে নিজেকে জয় করতে পারে তার সঙ্গে তুলনায় জয়ী বলে বিবেচিত নয়।

অন্য কথাতে এসে গেলাম। স্পিনোজার কথা থেকে। এইসব প্রসঙ্গে একবার এলে, এত এত পথ, এত এত মত যে, পথ হারিয়ে যাওয়া বিচিত্র নয় একটুও।

যে-কথা বলছিলাম- সাধারণ মানুষদের পক্ষে ঈশ্বরকে কল্পনা করতে বিগ্রহর দরকার হয়, ধর্মীয় আচারে পান্ডার বা পুরোহিতের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যে মানুষ এক বিশেষ মানসিক উচ্চতাতে নিজেকে উন্নত করতে পেরেছে তার পক্ষে মসজিদে বা বাড়িতে বারংবার নামাজ পড়া অথবা উপোস করে ফুল বেলপাতা দিয়ে পুজো করার প্রয়োজন হয় না। আকাশে, বাতাসে, বনে, পাহাড়ে, দ্রুতধাবমানা নদীর দিকে চেয়েই তার ঈশ্বরকে সে প্রত্যক্ষ করতে পারে, হৃদয়ের মাঝে অনুভব করতে পারে সহজে। শিক্ষিত, উচ্চকোটির মানুষের এই ঈশ্বরের কোনো বিশেষ অবয়ব নেই। প্রত্যেক জীবের মধ্যেই তিনি থাকেন। অন্তত থাকার চেষ্টা করেন। তিনিই শুভবোধ, ন্যায়, সততা ইত্যাদির সংজ্ঞা। যাঁরা ঈশ্বরকে মানেন না বলেন, তাঁরা এইসব বৃত্তিকেই মানেন না।

 ঈশ্বরের বাস মসজিদে মন্দিরে বা গির্জাতে নয়, তা মানুষের মনে।

ড. সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ পি ই এন কংগ্রেসের এক বক্তৃতাতে বলেছিলেন

প্রকৃত ধর্মকে আমরা কখনো বাইরে থেকে পাই না, বই পড়ে বা শিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়ে। প্রকৃত ধর্ম বাধাবন্ধের ধর্ম নয়, নিয়মবদ্ধতা নয়, অভ্যেস নয়। সে ধর্ম প্রত্যেক মানুষের আত্মার আকুতি, যে আকুতি খুলে যায় জড়িয়ে রাখা গালচের মতো নিজেরই অন্তরের অভ্যন্তরে। সেই ধর্ম তার জীবনের রক্তকণিকা দিয়ে তৈরি করে নিয়েই পেতে হয়।

এত কথা এসে পড়ছে কারণ ফাদার উইধাস-এর সঙ্গে এইসব নিয়ে সেদিন আলোচনা হল বলে এখনও টাটাকা টাটকা মনে আছে।

খ্রিস্টান মিশনারিদের মধ্যে সকলেই ফাদার হফম্যান নন। ফাদার উইধাসও নন। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই ধর্ম সম্বন্ধেও কোনো স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ধারণা নেই, অনেক টিকিওয়ালা ধর্মান্ধ পন্ডিত বা দাড়িওয়ালা মোল্লারই মতো। গায়ের চামড়া সাদা হলেই মানুষ কিছু অন্যরকম হয়ে যায় না। এইসব সাদা-চামড়া মিশনারিদের কাছে ধর্ম আর বাইবেলের বাণী সমার্থক, যেমন অনেকের কাছে কোরান বা গীতাই হচ্ছে ধর্ম।

আমার মুখে জৈন ধর্ম, জরাথ্রস্টের কথা, বুদ্ধদেবের এবং মহম্মদের এবং আরও অনেকের কথা শুনে ফাদার উইস খুব আগ্রহভরে আলোচনা করেছিলেন।

আমি যখন উঠে আসব তখন কুটুস করে বললেন যে, তোমরা এল যে, মানে তোমাদের শাস্ত্র বলে যে, রিলিজিন ইজ আ বাইণ্ডিং ফোর্স তাই কি? তোমাদের হিন্দুধর্ম কি এখনও তাই আছে? কিছু মনে কোরো না। কোনো লক্ষণ তো দেখি না।

আমি বললাম, নিশ্চয়ই। কিন্তু আগেই বলেছি যে, এই ধারণশক্তি সাধারণের জন্যে। ধর্ম কথাটার মানে হচ্ছে যা ধারণ করে। সংস্কৃত শব্দ তো!

উনি বললেন, এখনকার হিন্দুদের দেখে মনেই হয় না যে তোমাদের দেশে হিন্দুধর্ম বলে কিছু আছে। খ্রিস্টানরা প্রতিরবিবারে গির্জায় আসে প্রার্থনা করতে। মুসলমানরা নমাজ পড়ে। তোমরা তো নিয়মিত ভাবে তোমাদের বত্রিশ কোটি দেবতার কোনো দেবতাকেই স্মরণ করো না। করো না, তা ঠিক নয়; করো। যখন মেয়ের পরীক্ষা আসে, স্বামীর দুরারোগ্য অসুখ হয় তখনই।

আমি হেসে বললাম, কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু যাকে ধর্ম বলে অভিহিত করছ তা রিচুয়ালসই মাত্র। আচার অনুষ্ঠান বা ধর্মান্ধতা দেখতে হলে তো বলতে হয় মুসলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি ধার্মিক। কথাটা ঠিক নয়। হিন্দুধর্মও যে গোঁড়ামি এবং ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেয়নি বা এখনও দেয় না তা অস্বীকার করব না কিন্তু শিক্ষিত হিন্দুদের এক বিরাট অংশই এই রিচুয়ালস-মানাতে আর বিশ্বাস করে না। অনেকেই বলে যে, আমরা ধর্মও মানি না। কিন্তু সে তারা অতিসপ্রতিভ বশে বলে। ধর্ম কাকে যে বলে সেটুকু জ্ঞানও ফালতু, ফাঁকা ইংরিজি শিক্ষার দম্ভ তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে দেয়নি। তোমাকে আমি একটা কথা বলব ফাদার। অনেকদিন আগে বারাণসীর মণিকর্ণিকা ঘাটে আমার সঙ্গে একজন অ্যামেরিকান দার্শনিকের আলাপ হয়। ভদ্রলোকের হিন্দুধর্ম ও নানা শাস্ত্র সম্বন্ধে অসীম জ্ঞান ছিল। বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না; ভদ্রলোককে তুমি যে প্রশ্ন আমাকে করলে আমিও ঠিক সেই প্রশ্নই করেছিলাম।

কী বললেন উনি?

উনি বললেন যে, হিন্দুধর্ম বড়োই গভীর। গয়ার ফন্তু নদীরই মতো তার চলন অন্তঃসলিলা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। অন্য অনেক ধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্ম তুলনীয়ও নয়।

তারপরেই হেসে বলেছিলেন সেই অ্যামেরিকান দার্শনিক : You have to scratch a

Hindu to find Hinduism in him.

ফাদার উইধাস অনেকক্ষণ চুপ করেছিলেন।

তারপরে বলেছিলেন, কথাটা ভাববার মতো।

.

১৪.

রাত অনেকই হল। একদল জংলি কুকুর কোনো শম্বর বা বারাশিঙাকে তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে নদী পারের জঙ্গলে। এরকম কুঁই কুঁই আওয়াজ করে এই সময় কুকুরগুলো।

 মেঘ জমেছিল পশ্চিমের আকাশে বিকেল থেকেই। মেঘের মাদল বাজছে দ্রিমি-দ্রিমি-দ্রিম দিম। ঝরে পড়বে বলে সাজছে আকাশ। আমার ঘুমন্ত, পরমাসুন্দরী স্ত্রীর কালকেউটের মতো মসৃণ কালো আবৃত শরীরের ওপর লণ্ঠনের আলো-আঁধারি তাকে বড়ো রহস্যময়ী করে তুলেছে। সে পেছন ফিরে শুয়ে আছে। মাটির দেওয়াল সাজিমাটি দিয়ে রাঙানো। সেই দেওয়ালে তার শরীরের ছায়া পড়েছে। মনে হচ্ছে, অজন্তার গুহাগাত্রেরই কোনো ছবি।

লণ্ঠনটার ফিতে কমিয়ে ঘরের এককোণে রেখে দিলাম। তারপর হনসোর পাশে গিয়ে ওর ঢেউ-খেলানো কোমরে হাত রেখে শুয়ে পড়লাম। আঃ! যেন গ্রীষ্মবনের কোনো ছায়াচ্ছন্ন উপত্যকা সবুজ অন্ধকারে ঢাকা। ও জেগে গেল। তারপর আমার হাতটিকে টেনে নিয়ে ওর মসৃণ চিকন উরুসন্ধিতে রেখে আরও ঘুমিয়ে পড়ল। তার শরীরের পরম-রতনকে পাহারা দিয়ে রাখতে হবে সারারাত এমনই নীরব আদেশ করল। যেন!

ভাবছিলাম, এই মেয়েরা এক আশ্চর্য সৃষ্টি বিধাতার। ইংল্যাণ্ডর, ইয়োরোপের, জাপানের, থাইল্যাণ্ডের এবং আরও কত দেশের কত শ্বেতাঙ্গিনি, কৃষ্ণাঙ্গিনি, পীতাঙ্গিনি, জলপাইরঙা শরীরের নারীর সঙ্গে সহবাস করলাম কিন্তু আমার এই হনসোর কোনো তুলনা নেই। ও যেন পৃথিবীর আদিমতম রমণী। জীবনানন্দর কবিতার লাইন থেকে উঠে এসেছে। ব্যাবিলনেও ছিল যেন ও কোনো সময়ে, ছিল কায়রোতেও।

নারীশরীর সম্বন্ধে যেসব পুরুষের কৌতূহল পরিপূর্ণভাবে নিবৃত্ত না হয়, তার পক্ষে বোধ হয় কাম আর প্রেমের মধ্যে কী এবং কতটুকু তফাত তা বোঝা সম্ভব নয়। ভোগীরাই একমাত্র প্রকৃত ত্যাগী হতে পারে, যখন সে তা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। আমার শরীরজাত বাসনা-কামনাতে এখন আর কোনো এলমেলোমি নেই। নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখারই মতো সে সমাহিত। যেমন আমার মন। অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু লেখা তখনই সার্থক যখন পাঠক-পাঠিকা তা পড়েন তার রস আস্বাদন করেন। পাঠক-পাঠিকার কাছে পৌঁছোতে না পারলে পান্ডিত্যের দার্ট আর দম্ভ দিয়ে লাভ কী? আবার যে লেখক পাঠক পাঠিকার প্রশংসা পাওয়ার জন্যে নিজেকে নিলামে চড়ান তাঁর লেখকত্বই তো মাটি! পাঠক পাঠিকারা লেখকের অতিসম্মানিত মানুষ কিন্তু লেখকের নিজস্বতা ও প্রকৃত বক্তব্যকে বিকিয়ে দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার জন্যে দৌড়ে-বেড়ানো লেখকেরা লেখক নন। বিশ্বাসতাড়িত হয়ে, গভীরতা থেকে উঠে এসে যদি কলম আঁচড় কাটা শুরু করে, লেখক যদি না-লিখে না পারেন তখনই লেখক হল। প্রকাশকের হুকুমে বা নিজের তড়ি-ঘড়ি অর্থোপার্জনের তাগিদে যে লেখা, সে-লেখা থাকে না। মেডিয়া, সেই লেখককে মইয়ের ওপরে তুলে তার মুখে যত শক্তিশালী আলোই ফেলে রাখুন না কেন। এইসব ভেবে-টেবেই কোনাদিন লেখক হওয়ার বাসনা বা সাহসও আমার হবে না।

লেখক বেঁচে থাকেন পাঠক-পাঠিকার হৃদয়ে। তাই-ই তাঁর চিরদিনের নীড়। তাঁর মহত্তম অবলম্বন। একথা বোধ হয় স্বদেশ-বিদেশের বেশির ভাগ লেখকই বোঝেন না। টাকা রোজগারই যদি করতে হবে তো পাটের ব্যাবসা বা আফিং-এর চোরাচালান করলেই হয়! লেখক হয়ে টাকা রোজগারের হুল্লোড় পড়ে গেছে ইংল্যাণ্ডে অ্যামেরিকাতে এখন। টাকা হয়েছে অনেক লেখকেরই অঢেল। এখানে ভিলা, ওখানে কটেজ, সমুদ্রে বেড়ানোর বোট, কিন্তু পাঠকের সম্মান তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। একজন চিত্রতারকা বা ফুটবলার বা ক্রিকেটারের সঙ্গে একজন লেখককে আগে একাসনে কখনোই বসানো হত না। সারাপৃথিবীর অর্থগৃধ কিছু লেখকরাই তাঁদের হঠকারী অপরিণামদর্শিতায় সমস্ত লেখকদেরই এই ধুলো কাদায় টেনে নামিয়েছেন। এটা পরমদুঃখের।

আমার এই ডাইরি তো ছাপা হবে না কোথাওই। অন্য একজনের হাতেও পড়বে কি না তাও জানি না। হনসো তো পড়তে পারে না। ওদের নিজেদের ভাষাও তো মুখেরই ভাষা। হরফ তো নেই ওদের। ফাদার হফম্যান কিছু কাজ করেছিলেন। হো, মুণ্ডা, গোল এইসব ভাষায় বিশেষ তফাত নেই তাই এই তিন ভাষাভাষীরাই উপকৃত ওঁর কাছে।

ঘুম আসছিল না। ভাবছিলাম, ছেলে বা মেয়ে যেই-ই আসুক সে কেমন হবে কে জানে? সে যদি পড়াশুনো না করতে চায়? আমার জিন-ই যে তার মধ্যে আসবে তা কে বলতে পারে? হয়তো হনসোর বাবার জিন আসবে। সেই বৃদ্ধ কেবলই বসে থাকেন, চুট্টা টানেন আর মহুয়া খান। প্রথম যৌবন থেকেই নাকি তা-ই করে আসছেন। হনসোর জন্ম দেওয়ার পর কষ্ট করে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আর একবারের জন্যেও নাকি সহবাস করেননি। হনসো হাসতে হাসতে বলেছিল। নড়াচড়ার মধ্যেই উনি নেই।

হনসোর মা চলে গেছিলেন অন্য একজনের সঙ্গে। তখন যৌবনের শরীর। বুনো কুকুরেরই মতো। খুবলে খেতে চায় অন্যকে। তারপর শরীরের সাধ মিটে গেলে আবার ফিরে এসেছেন। হনসোর বাবারই কাছে।

মানুষের জীবনে মনই যে আসল, শরীর কিছুই নয়, এই কথাটা হনসোর মা আজকে জেনেছেন যৌবনের জ্বালা প্রশমিত করে। কিন্তু অনেক শিক্ষিত মানুষদের জানি যাঁরা আমৃত্যু তা না-জেনেই চলে গেলেন। মৃত্যুদিন পর্যন্ত পাগলা-শেয়ালের মতো খ্যাঁক-খ্যাঁক করে গেলেন চড়ুই পাখির ক্ষমতা নিয়ে। কী যে চিত্তির!

 হনসোর বাবা মানুষটিকে আমার ভারি ভালো লাগে। দু-কানে পেতলের মাকড়ি। তীক্ষ্ণ নাক, বুদ্ধিতে উজ্জ্বল দুটি চোখ। সাধারণত কথা বলেন চোখ দিয়েই বেশি, মুখ দিয়ে কম। সব সময়ই হাসছেন, না হেসে। গরমে খালি-গা। শীতে, নানা রঙের সুতোর কাজ করা পাতলা লেপের জামা। সকাল থেকে রাত অবধি গাঁয়ের মস্ত শালগাছে হেলান দিয়ে বসে মহুয়া খাচ্ছেন আর চুট্টা টানছেন। সব সময়ই শিশুরা ঘিরে আছে তাঁকে।

গাঁয়ের লোকেরাই সকলে মিলে ওঁর মহুয়া আর চুট্টা সাপ্লাই করে। ওরা বলে, উনি গাঁয়ের মাঙ্গলিক। যেন টোটেম। অধিষ্ঠাত্রী দেবতারই মতো। বুড়ো বলছি বটে কিন্তু শিশুদের সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকাতে আর তাদের গল্প বলাতে তাঁর শৈশব রয়ে গেছে যেন এখনও। কোনো দাবিই নেই কারও ওপরে। অন্যনির্ভর হয়ে বাঁচার কারণে কোনো গ্লানিও নেই। যেন শাক্যসিংহ বোধিলাভের জন্যে বসে রয়েছেন তরুমূলে।

একটা জীবন, মাত্র একটাই জীবন কি? জানি না, এখনও নিঃসন্দেহ নই আমি। যদি মেনেই নিই যে, একটামাত্র জীবন, তবু সেই একটা মাত্র জীবনও কতভাবে বাঁচা যায়! অবাক লাগে ভাবলে। হনসোর বাবাকে দেখেও।

অনেকদিন যাওয়া হয়নি ওঁর কাছে। বিয়ের আগে আমিও বসে গল্প শুনতাম শিশুদের সঙ্গে। একদিন যাব। খুব ভালো লাগে ওঁর কাছে বসে থাকতে। মনটা এক গভীর অনাবিল প্রসন্নতায় ভরে যায়। বড়ো ভালো আত্মার মানুষ।

.

১৫.

আজ পঁচিশে বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে রবীন্দ্রনাথকে কখনো দেখিনি। কখনো দেখিনি বললে অবশ্য ভুলে হবে। দেখেছি আবার দেখিওনি।

আমি তখন খড়্গপুরে গেছি আমাদের পাড়ার বন্ধু যতীনদের মামাবাড়িতে বেড়াতে, স্কুলের পরীক্ষার পরে। তারই সঙ্গে। যতীনের মামা রেলে কাজ করতেন। স্টেশনের কাছেই ছিল তাঁর কোয়ার্টার। তখন খড়্গপুরে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের মহা রবরবা। যতীন, যতীনের মামাতো ভাই, আমাদেরই সমবয়েসি পতে আর আমি প্রায়ই স্টেশনে বেড়াতে যেতাম। একদিন সকালের জলখাবার খেয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখি হই-হই পড়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ কোথাও যাচ্ছেন। খড়গপুরের ওপর দিয়ে যে-ট্রেনে তিনি যাচ্ছেন সেই ট্রেন যাবে। একদল মহিলা ও পুরুষ মালা-টালা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন রবীন্দ্রনাথকে দেবেন বলে। তখনও রবীন্দ্রনাথকে নামেই চিনি। তাঁর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত হইনি। তবু যে বয়েসে, ডাইনোসর অথবা গণ্ডার রোমাঁ বেঁলা অথবা ডাব্লু বি ইয়েটস-এর সম্বন্ধে এক ধরনের হুজুগ এবং ধোঁয়াশা ভরা ঔৎসুক্য থাকে, সেই বয়েসে রবীন্দ্রনাথের প্রতিও সেই রকমই এক ঔৎসুক্য ছিল। তার বেশি নয়। তাই রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম একটু।

ট্রেন এল যথাসময়ে। চারফিটেরও কম উচ্চতার–আমরা নানা মানুষের ভিড়ে তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছোতেই পারলাম না। রবীন্দ্রনাথের মুখও দেখতে পেলাম না। দেখতে পেয়েছিলাম শুধু তাঁর বাঁ হাতখানি। হালকা নীল অথবা সবুজ রঙা ভারী কাপড়ে তৈরি জোব্বার হাতায় মোড়া। হাতখানি রাখা ছিল ফাস্ট-ক্লাসের কামরার জানলার ওপরে। বড়ো বড়ো এবং মোটা মোটা আঙুলগুলি। এখনও স্পষ্ট মনে আছে। রবীন্দ্রনাথ প্রথিতযশা কবি না হয়ে প্রতিথযশা কুস্তিগিরও হতে পারতেন। অন্তত হাতখানি ও আঙুলগুলি দেখে তখন তাই-ই মনে হয়েছিল। ফাস্ট-ক্লাসের কামরার জানলাতে রাখা সেই হাতখানি গেঁথে গেছিল কিশোর মনের মধ্যে।

সাহিত্য আমার প্রিয় বিষয়। সে কারণে পরবর্তী জীবনে রবীন্দ্রনাথ আমার মনে অনেকখানি জায়গাই জুড়ে বসেছিলেন। এবং যতদিন বাঁচি থাকবেনও। তবে আজ পেছন ফিরে চাইলে মনে হয় জমিদার এবং ইংরেজদের ঘনিষ্ঠ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র রবীন্দ্রনাথকে বড়ো করতে গিয়ে আমরা অন্যান্য বাঙালিদের ন্যায্য সম্মান থেকে বঞ্চিত নাও করতে পারতাম। আমাদের দেশের সাধারণ এবং হয়তো অসাধারণ মানুষেরাও ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর এবং কলেরাতে যেমন চিরদিনই মরেছেন তার চেয়ে একটুও কম মরেননি অন্ধ নায়ক-পুজোর হিড়িকে এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের যেসব নায়ক সাধারণ্যের চোখে দেবতা হয়ে থেকেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই মূর্তি এমনকী ব্যক্তিপূজারও ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এই দ্বৈত-মানের ব্যাপারটা আমি কোনোদিনই ঠিক বুঝিনি। গুরুবাদকে নস্যাৎ করে অনেকেই নিজেরা গুরুদেব হয়ে উঠেছিলেন এবং তা হয়ে উঠতে একটুও লজ্জিত হননি। ভারতীয় চরিত্রে ভন্ডামির শিকড় মনে হয় বড়ো গভীরেই প্রোথিত হয়ে আছে। পথের মানুষেরা তো সাধারণ! তাঁদের দোষ দিই না। কিন্তু অশেষ মেধা ও বিদ্যা-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরাও তাঁদের তাবৎ অধীত জ্ঞান নিয়েও জনারণ্যের পুজো কুড়িয়েছেন নিজেরাই মূর্তি বনে গিয়ে। অথচ সাকার ঈশ্বরে তাঁদের অনেকেরই বিশ্বাস ছিল না।

 রবীন্দ্রনাথ নিজে তো ঈশ্বর-বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী। পৌত্তলিকতার প্রতি তাঁর শুধু অনীহাই ছিল না একধরনের সূক্ষ্ম বিরূপতাও ছিল। ব্রাহ্ম ধর্মকে বড়ো করতে গিয়ে অজানিতে ও হয়তো অনিচ্ছাকৃত ভাবেও হিন্দুধর্মকে তিনি ছোটোও করেছেন অনেক সময়ে। পৌত্তলিকতা ব্যাপারটা সাহেবদের কাছে যেমন ঘৃণার, বেঁনেসার বাঙালিবাবুদের কাছেও তাই-ই। অথচ হিন্দু ধর্মর সবটাই নির্লজ্জ ব্রাহ্মণদের এবং অন্যান্য উচ্চবর্ণদের বিভিন্ন নিম্নবর্ণের মানুষের ওপর অত্যাচারে, নানা আচার অনুষ্ঠানের বদ্ধতায় এবং হিন্দুধর্মর বহি:প্রকাশের সাধারণ সংকীর্ণতার মধ্যে আদৌ সীমিত নয়। এই কথাটা স্বামী বিবেকানন্দ যেমন স্পষ্ট করে বলেছেন তেমন স্পষ্ট করে আর কোনো ভারতীয়ই হয়তো বলেননি। স্বামী বিবেকানন্দর মতো বড়ো সমাজতান্ত্রিক, মানবিক, উদার, হিন্দুধর্মর সার-অনুসন্ধানকারী মানুষ আর হননি। ওঁর চেয়ে বড়ো কমিউনিস্টও হয়তো কেউ ছিলেন না। ছিলেন না কেউ ওঁর চেয়ে বড়ো প্রেমিকও। তাঁর ধর্ম ছিল মানুষের ধর্ম। তাঁর দৃষ্টি ছিল অনাবিল। তাঁর প্রেম ছিল সর্বমানবের প্রতি। সর্বধর্মের প্রতি। তাঁর ইংরিজি ও বাংলার জ্ঞানও ছিল অপরিসীম। অথচ তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো বড়লোকের ছেলে ছিলেন না। বড়ো হওয়া তাঁর পক্ষে অনেকই বেশি কষ্টসাধ্য ছিল।

এত কথা বলার উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়। এত কথা শুধু এইজন্যেই বলা যে, এদেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথ বা মহাত্মা গান্ধি সুভাষ বোস বা জওহরলাল নেহরু বা সাম্প্রতিককালের সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে যত নাচানাচি করেছেন এবং এখনও করছেন, তার সিকিভাগও যদি স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে করতেন তবে আজ এই দেশের এবং বাংলার চেহারা হয়তো একেবারেই অন্যরকম হত। এখানে ভঙ্গি চিরদিনই সারল্যর ওপরে জয়ী হয়ে এসেছে, এখানের সবজি ও মাছের বাজারে চিরদিনই ওজনে চুরি যেমন ছিল তেমনই চুরি ছিল মানের ও গুণের বাজারেও। সেই চুরি বন্ধ করার চেষ্টা করেননি কোনো ক্রেতাই, আর বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ বিক্রেতারা তো চিরদিনই ভেবেছেন গুণ ও মানের ব্যাপার বোকারা আর কী বুঝবে! যারা চিরদিন নৈবেদ্য সাজিয়ে এনে মানুষরূপী দেবতার পায়ে তা উজাড় করে দিয়েই খুশি হয়েছে, গুরুর নামে জয়ধ্বনি দিয়েছে। তাদের পুজো গ্রহণ করেই চিরদিন তাঁরা ধন্য করেছেন সেই আপামর গুণগ্রাহীদেরই।

এঁকে অবাঙালিরা কিন্তু প্রথমদিন থেকে যে সম্মানের আসনে বসিয়েছেন তাঁদের হৃদয়ে, বাঙালিরা তাঁদের মিথ্যে উচ্চমন্যতায় এবং কিছুটা ইংরিজি সাহিত্য, জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হওয়ার কারণেও স্বামী বিবেকানন্দকে তাঁর যোগ্য সম্মান দেননি। দিলে, আজ বাঙালি জাতি হিসেবে একেবারেই অন্যরকম হত হয়তো। তার গরিমা রাখার জায়গা থাকত না। কর্মযোগ কাকে বলে তা হৃদয়ে উপলব্ধি করলে কুঁড়ে, শ্রমবিমুখ, অনিয়মানুবর্তী উচ্ছঙ্খল প্রজাতি হিসেবে আজকে তার এমন বদনাম হত না।

অবশ্য এসব আমারই একান্ত ধারণা। ও ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্তও হতে পারে। নগরসভ্যতার, পশ্চিমি দুনিয়ার সমস্ত সুখ আহ্লাদ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে এই বনবাসে এসেছিলাম বলেই হয়তো একাধিক যুগ ও কালের অনেক ব্যাপার, অনেক ঘটনা সম্পূর্ণ অন্য প্রেক্ষিতে, আলোতে আভাসিত ও আলোকিত দেখতে পাই, শহরে থেকে নিরন্তর জাগতিক প্রাপ্তির পেছনে দৌড়ে সেইসব উপলব্ধি করার ক্ষমতা থেকেও হয়তো বঞ্চিত হতাম। স্বামী বিবেকানন্দর সব কথা বাঙালি জানলে, জানতে আগ্রহী হলে সাহিত্য সংগীত চলচ্চিত্র ইত্যাদিকে স্বামী বিবেকানন্দের দর্শনের ওপরে স্থান দিতেন না। আধ্যাত্মিক জীবন সবচেয়ে ওপরে। অন্য সমস্ত কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জগৎ দাঁড়িয়ে আছে অধ্যাত্মবোধেরই ভিত্তির ওপরে।

আধুনিক বুদ্ধিজীবী এবং বিশেষ করে ইংরিজি-শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। বুদ্ধিজীবীদের যে বড় অংশ কমিউনিস্ট তাঁরা আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে নাস্তিকতার মধ্যে শুধু জ্ঞানের গরিমাই নয় শ্লাঘার কারণও খোঁজেন। সেদিন ফাদার উইধাসের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে সত্যিই খুব আনন্দ পেলাম। আস্তিকতা ব্যাপারটা সকলের সঙ্গে আলোচনার নয়। এই প্রকৃতির বিরাটত্বের মধ্যে বাস না করলে, এর অমোঘতাকে হৃদয়ে না জানলে ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ধারণাও আমার হত না। আমিও অবহেলায় নগরভিত্তিক সবজান্তাদের মতো নাস্তিকতা নিয়ে হয়তো গর্বিতই বোধ করতাম। আসলে ঈশ্বরবোধ আর শুভাশুভ বা ন্যায়-অন্যায় বোধ যে সমার্থক, ঈশ্বরবোধের অভাব যে মানুষকে পশুতেই পর্যবসিত করে এই কথাটা উপলব্ধির। যুক্তি দিয়ে প্রমাণের নয়।

বিজ্ঞানের সঙ্গে ঈশ্বরবোধের যে কোনোই বিরোধ নেই তা আমি স্পষ্ট বুঝি। বিজ্ঞান কোনো কিছুই উদ্ভাবন করেনি। করবেও না। যা কিছুই ছিল তাকেই তা আবিষ্কার করেছে মাত্র। মানুষের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরিধি যতই বিস্তৃত হয়েছে মানুষ ততই সমস্ত বিজ্ঞানের আদি যে শক্তি তাকে ভুলেই শুধু যায়নি তাকে অস্বীকার পর্যন্ত করেছে তার পরমনির্বুদ্ধি-নির্ভর ঔদ্ধত্যে। এটা পরমলজ্জা ও ক্ষোভের ঘটনা বলেই আমি মনে করি।

স্বামীজি আমেরিকায় তাঁর বক্তৃতাতে বলেছিলেন :

Science is nothing but the finding of unity. As soon as science would reach perfect unity, it would stop from further progress, because it would reach the goal, Thus Chemistry could not progress farther when it would discover one element out of which all others could be made.

ঠিক এইভাবেই স্বামীজি হিন্দুধর্মে অবিশ্বাসী পশ্চিমিদের বুঝিয়েছিলেন যে,

Physics would stop when it would be able to fulfill its services in discovering one energy of which all the others are but manifestations and the science of religion becomes perfect when it would discover Him who is one life in a universe of death…

All Science is bound to come to this conclusion in the long run. Manifestation, and not creation, is the word of Science to-day, and the Hindu is only glad that what he has been cherishing in his bosom for ages is going to be taught in more forcible language and with further light from the latest conclusions of Science.

তবে একথা ঠিক যে, নিরাকার ঈশ্বরের ধারণা করা সাধারণ মানের মনের মানুষদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিভিন্ন মানুষের মানসিকতার স্তর তো আর এক হতে পারে না। যাদের পক্ষে নিরাকার ঈশ্বরের ধারণা করা সম্ভব নয় তাদের জন্যেই মূর্তি।

আমার মনে হয় যে, হিন্দুদের অধিকাংশ ধর্মস্থান, মন্দির এবং বিগ্রহই যে অসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এবং প্রায়শই দুর্গম স্থানে অবস্থিত, তার কারণ হিন্দুধর্ম, প্রত্যেক মানুষ বিশেষ করে সাধারণদের মানসিকতার প্রতিও অত্যন্ত সম্মান পোষণ করে। সমুদ্রের পারে এসে দাঁড়ালে যেকোনো মানুষেরই মনে অসীম সম্বন্ধে, আদি ও অনন্ত সম্বন্ধে এক ধরনের বোধ জাগরূক হয়। যেমন হয় সুউচ্চ তুষারাবৃত গিরিশৃঙ্গে গিয়ে পৌঁছেলে। অথবা গভীর অরণ্যানীবেষ্টিত দুর্গম স্থানের মন্দির বা বিগ্ৰহর সামনে উপস্থিত হলে।

 হিন্দুদের প্রত্যেকটি ধর্মস্থানের অবস্থানের পেছনে হয়তো সুচিন্তা ও সুপরিকল্পনা আছে। মানুষ-ইযে সবজান্তা এবং সে-ই যে সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক নয়–এই কথাটা মনের মধ্যে প্রাকৃতিক বিরাটত্বর সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক মানুষেরই মনে হতে বাধ্য। যিনি নাস্তিক তাঁর মনেও আলোড়ন ওঠা স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষদের মনে ঈশ্বরের বোধ জাগানোর জন্যেই হয়তো এইরকম জায়গাতে মন্দির এবং মন্দিরের ভেতরে বিগ্রহর প্রতিষ্ঠা। তাদের কাছে বিগ্রহই ঈশ্বর। আর যাঁদের মানসিকতার স্তর এইসব সাধারণের মানসিকতার স্তরের চেয়ে উঁচুমানের তাঁরা সৃষ্টির মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যেই ঈশ্বরকে সহজে উপলব্ধি করতে পারেন। পশ্চিমি দুনিয়ার মানুষ এবং অধুনা দিশি বুদ্ধিজীবীরা পৌত্তলিকতাকে দূষণীয় বলে মনে করেন হয়তো এই কারণেই যে, এই মানিসকতার স্তরের বিভিন্নতা সম্বন্ধে তাঁদের কোনো স্পষ্ট ধারণাই নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে বলেছেন :

ওদের কথায় ধাঁধাঁ লাগে তোমার কথা আমি বুঝি।
তোমার আকাশ তোমার বাতাস এই তো সবই সোজাসুজি।

আকাশ বাতাসে সোজাসুজি ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করার মানসিকতা সকলের থাকে না। কিন্তু থাকে না বলেই যাদের তা নেই তাদের মধ্যে এই মানসিক উচ্চতা আশা করাটাও অন্যায়। হিন্দুধর্মই বোধ হয় একমাত্র ধর্ম যেখানে এমন দ্বিস্তর বোধের কথাকে যথার্থ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো ধর্মেই বোধ হয় এই সচেতনতা দেখা যায় না।

স্বামীজি বলেছিলেন :

One thing I must tell you. Idolatory in India does not mean anything horrible. It is not the mother of hariots. On the other hand it is the attempt of undeveloped minds to grasp high spiritual truths.

এত কথা বললাম বলে একথা কারোরই ভাবা উচিত নয় যে, মূর্তি পুজো যিনিই করেন তিনিই দ্বিস্তরের মধ্যে নিম্নস্তরের। তেমন যে হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। শ্রীরামকৃষ্ণও তো মা কালীর মূর্তিকেই পুজো করতেন। তাই বলে কি একথা কেউ বলবেন যে, তাঁর মানসিক স্তরটি নিম্নমানের ছিল? উচ্চস্তরের বহু মানুষই মূর্তি পুজো করে থাকেন। কিন্তু সামনে কোনো দেব বা দেবীর মূর্তি না থাকলেও তাঁদের সাধনাতে কোনো হের-ফের হত না।

বৌদ্ধ অথবা জৈনরা ঈশ্বরের উপাসক নন। বুদ্ধদেব এবং মহাবীর, দুই ঈশ্বরের অবতারকেই তাঁরা পুজো করেন। কিন্তু তাঁদের ধর্মর সমস্ত বেগই সঞ্চারিত হচ্ছে এক মহান সত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে, যে কেন্দ্রবিন্দু সমস্ত ধর্মেরই মূলবক্তব্য, মানুষকে উত্তীর্ণ করা, মানুষের উত্তরণ সম্পূর্ণ করে তাকে অন্য এক উচ্চতাতে ঠেলে তোলা; যে উচ্চতায় পৌঁছোনোর মধ্যেই মানুষের মনুষ্যত্ব নিহিত আছে। বৌদ্ধ জৈনরা ঈশ্বরের জাতকের পূজারি; জনকের নন। কিন্তু জাতকের পুজোর মধ্যে দিয়েই তাঁদের জনকের কাছে পৌঁছান।

হিন্দুধর্মের গুণগানের সঙ্গে সঙ্গে তার দোষের কথাও বলা দরকার। হিন্দুধর্মের অবশ্য কোনো দোষ নেই। দোষ, উচ্চবর্ণের যেসব মানুষেরা এই ধর্ম পরিচালনের মূলে ছিলেন তাঁদের। বর্ণাশ্রম প্রথা সৃষ্টি হয়েছিল সমাজের হিতার্থেই। কিন্তু ধর্ম কখনো মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদের কথা বলেনি। ব্রাহ্মণ্য উপবীত ধারণ করলেই কেউ ব্রাহ্মণ হন না। ব্রাহ্মণ হতে হয় আচারে আচরণে। মনের উচ্চতায়। তাঁর বর্ণর উচ্চতার দম্ভর কারণে নয়। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যে অত্যাচার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ওপর চিরদিন করেছে এবং আজও করছে তারও সঙ্গে জার্মানদের ইহুদি নির্যাতনের তুলনা করা চলে। বাংলাদেশের যত মুসলমান আছেন তাঁদের মস্ত বড়ো একটি অংশই আগে হিন্দু ছিলেন। উচ্চবর্ণের অকথ্য অত্যচারে তাঁদের মানুষের মর্যাদা না দেওয়াতে তাঁরা ধীরে ধীরে মুসলমান বা খ্রিস্টান হয়ে গেছেন। আজও উত্তরপ্রদেশে ও বিহারে নিম্নবর্ণর হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার চলছে তা কোনো সভ্যদেশের পক্ষে অভাবনীয়। অবশ্য আমরা আদৌ সভ্য কি না সে বিষয়ে আমার ঘোর সন্দেহ আছে। অথচ এই উত্তরপ্রদেশের আর বিহারের মানুষেরাই লোকসভায় ও কেন্দ্রের সরকারে প্রধানতম আসন ও প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা রেখে এসেছেন প্রথম থেকে। তাঁদের ন্যায্য কারণেই লজ্জায় অধোবদন হওয়া উচিত। যে ধর্ম মানুষকে মানুষের মর্যাদা না দেয় সে ধর্মর অন্য সব গুণ নস্যাৎ হয়ে যায়। বিবেকানন্দর দেশে জন্মেও এতদিন পরেও যে এই জিনিস চলছে এদেশে তা এই দেশের হিন্দুদের মস্ত বড়ো কলঙ্ক। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন–হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ অপমান অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। এখনও যদি শিক্ষা সম্পূর্ণ না হয়ে থাকে তবে আর কবে হবে?

.

১৬.

কাল নদীর ওপরের সেই বড়ো গাছের মাচায় গিয়ে বসেছিলাম দুপুর বেলায়। গ্রীষ্মের যে দাবদাহ তা অরণ্য-গভীরে না থাকলে অনুভব করা যায় না। প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঘাস, লতা, ফুল, পাতা যেন এক অনন্ত তৃষ্ণায় জ্বলতে থাকে, তীব্র অকরুণ রোদে ঝলসে যেতে থাকে। অথচ যেদিন প্রথম বর্ষা নামে সেই একরাতের বৃষ্টিতে যখন অগণ্য গাছে গাছে কিশলয় আসে, অঙ্কুরিত সবুজ; তখনই যেন জীবন মরণের প্রকৃত মানে বোঝা যায়। আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে এই কথার তাৎপর্য হৃদয়ের অন্তস্তলে অনুভব করা যায়।

 এখন বহুদূর অবধি নজর চলে জঙ্গলে। নিঃশব্দে কারও পক্ষেই চলাচল করা সম্ভব হয়। না ঝরাপাতার জন্যে। সে বুনো ইঁদুর আর সাপই হোক কি বাঘই হোক। এখন নয়নের ভূমিকা নেয় শ্রবণ। শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়েই দেখাদেখি এখন।

একফালি জলরেখা চলেছে কোনোক্রমে এই তৃষ্ণার রাজত্বে প্রাণ জাগিয়ে, প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার সমস্ত দায়িত্ব নিজের স্বচ্ছ শরীরে নিয়ে। বেলা পড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রজাপতি, পোকা, ছোটো ছোটো পাখি, নানারঙা সাপ আসতে থাকে উড়ে, পায়ে হেঁটে। বিভিন্ন তাদের তৃষ্ণা নিবারণের কায়দা। তারপরে আসে অপেক্ষাকৃত বড়োরা। খরগোশ, শজারু, ছোটোজাতের হরিণেরা, কুটরা (বার্কিং-ডিয়ার), মাউসডিয়ার, শেয়াল, হায়না, খাটাশ। তারপর আসে চিতল হরিণেরা, শম্বরেরা, চৌশিঙা, বারাশিঙা, চিংকারা, কৃষ্ণসারেরা। তারও পর বুনোমোষ, বাইসন, গাউর। তারপর চিতারা এবং বাঘ। হাতির এতটুকু জলে চলে না। মোষদের বাইসনেদেরও না। তারা জলে-কাদায় বসে থাকতেও ভালোবাসে। বাঘও তাই। তাই দূরে কোথাও বেশি জল যেখানে আছে সেখানের কাছাকাছি তারা থাকে। বিষ মাখানো তির আর ধনুক নিয়ে আমি বসে আছি আজ। জানোয়ার শিকারের জন্যে নয়, জানোয়ারেরও অধম যেসব মানুষ এমন নিরুপায় পশু-পাখিদের ভরা-গ্রীষ্মে জলের পাশে মারে তাদের মারার জন্যে। গতকাল একটি বড়ো বারাশিঙাকে মেরেছিল এক শিকারি। লেখাপড়া জানা সরকারি অফিসার। হেভি রাইফেল দিয়ে। তাই দুপুর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি মাচা ছেড়ে মগডালে উঠে বসি যতটুকু পাতার আড়াল পাই এই চাঁর গাছে, তারই আড়ালে লুকিয়ে।

তখন বেলা চারটে। গুটগুট করে জিপের শব্দ হল। ফাস্ট সেকেণ্ড গিয়ারে তারা পাহাড়ি পথে আসছে। জিপের আওয়াজ শুনে আমি বলতে পারি কোন গিয়ারে চলছে জিপ। জিপ থামল এসে কাছাকাছি। রাস্তার ওপরে। তারপর নেমে এল দুজন খাকি পোশাক পরা মানুষ। তাদের দুজনের হাতেই বন্দুক দোনলা। তারা শিক্ষিত বটে কিন্তু সে শিক্ষা ডিগ্রি পেয়েই হারিয়ে গেছে। বনবিভাগ বা পুলিশের অফিসার বলে মনে হল। তাদের কাছে আত্মপ্রকাশ করা মানেই মৃত্যু। যারা মৃত্যুর দূত, তাদের শুধু মৃত্যু দিয়েই মোকাবিলা করা যায়। করা উচিতও। এখানে কোনো মধ্যপন্থা নেই। আমাদের ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় বা বিবেকগত কোনো বাধাও নেই। যে চোরা, ধর্মের কাহিনি শোনে না, যে শঠ সাধুতা বোঝে না, যে সশস্ত্র মানুষ বিবেচনা হারিয়েছে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা দোষের নয়।

আমি শুধু প্রার্থনা করেছিলাম যে, আজ যেন পশু-পাখিরা দেখে ফেলে এই ভীরু ব্যাধদের। আমার যেন মারতে না হয় এদের। জিপে আরও কেউ আছে কি না জানি না। তবে যদি কেউ থেকেও থাকে সে জিপে বসে এই গাছের মাচা বা পাতার আড়ালে থাকা আমাকে দেখতে নিশ্চয়ই পাচ্ছে না।

 শিকারিরা পায়ে পায়ে হেঁটে আসতেই তাদের দেখে ফেলল একটি ময়ূর তার তীক্ষ্ণ চোখে। তীব্র কর্কশ স্বরে সে কেঁয়া কেয়া কেঁয়া করে ডেকে সমস্ত বনের প্রাণীদের সাবধান করে দিল। তার দিকেই বন্দুক উঁচাল। তা দেখে অন্য জন তার বন্দুকের নল টেনে নামিয়ে দিল। বলল, পাল্লার মধ্যে নেই। তা ছাড়া প্রথমেই ময়ূর মেরে কী হবে। কত কী মারতে চাস? সাধ মিটিয়ে মার আজকে। তারপর নেপালে ফিরে গিয়ে তোর বউ-এর কাছে হিরো বনিস। কিন্তু সেই আনাড়ি ও পেটুক লোকটি বলল, ময়ূরের মাংস তো খুব ভালো খেতে। বেস্ট হোয়াইট মিট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। বলেই, তার অভিজ্ঞ সঙ্গীর বারণ সত্ত্বেও সে বন্দুক দেগে দিল। ময়ূরটি মরল না। কিন্তু গাছ থেকে আহত হয়ে নীচে পড়ে গেল। পড়ে যেতেই রংরুট শিকারি ময়ূর ধরার জন্যে দৌড়ে গেল। গুলি লেগেছিল ময়ূরের পায়ে। বেচারির পক্ষে, বাঁচা এমনি মুশকিল হত যদি এই শিকারির হাতে বেঁচেও যায় এযাত্রা। সঙ্গী বারণ করল তাকে, তবু সে শুনল না। এদিকে গুলির আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জঙ্গল জেগে উঠল। নানারকম পাখি, বাঁদর, কুটরা হরিণ ডেকে উঠল। শিকারি এবড়োখেবড়ো নদীর মধ্যে দিয়ে দৌড়ে যেতেই আছাড় খেল এবং দড়াম করে তার হাতে-ধরা বন্দুক ফায়ার হয়ে গেল। লোকটি যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল। নিজের বাঁ-দিকের ব্যারেলের গুলি লাগল তার বুকে। সঙ্গী কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই উলটোদিকে ফিরে ডাকল, হরবনস! হরবনস! জলদি আও৷

ডাকতেই দেখলাম, একজন খাকি পোশাক পরা ড্রাইভার দৌড়ে আসছে একটি টিলা টপকে। কাছে আসতেই নীচের লোকটি বলল, খতরা বন গ্যয়া। ছোটেবাবুকো গোলি লাগ গ্যয়া। দুজনে ধরাধরি করে ওরা রক্তাক্ত এবং প্রায়মৃত সঙ্গীকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল জিপের দিকে।

জিপের আওয়াজ মরে যেতেই নেমে ময়ুরটির খোঁজে গেলাম। কী হল তার তাই দেখতে। পা যদি ভেঙে গিয়ে থাকে তবে আজ রাতেই সে খাদ্য হবে কোনো মাংসাশী জানোয়ারের। ময়ুরের মাংসর ওপর লোভ অনেকেরই। বাঘ-চিতারও কম নয়। গাছটার নীচে গিয়ে রক্ত দেখলাম না কিন্তু ডানা ঝাঁপটা-ঝাঁপটির চিহ্ন আছে। একটু শুকনো মাটিতে এগোতেই সামান্য রক্তর ফোঁটা পেলাম। কিছুটা দূর তা অনুসরণ করে এগোতেই দেখি একটি ছোটো টিলা মতো জায়গায় উঠে বসে আছে সে। আমার দিকে তার পেছন। মস্ত ল্যাজখানি ঝুলছে পেছনে। যতখানি পারি নিঃশব্দে ঘুরে একটু এগিয়ে গিয়ে যেখান থেকে তার সামনেটা কোনাকুনি দেখা যায় এমন জায়গাতে পৌঁছে ভালো করে দেখলাম তার ডান পায়ের পাতার একটি নখ ছররা গুলিতে খসে গেছে। বুঝলাম, এখন যন্ত্রণার জন্যে সে গাছে উঠে বসতে পারছে না তবে আজই রাতে প্রাণভয়ে হয়তো বসতে পারবে নইলে বড়ো গাছের কোনো নিরাপদ মোটা ডালে আশ্রয় নেবে। প্রকৃতিই তার এই ক্ষত সারিয়ে দেবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই।

যখন ফিরছি তখন শুনি আবারও জিপের শব্দ। তখন নিজের প্রাণভয়ে আমি শাখামৃগর মতো তরতরিয়ে ওপরে উঠলাম সেই মাচায়। তারপরে আরও ওপরের ডালে। ওই গাছ ছাড়া অন্য কোথাওই পাতা ছিল না লুকিয়ে থাকার মতো। ওই ন্যাড়া গ্রীষ্মবনে অন্যত্র যাওয়ারও উপায় ছিল না কোনো। এই জিপটি এল অন্যদিক থেকে। প্রায় একই জায়গায় দাঁড়াল জিপটি। তিন শিকারি নেমে এলেন। এঁদের একজনের হাতে রাইফেল, দুজনের হাতে বন্দুক। এদের দেখে চিনতে ভুল হল না যে, ওঁরা পুলিশের লোক। একজন বোধ হয় দারোগা গোছের ছিলেন। দুজনে তাঁর অধস্তন কর্মচারী। দারোগাবাবু বেশ মোটা-সোটা। বললেন, গাছে। চড়তে পারবেন না। হাতে রাইফেল আছে সুতরাং পাশের টিলার ওপরে উঠে মোটা একটা মহুয়া গাছে পিঠ দিয়ে বসবেন। খাকি পোশাকে অনড় হয়ে বসলে জানোয়ারদের চোখে নাও পড়তে পারেন। অধস্তন কর্মচারীরা এই প্রস্তাবে সায় দেওয়াতে তাঁরা দুজন মাচায় উঠে এলেন এবং উনি মহুয়া গাছের গোড়ায় বসলেন দু-পা দু-দিকে ছড়িয়ে।

এদিকে বেলা পড়ে আসছে। কত পশুপাখিই যে এই বিপত্তির ফলে জলে আসতে পারছে না তা অনুমান করে আমার কষ্ট হতে লাগল। এমন সময় বড়োবাবু বললেন, বাঘ ইয়া শোনচিতোয়া ছোড়কর ঔর কুছ নেহি।

একজন বললেন, ভাল আপকো নোচনে আনেসে ক্যা কিজিয়েগা হজৌর?

বড়োবাবু বললেন, ভাল কুছ না করেগা।

ওঁরা চুপ করতেই একদল চিতল হরিণ এল হুড়মুড় করে। বড়োবাবুর নিষেধ সত্ত্বেও মাচা থেকে একজন মেরে দিলেন একটি মাদি হরিণকে। ধপাস করে পড়ে গেল হরিণটি।

বড়োবাবু গাছতলাতে বসেই ধমক দিয়ে উঠলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি প্রকান্ড ভাল্লুক মহুয়াগাছের পেছন থেকে বেরিয়ে বড়োবাবুর সঙ্গে কুস্তি লড়তে লেগে গেল। ভাল্লুকের কবলে যাঁরা পড়েছেন জঙ্গলে তাঁরাই একমাত্র জানেন ভাল্লুক কী জিনিস। এই জানোয়ারই একমাত্র জানোয়ার যে, বিনা প্ররোচনায় মানুষকে আক্রমণ করে এবং তার নাক চিবুক চোখ খুবলে নেয়। ভাল্লুকের হাতে পড়েও বেঁচে ওঠা মানুষের মতো বীভৎস-দর্শন মানুষ খুব কমই হয়। বড়োবাবুর রাইফেলটি ডান দিকে শোয়ানো ছিল ঊরুর ওপরে। প্রথমেই ভাল্লুক তার ডানপায়ের অ-খেলোয়াড় সুলভ একলাথিতে রাইফেলকে ছিটকে ফেলে দিল দূরে। বড়োবাবু গাঁক গাঁক করে আওয়াজ করে আমি খেলব না গোছের কিছু একটা বলতে গেলেন কিন্তু উনি না খেললে কী হয় ভাল্লুক তো খেলবেই!

 জঙ্গুলে জায়গার দারোগা! রোজ রোজ মোরগা-আণ্ডা-পাঁঠা-হরিণ-ঘি খেয়ে প্রায় চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। ভাল্লুক সচরাচর মানুষের মাংস খায় না। কিন্তু না খেলে কী হয়, সুযোগ ঘটলেই সে মানুষের মাংস দিয়ে লুচির লেচির মতো খেলে। বড়োবাবুর ভুড়ির অর্ধেক বাইরে বেরিয়ে এল নাড়ি-ভুড়ি সুষ্ঠু। একবার আমার ইচ্ছে হল মারি এক বিষের-তির ভাল্লুকটাকে, বড়োবাবুকে বাঁচাতে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল মানুষটার চেহারা দেখেই মনে হয় অনেক অন্যায় সে করেছে এবং আজ বিকেলেই যে নতুন অন্যায় করতে এসেছিল তার শাস্তি হওয়া দরকার।

ততক্ষণে শাকরেদরা গাছ থেকে নেমে ওদিকে দৌড়ে গেছে। কিন্তু গুলি করতে পারছে না পাছে বড়োবাবুর গায়ে গুলি লেগে যায় এই ভয়ে। তবে ভাল্লুকটাই ওদের দেখে ফাটা কাঁঠালের মতো বড়োবাবুকে ফেলে রেখে এদের দিকে দৌড়ে এল এবং সেটাই হল তার কাল। দুই শিকারি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে-ওঠা ভাল্লুকের বুকে একইসঙ্গে গুলি করল। মরণোন্মুখ মানুষ যেমন কাঁদে তেমন করে কাঁদতে কাঁদতে ভাল্লুকটি পড়ে গিয়ে দু-হাত জড়ো করে যেন ভগবানকে কী বলতে লাগল।

শিকারিরা তার দিকে আর না চেয়ে দু-খন্ড বড়োবাবুকে কোনোরকমে জোড়া দিয়ে তুলে নাড়িভুড়ি ছড়াতে ছড়াতে পাহাড় টপকে জিপের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।

একদিনের মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে মনে করে ওরা অদৃশ্য হতেই আমি গাছ থেকে নেমে নিঃশব্দে আমার ডেরার দিকে পা বাড়ালাম। মনে হয় না আজ আর কেউ জানোয়ারদের পিপাসার পথে বাধা হবে বলে। তবে আজকের অভিজ্ঞতায় অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে আমি ঠিক করলাম আগামীকাল আরও তাড়াতাড়ি ওখানে গিয়ে মাচার ওপরের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকব।

হনসো আমাকে রোজই মানা করত। বলত, সন্ধ্যেবেলায় একা বাড়ি থাকতে মন খারাপ করে। অথচ ওর শারীরিক অবস্থার কারণে ওকে নিয়ে গাছে চড়া সম্ভব ছিল না। ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি পরদিনও বেরোলাম।

সুরজা বলে আমাদের বস্তিরই একটি ছেলে ছিলো। দূরের জঙ্গলে বিড়িপাতার ঠিকাদারের কুপ কাটত। তার সঙ্গে নাকি হনসোর প্রেম ছিল। অনেকেই বলত। হনসো বলত, দুর, মেয়ের সঙ্গে আবার কোনো মেয়ের প্রেম হয় নাকি।

 আমি যখন বেরোচ্ছি হাতে তির-ধনুক নিয়ে তখন সুরজা এসে হাজির। সবে ফিরছে কুপ থেকে। হাতে লাল ফুলের ঝাড় আর মহুয়ার বোতল। ও তল্লাটে বোধ হয় হাট ছিল আজ। আমি হেসে বললাম হনসোকে, এই তো! একা থাকতে ভয় পাচ্ছিলি, তোর বন্ধু এসে গেল। মহুয়া খা, গল্প কর। আমি এলে গান-নাচ করবখন তিনজনে মিলে। আমার জন্যেও রাখিস মহুয়া একটু।

হনসোর মুখ দেখে মনে হল ও বারণ করছে আমাকে যেতে। আর সুরজার মুখ দেখে মনে হল ও আসবার আগেই হাট থেকে ভালোরকম মহুয়া খেয়ে এসেছে।

আমার মন পড়েছিল ওই নদীতে। হেসে বললাম হনসোকে। এই গেলাম আর এলাম।

 সেদিন কিন্তু কোনো ঘটনা ঘটল না। সারাদুপুরই অনেক পাখি, সাপ, প্রজাপতি, ইঁদুর, খরগোশ জল খেল, একবার মনে হল যেন একটা জিপের আওয়াজ পেলাম। কিন্তু না। জিপটা ভালুগাড়ার দিকে চলে গেল। বোধ হয় মিশনের জিপ হবে।

 সেদিন ঠিক-ই করেছিলাম যে, সন্ধের আগেই ফিরে যাব। হনসো কখনোই আমার কোনো ইচ্ছেতে বাধা দেয় না। কোনোরকম বিধিনিষেধ আরোপ করে না আমার গতিবিধিতে। কিন্তু আজই যখন প্রথম নিষেধ করল আমার সেটা মানা উচিত।

 বিকেল তিনটে নাগাদ একটি জিপের আওয়াজ পেলাম। এই নয় যে, এই জলে শুধু জিপারূঢ় শিকারিরাই আসে। স্থানীয় তির-ধনুক এবং বে-পাসি গাদা-বন্দুক-ওয়ালারাও কম আসে না। কিন্তু তারা সকলেই আমার কথা মানে। আসলে তারা আজকের খাটো ধুতি পরা খালি গায়ের মানুষটাকেই আগে পুরোদস্তুর সাহেবি পোশাকে পাইপ-মুখে এখানে দেখেছে। ওদের অনেকেরই মধ্যে এখনও আমার সাহেবের ইমেজটা জাজ্বল্যমান আছে। তাই আমি যে পছন্দ করি না কেউ গ্রীষ্মের সময় তৃষিত পশুপাখি সরীসৃপদের জলের কাছে মারুক তা জানত। গাদা বন্দুকের শব্দ শোনাই যায়। কিন্তু রাতের বেলা কেউ যদি তিরধনুক দিয়ে কোন জানোয়ার মেরে তা রাতারাতি পাচার করে দেয় নিজের গ্রামে তা জানার কোনো উপায় নেই।

এই কথাটা ভাবলে আমার কষ্ট হয় যে স্বাধীনতার পরেও সাহেবপ্রীতি আমাদের গেল না বরং আরও বেশি করেই জাঁকিয়ে বসল। ইংরেজরা চলে গিয়ে আমাদের আরও বেশি পরাধীন করে রেখে গেল। ওর চেয়ে হয়তো স্বাধীনতা না আসাও ভালো ছিল। যে জাত নিজেদের স্বাধীনতার যোগ্য করে তুলতে পারেনি তাদের স্বাধীনতা চাওয়াই উচিত নয়। যে নদী তার জলধারা অব্যাহত থাকবে কি না সে সম্বন্ধে নিশ্চিত নয় তার উচিত নয় তার বুকে বাঁধ বাঁধতে বলা জলাধারের এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে। জলের প্রাচুর্য, সময়ানুগতা এবং যাতে তার জোগান অব্যাহত থাকে তা যেমন বাঁধ-প্রত্যাশী নদীর সুনিশ্চিত করা দরকার, স্বাধীনতাকামী কোনো জাতির পক্ষেও তার চারিত্রিক কাঠামোর ঋজুতা, সততা ও নিয়মানুবর্তিতা সম্বন্ধেও সুনিশ্চিত হওয়া দরকার।

হনসোর বাবার মুখে শুনি যে, ইংরেজ আমলে এই বনের মধ্যে বন-সংক্রান্ত আইনকানুন অনেক বেশি কঠোরতার সঙ্গে পালিত হত। সরকারি নিয়মকানুন এবং খাকি উর্দি-পরা সরকারী নগণ্য কর্মচারীকেও মানুষ মান্য করত। প্রশাসনের কাঠামো অনেকই বেশি মজবুত ছিল। এবং যা হনসোর বাবা জানেন না সেকথা হচ্ছে এই যে, একথা শুধু বনের আইনকানুনের বেলাতেই নয়, সমস্ত আইনকানুনের বেলাতেই সমানভাবে প্রযোজ্য। আইন, এই স্বাধীন দেশে প্রকৃতই তামাশা হয়ে গেছে। আইনকানুনের রকমও হচ্ছে সুকুমার রায়ের শিবঠাকুরের আপন দেশের মতোই সব্বোনেশে। সরষের মধ্যে ভূত ঢুকে গেছে। শুধু ভারতবর্ষেই নয়, মূল ভারতীয় ভূখন্ডের সব জায়গাতে। তা সে পাকিস্তানই হোক, শ্রীলঙ্কাই হোক কি বাংলাদেশই হোক। ভারতীয় ভূখন্ডর মানুষেরা যে স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রর যোগ্য করে তুলতে পারেনি নিজেদের তা স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে। যেখানে গণতন্ত্র চালু আছে। সেখানেও আছে তা একনায়কত্বরই রকমফের হয়ে। জনগণ যাদের নির্বাচন করে পাঠাচ্ছেন তাঁদের ভাগ্যের ও ভবিষ্যৎ-এর নিয়ন্ত্রক করে, তাঁরা গোরু-ছাগলের মতো ব্যবহার করে চলেছেন। ফলে, এই অশিক্ষিত বা তথাকথিত শিক্ষিত প্রতিনিধিদের সীমাহীন লোভ, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং লজ্জাহীনতার কারণে গণতন্ত্র এক প্রহসনে রূপান্তরিত হয়েছে। আর যেখানে একনায়কত্ব আছে, সেখানে তা আছে অত্যন্ত নগ্নভাবেই লাজ-লজ্জার কোনোরকম বালাই না রেখে।

 জিপটা এসে থামল। তারপরে একটু সময়ের পর যাঁরা এসে রঙ্গভূমে অবতীর্ণ হলেন তাঁরা সেদিনেরই দুজন। বড়োদারোগা ছিলেন না। তিনি যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন তাতে তাঁর বাঁচার কথাও ছিল না। তবে তিনি বেঁচে নিশ্চয়ই আছেন নইলে তাঁর চেলারা আজই আসতে পারতেন না, বড়ো সাহেবকে দাহ করার জন্যে শ্মশানেই থাকতে হত এখন।

 এ লোক দুটি দেখতে যেমন পুলিশ পুলিশ, তাদের মুখেও নিষ্ঠুরতার ছাপ। তারা এসে বসার সঙ্গে সঙ্গেই একটি মাদি শম্বর এসে পৌঁছোল জলে। মুহূর্তের বিলম্ব না করে ওঁদের মধ্যে একজন একগুলিতে তাকে প্রায় জলধারার ওপরেই ধরাশায়ী করল। গুলিটা করেছিল খুব ভালো। একেবারে কানে। শম্বরটা সামান্যক্ষণ হাত-পা-ছুঁড়ে স্থির হয়ে গেল। রক্ত মিশে গেল জলধারার সঙ্গে। লাল, খয়েরি, গোলাপি নানারঙের খেলা চলতে লাগল, কত জলের বুকে।

তার একটুপরেই একটি মস্ত ময়াল সাপ, পাহাড়ি পাইথন আস্তে আস্তে তার বিরাট শরীরকে টেনে টেনে নদীর উলটো পার থেকে জলে মুখ নামাল এবং জল খেতে লাগল। তাকে প্রথম দেখা যাওয়া এবং তার জলে এসে পৌঁছোনার মধ্যে প্রায় পাঁচ মিনিট সময় কাটল। জল যখন সে খাচ্ছে তখন অপর-জন মুহূর্তের মধ্যে নিশানা নিয়ে তার মাথায় গুলি করল। বোধ হয় এল জি দিয়ে। জলের তীরবর্তী গ্রীষ্মের দাবদাহে দগ্ধ জঙ্গলকে লন্ডভন্ড করে একবার কুন্ডলী পাকিয়ে আর একবার কুন্ডলী ছাড়িয়ে ওই বিশাল সাপ প্রলয় উপস্থিত করল। কিন্তু মিনিট দশেক পরে সব শান্ত হল। সে মরে যাবার পরও তার শরীরের পেশিতে তরঙ্গ খেলতে লাগল।

লোকগুলো শুধু নিষ্ঠুরই নয়, সাংঘাতিকও। এদের নিশানা অব্যর্থ, এদের দয়ামায়া বলতে কিছুমাত্র নেই, এবং এদের লোভের কোনো সীমা নেই। এদের সর্বগ্রাসী লোভ অচিরেই এই সুন্দর জঙ্গলের সব জানোয়ারই যে শেষ করে দেবে সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ রইল না।

একজন বলল, সাপের চামড়াটার দাম কত হবে?

অন্যজন বলল, কাসিম মিয়া দেখলে না দাম বলবে!

 ক-মন মাংস হবে শম্বরটার?

তা হবে দেড় মনের বেশি।

সাপের চামড়া ছাড়াতে এবং শম্বরটা কাটাকুটি করতে লোকও লাগবে সময়ও লাগবে।

দুজনের মধ্যে যাকে অভিজ্ঞ বেশি বলে মনে হল, সে বলল।

তুই চলে যা থানাতে জিপ নিয়ে। চারজন কনস্টেবল নিয়ে আয়। পেট্রোম্যাক্স, টাঙ্গি, ঝুড়ি, বস্তা সব। পেছনের একটা রাং দিতে হবে রেঞ্জার সাহেবকে, মনে রাখিস। সাপের চামড়ার কথাটা বলব না। তাড়াতাড়ি যা। একঘণ্টার মধ্যে ফিরবি। সন্ধেবেলা এখানে ভারী জানোয়ারেরা আসবে। খতরনাক হয়ে যাবে এ জায়গা।

তুমিও চলো না।

পাগল! শেয়াল, হায়না, শকুন কত ঝুট-ঝামেলা আছে না। দুজনেই চলে গেলে ফিরে এসে দেখব ভোঁ-ভাঁ। তার চেয়ে আমি থাকি। এরপরেও যদি আরও কোনো পিয়াস-লাগা জানোয়ার আসে তো তাকেও ধড়কে দেব। যা। দেরি করিস না।

এদের কথাবার্তা, চোহারা, মনোভাব আমাকে বড়ো ঘৃণাতে ভরে দিল। আমি ঠিকই করে ফেললাম যে একজন চলে গেলে অন্যজনকে আমি বিশেষ তির মেরে শেষ করে দেব। এদের কাছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা খুবই দরকার। পুলিশের এবং বনবিভাগের আমলারা যেখানে যোগসাজস করে সমস্ত প্রাণী ও পাখি নির্মূল করার ষড়যন্ত্র করেছে সেখানে এমন কিছু না করলেই নয়।

 দ্বিতীয় লোকটি নেমে গেলে প্রথম লোকটিও নামল। দুজনকে মারা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ ওদের নিশানা এমনই নির্ভুল এবং বন্দুক-চালনাতে এরা এমনই দক্ষ যে, একটি তির মেরে অন্য তির ধনুকে লাগাবার আগেই অন্যজন আমাকে গুলি করে পাকা ফলের মতো গাছ থেকে ফেলে দেবে।

দ্বিতীয় লোকটি সঁড়িপথ ধরে বনের বড়ড়া রাস্তার দিকে চলে গেল। প্রথম লোকটি বলল, টর্চও আনিস দুটো। আর হুইস্কির একটা বোতল হুতম শাহুর দোকান থেকে। যদি না দিতে চায় তো বলবি কাল ওর মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে আসব। হারামির বাড় বেড়েছে বড়ো। পরশুদিনে গাঁইগুই করছিল।

ঠিক আছে।

 বলে দ্বিতীয় লোকটি চলে গেল।

প্রথম জন গাছ থেকে নেমে চারধারে দেখল ভালো করে। একবার ওপরেও চাইল। আমি পাতার মধ্যে একেবারে ফ্রিজ করে গেলাম। তবুও মনে হল লোকটা দেখতে পেল আমাকে। কিন্তু চোখ নামিয়ে নিল এবং নদীর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সোজা নয়, এঁকে বেঁকে, হঠাৎ তাকে লক্ষ করে আমার হৃৎপিন্ড স্তব্ধ হয়ে গেল, দেখি সে গাছটার বাঁ-দিকে গিয়ে আমার অবস্থানের দিকে খুব তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পরই সে দ্রুত বন্দুক ওঠাতে লাগল আমার দিকে লক্ষ্য করে।

আমি তো মারতেই এসেছিলাম। তবু যারা খুনি নয়, মানুষ হিসেবে খারাপ নয়, তাদের পক্ষে অন্য একজন মানুষকে মারতে হাত ওঠে না, সে মানুষ যতই খারাপ হোক না কেন! কিন্তু এখন আমার প্রাণ সংশয়। আমিও মুহূর্তের মধ্যে নিজের অবস্থান প্রকাশ করে দিয়ে বাঁ হাতে ধনুকটা ধরে ডান-হাত দিয়ে ছিলা টেনে তির ছুড়লাম। যে ধনুক দিয়ে শুধু মানুষই মারা হবে সেই ধনুক লম্বা চওড়া হয় না। তির ছুঁড়েই আমি হাত ইচ্ছে করে হড়কে ডাল বেয়ে সরসর করে একঝটকায় অনেকখানি নীচে নেমে এলাম। ততক্ষণে তির গিয়ে বিঁধেছে তার ডানবুকে আর গুলিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। যেখানে আমি ছিলাম সেখানেই ঠিক গিয়ে লেগেছে। দ্বিতীয় ব্যারেলটিও ফায়ার করবে কি না কে জানে? পরক্ষণেই মনে পড়ল যে, এই লোকটিই ময়াল সাপকে গুলি করেছিল এবং গুলি করার পর বন্দুক আর রি-লোড করেনি। করলেও সে হয়তো গুলি আর করতে পারতও না। সে ততক্ষণে ঢলে পড়েছিল বাঁ-কাঁতে। বুকে হাত দিয়ে তিরটা টেনে বের করার চেষ্টা করল একবার, কিন্তু হেল-এর বিষ মাখাবার জন্যে তিরের ফলা এমনভাবে আমি নিজেই বানাতাম বাড়িতে যে, সে তির সহজে ঢোকে কিন্তু ঢুকলে আর বেরোয় না।

গাছতলায় নেমেই একহাতে তির ধনুক আর একহাতে আমার চটি নিয়ে আমি লোকটার কাছে গিয়ে তাকে লাথি মেরে উলটে দিলাম যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে, গাছটার দিক থেকে তাকে কেউ তির মেরেছিল। তিরটা যে কোণে ঢুকেছিল বুকে সেই কোণ, অর্থাৎ তির আসতে পারে এমন উচ্চতাসম্পন্ন একটা গাছ নদীর উলটো পারে দেখে আমি লোকটার সামনে দিকটা সেদিকে করে দিলাম। লোকটার হাতে তখনও বন্দুক ধরা ছিল। চোখ দুটো খোলা। আমাকে দেখছিল বিস্ময় আর অবিশ্বাসের চোখে। ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও আমাকে চেনে এ তল্লাটের সকলেই।

লোকটা বলল, জল।

আমি নদীতে গিয়ে, যেখানে জল শম্বরের রক্তে দূষিত নয়, সেখান থেকে আঁজলা ভরে এবং আমার ধুতির খুঁট ভিজিয়ে জল নিয়ে এসে লোকটার মুখে দিলাম। একটু জল খেলও সে। তার পরই তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল। এবং মাথাটা ডানদিকে কাত হয়ে গেল।

একজন মানুষ খুন করলাম কিন্তু আমার একটুও দুঃখ হল না। মানুষটাকে মানুষ বলে গণ্য করিনি আমি, তাই।

তিরটা আমি ওর বুক থেকে খুলে নিতে পারতাম। তার সময় ছিল। কিন্তু খুলোম না এই ভয়ে যে, আমার হাতের ছাপ, পড়বে ওর জামায়। ভালো কাজ যে করে তাকেও যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

তারপরই আমি সরে এলাম অকুস্থল থেকে। আমার কুঁড়েতে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে এল। পৌঁছে দেখি, সুরজা চলে গেছে এবং হনসো অত্যন্ত ভীত-চকিত হয়ে আমার অপেক্ষায় দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

 কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে সে বলল স্পষ্ট করে কিছু কিন্তু আমি বুঝলাম যে, সুরজা মত্ত অবস্থাতে ওর ওপরে জোর করেছিল বা করতে চেয়েছিল। হনসো কিন্তু তার নিজের কারণের চেয়েও আমার জন্যে বেশি ভীত ছিল। সুরজা নাকি যাওয়ার সময় হনসোকে বলে গেছে যে ও পুলিশে এবং বনবিভাগে খবর দেবে যে, আমি জলের পাশে গিয়ে রোজ বসি এবং নিঃশব্দে শিকার করি। সরল হনসো তাতে বলেছিল যে আমার স্বামী শিকার করবে কেন, শিকার তো ছেড়েই দিয়েছে এবং আমরা নিরামিষাশী। সুরজা বলেছে যে, তার সঙ্গে থানার জানাশোনা আছে। হনসো যে তাকে ফিরিয়ে দিল তার বদলা সে নেবেই।

হনসো খুবই ভয় পেয়েছিল। অপরিচিতর অসভ্যতা অসহ্য নাও হতে পারে কিন্তু একদিন যে প্রেমিক ছিল সে যদি জন্তুর মতো ব্যবহার করে তবে বুক ভেঙে যাওয়ারই কথা।

একবার বলল, গাঁওবুড়ার কাছে নালিশ করবে। হোক না সুরজ অন্য গাঁয়ের লোক। তাকে উচিত সাজা দেওয়াবে।

আমি শান্ত করলাম হনসোকে। হনসো কী করে জানবে যে, আমি কিছুক্ষণ আগে পুলিশেরই একজন জঙ্গলের আইন-ভাঙা মানুষকে খুন করে এসেছি বিষের তির দিয়ে। তির বা ধনুক তারা অবশ্য পাবে না কারণ এমনই বে-জায়গার একটি টিলার মধ্যে একটি গুহার পাশের গাছের ফোকরে আমি সেগুলো লুকিয়ে রাখতাম যে, কারোর-ই সাধ্য নেই তা বের করে। হেল গাছের ফল থেকে বিষ তৈরি করতাম নিজেই জঙ্গলের গভীরে। তির শুধু বানাতাম বাড়িতে। ধনুকও ছিল বড়ো। কিন্তু বিষের তিরের ছোটো ফলা এবং ছোটো ধনুক বাড়িতে ছিল না। হনুসোও ওই ছোটো তিরের ফলার কথা জানত না।

সত্যি কথা বলতে কী, হনসো গর্ভবতী হওয়ার পর থেকেই, বন্দুক রাইফেলগুলো না থাকাতে আমি একধরনের অসহায়তা বোধ করতাম। পুঁজি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই পুঁজি রক্ষা করার এক তীব্র তাগিদও বোধ হয় জন্মায় মনের মধ্যে। নইলে স্বেচ্ছায় সর্বস্ব ছেড়ে এসে হনসোর গর্ভে আমার শিশু আসার সম্ভাবনা দেখা দেওয়া মাত্র আমি কেন অমন তির ধনুকের দিকে ঝুঁকলাম? নিজের জন্যে কোনো ভয় আমার ছিল না। কোনোদিনই না। হনসোর জন্যে, হনসোর অনাগত শিশুর কারণে আমার মনে এক অননুভূতপূর্ব ভয় জাগল। অবশ্য যখন ওই বিষের তিরের কথা ভেবেছিলাম তখন ভাবিনি একবারও যে, জঙ্গলের বাসিন্দা পশু-পাখিদের রক্ষার্থেই তা আমাকে ব্যবহার করতে হবে।

পরদিন হাট ছিল। শালডুংরিতেই। সকালবেলা বসে হনসো একটা ফর্দ করে দিল। বলল, আজ ও হাটে যাবে না। গতকাল ঠিক কী যে ঘটেছিল তা হনসেই জানে কিন্তু ভারি মনমরা হয়েছিল কাল থেকেই। আমাকে বলল, ওর শরীর ভালো নেই তাই যাবে না।

বনবালাদের মনের কথা তারাই জানে। সুরজা কি আসবে আজ ওর কাছে আমার অনুপস্থিতে? এমন গর্ভিণী নারীর পক্ষে উত্তেজনা এবং অনিচ্ছায় সহবাস করা কি ভালো হবে? বিপজ্জনক হবে না তো? আর সূরজার সঙ্গেই যদি সে আজ সংগম করবে তবে আমাকে বিয়েই বা করল কেন? সুরজাকে তো সে আমার চেয়ে অনেকদিন আগে থেকেই চিনত! তা ছাড়া স্বামী হিসেবে আমিও তো ফেলনা ছিলাম না। হনসোর জন্যে আমিও তো কম কিছু ছাড়িনি জীবনে! বনের ছায়ায় এই বনবালার কাছে নিজেকে পুরোপুরি বুনোরই মতো আমার শিক্ষা, ঐতিহ্য, সংস্কার সবকিছুকে, আমার দম্ভ ও গর্বকে বিসর্জন দিয়ে সমস্ত নাগরিক নির্মোক ছিঁড়ে ফেলেই তো নিবেদন করেছিলাম। আমার এই সমর্পণে তো কোনো মিথ্যা বা ফাঁকি ছিল না। তবে? হনসো? কেন?

হাটে সকলের মুখেই এক আলোচনা। গোপনে কোনো ডাকাতের দল এসে ডেরা বেঁধেছে জঙ্গলে। গতকাল নদীর কাছে একজন পুলিশকে বিষের তির দিয়ে মেরেছে তারা। এস পি সাহেব আসছেন। ক্যাম্প করে থাকবেন শালডুংরিতে। সারাদিনে তদন্ত করে যা করার করবেন।

গ্রামেগঞ্জে পুলিশের যা করার–মানে, নিরপরাধ অসহায় কতগুলো মানুষকে ধরে বেধড়ক পিটিয়ে মিথ্যে জবানবন্দি জোর করে নেওয়া–তাই করবে।

ফাদার উইধাসও এসেছিলেন হাটে। গল্পে গল্পে দেরি হয়ে গেল। পুলিশ-খুনের প্রসঙ্গও উঠল। যখন বাড়ি ফিরলাম তখন সন্ধে হব হব। কাছে এসেই দেখতে পেলাম একটি জিপ চলে যাচ্ছে ধুলো উড়িয়ে আমার বাড়ির সামনে থেকে বনের মধ্যে দিয়ে ঝোঁপ-ঝাড় ভেঙে পথ বানিয়ে বড়ো রাস্তায় পড়বে বলে! বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বুঝলাম যে, আসবার সময়ও তারা ওইভাবেই এসেছিল। গ্রামের মূলরাস্তা দিয়ে আমার বাড়িতে আসতে হলেও অবশ্য ঝোঁপ-ঝাড় ভেঙেই আসতে হত কিন্তু জিপটিকে গ্রামের লোকে দেখতে পেত। এরা এসেছে। জঙ্গলের গভীরের সেই রাস্তা দিয়ে, যে রাস্তা দিয়ে ওরা জলের কাছের মাচায় বসত এসে।

আমি ডাকলাম, হনসো।

কোনো সাড়া পেলাম ন।

ঘরে ঢুকে দেখি, নগ্না হনসো অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভিজে গেছে তার শাড়ি, দুই-পা, মেঝে। তার মুখেচোখ দুই স্তনে বুনো কুকুরের চেয়েও হিংস্র আইনরক্ষক মানুষদের নখ আর দাঁতের দাগ।

 একটুপরই সন্ধে হয়ে যাবে। তখন হনসোকে এ অবস্থাতে একা রেখেও যাওয়া যাবে না। আমি দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ওকে পিঠে তুলে নিয়ে সোজা ছুটলাম হাটের দিকে। হাট, বাড়ি থেকে পাকদন্ডী হয়ে বেশিদূর নয়। হাট-ফিরতি দু-একজন আতঙ্কিত মানুষ প্রশ্ন করল। সঙ্গও নিল দু-তিনজন। কেউ উৎকট ঔৎসুক্যে, কেউ আন্তরিক সমবেদনায়। কিন্তু আমি উত্তর করার জন্যে দাঁড়ালাম না একবারও। হাটে যখন গিয়ে পৌঁছোলাম তখন দেখি ভালুগাড়ার মিশনের সাদাভ্যানটা ছাড়ছে। আমার চিৎকারে ফাদার উইপাস ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বললেন।

হাসপাতালে মেয়ে ডাক্তার তো ছিলেন না। তবে মেয়ে নার্স ছিলেন। ডাক্তার আর নার্সেরা হনসোকে দেখে পরীক্ষা করে বললেন অনেকে মিলে তাকে অনেকক্ষণ ধরে ধর্ষণ করেছে। গর্ভপাত এখুনি না করলে হনসোর নিজের জীবন নিয়েও যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে।

আমি রাজি হয়ে গেলাম। বণ্ড সই করিয়ে ওরা যা করবার করলেন। হনসোর জ্ঞান আসা মাত্রই হাসপাতাল আর পুরুষ ডাক্তার দেখে কান্না জুড়ে দিল। ফাদার উইধাসই বললেন যে, একজন নার্স এবং ওষুধপত্র সব দিয়ে গাড়িতে করে আমি ওঁকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার সঙ্গে। কিন্তু ব্যাপারটাকে এমনভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। মেট্রনও যাবেন প্রতিদিন যতদিন রুগি সম্পূর্ণ ভালো না হয়ে ওঠেন।

ফাদার, হনসোর ব্যাপারে হাসপাতালের একটি রিপোর্ট তৈরি করতে বললেন। তারপর বললেন, চলুন আপনার স্ত্রীকে নামিয়ে দিয়ে ওই গাড়ি নিয়েই আমরা থানাতে যাই। ডাইরি তো করতে হবে। এফ আই আর! নার্স থাকবেন আপনার স্ত্রীর সঙ্গে।

বললাম, থানায় ডাইরি করে লাভ হবে না। আই জি সাহেবকে আমি চিনতাম। যখন তিনি ডি আইজি ছিলেন। ভোপালে একটা চিঠি যদি পৌঁছোতে পারেন তাহলে আমি লিখে দিতে পারি। আর একটা চিঠি দিতে হবে চিফ-কনসার্ভেটর অফ ফরেস্টকে। গরমের বাকি দিন কটা যাতে এই জলের জায়গাতে আমড় পাহারার বন্দোবস্ত করেন।

বললাম বটে, কিন্তু জানতাম তা সম্ভব নয়। সম্ভব যদি হয়ও তো বড়ো জোর স্থানীয় থানাকেই ভার দেওয়া হবে। অথবা সদরের থানাকে। রক্ষকই যদি ভক্ষক হন তবে কী আর করার!

হনসোকে নামিয়ে দিয়ে থানায় যখন গেলাম আমরা তখন দারোগা ছিলেন না। থাকবেন না জানতাম। আমি ঠাণ্ডা মাথায় এফ আই আর লেখালাম। ফাদার উইধাসও যা বলার বললেন। ইতিমধ্যে পুলিশ খুনের কিনারা করতে এস পি সাহেব এসে হাজির। বাচ্চা ছেলে। আই পি এস। ফাদার উইধাস ওঁকে আমার পরিচয় দিলেন এবং আমার স্ত্রীর প্রতি পুলিশ কী ব্যবহার করেছে তাও বললেন।

 এস পি পট্টনায়ক সাহেব ওড়িয়া। সব শুনে এতই রেগে গেলেন তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের ওপর যে বললেন, নো ওয়াণ্ডার দ্যাট দে উইল বি কিলড লাইক দিস। ওয়ান বাই ওয়ান। আ পুলিশ ফোর্স উইদাউট মরালিটি হ্যাঁজ নো ওয়ে অফ সারভাইভাল।

বলেই, ডি আই জি সাহেবের সঙ্গে ওয়ারলেসে কথা বলার জন্য লাইন চাইলেন।

 তখন আমি বললাম যে, বর্তমান আই জিকে আমি চিনি। তাঁর সঙ্গে কি কথা বলতে পারি একটু?

এস পি বললেন, নিশ্চয়ই। তবে ডি আই জি সাহেবকে বলে তারপরই বলুন। আই অ্যাম টু স্মল আ ফ্রাই।

আই জির সঙ্গে কথা হয়ে গেলে উনি ডি আই জিকে যা বলার বললেন। তারপর এস পি অনেকক্ষণ কথা বললেন ডি-আই-জির সঙ্গে। ডি-আই-জি বললেন, তিনি পরশুদিন আসছেন নিজে।

এস পি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার স্ত্রী, আমার লোকাল স্টাফদের আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড করালে চিনতে পারবেন?

হয়তো পারবেন। যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠলে।

তার আগে যদি কারও নাম বলেন তাহলে আপনি সেই নাম আমাকে জানিয়ে যাবেন। এই থানার সব কনস্টেবল ও সিপাইদের গাঁয়ের সকলেই মুখ চেনে। আপনার ঘরের সামনে দুজন আর্মড গার্ড থাকবে চব্বিশ ঘণ্টা।

আমি বললাম, তার দরকার হবে না। আপনি এখানে এসেছেন এটাই দুষ্কৃতকারীদের মনে যথেষ্ট ভয়ের উদ্রেক করবে।

 এবার আমরা উঠব। আমার স্ত্রীর জন্যে উদবেগ আছে।

এস পি পট্টনায়ক বললেন, নিশ্চয়ই। আপনারা আর দেরি করবেন না।

গাড়িতে ওঠার আগে আমি বললাম, আই-জি সাহেবকে বলবেন যে চিফ-কনসার্ভেটর সাহেবকে যেন বলেন এখানের বনবিভাগ ঢেলে সাজাতে। যেখানে পুলিশ অফিসার খুন হলেন সেখানে বন-বিভাগের অবিলম্বে উচিত নিজেদের আর্মড-উইং গড়ে তোলা।

 পট্টনায়ক ছেলেমানুষ হলে কী হয়, বললেন, সেই আর্মড গার্ডেরাও যে আমার পুলিশেরই মতো জানোয়ার নিধন করবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? ভূত যে সরষের মধ্যেই ঢুকে গেছে। কি না!

পট্টনায়ককে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আমরা ফিরলাম। ফাদার উইপাস ফেরার পথে গম্ভীরমুখে বললেন, রিয়্যালি ইয়োর কান্ট্রি ইজ ভেরি স্ট্রেঞ্জ। তোমার মতো লোকে এদেশে থাকে, তোমার গর্ভিণী স্ত্রীকে দল বেঁধে ধর্ষণ করার মতো পুলিশও থাকে, আবার পট্টনায়কের মতো ইয়াং পুলিশ অফিসারও থাকে।

আমি বললাম, ফাদার উইধাসও থাকেন।

ফাদার হেসে বললেন, কিন্তু মাইণ্ড ইউ! উনি কিন্তু তুমি যে, আই জি-কে কে চেনো তা না জেনেই অত্যন্ত কড়াভাবে ব্যাপারটা হ্যাঁণ্ডল করতে লেগে পড়েছিলেন।

আমি বললাম, নিশ্চয়ই।

ইণ্ডিয়াতে যতদিন পট্টনায়কদের মতো ডায়রেক্ট রিক্রুট অফিসারেরা আসতে থাকবে তোমাদের কোনোই চিন্তা নেই। নতুন স্বাধীনতা পাওয়র পর বেশ কিছুদিন টিথিং-ট্রাবল তো থাকবেই। সব দেশেই থাকে। ইতিহাস তাই-ই বলে।

তা ঠিক তবে সেটা কতদিন থাকে সেইটেই বড়ো কথা।

.

১৭.

হনসো আজ সকাল থেকেই ভালো। দু-দিন হয়ে গেল। দুপুরের দিকে আজ ভাতও খেল। এ ক-দিন শকড থাকার কিছুই খেতে চাইছিল না। ফেনাভাত। আমি বেঁধেছিলাম। সারাশরীরে কালশিটে। এখনও প্রচন্ড ব্যথা শরীরে সর্বত্র এবং অলিগলিতেও।

দুপুরেই আমি নার্সকে সঙ্গে করে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে এলাম। হনসোর ব্যথাটা শরীরের চেয়ে মনে ছিল অনেক বেশি। যে মেয়ে প্রথমবার গর্ভিণী হয় এবং তার গর্ভপাত করাতে হয় গণধর্ষণে তার ব্যথা সমব্যথী ছাড়া কেই বা বুঝবে!

আইডেন্টিফিকেশান প্যারেডের কথা বলাতে হনসো লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

বলল, তুমি কি পাগল? ওদের আমি আবারও দেখলে অজ্ঞানই হয়ে যাব।

 তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, আমি তখন উঠোন ঝাড় দিচ্ছিলাম। আর জিপটা হাতির মতো মড়মড় শব্দ করে ডালপালা ভেঙে এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। সুরজা এসে বলল, পুলিশ তোর বাড়ি খুঁজে দেখতে এসেছে।

কেন?

কাল পুলিশ খুন হয়েছে বিষের তিরে। সারাবস্তির সব ঘর কাল তল্লাসি হয়েছে। দুজনকে ধরেও নিয়ে গেছে। এখন তোর বাড়ি দেখবে। তোর মরদ কোথায়?

আমি বললাম, জানিস না, আজ হাট। তুই কোন শহরের বাবু রে!

ইতিমধ্যে চারজন পুলিশ এসে ঢুকল। আমাকে বলল, ফাঁকা ঘরে সিরাচ করার নিয়ম নেই, আমাকে ঘরে থাকতে হবে। যেই না ঘরে গেছি অমনি আমাকে মেঝের মাদুরে পেড়ে ফেলে…

বলেই, হনসো কেঁদে উঠল।

একেকজনের শেষ হয়, অন্যজন ঢোকে। বাকিরা উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। চারজনে সবসুদ্ধ প্রায় একঘণ্টা। তখন অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি শুধু বড়হাদেবকে ডাকছি প্রাণপণে। ওরা বেরিয়ে গেল যখন, তখন সুরজা–আমার সাঙাত–বলল ওদের, আমার জন্যে একটু দাঁড়াও। বলেই সেও এসে হায় রে! যতটুকু জ্ঞান ছিল তখুনি তা চলে গেল।

 পরদিন ডি আই জি সাহেব আমাকে নিতে জিপ পাঠিয়েছিলেন। পাঠিয়েছিলেন হনসোর জন্যে ফুল, শাড়ি, আই জি সাহেবের হয়ে এবং ক্ষমাভিক্ষাও। উনিও বললেন, আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডের কথা।

আমি নিজে চোখে জিপটাকে যেতে দেখেছিলাম। নম্বরও আমার জানা ছিল না। কিন্তু পুলিশ মারা যাওয়াতে সেদিন সকালেই অন্য একটি জিপও এসেছিল। কোন জিপের আরোহী তারা ছিল তা আমার জানার কথা নয়। তা ছাড়া যারা আমার হনসোকে নির্যাতন করেছে তাদের আদালতের প্রহসনের হাতে ছেড়ে দিতে আমার মন চাইছিল না। সব পুলিশ অফিসারই নিখিল পট্টনায়কের মতো নয়। যত অপরাধই তাদের সহকর্মীরা করুক না কেন, তাদের বাঁচিয়ে দিতে চেষ্টা করবেন সকলেই। বঙ্কিমচন্দ্র যে সেই বলে গেছিলেন কোন কালে –আইন! সে তো তামাশা মাত্র! বড়লোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে, তা আজকেও সত্যি।

আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি বললাম, আমার স্ত্রী তো এখনও অসুস্থ আর স্বাভাবিক কারণে বড়োই লজ্জা পাচ্ছেন আবারও সেই বুনোকুকুরদের মুখোমুখি হতে। আপনি যদি আমার একটা উপকার করেন তো খুব ভালো হয়।

কী?

এখানে যেসব পুলিশ আছে তাদের ফোটো যদি পাঠিয়ে দেন

উনি বললেন, ভালো কথা। আমি দুটি ফোটোয় সেদিন পুলিশের যত লোক এখানে ছিল তাদের সকলের ছবিই তুলিয়ে দেব। আপনি পরশু পেয়ে যাবেন ফোটো।

.

১৮.

হনসো শারীরিকভাবে আগের চেয়ে ভালো কিন্তু তার মনে যে আঘাত লেগেছে তা সারতে বহু সময় লাগবে। ভেবেছিলাম, আমাদের সন্তান আসবে। আমার মনে যত না সাধ-আহ্লাদ, নারী হিসেবে হনসোর মনে তার চেয়ে অনেকই বেশি ছিল। আর ছিল কল্পনা। শিশুকাল থেকে তার মনে মনে যেসব ছবি এঁকেছিল সে, সেসব ধুয়েমুছে একাকার হয়ে গেল!

এখন রাত অনেক। হনসো ঘুমোচ্ছে। আমি বারান্দায় বসে আছি, বাইরের তারাভরা আকাশের নীচে দামাল বাগালের মতো গরম হাওয়া যেন মস্ত এক মোষের দলকে নিয়ে ধুলো আর ঝরাপাতা আর ঝোঁপঝাড় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বনে-পাহাড়ে। তারারাও যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে তাদের আলোড়নে।

আমার মন ভারি খারাপ হয়েছিল। এই আমার দেশ! দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে কিন্তু স্বাধীনতার একটুও যোগ্য বোধ হয় হইনি আমরা। স্বাধীনতার যোগ্যতা না থাকলে পড়ে পাওয়া স্বাধীনতা খোওয়া যাবে। যে স্বাধীনতা বুকের রক্তে না অর্জন করা যায় সেই স্বাধীনতা থাকে না। তাকে রাখা ভারি মুশকিল। গণতন্ত্র তখনই একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে যখন তার প্রত্যেকটি ভোটদাতা শিক্ষায় এবং সচেতনতায় তার দায়িত্ব এবং অধিকার সম্বন্ধে পূর্ণ সজাগ হয়। নইলে হাত-তোলা মানুষের ভিড়ই বাড়ে শুধু। পার্টির নেতারা যদি সৎ না হয়, বিবেকসম্পন্ন না হয়, যদি ভন্ড এবং স্বার্থপর হয়, দেশের চেয়েও তাদের দল এবং ইজম যদি বড়ো হয় তবে এই এত বড়ো দেশটার এক বা দু-যুগের মধ্যে সর্বনাশ হয়ে যাবে। পুলিশদের হনলোকে গণধর্ষণ সেই দুর্যোগেরই সূচক। এই দেশের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার।

কাল থেকেই ভাবছি এই দেশকে আর দেশের মানুষদের ভালোবেসে ইংল্যাণ্ড থেকে ফিরে শিকারে এসে এখানেই থেকে গিয়ে ভালো করেছিলাম কি না। হনসোকে নিয়ে ইংল্যাণ্ডে চলে যাব কি যাব না সেই চিন্তাও বার বার ফিরে ফিরে আসছে। কিন্তু চোরের ওপরে রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো বোকামিও তো আর নেই। এই দেশের অবস্থা অচিরে এমনই দাঁড়াবে যখন গরিবের এবং বড়লোকেরও ওপর সমান অত্যাচার চলবে স্বল্প কিছু গদি-আসীন নিম্নস্তরের মানুষের দ্বারা। তারা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, শুধুমাত্র ভোট পাওয়ার জন্যে নানান ছলাকলায় এই দেশের সমস্ত মানুষের সমূহ সর্বনাশ ডেকে আনবে। তখনও যদি আমি এবং আমার মতো অগণ্য মানুষেরা চোখ বুজে থাকি, বাস্তবকে পাশ কাটিয়ে যাই; তবে যা অবশ্যম্ভাবী তাই-ই ঘটবে।

গরম হাওয়াতে দু-চোখ আমার জ্বালা করতে লাগল। শুধু গরম হাওয়াতেই কি?

.

১৯.

আজ ডি আই জি সাহেব দুটি নয় চারটি গ্রুপের ফোটো পাঠালেন পোস্টকার্ড সাইজে এনলার্জ করে। যে পুলিশ তা নিয়ে এসেছিল তার ছবিও তারমধ্যে ছিল। আমি তাকে বললাম যে, বিকেলে আমি নিজে গিয়ে থানায় নতুন দারোগার সঙ্গে ফোটোগুলি নিয়ে দেখা করব।

হনসোকে ছবিগুলি দেখাতে হনসো দেখতে চাইল না। তার মুখের আর বুকের খুবই কাছে নেমে-আসা যে কামার্ত মুখগুলি তার সারাজীবনের আতঙ্ক হয়ে থাকবে সেই মুখগুলিকে দেখতে কারই বা ভালো লাগে! তবুও আমার পীড়াপীড়িতে সে বারান্দায় বসে আলোর মধ্যে বার বার দেখল ফোটোগুলি। তিনজনকে শনাক্ত করতে পারল সে। সুরজা ছাড়া। আর একজনকে পারল না। হনসো বলল, তখন আমার চোখ খোলার ক্ষমতা ছিল না। তবে লোকটা ভীষণ মোটা আর ভারী ছিল। সুরজাকে চিনি তো! তাই তাকে চোখ-বোজা থাকলেও চিনতে অসুবিধে হয়নি। তারপর হনসো বলল, জানো ও এরকম ছিল না, শহরের কারখানাতে গিয়েই ওর এরকম অবস্থা হল। কত বদলে গেছে মানুষটা!

সুরজা ছাড়া অন্য তিনজনকে আমি খুব ভালো করে দেখলাম। বার বার দেখলাম। তবুও তাদের মুখগুলি আমার মনে গেঁথে বসল না।

 যদিও হনসো শনাক্ত করেছিল সকলকেই, একজনকে ছাড়া; তবু আমার নিজের শনাক্ত করা হয়নি বলে, বিকেলে গিয়ে আমি নতুন দারোগাকে বললাম যে, আমার স্ত্রী এখনও একজনকেও শনাক্ত করতে পারছেন না। সময় লাগবে আরও। যাঁদের ফোটো পাঠিয়েছেন ডি আই জি সাহেব তাঁদের সকলেই কি এখনও এখানেই আছেন?

এই দারোগা খুবই ভদ্র এবং শিক্ষিত। শুনলাম, কবিতা-টবিতাও লেখেন নাকি!

উনি বললেন যে, চারজন তো মান্দলা থেকে এসেছিল, তারা ফিরে গেছে। বাকিরা এখনও এখানেই আছে।

আমি আরও দু-দিন সময় চেয়ে নিলাম ওঁর কাছ থেকে।

তিনি বললেন, ঠিক আছে। আমি এস পি সাহেবকে জানিয়ে দেব, উনি ডি আই জি সাহেবকে জানাবেন।

বাড়ি ফিরে এলাম ফোটোগুলি নিয়ে। আমি ঠিক করলাম যে, দু-দিন ও আমি গিয়ে ওই এককথাই বলব দারোগাকে। বলব যে, আমার স্ত্রী একজনকেও শনাক্ত করতে পারেননি। শনাক্ত করতে পেরেছেন বললে এদেশীয় আইনের হাস্যকর লজ্জাকর এক গোলোকধাঁধার জগতে প্রবেশ করতে হবে আমাকে এবং হনসোকেও। সাবডিভিশানের, ডিস্ট্রিক্টের, তারপর রাজ্যের কোর্ট এবং তারপরে হয়তো সুপ্রিম কোর্ট অবধি চলবে এই আইনের সর্বস্বান্ত-করা খেলা। হয়তো দীর্ঘ দুই যুগ ধরে। এবং তার পরেও হয়তো প্রকৃত আসামিরা ছাড়াই পেয়ে যাবে, যদি তাদের পয়সা ও মুরুব্বির জোর থাকে। তা আমি হতে দেব না। যে-দেশে আইন তামাশাই হয়ে আছে, সে-দেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া আদৌ অপরাধের নয়। ওই মানুষগুলিকে একে একে আমার মনের মধ্যে গেঁথে নেব। তারপর আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে আমি তাদের প্রত্যেকে শাস্তি দেব। যেমন যেমন শাস্তি তাদের প্রাপ্য। এমনভাবে দেব যাতে আমি নিজে এই আইনি নাগপাশে বাঁধা না পড়ি। তাদের কারও চোখ উপড়ে নেব আমি, কারো মেরুদন্ড ভেঙে দেব, কারও বা প্রাণও নেব। সুরজার তো নেবই। এই শাস্তি এমনভাবেই দিতে হবে যাতে আইনের অক্ষম হাত, যে হাত দুর্বলকে বাঁচাতে পারে না, শুধু সবলেরই সহায়ক হয়, সেই হাত আমাকে স্পর্শ না করতে পারে।

পশু-শিকার তো ছেড়ে দিয়েছি অনেক দিনই। এবার মনুষ্যেতর কিছু মানুষকে শিকার করব রয়ে-সয়ে, ধীরে-সুস্থে। যতক্ষণ না এই প্রতিশোধ নেওয়া আমার সম্পূর্ণ হচ্ছে ততদিন হনসোকে আমি গর্ভবতী করব না। এই ঘৃণ্য জন্তুদের রক্তে স্নান করে এই অন্যায়ের প্রতিকার করার পরই আমরা নতুন করে আমাদের উত্তরসূরির কথা ভাবব।

 আমার প্রথম শিকার হবে সুরজা। তার প্রাণ নেব আমি। তারপর যথাযথ শাস্তি দেব অন্যদের একে একে। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে। চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন যে, ইফ ইউ পে ইভিল উইথ গুড হোয়াট ডু ইউ পে গুড উইথ?

আই উইল পে ইভিল উইথ ইভিল। অবলা বনবালা নীরবে অত্যাচার সয়েছে তাই আমি সেই অত্যাচারীদের ছেড়ে দেব এই আইনের হাতে, আইনরক্ষকদের হাতেই, তা হবে না। যে দেশে দুর্বলকে, নারীকে রক্ষা করার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালিত হয় না সেই দেশে দুর্বল এবং নারীর নিজেকেই নিজেদের রক্ষা করতে হবে।

ধর্ষিতা শুধু হনসোই হয়নি, ধর্ষিতা হয়েছে এই দেশ সম্বন্ধে আমার সমস্ত উচ্চ ধারণা, হয়েছে আমার মাতৃভূমির, স্বাধীন মাতৃভূমিতে মানুষের মতো মানুষ হয়ে সরল সুন্দর আড়ম্বরহীন গ্রামীণ মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নও।

বাড়ি ফিরলে হনসো বলল, চিনিয়ে দিয়ে এলে? কী হবে এখন? ওরা যদি আবারও কিছু করে। তোমার ওপর প্রতিশোধ নেয়?

আমি বললাম, সেই ভয়েই তো তুমি যে শনাক্ত করেছ একথা বলতেই পারলাম না দারোগাকে।

তবে? যদি ওরা আবার আসে?

আমি হেসে বললাম, আসবে না। ওদের বিচার হবে জব্বলপুর বা রায়পুর বা ভোপাল বা দিল্লিতে নয়, বিচার হবে ওপরের কোর্টে!

হনসো জঙ্গলের দিকে চেয়ে বলল, বড়হাদেব বুঝি মিটিং বসাবেন ওদের শাস্তি দেবার জন্য?

বসাবেন।

আমি বললাম।

 আমার চোয়াল শক্ত হয়ে এল।

 বাঁচালে তুমি আমাকে।

হনসো বলল।

আমি কিছু না বলে ওর ডানহাতটি নিজের হাতে নিয়ে চাপ দিলাম একটু।

বললাম, আমি না বাঁচালে, তোমায় বাঁচাবে কে?

.

২০.

চৌকিদার হঠাৎ আমার পেছন থেকে ডাকল, স্যার!

আমি চমকে উঠে প্রায় হার্টফেল করেই মরছিলাম একটু হলে।

সে বলল, খানা লাগা দিয়া সাব। রাত ইগারা বাজ রাহা হ্যায়।

 স্বপ্নভঙ্গ হল যেন আমার। এক আশ্চর্য আদিম জগতে চলে গেছিলাম আমি। যেখানে বাঙালিবাবু আর হনসোরা বাস করেন, বনেজঙ্গলে অনেকবার ঘুরেও যে জগতের স্বরূপ সম্বন্ধে আংশিক ধারণাও আমার গড়ে ওঠেনি, গড়ে ওঠেনি এই দেশের ভেতরকার সুন্দর এবং অসুন্দর অন্তরের প্রকৃতি সম্বন্ধে এই দেশের, আত্মার মুক্তির প্রকার এবং উপায় সম্বন্ধেও।

 আমার কলমটি দিয়ে বাঙালিবাবুর ডাইরির ওই পাতাটিতে একটি পেজ-মার্ক দিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম চেয়ার ঠেলে। তারপর ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে বারান্দায় এলাম। খুব শীত। নদীতীরে নীল কুয়াশা। টিটি পাখি ডেকে ফিরছে প্রায় জমে-যওয়া নদীর ওপরে চক্রাকারে। কেউ ডাকছে নদীর ওপার থেকে ফিচঁচ ফিচ-চ করে। শেয়ালে কি বাঘ দেখেছে? সঙ্গে সঙ্গে একটি বার্কিং-ডিয়ার ডেকে উঠল ব্বাক ব্যাক করে। খান খান হয়ে গেল বনজ নিস্তব্ধতা। নদীর ওপরের জলজ হিমেল নিস্তব্ধতাও।

আমি বললাম, মনে মনে, আমিও দেখেছি। এক বাঘকে। এ এক অন্য বাঘ! বাঙালিবাবু!

আজ সারারাত না হয় জেগেই থাকব। এরপরের অংশটুকু না পড়ে শেষ না করতে পারলে ঘুম কিছুতেই আসবে না।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ