এর বাড়ি ওর বাড়ি – উপন্যাস – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রথম অধ্যায়

০১.

মানুষের মৃত্যুর সময় নাকি শৈশব ফিরে আসে? সিরাজুল চৌধুরী বলেন, তাহলে কি আমার শেষ সময় ঘনিয়ে এল? রিপোর্ট এসে গেছে এর মধ্যে?

চোখ বুজলেই তিনি একটি বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছেন। দশ-এগারো বছর বয়েস, ইজের পরা, খালি গা, ডান বাহুতে একটা তাগা বাঁধা। এই বালকটি কে? তিনি নিজেও একটু একটু চেনা লাগছে ঠিকই। তার ওই বয়সের কোনও ছবি নেই, তখনকার দিনে ছবি তোলার তেমন রেওয়াজছিল না। এখন পোলাপানদের হাতেও ক্যামেরা থাকে। সেই সময় ছবি তোলাতে হত দোকানে গিয়ে।

ছেলেটি একা সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে নেমে আসছে। বার বার ওই একই দৃশ্য। কীসের যেন ব্যস্ততা, হুড়মুড় করে নামছে। যে-কোনও মুহূর্তে আছাড় খেয়ে পড়তে পারে। এই দৃশ্যটা তিনি দেখছেন কেন? এর তাৎপর্য কী?

সিরাজুল চৌধুরী চোখ মেলে তাকালেন। নার্সিংহোমের কেবিন। সাদা ধপধপে দেয়াল। পায়ের দিকে একটা জানলা। সেই জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায় না। মাঝখানে একটা পুকুর আছে। তার ও-পারে পাশাপাশি দুটি আকাশচুম্বী বাড়ি। আগে বলা হত স্কাইস্ক্র্যাপার, এখন বলা হয় মাল্টিস্টোরিড বিন্ডিং।

পেটজোড়া ব্যান্ডেজ, কিন্তু শরীরে বিশেষ ব্যথা-বেদনা বোধ নেই। একট ঘুম ঘুম ভাব আছে। সকালে হরলিক্স আর বিস্কুট দিয়েছিল, খেতে কোনও অসুবিধে হয়নি। তারপর খবরের কাগজ পড়তে পড়তে আবার ঘুম এসে গেল। রাত্তিরে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল, দিনেরবেলাতেও তার জের থাকে।

ওই বালকটিকে দেখা মানে কি তিনি নিজের বাল্যকাল দেখছেন? এখুনি মরে যাবেন, এটা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। একটু খিদেখিদে পাচ্ছে। মৃত্যুর আগে কি মানুষের খিদে পায়? ক্ষুধা-তৃষ্ণাই তো বেঁচে থাকার লক্ষণ।

বিছানার পাশে একটা সুইচ আছে। সেটা টিপলেই নার্স আসে। হাত দিয়ে সুইচটা খুঁজতে লাগলেন, তার মধ্যেই এক জন নার্স ঘরে ঢুকল।

নার্সটির বয়স বছর পঁয়তিরিশের হবে, স্বাস্থ্য ভাল, মুখখানি কমনীয়। বেশ ফিটফাট পোশাক। নার্সদের একটু দেখতে ভাল হলে মনটা ভাল লাগে। সেদিক থেকে ঠিক আছে, কিন্তু এই নার্সটির ব্যবহার বড় যান্ত্রিক। গলার আওয়াজটাও কর্কশ। অনেকটা কাকাতুয়া পাখির মতো।

নার্সটি বলল, হাঁ করুন, আপনার টেম্পারেচার নেব!

 সিরাজুল চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন, আমি কেমন আছি?

 নার্সটির ভুরু কুঁচকে গেল। বলল, কেমন আছেন, তা তো আপনিই ভাল জানবেন!

সিরাজুল চৌধুরী বললেন, আমার তো মনে হয়, আমি এখন বেশ ভালই আছি।

নার্সটি বলল, তাহলে ভালই আছেন। নিন, হা করুন!

সিরাজুল চৌধুরী এর পরেও জিজ্ঞেস করতে চাইছিলেন, আমি যদি ভাল থাকি, তাহলে আমি চোখ বুজে বার বার একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি কেন?

কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলেন, এমন একটা প্রশ্ন করলে ওর কাছে ধমক খেতে হবে।

মুখে থার্মোমিটার ঢোকানো থাকলে কথা বলা যায় না। নার্সটি বিছানা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজুল তার শরীরের গড়ন ও রেখা দেখছেন। লোকে তাকে বুড়ো মানুষ মনে করে, চুল সব পেকে গেছে, কিন্তু শরীরের রসকষ এখনও শুকিয়ে যায়নি। এখনও স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীলোকদের দেখলে মনটা চনমনে হয়। এত বড় একটা অপারেশন হয়েছে, এই অবস্থাতেও মেয়েটি কপালে হাত রাখলে মনে হয়, আরও খানিকক্ষণ রাখুক।

থার্মোমিটার তুলে নিয়ে নার্সটি বলল, সত্যিই তো ভাল আছেন। খুব তাড়াতাড়ি ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে।

সিরাজুল চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন, আমার বাড়ির লোক আসেনি?

 নটা তো বাজেনি। নটার আগে ভিজিটার্স নট অ্যালাউড।

এখন কটা বাজে? আটটা কুড়ি।

আমার একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে। চা পেতে পারি?

অবশ্যই পাবেন। আর কিছু চাই?

একটা আণ্ডা সেদ্ধ!

 সেটা দিতে পারব না। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। কর্নফ্লেক্স খাবেন?

না। তাহলে শুধু চা। আপনার বাড়ি কোথায়?

পার্ক সার্কাসে। কেন বলুন তো?

 আপনার বাবা, মানে আপনারা কি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ?

আমার বাবার বাড়ি ছিল টাঙ্গাইল, শুনেছি।

টাঙ্গাইল? কোথায় কোথায়? শহরে? না বাইরে? আমি টাঙ্গাইল খুব ভাল চিনি।

নার্সটি এ আলোচনায় কোনও উৎসাহ না দেখিয়ে বলল, আপনার প্রেসারটা একটু মাপতে হবে। তারপর দুটো ওষুধ।

সে কোনও রকম ব্যক্তিগত আলোচনায় যেতে রাজি নয়। এদের বুঝি এই রকমই ট্রেইনিং দেয়? সিরাজুল চৌধুরীর কথা বলার ইচ্ছা হচ্ছিল। এক-এক সময় মানুষের সাহচর্য, মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য একটা ব্যাকুলতা জাগে। কিন্তু নার্সটি গম্ভীর ভাবে কাজ সেরে বেরিয়ে গেল।

মিন্টু কি আজই রিপোর্ট পাবে?

জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে রয়েছে ওই একটা রিপোর্ট। ঢাকায় তিন জন ডাক্তারই বলেছিল, ক্যানসার। অপারেশন ছাড়া গতি নেই। কিন্তু সিরাজুল রাজি হননি। মরতে যদি হয়, তাহলে শরীরটা কাটা-ছেঁড়া না করেই মরতে চান।

এ বছর ব্যথাটা খুব বেড়েছিল, তার শালা মিন্টু জোর করে নিয়ে এল কলকাতায়। মিন্টুর মায়ের অপারেশন করেছেন অংশুমান রায়, তার ওপর মিন্টুর খুব ভরসা। তা ভালভাবেই অপারেশন হয়ে গেছে কদিন আগে। এই ডাক্তার কিন্তু ক্যানসার সম্পর্কে নিশ্চিত নন। তিনি বলেছেন, এবারের বায়োপসি রিপোর্ট না দেখে কিছু বলা যাবেনা।

সেই রিপোর্টের জন্য অধীর প্রতীক্ষা। দারুণ সাসপেন্স। যেন কোনও এক বিচারক ফাঁসি দেবেন কি দেবেন না, সেই রায় দেবার জন্য চিন্তা করছেন।

যদি ক্যানসার হয়, তাহলে আর কতদিন আয়ু? বড় জোর ছ’মাস। তার পরেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে?

সেই নার্সটি আর এল না, একজন আয়া এসে চা দিয়ে গেল।

মিন্টুরা ঠিক নটার সময়েই আসবে তো? দেরি করে বেরুলে রাস্তায় খুব জ্যাম হয়।

চায়ে দুবার চুমুক দিতে না-দিতেই সিরাজুল চৌধুরীর আবার ঘুম এসে গেল। আবার তিনি দেখতে পেলেন সেই বালকটিকে। সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে নামছে।

এটা কোন বাড়ির সিঁড়ি? রট আয়রনের রেলিং। মাঝখানটা ঘুরে গেছে। সিঁড়িগুলো লাল রঙের। সিঁড়ির নিচে দেখা যাচ্ছে একটা চৌকো উঠোন, একটু খুব বড় কাতলা মাছ, জ্যান্ত, লাফাচ্ছে সেই উঠোনে। এক জন স্ত্রীলোক দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে।

এটা কি স্বপ্ন, না ভুলে যাওয়া স্মৃতির এক ঝলক? ওই স্ত্রীলোকটি কে? সিঁড়ির বাঁক ঘুরতে গিয়েই বালকটির পা পিছলে গেল, পড়তে লাগল গড়িয়ে। সিরাজুল চৌধুরীর বুকটা ধক করে উঠল। ঠিক এ-রকমই তিনি আশঙ্কা করেছিলেন। অত জোরে কেউ সিঁড়ি দিয়ে নামে? অতি দুরন্ত ছেলে! এবার মাথা ফাটবে। প্রাণে বাঁচবে তো?

যেন নিজেই যন্ত্রণা পাচ্ছেন, এইভাবে কঁকিয়ে উঠলেন তিনি।

তার পরই দৃশ্যটা মুছে গেল।

এর পরের ঘটনাটা তিনি দেখবার অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু দৃশ্যটা আর ফিরে এলনা। পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছু একটা স্বপ্ন দেখে হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে।

ঘুম ভাঙল ফিসফিসানি শুনে। চোখ মেলে দেখলেন, মিন্টু আর রেহানা এসে গেছে। একটা সুন্দর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, সুস্থ মানুষের গন্ধ। তাছাড়া রেহানা বোধহয় কোনও ভাল পারফিউম মেখে এসেছে। মিন্টুর ছোট মেয়ে রেহানা। বয়েস হল বাইশ না তেইশ? হালকা, স্নিন্ধ নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরে আছে, মুখখানি যেন ফুলের মতো। দেখলে মনে হয়, অতি সরল, এখনও পৃথিবীর বিশেষ কিছুই জানে না। কিন্তু ও-মেয়ের বুদ্ধি খুব চোখা, জেনেটিকস নিয়ে এমএসসি পড়ছে।

তাকে চোখ মেলতে দেখে মিন্টু জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন দুলাভাই?

সিরাজুল চৌধুরী কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলেন যে, তিনি নার্সিংহোমে বিছানায় বন্দি হয়ে আছেন।

তাড়াতাড়ি উঠে বসার চেষ্টা করতেই পেটের ব্যান্ডেজে টান লাগল, ব্যথা বোধ হল। তবু তিনি বললেন, ভালই আছি, বেশ ক্ষুধা হচ্ছে।

রেহানা হাসিমুখে বলল, মুসাফির, ইউ লুক ফ্রেস! চলল, বেড়াতে যাই।

 সিরাজুল চৌধুরী দৈনিক পত্রিকায় মুসাফির ছদ্মনামে নিয়মিত কলম লেখেন, তাই পরিবারের ছোটরা সবাই তাকে মুসাফির নামেই ডাকে। তার শুনতেও ভাল লাগে।

তিনি মিন্টুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রিপোর্ট পাওয়া গেল?

মিন্টু বলল, তিনটার সময় পাওয়া যাবে। আমার তো মনে হয়…।

এরপর কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপ। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা আসবে কি আসবেনা? তিনটে বাজতে আর কত দেরি?

.

০২.

মিউজিয়ামের পাশের রাস্তাটার নাম সদর স্ট্রিট। এক সময় এই রাস্তার একটি বাড়িতে দাদা বউদির সঙ্গে থাকতেন তরুণ রবীন্দ্রনাথ, এখানেই লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। তখন এখানকার দৃশ্য কী-রকম ছিল, এখন আর তা বোঝার উপায় নেই, এ রাস্তায় পর পর শুধু হোটেল।

বাংলাদেশ থেকে অনেকেই কলকাতায় এসে এই রাস্তার কোনও হোটেলে ওঠে। এখান থেকে নিউ মার্কেট খুব কাছে, কেনাকাটার সুবিধে হয়। শহরের যে-কোনও জায়গাতেই যাতায়াত সহজ।

নিয়মিত বাংলাদেশি খদ্দেরদের পেয়ে এখানকার দু’একটা ছোটখাটো হোটেল ফুলে-ফেঁপে বড় হয়ে গেছে। দোতলা হয়েছে চার তলা, লিফট বসেছে।

সিরাজুল চৌধুরী সাত বছর আগে কলকাতায় এসেছিলেন, তখন এই হোটেলটার চেহারা ছিল অতি সাধারণ। এখন রীতিমতো ঝলমলে ভাবে সাজানো। নতুন ঘরগুলির বাথরুম শ্বেত পাথরের।

বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিরাজুল চৌধুরী হাঁ করে নিজের দাঁত দেখছেন। তার ওপরের পাটির একটি দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। তিনি আপন মনে হাসলেন।

তার এই একটা দাঁত অনেক দিনই নেই। স্কুলে পড়ার সময় সহপাঠীরা তাকে ফোকলা বলে খেপাত। তখন তিনি গর্ব করে বলতেন, একদল গুণ্ডার সঙ্গে মারামারি করতে গিয়ে তার ওই দাঁত ভেঙে যায়। এটা অবশ্যই মিথ্যে কথা। তবে অনবরত ওই মিথ্যে কথাটা রোমহর্ষক ভাবে বর্ণনা করতে করতে সেটা তার নিজের কাছেই সত্যি হয়ে গিয়েছিল। আসল কারণটা ভুলেই গিয়েছিলেন।

সেটা মনে পড়ল এতকাল বাদে! সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে গিয়ে আছাড় খেয়ে গড়িয়ে পড়েছিলেন একবার। মাথা ফেটেছিল, একটা দাঁত ছিটকে গিয়েছিল। গত কাল টেলিফোনে ঢাকায় বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি তার আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আম্মার ঠিক মনে আছে, তিনিও সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাওয়ার কথা বললেন।

ভুলে যাওয়া স্মৃতিটা এত কাল পরে ফিরে এল কেন?

মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে। রিপোর্টে ঠিক ফাঁসির হুকুম আসেনি, আবার পুরোপুরি ছাড়া পাওয়া যায়নি। দণ্ডাজ্ঞা কিছু দিনের জন্য স্থগিত রইল। বায়োপসিতে ক্যানসার ধরা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু ডাক্তার দৃঢ়ভাবে বলেছেন, অপারেশনে তিনি যতখানি বাদ দিয়েছেন, তারপর আর ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে ছমাস অন্তর অন্তর চেকআপ করাতে হবে।

নার্সিংহোম থেকে এত তাড়াতাড়ি ছাড়া পাওয়া যাবে, তা-ও আশা করা যায়নি। তিনি কানাঘুষো শুনেছিলেন, কলকাতার ডাক্তাররা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বেশি টাকা রোজগার করার জন্য ইচ্ছে করে বেশি দিন নার্সিংহোমে আটকে রাখে। কিন্তু মিন্টুর সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় থাকার জন্যই হোক বা যে-কারণেই হোক, এ ডাক্তারটি সেরকম চশমধোর নয় দেখা যাচ্ছে। সিরাজুল চৌধুরীকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে তিনি বললেন, শুধু শুধু নার্সিংহোমে শুয়ে থেকে কী করবেন? বাড়ি চলে যান। হাঁটুন। সিগারেট ছাড়া আর যা ইচ্ছে করে খাবেন। স্বাভাবিক জীবন যাপন করুন।

ইচ্ছে করলেই তো ফিরে যাওয়া যায় না। টিকিট কাটা আছে সাত তারিখের। সে-টিকিট বদলানো যাচ্ছে না। ঢাকায় ক্রিকেট খেলা হচ্ছে বলে বিমানের টিকিটের খুব ডিমান্ড, বড়জোর একটা পাওয়া যেতে পারে, একই ফ্লাইটে তিনখানা অসম্ভব।

অগত্যা আরও দু’দিন থেকে যেতে হবে।

রেহানা এই প্রথম বার ইন্ডিয়ায় এসেছে। তার খুব আগ্রা-দিল্লি দেখার শখ। এবারে তা সম্ভব নয়। তবে, এক দিনের জন্য শান্তিনিকেতন ঘুরে আসা যেতে পারে।

সিরাজুল চৌধুরীও কখনও শান্তিনিকেতন যাননি। মিন্টু অবশ্য দু’বার গেছে, সে কবি, নানা কবি সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়।

সিরাজুল চৌধুরীর দুই ছেলেই জার্মানিতে থাকে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে রাজশাহি আর সিলেটে। স্ত্রী গত হয়েছেন দু’বছর আগে। শ্যালক মিন্টুই এখন তার প্রধান ভরসা। শান্তিনিকেতনে বেড়াবার প্রস্তাবে রেহানাও খুব খুশি।

শান্তিনিকেতনের ট্রেন সকাল দশটায়। সিরাজুল চৌধুরী নিজেই দিব্যি প্ল্যাটফর্মে হেঁটে গিয়ে ট্রেনে উঠলেন। এ ট্রেনে তেমন ভিড় হয় না, লোকজনের ঠেলাঠেলি নেই।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত শান্তিনিকেতন যাওয়া হল না।

ট্রেনটা বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছতেই সিরাজুল চৌধুরীর বুকের মধ্যে আকুলি-বিকুলি করে উঠল। চোখে আবার ভেসে উঠল সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়া বালকের দৃশ্যটা। তিনি উতলা ভাবে বললেন, মিন্টু, এখানে একবার নামবে?

মিন্টু বলল, বর্ধমানে? এখানে কী দেখার আছে?

সিরাজুল চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো চলো নামি, কথা আছে, নেমে বলব। তাড়াহুড়ো করে ওঁরা নামতেই ট্রেনটা ছেড়ে গেল।

রেহানা বলল, মুসাফির, তুমি তোমার নামটা সব সময় সার্থক করতে চাও? কখন কোথায় যাবে, ঠিক নেই! বর্ধমানে নামার কথা আগে বলোনি!

সিরাজুল চৌধুরী একটু অপরাধী, একটু লাজুক মুখ করে বললেন, আমি আগে ভাবিনি। স্টেশনের নামটা দেখে মনে পড়ল। এইখানে আমাদের বাড়ি ছিল, আমি এখানে জন্মেছি। সেই জন্মস্থানটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল। একবার শুধু দেখে আসি, পরের ট্রেনে না হয় শান্তিনিকেতন যাব।

সে-বাড়ি বর্ধমানে শহরে নয়, খানিকটা দূরে, জায়গাটার নাম তালিত। সিরাজুল চৌধুরীর মনে আছে। বাস যায়, কিন্তু তিনি ভিড়ের বাসে উঠতে পারবেন না। মিন্টু একটা গাড়ি ভাড়া করে ফেলল।

গাড়িতে ওঠার পর মিন্টু বলল, সে-বাড়ি কি এখন আছে? আপনারা অ্যাবানডান করে চলে গিয়েছিলেন, এখানকার লোকেরা জবরদখল করে ভেঙেচুরে ফেলেছে। কত কাল আগের ব্যাপার!

সিরাজুল চৌধুরী বললেন, আমরা বাড়ি অ্যাবানডান করিনি। রিফিউজি হয়ে ঢাকায় যাইনি। ভাগ্য ভাল ছিল, আমরা বাড়ি এক্সচেঞ্জ করেছিলাম। নারায়ণগঞ্জে আমাদের বাড়িটা ছিল আগে এক হিন্দু ভদ্রলোকের। তার সঙ্গে আমরা এই বাড়িটা বদল করতে পেরেছিলাম ঠিক সময়ে। ফার্নিচার সমেত। পার্টিশনের সময় আমরা মনে করেছিলাম, ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ভিসা-পাসপোর্ট লাগবেনা। আবার এ বাড়িটা দেখতে আসব। তা আর হল কই? পাকিস্তানি আমলে তো আসাই যেত না।

রেহানা বলল, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তো তুমি কয়েক বার কলকাতা এসেছ। তখন যাওনি?

সিরাজুল চৌধুরী বললেন, না রে। প্রত্যেক বার কাজেই এসেছি। একবার সোজা গেলাম আজমিড় শরিফ, এই বর্ধমানের ওপর দিয়েই তো সে-ট্রেন গেল, তখন ইচ্ছে হয়নি। ঠিক মনেও পড়েনি।

এতগুলি বছর, কত বছর হয়ে গেল?

 তোর বয়সের থেকে দ্বিগুণ তো হবেই।

এখন গেলে চিনতে পারবে?

একটা আশ্চর্য ব্যাপার কি জানিস? ভুলেই গেছিলাম। কিন্তু নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কী করে যেন আবার সব মনে পড়ে যেতে লাগল। স্পষ্ট দেখলাম বাড়িটাকে। পিছনে একটা মস্ত বড় দিঘি। কাকচক্ষুর মতো পরিষ্কার, টলটলে পানি, মাঝখানে পদ্মফুল। লাল রঙের বাঁধানো ঘাটলা। বাগানও ছিল। অনেক গাছ, কিন্তু বেশি করে মনে পড়ল পাশাপাশি দুটো জন্তুরা গাছের কথা। এ-দেশে বলে বাতাবি লেবু। এত বেশি জম্বুরা হত, খাওয়ার লোক নাই, বড় বড় জম্বুরা, আমরা ছোটরা সেইগুলি দিয়ে ফুটবল খেলতাম।

সে-বাড়ি কি আর আছে? পঞ্চাশ বছরেকত কিছুই বদল হয়ে যায়।

 গিয়ে দেখাই যাক না। বেশিক্ষণ লাগবেনা।

ঠিকানা মনে আছে?

ঠিকানা? তখন তো ঠিকানা ছিল না। বাড়ির কর্তার নাম শুনলে লোকে বলে দিত। নারায়ণগঞ্জের যে-হিন্দু ভদ্রলোকের সঙ্গে বাড়িটা এক্সচেঞ্জ করেছিলাম, তার নামটাও মনে পড়ে গেছে। বলরাম চৌধুরী। তার ছোট ভাইয়ের নাম ছিল শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী। হিন্দুদের মধ্যেও চৌধুরী হয়, জানিস তো?

মিন্টু বলল, এটা সবাই জানে। প্রমথ চৌধুরী নামে একজন বড় রাইটার ছিলেন না? রবীন্দ্রনাথের ভাইয়ের মেয়ে ইন্দিরাকে যিনি বিয়ে করেছিলেন, সবুজ পত্র পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

সিরাজুল বললেন, তোরা যে কতখানি জানিস, আর কতখানি জানিসনা, তা আমি ঠিক বুঝি না।

রেহানা বলল, আমাদের মধ্যেও ঠাকুর পদবি হয়। আমি কাগজে দেখি নাম মাঝে মাঝে। তাহের ঠাকুর আছে না এক জন?

সিরাজুল বললেন, ঠিক বলেছিস। ঠাকুররা পিরিলিব বামুন। ওদের ফ্যামিলির একটা ব্রাঞ্চ মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। তারাই বোধহয় এখনও নামের সঙ্গে ঠাকুর জুড়ে রেখেছে।

রেহানা জিজ্ঞেস করল, বাড়িটা কি শহরে মধ্যেই ছিল?

সিরাজুল বললেন, না, বেশ ফাঁকা ফাঁকা জায়গা। তালিত-এর বাজারে গেলেই আমার চিনতে অসুবিধে হবে না। বাজারের পুব দিকে একটা সোজা রাস্তা গেছে। প্রায় আধ মাইল পর আর বাড়িঘর বিশেষ নাই, ফাঁকা ফাঁকা, ধানখেত, একটা বড় বটগাছের কাছে রাস্তাটা দুই ভাগ হয়ে গেছে, তার নিকটেই আমাদের বাড়ি। একেবারে ছবির মতো স্পষ্ট দেখতে পাই।

তালিত বাজারের কাছে পৌঁছে কিন্তু দিশা পাওয়া গেল না। সাইকেল রিকশা, ঠেলা গাড়ি, ট্রাকের গ্যাঞ্জাম। তিন দিকের তিনটে রাস্তা, তার মধ্যে কোনটা পুব দিকে তা বোঝাই শক্ত। কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করা হল, বলরাম চৌধুরীর বাড়িটা কোথায়? কেউ কিছু বলতে পারে না।

তারপর জানা গেল, ওরা গাড়িতে যে-পথে এসেছে, সেটাই পুব দিকের রাস্তা। অর্থাৎ সিরাজুল চৌধুরী তার জন্মস্থানের পাশ দিয়েই এসেছেন। তিনি চিনতে পারেননি।

রেহানা ফিক ফিক করে হাসতে লাগল।

খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে সিরাজুল বললেন, ধানখেত তো দেখলাম না। আর সেই বটগাছটাও।

গাড়ি ঘুরিয়ে নেওয়া হল।

রাস্তার দু’ধারে একটুও ফাঁকা নেই, পর পর বাড়ি। আধ মাইল কেন, এক মাইলের মধ্যেও কোনও বড় বটগাছ নেই।

রেহানা বলল, মুসাফির, তোমার সেই বটগাছ কবে ঝড়ে পড়ে গেছে।

মিন্টু বলল, তাহলে বর্ধমানেই ফিরে যাওয়া যাক?

সিরাজুল আফশোসের সুরে বললেন, শুধু শুধু ট্রেন থেকে নামলাম! গেল কোথায় বাড়িটা? অদৃশ্য হয়ে যেতে তো পারে না? বাগান, দিঘিটা তো থাকবে?

আবার লোকজনদের জিজ্ঞেস করায় কয়েক জন একটা চৌধুরীবাড়ি দেখিয়ে দিল। সেটা এক তলা বাড়ি, সঙ্গে চুন-সুরকির দোকান। তারা চৌধুরী বটে, কিন্তু বলরাম-শ্রীকৃষ্ণের নাম শোনেনি।

তারা আর একটা চৌধুরী বাড়িতে পাঠিয়ে দিল।

স্মৃতি খানিকটা প্রতারণা করেছে সিরাজুল চৌধুরীর সঙ্গে।

বড় রাস্তায় কোনও বটগাছ নেই। একটা সরু রাস্তা দিয়ে এঁকেবেঁকে খানিকটা যাবার পর দেখা গেল ধানের খেত, দূরে মাঠের মধ্যে একটা বটগাছ। এই সরু রাস্তার শেষ বাড়িটা দেখে সিরাজুল প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, এই তো এটাই সেই বাড়ি! পেয়েছি!

সিরাজুল চৌধুরীর মনের ছবিতে তাদের বসতবাড়িটা ছিল তিন তলা, কিন্তু এ বাড়িটা দো-তলা। বড় দিঘি নেই, একটা মাঝারি আকারের পুকুর আছে বটে, তার অর্ধেকটা পানায় ভর্তি। বাগান কোথায়? কোথায় জাম্বুরা গাছ?

কিন্তু দো-তলার একটা বারান্দা আর সদর দরজাটা দেখে সিরাজুল চৌধুরী দৃঢ়ভাবে বললেন, এইটাই সেই বাড়ি। আই অ্যাম ডেফিনিট।

বাড়িটার অবস্থা প্রায় জরাজীর্ণ। এক দিকের দেয়ালের গা দিয়ে অশত্থ গাছের চারা উঠেছে। রঙ করা হয়নি অনেক দিন।

সদর দরজা বন্ধ।

সবাই নামল গাড়ি থেকে। বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা, সূর্য মধ্যগগনে, এর মধ্যেই গরম পড়েছে খুব।

দরজার পাশের দেয়ালে একটা শ্বেত পাথরের ট্যাবলেটে লেখা ‘চৌধুরী ধাম’। তা দেখে শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে সিরাজুল বললেন, দেখেছিস, নামটা প্রায় একই আছে। আমাদের সময় লেখা ছিল ‘চৌধুরী লজ’।

রেহানা বলল, যাক, পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত! দেখাও হল। এখন অন্যের বাড়ি, ভিতরে কি আর যেতে দেবে?

সিরাজুল বললেন, একবার শুধু ভিতরের সিঁড়িটা দেখব।

কলিং বেল নেই, কড়া নাড়তে হল।

একটু পরে দরজা খুলে দিল এক জন মাঝবয়সী স্ত্রীলোক। ছিরিছাঁদহীন ঢ্যাঙা চেহারা, চুলের খোঁপাটা মাথার মাঝখানে, শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে বাঁধা।

তিন জন আগন্তুককে চোখ বুলিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বেশ খ্যারখেরে গলায় সে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?

যা বলার তা সিরাজুল চৌধুরীকেই বলতে হবে, মিন্টু আর রেহানা তার পেছনে।

সিরাজুল বললেন, এটা কি বলরাম চৌধুরীর বাড়ি?

 স্ত্রীলোকটি বলল, না। এটা অবনী চৌধুরীর বাড়ি।

সিরাজুল বুঝলেন, বলরাম চৌধুরী ছিলেন তার বাবার বয়সী। এত দিন তার বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু এরপর কী বলা উচিত, তা তিনি আগে ভাবেননি।

একটু আমতা আমতা করে বললেন, আমরা এই বাড়ির ভেতরটা একবার দেখতে পারি?

স্ত্রীলোকটি মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, কেন? এ বাড়ি বিক্রি আছে, তা আপনাদের কে বলেছে? মোটেই বিক্রি নেই।

সিরাজুল বললেন, না না, আমরা বাড়ি কিনতে আসিনি। শুধু ভেতরটা একবার দেখেই চলে যাব।

স্ত্রীলোকটি বলল, যে-সে উটকো লোক এসে ভেতরে ঢুকতে চাইলেই দেব? মামাবাড়ির আবদার।

তারপর সে মুখ ফিরিয়ে বাড়ির ভেতরের কারুকে উদ্দেশ করে বলল, অ বউদি। কারা সব এসেছে, ভেতরে ঢুকতে চাইছে। সঙ্গে আবার এক জন পুলিশ এনেছে!

সিরাজুল বিস্মিত ভাবে বললেন, কই, আমরা তো পুলিশ আনিনি!

 স্ত্রীলোকটি মিন্টুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওই লোকটাই তো পুলিশ। আর একদিন এসেছিল।

মিন্টু যেন আকাশ থেকে পড়ে বলল, আমি পুলিশ? আমাদের সাত জন্মে কেউ পুলিশে কাজ করেনি। আমি জীবনেও এখানে আগে আসিনি।

ভেতর থেকে একটা নারীকণ্ঠ শোনা গেল, এই নারানী, অত কথা বলার দরকার কী? দরজা বন্ধ করে দে।

স্ত্রীলোকটি ঝপাস করে দরজা বন্ধ করে দিল ওদের মুখের ওপর।

অপমানে মুখখানা কালো হয়ে গেল রেহানার।

সে ফিরে যেতে লাগল গাড়ির দিকে।

সিরাজুল অতটা অপমান গায়ে মাখলেন না। তিনি বললেন, তাহলে বাইরে থেকেই একটু দেখে যাই। ছোটবেলায় এই পুকুরটাকেই মনে হত কত বড়। অনেক মাছ ছিল! অ্যাত্ত বড় বড় কাতল মাছ।

রেহানা ঝাঁঝালো গলায় বলল, আর দেখতে হবে না। এবার চলো ফিরে যাই। এরা অতি অভদ্র।

এইসময় সাইকেলে চেপে এক জন লোক এল সেখানে। বছর তিরিশেকের এক যুবক। খানিকটা কৌতূহল, খানিকটা সন্দেহমাখা চোখে সে দেখল এঁদের। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন? কাকে চাইছেন?

মিন্টু গম্ভীর ভাবে বলল, আমরা কারুকে চাই না। দুলাভাই, চলেন, চলেন।

ওরা দুজনে এগোল গাড়ির দিকে।

 যুবকটির ভুরু কুঁচকে গেল। সে সাইকেল থেকে নেমে কাছে এসে বলল, কী ব্যাপার? আপনারা আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন। এখন কিছু না বলে চলে যাচ্ছেন? আপনাদের কে পাঠিয়েছে?

মিন্টু কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে সিরাজুল বললেন, ব্যাপার কিছু নয়। কেউ আমাদের পাঠায়নি। ইট সো হ্যাপেন্ড, আমি এই বাড়িতে জন্মেছিলাম। তাই শুধু একবার দেখতে এসেছি। আপনাদের আপত্তি থাকলে ভিতরেও যেতে চাই না। বাইরে থেকে দেখায় কি দোষ আছে?

আপনি এখানে জন্মেছিলেন মানে?

আপনার বয়স কম, আপনার জানবার কথা নয়। পার্টিশনের আগে, এ জায়গাটা ছিল আমার বাবা-দাদাদের প্রপার্টি। নারায়ণগঞ্জের বলরাম চৌধুরীর বাড়ির সঙ্গে এটা এক্সচেঞ্জ করা হয়েছিল। এর ওপর আমাদের কোনও দাবি নেই। শুধু একটু চোখের দেখা। নস্টালজিয়া বলতে পারেন।

আপনারা বাংলাদেশ থেকে আসছেন?

জি। আমার নাম সিরাজুল চৌধুরী। এ আমার শ্যালক, আরদুল কাদের, এক জন নামকরা কবি, আপনি হয়তো নাম শুনে থাকতে পারেন। আর ওই যে রেহানা, আমার শ্যালকের কন্যা।

যুবকটির ভুরুও কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল। হাসিমুখে বলল, ও এই ব্যাপার? আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন।

মিন্টু বলল, না, আর ভেতরে যাবার দরকার নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে।

যুবকটি বলল, একটু বসবেন চলুন। আসন্ত্র ব্যাপার কি হয়েছে জানেন, আমার খুড়তুতো ভাইদের সঙ্গে এই বাড়িটা নিয়ে মামলা চলছে। মামলা এখনও শো হয়নি, ওরা জোর করে বাড়িতে ঢুকে পজেশান নিতে চাইছে। একবার ঢুকে পড়লে তাড়ানো মুশকিল। তাই সাবধানে থাকতে হয়। আসুন।

রেহানা বলল, আমি গাড়িতে বসে থাকছি। তোমরা দেখে এসো।

যুবকটি হেসে বলল, তা বললে কি হয়? এই গরমে গাড়িতে বসে থাকবেন? এক গেলাস জল খেয়ে যান অন্তত।

.

০৩.

পৌরাণিক কাহিনিতে বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ এই দুই ভাইয়ের খুব গলাগলি ভাবছিল। কৃষ্ণ মহাশক্তিমান হলেও মান্যগণ্য করতেন তার বড় ভাই বলরামকে। বলরাম বেশ মাতাল ছিলেন, কৃষ্ণও অর্জুনের সঙ্গে বসে মদ্যপান করতেন বটে, তবে কখনও বেচাল হতেন না, বলরাম কখনও বাড়াবাড়ি করে ফেললে কৃষ্ণই সামলাতেন।

নারায়ণগঞ্জের কাঠের ব্যবসায়ী বলরাম চৌধুরীর সঙ্গে তার ছোট ভাই কৃষ্ণ চৌধুরীর কিন্তু তেমন সদভাব ছিল না। বলরাম ছিলেন উদ্যমী, কর্মী পুরুষ, কৃষ্ণ সেই তুলনায় কোনও কম্মের নয়। বলরাম নিজের চেষ্টায় কাঠের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন, আর কৃষ্ণ-পাশা খেলে সময় কাটাত, গাঁজার নেশাও করত। টাকার চিন্তা ছিল না, সে জানত, দাদাই তাকে সারা জীবন খাওয়াবে।

বলরাম চৌধুরী ছিলেন নিঃসন্তান, কৃষ্ণর চার ছেলে মেয়ে। কৃষ্ণ ধরেই রেখেছিল, দাদার বিষয় সম্পত্তি তার ছেলে মেয়েরাই পাবে। সেটাই স্বাভাবিক ছিল।

হঠাৎ একটা অঘটন ঘটে গেল। প্রৌঢ় বয়সে বলরাম চৌধুরীর স্ত্রী একটি পুত্রসন্তান জন্ম দিলেন। জন্মের পর সেই সন্তানের জীবন-সংকট দেখা গিয়েছিল। বেঁচে গেল কোনও ক্রমে। তাতেই বদলে গেল সব কিছু।

বেশি বয়সের ছেলে অতি আদরের হয়। বাবা-মায়ের সে একেবারে নয়নের মণি। যথারীতি বলরাম চৌধুরী নিজের সন্তানকেই উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেন। সেই সন্তানের নাম অবনী।

বলরাম চৌধুরী তার ছোট ভাই কৃষ্ণ এবং তার ছেলে-মেয়েদেরও একেবারে বঞ্চিত করেননি। দেশবিভাগের পর এক মুসলমান পরিবারের সঙ্গে বাড়ি বদল করে বর্ধমানে চলে আসেন। সঙ্গে যথেষ্ট টাকাকড়িও নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, নৈহাটিতে কৃষ্ণর জন্য একটি ছোট বাড়ি কিনে দিলেন, স্টেশনের কাছে একটা জামাকাপড়ের দোকানও সাজিয়ে দিলেন, তার আয়ে কৃষ্ণর সংসার বেশ ভালভাবেই চলে যাবার কথা।

বলরাম এবং কৃষ্ণ দু’জনেই মারা গেছেন বছর পনেরো আগে।

বলরামের ছেলের অবনী লেখাপড়ায় বেশ ভাল হয়েছে। এখন সে সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স পড়ায়, তাছাড়া তার ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা আছে। কলকাতাতেও ফ্ল্যাট কিনেছে, সেখানেই বেশির ভাগ সময় থাকে।

সেই তুলনায় কৃষ্ণর ছেলেরা অপদার্থ। ছোট ছেলেটি তো হিংস্র প্রকৃতির, জুট মিল এলাকায় গুণ্ডামি করে বেড়ায়, আপাতত সে জেলে। বড় ছেলেটি অসুস্থ। মেজোটিই ধুরন্ধর। কাপড়ের দোকানটা ঠিক মতো চালাতে পারে না, সে-ই মামলা করেছে অবনীর বিরুদ্ধে। তার দাবি, বর্ধমানের এত বড় বাড়িটা, পুকুর ও অনেকখানি জমি, এটা তাদের পারিবারিক যৌথ সম্পত্তি, সুতরাং এই সব কিছুতে তাদেরও ভাগ আছে। এ মামলায় তাদের জয়ের সম্ভাবনা কম, কারণ বলরাম চৌধুরীর উইলে সব কিছু তার ছেলের নামে স্পষ্ট লেখা আছে। মামলা নিষ্পত্তির আগেই কৃষ্ণর ছেলেরা জোর করে এ বাড়িতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেছে দু’বার।

অবনীর বৃদ্ধা মা কলকাতায় যাননি, তিনি এ বাড়িতেই থাকেন। আর থাকে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া, তার যেমন উগ্র মেজাজ, সেই রকম চোপা। সেই নারায়ণীই সিরাজুল চৌধুরীর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।

অবনীর সঙ্গে সেই দলটিকে ফিরে আসতে দেখে নারায়ণী তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বিশেষ করে মিন্টুর দিকে। তার বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে, এই লোকটি ছদ্মবেশী পুলিশ।

ভেতরের উঠোনে এসে অবনী বলল, সিরাজ সাহেব, চিনতে পারছেন? ভেতরটা বিশেষ বদলায়নি।

সিরাজুল তাকালেন সিঁড়িটার দিকে।

 নার্সিংহোমে শুয়ে চোখ বুজে তিনি এই সিঁড়িটাই দেখছিলেন বার বার।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন খানিকটা। আবার নেমে এলেন।

মিন্টু আর রেহানা খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের তো এই বাড়ি নিয়ে কোনও স্মৃতি নেই। তারা উদ্বেল হবে কেন? সিরাজুল সাহেবের ব্যবহার তাদের কাছে খানিকটা বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে।

সিরাজুল নেমে এসে, মুখ ফাঁক করে সোনার দাঁতটা দেখিয়ে বললেন, এই যে দেখছ আমার একটা দাঁত ভাঙা? এই সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে ভেঙেছিল।

রেহানা এবার হেসে ফেলে বলল, শুধু দাঁত ভাঙার কথাটাই তোমার আগে মনে পড়ল?

সিরাজুল বললেন, সত্যি রে, কেন জানি, এটাই বার বার মনে আসছিল। পুকুর থেকে একটা বড় কাতলা মাছ ধরে এনে এই উঠোনে রেখেছিল, মাছটা লাফাচ্ছিল। সেটা দেখার জন্যই তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে–।

অবনী বলল, চলুন, ওপরে চলুন!

সিরাজুল বললেন, না না। আর উপরে যাবার দরকার নেই।

অবনী বলল, কেন, ওপরটা ঘুরে দেখলে আপনার হয়তো আরও অনেক কিছু মনে পড়ে যেতে পারে।

রেহানা বলল, আমাদের এবার যেতে হবে।

অবনী বলল, এত তাড়া কীসের?

রেহানা বলল, আমরা শান্তিনিকেতনে যাব।

সিরাজুলের দিকে ফিরে বলল, তোমার জন্মস্থানের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান আমি ভাল করে দেখতে চাই। এবার চলো!

সিরাজুল কিছু বলার আগেই অবনী বলল, শান্তিনিকেতন তো রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান নয়। সে যাই হোক, শান্তিনিকেতনও দেখবার মতো। দেখবেন, দেখবেন। শান্তিনিকেতনের ট্রেন তো সেই বিকেলে।

সিরাজুল বললেন, রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। সেটাও দেখাব।

অবনী বলল, ওঃ আপনাদের জল দেওয়া হয়নি। ও পিসি, বাড়িতে মিষ্টি-টিষ্টি কিছু আছে? নেই বোধহয়। আমি তো কালই এসেছি। একটু বসবেন চলুন।

সিরাজুল হাত তুলে বললেন, না না, মিষ্টির দরকার নেই। আমার ডায়াবেটিস আছে, তাছাড়া রিসেন্টলি অপারেশন হয়েছে। মিষ্টি খাওয়া একেবারে নিষেধ। আগে কলকাতার মিষ্টি ভালবাসতাম। আর ওই যে আমার শালার মেয়েকে দেখছেন, আজকালকার মেয়ে, মিষ্টি ছোঁয় না। ফিগার ঠিক রাখতে হবে তো, ডায়েটিং করে।

অবনী এক পলক রেহানার দিকে তাকিয়ে তার তনুশ্রীর তারিফ করল।

 মিন্টু বলল, আমার এক গেলাস পানি, ইয়ে, জল পেলেই চলবে।

অবনী ওদের প্রায় জোর করেই নিয়ে এল বসবার ঘরে।

পুরনো আমলের সোফা ও চেয়ার-টেবিল দিয়ে সাজানো, কিন্তু ধূলিমলিন। অনেক দিন ব্যবহার করা হয় না, বোঝাই যায়।

অবনী জিজ্ঞেস করল, এই ঘরটা চিনতে পারেন?

সিরাজুল দু’দিকে মাথা নেড়ে বললেন, না।

অবনী বলল, ঘরটা আগে ছোট ছিল। বাবা মাঝখানের দেয়ালটা ভেঙে দুটো ঘর মিলিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বোধহয় ভেবেছিলেন, বাড়িতে অনেক লোকজন আসবে, বড় বৈঠকখানা দরকার। কোথায় লোকজন? আমাদের তো এখন এখানে থাকাই হয় না। কলকাতায় আমার অনেক কাজ।

একটা ঝাড়ন দিয়ে সে ধুলো সাফ করতে লাগল।

একটি বাচ্চা ছেলে কাচের জাগে জল আর কয়েকটা গেলাস নিয়ে এল একটু পরে।

 অবনী বলল, ইস, শুধু জল, এমন লজ্জার ব্যাপার!

সিরাজুল বললেন, আগেকার দিনে দেখেছি, হিন্দুবাড়িতে কারুকে জল দেবার সময়, অন্য মিষ্টি না থাকলে কয়েকখানা বাতাসা দিত। এখন বোধকরি বাড়িতে বাতাসা রাখা হয় না।

অবনী বলল, বাতাসা? প্রায় উঠেই গেছে। অনেক দিন দেখি না।

রেহানার মুখে-চোখে অধৈর্য ফুটে উঠেছে। গেলাস নামিয়ে রেখে সে বলল, আমরা এখন যাব না?

সিরাজুল বললেন, হ্যাঁ যাব। চলো। ধন্যবাদ অবনীবাবু। আপনিও একবার বাংলাদেশ আসুন। নারায়ণগঞ্জে আপনাদের বাড়িটা প্রায় একই রকম আছে। দেখে আসবেন।

অবনী হেসে বলল, সে-বাড়ি তো আমি জীবনে দেখিইনি। আমার জন্ম দেশভাগের অনেক পরে। আমার তো কোনও নস্টালজিয়া নেই!

সিরাজুল বললেন, তবু বাপ-দাদার ভিটে তো। উঠানে একটা তুলসি মঞ্চ ছিল, সেটাও ভাঙা হয় নাই। তুলসিগাছ আর নাই অবশ্য।

অবনী জিজ্ঞেস করল, একটা ব্যাপারে আমার কৌতূহল হচ্ছে। আপনারা এই বাড়ি ছেড়ে ইস্ট পাকিস্তানে চলে গেলেন কেন? এখানে কি দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়েছিল?

সিরাজুল বললেন, আমি তো তখন বালক ছিলাম, সব মনে নাই। আমার বাবার কাছে অনেক গল্প শুনেছি। না, দাঙ্গা বোধহয় এ-দিকে হয়নি তেমন। কারণটা ছিল অন্য। আমার বাবা ছিলেন সরকারি উকিল। সে-সময়, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ভাগ হবার পর, সরকারি কর্মচারীদের অপশান দেওয়া হয়, যার ইচ্ছা ইন্ডিয়ায় থাকবে, যার ইচ্ছা পাকিস্তানে চলে যাবে। বাবা তবু দোনামোনা করছিলেন। সাধারণ অবস্থা থেকে উঁচুতে উঠেছিলেন, এ বাড়িটা অনেক শখ করে বানিয়েছিলেন। ছেড়ে যাবার ইচ্ছা ছিল না।

এই অঞ্চলে তো অনেক মুসলমান রয়ে গেছে। দু’জন মুসলমান উকিলও আছেন। আমাদের মামলা দেখছেন মিস্টার আমিনুল হক।

আমাদের যাবার কারণ অন্য। বর্ধমানে তখন খুব বড় নেতা ছিলেন আবুল হাসেম। একালের ছেলে মেয়েরা বোধহয় তার নাম জানে না, তবে সেকালে তার খুব প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। এখনকার নামজাদা লেখক বদরুদ্দীন ওমনর ওনারই ছেলে। আবুল হাসেম শেষ জীবনে অন্ধ হয়ে যান। ওই হাসেম সাহেব ছিলেন আমার বাবার মুরুব্বি। বাবা তার পরামর্শ নিতে গেলেন। হাসেম সাহেব বললেন, আমিও যাচ্ছি, তুমিও চলো ও-পারে। নতুন দেশ গড়া হচ্ছে, তোমাদের মতো শিক্ষিত লোকদের খুব দরকার হবে। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জের বাড়িটা সুবিধামতো পাওয়া গেল। বাবা ওখানে গিয়ে বাড়ির পাশে পুকুর কাটালেন।

 আমার বাবাকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনিও দাঙ্গার ভয়ে পালিয়ে আসেননি। নারায়ণগঞ্জে ওঁর কাঠের ব্যবসায়ে নাকি এক জন রাইভাল ছিল। সে খুব শত্রুতা করত। দেশভাগের ডামাডোলে সে যদি কোনও ক্ষতি করে, এই আশঙ্কা ছিল বাবার। তারও ইচ্ছে ছিল না আসার। তবু তো আমরা লাকি, সম্পত্তি এক্সচেঞ্জ করতে পেরেছি। কত লোক তা-ও পারেনি।

ও-দিকে আপনাদের আর কেউ নাই?

 টাঙ্গাইলে আমার পিসেমশাইরা রয়ে গেছেন শুনেছি। অনেক দিন কোনও যোগাযোগ নেই। আমার মায়ের অনেক বয়স হয়েছে, সব কথা মনে রাখতে পারেন না।

আমাদেরও কিছু কিছু আত্মীয় আছে ওয়েস্ট বেঙ্গলে। বারাসাতে থাকেন আমার মামাতো ভাইরা। এই সময় নারায়ণী দরজার আড়াল থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকল অবনীকে।

অবনী উঠে গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে ফিরে এল। তারপর হাত জোড় করে বলল, মা বলে পাঠিয়েছেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে, আপনাদের দুটি ডালভাত খেয়ে যেতে হবে।

রেহানা আর মিন্টু একসঙ্গে বলে উঠলো, না না, আমরা এখন খাব না।

অবনী বলল, গৃহস্থবাড়ি থেকে কিছু না খেয়ে গেলে অকল্যাণ হয়। এই ভরদুপুরে… অবশ্য ভাতের বদলে লুচিও খেতে পারেন।

মিন্টু এবার মিথ্যে করে বলল, আমাদের তাড়াতাড়ি বর্ধমান ফিরতে হবে, ওখানকার একটা হোটেলে খাওয়ার কথা বলে এসেছি।

হাত নেড়ে হোটেলের কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে অবনী বলল, হোটেলে তো জীবনে আরও কতবারই খাবেন, আমাদের বাড়ি থেকে কিছু অন্তত…সত্যি কথা বলছি, আপনাদের আপ্যায়ন করার মতো তেমন কিছুই নেই, আমার লজ্জাই করছে, তবু যদি দয়া করে… দেখুন খুব মেঘ করেছে হঠাৎ, বৃষ্টি নামবে, খিচুড়ি করে দেওয়া যেতে পারে, তাড়াতাড়ি হবে।

রেহানা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ধন্যবাদ। শুধু খাওয়ার জন্য আর দেরি করার কোনও মানে হয় না। এবার আমাদের যেতেই হবে।

অবনী সিরাজুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, থাকবেন না?

সিরাজুল এতক্ষণ কিছু বলেননি। এবার তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী রে, কী করবি?

রেহানা অস্থির ভাবে বলল, মুসাফির, ওঠো।

সিরাজুল গা মুচড়ে বললেন, এঁরা এত করে বলছেন। আমার লুচি খাওয়ার নিষেধ আছে, তবে খিচুড়ি আমি ভালবাসি!

এরপর আর অন্য দু’জনের আপত্তি টেকে না।

সোফায় হেলান দিয়ে বসে সিরাজুল বললেন, একটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এত দিন আমার ধারণা ছিল, এই বাড়ি সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছুই মনে নাই। এখানে এলে টুকরো টুকরো অনেক কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছে। সাবকনশাস মাইন্ডে এ-সব লুকিয়ে ছিল। আতাউর নামে আমার এক খেলার সাথি ছিল এখানে, ডাক নাম ছিল আতা। আমাদের চলে যাওয়ার দিনে সে খুব কেঁদেছিল। স্পষ্ট মনে পড়ে তার মুখখানা। তাদের পরিবারের কেউ পাকিস্তানে যায় নাই, কী জানি সেই আতাউর এখন এখানে থাকে কি না!

অবনী বলল, এখানে বেশ কিছু খানদানি মুসলমানের বাড়ি আছে, সেখানে গিয়ে খোঁজ করা যেতে পারে।

সিরাজুল বললেন, আতাউররা খানদানি ছিল না, ওর বাবা ছিল আমাদেরই কর্মচারী, ওর একটা ছোট বোন ছিল, তার নাম পারভিন, তার মুখের হাসিটা এত মিষ্টি, ওই যে বলে না, কথা বললে মুক্তা ঝরে পড়ে।

মিন্টু বলল, তার সাথে আপনার রোমান্স ছিল নাকি?

সিরাজুল বললেন, ছিল তো বটেই। নয় বছরের ছেলের সাথে সাত বছরের মেয়ের যতখানি রোমান্স হতে পারে। আর একটা কথাও মনে পড়ছে। আমাদের এ বাড়ির ছাদ থেকে ট্রেনলাইন দেখা যায়, তার পাশে পাশে কাশফুল ফুটে থাকত। ট্রেন আসার শব্দ শুনলেই আমি ছাদে উঠে ট্রেন দেখতাম। তখন অবশ্য আমরা বলতাম রেলগাড়ি। পরে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি ফিল্মটা যখন দেখলাম, অপু আর দুর্গা ছুটতে ছুটতে কাশফুলের মধ্য দিয়ে ট্রেন দেখতে যাচ্ছে, তখন নিজের সঙ্গে খুব মিল খুঁজে পেয়েছিলাম।

রেহানা বলল, তুমি বললে, আমাদের বাড়ি! পঞ্চাশ বছর আগে ছেড়ে চলে গেছ!

সিরাজুল বললেন, সেটাও পিকিউলিয়ার ফিলিং হচ্ছে। এত বছর নারায়ণগঞ্জের ওই বাড়িতে আছি, কিন্তু যেহেতু বাপ-দাদারা ওই বাড়ি তৈরি করেননি, তাই ওটা ঠিক যেন নিজের বাড়ি মনে হয় না। এটাই যেন আসল নিজের বাড়ি। বার বার ফিরে যাচ্ছি শৈশবে। বৃদ্ধ বয়সে বোধকরি এ-রকমই হয়।

অবনী বলল, আপনি এ বাড়িটা কিনে নিন না। আবার আপনার নিজের বাড়ি হবে।

কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে সিরাজুল তাকিয়ে রইলেন।

অবনী বলল, মামলার রায় বেরুবে সামনে সপ্তাহে। আমরা জিতবই। তারপর এ বাড়ি নিয়ে কী হবে, সেটাই সমস্যা। আর ঠিক দেড় মাস পরেই আমি চলে যাচ্ছি আমেরিকা। তখন কে দেখবে? মাকে কলকাতায় নিয়ে রাখব। আমরা এখানকার পাট তুলে দিতে চাই! আপনারা বাড়িটা নিয়ে নিন। এখানে এসে মাঝে মাঝে থাকবেন।

সিরাজুল এক গাল হেসে বললেন, তা হয় নাকি? আমরা অন্য দেশের নাগরিক, অন্য দেশে প্রপার্টি রাখতে পারি না।

অবনী বলল, বাংলদেশের লোক আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডে বাড়ি কিনতে পারে না?

সিরাজুল বললেন, তা পারে। কিন্তু এখানে সম্ভব নয়। আপনাদেরও একই ব্যাপার। ইন্ডিয়ানরাও ইওরোপ-আমেরিকায় বাড়ি কিনতে পাবে, কিন্তু বাংলাদেশে পারবে না। এই রকমই তো ব্যাপার।

অবনী বলল, তাই বুঝি! জানতাম না। আমাকে আপনি বলছেন কেন, তুমি বলুন। চলুন, একবার ছাদে যাবেন? রেললাইন এখনও দেখা যায়।

সিরাজুল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন।

মিন্টু বলল, দুলাভাই আপনার পক্ষে কি অত সিঁড়ি ভাঙা উচিত হবে?

 সিরাজুল উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আস্তে আস্তে উঠব। একবার দেখে আসি।

অবনীর পাশ দিয়ে উঠতে উঠতে রেহানা জিজ্ঞাসা করল, আপনি আমেরিকায় কোথায় যাচ্ছেন?

অবনী বলল, বোস্টনে। একটা স্কলারশিপ পেয়েছি, এমআইটি’তে জয়েন করব।

মিন্টু বলল, খুকিও তো যাচ্ছে। তবে, ও অন্য জায়গায়, বাফেলো। ওখানে পিএইচডি করবে।

দো-তলায় একটা টানা বারান্দা। পর পর ঘর। একটি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। সাদা শাড়ি পরা, মাথার চুল সব সাদা, ফর্সা রঙ, মুখে অনেক ভাঁজ। মাথায় অর্ধেক ঘোমটা।

অবনী বলল, আমার মা।

সিরাজুল অস্ফুট স্বরে বললেন, আশ্চর্য, আমার মায়ের সঙ্গে অদ্ভুত মিল। চমকে উঠেছিলাম। যেন আমার মা-ই দাঁড়িয়ে আছেন।

অবনী সকলের সঙ্গে মায়ের পরিচয় করিয়ে দিল।

মিন্টু আর রেহানা সালাম জানাল।

আবেগের আতিশয্যে সিরাজুল এগিয়ে গিয়ে অবনীর মায়ের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করে ফেললেন।

অবনীর মা সসঙ্কোচে বললেন, এ কী, এ কী, থাক থাক!

 সিরাজুল বললেন, মাসিমা, আপনার নিশ্চয়ই নারায়ণগঞ্জের কথা মনে আছে? একবার চলেন না সেখানে।

অবনীর মা বললেন, আমার দু’পায়ে রাত। আর চলাফেরার সাধ্য নেই। নিচেই নামতে পারি না।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নারায়ণী বলল, আমার একবার বাংলাদেশ দেখে আসতে খুব ইচ্ছে করে।

তার গলার স্বর এখন নরম।

রেহানা তার বাবার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল।

সিরাজুল নারায়ণীকে অগ্রাহ্য করে অবনীর মাকে বললেন, প্লেনে গিয়ে উঠবেন আর নামবেন। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি করে নিয়ে যাব। কোনও অসুবিধে হবে না।

অবনীর মা বললেন, তা আর হবে না। আপনারাই এ বাড়িতে কয়েকটা দিন থেকে যান। কত ঘর খালি পড়ে আছে।

সিরাজুল ভদ্রতা করে বললেন, সম্ভব হলে নিশ্চয় থাকতাম। কিন্তু আমার শরীর ভাল না, ফিরে যেতে হবে। আপনাদের নারায়ণগঞ্জের বাড়িটা ঠিকঠাকই আছে।

অবনীর মা আর কোনও কথা না বলে তাকিয়ে রইলেন। যেন তার দৃষ্টি সুদূরে চলে গেছে। অতীতে, কিংবা শেষ দিনগুলির ও-পারে।

ছাদের সিঁড়ির দিকে ফিরে আসতে আসতে আর একটা ঘরের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে সিরাজুল বললেন, এই ঘরখানায় আমার বড় আপার বিয়ে হয়েছিল। আমার তখন তিন-চার বছর বয়েস, স্পষ্ট মনে পড়ছে, দুই হাতে মেহেন্দির ছাপ দেওয়া হয়েছিল। আমার আর দুই বোন, এখন বেঁচে নাই, মুখ দেখতে পাচ্ছি।

ছাদ থেকে দেখা যায় বাড়ির পেছন দিকে অনেকখানি মাঠ ও জলাভূমি, তার মাঝখানে রেললাইন। একটু দূরে সেই বটগাছ। এমনকিছু আহামরি দৃশ্য নয়। কাশফুল এখন ফোটেনি।

ঠিক সেই সময়েই একটা ট্রেন এল।

সিরাজুল হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, ওই যে ওই যে, দেখ, ট্রেন যাচ্ছে।

রেহানা বলল, মুসাফির, তুমি যে একেবারে বাচ্চা হয়ে গেলে!

সিরাজুল বললেন, তাই বোধহয় হয়ে গেছি। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বোধহয় একটু একটু অপু চরিত্রটা থাকে। ট্রেনটা দেখে বাচ্চা বয়সের মতোই আনন্দ হল।

আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে। আর ছাদে থাকা যায় না। কিন্তু সিরাজুল যেতে চাইলেন না। এক দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ওইখানে দুটো বাতাবি লেবুর গাছ ছিল। এখনও একটা আছে দেখছি।

রেহানা বলল, ওই গাছ কি অত দিন বাঁচে? ওটা নিশ্চয়ই অন্য একটা নতুন গাছ।

সিরাজুল তবু জোর দিয়ে বললেন, না না, নতুন না, কত বড় দেখছিস না, সে-আমলেরই। মানুষ কত কথা ভুলে যায়, কিন্তু গাছ মনে রাখে। ওই গাছটা কি আমাকে মনে রেখেছে?

.

০৪.

ঠিকানা দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল, চিঠি লেখা ও আবার দেখা হবার প্রতিশ্রুতি বিনিময় হয়েছিল। কিন্তু সে-সব আর পরে মনে থাকেনা।

সিরাজুলরা ফিরে গিয়ে চিঠি দেননি। অবনীও বিদেশে যাবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। খুড়তুতো ভাইদের সঙ্গে মামলায় সে জিতেছে, তবুও বাড়ি জবরদখলের সম্ভাবনা রয়েই গেল। মাকে সে নিয়ে এসেছে কলকাতার ফ্ল্যাটে। অবনী বিয়ে করেনি, তার অনুপস্থিতিতে এক মামাতো ভাই সস্ত্রীক এই ফ্ল্যাটে থেকে মায়ের দেখাশুনো করবে।

কিছুদিন আগে একবার সে ভেবেছিল, খুড়তুতো ভাইদের সে ও-বাড়িটা ব্যবহার করতে দিতে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু ওরা মামলা করার পর আর সে প্রশ্ন ওঠেনা। মামলার সময় তারা অবনীকে অকথ্য-কুকথ্য গালিগালাজ করেছে। বলরাম চৌধুরীর বেশি বয়সের সন্তান অবনী, কিন্তু ওরা ইঙ্গিত করেছিল, অবনী আসলে বলরামের ছেলেই নয়, তার জনক অন্য কেউ। এটা অবনীর মায়ের চরিত্র সম্পর্কেও কুৎসিত অপবাদ। তাই অবনীর জেদ চেপে গেছে, ও-বাড়ি সে জলের দরে বেচে দেবে, তবু সে খুড়তুতো ভাইদের ও-বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেবে না।

আপাত সে বাড়ি পাহারা দেবার জন্য এক জন নেপালি দারোয়ান নিযুক্ত করেছে।

মাকে ফেলে রেখে বিদেশে চলে যেতে হবে, সেজন্য অবনীর মনে খানিকটা খুঁতখুঁতুনি ছিল। কিন্তু মা-ই তাকে যেতে বলছেন বার বার। মা যেন তার জীবন থেকে সব চাওয়া-পাওয়া ঝেড়ে ফেলেছেন। বার বার বলেছেন, তার কোনও অসুবিধে হবে না। টেলিফোনে তো কথা হবেই।

যাবার আগের কয়েকটা দিন অবনী তার মায়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে চায়।

মা যশোরের মেয়ে। বিয়ের পর গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ। তা-ও খুব বেশিদিন সেখানে থাকেননি। স্বামীর সঙ্গে তার বয়সের বেশ তফাৎ ছিল।

মায়ের মুখে পুরনো কথা বিশেষ শোনেনি অবনী।

সিরাজুল সাহেবরা ঘুরে যাওয়ার পর হঠাৎ যেন মায়ের স্মৃতির দরজা খুলে গেছে। বলতে শুরু করেছেন শ্বশুর-শাশুড়ির কথা। ঠাকুর্দা-ঠাকুমাকে চোখেই দেখেনি অবনী, তাদের ছবিও নেই। নারায়ণগঞ্জের বাড়িটা প্রায় শীতলক্ষা নদীর ধারে, বড় বাগান ছিল। আগে দু’একবার অবনী শুনেছে, মা শ্বশুর বাড়ির চেয়ে বাপের বাড়ি বেশি পছন্দ করতেন। নারায়ণগঞ্জের চেয়ে যশোর অনেক বেশি সুন্দর শহর। সেই তুলনায় নারায়ণগঞ্জ ঘিঞ্জি, সবসময় লোকজনের চ্যাঁচামেচি। এখন মা নারায়ণগঞ্জের বাড়িটার কথাই বলতে লাগলেন বার বার। একবার একটা ব্রত উপলক্ষে তিনি চাপাগাছের চারা পুঁতেছিলেন নিজের হাতে। সেই গাছটাকে বড় হতে দেখেছেন, ফুল ফোঁটার আগেই অবশ্য সেবাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়। সেই গাছটা এখনও আছে কি না কে জানে!

মা বললেন, তুই তো একবার বাড়িটা দেখতে গেলেও পারিস!

অবনী বলল, এখন সময় কোথায়? দেখি যদি ফিরে আসার পর– ।

আমেরিকায় যাবার পথে ঢাকার অবশ্য থামতে হল অবনীকে।

বাংলাদেশ বিমানের টিকিট, কলকাতা থেকে উড়তে না-উড়তেই পৌঁছে গেল ঢাকা। পরবর্তী ফ্লাইট সাড়ে তিন ঘণ্টা পর, এই সময়টা কাটাতে হবে ট্রানজিট লাউঞ্জে।

পৃথিবীর সব দেশের এয়ারপোর্ট প্রায় একই রকম। কোনওটা বেশি বড়, কোনওটা তুলনায় ছোট। ট্রানজিট লাউঞ্জ থেকে বাইরে বেরুতে দেবেনা, শহরটাও দেখা যাবে না।

বসে বসে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল অবনীর, হঠাৎ একটা ঘোষণা শুনে সে চমকে উঠল। কিছু একটা যান্ত্রিক গোলযোগে পরবর্তী বিমান ছাড়তে অনেক দেরি হবে, ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে হোটেলে।

অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে একটা বাসে তুলে দেওয়া হল অবনীকে। রাত প্রায় এগারোটা। বড় বড় রাস্তা, ঝকঝক করছে আলল, এ ছাড়া শহরের আর কিছু দেখার নেই। দোকানপাটও সব বন্ধ।

কলেজের ছাত্র অবস্থায় একবার ক্রিকেট টিমের সঙ্গে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে গিয়েছিল অবনী। বিদেশযাত্রা তার কাছে একেবারে নতুন নয়। বিদেশের হোটেলেও থেকেছে। মাঝারি ধরনের হোটেল সব জায়গায় এক।

ভোরবেলায় আবার তুলে নিয়ে যাওয়া হবে তাদের। অবনী দাঁত-টাত মেজে তৈরি হয়ে রইল। কেউ এল না। একটু বেলা হবার পর জানা গেল, আরও একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে তাদের। হোটেলের খরচ বিমান কোম্পানিই দেবে।

পুরো একটা দিন তাকে কাটাতে হবে ঢাকায়। এখানকার কারুকেই সে চেনে না। তখন তার মনে পড়ল নারায়ণগঞ্জের কথা। নারায়ণগঞ্জ কত দূরে? হোটেলের এক জন বেয়ারার কাছে জিজ্ঞেস করে সে জানল, নারায়ণগঞ্জ বেশ কাছেই দশ-বারো মাইলের দূরত্ব। ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জকে টুইন সিটি বলা যায়, অনবরত লোকজন যাতায়াত করছে।

যাঃ, সিরাজুল চৌধুরীর ঠিকানা লেখা কাগজটা তো সে আনেনি!

হোটেলটা শহরের কেন্দ্রস্থলে। বাইরে বেরিয়ে খানিকটা ঘুরে এল অবনী। বড় বড় সব বাড়ি, ঝলমলে দোকান, কলকাতার চেয়েও সুদৃশ্য মনে হয়। তবে বড় বেশি সাইকেল রিকশা, ট্রাফিকও খুব বিশৃঙ্খল।

একা একা নতুন কোনও জায়গায় ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে না। তাছাড়া অবনীর মনটা আমেরিকার চিন্তায় আবিষ্ট হয়ে আছে। বোস্টনে তার এক দাদার বন্ধু থাকে, তার এয়ারপোর্টে রিসিভ করার কথা ছিল। সে এসে ফিরে গেছে। তাকে একটা ফোন করতে হবে, কিন্তু পরের ফ্লাইট ঠিক কখন যাবে, তাই-ই যে এখনও নিশ্চিত করে জানা যাচ্ছে না।

দিনেরবেলা শুধু শুধু ছোটলের ঘরে বসে থাকতেও খুব খারাপ লাগে। একটা গাড়ি ভাড়া করে অনায়াসে নারায়ণগঞ্জ ঘুরে আসা যেত। বর্ধমানের তালিত একটা ছোট জায়গা, সেখানে সিরাজুল চৌধুরীরা যেভাবে বাড়ি খুঁজে পেয়েছিলেন, সেভাবে কি নারায়ণগঞ্জে বাড়ি খুঁজে পাওয়া সম্ভব? তাছাড়া সিরাজুল চৌধুরীর কিছুটা স্মৃতিও ছিল।

সিরাজুল চৌধুরীর শ্যালক মিন্টু একজন নামকরা কবি। কিন্তু কী যেন তার ভাল নামটা? একেবারেই মনে পড়ছে না। মুসলমানদের নাম একবার-দু’বার শুনলে মনে রাখা শক্ত। কারণ মানে বোঝা যায় না, শব্দগুলোও পরিচিত নয়। অমল, কমল, বিমল কিংবা অভিজিৎ, অনির্বাণ, রণজয় ধরনের নামগুলি চোখ বা কানে বহুপরিচিত। সেই তুলনায় ইফতিকার, আনোয়ারুল, ইমতিয়াজ বা খন্দকার যেন নিছক শব্দ। মুসলমানরা নিশ্চয়ই মানে বোঝে, হিন্দুরা বোঝে না। ওদের ওই সবনাম পৃথিবীর যে-কোনও দেশের মানুষের হতে পারে, বাঙালি বলে আলাদা ভাবে চেনার উপায় নেই।

সকালে ঘরে একটা ইংরিজি ও একটা বাংলা কাগজ দিয়েছিল। তাতে চোখ বোলাতে গিয়ে অবনী লক্ষ্য করেছে, কেউ কেউ নিজেদের বাঙালিত্ব বোঝাবার জন্য আরবি নামের শেষে মিলন, মুকুল, মিন্টু, বাবু এই সব জুড়ে দিয়েছে। এগুলো বোধহয় এঁদের ডাকনাম।

সিরাজুল চৌধুরীর নামটা তার মনে আছে অবশ্য। তার কারণ সিরাজ নামটা কোন না বাঙালি জানে? তবে সিরাজুল চৌধুরীও যে ছদ্মনামে কিছু লেখেন, তা সে জানে না।

হোটেলের লবিতে একটা ছোট বইয়ের দোকানও আছে। দোকানের কর্মচারীটির সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে দু’জন যুবক। অবনী সেখানে গিয়ে কয়েকটা বইয়ের পাতা উলটে দেখল, তারপর খুব সংকোচের সঙ্গে ওদের জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কিছু মনে করবেন না, বোকার মতো একটা প্রশ্ন করছি, আপনাদের এখানে একজন কবি আছেন, নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না, তবে মিন্টু বলে তাকে অনেকে চেনে।

অবনী আর কিছু বলার আগেই ওদের এক জন বলল, আবদুল কাদের। তার বই চান? আপনি ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন?

অবনী মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। ওঁর সঙ্গে আমার একবার পরিচয় হয়েছিল। ঠিকানা জানি না, একবার দেখা করার ইচ্ছা ছিল।

ওদের এক জন বলল, মিন্টুভাই এলিফ্যান্ট রোডে থাকেন না?

আর এক জন বলল, ইত্তেফাকে আছেন, সেখান থেকেই তো জানা যায়।

নিজেরাই উৎসাহ করে ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসে ফোন করল। সেখানে জানা গেল, আবদুল কাদের ছুটিতে আছে, তার বাড়ির ফোন নম্বর পাওয়া গেল।

সেই নম্বরে ফোন করার পর এক জন মহিলা বললেন, আসসালামু আলাইকুম।

কথাটা এত দ্রুত বলা হল যে অবনী কিছুই বুঝল না। সে জিজ্ঞেস করল, আবদুল কাদের সাহেব আছেন?

জি না। এখন বাসায় নাই।

কখন ফিরবেন?

 আপনি কে বলছেন?

আমি ইন্ডিয়া থেকে এসেছি। ঠিক আছে, আমি পূর্বাণী হোটেলে আছি, পরে ফোন করব।

 আপনার নামটা বলেন, লিখে রাখব।

আমার নাম অবনী চৌধুরী।

কী নাম বললেন?

অবনী আর একবার নিজের নাম বলতেই সেই মহিলাটি বললেন, আপনি হোটেলের লবিতে আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। কাদের সাহেবকে খবর দিচ্ছি, তিনি পৌঁছে যাবেন।

অবনী আবদুল কাদেরের একটি কবিতার বই কিনে এক জায়গায় বসে পড়তে শুরু করে দিল।

সে বিজ্ঞানের ছাত্র, খেলাধুলাতেই উৎসাহ ছিল বেশি, সাহিত্যের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নেই। গল্প উপন্যাস তবু কিছু পড়েছে, শখ করে কবিতা পড়েনি কখনও। আবদুল কাদেরের কবিতাগুলি দুর্বোধ্য নয়, বেশ বোঝা যায়।

একটা ব্যাপারে সে খুব বিস্মিত হয়েছে। শুধু ডাকনাম শুনেই এরা একজন কবিকে চিনে ফেলল? কবিরা এখানে এত জনপ্রিয়? কিংবা এমনও হতে পারে, বইয়ের দোকনে যে ছোকরা দুটি দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও কবিতা লেখে।

সে যাই হক, মিন্টু অর্থাৎ আবদুল কাদের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। তিনি অবনীর মতো একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করার জন্য হোটেলে আসবেন কেন? অবনীরই যাওয়া উচিত তাঁর বাড়িতে। মহিলার কাছ থেকে বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নিলেই হত।

মাঝে মাঝে হোটেলের প্রবেশ পথটার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে অবনী। হঠাৎ এক সময় তার বুকটা ধক করে উঠল। মিন্টু নয়, তার মেয়ে রেহানা আসছে দ্রুত পায়ে।

বর্ধমানে সে রেহানাকে দেখেছিল সালোয়ার-কামিজ পরা অবস্থায়। মনে হয়েছিল, ছোটখাটো চেহারা। মুখে রাগী রাগী ভাব। আজ সে পরে আছে একটা ঘি রঙের শাড়ি, মাথার চুল খোলা, যেন অন্য রকমের এক পূর্ণ যুবতী।

রেহানা চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগল, অবনী বসেই রইল চুপ করে। তাকে দেখতে পেয়ে রেহানা কাছে এগিয়ে এসে ধমকের সুরে বলল, ঢাকায় এসেছেন, আগে খবর দেননি?

অবনী বলল, এখানে থাকার কথা ছিল না। বিমানে কী যেন গণ্ডগোল হয়েছে।

 রেহানা বলল, চলুন, উঠুন, উঠুন!

 কোথায় যাব?

আপনার ফ্লাইট কোন সময়?

সম্ভবত আজ রাত্তিরে।

 অনেক সময় আছে। উঠুন।

এত ভাল ভাল বিদেশি গাড়ি কলকাতায় কেন, ভারতের কোথাও দেখা যায় না। রেহানা তাকে তুলল একটা বড় জাপানি গাড়িতে। এক জন কবির মেয়ে এমন দামি গাড়িতে চড়ে? ড্রাইভারের পরিষ্কার সাদা উর্দি।

ড্রাইভারকে কিছু একটা নির্দেশ দিয়ে রেহানা অবনীর দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, এখানে আপনাকে বাগে পেয়েছি। আর ছাড়ছি না। আপনার ওপর আমার রাগ আছে। আজ আপনার ফ্লাইট মিস করাব!

অবনী বলল, সে কী! আমি কী দোষ করেছি?

রেহানা বলল, আপনি আমাদের শান্তিনিকেতন যেতে দেননি! শান্তিনিকেতন না দেখে শুধু বর্ধমান দেখে এসেছি, তা শুনলে এখানকার মানুষ হাসে।

সে-দিন খিচুড়ি রান্নার পর খেতে খেতে বেলা তিনটে বেজে গিয়েছিল। তারপর নামল তুমুল বৃষ্টি। তার মধ্যে বেরুনো যায় না। বসে বসে গল্প হয়েছিল শেষ-বিকেল পর্যন্ত।

শান্তিনিকেতনের প্রোগ্রাম ক্যানসেল করতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। অবনীরও সে-দিন ফেরার কথা। ওদের সঙ্গেই বর্ধমান এসে, একই ট্রেনে ফিরেছিল কলকাতায়।

শান্তিনিকেতন তো এর পরেও একবার এসে দেখে যেতে পারেন।

একবার কেন, একশো বার যেতে পারি। কিন্তু সেবারই আমার দেখার ইচ্ছে ছিল, সেই জন্যই বেরিয়েছিলাম। আপনি খিচুড়ি খাওয়াবার নাম করে আমাদের দেরি করালেন।

এক্সট্রিমলি সরি। খিচুড়ি যে আপনার একেবারে পছন্দ নয়, তা বুঝতে পারিনি।

সেকথা হচ্ছে না। খিচুড়িটা ইম্‌মেটিরিয়াল, দেরিটাই আসল।

পরে যে অত বৃষ্টি নামবে, সে ব্যাপারে আমার হাত ছিল না।

আপনি শহিদ মিনার দেখেছেন? সাভারের স্মৃতিসৌধ দেখেছেন?

আমি তো বাংলাদেশে আগে আসিনি। কিছুই দেখিনি।

ও-সব কিছু আপনাকে দেখাব না। নারায়ণগঞ্জের একটা পুরনো শ্যাওলাধরা বাড়ির মধ্যে আপনাকে ঠেসে রাখব। আপনি যেমন বর্ধমানে আমাদের রেখেছিলেন।

আমরা কি এখন নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছি? সিরাজুল চৌধুরী সাহেব কি সেখানে? তার সঙ্গে দেখা হলে ভাল লাগবে।

আমার বাবাও সেখানে।

ঢাকা শহর ক্রমশই বাড়ছে। গাড়ির সংখ্যাও প্রচুর। মাঝে মাঝেই যানজট, গাড়ি থেমে থাকে কিছুক্ষণ। গরম অবশ্য নেই। তাছাড়া এ গাড়িটা এসি।

অধিকাংশ দোকানের নাম বাংলায় লেখা। এমনকী ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপনও বাংলায়, এ-সব অবনীর চোখে অভিনব লাগে।

নারায়ণগঞ্জে পৌঁছতে দূরত্বের তুলনায় অনেকটা বেশি সময় লাগল।

গাড়ি থেকে নেমে প্রথম দর্শনে অবনী তাজ্জব বনে গেল। এত বড় বাড়ি? মনে হয় যেন দু’মহলা। রেহানা বলেছিল, শ্যাওলাধরা, বাইরের দিকে অন্তত সে-রকম কোনও চিহ্নই নেই।

এ বাড়ির সঙ্গে বর্ধমানের বাড়িটার কোনও তুলনাই হয় না। এটাকে মনে হয়, রীতিমতো কোনও ধনীর বাড়ি। গেটে দারোয়ান রয়েছে।

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অবনীর মনে হল, এক্সচেঞ্জের ব্যাপারে তার বাবা খুব ঠকে গিয়েছিলেন। এই বাড়ির বদলে বর্ধমানের ওই বাড়ি কেউ নেয়? বাধ্য হয়ে নিতে হয়েছিল।

বাড়িভর্তি অনেক লোক।

গেট দিয়ে ঢুকে, একটা লন পেরিয়ে প্রশস্ত বৈঠকখানায় পাওয়া গেল সিরাজুল ও মিন্টুকে। অন্য দু’জন ভদ্রলোকের সঙ্গে বসে তারা কী সব বৈষয়িক ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রেহানা বলল, আব্বু, দেখো, কাকে ধরে এনেছি।

মিন্টু মুখ তুলে বলল, আরেঃ! সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ! কোথায় পেলি একে?

সিরাজুল বললেন, অবনী? এসো, এসো, ওয়েলকাম হোম!

একটু পরেই চা এল, তার সঙ্গে একটা বড় প্লেটভর্তি বিস্কুট আর মিষ্টি। তারপর অগণিত মানুষের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দেওয়া হল। কেউ নানির মেয়ে, কেউ ফুফার ছেলে, কেউ বড় আপা।

নানী, ফুফা ঠিক কাদের বলে, তা অবনী জানে না। তবে আপা মানে দিদি, তা সে জনে, আর দাদাকে এরা বলে ভাই। এত আত্মীয়-স্বজন এই বাড়িতেই এক সঙ্গে থাকে, না কোনো উৎসব উপলক্ষে এসেছে, তা ঠিক বোঝা গেল না।

প্রথম দেখা হলে সকলেই একটা হাত বুকের কাছে খানিকটা তুলে বলে, সেলাম আলেকুম। এটাই সম্বোধন। কিন্তু সবাই খুব তাড়াতাড়ি বলে কেন? অবনীর বয়সী পশ্চিম বাংলার ছেলেরা আজকাল আর সচরাচর হাতজোড়ও করেনা, নমস্কার কথাটাও উচ্চারণ করে না। এমনিই কথা শুরু করে।

এদের এইভাবে সম্বোধনের উত্তরে কী করা উচিত, তা বুঝতে না পেরে অবনী বেশ অস্বস্তিতে রইল।

গল্পের বইতে সে পড়েছে, মুসলমানরা প্রথম সম্বোধনে আদাব বলে। এখানে আদাব শব্দটা সে কারুকেই ব্যবহার করতে শোনেননি!

চা শেষ করার পর সিরাজুল বললেন, চলো, তোমাদের আসল বাড়িটা দেখিয়ে আনি। সামনের পোরশানটা নতুন, খানিকটা জমি কিনে আমরা বাড়িয়েছি!

বাবা ঠকে গেছেন, এই রকম একটা চিন্তা নিয়ে অবনীর ভেতরে খানিকটা ক্ষোভ জমেছিল। এবার সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বাড়িটা আদতে এত বড় ছিল না, জমিও ছিল না এতটা। তাছাড়া সিরাজুল সাহেবরা এটাকে বসতবাড়ি করে রেখেছেন, বর্ধমানের বাড়িটার সেরকম ব্যবহার হয়নি অনেক দিন।

পেছন দিকে একটা উঠোন, তারও দিকের বাড়িটার গড়নই পুরনো ধরনের। মোটা মোটা দেওয়াল। এক তলায় অনেকখানি খোলা বারান্দা, যা এখন অপ্রয়োজনীয়। আগেকার কালে বাড়ির মহিলারা ওখানে বসে তরকারি কুটতেন বোধহয়।

এ বাড়ির দেওয়ালে কিছু কিছু শ্যাওলার ছোপ আছে।

সিরাজুল বললেন, পুরনো বাড়িটাই আমার বেশি ফেভারিট। দোতলার জানলা দিয়ে শীতলক্ষা নদী দেখা যায়। আমি সেই ঘরেই থাকি।

অবনীর কিছুই রোমাঞ্চ হচ্ছে না। এখানে সে জন্মায়নি। তার বাবা-মা এখানে ঘুরে বেড়াতেন, সে কল্পনা করার চেষ্টা করছে। উঠোনে একটা তুলসিমঞ্চ রয়েছে, গাছটা নেই। একেবারে খালি। ওখানে মা প্রতি সন্ধেবেলা প্রদীপ জ্বালতেন?

মায়ের নিজের হাতে পোঁতা চাপা গাছটা কি এখন আছে?

সেকথা জিজ্ঞেস করতেই সিরাজুল বললেন, একটা চাপাগাছ ছিল বটে, অনেক ফুল ফুটত। আমি ছোটবেলায় দেখেছি। একবার খুব ঝড়ে সেই গাছটা পড়ে যায়।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে মিন্টু বলল, দুলাভাই, বর্ধমান গিয়ে দেখার পর বুঝলাম, সম্পত্তি বদলাবদলি করে আপনারাই জিতেছেন।

সিরাজুল বললেন, কেন? দুটো বাড়ির সাইজ প্রায় সমান সমান। উনিশ-বিশ!

 মিন্টু বলল, তা হতে পারে। কিন্তু পোজিশান? বর্ধমানের ওই তালিত নিতান্তই মফঃস্বল। সে-তুলনায় নারায়ণগঞ্জ অনেক জমজমাট। এখান থেকে ঢাকা যাওয়া-আসাও অনেক সহজ।

সিরাজুল বললেন, পার্টিশনের সময় এখান থেকে ঢাকাও বেশ দূর মনে হত। তখন তো এত মোটরগাড়ি ছিল না। আমরা যেতাম নৌকায়।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসে অবনীর চক্ষু চড়ক গাছ।

একটা লম্বা টেবিল ভর্তি বিভিন্ন আকারের পাত্রে কত রকম যে খাদ্যদ্রব্য সাজানো, তার ঠিক নেই।

খাবে মাত্র চার জন, সিরাজুল, তার একবড় ভাই গনি সাহেব, মিন্টু আর অবনী।

রেহানা আর একজন মহিলা পরিবেশন করবেন।

অবনী বসার বদলে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে দেখে রেহানা বুঝিয়ে দিতে লাগল কোনটা কী।

টাকিমাছের শুঁটকি, শাক-শুঁটকি, আলুভাজা, বেগুনভাজা, দু’রকম ডাল, কই মাছ, চিতল মাছের পেটি, বড় বড় গলদা চিংড়ি, দু’রকম মাংস, চাটনি, দই, তিন রকম মিষ্টি…।

সিরাজুল বললেন, বিফ নেই, চিন্তা করো না, আমি আগেই বলে দিয়েছি।

অবনী বলল, সেটা চিন্তার বিষয় নয়। কলেজে পড়ার সময় আমরা নিয়মিত নিজামের দোকানের বিফ রোল খেয়েছি। কিন্তু…এত খাবার কি মানুষে খেতে পারে?

রেহানা বলল, ও-সব শুনবনা। প্রত্যেকটা আপনাকে খেতে হবে।

অবনী একেবারে মরমে মরে গেল। ছি ছি ছি, তাদের বাড়িতে এই অতিথিদের সে খিচুড়ি, বেগুনভাজা, ডিমভাজা আর একটা করে পার্শে মাছ ছাড়া আর কিছু খাওয়াতে পারেনি। আগে থেকে ব্যবস্থা ছিল না, অত বেলায় তালিতের বাজারে ভালো মাছও পাওয়া যায় না।

রেহানার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি।

অবনী অত সামান্য খাবার আয়োজন করেছিল বলেই যেন রেহানা তার প্রতিশোধ নিতে চাইছে।

এত কম সময়ের মধ্যে এত পদ রান্না হল কী করে? এরা কি প্রত্যেক দিনই এত রকম জিনিস খায়?

শুঁটকি মাছ আগে কখনও খায়নি অবনী। শুনেছে, ওতে খুব বদগন্ধ থাকে। তবে কোনও খাদ্য সম্পর্কেই তার মনে কোনও পূর্ব-সংস্কার নেই, সব কিছুই সে চেখে দেখতে রাজি আছে।

একটুখানি শুঁটকি মাছ সে মুখে তুলে দেখল, কোনও গন্ধ নেই তো!

তার ভয় ভয় ভাবটা দেখে সিরাজুল বললেন, শুঁটকি মাছ রান্না হলে আর গন্ধ থাকে না। কেমন লাগল?

অবনী বলল, বেশ নতুন ধরনের। আর একটু খাব।

তারপর সে মনের কথাটা বলেই ফেলল। সিরাজ সাহেব, আমাদের বাড়িতে আপনাদের কিছুই খাওয়াতে পারিনি। সে-রকম ব্যবস্থা ছিল না। তবু আপনাদের জোর করেছিলাম!

সিরাজুল বললেন, কী বলো! খিচুড়ি আমার দারুণ ফেভারিট! প্রায়ই খাই। তাছাড়া পার্শে মাছ ছিল, কত দিন পর খেলাম। ও-মাছটা আবার এ-দিকে পাওয়া যায় না।

মিন্টু বলল, খিচুড়ির কী চমৎকার স্বাদ হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে অত পাতলা খিচুড়ি বানাতে জানে না, বেশি ঘন হয়ে যায়।

অবনী বুঝল, এ-সবই ভদ্রতার কথা। এঁরা আবার পশ্চিম বাংলায় বেড়াতে গেলে… কিন্তু সে আর কবে হবে? আগামী দু’বছরের মধ্যে অন্তত তার আমেরিকা থেকে ফেরা সম্ভব নয়।

রেহানা বলল, আপনি পাঙাস মাছ খেয়েছেন?

অবনী ও-মাছের নামও শোনেনি। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় কিছু কিছু মাছের নাম আলাদা। মায়ের মুখে সে বাঁশপাতা, চ্যালা, ভ্যাদা এই সব নাম শুনেছে, পশ্চিম বাংলায় ও-রকম নামের চল নেই।

সে দুদিকে মাথা নাড়ল।

রেহানা বলল, রাত্তিরে আপনাকে পাঙাস খাওয়ানো হবে। খুব মজার খেতে লাগে।

অবনী বলল, রাত্তিরে? আমাকে তো বিকেলেই চলে যেতে হবে। রাত্তিরে আমার ফ্লাইট।

রেহানা বলল, আপনার ফ্লাইট কাল বেলা এগারোটার আগে যাবেনা। আরও দেরি হতে পারে। রাত্তিরে আপনি এখানেই থেকে যাবেন। আপনাকে যেতে দেওয়া হবে না।

অবনী প্রায় আঁতকে উঠে বলল, না না, আমাকে ফিরতেই হবে। ফ্লাইট মিস করলে…আপনি কী করে জানলেন, কাল এগারোটার আগে ফ্লাইট যাবে না?

রেহানা বলল, জানা খুব সোজা। টেলিফোন করলেই জানা যায়! আপনাদের কলকাতার মতো তো নয় যে, এয়ারপোর্টে ফোন করলে কেউ ধরেই না।

মিন্টু বলল, সব খবর নেওয়া হয়ে গেছে। বিমানে আমার এক বন্ধু কাজ করে। কোনও চিন্তা নেই, সে ঠিক সময় আমাদের জানাবে।

সিরাজুল বললেন, সন্ধ্যার সময় এখানকার কিছু গণ্যমান্য লোককে ডেকেছি। তোমাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে। তুমি তো এখানকারই সন্তান। নারায়ণগঞ্জের এক কৃতী সন্তান উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা যাচ্ছে, এ তো আমাদেরও গর্ব।

অবনী বলল, কী যে বলেন! হাজার হাজার ছেলে মেয়ে বিদেশে যায়, এটা আবার কোনও ব্যাপার নাকি! এই রেহানাও তো যাচ্ছেন শুনলাম। বরং ওঁকে সম্বর্ধনা দিন।

রেহানা বলল, আমাকে কেন? আমি মেয়ে বলে?

মিন্টু বলল, আমাদের এখান থেকে অনেক মেয়েও পিএইচডি করতে গেছে। তবে জেনেটিক্সের মতো সাবজেক্ট নিয়ে ওর মতো এত ভাল রেজাল্ট আগে কেউ করেনি।

রেহানা বাবার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, তুমি খবরদার ওইসব কথা বলবে না লোকের সামনে।

সব কটা পদ একটু একটু করে খেলে দারুণ পেট ভরে যায়। অবনীর মনে হল, জীবনে কখনও সে এত বেশি খায়নি।

খাওয়ার পর সিরাজুল প্রস্তাব দিলেন অবনীকে খানিকটা বিশ্রাম নিতে। একটা ঘর তার জন্য রেডি করা আছে। সে ঘুমিয়েও নিতে পারে।

অবনীর দুপুরে ঘুমোনোর অভ্যেস নেই। ভেতরে ভেতরে সে অস্থির বোধ করছে খুব। সত্যিই কি তার বিমান কাল এগারোটার আগে ছাড়বেনা? নাকি এরা প্র্যাকটিক্যাল জোক করছে তার সঙ্গে। সে নিজে একবার টেলিফোনে জেনে নিতে পারলে নিশ্চিন্ত হতে পারত। কিন্তু এদের মুখের ওপর অবিশ্বাসই-বা করে কী করে!

রেহানার ঠোঁটে চাপা হাসিটাই সন্দেহজনক। বিশ্রাম নেবার প্রস্তাবটা না মেনে সে বলল, আমি বরং চারপাশটা ঘুরে টুরে দেখি!

সিরাজুল চৌধুরীরও দুপুরে শোওয়ার অভ্যেস নেই। বাগানে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। বাড়ির পেছনে দিকে খানিকটা জায়গায় বেগুন ও লঙ্কার চাষ হয়েছে। বেশ নধর বেগুন ফলেছে, লঙ্কাগুলিও সূর্যমুখী।

অবনীকে বললেন, তোমার বাবার আমলে একজন লোক এখানে আছে এখন। সে তোমাকে পুরনো কিছু কথা বলতে পারবে। দাঁড়াও তাকে ডাকি। এক জন মালিকে বললেন, এই শশাকে একবার আসতে বল তো এখানে।

একটু পরেই লুঙ্গি গেঞ্জি পরা এক জন বৃদ্ধ এল সেখানে। শরীরটা বেঁকে গেছে খানিকটা, মাথায় ঠিক টাক নেই, খামচা খামচা করে চুল উঠে গেছে।

সিরাজুল বললেন, এর নাম শশধর, সবাই শশা বলে ডাকে। তোমার বাবার আমলেও এই বাড়িতে কাজ করত, এখনও করে।

শশা, তোমার বলরাম চৌধুরীকে মনে আছে তো? ইনি তেনার ছেলে। শশধর ফ্যাল ফ্যাল করে অবনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হ, সব মন আছে। এনাকেও মনে আছে। ছুট ছিলেন, দুই তিন বছরের বাইচ্চা, আমি কোলে নিছি।

অবনী হাসল, এই বাড়ি বদলের আঠেরো বছর পর সে জন্মেছে কলকাতায়। এই মাটিতে সে আগে কখনও পা দেয়নি। এই লোকটি তাকে কোলে নিয়েছে?

সিরাজুল বললেন, যাঃ, তা কী করে হবে? সেই সময় বলরাম চৌধুরীর কোনও ছেলে-মেয়ে ছিল না।

এতেও দমে না গিয়ে শশধর বলল, ওই সইজনা গাছটার তলায় বইয়া বলরাম চৌঞ্জি তামুক খাইত। তেনার কোলে একটা শিশুরে দেখছি কতবার।

সিরাজুল বললেন, ওই সজিনা গাছটা আমাদের আমলের। আগে ছিল না।

শশধর বলল, দুর্গাপূজা হইত এ-বাড়িতে। কত ধুমধাম। একবার ছত্রিশটা রাজভোগ খাইছিলাম, তারপর মাটিতে গড়াগড়ি।

সিরাজুল হাসতে হাসতে বললেন, ছত্রিশটা রাজভোগ? এখনকার দিনে কেউ খেলে আর বাঁচবেই না।

দুর্গাপুজোর কাহিনিটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না অবনীর। সে তার মায়ের কাছে এ বিষয়ে কিছু শোনেনি।

সে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি মনে আছে, এখানে একটা চাঁপা ফুলের গাছ ছিল? ঠিক কোন জায়গাটায়?

অবনী লক্ষ্য করেছে, কিছু কিছু শব্দে সামান্য উচ্চারণের পার্থক্য থাকলেও সিরাজুল-মিন্টু-রেহানাদের মুখের ভাষা আর তার নিজের ভাষা প্রায় একই রকম। এই শশধরের মুখেই সে প্রথম কাঠ বাঙাল ভাষা শুনছে। শশধর সম্ভবত তার উচ্চারণ বুঝতে পারছে না।

অবনীর প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, অনেক গাছ আছিল, বোরোই গাছ, কদম গাছ, চাইলতা গাছ।

পঞ্চাশ বছরের স্মৃতি ক’জন ধরে রাখতে পারে? পুরনোও কথা শোনার কোনও রোমাঞ্চও বোধ করছে না অবনী।

সন্ধেবেলা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হল না বটে, তবে ছোটখাটো একটা গান-বাজনার আসর বসল। স্থানীয় প্রতিভার অভাব নেই। দু’জন আবৃত্তি করে শোনাল লম্বা লম্বা কবিতা। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, লালন ফকিরের গান গাইল কয়েক জন। রেহানাও বেশ ভাল গান জানে। প্রথমে সে কিছুতেই গাইতে রাজি হয়নি, মিন্টুর পেড়াপিড়িতেই তাকে হারমোনিয়াম ধরতে হল। মেয়ের গুণাবলীর জন্য খুব গর্বিত মিন্টু। সে নিজেও কবিতা পাঠ করল একেবারে শেষে।

অবনী গান জানে না। কবিতা আবৃত্তি করেনি কখনও। তবু তাকেও কিছু বলতে হল। প্রথম বাংলাদেশ দেখার অভিজ্ঞতা। পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান প্রসঙ্গে তার গলায় তেমন আবেগ ফুটল না।

এর মধ্যে সে অন্তত তিনবার মিন্টু ও রেহানাকে জিজ্ঞেস করেছে, তার ফ্লাইট সত্যিই ডিলেইড কি না।

আসর ভাঙার পর সে রেহানাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি বাফেলোতে কবে জয়েন করছেন?

রেহানা বলল, সামনের মাসের দশ তারিখে।

অবনী বলল, বাফেলোর কাছেই নায়েগ্রা জলপ্রপাত না? একবার নিশ্চয়ই দেখতে যাব। তখন খোঁজ করব আপনার।

রেহানা বলল, অবশ্যই আসবেন। আমিও বোস্টনে যাব। খুব সুন্দর শহর শুনেছি।

পাশ থেকে মিন্টু বলল, একটু মুশকিল কি হয়েছে জানেন? রেহানার হাজব্যান্ড আনোয়ার থাকে ক্যালিফোর্নিয়ায়। একেবারে অন্য প্রান্তে। দু’জনে থাকবে অত দূরে দূরে, যাওয়া-আসার খরচও তো অনেক। যদি মেয়েটা ওয়েস্ট কোস্টের কোনও ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন পায়, অনেক সুবিধে হয়।

রেহানা বলল, আব্বু, আমি যেখানে অ্যাডমিশান পেয়েছি, আমার সাবজেক্টের জন্য সেই ইউনিভার্সিটির খুব নাম আছে। ওটাই আমার পক্ষে ভাল।

সিরাজুল বললেন, অবনী, তুমি মেয়েটার একটু খোঁজখবর নিও। তোমার ঠিকানা, ফোন নাম্বার…।

অবনী বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমি লিখে দিয়ে যাচ্ছি।

.

০৫.

 অক্টোবরের কুড়ি তারিখ, এর মধ্যেই বরফ পড়তে শুরু করেছে।

বরফ পড়াটা কথার কথা, আসলে তুষারপাত। পেঁজা তুলোর মতো কিংবা পাখির সাদা পালকের মতো দুলতে দুলতে নামে, একটু পরেই গাছপালাগুলো সব সাদা হয়ে যায়।

প্রথম কয়েক বার এ দৃশ্য বিমোহিত করে রাখে। কাচের জানলায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখতে ইচ্ছে হয়। আস্তে আস্তে বদলে যায় পৃথিবীর রূপ। সব দিকে শুভ্রতা।

কয়েকদিন পর এ দৃশ্যে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আর ওই মুগ্ধতাবোধ থাকে না। তখন নানা অসুবিধের কথা মনে পড়ে। তুষারপাত হলেই তো আর ঘরে বসে থাকলে চলে না, কাজে বেরুতে হয়, দোকানে যেতে হয়। তার জন্য পরতে হয় একগাদা পোশাক, ঠাণ্ডা ছাড়াও যখন তখন পা-পিছলে পড়ার সম্ভাবনা।

অবনীর গাড়ি নেই। গাড়ি চালানো সে শিখে এসেছে কলকাতা থেকেই, ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্সও নিয়ে এসেছে, কিন্তু এখনও গাড়ি কেনার সামর্থ্য হয়নি। একটা সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল কিনেছে, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে জ্যাকসন স্ট্রিটে, কাছেই একটা টিউব স্টেশন।

এখন তুষারপাত হলেই অবনীর মনখারাপ লাগে। নিঃসঙ্গতা বোধটা তাকে চেপে ধরে। বিশেষত শেষ বিকেলের দিকে।

ওভারকোটের কলার তুলে দিয়েছে, দু’হাতে গ্লাভস, পাড়ায় গ্রসারি স্টোর থেকে কিছু মাছ-মাংস আর সবজি কিনে, খাকি রঙের ঠোঙাটা বুকে চেপে বাড়ি ফিরছে অবনী। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। মনে হয় যেন পৃথিবীতে আর কেউ নেই।

এই রকম সময় মনে হয়, ধুৎ, কেন বিদেশে এই রকম ভাবে পড়ে থাকা! একটা আমেরিকান ডিগ্রি কিংবা কিছু ডলার জমিয়ে কী এমন হাতি-ঘোড়া পাওয়া যাবে? আজকাল বিদেশি ডিগ্রির তেমন কোনও কদর নেই। দেশে অবনীর অবস্থা বেশ সচ্ছলই ছিল, আরও বেশি উপার্জনের লোভেও সে আসেনি। কিন্তু বিদেশে না আসাটা যেন দারুণ অযোগ্যতা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ ভাল রেজাল্ট করেও বিদেশে না গেলে অন্যরা বলে, কী রে, তুই চান্স পেলি না? তাই, যেন যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্যই আসা।

সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ উঠে দু’পা ঠুকে বরফ ঝাড়ল অবনী। মাথা থেকে টুপিটা খুলে পকেটে রাখল। প্রধান দরজাটা বন্ধ থাকে সব সময়, প্রত্যেক ভাড়াটে কোড নাম্বার টিপে সেই দরজা খোলে।

বাড়িটা চার তলা। অবনীর অ্যাপার্টমেন্ট সব চেয়ে ওপরতলায়। অ্যাটিকের ঘর খানিকটা সস্তা হয়। ব্যাচেলরের পক্ষে দেড়খানা ঘরই যথেষ্ট।

চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল অবনী। ঘড়িতে এখন বিকেল শেষ হয়নি, এর মধ্যে আকাশ অন্ধকার। এ ঘরের এক দিকে বিরাট জানলা, অনেকখানি আকাশ দেখা যায় অন্য সময়।

রোজ রোজ শুধু নিজের জন্য রান্না করতে কী যে একঘেয়ে লাগে! একা একা বসে খাওয়া।

কলকাতায় অবনীর ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। এক বিধবা মামাতো দিদি সেখানে আছেন অনেক দিন। তাঁর দুই ছেলে। ওরাই সংসার চালায়। হাট-বাজার করার কথা অবনীকে কখনও ভাবতে হয়নি। সে কখনও এককাপ চা-ও বানায়নি নিজে। এখানে সব কিছুই করতে হয়। বাসন মাজার সময় এক-এক দিন তার ইচ্ছে হয় সব কিছু ছুঁড়ে ভেঙে ফেলতে।

ঘরে ঢুকেই প্রথমে টিভি চালিয়ে দেয় অবনী। বেশির ভাগ প্রোগামই দেখতে তার ভাল লাগে না, তবু টিভি চলতে থাকলে মনে হয়, ঘরের মধ্যে অন্য কেউ কথা বলছে, তাতে নির্জনতা খানিকটা কাটে।

প্রায় মাস দু’এক কেটে গেলে বোস্টনে। এখানে অনেক বাংলাদেশি এবং ভারতীয় আছে। কয়েক জনের সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। তবে ঘনিষ্ঠতা হয়নি কারুর সঙ্গে।

ছাত্রদের তুলনায় অবনী বয়সে খানিকটা বড়। পড়াশুনো শেষ করেই অবনী আসার চেষ্টা করেনি, কয়েক বছর অধ্যাপনা করেছে। ছাত্র ছাড়া, আর যারা অনেক দিন ধরে আছে, তারা সবাই বিবাহিত, সস্ত্রীক সংসার পেতেছে।

অবনী এদের মাঝামাঝি। সে বিয়ে করার কথা এত দিন চিন্তা করেনি। মা আর মামারা মাঝে মাঝে চাপ দিয়েছে বটে, কিন্তু খবরের কাগজ দেখে একটা অচেনা মেয়েকে বিয়ে করা যায় নাকি?

যাকে প্রেম বলে, সে-অভিজ্ঞতা অবনীর কখনও হয়নি। কিছু কিছু মেয়েকে চেনে অবশ্যই। আলগা ভাবে বন্ধুত্ব হয়েছে, তার বেশি কিছু নয়। এম এসসি পড়ার সময় জয়া নামের একটি মেয়ে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু অবনী তখন পড়াশুনো নিয়ে এমনই ব্যস্ত যে, জয়া সম্পর্কে বেশি মাথা ঘামাতে পারেনি। জয়া একটা চিঠিও লিখেছিল, উত্তর দেওয়া উচিত ভেবে ভেবেও লেখা হয়নি শেষ পর্যন্ত। অবনীর পরীক্ষা যখন শেষ হল, তার মধ্যে বিয়ে করে ফেলেছে জয়া। পরে একবার জয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে কথাই বলেনি। জয়ার তো রাগ হতেই পারে, অবনীরই দোষ।

বাফেলো থেকে রেহানা ফোন করেছিল এক দিন।

সে ভালভাবে পৌঁছে গেছে, আপাতত পেয়িং গেস্ট হয়ে আছে এক বাড়িতে, আগামী মাসে অ্যাপার্টমেন্ট পেয়ে যাবে।

রেহানার ফোন নাম্বার লেখা কাগজটা সাঁটা আছে ফ্রিজের গায়ে, কিন্তু অবনী এক দিনও ফোন করেনি। রেহানা নিজে থেকেই প্রথম ফোনটা করেছে, এরপর একবার অন্তত তাকে ফোন করা উচিত, অন্তত নিছক ভদ্রতাবশতই করা উচিত ছিল।

কেন রেহানাকে ফোন করার ইচ্ছে হয়নি অবনীর? সে নিজেকেই বিশ্লেষণ করতে চায়।

বাংলাদেশে সিরাজুল সাহেবের বাড়ির আতিথেয়তায় সে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছে। এত আন্তরিক ব্যবহার, এত সহজে আপন করে নেওয়া!

ঢাকার হোটেলে পড়ে রইল মালপত্র, অবনীকে রাত কাটাতে হল নারায়ণগঞ্জে। মিন্টু এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর বাংলাদেশ বিমানে তার বন্ধুকে ফোন করে ফ্লাইটের খবর জেনে অবনীকে আশ্বস্ত করেছে।

সিরাজুল সাহেব বলেছিলেন, নিজের বাপ-ঠাকুর্দার বাড়িতে অন্তত একটা রাত্রি বাস করে যাও!

অবনীকে আপ্যায়ন করার জন্য ওঁদের তো কোনও স্বার্থ ছিল না। একেই বলে আন্তরিকতা।

রেহানাকে তার বেশ ভাল লেগেছিল। যদিও মাত্র দু’দিনের পরিচয়। কারুর কারুর সঙ্গে অনেক বার দেখা হলেও আড়ষ্টতা কাটে না, আবার কারুর কারুর সঙ্গে অল্প সময়েই ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। রেহানার স্বভাবটাই ঝর্নার জলের মতো।

কিন্তু রেহানা বিবাহিত, এটা জানার পরই অবনী সহজ ভাবটা হারিয়ে ফেলল কেন? আর সে রেহানার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা চালিয়ে যেতে পারেনি!

তাহলে কি সে রেহানার প্রেমে পড়েছিল, কিংবা তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল? মোটেই না। সে-রকম চিন্তা ঘুণাক্ষরেও তার মনে আসেনি। এমনিই সম্পর্কটা এগোচ্ছিল বন্ধুত্বের দিকে।

একটি তরুণী মেয়ে বিবাহিত জানলেই সম্পর্কের এত তফাৎ হয়ে যায়?

প্রথম পরিচয়ের সময় কেউ তো আর জানতে চায় না, তুমি বিবাহিত না অবিবাহিত? অবনী সম্পর্কেও ওরা কিছু জানতে চায়নি।

অবনী যেন ধরেই নিয়েছিল, রেহানা যেহেতু এখনও ছাত্রী, তাই তার বিয়ে হয়নি। ছাত্ৰবয়সে কারুর বিয়ে হয় না? শুধু মেয়ের কেন, ছেলেদেরও হয়। অবনীর বন্ধু মৃণালই তো মাত্র বাইশ বছর বয়েসে তার এক সহপাঠিনীকে বিয়ে করে ফেলেছে।

রেহানার স্বামী এ-দেশে থাকে, এটা শোনার পরই কেন চুপসে গিয়েছিল অবনী?

রেহানার স্বামী আনোয়ার খুব গুণী পুরুষ। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি করে আই বি এম-এর মতো বড় কোম্পানিতে। নিজের সাবজেক্টে তার একটা বইও ছাপা হয়েছে এখান থেকে। সে আবার কবিতাও লেখে। বাংলাদেশে সবাই কি কবিতা লেখে? আনোয়ারের ছবিও দেখেছে অবনী, রীতিমতো সুপুরুষ। রেহানার সঙ্গে সুন্দর মানিয়েছে, বলতেই হবে।

পূর্বাণী হোটেলের লবিতে অবনী যখন অপেক্ষা করছিল, ভেবেছিল মিন্টু তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে, তার বদলে রেহানা হঠাৎ এসে হাজির হল। তার সেই ঝলমলে রূপ দেখে অবনীর বুকের মধ্যে ধক করে উঠেছিল। এখনও রেহানার মুখটা মনে করলেই তার বুকের মধ্যে একটু ব্যথা ব্যথা করে! একেই কি প্রেম বলে? যদি হয়ও, এই প্রেম নিজের মধ্যে গোপন রাখাই ভাল।

টেলিফোনটার দিকে মাঝে মাঝে চোখ পড়ে অবনীর। মাকে সপ্তাহে একবার সে ফোন করে। মা এখন কলকাতার ফ্ল্যাটে এসে আছেন। অবনীর আত্মীয় স্বজনের সংখ্যা বড় কম। সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েক জন এখন ইউরোপ-আমেরিকায়। তবে বোস্টনে কেউ থাকে না। কাছাকাছির মধ্যে অতীন আছে ওয়াশিংটন ডিসি-তে। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথা হয়।

রেহানাকে ফোন করে কী কথা বলবে, তা অবনী ভেবেই পায় না।

এই তুষারঝরা সন্ধেবেলা কারুর সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে। অতীন কালই ফোন করেছিল, আজ কি তাকে ফোন করা যায়?

ফোনটা ঝন ঝন করে বেজে উঠল।

কণ্ঠস্বর শুনে অবনী কেঁপে উঠল। অবিশ্বাস্য। যার কথা এতক্ষণ ভাবছিল, সে-ই ফোন করেছে। এ কি ফোন না টেলিপ্যাথি?

রেহানা বলল, কেমন আছেন? আপনি এর মধ্যে ফোন-টোন করলেন না তো?

অবনী আমতা আমতা করে বলল, এই তো আজকেই ভেবেছিলাম, আসলে কয়েক দিন খুবই ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল।

রেহানা কৌতুকের সুরে বলল, আজকেই ভেবেছিলেন? এটা সত্যি কথা?

হ্যাঁ সত্যি।

আচ্ছা, আপনাকে বেনিফিট অফ ডাউট দেয়া গেল। আজ এখানে কী দারুণ বরফ পড়ছে। সারা দিন। কী মজা! কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে! আমার হাজব্যান্ড দুপুরে ফোন করেছিল। ও ক্যালিফোর্নিয়ায় যেখানে থাকে, সেখানে সারা বছরেই একবারও বরফ পড়ে না। ওকে বললাম, তুমি এসে দেখে যাও! নায়েগ্রা ফলস অনেকটা জমে গেছে। সে বলল, পাখি হলে ডানা মেলে উড়ে যেতাম! আপনাদের ওখানে…।

এখানেও সারা দিন বরফ পড়ছে। কিন্তু আমার মোটেই সুন্দর লাগছে না।

কেন?

ঘরে বসে ও-সব দেখতে ভাল লাগে। আমাকে কাজে যেতে হয়েছিল, বাজার করতে হল, তখন বিরক্তিকর মনে হয়!

আপনি খুব বেরসিক তো। অমিও বেরিয়েছিলাম। কাজ ছিল না, ইচ্ছে করে। চোখ একেবারে জুড়িয়ে গেল। আপনি কি রেস্টুরেন্টে খেতে যান না নিজে রান্না করেন?

রোজ রেস্টুরেন্টে খাব। অত পয়সা কোথায়? নিজেই রান্না করি।

 রাঁধতে জানেন?

 ঠেলায় পড়ে শিখে নিয়েছি।

কী রাঁধেন, খিচুড়ি?

সেই খিচুড়ির কথা ভুলতে পারছেন না? খুব খারাপ খাইয়েছি, স্বীকার করছি। মাপ চাইছি।

 শুধু মাপ চাইলে চলবে না। পরে এক দিন ভাল করে খাওয়াতে হবে।

নিশ্চয়ই।

আপনি নায়েগ্রা ফলস দেখতে আসবেন না? দেখেননি তো আগে। এখানে সবাই বলছে, শীতকালে নায়েগ্রার একেবারে অন্য রূপ। এটাই বেশি ভাল।

সময় করে যেতে হবে। শীত তো এখন অনেক দিন চলবে।

 তাড়াতাড়ি আসুন। কয়েকটা সহজ রান্না শিখিয়ে দেব! এর মধ্যে কী কী শিখেছেন? ভাত?

বাঃ, ভাত ছাড়া রোজ রোজ রুটি খাওয়া যায় নাকি?

ফ্যান গালতে জানেন?

ইন্সট্যান্ট রাইস পাওয়া যায়, ফ্যান গালতে হয় না। ডাল রাঁধতেও পারি। আর মাছ ভাজা, ডাবল ডিমের ওমলেট।

ওমলেট? কলকাতায় ওমলেট যেখানেই খেয়েছি, যাচ্ছেতাই! আপনারা ওমলেট বানাতে জানেন না। শুধু কয়েক টুকরো পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিলেই বুঝি ওমলেট হয়? ওমলেট কী করে সুন্দর, নরম হয় বলুন তো? কী দিতে হয়?

আমার তো নরমই হয়!

হতেই পারে না। ডিম ভাঙার পর তাতে এক চামচ দুধ দিতে হয়। তারপর ভাল করে ফ্যাটাতে হয়। দেখবেন কী-রকম ফুলে উঠবে।

আচ্ছা, পরীক্ষা কবে দেখব।

এইসব অতি সাধারণ কথাবার্তাতেই কেটে গেল আধ ঘণ্টা।

ফোনটা রাখার পব অবনী ভাবল, সে রেহানার সঙ্গে কী কথা বলবে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু এ-রকম সাধারণ কথা দিয়েই তো মানুষের সঙ্গে আলাপ চালানো যায়। কোনও ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নেই।

রেহানার কথার মধ্যে খানিকটা কৌতুক আর খানিকটা বকুনির সুর থাকে। শুনতে বেশ লাগে। ওর কথামতো খানিকটা দুধ মিশিয়ে একটা ওমলেট বানিয়ে ফেলল। সত্যিই তো অন্য রকম।

একটা টেলিফোন পেয়েই নিঃসঙ্গতা বোধই কেটে গেল অনেকটা। অবনী কমপিউটারে কাজে বসে গেল এর পরে।

পরের সপ্তাহে স্থানীয় বাঙালিদের একটি অনুষ্ঠানে টিকিট কাটতে হল অবনীকে। পশ্চিম বাংলার বাঙালি আর বাংলাদেশিদের আলাদা গোষ্ঠী, তা অবনী লক্ষ্য করেছে। এ-রকম দু’একটা অনুষ্ঠানে তারা মিলিত হয়। বাংলাদেশিদের সংখ্যাই বেশি, বাংলা অনুষ্ঠানে তারাই বেশি উৎসাহ দেখায়। টিকিট বিক্রির টাকা পাঠানো হবে বাংলাদেশের বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য।

এ-রকম অনুষ্ঠানে যেতেই হয়। গান-বাজনা-নাচ সবই আছে, কোনওটাই তেমন আহামরি কিছু নয়। এখানে হলভাড়া অনেক, তাই অনুষ্ঠান হচ্ছে একটা বাড়ির বেসমেন্টে, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ জন শ্রোতা।

টিকিটের সঙ্গে খাদ্য-পানীয়ও যুক্ত। আজ আর অবনীকে রান্না করতে হবে না। অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ও হল।

এদের মধ্যে একটি দম্পতি বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটা গেলাসে বিয়ার নিয়ে অবনী দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল, সাদেক নামে একটি ছেলে প্রথমে নিজে এসে যেচে আলাপ করল তার সঙ্গে। সাদেক একটি দোকানের মালিক, সে বাংলাদেশ থেকে অনেক রকম মাছ আনায়। মাছ-প্রিয় বাঙালিরা সবাই তার দোকান চেনে।

একটু পরে সে অবনীকে জিজ্ঞেস করল, আপনার সঙ্গে জহির ভাইয়ের আলাপ নেই? আসেন আসেন, পরিচয় করিয়ে দিই। জহির ভাইয়ের বাসায় আমাদের প্রায়ই আড্ডা বসে।

জহির নামের লোকটি মনে হয় ছ’ফুটের বেশি লম্বা। মাথার চুল কাঁচা-পাকা, তবে চল্লিশের বেশি বয়স নয়। দামি সুট পরা, এমনই ফর্সা রঙ যে, দাড়ি কামাবার জায়গায় গালে একটা নীলচে ছোপ পড়েছে। প্রথম দর্শনে অবনীর মনে হল, ভদ্রলোক বাঙালি নয়, পাকিস্তানি হতে পারে।

কিন্তু জহিরের মুখের ভাষা বাংলা তো বটেই, সম্ভাষণে সে সেলাম আলেকুম-এর বদলে বলল, নমস্কার। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি পশ্চিম বাংলা থেকে এসেছেন? কোথায় বাড়ি, কলকাতায়?

অবনী বলল, কলকাতায় থাকি বটে, আসল বাড়ি বর্ধমানে।

জহির সহাস্যে হাত বাড়িয়ে বলল, আসুন, আসুন, তাহলে কোলাকুলি করি। আমরা দেশোয়ালি। আমার বাড়িও বর্ধমান জেলার রানিগঞ্জে।

জহিরের স্ত্রী একটু দূরে অন্যদের সঙ্গে গল্প করছিল, তাকে ডেকে আনা হল।

জহির বলল, আমার স্ত্রী কিন্তু বাংলাদেশের মেয়ে। টাঙ্গাইলের। সীতা, এই ভদ্রলোক আমাদের বর্ধমান জেলার লোক। এক দিন বাড়িতে ডাকো।

মহিলাটি নমস্কার করে বলল, নিশ্চয়ই, আসুন এক দিন। আপনাকে আগে দেখিনি। নতুন এসেছেন?

সাদেক বলল, আমি পর্যন্ত চিনি না, এমন বাংগালি আছে? দাদার কাছে শুনলাম, জ্যাকসন স্ট্রিটে একলা একলা থাকেন।

বাঙালি মুসলমান মেয়েদের বীথি, কাজল, নীলা এই ধরনের ডাকনাম থাকে। কিন্তু সীতা? ঠাকুর-দেবতার নাম বাদ দেওয়াই ওদের পক্ষে স্বাভাবিক। অবনী সীতার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল।

সাদেক বলল, সীতা ভাবির হাতের রান্না একবার খেলে জীবনে ভুলবেন না। সত্যি কথা বলতে কি, হিন্দুরাই মাছটা ভাল রান্না করতে জানে। আমরা আবার মাংসটা ভাল জানি।

সীতা বলল, সে কী রে, আমি মাংস ভাল রাঁধি না? গত শনিবার যে বললি– ।

জহির বলল, এখানে বাঙালিরা দেখা হলেই বড় বেশি খাওয়া-দাওয়ার কথা বলে। আপনার ভালগার মনে হয় না?

অবনী চুপ করে রইল। কথাটা সত্যি। সে-ও লক্ষ্য করেছে।

জহির আবার বলল, কিছু দিন পর আপনারও অভ্যেস হয়ে যাবে। আপনিও সাদেকের দোকানে ইলিশ মাছ দেখলে বন্ধু-বান্ধবদের ফোন করে জানাবেন। বাঙালির কালচারে শিল্প-সাহিত্য না মাছ ভাত, কোনটার টান বেশি, তা বলা শক্ত! দিনের পর দিন স্যান্ডুইচ খেতে হলে বাঙালির রস-কষ শুকিয়ে যায়।

সীতা বলল, আমার স্বামী খুব সাহেব। সপ্তাহে এক দিন মোটে ভাত খায়।

জহির বলল, শুধু শনিবার রাত্রে। শনিবার আড্ডাও হয়। এই শনিবার আপনি চলে আসুন! যারা নতুন আসে, তাদের কিছু কিছু অসুবিধে ফেস করতে হয়। সে-ব্যাপারে আমি টিপস দিতে পারি।

জহিররা থাকে সমারভিল-এ স্প্রিংফিল্ড স্ট্রিটে। রাস্তা চিনে যাওয়া অবনীর পক্ষে শক্ত। ঠিক হল, বিপুল নামে এক জন ছাত্র তাকে তুলে নিয়ে যাবে।

ছাত্র হলেও বিপুলের অবস্থা বেশ সচ্ছল মনে হল। দেশ থেকে স্ত্রীকে আনিয়েছে, তার গাড়িটিও বেশ দামি। অনবরত সিগারেট খায়। তার স্ত্রী মৃদুলার ছোট্টখাট্টো চেহারা, কিন্তু দু’একটা কথা শুনলেই বোঝা যায়, বেশি বুদ্ধিমতী।

গাড়িতে উঠে সামান্য মামুলি আলাপের পরই বিপুল জিজ্ঞেস করল, দাদা, আপনার পদবি তো চৌধুরী। আপনি কি ব্রাহ্মণ? চৌধুরীরা তো অনেক কিছুই হয়।

অবনী কিছুটা অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ, ব্রাহ্মণই বটে। চৌধুরী তো খেতাব। আমাদের অরিজিনাল টাইটেল ছিল নাকি চক্রবর্তী। হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

বিপুল বলল, আমরা মেদিনীপুরের লোক। আমার টাইটেল দাস মহাপাত্র। হাফ ওড়িয়া হাফ বাঙালি বলতে পারেন। মৃদুলারা ব্রাহ্মণ। আমাদের বিয়ের সময় খুব ঝামেলা হয়েছিল। ব্রাহ্মণরা বড় জ্বালায়!

অবনী বলল, আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি ব্রাহ্মণ কি না তাতে কী আসে যায়? ব্রাহ্মণরা তোমার বিয়ের সময় জ্বালিয়েছিল বলে কি তুমি আমাকে গাড়িতে নেবে না?

বিপুল বলল, তা বলছি না। হঠাৎ কথাটা মনে এল। ব্রাহ্মণরা জাত-পাত নিয়ে এখনও এত মাথা ঘামায়, আপনাদের মতো শিক্ষিত লোকরা এটা বদলাতে পারেন না?

অবনী বলল, একটু একটু বদলেছে। অনেকে এখন সব মানে না।

বিপুল বলল, গোটা হিন্দু ধর্মের মধ্যেই এত জাত, এত ভেদাভেদ, এতে কত যে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, সেটা কেন আমরা বুঝি না! কেন সব হিন্দু সমান হবে না?

অবনী বলল, বিদ্যাসাগর বা বিবেকানন্দর মতো বড় মাপের কোনও মানুষ তো আমাদের মধ্যে এখন নেই। ওই রকম কেউই বদলাতে পারেন। তোমার-আমার কথা কে শুনবে? তবে কিছু না-কিছু জাতিভেদ বা আলাদা সম্প্রদায় তো সব ধর্মেই আছে। মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি নেই? তারপর কাদিয়ানি, আরও কী সব যেন আছে। তাদের মধ্যে মারামারিও হয়। আয়ারল্যান্ডে ক্যাথলিক প্রেটেস্টান্টদের মধ্যে মারামারি হয় না? এই আমেরিকাতেও অন্য ক্রিশ্চানদের চেয়ে অ্যাংলো স্যাক্সন প্রোটেস্টান্টদের দাপটই বেশি।

পেছনের সিট থেকে মৃদুলা বলল, আমাদের বিয়েতে আর এমন কী ঝামেলা হয়েছে! আপনি জহির সাহেব আর সীতা বউদির রোমান্সের কথা শুনেছেন? আমেরিকার মতো জায়গাতেও তা নিয়ে তুলকালাম হয়েছিল।

অবনী বলল, আমি কিছু শুনিনি, এই তো সদ্য আলাপ হল।

মৃদুলা বলল, সীতাবউদিরা বাংলাদেশের হিন্দু। তার ওপর ব্রাহ্মণ। অসম্ভব গোঁড়া। সীতাবউদির মুখেই শুনেছি, ঢাকায় পড়াশুনোর সময় একটি কায়স্থ ছেলে ওঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, বাড়ির লোক রাজি হয়নি। তারপর তো উনি চলে এলেন ব্লুমিংটন, ইন্ডিয়ানা-তে। সেখানে ওঁর এক মামা থাকেন, তার বাড়িতে থেকেই সীতাবউদি পড়াশুনো করতেন। জহির সাহেবও পড়াশুনোতে ভাল, ইঞ্জিনিয়ার, এখন অবশ্য এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা করেন। দুজনের আলাপ, তারপর প্রেম। বিয়ের কথা উঠতেই দুই পরিবারের ঘোর আপত্তি। জহির সাহেবের বাবা-মা, ভাই সবাই এ-দেশে।

জহিরের বাড়ি থেকেও আপত্তি করল? সাধারণত ওরা এত কিছু মানে না।

ভুল ধারণা। ওরা নাকি বনেদি বংশ। ওদের বাড়িতে শিয়া সম্প্রদায়ের কোনও মেয়েও বউ হয়ে আসতে পারে না। হিন্দু মেয়ে তো দূরের কথা। জহির সাহেবের মা কান্নাকাটি করে আত্মহত্যার ভয় দেখিয়েছিলেন। আর সীতাবউদির মামা তো আরও কেলেঙ্কারি করেছিলেন, তিনি ভাগ্নিকে ঘরে আটকে রেখেছিলেন তালাচাবি দিয়ে।

সীতা তখন অ্যাডাল্ট নয়?

অবশ্যই অ্যাডাল্ট, ছাব্বিশ বছর বয়স।

 তাহলে, এ-ভাবে আটকে রাখা সম্পূর্ণ বে-আইনি। পুলিশ জানতে পারলে –।

জহির সাহেব তারপর কী করলেন, শুনুন না। নিজের বাড়িতে বললেন, ঠিক আছে, ওই হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করব না। আর সীতাবউদির মামার বিরুদ্ধে পুলিশেও খবর দিলেন না। যেন খুব উদাসীন হয়ে গেলেন। আসলে তক্কে তক্কে থাকতেন। সীতাবউদির মামা কখন বাড়িতে থাকেন না, সে খবর নিতেন। এক দিন সেই রকম সময়ে ও-বাড়ির জানলা ভেঙে সীতাবউদিকে বার করে আনলেন। তারপর দুজনে মিলে চম্পট।

এ যে রীতিমতো সীতা উদ্ধার কাহিনি।

হ্যাঁ, কিন্তু এরপর দুজনের আর পাত্তাই পাওয়া গেল না। দু’পক্ষ থেকেই প্রচুর খোঁজাখুঁজি, তারপর কান্নাকাটি। সাড়ে চার মাস ওঁরা একেবারে উধাও! প্রকাশ্যে উদয় হলেন এই বোস্টন শহরে, এর মধ্যে রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়ে গেছে। তত দিনে দু’পক্ষই ঠাণ্ডা!

বিপুল বলল, পুরো ঠাণ্ডা নয়। জহির সাহেবের বাবা এখনও ছেলের সঙ্গে কথা বলেন না।

মৃদুলা বলল, কথা বলেন না, কিন্তু ছেলের টাকা তো নিতে হয়।

 বিপুল বলল, সাত-আট বছর হয়ে গেল, ওদের দুজনের প্রেমকাহিনি। এখনও অনেকে বলাবলি করে। এমন একটা চমৎকার কাপল খুব কম দেখা যায়।

জহির-সীতারা ফ্ল্যাটে থাকেন না, নিজস্ব বাড়ি। সামনে লন, পেছনে সুইমিং পুল। নিমন্ত্রিতের সংখ্যা প্রায় কুড়ি-বাইশ জন। প্রতি শনিবারই নাকি এ-রকম হয়। প্রচুর খাদ্য-পানীয়র ব্যবস্থা।

অবনীর একটা ব্যাপার বেশ পছন্দ হল।

সিরাজুল সাহেবরা বর্ধমানের বাড়িতে আসার আগে আর কোনও বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়নি। পাকিস্তানি আমলে সে খুব ছোট ছিল, বাংলাদেশ সৃষ্টি হবার পরেও ও-দিকে কখনও সে যেতে আগ্রহী হয়নি। কাগজে মাঝে মাঝে কিছু খবর পড়েছে, তাহলেও ও-দিককার বৃহত্তর বাঙালি জাতি সম্পর্কে তার বিশেষ কিছু ধারণা ছিল না। কাগজে তো ঝড়, বন্যা বা মারামারির খবরই বেশি থাকে। বাংলাদেশ থেকে যারা কলকাতায় আসে, তারাও তো বাজার-টাজার করে ফিরে যায়, কটা পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা হয় তাদের?

কিন্তু এখানে এসে সে দেখছে, আলাদা আলাদা গোষ্ঠী হলেও, দুদিকের বাঙালিদের মধ্যে পারিবারিক যোগাযোগও আছে যথেষ্ট। এ বাড়িতে এত জন অতিথির মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের কোনও প্রশ্নই নেই যেন। শুধু নাম শুনে বোঝা যায়, আর তফাৎ নেই কিছু।

জহিরসীতার মতো মিশ্র বিবাহও দুর্লভ নয় মোটেই।

 অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বার বার অন্য মনস্ক হয়ে যেতে লাগল অবনী।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় বারোটা হয়ে গেল।

তার অ্যাপার্টমেন্টটা আজ এত ঠাণ্ডা কেন? সেন্ট্রাল হিটিং চালায়নি? বিছানাটা ঠাণ্ডায় স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। সে আর একটা রুম হিটার চালিয়ে দিল।

হঠাৎ খুব ইচ্ছে করল রেহানাকে ফোন করতে। এত রাতে কি ফোন করা উচিত? উইক এন্ডে সকলেরই বেশি রাত হয়। তাহলেও…।

ফোনের আনসারিং মেশিনে লাল আলো টিপ টিপ করছে। অর্থাৎ জমে আছে বার্তা। অবনী বোতাম টিপল।

প্রথম বার্তাটা তার বন্ধু অতীনের। সে আগামী মাসে দেশে যাচ্ছে। দ্বিতীয়টি এক অধ্যাপকের, তিনিও ভারতে যাচ্ছেন, ব্যাঙ্গালোরে বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেয়েছেন, ভারত সম্পর্কে দুই-একটা বই পড়তে চান। তৃতীয় বার্তাটা…।

আবার অবনী কেঁপে উঠল। রেহানার কণ্ঠস্বর।

এই নিয়ে রেহানা তৃতীয় বার তাকে ফোন করল। অবনী নিজে থেকে করেনি একবারও। এটা কি চূড়ান্ত অভদ্রতা নয়?

মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে, কিন্তু প্রথম কী কথা দিয়ে শুরু করবে, সেটাই ঠিক করতে পারেনি।

রেহানা ফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছে মানে অবনীকে ফোন করতে বলা হচ্ছে। জরুরি কোনও ব্যাপার আছে? অবনীর সঙ্গে রেহানার এমন কী জরুরি কথা থাকতে পারে?

এখন, না কাল সকালে?

রেহানা অন্যের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকে, এত রাত্রে সেখানে ফোন করা চলে না। তবু অবনী কৌতূহল দমন করতে পারছে না।

দু’বার বাজতেই রেহানার গলা পাওয়া গেল। আমি অবনী। তুমি ফোন করেছিলে?

করেছিলাম তো। মেসেজ পাননি?

 হ্যাঁ, সেটা শুনেই… এত রাত্রে ফোন করা আমার উচিত হয়নি।

রাত্রে কেন, দিনেও তো আপনি ফোন করেন না।

দিনেরবেলা ব্যস্ত থাকি, তুমি নিজে এই ক’বার ফোন করলে… ও আই অ্যাম সরি, তুমি বলে ফেলেছি, আজ খানিকটা হুইস্কি খেয়ে ফেলেছি তো।

শুনুন, আমি ফোন করেছিলাম আমার নতুন নাম্বারটা জানাবার জন্য। আজই আমি নিজের অ্যাপার্টমেন্টে এসেছি, এখানে ফোন আছে।

তাই নাকি? আজই নতুন অ্যাপার্টমেন্টে… কীরকম, কারুর সঙ্গে শেয়ার করতে হবে?

না। আর একটা কথাও জানাবার ছিল। মুসাফির, মানে সিরাজুল চৌধুরী আগামী মাসে চেকআপ করাবার জন্য এ দেশে আসছেন। উনি আপনাকে জানাতে বললেন। উনি যখনই ফোন করেন, আপনার কথা জিজ্ঞেস করেন।

এ-দেশে আসছেন? খবর পেলে নিশ্চয়ই আমি দেখা করব।

খবর পাবেন। ঠিক আছে, এবার রাখি? খোদা হাফেজ।

হঠাৎ-ই যেন রেখে দিল রেহানা। আজ তার কথার মধ্যে কৌতুক ছিল না, কেমন যেন গম্ভীর গম্ভীর। ওকে তুমি বলে ফেলাটা পছন্দ করেনি? বলল না তো, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমিই বলবেন।

ভুল হয়েছে, তুমি বলাটা ভুল হয়েছে। রেহানা বয়সে এমন কিছু ছোট নয়!

নতুন অ্যাপার্টমেন্টে, নতুন ফোন নাম্বার সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। রেহানা নিশ্চয়ই অনেককেই জানিয়েছে, তাদের মধ্যে অবনী এক জন। জরুরি কোনও খবরও ছিল না।

আর একবার ফোন করে তুমি বলার জন্য মাপ চাইবে? অবনী টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল।

.

০৬.

 একটা অ্যালার্ম ঘড়ি কিনব কিনব করেও কেনা হয়নি। এক-এক দিন সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায়।

বড় কাচের জানলাটার পর্দা খোলাই রাখে অবনী, যাতে সকালের রোদ এসে চোখে পড়ে কিন্তু হায়, এ-দেশে শীতকালে সূর্যই যে দুর্লভ। প্রায়ই সারা দিন আকাশ থমথমে থাকে।

হঠাৎ যে-দিন ঝকঝকে রোদ ওঠে, সে-দিন দলে দলে মানুষজন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। গায়ে রোদ মাখাটা যেন উৎসবের মতো।

আশ্চর্য ব্যাপার, যখন বরফ পড়ে, তখন খুব বেশি শীত থাকে না। রোদ্দুর উঠলেই শীত লাগে বেশি।

আজ ঘুম ভেঙেছে, তবু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না।

জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র রঙের আকাশ। একটু দূরে পাশাপাশি দুটো উইপিং উইলো গাছ। শীতকালে একেবারেই পাখি দেখা যায় না। বাতাসে কী যেন ভাসছে।

উইক ডেজ আর উইক এন্ডে অনেক তফাৎ। উইক ডেজ মানেই দায়িত্ব আর ব্যস্ততা। সব কিছুই নিয়মে বাঁধা। ঘুম থেকে উঠেই জল গরম করতে দেওয়া। এক কাপ কফি খেয়েই বাথরুমে দৌড়। তারপর দাড়ি কামানো ও স্নান। শিট, শেভ অ্যান্ড শাওয়ার যাকে বলে। তারপর পোশাক পরে নিতে নিতে স্যান্ডুইচ বানানো। এক ফাঁকে হুড়মুড়িয়ে নিচে গিয়ে ডাকবাক্স খুলে দেখে আসা, কোনও চিঠি এসেছে কিনা। স্যান্ডুইচে কামড় দিতে দিতে আর এক কাপ কফিতে চুমুক। ঘড়ির দিকে চোখ। কফি শেষ না হতেই ছুট ছুট, রাস্তায় সবাই একরকম।

এ-দেশে কেউ ধীর লয়ে হাঁটে না, সবাই ছোটে। সকালবেলা মনে হয়, পুরো দেশটাই ছুটছে।

আজ অফিস যেতে ভাল লাগছে না। কিন্তু যেতেই হবে, হঠাৎ হঠাৎ ছুটি নেবার বিলাসিতা এ-দেশে চলে না।

ঘড়িতে সাতটা দশ, তবু এখনও উঠছে না কেন অবনী? সে ভাবছে, আচ্ছা, আরও দশ মিনিট যাক।

বারো মিনিট বাদে অবনী কম্বলটা সরিয়ে উঠে বসল। মাথাটা প্রচণ্ড ভারি লাগছে, দপদপ করছে। কপালের দু’পাশের শিরা। জ্বর জ্বর লাগছে।

বাথরুমের দরজায় একটা লম্বা আয়না লাগানো আছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে দেখল, চোখ দুটো বেশ লালচে। তাহলে কি হে ফিভার হল নাকি? আমাদের দেশের মতো এখানেও নানা রকম জ্বর হয়, তার একটার নামে হে ফিভার। কোনও কোনও ফুলের রেণু থেকে নাকি হয়।

আজ শুক্রবার, আজ তো কাজে যেতেই হবে। কাল-পরশু ছুটি।

অতি কষ্টে তৈরি হয়ে নিল অবনী। একেবারেই ইচ্ছে করছে না, তবু না গিয়ে উপায় নেই। টিউব ট্রেনে এই সময়টায় দারুণ ভিড় হয়। গোটা রাস্তাটাই দাঁড়িয়ে যেতে হল অবনীকে।

বাড়ি ফিরতে ফিতে সাতটা বেজে গেল।

টিভিটা খুলতেই শুনল আবহাওয়ার সতর্কবাণী। এর আগের তিন দিন পরিষ্কার আকাশ ছিল। আজ সন্ধে থেকে আবার খুব তুষারপাত শুরু হবে। তুষারঝড় হতে পারে। বিমানবন্দর বন্ধ করে দিতে হবে হয়তো। ট্রেনও চলবেনা।

অবনী জানলার কাছে এসে উঁকি মেরে দেখল, এখন পর্যন্ত তুষারপাতের কোনও চিহ্ন নেই।

জুর একটুও কমেনি। দুটো অ্যাসপিরিন খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। তার আগে কিছু খাদ্য পেটে যাওয়া দরকার। খিদেও পেয়েছে।

ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে অবনী শুধু খানিকটা সুপ আর একটা হটডগ খেয়েছে দুপুরে। তখন খিদে ছিল না। এ-দেশে আমেরিকানরা সন্ধে সাড়ে ছ’টা-সাতটার মধ্যে ডিনার সেরে নেয়।

যাঃ, বাড়িতে যে কিছুই নেই। শুক্রবার সন্ধেবেলায় ফেরার পথে অবনী বাজার করে। আজ সে-কথা মনেই পড়েনি। মাছ-মাংস সব শেষ। ফ্রিজ একেবারে খালি, শুধু রয়েছে কয়েকটা ডিম।

চাল আর ডাল আছে অবশ্য। ডাল-ভাতের সঙ্গে ডিমভাজা খেয়ে নেওয়া যেতে পারে।

এই অবস্থায় রান্না করতে কারুর ইচ্ছে করে? মাঝে মাঝে রেস্তোরাঁতেও খেতে যায় অবনী, আজ আর বেরুবার প্রশ্নই ওঠে না। আহা, আজ যদি কেউ তাকে রান্না করে খাওয়াত!

খানিকক্ষণ শুয়ে রইল অবনী। তারপর একবার চোখ বুজে আসতেই উঠে পড়ল ধড়ফড় করে। একেবারে ঘুমিয়ে পড়লে আর কিছুই খাওয়াই হবে না।

রান্নাঘরে এসে একটা বড় সসপ্যানে চাল-ডাল মিশিয়ে ফেলল। আলাদা ডাল-ভাত রান্নার কী দরকার! খিচুড়ি খেলেই হয়। ডিমও ভাজবে না, ওর মধ্যে সেদ্ধ করতে ফেলে দেবে। ইস, দুএকটা আলুও যদি থাকত! রয়ে গেছে শুধু একটু বাঁধাকপি। এটাও খিচুড়িতে মিশিয়ে দিলে কেমন হয়?

খিচুড়ি চাপিয়ে দিয়ে অবনী টিভির সামনে বসল।

অফিসের কিছু জরুরি কাজ বাড়িতে নিয়ে এসেছে, এখন আর তাতে মন বসানো সম্ভব নয়। কাল দেখা যাবে।

অবনী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে, তাকে একটা ছোট ঘর দেওয়া হয়েছে, সেটাকে অফিস বলে। তাকে পড়াতেও হয়। ভাগ্যিস কাল-পরশু ছুটি।

টিভি’র দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু দেখছে না। মন চলে গেছে দেশে। এখানে রাত, কলকাতায় এখন সকাল। নভেম্বরের শেষে ওখানে নরম নরম শীত, একটা পাতলা সোয়েটার গায় দিলেই চলে। এখানকার মতো গাদা গাদা গরম পোশাক পরতে হয় না। রোজ রোজ গেঞ্জি, জামা, তার ওপরে সোয়েটার, জ্যাকেট, ওভারকোট পরতে পরতে বিরক্তি লেগে যায়।

খিচুড়িটা ফুটছে। এই রে, তলায় লেগে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে স্টোভ বন্ধ করতে যেতেই টেলিফোন বেজে উঠল।

একটি অপরিচিত পুরুষকণ্ঠ প্রথমে ইংরিজিতে বলল, কুড আই স্পিক টু মিস্টার অবনী চৌধুরী?

অবনী ইয়েস স্পিকিং বলতেই লোকটি বাংলায় বলল, আমার নাম আনোয়ার হোসেন, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি লস অ্যাঞ্জেলিসে থাকি। তবে আমার স্ত্রী রেহানার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে।

অবনী সঙ্গে সঙ্গে বলল, ও হ্যাঁ। আপনার কথাও শুনেছি।

আমরা আজ সকালেই এসেছি, আমার বড় ভাই এখানে থাকেন, তার মেয়ের বিয়ে আগামী কাল।

এখানে, মানে, বোস্টনে এসেছেন?

জি। আমরা শপিং করতে বেরিয়েছিলাম, এখন আপনার বাড়ির কাছেই আছি। আপনি কি সন্ধেবেলা ফ্রি আছেন?

ফ্রি, হ্যাঁ, বাড়িতেই আছি।

আমরা ভাবছিলাম, আপনার যদি অসুবিধা না হয়, কয়েক মিনিটের জন্য আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারি। কাল আর সময় পাওয়া যাবে না। পরশুই আমাদের ফিরে যেতে হবে।

না, কোনও অসুবিধে নেই, চলে আসুন। অবশ্যই চলে আসুন। আমার দরজার কোড নাম্বারটা লিখে নিন।

ঘরদোর সবই অগোছালো হয়ে আছে। কোনও রকমে তাড়াহুড়ো করে এখটা ভদ্র চেহারা দেওয়া হল।

এই রে, ওদের কী খেতে দেওয়া হবে? চা, কফি ছাড়া কিছুই নেই। কয়েক মিনিটের জন্য আসছে বলল, নিশ্চয়ই কিছু খেতেই চাইবেনা। বিয়েবাড়ির ব্যস্ততা আছে।

খিচুড়িটা ঢাকা দিয়ে রাখল অবনী। এত গরম অবস্থায় ফ্রিজেও ঢোকানো যাবে না।

সাত-আট মিনিটের মধ্যে ওরা এসে পড়ল।

আনোয়ারকে দেখলেই বোঝা যায় বেশ শক্তসমর্থ পুরষ। মেদহীন শরীর, মাথাভর্তি ঝাঁকড়াচুল। উজ্জ্বল দুটি চোখ। গায়ের রঙ কালো হলেও চকচকে ভাব আছে।

রেহানাকে প্যান্ট-কোট পরা অবস্থায় কখনও দেখেনি অবনী। এ-দেশে এসে এর মধ্যেই আরও ফর্সা হয়ে গেছে নাকি?

স্বামী-স্ত্রী দু’জনের মুখেই বেশ একটা প্রফুল্ল ভাব আছে।

আনোয়ার অবনীর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, গুড ইভিনিং, কেমন আছেন? আপনার কথা সব শুনেছি। নারায়ণগঞ্জে যে বাড়িটা এক কালে আপনাদের ছিল, সেই বাড়িতেই আমার বিয়ে হয়েছে গত বছর। সেই হিসেবে, আমি আপনাদের বাড়ির জামাই, তাই না?

বলেই হো-হো করে হেসে উঠল আনোয়ার।

অবনীও হেসে বলল, তাই তো হয়। বসুন, বসুন, কোট খুলে ফেলুন।

রেহানা বলল, বেশিক্ষণ বসব না। হঠাৎ ঝড় উঠেছে। আপনার বাসাটা দেখতে এলাম। ফোনে কথা বলেছি।

আনোয়ার বলল, ঘণ্টা খানেক বসতে পারি? কী মশাই, খুব ব্যস্ত না তো?

অবনী বলল, না না, আমার কোনও কাজ নেই এখন।

আনোয়ার ওভারকোটের পকেট থেকে একটা স্কচের বোতল বার করে বলল, একটুখানি পান করব। আমার বড় ভাইয়ের বাসায় এ-সব চলেনা। ওদের গাড়ি আমাদের এখানে নামিয়ে দিয়ে গেল, আমরা একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে যাব। আপনার এতে আপত্তি নেই আশা করি?

এ-দেশে এসে অবনী একটু-আধটু হুইস্কি বা বিয়ার পান করে। নেশা নেই। একা খায় না, বাড়িতে বোতলও রাখে না।

আনোয়ারের সঙ্গে তাকেও খেতে হবে। গায় এত জ্বর, তাছাড়া পেট একেবারে খালি, এই অবস্থায় কি খাওয়া উচিত?

তবু অবনী দুটো গেলাস এনে, রেহানাকে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কী দেব? আনফরচুনেটলি বাড়িতে কোল্ড ড্রিঙ্কস কিছু নেই, চা কিংবা কফি বানিয়ে দেব?

রেহানা জিজ্ঞেস করল, আপনার চোখে কী হয়েছে?

অবনী বলল, চোখে? কিছু হয়নি তো?

রেহানা বলল, চক্ষু দুটো এত লাল?

গেলাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে আনোয়ার মুখ তুলে অবনীকে দেখে বলল, ইউ লুক সিক। আপনার কি শরীর খারাপ নাকি?

অবনী বলল, না না, কিছু হয়নি।

আনোয়ার অবনীর হাতটা চেপে ধরে বলল, বলেন কী মশাই, আপনার তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মিঠু, তুমি দেখো তো।

রেহানা হাত রাখল অবনীর কপালে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, অন্তত একশা চার-পাঁচ জ্বর।

অবনী বলল, ও কিছুনা, এমনি একটু জ্বর হয়েছে। ঠাণ্ডা লেগেছে বোধহয়।

আনোয়ার বলল, মেয়েদের চোখ ফাঁকি দিতে পারবেন না। মিঠু আপনার চোখ দেখেই বুঝেছে।

রেহানা বলল, এই জ্বর নিয়ে আপনি হুইস্কি খেতে যাচ্ছিলেন? খবরদার খাবেন না। ডাক্তার দেখিয়েছেন?

অবনী বলল, এমনিই সাধারণ জ্বর, আজই হয়েছে, অ্যাসপিরিন খেলেই সেরে যাবে।

আনোয়ার স্ত্রীকে বলল, মিঠু, ব্যস্ত হয়ো না। পুরুষমানুষরা অত জ্বর-টর গ্রাহ্য করে না। আর অ্যাসপিরিন এখন ম্যাজিক ড্রাগ, সব অসুখেই কাজে লাগে।

অবনী রেহানাকে বলল, আপনি কী খাবেন, আমি চা-কফি করে দিই?

রেহানা বলল, আপনাকে কিছু করতে হবে না। এক কাপ চা খেতে পারি, কোথায় আছে বলুন আমি বানিয়ে নিচ্ছি।

সঙ্গে সঙ্গে জানলায় গুম গুম শব্দ হল, সমস্ত বাড়িটা যেন কেঁপে উঠল। প্রবল বেগে আছড়ে পড়েছে ঝড়।

রেহানা বলল, ঝড় বেড়ে গেল। এরপর বাড়ি যাব কী করে? চলো, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি।

আনোয়ার বলল, এর মধ্যে কেউ বেরোয়? ব্যস্ত হয়ো না। ঝড় একটু কমুক!

 কিন্তু সে ঝড় কমার আর কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। দারুণ দাপাদাপি করছে প্রকৃতি। টিভিতে শোনা যাচ্ছে, এর মধ্যেই ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে গেছে। আরও আট-ন’ঘন্টা এ-রকম ঝড় ও তুষারপাত চলবে। সমস্ত ট্রেন আর বাস বন্ধ হয়ে গেছে, রাস্তায় অনেক গাড়ি উলটে গেছে।

এখানে ফোন করলেই ট্যাক্সি আসে। আজ যতবার ফোন করা হল, ততবারই একউত্তর, সরি, নট অ্যাভেইলেবল।

একটা সময় বোঝা গেল, আজ আর ওরা দুজন ফিরতে পারবে না। এই অবস্থায় রাস্তায় বেরুনো খুবই বিপজ্জনক। আনোয়ারের দাদার বাড়িতে ফোন করা হলে তারাও বললেন, না ফিরতে।

অবনী দুর্বল গলায় বলল, আমার ছোট ঘরটায় যে-সোফাটি আছে, সেটা টানলে বিছানা হয়ে যায়। আপনাদের খুবই অসুবিধে হবে যদিও..।

আনোয়ার বলল, আরে মশাই, একটা রাত তো। এই দুর্যোগের মধ্যে গাছতলায় যে থাকিনি, তাই তো যথেষ্ট। খাবারদাবার কী আছে বাড়িতে?

রেহানা সসপ্যানের ঢাকনাটা তুলে প্রায় আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ? আবার খিচুড়ি? তারপর সে হাসিতে ভেঙে পড়ল।

আনোয়ার হাসির কারণটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, অতহাসির কী আছে? খিচুড়ি খারাপ কী? ভাগাভাগি করে খাওয়া যাবে।

হাসি থামিয়ে রেহানা বলল, ফ্রিজ একেবারে খালি। আপনি এত কৃপণ কেন?

অবনীর কাচুমাচু অবস্থা দেখে আনোয়ার বলল, ব্যাচেলারদের এ-রকমই হয়, কখনও ফ্রিজ বেশি ভর্তি থাকে, কখনও একেবারে খালি। তাছাড়া, দেখছ না ভদ্রলোকের অসুখ হয়েছে। বাজারে যেতে পারেননি।

রেহানা বলল, কয়েকটা ডিম আছে। দেখুন, আমি কী চমৎকার ওমলেট বানাতে পারি।

আনোয়ার বলল, চৌধুরীবাবু, আপনি চুপটি করে বসে থাকুন। আপনাকে কিছু করতে হবে না। খিচুড়িটা আমি গরম করে নিচ্ছি। গরম মশল্লা আছে?

সেই খিচুড়ি আর ওমলেটই তৃপ্তি করে খাওয়া হল। এক সময় আনোয়ার আর রেহানা শুতে চলে গেল পাশের ঘরটায়।

আলো নিভিয়ে শুয়ে রইল অবনী। তার ঘুম আসছে না। বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। কাগজে সে পড়েছে, এখানে মাঝে মাঝে এমন ঝড় হয় যে, গাড়ি পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যায়। সমুদ্রের জল উঠে এসে ডুবিয়ে দেয় শহরের রাস্তা-ঘাট।

রেহানা আর আনোয়ার কি ঘুমিয়ে পড়েছে এর মধ্যে? কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

আনোয়ার সম্পর্কে একটু একটু ঈর্ষা হচ্ছে ঠিকই। আবার, আনোয়ার এমনই দিলখোলা, প্রাণবন্ত মানুষ যে, তাকে পছন্দ না করে পারা যায় না।

রেহানা যে একবার তার কপালে হাত রেখেছে, তাই তো যথেষ্ট! নারায়ণগঞ্জে রেহানাদের বাড়িতে অবনী এক রাত কাটিয়েছিল, এখানে অবনীর বাড়িতে পাকেচক্রে রেহানাকে রাত কাটাতে হল। ব্যাস, শোধবোধ হয়ে গেল। অবশ্য, এটা অবনীর নিজের বাড়ি নয়, অস্থায়ী অ্যাপার্টমেন্ট। বর্ধমানের বাড়িটাই কি তার নিজের বাড়ি? সে-বাড়ি আগে ছিল সিরাজুল চৌধুরীদের, তারও আগে ওই জমির মালিক কে ছিল কে জানে।

নারায়ণগঞ্জে বাড়িটাও রেহানাদের নয়, তার পিসেমশাই সিরাজুল চৌধুরীদের। তার আগে ও-বাড়ি ছিল অবনীর বাবার। তারও আগে ওই জমি ছিল অন্য কারুর।

কোনও বাড়িই কি মানুষের ঠিক ঠিক নিজের বাড়ি? সব মানুষই এই পৃথিবীর অতিথি।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়