হেমকান্তি

প্রিয় বিমলেন্দুবাবু,

আপনাকে এই চিঠি লিখছি অনেক ভেবে, ভাবনার পর ক্লান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত, কারণ আর হয়তো আপনাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। দেরাদুনে আমার এক আত্মীয় আছেন, প্রথম কিছু দিন তার ওখানে থাকব, তারপর আরও দূরে সরে গিয়ে, ইচ্ছে আছে পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্যে কোথাও বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। না, আমার ঈশ্বর-দর্শন হয়নি, ঈশ্বরকে জানার তৃষ্ণা জাগেনি, সাধু-সন্ন্যাসী হতে চাইনা, তবু কোথাও আত্মপরিচয়হীন হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। এ ছাড়া আমার অন্য কোনও উপায় নেই। চেনা লোকদের থেকে দূরে, একটা অন্য রকমের, সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে থাকা যায় কিনা দেখি। আমার যদি বেশি অর্থ বা কিছু উদ্দীপনা থাকত তাহলে আমি হয়তোইতালি কিংবা কোনও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রিতে চলে যেতাম, সেখানেও হয়তো অন্য মানুষ হওয়া যেত, কিন্তু তার চেয়ে হিমালয়ের গাড়োয়াল অঞ্চল সহজ মনে হল। এখানে আমার বেঁচে থাকার কোনও স্বাদ পাচ্ছিনা, আমার মৃত্যুও খুব মূল্যবান নয়।

জানি না, আপনি আমার এ চিঠি পড়ে বিরক্ত হবেন কি না, কিন্তু এ চিঠি আমাকে লিখতে হবে, কারণ, আপনাদের বিরুদ্ধে আমার কতগুলি অভিযোগ এই প্রথম আমি জানাতে চাই। আমি আপনাদের মধ্যে গিয়েছিলাম বেঁচে ওঠার জন্য, আপনারা লেখক, আপনারা জীবন সৃষ্টি করছেন, আমি ভেবেছিলাম আপনারা আমার মধ্যেও জীবন এনে দিতে পারবেন। বেঁচে থাকার জন্য আমার খুব বেশি দাবি ছিল না, আমার দরকার ছিল, শুধু খানিকটা বিদ্যুতের মতো ঝলক, ঘুমন্ত মানুষের কানের কাছে ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে চেঁচিয়ে উঠলে সে যেমন আচমকা ছিটকে ওঠে, আমিও সে-রকম চেয়েছিলাম, আমি আপনাদের মুখের কাছে কান পেতে রাখতাম, কিন্তু আমি জেগে উঠতে পারলুম না তবুও। আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারব কিনা জানিনা, কিন্তু আমার একটা নতুন মানুষ হওয়া খুব দরকার, খুবই দরকার ছিল, নইলে সাধারণ সুস্থ মানুষের মধ্যে আমার আর থাকা চলে না।

আমি একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম, তখন আমার বয়েস উনিশ, আপনাদের সঙ্গে পরিচয়ের আগে, তখন যদি মৃত্যু হত, তাহলেই বোধহয় ছিল ভাল, আমার মনে হয় তাহলে দ্বিতীয় বার বেঁচে থাকা আমার পক্ষে এতটা সমস্যা হত না। আত্মহত্যার কথা শুনলেই তার কারণটা শুনতে ইচ্ছে হয়, জানিনা আপনারও হয় কিনা, অবশ্য সেকারণ শুনলে আপনারা এখন হাসবেন, আপনারা আধুনিক লেখক। আমি একটি মেয়েকে ভালবাসতাম, মনে হত তাকে না পেলে আমি বাঁচব না। আমি রাত্রে জ্যোৎস্নায় বসে তাকে চিঠি লিখতাম। অনেক দিন, মনে আছে, মেয়েটি পাশে বসে আছে আর আমি তাকে চিঠি লিখছি। তার জন্মদিনে এক শিশি আতর কিনে দিয়েছিলাম। মেয়েটির সঙ্গে দেখা হত প্রত্যেক দুবেলা, যত না কথা বলতাম, তার চেয়ে চিঠি লিখতাম বেশি, চিঠি লিখে ওর ব্লাউজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতাম, বলতাম, তোমাকে ও চিঠি পড়তে হবে না, বুকের সঙ্গে লেগে থাক, আমার চিঠির ভাষা তাহলেই তোমার হৃদয়ে পৌঁছে যাবে। আঠারো-উনিশ বছরের কোন ছেলে না বিশ্বাস করে যে বুক মানেই হৃদয়। আর হৃদয়ে পৌঁছে যাওয়া মানেই হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া। আমি কখনও মেয়েটিকে শরীর দিয়ে ছুঁতে চাইনি, আমি ভাবতাম, আঙুল ছোঁয়ালেই বুঝি ফুলের পরাগের মতো ওর গা থেকে রঙ উঠে আসবে। শুধু ক’দিন ওর দু’পা জড়িয়ে ধরেছিলাম, ও কী, ও কী, ও কী, বলে বালিকাটি চেঁচিয়ে উঠলেও ছাড়িনি। ওর পায়ে আমার মুখ ঘষেছি, বার বার ইচ্ছে হয়েছে, আমার চোখে যদি অনেক জল থাকত আমি চোখের জল দিয়ে ওর পা ধুয়ে দিতাম। আপনি ভয় পাবেন না বিমলেন্দুবাবু, আপনাকে মারি করেলির লেখার মতো কোনও প্রেমের কাহিনি শোনাতে বসিনি। কারণ আজ আমি মেয়েটির নামই ভুলে গেছি, রেণু, রিনা বা রানি, যে-কোনও একটা হতে পারে। চোখ বুজলে মেয়েটির মুখও মনে পড়ে না। সে ছিল আমার সমবয়সি, হঠাৎ ওর বিয়ে ঠিক হল, মেয়েটি আপত্তি করল না। ছেলেটি ওদের বাড়ি আসত, বেশ ভাল ছেলেটি, আমারও ওকে খুব ভাল লাগত, মেয়েটিকে খুব খুশি মনে হল। আমাকে শেষ চিঠিতে লিখেছিল, তুমি মন খারাপ করো না, ভাল করে পড়াশুনো করো। তুমি এখনও কত ছেলেমানুষ, আমাকে মনে রাখবে তো?

এইসব। ভেবে দেখুন, এই জন্য আমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। এ তো প্রতি দিন পৃথিবীতে দু’বেলা ঘটছে। আসলে সাঁতার না জেনেও আমি বন্ধুদের সঙ্গে একবার পুরীর সমুদ্রে অনেক দূর গিয়েছিলাম। আমার আত্মহত্যার চেষ্টাও অনেকটা সেই রকম। জানি না, আপনারও ছেলেবেলায় এ-রকম কোনও অভিজ্ঞতা আছে কি না। মেয়েটার বিয়ে হবার পর কিছুদিন আমার কিছু মনে হয়নি, একটু ছোট দুঃখ ছাড়া। তারপর একট পূর্ণিমা কেটে গেল, একটা অমাবস্যা, আবার পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় চিঠি লেখার কথাও মনে পড়েনি। হঠাৎ এক দিন দুপুরবেলা আমার সারাশরীরে যেন আগুন জ্বলে উঠল, যেন প্রত্যেকটি লোমকূপ দিয়ে তাপ বেরুতে লাগল, আমার স্নায়ুমণ্ডলী ও শিরাগুলি দপ দপ করতে লাগল অসম্ভব অভিমানে। জীবনে সেই প্রথম ও মাত্র একবার বুঝতে পারলাম, কাকে বলে প্যাশান। ইচ্ছে হল, একটা ছুরি হাতে নিয়ে খোলা রাস্তা দিয়ে তক্ষুনি ছুটে যাই। প্রেমে ব্যর্থতা মানুষকে বড় অহঙ্কারী করে, তখন কেউ কেউ বিরাট শিল্প সৃষ্টি করতে পারে বা শিল্পকে ভাঙতে, অর্থাৎ মানুষ খুন, বা নিজেকে ভাঙে। আমি শেষেরটা বেছে নিলাম। দুপুরবেলা বাড়িতে শুধু মা আর আমি, আমার দিদি তখন হাসপাতালে। ছাদে ঘরে পা-জামাটার নিচের দিকটা কেরোসিনে ভিজিয়ে আগুন জ্বেলে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, একটা শুকনো গাছের মতো আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুড়ে যাব। কিন্তু সত্যিকারের অবস্থা তেমন সহজ নয়। সেই থেকেই আমি রিয়েলিটি অত্যন্ত ঘৃণা করি।

প্রথম আগুনের আঁচ গায়ে লাগতেই আমার মনে হল, না না না, অসম্ভব অসম্ভব। কিন্তু আগুন নেভানো সহজ নয়। দেশলাইয়ের কাঠির খোঁচাষ আণ্ডন যে-কেউ জ্বালতে পারে আজ, প্রমিথিউসের আত্মদানে, কিন্তু নেভানো শিখতে হয়। আমি হাতচাপা দিয়ে আগুন নেভাবাব চেষ্টা করলাম, হাত ঝলসে গেল, আমি ছুটতে লাগলাম, উদভ্রান্ত, মনে হল দু’এক মিনিটের মধ্যেই আমার জীবন-মৃত্যু নির্ভর করছে। কিন্তু আমার বেছে নেবার সময় নেই, আমি ছুটে নিচে নেমে এলাম। আগুন আমাকে তাড়া করে এল, বস্তুত আগুন আমার সঙ্গেই ছিল। দোতলার বারান্দায়।

থাক, ও-সব আর লিখতে বা মনে করতে আমার ভাল লাগে না। তাছাড়া আমি লেখকও নই। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমি বেঁচে গেলাম খুবই আশ্চর্য ভাবে, সেই বেঁচে ওঠার মতো বিস্ময় আর কিছু নেই আমার কাছে। সেই বেঁচে ওঠা আমাকে চিরকালের মতো হতভম্ব করে দিল।

আকস্মিক ভাবে বেঁচে ওঠার প্রচণ্ড ধাক্কা আমাকে কিছু দিন ভাল রেখেছিল। মন দিয়েছিলাম পড়াশুনোয়। বেশ ছিলাম সাধারণ মানুষ। হাসির কথায় হাসতাম, কখনও ক্রুদ্ধ হয়েছি, কত সময় সাধারণ দুঃখ পেয়েছি। তারপর চার-পাঁচ বছর বাদে আমার প্রেত আমার কাছে ফিরে এল। এসে কৈফিয়ৎ দাবি করল। আমি বুঝতে পারলাম, এ জীবনটা আমার অতিব, এটা ঠিক আমার নয়।

মানুষ একটাই জীবন পায়, যেমন ইচ্ছে সেটাকে খরচ করে, কিন্তু আমি পেয়েছি দুটো, একটা আমি নিজের হাতে নষ্ট করতে গিয়েছিলাম, নিশ্চিত নষ্ট হয়েছিল, ও দো-তলার বারান্দা থেকে যখন আমি লাফ দিয়েছিলাম, তখন তো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকেই গিয়েছিলাম। আমাকে কখনও খালি গায়ে দেখেননি। দেখলে শিউরে উঠতেন। আমার দু’পা, বুক-পিঠ জুড়ে কালো কালো দাগ। ও-রকম ভাবে পুড়লে কেউ বাঁচে না। আমি কী করে বেঁচে উঠলাম কে জানে! তাছাড়া আমার মুখে আঁচ লাগেনি বলে আমাকে দেখেও কিছু বোঝা যায় না। অর্থাৎ আমি একবার মরে গেছি। পরে যেটা পেলাম, আমার বাকি জীবন, এটার ওপর আমার আর কোনও অধিকার নেই, এমনকী আমি একে নষ্টও করতে পারি না। যেন আমাকে অন্য লোকের জীবন ধার দেওয়া হয়েছে। এই জীবন নিয়ে আমি কী করে বাঁচব যদি এর ওপর নিজের মতো করে মায়া না পড়ে, যদি পরের জামা পরার মতো সব সময় সাবধানে থাকতে হয়। বেঁচে থাকার মায়া পাবার জন্য আমি চারদিকে ছুটে গিয়েছিলাম। আমি রাজনীতিতে গিয়েছিলাম, ফিরে আসতে হল। রাজনৈতিক নেতাদের হওয়া উচিত কবিদের মতে, তার বদলে কবিরাই আমাদের দেশে পলিটিকস শিখছে! আমি খেলাধূলায় গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম, খেলাধূলার মধ্যে তার শরীর ছাড়া কোনও কথা নেই, ওরা অমরত্ব জানে না, ওরা জানে শুধু শারীরিক বেঁচে থাকা। আমি সাঁতার এমনকী খুঁষোঘুষি শিখতেও গিয়েছিলাম। আমার হল না, কেননা আমার শরীর কেটে রক্তপাত হলেও আমার ব্যথা লাগত না, মনে পড়ে যেত, এ শরীর নয়, আমার শরীরের সমস্ত ব্যথা আমি আগুন লাগিয়ে এক দিন ভোগ করেছি। গান-বাজনা করতে গিয়েও মন বসাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত এলাম সাহিত্যে। নিজে কিছু লিখতে শুরু করার আগেই আপনাদের মতো লেখকদের মধ্যে এসে পড়লাম। ভেবেছিলাম, শেষ পর্যন্ত বোধহয় আপনাদের মধ্যে এসে আমি বেঁচে যাব, আমার নতুন জীবনের প্রতি মমতা আসবে।

কিন্তু আপনারাও আমাকে নিরাশ করলেন বিমলেন্দুবাবু, আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আপনাদের প্রত্যেকের জীবন বিষম স্বার্থপর, জীবনের যে-কোনও সুযোগ-সুবিধে সম্পর্কেই আপনারা অত্যন্ত সজাগ, কিন্তু আপনাদের রচনা মিথ্যাভাষী। আপনাদের লেখার মধ্যে ঔদাসীন্য, নির্জনতা, এ-সব ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু ব্যগিত জীবনে আপনারা কেউ সে-রকম নন। আপনারা কে কতক্ষণ একা থাকেন, জানি না, সব সময় দেখি হই-হুল্লোড়, বান্ধবসভা আপনারা প্রত্যেকে নিজের নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধির কখন সময় পান? নাকি সেই জন্যই সব অনুভবের কথা বানানো?

মৃত্যু, ধ্বংস, নীতিহীনতা–এই হয়ে উঠেছে আপনাদের বিষয়। তাপসবাবুকে দেখেছি, কপালে একটা ব্রন উঠলে কত ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, সাতবার ডাক্তারের কাছে ছুটে যান অথচ তার উপন্যাসের নায়করা উদাসীন, ক্যানসার বা সিফিলিসের রোগী। আপনিও বিমলবাবু, আপনার কবিতায় মেয়ে পুরুষরা অত আত্মহত্যা করে কেন? অথচ আপনি জীবনে হয়তো সামান্য আত্মত্যাগও করেননি কখনও। আমি মৃত্যুর শেষ পর্যন্ত ঘুরে এসেছি, আমি জানি মৃত্যু কী-রকম, তাই আমি জীবন্ত মানুষ দেখতে চাই। আপনি মৃত্যু সম্বন্ধে কিছুই না জেনে মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছেন। কবিতা হল এক ধরনের প্রার্থনা, আপনার কবিতায় কীসের প্রার্থনা? মৃত্যুর মধ্যে কোনও বৈচিত্র্য নেই, অনেকটা একঘেয়ে।

মৃত্যু, তিন রকম, ভেবে দেখতে গেলে। আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা বা আততায়ী, অথবা বিছানায় শুয়ে নানা জনের চোখের জল, দীর্ঘশ্বাসের নিচে। যাবার সময় কেউ কেউ বলে, ‘মা চললাম। এমন নিশ্চিন্ত সেই বলা যে, শেষতম যাত্রার আগে যেন সে কিছুই নিতে ভুলে যায়নি, চন্দনের টিপ পর্যন্ত না। আবার কেউ কেউ বাকরুদ্ধ চোখে প্রবল ভাবে চেয়ে থাকে, চোখ দিয়ে দু’হাত বাড়াতে চায়, যেন তার শেষ অস্তিত্ব চিৎকার করে, যেতে দিও না, আমাকে বাঁচাও, — আমি এই মাটির ঘরে বা রাজপ্রাসাদে, করমচার ঝোপের পাশে, জ্যোৎস্নায় আরও কিছুদিন থেকে যেতে চাই, যেতে দিও না, কোথায় যাবজানিনা, এখানে চেনা জিনিসগুলো কিছুই চেনা হয়নি, যেতে দিও না। এই। কিন্তু জীবন বহু রকম, অসংখ্য, অসংখ্য, আপনি কখনও বলতে পারবেন না, মানুষ এইভাবে বাঁচে। কেননা, প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিগত বেঁচে থাকা সম্পূর্ণ রকম তার নিজের। মাস্তুলের মাথায় বালক ঘুমোয়, সম্রাট অনিদ্রারোগী, খনির নিচে মাটি চাপা পড়ার তেরো দিন পর বেঁচে ফিরে এল মানুষ, প্রবল পিতৃশোকের মধ্যেও সিগারেট না পেলে মন চঞ্চল হয় কারুর, জানি নামহাশূন্যের রকেটে মানুষগুলো সত্যিই কী ভাবে। আমি এসেছিলাম বাঁচতে বিমলেন্দুবাবু, আপনাদের কাছে জীবনের একটা নতুন মুখচ্ছবি পেতে, দেখলাম, আপনারাও ভ্রষ্ট এবং জীর্ণ, পোকায় ধরা মৃত্যুবিলাসী। পরীক্ষিৎ লোভী, তাপস নিজেকে ঠকায়, অবিনাশ নিজেকে চেনে না, আপনিও মিথ্যে আত্মবিশ্বাসী।

ক্রমে আমার বুকের ভিতরের মৃত্যু আবার জেগে উঠল। এইভাবে মায়া-মমতাহীন ভাবে, পরের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার মতো কেউ বাঁচতে পারে? আমি আমার শরীরেমড়ার গন্ধ পেতে লাগলাম। লোকজনের মধ্যে বসতে আমার ভয়, আমি সবার আড়ালে নিজের হাতটা তুলে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকি। কেউ টের পায় না, কিন্তু আমি গন্ধ পাই, পচা গন্ধ, বুঝতে পারি আমার শরীর পচে যাচ্ছে। একটা আত্মাহীন, মায়াহীন, ভালবাসাহীন শরীর কখনও বেঁচে থাকতে পারে না।

কয়েক দিন আগে একটু জিনিস লক্ষ্য করে আমি শিউরে উঠলুম, সম্প্রতি আমার শরীরে কয়েকটা নতুন তিল উঠেছিল, ঠিক কালো নয়, লালচে বাদামি রঙের। জায়গাগুলো একটু একটু উসখুস করত। একটা তিল খুঁটতে গিয়ে একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করলাম। তিলটা জীবন্ত। বুঝতে পারলেন, তিলটা জীবন্ত? একটু খুটতেই সরে গেল। অবাক হয়ে আর একবার আঙুল ছোঁয়াতে সেটা আর একটু সরে গেল। লক্ষ্য করলাম, ওটা তিল নয়, একটা পোকা, আমার শরীর থেকে জন্মেছে, ক্ষুদে অক্টোপাসের মতে, প্রবলভাবে চামড়া আঁকড়ে আছে–সবগুলো তিলই এই। আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। বুঝতে পারলাম, আর নয়। আমার শাস্তি শেষ হয়েছে। জানি, আপনি কী বলবেন বা ডাক্তার কী বলতে পারে এ ব্যাপারটা শুনে, ও কিছু নয়, এক ধরনের চর্মরোগ, কোনও একটা পাউডার লাগালেই সেরে যাবে। জানি সেরে যায়, অন্য লোকের সারে, কিন্তু আমার নয়। আমার এগুলো, পচা মাংসে যে-পোকা পড়ে– তাই। আর এখানে নয়, আমি বুঝতে পারলাম। আমি বাঁচতে এসেছিলাম, আপনারা আমাকে দূরে ঠেলে দিলেন। জানি না আমার কোথায় স্থান হবে।
—আপনাদের হেমকান্তি

মায়া,

তোমাকে চিঠি লিখতে গিয়ে আমার হাত কাঁপছে, জানি না এ চিঠি তোমাকে কোনও রকম আঘাত দেবে কি না, কারণ আমি এটুকু অন্তত জানি নিশ্চিত যে, আমি নিজেকে কিছুতেই সম্পূর্ণ বোঝাতে পারব না। তোমাকে কোনও আঘাত দিতে চাই না। মায়া, আমি তোমাকে ভালবাসতে চাই অন্য কোনও কথা মাথায় এসে জটিল হবার আগেই তোমাকে একথা জানালাম।

তোমাদের বাড়িতে যাবার তৃতীয় দিনে তুমি আমার সামনে এসে বলেছিলে, আপনার ওটা কীসের বোতাম, চন্দনের? বলে তুমি আমার বুকে হাত দিয়ে বোতাম দেখছিলে। সে প্রায় এক বছর আগে, তখনও তুমি অনেকটা শিশু ছিলে, এমন পূর্ণ যুবতী হওনি, তাই ওই অকপট হাত রেখেছিলে আমার বুকে, আমার বুকের মধ্যে যে হৃৎস্পন্দনের কোনও শব্দ নেই, তা-ও তুমি টের পাওনি। আমি মাথা নিচু করে নিঃশব্দে ছিলাম। তুমি বললে, আপনি বাইরে কার ওপর রাগ করে এসে এখানে গভীর? একটু পরে তুমি দিদিকে বলেছিলে, ওই ফর্সা লোকটা খুব অহংকারী। আসলে আমি মাথা নিচু করে তোমার পায়ের দিকে দেখছিলাম, কী সুন্দর ঝকঝকে দু’টি পা, যেন তুমি আমার স্মৃতির ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়েছিলে, রঙ লাগাওনি অথচ প্রত্যেকটি নখে লাল আভা, গোড়ালি একটুও ফাটা নয়, একছিটে ময়লা নেই কোথাও। কত দিন পর আমার বুকে একটি মেয়ের হাত, একথাও মনে পড়েনি। তখন কোনও কথার উত্তর দেবার আমার সময় ছিল না। সেই পায়ের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল, এই মেয়েটিকে যদি আমি ভালবাসতে পারি, তবে হয়তো আমি বেঁচে উঠতে পারি আর একবার। কিন্তু তবু যে কেন আমি শেষ পর্যন্ত মাথা নিচু করে রইলাম জানি না। ভালবাসার অনিচ্ছা, না বেঁচে থাকার অনিচ্ছা, কী জানি।

একদিন হঠাৎ তোমাদের ঘরে ঢুকে দেখেছিলাম, অবিনাশ তোমার হাত ধরে টানছেন, আর তুমি বলছ, ছাড়ুন, ছাড়ুন! আমাকে দেখেই অবিনাশবাবু হাত ছেড়ে দিয়ে যেন কী একটা হাসির কথা বললেন। তোমরা দু’জনে হো-হো করে হেসে উঠলে। এমন হতে পারে, তোমার হাতের মুঠোয় কোনও জিনিস লুকোনো ছিল, অবিনাশবাবু কেড়ে নেবার চেষ্টা করছিলেন, বা হাত ধরে তোমাকে টেনে নিতে চাইছিলেন ওর বুকে। আমাকে দেখে থেমে গেলেন এবং একটু বিব্রত বা দুঃখিত না হয়ে পরবর্তী হাসির কথাগুলি বলেছিলেন। আসলে দুঃখিত হয়েছিলাম আমি, মৃত্যুর চেয়ে বড় দুঃখ। আমার খুব ভাল লেগেছিল, ওই রকম প্রবল ভাবে টানাটানি ও হাস্য। আমাকে দেখে থেমে যেতেই আমি বিমূঢ় ও লজ্জিত হয়েছিলাম, ফিরে যাবার জন্য এক-পা তুলেও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, আবার শুরু হোক, না হয় আমিই তোমার হাত ধরে টানি, প্রবল ভাবে বুকের ওপর নিয়ে আসি, তোমার হালকা শরীরটা শূন্যে তুলে লুফে নিই, তোমার ঠোঁট থেকে হাসি চলে আসুক আমার ঠোঁটে, কিংবা অবিনাশের, হাওয়ার হুড়োহুড়ির মধ্যে আমরা তিন জন– অনেকক্ষণ বাদে লক্ষ করলাম, আমি আমার হাত দুটো পকেট থেকেই বার করিনি, ঘরের মাঝখানে বিকট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আমি চুপ করে। ইচ্ছে হল, তখুনি ছুটে পালিয়ে যাই, তার বদলে তোমার দিদির হাত ধরে সরবতের গ্লাস নিলাম।

আর এক দিনের কথা মনে পড়ে, দোলের দিন। দল বেঁধে সবাই তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল, গগনবাবুআমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে-দিনও অবিনাশবাবুকে দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম। সবাই ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি করছে, রঙের স্রোত আর আবিরের ধুলো চারদিকে, কিন্তু আমি যোগ দিতে পারিনি, এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলাম অস্পৃশ্যের মতো। সবাই সেদিন আমাকে গঞ্জনা দিয়েছিল, আমাকে জোর করে ফেলে দিয়েছিল মাটিতে। তবু পারিনি, তবু পারিনি ওদের মতো ভোলা হতে, লাল রঙকে ব্যবহার করতে। এক ফোঁটা আবির বুঝি দিয়েছিলাম সকলকে, সেই প্রথম আমি তোমার কপাল ছুঁয়েছিলাম। কত ব্যর্থ সেই ছোঁয়া। অবিনাশবাবু তোমার সারা মুখ ভরিয়ে অবলীলায় তোমার ব্লাউজের মধ্য দিয়ে পিঠে হাত ঢুকিয়ে দিলেন, সকলের সামনে তোমার জামার মধ্যে পিঠেঅবিনাশের হাত ঘুরতে লাগল, কোনও দ্বিধা নেই। আড়ষ্টতা নেই। আ, আমার এত আনন্দ হয়েছিল। মানুষকে বেপরোয়া, স্বাধীন, গ্লানিমুক্ত দেখলে আমি তার আত্মা থেকে ফুলের মতো গোপন সৌরভ পাই। আমারও ও-রকম হতে ইচ্ছে হয়, মনে মনে বলি, ঈশ্বর, ঈশ্বর, আমাকে আর একবার বাঁচার সুযোগ দাও, আমাকে ও-রকম স্বাভাবিক, জীবন্ত করো। হয় না, আমি পারি না। কেন পারি না মায়া, তা তোমাকে আর এখন বলা যাবেনা।

কিছুদিন আগে তোমাদের বাড়িতে সিনেমার টিকিট নিয়ে একটা লটারি হয়েছিল তোমার সঙ্গে কে যাবে তাই নিয়ে। আমার সে-দিন খুব মাথা ধরেছিল, খুব মন খারাপও লাগছিল, হঠাৎ আমার ইচ্ছে হল আমি যাই তোমার সঙ্গে। তাহলে আমার সব রোগ সেরে যাবে, আমি অন্ধকারে তোমার পাশে বসে তোমার যোগ্য হয়ে উঠব। কে যেন একবার আমার নামও বলল, আমি ব্যগ্রভাবে মুখ তুলে তাকালাম, নিঃশব্দে যেতে চাই, যেতে চাই বললাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সবাই চলে গেল অন্য নামে, আমার প্রার্থীপদ বাতিল হয়ে গেল। যেন আমি উপস্থিত নেই, শুধু একটা নাম মাত্র, এক জন উত্থাপন করল, অপরে বাতিল করে দিল। মায়া, সে-দিন রাত্রেই আমার মা মারা গিয়েছিলেন। আজও আমি জানি না, তোমার সঙ্গে সিনেমা দেখে, তোমাকে আমার সব কথা বলার পর বাড়ি ফিরে যদি দেখতাম মারা গেছেন, তাহলে সেইটাই ভাল হত কিনা। তোমার সঙ্গে যেতে না পারার দুঃখ, মায়ের মৃত্যুর আঘাতও অনেকটা ম্লান করে দিয়েছিল সেদিন রাতের জন্য। আমার মধ্যে শোক বা অনুতাপও জেগে উঠতে পারল না।

তোমাকে আজ এ চিঠি লিখছি, কারণ আজ আমি এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর কোনও দিন ফিরব না, এই জেনে। আমার পক্ষে আর স্বাভাবিক মানুষ হওয়া সম্ভব নয়, যেন বুঝতে পারছি। এত দিনেও যখন পারলাম না। কোথাও দাঁড়াতে পারলাম না, কোথাও দাগ রইল না, ভালবাসার কথা জানাতে পারিনি, এক লাইন কবিতা লেখা হল না, কিছুই হল না। একটি ব্যর্থতা তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তোমাকে ভালবাসতে চেয়েছিলাম এ-কথা তোমাকে আজ জানাবার মধ্যে কোনও আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে নেই। আমার জানাবার উদ্দেশ্য, তোমাকে আমি ভালবাসতে পারিনি। বড় অদ্ভুত এই ব্যর্থতা। আমাকে কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি ভালবাসতে। আমারই নিজের প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল, তোমাকে ভালবাসার। ভালবাসার ইচ্ছে জেগেছিল শুধু, ভালবাসা জাগেনি। মনে মনে হাজার কথা বলেছি তোমাকে লক্ষ্য করে, এমনকী ভেবেছি, তোমাকে মুখে বলার সুযোগ না পেলেও একটা চিঠি লেখা অনায়াসেই চলত, আজ যেমন লিখছি। তুমি যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে, সেই হত আমার পরম প্রাপ্তি, সেই আঘাত যদি আমাকে কোনও উত্তেজনা দিত! কিন্তু আমি মিথ্যে কথা লিখতে পারি না, ‘তোমাকে আমি ভালবাসি’ এ-কথা লেখা অসম্ভব আমার পক্ষে, আসলে, তোমাকে আমি ভালবাসতে চেয়েছি এইটাই সত্যি এবং তার চেয়েও মর্মান্তিক সত্যি, তোমাকে আমি ভালবাসতে পারিনি। এ-কথা কি কাউকে জানানো যা? কিন্তু আজ লিখতে হল, কারণ আজ চলে যাচ্ছি আমি, জীবনে আর হয়তো দেখা হবে না, কারুকে কারুকে কোনও কোনও কথা অপমান করে, তবে আমার ওপর ক্রুদ্ধ হওয়াই উচিত তোমার। তুমি আমাকে মনে বেখো বা সামান্য ভালবাসা– এ দাবি আমার নেই। তবু তোমার কাছ থেকে কিছু একটা সামান্য পেতে যেন ইচ্ছে করছে। অন্তত রাগ বা ঘৃণা।

দিদিকে আমার নমস্কার জানিও।
—হেমকান্তি রায়চৌধুরী

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়