নবজাতক – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এক নিদারুণ রৌদ্রতপ্ত দিনে বাঁকুড়া জেলার দু’টি গ্রামের মধ্যবর্তী প্রান্তরে একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে জেগে উঠলেন বোধিসত্ত্ব। তখন ঠিক মধ্যাহ্ন। তিনি চোখ মেলে প্রথম দেখলেন সেই বিশাল ও দুর্ধর্ষ গাছটিকে এবং তার ওপরের আকাশ। প্রথমেই তার মনে হল, এই বিশ্বে আর কিছু নেই, শুধু সীমাহীন আকাশের নিচে এই এক প্রবল প্রতাপান্বিত মহীরুহ– যার শাখা-প্রশাখা, ঝুলন্ত শিকড় আর পাতলা সবুজ রঙের অসংখ্য পাতায় বেঁচে থাকার এক প্রমত্ত শক্তির প্রকাশ সবসময় ঝলসাচ্ছে। আর তার নিচে শয়ান এক জন মানুষ। তিনি।

যদিও বাতাসে অদৃশ্য আগুনের হলকা ছুটোছুটি করছে, আকাশ এমন ঝাঁঝালো যে সে-দিকে চোখ রাখা যায় না, তবু তিনি একটি তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন। তিনি দেখতে লাগলেন অশ্বত্থ পাতার খেলা। ডালপালার মধ্য দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে হাওয়া, একদল পাতা নাচানাচি করছে খুব, আর একদল পাতা চুপ করে দেখছে। এরমধ্যে উড়ে এসে বসল দুটি কাক। সদাব্যস্ত ভঙ্গিতে এ-দিক ও-দিক মাথা ঘুরিয়ে তারা ডাকল, কা, কা–।

ঈষৎ হেসে বোধিসত্ত্বও উচ্চারণ করলেন, কা, কা!

এইভাবে স্বাগত সম্ভাষণের প্রতি-উত্তর দিয়ে তিনি পাশ ফিরলেন। তিনি দেখলেন ফসল কাটা এক নিঃস্ব প্রান্তর। দূরে কয়েকটি ছোট ছোট টিলা। একটি কালো রঙের চওড়া পথ চলে গেছে সেই প্রান্তর চিরে। একটু পরেই দূর থেকে কিছু একটা ছুটে আসতে লাগল সেই পথ ধরে, তার সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল শব্দ। সেটি একটি বাঁকুড়া-দুর্গাপুর গমনাগমনকারী বাস। যথারীতি সেটির ভিতর থেকে কিছু মানুষ উপছে বাইরে এসে ঝুলছে। ছাদের ওপরেও উঁচু হয়ে বসে আছে কিছু মানুষ। শব্দ ছড়াতে ছড়াতে বাসটা চলে গেল।

বোধিসত্ত্ব মোটর বাস আগে দেখেননি। যন্ত্রযান সম্পর্কে তাঁর কোনও পূর্ব সংস্কার নেই। কিন্তু তিনি সহজে বিস্মিত হন না। খানিকটা হালকা কৌতূহলের সঙ্গে তিনি তাকিয়ে রইলেন সেই অপসৃয়মাণ বাসটির দিকে। তারপর চোখ ফিরিয়ে দেখলেন নিজেকে।

তাঁর শরীরে এক টুকরোও বস্ত্র নেই। তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক জন দীর্ঘকায়, সবল, তরুণ পুরুষ হিসেবে। তিনি ভাবলেন, আমি কে? আমি কোথা থেকে এসেছি? এটা কোন দেশ? কোন কাল?

তিনি এর উত্তর জানেন না। তবু বিস্মিত হলেন না। গাছতলায় একা শুয়ে থাকার আনন্দ উপভোগ করে ক্ষীণভাবে হাসলেন।

অন্য দিকে পাশ ফিরে তিনি দেখলেন অদূরে ছোট ছোট শালগাছের একটি পাতলা জঙ্গল। এবং জঙ্গলটি ঢেউয়ের মতো উঁচু হয়ে গেছে একটা টিলার ওপরে।

অল্প পরে জঙ্গল থেকে ছুটে বেরিয়ে এল একটি কুকুর। তার পেছন পেছন তিনজন মানুষ। এর মধ্যে দুজন লোকের পরনে শুধু মালকোঁচা-মারা ধুতি, খালি গা। বাকি লোকটি পরে আছে খাকি প্যান্ট ও সাদা গেঞ্জি, পিঠে ঝুলছে একটা বন্দুক, মাথায় শোলার টুপি। এ-রকম বেশবাস বোধিসত্ত্বের কাছে অপরিচিত। তবু শুধু মানুষের মুখ দেখেই তিনি খুশি হয়ে উঠলেন। মৃদু আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে।

এই দলটির গতিমুখ ছিল অন্য দিকে, কিন্তু কুকুরটি তাকে দেখতে পেয়ে দিক বদলে ছুটে এল। কুকুরটি প্রায় ব্যাঘ্ৰ আকৃতির। সে হাড়-হিম-করা গ্রাউ গ্রাউ শব্দে ডাকতে ডাকতে ছুটে এসে হিংস্র ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে বোধিসত্ত্ব অবিকল তার ডাকের অনুকরণে ডাকলেন গ্রাউ গ্রাউ! কুকুরটি থমকে গেল। তখন বোধিসত্ত্ব নিচু গলায় কুকুরের ভাষায় তাকে আরও কিছু বললেন, সে কান ঝুলিয়ে, ল্যাজ নিচু করে বোধিসত্ত্বের পা চেটে দিতে লাগল বার বার।

অন্য দু’জনের সঙ্গে সেই খাকি পোশাক-পরা লোকটিও চলে এল এ-দিকে। লোকটি পা ফাঁক করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। চোখ দুটি চঞ্চল। তার ডাকসাইটে কুকুরের ব্যবহারে সে বিস্মিত। ঘামে সারা শরীর জ্যাবজেবে। শোলার টুপিটা খুলে মাথার টাকে হাত বুলোতে বুলোতে সে জিজ্ঞেস করল, এই! তুই কে রে? আরে রাম রাম, একেবারে দিগম্বর অবস্থা!

বোধিসত্ত্ব চুপ করে রইলেন।

এই, তুই কে? চুপ করে আছিস কেন?

ধুতি-পরা এক জন বলল, সাহেব, এ কোনও পাগল-ছাগল হবে নিশ্চয়।

পাগল! কিন্তু চেহারাখানা তো জলদস্যুর মতো।

 এই গরমে বাঁকড়োয় প্রত্যেক বছর কিছু লোক পাগল হয়!

কিন্তু এখানে এই ব্যাটা নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে, বুনো হাতি বেরিয়েছে, এ-দিকে যদি চলে আসে? এই ওঠ, অন্য কোথাও যা, হাতি এসে পড়লে মারা পড়বি! রানিবাঁধে একটা লোককে মেরেছে।

বোধিসত্ত্ব নিষ্পলক ভাবে লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দ হয়ে রইলেন।

 ধুতি-পরা দ্বিতীয় লোকটি বলল, সাহেব, চলুন! আবার ও বেলা আসতে হবে। ও থাক। পাগল সহজে মরে না।

লোকটি বলল, হুঁ!

 গাছপালার আড়ালে একটি জিপ দাঁড় করানো ছিল, বোধিসত্ত্ব সেটা আগে লক্ষ্য করেননি। ওরা সেই জিপ গাড়িতে উঠে চলে গেল। যানটির শব্দ শুনে বোধিসত্ত্বের একটি পাখির কথা মনে পড়ল। শালিক পাখি, যারা এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় যাবার সময় শব্দ করে।

তিনি লোকগুলির ভাষা বুঝতে পারেননি। ওদের উচ্চারিত শব্দগুলি সম্পর্কে তিনি গাঢ়ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। একটু পরে তার মনে হল, মাগধী প্রাকৃতের সঙ্গে এই ভাষার যেন কিছু মিল আছে। পূর্ব মাগধী। তবে স্বরবর্ণের উচ্চারণ বেশ হ্রস্ব। এদের কথার মধ্যে কিছুটা ব্যস্ততা রয়েছে জানি।

আরও কিছুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে রইলেন তিনি। তারপর এক সময় তার পেটের মধ্যে দপ করে জ্বলে উঠল একটা আগুনের শিখা। এর নাম দ্বিপ্রহরের ক্ষুধা। সেই ক্ষুধার একটি স্পষ্ট সর্বজনবোধ্য ভাষা আছে। ক্ষুধা বোধিসত্ত্বকে ডেকে বলল, ওঠো, আর শুয়ে থেকো না। বুনো হাতির চেয়েও আমি অনেক বেশি ভয়াবহ। মনুষ্যজন্ম পেয়েছ, এবার প্রতি দিন আমার ঋণ শোধ করো!

বোধিসত্ত্ব উঠে বসলেন। খিদে পাওয়ার ফলে তিনি নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে জীবন্ত বোধ করলেন। এবার তিনি সত্যিই পৃথিবীতে এসেছেন।

প্রথমে তিনি ঢুকলেন কাছের জঙ্গলে। একটুখানি ঘোরাঘুরি করার পরই বুঝলেন, এখানে ফলবান বৃক্ষ একটিও নেই। তবু তিনি খাদ্যের জন্য চিন্তিত হলেন না। তিনি জানেন, মানুষের জন্য খাদ্য আছে পৃথিবীতে। খুব মায়ার সঙ্গে তিনি হাত বুলোত লাগলেন নিজের মুখে, চোখে, বুকে। কালের সীমানায় বাঁধা এই শরীর, তবু কত প্রিয়।

বন ছেড়ে রাজপথের ওপরে এসে দাঁড়ালেন তিনি। কোন দিকে যাবেন?

তিনি এই দেশ ও কালের পরিচয় জানেন না, তার কাছে দিক-নির্ণয়েরও কোনও মানদণ্ড থাকতে পারে না। অজানা অঞ্চলে সব দিকই সমান। তিনি আকাশের সূর্য ও নিজের ছায়া দেখে পূর্ব-পশ্চিম বুঝলেন। এখন সূর্য ক্রমশ পশ্চিমে হেলবে, সুতরাং পশ্চিমমুখী যাত্রায় মুখের ওপর রোদ লাগবে সর্বক্ষণ। এই বিবেচনায় তিনি পূর্বদিকেই যাবেন ঠিক করলেন। এবং সে-দিকে পা বাড়াবার আগে প্রণাম করলেন তার আশ্রয়দাতা অশ্বত্থ বৃক্ষটিকে।

বোধিসত্ত্ব হাঁটতে লাগলেন পথের রাজার মতো, পথের ঠিক মাঝখান দিয়ে। মাঝে মাঝে কয়েকটি বাস, লরি বা ট্যাক্সি যাতায়াত করল এ-দিক ও-দিক থেকে। তাকে পথ থেকে সরাবার জন্য সেগুলো তীব্র কর্কশ শব্দে হর্ন বাজাল বহুবার, বোধিসত্ত্ব ভ্রূক্ষেপও করলেন না। তিনি আপন মনে হাঁটছেন। গাড়ির চালকরা কুৎসিত গালাগালি দিল, অশ্লীল ইয়ার্কি করল, তবু পাগল ভেবে তাকে সম্মান দিয়ে তাদের যেতে হল পথের পাশ দিয়ে নেমে।

এই যানগুলিকে দেখে বোধিসত্ত্ব খুব একটা বিচলিত হননি। তিনি অপাঙ্গে দেখে নিয়েছেন যে, এই সব কটি গাড়ির নিচেই চাকা বসান। দু’টি চাকার বদলে কোনওটির চারটি চাকা, কোনওটির ছ’টি। পশু বা মানুষের বদলে এই চক্রযানগুলিকে কোনও যন্ত্রে টানছে। বোধিসত্ত্বকে বিস্মিত করার জন্য মানুষের মেধাকে আরও অনেক বিস্তৃত করতে হবে। এই নতুন যুগ কি ভূমির ওপর দিয়ে চক্ৰহীন কোনও যান চালাতে পেরেছে?

গৌতম বুদ্ধেরও জন্মের তিন হাজার বছর আগে সুমের দেশে মানুষ গাছের গুঁড়িকে গোল গোল করে কেটে হাতে-টানা যানের তলায় লাগিয়ে দেয়। সেই দিন থেকে মানুষের তৈরি যান গড়াতে শুরু করেছে। এরও দু’হাজার বছর পর কান্দাহার সীমান্তে এক জন মানুষ, আরও হালকা, অনেকগুলো দাঁড়া লাগানো চক্র আবিষ্কার করে। তারপর আর নতুনত্ব কেউ দেখাতে পারেনি। এই চাকাগুলি কাঠের বদলে ধাতুর বা অন্য কিছুর তৈরি এই যা।

কিছুক্ষণ পরে তিনি লোকালয়ের কাছাকাছি এসে পৌঁছলেন। পথিকরা তার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। কিন্তু মুশকিল বাধল শিশুদের নিয়ে। ঝাঁক ঝাঁক বাচ্চা বিভিন্ন ঘর থেকে পিল পিল করে বেরিয়ে এসে ছুটতে লাগল তার পেছনে পেছনে। সেই সঙ্গে যোগ হল কুকুরের ঘেউ ঘেউ। শিশুদের মধ্যে যেগুলি এঁচোড়ে পাকা, তারা ঢিল ছুঁড়তে লাগল বোধিসত্ত্বের দিকে। বয়স্করা তা দেখে হাসছে, বাধা দিচ্ছেনা। বোধিসত্ত্ব প্রশান্ত মনে এসব উৎপাত সহ্য করছিলেন, কিন্তু একটি ঢিল কপালে এসে আঘাত করে রক্তপাত ঘটাল। তিনি এক আঙুলের ডগায় কপাল ছুঁয়ে তারপর সেই আঙুলটা চোখের সামনে এনে নিজের রক্ত দর্শন করলেন। তখন তিনি বুঝলেন, এই অচেনা যুগে ও জনপদে অন্নের চেয়ে বস্ত্রের প্রয়োজন আগে।

তিনি মুখ ঘুরিয়ে জনপদ ছেড়ে ফাঁকা প্রান্তরের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। জঠরের মধ্যে বুভুক্ষার জ্বালা বেশ তীব্র হয়ে উঠেছে, কিন্তু আগে সংগ্রহ করতে হবে কটিদেশের জন্য এক টুকরো বস্ত্র। তিনি জানেন, বস্ত্র সংগ্রহ করতে বিশেষ অসুবিধা হবার কথা নয়। যদি এ-দেশে বেদান্ত আজও প্রচলিত থাকে, যদি মনুসংহিতা নামে ভুলে-ভরা ও পরস্পর-বিরোধী বাক্যসম্বলিত গ্রন্থটি আজও সুযোগ-সন্ধানী পুরোহিতশ্রেণী মান্য করে চলে, যদি আজও এখানকার মানুষের পরলোকে বিশ্বাস থাকে, তাহলে একজন উলঙ্গ মানুষের জন্য বস্ত্রের অভাব হবে না।

প্রথমে চাই একটি নদী। প্রান্তরের ওপর যে-কোনও দিকে কয়েক ক্রোশ হেঁটে গেলে একটা না-একটা নদী পাওয়া যাবেই। কিছু দিন আগে ধান কাটা হয়ে গেছে, কিন্তু ধানগাছের গোড়াগুলি এখনও রয়ে গেছে জমিতে। সে-দিকে তাকিয়ে ফসলের ঘনত্ব পরীক্ষা করে বোধিসত্ত্ব বুঝে নিলেন যে, নদী খুব দূরে নয়।

অচিরেই বোধিসত্ত্ব পৌঁছলেন কংসাবতী নদীর কিনারে। এই প্রখর গ্রীষ্মে নদীটি ক্ষীণকায়া। তিনি নদীর মাঝখানে নেমে গিয়ে অঞ্জলি ভরে জল তুলে প্রথমে আচমন ও পরে গণ্ডুষ পান করলেন। তিনি সেই জলের স্বচ্ছ কমনীয়তার দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টে। জলের দর্পণে তার মুখের ছায়া। দাড়িগোঁফের জঙ্গলের মধ্যে দুটি চোখ ও একটি উচ্চ নাক। এই মুখ তাঁর অচেনা। তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, আমি কে? আমি কোথা থেকে এসেছি?

নদীটি খুব শীর্ণা হলেও সামান্য স্রোত আছে। কিছুক্ষণ সেই জলে অবগাহন করে শরীর জুড়িয়ে নেবার পর বোধিসত্ত্ব লক্ষ্য করলেন যে, স্রোতে দু’একটি পোড়া কাঠের টুকরো ভেসে আসছে। তখন তিনি উঠে এসে নদীপ্রান্ত ধরে স্রোতের বিপরীত দিক ধরে হাঁটতে লাগলেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর পাওয়া গেল নদীর ধারে একটি শিবমন্দির, এবং শ্মশান। বোধিসত্ত্ব সেখানে থামলেন। এখানে নদী খানিকটা চওড়া, ঘাটে কয়েক ধাপ পাথরের বাঁধানো সিঁড়ি। একটি প্রাচীন বটগাছের নিচে একটি ছোট খড়ের চালার ঘর, যার কোনও দেয়াল নেই। সেই ঘরে রয়েছে স্তুপাকার কাঠ ও একটি খাটিয়া পাতা। শ্মশানটি জনশূন্য।

শিবমন্দিরটি দেখেও বোধিসত্ত্ব সেটির মধ্যে প্রবেশ করার কোনও আগ্রহ বোধ করলেন না। তিনি শ্মশানটি ঘুরে দেখলেন। এরকম স্থান তার পরিচিত। কিন্তু এখানে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে।

ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে তিনি বসলেন পা ডুবিয়ে নদীর জলে। তিনি মনে মনে ফিরে যেতে চাইলেন কয়েক শতাব্দী পরিভ্রমণে। কিন্তু মন কিছুতেই স্থির হচ্ছে না। জঠরের মধ্যে আগুনের শিখাটি সব মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। যেন সেই শিখাটি বলছে, আর কিছু নয়, শুধু আমার স্তব করো।

নদীর ওপারে হলুদ সর্ষের খেত। বাতাসে সেখানে চোখ ধাঁধানো হলুদের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। বোধিসত্ত্ব এই শস্যটি চিনতে পারলেন না। তবুমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন সে-দিকে। ও-পারে দু’একটি মানুষজনও দেখা যায়। খানিকটা দূরে রয়েছে কয়েকটি সারবদ্ধ কুটির। উলঙ্গ অবস্থায় ও-দিকে যাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নিথর হয়ে বসেই রইলেন সেখানে।

পশ্চিমের আকাশ লাল করে বেলা ঢলে আসবার পর একদল লোক এল শ্মশানে। কাঁধের খাটিয়াটা নামিয়ে রেখে শ্মশানবন্ধুরা গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে লাগল। আর দীর্ঘ কণ্ঠস্বরে কাঁদতে লাগল এক পুরুষ ও এক রমণী। সেই কান্না শুনে বোধিসত্ত্ব একটু মুচকি হাসলেন। এটা যে যুগ বা কালই হোক, মানুষের ক্রন্দন শব্দের কোনও পরিবর্তন হয়নি। এ পৃথিবীতে জন্ম অনিশ্চিত, কিন্তু মৃত্যু একেবারে ধ্রুব। তবু মানুষ মৃত্যু দেখে কাঁদে।

কান্নার রোল ক্রমে স্তিমিত হয়ে এল, কাঠ নিয়ে সাজানো হল চিতা। তখন এক সময় বোধিসত্ত্ব নদীতীর ছেড়ে এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে। পিছন দিকের গাঢ় লাল রঙের আকাশের পটভূমিকায় তিনি একজন দীর্ঘকায় মানুষ, মাথা ও মুখে চুল-দাড়ি-গোঁফের এক জঙ্গল। লোহার কপাটের মতো বুক, বলশালী দুই বাহু, মেদ-বর্জিত কোমর, কালো চুলের মধ্যে সুস্পষ্ট পরিদৃশ্যমান সুদীর্ঘ লিঙ্গ, রোমহীন মসৃণ উরু এবং সুষম অঙ্গুলিবিশিষ্ট পদতল। তার চোখ দুটি সঙ্কোচশূণ্য, প্রশান্ত। তার গায়ের রঙ এত পরিষ্কার যে, মনে হয় উজ্জ্বল হলুদ রঙের।

মৃত লোকটি ব্যতীত বাকি সকলে সচমকে তাকাল তার দিকে। যেন তারা স্বয়ং মহাকালকে দেখছে। অস্ত সূর্যের রশ্মি এসে পড়েছে এঁর মাথায়। ইনি দাঁড়িয়ে আছেন, সকলের চোখ থেকে দিগন্তকে আড়াল করে।

মৃত ব্যক্তিটি একজন ভূতপূর্ব স্কুল শিক্ষক। তিনি আবার কখনও কখনও গ্রামের যাত্রা বা পালাগানে অংশগ্রহণ করতেন। গলায় উড়নি জড়িয়ে বাঁ-হাত দিয়ে এক কান চেপে ধরে, ডান হাতটা বাড়িয়ে তিনি চমৎকার বিবেকের গান গেয়েছেন বহুবার। এখন সেই প্রাক্তন শিক্ষক ও গায়কের মুখটি হাঁ করা, চক্ষু দুটি বোজা, বুকের খাঁচার ভিতর থেকে পাখিটা হঠাৎ উড়ে গেছে। মৃতের স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে তার শরীরের জামা-কাপড় ছাড়িয়ে নতুন পোশাক পরাচ্ছিল। হাত দুটি অতর্কিতে থেমে আছে মৃতের স্পন্দনহীন বুকের ওপর। এই মৃতের সামনে ওই উলঙ্গ প্রকাণ্ড লোকটি কী প্রবল ভাবে জীবন্ত।

বোধিসত্ত্ব দুটি হাত যুক্ত করে সুমিষ্ট স্বরে বললেন, বসন!

কেউ তাঁর কথা বুঝল না। তার কণ্ঠস্বর, তার উচ্চারণ অন্য যুগের, কিন্তু সকলেই বুঝতে পারল তার প্রয়োজন। তৎক্ষণাৎ মৃতের পরিত্যক্ত বস্ত্রগুলি ছুঁড়ে দেওয়া হল তার দিকে। বোধিসত্ত্ব সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে ছোঁয়ালেন কপালে, তারপর ফিরে গেলেন নদীর দিকে।

নদীর জলে বস্ত্রগুলি খুব ভাল করে ধুতে লাগলেন তিনি। যেন মৃত ব্যক্তির শরীরের গন্ধ দূর হয়ে যায়। তারপর নিজেও স্নান করে উঠে সেই সিক্ত বসন পরিধান করলেন। ধুতি, পাঞ্জাবি ও উড়নি। ধুতিটাকে কয়েক পাট করে জড়ালেন কোমরে। পাঞ্জাবিটি গলিয়ে দিলেন মাথা দিয়ে। তার গায়ে বেশ আঁট হল। উড়নিটি নিয়ে তিনি কী করবেন, একটুক্ষণ চিন্তা করলেন। কোনও রকম স্থির সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রায় অন্য মনস্ক ভাবেই তিনি সেই উড়নি কোমরে জড়িয়ে ফাস বাঁধলেন বাঁ-দিকে। আর কিছু নয়, শুধু এই বাঁ-দিকে ফাস বাঁধার জন্যই তিনি সারা শরীরে একবার কেঁপে উঠলেন। যেন তার কিছু মনে পড়বার কথা। কিন্তু মনে পড়ল না।

পোশাক পরিধান করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আকৃতিতে একটা পরিবর্তন এসে গেল। আর পথের উন্মাদ নয়, এক দীপ্তকান্তি যুবা। মাথার ভিজে চুল ও ভিজে দাড়ি চিপড়ে তিনি জল ফেলতে লাগলেন। কয়েক জন শ্মশানবন্ধু নদীর জলে হাত-মুখ ধুতে এসে বিচিত্র বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। বোধিসত্ত্ব তাদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে উঠে এলেন ওপরে।

ততক্ষণে মৃতকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে চিতার ওপরে। একটি তেরো-চোদ্দো বছরের বালককে কুশাসনে বসিয়ে মন্ত্র পড়াচ্ছে এক জন সিড়িঙ্গে চেহারার লোক। বালকটির মুখ বাঘের তাড়া খাওয়া হরিণের মতো। বোধিসত্ত্ব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাহলে মানুষের শেষকৃত্যের জন্য এখনও ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়। জীবদেহের অনিত্যতা বিষয়ে শ্লোক উচ্চারণ করে, ব্রাহ্মণ, তুমি দক্ষিণা পাবে। তাতে তোমার দেহের প্রয়োজন মিটবে।

শোক-সন্তপ্তদের মধ্যে কয়েক জন নানা রকম প্রশ্ন করল বোধিসত্ত্বকে। তিনি নিঃশব্দ রইলেন। বার বার দেখতে লাগলেন বালকটিকে। খুব সম্ভবত এ মৃতের জ্যেষ্ঠপুত্র। আজ থেকে এই বালক প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেল। বালকটি হঠাৎ মন্ত্র ভুলে তাকাল বোধিসত্ত্বের দিকে। তার পিতার পোশাকধারী এই লোকটির দিকে সে কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত ভাবে চেয়ে রইল। তার রোরুদ্যমানা মা-ও এখন স্তব্ধ।

বোধিসত্ত্ব আবার অনুভব করলেন খিদের জ্বালা। আর দেরি না করে তিনি শ্মশান ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন।

.

০২.

পর পর তিন দিন বোধিসত্ত্ব মাটি কাটার কাজ করলেন। ক্ষীণতোয়া কংসাবতী বর্ষার সময় উত্তাল হয়ে ওঠে, তখন দু’কুল ভাসিয়ে যায়। তাই যেখানে কংসাবতীর সঙ্গে কুমারী নদী এসে মিশেছে, সেখানে বাঁধ বেঁধে একটি জলাধার বানাবার কাজ শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, কন্ট্রাকটারদের মোচ্ছব। দিকশুন্য ভাবে ঘুরতে ঘুরতে বোধিসত্ত্ব সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এর আগের দিন ডিনামাইট চার্জের সময় দু’জন নিহত এবং সতেরো জন মজুর আহত হয়। প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। তাই বোধিসত্ত্বের সবল শরীর দেখে এক জন ঠিকাদার তার হাত ধরে টেনে কাজে লাগিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ!

দিন শেষে সাড়ে চার টাকা মজুরি। বড় বড় কাগজে টিপসই দিয়ে নিতে হয়। কাছেই এক ঝোপড়িতে পাওয়া যায় ছাতু ও লঙ্কা, অথবা রুটি ও ঢ্যাঁড়শের ঘ্যাঁট। এর পর মুক্তাঙ্গনে নিদ্রা।

এখানে বোধিসত্ত্বের নাম কুঁয়ার সিং। কেন তার এই বিচিত্র নাম হল, তা তিনি নিজেই জানেন না। ঠিকাদার তার নাম জিজ্ঞেস করেছিল, বোধিসত্ত্ব নিশ্চুপ ছিলেন। তিনি জানেন না, তিনি কে, নামের তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মাটি কাটা কুলির নাম নিয়ে কিছু যায় আসে না, অতি ব্যস্ততায় ঠিকাদার নিজেই এই নতুন রিক্রুটের নামকরণ করে দিয়েছিল।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে বোধিসত্ত্ব বার বার তার এই নবলব্ধ নামটি উচ্চারণ করে কৌতুক পান। কুঁয়ার সিং। নামটির মধ্যে কেমন যেন একটা যুদ্ধপ্রবণ নিষ্ঠুরতা রয়েছে। ঠিকাদার কেন ভাবল, এই নাম তাকে মানায়? এ-রকম নামের চরিত্র অনুযায়ী কি তাঁকে নিজেকে গড়ে নিতে হবে।

উঁচুবাধের কাছে সারি সারি তাঁবু, ওখানে বাবুরা থাকেন। কুলিরা নদীর কাছাকাছি ঢালাও প্রান্তরে। অনেক রাত জেগে তারা গান গায়। কেউ কেউ সঙ্গে ঢোল ও করতাল এনেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই সুরে চিৎকার করে তারা দেহের অবসাদ কাটায়। এখানে অনেক স্ত্রীলোকও রয়েছে, তাদের কলস্বর চিরে দেয় রাত্রির বাতাস। তাদের মধ্যে দু’তিন জন নাচে। দূরে, লণ্ঠনের ধোঁয়াটে আলোয় মনে হয় প্রেতনৃত্যের মতো।

ভোরের একটু পর থেকেই বাঁকুড়ার আকাশে সূর্য দারুণ ক্রুদ্ধ। নামে মাটি কাটা মজুর হলেও, আসলে পাথর কাটতে হয়। গেরুয়া রঙের মাটির পাতলা স্তরের নিচেই কঠিন পাথর। প্রতিরোধের পাথর। গাঁইতির আঘাতে ফুলকি দিয়ে ওঠে আগুন ধরিত্রীকে বিদীর্ণ করতে করতে বিস্ফারিত হয়ে ওঠে বোধিসত্ত্বের চোখ। ভূমির পরতে পরতে এক রূপ! এক একটি পাথর ভাঙার পর তার ভেতরটা যেন শিশুর করতলের মতো কোমল রক্তাভ। যেন অযুত বর্ষ ধরে সেখানে সুপ্ত ছিল এক স্তব্ধতা, বোধিসত্ত্ব সেটাকে এই মাত্র ভেঙে দিলেন। তার পাপবোধ হয়। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি কপালের ঘাম মুছলেন।

এ কুঁয়ার সিং! কুঁয়ার সিং।

যেন চারদিক থেকে শত শত কণ্ঠস্বরে তার নাম ডাক আসছে। তিনি বিভ্রান্ত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন। কই, কেউ না তো। হাজার হাজার মজুর তালে তালে গাঁইতি চালিয়ে যাচ্ছে। তার থেকে শব্দ উঠছে একটা। সেই শব্দই কি কুঁয়ার সিং বলে ধ্বনিত হল?

তিনি মাথা নিচু করতেই আবার সেই ডাক উঠল। তিনি দেখলেন, মাটি থেকে একটা ভাপ উঠছে, বাতাস পাতলা হয়ে এসেছে, নদীর জলে যেন একটা রেশমের চাদর বিছানো। বোধিসত্ত্বের চোখে জল এসে গেল। তিনি ভাবলেন, তিনি এখানকার কেউ নন।

এবার খুব কাছ থেকেই খুব নরম গলায় ডাক এল, এ কুঁয়ার সিং।

তিনি দেখলেন, ফুল-ছাপ শাড়িপরা এক কামিনী। তার মাথায় মাটি-ভর্তি ঝুড়ি। বোধিসত্ত্ব কুঞ্চিত করে তাকালেন মেয়েটির দিকে। এই মেয়েটি কি আগে এখানে ছিল? অনেক স্ত্রীলোকই মাথায় ঝুড়িতে মাটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাঁধের দিকে, কিন্তু ঠিক এই মেয়েটিকে তিনি দেখেছেন কি আগে? নাকি হঠাৎ আবির্ভূতা হল বাতাস থেকে!

পাতলা নরম ছিপছিপে মেয়েটি সাহসিনীর মতো সহাস্য মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

 বোধিসত্ত্ব প্রসন্ন নয়ন তুলতেই মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার ঘর কোথায়, কুঁয়ার সিং? বোধিসত্ত্ব উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে আঙুল দেখালেন।

মেয়েটি এই উত্তরটিকে খুব সহজ ভাবে গ্রহণ করে বলল, তুমি বালিয়া জেলার বিষুণগঞ্জ গ্রামের সাহেবরামকে চিনতে?

বোধিসত্ত্ব মাথা নাড়লেন।

মেয়েটি বলল, সে আমার মরদ। তার শরীরে তাগদ খুব। সে এক নাগাড়ে কুঁয়া থেকে হাজার বালতি জল তুললেও থকে যেত না। সে তার মা-বাবাকে বড় ভক্তি করে। সে তার বুড়িয়া মাইয়াকে কাঁধে করে দশ মিল দূরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। তুমি সেই সাহেবরামকে চিনতে না?

বোধিসত্ত্ব আবার মাথা নাড়লেন।

মেয়েটি মুখের হাসি মুছে ফেলল। উদাসকরা গলায় বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি তাকে চিনবে। সে আর নেই। উ তো মর গ্যয়া। আগের বছর ওর হৈজা হল, আর তিন দিনে মরে গেল। উ শালা আমাকে রেখে ভাগল। কুঁয়ার সিং, এ দুনিয়ায় কত ফালটু আদমি আছে, তারা মরে না, আর সাহেবরামের মতো এমন মরদের বাচ্চা মরদ কেন মরে যায়?

কোথাও ছায়া নেই, ইচ্ছে হয় নিজের ছায়াতেই আশ্রয় নিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে। মাটি বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে এই যুবতী মেয়েটি হঠাৎ পুরনো শোকে উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। তার দুঃখের কথা সে কারুকে বলতে চায়। মেয়েটির শরীরের গড়ন ভারি সুন্দর। কিন্তু সে-সম্পর্কে বোধিসত্ত্বের কোনও বিকার হল না। তিনি শান্তভাবে মেয়েটির চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন।

মেয়েটি দু’কদম কাছে এগিয়ে এসে বলল, এই গরম চলে যাবে, তারপর বরসাত আসবে, এই নদী পানিতে বিলকুল ভরে যাবে, তারপর আসবে পূজা কা টাইম, তারপর আসবে শীত, কিন্তু আমার মরদ আর আসবে না। কুঁয়ার সিং, তুমিও তো মরদ।

এতক্ষণ যেন সব শব্দ থেমে ছিল, আবার বোধিসত্ত্ব শুনতে পেলেন রুক্ষ পাথরের ওপর শত শত গাঁইতির আওয়াজে একটাই ধ্বনি উঠছে, কুঁয়ার সিং, কুঁয়ার সিং! যেন মেদিনীর গর্ভ থেকে উঠছে এই আর্তনাদ। এতগুলো মানুষের হাতের লোহার অস্ত্র ভেঙে দিচ্ছে অযুত বছরের স্তব্ধতা।

এই সময় কিছু দূর থেকে আর এক জন মজুর ডাকল, এ লছমিয়া, লছমিয়া!

এই ফুল-ছাপওয়ালা শাড়িপরা মেয়েটিকে ডাকা হচ্ছে, কিন্তু সে সাড়া দিল না।

লোকটি আরও দু’বার ডেকে সাড়া না পেয়ে দৌড়ে এল এ-দিকে। লোকটি বেশ সুঠাম ও লম্বা, কিন্তু এইটুকু দৌড়ে এসেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে দু’বার কাশল, স্পষ্টত ক্ষয়কাশ। সে বোধিসত্ত্বের দিকে রুক্ষভাবে তাকিয়ে বলল, এখানে কোন নৌটাঙ্কি হচ্ছে?

তারপর মেয়েটিকে বলল, কাজে বেশি পয়সা না রসের খেলায় বেশি পয়সা?

মেয়েটি বলল, চুপ রহ, কমজোরি বেহুদা–।

লোকটি বোধিসত্ত্বের কাছে এগিয়ে এসে বলল, তুমি নতুন আদমি, দু’দিন এসেই তুমি আমার জেনানার দিকে চোখ দিয়েছ?

বোধিসত্ত্ব মৃদুভাবে হাসলেন শুধু।

লোকটি বোধিসত্ত্বের কাঁধ খামচে ধরে হিংস্রভাবে ঝাঁকানি দিল।

মেয়েটি ছুটে এসে লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ছাড়, ছাড় ওকে! কে তোকে বলেছে, আমি তোর জেনানা? আমি কারুর নই। আমি সাহেবরামের। এই নতুন মানুষটিকে ঠিক সাহেবরামের মতো দেখতে।

বোধিসত্ত্ব আবার শুনতে পেলেন অন্তরীক্ষ জুড়ে এক ব্যাকুল ধ্বনি উঠছে-কুঁয়ার সিং। কুঁয়ার সিং।

বোধিসত্ত্ব হাতের গাঁইতিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মেয়েটিকে প্রণাম জানালেন। তার পরই পেছন ফিরে হাঁটতে লাগলেন হন হন করে।

উঁচু বাঁধের দিকে উঠতে উঠতে তার মনে পড়ল একটি নাম। বুধকুমার। তিনি চোখের সামনে দেখতে পেলেন বুধকুমারকে। এক উদ্যানে পাথরের আসনে বুধকুমার আর তার অসামান্য রূপবতী স্ত্রী বসেছিলেন। তারা দু’জনেই বিলাসময় সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়েছে। দু’জনে ধ্যানমগ্ন। এমন সময় সেখানে এলেন কাশীর রাজা ব্রহ্মদত্ত। রাজা জিজ্ঞেস করলেন বুধকুমারকে, এই রমণী তোমার কে?

বোধিসত্ত্ব যেন চলচ্ছবির মতো এই দৃশ্য দেখতে লাগলেন। বুধকুমারকে তার খুব চেনা লাগল।

বুধকুমার বললেন, ও আমার কেউ না। আমরা দুজনে এক সঙ্গে সাধনা করি। সংসার জীবনে ও আমার স্ত্রী ছিল বটে।

রাজা বললেন, ওকে যদি আমি জোর করে ধরে নিয়ে যাই আমার ভোগের জন্য, তাহলে তুমি কী করবে?

বুধকুমার জলদগম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন, যদি একবার জাগে, তবে সারা জীবনের মতো ও আমাকে ছাড়বেনা। না, আমি তাই জাগাবনা। ধুলোর ঝড়কে যেমন বৃষ্টি চাপা দিয়ে দেয়, সেই রকম মাথাচাড়া দেবার আগেই আমি তাকে দমন করব।

রাজা বুঝতে পারলেন না, তিনি প্রতিবাদ ও কান্না সত্ত্বেও সেই রূপসীকে সবলে হরণ করলেন। বুধকুমার একবার মাত্র সেদিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে বসে বইলেন স্তব্ধভাবে।

বাঁধের ওপর উঠতে গিয়ে একবার হোঁচট খেয়ে পড়লেন বোধিসত্ত্ব। কিন্তু কিছু একটা স্মৃতি ফিরে আসায় তিনি বেশ তৃপ্তি বোধ করলেন। তিনি কুঁয়ার সিং নন, তিনি বুধকুমার। যা একবার জাগলে সারা জীবনের মতো আর ছাড়ে না, তাকে না জাগানোই ভাল। তার নাম ক্রোধ। অক্ৰোধী বুধকুমারের কাছে শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে হয়েছিল রাজাকে।

বাঁধটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে একটা টুলের ওপর বসে আছেন ঠিকাদারবাবু। এক জন লোক তার মাথার ওপর ছাতা ধরে আছে। তিনি কৌটো থেকে পান মুখে দিচ্ছেন আর গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছেন। তার মুখখানি অবিকল পান্তুয়ার মতো।

বোধিসত্ত্বর হাঁটার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় সেটা না-ফেরার যাত্রা। তাঁকে দেখেই ঠিকাদারবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, এই, এই, এই তুই কোথায় যাচ্ছিস? অ্যাঁ? এখনও টিফিন টাইম হয়নি।

বোধিসত্ত্ব থামলেন না।

ঠিকাদারবাবু চিড়বিড়িয়ে উঠে বললেন, উত্তরই দিচ্ছে না, ব্যাটা লাটসাহেব।

এক জন অনুচরকে তিনি আদেশ দিলেন, এই ওকে ধর তো!

 দু’জন অনুচর গিয়ে বোধিসত্ত্বের হাত চেপে ধরল। তিনি বাধা না দিয়ে ফিরে এলেন।

কাজ ফেলে পালাচ্ছিস কোথায় রে ব্যাটা? টাট্টি পেয়েছে? সেকথা মুখ ফুটে বলতে পারিস না? এই! আরে, এ ব্যাটা ভূতটা উত্তর দেয় না কেন? তোর ব্যাপার কী, তুই আর কাজ করবিনা?

মাগধীর অপভ্রংশ এই ভাষাটি বোধিসত্ত্ব এর মধ্যেই অনেকখানি আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। তিনি শান্তভাবে বললেন, না।

বোধিসত্ত্ব প্রত্যাশা করেছিলেন এবার তাকে চাবুক মারা হবে। অবাধ্য শ্রমিকের এ-রকমই শাস্তির প্রথার কথা তিনি স্মরণ করতে পারেন। কিন্তু মানুষ অনেক দূরে চলে এসেছে। এখন শ্রমিকের পাশাপাশি মাথা তুলে থাকে বড় বড় যন্ত্র, মানুষের তৈরি গর্জনকারী পেটিকা পাহাড় ফাটিয়ে দেয়, চাবুক এখন পরিত্যক্ত।

ঠিকাদারবাবু বললেন, ব্যাটাদের কাজ দিলেও কাজ করবে না। মাথায় একেবারে গোবর! কেন, কাজ করবি না কেন? যা। চেহারাখানা তো আছে ষাঁড়ের মতো।

বোধিসত্ত্ব আবার বললেন, না।

 ঠিকাদারবাবু একটা ধাতুমুদ্রা ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, তবে এই নে, যা ভাগ। হাফ রোজও কাজ হয়নি, আর কত পাবি।

মুদ্রাটি তুলে নিয়ে বোধিসত্ত্ব চলে যাচ্ছিলেন, ঠিকাদারবাবু আবার বললেন, আরে যাচ্ছিস কোথায়? এখানে টিপছাপ দিয়ে যা। ওপরওয়ালাদের আমার হিসেব দেখাতে হবে না?

পুরো রোজের অঙ্ক বসানো ঘরে বোধিসত্ত্বের টিপসই দেওয়ানো হল। তিনি কালিলাগা বুড়ো আঙুলটি দেখতে দেখতে ভাবলেন, এ যেন দাগী হয়ে যাওয়া। তিনি কোনও অন্যায় করেছিলেন, তার শাস্তির চিহ্ন। একবার তিনি ইচ্ছে করলেন, ধাতুমুদ্রাটি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। পরক্ষণেই মনে পড়ল, ভোগবাসনা পূর্ণ না হলে কখনও অর্থ ত্যাগ করতে নেই। তাতে অতৃপ্তির মূল্য আরও বেশি হয়ে ওঠে। তিনি এই নতুন যুগের ভোগবাসনার কথা কিছুই জানেন না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়