১.২

একটা বড় টেবিলের একধারে চেয়ারে বসে আছে মহিলাটি।

বয়েস বছর পঁয়তিরিশ-ছত্রিশ হবে। খয়েরি রঙের ব্লাউজ ও কস্তা ডুরে শাড়ি পরা। কপালটা অনেকটা চওড়া, এই সব মেয়েদের বলা হয় উঁচু কপালি।

চেহারা কেমন? অভাব, দারিদ্র্য ও দুর্ভাগ্যে পোড়া মুখ সুন্দর কি অসুন্দর, তার বিচারই চলে না। চোখ, মুখ, নাক ঠিকঠাকই আছে, মুখে একটা সারল্যের ভাবও আছে। আর এত কাণ্ডের পরও তার স্বাস্থ্যটি খারাপ নয়। সেটাই তো তার বিপদের কারণ।

হাজার খানেক বছর আগে এক কবি লিখেছিলেন, আপনা মাসে হরিণা বৈরি। হরিণীদের মতন মনুষ্যসমাজের নারীদেরও আজও পর্যন্ত প্রধান শত্রু তাদের শরীরের মাংস। এ রমণীর শরীরের গড়নটিও ভালো, বেশি লম্বাও নয়, বেঁটেও নয়। হাসলে তার বয়েস আরও কম দেখায়।

টেবিলের এপাশে বলে আছেন এক দীর্ঘকায়, বলশালী সুপুরুষ। মাথায় অল্প টাক চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, কোট-প্যান্ট পরা, কিন্তু গলায় টাই নেই। তাঁর সামনে একটা ফাইল ও হাতে পেন্সিল, মাঝে-মাঝে ফাইলের পাতা ওলটালেও তিনি কিছু লেখেন না, পেন্সিলটা টেবিলে ঠুকে টকটক শব্দ করেন।

তার ডান পাশে একটু দূরে আর একটা চেয়ারে বসে আছেন আর একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। ইনি তেমন কিছু সুপুরুষ নন, মাঝারি ধরনের চেহারা, বরং একটু মোটার দিকে ধাত। কলার দেওয়া পাঞ্জাবি ও পাজামা পরা, মাথার চুল নুন-গোলমরিচ রঙের, তীক্ষ্ণ নাক, গায়ের রং কালো নয়, বেশি ফরসা নয়। ইনি প্রায় নিঃশব্দ, একটার পর একটা সিগারেট টেনে যাচ্ছেন।

উচ্চপদস্থ রাজপুরুষটি রমণীটিকে বললেন, শোনো, তুমি সরিফন না লক্ষ্মী, সে বিষয়ে আমি এখনও মনস্থির করতে পারিনি। ফাইলটাতে পরিষ্কার কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সে যাই হোক, তোমার অভিজ্ঞতার কাহিনি খুব লম্বা করার দরকার নেই। আসল ঘটনাগুলো জানলেই হবে। আমি কতকগুলো প্রশ্ন করব, তার ঠিক-ঠিক উত্তর দেবে। প্রথম কথা, তুমি বলছ, তোমার দুটি ছেলেমেয়ে আছে। তারপর এর মধ্যে তুমি কি আবার প্রেগন্যান্ট হয়েছিলে? মানে, তোমার পেটে আবার সন্তান এসেছিল?

না, সাহেব।

 ঠিক বলছ?

জি সাহেব। আমার মায়ের দিব্যি বলছি।

তোমার মা বেঁচে আছেন?

আজ্ঞে না। আমার এগারো বছর বয়সে মা….

যারা মারা গেছেন, তাদের নামে মিথ্যে দিব্যি কাটা সহজ। শোনো, তুমি বাড়িছাড়া হয়ে আছ প্রায় এক বছর। এর মধ্যে তোমার একবার অ্যাবর্শান হয়েছে, মেডিক্যাল রিপোর্টে তা আছে। তা হলে নিশ্চয়ই অন্য কারও সঙ্গে।

না, না, স্যার। এক বছর না, বড়জোর সাত-আট মাস হবে। পেটে যদি কিছু এসে থাকে, তবে তা আগেই, আমার সোয়ামির, আমি অন্য কোনও…

শোনো। তোমরা গ্রামের মেয়ে, তোমরা সরল ভাবে কিছু কিছু মিথ্যে কথা বলো আমি জানি। কোনও-কোনও ঘটনা মেনে নেওয়ার চেয়ে মৃত্যুও ভালো মনে করো, তাই না? কিন্তু তোমাকে বাঁচাবার জন্যই সব সত্যি কথা জানা আমাদের দরকার। তুমি যাই-ই বলো না কেন, ডাক্তারি পরীক্ষায় আসল সত্য ধরা পড়ে যায়। তোমার একবার গর্ভপাত হয়েছে তিন মাস আগে। তখন তোমার গর্ভের ফুলটির বয়েস ছিল সাড়ে তিন মাস। সুতরাং সেটি তোমার স্বামীর সন্তান হতেই পারে না।

রমণীটি মুখ নীচু করে রইল।

রাজপুরুষটি তার ডান দিকের বন্ধুটির দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজেও একটি সিগারেট ধরালেন।

তারপর অত্যন্ত নরম গলায় বললেন, শোনো মেয়ে, তোমাকে কথার মারপ্যাঁচে বিপদে ফেলার কোনও উদ্দেশ্যই আমার নেই। এর মধ্যে যা-যা ঘটেছে, তার অনেক কিছুর জন্যেই তুমি দায়ী নও, আমি জানি। তোমাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছে। পুরুষরা মেয়েদের কত কিছু মেনে নিতে বাধ্য করে। আবার অনেক মেয়ে বোকার মতন ভুলও করে। লোভের বশে। ফঁদে পা দেয়। নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই বোঝে না। এ দেশ থেকে অনেক মেয়েকে আড়কাঠিরা মিথ্যে কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যায়, চুরি করে, জোর করেও পাচার করে দেয়। আবার কিছু কিছু মেয়ে স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়ে। তারাই বেশি হতভাগ্য। যা আশা করে ঘর ছাড়ে, তা পায় না। তোমার বয়েসি কোনও মেয়ের স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়া তেমন স্বাভাবিক নয়।

এবার তুমি বলো, তুমি ঘর ছেড়েছিলে কি মেলা দেখতে যাওয়ার লোভে? একজনকে বিশ্বাস করে? নাকি তুমি ঘর ছাড়তেই চেয়েছিলে? একেবারে সত্যি কারণটা আমাদের জানা দরকার। যা বলবে, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে। মুখ নীচু করে থাকবে না।

বাবু, তাইলে আপনি আগে একটি কথা বলেন তো? অনেক মেয়ের তো বিয়াই হয় না। গরিব ঘরের মেয়েদের বিয়ে হওয়াটাই তো ভাগ্যের কথা। আমার বিয়া হয়েছিল। স্বামী পেয়েছি। সন্তান পেয়েছি। তবু আমি নিজের ইচ্ছায় ঘর ছাড়ব কেন? নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে কোনও মেয়ে কি বাইরে পা বাড়ায়। পুরুষরা যেতে পারে। মেয়েরা কি যায়? সন্তানের টানই তো বড় টান। তাদের ছেড়ে কেউ যায়?

তোমার কথা পুরোটা ঠিক না হলেও অনেকটা ঠিক বলেছ। সাধারণত পুরুষরাই ঘর ভাঙে। বউকে ছেড়ে অন্য মেয়ের কাছে যায়। সন্তানের টানও পুরুষদের কম। তবু, এসব সত্ত্বেও কখনও কখনও মেয়েরা ঘর ছাড়ে, যদি অন্নে টান পড়ে। দু-বেলা যদি ভাত না জোটে, বাচ্চারাও খেতে না পায়। কিংবা স্বামী বা শাশুড়ি অত্যাচার করে মারে, তা বেশিদিন সহ্য করতে না পেরে…। তোমার শ্বশুরবাড়িতে তোমার ওপর কখনও অত্যাচার করা হত? মার খেয়েছ? তোমার স্বামী…

না, সাহেব, সোয়ামির হাতে আমি কখনও মাইর খাই নাই। আর অন্নে টান, তা ছিল, গ্রীষ্মকালের তিন মাস দুই বেলা ভাত জুটত না, শুধু আমানি খেয়ে থেকেছি। তবু অসহ্য হয় নাই। নিজেরা আধপেটা থেকেও ছেলেমেয়েদের খেতে দিয়েছি। তা হলে ঘর ছাড়ব কেন, বলেন?

তবে শুধু মেলা দেখার টানেই বেরিয়েছিলে?

ইচ্ছা হয়েছিল, নিজের গেরামের বাইরেও কত গেরাম আছে, কত মানুষ আছে, যাই, একটু দেখে আসি। সোয়ামি রাজি হয়ে গেল, এমনকী শেষ পর্যন্ত পাঁচটা টাকাও দিয়েছিল।

তোমার স্বামী আগে কখনও তোমাকে এরকম ভাবে অন্যদের সঙ্গে যেতে দিয়েছে?

না।

 এবার যে এক কথায় রাজি হল, তাতে তুমি অবাক হওনি?

একটু হয়েছিলাম। কিন্তু তখন বেড়াবার নামে এমন নেচে উঠেছিলাম যে অন্য কথা ভাবি নাই।

তোমার স্বামী ঘরামির কাজ করে?

জি। টালির কাজ জানে। তয় এখন টালির কাজ কমে গেছে, টিনের চাল হয়, ছাদ ঢালাই হয়, সে-সব পারে না। একটা পা-ও কমজোরি।

ঠিক আছে, তোমার স্বামীর কথায় পরে আসছি। এখন বলো, আগে যে বলেছিলে ট্রেন থেকে নামিয়ে নেওয়ার পর ঘুমন্ত অবস্থায় যে ঘরটায় তোমাকে আর গোলাপিকে রেখেছিল, সেখানে তুমি মোটে দুরাত্তির ছিলে। তাই না?

হ, দুই রাত্তির।

ফাইলে রিপোর্টে লেখা আছে, সেখানে তুমি ছিলে মোট পাঁচদিন।

তা হতে পারে, হিসাব মনে নাই।

কোর্ট জানো তো? আদালত। সেখানে যখন তোলা হবে, তখন ঠিক-ঠিক উত্তর দিতে হবে। একবার দু-রাত্তির, একবার পাঁচদিন বললে চলবে না। অবশ্য, আমি জানি, মনে না থাকাও অস্বাভাবিক কিছু না। দ্বিতীয় রাত্তিরে যে লোকটি তোমার ওপর অত্যাচার করেছিল, সে কি তোমায় শেষ পর্যন্ত…

না, না, না, হুজুর। মা কালীর দিব্যি। আমারে পারে নাই। গোলাপিরে প্রথমে ধরে ছিল।

তোমাকে পারেনি সেই রাত্রে। তার পরেও আরও তিন রাত্রি। সে কি পরে পেরেছিল?

 হা ভগবান, হা ভগবান, আমারে বিষ দিলা না কেন?

বুঝেছি। তোমার দোষ নেই। ভগবান এত ব্যস্ত থাকেন যে তোমার মতন মেয়েদের প্রার্থনা শোনার সময় পান না। তার বিষের স্টকও এখন কম। তোমাকে দোষ দিচ্ছি না, পুরুষদের গায়ে জোর বেশি, তারা অনেক কিছু করতে পারে। তোমাকে আমি এই কখানা ছবি দেখাচ্ছি। এর মধ্যে সেই রাতের গোরিলাটি আছে কি না দ্যাখো তো।

…………

কাঁদছ কেন? চোখের জল এখন খরচ কোরো না, পরে অন্য কোনও সময়ের জন্য তুলে রাখো। ছবিগুলো ভালো করে দ্যাখো। একজনকেও চিনতে পারছ?

না, সাহেব।

এরা সবাই একবার করে ধরা পড়েছে। তোমার কাছে যে এসেছিল, সে তা হলে আরও গভীর জলের মাছ। এদের মধ্যে প্রথা আছে, যেসব মেয়েদের এরা ভুলিয়ে ভালিয়ে কিংবা জোর করে নিয়ে আসে, দূরে কোথাও বিক্রি করে দেয়, তারা আগে, তারা মানে যে এদের পাণ্ডা, সে প্রত্যেকটি মেয়েকে একবার গুরুপ্রসাদী করে দেয়। তার প্রধান উদ্দেশ্য দুটি। এক তো, নিজেদের যৌন লোভ মেটানো, আর দ্বিতীয় হল, এই সব মেয়েদের মধ্যে একটা অপরাধ বা পাপবোধ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ সতীত্ব তো নষ্ট হয়ে গেলই, এখন আর বেশি তেড়িবেড়ি করে কী হবে। ফিরে যাওয়ার পথ যে বন্ধ, তা যে-কোনও গ্রামের মেয়েও জানে। ধরব, ওই পালের গোদাটাকেও ধরব। শোনো, ট্রেন থেকে নামিয়ে তোমাদের যেখানে রাখা হয়েছিল, সে জায়গাটার নাম সালার। মুর্শিদাবাদ জেলার সালার। ওখানে কিছুদিন পাচারকারীদের ঘাঁটি ছিল। কিছুদিন অন্তর-অন্তর এরা ঘাঁটি পালটায়। সালার থেকে বিহারে পাচার করা সহজ।

হাঁ সাহেব, আমি সালার নামটা কয়েকবার শুনেছি।

তোমাদের দলে ছিল এগারোটা মেয়ে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে সংগ্রহ করা। এদের মধ্যে কয়েকজনকে আগেই জড়ো করা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। দুজন নেপালি। হিন্দু মুসলমানের কোনও ভেদ নেই, মেয়ে-বিক্রির বাজারে সবাই মেয়ে। তোমাদের এই দলটাকে সালার থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কঁসি। পুলিশ সবই খবর জোগাড় করেছে, কিন্তু অনেক পরে। এখন ফাইল রেডি, অথচ পাখি হাওয়া। এই লক্ষ্মী ওরফে সরিফন ছাড়া আর একটি মেয়ের সন্ধান আমরা পেয়েছি, সে মেয়েটির কথা পরে হবে।

সাহেব, গোলাপির কী হল? সে কোথায় গেল?

ফাইলে তার কথা আর বিশেষ কিছু নেই। যতদূর মনে হয় তাকে পাচার করা হয়েছে সৌদি আরবে। তোমাকেও সেখানেই পাঠাবার সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল, একেবারে শেষ মুহূর্তে বোধহয় আটকে যায়। পুলিশের তাড়া খেয়ে পালায়। নইলে এতক্ষণে তুমি পা পর্যন্ত ঢাকা বোরখা পরে থাকতে আর আরব শেখদের পদসেবা করতে!

সৌদি আরব কোথায়?

তোমাদের গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে। ডায়মন্ড হারবার থেকেও দূরে। কলকাতা থেকেও…সে যাই হোক, আসল কথা হল, তুমি কতদূর গিয়েছিলে, আর কোথা থেকে ফিরলে।

আমি এখন কোথায়?

 খুব ভয়ের জায়গায়। তোমাদের গ্রামে সবাই কলকাতার নাম শুনলেই ভয় পায় না?

না, সাহেব। কত লোক কলকাতায় কাজ করতে আসে। আমি তো মুখ-সুখ মানুষ। কী করে এখানে এসেছি, তাও জানি না।

তুমি জানো না। অথচ তুমি সারা দেশ ঘুরে এসেছ। এরকমই তো হয়। ঝাঁসির নাম শুনেছ তুমি? খুব সম্ভবত শোনোনি।

আজ্ঞে না।

একজন নারী, দারুণ তেজস্বী ছিলেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। নিজে ঘোড়ায় চড়ে লড়াই করতেন। লোকে বলে, সাহেবদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে যখন দেখলেন ধরা পড়া ছাড়া আর উপায় নেই, তখন একটা দুর্গ থেকে ঘোড়া শুদ্ধ ঝাঁপ দিলেন, তবু ধরা দিলেন না। এরকম স্মৃতি বিজড়িত এক অসাধারণ নারীর সেই জায়গা, যে আঁসির রানি লক্ষ্মীবাই দারুণ গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, মেরি আঁসি নেহি দেউঙ্গি, আজ সেখানেই নারী। পাচারের একটি কেন্দ্র! হয়তো এসব কিছুই তুমি বুঝবে না। তোমাকে বারবার ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। ওই কঁসিতে তুমি ছিলে পাঁচ সপ্তাহ। সেখানকার কথা কিছু মনে আছে?

সেখানে কি পাহাড় ছিল?

ঝাঁসিতে ছোট-ছোট টিলা আছে। পাহাড় ঠিক বলা যায় না। ঝাঁসিতে আমি গেছি অনেক দিন আগে, দুৰ্গটাও একটা টিলার ওপরে। তবে তোমাদের কাছে টিলাও তো পাহাড়।

আমি ভাবতাম ম্যাঘ। আকাশের গায়ে ম্যাঘ। কয়দিন পর ভাবলাম, ম্যাঘ কি রোজ রোজ একইরকম থাকে? ম্যাঘ তো উইড়া যায়। তখন একজন কইল, ম্যাঘ না, ওইরে কয় পাহাড়।

একজন বলল, সেই একজনটা কে? সে কি বাংলায় কথা বলেছিল?

না, হিন্দিতে।

 তুমি হিন্দি বোঝ?

একটু-একটু বুঝি। সে-ও একজন মেয়েলোক, দুই হাত ভরতি কাচের চুড়ি। একদিন। দেখি সব চুড়ির রং লাল, আর একদিন দেখি সব সবুজ। সে আমাদের খাবার দিত।

আমাদের মানে? তোমরা কজন ছিলে সেখানে?

পাঁচজন। তার মধ্যে দুইজন নেপালি। বাংলা বোঝে না। একজন বেশ ছোট, ষোলো সতেরো বছর বয়েস। সে খালি কান্দে। সব সময় কান্দে। তার কান্না শুনলে আমারও কষ্ট হয়। কান্না আসে। কিন্তু জোরে কান্দলেই একজন এসে মারে। চুলের মুঠি ধরে লাইথথ্যায়। তাই আমি পলাইলাম একদিন।

এই সময় একজন আর্দালি এসে প্রশ্নকারী পুলিশ অফিসারটির হাতে একটা চিরকুট দিল।

সেটা পড়ে নিয়ে অফিসারটি বললেন, নাঃ, আজ আর বসা যাবে না। আমাকে এক্ষুনি একবার রাইটার্স বিল্ডিংস যেতে হবে। কাল আবার সকাল সাড়ে দশটায়।

আর্দালিকে নির্দেশ দিলেন লক্ষ্মী নামের স্ত্রীলোকটিকে কাস্টোডিতে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। তারপর তার পাশে বসা ব্যক্তিটিকে বললেন, চলো, আমরা বেরোই, তুমি যদি চাও, তোমাকে পথে কোথাও নামিয়ে দিতে পারি।

আলিপুরের ভবানীভবন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে-উঠতে পুলিশ অফিসার হুমায়ুন কবির তার বন্ধু বিনায়ক ঘোষালকে বললেন, শুনছো তো সব, মেয়েটির কথা? গল্প নয়, একেবারে কঠিন বাস্তব।

বিনায়ক বললেন, বাস্তব তো বটেই, ট্র্যাজিকও বটে। কিন্তু নতুনত্ব কী আছে? বহু মেয়ের জীবনেই তো এরকম ঘটছে?

হুমায়ুন বললেন, নতুনত্ব না থাকতে পারে, তবু প্রতিটি মেয়েরই জীবনটা তো আলাদা।

বিনায়ক গাড়িতে বসে বললেন, মাঝে-মাঝে আমার নিজেরই ইচ্ছে করছে দু-একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করতে। কিন্তু তা বোধহয় উচিত হবে না।

একদম উচিত নয়। তুমি বাইরের লোক, তোমাকে আমি বন্ধু হিসেবে এনেছি। যদি তোমার বিশেষ কিছু জানতে ইচ্ছে হয়, তুমি আমাকে ইংরিজিতে সেটা বলতে পারো। তারপর আমি ওকে জিগ্যেস করব, সেটা অফিশিয়াল হয়ে যাবে।

–আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না হুমায়ুন, তুমি এই লক্ষ্মীমণি আর সরিফন বিবির ব্যাপারটা পরিষ্কার করছ না কেন? এ মেয়েটিকে তো লক্ষ্মীমণি বলেই মনে হচ্ছে।

–মুশকিল হচ্ছে কী জানো, লক্ষ্মীমণি নামে কারুর মিসিং ডায়েরিতে নাম নেই, কেউ তার নামে থানায় কিছু জানায়নি। অথচ সরিফন বিবির নামে ডায়েরি আছে, ওই একই জায়গা থেকে যে নিরুদ্দেশ হয়েছে। অথচ ঘটনা যা ঘটছে, মানে মেয়েটি যা বলছে, তাও ফাইলের রিপোর্টের সঙ্গে অনেকটা মিলে যাচ্ছে। এ মেয়েটি যদি সরিফন না হয়, তাহলে তার জীবনের সব ঘটনা এ জানবে কী করে?

–তোমাদের রিপোর্টে নিশ্চয়ই নামের গন্ডগোল হয়েছে।

–তা তো হতেই পারে। কিন্তু একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে, সরিফন বিবি মিশিং এটা যেমন ঠিক, আর এই লক্ষ্মীমণিও চালান হয়েছিল। দুজনের কাহিনি মিশে গেছে। সেইজন্যই আমি এর কাছ থেকে ডিটেইল্স জানতে চাইছি।

–আচ্ছা, হুমায়ুন, আমাদের এই পশ্চিম বাংলা থেকে এত মেয়ে বাইরে চালান যায়, তোমরা পুলিশরা কিছু করতে পারো না? এটা তো তোমাদের পক্ষে একটা ডিসগ্রেস।

শুধু পুলিশের দোষ দিচ্ছ, দোষ তো গোটা সমাজের। যে সমাজে মেয়েদের কোনও মর্যাদা নেই, শিক্ষা কিংবা জীবিকার সুযোগ এত কম, সেই সব সমাজে মেয়েদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা তো চলবেই। বহুকাল ধরে চলে আসছে। বাংলাদেশ থেকে, নেপাল থেকেও প্রচুর মেয়ে চালান হয়।

–খবরের কাগজগুলোও এ ব্যাপারে বেশি উচ্চবাচ্য করে না। এইসব খবর চাপা দেওয়ার একটা চেষ্টা চলে মনে হয়।

–আর তোমরা লেখকরাই বা কী করছ, বিনায়ক? তোমাদের কিছু দায়িত্ব নেই? এক সময় লন্ডন শহরে বেশ্যাবৃত্তির খুব রমরমা ছিল। সেই সময় জর্জ বার্নার্ড শ একটা নাটক লিখেছিলেন, মিসেস ওয়ারেন্স প্রফেশনস, তাতে উচ্চবিত্ত বিলিতি সমাজের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। তোমরা বাঙালি লেখকরা সেরকম কিছু লিখতে পারো না? এই যে কলকাতা শহরে সোনাগাছি বলে বিরাট একটা পতিতাপল্লি আছে, তোমাদের কোনও লেখায় তার উল্লেখ থাকে? শরৎচন্দ্র তবু লিখেছিলেন একটুআধটু, তাও এমন একটা রোমান্টিক ভাব দিয়েছিলেন যে আসল ব্যাপারটা কিছুই ফুটে ওঠেনি।

বিনায়ক বললেন, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। পরে আলোচনা করব। তুমি আপাতত আমাকে রবীন্দ্রসদনের কাছে নামিয়ে দাও।

হুমায়ুন বললেন, ঠিক আছে। তুমি কাল আসছ? আমি বরং অফিসে আসার সময় তোমার বাড়ি থেকে তুলে আনব। অ্যারাউন্ড টেন। আমি চাই তুমি এই মেয়েটির ঘটনা সবটা শুনে দেখো। তুমি এর থেকে তোমার লেখার মাল-মসলা পেয়ে যেতে পারো।

বিনায়ক বললেন, ঠিক আছে, আমি দশটার সময় তৈরি থাকব।

 গাড়ি থেকে তিনি নেমে গেলেন।

রবীন্দ্রভবনে এখন একটা নাট্য-উৎসব চলছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছে নাটকের দল। বড়-বড় সব ছবিওয়ালা হোর্ডিং চতুর্দিকে। লোকজন আসছে প্রচুর।

বিনায়ক গেট দিয়ে ঢুকে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।

এইসব নাটকে কত উচ্চাঙ্গের শিল্পের ব্যাপার থাকে। নারী স্বাধীনতা বিষয়ে বাণী দেওয়া হয়। দর্শকরা উপভোগ করে। আর এখান থেকে তিরিশ-চল্লিশ মাইল দূরে যে-সব গ্রাম সেখান থেকে গরিব ঘরের মেয়েরা আজও পাচার হচ্ছে, বিক্রি হচ্ছে মাংসের বাজারে। চালান যাচ্ছে আরব দেশে।

এটাই বাস্তবতা। সেই সব মেয়েরা সারা জীবনে জানতেই পারে না, স্বাধীনতা কাকে বলে।

বিনায়ক একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাটক দেখার জন্য হলের মধ্যে ঢুকে গেলেন। তিনি এখানকার একজন কমিটি মেম্বার, তার টিকিট লাগে না।

পরদিন ঠিক দশটা বেজে পাঁচ মিনিটে হুমায়ুন কবিরের গাড়ি এসে হাজির। প্রত্যেকদিন বাড়ি থেকে বেরুবার সময় হুমায়ুন স্নানটান করে ফিটফাট হয়ে বেরোন। বিনায়ক রোজ দাড়ি কামান না, কখনও তিন-চারদিনও বাদ পড়ে যায়। এক-একদিন স্নান করতেও ভুলে যান।

বিনায়কের স্ত্রী একটি স্কুলে পড়ান, তিনি বেরিয়ে যান একটু আগেই। ওদের একটিমাত্র ছেলে কলেজে পড়ে। সে বলল, বাবা, তুমি বেরুচ্ছ। আমার আজ একশোটা টাকা লাগবে।

বিনায়ক মানিব্যাগ রাখেন না, শার্টের বুক পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে দিয়ে হেসে বললেন, আমি যখন কলেজে পড়তাম, তখন আমার বাবা আমাকে সারা মাসের জন্য মোটে তিরিশ টাকা হাত খরচ দিতেন। আর তুই যখনতখন একশো টাকা চাস!

বিনায়কের ছেলে সুপ্রতিম বলল, তোমাদের সে আমলে টাকার দাম কত বেশি ছিল। তুমিই তো বলেছিলে, সে সময় পাঁচ টাকায় একটা চিংড়ির কাটলেট পাওয়া যেত। এখন পঞ্চাশ টাকা।

বিনায়কের মনে পড়ল, ছাত্র বয়েসে তিনি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একবার সোনাগাছি বেশ্যাপল্লিতে গিয়েছিলেন। ওই নিষিদ্ধ এলাকাটা সম্পর্কে কৌতূহল ছিল কৈশোর বয়েস থেকেই। বাসে করে ওই এলাকার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আড়চোখে তাকাতেন। কলেজে এসে অনেক সংস্কারই ভাঙতে ইচ্ছে করে।

বেশ্যাপল্লিতে গিয়ে ঠিক অপরাধবোধ হয়নি, তবে কেন যেন একটু-একটু ভয় করছিল। গল্প-উপন্যাসে ওইসব জায়গার সঙ্গে গুন্ডা-বদমাশদের যোগাযোগের কথাও থাকে।

সেদিন তিন বন্ধুতে মিলে একটি মেয়ের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করেই চলে এসেছিলেন। একজন বন্ধু শুধু চলে আসার আগে হঠাৎ মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়েছিল। বিনায়ক মেয়েটিকে একবারও স্পর্শ করেননি।

এক ঘণ্টা সেই মেয়েটির ঘরে সময় কাটাবার জন্য দিতে হয়েছিল পনেরো টাকা। সেটাই তার রেট। তিন বন্ধু ভাগাভাগি করে দিয়েছিল টাকাটা।

তাঁর ছেলে কাটলেটের দাম বলা মাত্র বিনায়কের হঠাৎ যেন এক বেশ্যার এক ঘণ্টা রেটের কথা মনে পড়ল? স্মৃতির এই লেখা বোঝা খুব শক্ত। এখন ওদের রেট কত? বিনায়ক আর কখনও যাননি।

একথাও তার অবধারিতভাবে মনে হচ্ছে, তার ছেলেও কি বন্ধুদের সঙ্গে বেশ্যাপল্লিতে গেছে কখনও? সরাসরি জিগ্যেস করা তো যায় না। তবে সম্ভাবনা কম। এখন ছেলে আর মেয়েদের মেলামেশা কত সহজ হয়ে গেছে। বিনায়কের যৌবনকালে মেয়েদের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক স্থাপন করতে হত অনেক সাবধানে, বন্ধু-বান্ধবদেরও না জানিয়ে। এখন কলেজের ছেলে আর মেয়েরা কলকাতার বাইরে একসঙ্গে বেড়াতে যায় দু-তিনদিনের জন্য। সুপ্রতিমই তো গত মাসে বাইরে ঘাটশিলা থেকে ঘুরে এল, তিনটি ছেলে আর দুটি মেয়ে, একটা বাংলোতে ওরা রাত কাটিয়েছে। আজকাল সব মেয়েদেরই বোধহয় বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা হয়ে যায়।

বিনায়কের দেরির সময়টায় হুমায়ুন খবরের কাগজ পড়ছিলেন, বিনায়ক গাড়িতে ওঠার পর তিনি বললেন, আজ ইন্টারোগেশানটা শেষ করে ফেলব ভাবছি। সারাদিন লেগে যেতে পারে। দুপুরে কি তোমায় বাড়িতে ফিরতে হবে?

বিনায়ক বললেন, না ফিরলে বাড়িতে ফোনে বলে দেব।

হুমায়ুন বললেন, কাল সরিফনবিবির পুরো রিপোর্ট পেয়েছি। মুন্সিগঞ্জ আর নবীপুর এই দুটো পাশাপাশি গ্রাম। এই নবীপুরের কালু মির্জার তিন মেয়ের এক মেয়ে সরিফন। এক শনিবারের হাট থেকে সে আর বাড়ি ফেরেনি। আড়কাঠির দল তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল বলেই মনে হয়। তারপর তাকে বঁসিতে একবার ট্রেস করা গেছে। এই লক্ষ্মিমণিও ঝাঁসির কথা বলল।

বিনায়ক বললেন, ওই সরিফনকে যে ঝাঁসিতে ট্রেস করা গেছে, তা তোমরা কী করে জানলে?

সারা দেশেই তো এই সব চোরাচালানিদের ঘাঁটি আছে। পুলিশ যে একেবারে কিছু করে না, তাও তো নয়। হয়তো দেরিতে খবর পায়। তখন পুলিশের রেইড হয় ওইসব ঘাঁটিতে। পুলিশ কয়েকজনকে রাউন্ড আপ করে। কখনও আবার পুলিশ পৌঁছোবার আগেই পাখি উড়ে যায়। আগেই রেইড-এর খবর পেয়ে সেই দলবল পালিয়ে যায়।

–আগেই খবর পায় কী করে? নিশ্চয়ই পুলিশেরই কোনও লোক তাদের খবর দিয়ে দেয়?

–সেটাও মিথ্যে নয়। বাংলায় কথা আছে না, সর্ষের মধ্যেই ভূত। পুলিশের মধ্যেই এরকম অনেক ভূত আছে। আসলে তো প্রচুর টাকার খেলা। এইসব বদমাশরা এত বেশি ঘুষ অফার করে যে অনেকেই লোভ সামলাতে পারে না।

–এখন আর বেশি কমের ব্যাপার নেই। তোমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে নীচের তলায় লোকেরা তো দশ-কুড়ি টাকা ঘুষ নিতেও ছাড়ে না।

–আপাতত ওই বিষয়টা থাক। আসল কথাটা বলি?

–ঠিক আছে, বলো।

–বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ এইসব মেয়ে পাচারকারীদের ধরে যে-সব রিপোর্ট বানায়, সেগুলো আবার সব রাজ্যেই এক্সচেঞ্জ হয়। সবগুলো মিলিয়ে আমরা আবার একটা রিপোর্ট তৈরি করি। সেই অনুযায়ী, ঝাঁসিতে এক সরিফনের উল্লেখ আছে, যদিও সেখানে তাকে উদ্ধার করা যায়নি। লক্ষ্মীমণির কোনও কিছু উল্লেখ আমরা এ পর্যন্ত পাইনি। অথচ এর কাহিনিটাও মিথ্যে হতে পারে না।

বোঝাই যাচ্ছে, তোমাদের রিপোর্টে ভুল আছে। আচ্ছা, তুমি কী করে লক্ষ্মীমণিকে বললে যে সে কঁসিতে পাঁচ সপ্তাহ ছিল?

–পুলিশ যখন কোনও একটা পাচারকারীদের আখড়ায় গিয়ে রেইড করে, তখন যদি দেরি হয়ে যায়, যদি মেয়েদের নিয়ে দালালরা আগেই পালিয়ে যায়, সেখানেও কাছাকাছি কিছু লোককে পুলিশ জেরা করে। এমন কয়েকজনকে পাওয়া যায়, যারা ওইসব পাচারকারীদের সাহায্য করে, তাদের অ্যারেস্ট করতে হয়।

তারা তো সব চুনোপুঁটি!

হ্যাঁ, চুনোপুঁটি হলেও তাদের পেট থেকে অনেক খবর বার করা যায়। তাদের কাছ থেকেই কিছু কিছু মেয়ের নামও জোগাড় হয়। এইসব মিলিয়ে একটা কেস হিস্ট্রি তৈরি হয়। আরও দু-জায়গায় সরিফনের উল্লেখ আছে, একবার সে প্রেগন্যান্ট হয়েও পড়েছিল। শেষবার তার উল্লেখ আছে দিল্লির এক রিপোর্টে। তার থেকেই বোঝা যাচ্ছে, সে আরব দেশে চালান। হয়নি। প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে তার বাজারদর অনেক কমে যায়।

–এমনও হতে পারে, ঝাঁসিতে দু-ব্যাচ মেয়ের মধ্যে সরিফন আর লক্ষ্মীমণি, দুজনেই ছিল?

তবু কেউ কারুকে চিনবে না?

–সেটাও অসম্ভব কিছু নয়।

–দেখা যাক, জেরায় শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীমণি আর সরিফনের কাহিনির আলাদা কিছু বেরিয়ে আসে কি না। দিল্লিতে রেড করে অনেক মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু সেখানেও সরিফনকে পাওয়া যায়নি। একটা পিকিউলিয়ার ব্যাপার কি জানো, দিল্লিতে একজন লক্ষ্মীমণির উল্লেখ আছে। সে আর এই মেয়েটি একই কিনা তা এখনও বলা যাচ্ছে না। দেখা যাক, এর গল্প কোথায় গিয়ে পৌঁছোয়। দিল্লির লক্ষ্মীমণিকে কিন্তু রিপোর্টে মৃত বলা হয়েছে। সে খুন হয়।

কাহিনির শেষটা আগে বলে দিও না। মনে তো হচ্ছে, দুটো লক্ষ্মীমণি আলাদা হওয়াই সম্ভব।

দুই বন্ধু দুটি সিগারেট ধরালেন।

একটুপরে বিনায়ক বললেন, কাল তো তুমি আমাকে রবীন্দ্রসদনে নামিয়ে দিয়ে গেলে। তারপর আমি একটা নাটক দেখলাম। নাট্য উৎসব চলছে তো। আমার গোড়ার দিকে মিনিটসাতেক বাদ গেছে। সেই নাটকটার কথা তুমি একটু শুনবে?

হুমায়ুন বললেন, ইয়েস, অফকোর্স শুনব। কার নাটক?

–বিজয় তেন্ডুলকরের। তুমি না শুনেছ?

–বাঃ, শুনব না কেন? ওঁর ঘাসিরাম কোতোয়াল নামে একটা নাটক তো খুব নাম করেছিল, তাই না? উনি তো মারাঠি ভাষায় লেখেন।

–আমি তো ভেবেছিলাম, পুলিশের লোকেরা নাটক-ফাটকের কোনও খবরই রাখে না। হা, নাটকটা মারাঠি ভাষায়, কিন্তু বুঝতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। নাটকটার নাম কমলা। এক-একদিন বেশ মজার ব্যাপার হয়। কাল তোমার অফিসে বসে মেয়ে পাচারের কাহিনি শুনছিলাম, তারপর এসে একটা নাটক দেখলাম, সেটাও ওই একই বিষয়ে। তোমার তো মনে আছে, একবার রাজস্থানের একটা মেলা সম্পর্কে রিপোর্ট বেরিয়েছিল দিল্লির কাগজে, তাতে খুব হইচই পড়ে গিলেছিল?

–হ্যাঁ, মনে আছে। এই তো বছর দু-এক আগের কথা। সরকার থেকে বলা হয়েছিল যে ওই রিপোর্টের সব কথাই মিথ্যে। মেয়ে বিক্রির ব্যাপার তো?

রাজস্থানের সেই মেলায় গরু-ছাগল-উট যেমন বিক্রি হয়, তেমনি মেয়েও বিক্রি হয়, রিপোর্টে এই কথাই ছিল। প্রকাশ্যে, মেয়েরা সার বেঁধে বসে আছে, লোকেরা বেছে-বেছে দর দাম করে কেনে। একটা গরুর চেয়ে একটা মেয়ের দাম শস্তা পড়ে বোধহয়।

এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। সাংবাদিকের গিমিক। এখনকার দিনে এটা হতে পারে না। গোপনে মেয়ে পাচার হয় ঠিকই। কিন্তু প্রকাশ্যে মেয়ে বিক্রি? অ্যাবসার্ড!

–এইরকমই তো অভিযোগ করা হয়েছিল সাংবাদিকটি সম্পর্কে? তাই নিয়েই নাটক। সাংবাদিকটিকে যখন দিল্লির অনেকে মিলে খুব অপমান করে, তখন সে সত্যি-সত্যি ওই মেলায় চলে গিয়ে সাতহাজার না কত হাজার টাকা দিয়ে সত্যি-সত্যি একটা মেয়েকে কিনে নিয়ে আসে। ওই মেয়েটিরই নাম কমলা। সে বিবাহিত, স্ত্রী আছে। স্ত্রীকে বুঝিয়ে মেয়েটিকে সে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিল। সে ঠিক করেছিল, পার্লামেন্ট খুললে সে মেয়েটিকে একেবারে পার্লামেন্টের সামনে হাজির করে দেখাবে যে দেশে মেয়েদের নিয়ে কত নৃশংস, অমানবিক কাণ্ড চলছে।

তারপর সেই সাংবাদিককেই পুলিশ গ্রেফতার করে, তাই না? কারণ, মানুষ বিক্রি করা যেমন বে-আইনি, তেমনি মানুষ কেনাও তো সমাজে বে-আইনি!

-হ্যাঁ, নাটকে অবশ্য একটু অন্যরকম ভাবে দেখানো হয়েছে। মোটকথা, তুমি কাল বলছিলে, এই সমস্যা নিয়ে সাহিত্যিকরা মাথা ঘামায় না কেন? এই তো একজন নাম করা নাট্যকার লিখেছেন, তা নিয়ে এক সময় কিছুটা হই-চইও হয়েছিল। তাতে কি সমস্যাটা একটুও কমল? সাহিত্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায় না। কাল যারা নাটকটা দেখলেন, তারাও একটা ভালো নাটক, ভালো অভিনয় এইসব নিয়ে মুগ্ধ হচ্ছেন, সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। বার্নার্ড শ-এর যে-নাটকটার কথা বলছিলে, সেটাও ইংল্যান্ডের মেয়েদের অবস্থা নিশ্চয়ই কিছু বদলাতে পারেনি। লন্ডনে এখনও প্রচুর বেশ্যাবৃত্তি চলে।

–তা বলে তোমরা দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারো না। বারবার লিখে মানুষকে সচেতন। করতে হয়।

গাড়ি পৌঁছে গেছে ভবানীভবনে।

নেমে দাঁড়াবার পর বিনায়ক বলল, আর একটা কথা শোনেনা। ওই নাটকে একটা দৃশ্য আমার বিশেষ ভালো লেগেছে। একটু দাঁড়াও।

হুমায়ুন গেটের পাশটায় সরে এলেন। বিনায়ক বললেন, সাংবাদিক তো কমলা নামের মেয়েটিকে বাড়িতে এনে রেখেছেন। তার স্ত্রী বিদূষী, সুন্দরী, কোনও একটা কলেজে পড়ান। সমাজের আলোকপ্রাপ্তা মহিলা যাকে বলে। তিনিও এই মেয়ে বিক্রির ব্যাপারটাতে খুব উত্তেজিত। তিনি কমলার প্রতি সহানুভূতিশীল। ভালো শাড়ি দিয়েছেন, ভালো খেতে দিয়েছেন। তারপর খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জিগ্যেস করতে লাগলেন, কমলার বাড়ির কথা, সংসারের কতটা অভাব, কেন তাকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, এইসব। কমলাকে যে কিনে আনা হয়েছে, সে নিজে কিন্তু তা একটুও অস্বাভাবিক মনে করে না। একসময় সে খুব সরলভাবে প্রশ্ন করল, মাইজি, আপনার সাহেব আপনাকে কত দিয়ে কিনেছিলেন? সে মহিলা তো আঁতকে উঠে বললেন না, না, আমাদের এখানে…। ভদ্রমহিলা যাই-ই বলুন, প্রশ্নটা তো মিথ্যে নয়। তোমাদের মুসলমানদের মধ্যে কী সিস্টেম, ঠিক জানি না, হিন্দুদের মধ্যে, যতই বে-আইনি বলা হোক, তবু তো নানানভাবে পণপ্রথা চলছে! বাঙালি মেয়ের বাপ ছেলের বাপকে টাকা দেয়। উত্তরভারতে পাত্রপক্ষ টাকা দেয়। কেনাই তো হল।

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়