অ্যালগি উপন্যাসবুদ্ধদেব গুহ

০১.

তামারহাটে জল কতদূর উঠল রে ছাইন্যা? কুমুদিনী জিজ্ঞেস করলেন।

ছানু বলল, বড়ো মিত্তিরগোর গদিঘরের সিঁড়ি অবধি উঠছে। আর দুই পশলা বৃষ্টি হইলেই গদিঘরে জল ঢুইক্যা পড়ব।

বাঃ। চমৎকার। এত্ব বছর ইখানে আছি এমনটা তো কখনো দেখি নাই।

তারপর কুমুদিনী বললেন, ধুবড়ি শহরের খোঁজ কিছু রাখস?

রাখুম না ক্যান? পরশুও তো গেছিলাম। সারাশহর ভাইস্যা যাওনের উপক্রম হইছে। ব্ৰহ্মপুত্ৰর এমন ভয়াল রূপ আর কখনো দ্যাহে নাই মাইনষে।

ধুবড়ির ছাতিয়ানতলার রাজাগো খোঁজ লইছিলি?

লইছিলাম। শহরের মধ্যেই ইবার নৌকা চলতাছে।

ছাতিয়ানতলার রাজাদের বাড়ি তো প্রতিবছরই এই সময়ে ডুবুডুবু হয়।

 ইবারে রাজাদাদের বারবাড়িতেই নয়, ভিতরের পাকাবাড়িতেও জল ঢুইক্যা পড়নের উপক্রম হইছে।

কইস কী রে ছাইন্যা। সে তো সাংঘাতিক কথা। আমার বিয়ার পরে, তহন বড়োকর্তা বাঁইচ্যা ছিলেন, তহনও ইকবারমাত্র অমন অবস্থা হইছিল। তারপর আর কখনো শুনি নাই।

রাজাদা কুমারগঞ্জ আর তামারহাটের খোঁজ লইতেছিল। সব কইলাম তারে। তাগো মাইয়াডা তো এহনে কলকাতায় থাইক্যা সি এ পড়ে, তার মামার বাসায় থাইক্যা।

তার পড়ন কি শ্যাষ হইছে?

না। এহনও হয় নাই। স্যা তো এহনে কুচবিহারে আছে তার জ্যাঠার বাড়িতে।

পাশডা কইরলেই তার একটা বিয়া দিয়া দিবার ক।

হ। আজকালকার ছাওয়াল-মাইয়া কেউই বিয়া কইরতেই চায় না। এহনে হলেই স্বাবলম্বী।

-ঠিকেই কইছস। এও এক সমস্যা।

 কাল যে শালিখ আইব কুচবিহার থিক্যা। তারে তো তুই-ই আনতে যাইবি ধুবড়ি থিক্যা, নাকি?

না। আমার যাইতে লাগব না। রাজার এক শালার ছাওয়াল কলকাতা থিক্যা ধুবড়িতে আইস্যা আছে কয়দিন হইল। স্যাই সঙ্গে কইর‍্যা লইয়া আইব শালিখরে।

সে ছাওয়াল কত বড়ো?

পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের হইব।

করেটা কী? পড়াশোনা?

না, না। পড়াশোনা শ্যাষ কইর‍্যা সে এখন স্টেট ব্যাংকে বড়ো কাজ করে। আসলে শালিখরে তার খুবই পছন্দ। আমার মন কয় তাগো বিয়াও অইব এক সময়ে। তবে শালিখের মন বোঝোন যায় না। কুচবিহারেও কি যোগ্য ছাওয়ালের অভাব? তাগো কলেজেই ভালো ঘরের কত ভালো ছাওয়াল পড়ে–কত ছাওয়ালের সঙ্গেই ভাব-সাব আছে। ওদিকেই বড়ো হইছে, লেখাপড়া করছে তার ক্যালকেশিয়ান ছাওয়ালরে মনে ধরে কি না দ্যাহেন।

তারপরে ছানু বলল, তুমি তো তারে ভালো কইর‍্যাই চিনো।

কে? কার কথা কইতাছিস?

 আরে আমাগো ধৃতি।

 চিনতাম তো নিশ্চয়ই। কইতে গ্যালে সে তো তামারহাটেরই পোলা। তারে ভালো কইরাই চিনি। ভারি ভালো ছাওয়াল।

ভালো ছিল, জানি না এহনে কেমন হইছে।

কী য্যান একডা খটমট নাম আছিল পোলাডার?

 ধৃতিমান।

হ। মনে পড়ছে। তাও একটা কথা বটে।

তবে শালিখ সেই ছাওয়ালের সঙ্গে আইলেও তুই অবশ্যই বাসস্ট্যাণ্ডে গিয়া শালিখরে লইয়া আইবি। শালিখ তো আমাদের এখানেই উঠব, নাকি বড়ো মিত্তিরদের বাড়িতে উঠব?

জানি না। তামারহাটে বাদল মিত্তিরের বাড়িতেও থাকতে পারে। বড়োপিসিমা, মানে, বাদল মিত্তিরের স্ত্রী, শালিখরে খুবই ভালো পায়। শালিখও দিদা কইতে অজ্ঞান ছুটোবেলা থিক্যাই।

তা অবশ্য ঠিকোই।

তারপরে বললেন, যার যেহানে পছন্দ স্যা সেহানেই থাকুক। আমি তো পোড়াকপাইল্যা, নিজের ছাওয়ালরেও এককড়ি দিয়া বিক্রি কইরা দিছি বাদল মিত্তিরের বউয়ের কাছে। স্যা তো নীহারনলিনীকেই মা বইল্যা ডাকে। আমার আর আছে কে?

ক্যান? আমি নাই?

তারপর বলল, বাদলজেঠুর স্ত্রীকে সে মা কয় না, কয় দিদা।

তাই?

হ।

 তুই তো বসন্তের কোকিল। এই আছিস, এই নাই। তা ছাড়া, তুই তো তর নিজের ধাইন্ধা লইগ্যাই এখানে থাকস। আমি কি বুঝি না ভাবছস?

 তা তো কইবাই দিদা। তোমার জ্বর আইলে পা টিইপ্যা দিই না? মাথায় পুরানা ঘি মালিশ কইরা দিই না! বাপরে! পুরানা ঘিতে কী দুর্গন্ধ! তা ছাড়া, নসু ডাক্তারের কাছ থিক্যা লাল নীল মিক্সচার লইয়া আসি না? আর তুমিই আমারে ইসব কও! কী আর কমু!

 সে সব তো মাইনে কইর‍্যা লোক রাখলেও করত। ভাবতাছি পদিরে আবার ডাইক্যা পাঠাইমু। মাইয়াডার সবই ভালো কেবল মুখড়া বড়োই খারাপ। যা নয় তাই কইয়া বসে। তা, কী আর করুম। তুই তো সারাটা দিন তামারহাটেই চরকি মারস, আমার খোঁজ রাখস কখন? শুধু রাতটাই কাটাইস এহানে। যা দু-মুঠা রাইন্ধ্যা থুই তাই খাইয়া রাত কাটাস। আমার এই ভাঙা ঘরে কীই বা আছে যে, চোর আইব। যৌবন থাইকলেও না হয় ভয়ের কিছু ছিল। এহনে এই বুড়িরে তো কেউ চাইয়াই দ্যাহে না।

তুমি তো প্যাচাল পাড়বাই। আমার এহনে তোমার প্যাচাল শোনোনের সময় নাই। আমি সাইকেলটা লইয়া যাই একবার তামারহাট থিক্যা ঘুইরা আসি। তারপরে স্বগতোক্তি করল, হেই তামারহাট তো আর নাই। বঙ্গাইগাঁও, গোলোকগঞ্জ, এমনকী গোসাইগাঁওতেও তো গোলমাল। সেদিন শুনছিলাম কচুগাঁওতেও গোলমাল হইছে। আমাগো খ্যাদাইবার চক্রান্ত হইতাছে। বাস্তুহারা কইরাই ছাড়ব দেখতাছি।

দিদা বললেন, আর কয়বার বাস্তুহারা হওন যায়, ক দেহি? ছিলাম রংপুরে সেহান থিকা তাড়া খাইয়া আইলাম এই নামনি আসামে। আবার এহান থিক্যা তাড়া খাইয়া যামু কোথায়?

 যেহানেই যাও দিদা, বাংলার মধ্যেই যাইতে হইব। অন্য কোনো রাজ্যেই আর ভরসা নাই।

তোর মনে থাকনের কথা নয়। আমাগো বাড়ির সেই জলপাই গাছ, গোলা কাঁঠালের গাছ, ইন্দারার পাড়ের সিঁদুরে আমের গাছখান, সব যেন চক্ষের সামনে দেখতে পাই। আর চ্যাগারের পাশের চালতা গাছখান। তার নীচে মাদুর পাইত্যা বইস্যা লবণ আর লঙ্কার গুঁড়া দিয়া হলে মিল্যা চালতা খাওয়া। আহা! কীসব দিন আছিল।

তহন তোমার বয়স কত ছিল দিদা?

কে জানে! উনিশ-কুড়ি হইব। তোর দাদুও তো তখন ছেলেমানুষ। হরিসভায় অষ্টপ্রহর কীর্তন, হরিসভার পুকুরে কলার ভেলায় কইর‍্যা প্রতিমা ভাসান, সিঁদুর খেলা। তারপর বললেন, তুই ত তহনে জন্মাসই নাই, তুই জানবি ক্যামনে? তারপরে আবার বললেন, কী খাওন-দাওন, কী মজা। খ্যাতের ধান আইত গোরুর গাড়ি কইর‍্যা, ফুলমণি গাইয়ের দুধ, পাথরের বাটিতে পুরু সর পইড়া থাইকত পায়েসের উপর, বাড়িতেই তৈরি হইত ঘি। শীতকালে সকালের খাওন বইলতে সুগন্ধি চালের ফেনাভাত, বাড়ির জমির আলু সিদ্ধ, কপি সিদ্ধ, শিম সিদ্ধ, সঙ্গে বাড়িতে তৈরি ফুলমণির দুধের ঘি, কাঁচালঙ্কা। আহা স্বাদ মুখে য্যান লাইগ্যা আছে এহনও। তোরা তো সব জন্মাইসনাই তহন। আমরা উদবাস্তু হইয়্যা চইল্যা আসনের অনেক পরেই তো তাদের জন্ম।

ছাড়ান দ্যান দিদা। ওইসব সুখের দিনের কথা মনে কইর‍্যা আর কষ্ট পাওন ক্যান?

 ঠিকোই কইছস। যা ফ্যালাইয়া আইছি, তা তো ফ্যালাইয়াই আইছি।

তারপর বললেন, ত্যানারা তো কেউই বিএ, এমএ পাস আছিলেন না যে, ফটাফট চাকরি পাইবেন। ব্যাবসাও কুনোদিনও করেন নাই তবু বড়োকর্তা আগে থাইকতেই ধুবড়িতে থাইকতেন বইল্যা ওনারা সব ভাইই কুমারগঞ্জ আর তামারহাটে জায়গা জমি কিইন্যা নতুন কইরা জীবন শুরু করছিলেন। মেজোভাসুর ধুবড়িতেই রয়্যা গেলেন। সেখানেই নানা ব্যাবসা শুরু কইরলেন। সেজো গেলেন গৌরীপুরে। ধুবড়ি আর কুমারগঞ্জ ধুবড়ির মাঝামাঝি জায়গা। ভারি সুন্দর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা আছিল গৌরীপুর। প্রমথেশ বড়ুয়াগো রাজবাড়ি আছিল মাটিয়াবাগ প্যালেস। তোর দাদুর লগে মেজোকুমার প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়ার ভালো আলাপ আছিল। উনি তোর দাদুরে খুবই ভালো পাইতেন।

ওইসব কথা শুরু করলে আর শ্যাষ হওয়ার নয়। তুই ঘুইর‍্যা আয়, তামারহাট থিক্যা– আকাশ থমথম করতাছে। তারপরে বললেন, কী রাঁধুম রাতে তোর লইগ্যা।

দিদা, তুমি পদিদিদিরেই ডাইক্যা লও। তারও তিনকুলে কেউ নাই–তোমারও একজন সেবাদাসী লাগে। এই বয়সে রান্না-বান্না, ঘর-উঠান ঝাঁট দেওয়ন কি সম্ভব? পোস্টাফিসে যা সঞ্চয় আছে তাই ভাইঙ্গা খরচ-খরচা চালাইয়া লও। আমি তো একখান অপদার্থ। তবু যা পারি, যতটুকু পারি, সব তোমারেই আইন্যা দিমু। কুন চিন্তা কইরো না তুমি। বোঝো না?

হ বুঝছি। মুগের ডালের খিচুড়ি চাপাইতাছি–সঙ্গে আলু আর কুমড়া ভাইজ্যা দিমু অনে। একটুক ঘি এহনও আছে! নীহার দিছিল মাসখানেক আগে। যা। আর দেরি করস না। বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বরে পড়বি। তহন তরে দেখবটা কে? আমি তো নিজেরেই দ্যাখতে পারি না।

হ৷ দিদা। যাই।

বলে ছানু, সাইকেলটা এক সময়ের গোয়াল ঘর থেকে বার করে তাতে উঠে বসল। বাইরের রাস্তাতে পড়ে, ঢিল খাওয়া ঠাকুরের থানের কাছ থেকে তার সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শোনা গেল।

সন্ধে হবে একটু পরে। নানা পাখি ডাকছে একসঙ্গে নদীর দিক থেকে। নদীর গন্ধ ভেসে আসছে বাদলা হাওয়াতে। প্যাঁচা দুটো রোজই তো ঝগড়া করে এই সময়ে। তারা এখন উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ঝগড়া করবে। আসলে, ওদের দুজনের মধ্যে খুব ভাব–কুমুদিনী আর তার স্বামীর মধ্যে যেমন ছিল। রংপুরের সেইসব দিন-রাত, তাঁদের যৌবনের কথা মনে পড়ে। মনটা উদাস হয়ে যায়। রোজই সন্ধের আগে এইরকমই খারাপ হয়ে যায় কুমুদিনীর মনটা।

ভাবে, মন বইল্যা একটা বস্তু এহনও আছে। সিটা যে কী তা বোঝোন যায় না। তবে আছে ঠিকেই। মন ছাড়া কি মানুষ হয়?

.

হরজাই গাছের ছায়া ঘন হয়ে বিছিয়ে পড়ে উঠোনের ওপরে।

একটু পরেই নদীর ধার থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসবে। অনেকক্ষণ ধরে হুক্কা-হুঁয়া হুয়া করে ডাকবে তারা। একজোড়া তক্ষক আছে বাড়িতে। তাদের একজন ডাকবে একদিক থেকে অন্যজনে সাড়া দেবে অন্যদিক থেকে। তাদের মধ্যেও খুব ভাব প্যাঁচা আর প্যাঁচানির মতো।

সকলের ডাকেই সাড়া দেওয়ার কেউ আছে। শুধু কুমুদিনীই একা। ডাকার মতো কেউই নেই তাঁর, নিজে ডাকলেও তেমন করে সাড়া দেওয়ার মতোও কেউ নেই।

.

০২.

বাসস্ট্যাণ্ডে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ধৃতিমান। কোচবিহারের বাসটা আসতেই শালিখ নামল সেই বাস থেকে। ধৃতির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শালিখেরও।

কেমন আছিস? ধৃতি বলল।

ভালোই তো। ধুবড়ি শহর তো ডুবে গেছে কোচবিহারের সকলেই বলছিল।

 প্রায় সেরকমই। রাজাদের বাড়িতেও এবারে যা জল উঠেছে কোনোবারেই তেমন ওঠে না।

তারপর শালিখকে বলল, রাজাদাদের বাড়িতে যাবি না একবার?

রাজাদা তো অফিসে চলে গেছে। বউদিও তো কলকাতায়। মেয়েকে দেখেনি অনেকদিন তাই গেছে সেখানে।

কলকাতাতে কোথায় উঠেছে?

কেন? বউদির দাদার বাড়িতে। যেমন ওঠে।

তাহলে কোথায় যাবি?

তামারহাটেই যাব। সোজা। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হয় না বহুদিন। বড়োদিদার সঙ্গেও দেখা হয়নি বহুদিন। তবে বাবা-মা তেমন না লিখলেও বড়োদিদা সপ্তাহে অন্তত একটি করে চিঠি লেখে। কুমুদিনীদিদা কেমন আছে রে ধৃতিদা?

ভালোই আছে। যেমন থাকা যায় এই বয়েসে। সকলেই এখন একা। সকলেরই সুখের সময় শেষ হয়ে গেছে।

কুমুদিনীদিদা কি একেবারেই একা থাকেন?

 ছানুকাকু থাকে। তবে না-থাকারই মতো।

কেন? পদিমাসি?

পদিমাসি মাঝে চলে গেছিল। তারও তো বয়েস হচ্ছে। তা ছাড়া তারও বাড়িতে তো কেউই নেই তাই কুমুদিনীদিদার কাছে থাকলেই সে ভালো থাকে। দিদারও একজন কথা বলার মানুষ থাকে। দিদার পা টিপে দেওয়া আর রান্না-বান্না করে দেয় পদিমাসি। সকলেই তো একা। তা ছাড়া, টাকার জোর না থাকলে সকলেই আরও একা হয়ে যায়।

সেই তো কথা। টাকার জোর আর কার আছে। তবে মা-বাবা তাও আছে দুজনে। যেদিন তারাও চলে যাবে তখন তামারহাটেও যাওয়ার মতো আমার আর কেউই থাকবে না। নীহারদিদা ছাড়া।

তারপর বলল, মানিককাকু কেমন আছে রে? এখনও তামারহাটেই থাকে?

আর কোথায় থাকবে। তার তো ঘর-সংসারও নেই। তবু মানিককাকু মজার মজার কথা বলে। যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই সকলকে হাসিখুশি থাকতে হয়।

মানিককাকু কি সেইরকমই আছে?

একেবারেই সেরকম। শুনলাম, তাঁর এক বন্ধুর দোকানে, নতুন খুলেছে মনোহারি দোকান তামারহাটের হাটে, খাবার মতো কিছু না থাকায় সেই দোকানের এককৌটো ব্রাসোই নাকি খেয়ে ফেলেছিল ক-দিন আগে। তা নিয়ে কী কান্ড।

ব্রাসো কি কেউ খায়?

খায়।

মানিককাকু সবই খায়। বলে, বিনি পয়সাতে যা পাওয়া যায় তা-ই খাওয়া যায়।

এখনও সেইরকম সব গল্প করে?

করে না আবার!

তার কিপটে বন্ধুর মেয়ে হওয়ার গল্পটা মনে আছে?

না। ঠিক মনে নেই। কী যেন গল্পটা?

কিপটে বন্ধু বলেছিল, ছেলে হলে মানিককাকুকে টেলিগ্রাম করবে। Got a bicycle বলে। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক সেই খবরে অন্য বন্ধুরা খেতে চাইবে। সে জন্যেই এই ছলনা। ছেলে হল না, হল মেয়ে। মানিককাকুর বন্ধু বলেছিল ছেলে হলে মানিককাকুকে টেলিগ্রাম করবে Got a bicycle বলে। কিন্তু হয়ে গেল মেয়ে। তাই টেলিগ্রাম এল, Got a bicycle but the front wheel is punctured and the pumper missing. অন্য কেউ বুঝলই না টেলিগ্রামের মানে। মানিককাকু ঠিকই বুঝেছিল। সকলেই খাওয়া থেকে বঞ্চিত হল।

শালিখ খুব জোরে হেসে উঠল। বলল, এসবই মানিককাকুর বানানো গল্প।

কোথায় যেন কাজ করত মানিককাকু?

 যুদ্ধের সময়ে এয়ারফোর্সে কাজ করত।

পাইলট?

আরে না না। গ্রাউণ্ড ইঞ্জিনিয়ারের নীচে কাজ করত। হয়তো খালাসি-টালাসি ছিল। কিন্তু ঘর-সংসার তো করেনি, মাইনে পেত তাতেই মহানন্দে থাকত। যুদ্ধের পরে তো চাকরি চলে গেল। তখন থেকেই তামারহাটেই থাকত তোদের বাড়িতে। তোর বাবাকে ব্যাবসাতে টুকটাক সাহায্যও করে সে, তা তো তুই জানিসই। তামারহাটে যার যেরকমই অবস্থা থাক কারও বাড়িতেই ডাল-ভাতের অভাব ছিল না।

কেন মাছ? মাছেরও অভাব ছিল না কোনো। হাটবারে তামারহাটে মাছের বন্যা বয়ে যেত। কতরকমের যে মাছ।

তা ঠিক।

দেখতে দেখতে গৌরীপুরে এসে পৌঁছোল বাস। ধৃতির চিরদিনের প্রিয় জায়গা এই গৌরীপুর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সব বাড়ি-ঘর। পথঘাট।

তুই গৌরীপুরের রাজবাড়ি দেখেছিস কখনো? মাটিয়াবাগ প্যালেস?

না। দেখিনি।

 ফেরার পথে তোকে দেখিয়ে দেব। প্রমথেশ বড়ুয়াদের বাড়ি। মেজোকুমার প্রকৃতীশচন্দ্র বড়য়াও বিখ্যাত মানুষ। পৃথিবীর মধ্যে ওঁর মতো বড়ো হাতি-বিশেষজ্ঞ খুব কমই আছেন। যৌবনে খুব ভালো শিকারিও ছিলেন। অনেকদিন হল শিকার ছেড়ে খেদা করে হাতি ধরে নানা রাজা-মহারাজা আর চিড়িয়াখানাকে সেইসব হাতি বিক্রি করতেন। ইদানীং বুনোহাতি লোকালয়ে চলে এলে সেইসব হাতি তাড়াতে তাঁর ডাক পড়ে। তাঁর মেয়ে পার্বতী বড়ুয়াও এখন একজন হাতি-বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত। গৌরীপুরের রাজকুমারী প্রতিমা বড়য়াও গোয়ালপাড়িয়া গানের জন্য বিখ্যাত। এখন বয়েস হয়ে গেছে অনেক।

তুই এতসব জানলি কী করে!

বাঃ। আমি তো এই অঞ্চলেরই ছেলে। গোয়ালপাড়া জেলারই ছেলে। আমি জানব না তো, কে জানবে!

তা ঠিক।

মাটিয়াবাগ প্যালেস তো এখন দেখা যাবে না, না?

না। মাটিয়াবাগ প্যালেস তো বাসরাস্তার ওপরে পড়েও না।

এখানে বানের জল তো নেই-ই দেখছি।

না। গৌরীপুর উঁচু জায়গা। এখানে জল আসে না।

 আরও কিছুক্ষণ বাস চলার পরে পথে বড়ো বড়ো নুড়ি-পাথরের ভিড় দেখা গেল। বাসের টায়ারে সড়সড় শব্দ উঠছিল। তবে ইদানীং পথ পাকা হয়ে গেছে। আগে তো পথের অনেকটাই নুড়িময় ছিল।

কিছুক্ষণ পরই কুমারগঞ্জ এসে গেল। পথের ডানদিকে বিশেষ বাড়িঘর নেই। আগে তো পুরোটাই ধানখেত ছিল। তার দু-পাশে ঘন জঙ্গল। সেই ধানখেত পেরিয়ে গেলেই পাহাড়। সেই পাহাড়ের নাম লালমাটি। পাহাড়ে উঠলেই মস্ত টুঙবাগান পড়ত। এই টুঙের ইংরেজি নাম কী তা জানা ছিল না শালিখ এবং ধৃতির। ধৃতির তো জানবার কথাও ছিল না। সেই বাগানের ভেতরে একটি এক-কামরার বাংলো ছিল। বাগানের কেয়ারটেকার অথবা মালিক থাকতেন। এই টুঙফলের রস দিয়ে নাকি এরোপ্লেনের গায়ের রং তৈরি হত। সত্যি মিথ্যা তা ওরা জানে না। ছেলেবেলায় এবং বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এরকম কত গল্প চালু থাকে। কারা যে রটায়, তা জানা নেই। তবে যারাই রটাক, সহজে বিশ্বাস করা যায় বলেই হয়তো সকলেই সেইসব গল্পে বিশ্বাস করে। আশ্চর্য মানুষের স্বভাব।

কুমারগঞ্জের ছায়াছন্ন পথের ওপরেই একটি বহুপুরোনো শ্যাওড়া গাছের কোটরে কী এক দেবতার থান। সে-ই দেবতা ফুল, ফল, মিষ্টি এসব কিছুতেই অন্য দশজন দেবতার মতো তুষ্ট হন না। যে-ই সে পথ দিয়ে যাতায়াত করে সেই একটি পাথর ছুঁড়ে মারে দেবতার উদ্দেশে। পাথরে পাথরে প্রাচীন গাছের পুরোনো কোটর ভরতি হয়ে গেছে। সেই দেবতার নাম ঢিল খাওয়া ঠাকুর। পথচলতি বাসও সেখানে দাঁড়ায় একমুহূর্ত। কণ্ডাক্টর ছেলেটি বাস থেকে নেমে পথ থেকে একটি পাথর তুলে নিয়ে দেবতার উদ্দেশে ছুঁড়ে মারে কোটরের মধ্যে। স্তূপীকৃত পাথরের ওপরে সেই ছুঁড়ে দেওয়া পাথরটি টং শব্দ করে থিতু হয়। কণ্ডাক্টর উঠে পড়লেই বাস আবার চালু হয়।

দেখতে দেখতে তামারহাটে পৌঁছে গেল বাস। হাটের পাশেই বাস-স্টপেজ। আরও ক জনের সঙ্গে শালিখ আর ধৃতি নেমে পড়ল বাস থেকে। শালিখদের বাড়ি ছাড়িয়ে এসেছে। ওরা। ধৃতি যাবে, নীহারদিদার বাড়িতে। বাদলদাদু নেই। একদিন, কয়েক বছর আগে, কী কাজে ধুবড়ি শহরে গিয়ে পথের মধ্যেই বুকে ব্যথা বোধ করাতে তাঁর মেজো শ্যালক টোনা গুহর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে, খাটে শুয়েই চোখ বোজেন।

জল হয় বটে টোনাদাদুদের পাড়াতে। নদীর কাছের এলাকা একে, তায় আবার নীচু এলাকা। বর্ষাকালের দু-তিনটি মাস সে অঞ্চলের মানুষে বড়ো কষ্টে থাকে। দেশভাগের পরে টোনাদাদুরাও রংপুর ছেড়ে বাদলদাদুর মাধ্যমেই এই বাসা ঠিক করে তাতে এসে ওঠেন। এম এম ঘোষ অ্যাণ্ড কোম্পানি নামের কলকাতার এক সাইকেল কোম্পানির এজেন্সি নিয়ে ধুবড়ি শহরের ব্যাবসার এলাকাতে একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে সেখানেই দোকান খুলে বসেন। ব্যাবসা মুখ্যত সাইকেলের, কিন্তু দোকানের নাম দেন ধুবড়ি সাপ্লাই স্টোরস। ব্যাবসার মনোবৃত্তিই ছিল না টোনাদাদুর। খুব ঈশ্বরভক্ত মানুষ ছিলেন। মা দুর্গাই ছিলেন তাঁর উপাস্য দেবতা।

দেশভাগের পরে প্রায় সকলেই একে একে রংপুর ছেড়ে চলে এলেন। কেউ আগে, কেউ পরে। মুসলমান পাড়া-প্রতিবেশীরা অনেকেই, মুখে মুখে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু সে কেবল কথারই কথা। থেকে যাওয়ার জন্যে যা কিছু করণীয় ছিল, তার কিছুই কেউ করেননি। সেইসব কথা মনে না রাখাই ভালো। ধৃতিমানেরা বা শালিখরা নিজেরা দেশভাগের আঁচ বুঝতে পারেনি কারণ তারা তখন হয় জন্মায়ইনি অথবা অত্যন্তই ছোটো ছিল। তা ছাড়া, সেইসব ফেলে-আসা ঘর-বাড়ি, খেত-জমি, গাছপালা, গোরু-ছাগল, হাঁস তাদের বাবা কাকারা নিজেরা দেখলেও দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কীই বা করার ছিল? ঝড়টা সহ্য করতে হয়েছিল পূর্বপুরুষদেরই। যাঁরা সেই ঝড়ে শারীরিক, মানসিক, আর্থিকভাবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছিলেন, তাঁদের প্রজন্ম প্রায় শেষ হয়ে গেছেন। তাঁদের পক্ষে এ পরম সৌভাগ্যের কথা। বড়োই কষ্ট পেয়ে গেছেন তাঁরা। প্রত্যেক মানুষকে একদিন যে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়ই এ যেমন দুঃখের কথা তেমনই আনন্দেরও কথা। যে জীবন বইবার উপযুক্ত নয়, যা বড়ো কষ্টের, বড়ো যন্ত্রণার, বড়ো লাঞ্ছনার, তা শেষ হয়ে যাওয়াই ভালো।

পূর্বপুরুষদের দেখে মাঝে মাঝে ধৃতির মনে হয়, বাঙালি জাতের মতো সর্বংসহ জাত সম্ভবত পৃথিবীতেই আর নেই। ইহুদিদের ওপরেও কম অত্যাচার করেনি হিটলারের নাতসি বাহিনী, কম মানুষকে হত্যা করা হয়নি, কম মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়নি, কম মানুষকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারা হয়নি বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রাখা হয়নি কিন্তু এতকিছু করেও ইহুদিদের মুছে ফেলা যায়নি। যুদ্ধর পরে মরুভূমির মধ্যে তারা ইজরায়েলের মতো দেশ গড়ে তুলেছিল–মরুভূমিতে ফসল ফলিয়েছিল, ফুল ফুটিয়েছিল এবং শুধু তাই-ই নয়, অতটুকু দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের সাহস এবং মৃত্যুভয়হীন মনোভাবে এবং সর্বত্রই তাদের নিজেদের তৈরি অস্ত্রশস্ত্রর জন্যেও অনেক দেশ তাদের ভয় পায়।

চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস লিখেছিলেন, If you pay evil with good what do you pay good with? যারা যে ভাষা বোঝে তাদের সঙ্গে সেই ভাষাতেই কথা বলতে হয়। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি।

নীহারদিদার বাড়ির দিকে ওর ছোটো ব্যাগটা নিয়ে হেঁটে যেতে যেতে এতসব কথা কেন যে, মনে আসছে ধৃতির সে জানে না। কিন্তু এটা ঠিক যে তারা সব ভুলে গিয়ে অতিসহজ সুখ-শান্তিতে আছে। এখন বেঁচে থাকাটাই সুখ-শান্তি। মানে, তাদের পূর্বপুরুষেরা ভেবেছিলেন, পূর্ব ও উত্তরবঙ্গ ছেড়ে নামনি অসমে এসে বুঝি থিতু হতে পারবেন। কিন্তু এখানেও তো ভিটে-মাটিতে টান পড়েছে, সেসবও তো হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আগে ছিল বাঙাল-খেদা এখন অন্য ভয়। যারা ভালো আছে, বিশেষ করে কলকাতার মতো শহরে, সাধু অথবা অসাধু উপায়ে প্রভূত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়ে গেছে তাদের আর পেছনে তাকাবার দরকার নেই–তাদের কথা অন্য। কিন্তু অধিকাংশই তো তা নয়। তবু পেছনের কথা কেউ ভাবেও না। ভেবে লাভ নেই বলে। এই-ই তাদের ভাগ্যের লিখন বলে তাঁরা মেনে নিয়েছেন।

 নীহারদিদার বাড়িটা অনেকখানি জায়গা নিয়ে। একেবারে হাটমুখো। হাটের নামেই জায়গার নাম। তামারহাট।

প্রথমে অনেকখানি বারান্দা। সিমেন্ট-বাঁধানো। মাঝে বাঁশের খুঁটি পরপর অনেকগুলো। তারপরে গদিঘর। তাতে মস্ত গদি। ঘরের নামই গদিঘর। তামারহাটে অনেক মাড়োয়ারি ব্যাবসাদার আছেন। তাঁদের প্রত্যেক বাড়িতেই সামনের ঘরটি গদিঘর। তাদেরই দেখাদেখি এই গদিঘর। ঘরে একটি ভারী লোহার সিন্দুক গদির ওপরে রাখা। অনেকগুলি তাকিয়া ছড়ানো-ছিটানো। গদির অন্যদিকে একটি কাঠের তক্তা। তার ওপরে নানা জিনিস রাখা। সব লাল শালুর বাঁধানো খাতা–পুরোনো বছরের হিসেব–আরও নানা জিনিস।

তামারহাট দেশভাগের আগে পর্যন্ত গমগমে বন্দর ছিল। পাটের ব্যাবসাই ছিল এখানের মূলব্যাবসা। বাদলদাদু এবং তাঁর দাদারা দেশভাগের আগে থেকেই নামনি অসমে থিতু হয়েছিলেন।

পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বড়ো বড়ো মহাজনি নৌকো করে পাট চালান আসত এখানে। দেশভাগের আগে। বাদলদাদুর গদিঘরের পরেই ছিল অনেকখানি জায়গা। তার একপাশে নানা গাছগাছালি। সযত্নে লাগানো ঝোঁপ-ঝাড়। রঙ্গন, কাঠগোলাপ আরও অনেক কিছু। একটি রুদ্রাক্ষর গাছ। বড়োপিসিমার অনুরোধে পিসতুতো ভাই ঝন্টুদা নিয়ে এসে পুঁতেছিল। এইসব রঙ্গনের ঝোপেই ধৃতি প্রথম দেখে অগণ্য মৌটুসি পাখি। মৌটুসি ছাড়াও ছিল আরও অনেক পাখি–বুলবুলি, টুনটুনি, আরও অনেক নাম না জানা ছোটো ছোটো পাখি। এখানেই সে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল। রংপুর দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি।

গদিঘরের পরে সেই ফাঁকা জায়গার ডানপাশে ছিল মস্ত গুদাম। মোটা মোটা শালকাঠের খুঁটির ওপরে ছিল সেই গুদাম। তাতে ভরতি পাট থাকত–Brunnei মেমসাহেবদের চুলের মতো সাদারঙা, নরম, রেশমি। ওই পাটই গুদামজাত করে পরে দাম বাড়লে বিক্রি করে দেওয়া হত। বড়ো বড়ো মোষের গাড়িতে করে নিয়ে যেত ব্যবসায়ীরা পাটের মরশুম শেষ হলে।

 গদি এবং পাট-গুদামের পরে ছিল অন্দরমহল। ডানদিকে দুটি ঘর। উলটোদিকে পাকা বারান্দাসমেত মস্ত রান্নাঘর। একপাশে ছিল ইঁদারা। তার গায়ে একটি জলের সিমেন্ট-বাঁধানো চৌবাচ্চা। তাঁর গায়ে লেখা ঝুমুর স্মৃতি। নীহারদিদার বডোমেয়ে ছবিপিসির বিয়ে হয়েছিল কলকাতার লয়েডস ব্যাংকে কাজ করা বাহাদুর পিসের সঙ্গে। ওঁরাও উদবাস্তু ছিলেন। ঢাকায় বাড়ি ছিল তাঁদের। তার ছোটোভাই সুকোমল ছিল ধৃতিরই বয়েসি। বি কম পাস করে সেও ওই ব্যাংকেই চাকরিতে ঢোকে। চাকরিতে ঢোকে বড়োকাকাও। ক্যাশিয়ারের চাকরি।

ঝুমুরকে কখনো চোখেও দেখেনি ধূতি। কিন্তু ওই ঝুমুর স্মৃতি-সিমেন্টের জলের ট্যাঙ্কের কারণেই ঝুমুরের নামটি মনে আছে এবং থাকবে যতদিন সেই জলের ট্যাঙ্কটি থাকে।

বড়োদিদা রান্নাঘরেই ছিলেন। না-বলে-কয়ে আসা ধৃতি ডাক দিল বড়োদিদা বলে। দিদা অবাক হয়ে রান্নাঘর থেকেই বললেন, কে রে। ধৃতি? আয় আয়।

ধৃতি সিঁড়ি বেয়ে উঠে দাঁড়াল রান্নাঘরের বারান্দাতে। দিদার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

–কখন আইলি?

বাসে এলাম ধুবড়ি থেকে। আমার সঙ্গে শালিখও এসেছে।

স্যা কোথায়?

সে গেল তাদের বাড়ি।

 তা দিদার বাড়ি আসব কখন?

 মনে হয় বিকেলে আসবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে দুপুরের খাওয়া ওখানেই সেরে তারপরেই আসবে।

তা, তুই তো না বইল্যা কইয়াই আইলি। বিশেষ কিছু তো রান্ধি নাই। আমি যা খামু তাই খা এবেলা। রাতে যা খাইতে চাইবি তাই রাইন্ধ্যা দিমু অনে।

আমার জন্যে আলাদা কিছু রাঁধতে হবে না। যা হয় কিছু বেঁধে দেবেন।

তারপর বলল, অনেকদিন কাঁঠালের বিচি ভাজা খাইনি। বাড়িতে আছে কাঁঠালের বিচি বড়োদিদা?

কাঁঠালের বিচিও থাকব না বাড়িতে! অবশ্যই আছে। আর কী খাইবি তাই ক।

আগে দুপুরের খাওয়াটাই খেয়ে নিই। তোমার খাবারে ভাগ বসাই আগে।

ছাইন্যাটা কইছিল আইবে, খাইবেও দুপুরে। এহনেও ভাত চাপাই নাই। ইখানে তো ফ্রিজ ট্রিজ নাই। কারিপাতা ফ্যালাইয়া ডিমের ঝোল রাঁধছি–আলুর চচ্চড়ি, লেবুর আচার আছে, সোনামুগের ডাল। তুলাইপন্ধী চাউল আইন্যা দিছিল মানিক, রায়গঞ্জ থিক্যা–কী কাজে য্যান গ্যাছিল সিখানে। বড়োই সুগন্ধি চাল। তুই খাইছস কখনো?

না তো। তুলাইপন্ধী? সেটা আবার কী চাল?

খাইলেই বুঝবি অনে। হাতে তিনদিন গন্ধ থাকব।

 শালিখদের জন্যেও এনেছিল মানিককাকু?

আনব না ক্যান? স্যা তো থাকেই তাগো বাড়িতে। তারপর বললেন, শালিখের জইন্যে তো বড়োই দরদ দেহি তর।

ধৃতি লজ্জা লজ্জা মুখে বলল, একইসঙ্গে এলাম তো। তাই-ই মনে হল।

লজ্জা পাওনের আছেটা কী? শালিখের লগে তো আমার বাড়িতেই প্রথম দেখা তর। ভারি ভালো মাইয়া। অমন মাইয়া লাখে মেলে।

তারপর বললেন, আমার লইগ্যা শালিখ কী আনছেরে কুচবিহার থিক্যা? জানস?

আপনি যা ভালোবাসেন। তাই এনেছে।

 কী?

 বই আর কী। উপন্যাস, গল্পের বই। অনেকগুলো এনেছে। বলল, বড়োদিদা ভালো না খেয়েও থাকতে পারে, বই না পড়ে থাকতে পারে না।

ঠিকোই কইছে ছেমরি। আমার কাছে তো আইত বইয়ের লইগ্যাই। অগো বাসাতে তো বই আর কেউই পড়ে না। ভুল কইলাম। পাগুও পড়ত। মানে ভানুর শালি। ওর লগেই তো বাচ্চুর বিয়া হইছে জানস নাকি?

না তো। আমাকে কেউই বলেনি। ভালোই হয়েছে। দুই বোন একই বাড়িতে বউ হয়ে থাকবে।

হ। ভালো তো অবশ্যই হইছে। ঘি আর আগুন একসাথে রাখন ঠিকও নয়। তবে বিয়ার পরে বাচ্চু এহন আর তামারহাটে থাকে না। তারা বাড়ি ছাইড়্যা গেছে গিয়া। ধুবড়িতে সিখানেই একখান ছুটো বাড়ি বানাইছে। তবে শুনছি জায়গা বিশেষ নাই। শুধুই বাড়িখান। গাছপালা ছাড়া বাড়ি, বাড়ি বইল্যাই মনে হয় না।

তা ঠিকই বলেছেন। কিন্তু, শহরে জমি পাবে কোথায়? আমাদের কলকাতা তো শুধুই সিমেন্ট আর ইট-কাঠের জঙ্গল। মানুষ কী করে যে থাকে সেখানে কে জানে!

ঠিকেই কইছস। পাগু মাঝে একবার আইছিল। সে মা হইব। কইতেছিল ধুবড়িতে দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে।

তারপর বললেন, জিনিসপত্তর থুইয়া আয় তুই যে ঘরে থাকস সেই ঘরে। তারপর হাত মুখ ধুইয়া ল। চা করুম। আমি নিজেও এই সময়ে রোজই খাই এককাপ।

ঠিক আছে। আসছি। আসছি।

ঘরে জিনিসপত্র রেখে, হাত-মুখ ধুয়ে ধৃতি ফিরতে ফিরতেই শুনল, বড়োদিদা কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন।

ফিরে এসে দেখল ছানুকাকু। সাইকেলটা রান্নাঘরের বারান্দাতে ঠেসান দিয়ে রেখেছে। বহুদিন পরে দেখল ছানুকাকুকে। একটা জিনস-এর প্যান্ট আর সাদা-কালো একটা হাওয়াই শার্ট গায়ে। মুখে সবসময় সেই হাসিটি লেগেই আছে।

ধৃতিকে দেখেই বলল, কী খবর কইলকাতার সাহেবের? দ্যাখতাছি বাহাদুর জামাইবাবুকে দেইখ্যা হলেই ব্যাংকে চাকরি করতাসে।

ধৃতি কথা বলল না। হাসল শুধু।

 একদিন আসবেন ছানুকাকু কুমারগঞ্জে।

আরে ছ্যামড়া, আমি তো কুমারগঞ্জেই থাহি। তবে তামারহাটে আসি সপ্তাহে তিন-চার দিন। ওইখানে বইস্যা বইস্যা দিদার প্যাচাল শুইন্যা পাগল হইয়া যাই। মাইনষে বুড়া হইলে বড়ো বেশি কথা কয়।

নীহারবালা বললেন, ভুইল্যা যাস না যে, তোরাও একদিন বুড়া হইবি। বুড়া-বুড়িদের এমন কইর‍্যা হেলাফেলা করস না, বুঝছস ছাইন্যা।

বুঝছি। সবই বুঝি। যহন হইব তহনে দেখন যাইব। এখনও তো হই নাই বুড়া।

 খাইয়া যাইবি নাকি ছাইন্যা? ধৃতি যে আইব তা তো আগে জানি নাই। খাওনের বিশেষ কিছুই নাই তবু যা আছে তাই-ই খাইবি।

ছানুকাকু বলল, না, আমি ভানুদার বাড়িতেই খামু। আইজ শালিখ আইছে। বউদি কয়্যা দিছে যাইতে হইবই।

শালিখরে কেমন দেখলি রে ছাইন্যা? অনেক বড়ো হইয়া গেছে?

তা তো হইবই। জল পাওয়া পুঁইডাঁটার মতো তরতরাইয়া বাইড়্যা উঠছে। মাইয়ারা বড়ো তাড়াতাড়ি বড়ো হইয়া যায়।

তা যায়। তাইলে ক, খাইবি কি না? তাইলে আরও দু-মুঠা চাউল লই। তুলাইপন্ধী চাউল কিন্তু।

 একদিন রায়গঞ্জে খাইছিলাম। হত্যই, বাসমতীর থিক্যাও ভালো গন্ধ। তবে আমি আইজ খামু না।

ধৃতি ভাবছিল, সে নিজে যদিও বাঙাল কিন্তু বাঙালদের এই সবসময়ে খাওয়া-দাওয়া ভালো লাগে না। যেন খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। The only way to the heart is through the stomach এই হচ্ছে বাঙালদের জীবনের মূলমন্ত্র।

.

০৩.

তুলাইপন্ধী চালের ভাত খেয়ে জম্পেস করে একটা ঘুম লাগাল ধূতি। মৌটুসি, বুলবুলি আর টুনটুনিদের ডাকের মধ্যে বড়ো আরামে ঘুমোল। কলকাতার মতো, এমনকী ধুবড়ির মতোও গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ নেই এখানে। বড়ো শান্তি এখানে। হাটবারে অবশ্য হাটে মেলাই শোরগোল ওঠে। তবে হাট যেদিন থাকে না সেদিন হাটও প্রায় নিঃশব্দ। পায়রারা চাল খুঁটে খায়, কিছু শালিখ ইতিউতি ওড়াউড়ি করে। ধুবড়ি এবং কচুগাঁও-এর দিক থেকে খানকয়েক ট্রাক ও গোনাগুনতি বাস আসে-যায়।

 ঘুম যখন ভাঙল তখন শ্রাবণের আকাশে মেঘ আর রোদের খেলা। নীহারদিদা দুপুরে কোনোদিনও ঘুমোন না-বই পড়েন। এখন গতবারের পুজোসংখ্যাগুলো পড়ছেন একে একে।

ধৃতিকে উঠতে দেখে বললেন, চা করি?

ধৃতি কিছু বলল না।

দিদা বললেন, আমার লইগ্যাও করুম। খাবি তো ক।

 ধৃতি সম্মতি জানাল।

নীহারদিদা স্বগতোক্তি করলেন, বৈদ্যটা তো আইজ আইল না। রোজই তো এইসময়ে আসে একবার। আমার লগ্যে বইস্যা চা খায় আর রাজ্যের খবর দেয়। ও-ই তো আমার খবরের কাগজ।

তারপর বললেন, শুনতাছি শিগগিরি টিভি আইব তামারহাটেও। সময় কাটানোর আর অসুবিধা থাকব না।

ধৃতি বলল, টিভি দেখলে সময় নষ্ট হয় বড়োদিদা। টিভি না থাকাই ভালো। সময় কি নষ্ট করার জিনিস? টিভির চেয়ে বই অনেক ভালো। কত বিষয় জানার আছে, ভাববার আছে। টিভি বেশি দেখলে মানুষের চিন্তাশক্তিই নষ্ট হয়ে যায়। কলকাতাতে আমার বাসাতেও আমি টিভি রাখিনি। এত খবরে আর এতরকমের খবরে মানুষের সত্যিই কি কোনো দরকার আছে? আপনিই বলুন? এই তো বেশ শান্তিতে আছেন। প্রকৃতির মধ্যে থাকার মতো আনন্দ আর কী আছে দিদা? আপনার রেডিয়ো তো আছে।

তা আছে।

আপনাকে একটা ট্রানজিস্টার কিনে দিয়ে যাব এবারে। এফ এম রেডিয়ো শুনবেন। কত ভালো ভালো গান, ভালো ভালো প্রোগ্রাম। বালিশের পাশে রেখে শোবেন–দেখবেন সময় কী করে কেটে যাচ্ছে।

তবে আমি চুপচাপ একা থাইকতেই ভালোবাসি। সারাদিন তো নানা অকাজে কাটে নানা অকাজ কইর‍্যাই। ভাবনের সময় আর পাই কোথায়?

কী ভাবেন এত?

অতীতের স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া আর কী করনের আছে ক? বেলা পইড়্যা গ্যালেই রংপুরের স্মৃতি ভিড় কইর‍্যা আসে। চারদিক থিক্যা নানান পাখির ডাক শোনা যাইত। আমাগো উঠানে দাঁড়াইয়াই তো, আকাশ পরিষ্কার থাইকলে, দূরের সোনালি ম্যাঘের মত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাইত। মনে হইত যে, সে বাঁধানো ছবি একখান। তোর দাদুর চিঠি আইত ডাকে। বড়ো ঘরের সিঁড়িতে বইস্যা সেই চিঠিখান পইড়তাম বারে বারে।

প্রেমের চিঠি?

তাই তো! প্রেম তো যৌবনেই থাকে। যৌবন যে কী দামি জিনিস তা যৌবন থাইকতে থাইকতে বোঝোন যায় না। যৌবন থাইকতে তার দাম হত্যই বোঝোন যায় না–দাঁতেরই মতো৷ যৌবন যহন চইল্যা যায়, হঠাৎই চইল্যা যায় আগে জানান না দিয়া, তখনই বোঝেন যায় কী তার দাম। তারপর বললেন, এহন তো চিঠি আসতে কত্ব সময় যায়। ধুবড়ি থিক্যা চিঠি আইতেও এহনে চার-পাঁচ দিন লাইগ্যা যায় আর তহনে তামারহাট থিক্যা চিঠি রংপুরে আইস্যা যাইত দুইদিনের মইধ্যে। পোস্ট-অফিসের সব লোকগুলানকে ছাড়াইয়া দিবার লাগে। তারা এহনে কুনও কাজই করে না। অকম্মার ঢেকি সব।

সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন। সর্বত্রই তাই অবস্থা। কলকাতাতেও এক পাড়া থেকে অন্য পাড়াতে চিঠি পৌঁছোতে চার-পাঁচ দিন লেগে যায়। সত্যিই পোস্ট-অফিসের সব লোকের চাকরি যাওয়া উচিত। কেউই কিছু দেখে না। আগেকার দিনের কথাই আলাদা ছিল।

চা খেতে খেতে ধৃতি একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, যাই, চা খেয়ে একবার শালিখদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। নইলে ভালোকাকা আবার রাগ করবেন।

তা যাইবি যা। রাতে খাইবি কী?

 আপনি যা দেবেন তাই খাব।

রাতে কি এহনও ভাত খাস, না রুটি?

কলকাতাতে রুটিই খাই কিন্তু এখানে যতদিন আছি ভাতই খাব। আপনার তুলাইপন্ধী চাল আর কতদিন থাকবে?

অনেকদিন। একবস্তা চাল আইন্যা দিছিল বৈদ্য। আমি একা খাই, তাও একবেলা, কতটুকুই বা খরচ হয়।

 তারপর বললেন, দুপুরের মাছও আছে। মাছ ভাইজ্যা দিমু-ভাতের সঙ্গে গাওয়া ঘি দিয়া খাইস। মাছের ঝোলও আছে।

মাছের টক খাইবি নাকি?

 যা দেবেন, তাই-ই খাব।

চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে ধৃতি উঠে পড়ল। বলল, তাহলে ঘুরেই আসি। যাই তবে।

 যাওন নাই, আয়। ওখানে আবার খাইয়া আসিস না য্যান। খাইলে কাল দুপুরে খাইস। আজ রাতে আমার ইহানেই খাইস।

আচ্ছা। বলে, ধৃতি উঠল।

বাইরে বেরিয়ে দেখল রোদের তেজ কমে এসেছে। হাটটা পেরোবার আগেই দেখল বৈদ্যকাকু আসছেন।

কী রে ছ্যামড়া। কবে আইলি তুই? বৈদ্যকাকু বললেন।

 আজই এলাম। সকালের বাসে ধুবড়ি থেকে।

তা এহনে চললি কই?

ভানুকাকাদের বাড়ি থেকে একবার ঘুরে আসি।

ছাইন্যা কইতেছিল শালিখ আইছে নাকি কুচবিহার থিক্যা।

 তারপরেই বলল, ধুবড়িতে জল কেমন? রাজাদের ছাতিয়ানতলা রোডও কি এবারে ডুবছে নাকি?

ডোবেনি এখনও, তবে ডুবু ডুবু। তবে মনে হয় জল নেমে যাবে দু-একদিনের মধ্যেই।

বৈদ্যকাকু বললেন, কাল বিকালে থাইকবি তো? আমি তো রোজই আসি বউদির খবর লইতে। কাল বিকালে থাকলে নাস্তা করুম। তোর জন্যে মোচার চপ লইয়া আসবনে। আমাদের বাড়িতেও আসিস একবার–তোর রাঙাপিসি খুশি হইবনে।

বৈদ্যকাকুর চেহারাটা লকলকে। সবসময়েই হাসিমুখ। গায়ের রং কুচকুচে কালো। কালো বললেও সব বলা হয় না। সেভেন্টি-এইট-আরপি এম রেকর্ডের মতো কালো। পরনে সবসময়েই ধুতি আর গেঞ্জি। বৈদ্যকাকুর মা-বাবা বা অন্য আত্মীয়স্বজন কেউই ছিলেন বলে জানে না ধূতি। রাঙাপিসি নামেই রাঙা কিন্তু তিনিও বৈদ্যকাকুর মতোই কালো ছিলেন। তবে অতিসুশ্রী মহিলা–কাটা-কাটা-নাক-চিবুক–সবসময়েই হাসিমুখ। বৈদ্যকাকু বাদলদাদুর সঙ্গে কাজ করতেন। আগে গদিঘরেই থাকতেন। পরে তামারহাটের বড়ো রাস্তাতেই একটি বাড়ি করেছিলেন। তবে পাকা নয়, কাঁচাবাড়ি। সামনেই একটি উঠোন। তার পাশেই ইঁদারা। আর পেছনে থাকার ঘর, টিনের চালের, ছ্যাঁচা বেড়ার ঘর। পেছনে রান্নাঘর। অতিসাধারণ বাড়ি, অতিসাধারণ জীবনযাত্রা কিন্তু ভাব দেখে মনে হত মহারাজা। দারিদ্র্য বা বৈভব যে মনেরই জিনিস, তা বৈদ্যকাকুকে দেখে বোঝা যেত। ধৃতির মনে বৈদ্যকাকুর এক বিশেষ জায়গা ছিল। শালিখদের বাড়ির মানিককাকা আর বৈদ্যকাকু একসঙ্গে হলে মনে হত পৃথিবীতে কোথাওই কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই–চারিধারে শুধু আনন্দই আনন্দ। অথচ ওঁদের দুজনের কারোকেই কখনো কারো নিন্দা করতে শোনেনি। কোথা থেকে যে এত হাসি আসত দুজনের, তাঁরাই জানেন।

.

০৪.

ভানুকাকাদের বাড়ি পৌঁছে গেল ধৃতি কিছুটা হেঁটেই।

উলটোদিকে রতুজেঠুর বাড়ি। দারুণ সুগঠিত সুপুরুষ চেহারা রতুজেঠুর। রতু বিশ্বাস। বাঁশের ঢ্যাগার দেওয়া বাড়ি ছিল তাঁর। তাঁর বড়ছেলের নাম ছিল এককড়ি। আর তিন চারটি মেয়ে ছিল। সকলেই মিষ্টি দেখতে। ধৃতি কখনো গেলে তাঁর বাড়িতে সকলেই, জেঠিমা সুন্ধু তাকে খুবই আদর-যত্ন করত ও করতেন। রতুজেঠুর বাড়ির উঠোনেই একটি ছোটো কারখানা-মতো ছিল। তিনিই ম্যানেজার, তিনিই মেকানিক, তিনিই মালিক। একটি মোড়া পেতে বসে নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে, যতক্ষণ দিনের আলো থাকত ততক্ষণই কাজ করতেন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে। পান-জর্দা নয়, সিগারেট খেতেন। কোন জাদুমন্ত্রে যে তিনি অত বড়ো সংসার চালিয়ে নিতেন হাসিমুখে, তা ধৃতির কাছে এক রহস্য বলে মনে হত। কখনো তাঁকে রাগ করতে বা বিরক্ত হতে দেখেনি কিন্তু তাঁর রাগ ছিল চন্ডালের মতো।

এক শীতের দুপুরে হাটের দিনে চাল কিনতে গিয়ে চাল নিয়ে আসা দূরের এক গ্রামের মুসলমান মানুষ চাল মাপতে মাপতে জোচ্চুরি করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে রতুজেই তার পেটে এক ঘুসি মারেন। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি মারা যায়। গাড়ি করে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কুমারগঞ্জ থেকে নসু ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়। তিনি তখন খেতে বসেছিলেন। কোনোরকমে না-খেয়েই এঁটোহাত ধুয়ে তামারহাটে এসে লোকটিকে পরীক্ষা করে রায় দেন যে, সেই লোকটির পিলে মস্ত বড়ো ছিল। রতুজেঠুর ঘুসিতে তার পিলে ফেটে সে তৎক্ষণাৎ মারা যায়। সেও গরিব মানুষ ছিল, চালের সামান্য কারবারি। রতুজেঠু সেই মানুষটির পরিবারকে তাঁর যথাসাধ্য আর্থিক সাহায্য করেন। হাটের মধ্যেই হাট চলাকালীন ঘটনাটি ঘটে। দশ-জনের সালিশিতে ব্যাপারটা মিটে যায়।

 তখন সবকিছুই এরকমই ছিল। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি বা উত্তেজনা ঘটত না। রাজনৈতিক নেতাদের দুর্মতি ও অত্যাচার ছিল না–এক গরিবের ভালো করতে গিয়ে দশ-জন গরিবের সর্বনাশ তাঁরা করতেন না। রতুজেঠু এবং তামারহাটের গরিব বড়োলোকেরা নিজে দাঁড়িয়ে লোকটিকে কবর দেন। তখন যে-কোনো ঘটনা নিয়েই জলঘোলা করার এত নোংরা ও মতলববাজ মানুষের ভিড় ছিল না। রতুজেঠু নিজেও আদৌ বড়োলোক ছিলেন না যদিও তাঁর একটি টি-এইট-মডেল হুডখোলা ফোর্ড গাড়ি ছিল, যে-গাড়ি মাঠ-ঘাট আল পেরিয়ে রতুজেঠুর বিনা ডিগ্রির ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রয়োজনে এখানে ওখানে যাতায়াত করত। তাঁর ঘুসি খেয়ে হাটের মধ্যে পেট ফেটে পড়ে যাওয়ার পরে এককড়িদাই রতুজেঠুর সেই গাড়ি নিয়েই কুমারগঞ্জে গিয়ে নসু ডাক্তারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।

রতুজেঠুর কাছে সেই পিলে-ফাটা লোকটির বড়োছেলে আনসার মাঝেমধ্যেই আসত প্রয়োজনে। এবং রতুজেঠু যতটুকু পারেন তাঁকে আর্থিক সাহায্যও করতেন।

রতুজেঠুর একটি একনলা বারো বোরের শটগান ছিল। তা দিয়ে তিনি অনেক চিতাবাঘ এবং হরিণ শিকার করতেন। হরিণ শিকার হলে আনসারকে মাংসও পাঠাতেন তাদের গ্রামে। ওদের গ্রামেই মুনসের সর্দার নামের একজন ফেজটুপি-পরা মোড়ল থাকতেন। হাটের দিনে তিনি তাঁর টাটু ঘোড়াতে চড়ে হাট করতে আসতেন। একসময় তাঁদের গ্রামে চিতাবাঘে প্রচুর গোরু-ছাগল ধরছিল। তাই তিনি শিকারি রতুজেঠুকে বাঘ মারার জন্যে অনুরোধ করেন। রতুজেই তাঁর টি-এইট ফোর্ড-এ উৎসাহী ধৃতিমানকে সঙ্গে নিয়ে একদিন চিতাবাঘ মারতে যান। ধৃতি তার বাদলদাদুর দাদা পূর্ণ মিত্তিরের দোনলা বন্দুকটি নিয়ে সঙ্গে যায়।

তারপরের গল্প অন্য গল্প। অন্য সময়ে বলা যাবে।

.

০৫.

ভানুকাকাদের অবস্থা ভালো ছিল। মধ্যে বিরাট উঠোন। চারদিকে চারটি বড়ো বড়ো ঘর। সিমেন্ট-বাঁধানো কিন্তু টিনের চালের। বাড়িতে ঢুকতেই মানিককাকার মুখোমুখি পড়ল ধূতি।

এই যে ক্যালকেশিয়ান। তুমি নাকি এখন ব্যাংকের অফিসার হইছ শুনি। তা, কবে ডুবাইবা ব্যাংক তাই কও।

ইতিমধ্যে শালিখ ধৃতির গলার স্বর শুনে বড়ো ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার পেছন পেছন কাকিমা। ওই কাকিমার মতো সুন্দরী মহিলা তামারহাটে তো বটেই ওই অঞ্চলের দশটা গ্রামেও খুঁজে পাওয়া যেত না। দীর্ঘাঙ্গী, ফর্সা, সম্ভ্রান্ত এবং মধুরস্বভাবা। শালিখ তাঁর মতোই হয়েছে তবে গায়ের রং পেয়েছে বাবার মতো। ফর্সা নয়, কালো। তবে ভারি সুন্দরী এবং প্রখর বুদ্ধিমতী। শালিখ একটি লাল-কালো তাঁতের শাড়ি পরেছে। লাল ব্লাউজ। গলাতে একটি সোনার চেন। কানে রুবির দুল।

হেসে বলল, এসেছ?

এলাম তো।

কাকিমা বললেন কী খাবে বল।

 কিছুই খাব না। ভানুকাকা কোথায়?

কোথাও বেরিয়েছেন। নদীরঘাটে গেছেন বোধ হয়।

কাকিমা কিন্তু কলকাতার মেয়ে। মেয়েদের যার যেখানে বিয়ে হয় তিনি সেখানেরই হয়ে যান। বিয়ের পরে মাত্র একবারই কলকাতা গেছিলেন। তখন, শালিখ হয়নি। ওঁদের দেশ ছিল রাজশাহিতে। বাবা আদালতে কাজ করতেন। তাঁদেরও রাজশাহির পাট পাকাপাকি চুকিয়ে দিয়ে উদবাস্তু হয়ে কলকাতাতে চলে আসতে হয়। ওঁর এক মাসির বাড়িতে এসে ওঠেন ওঁরা। মেসোমশাই একটি বিদেশি সওদাগরি অফিসে ভালো কাজ করতেন কিন্তু তিনকন্যা নিয়ে কাকিমার বাবা মা তাঁদের ওখানে থাকতে চাননি। তাঁদেরও কম অসুবিধে হয়নি। সেই সময়েই ভানুকাকার বাবা কাজে কলকাতাতে গেছিলেন। কাকিমাকে দেখেই তাঁর খুবই পছন্দ হয়ে যায় এবং একমাসের মধ্যেই কলকাতাতেই ভানুকাকার সঙ্গে কাকিমার বিয়ে হয়ে যায়। তারপর কুমারগঞ্জে এসে সেই যে থিতু হলেন আর ওই একবারই কলকাতাতে গেছিলেন। শালিখ তারপরে জন্মায়।

মানিককাকা থাকলে হাসিঠাট্টায় সময় যে কী করে কেটে যায় তা বলার নয়।

মানিককাকু বললেন ফার্স্ট কাজিন কাকে বলে জানিস ধৃতি? তুই তো অনেক লেখাপড়া করেছিস।

 ধৃতি কিছু বলার আগেই মানিককাকু বললেন, তোকে বলি তাহলে, শোন। দেশ সবে ভাগ হয়েছে। শ্যামবাজারের গলির মধ্যে এক মধ্যবিত্তর বাড়ি। তিনি সকালে এক হাতে চায়ের কাপ আর অন্য হাতে আনন্দবাজার ধরে পড়ছেন এমন সময়ে দরজার কড়া নড়ে উঠল। দরজা খুলে ভদ্রলোক দেখেন একটি ছ্যাকরা ঘোড়ার গাড়ি থেকে এক দম্পতি এবং তাঁদের তিন ছেলে মেয়ে নামলেন।

আপনারা?

আমরা খুলনা থেকে আসছি। আপনি আমার ফার্স্ট কাজিন। দেশ ভাগ হওয়ায় ভিটে-মাটি ছেড়ে আপনার এখানেই এলাম। আমাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। তা ছাড়া আপনি আমার ফার্স্ট কাজিন হন।

এই দুর্দিনে বাস্তুহারা হয়ে আর কার কাছেই বা যাব? আমাদের আপনজন তো কেউই নেই।

ফাস্ট-কাজিন? আপনাকে আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।

আপনার বাবার নাম তো গোপেন ঘোষ?

 হ্যাঁ। আমার বাবার নাম তো তাই-ই।

আমার বাবার নাম যতীন চক্কোত্তি। আপনার বাবার বাড়ি আর আমার বাবার বাড়ি বরিশালের বাখরগঞ্জ সাবডিভিশনের একই গ্রামে ছিল। সুন্দরবনের কাছেই।

তাই?

হ্যাঁ তাই। কিন্তু …

আপনার বাবা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। আনফরচুনেটলি বোথ অফ দেম ওয়্যার ইটন বাই দ্য সেম ম্যানইটার ইন ইস্টবেঙ্গল।

আপনি কী বলতে চাইছেন?

ততক্ষণে ভদ্রলোকের স্ত্রী এবং ছেলে মেয়েরা বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন।

তারপর ভদ্রলোক বললেন, একমিনিট। আমি আসছি।

বলেই, গাড়োয়ানের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ফিরে এলেন।

 চা পানরত ভদ্রলোক বললন, কিন্তু ফাস্ট কাজিনের রহস্যটা বুঝলাম না।

বুঝলেন না? ভেরি স্যাড।

একমায়ের প্যাট থিক্যা বাইরালে যদি ভাই হয় তবে একবাঘের প্যাটে গ্যালে ভাই ক্যান হইব না কন? বোথ অব আওয়ার ফাদারস ওয়্যার ইটন বাই দ্য সেম ম্যান-ইটিং টাইগার। আপনে আমার কাজিন কি না কন দেহি?

ধৃতিরা সকলে হো হো করে হেসে উঠল।

 ততক্ষণে ছানুকাকু সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এসে হাজির। তিনিও হো হো করে হেসে উঠলেন মানিককাকুর ফার্স্ট কাজিনের গল্প শুনে।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ