তোমার ঘাড়ের কাছে এটা কীসের দাগ?

বোধিসত্ত্ব বললেন, এক জন ছুরি মেরেছিল।

 কৃষ্ণা শিউরে উঠে বলল, কে?

আমারই মতো আর এক জন মানুষ।

 তুমি কি কারুর সঙ্গে মারামারি করতে গিয়েছিলে নাকি?

 সেই উদ্দেশ্যেই যাইনি। তবে হঠাৎ ও-রকম একটা ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল।

তোমার ঊরুতে কীসের দাগ?

 ওই একই দিনের ঘটনা!

বাবা রে, খুব সাংঘাতিক ভাবে মেরেছিল তো। তোমার পিঠে, ঠিক কোমরের কাছে শিরদাঁড়ার ওপরে, এই দাগটা কীসের?

বোধিসত্ত্বচমকে উঠে বললেন, কোথায়? আর কোনও দাগ নেই তো।

কৃষ্ণা তার পিঠের শিরদাঁড়ার ওপর আঙুল রেখে বলল, এই তো, অনেকটা জরুলের মতো, আবার জরুল না-ও হতে পারে, হয়তো ছোটবেলা জোরে ধাক্কা লেগেছিল, অনেকটা পদ্মফুলের মতো হয়ে আছে।

এ-রকম কোনও দাগের কথা তো আমি জানি না!

 বাঃ, তোমার শরীরে একটা দাগ রয়েছে, তুমি তা জানো না?

মানুষ তো নিজের পিঠ দেখতে পায় না।

কিন্তু আগে কেউ তোমাকে একথা বলেনি?

না। সে-রকম বলবার মতো কেউ ছিল না।

তোমার মা-বাবা! আচ্ছা, আগে তুমি কোথায় ছিলে? তোমার বাড়ির অন্য লোকেরা কোথায় থাকে?

সেসব কিছুই আমি জানি না। বোধহয় সে-রকম কেউ নেই আমার।

তার মানে তুমি আমাকে বলতে চাও না।

 তাহলে তুমি বলো, কেন তুমি গঙ্গায় ডুবে মরতে গিয়েছিলে?

বলব, কোনও এক দিন বলব, এখনও বলার সময় আসেনি। সেকথা জানার জন্য তুমি কি কৌতূহলে ছটফট করছ?

না, আমার সেরকম কৌতূহল নেই।

তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করো?

কেন অবিশ্বাস করব?

কৃষ্ণা সামনের দিকে ঘুরে এসে বোধিসত্ত্বের কণ্ঠলগ্না হল। বোধিসত্ত্ব দু’হাত দিয়ে কৃষ্ণার মুখখানা ধরে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তুমি কী সুন্দর।

কৃষ্ণা বলল, তুমি এই কথাটা এত বার বার বলল কেন! আমি তো জানি, আমি তেমন সুন্দরী নই। তবু তুমি যখন এই কথাটা বলল, তখন সুন্দর কথাটাই আশ্চর্য সুন্দর হয়ে ওঠে।

বোধিসত্ত্ব মুখ নিচু করে তার চোখ দুটি রাখলেন কৃষ্ণার চোখের ওপর। যখন আর কেউ কারুকে দেখতে পায় না। তবু সেই অন্ধকারের মধ্যেও তিনি খুঁজতে লাগলেন রূপ।

গত চার মাস ধরে তিনি কৃষ্ণার শরীরের ঘাম বা নখের ধুলোর মতো তার মধ্যে লীন হয়ে আছেন। তিনি এই সুস্বাস্থ্যবতী যুবতীর সুঠাম স্তনে চোখ ঘষেছেন পাগলের মতো। তিনি এর যোনিতে যোনি-কীট হয়ে থেকেছেন। কৃষ্ণার নগ্ন মূর্তির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তিনি দেখেছেন পাহাড়, সমুদ্র থেকে জেগে-ওঠা ডুবো পাহাড়। এর নিতম্বে দুই সুমেরু পর্বত। এর কোমরের খাঁজে, নিম্ন নাভিতে সাগরের ঢেউ। আলুলায়িত চুলে বনকুসুমের গন্ধ, ঊরুতে অবিরাম ভূমিকম্প। তিনি ওকে দাঁত দিয়ে কামড়েছেন, জিভ দিয়ে চেটেছেন, পৌরুষ দিয়ে বিঁধেছেন। তিনি উন্মত্ত হয়ে, নিজের শরীরের চেয়েও প্রকাণ্ড হয়ে আথালি-পাথালি খেলা খেলেছেন ওকে নিয়ে। তিনি ওর সারা শরীরে বার বার ঘষেছেন নিজের চোখ, তবু তার বুকের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে রূপদাহ।

কৃষ্ণা এক-এক সময় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, তুমি এমন পাগলের মতো করো, আমার ভয় করে। আমার সত্যিই ভয় করে। আমার মনে হয়, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাব।

বোধিসত্ত্ব সহাস্যে বললেন, তোমার কী ফুরিয়ে যাবে কৃষ্ণা? এই রূপ তোমার নয়। তুমি এই রূপের নও। রূপ তোমার আত্মা নয়।

কৃষ্ণা বলে, তোমার এই সব কথা শুনলেও আমার ভয় করে।

বোধিসত্ত্ব বলেন, এটা জেনে ফেলার ভয়। সব কিছু জানতে আমারও ভয় করে এখন। একথা আমি অস্বীকার করতে পারি না।

তাহলে আমাকে ভয় দেখাও কেন?

কৃষ্ণা, তোমাকে আমি সব কিছু দিতে চাই। এমনকী ভয় পর্যন্ত।

শীত ফুরিয়েছে, বছর ফুরিয়েছে, আবার পৃথিবী তেতে উঠেছে। এক-এক দিন সন্ধেবেলা ঝড় ওঠে। ঘর থেকে বেরিয়ে ওরা দু’জনে এসে বসে ছাদে। কলকাতার আকাশ মড় মড় করে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। হুঙ্কার দিয়ে ছোটাছুটি করে একশোটা দৈত্য। তারপর বড় বড় ফোঁটায় আসে বৃষ্টি। ওরা বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। তখন মনে হয়, পৃথিবীতে ওরা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই।

বোধিসত্ত্ব কৃষ্ণাকে ছুঁয়ে থাকেন। বজ্রের শব্দে তিনি যেন শুনতে পান কার কণ্ঠস্বর। খুব দুর্বোধ্য তার ভাষা। কারা যেন এক অপরিচিত নাম ধরে তাকে ডাকে। বোধিসত্ত্ব সেই আকাশবাণী শুনতে চান না।

এই বৃষ্টির মধ্যেও কৃষ্ণার শরীর উষ্ণ, তার বুকে হাত রেখে বোধিসত্ত্ব ভাবেন, সবাই জানে, এই সুখ ক্ষণস্থায়ী। তবু এই সুখ ছেড়ে আর কোন বড় সুখের সন্ধানে তার যাবার কথা ছিল?

বিদ্যুতের ঝিলিকের সঙ্গে সারা আকাশ গড় গড় করে ওঠে। আবার তার মনে হয়, আকাশ যেন কথা বলছে। বোধিসত্ত্ব সেই ভাষা বোঝার চেষ্টা করলেন, তিনি তাকিয়ে রইলেন কৃষ্ণার মুখের দিকে।

কৃষ্ণা বলল, এই সময় কী ইচ্ছে করছে জানো?

বোধিসত্ত্ব উৎসুকভাবে তাকালেন।

কৃষ্ণা বলল, আমরা অনেক দূরে চলে যাব, কোনও একটা গ্রামের নদীর ধারে, সেখানে খুব ছোট্ট চায়ের দোকান থাকেনা? সেই রকম একটা দোকানে বসে থাকব, গেলাসে করে চা দেবে, গুঁড়ো চা, ওপরে দুধের সর ভাসে, খুব খারাপ খেতে হয় সেই চা, তবু সেই চা-ই আমরা মজা করে খাব আর নদীর ওপরে বৃষ্টি পড়া দেখব। দোকানের ছেলেটাকে বলবমুড়ি মেখে দিতে। সেলাই করা থালায় একগাদা মুড়ি, ভেজাল সরষের তেল দিয়ে মেখে এনে দেবে, সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা। তার কী অপূর্ব স্বাদ। মাছধরা নৌকোগুলো এসে ভিড়বে নদীর ধারে, তুমি সেই বৃষ্টির মধ্যেই ছুটে গিয়ে কিনে নিয়ে আসবে এক কিলো জ্যান্ত চিংড়ি মাছ, সেই দোকানেই ভাজা হবে, মুড়ির সঙ্গে টাটকা চিংড়ি মাছ ভাজা, দারুণ। তারপর রাত্রে কোনও গৃহস্থের বাড়ি গিয়ে বলব, আমাদের একটু থাকতে দেবেন।

বোধিসত্ত্ব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো।

 কৃষ্ণা অবাক হয়ে বলল, এখন? পাগল নাকি!

কেন? এখনই বেরিয়ে পড়ব আমরা!

তা কি হয়? এই সব কথা ভাবতেই ভাল লাগে, সত্যি সত্যি কি যাওয়া যায়?

কেন যাবেনা? যে-কোনও ট্রেনে উঠে আমরা যে-কোনও জায়গায় নেমে পড়ব! যেখানে নদী থাকবে।

এই সন্ধেবেলা বেরিয়ে কোথায় যাব? যেতে হয় সকালবেলা।

সন্ধেবেলা গেলেই বা ক্ষতি কী? চলো, চলো।

কাল সকালে ঠিকে ঝি আসবে, তাকে কিছু বলা হয়নি। পরশুই এক তলায় চুরি হয়ে গেছে, আমাদের ঘর খালি রেখে গেলে যদি সব চুরি হয়ে যায়?

আমাদের কী আছে যে চুরি হবে?

 কদিন আগেই স্টিলের নতুন থালাবাসন কিনেছি!

এত মায়া?

 আর এক দিন যাব, ঠিক যাব। আজ নয়।

বোধিসত্ত্ব একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ঠিক আছে, আজ নদীর ধারে বসে বৃষ্টি দেখা না-ই বা হল। কিন্তু এখানেও বৃষ্টি পড়ছে। তোমার তেলমাখা মুড়ি আর চিংড়ি মাছ ভাজা খেতে ইচ্ছে হয়েছে। সেগুলো আমি নিয়ে আসছি।

কৃষ্ণা বোধিসত্ত্বের হাত টেনে ধরে বলল, না না, এই বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে যেতে হবে না, লক্ষ্মীটি!

বোধিসত্ত্ব বললেন, আমারও ইচ্ছে করছে।

 কৃষ্ণা বলল, ঠিক আছে, যেতে হবে না, মুড়ি বাড়িতেই আছে।

তাহলে চিংড়ি মাছ নিয়ে আসি। হয়তো জ্যান্ত হবে না। কিংবা গঙ্গার ধারে গিয়ে দেখি যদি পাই।

তারপর মুচকি হেসে তিনি চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু ভেজাল সরষের তেল কোথায় পাওয়া যায়?

কৃষও হাসতে হাসতে বলল, যে-কোনও দোকানে।

বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে বোধিসত্ত্ব বেরিয়ে পড়লেন। তাদের বাড়ির সামনের গলিতে জল জমে গেছে, তার মধ্য দিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন ছপছপিয়ে।

এক-এক দিন মাঝরাত্রে বোধিসত্ত্ব ঘুম ভেঙে উঠে পড়েন ধড়মড় করে। কেন ঘুম ভেঙে যায় তিনি বুঝতে পারেন না। আগে অনবরত পথে পথে ঘুরতেন। এখন শুধুঅফিস যাওয়া-আসা ছাড়া আর কোথাও বেরোন না। সময় বাঁচাবার জন্য তিনি যাতায়াত করেন বাসে বাদুড়-ঝোলা হয়ে।

কখনও কখনও হঠাৎ তাঁর মনে হয়, পথ বুঝি তাকে ডাকছে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে পথে পথে ঘোরার একটা নেশা আছে। এক একদিন তিনি মাঝ রাতে উঠে জামাও পরেছিলেন একটু পথে ঘুরে আসবেন বলে। কিন্তু আবার নিবৃত্ত হয়েছেন। কৃষ্ণা হঠাৎ জেগে উঠে তাকে দেখতে না পেলে ভয় পাবে। তাছাড়া তিনি কোনও কারণে যদি আর ফিরতে না পারেন?

তিনি এক দৃষ্টে চেয়ে থাকেন কৃষ্ণার মুখের দিকে। ঘুমন্ত মানুষের মুখে একটা ধ্যানের প্রশান্তি থাকে। কড়াই কারখানার ফার্নেসের শিখা এসে পড়ে জানলা দিয়ে। সেই অল্প আলোয় তিনি দেখেন এই যৌবনবতী নারীকে। দেখে দেখে আর ফুরোয় না৷ রূপে বাসস্থান চক্ষু। এই চোখ রূপে রত। এই চোখ আর কিছুতে ফেরে না অন্য দিকে। অথচ এই রূপ কি শুধুই বাইরে? কৃষ্ণার ভিতরের পরিচয় তিনি কিছুই জানেন না। যেমন জানেন না নিজের।

কখনও কখনও কৃষ্ণার ঘুম ভেঙে যায়। সে প্রথমে আধোঘুমে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে। তারপর তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলে, এ কী, তুমি এখনও জেগে আছ?

বোধিসত্ত্ব বলেন, জেগে ছিলাম না, তোমারই মতো হঠাই জেগে উঠলাম।

আমাকে ডাকোনি কেন?

 ডাকিনি, তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে ভাল লাগছিল।

তোমার গায়ে জামা? তুমি কোথাও যাচ্ছিলে?

বোধিসত্ত্ব একটু লজ্জিত হয়ে বললেন, না। কোথাও যাবনা। একবার শুধু ভেবেছিলাম পথে ঘুরে আসব।

কৃষ্ণা বোধিসত্ত্বর দু’হাত জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল গলায় বলল, তুমি আমাকে এ-রকম ভয় দেখাও কেন বলো তো?

বোধিসত্ত্ব তার মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বললেন, তোমার কীসের ভয় কৃষ্ণা?

 আমার ভয় হয়, তুমি হঠাৎ কোনও দিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে!

বোধিসত্ত্ব হাসলেন, ক্ষীণভাবে।

 তুমি কথা দাও, আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না?

কোথায় যাব?

তা জানি না। তবু মাঝে মাঝে তোমার মুখ দেখে কী-রকম যেন মনে হয়। ভয় হয়, তোমাকে যেমন হঠাৎ পেয়েছি, তেমনি হঠাৎ তুমি এক দিন চলে যাবে।

কোথায় যাব, কেন যাব, সে-কথা যদি জানতাম, তাহলে যাওয়ার প্রশ্ন উঠত। কিন্তু তা তো আমি জানিনা!

তুমি সব সময় আমার মুখের দিকে চেয়ে কী দেখো?

 তোমাকেই দেখি।

কিন্তু আমার মনে হয় তুমি আমাকে ছাড়িয়ে আরও কিছু দেখছ।

নাঃ, তত দূর আমার দৃষ্টি যায় না।

এবার থেকে যখন জেগে উঠবে, তখন আমাকে ডেকে তুলবে। আমিও তোমার সঙ্গে জাগব। সব রাত্তিরেই ঘুমিয়েই-বা কী হবে?

তুমি ভয় পেয়ো না, এরপর থেকে মাঝরাত্রে আমি জেগে উঠলেও গায়ে জামা পরবনা।

কৃষ্ণা বোধিসত্ত্বের বুকে হেলান দিয়ে আবেশে চোখ বুজল। বোধিসত্ত্বের একখানি হাত নিয়ে খেলা করতে করতে বলল, তুমি যখন ঘুমিয়ে থাকো, তখন এক-এক দিন আমিও তোমাকে দেখি। তুমি আমাকে সুন্দর বলল, কিন্তু আসল সুন্দর তো তুমি! তোমার মতো এমন মানুষকে পাওয়া ক’জন মেয়ের ভাগ্যে থাকে। প্রায়ই আমি ভাবি, ভাগ্যিস সেদিন আমি গঙ্গায় ডুবতে গিয়েছিলাম, তাই তোমাকে পেলাম। ভগবান আমাকে উপহার দিয়েছে তোমার মতো এক জন মানুষকে।

ভগবান দিয়েছেন?

তাছাড়া আর কে? ওই সময় গঙ্গার ধারে তো কেউ না-ও বসে থাকতে পারত? কিংবা অন্য কোনও মানুষ থাকতে পারত। এটা ভগবানের দান নয়?

ভগবান যদি আমাকে দান করে থাকেন, তবে আমার তো তাকে চেনার কথা। কিন্তু আমি তো তাঁকে চিনি না।

কৃষ্ণা তীক্ষ্ণভাবে বোধিসত্ত্বের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক পলক। তারপর বলল, তুমি না চেনো, তাতে কোনও ক্ষতি নেই। আমিও আগে ঈশ্বর মানতাম না, সেই স্কুল পড়ার সময় সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিয়েছি, তারপর আর ঠাকুর-ফাকুর পুজো করিনি কক্ষনও। আমাদের বাড়িতে– ।

তোমাদের বাড়িতে?

ও, এই বলে তুমি আমাদের বাড়ির খবর জেনে নিতে চাও? না, সে-সব এখন বলব না। শোনো, যা বলছিলাম, ঘুমের মধ্যে এক-এক সময় যখন তোমার মুখটা দেখি, তখন মনে হয়, তোমার মনের মধ্যে খুব খুব একটা দুঃখ আছে। কিছু একটা দুঃখ তুমি পুষে রেখেছ।

না তো! আমার কোনও দুঃখ নেই। আমি সুখী।

 ঠিক বলছ?

তুমি জানো না আমি সুখী?

জানি। তবু তোমার মুখ দেখলে এক-এক সময় অন্য রকম মনে হয়। তখনই আমার ভয় করে। আমি জানি, পুরুষ মানুষের একটা বাইরের জীবন দরকার। তুমি সব সময় আমার কাছে থাকো। মাঝে মাঝে বাইরে বেরোলেও তো পারো! বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মিশতে পারো। তোমার কোনও বন্ধু-টন্ধুকে বাড়িতে ডেকে আনতেও পারো! হয়তো সব সময় আমাকে তোমার ভাল লাগে না।

সে-রকম কথা আমার কখনও মনে হয়নি।

 তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও, তাহলে আমি আবার ঠিক গঙ্গায় ডুবে মরব!

 কৃষ্ণা, আমি তো তোমার কাছেই আছি।

বোধিসত্ত্বকে হারাবার চিন্তাতেই কৃষ্ণার সারা শরীরটা একবার কেঁপে উঠল। এই দুর্বোধ্য মানুষটিকে আরও দৃঢ় বন্ধনে বাঁধবার জন্য সে তক্ষুনি আঁচল সরিয়ে, ব্লাউজের বোতাম খুলে ফেলল। তারপর মা যেমন শিশুকে ডাকে, সেই রকম নিজের স্তন দেখিয়ে বলল, এসো।

এক দিন মাঝ রাত্রে কৃষ্ণা নিজেই ডেকে তুলল বোধিসত্ত্বকে। আনন্দব্যাকুল স্বরে বলল, এই, দ্যাখো, দ্যাখো!

সে বোধিসত্ত্বের একখানা হাত টেনে নিজের শায়া খোলা তলপেটের ওপরে চেপে ধরল।

বোধিসত্ত্ব প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলেন না। কৃষ্ণা বলল, টের পাচ্ছ না? নড়ছে। ভীষণ নড়ছে আজ দুষ্টুটা।

বোধিসত্ত্ব অনুভব করলেন কৃষ্ণার পেটের মধ্যে একটা স্পন্দন। একটি নতুন প্রাণ আসছে পৃথিবীতে। সে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। তিনি হাত সরিয়ে নিচু হয়ে সেখানে কান পাতলেন। হ্যাঁ, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কৃষ্ণার গর্ভে রয়েছে দ্বিতীয় একটি আত্মা।

আনন্দের চোটে কৃষ্ণা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বোধিসত্ত্ব তার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। তার নিজের মধ্যে একবিচিত্র অনুভূতি, যা ঠিক আনন্দ বা উৎকণ্ঠা নয়। বহুকাল ধরে মানব-জীবনের যে ধারা বহে আসছে, তিনি এবার থেকে তার অন্তর্গত হয়ে গেলেন। তিনি এর থেকে আর আলাদা হয়ে যেতে পারবেন না, তার রক্তের ধারা বয়ে নিয়ে যাবে অন্য এক জন।

কৃষ্ণা বলল, তুমি আগে কোনও দিন টের পাওনি, না?

না!

তুমি কিছু লক্ষ্যও করোনি? আমার কোনও পরিবর্তনও তুমি দেখোনি?

বোধিসত্ত্ব হেসে বললেন, না, বুঝতে পারিনি।

আমি ইচ্ছে করেই এত দিন তোমাকে কিছু বলিনি। প্রায় পাঁচ মাস– ।

 কেন বলোনি?

কী জানি, আমার একটু একটু ভয় করত। যদি তুমি পছন্দ না করো, যদি তুমি রেগে যাও।

কথা বলতে বলতে কৃষ্ণার মুখখানা শুকিয়ে গেল। মুখে ফুটে উঠল খানিকটা অস্বাভাবিক ম্লান ছায়া।

বোধিসত্ত্ব তার চিবুকে হাত রেখে বললেন, আমাকে কেন ভয় পাবে কৃষ্ণা? আমি তো তোমার সব কিছু নিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে আছি।

কৃষ্ণা বোধিসত্ত্বের বুকে মুখ ডুবিয়ে তবু কাঁদতে লাগল।

 দিনের পর দিন কেটে যায়। কৃষ্ণার মা হবার দিন যত ঘনিয়ে এল, ততই বোধিসত্ত্বলক্ষ্য করলেন কৃষ্ণা মাঝে মাঝে একা চুপ করে বিষণ্ণ ভাবে বসে থেকে কী যেন চিন্তা করে। এমনকী, কথা বলতে বলতেও অন্য মনস্ক হয়ে যায়। বোধিসত্ত্ব কৃষ্ণার চরিত্রের সঙ্গে এটা ঠিক মানতে পারেন না। সে স্বভাবতই উচ্ছল, সামান্য জিনিস থেকেও আনন্দ খুঁজে পায়। হ্যাঁ, এই সময় মেয়েরা একটু মৃদুভাষিণী, অলসগামিনী হয় বটে, কিন্তু মুখে যে-খুশির আভা লেগে থাকে, সেটা নেই কেন? মেয়েরা সকলেই মা হতে চায়, প্রকৃতি মেয়েদের মধ্যে এই ফাঁদ পেতে রেখেছে, আর তাদের শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও মিশিয়ে রেখেছে গৌরব-বোধ।

নিচতলার ভাড়াটেরা প্রথম দিকে এই দম্পতিকে সুনজরে দেখত না। কারণ এরা অমিশুক। উচ্চ বৃক্ষচূড়ের কপোত-কপোতর মতোই এরা ছাদের ঘরে নিজেদের নিয়েই মত্ত থাকত। কৃষ্ণা গর্ভিণী হবার পর ইদানীং ভাড়াটে বউরা ওপরে আসে। কৃষ্ণাকে নানা রকম উপদেশ দেয়। এটাও প্রাকৃতিক নিয়ম। এক নারী থেকে আর এক নারীতে জ্ঞান সঞ্চারিত হয়ে যায়। গায়কের স্ত্রীটি এ বাড়ির মধ্যে সব চেয়ে দজ্জাল, ঝগড়ায় যার জুড়ি নেই, সেই কিন্তু সব চেয়ে নরম ব্যবহার করে কৃষ্ণার সঙ্গে। কোনও মানুষের যে কোনখানে সঠিক পরিচয়, তা বোঝা শক্ত।

বাড়ির মেয়েরা যখন কৃষ্ণার কাছে আসে, তখন বোধিসত্ত্ব পাশের ঘরে চলে যান। তবু মাঝে মাঝে ওদের টুকরো কথাবার্তা শুনে বুঝেছেন, এ-দেশের মেয়েরা প্রথম সন্তানের আগে বাপের বাড়ি যায়। নিজের মায়ের কাছ থেকেই বেশির ভাগ স্ত্রী-আচার শেখে। কৃষ্ণা এড়িয়ে যায় সে প্রসঙ্গ।

বোধিসত্ত্ব হঠাৎ এক দিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলছ কেন, কৃষ্ণা?

কৃষ্ণা অপ্রস্তুত ভাবে বলল, কই না তো!

বোধিসত্ত্ব হেসে বললেন, হ্যাঁ, তুমি বিরাট একটি শ্বাস ফেলেছ, আমার হাতে এসে লেগেছে সেই গরম হাওয়া। এই দেখো, আমার হাতের রোম সরে গেছে।

কৃষ্ণা চুপ করে রইল।

মানুষ সাধারণত দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখ বা দুশ্চিন্তায়। এর মধ্যে কোনটি হয়েছে তোমার?

 কোনওটাই না। সত্যি নয়।

তোমার কি মনে পড়ছে তোমার বাড়ির কথা? মায়ের জন্য মন কেমন করছে? আজ পর্যন্ত তোমার বাড়ির কথা কিছু বলেনি। আমার মনে হয়, তোমার বাড়ির কারুকে একটা খবর দেওয়া উচিত।

আমার বাড়ি নেই, আমার মা-বাবা কেউ নেই।

তা কি হয়? কেউ না-কেউ নিশ্চয়ই থাকবে। গঙ্গার ধারে যে-দিন তুমি এসেছিলে, সে-দিন নিশ্চয়ই কোনও বাড়ি থেকেই এসেছিলে?

তোমার তাহলে কেউ নেই কেন? তুমিও তো তোমার মা-বাবা, ঘরবাড়ির কথা কিছুই বলোনি আমাকে।

আমার সত্যিই মনে নেই কৃষ্ণা। নিশ্চয়ই আমার ছিল কেউ। মানুষ অযোনিসম্ভূত হয় না। নিশ্চয়ই কোথাও কোনও নারীর গর্ভেই আমি জন্মেছি। তার বুকের দুধ খেয়ে বেঁচেছি, নিশ্চয়ই কারুর না কারুর স্নেহে আমি লালিত হয়েছি শৈশবে, কৈশোরে। গোরুর বাচ্চা পেট থেকে পড়েই লাফায়, কিন্তু মানবশিশুর স্বাবলম্বী হতে অনেক সময় লাগে। রাস্তার ভিখারি-শিশুও পায় ভিখারি-মায়ের স্নেহ। নিশ্চয়ই আমারও কেউ ছিল, কিন্তু আমার কিছু মনে পড়ে না।

এ-রকম কখনও হয়?

হয়েছে তো দেখছি! বোধহয় আমি তোমাদের মতো বাঙালিও ছিলাম না। কারণ এক গাছতলায় যখন আমার জ্ঞান হয় তখন আমি বুঝতাম না তোমাদের ভাষা। কিন্তু আমি জড়ভরতও ছিলাম না, আমার অনেক কিছু মনে পড়ত শুধু নিজের পূর্ব পরিচয় ছাড়া। সে কথা থাক। কিন্তু তোমার নিশ্চয়ই মনে আহে।

মনে থাকলেও আমি সেখানে ফিরে যাব না!

 কিন্তু এ সময় একটা খবর দেওয়া উচিত বোধহয়। ওঁরা যদি কোনও কারণে রেগে থাকেন, আমি ক্ষমা চাইব। আমি নিশ্চয়ই ক্ষমা ভিক্ষা করে নিতে পারব।

না, তার দরকার নেই। সে-সব চুকেবুকে গেছে।

 তবু তোমার মুখে ভয়ের ছায়া দেখি কেন? তুমি কি সন্তান চাওনি?

চাইনি? আমি রোজ স্বপ্ন দেখি, আমার একটি ছেলে হয়েছে, ঠিক তোমার মতো মুখ-চোখ। এক দিন সে এই ঘরে ছোট ছোট পায়ে ঘুরে বেড়াবে। আমি ভয় পাই তোমার জন্য, আমি যে ক’দিন হাসপাতালে থাকব, তোমাকে কে দেখবে? তোমার তো নিজের জিনিস সম্বন্ধে কিছুই খেয়াল থাকে না।

যা পাগল, এটা আবার একটা ভয়ের ব্যাপার নাকি? আমি আগে একলা থাকতাম না?

 আমার এমন হয়েছে, আমি যেন একদিনও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না।

আমি সবসময় তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব।

সবসময়?

যত দিন না মৃত্যু আসে। জন্ম, যৌবনের পর জরা আর মৃত্যু তো আসবেই!

কৃষ্ণা বোধিসত্ত্বের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে ওঠে, থাক, থাক, মৃত্যুর কথা বোলো না এখন। মৃত্যুর কথা শুনতে চাই না!

.

কৃষ্ণার প্রসব-বেদনা উঠল অনেক রাতে। এ সম্পর্কে গায়ক-পত্নী পরামর্শ দিয়ে রেখেছিল যে, আগে থেকে এক জন কোনও ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে কথাবার্তা বলে রাখতে। এই ব্যাপারে সাহায্য করছে স্কুল-শিক্ষকের বেকার ভাই। পাড়ার এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে তার চেনা আছে।

নিচ থেকে সেই ছেলেটি হেঁকে বলল, ও কুমারদা, ট্যাক্সি এসে গেছে!

বোধিসত্ত্ব কৃষ্ণাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি হেঁটে নামতে পারবে,না  তোমাকে তুলে নেব?

 কৃষ্ণার মুখখানা তখন ব্যথায় নীল। যন্ত্রণার চোটে সে মাঝে মাঝে কামড়ে ধরছে নিজের ডান বাহু। আস্তে আস্তে সে উঠে দাঁড়াল, বলল, পারব!

দু’পা এসে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে চেপে ধরল বোধিসত্ত্বের হাত। চেষ্টা করে অনেকখানি দম নিয়ে সে বলল, তোমাকে একটা কথা বলব, বলতেই হবে, তুমি আমাকে যাই ভাবো না কেন, তোমার কাছে আসবার আগে আমি কুমারী ছিলাম না।

বোধিসত্ত্ব চুপ করে রইলেন। কৃষ্ণা আবার বলল, শুনতে পেয়েছ কথাটা? তোমার কাছে আসবার আগে আমি কুমারী ছিলাম না!

বোধিসত্ত্ব বললেন, আমি তো সেরকম কিছু দাবি করিনি। চলো।

 কৃষ্ণা বলল, আরও কয়েকটা কথা বলতেই হবে, ভেবেছিলাম বলবনা, আগের বার আমি আমার পেটের সন্তানকে মেরে ফেলেছি!

বোধিসত্ত্ব তার মায়াময় হাত কৃষ্ণার মাথায় রেখে বললেন, ও-সব কথা পরে নিশ্চয়ই শুনব। এখন চলো।

কৃষ্ণা তবু গেল না। হঠাৎ যেন ব্যথাটা চলে গেছে, শান্ত মুখে বলল, আমি তোমাকে ঠকিয়েছি, যদি সিজারিয়ান হয়, ডাক্তারকে আগেকার কথা বলতেই হবে, তাই তোমাকে বললাম। আমার নিজের মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে…আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলাম, কিন্তু সে ভয় পেল, আমার বাড়ির কেউই রাজি হল না, আমার বাবা ডাক্তার, বাবাই ব্যবস্থা করে আট মাসের সময় নষ্ট করে দিল। তার দশদিন পরেই…আমি থাকতে পারতাম না। সব সময় শুনতাম একটা বাচ্চার কান্না, সেই জন্যই চেয়েছিলাম আত্মহত্যা করতে!

বোধিসত্ত্ব স্থিরভাবে চেয়ে রইলেন কৃষ্ণার মুখের দিকে।

 কৃষ্ণা বলল, এবার তুমি আমাকে ঘৃণা করবে তো?

না।

আমার বাড়ির লোক চেয়েছিল ওই কথা লুকিয়ে অন্য জায়গায় আমার বিয়ে দিতে। কিন্তু আমি লুকোতে পারতাম না, ঠিক বলে ফেলতাম। তোমাকে এত দিন বলিনি, কারণ তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ, আমার নতুন জন্ম হয়েছে, আর আগেকার কিছু নেই।

তোমার আগেকার কিছু সত্যিই তো নেই!

আমাকে ঘেন্না করে তুমি এবার ছেড়ে চলে যাবে। তুমি কত ভাল, তোমাকে আমি ঠকিয়েছি। তোমার মতো মানুষ পাওয়া কত বড় ভাগ্য, কিন্তু আমি যে-।

কৃষ্ণা, আমার মুখের দিকে চেয়ে দেখো। এই কি অবিশ্বাসীর মুখ?

এবার ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল কৃষ্ণা। অসহায় শিশুর মতো মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ওগো, আমার আর কেউ নেই, আমি আর কোথায় যাব? আমার বড় শখ ছিল, একটা বাচ্চা ঘরের মধ্যে ছুটে ছুটে বেড়াবে, তুমি তাকে আদর করবে।

কৃষ্ণা, কৃষ্ণা!

তুমি এই ক’দিনের মধ্যে কোথাও চলে যাবে না, কথা দাও। আমার গা ছুঁয়ে বলো! বলো, বলো, বলো!

এই তো তোমার গা ছুঁয়ে আছি আমি। কৃষ্ণা, আমি কোথাও যাব না।

ওগো, এমন আনন্দ আমি জীবনে কখনও পাইনি। তোমাকে নিয়ে…তুমি আমাকে এতখানি ভালবাসা দিয়েছ, আমার সন্তান, আমার সংসার…ওগো, আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, ক্ষমা ঘেন্না করে আমাকে কাছে রেখো, ছেড়ে যেয়ো না, ছেড়ে যেয়ো না, ছেড়ে যেয়ো না।

বোধিসত্ত্বকে শপথ ভঙ্গ করতে হল না। সন্তানের জন্ম দেবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কৃষ্ণা শেষ নিশ্বাস ফেলল। তার ছেলেটি পরের দেড় দিন যেন ঘোর যোগনিদ্রার মধ্যে রইল, কাঁদলনা, হাসল না, এ পৃথিবীর দিকে একবার চোখ মেলে তাকাল না পর্যন্ত। তারপর, তার মা যেখানে গেছে, সে-ও চলে গেল সেখানে।

.

১০.

 কয়েক মাস ধরে বহু জায়গায় ঘুরলেন বোধিসত্ত্ব। বাড়িঘর, চাকরি-বাকরি সব ছেড়ে দিয়েছেন। ঘুরতে ঘুরতে এক দিন দেখলেন, তার জামা শতচ্ছিন্ন, পকেটে একটা পয়সা নেই, মাথার চুল এসে নেমেছে ঘাড় পর্যন্ত, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। আর শরীরের মধ্যে জ্বলছে এক বাঙ্ময় আগুন। সেই আগুনের শিখা তাকে ডেকে বলল, ওহে পরিব্রাজক, অনেক কিছু তো দেখলে, এবার আবার আমাকে দেখো, নইলে তোমাকে আমি ভস্মসাৎ করব।

বোধিসত্ত্ব প্রায় তিন দিন ধরে কিছু খাননি, শরীরটা দারুণ অবসন্ন, আর চলতে পারছেন না। তিনি বসে পড়লেন একটা মাঠের ধারে। কাছাকাছি কোনও বাড়ি-ঘর নেই, একটা ডোবার পাশে চরে বেড়াচ্ছে তিনটে গোর, আর একটা শিরীষ গাছের ছায়ায় শুয়ে আছে বাচ্চা রাখাল।

বোধিসত্ত্ব একবার ভাবলেন, ওই বাচ্চাটার কাছেই কিছু খাবার চাইবেন। কিন্তু ছেলেটি খাবার এনে দেবে কোথা থেকে? আশেপাশের এমন কোনও গাছপালা নেই যার থেকে কিছু খাদ্য পাওয়া যায়। যত দূর পর্যন্ত দেখা যায়, জমিতে ফলে রয়েছে ধান। ওই ধান এক দিন হাজার হাজার লোককে খাদ্য দেবে। কিন্তু আপাতত এক জন ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ওর কোনও মূল্য নেই।

একটু বাদে রাস্তা দিয়ে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে যেতে লাগল একটা বলদের গাড়ি। সেটা গুড়ের কলসিতে ভরা।

চোখের সামনে খাদ্য দেখে বোধিসত্ত্বর খিদে আরও চনমনিয়ে উঠল, তিনি আর থাকতে পারলেন না। ছুটে গেলেন গাড়িটার সামনে। বৃদ্ধ গাড়োয়ান চোখ বুজে ঢুলছে, ষাঁড় দুটি চলছে অলস মনে।

তিনি লোকটিকে ডেকে বললেন, ভাই, আমাকে একটু গুড় খেতে দেবে?

লোকটি চোখ মেলে বলল, হবে নে! হবে নে!

গাড়িটার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলতে লাগলেন, দাও ভাই, একটু দাও।

গাড়োয়ানের পিছনে এক জন বলিষ্ঠকায় প্রৌঢ় লোক বসে ছিল। সে বলল, এই গুড় খুচরো বিক্কিরি নেই।

বোধিসত্ত্ব বললেন, আমি কিনতে চাইছি না। কেনার মতো পয়সাও নেই আমার। আমাকে এমনিই একটু দান করো!

গাড়োয়ানটি বলল, আরে, মলো যা! ছোট ছেলেপিলেরা এসে গুড় চায়, সে বুঝি এক কথা। আর এ দামড়াটা বলে কী?

গাড়োয়ানের পিছনের লোকটি বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞেস করল, তুমি জোয়ান মরদ। তুমি গুড় ভেঙে খেতে চাচ্ছ কেন?

বোধিসত্ত্ব বললেন, আমার অসম্ভব খিদে পেয়েছে। আমাকে দান করো, সামান্য একটু।

গাড়োয়ান হেঁকে বলল, আরে যা যা যা, পাগল!

 পিছনের লোকটি বলল, আহা, দাও লোকটারে একটুখানি!

গাড়িটি থামল। দয়ালু লোকটি দু’খাবলা আখের গুড় তুলে দিল বোধিসত্ত্বের হাতে। বোধিসত্ত্ব হ্যাংলা মানুষের মতো গপ গপ করে তা গিলে ফেললেন। তারপর একটি তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললেন, আমাকে বাঁচালে। আমার যে-উপকার তোমরা করলে, তার বিনিময়ে আমি কিছু করতে চাই।

গাড়োয়ানটি বলল, ঢের হয়েছে। এবার হঠো সামনে থেকে।

অন্য লোকটি হেসে বলল, ঠিক আছে যাও, ওই সামনের পুকুর থেকে হাত ধুয়ে নাও গে!

বোধিসত্ত্ব দৌড়ে গিয়ে ডোবাটায় হাত ধুয়ে কয়েক আঁজলা জল পান করলেন। ততক্ষণে গাড়িটি আবার চলতে শুরু করেছে। তিনি ফিরে এসে সেটার পাশে ছুটতে ছুটতে বললেন, তোমরা আমাকে ঋণী করে গেলে, আমি কী করে তা শোধ দেব?

গাড়োয়ানটি বলল, আরে, এ যে বড় নাছোড়বান্দা দেখছি! তুমি তো বললে তোমার কাছে পয়সা নেই। ও একছিটে গুড় আমি এমনিই দিয়েছি!

বোধিসত্ত্ব বললেন, পয়সা ছাড়া আর কোনও ভাবে উপকার শোধ দেওয়া যায় না!

অন্য লোকটি বলল, এ তো বেশ মজাদার মানুষ। ভদ্দোর লোক বলে মনে হয়। বোধহয় ভাল বংশের ছেলে ছিল, মাথা বিগড়ে গেছে। ও কত্তা, তুমি কোথা থেকে আসছ, কোথায় যাবে?

বোধিসত্ত্ব বললেন, আমি কোনও জায়গা থেকে আসিনি, আমি কোথায় যাব জানি না! আমি এখন এইখানে আছি, এইটুকুই জানি।

পিছনের লোকটি গাড়োয়ানকে গাড়ি থামাতে অনুরোধ করে বোধিসত্ত্বকে বলল, এসো, উঠে এসো। চলো আমাদের সঙ্গে।

বোধিসত্ত্ব সেই গাড়িতে চড়ে বসলেন।

গাড়োয়ানটির নাম এককড়ি দাস আর অন্য লোকটি দীনু মণ্ডল। এরা যাচ্ছে ঝিকড়দার হাটে। দীন মণ্ডল একটা বিড়ির কৌটো বার করে বলল, নাও। বোধিসত্ত্ব নিলেন একটা বিড়ি। দীনু মণ্ডল ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ভাইডি, তুমি যে এমন পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছ, কোথায় যাবে, তা-ও জানো না, রাত্রে থাকবে কোথায়, খাওয়া জুটবে কোথায়?

এই ক’মাস বোধিসত্ত্ব এ-সব কথা একবারও চিন্তা করেননি। কিন্তু আজ বুঝতে পারলেন, এইবার থেকে ভাবতে হবে। একটু আগে খিদের চোটে তার মাথা ঘুরছিল। পেটের ভেতরের আগুনের শিখাটি সহজে তার দাবি ছাড়বে না। তিনি কিছুই উত্তর দিতে পারলেন না।

দীনু মণ্ডল বলল, ভগবান শরীর দিয়েছেন, স্বাস্থ্য দিয়েছেন, তা কি মিছি মিছি নষ্ট করা উচিত? তোমার বাড়িঘর কোথায়? মা-বাবা কেউ নেই?

বোধিসত্ত্ব বললেন, না, আমার কেউ নেই।

তাহলে অনেকটা নিশ্চিন্দি। একলা মানুষের খোরাকি কোনওক্রমে ঠিক জুটে যায়। আজকালকার দিনে বুড়োবাপ-মা থাকলেও ঝামেলা। আর ঘরে বউ আর গণ্ডাখানেক এণ্ডিগেণ্ডি থাকলে সেগুলোকে খাওয়াতেই তো মুখের রক্ত উঠে যায়।

বলদ-গাড়ির চালক এককড়ি দাস বলল, এখন ধান রেওয়ার মরশুম, এখন মাঠে গিয়ে জন খাটলেও চার টাকা, সাড়ে চার টাকা পেয়ে যাবে।

দীনু মণ্ডল বলল, চলো আমাদের সঙ্গে। একটু কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

ঝিকড়দার হাট তেমন কিছু জমজমাট ব্যাপার নয়। এখানে সেখানে কুমড়ো আর মিষ্টি আলু ডাই করা। কেনার লোকের তুলনায় বিক্রির দ্রব্য কম। মাছ আর গুড়ের জন্য সব জায়গায় মাছি ভ্যান ভ্যান করছে। ওদের দুজনের সঙ্গে হাত লাগিয়ে বোধিসত্ত্ব গুড়ের হাঁড়িগুলো নামিয়ে ফেললেন। ওই গুড়ের মালিক এককড়ি দাস, দীনু মণ্ডল সঙ্গে এসেছে, ফেরার পথে সে তার জমির জন্য পটাস সার কিনে নিয়ে যাবে।

গুড় বিক্রি হয়ে গেল ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই। তারপর এককড়ি দাস ওদের দুজনকে আধ কেনেস্তারা তাড়ি খাওয়াল। ফেরার পথে বড় এক ঠোঙামুড়ি আর তেলেভাজা নিয়ে তিন জনে মিলে খেতে লাগল এক জায়গা থেকে। এককড়ি দাস বিরাট হেঁড়ে গলায় গান ধরলে :

করছি পরের কারণ, সদাই রোদন
আপন কাঁদন তো কাঁদ না
টোকাহীন হলে নাড়ি যুড়ি করি
 খুঁজবে দড়ি পাট বিছানা..

উৎসাহের চোটে সে মাঝে মাঝে বোধিসত্ত্বের পিঠে ঢোল বাজাতে লাগল, আর বলতে লাগল, গাও, তোমরাও গাও। করছি পরের কারণ, সদাই রোদন…।

ওরা বাড়ি এসে পৌঁছল ঘুরঘুট্টি রাতে। বোধিসত্ত্ব আশ্রয় পেলেন দীনু মণ্ডলের বাড়ির শূন্য গোয়াল ঘরে। তার হালের বলদটি মারা গেছে দু’সপ্তাহ আগে।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে বোধিসত্ত্ব শুনতে পেলেন জলের কল কল ধ্বনি। কাছেই কোথাও নদী আছে! কিছু খড় পেতে রচনা করা হয়েছে তার শয্যা। প্রায় তিন দিন পরে পেটে কিছু খাদ্য পড়ায় এবং স্বল্প তাড়ির নেশায় অচিরেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন নিশ্চিন্ত ভাবে।

তার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে এলেন। প্রথম সূর্যের আলোয় নিজেকে তার বেশ পরিশুদ্ধ মনে হল।

দীনু মণ্ডলের বাড়িটি অতি যৎকিঞ্চিৎ ধরনের হলেও তার মধ্যে একটি সৌন্দর্য আছে। একটি ছোট উঠোনের এক পাশে একটি বড় ঘর, অন্য পাশেরটি রান্নাঘর, আর দুদিকে গোয়াল ঘর ও একটি বড় জামরুল গাছ। উঠোনটি তকতকে করে নিকোনো। জামরুল গাছের সাদা ফুল ঝরে পড়েছে উঠোনে। রান্নাঘরের ঢালু চালে লক লক করছে কয়েকটি স্বাস্থ্যবান কুমড়ো ডগা। একটা কুমড়ো পেকে পাটকিলে রঙের হয়ে আছে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে, পিছনের গাছপালার ফাঁকে খানিক দূরে দেখা যায় একটি নদী।

রান্নাঘরের দেয়াল গোবর ছড়া দিয়ে নিকিয়ে দিচ্ছিল এক জন ঘোমটা মাথায় বউ। সে পিছনে ফিরে দেখল বোধিসত্ত্বকে। এক দৃষ্টে চেয়ে রইল কয়েক পলক। বউটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, কিন্তু মুখে দারিদ্রের বা বয়েসের আঁকিবুকি পড়েনি।

বোধিসত্ত্বকে দেখে সে লজ্জা পেল না বা দৌড়ে পালাল না। বরং ফিক করে হেসে ফেলে বলল, তুমি কীরকম মানুষ গো? সারা রাত ওই গোয়াল ঘরে শুয়ে রইলে? তোমাকে ডাঁশে-মশায় ঘুমোতে দিয়েছে একটুও?

বোধিসত্ত্ব ঘাড় হেলালেন।

বউটি আবার বলল, কাল রাতে আমি ভাবলাম, এ বাড়ির মানুষটি বুঝি ঝিকড়দার হাট থেকে একটা হেলে বলদ কিনে আনল। সকালে উঠে দেখি, ও মা, বলদ কোথায়, এ যে এক জন মানুষ! তোমার নাম কী?

কুমার সিংহ!

 এ তো বাবুদের মতো নাম। তুমি এখানে কোথা থেকে এলে? কেন এলে?

 যদি চলে যেতে বলেন, চলে যাব।

ও মা, সক্কালবেলা কেউ কারুর বাড়ি থেকে কোনও মানুষকে তাড়িয়ে দেয়? সে কথা আমি বলেছি? তবে কোথাও খুন-ডাকাতি করে পালিয়ে আসোনি তো? আমরা গরিব লোক, এর মধ্যে যদি আবার পুলিশের হুজ্জোতে পড়ি।

না, আমি সেরকম কিছু করিনি।

দশ দিন আগে ওই ঘরে আমাদের বুধু মরেছে, তারপব ঘরটা ভাল করে সাফ হয়নি পর্যন্ত। ওই ঘরে মানুষ থাকে? আমাদের বাড়ির লোকটির যেমন আক্কেল। রাতেরবেলা আমাকে একবার ডেকে বলবে তো!

তারপর বউটি হঠাৎ চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে উঠে বলল, হঠাৎ গো-মড়ক লাগল। এ গাঁয়ের সতেরটা গোরু সাফ হয়ে গেল। আমাদের বুধু..আদর করলে মুখ তুলে চাইত।

দীনু মণ্ডল এই সময় বেবিয়ে এসে বলল, এ কী, সকাল বেলাতেই মড়াকান্না শুরু করলে কেন? একটা নতুন মানুষ এসেছে বাড়িতে।

বোধিসত্ত্বকে ডেকে বলল, এসো ভাইডি, এখানে এসে বসো। এক গাল মুড়ি খেয়েই মাঠে যাব। চাষের কাজ জানো কিছু?

বোধিসত্ত্ব বললেন, শিখে নেব।

 দীনু বলল, গা-গতরে খাটতে পারলেই শিখে যাবে। প্রথমে তোমাকে আগাছা নিড়ুনোর কাজ দেব, সহজ কাজ।

দীনু মণ্ডলের পরিবারটি বেশি বড় নয়। এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন রয়েছে তিন ছেলে মেয়ে। এর মধ্যে ছেলেটিই ছোট। স্বামী-স্ত্রীর আফশোস শুধু এই, প্রথম সন্তান যদি ছেলে হত, তাহলে সে এত দিন বাপের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধ মিলিয়ে কাজে লেগে পড়তে পারত।

দীনুর নিজস্ব জমি মাত্র আড়াই বিঘে। শুধু এটুকু জমিতে চাষ করে তার সম্বৎসরের খাদ্য জোটে না, তাই আরও কিছু জমিতে সে ভাগ-চাষ করে। হাপাহাপি ভাগ। চাষের খরচা আর পরিশ্রম সব তার। ফসলের অর্ধেক নিয়ে যাবে জমির মালিক। সব জমিই নদীর কিনারায়। সব সময় একটা ভয়, কখন নদী একটা রাক্ষসে জিভ বাড়িয়ে জমি গ্রাস করে নিয়ে যাবে। নদী এখানে বেশ চওড়া, কারণ কাছে সমুদ্র।

আগের বারের ফসল মোটামুটি ভাল হয়েছিল, তাই দীনু মণ্ডলের বাড়িতে বেশ শান্তি আছে। দুবেলাভাত হয়। সকলে আনন্দ করে খায়। বোধিসত্ত্ব কয়েকদিনেই লক্ষ্য করলেন, এদের জীবনযাত্রার প্রয়োজন কত সামান্য। পায়ের জুতো, গায়ের জামার কোনও বাহুল্য নেই। ঘরের ফুটো চাল দিয়ে বৃষ্টির জল পড়লেও এরা তাকে খুব স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়। শুধু দু’বেলা দুটি খেতে পাওয়া, তাতেই যত কিছু আনন্দ। বাড়ির ছোট ছেলেটি বঁড়শিতে এক দিন একটা মাঝারি আকারের কাতলা মাছ ধরে নিয়ে এল নদী থেকে, বাড়িতে একটা উৎসব পড়ে গেল সে-দিন। এক মাস বাদে সে-দিন আট আনার সরষের তেল কিনে আনা হল মুদির দোকান থেকে। রান্নাঘরে ছেলে মেয়েরা মাকে ঘিরে গোল হয়ে বসে রইল উদগ্রীব মুখে। কখন মাছ রান্না হবে। তার আগে তারা মাছের ঝোলের বাষ্পও গন্ধ টেনে নিচ্ছে নিশ্বাসের সঙ্গে। আর শব্দ করছে, আঃ!

বোধিসত্ত্ব কিছুদিন শহরে কাটিয়ে এসেছেন বলেই দেখেছেন সভ্যতার আর একটি দিক। এখানে এসে তিনি উপলব্ধি করলেন, আধুনিক সভ্যতার যেগুলি স্তম্ভ, যেমন, বিমান, রাইটার্স বিল্ডিংস, খবরের কাগজ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, রেডিয়ো, ইন্দিরা, জয়প্রকাশ, ফরেন এক্সচেঞ্জ, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আইসক্রিম, বিদ্যুৎ, মেডিকেল কলেজ–এ-সবের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্কই নেই। এরা আকাশের নিচে নদীর ধারের জমিতে বছরের পর বছর বেঁচে আছে শুধু বেঁচে থাকার জন্য। এদের নিয়তি মানব সভ্যতার রান্নাঘরে নিয়মিত সরবরাহ বজায় রেখে খাওয়া।

বাইরের মানুষ হলেও এই পরিবারটি বোধিসত্ত্বকে বেশ ভালভাবেই গ্রহণ করেছে। দীনুমণ্ডলের স্ত্রীর কোনও এক সময়ে নিশ্চয়ই একটা নিজস্ব নাম ছিল, কিন্তু এখন তার নাম মঙ্গলার মা। মঙ্গলা বিয়ের পর চলে গেছে তমলুকের পাশের এক গাঁয়ে। মঙ্গলার মা বোধিসত্ত্বকে ছেলে ছেলে বলে ডাকেন। অ ছেলে, রান্নাঘরের খুঁটির দড়িটা একটু বেঁধে দাও তো! অ ছেলে, হ্যারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করতে জানো? দেখি তো কেমন পারো! এইভাবে কথা বলে সে বোধিসত্ত্বের সঙ্গে। এই মানুষটিকে পেয়ে সে তার নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রের অভাবটা যেন মিটিয়ে নিচ্ছে। গোড়ার দিকে দু-একবার সে অবশ্য বলেছে, তুমি বামুন নও তো? কী জানি বাবা! বামুনকে দিয়ে এসব ছোট কাজ করালে আমার পাপ হবে।

বোধিসত্ত্ব হেসে বলেছেন, না, আমি বামুন নই।

সারা দিন বোধিসত্ত্ব দীনু মণ্ডলের সঙ্গে মাঠে গিয়ে কাজ করেন। রোদ-বৃষ্টি সব মাথার ওপর দিয়ে যায়। দুপুরবেলা মঙ্গলার পরের বোন সুহাসিনী পান্তা নিয়ে আসে, খেজুর গাছের ছায়ায় বসে খাওয়া সেরে নেয় দু’জনে। সন্ধের পর বাড়ি ফিরে বোধিসত্ত্ব ছেলে-মেয়ে তিনটির সঙ্গে গল্প করেন, এক-এক দিন তাদের মুখে মুখে অঙ্ক শেখান।

নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক দিন বোধিসত্ত্ব চলে গিয়েছিলেন সমুদ্র পর্যন্ত। খুব বেশি দূরে, ক্রোশ তিনেকের পথ। সমুদ্রের সামনে তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ। কোনও সমুদ্রই অকুল নয়। এ সমুদ্রের পরপারেও আছে অন্য দেশ, অন্য মানুষ, অন্য সমাজ। তবু এখানে দাঁড়ালে এক অপার অসীমের অনুভূতি হয়। মানুষের জীবন যত ক্ষুদ্রই হোক, তবু সে অসীমকে জানতে চেয়েছে।

পথে এক জায়গায় তিনি দেখেছিলেন ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। সামনেই নদী। সেই নদীর বুকে দুলছে কয়েকটি মাছধরার নৌকো। দৃশ্যটি দেখেই বোধিসত্ত্বের শরীরে একটা ঝাঁকুনি লেগেছিল। কৃষ্ণা ঠিক এমনই একটি চায়ের দোকানের কথা বলেছিল, যেখানে সে বোধিসত্ত্বের পাশে বসে দেখবে নদীর ওপরে বৃষ্টি পড়া। কোথায় চলে গেল কৃষ্ণা? তার অতৃপ্ত ইচ্ছেটা কি ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানকার বাতাসে?

বোধিসত্ত্বের চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। তিনি বুঝতে পারলেন, এর নাম মায়া। মানুষ মরে গেলে আর কিছুই থাকেনা, শুধু একটুখানি মায়া থেকে যায়। সেই মায়াই শোক হয়ে কারুকে কারুকে কাঁদায়।

দুমাসের মধ্যেই বোধিসত্ত্ব এখানে রীতিমতো পুরনো হয়ে গেলেন, যেন তিনি এই চাষি পরিবারেরই এক জন। জন্ম থেকেই রয়েছেন এখানে।

তিনি যে আলাদা রকমের মানুষ সেটা আবার হঠাৎ বোঝা গেল এক দিন। সে-দিনও বোধিসত্ত্ব মাঠে কাজ করছিলেন। নতুন ধানের বীজতলা করা হচ্ছে। চারপাশের জমির সব চাষিরাই ব্যস্ত। এই রকম সময় আলের ওপর দিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে এলেন দু’জন সুসজ্জিত চেহারার বাবু। তারা এসে দাঁড়ালেন, যে-জমিতে পটলের চাষ দেওয়া হয়েছে, সেই পটল খেতের পাশে।

বোধিসত্ত্ব তাকিয়ে রইলেন ওই দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কে?

দীনু বলল, তুমি এই যে-জমিতে বসে কাজ করতেছ, এটা হল ওই বাবুদের জমি। ওনাদের এক লপ্তে চল্লিশ বিঘে জমি আছে এখানে। তার মধ্যে মোট সাত বিঘে আমি চষি।

ওই মাঠের মধ্যে ওই বাবু দু’টির উপস্থিতি কেমন যেন বেমানান। ওদের ফর্সা ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে জুতো, চোখে রোদ-চশমা –এ-সবই যেন অনেক দূরের জিনিস।

এক জন লোক পকেট থেকে একটা গোটানো প্লাস্টিকের থলি বার করল। তারপর জমিতে নেমে পটাপট করে ছিঁড়তে লাগল কয়েকটা পটল। সেই জমির চাষিটি দৌড়ে এসে বাবুদের ভাল পটল বেছে দেবার জন্য সাহায্য করতে লাগল।

এক জন বাবু আরেক জনকে বলল, এ-সব টাটকা জিনিস, এব স্বাদই আলাদা। ক্রমে বেড়াতে বেড়াতে সেই লোক দুটি এ-দিকে চলে এল। দীনুকে বলল, ও মণ্ডল, এবার তো বৃষ্টির শুরুটা ভালই হয়েছে, এবার ফসল ভালই হবে, কি বলো?

দীনু উঠে দাঁড়িয়ে বিগলিত ভাবে হেসে বলল, হ্যাঁ বাবু, মনে তো করি!

এবার কত হবে? বিঘেয় বিশ মণ হবে?

তা কী করে বলি এখন? ভগবানের যদি দয়া হয়– ।

গেল বছর অজু শেখ ফলিয়েছিল আঠারো মণ, আর তুমি আমাকে হিসেব দিলে সাড়ে তেরো মণের!

আর বাবু সবই যেত, যেমন পোকা লেগেছিল, বাঁচিয়েছি অতি কষ্টে।

অজু শেখের ধানে পোকা লাগল না! যত পোকা তোমার ধানে। দেখো বাপু, ঠকিয়ো না, ধর্মে সইবে না।

এই মাঠের মধ্যে ধর্ম কথাটা উচ্চারিত হতে শুনে বোধিসত্ত্ব কৌতুক বোধ করলেন। এটা কোন ধর্ম? বাপ-ঠাকুরদা জমি রেখে গেছে বলে, সেই মালিকানার সুবাদে এই ফর্সা জামাকাপড় পরা মানুষ নিয়ে যাবে জমির অর্ধেক ফসল। আর যে-মানুষটি বীজ ধান কিনবে, সার কিনবে, ঠা-ঠা রোদ্দুরে মাসের পর মাস খেটে ফসল ফলাবে, পোকা-মাকড় তাড়াবে সে পাবে অর্ধেক। এর পরেও ছাতা মাথায় দিয়ে এসে এক জন বাবু তাকে শোনাবে ধর্মের কথা!

এক জন লোক বোধিসত্ত্বকে লক্ষ্য করে দীনুকে জিজ্ঞেস করল, এই লোকটা কে? আগে তো একে কখনও দেখিনি।

দীনু বলল, বাবু, ও আমার সঙ্গে কাজ করে।

ও এল কোথা থেকে? চাষির ঘরে এ-রকম ফর্সা মানুষ তো দেখা যায় না।

অন্য বাবুটি নিচু গলায় বলল, বেজন্মা হতে পারে। ওর মা বোধহয় কোনও ভদ্দরলোকের বাড়িতে কাজ করত।

প্রথম বাবুটি বলল, না ভাই, ভয় করে। যদি কোনও নকশাল-ফকশাল এসে ঢোকে এই এলাকায়। এই, এ-দিকে এসো তো!

বোধিসত্ত্ব উঠে দাঁড়িয়ে হাতের মাটি ঝেড়ে এগিয়ে গেলেন। তার পরনে একটা খাটো ধুতি, খালি গা।

তোমার নাম কী?

কুমার।

 তুমি এখানে কদ্দিন এসেছ?

তিন মাস হবে বোধহয়।

আগে কোথায় ছিলে? আগের জায়গা ছেড়ে এখানে কেন এসেছ? তোমাকে দেখে তো চাষি মনে হয় না!

এক জন লোক আরেক জনের দিকে ফিরে বলল, না ভাই, ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না। একটা অচেনা লোক গাঁয়ের মধ্যে এসে যদি লুকিয়ে থাকে, বুঝতে হবে নিশ্চয়ই কোনও গণ্ডগোল আছে।

দীনু দৌড়ে এসে বোধিসত্ত্বকে আড়াল করে বলল, না বাবু, এ আমার এক দূর সম্পর্কের ভাই হয়। মানুষটা ভাল, মাথার একটু গোলমাল আছে। কিন্তু কাজকর্ম ঠিক করে।

দেখো বাপু! ঠিক ভাই হয় তো? অচেনা লোককে গাঁয়ে ঢুকিয়ো না। দিনকাল ভাল নয়।

লোক দুটি বোধিসত্ত্বের দিকে সন্দেহজনক ভাবে তাকাতে তাকাতে চলে গেল।

দীনু বলল, হু! যত সব হুজুগে কথা। এই বাবুটি সব সময়ই চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলেন। এঁয়ার বাবা ছিলেন ভাল মানুষ, দেবতুল্য লোক।

বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, এটাও একটা মজা যে, সব সময়েই আগের লোকটি বা আগের জিনিসটি ভাল থাকে।

কিছুক্ষণ মুখ বুজে কাজ করলেন বোধিসত্ত্ব। ভূমি যেন এক দর্পণ, তার মধ্যে তিনি দেখতে পাচ্ছেন অনেক কিছু। হঠাৎ এক সময় বললেন, দীনুদা, একটা গল্প শুনবে?

দীনু বলল, কও দেখি শুনি।

বোধিসত্ত্ব বললেন, অনেক দিন আগে, অনেক দূরের একনগরে যেত এক ফেরিওয়ালা। সে তার জিনিসপত্র চাপিয়ে নিয়ে যেত এক গাধার পিঠে। নগরে গিয়ে পথের ওপর জিনিস সাজিয়ে বসবার পর গাধাটাকে নিয়ে হত এক ঝঞ্ঝাট। সেটা এক জায়গায় বাঁধা থাকতে চায় না, আবার এ-দিক ও-দিক ঘুরে বেড়ালে ছোট ছোট ছেলেরা তার গায়ে ঢিল মারে। তখন সেই ফেরিওয়ালা এক বুদ্ধি বার করল।

কী বুদ্ধি?

ফেরিওয়ালা করল কী, একটা সিংহের চামড়া জোগাড় করে ফেলল। শহরে পৌঁছে জিনিসপত্র নামিয়ে নেবার পর গাধাটাকে শহরের বাইরের গ্রামে ছেড়ে দিত ওই সিংহের চামড়াটা পরিয়ে। তখন গাধাটা সিংহের চামড়া পরে ঘুরে বেড়াত নিশ্চিন্তে। সবাই তাকে দেখে ভয়ে পালাত।

দীনু হো হো করে হেসে বলল, বা রে, বা! ফেরিওয়ালার তো খুব বুদ্ধি! সাবাস! তুমি ভাল গল্প বলেছ, ভাইডি।

বোধিসত্ত্ব বললেন, গল্প এখনও শেষ হয়নি। গাধাটা গ্রামের মাঠে ঘোরে। চাষিরা সবাই তাকে দেখে ভয়ে পালায়। চাষবাস সব বন্ধ হয়ে গেল। চাষিদের ক্রমে না খেতে পেয়ে মরার উপক্রম। তখন এক দিন আমি বললাম–।

তুমি ছিলে সেখানে? তুমি নিজে দেখেছ এটা?

বোধিসত্ত্ব গল্পটা একটু ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, সেখানকার চাষিদের মধ্যে একজন বলল একদিন, এটা যদি সিংহ হয়, তবে সিংহের মতো ডাকেনা কেন? তখন সেই চাষিটি একদিন সাহস করে কাছে গিয়ে দেখল সেই সিংহ ঠিক গাধার মতো মাঠের আগাছা খাচ্ছে। তখন সে অন্য চাষিদের ডেকে বলল, ভাইসব, এটা সিংহ নয়, এটা একটা গাধা। তখন সবাই মিলে এসে তাড়া করতেই গাধাটা দৌড়ে পালাল, আর কোনও দিন সে মাঠ আসত না।

দীনু বলল, বাঃ, বেশ গল্প। মজাদার গল্প। তুমি তো অনেক ভাল ভাল গল্প জানো।

বোধিসত্ত্ব বললেন, দীনুদা, এই যে বাবুরা এসেছিল একটু আগে, এদের গায়েও সিংহের চামড়া জড়ানো। এরা আসলে সিংহ নয়। সবাই মিলে তাড়া করলেই এরা পালাবে।

দীনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বললে তুমি? বাবুরা সিংহের জামা গায়ে দিয়েছে? হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ! এ যে বড় আজব কথা।

তখন বোধিসত্ত্বকে ব্যাপারটি আরও বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দিতে হল। তিনি বললেন, দীনুদা, আমি নিজে আগে জমিতে কাজ করিনি বলে ব্যাপারটা বুঝিনি। ওই চশমাপরা বাবুরা যখন নিজেদের ব্যাগে পটল ভরে তুলে নিয়ে গেল, তখন আমার চোখ খুলে গেল। এক জন গায়ের রক্ত জল করে জমিতে ফসল ফলাবে আর অন্য জন বিনি মাগনায় সেই ফসলের ভাগ নিয়ে যাবে, এ হতে পারে না।

দীনু বলল, উরি সর্বনাশ? তুমি কী মতলবে গায়ে এসেচ ঠিক করে বলো তো ভাইডি! ওই বাবুরা যে বলল, তুমি কি সত্যিই নকশাল নাকি গো?

বোধিসত্ত্ব বললেন, নকশাল কাদের বলে আমি জানি না। আমি কেউ নই। কিন্তু আমি যা বললাম, সেটা ঠিক কি না বলো।

দীনু মুখ ঘুরিয়ে তাকাল বোধিসত্ত্বের দিকে। তার মুখে একটা দুঃখের ছায়া পড়ল। খুব আস্তে আস্তে বলল, ভাইডি, ও-সব কথা বোলো না। ও-রকম কথা অনেক শুনেছি। আমাদের কপালে যা আছে, তাই হবে। এই দ্যাখো না, মেজো মেয়েটার বিয়ে দেওয়ার সময় আবার বেচতে হবে জমি!

বোধিসত্ত্ব তবু ভাবলেন, এক দিন মাঠের সব চাষিদের ডেকে এই গল্পটা শোনালে কেমন হয়। সবাই কি বলবে, কপাল? সবাই মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করবে? সুহাসিনীর দিকে এর পরে যখনই তিনি তাকান, তার মনে পড়ে, এই মেয়েটার দাম দেড় বিঘে জমি।

সুহাসিনীর ডাক নাম সুষি, তার বয়েস চোদ্দো কিংবা পনেরো। তার জন্য চতুর্দিকে পাত্র খোঁজা হচ্ছে। আট হাজার টাকা পণের কম কোনও সুপাত্র দেওয়া সম্ভব নয়। তার সঙ্গে আরও খরচাপাতি আছে। দীনুর দো-ফসলা জমি, তবু তার দাম ছ’হাজার টাকায় বিঘের বেশি ওঠেনি। জমির দরাদরি পাত্রপক্ষের সঙ্গে দরাদরি একই সঙ্গে চালাতে হচ্ছে তাকে।

এক দিন বোধিসত্ত্ব শুনতে পেয়েছিলেন, দীনু আর মঙ্গলার মা তার সম্পর্কেই আলোচনা করছে।

মঙ্গলার মা বলল, হ্যাঁ গো, আমাদের এই কুমারের সঙ্গেই সুষির বিয়ে দাও না কেন? তাহলে আর জমি বেচতে হবে না, ছেলেটিও বেশ ঠাণ্ডা, কাজ-কর্মের।

দীনু ধমক দিয়ে বলেছিল, কী মাথা খারাপের মতো কথা কও! ওর কোন জাত তার কিছু ঠিক আছে? হুট করে বিয়ে দিলেই হয়?

মঙ্গলার মা বলল, আমরা কৈবর্ত, আমাদের চেয়ে আর কি নিচু জাত হবে?

দীনু বলল, নিচু জাত না হয়ে বামুন-কায়েত হলেই-বাকি সুরাহা হবে? সমাজে পাঁচ জন ছ্যা-ছ্যা করবে না? তাছাড়া ও কবে আছে, কবে চলে যায়, তার ঠিক কী?

বোধিসত্ত্ব আর বেশি শোনেননি, তিনি চলে গিয়েছিলেন। তার মুখে মৃদু হাস্য। সংসার-ধর্ম তার দেখা হয়ে গেছে, তিনি আর ওর মধ্যে প্রবেশ করবেন না। তিনি এখন চান মাটি ও মানুষের নিবিড় সম্পর্ক। এই দিকটা সম্পর্কে তার কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি এসে তার খেয়াল হয়েছিল, তিনি প্রায় দেড় বিঘে জমিই পেরিয়ে এসেছেন। সুষির বিয়ের দাম এতখানি জমি। দীনুর নিজস্ব আড়াই বিঘের মধ্যে দেড় বিঘে বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। নইলে সমাজের নিন্দে হবে!

এক দিন রাত্রে শুয়ে শুয়ে বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, আমি যেখানে যাই, সেখানেই কি দুর্ভাগ্য নিয়ে আসি?

এই চাষি পরিবারটিকে ঘিরেও ঘনিয়ে আসছে একটা মহা বিপদের সম্ভাবনা। তিন দিন ধরে অজস্র ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে অবিরাম ঝোড়ো হাওয়া। সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে উঠছে, নদীতে ছলাৎ ছলাৎ করছে লকলকে ঢেউ। মাঝে মাঝে ঝুপঝাপ শব্দে পাড় ভেঙে পড়ছে। নদী এখন বইছে দীনুর নিজের জমির ধার ঘেঁষে।

বিপদ এখন তিন রকম। নদীর ভাঙনে দীনুর সমস্ত জমি এমনকী বাড়িটা পর্যন্ত চলে যেতে পারে এবার। সমুদ্রের জল ঢুকে পড়তে পারে যে-কোনও সময়। একবার সেই নোনা জল ঢুকলে দু’বছরের মতো চাষ বন্ধ। অথবা অতি বৃষ্টিতে জমিতে বেশি জল দাঁড়িয়ে যেতে পারে। সব জমিতে এখন ধান। ধানের চারার বয়েস মাত্র সওয়া এক মাস, সেই কচি কচি চারা বেশি জল সহ্য করতে পারবে না। ডুবো জল হলেই পচে যাবে।

বোধিসত্ত্বর মনে হল, এখন এই চাষি পরিবারটির জমি, বাড়ি এবং ধান বাঁচাবার চেয়ে আর কোনও বড় কাজ নেই। কিন্তু কোন উপায়ে বাঁচানো যাবে? হঠাৎ এখন থেকে সব আনন্দ উবে সকলের বুকের মধ্যে গুরগুর করছে ভয়। নদী এগিয়ে আসছে, সমুদ্র এগিয়ে আসছে, আকাশ ভেঙে জল পড়ছে। এর কোনওটাকেই রোখবার সাধ্য নেই কারুর। কত রকম সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বীজাণু থেকে শুরু করে হাজার রকম পোকামাকড়, এমনকী প্রকৃতি পর্যন্ত যেন সব সময় ষড়যন্ত্রে মেতে আছে মানুষের বিরুদ্ধে। মানুষের জীবনে এক অনন্ত যুদ্ধ। জীবন-ডোর অসংখ্য দুঃখ। তবু তো এ দুঃখ থেকে সরে যেতে ইচ্ছে করে না।

চড়াৎ করে একটা বিদ্যুতের ঝলকে বিশ্বচরাচর যেন ঝলসে গেল। তারপর গর্জন উঠল সারা আকাশে। সেই মেঘের ধ্বনির মধ্যে শোনা গেল এক কণ্ঠস্বর।

বোধিসত্ত্ব তাড়াতাড়ি উঠে এসে দরজার কাছে দাঁড়ালেন। অন্ধকার আকাশ থেকে এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বলে উঠল, হে মৈত্রেয়, আপনি কোথায় আবদ্ধ হয়ে রয়েছেন? হে বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়, আপনি তুষিত স্বর্গ ছেড়ে এই মাটির পৃথিবীতে এসেছেন লুপ্ত সত্য পুনরুদ্ধারের জন্য। আমরা প্রতীক্ষা করে আছি। আপনি সত্যের প্রকাশ করুন।

বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, আসলে হয়তো কেউ বলছে না, তিনি নিজেই এর উদ্ভাবন করছেন। তার নিজের চিন্তাই প্রতিফলিত হচ্ছে আকাশের মেঘগর্জনে।

তিনি ফিস ফিস করে বলে উঠলেন, না, আমি নই! আর কেউ আসবে, সে উদ্ধার করবে সত্যের। আমি এখনও বুঝলাম না প্রকৃত সত্য কী। আমি এত ঘুরলাম, এত দেখলাম, তবু কোনও মহত্তর সত্যের সন্ধান পেলাম না। মানুষের জীবনের একটা সত্য– সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকা। তার চেয়ে বড় সত্য আছে? অন্য কেউ এসে সেই সত্যকে খুঁজে দিয়ে যাক।

তিনি আবার নিজেকে শুনিয়ে বললেন, এত যুদ্ধ, এত দুঃখ, তবু মনুষ্য-জন্মকে আমার প্রিয় লাগল। আমি নিবৃত্তি মার্গ দেখাতে পারব না মানুষকে। আমি মানুষকে তার নিজস্ব এক জীবনে সুখী দেখতে চাই।

ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে বোধিসত্ত্ব দেখলেন বৃষ্টি একেবারে কমে গেছে, কাঁচা সোনার মতো রোদ এসে পড়েছে তার ঘরে। তিনি আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। চার দিন পর এই প্রথম রোদ। আজ সারা দিন যদি রোদ থাকে, তবে রাতে নামুক না আবার বৃষ্টি। দিনে রোদ, রাতে জল এটাই সব চেয়ে ভাল, ধান গাছের সুস্বাস্থ্যের জন্য।

তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাইরে। দীনুরা কেউ এখনও ওঠেনি। বোধহয় কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। তিনি ওদের ডাকলেন না, একা ছুটতে লাগলেন মাঠের দিকে। তিনি নিজের হাতে ধানের চারা রয়েছেন, ওদের প্রতি তার যেন বাৎসল্য জন্মে গেছে।

তিনি এসে দাঁড়ালেন একেবারে জমির মধ্যে। যথেষ্ট জল জমে আছে জমির মধ্যে। কিছু চারা নেতিয়ে পড়েছে জলে, কিছু কিছু এখনও মাত্র এক ইঞ্চি মাথা উঁচু করে আছে। আজ সারা দিন যদি রোদ থাকে, তাহলেই টেনে যাবে অনেকটা জল। নদীর জল কানায় কানায় এসে পৌঁচেছে। সমুদ্র আর একটা ঠিলা মারলেই আর রক্ষে নেই। আজ যদি বৃষ্টি না হয়, ঝড় থেমে থাকে, তবে শান্ত হবে সমুদ্র, সংযত হবে নদীর ঢেউ।

সেই মোহময় তরুণ সবুজ রঙের খেতের মধ্যে ঘুরতে লাগলেন বোধিসত্ত্ব। যত্ন করে, খুব নরম হাতে তুলে দিতে লাগলেন নুয়ে পড়া চারাগুলো। তীক্ষ্ম চোখে দেখতে লাগলেন কোনও গাছে পোকা লেগেছে কি না, এক জায়গায় আল ভেঙে গিয়েছিল, তিনি কাদামাটি ঘেঁটে সে জায়গা আটকে দিলেন।

বোধিসত্ত্ব বুঝতে পারলেন, কেন জমির সঙ্গে এত মায়া লেগে আছে। এই সব জমি যেন নারীরই মতো, পুরুষের কাছ থেকে অনবরত আদরযত্ন চায়। তার বিনিময়ে জমি প্রসব করে ফসল। চাষিরাই জমির আসল স্বামী বা প্রেমিক। আর দূর থেকে এসে যে-সব বাবু এই ফসলের ভাগ চায়, তারা ব্যভিচারী।

বোধিসত্ত্ব আনন্দিত চঞ্চল হয়ে ভাবলেন, এবার চাষিদের ডেকে তিনি এই সরল অঙ্কগুলো বোঝাবেন। অঙ্ক মিলিয়ে দিতে হবে, তাহলে তারা ঠিক বুঝবে। দীনু যতখানি জমি চাষ করে, তার সবটা ফসলই যদি সে নিজে পেত তাহলে তাকে মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করতে হত না। এটা খুব সরল অঙ্ক। সুহাসিনীর বিয়ে হোক, সে সুখে থাকুক, কিন্তু সে-জন্য সে তার বাবা-মাকে নীরস করে দিয়ে যাবে কেন? আহা, বেচারা সুহাসিনী নিজেও এটা বোঝে না। তাকেও এই সরল অঙ্ক বোঝাতে হবে।

তিনি দাঁড়ালেন এসে একেবারে নদীর ধারে। একটা বটগাছের তলা থেকে খসে গেছে অর্ধেক মাটি। শিকড়গুলো ঝুলে আছে জলের ওপর। যেন কোনও দৈত্যের আঙুল। আর কয়েকটা ঢেউয়ের ঝাপটা লাগলেই গাছটা ঢলে পড়বে নদীতে। এত বড় একটা প্রাণবন্ত গাছ। এই গাছের ওপরেই দীনু মণ্ডলের জমি।

একটু বাদেই নদীর জল কালো হয়ে এল। সর সর শব্দ হল গাছের পাতায়। বোধিসত্ত্ব চমকে ওপরের দিকে তাকালেন। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল! হঠাৎ যেন বন্ধ হয়ে গেল নিশ্বাস। একটা বিশাল কালো মেঘ উড়ে আসছে পশ্চিমের আকাশ থেকে। সেই সঙ্গে জোরে জোরে বইছে হাওয়া। এই মেঘ দেখলে সন্দেহ থাকে না, এরা প্রবল বর্ষণ নিয়ে আসে।

মেঘটা কাছে এসে গেল। বাতাস তখন ঝড়ের রূপ নিয়েছে। বোধিসত্ত্ব টের পেলেন, মেঘটা হু-হু করে নেমে আসছে নিচে, বিশাল কালো রূপ নিয়ে তাকে ভয় দেখাতে চাইছে। তারপর একসঙ্গে শত শত কামান দেগে উঠল। এবারও মনে হল, সেই মেঘগর্জনের কোনও ভাষা আছে।

এখন এই আকাশ, এই মেঘকে মনে হয় জীবন্ত। পৃথিবীর ওপর ভয়াল ছায়া মেলে সবসুদ্ধ নেমে আসছে নিচে। মানুষকে বলতে চাইছে, দেখো, তোমরা কত অসহায়।

মেঘের হুঙ্কারে বোধিসত্ত্ব স্পষ্ট শুনতে পেলেন এক ডাক। আজ আর মৈত্রেয় নয়, আজ মেঘ তাকে ডাকছে, কুমার সিং! কুমার সিং! এখনও ফেরো।

বোধিসত্ত্ব বুঝতে পারলেন না, তিনি কোথায় ফিরবেন। মেঘ কেন তাকে ডাকে? ফেরা মানে কি পালিয়ে যাওয়া?

তিনি বলে উঠলেন, আমি গ্রাহ্য করি না।

বৃষ্টির ঠিক আগের মুহূর্তে জমি থেকে ফরফর করে উড়ে গেল অসংখ্য পোকা। এরাও আকাশের ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় যেন।

বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, মানুষের সঙ্গে লড়াই করা যায়, সিংহ চৰ্মাবৃত গর্দভের চামড়া খুলে আসল রূপটা দেখিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে কী করে লড়বেন? প্রকৃতি কোন প্রতিশোধের বাসনায় মানুষকে কষ্ট দিতে আসে? এই ভয়ঙ্কর মেঘ ও ঝড় যেন সমস্ত ফসল নষ্ট করে জমি ভাসিয়ে দিতে আসছে কেন? কেন? সর্বস্বান্ত চাষিরা এর পরও মাথায় হাত দিয়ে বলবে, সবই ভগবানের ইচ্ছে। তারা প্রকৃতি চেনে না।

মেঘের গর্জন শুনে অনেক চাষিই ঘুম ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল, আকাশ চিরে বজ্রপাত হতেই তারা ভয় পেয়ে দৌড়ে ফিরে গেল। বজ্রপাতের সময় ফাঁকা মাঠে কেউ থাকে না।

কিন্তু বোধিসত্ত্ব ফিরে গেলেন না। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন সোজা হয়ে।

মেঘ আবার ডেকে উঠে বলল, কুমার সিং! কুমার সিং! এখনও ফিরে এসো।

বোধিসত্ত্ব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। সেই মেঘের উদ্দেশে তিনি বললেন, তুমি যতই ভয় দেখাও, আমি অমর মানুষ! তুমি যতই বর্ষণ করো, যতই ঝড় ওঠাও, তুমি সমুদ্রকে উত্তাল করো, নদীকে টেনে আনো কূলের ওপর, তবু আমরা মরবনা। অথবা আমি মরব, আর-একজন কেউ আসবে। তোমাদের বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষ তার বেঁচে থাকাটা সার্থক করে যাবে।

বোধিসত্ত্ব তাঁর ডান হাতের মুষ্টি তুলে ধরলেন আকাশের দিকে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়