চিরকাল একজনের দোষে অন্য এক জন মার খায়।

হিরোসিমা-নাগাসাকিতে যে হাজার হাজার মানুষ অ্যাটম বোমার ঘা খেয়ে মরেছিল, তারা কি যুদ্ধ বাধাবার জন্য দায়ী ছিল? দাঙ্গার সময় মরে শুধু নিরীহ লোকেরা, যারা অস্ত্র ধরতেই জানে না। দুই গুণ্ডার দলের বোমা মারামারির সময় শিয়ালদার কাছে প্রাণ দিয়েছিল শুধু একটি স্কুলের মেয়ে।

আড়াই বছর আগে ছোটপাহাড়ি থেকে এক জন কন্ট্রাকটর নাকি একটি বেশ ডবকা আদিবাসী মেয়েকে ফুসলে নিয়ে গিয়েছিল। তা আমি জানব কী করে? সেই কারণে ছোটপাহাড়ির লোকেরা সন্দেহপ্রবণ হয়ে আছে। আমি কি ফুলমণিকে ফুসলে নিয়ে গেছি নাকি? আহা একে ফুসলানি বলে, আমি তার হাতও ধরিনি একবার, সব মিলিয়ে তার সঙ্গে আড়াইখানা বাক্য বিনিময় হয়েছে কি না সন্দেহ।

আড়াই বছর আগেকার সেই ঠিকাদার পালিয়ে গিয়ে দিব্যি মজা মারল, তাকে কেউ ধরতে ছুঁতে পারল না, তার বদলে মার খেয়ে মরলাম আমি!

না, ঠিক মরিনি অবশ্য। বেকারের জান খুব কড়া হয়। বেকাররা যদি পটাপট মরে যেত, তাহলে তো এ-দেশের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত। বেকাররা মরে না, তারা রক্তবীজের মতো বাড়ে।

মাথা ও ঘাড়ের ঘা শুকিয়ে গেছে, ঝামেলা বাঁধিয়েছে বাঁ পাটা। ঢাউস একটা প্লাস্টারের পোশাক পরিয়ে আমায় বিছানায় শুইয়ে রেখেছে এক মাস। হাঁটুর মালাইচাকি আর গোড়ালি নাকি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।

মাকে বলা হয়েছে যে, আমি পাহাড়ে ট্রেকিং করতে গিয়ে এক খাদে পড়ে গিয়েছিলাম। দুর্ঘটনার চেয়ে মানুষের হাতে মার খাওয়া মায়েদের চোখে বেশি ভয়াবহ। কারণ যারা মেরেছে তারা আবার মারার চেষ্টা করতে পারে। আমি অবশ্য হালফিল আর ছোটপাহাড়িতে যাচ্ছি না।

নীপাবউদিরা প্রায়ই আমাকে দেখতে আসে। চন্দনদা দু’বার ঘুরে গেছে। প্রায় প্রতি দিন আসে লালুদা। লালুদা এলেই আমি মুখের ওপর চাদর টেনে, ঘাপটি মেরে ঘুমের ভান করে থাকি। লালুদার বাক্যস্রোত কি রোজ সহ্য করা যায়? অথচ একটা মানুষকে বাড়িতে আসতে বারণ করা যায়?

লালুদা আসে দুপুরের দিকে। নিজস্ব ব্যবসা, যখন তখন ছুটি। আমার সন্দেহ হচ্ছে লালুদা এই সুযোগে আমার বউদির সঙ্গে প্রেম করার চেষ্টা করবে। বউদি সকালের স্কুলে পড়াতে যায়, সারা দুপুর বাড়িতে থাকে। বিবাহিতা বউদের সঙ্গে প্রেম করা লালুদার দ্বিতীয় পেশা।

আমার বউদি দুটো মিষ্টি কথায় গলে যাবার মতো মেয়ে নয়। লালুদার কাঠালি কলা মার্কা ঠোঁট কোনও মেয়ের পছন্দ হবেই বা কেন? কিন্তু লালুদার একটি মোক্ষম অস্ত্র আছে। পরোপকার। আমাদের বাথরুমের সিস্টার্ন থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়া আজ পর্যন্ত কেউ বন্ধ করতে পারেনি, তলায় গামলা পেতে রাখতে হয়, লালুদা কোথা থেকে এক জাদুকর মিস্ত্রি নিয়ে এসে সেটা সারিয়ে দিল। ঠিকে ঝি দেশে গিয়ে আর ফেরেনি, লালুদা এনে দিয়েছে এক আদর্শ কাজের মেয়ে, যে মাইনে কম নেয়, ফাঁকি মারে না। মা ও বউদির কাছে লালুদার ভাবমূর্তি বেশ উজ্জ্বল।

আমাকে প্রায়ই সান্ত্বনা দিয়ে লালুদা বলে, তোমার কোনও চিন্তা নেই নীলকণ্ঠ, তুমি সেরে উঠলেই তোমাকে আমি অন্য চাকরি জোগাড় করে দেব। ও-রকম ধাদ্ধাড়া গোবিন্দপুরেও যেতে হবে না।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আবার চাকরি! আমার কপালে চাকরি সয় না।

মুমু এক দিন এসে বলল, অ্যাই, তুমি সব সময় শুয়ে থাকো কেন? লেজি বোনস! শুধু শুয়ে থাকলে তুমি আরও লেজি হয়ে যাবে, আর কোনওদিন হাঁটতে পারবে না।

মুমু এলেই ঘরের মধ্যে টাটকা বাতাস খেলে যায়। জবা ফুলের মতো একটা লাল টকটকে ফ্রক পরে এসেছে মুমু। হাতে একটা চকোলেট বার। বাচ্চা ছেলেকে লোভ দেখাবার মতো করে বলল, তুমি যদি আজ হাঁটতে পারো, তোমাকে এই চকোলেট খাওয়াব।

আমার হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে নামাল মুমু। তারপর সুর করে বলল, হাঁটি হাঁটি পা পা, খোকাবাবু আসছে সরে যা!

মুমুর কাঁধে ভর দিয়ে এক দিকের দেয়াল পর্যন্ত গেলাম। হাঁটুতে ব্যথা লাগছে বেশ, কিন্তু অসহ্য নয়।

মুমু বলল, রোজ একটু হাঁটতে হয়, না হলে জয়েন্টগুলো খারাপ হয়ে যায়।

তুই কোথা থেকে জানলি রে মুমু?

আমার একবার পা ভেঙেছিল না? প্রত্যেকেরই একবার করে পা ভাঙে।

তা ঠিক বলেছিস। যাদের একবারও পা ভাঙে না, তারা পায়ের মর্ম বোঝে না।

ব্লু, সেবারে তুমি আমাকে দিকশূন্যপুরে নিয়ে যাবে বলে আমাকে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ে রেখে এলে। আমার আর দিকশূন্যপুর দেখা হল না। একবার নিয়ে যাবে না?

তোর বয়সী মেয়েদের সেখানে যেতে নেই।

 তাহলে তখন বলেছিলে কেন?

 তখন তোকে ভোলাবার জন্য…তোর তখন খুব মন খারাপ ছিল।

কেন আমার বয়সীদের দিকশূন্যপুরে যেতে নেই?

ওখানে যারা যায়, তারা সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে যায়, আর ফেরার কথা চিন্তা করে না। তোর এখনও পড়াশুনা বাকি, আরও অনেক কিছু বাকি।

তুমি যাও কেন? তুমি তো ফিরে আসো!

ওখানে বন্দনাদি বলে এক জন আমাকে খুব ভালবাসে। তাকে দেখতে যাই। ওখানে কেউ শুধু শুধু বেড়াতে গেলে অন্যরা পছন্দ করে না। শুধু আমার পারমিশান আছে। আমি দু’এক জনকে দিকশূন্যপুরে পৌঁছে দিয়েছি।

ওখানে কী আছে বলো না।

 খুব সুন্দর জায়গা, যার যেমন ইচ্ছে সেইভাবে থাকতে পারে। প্রত্যেকেই নিজের জিনিসটা তৈরি করে নেয়, কোনও কিছুরই অভাব নেই। যার যেটা বেশি আছে, সে সেটা অন্যকে দেয়, এই রকম ভাবে বদলাবদলি হয়।

কারা ওখানে গিয়ে থাকে?

যারা খুব দুঃখী, যাদের কেউ ঠকিয়েছে, খুব আঘাত দিয়েছে, তারা যায়, ওখানে গিয়ে সব দুঃখ ভুলে যায়।

কোথায় জায়গাটা? কত দূরে?

সে এক নিরুদ্দেশের দেশ। ঠিকানা বলতে নেই!

 মুমু অনেক দিন পর আমাকে দিকশূন্যপুরের কথা মনে পড়িয়ে দিল। দিকশূন্যপুর আমাকে টানে। বন্দনাদি, রোহিলা, জয়দীপ, বসন্ত রাও এদের দেখিনি কত দিন।

যে-দিন আমার পায়ের প্লাস্টার কাটা হল, সে-দিন বিকেলে এল চন্দনদা। মুখখানা গম্ভীর। একটা না-জ্বালা চুরুট মুখে দিয়ে বসে রইল চুপ করে।

আমি এক সময় বললাম, আর দুদিন পরেই পুরোপুরি ফিট হয়ে যাব। মধ্যপ্রদেশে আমার এক বন্ধু চাকরি পেয়েছে, আমাকে নেমন্তন্ন করেছে, ওর ওখান থেকে ঘুরে আসব ভাবছি। বস্তারের জঙ্গল।

চন্দনদা বলল, হুঁ, বস্তারের জঙ্গল। তুই জঙ্গল খুব ভালবাসিস, তাইনা নীলু! সুন্দরবনে গেছিস?

অনেক বার।

আমাকে একবার নিয়ে যাবি? আমি সুন্দরবন দেখিনি। আচ্ছা, না থাক।

থাক কেন? সুন্দরবন তো যে-কোনও দিন যাওয়া যায়। তোমার ছুটি থাকলে এই উইকএন্ডেই চলো।

নাঃ, এখন সুন্দরবন যাবনা।

চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে একবার জানলার ধারে গিয়ে বাইরে উঁকি দিল চন্দনদা। আমার টেবিলের ওপর বইগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ফুলমণির খবর পাওয়া গেছে, শুনেছিস তো?

না তো! কোথায়?

লালু তোকে বলেনি?

লালুদা ঠিক দরকারের কথা ছাড়া অন্য সব কথা বলে। কোথায় আছে ফুলমণি! ছোটপাহাড়িতে ফিরে গেছে?

সেখানে ফেরেনি। ফুলমণি থাকে অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে।

আমি দারুণ চমকে গেলাম এবার। অনিন্দ্য দাস? সেই দুর্মুখ শিল্পী? যিনি সেই রাতে ফুলমণিকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন?

চন্দনদা বলল, নাঃ, জোর-টোরের ব্যাপার নেই। প্রেমের ব্যাপার। যাতে যার মজে মন, কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম।

অনিন্দ্যবাবু কখন ফুলমণির প্রেমে পড়লেন?

অনিন্দ্য তো প্রেমে পড়েনি, সে প্রেম-ট্রেমে বিশ্বাসই করে না। এক্ষেত্রে অনিন্দ্যই হচ্ছে ডোম, তার প্রেমে পড়েছে ফুলমণি।

কী উলটো-পালটা বলছ চন্দনদা? ফুলমণি কারুর প্রেমে পড়তে পারে নাকি? মানে…অনিন্দ্যবাবুকে সে কতটুকু দেখেছে?

শোন, তুই কানু রায়কে চিনিস? কানু রায় ছবি আঁকে না। কিন্তু সেসব ছোট-বড় শিল্পীদের চেনে, আর্ট ওয়ার্লডে ঘোরাফেরা করে। সেই কানু রায় গিয়েছিল অনিন্দ্যর বাড়িতে। সে দেখে এসেছে, ওরা দু’জনে বেশ মজায় আছে, দু’জনেই ছবি আঁকছে। ফুলমণি নাকি তাকে বলেছে যে, অ্যাকাডেমির প্রদর্শনীতে সে যত শিল্পীকে দেখেছে, তাদের কারুকেই তার সত্যিকারে পুরুষ বলে মনে হয়নি। অনিন্দ্য তাকে বকাবকি করলেও তাকে দেখা মাত্র ফুলমণি মুগ্ধ হয়েছে। তার চোখে অনিন্দ্যই সত্যিকারে পুরুষ এবং শিল্পী। তাই অনিন্দ্য একটা ইঙ্গিত করা মাত্র ফুলমণি তার সঙ্গে চলে গেছে।

ফুলমণি এত কথা বলতে পারে?

এখন হয়তো তার মুখে কথা ফুটেছে।

অনিন্দ্যবাবু তো দমদমে থাকেন, তাইনা?

দমদমে এ-রকম ভাবে একটা মেয়েকে নিয়ে থাকা চলত না। সুন্দরবনে অনিন্দ্যদের একটা লাট আছে। চাষবাস হয়, মাছের চাষ হয়, একটা বাড়িও তৈরি করেছে। সেখানে অনিন্দ্য প্রায়ই ছবি আঁকতে বা মূর্তি গড়তে যায়। ও এমনিতেই কারুকে গ্রাহ্য করে না, আর সেখানে তো সমাজ বলতে কিছু নেই।

ফুলমণি কারুকে কিছু না বলে অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে চলে যাবে, এটা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না চন্দনদা। যাই হোক, যদি সত্যি হয়, ফুলমণি তা হলে ভালই আছে। ওর জন্য ছোটপাহাড়িতে তোমাদের আর কোনও গোলমাল হয়নি তো?

নাঃ! তোকে মারধোর করার পর ওরা খানিকটা স্কেয়ার্ড হয়ে গেছে। আমরাও পুলিস প্রোটেকশান নিয়েছিলাম। আমি এখানে আসবার দুদিন আগে শুনলাম, ফুলমণি তার শ্বশুরের নামে দুশো টাকা পাঠিয়েছে মানিঅর্ডার করে। তাতে লোকে বুঝে গেল যে, সে স্বেচ্ছায় অন্য কোনও জায়গায় রয়েছে। এরপর আর আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। বুড়োটা বেশ মজাতেই আছে! এর মধ্যে আবার তার কোন এক ভাইপো বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলে এসেছে ওই বাড়িতে। তারা বুড়োকে খুব আদরযত্ন করে খাওয়াচ্ছে। তার মানে, বুড়ো চোখ বুজলেই বাড়িটা হাতিয়ে নেবে।

ফুলমণিকে নিয়ে তাহলে আর আমাদের মাথা ঘামাতে হবে না? যাক বাঁচা গেল!

তুই অবশ্য ইচ্ছে করলে একবার দেখে আসতে পারিস নীলু, কানু রায়ের কথা কতটা সত্যি। আমি অবশ্য তোকে যেতে বলছি না। তোর কোনও দায়িত্ব নেই, তুই যথেষ্ট ভুগেছিস।

যেতে হলে আমরা দুজনেই তো এক সঙ্গে—

আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না রে।

কেন?

নীপা দারুণ রেগে আছে। ফুলমণি অনিন্দ্যর কাছে আছে শুনেই বলল, তোমার বন্ধু একটা দুশ্চরিত্র। তোমরা পুরুষরা সবাই এ-রকম। ফুলমণির ছবি নিয়ে মাতামাতি করে তোমরা আসলে নিজেদের আর্ট-বোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছিলে, ওর জীবনটা কোনও মূল্য দাওনি। ওর শেকড় ছিঁড়ে ওকে ছোটপাহাড়ি থেকে উপড়ে আনার কী দরকার ছিল? এখন যদি আমি যাই?

অনিন্দ্য দাস বুঝি আগেও এ-রকম করেছে?

ওকে ছোটবেলা থেকে চিনি তো। মেয়েদের মন ভোলাতে একেবারে ওস্তাদ। ওর টেকনিকটা কি জানিস, ও মেয়েদের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে না, প্রেম জানায় না, প্রথমেই রুক্ষভাবে কথা বলে, এমনকী দুমদাম গালাগালি দেয়। আশ্চর্য! তাতেই অনেক মেয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। চেহারাটা তো রাফ, মেয়েরা মনে করেও একেবারে রিয়েল মাচো, হি-ম্যান। কয়েক বছর আগে হাইকোর্টের এক জজের মেয়ে, দারুণ সুন্দরী, ওর জন্য একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল।

সে-মেয়েটি এখন কোথায়?

কে জানে!

তুমি না গেলে, আমিও যাবনা চন্দনদা।

যাস না। আমি মোটেই যেতে বলছি না। অনিন্দ্যদের গ্রামটার নাম বোয়ালভাসি, ক্যানিং থেকে লঞ্চে যেতে হয় গোসাবা, সেখান থেকে মাইল চারেক দূরে গ্রাম। ও, তোকে আর এসব কথা বলছি কেন, তুই তো সুন্দরবনের সবই চিনিস।

চন্দনদা চলে যাবার পর বোয়ালভাসি নামটা আমার মাথায় ঘুরতে লাগল অনবরত। এক-একটা নাম, এক-একটা শব্দ হঠাৎ মনে গেঁথে যায় কেন যেন!

গোসাবার কাছে রাঙাবেলিয়া, সাতজেলিয়া, সজনেখালি এইসব গ্রাম আমি চিনি, গেছিও কয়েক বার। কিন্তু বোয়ালভাসির নাম আমি আগে শুনিনি। এক কালে এই সব অঞ্চল ছিল হ্যামিলটন সাহেবের জমিদারি, সাহেব চলে যাবার পর কিছু কিছু সমৃদ্ধ বাঙালি সেখানে ফার্মিং শুরু করেছিল।

রাস্তায় বেরুতে শুরু করার দু’তিন দিন বাদেই বুঝতে পারলাম, বোয়ালভাসি গ্রামটা আমাকে চুম্বকের মতো টানছে।

একটা অদম্য কৌতূহল, অনিন্দ্য দাসের মতো মানুষের সঙ্গে ফুলমণির কী করে জোড় মিলল, সেটা শুধু দেখে আসা।

তাহলে মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে যাবার আগে একবার সুন্দরবনটাই ঘুরে আসা যাক।

গোসাবা পৌঁছে একটা সাইকেল ভ্যান ধরলাম। নিজের দুটো পা ছাড়া এটাই এখানকার প্রধান যানবাহন। ভ্যান চালককে বললাম, বোয়ালভাসি যাব গো, দাসবাবুদের খামারে।

ভ্যানচালক বলল, সেখানে তো দুটো দাসবাবুর খামার। কোনটায় যাবেন?

 বললাম, এক জন দাসবাবু, খুব লম্বা, ছবি টবি আঁকেন, তাকে চেনো?

সে বলল, অ। যে-বাবু মেয়েছেলে দাঁড় করিয়ে তার মূর্তি বানায়, সে তো? হ্যাঁ চিনি।

বোঝা গেল, অনিন্দ্য দাস সেখানেও বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে।

ভ্যানচালক মাইল চারেক ইটের রাস্তায় চালিয়ে নিয়ে এসে একটা নদীর ধারে থেমে বলল, এবার খেয়া নৌকায় পার হয়ে যান। ওই যে দেখা যাচ্ছে ও-পারে দাসবাবুদের খামার।

খেয়ার নৌকোয় ওঠার পর আমার ভয় ভয় করতে লাগল।

অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। উনি এখন কী-রকম মেজাজে আছেন কে জানে। উনি যদি মনে করেন আমি অপমানের শোধ নিতে এসেছি! এখন আর ফিরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। এখন বেলা তিনটে, আশা করি এখনই উনি মৌজ করে বসেননি!

খেয়াঘাট থেকে একটা সরু পথ গেছে দাসদের খামারের দিকে। খানিকটা ইটের দেওয়াল, খানিকটা কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘেরা। গেটটা খোলাই রয়েছে। তারপর মস্ত বড় একটা উঠোন, এক পাশে দুটো ধানের গোলা, অন্য পাশে একটা মস্ত বড় বাড়ি। প্রশস্ত বারান্দা, ওপরে টিনের চাল। উঠোনে হাঁস মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছে, পাঁচটা ছাগলছানা লাফাচ্ছে এক ছাগ-মাতার পেছন পেছন, আর এই সবকিছুর মাঝখানে, গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে একটা পাথরের চাইতে ছেনি চালাচ্ছেন অনিন্দ্য দাস। পরনে শুধু জিনসের ট্রাউজার্স, খালি গা, মাথায় টোকা।

আমার প্রথমেই আশ্চর্য লাগল পাথরটা দেখে।

সুন্দরবন জলকাদার দেশ, এখানে এক টুকরো পাথর নেই, পাহাড় বহু দূরে। এখানে এত বড় পাথর এল কী করে?

আমার ধারণা ছিল, আজকালকার ভাস্কররা প্রথমে প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তি বানিয়ে তারপর ব্রোঞ্জ কাস্টিং করেন। এখনও পাথর কুঁদে কুঁদে মূর্তি বানানো হয়! অনিন্দ্য দাসের মতো দীর্ঘকায় বলশালী পুরুষ না হলে সম্ভবও না।

কোথা থেকে একটা কুকুর হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে উঠতেই অনিন্দ্য দাস আমার দিকে ফিরে তাকালেন। চোখ কুঁচকে দেখলেন কয়েক মুহূর্ত।

তারপর বললেন, তুমি কে! তোমাকে আগে যেন কোথায় দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে।

আমি হাত তুলে বললাম, নমস্কার। হ্যাঁ, আপনি আমাকে আগে দেখেছেন। আমি চন্দন ঘোষালের ছোট ভাইয়ের মতো। আমি এ-দিকে সাতজেলিয়ায় এসেছিলাম এক জনের কাছে, শুনলাম আপনি এখানেই স্টুডিয়ো বানিয়েছেন, তাই আপনার কাজ দেখতে এসে পড়লাম। আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম বোধহয়।

অনিন্দ্য দাস এক গাল হাসলেন। মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, না, তুমি সাতজেলিয়ায় আসোনি। তুমি শালা এখানে স্পায়িং করতে এসেছ। দেখতে এসেছ, ফুলমণিকে আমি খেয়ে ফেলিচি না আস্ত রেখিচি।

তারপর চেঁচিয়ে দুজনকে ডাকলেন। প্রথমে বললেন, ফুলমণি, এ-দিকে এসো গো। দেখো, তোমার বাপের বাড়ির লোক এসছে।

আবার বললেন, নিরাপদ, একটা টুল নিয়ে আয়। কুটুমকে বসতে দে। আগে এল এক জন বাঁটকুল ধরনের লোক। আমার কাছে একটা টুল পেতে দিল।

অনিন্দ্য দাস খাতির করে বললেন, বসো, বসো ছোকরা। তোমাদের ছবিউলি মেয়েটাকে আমি টেনে হিচড়েও আনিনি, এখেনে জোর করে ধরেও রাখিনি। সে এলেই জিজ্ঞেস করো, নিজের ইচ্ছেতে এসেছে কি না।

অনিন্দ্য দাসের কথা শুনবকী, আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে নেমে এল ফুলমণি। এ কোন ফুলমণি? তাকে যে চেনাই যায় না। সে একটা বাটিক প্রিন্টের শাড়ি পরে আছে, মাথার চুল খোলা, এই দেড় মাসেই তার স্বাস্থ্য ফিরেছে অনেক। শীর্ণ ভাবটা মোটেই নেই, মসৃণতা এসেছে চামড়ায়, চোখের দৃষ্টিতে গভীরতা। সে এখন তাকিয়ে থাকার মতো সুন্দর। আগে বোঝা যায়নি, তার মুখখানা বেশ ধারালো।

কী করে ফুলমণির এতটা পরিবর্তন হল? একজন পুরুষের সঙ্গে উদ্দাম ভালবাসা, না পেট ভরে দু’বেলা খাওয়া, নাকি মনের ফুর্তি?

ফুলমণি আমাকে দেখে অবাক হয়েছে ঠিকই। কাছে এসে বলল, নমস্কার ছোটবাবু।

কানু রায় তো মিথ্যে বলেনি। ফুলমণির মুখে কথা ফুটেছে। আগে সে নিজের থেকে কোনও কথাই বলত না।

কিন্তু হঠাৎ একরাশ অভিমান ঢুকে গেল আমার গলার মধ্যে। ফুলমণির সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করল না। অ্যাকাডেমি থেকে অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে চলে আসার আগে ও একবার আমাকে বলে আসাবও প্রয়োজন মনে করেনি? আমি ওর ছোটবাবু নই, কেউ নই।

অনিন্দ্য দাস বললেন, হাঁড়িয়া আনিসনি? নিয়ে আয। তোর নিজের লোককে খাওয়া।

নিরাপদ নামে বাঁটকুল লোকটিই নিয়ে এল কাঁচের জগ ভর্তি হাঁড়িয়া আর কয়েকটা গেলাস।

অনিন্দ্য দাস একচুমুকে এক গেলাস সাবাড় করে বলল, ফুলমণি ফার্স্টক্লাস হাঁড়িয়া বানায়। খেয়ে দেখো! সে-দিন, বুঝলে, অ্যাকাডেমিতে তুমি আমার সঙ্গে ঝঞ্ঝাট করছিলে, আমার বেশ রাগই হয়েছিল, ভাগ্যিস তোমাকে মেরে বসিনি। তোমার দোষ নেই, তুমি তো আমাকে চেনো না। আমি গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, দেখি যে এই মেয়েটাও এসেছে। আমি ওকে বললাম, অ্যাঁই ছুঁড়ি, তুই এইসব বাবুদের মধ্যে কী কচ্ছিস? যদি সত্যি ছবি আঁকতে চাস, ছবি আঁকা শিখতে চাস, তো আয়, আমার সঙ্গে। অমনি সুড়সুড় করে চলে এল।

আমি গেলাস হাতে নিয়ে চুপ করে তাকিয়ে রইলাম।

অনিন্দ্য দাস আবার বলল, ওকে এনে ভাল করিচি কিনা বলো! চেহারার কেমন চেকনাই হয়েছে দেখেছ? বুলু দেখেছ, বুলু!

অনিন্দ্য দাস ফুলমণির নিম্ন শরীরে চাপড় মারলেন দু’বার।

আমার দিকে তাকিয়ে আধখানা ঠোঁটে হেসে বললেন, বুলু মানে জানো? ওদের ভাষায় ঊরুকে বলে বুলু! আরও অনেকগুলো সাঁওতালি কথা শিখেছি। এরা পাগলকে বলে কঙ্কা। এ বেটি প্রায়ই আমাকে বলে কঙ্কা, কঙ্কা, প্রথমে বুঝতুম না। পাহাড়কে বলে বুরু। ঠোঁট হচ্ছে লুটি আর বুক হচ্ছে কোড়াম। আঙুল হচ্ছে কাটুকা। বেশ, না? এই সব শব্দ বাংলা ভাষাতেও নিয়ে নেওয়া উচিত আর পড়হাও-কুঁড়ি মানে কী বলল তো? ছাত্রী! এই মেয়েটা আমার পড়হাও-কুঁড়ি! অবশ্য আমি ওকে ছবি আঁকতে দিইনা এখনও।

এবার আমি একটু চমকে উঠলাম।

অনিন্দ্য দাস বললেন, কেন আঁকতে দিই না জানো? আরে বাবা, ছবিই বলো, আর যে-কোনও শিল্পই বলল, আগে ফর্মটা ভাল করে শিখে নিয়ে তারপর ফর্ম ভাঙতে হয়। না ভাঙলে নতুন কিছু গড়া যায় না। শিল্পের ফর্ম ভাঙতে গেলে জীবনটাকেও কিছু ভাঙচুর করতে হয়। চাকরি-বাকরি, রোজগার, রোজ রাত্তিরে কখানা হাতে গড়া রুটি আর তরকারি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া, বছরের পর বছর এ-রকম জীবন কাটিয়ে শিল্প হয় না। ওকে ওর আগেকার জীবনের বাপের নাম ভুলিয়ে দিচ্ছি। সব উলটো পালটা হয়ে যাক! আর একটা কথা। অশিক্ষিত পটুত্বের আমি ইয়ে মারি। ও-সব দিন চলে গেছে। শিখতে হয়, সব গোড়া থেকে শিখতে হয়। ভেতরে মালমশলা আছে বলে দু’চারখানা ছবি এঁকে ফেলল, কিন্তু তা দিয়ে শিল্প হয় না। দু’দিনে একঘেয়ে হয়ে যায়। ফোক আর্ট সব একই রকম। মহৎ শিল্পীর হাতে হাজার রকম খেলা। জীবনটাকে শিল্প করে না নিলে তা হয় না। ফুলমণিকে আমি বলেছি, এখন এক বছর শুধু সোজা সোজা দাগ টেনে যা। চোখ বুজে মানুষের মুখটা দেখতে শেখ।

লম্বা লেকচার দিচ্ছেন বটে, তবু ওঁর কোনও কথাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

হঠাৎ ফুলমণিকে কাছে ডেকে তিনি ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বললেন, এ মেয়েটার প্রোফাইলটা দারুণ! প্রথম দেখেই মনে হয়েছিল মাগিটাকে পাথরে ধরতে হবে।

পরক্ষণেই ফুলমণিকে সরিয়ে দিয়ে বললেন, অ্যাই হারামজাদি, আর মোটাবি না বলে দিচ্ছি। যদি দেখি আরও মুটিয়েছিস, মেরে একেবারে পাট করে দেব।

ফুলমণিকে এখনও কোনওক্রমেই মোটা বলা যায় না। আমি অনেক আদিবাসী পল্লিতে ঘুরেছি। সাঁওতাল, ওরাওঁ, হো, মুণ্ডা, লোধাদের মধ্যে এ পর্যন্ত এক জনও স্থূলকায়া মহিলা দেখিনি।

অনিন্দ্য দাসের এই সব ভাষা শুনেও ফুলমণি মিটমিটিয়ে হাসছে।

আমি পাথরটার পেছন দিকে বসে আছি। অনিন্দ্য দাস ডাকতেই সামনের দিকে গিয়ে অবাক হলাম। ফুলমণির অনেকখানি প্রতিমূর্তি গড়া হয়ে গেছে। তার নগ্ন প্রতিমূর্তি।

আমি ভাস্কর্য কিছুই বুঝি না। তবে দেখেই মুগ্ধ হলাম। এর সঙ্গে দেবীপ্রসাদ, রামকিঙ্করের কোনও মিল নেই। হেনরি মুর বা রদ্যাঁর ধরনেরও নয়। অনেকটা যেন রিলিফের মতো। পাথরটা পাথরই থাকছে, তার মধ্য থেকে একটা বেশ চিনতে পারার মতো মূর্তি ফুটে বেরুচ্ছে।

অনিন্দ্য দাস বললেন, আমি আর্টকে কমার্সিয়াল করিনি। আমার মূর্তি বেচি না। শেষ হবার পর এটা কোথায় বসাব জানো, চমটা ব্লকে, নদীর মোহনার ধারে। সমুদ্র দিয়ে জাহাজ যাবে, নৌকোর মাঝিরা দেখবে। জঙ্গলের বাঘেরা এসে মূর্তিটাকে আদর করবে। কয়েকশো বছর বাদে লোকেরা ভাববে, সুন্দরবনের নরম মাটিতে একটা পাথরের মূর্তি গজিয়ে উঠল কী করে? নিশ্চয়ই আকাশ থেকে দেবতারা ফেলেছে। সেইভাবে আমি দেবতা হয়ে যাব। হা-হা-হা-হা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, পাথরটা আপনি আনলেন কী করে?

অনিন্দ্য দাস বললেন, বাজে প্রশ্ন। নৌকোয় আনিয়েছি। ঘাটশিলা থেকে। আর একটা মূর্তি দেখবে। এসো।

বাড়ির পেছন দিকে একটা বাগান। সেখানে একটা প্রমাণ সাইজের মূর্তি বসানো আছে। সেটাও ফুলমণির। কঠিন পাথরের মধ্যে ফুলমণির লাজুক ভাবটা কী আশ্চর্য ফুটেছে। অনিন্দ্য দাস সত্যিই শক্তিশালী শিল্পী।

অনিন্দ্য দাস বললেন, অ্যাই ফুলমণি, তুই এই মূর্তিটার পাশে দাঁড়া।

আমাকে বললেন, একবার দেখো, খুঁটিয়ে দেখো, ফুলমণির চেহারার সঙ্গে মুর্তিটায় কিন্তু মিল নেই। অথচ মিল আছে। এই অথচ মিলটাই আসল। ক’জন শালা এটা বোঝে?

বাঁটকুল লোকটি এবার এসে বলল, আপনারা এবার খাবেন না? বিকেল হয়ে গেল।

 অনিন্দ্য দাস বললেন, কী রেঁধেছিস? নিয়ে আয় না শুয়ার। বক বক করছিস কেন?

 নিরাপদ সঙ্গে সঙ্গে এক ডেকচি খিচুড়ি নিয়ে এল। কলাপাতায় বেড়ে দিয়ে গেল হাতে হাতে। বিকেল সাড়ে চারটের সময় এই ওদের দুপুরের খাবার। শুধু কলাপাতায় খানিকটা খিচুড়ি, ভেতরে অবশ্য আলুটালু আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া। অনিন্দ্য দাস খিচুড়ি খেতে খেতেই হাঁড়িয়ার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। ফুলমণিও হাঁড়িয়া খেয়ে যাচ্ছে সমানে।

আমি খানিকটা খিচুড়ি খেয়ে পাতাটা নামিয়ে রাখলাম।

অনিন্দ্য দাস ধমক দিয়ে বললেন, এই, এই, ও কী, আরও নাও। নিরাপদ, ওকে আরও খিচুড়ি দে। বেগুনভাজা কোথায়? হারামজাদা, আজ একটু মাছও জোগাড় করতে পারলি না? সবাই বলে সুন্দরবন মাছের দেশ, অথচ এখানেই মাছ পাওয়া যায় না। সব কলকাতায় চলে যায়।

আমি বললাম, না, আমি আর খাব না।

কেন খাবেনা? ওইটুকু খেলে পেট ভরে? খাও, খাও।

না, আমাকে এবার যেতে হবে। এরপর আর ফেরার লঞ্চ পাবনা।

 ফিরবে কেন? কে মাথার দিব্যি দিয়েছে, চাঁদু? এখানে থেকে যাবে। উঠোনে খাটিয়া পেতে দেব রাত্তিরে। এই গরমে আমরা সবাই উঠোনে শুই। ভয় নেই, বাঘ আসবে না।

মাটি থেকে আমার ঝোলাটা তুলে নিয়ে বললাম, আমাকে ফিরতেই হবে আজ।

ফুলমণি ঈষৎ নেশাগ্রস্ত গলায় বলল, কেন যাবে? থাকো, থাকো।

এই প্রথম আমি ফুলমণির দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ফুলমণি তোমাকে নিয়ে এই যে-মূর্তিটা গড়েছে তোমার কেমন লেগেছে?

ফুলমণির মুখ হাসিতে ঝলমল করে উঠল।

অনিন্দ্য দাসের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, মূর্তি তো গড়ে নাই।

তারপর আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, উ গড়াইছে।

 ওরে বাবা, এত প্রেম!

 হাতের কলাপাতায় খিচুড়ি নিয়েই ওরা আমাকে বিদায় দিতে এল গেট পর্যন্ত। ফুলমণি কঞ্চির বেড়ায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে, অনিন্দ্য দাস তার এঁটো হাত ফুলমণির কাঁধে রাখলেন। আমাকে বললেন, এই ছেলে আবার আসিস। যখন খুশি চলে আসবি।

ওদের দুজনের গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভঙ্গিটা আমার চোখে লেগে রইল। আমি আর এখানে কখনও আসবনা।

.

১০.

 ফুলমণির কাহিনি এখানেই শেষ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু গল্প-উপন্যাসে এ-রকম একটা সুখের মিলন হলেও সেটা হয় ইচ্ছাপূরণ। বাস্তব বড় নিষ্ঠুর। ফুলমণি আর অনিন্দ্য দাসের মতো দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ কি সারা জীবন একসঙ্গে কাটাতে পারে।

বোয়ালসিতে ওদের দুজনের উদ্দাম জীবনের একটা টুকরো ছবি আমি দেখে এসেছি, তা আসলে এক ধরনের পিকনিক। ভারি চমৎকার, খুব লোভনীয়, কিন্তু পিকনিক একটানা কত দিন চলে?

ফুলমণির জীবনে আরও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে, আমার সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ নেই অবশ্য, কিন্তু খবরগুলো আমার কানে এসেছে।

অনিন্দ্য দাস কোনও এক জায়গায় বাঁধা পড়ে থাকার মানুষ নন। সেই জন্য তিনি বিয়েই করেননি। মেয়েরা তার মাথায় উত্তেজনা জোগায়, তার কাজে গতি আনে। তিনি প্রেরণা-ট্রেরণায় বিশ্বাস করেন না। স্নায়বিক উত্তেজনা আর ফুর্তিই তাঁর কাছে প্রধান।

একথাও শুনেছি, তিনি কোনও মেয়েকেই প্রতারণা করেন না। তার বিবেক পরিষ্কার। যে-মেয়েকের পছন্দ হয়, তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, এই তুই আসবি আমার সঙ্গে? বোয়ালভাসির খামারে গিয়ে থাকবি? যে রাজি হয় না, তাকে তিনি জোর করেন না। তার দিকে আর ফিরেও তাকান না। আর যে মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাজি হয়ে যায়, সে যায় নিজের দায়িত্বে, কোনও প্রতিশ্রুতি নেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে গাঁটছড়া বাঁধার কোনও সম্ভাবনাও নেই।

ফুলমণির সঙ্গে অনিন্দ্য দাসের পিকনিক সাত মাসেই শেষ হয়ে গেছে।

ফুলমণির ছিপছিপে ধারালো শরীরটা ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু হিসেবে অনিন্দ্য দাসের পছন্দ হয়েছিল। ফুলমণিকে মডেল করে দুটো মূর্তি গড়েছেন তিনি। বিষয়বস্তু হিসেবে সে ফুরিয়ে গেছে। যে-বিষয়বস্তু একবার ব্যবহার করা হয়ে যায়, তার প্রতি শিল্পীদের আর কোনও আকর্ষণ থাকে না। এরপর ফুলমণি একটি সাধারণ নারী।

কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে এক দিন অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

আমি ছিলাম অন্য টেবিলে, উনি অনেক দূরে। চোখাচোখি হতেও আমি চেনার কোনও ভাব দেখাইনি, উনিই উঠে এলেন এক সময়।

খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, কী খবর নীলু? চন্দন এখন কোথায় থাকে? সেই ছোটপাহাড়িতে? ওর ওখানে একবার যাব। কী করে ছোটপাহাড়িতে যেতে হয় বলো তো? কোন স্টেশানে নামতে হয়? সেই মেয়েটার কোনও খবর জানো?

তার খবর তো আমার জানবার কথা নয়। আমি ছোটপাহাড়ীতে আর যাইনা।

 হ্যাঁ, এক দিন রাগ করে চলে গেল, আমি ভাবলাম আবার হয়তো আসবে একবার।

অন্য এক জন চেনা লোক অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে কথা বলা শুরু করতেই তিনি আমাকে যেন ভুলে গেলেন। সেই লোকটির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন দরজার দিকে।

আমাকে দেখে ফুলমণির কথা একবার মনে পড়েছিল অনিন্দ্য দাসের। কিন্তু সেই মনে হওয়ার কোনও গভীরতা নেই। কয়েক মিনিটের জন্য স্মৃতির আন্দোলন। ছোটপাহাড়িতে তিনি সত্যি সত্যি ফুলমণিকে আর দেখতে যাবেন না, আমার কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত ছোটপাহাড়ি যাবার সন্ধানও নিলেন না।

সিরাজুল তারিক সাহেবও ফুলমণি সম্পর্কে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে সংস্পর্শ ঘটার পর থেকেই তিনি ফুলমণি সম্পর্কে আর একটি কথাও বলেননি কখনও কলকাতার শিল্প জগতে ফুলমণির নামটা কয়েকটা দিনের জন্য উঠেই আবার মিলিয়ে গেছে, বুদবুদের মতো। প্রদর্শনীতে ফুলমণির একটি মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল। দু’হাজার টাকায় কিনেছিলেন প্রখ্যাত এক জন শিল্পী। ছবিটাই তার পছন্দ হয়েছিল। ছবির শিল্পী সম্পর্কে তিনি কোনও কৌতূহল দেখাননি।

ভবিষ্যতে অনিন্দ্য দাসের ভাস্কর্য প্রসঙ্গেও ফুলমণির নামটা কখনও উঠবে কিনা সন্দেহ। অনিন্দ্য দাসের ভাষায় ‘অথচ মিল আছে’ ক’জনের নজরে পড়বে?

চন্দনদা যদি ফুলমণির ছবি নিয়ে ব্যবসা করতে চাইতেন, নীপাবউদির ঈর্ষাফির্সা অগ্রাহ্য করে ওর পেছনে টাকা ঢালতেন, ওকে ছবি আঁকার সব সুযোগ করে দিতেন, তাহলে ফুলমণির প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশা ছিল, ওর ছবিও বিক্রি হত। সেই রকম এক জন প্রফেশনাল প্রোমোটারের দরকার ছিল, নিছক শখের পরোপকারীরা বেশি দূর যেতে পারে না। অনিন্দ্য দাস একবার ছুঁয়ে দিয়েছেন বলে আমরা আর কেউ ফুলমণির দিকে তাকাইনি।

অনিন্দ্য দাস ছোটপাহাড়িতে গেলেও অবশ্য ফুলমণির দেখা পেতেন না। চন্দনদার কাছে শুনেছি, ফুলমণি ছোটপাহাড়িতে ফিরলেও তার শ্বশুরের ভাইপো তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সে-লোকটি বাড়ি, জমিজমা দখল করে বসেছে, সে ও-বাড়ির একটা বিধবা বউকে ঠাঁই দেবে কেন? ফুলমণির নামে নানা বদনাম দেওয়া, এমনকী তাকে ডাইনি সাজানোও সে-লোকটির পক্ষে সহজ। একলা একটা মেয়ের তুলনায় এক জন বিবাহিত, সংসারী মানুষকে সব সমাজই বেশি বিশ্বাস করে।

ফুলমণি ছোটপাহাড়িতে নেই, সে আবার হারিয়ে গেছে।

এর পরেও কেটে গেছে এক বছর।

আমি আবার গা আলগা করে ঘুরে বেড়াই, কেউ আমাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। দাদা অবশ্য প্রায়ই রাগারাগি করে, কিন্তু আমার বউদির মতে, প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে এক জন অন্তত বাউণ্ডুলে বা ভবঘুরে বা অভিযাত্রী থাকা উচিত, না হলে সে-সমাজটা বর্ণহীন হয়ে যায়। সেই সুবাদে আমি বাড়িতে দু’বেলা খেতে পাই।

মাঝে মাঝে অন্যের ফাই ফরমাস খেটে আমার কিছু কিছু রোজগারও হয়।

কেউ কেউ আমার হাত দিয়ে জরুরি কাগজপত্র পাটনা কিংবা ভুপালে পাঠায়। কারুর হয়তো বৃদ্ধা মা কিংবা অশক্ত ঠাকুর্দাকে কাশী কিংবা এলাহাবাদ পৌঁছে দেবার কোনও লোক নেই, তখন আমি আছি। ট্রেন ভাড়া ছাড়াও হাতখরচ মন্দ জোটে না।

লালুদার এক আত্মীয় থাকে ঝুমরি তিলাইয়ায়, তাকে একটা সম্পত্তির দলিল পৌঁছে দিতে হবে, সেই ভারটা পেয়ে গেলাম আমি। টাকা-পয়সার ব্যাপারে লালুদা উদার, আমাকে হাতখরচ দিয়েছে পাঁচশো টাকা।

একটা স্টেশনে ট্রেন পালটাতে হবে, বসে আছি প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে।

ট্রেনের পাত্তা নেই। একটা মালগাড়ি থেমে আছে অদূরে, সেটা না গেলে আর ট্রেন আসবে না। গোটা স্টেশানটায় ভ্যান ভ্যান করছে মাছি। কিছু বাসি কচুরি, তরকারি আর দরবেশ যা বিক্রি হচ্ছে, তা মানুষের অখাদ্য, মাছিরই খাদ্য।

রেললাইন থেকে পোড়া কয়লা কুড়োচ্ছে গোটা পাঁচেক নানা বয়সী মেয়ে। প্ল্যাটফর্মে ওদেরই কেউ একটা বাচ্চাকে শুইয়ে রেখেছে, চিৎহয়ে বাচ্চাটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদছে।

অলস ভাবে তাকিয়ে ছিলাম, একসময় চোখ আটকে গেল।

কোনও সন্দেহ নেই, ওই মেয়েগুলোর মধ্যে এক জন ফুলমণি। আবার সেই আগেকার মতো রোগা চেহারা, পরনের নীল পাড় সাদা শাড়িটা যেমন ময়লা, তেমনি ছেঁড়া, মাথার চুল জট পাকিয়ে গেছে। মাথায় ঝুড়ি ভরে কয়লা তুলে তুলে প্ল্যাটফর্মের অনেক দূরে একটা কোণে জড়ো করে রাখছে।

হোক না ফুলমণি, তাতে আমার কী আসে যায়? ছবি আঁকা ছেড়ে কেউ যদি কয়লাকুড়োনি হয়, আমি তার কী করব?

অন্য কোনও কাজ নেই, সঙ্গে একটা বইও নেই, তাই বসে বসে দেখতে লাগলাম মেয়েগুলোকে। একটি মেয়েরও স্বাস্থ্য ভাল নয়। কয়লা তুলে দু’বেলার অন্ন জোটে না বোধহয়।

ঝুড়ি খালি করে ফেরার সময় মেয়েরা কেউ না-কেউ বাচ্চাটাকে একটু আদর করে যাচ্ছে। ওটা কার বাচ্চা? ফুলমণির? খুবই স্বাভাবিক।

কাছেই নিশ্চয়ই ওদের ঝুপড়ি আছে। সেখানেই জীবন কেটে যাচ্ছে, এক-একটা রেল স্টেশনে অনেকগুলো পরগাছার জীবিকার সংস্থান হয়।

ফুলমণি যদি নিজে থেকে এসে আমার সঙ্গে কথা না বলত, তাহলে পরবর্তী চিন্তাটা আমার মাথাতেই আসত না।

অন্য মেয়েরা মাঝে মাঝে কল কল করে কথা বলে উঠছে, কিন্তু ফুলমণি আগের মতোই নীরব। ফুলমণি অন্যদের মতো নয়। ওর নীরবতা ওর অহঙ্কার।

আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফুলমণি একবার থমকে দাঁড়াল। নীরবতা ভেঙে বলল, ছোটবাবু।

কবে আমার চাকরি গেছে, আমি আর ছোটবাবু নই, কোনও বাবুই নই, তবু এই ডাক শুনে যেন আমি ধন্য হয়ে গেলাম।

আমি শুধু বললাম, ফুলমণি।

ব্যাস ওইটুকুই। আর কোনও বাক্য বিনিময় হল না। ফুলমণি আবার লাইনে নেমে গেল।

কী কথা বলব ওকে? ওর অতীত ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করে কী লাভ? কয়লা কুড়িয়ে যার দিন চলে, তার ছবি আঁকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

প্ল্যাটফর্ম থেকে রেল লাইন বেশ নিচু। ঝুড়িভর্তি কয়লা নিয়ে ওপরে উঠতে মেয়েদের বেশ কষ্ট হচ্ছে। একবার ফুলমণি উঠতে গিয়ে তার কয়লার ঝুড়িটা উলটে গেল। তখনই আমার মাথায় এল সেই চিন্তাটা।

আমি উঠে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ফুলমণিকে টেনে তুললাম ওপরে। জিজ্ঞেস করলাম, ফুলমণি আমার সঙ্গে যাবে?

কোথায়?

অনেক দূরে, পোড়া কয়লা কুড়োবার চেয়ে কোনও খারাপ কাজ সেখানে করতে হবে না। ফুলমণি এ-দিক ওদিক তাকাল। খালি ঝুড়িটা সরিয়ে নিল খানিকটা। তারপর বলব, যাব।

অনিন্দ্য দাসের আহ্বানে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছিল ফুলমণি। ঠিক সেই রকম ভাবেই রাজি হয়ে গেল আমার এক কথায়? ফুলমণি স্থাণু হতে চায় না। পরিবেশ বদলাতে চায় সব সময়। অনিন্দ্য দাস যেমন বলেছিল, ও জীবনকে ভাঙছে?

হাতের ধুলো ঝেড়ে ফুলমণি বাচ্চাটাকে একবার গাল টিপে দিল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ বাচ্চাটা তোমার?

ফুলমণি বলল, না, আমার বাচ্চাটা এইটুকুন হয়েই মরে গেছে।

 আমি মনে মনে বললাম, এক দিক থেকে ভালই হয়েছে। বাচ্চা কাচ্চা সঙ্গে থাকলে ঝামেলা হত।

স্টেশনের বাইরে বাস দাঁড়িয়ে আছে।

বাস পালটাতে হল তিনবার। ফুলমণি আর একবারও জিজ্ঞেস করল না, কোথায় যাচ্ছি।

সন্ধে হয়ে এসেছে। শেষবার বাস থেকে নেমে আমি জিজ্ঞেস করলাম, সাঁতার জানো?

 ফুলমণি দু’বার মাথা ঝোঁকাল।

এবার খানিকটা জঙ্গলের পথ। দুপুর দু’বার আমরা শুধু ঝালমুড়ি খেয়েছি। ফুলমণির শরীর দুর্বল। খিদেয় নিশ্চয়ই আরও কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু মুখে তার কোনও চিহ্ন নেই। অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা ওকে টানছে।

জঙ্গলের রাস্তাটা ছমছমে অন্ধকার। কোনও একটা প্রাণী পাশ দিয়ে ছুটে যেতেই ফুলমণি থমকে গিয়ে আমার হাত চেপে ধরল।

এই প্রথম আমার হাত ধরল ফুলমণি। প্রথম ও শেষবার।

আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছলাম নদীটার কাছে। বেশ চওড়া নদী, স্রোত আছে, তবে খুব গভীর নয়। মাঝখানটায় শুধু সাঁতরে যেতে হবে।

ওপরে মিট মিট করে দু-চারটে আলো জ্বলছে। দূরে পাহাড়ের মাথায় পাতা-পোড়া আগুন।

আমি ফুলমণির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, এই নদী পার হয়ে সোজা চলে যাও। ও-পারে দিকশূন্যপুর নামে একটা গাঁও আছে। সেখানে আছে বন্দনাদি। তার কাছে গিয়ে বলবে, নীলু তোমাকে পাঠিয়েছে। ব্যাস, তোমার আর কিছু চিন্তা করতে হবে না। তুমি খাবার পাবে। থাকার জায়গা পাবে। তোমার যা খুশি তাই করতে পারো। ইচ্ছে হলে ছবিও আঁকতে পারো। বসন্ত রাও, রোহিলা এরাও ছবি আঁকে। ওরা তোমাকে রঙ-তুলি দেবে। ফুলমণি জিজ্ঞেস করল, তুমি যাবে না?

আমি বললাম, ওখানে সবাই একলা যায়। তোমার কোনও ভয় নেই। দিকশূন্যপুরের বন্দনাদিকে আমার নাম করলেই হবে। আমি এখন গেলে ফিরতে পাব না। আমি যে অন্য লোকের কাজ নিয়ে এসেছি।

হাঁটু পর্যন্ত জলে আমি গেলাম ওর সঙ্গে সঙ্গে, তারপর থেমে পড়ে বললাম, এবার তুমি একা যাও।

ফুলমণি নিষ্পলকভাবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর জল ঠেলে এগিয়ে গেল। একটু পরে তাকে আর দেখা গেল না। শুধু শোনা যেতে লাগল জলের শব্দ।

হাঁটুজলে আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ।

যাও ফুলমণি দিকশূন্যপুরে। ওখানে কেউ তোমাকে ছোট করবে না। ওখানে ওরা যে সবাই সমান। কেউ তোমাকে আদিবাসী বলে আলাদা করে দেখবে না। কারণ ওরা মনে করে সকলেই এই পৃথিবীর আদিবাসী। ওখানে কাজের কোনও অভাব নেই, কারণ কারুর লোভ নেই। ওরা নিজের জন্য কিছু রাখতে চায় না। অন্যকে দিয়ে আনন্দ পায়, সবাই অন্যকে দেয় বলে সবার সব কিছু থাকে। ওখানে দুঃখ আছে, সব মানুষেরই দুঃখ থাকে, কিন্তু ওখানে অপমান নেই। দিকশূন্যপুরে কোনও নিয়ম নেই, মানুষের ইচ্ছেটাই নিয়ম।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়